চব্বিশ
ইতিহাসের এই প্রবল প্রবাহের মধ্যেই আমার মতো বাঙালি যুবকের জীবনে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেল। স্কটিশ কলেজে অনার্স নিয়ে বিএ পড়বার সময় মনে হয়েছিল যে কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ধরাবাধা পড়াশোনা মনকে কেবলমাত্র ক্ষুদ্রতার মধ্যে বন্দী করে রাখে। হঠাৎ শেক্সপিয়র, উইলিয়ম স্কট, মিলটন, বায়রন, কীটস, শেলী, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, একেবারে ইংরেজের চোখে দেখা ভারতীয় পণ্ডিতদের হাতে লেখা রাজনীতি, অর্থনীতি ও বিশ্ব-ইতিহাস, এই সমস্ত পাঠ্য পরিধিটাই আমার কাছে একটা নিষ্ঠুর প্রতারণা হিসেবে ধরা পড়েছিল। একমাত্র বাংলা ছাড়া আর সবটাই আমার মনে হতো ‘আমাদের রেখেছ কেরানি করে মানুষ করনি’ নীতির সুপ্রণীত অংশ।
অধ্যাপক সুধাংশু দাসগুপ্তের ক্লাসে বাংলা পড়তে গিয়ে আমার দৃষ্টি বহুদূর প্রসারিত হয়ে গিয়েছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ইত্যাদির অনেকের দরজা পেরিয়ে আমি রবীন্দ্র ও রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের উৎসাহী ছাত্র হয়ে উঠেছিলাম। গোরা, ঘরে-বাইরে, আনন্দমঠ, জাগরী, ডি.এল. রায় ও গিরীশ ঘোষের নাটক, ‘পরিচয়’ পত্রিকার প্রবন্ধাবলি, আমাদের সুভাষ মুখোপাধ্যায় থেকে সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সুধীন্দ্র দত্তের কবিতা এবং কল্লোল যুগের রথী-মহারথীদের উপন্যাস ও দুর্বোধ্য এবং অশ্লীল কবিতা’ আমার মানসিকতার অন্যতম প্রধান খাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, বামপন্থী উপন্যাস, কবিতা, আলোচনা, বামঘেঁষা রাজনীতি—সুলভ লেখা, আমার মনের আর এক প্রধান খোরাক।
এর ফল হলো বি.এ. পরীক্ষায় অনার্সে প্রথম শ্রেণি জুটল না। দোষটা যে পুরোপুরি আমার তা কখনো মেনে নিতে পারিনি। প্ৰথমত এমন একজনও অধ্যাপক ছিলেন না, যাঁর কাছে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে আমি আমার মনে উৎসাহের স্ফুলিঙ্গ তৈরি করতে পারতাম। সুশীল মুখার্জী মশাই আমাকে মিথ্যে আশ্বাস দিতেন যে আমার লিখিত প্রশ্নের উত্তর প্রথম শ্রেণি পাবার জন্য যথেষ্ট। প্রথম শ্রেণির বদলে স্কটিশ কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্সে পাস করা ছাত্রদের মধ্যে প্রথম হবার জন্য ছাত্রজীবনের প্রথম ও শেষ স্বর্ণপদক মিলেছিল, তাতে বিন্দুমাত্ৰ গৌরববোধ করিনি। বোধহয় বিশেষ করে এ কারণে যে, পদকটা আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিলেন একেবারে বিনা অনুষ্ঠানে, অফিসের হেড ক্লার্ক।
স্কটিশ কলেজে পড়ার সময় সবচেয়ে বড় দাগ কেটেছে আমার মনে তা হলো অধ্যাপক মার্কাস গ্রে-র দীর্ঘকালীন বন্ধুতা। সাহেবদের বয়স বুঝতে পারার শক্তি সে সময়ে আমার একেবারে ছিল না। ইংরেজ অধ্যাপক ও অধ্যাপিকারা সকলেই চার্চ অব স্কটল্যান্ডের পাদরি। খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করা তাদের প্রত্যেকের আদর্শ ও কর্তব্য। মার্কস গ্রে, আমি এখন বুঝতে পারি, আসলে ছিলেন সমাজবাদী। তখন তাঁকে আমার মনে হতো আদর্শবাদী। আমাকে তিনি খুব সহজে বন্ধু করে নিয়েছিলেন। অবাধ অধিকার দিয়েছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরি থেকে যে কোনো বই যে কোনো সময় নিয়ে যাওয়া, একমাত্র শর্ত ছিল পড়া শেষ হয়ে গেলে স্বস্থানে রেখে দিতে হবে। গ্রে-র কাছে আমি কৃতজ্ঞ বার্নাড শ, ল্যাস্কি, এবং বিখ্যাত অর্থনীতিক কীনস-এর লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। ল্যাস্কির ‘গ্রামার অব পলিটিক্স’ আমি তার কাছেই পড়ি। অবশ্য তাঁর নিজের কাছে প্রিয়তর ছিলেন রাস্কিন এবং গ্রহণযোগ্য ছিল খ্রিষ্টধর্মের মরালিটি সমৃদ্ধ সিন্ডি কলিসন। অধ্যাপক গ্রে ঘোরতর কমিউনিস্ট বিরোধী ছিলেন। আমি যে ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে সংযুক্ত এটা তাঁর কাছে অপরাধ ছিল না, ছিল শোধনীয় দোষ ও দুর্বলতা। তখন বিদেশ থেকে ভারতবর্ষে মরাল-রি—আর্মান্ট, অথবা এমআরএ আন্দোলন, আমদানি হয়েছিল খ্রিষ্টান পাদরি ও সিভিলিয়ান অফিসারদের মাধ্যমে।
গ্রে ছিলেন এমআরএ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা। আমাকে তিনি এর মধ্যে টেনে নিয়েছিলেন। সব ব্যাপারটা আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় মনে হতো। এমআরএ-র সভায় উপস্থিত প্রত্যেকে নিজেদের দোষ, অন্যায়, অপরাধ, ত্রুটি, বিচ্যুতি—এক কথায় খ্রিষ্টানরা যাকে বলে পাপ—অকপটে নিবেদন করে দিতেন। তা নিয়ে সুন্দর সংগঠক আলোচনা হতো। হিন্দু পরিবারের ছেলে হিসেবে আমার কাছে এটা ছিল বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। আমরা শৈশব থেকে দোষ ত্রুটি অপরাধ লুকাবার জন্য পুরো অথবা আধা মিথ্যের ব্যবহারে চতুর হয়ে উঠি। মিথ্যে বলি, কেননা আমাদের মনে শাস্তির ভয়। অন্যায় স্বীকার করলে অভিভাবকদের কাছে তৎক্ষণাৎ মার্জনা পাওয়া আমাদের সমাজনীতির বহির্গত। অন্যায় করেছ তো শাস্তি পেতে হবে। আমাদের গ্রামে ছোট পরিবারেও বাল্যকাল থেকে কত অন্যায় দেখেছি ও নিজেও করেছি, যার সবটাই আমার মধ্যে লুকোনো লজ্জাকর স্মৃতি। এখন এই এমআরএ-র সভ্যদের খোলাখুলি অন্যায় ও অপরাধ স্বীকার ও তা নিয়ে সংগঠক আলোচনা আমার মনে হয় চরিত্র গঠনের পক্ষে বিশেষ সহায়ক। বর্তমানকালের থেরাপির সঙ্গে ব্যাপারটা তুলনীয়। তফাত শুধু এই যে, এমআরএ-রা ঈশ্বরের পুত্র যিশুকে সর্বদা চোখের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতেন। স্কটিশে আমাদের বাইবেল পড়তে হতো, যদিও প্রিন্সিপ্যাল ক্যামেরন সাহেব বাইবেলকে আকর্ষণীয় করে পড়াতে পারতেন না। বাইবেল ক্লাস বাধ্যতামূলক ছিল না। অতএব ছাত্রসংখ্যা খুব হতো না। আমার কিন্তু বাইবেল পড়তে ভালো লাগত। যিশুর জীবন আমার কাছে ছিল প্রচণ্ড আকর্ষণীয়। অনেক সময় বাইবেল বা যিশুর কাহিনি পড়তে গিয়ে আমার মনে গুঞ্জরিত হতো ‘ওই মহামানব আসে’। পরবর্তী জীবনে আরও দুজন মহাপুরুষদের সম্বন্ধে সেই গুঞ্জন আমার মনে বারবার ধ্বনিত হয়েছে— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
একদিন এমআরএ-র সভায় গ্রে সাহেব আমাকে প্রশ্ন করলেন, আমার কোনো অন্যায় অপরাধ কনফেসন করার মতো আছে কিনা। আমার বুক কেঁপে উঠল। পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, হাত ঘর্মাক্ত। এমআরএ-তে খ্রিষ্টান এবং বাঙালি ও ভারতীয় কিছু স্ত্রী-পুরুষ সংযুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মস্করা করে বলে উঠলেন, ও তো কমিউনিস্ট। কমিউনিস্টদের কোনো পাপবোধ থাকে না। অনেকেই একটু হাসল। কিন্তু দেখলাম সবাই আগ্রহের সঙ্গে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। এই ছেলেটির স্বীকার করার মতো কোনো দোষ বা অপরাধ নেই?
আমার মনের পর্দায় একের পর এক অন্যায় ত্রুটি বিচ্যুতির ঘটনা ভেসে উঠল। সেই গ্রামের ছোটবেলা থেকে বর্তমানের আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি? প্রত্যেকটা বলতেই মুখ আড়ষ্ট, আমার মতো বচনশীল যুবকেরও শব্দের দুর্ভিক্ষ।
তবু সাহস বেঁধে বলতে শুরু করলাম। প্রথমে আস্তে, তারপর দেখলাম নিজে থেকেই কণ্ঠে জোর এল। বললাম, “আমার জন্ম পূর্ববঙ্গের সুদূর এক গ্রামে এক দরিদ্র অথচ অভিজাত পরিবারে। আমার বাবা বিদেশে স্কুল মাস্টারি করতেন। ছ’সাত বছর বয়স থেকে বলতে গেলে আমিই সংসারের কর্তা, আমার সবটুকু শক্তি ও প্রেরণা আসত আমার মা’র কাছ থেকে। অনেক খারাপ কাজ করেছি কিন্তু সেগুলো বলার এখন কোনো মানে হয় না। আমি আপনাদের কাছে সম্প্রতি কৃত একটি অপরাধ স্বীকার করছি। টমোড়ি হোস্টেলের পরিচালনার ভার প্রত্যেক মাসে এক একটি ছাত্রকে বহন করতে হয়। আমাকে তিনবার এই ভার নিতে হয়েছে। দু’বার খাওয়া-দাওয়ার জন্য নির্ধারিত অর্থ থেকে আমি কিছু টাকা চুরি করেছি। একবার বারো টাকা, দ্বিতীয়বার পনেরো। ঠাকুরের সঙ্গে বাজার করতে গেছি, নিজের হাতে দাম দিয়ে ওই টাকাটা বেঁচেছিল, সেটা আমি হোস্টেল ফান্ডে ফেরত না দিয়ে একবার দেশে মাকে পাঠিয়েছি। দ্বিতীয়বার নিজের জন্য বই কিনেছি। আমি আরও একটি গুরুতর অন্যায় করেছি হোস্টেলে লাইব্রেরির জন্য বই কেনার ব্যবস্থা আছে। দু’মাস আগে বই কেনার ভার ছিল আমার উপরে। আমি একটি দোকান থেকে বই কিনে তার রশিদের উপর দুখানা অ-ক্রীত পুস্তকের নাম লিখে মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছি এবং বাড়তি টাকাটা দিয়ে নিজের জন্য বই কিনেছি। আমার এই অন্যায় স্বীকার করতে পেরে ভালো লাগছে। বোধহয় আমি এ কাজ আর করব না।”
আমি নিজেই বুঝতে পারিনি স্বীকারোক্তির সময় দু-চোখ থেকে অশ্রু বেয়ে আমার গাল ভিজে গেছে। বুঝতে পারলাম আরও কয়েকজনকে চোখ মুছতে দেখে। তাদের মধ্যে ঠিক আমার বরাবর বসা অধ্যাপক গ্রে ও তাঁর স্ত্রী মেরী।