পিতা পুত্রকে – ২১

একুশ

বিদ্যাসাগর কলেজে পড়ার দ্বিতীয় বছরে রাজনৈতিক হাওয়া বিশেষ গরম হয়ে উঠল। বিঘোষিত হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। কলেজে বিরাট উত্তেজনা। অধ্যাপকদের মধ্যে উত্তেজিত আলোচনা। আমার এটুকু বোঝার ক্ষমতা ছিল যে ভারতবর্ষ যুদ্ধে যোগ দেয়নি, ইংরেজের কলোনি হিসেবে তাকে যুদ্ধে টেনে নেওয়া হয়েছে। কংগ্রেসী, মন্ত্রীদলের পদত্যাগ, কংগ্রেসব হাইকমান্ডের প্রতিবাদ ও ইংরেজ শাসনের ক্রমান্বয় ক্রুদ্ধ চেহারা : এসব নিয়েও ছাত্রদের মধ্যেও কিছু কিছু আলোচনা এবং সংবাদপত্রে তারস্বরে বিশ্লেষণ আমার দৈহিক মানসিক খাদ্যের অনিবার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বাবা একখানা কার্ড লিখেছিলেন, ভালো ইংরেজি শিখতে হলে, ‘স্টেটসম্যান’ পড়তে হবে, বিশেষ করে সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলো। সাত টাকা বৃত্তিতে আমি তখন বিত্তমান, মাসে তিন টাকা মাকে পাঠাবার পরেও আমার হাতে প্রতি মাসে বই কেনা ও ‘স্টেটসম্যান’ এবং ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ রোজ খরিদ করার মতো পয়সার অভাব হতো না। দুটি পত্রিকার মনোভাব সম্পূর্ণ বিপরীত। সেই ছোটবেলায় দুই বিপরীত মনোভাব সমান মনোযোগ দিয়ে পড়বার অভ্যাস পরিণত জীবনে আমার মনকে বিশ্লেষক ও বাস্তবভিত্তিক হতে সাহায্য করেছিল। ‘স্টেটসম্যানে’র সম্পাদকীয় প্রবন্ধ থেকে অজানা অচেনা শব্দগুলোকে খাতায় লিখে নিয়ে এ.টি. দেবের ইংরেজি-বাংলা অভিধান থেকে তাদের অর্থ সংগ্রহ করে প্রায় প্রতিদিন লিখে নিতাম। চমকে দেওয়া বাক্য বা পরিচ্ছেদ টুকে রাখতাম। কিন্তু মন প্রাণ গরম করে দেওয়া সংবাদ ও মন্তব্য আসত ‘আনন্দবাজারের’ পৃষ্ঠাগুলো থেকে।

‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা হাই কমান্ডের সমর্থক! শরৎ বসু-ফজলুল হকের জোট বাঁধার কট্টর বিরোধী। এর আগে, তখন আমি স্কুল পাস করিনি, একদিকে সুভাষ চন্দ্র বসু ও অন্যদিকে মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহেরুর মধ্যে যে কূট সংগ্রামে সারা দেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল তার প্রকৃত অর্থ ও প্রভাব বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না। বোঝবার উপাদানও অনুপস্থিত। এখন যুদ্ধের প্রারম্ভে সুভাস চন্দ্ৰ বসু গৃহবন্দী। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় তাঁর প্রতি প্রাণখোলা সমর্থন দেখা যেত না। অনেক পরে যখন ভারতবর্ষের ও পৃথিবীর রাজনৈতিক বিচার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার কিছুটা অর্জিত হলো তখন আমি বুঝতে পারলাম যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধবার পর থেকে পুরো চল্লিশ দশকের প্রচণ্ড অর্থবাহক ঐতিহাসিক ঘটনায় বঙ্গের ভূমিকা ছিল দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের। এসব ঘটনার মধ্যে ছিল কংগ্রেস-লীগ-ইংরেজের মধ্যে আপস ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজের অপসারণ, ভারত বিভাগ, পাকিস্তানের জন্ম, বঙ্গ ও পাঞ্জাব ভাগ। ষাট লক্ষ মানুষ বাস্তুহারা। দু’তিন লাখ মানুষের মৃত্যু। কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে এমন কেউ ছিলেন না যিনি দৃঢ়কণ্ঠে বঙ্গবাসীর পরিপূর্ণ সমর্থন নিয়ে বঙ্গের স্বার্থ সুরক্ষার বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে পারেন। এটুকু আমার পরিষ্কার মনে আছে, বিশ্বযুদ্ধ বাধার পর থেকেই বাঙালি মানসিকতায় একটা দৌর্বল্য ও পরাজয়-আশঙ্কা প্রচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল।

এই পরিস্থিতির মধ্যে আমার জীবনে প্রথম এক বিরাট শুভ ঘটনা ঘটে গেল। দশ-বারোজন ছাত্র নিয়ে আমাদের যে টিউটোরিয়াল গ্রুপ তৈরি হয়েছিল, বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলাম, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার অনেক খবর রাখত। দুই অধ্যাপক আমার উপর অতিশয় সদয় ছিলেন। তাদের একজন পড়াতেন সিভিক্স, অন্যজন লজিক। এবং দুজনেই আমাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, সবকিছু বইপত্র পড়ে ‘আইডিয়াল আনসার’ লিখে নিতে একটি খাতায়। বলেছিলেন, এমনি করে লিখো যাতে ষোলো নম্বরের মধ্যে পনেরো নম্বর পাওয়ার যোগ্য হয়। আমি এই ধরনের ‘আইডিয়াল আনসারে’ দু’খানা বড় বড় এক্সারসাইজ বুক পুরো করে ফেলেছিলাম। দুই অধ্যাপক উত্তরগুলো পড়ে, রচনার দুর্বলতা ও ভুল চিহ্নিত করেছিলেন। এ দুজনের একজনের নাম খুব মনে আছে, কেননা পরবর্তী জীবনেও তাঁর সঙ্গে আমার সংযোগ ছিল। তিনি পুরাতন সুধাংশু কুমার বসু, যিনি কলেজ থেকে ইস্তফা দিয়ে ‘আনন্দবাজার’-এর প্রথম ইংরেজি সতীর্থ ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’-এর সম্পাদক হয়েছিলেন। এক ঝাঁপে নয়, কয়েক বছরে।

আমাদের টিউটোরিয়াল গ্রুপের মধ্যে রটনা হয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় আমার স্থান খুব উঁচুতে হবে। খবরটা খুশি মনে ভীত আশায় বাবাকে জানিয়েছিলাম। উত্তরে একখানা কার্ড পেয়েছিলাম। তিনি লিখেছিলেন, “প্রথম বিভাগে পাস করতে পারলেই আমাদের সৌভাগ্য।” কার্ডখানা, পড়ে একটু দমে গিয়েছিলাম বৈকি, কিন্তু এ নিয়ে কথাবার্তা বলার মতো কেউ ছিল না। একদিন হঠাৎ ২৯ নম্বর বীডন স্ট্রিটে অতি প্রত্যুষে দারুণ হইচই। আনন্দবাজার পরিবেশিত হতো বাড়িতে। তার প্রথম পৃষ্ঠায় আইএ পরীক্ষায় প্রথম দশটি স্থান অধিকৃত ছাত্রদের নাম। আমি তার মধ্যে তৃতীয়। আমার কাকামণি এর কিছুদিন আগে বাহাওয়ালপুর কলেজ থেকে পুনরায় নিয়োগ পত্র পেয়ে একাই পাঞ্জাবে চলে গেছেন, কাকিমা ও ভাইবোনেরা দু’মাসের মধ্যে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। ঠিক মনে নেই, খুব সম্ভবত আমার দিদি, যার সঙ্গে আমার অনুরাগপূর্ণ ভালোবাসার মনোভাবের কথা অজানা নেই, ছুটে এসে আমাকে বলেছিল, “জানো জানো, তুমি পরীক্ষায় থার্ড হয়েছ।” কাকিমা, পিসিমা, খুড়তুতো, পিসতুতো ভাই-বোনদের খুশি আনন্দ উপছে না পড়লেও সোচ্চার প্রকাশ পেয়েছিল। মুরলা পিসিমা স্বামীর বিরহে সর্বদাই এত কাতর থাকতেন যে তাঁর মুখে হাসি ছিল বিরল, কিন্তু অন্য জ্ঞাতি আত্মীয়দের মুখ, ‘দত্তা’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্রের ভাষায়, আনন্দে কালি হয়ে গিয়েছিল। দু-চারদিন পরে শুনেছিলাম আমার জ্ঞাতি জ্যেঠামশাই প্রচণ্ড বিস্ময়ে ও প্রচ্ছন্ন অসন্তোষ নিয়ে ছেলেদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, এ ছেলেটা লেখাপড়ায় কবে থেকে এত ভালো হলো।

মা ভাই-বোনদের গণেশপুরের বাস তুলে দিয়ে খুলনাতে বাবার কাছে চলে যাওয়ার আয়োজন তখনও চলছে। আমি চারখানা পোস্টকার্ড লিখেছিলাম, গণেশপুরে মাকে, পাঞ্জাবে কাকামণিকে, খুলনায় বাবাকে, এবং দু-চার দিন পরেই গণেশপুরে জ্যেঠামশাইকে। জবাবগুলো এখনও আমার পরিষ্কার মনে আছে। বাবা লিখেছেন, “তোমার পরীক্ষার খবরে সুখী হইলাম। বিএ পরীক্ষার জন্য স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হইবে। ইংরাজ অধ্যাপকের কাছে শিক্ষা পাওয়া অতিশয় সৌভাগ্য।”

কাকামণি লিখেছিলেন, “জীবনে এত বড় খবর এর আগে পাইনি। আমার দুই হাত তুলিয়া নৃত্য করিতে ইচ্ছা হইতেছে।” মা লিখেছিলেন, “তুমি যে এমন করিবে তাহা আমি আগেই জানিতাম। এবার তো তুমি স্কলারশিপ পাইবে। কত টাকা স্কলারশিপ? আমরা খুলনা গেলে একটু বেশি টাকা পাঠাইতে পারিবে কি?”

গ্রাম থেকে জ্যেঠামশাইয়ের চিঠি : “তুমি বঙ্গ উড়িষ্যা আসামের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করিয়া আমাদের সকলকে গর্বিত করিয়াছ। গ্রামের সকলেই ইহাতে বিশেষ আনন্দিত।”

একটা বড় কিছু করে ফেলেছি এটা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু কেন কীভাবে বড় কাজটা ঘটে গেল তার রহস্য আমাকে অধিকার করে রেখেছিল। একমাত্র দু’বছর কঠোর পরিশ্রম ছাড়া আর যে কিছু করেছিলাম বা পেয়েছিলাম তার অনুভূতি খুঁজে পাইনি। খুঁজে পেতে এক সপ্তাহ সময় লাগল। ছাদে বসে সকালে আমি পড়ছি, হঠাৎ দেখলাম গীতা মিত্র স্নান সেরে শাড়ি শুকোতে দিতে ছাদে উঠে এসেছে। আমাকে দেখতে পেয়ে সোজা ছাদের পাঁচিল ঘেঁষে দাঁড়াল। আমি তখন অনেকটা ভদ্র হয়েছি। চোখে চোখ পড়তে দু’হাত তুলে নমস্কার করলাম। গীতা মিত্র বললেন, “আপনি ইউনিভার্সিটিতে থার্ড হয়েছেন? দাঁড়ান, আপনাকে এক মিনিট দেখি। ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়া ছাত্র আমাদের বাড়িতে কেউ কখনো দেখেনি।”

আমি আনন্দে লজ্জায় মরে গিয়েছিলাম। শুধু বলতে পেরেছিলাম, “কী করে যেন ঘটনাটা ঘটে গেল।”

গীতা মিত্র হেসে বললেন, “দাদা এ নিয়ে তিন-চার দিন ধরে বকে যাচ্ছেন। মা আপনাকে দেখতে চাইছেন। একদিন আসুন না আমাদের বাড়িতে।”

আমি বললাম, “আসব।”

গীতা মিত্র বললেন, “আমারও একটা সুখবর আছে।”

আমি বললাম, “দিদির কাছে শুনেছি আগামী মাসে আপনার বিয়ে হচ্ছে।”

কথাটি ফুরোল। মেয়েটি হেসে হেসে ছাদ থেকে নেমে গেল। ছেলেটা অনেক আনন্দ এবং একান্ত ঔদাস্যে কলকাতায় ধোঁয়া ভরা সকালের আকাশের সঙ্গে কথা বলতে চাইল। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে কয়লার উনুনের ধোঁয়া মধ্যবিত্ত কলকাতার আকাশকে প্রথম প্রভাত থেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। সে ধোঁয়া মানুষের চোখে জল এনে দেয়। আমিও দেখলাম আমার দুচোখ ভিজে। নিশ্চয়ই কয়লার উনুনের ধোঁয়া চোখে লেগেছে। না কি কোনো এক অপূর্ব সুখ ও অনুসর্গ ব্যথার মিলিত শরাঘাত? গীতা মিত্রের সঙ্গে এরপরে আমার আর দেখা হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *