দুই
আমি যে “এলাম” তার বুঝি যুগের ও সময়ের কিছুটা পারস্পরিক তাৎপর্য আছে। বছরটা ছিল ১৯২১, গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃত আরম্ভের বছর। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ছিল যার উপক্রমণিকা, এখন জাতীয় অসহযোগ ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন তার যৌবন-জাগরণ। ১৯২১ এর প্রজন্ম তাদের পূর্বসুরিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতবর্ষ শাসন-গঠন করে এসেছে এই ঘটনা ঘনঘোর শতাব্দীর শেষ দশক পর্যন্ত। তোমরা, যারা জন্মেছ ভারত দ্বিখণ্ডিত ও স্বাধীন হবার পর, তারাও এখন এই কর্ম কোলাহলে সামিল হয়েছ। আমার কাহিনি, পুত্র, আবশ্যিকভাবে স্বাধীন ভারতের পদযাত্রার সঙ্গে গ্রন্থিত। এই বিশাল ঐতিহাসিক নাটকে আমার ভূমিকা রামায়ণে লঙ্কা-সেতু নির্মাণে বাঁদরদের ভূমিকার চেয়েও ক্ষুদ্র। সব মহামানবিক সংগ্রাম এক একটি অগ্নিপ্রবাহ : ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামও তাই। তার উত্তাপ থেকে গণেশপুরের মতো অতি দুঃস্থ গ্রামও রেহাই পায়নি, রেহাই পায়নি রজনীকান্ত নামে এক ক্ষুদে জমিদার, তার পুত্রপৌত্ররা।
ক্ষুদে জমিদার ও রজনীকান্তের মধ্যে ব্যবধান ছিল বিস্তর। পার্মানেন্ট সেটেলমেন্ট বঙ্গের ভূমি ব্যবস্থাকে জমিদারদের হাতে সঁপে দিয়েছিল। জমিদারিগুলো ভাঙতে ভাঙতে ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রতর, ক্ষুদ্রতম হয়ে গেল। কিন্তু জমিদারি মনোভাব রয়ে গেল প্রচণ্ড ও ব্যাপক। ক্ষুদে জমিদারদের বলা হতো তালুকদার। আমাদের তালুক দশ-বারো ঘর প্রজা গণেশপুর গ্রামেই, আরও কিছু প্রজা অনেক দূরে, ঠিক কোথায় আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি। গণেশপুরের প্রজাদের মধ্যে প্রায় সবাই জেলে, একঘর নাপিত, কয়েকঘর মুসলমান ক্ষেত-মজুর। প্রজাদের মধ্যে কারুর কারুর আর্থিক অবস্থা তালুকদারের চেয়ে ভালো। কিন্তু প্রজা-মনিব সম্পর্ক তালুকদারদের ও প্রজাদের মধ্যে বড় রকমের ব্যবধান তৈরি করে রেখেছিল। হিন্দু সমাজের অন্যান্য ব্যবধানের মতোই এই জমি অধিকারের ব্যবধান চিরস্থায়ী।
রজনীকান্ত ছিলেন ছোট তালুকদার, কিন্তু তাঁর নামডাক দশখান গ্রাম পেরিয়ে, মহকুমা শহর মাদারীপুর ছাড়িয়ে, জেলা শহর ফরিদপুর পার হয়ে কলকাতা পর্যন্ত হয়েছিল প্রসারিত। তার কারণ রজনীকান্ত ছিলেন প্রচণ্ড স্বদেশি। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে তিনি বড় বড় জনসভায়, মনে আগুন জ্বালানো বক্তৃতার মাধ্যমে ইংরেজের রোষ-দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। দু’বার তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। একবার গ্রীষ্মকালে পুলিশ গণেশপুরে হানা দিয়ে রজনীকান্তকে না পেয়ে তাঁর বড় ছেলে দুর্জয় সিংহকে ধরে নিয়ে তিন মাস জেলে রেখেছিল। অথচ দুর্জয় সিংহের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না, তিনি ছিলেন মনে প্রাণে ইংরেজ ভক্ত।
রজনীকান্তকে দশ গ্রামের লোকেরা “ডাকাত” বলত। মাঝারি দৈর্ঘ্যের দেহ, বাবরি চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে, বড় বড় লালচে চোখ, দেহে অসাধারণ শক্তি, মনে অসাধারণ সাহস। লাঠিয়াল হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ। তিনি একটি লাঠিয়ালের দল গড়েছিলেন। দলের বারোজন লাঠিয়াল ছিল তাঁর একান্ত অনুরক্ত। লাঠিয়াল গড়ার প্রয়োজন হয়েছিল গণেশপুর গ্রামের সীমান্ত দক্ষিণের খাল পেরিয়ে হোগলা গ্রামে বিখ্যাত এক মুসলমান জমিদারের অত্যাচার থেকে সাধারণ প্রজা মানুষদের বাঁচাতে। জমিদার বাড়ির লাঠিয়াল বাহিনীর সঙ্গে রজনীকান্তের লাঠিয়ালদের লড়াই বাঁধত, যদি বিনা কারণে বা অন্যায় কারণে জমিদারের লোকেরা কোনো গরিব প্রজাকে হঠাৎ বাড়ি—ঘর থেকে উৎখাত করবার উদ্দেশ্যে প্রজাদের পাড়ায় হানা দিত। এইসব লাঠির যুদ্ধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রজনীকান্তর দল জয়ী হতো।
গণেশপুর মুসলমান জমিদারের অধীনে নয়, অতএব রজনীকান্তের ওপর জমিদারের কোনো প্রভাব ছিল না। জমিদারের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রজাদের নালিশ রজনীকান্তের হাতে লিখিত হতো। প্রজাদের টিপ-সই ও কদাচ স্বাক্ষরসহ মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হতো। একবার রজনীকান্তের লিখিত একখানা চিঠি আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। জমিদারদের কাছে রজনীকান্ত ছিলেন ডাকাত। তাঁকে শায়েস্তা করার জন্যে কোনো প্রচেষ্টাই সার্থক হতে পারেনি। জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনীর মধ্যে ছিল রজনীকান্তের গুপ্তচর। প্রত্যেকটি প্রচেষ্টার খবর আগেভাগেই তিনি পেয়ে যেতেন। অসাধারণ ক্ষিপ্র গতিতে হয়ে যেতেন গায়েব। পুলিশ হানা দিত গণেশপুরে আমাদের বাড়িতে। রজনীকান্তকে খুঁজে পেত না। কেউ জানতও না তিনি কোথায় গেছেন, কবে ফিরবেন।
আমি আমার বাল্যকালে শুনেছিলাম যে জমিদার বাড়ি থেকে নিমন্ত্রণ পেয়ে একবার রজনীকান্ত দেখা করতে গিয়েছিলেন মুখ্য জমিদার সৈয়দ জালালউদ্দিন মহম্মদের সঙ্গে। জমিদারির মালিক ছিলেন দু’ভাই। সবাই বলত, ছোট জমিদার গিয়াসউদ্দিন মহম্মদ ছিল আসল অত্যাচারী। রজনীকান্তের লাঠিয়ালরা তাঁকে জমিদারের কাছে যেতে বারণ করেছিল। তাদের ভয় ছিল জমিদার বাড়ির নায়েব গোমস্তারা লোকজন দিয়ে রজনীকান্তকে ঘিরে ফেলবে, লাঠিয়ালদের হাতে তিনি বন্দী হবেন। রজনীকান্ত হেসে বলেছিলেন, আমাকে বন্দী করতে পারে এমন শক্তি জমিদারদের নেই। শুধু আছে ইংরেজ সরকারের।
সৈয়দ জালালউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে রজনীকান্তের একঘণ্টারও বেশি কথাবার্তা হয়েছিল। তিনি রজনীকান্তের বিরুদ্ধে সব অভিযোগগুলো তুলে ধরতে, “ডাকাত” রজনীকান্ত বলেছিলেন, আপনার অভিযোগগুলো সত্যি। কিন্তু যেসব প্ররোচনার বিরুদ্ধে আমাকে লড়তে হয় তার কোনো উল্লেখ করেননি। আপনাদের লোকেরা গরিব ও অসহায় প্রজাদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে যায়। খেয়ালখুশি মতো প্রজাদের উৎখাত করে। প্রজাদের কাছ থেকে বাহুবলে টাকা পয়সা আদায় করে। তারা যে নিঃস্ব, কারু-কারুর দু’বেলা ভাত জোটে না, একথা ভেবে দেখে না। তাদের মেয়ে-বউরা আপনার লাঠিয়ালদের দৈনিক খোরাক। আপনার নায়েব-গোমস্তারাও এই ভোগ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেন না। আপনি এসব অত্যাচার বন্ধ করুন, আমাদের “ডাকাতি” বন্ধ হয়ে যাবে।
বড় জমিদার রজনীকান্তের সঙ্গে বাক্যালাপে খুশি হয়েছিলেন। জমিদারি অত্যাচার কিছুটা লাঘবও হয়েছিল। বড় জমিদার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন যদি রজনীকান্ত তাঁর জমিদারি দেখাশোনার নায়েবি নেন। রজনীকান্ত এককথায় চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলেছিলেন, জমিদার সাহেব, আমি জমিদারির বিরুদ্ধে; কোনো জমিদারের নোকর হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
“ডাকাত” রজনীকান্ত পরে হয়েছিলেন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সৈনিক। গণেশপুর ও আশপাশে গ্রামে এই আন্দোলনের স্রোতকে ডেকে এনেছিলেন রজনীকান্ত। এই জন্যে তাঁর পুরস্কার মিলেছিল। কলকাতা থেকে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি গিয়েছিলেন এক নিখিল ভারত বঙ্গভঙ্গ বিরোধী জন-মহাসভায় ভাষণ দিতে। গণেশপুরের লোকেরা তাঁকে মালা পরিয়ে নৌকোয় তুলে দিয়েছিল। ফেরার সময়ও পদ্মা-নদীতীরে তিনি গ্রামবাসীদের দ্বারা অভিনন্দিত হয়েছিলেন।
রজনীকান্তের সব ছিল, আবার অনেক কিছু ছিল না। অর্থ ছিল না, কিন্তু তাঁকে কেউ কখনো দরিদ্র ভাবতে পারেনি। ত্রিপুরার মহারাজার নেক্ নজরে এসেছিলেন রজনীকান্ত, রাজ্যের রক্ষীবাহিনীতে কিছুদিন ছোট অফিসারের পদে মহারাজ তাঁকে নিযুক্ত করেছিলেন। দেখা গেল রজনীকান্তকে দিয়ে যেমন অনেক ক্ষেত্রে ভালো কাজ পাওয়া যায়, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে তাকে নিয়ে দেখা দেয় সমস্যা। মহারাজের রক্ষীবাহিনী সাধারণ মানুষের সঙ্গে যে ধরনের ব্যবহার করত তা জমিদার জালালউদ্দিন সাহেবের লাঠিয়ালদের ব্যবহারের সঙ্গে সংমিল। অত্যাচারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার রুখে দাঁড়িয়েছিলেন রজনীকান্ত। মহারাজার কাছে নালিশ পৌঁছেছিল যে রজনীকান্ত প্রশাসনের চাকায় অনবরত বাধা দিয়ে যাচ্ছে। মহারাজ রজনীকান্তকে সসম্মানে অবসর দিয়েছিলেন। দশ টাকা মাসিক পেনসন করিয়ে দিয়েছিলেন। দশটাকা তখনকার দিনে অনেক টাকা। প্রচুর খেয়ে, খাইয়ে, দান করে, লাঠিয়াল পোষণে এ টাকা ফুঁৎকারে উড়ে যেত। তাই অভাব লেগে থাকত সর্বদা। পুত্রবধূর গহনা বিক্রী করে গ্রীষ্মে আম খেতেন রজনীকান্ত।
রজনীকান্তের পত্নী, অর্থাৎ আমার ঠাকুমা অনেক বছর আগে বিগত হয়েছিলেন। আমার বাবারা ছিলেন দু’ভাই এক বোন। একটি বোন বিবাহিত হবার পর প্রথমবার বাপের বাড়ি ফেরবার সময়ে গভীর রাত্রে সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল পেছনের বিস্তীর্ণ আমবাগানে। পরের দিন সকালে তাঁর দেহকে একটা আমগাছের ডাল থেকে ঝুলতে দেখা গিয়েছিল। দেখেছিল বাগানের উত্তরে এক ধোবা বাড়ির লোকেরা। এই আত্মহত্যা রজনীকান্তকে বিশেষ বিচলিত করেছিল, এর চেয়ে বেশি এ সম্বন্ধে কোনো আলোচনা বাড়ির লোকদের মুখে আমি শুনতে পাইনি। আমার ঠাকুমাকে নিয়ে ও খুব কম কথাবার্তা শুনেছি, এমনকি আমার মাও কোনোদিন কিছু বলেননি আমাকে। যে খবরটা সবাই জানত, যা রজনীকান্তের পরিবারে বংশানুক্রমিক উপস্থিত, তা হলো আমার ঠাকুমার হাঁপানি রোগ। এই রোগের উত্তরাধিকারী ছিলেন আমার বাবা, আমার বোন মধু। আমি এটুকু জানতাম যে রজনীকান্তের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর সম্পর্ক ছিল নিরেট সংসারী, তিনি প্রায় কখনোই মৃত পত্নীর নাম করতেন না, অন্য স্ত্রীলোক তাঁর প্রলোভন ছিল যথেষ্ট। আমার কাকিমা সুন্দরী ছিলেন, কাকা ছিলেন তাঁর সঙ্গে সুগভীর প্রেমে আবদ্ধ। আমার যখন সাত বছর বয়স তখন রজনীকান্ত প্রয়াত হন। সাত বছর বয়সেই আমি শুনতে পেয়েছিলাম আমার কাকা তাঁর স্ত্রীকে গ্রামে রাখতেন না পিতৃদেবের ভয়ে। সুদীর্ঘ পঁচাশি বছরের সর্বশেষ বছর রজনীকান্ত নানারকম রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমাদের পরিবারে বাবার এক বিধবা কাকিমা তাঁর পুত্র নিয়ে বাস করতেন, তাঁদের অন্যকোনো সংগতি ছিল না। আমার মনে আছে রজনীকান্তের শেষ বছরে, বাড়িতে একদিন বেশ কিছু উত্তেজনা ঘটেছিল রাঙ্গাঠাকুমাকে নিয়ে। আমি জানতে পেরেছিলাম সেবারত রাঙ্গাঠাকুমাকে অসুস্থ রজনীকান্ত এক রাত্রে বিছানায় টানবার চেষ্টা করেছিলেন। আমার মা’র সঙ্গে তাঁর ব্যবহার কিন্তু আগাগোড়া বিশুদ্ধ। আমি লক্ষ্য করতাম রজনীকান্তের সেবা শুশ্রূষায় মা’র ভূমিকা ছিল খুবই সামান্য
রজনীকান্তের দুই পুত্র, আমার বাবা ও কাকা। কাকা ছিলেন সুপুরুষ, দেহে ছিল না মেদাধিক্য, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কশাস্ত্ৰে প্ৰথম বিভাগে এম.এ. পাস করে বঙ্গদেশের বাইরের বিহার, নেপাল, পাঞ্জাব ও বার্মাতে অধ্যাপনা করেন। আমার খুড়তুতো ভাইবোনেরাও ছোটবেলা থেকে বঙ্গের বাইরে মানুষ। মাঝে মধ্যে কাকা সপরিবারে গ্রামে আসতেন, তখন সবকিছু কী রকম বদলে যেত। বাজার থেকে এমন সব জিনিস আসত যা আমি আগে কখনো দেখতে পাইনি। মিঠাইওয়ালা এসে হাঁড়ি ভর্তি রসগোল্লা, পানতুয়া, কাঁচাগোল্লা ও ক্ষীর দিয়ে যেত, বড় বড় মাছ আসত, অনেক সবজি এবং ফল। আমার চেয়ে বছরখানেকের ছোট খুড়তুতো ভাই বাদলকে ইংরেজি ও বাংলায় প্রথমপাঠ শেখাবার জন্যে কাকা কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন রং বেরঙের বই, চার্ট, সুন্দর বাঁধানো এক্সারসাইজ বুক। বাদল আমার পিঠাপিঠি ভাই, আমার সারা জীবনের নিকট বন্ধু। খুড়তুতো দিদি রাণু ধবধবে ফর্সা, আমার চেয়ে তিন বছরের বড়, আমি যখন স্কুলের প্রথম শ্রেণিগুলোতে পড়ি, তখন সে প্রথম যৌবনে ঢলঢল। রাণু, যাকে আমি বলতাম দিদি, একটি গ্রামীণ বালকের হৃদয় মন কেড়ে নিয়েছিল। সারা জীবন আমি বোধহয় আর কাউকে এভাবে ভালোবাসিনি। স্কুলে টিফিন নিয়ে যাওয়অ আমার ও মধুর পক্ষে সম্ভব হতো না। আমরা ভাত খেয়ে স্কুলে যেতাম, স্কুল থেকে ফিরে খেতাম মুড়ি। মাঝে মাঝে মা একটি-দুটি পয়সা দিতেন। সে পয়সা জমিয়ে আমি স্কুলের পাশ থেকে খুব ভালো সন্দেশ কিনতাম। একটির দাম দু’ পয়সা। সেই সন্দেশ এনে দিদিকে কাছে ডেকে শুধু ওকেই দিতাম। দিদি জিজ্ঞেস করত, আমি খেয়েছি কিনা। আমি মিথ্যে বলে ঘাড় নেড়ে জানাতাম খেয়েছি। দিদিকে সন্দেশ খেতে দেখে আমার মন প্রাণ যেভাবে ভরে উঠত, জীবনে সেরকম অনুভূতি সম্ভবত আর হয়নি। দিদি কিন্তু আমাকে ছোট ভাই হিসেবেই দেখত। আমাদের ছোটবেলার ছেলেমেয়েরা কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনের দিকে পা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয় মনের এবং সদ্য বেড়ে ওঠা দেশের আকুলতা বিস্তীর্ণ একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যেই স্ফূর্ত করতে বাধ্য হতো, যদি সে আকুলতা চেপে থাকা অথবা অনুভব না করার বেড়া তাদের ঘিরে না রাখত। দিদির সঙ্গে ভাব ছিল বিরাট একান্নবর্তী পরিবার ও বাড়ির অন্য শরিকদের ছেলেদের। হিংসেয় আমার দেহ মন জ্বলে যেত, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলবার অধিকার বা সাহস ছিল না।
.
আমার যখন জন্ম হলো তখন রজনীকান্ত মধ্যাহ্নের আহারে বসেছিলেন। আমাদের বসতঘরটা ছিল বাড়ির দক্ষিণ কোণে। তার নাম ছিল দক্ষিণের ঘর। বিরাট আটচালা ঘর। খুব উঁচু মাটির ভিত, মেঝেও মাটির। চারদিকের দেওয়াল ও ছাত মোটা টিনের। ঘরের মধ্যে ছিল অনেক ঘর, বাঁশের বোনা দেওয়াল দিয়ে আলাদা করা। খুব বড় বড় মোটা কাঠের চারটে দরজা আটচালার চারদিকে। শোওয়ার জন্য ছিল কাঠের তক্তপোষ। রজনীকান্তের ঘরখানা দক্ষিণে, বিরাট ঘর। ছ’টা লোহার শিকওয়ালা কাঠের জানালা, রজনীকান্তের তক্তপোষের ওপরে দুটো, তার মধ্যে যেটা দক্ষিণ দিকে সেটা দিয়ে দেখা যেত দুটো বড় বড় কামিনী ফুলের গাছ, দশ-বারোটা নারকেল গাছ এবং দূরে পুকুর পাড়ে বড় বাঁশঝাড়। এই জানালা দিয়ে প্রায় সবসময়ই সুন্দর বাতাস আসত, আর দেখা যেত আকাশ, বর্ষায় কৃষ্ণকঠিন, শরতে সীমাহীন নীল, হেমন্তে সে নীল অনেকখানি হালকা, শীতে আকাশে রং প্রায়ই স্লেট বর্ণ, বসন্তে সাদা মেঘের নৌকো চড়ে নীলের প্রত্যাবর্তন, গ্রীষ্মে প্রচণ্ড রোদে তাপে আকাশ ক্লান্ত ও বিষণ্ণ।
যে রবিবার আমার জন্ম এক ভাদ্রমাসের শেষ প্রান্তে, সেদিন সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার, বর্ষা শেষের রোদ তেজহীন। রজনীকান্তের দুপুরের আহার প্রতিদিনের এক একটি সমারোহ। বিরাট কাঁসার থালাতে বাটি দিয়ে তৈরি মাঝারি সাইজের ভাতের গোল মণ্ডল, তাতে একটি ভাতেরও স্থানচ্যুতি অমার্জনীয়। একই সাইজের পাঁচটি বাটিতে সাজানো পঞ্চব্যঞ্জন। তার মধ্যে থাকবে অন্তত একপোয়া মাছের একখানা বা দু’খানা টুকরো, নিখুঁত আকার দুটোরই, এককোণে একটু ভাঙ্গনও গ্রহণীয় নয়। অবশেষে একবাটি ক্ষীর। চারদিকে বাড়ির স্ত্রীলোকেরা ঘিরে বসবে, আহার তত্ত্বাবধানের জন্যে। একজন হাত পাখা দিয়ে বাতাস করবে অন্নব্যাঞ্জনে মাছি না পড়ে, অন্য একজন হাওয়া করবে রজনীকান্তকে। যে রেঁধেছে সে আগাগোড়া উপস্থিত থাকবে ত্রুটি-বিচ্যুতির কৈফিয়ত দিতে, প্ৰশংসা কুড়োতে। ক্ষুদে জমিদার হলেও রজনীকান্তের জমিদারি মনোভাব, আজকাল যাকে বলে “লাইফ স্টাইল”, ছিল পুরোপুরি বড় জমিদারদের।
এ হেন মধ্যাহ্ন ভোজন বাঁধা পড়ল যখন আমার এক বিধবা পিসিমা হঠাৎ হাজির হয়ে খবর দিলেন পুত্রবধূ ননীবালা একটি পুত্রসন্তান প্রসব করেছে। রজনীকান্ত আহার ক্ষান্ত করে এক মিনিট নীরব। সবাই দেখতে পেল, দেখে অবাক হলো, তাঁর দু’গাল বেয়ে অশ্রু ঝরছে। বিবাহের সাত বছর পর মা’র গর্ভে প্রথম সন্তান, সেই সন্তান পুত্র। হয়তো রজনীকান্তের মনে পড়ে গেল তাঁর স্ত্রী এই সৌভাগ্য ভোগ করতে পারেননি, হয়তো ভাবলেন তাঁর প্রথম পুত্ৰ থেকে তিনি যে নৈরাশ্য পেয়েছেন, পৌত্র তার ক্ষতিপূরণ করবে। “আহার ত্যাগ করে রজনীকান্ত দক্ষিণের ঘরের সংলগ্ন প্রসূতিঘরে উপস্থিত হলেন। গ্রামের ‘দাই’ তাঁর কাছে একটি সদ্যজাত পুরুষ শিশু একখানা ভাঁজকরা শাড়িতে জড়িয়ে নিয়ে এল। বলল, “নাতি হয়েছে কর্তা। জন্মাবার পরেই যদি দেখতেন! সারা গায়ে কালো ‘ছ্যাতা’। সাবান দিয়ে ঘসে ঘসে সরাতে হলো। এখন বেশ মানুষ মানুষ মনে হচ্ছে।” রজনীকান্ত শিশুর মুখখানাকে কিছুক্ষণ দেখলেন। বললেন, “গায়ে ‘ছ্যাতা’ নিয়ে জন্মালে বড় মানুষ হয়।” মা’র শরীর ঠিক আছে কিনা জানতে চেয়ে তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে।
জন্ম থেকে সাত বছর আমি ছিলাম তাঁর চোখের মণি।
আমার জন্মাবার সময় পিতা দুর্জয় সিংহ তাঁর কর্মস্থল খুলনায়। তাঁকে ‘তার’ করা হলো। তার করতে হলে গণেশপুর থেকে আড়াই মাইল দূরে ঘড়িসার যেতে হয়। গ্রামের নিকটতম গঞ্জ। কাপড় জামা জুতো কিনতে হলেও আমাদের ঘড়িসার যেতে হতো।
রজনীকান্ত সম্বন্ধে দুটি ঘটনা আমার বেশ মনে আছে। বৃদ্ধ বয়সে তিনি আফিম খেতেন। একদিন তাঁর শোবার ঘরের পরেই অন্য একটা ঘরে প্রকাণ্ড সিঁদ কেটে চোর বা চোরেরা ভেতরে ঢুকে মা’র যেটুকু সামান্য যা কিছু ছিল সব চুরি করে নিয়ে যায়। তার মধ্যে ছিল বাপের বাড়ি থেকে বিয়ের সময় পাওয়া একজোড়া সোনার বালা। এটা চুরি হওয়ায় মা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন। রজনীকান্তের কাছে ঘটনাটা ছিল অত্যন্ত অপমানকর। ডাকাত হিসেবে দশখানা গ্রামে তিনি প্রসিদ্ধ। নিজের প্রজাদের তিনি সন্তানের মতো স্নেহ করতেন, কারুর বিপদে-আপদে তৎক্ষণাৎ পাশে দাঁড়াতেন। শীতে কাতর হয়ে কেউ দেখা করতে এলে নিজের একমাত্র গরম চাদর তুলে দিতেন তার হাতে। শুধু লাঠিয়াল হিসেবে নয়, দয়াবান অভিভাবক হিসেবেও প্রজাসমাজে তাঁর খ্যাতি ছিল। সেই রজনীকান্ত বেঁচে থাকতে তাঁরই ঘরে সিঁদ কেটে চোর ঢুকে পুত্রবধূর সর্বস্ব নিয়ে যাবে, এই অপমান তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না। খবর গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ নিকটতম থানায়, ভেদেরগঞ্জে। পুলিশ চলে এসেছিল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। রজনীকান্তের কথামতো বারো-চৌদ্দজন লোককে ধরে নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়িতে।
তারপর এলেন দারোগা। দারোগার সঙ্গে রজনীকান্ত কথা বলতেন ইংরেজি ভাষায়। তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করতে পারেননি কিন্তু ইংরেজি ভাষায় আশ্চর্য দখল ছিল তাঁর। ভিকটর হুগো’র ‘লা মিজারেবলস্’ ছিল তাঁর পুরোপ মুখস্থ। অনায়াসে আবৃত্তি করে যেতে পারতেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এডমন্ট বার্কের বক্তৃতাগুলো, নেপোলিয়নের জীবনী থেকে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা, প্রায় পুরো ‘প্যারাডাইস লস্ট’। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণ চরিত্র, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের চন্দ্রগুপ্ত নাটক, বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতা, মাইকেল মধুসূদনের মেঘনাদ বধ, এইসব বইগুলো তাঁর প্রায় মুখস্থ ছিল। জনতার কাছে বক্তৃতা করার সময় এসব বই থেকে তিনি অহরহ অনেক কিছু উদ্ধৃত করতেন। রাজপুরুষের সঙ্গে ইংরেজিতে বাক্যালাপ করার সেকালে ছিল উচ্চশিক্ষা ও আভিজাত্যের পরিচয়। জমিদার জালালউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও দুজনের কথাবার্তা হয়েছিল ইংরেজিতে।
একদল প্রজাদের কোমরে দড়ি দিয়ে বসিয়ে রেখেছিল পুলিশ আমাদের বাড়ির বৈঠকখানায়, পূজা মণ্ডপের বরাবর উল্টো দিকে। দারোগাকে সঙ্গে নিয়ে রজনীকান্ত একসময় বৈঠকখানা ঘরে উপস্থিত হলেন। আমাদের ঘরে চেয়ার ছিল মাত্র একটি। তার একটি হাতল ভাঙা। তাতে বসলেন দারোগা। রজনীকান্ত বসলেন বৈঠকখানার তক্তপোষের ওপরে। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এসে গেছি আমিও। দুর্গা—প্রতিমার এককোণে একটি ইঁদুরের মতো। রজনীকান্তের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
রজনীকান্তের সঙ্গে দারোগার কিছুক্ষণ কথাবার্তা হলো। ধরে আনা লোকগুলো পাথরের মতো নিশ্চুপ। এই নীরবতা ভঙ্গ করে হঠাৎ নিনাদিত হলো রজনীকান্তের মেঘগর্জনের মতো কণ্ঠস্বর। “তোদের মধ্যে যে চুরি করেছিস তাকে স্বীকার করতে হবে। যদি স্বীকার না করিস তাহলে দারোগা সাহেব তোদের সবাইকে নিয়ে যাবেন থানায়। পুরে দেবেন হাজতে। তখন পুলিশের ঠেঙ্গায় স্বীকার করতে বাধ্য হবি।”
লোকগুলো একসঙ্গে কেঁদে উঠল। সবার মুখে এককথা, “কর্তা, আমার কোনো দোষ নেই। আমাকে ছেড়ে দিন।” একটু পরে সবাই একসঙ্গে ওই একই কথা কেঁদে কেঁদে বলে যেতে লাগল। মাঝে মাঝে রজনীকান্তর ধমক, দারোগার শাসানি, কিন্তু ওই সমবেত আর্ত—আবেদনের শেষ নেই। এইরকম চলল কিছুক্ষণ। তারপর আমার আর সহ্য হলো না। অনেকক্ষণ ধরে কান্না পাচ্ছিল আমার। কোনোমতে চেপে ছিলাম। এখন আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। কান্নার মধ্যেই বলতে লাগলাম, “দাদু, এদের ছেড়ে দাও। এরা সবাই কাঁদছে। আেেদর ছেড়ে দাও।”
আমার কান্না ও আবদার শুনে লোকগুলো আরও জোরে কাঁদতে লাগল। আরও উঁচু পর্দায় ধ্বনিত হলো তাদের কাতর মুক্তি প্রার্থনা। তাদের চিৎকার শুনে আমিও আরও জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম এবং বলে গেলাম, ওদের ছেড়ে দাও দাদু, ওদের ছেড়ে দাও, ওদের ছেড়ে দাও…।
রজনীকান্ত আমাকে বৈঠকখানা থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। আমি কামড়ে ধরলাম তার ধুতির কোঁচা”। হঠাৎ রজনীকান্তের দু’গাল বেয়ে চোখের জল ঝরতে লাগল। তিনি দারোগাকে ইংরেজিতে কী সব বললেন। দারোগা পুলিশদের হুকুম করলেন লোকগুলোকে ছেড়ে দিতে। প্রত্যেকটা লোক রজনীকান্তকে, দারোগাকে ও আমাকে প্রণাম করে চলে গেল।
আমার তখন সাত বছর বয়স। সবে গ্রামের স্কুলে নিম্নতম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছি। নিজেই হেঁটে স্কুলে যাই। স্কুলে মন টেকে না। মাঝে মাঝে মাস্টার মশাই বাড়ি পাঠিয়ে দেন। আমি জানি আমার দাদু খুব অসুস্থ। ডাক্তার, কবিরাজ প্রতিদিন বাড়িতে আসা-যাওয়া করছে। পাশের গ্রামে ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছেন এক সিভিল সার্জন। তাঁকে খবর দিতে তিনি তড়িঘড়ি চলে এলেন রজনীকান্তকে দেখতে। ওষুধ লিখে দিলেন। লোক পাঠিয়ে ঘড়িসার থেকে ওষুধ আনানো হলো। বাড়িতে সবার মন খারাপ। কারুর মুখে হাসি নেই। হঠাৎ আমার পিতৃদেব চলে এলেন তাঁর কর্মস্থল থেকে। কাকামণি থাকেন অনেক দূরে, পাঞ্জাবে। তাঁকে চিঠি দেওয়া হলো কিন্তু সবাই জানত তিনি আসতে পারবেন না। আমি রজনীকান্তের কাছে যেতে পারছি না। শুধু সন্ধ্যের পরে সামান্য একটু সময়ের জন্য আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি কাতরকণ্ঠে আমার সঙ্গে দু’একটা কথা বলছেন। তাঁর রুগ্ন হাত বোলাচ্ছেন আমার মুখে, কপালে, মাথায়। একদিন আমার সামনেই বাবাকে বললেন, “এই ছেলেটাকে ভালো করে মানুষ করিস।” আমার খেয়াল হলো দাদুর কণ্ঠে কোনো জোর নেই। খুব আস্তে উচ্চারিত হয়েছে কথাগুলো।
সেদিনের বার-তারিখ আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে ক্লাসে আমার মন টিকছিল না। কেবল কান্না পাচ্চিল। হঠাৎ দেখি আমার বাবা খালি দেহকে ধুতির খুঁটে আবৃত্ত করে ক্লাসের দুয়ারে হাজির। শিক্ষকমশাইকে তিনি কী যেন বললেন। আমি আদেশ পেলাম বাড়ি চলে যেতে।
বাবার সঙ্গে বাড়ি আসার পথে কোনো বাক্যালাপ হলো না। অর্থাৎ আমিও কিছু প্রশ্ন করলাম না, তিনিও বললেন না কেন আমাকে অসময়ে ক্লাস থেকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি পৌঁছবার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো রজনীকান্তের শয্যার পাশে। তাঁর চোখ মুদ্রিত, ঘন ঘন নিঃশ্বাস প্রশ্বাস। কে যেন জোরে বলল, আমি এসেছি, তাকিয়ে আমাকে দেখতে। রজনীকান্তের মুদ্রিত চোখ দুটি উন্মুক্ত হলো। দৃষ্টি পড়ল আমার উপর। তাঁর চোখ ভরা জল। হাতখানা নড়ে উঠল। আমার মনে হলো আমাকে খুঁজছে। কিন্তু ভয়ে আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম না। রজনীকান্তের ওষ্ঠাধর কম্পিত হলো। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না। কে যেন বলল, কিছু বলতে চাইছেন। পঁচাশি বছরের দেহ চোখ বুজল। পাশে বসে জ্যেঠামশাই গীতা পাঠ করছিলেন। তিনি বাবার দিকে চাইলেন। স্ত্রীলোকেরা একসঙ্গে কেঁদে উঠলেন। আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
রজনীকান্তের মৃত্যু গণেশপুরের ইতিহাসে, আমাদের পরিবারের জীবনে, একটি ঘটনাবহুল যুগের অবসান। আমাদের জীবনটা পাল্টে গেল। রজনীকান্তের দুই ভাই অল্প বয়সে মারা গিয়েছিলেন। তাদের দুই পরিবার আমাদের সঙ্গে সংযুক্ত। রাঙ্গা-ঠাকুমা তাঁর এক ছেলেকে নিয়ে আমাদের ঘরেই থাকতেন। বড় ছেলে বাস করত কুচবিহারে এক পিসিমার সঙ্গে। আরেক ঠাকুমা তাঁর এক মেয়েকে নিয়ে নিজেদের ঘরে বাস করতেন। তাঁর বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল বরিশালের গ্রামে। দু’তিনটি সন্তান রেখে তিনি মারা গিয়েছিলেন। ছোট মেয়ে, আমাদের কুট্টি পিসি, মা’র সঙ্গে আলাদা ঘরে বাস করলেও খেত আমাদের সঙ্গে।
দুই ঠাকুমার জন্যে ছিল হবিষ্যি রান্নাঘর। সেখানে প্রায়ই খুব সুস্বাদু নিরামিষ তরকারি তৈরি হতো। উপাদান ছিল কলমি শাক, পুঁই শাক, ঢেঁকি শাক ইত্যাদি। বাড়ির মধ্যেই অথবা আশপাশ থেকে তুলে আনা। সজনে ডাঁটার চচ্চড়ি হতো। কুমড়ো পাওয়া যেত আমাদের হাতে তৈরি ছোট ছোট ক্ষেত থেকে। আমাদের মানে রাঙ্গাঠাকুমার ছেলে চিনিকাকু ও আমি। চাল ডাল মসলা ছাড়া দোকান থেকে আর কিছু কিনতে হতো না। চাল ডাল তো অবশ্যি রজনীকান্তই যোগান দিতেন। তাঁর মৃত্যুর পরে এইসব ভার পড়ল আমার বাবা দুর্জয় সিংহের উপর। অর্থাৎ আমার মা’র ওপর।
.
রজনীকান্তের সময়কার বাড়িটার একটু বর্ণনা দেওয়া যাক। বলেইতোছি আমাদের দক্ষিণঘর। বসতভিটা ছাড়া দু’টি রান্নাঘর, একটি আমিষ, অন্যটি নিরামিষ। নিরামিষ রান্নাঘরের কাছাকাছি রজনীকান্তের দুই ভাইয়ের ঘর। ছোট দাদু, যিনি আরও বেশ কিছু বছর জীবিত ছিলেন, বাস করতেন বাঁ দিকের দক্ষিণ কোণের ঘরে, সঙ্গে রান্নাঘর ও একটা বাড়তি ঘর। এখানে নানারকম জিনিসপত্র জমা থাকত। হবিষ্যি রান্নাঘরের ডান দিকে কুট্টি পিসিদের ঘর, পেছনে বাড়ির সীমান্ত একটা খাল, যা প্রতি বর্ষায় নদীর উদ্বৃত্ত জল টেনে আনত আমাদের পুকুরে। দক্ষিণের ঘরের পরে বেশ বড় একটা উঠোন। এখানে মাঝে মধ্যে পালাগান হতো, হতো সরস্বতী পুজো, লক্ষ্মী পুজো এবং আরও কিছু কিছু উৎসব। এই উঠোনের তিনদিকে ছিল তিনটি বসতঘর। পশ্চিমে রাঙ্গাঠাকুমার ঘর, আমার সেই ছোটবেলাই ভেঙে পড়ে গেছে, সারানো হয়নি। উত্তরে ছিল জ্যেঠামশাইয়ের ঘর ও রান্নাঘর। জ্যেঠামশাই মানে বাবার খুড়তুতো দাদা। তিনি ও বড়মা নিঃসন্তান। জ্যেঠামশাই ছিলেন আমাদের গ্রাম্য জীবনের অভিভাবক। রান্নাঘরের পাশে পাতিলেবুর বাগান, দুটো অনেক উঁচু তালগাছ, তার গা ঘেঁষে চলে গেছে অন্দরমহলের পায়খানা। পুবদিকে আমাদের বাড়ির আর এক শরিক, রজনীকান্তের দূর সম্পর্কের কোনো এক ভাইয়ের বংশধরগণ। এই পরিবারের অভিভাবক, আমার অন্য এক জ্যেঠামশাই, রণজিৎ কুমার, অনেক দূরের অন্য গ্রামে স্কুল শিক্ষক। তিনি সপ্তাহে কেবল রবিবার বাড়িতে থাকতেন। বাকিটা কাটত স্কুলেরই পাশে ভাড়া করা একখানা ঘরে। তাঁর পাঁচ পুত্র ও পাঁচ কন্যা ছিল। এদের সবাই আমার ভাইবোনের মতো। আমার ছোটবেলায় এদের অবস্থা আমাদের চেয়েও দরিদ্র।
রজনীকান্ত বিগত হবার পর থেকে এতবড় সংসারের সমস্ত দায়িত্ব বাবার, মা’র ও আমার উপর পড়ল। বাবা টাকা পাঠাতেন। মা ও আমি সংসার চালাতাম। বাজার-আজার করতে হতো আমাকে, সেই সাত বছর বয়স থেকে।
এই পরিবেশে গণেশপুর গ্রামে আমার বাল্যকাল, কৈশোর, যৌবনের প্রারম্ভ। আমার ঘনিষ্ঠতম আপনার জন মা, সবচেয়ে স্নেহের পাত্র বোন মধু ও ভাই কানু, নিকটতম বন্ধু অনেক— বাগানের গাছগুলো, রাস্তার দুধারের জঙ্গল, বিশেষ করে অনির্বাণ দ্বীপশিখার মতো প্রতিভাত পদ্মা, যার তীরে বসে বসে অথবা বেরিয়ে কাটত আমার প্রতি বিকেল। যার সঙ্গে হতো আমার বালক মনের অবিরাম কথোপকথন।
রজনীকান্ত তখন পরলোকে। আমি স্কুলের মধ্যম স্তর অতিক্রান্ত করে উচ্চ স্তরে পদার্পণ করেছি।
একদিন গণেশপুরে মুখে মুখে প্রচারিত সংবাদপত্রে ঘোষিত হয়ে গেল, কে একজন স্বাধীনতা সৈনিক এখানে এসে হাজির হয়েছেন। তার নাম অনন্ত। আমাদের সবার অতি সহজে লব্ধ অনন্ত দা।
গণেশপুরে একটি সাধারণ পাঠাগার ছিল। আমাদের বাড়ির পেছনের আম-বাঁশ বাগান পেরিয়ে পাঁচ-সাত মিনিট হাঁটলে পাঠাগারে পৌঁছানো যেত। চক্রবর্তী বাড়ির একখানা অব্যবহৃত ঘরে এই পাঠাগার, দেদার বাংলা বই। চক্রবর্তী বাড়ির অনাদিকাকা প্রতিদিন বিকেলবেলা দু ঘণ্টা লাইব্রেরির পর্যবেক্ষক। গ্রামের যেসব শিক্ষিত ভদ্রলোকরা কলকাতা বা অন্য শহরে প্রবাসী ছিলেন, তাঁরাই মাঝে মধ্যে দু দশখানা বই দান করতেন ‘গণেশপুর সাধারণ পাঠাগারে’। শরৎ ঋতুতে দুর্গা পূজা উপলক্ষে যখন তাঁরা গ্রামে ফিরতেন, তখন প্রতি বছর এক বিকেলে পাঠাগারের বাৎসরিক সভা বসত। কয়েকটি মেয়ে গান্ করত, কয়েকটি ছেলে আবৃত্তি, বড়দের মধ্যে দু’চার জন ভাষণ দিতেন।
আমার মা’র ঢালাও অনুমতি ছিল যে-কোনো বই পড়বার। তাই বারো বছর অতিক্রান্ত হবার আগেই আমি কয়েকশো বাংলা উপন্যাস পড়ে ফেলেছিলাম। গণেশপুরে সে-সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জনপ্রিয় লেখক ছিলেন না, পাঠাগারে কবিতার বই ছিল না বললেই হয়। জনপ্রিয় ছিলেন বঙ্কিম, শরৎচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল, রমেশচন্দ্র, মহী চট্টোপাধ্যায়, অনুপমা দেবী, তারাশঙ্কর, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, জলধর সেন, নিরুপমা দেবী, দীনেন্দ্রকুমার রায়, নরেশ সেনগুপ্ত, পরশুরাম, প্রমথ চৌধুরী, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, প্রমথ বিশী, হেমচন্দ্ৰ বসু, সীতা দেবী, সরোজ রায়চৌধুরী, সতীনাথ ভাদুরী, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, মনীন্দ্রলাল বসু : এঁদের (নাম মনে নেই আরও কিছু লেখকের) কোনো না কোনো উপন্যাস আমার পড়া হয়ে গেছে— অনেক রাত্রি জেগে, চোখের জল, বুকের রুদ্ধশ্বাস, তরুণ হৃদয়ের আন্দোলন এসব উপন্যাস কেড়ে নিয়েছে একটি উঠতি বালকের কাছ থেকে। মাইকেল মধুসূদনের ‘মেঘদূত’ মা’র সাহায্য নিয়ে পড়ে ফেলেছি, এবং ‘গোরা’ উপন্যাস পড়তে পড়তে চলে গেছি এক অপূর্ব দেশে যার নাম ভারতবর্ষ, যার বিশেষ কিছুই খুঁজে পাইনি গণেশপুর গ্রামে। এখন, এই বিংশ শতাব্দীর শেষপাদে, এসব ঔপন্যাসিকদের অনেকেই ইতিহাস হয়ে গেছেন, তাঁদের উপন্যাসও এখন ইতিহাস। বসুমতী পত্রিকার কর্তৃপক্ষ সেক্সপিয়রের নাটক বাংলা অনুবাদে প্রকাশ করেছিলেন, তাও আমি পড়ে ফেলেছি। “কল্লোল যুগ” তখন কলকাতায় শুরু হয়ে গেছে, যদিও গণেশপুরে তার হাওয়া পৌছায়নি। কিন্তু নজরুল ইসলাম ও দ্বিজেন্দ্রলালের দেশপ্রেমী কবিতা ও গান গণেশপুরের ভদ্রঘরের ছেলেমেয়েরা গাইছে— সভায়, উৎসবে, গৃহে।
আমার পিতাঠাকুর উপন্যাস পড়া গর্হিত কাজ মনে করতেন। সারা জীবন তিনি একখানা উপন্যাস পড়েছেন। এটাই ছিল তাঁর পাঠ্যজগতের সীমানা। রবি ঠাকুরকে তিনি যুবক-যুবতিদের নীতিবোধ তরল করিয়ে দেবার দোষে দোষী মনে করতেন: তাঁর বিশ্বাস ছিল উপন্যাস পড়লে কিশোর কিশোরী যুবক যুবতিদের মনে যৌন-চেতনা ও রোমান্টিক ব্যাকুলতার সঞ্চার হয়। আমার মাকে তিনি তাঁর মাসিক পোস্টকার্ডে বার বার সতর্ক করে দিতেন আমি যেন কদাচ উপন্যাস না পড়ি। তাঁর নির্দেশ ছিল কেবল মহাপুরুষদের জীবনী পড়ার গ্রীষ্মের ছুটিতে যখন তিনি বাড়ি আসতেন, নিয়ে আসতেন এক বা দুখানা মহাপুরুষ-পুস্তক। আমুতোষ ধরের ইংলিজ-বেঙ্গলি অভিধানের ধারাবাহিক সাহায্যে আমাকে সেগুলো পড়তে হতো। তাতে ঐ সব মহাপুরুষরা আমার কল্পনায় বিশেষ স্থান পাননি। কিন্তু সেই অনেক কষ্ট ও বেদনা থেকে যা আমি লাভ করেছি তা হলো অনেক ইংরেজি শব্দের দখল, অর্থ ও ব্যবহার হোক না অনেক সময় ভ্রান্ত, হাস্যকর। দুপুরবেলা পিতৃদেব নিদ্রাবিলাসে দেহ ঢেলে দেবার সময় মাটিতে পাটির উপর বসে টানা দুঘণ্টা আমাকে লড়তে হতো আব্রাহাম লিঙ্কন, জর্জ ওয়াশিংটন, নেপোলিয়ন, গ্যারিবাল্ডি, নেলসন প্রমুখ ঐতিহাসিক বীরদের জীবনীর সঙ্গে।
মনে আছে, একদিন মাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “অশ্লীল উপন্যাস কাকে বলে?”
মা জবাব দিয়েছিলেন, “আমি তো পণ্ডিত নই, অধ্যাপক নই, সমালোচক নই। তোর প্রশ্নের জবাব দেব কী করে?”
“ওরা বলছিল কলকাতার নতুন লেখকরা অশ্লীল উপন্যাস আর কবিতা লিখছে।”
মা জানতে চেয়েছিলেন, “কারা? নাম কী তাদের?”
বলেছিলাম, “আমি শুধু দুটো নাম শুনেছি। বুদ্ধদেব বসু আর প্রবোধ সান্ন্যাল।”
“এদের বই আছে তোদের পাঠাগারে?”“
“জানি না।”
“থাকলে নিয়ে আসিস। আগে আমি পড়ব, তারপর তোকে পড়তে দেব, যদি তোর পড়ার মতো হয়।”
“কী করে বুঝবে আমার পড়ার মতো কিনা?”
“সব বয়সে সব খাদ্য হজম হয় না। দেখতে হবে কোন বই তোর পক্ষে হজম করা সহজ বা কঠিন।”
অনন্তদার (গণেশপুরের জীবনে) ঐতিহাসিক আবির্ভাবের আগে আমি এবং আমার পিতার প্রসঙ্গটা আর একটু বর্ণনা করছি। পিতা—পুত্র সম্পর্ককে যেমন সারা পৃথিবীতে তেমনি আমাদের এই ভারতবর্ষে কালের প্রবাহ বার বার বদলে দিয়েছে। পশ্চিমের সমাজে, যাকে ইংরেজিতে বলে পোস্ট-ইনডাস্ট্রিয়াল সোসাইটি, এখন পারিবারিক সম্পর্ক অতিশয় শিথিল : আমেরিকা ইংল্যান্ডে একশোটির মধ্যে চুয়ান্নটি বিবাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে, যেমন সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা আরও বেশি। ছেলেমেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক হবার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণত পিতৃমাতৃ গৃহ থেকে সরে পড়ে, তৈরি করে নিজেদের স্বকীয় স্বাধীন জীবন। পিতামাতার সঙ্গে বন্ধন এখনও বর্তমান, বিশেষ করে মা’র সঙ্গে মেয়েদের, কিন্তু সে বন্ধনে পিতা স্বর্গ মাতা স্বর্গ, পৃথিবী থেকে দুজনে গরিয়ান বা গরিয়সী, এ ধরনের প্রাচীন সমাজের পারিবারিক মূল্যবোধ, এখন কল্পনার অতীত। এখন আমেরিকা—ইউরোপের ষোলো বছরের ভার্জিন মেয়ে নিয়মের ব্যতিক্রম।
আমাদের দেশেও পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। উপর তলার উচ্চশিক্ষিত আধুনিক সমাজে হাওয়া বইছে কিছুটা বেগে। নিচের তলায় মৃদুমন্দে। পশ্চিমের তুলনায় এ বেগ খুব মন্দ।
পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, একশোর মধ্যে পঁচানব্বই ক্ষেত্রে পুত্রের ভবিষ্যৎ এখনও নির্দেশ করেন, অথবা নির্দেশে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, পিতা। কোন স্কুলে ভর্তি হবে, কী বিষয় নিয়ে পড়বে, ক্যারিয়ার কী করে বেছে নিতে হবে, কোথায় কার সঙ্গে বিবাহ হবে, এ সব মুখ্য বিষয়ে পিতার (এবং মাতার) ভূমিকা কোনোমতেই গৌণ নয়, অনেক ক্ষেত্রে অবশ্য গ্রাহ্য।
তবু, প্রায়ই যুবকদের মুখে শুনি, আমার বাবা ঠিক করেছেন আমি ডাক্তার হব।
অথবা, বাবা চাইছেন আমি আই-এ-এস পরীক্ষা দিই।
কিংবা, বাবা আমাকে ইঞ্জিনিয়র হতে বলেছেন।
অথবা, আমি কলেজে পড়াব, বা রিসার্চ করব, এতে বাবার আপত্তি নেই।
আমি যখন বালক-কৈশোর জীবন, অর্থ-শতাব্দীর অনেক আগে, গণেশপুর নামক এক ‘শিক্ষিত ভদ্রলোকদের’ গ্রামে কাটাই, তখন পিতা-পুত্রের সম্পর্কটা কী ধরনের ছিল তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাইবে।
ছিল তোমার আমার ক্ষেত্রে পিতা-পুত্রের সম্পর্কের সম্পূর্ণ বিপরীত।
দুর্জয় সিংহ বছরে তিনবার বাড়ি আসতেন। গ্রীষ্মের ছুটি ছিল দীর্ঘতম, পুরো দু’মাস। পুজোর ছুটি মাস খানেক। বড়দিনের ছুটি দু’সপ্তাহ।
পোস্টকার্ডে মাকে জানিয়ে দিতেন কবে, কোন তারিখ এবং কী বারে তিনি সমাগত হবেন।
খুলনা থেকে স্টিমারে চেপে পালং আসতে হতো। তারপর আট—দশ মাইল হেঁটে গণেশপুরে। সঙ্গে থাকত মুটের মাথায় শুধু একটা বিছানা। টিনের বাক্সও নয়, সুটকেস তো দূরের কথা বিছানাটা সতরঞ্জি দিয়ে সুন্দরভাবে মোড়ানো, পাটের দড়ি দিয়ে এমন শক্ত করে বাঁধা যে যদি সেটা জীবন্ত কোনো পশু হতো, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু অনিবার্য।
অনেক সময় পালং থেকে নৌকা চেপে গণেশপুরের পদ্মানদী পর্যন্ত আসতে পারতেন। তখন সওয়ারি নিয়ে নৌকা চলত, নির্ধারিত সব ‘স্টেশনে’ নেমে মাঝি ঢোল বাজাত। সওয়ারী পুরো হলে ছাড়ত সেই ‘নদীট্যাক্সি’, মন্থর তার গতি, নদীর মেজাজ ও বায়ুর গতি দিয়ে নির্ধারিত। প্রত্যেক নৌকায় দু’জন মাঝি; একজন, অনেক সময় দুজনেই, বৈঠা চালাত; প্রয়োজন হলে প্রতিকূল বায়ুর সঙ্গে পাঞ্জা দিয়ে লড়ার জন্যে এক মাঝি “গুণ” অর্থাৎ লম্বা নারকেলের ছোবরার দড়ি নিয়ে তীরে নেমে যেত, দড়ি বাঁধা থাকত নৌকার সঙ্গে, মাঝি তীরের মাটিতে চলত ‘গুণ’ টেনে, সহকর্মী চালাত বৈঠা।
দুর্জয় সিংহের বাড়ি আসার দিন আমার ও মধুর কি চাপা আনন্দ। ঠাসা ভয়। কানু জন্মাবার পর—তারও। আনন্দের কারণটা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না—পিতা বাড়ি আসছেন, সন্তানরা তো আনন্দ পাবেই। আহার্য দ্রব্যের চেহারা ও গুণ যাবে বদলে। সবচেয়ে বড় কথা, ঐ আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা বিছানার মধ্যে অপেক্ষা করবে আমাদের, আরও অনেকের, লোভনীয় সব প্রাপ্তি।
কিন্তু ভয়? ভয় কেন?
ভয় এজন্যে যে আমরা আমাদের পিতাকে সামান্যই চিনতাম। তিনি আমাকে কোনোদিনও কাছে ডেকে আদর করেননি, বুকে তুলে নেননি, আমাকে হাত ধরে বেড়াতে নিয়ে যান নি। ছোট বোন মধুকে বা তার পরের দু’ভাই কানু ও ভানুকে, ও আমার কনিষ্ঠ বোন বেনুকে, করেছেন কিনা মনে পড়ছে না, করে থাকলে নিশ্চয়ই মনে পড়ত। অথচ প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন আমাদের। আমরা ছিলাম তাঁর হৃদয়ের ধন।
অনেক, অনেক বছর পরে, বয়স তখন আমার ত্রিশ পেরিয়েছে, চাকরি করছি দিল্লিতে, পিতা অবসরপ্রাপ্ত, সংসারের দায়িত্ব সব আমার, তখন একবার জ্বরে বিছানা নিতে হয়েছিল। জ্বরটা যেন উঁচু মানের, ঘোর ঘোর ভাব, তোমরা মা শুধু ডাক্তার ডাকেননি, রোজ অনেকক্ষণ কপালে জলপট্টি দিয়েছেন।
হঠাৎ রাতে ঘুম বা ঘোরের মধ্যেই চমকে জেগে গেলাম। খালি দেহে এক অপরিচিত হাতের আদর স্নেহস্পর্শ! চোখ খুলে দেখি আমার বাবা হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আমার বুকে, কপালে, বাহুতে। সে স্পর্শ এখনও আমার শরীরে লেগে আছে। মনে তো আছেই। আমি কি আগে কখনো জেনেছি যে আমার বাবার হাত কত নরম, তার স্পর্শ কী ভীষণ স্নেহ ও ভালোবাসায় কতখানি স্নিগ্ধ?
প্রসঙ্গ থেকে সরে আসছি। তবু এখানে বলে রাখছি। আমি আমার বাবা, কাকা, কাকিমা, পিসিমা কারো দৈহিক ভালোবাসা পায়নি ছোটবেলা। ওটা সম্ভবত তখন চালু ছিল না। তোমরা যেমন আমার কোলে, পিঠে, বুকে, মাথায় করে শিশুকাল থেকে বড় হয়েছ, এই রীতি তখন সম্ভবত সমাজে নিষিদ্ধ ছিল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে ‘বাড়াবাড়ি’ বড়দের চোখে ভর্ৎসনার ব্যাপার। অথবা হয়তো আমাদের পিতারা লাজুক ছিলেন। আমার কাকা তো উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপক, প্রবাসেই তাঁর চাকরি জীবন, এবং আমাদের চোখে তিনি ছিলেন ‘আধুনিক’। কিন্তু তাঁকেও আমি, অন্তত গ্রামের বাড়িতে, দেখিনি বাদলকে বুকে জড়িয়ে আদর করতে, কোলে টেনে নিতে, হাত ধরে রাস্তায় অথবা বাগানে বেড়াতে।
দুর্জয় সিংহ কিন্তু তাঁর ছোটভাইয়ের সন্তানদের আদর করতেন। তাদের সঙ্গে খেলতেন পর্যন্ত। আমার নিশ্চয় দারুণ হিংসে হতো। বুঝতে পারার ক্ষমতা ছিল না।
বিরাট বাড়ির ‘দক্ষিণের ঘর’ আমাদের বাসগৃহ। তার খুব কাছাকাছি শ’দুই গজ পরে, রান্নাঘরের দরজা থেকে আমাদের বাড়ির প্রবেশ পথটা পুরো দৃষ্টিগোচর। নদীতীর থেকে দুটো সমান্তরাল ‘হাইওয়ে’ গণেশপুরের যানবাহন, মানুষের গতিপথ। যানবাহন বলতে একমাত্র মানুষের পদযুগল। গরুর গাড়ি পর্যন্ত নেই। একটি ‘হাইওয়ে’ দাশ বাড়ির দিকে দৌড়েছে, অথবা পায়ে পায়ে চলে গেছে, তার গা থেকে তৈরি আমাদের বাড়ির প্রবেশ পথ। মোড় নিলেই রান্নাঘর থেকে দেখতে পাওয়া যায়।
প্রবেশ পথ বেশ দীর্ঘ, বর্তমানের মাপে আধ-কিলোমিটার হবে। প্রবেশ পথের মাথায়, ডানপাশে শ্মশান ভূমি। আমাদের বাড়ির বিভিন্ন শরিকদের মধ্যে যারা মরে যেতেন তাদের শব দাহ করা হতো এই শ্মশান ক্ষেত্রে। আম, বকুল ও অন্যান্য গাছে ছায়াঘন। রাস্তার উল্টো বাঁ দিকটাও নানা গাছে সবুজ।
শ্মশানভূমি পেরিয়ে বসতবাড়ির দিকে এগোলে, ডান দিকেই দোল মণ্ডপ। বাঁ দিকে সরু রাস্তা তৈরি হয়েছে এক প্রজাবাড়ির, যারা জাতে মেথর অর্থাৎ চামার, কিন্তু বেশ ‘অবস্থাপন্ন, যাদের এক শরিক গ্রামের একমাত্র স্যাকরা, অন্য এক শরিক কাঠের মিস্ত্রী, শুধু দরিদ্র তৃতীয় শরিক গ্রামে মেথরের কাজ করত, মৃত গরুর শরীরটা কয়েক মাইল দূরে চামারদের গ্রামে নিয়ে বিক্রি করে দিত, বিবাহে, অন্নপ্রাশনে, পৈতায়, শ্রাদ্ধে মেথরদের প্রাপ্য পেত। আমার যে জ্যেঠামশাই পরিবারে দুর্গাপূজার অধিনায়ক ছিলেন তিনি এই মেথর পরিবারের নাকি সুরে কথা বলা বিহারীকে দিয়ে বেশ্যাঘরের মাটি সংগ্রহ করতেন, দুর্গাপূজার সহস্র উপকরণের মধ্যে যা ছিল অন্যতম, এবং যার সামাজিক তাৎপর্য হলো হিন্দুর শত জাত-পাত বিভাগের মধ্যেও কোনো বড় উৎসব থেকে বাদ যেত না কেউই, বেশ্যাঘরের মাটিরও দরকার হতো দুর্গামাতাকে বাৎসরিক পূজন-সম্বৰ্ধনা জানাতে।
প্রজাবাড়ির সঙ্গে বাইরের পুকুর, বসতবাড়ির বহিঃসীমানা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ। এই পুকুর বুঝি তিন পুরুষ পুরোনো, এর জল আমাদের পানীয় নয়। রজনীকান্তের এক ভাই অবনীকান্ত বসত বাড়ির পূর্ব সীমানায় নিজের খরচে একটু বৃহত্তর পুকুর খনন করে দিয়েছিলেন, শর্ত ছিল দশ বছর পুকুরের মাছ ও তিন পাড়ে নতুন তৈরি কলাবাগানের ফল তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি। এই পুকুরের জল আমরা খেতাম। সেদ্ধ করে খাবার নিয়ম তখনও গ্রামে পৌছায়নি। আমার মা ফিটকারি দিয়ে জল শুদ্ধ করে নিতেন।
পুকুর ঘেঁষে আমাদের বাড়ির প্রবেশ পথ। ডান দিকে প্রজা জেলেদের পর পর তিনটে বাড়ি। জেলে প্রজাদের আর্থিক অবস্থা আমাদের থেকে ভালো, যদিও তা প্রজা-মনিব সম্পর্ককে একটুও বিদ্ধ করেনি। প্রজারা পূজার সময় ও বর্ষাকালে মাছ দিয়ে যেত মনিবদের সন্তুষ্টির জন্য, অবশ্যই বিনা দামে। পূজার সময় তাদের দেয় খাজনাই ছিল বাজেটের প্রধান অংশ, বাড়ির শরিকদের অনুদান যৎসামান্য। প্রজারা ভিড় করে আরতি দেখতে আসত, আরতি নৃত্যে তাদের যুবকরা ছিল পারদর্শী। বিজয়া দশমীর দিনে তারা একত্র হয়ে প্রতিমা তুলে নিয়ে বাইরের পুকুরে বিসর্জন করত। রজনীকান্ত যতদিন বেঁচে ছিলেন তাঁর কান্না রোধ করা যেত না। তাঁর মৃত্যুর পর পাঁঠাবলি ও বিসর্জনের সময় যাঁর অশ্রু দুগাল ভিজিয়ে রাখত তিনি আমাদের পিতা, দুর্জয় সিংহ। বিজয়া দশমীর দিন সন্ধ্যেবেলায় প্রজাদের খাওয়ানো হতো— ভাত, মাংস, মাছ, ডাল, ভাজা, তরকারি, অম্বল এবং রসগোল্লা। এই নেমন্তন্নে শ’খানেক মানুষ সমবেত হতো, পরিবেশনের ক্ষুদ্র অংশের ভার পড়ত আমাদের মতো ‘ছেলেমানুষ মনিবদের’ ওপর— নুন, জল, পাতিনেবু, হয়তো বা অম্বল, এবং সবশেষে পান-বিড়ি।
প্রবেশ পথের ডান পাশে রজনীকান্তের অন্য এক ভাই কয়েকটা জামরুল (আমরা বলতাম আমরুল) ও লিচু গাছ লাগিয়েছিলেন। বলেইছি তিনি তখন বহুদিন বিগত হয়েছেন, তাঁর বিধবা পত্নী এবং প্রথম দুই এবং পরে এক অবিবাহিত কন্যা আমাদের সংসারে খাওয়া—দাওয়া করতেন, যদিও তাঁদের নিজেদের বসতবাড়ি ছিল। রাঙ্গাঠাকুমাদের ভেঙে পড়া বসতঘরকে আমরা মাঝে মধ্যে খেলাঘর হিসেবে ব্যবহার করতাম। তার চেয়েও প্রয়োজনীয় একটা কাজ এই আধ-ভাঙা ঘরখানা করে যেত। ঘড়ির কাজ। সকালের রোদ যখন সামনের দেওয়ালের ভাঙা জানালা স্পর্শ করত আমরা জানতাম নটা বেজেছে। স্নানের জন্য দৌড়ে পুকুরে চলে যেতাম, স্কুলে দশটার মধ্যে হাজির হবার তাগিদ আমাদের উত্তেজতি করে তুলত। ‘আমরা’ মানে আমি ও অন্য শরিকদের পরিবারের তিন ছেলে, আমার বোন মধু যে পাঁচ বছর বয়স থেকেই গ্রামের প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ে যেতে শুরু করেছিল।
দুর্জয় সিংহ গ্রামের বাড়িতে আসবার নির্দিষ্ট দিনে আমি, অনেক সময় আমার বোন, বারবার রান্নাঘর থেকে প্রবেশ পথের উপর নজর রাখতাম, মাঝে মাঝে দুর্গামণ্ডপ পেরিয়ে বাইরের পুকুর পর্যন্ত চলে যেতাম রক্ত-অস্থি-মজ্জার উত্তেজনায়। মা রান্নাঘরে নিঃশব্দে কাজ করে যেতেন, আর আমার অস্থিরতা দেখে মৃদু লাজুক হাসতেন। তাঁর নিজের উত্তেজনা প্রকাশ পেত না; যদিও আমার বোন আর আমি মৃদু স্বরে একে অন্যকে প্রশ্ন করতাম আজ মা’কে একটু বেশি খুশি খুশি মনে হচ্ছে না?
আমরা জানতাম দশ থেকে এগারোটার মধ্যে দুর্জয় সিংহের শরীর দেখতে পাব বাড়ির প্রবেশ পথের শেষ প্রান্তে। যখন তিনি টার্ন নেবেন দ্বিতীয় ‘হাইওয়ে’ থেকে। কিন্তু বাড়িতে তো ঘড়ি নেই, তাই আমরা ঐ আধভাঙা মাটির দেওয়ালে রোদ কতখানি উঠেছে তার উপর বারবার নজর রাখতাম।
এক সময় দুর্জয় সিংহের পদচালিত দেহ আমাদের চোখে ভেসে উঠত। তাঁর পিছে বিছানাবাহক মুটে। ‘কুলি’ শব্দটা আমাদের গ্রাম্য জীবনে ব্যবহৃত হতো না। গণেশপুরে ছিল না স্টীমার স্টেশন। নিকটতম রেললাইন তিনশত মাইল দূরে। আমাদের কাছে ভারবাহী মানুষেরা ছিল ‘মুটে’, যারা মোট বহন করে।
আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে মাকে বলতাম, “মা, মা, বাবা এসে গেছে।”
মা নড়ে চড়ে বসতেন। রান্নায় বা অন্য কাজে বাড়তি ব্যস্ততা দেখাতেন। একবার এসে প্রবেশ পথের উপর নজর রাখতেন।
পিতা ঠাকুর বাড়িতে ঢোকার আগেই দুর্গা, কালী ও নারায়ণ পূজার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গড় হয়ে প্রণাম করতেন।
বাড়িতে প্রবেশ করলে একটা থমথমে আবহাওয়া সৃষ্টি হতো।
আমরা দূরে সরে যেতাম, দূর থেকে দেখতাম আমাদের পিতাকে। মাথাভরা আধপাকা চুল, আধপাকা দাড়ি গালে, পরনে আধময়লা ধুতি ও লংক্লথের আধময়লা পাঞ্জাবি, পায়ে ধুলোমাখা, পুরোনো, তালি লাগানো সস্তা জুতো।
মা এসে একবার কাছে দাঁড়াতেন। কোনো বাক্যের বা চঞ্চলতার আদান-প্রদান হতো না।
দুর্জয় সিংহ মুটেকে বলতেন, “বিছানাটা ঘরে গিয়ে তক্তপোষের উপর রেখে দে।” তারপর তিনি মুটেকে তার প্রাপ্য তুলে দিতেন। একটু বেশিই দিতেন, কারণ দূর থেকে আমরা দেখতাম মুটে বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছে। তারপর মা’র হাতে ছোট কলস থেকে ঢেলে দেওয়া জল দু’হাত অঞ্জলি করে পেট ভরে পান করছে। কখনো হয়তো মা তার হাতে নাড়ু বা মোওয়া তুলে দিতেন। কখনো কিছুটা মুড়ি বা চিড়ে।
পিতৃদেব মাকে অথবা আমাদের জিজ্ঞেস করতেন না আমরা কেমন আছি। আমরা যে দূরত্ব রেখে তাঁরই চতুর্দিকে ঘুরছি সেটা তিনি জানতেন বা বুঝতেন কিনা তাও আমরা টের পেতাম না।
মা জানতে চাইতেন, পথে কোনো কষ্ট হয়েছে কিনা। স্টীমার লেট ছিল কিনা। পালং থেকে নৌকা নিয়েছেন না হেঁটে এসেছেন।
এক একটি শব্দে বাবা প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতেন।
মা রান্নাঘরে গিয়ে কাঠকয়লা ও তামাকের গুড়ো বাবার সামনে রাখতেন। তামাক পাতা পুড়িয়ে গুঁড়ো করে রাখতেন আমার মা। তাঁর নিজের অভ্যাস ছিল অঙ্গার ও তামাকপাতা চূর্ণ একসঙ্গে মিশিয়ে দাঁত মেজে সন্ধ্যেবেলা স্নান করার। বাবাও একই দত্ত-মাজন ব্যবহার করতেন।
আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করতাম কতক্ষণে পিতৃদেব জলভরা ঘটি নিয়ে অনেকদূরে পুরুষদের পায়খানায় যাবেন। তারপর অন্দরের পুকুরে যাবেন স্নানে। ইতোমধ্যে বাড়ির অন্য শরিকদের বড়দের কেউ কেউ তাঁর সঙ্গে দেখা করে যাবেন, মামুলি দু’একটা কথার আদান—প্রদান হবে। আসবেন উত্তর ঘরের জ্যেঠামশাই, বীরেন্দ্র সিংহ, বাবা তাঁর পা ছুঁয়ে প্রণাম করবেন, তিনি করবেন মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ। বর্ষায় বৃষ্টির পরিমাণ, ইলিশ মাছের দর, বাগানে আম ফলেছে কি রকম, এ ধরনের দু’চারটে কথাবার্তা একটা বা দুটো: শরীর ভালো আছে তো? হাঁপানির কষ্ট কম আছে কিনা। বাবা ‘হ্যাঁ’ জবাব দেবেন।
বাবা দাঁত মাজতে মাজতে ঘটিভরা জল নিয়ে পায়খানার পথে বেরিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তরিৎ বেগে বিছানাটা দখল করে নিতাম। সঙ্গে বোন মধু। দড়ি কাটবার সাহস নেই, অনেক লড়ে তার মরণ বন্ধন খুলতে হতো। বিছানার মধ্যে একটা তোষক, কয়েকখানা ধুতি, একটা পাঞ্জাবি, দুটো গামছা : এই থাকত বাবার নিজস্ব সম্পত্তি। বাকি সব আমাদের। আমরা যারা আছি তার ক্ষীণ পক্ষপুটে, সবার জন্য কিছু না কিছু সাজানো রয়েছে বিছানার মধ্যে।
মা’র জন্য দুখানা শাড়ি, সাদা, একখানা লালপাড়ের অন্যটা খয়েরি। অনেকখানি লংক্লথ, সেমিজ, সায়া তৈরি করে নেবার জন্য। আমার জন্য দু’তিনটে শার্ট, অন্য বিধবা কাকিমাদের জন্য থানের শাড়ি, রাঙ্গাঠাকুমার ছেলে চিনিকাকুর জন্য ধুতি ও শার্ট, কুট্টিপিসির জন্য ডুরে শাড়ি একটি।
এগুলো ছিল নিয়ম করে বাধা। কোনো বছর তার ব্যতিক্রম হতে পারত না। আমার জন্য শার্ট এক বছর দুটো, এক বছর তিনটে। মার জন্য কোনো গ্রীষ্মের ছুটিতে দুখানাার বেশি শাড়ি নয়। আরও দুখানা আসত পূজার সময়। বছরে মারও পাওনা ছিল চারখানা শাড়ি। আমার চার-পাঁচটা শার্ট আর হাফ-প্যান্ট। মেয়েকে একটু বেশি নেক নজরে দেখতেন পিতৃদেব, তার ফ্রকের রং বাহার ফ্যাশন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করত। পাঁচটার বেশিও ফ্রক কোনো কোনো বছর তার জন্য এসে যেত। কানুর জন্য দুজোড়া হাফ প্যান্ট, ফুল শার্ট।
কিন্তু বিছানার মধ্যে থাকত আরও অমূল্য ভাণ্ডার। আমার জন্য বই— বিদেশি মহাপুরুষের ইংরেজি জীবনী, দেশি মহাপুরুষদের বাংলায়; সারাবছরের জন্য রুল কাটা কাগজ দিস্তার পর দিস্তা; একগাদা ব্লটিং পেপার; দু ডজন পেনসিল, রাবার, এক্সারসাইজ বুক। মধুর জন্য প্রথম পাঠের কয়েকখানা বই।
দুর্জয় সিংহের মাসিক বেতন ছিল ত্রিশ টাকা। তা থেকে কুড়ি টাকা পাঠিয়ে দিতেন আমাদের ভরণপোষণের জন্যে। এতসব কেনার মতো অর্থ আসত কোথা থেকে?
এ প্রশ্ন সেই বাল্যকালে আমার মনে খোঁচা মারেনি। প্রাপ্ত ঐশ্বর্যে আমি সম্বোহিত, পুলকিত।
অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম অর্থ উপার্জন করতে কি অসম্ভব পরিশ্রম করতেন দুর্জয় সিংহ।
বাস করতেন গোপাল নাগ নামক জনৈক জমিদারের বাড়ি। তাঁর তিনটি ছেলে ও একটি মেয়েকে রোজ সন্ধ্যেবেলা পড়াতে হতো। শুতেন গোমস্তাদের জন্য নির্দিষ্ট একটা স্যাঁতসেঁতে ঘরে কাঠের তক্তপোষে চাদর বিছিয়ে। খেতেন জমিদারের বাড়িতে।
এ দৃশ্য আমি নিজে দেখতে পেয়েছিলাম ম্যাট্রিক পাশের পর কলকাতায় কলেজে পড়তে যাবার পথে খুলনায় বাবার সাথে চার দিন কাটাবার সময়। তাঁর জীবনযাত্রার তুলনায় আমরা রাজার হালে গ্রামের বাড়িতে বাস করতাম, বুঝতে পেরেছিলাম আমি।
হাঁপানির কষ্ট সারাবছর লেগেই থাকত, শীতের মাসগুলোতে আপক্রমণ হতো জোরালো। সকালবেলায় দুর্জয় সিংহ দু’মাইল হেঁটে এক বাড়িতে গিয়ে ট্যুইশন করতেন। ফিরে এসে স্কুল। স্কুলের শেষে আর একটা ট্যুইশন স্কুল বাড়ির কাছেই। সন্ধ্যায় নাগমশাই এর পাঁচটি সন্তানকে পড়ান।
সারা সপ্তাহে একমাত্র রবিবার ছুটি।
এই ছুটির দিনে স্কুলের আপিসে আয় ব্যয়ের হিসেব লিখতেন দুর্জয় সিংহ। ইংরেজি ভাষার ওপর ভালো দখল ছিল, তাই হেড মিস্ট্রেজ তাঁকে দিয়ে স্কুলের নানা সমস্যা নিয়ে অনেক আবেদন নিবেদন লিখিয়ে নিতেন জিলা শাসকের কাছে মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের কাছে। ইন্সপেক্টর অব স্কুলস-এর রিপোর্টে যদি কিছু ত্রুটি বিচ্যুতির উল্লেখ থাকত তার জবাবও। প্রতি রবিবারে এসব কাজ করে দেবার জন্য স্কুল থেকে বাড়তি পনেরো টাকা পেতেন আমার পিতা। টিউশনি থেকে আরও পনেরো। নিজের জন্য প্রতি মাসে দশ টাকার বেশি খরচ হতে দিতেন না।
হাঁপানি বাড়লে এক কবিরাজের থেকে কি একটা ওষুধ খেতেন। সারাবছর চ্যবনপ্রাশ খাবার মতো ‘বিলাসিতা’র সংকুলান ছিল না তাঁর। উদ্বৃত্ত অর্থের প্রতিটি পয়সা যক্ষের মতো জমাতেন, জমিদার খাজাঞ্চী ছিল তাঁর ব্যাঙ্ক। এই জমানো টাকা থেকে প্রতিবছর উঁচু ক্লাসে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সব বই নতুন কেনা হতো আমার জন্য। বছরে তিনবার দেশের গ্রামে আসা হতো, সব লালিত-পালিতদের জন্যে শাড়ি-কাপড়-জামা ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে। গ্রামের ছুটির দিনগুলোতে একটু খোলা হাতে খরচ করবার সঙ্গতিও সঙ্গে আনতেন।
বাবা বাড়ি আসার পরের দিনই বাজারে গিয়ে আমাদের বংশানুক্রমিক মুদি মনমোহন কাকার কাছে কিছু টাকা গচ্ছিত রেখে দিতেন। কত টাকা তা আমার জানবার সুযোগ হয়নি। প্রতিদিন বাজারে গিয়ে মনমোহন কাকার কাছ থেকে একটা করে টাকা নিতেন। তাতে বাজার হতো, অন্য সব খরচও। আমরা প্রায় রোজই টাটকা ইলিশ মাছের ঝোল খেতে পেতাম। সপ্তাহে একদিন মাংস রান্না হতো। গণেশপুরের বাজারে মাংসের দোকান ছিল না। তিন-চার বাড়ির কর্তারা একত্র হয়ে কিনে নিতেন একটা পাঁঠা। পাঁঠা বলতে গ্রামের সবচেয়ে পাকা হাত জল্লাদ ছিলেন জ্যেঠামশাই বীরেন্দ্র সিংহ। আমাদের বাড়িতে কালীপূজার মন্দিরের পিছনে বিরাট একটা কুল গাছের সঙ্গে পাঁঠাকে বেঁধে রাখা হতো। বীরেন্দ্র সিংহ ধুতিতে অর্ধেক দেহ আবৃত করে তার আড়ালে তাঁর ভীষণ ধারালো বলির দা লুকিয়ে রেখে পাঁঠার কাছে এসে দাঁড়াতেন। পাঁঠাটাকে ঘাসপাতা দেওয়া হতো খেতে। কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত ভীত দৃষ্টি এদিক ওদিক নিক্ষেপ করে সে যখন লোভনীয় খাদ্যে মুখ রাখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তখন পিছন থেকে বীরেন্দ্র সিংহ তাঁর সেই বিরাট দায়ের অব্যর্থ আঘাতে বেচারার শিরটাকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতেন। কিছুক্ষণ ছটফট করে নিষ্প্রাণ হয়ে যেত। তখন সেই দেহকে দড়ি বেঁধে ঝোলানো হতো গাছের ডালে। চামড়া কেটে ছিঁড়ে ফেলার কাজে আমরাও হাত লাগাতাম। তারপর মাংস কাটা হতো টুকরো টুকরো করে, ভাগ হতো খদ্দেরদের মধ্যে। মেথর বিহারী এসে চামড়াটা নিয়ে যেত। আমাদের অংশ থেকে ভাগ পেতেন জ্যেঠামশাই বীরেন্দ্র সিংহ।
বাবা বাড়ি এলে আমরা মাঝে মাঝে রসগোল্লা, লেডীকেনী, অমৃতি, ক্ষীর এসব আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অকলল্পনীয় আহার বিলাসের সুযোগ পেতাম।
আরও ঘটনা ঘটত।
কয়লা বোঝাই নৌকা এসে ভিড়ত গণেশপুরের বাজারের সামনে। নদীতীরে। দেখতে পেতাম বস্তার পর বস্তা কয়লা এসে জমা হচ্ছে মার রান্নাঘরের একপাশে। আমার হাতে মুটে এক বস্তা কয়লা রেখে একটা ক’রে বাঁশের টুকরো দিয়ে যেত। দশ বস্তা অর্থাৎ দশমণ কয়লা কেনা হতো প্রতিবছর গ্রীষ্মে।
রজনীকান্তের আমলে ‘দক্ষিণের ঘরে’ তিনটি প্রকাণ্ড পোড়ো মাটির মাইট (অর্থাৎ জালা) ছিল। তার অন্তত একটা ভরে যেত নতুন কেনা চালে।
আমাদের সব লেপ তোষক মশারিতেই মার হাতে বহু তালি লাগানো থাকত। যেগুলো একেবারে অব্যবহার্য হয়ে গেছে বাবা কারিগর ডেকে সেগুলো পুরোনো তুলোর সঙ্গে নতুন তুলো মিশিয়ে নতুন লেপ তোষক তৈরি করিয়ে নিতেন।
গ্রামের অন্য বাড়িগুলো থেকে বাবার সমবয়সী ও গুরুজনেরা আসতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। তাঁদের জন্যে তামাক সেজে জ্বলন্ত কয়লা সংযোগ করে কল্কি বসিয়ে হুকো নিয়ে যেতে হতো আমাকে। বাবার অনুপস্থিতিতে এঁরা কদাপি আমাদের বাড়িতে পদার্পণ করত না। মা’র কোনো বন্ধু বা সখী ছিল না গ্রামের মহিলাদের মধ্যে। তাঁকে কোনোদিন পাড়াবেড়াতে দেখিনি। প্রতিবেশীনীরাও কদাচ আমাদের বাড়িতে আসতেন। মার অভ্যাস ও অভিরুচি ছিল, অবসর সময়ে বই পড়া। বই-এর যোগানদার ছিলাম আমি। অবশ্যি আমাদের বাল্যকালে গ্রামের গিন্নীরা বিনা নিমন্ত্রণে খুব কদাচিৎ অন্য বাড়িতে স্রেফ গল্প করতে যেতেন। ব্যতিক্রম ছিল তরুণীদের বেলা। বান্ধবীরা অহরহ এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়াত। তবু কখনো সখনো গৃহিণীগণ যে বান্ধবীদের সঙ্গে মিলিত হতেন না তা নয়। এই সীমিত প্রথার ব্যতিক্রম ছিলেন আমার মা।
তাঁর মধ্যে যে একটি কোমল কবিমন, অনুভূতিশীল কল্পনাপ্রবণ সৃষ্টিশীল লেখকমন উপবাসী, উপেক্ষিত, অনাদৃত থেকে থেকে শুকিয়ে আসছিল, গ্রাম ছেড়ে আমি কলকাতা যাওয়ার আগেই তা বুঝতে পেরেছিলাম। স্বামীর কাছ থেকে তাঁর কোমল কল্পনাপ্রবণ মন সম্মান, স্বীকৃতি বা উৎসাহ পায়নি। আমার বাল্যকালে আমরা দুজন বসে বসে এক এক কর্মহীন অলস বিকেলে মাতাপুত্রের সংযুক্ত কল্পনার নৌকোয় চড়ে বেড়াতাম। আমাদের সঙ্গী হতো আকাশ ছোঁয়া বাঁশগাছ। আকাশে উড়ন্ত চিলপাখি, আরও অনেক উচ্চে, দৃষ্টির বাইরে, অসংখ্য নক্ষত্র। আমি অতি সরল ভাষায় কবিতা লিখে মাকে পড়ে শোনাতাম। মা শুনে শুনে যে সব ঝংকৃত শব্দের ছন্দিত লাইন তৈরি করত তা শুনে আমার বিস্ময়ের ও আনন্দের সীমা থাকত না। আমি বলতাম, মা, তুমি এত সুন্দর কবিতা মুখে মুখে তৈরি করতে পার। তুমি কবিতা লেখ না কেন?
মা চুপ করে যেতেন। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস নেমে আসত। দক্ষিণের জানালা দিয়ে হঠাৎ একপলক হালকা হাওয়া ছুটে এসে দীর্ঘশ্বাসটুকুকে কেড়ে নিয়ে পালিয়ে যেত।
আমার স্কুলের মধ্য জীবনে একবার মা’র বড়ভাই বড়মামার বিবাহ উপলক্ষ্যে আমাদের কলকাতা যেতে হয়েছিল। শৈলেশ সেনগুপ্ত, আচার্য প্রফুল্ল রায়ের প্রিয় ছাত্র ছিলেন বিজ্ঞান কলেজে, কেমিস্ট্রিতে এমএসসি পাশ করে তাঁর সঙ্গে গবেষণা করতেন। খাদি ছাড়া পরতেন না কিছু। বাল্যকালে পিতৃহীন দুই ভাই দু’বোন পিসির বাড়িতে মানুষ হয়েছিলেন— ছোটমামা সুবোধ জন্মাবার আগেই আমার মাতামহের মৃত্যু হয়েছিল। বড়মামা পরিণত বয়সে বৈষ্ণব শাস্ত্রে ও ধর্মে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলেন। কদাচ তিনি ধর্মপ্রচার করতেন না। ধর্ম, ঈশ্বর বৈষ্ণববাদ সবটুকুই ছিল তাঁর আত্মজ অভিজ্ঞান। আমি অনেক পরে বৈষ্ণব ধর্মের শীর্ষ স্থানীয় লোকেদের কাছে শুনেছিলাম আমার বড়মামার জ্ঞান-অভিজ্ঞান উপলব্ধিকে তাঁরা যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখতেন।
সেই বাল্যকালের কলকাতার কোনো ছাপ পড়েনি আমার মানসে। শুধু মনে আছে মা কর্পোরেশনের শিক্ষিকা হবার জন্য ট্রেনিং নেবার অনুমতি চেয়েছিল বাবার কাছে। তাঁর দুই পিসতুতো বোন কর্পোরেশনের স্কুলে পড়াতেন। তাঁদের সাধারণ শিক্ষা-দীক্ষা মা’র চেয়ে বেশি ছিল না। তাঁরাই মাকে বলেছিল ট্রেনিংয়ের সুযোগ পাওয়া খুব কঠিন হবে না।
বাবা একবাক্যে মা’র আবেদন নামঞ্জুর করে দিয়েছিলেন।
তার প্রধান কারণ ছিল বাবা কোনোদিনও চাননি তার পরিবার গ্রাম ত্যাগ করে কলকাতাবাসী হোক। সস্তায় খুলনায় বা কলকাতায় তিনি বসতজমি কিনতে পারতেন। কেনেননি শুধু একটাই কারণ: কর্মজীবনের শেষে অবসর নিয়ে গণেশপুরে নিজের বাড়িতে বাস করার দৃঢ় সংকল্প।
পিতা রজনীকান্তের শ্মশানে তৈরি হবে তাঁর নিজের শ্মশান। বাবার এটা ছিল দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা।
ভারতবর্ষের ভাগ্যবিধাতাগণ অবশ্য সে দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা, সুদৃঢ় সংকল্পকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিয়েছিলেন ১৯৪৮ সালে। গণেশপুর পূর্ব পাকিস্তান হয়ে গেল— আর স্বপ্নের জন্মভূমি, আপন ঘর, হয়ে গেল বিদেশ। তারপর ১৯৪৮ সালে খুলানও চলে গেল পূর্ব পাকিস্তানে।
আমার বাবা দুর্জয় সিংহ হয়ে গেলেন একান্ত পরাজিত একেবারে ভেঙে পড়া অকাল-বৃদ্ধ উদ্বাস্তু।
যে রাজনীতি ভারতবর্ষকে ১৯৪৮ সালে দু’টুকরো করে স্বাধীন করল তার একটা ছোট, কিন্তু আমার কাছে ঐতিহাসিক, নাটক ঘটে গেল গণেশপুরে।