পিকম্যানের মডেল

পিকম্যানের মডেল

মূল গল্প  Pickman’s Model (Howard Phillips Lovecraft)

প্রিয় এলিওট,

আমার সম্পর্কে তোমার মনে যে কী ধারণা হয়েছে তা তোমার চিঠি পড়েই বুঝেছি৷ এবং সত্যি কথা বলতে কী সেগুলো ভুল প্রমাণ করার মতো প্রমাণ আমার হাতে এই মুহূর্তে নেই৷ তার উপর ইদানীং আমার কিছু-কিছু কাজকর্ম দেখলে যে-কোনও স্বাভাবিক মানুষেরই সন্দেহ হতে বাধ্য৷ যেমন ধর পার্ক স্ট্রিটের ধারের সাবওয়ের পথ আমি আর মাড়াই না৷ সন্ধেবেলা বাড়ির বাইরে বেরোতে চাই না৷ আগে ভোরবেলা পাহাড়ের গা বেয়ে মর্নিংওয়াকে যেতাম৷ ইদানীং সেই সবকিছুতে হঠাৎ করেই ইতি দিয়েছি৷ কেন যে দিয়েছি সেকথা তোমার আগে পুলিশই জিজ্ঞেস করেছিল আমাকে৷ কিন্তু তাদের কাছে সত্যি কথা প্রায় কিছুই বলিনি আমি৷ বলিনি তার কারণটা তুমি এই চিঠি পড়লেই বুঝতে পারবে৷ শুধু আগেভাগে এটুকু বলে রাখি যে, একটা বিশেষ ঘটনার পর আমার নার্ভগুলো আর আগের মতো ধারালো নেই৷ তাই মাঝে মধ্যে ঘটনার খেই হারিয়ে ফেলতে পারি৷ সেটুকু দোষ নিজ গুণে ক্ষমা করে দিও৷

আসল ঘটনাটার কতটা তুমি কাগজে বা রেডিওতে জেনেছ তা আমি জানি না৷ কিছু শোনোনি ধরে নিয়ে গোড়া থেকেই শুরু করছি৷ কিছুদিন যাবৎ রিচার্ড আপ্তন পিকম্যান নামে এক শিল্পীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ আশা করি পিকম্যানের নাম তুমিও শুনেছ৷ কারণ শিল্পী হিসেবে তার সুখ্যাতি এবং কুখ্যাতি দুটোরই অভাব হয়নি কোনওকালে৷ আমার মতে, গোটা বোস্টন শহরে তার মতো বড়মাপের চিত্রকর আর জন্মায়নি৷ ছবি আঁকার ব্যাপারে সে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ আর্টিস্টদের মধ্যে অন্যতম তা কেবল আমি নয়, অনেক বড় চিত্রসমালোচকই স্বীকার করেছেন৷ দেশ-বিদেশে বিস্তর দামে বিক্রিও হয়েছে সেইসব মহামূল্য ছবি৷ এত সাফল্য সত্ত্বেও দেশের একদল বুদ্ধিজীবী ক্রমাগত গালমন্দ করে এসেছেন পিকম্যানকে৷ তার একমাত্র কারণ হল তার ছবির বিষয়বস্তু৷ এত কদর্য এত কদাকার এত ভয়ানক অথচ এত নিখুঁত প্রতিকৃতি অন্য কোনও আর্টিস্টের তুলিতে দেখিনি আমি৷ হঠাৎ করে তার স্টুডিওতে ঢুকে পড়লে মনে হবে যেন সাক্ষাৎ নরকে এসে পড়েছি৷ চারপাশে ধিকিধিকি আগুন জ্বলছে৷ তার মাঝে বীভৎস সব আদিম দানবদের হিংস্রদৃষ্টি বুকের ভিতরে ঢুকে হৃৎপিণ্ডে ঠান্ডা চাদর জড়িয়ে দেয়৷ এজন্যেই বোধহয় এসময়কার বেশিরভাগ আঁকিয়ে তাকে এড়িয়ে চলে৷ কোনও সংগ্রহশালায় তার আঁকা ছবি প্রদর্শিত হলে লোকজন সেই ছবির দিকে ভুল করেও তাকায় না৷ আমার অবশ্য এইসব ছবি দেখে ভয়ের থেকে কৌতূহলই হত বেশি৷ আচ্ছা, একটা মানুষ কেন সারাক্ষণ ভয়াবহ বীভৎস সব ছবি আঁকবে! বিশেষ করে তার হাতের টান যখন এত সূক্ষ্ম তখন অন্যধরনের সুন্দর ছবি এঁকে আর্টিস্টমহলে দিব্যি আসর-আলো করে বসতে পারত৷ ফলে বেশ মন দিয়ে তার আঁকাগুলো দেখতে বসলাম আমি৷ কিছুদিন পড়াশোনা করে বুঝলাম যে ব্যাপার অত সোজা নয়৷ ইদানীং বিভিন্ন ভূতুড়ে ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদশিল্পীরা নানারকম যন্ত্রপাতি আর রংতুলির কারসাজিতে কিম্ভূত সব দানবের ছবি সহজেই এঁকে ফেলতে পারেন৷ কিন্তু সেসব ছবির কোনওটাই পিকম্যানের ছবির মতো জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে না৷ ঠিক কোনখানে কতটা রেখা টানলে ছবিটা ফুটবে, কোন অংশে কতটা আলো-আঁধারের মিশেলে ছবিটা আরও রহস্যময় আরও ভয়ানক হয়ে উঠবে সেইসব জ্ঞান যেন হাতের প্যালেটে রেখেই ছবি আঁকতে বসে সে৷ সে ছবির দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে হাত-পা কাঁপতে থাকে৷

যাইহোক যে কথা তোমাকে বলতে বসেছি তাতেই আসা যাক৷ পিকম্যানের সাথে আলাপ করার আগে তার ব্যাপারে বেশ কিছু কথা জেনে নিয়েছিলাম আমি৷ একরকম কৌতূহলের বশেই বলতে পার৷ শোনা যায় তার কোনও এক পূর্বপুরুষকে নাকি ডাইনি সন্দেহে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়েছিল৷ তারপর থেকে তাদের গোটা পরিবারই রাতারাতি গা ঢাকা দিয়ে উধাও হয়৷ আমি কিছুদিন হল ছবি-আঁকিয়েদের নিয়ে কাগজে একটা কলাম লিখছিলাম৷ স্বভাবতই পিকম্যানের মতো কুখ্যাত শিল্পীকে নিয়ে আর্টিকেল লিখতে অন্য কোনও সাংবাদিক রাজি হয়নি৷ সেই অছিলাতেই যেচে পড়ে একদিন আলাপ করলাম পিকম্যানের সাথে৷ প্রথমে ভেবেছিলাম এমন ছবি যে আঁকে সে লোক নিশ্চয়ই তান্ত্রিকগোছের কিছু একটা হবে৷ আলাপ হবার পরে কিন্তু দেখলাম পিকম্যান অতি সজ্জন মানুষ৷ বীভৎস ছবি আঁকে বলে সাধারণ লোকজনই এড়িয়ে চলে তাকে৷ আমি নিজে গিয়ে পরিচয় দিতে এবং আমি লেখালিখি করি শুনে সে বেজায় খুশি হল৷ আমাকে সাথে করে নিয়ে গেল স্টুডিওতে৷ ছবিগুলো দেখে প্রথম- প্রথম একটু ভয় পেলেও পরে বুঝলাম ওই প্রত্যেকটা কালির দাগের পিছনে কী ভয়ানক পরিশ্রম আর মনঃসংযোগ মিশে আছে৷ এরপর মাঝে মধ্যেই তাকে ফোন করতাম আমি৷ সেও নতুন ছবির কাজ কতটা এগোল এইসব বিস্তারিত বলত আমাকে৷ মাঝে-মাঝে নেমন্তন্নও করত৷ কোনও কোনও দিন রাতে আমি বাড়ি ফিরতাম না৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে শুনতাম তার অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার কথা৷ এত আতিথেয়তার মাঝেও আমার কেবলই মনে হত সে কিছু একটা গোপন করতে চাইছে আমার থেকে৷ তখনও আমাদের বন্ধুত্বটা ততটা গাঢ় হয়নি৷ ফলে কথাটা জিজ্ঞেসও করতে পারতাম না৷ এরকমই একদিনের কথা৷ নতুন আঁকা একটা স্কেচ আমাকে দেখাচ্ছিল সে, আমার অবশ্য সেদিকে মন ছিল না৷ একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম ঢিমেতালে জ্বলতে থাকা মোমের আলোর দিকে, শেষে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘আচ্ছা, তোমার ছবিগুলোতে কী আছে বলতো?’

সে অবাক হয়ে হেসে বলল, ‘কী আবার থাকবে, রংতুলি আর আমার খ্যাপাটে মাথার খানিকটা কল্পনা৷’

‘উঁহু, সে তো সব ছবিতেই থাকে৷ তোমারগুলো এত আলাদা কেন?’

‘আলাদা বলেই তো আমি পিকম্যান৷ তাই না?’

‘সে যাই বল৷ আমার মনে হয় তুমি কিছু একটা চেপে যাচ্ছ আমার থেকে৷’

সে আবার আগের মতোই হাসল৷ আমার দিকে একটা ইশারা করে বলল, ‘চল, আমার স্টাডি থেকে ঘুরে আসি৷ কিছু জিনিস দেখানোর আছে তোমাকে৷’

আমি বাধা দিয়ে উঠলাম, ‘দোহাই বাবা৷ তোমার ওই ভয়ানক হাড়হিম করা ছবিগুলো আর দেখতে চাই না আমি৷’

একরকম জোর করেই আমাকে ধরে নিয়ে গেল পিকম্যান৷ এই ক-দিনে মুখে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও কেন জানি না আমার তার ছবিগুলো সম্পর্কে কেমন যেন নেশা হয়ে গেছিল৷ ছোটখাটো দু-একটা ম্যাগাজিনে আমি অলৌকিক গল্প লিখে থাকি৷ ফলে অতিপ্রাকৃতের দিকে আমারও কৌতূহল থাকাটা স্বাভাবিক৷ স্টাডিতে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল পিকম্যান৷ দেওয়ালের গা জুড়ে রাখা বড় আর মাঝারি সাইজের পোর্ট্রেট, সেগুলোর দিকে তাকালেই গা শিরশির করে ওঠে৷ অন্যদিন সেগুলোর দিকেই এগিয়ে যাই আমরা৷ আজ কিন্তু সেদিকে ফিরেও তাকাল না পিকম্যান৷ বরঞ্চ ঘরের বাঁদিকে ছোট একটা টেবিলের উপর রাখা সুটকেস হাতে তুলে নিল৷ লকটা খুলে ভিতর থেকে কয়েকটা পুরনো কাগজের তাড়া বের করে আনল৷ আমি ঝুঁকে পড়লাম তার উপর৷ কয়েকটা হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের উপর পেনসিলে কিছু আঁকা আছে৷ আমার দিকে কাগজগুলো এগিয়ে দিয়ে পিকম্যান বলল, ‘দেখো দেখি৷ কেমন হয়েছে?’

আমি কাগজগুলো চোখের সামনে মেলে ধরতে বুঝলাম সেগুলো কোনও শিশুর হাতে আঁকা পেনসিল স্কেচ৷ ছবিগুলো কিন্তু বেশ সুন্দর৷ কোনওটা আকাশের এক কোণ থেকে দল বেঁধে নেমে আসা পরীদের ছবি আবার কোনওটা জলের তলায় ভেসে যাওয়া রঙিন শামুকের৷ প্রতিটা ছবির নীচেই নাম সই করা৷ রিচার্ড আপ্তন পিকম্যান৷ অবাক হয়ে বললাম, ‘এগুলো তো দিব্যি সুন্দর হয়েছে৷’

‘নীচে তারিখটা দেখছ?’

সইয়ের নীচে ডেট লক্ষ করে বুঝলাম এগুলো পিকম্যানের বেশ অল্পবয়সে আঁকা৷ যে বয়সে আমরা সাধারণত আপেল, কলা বা একগাছা আঙুর এঁকে মন ভরাতাম সেই বয়সে পিকম্যানের ভাবনা কল্পলোকে ডানা মেলত৷

‘তাহলে এইসব কুৎসিত ছবি আঁকা শুরু করলে কবে?’

সে ভাবুক মুখে বলল, ‘কী জানি! ছোটবেলার কথা ঠিক মনে পড়ে না৷ মনে হয় মাথা থেকে কেউ যেন সাদা রং দিয়ে মুছে দিয়েছে?’

‘পরিবারের কেউ তো বলতে পারবে, মানে যারা ধর তোমাকে ছোটবেলা থেকে দেখেছে৷’

‘তেমন কেউ আর বেঁচে নেই৷ আর আমিও তো বড় হয়েছি বোর্ডিংয়ে৷ খুব একটা কেউ দেখতে আসত না৷’

আমি একটু ভেবে নিয়ে বললাম, ‘বেশ তাহলে এগুলো আপাতত আমিই নিয়ে যাচ্ছি৷’

পিকম্যান খুব একটা আপত্তি করল না৷ বরঞ্চ আমি যে তার ব্যাপারে এতটা আগ্রহ দেখাচ্ছি সে ব্যাপারে খুশিই হয়েছে মনে হল৷

সেদিন বাড়ি ফিরেই আমি স্কেচের কাগজগুলো নিয়ে বসে পড়লাম৷ স্টাডিতে ছবিগুলো দেখতে-দেখতেই একটা বুদ্ধি মাথায় এসেছিল৷ লক্ষ্য করেছিলাম একটা বিশেষ সময়ের পরে পিকম্যানের ছবিগুলোতে একটু- একটু করে ভয়ানক ভাব আসা শুরু করে৷ চারবছর বয়সে পা দিয়েই সে মৎস্যকন্যা আঁকতে শুরু করেছে, অথচ সাড়ে-চারের আগেই দেখছি সেই মৎস্যকন্যা শুয়ে পড়েছে জলের ধারে, শরীরের নীচের অংশ ছিড়ে খাচ্ছে কতগুলো মাংসখেকো পিরানহা মাছ৷ এরপর থেকেই ধীরে-ধীরে তার ছবি ভয়ানক হতে শুরু করছে৷ ব্যাপারটা খেয়াল করতে আগ্রহ আরও বেড়ে গেল আমার৷ অর্থাৎ চার থেকে সাড়ে-চার বছরের মাঝে তার জীবনে কিছু একটা বদল এসেছিল৷ সেই ঘটনার প্রভাবই ধীরে-ধীরে পড়েছে তার ছবিতে৷ সব ছবি যদি পাওয়া যেত তাহলে ঘটনার তারিখটাও জোগাড় করে ফেলতাম৷

এরপর থেকে দৌড়াদৌড়ি কম করিনি৷ যে বোর্ডিং স্কুলে পিকম্যানের শৈশব কেটেছে সেখানে অবধি হানা দিয়েছি৷ তারা অবশ্য কিছুই বলতে পারেনি৷ বাবা-মার সাথে তেমন হৃদ্যতা তার কোনওদিনই ছিল না৷ ফলে সেদিক থেকেও কোনও খবর জোগাড় করতে পারিনি৷ হতাশ হয়ে আবার ফিরে এসেছিলাম নিজের বাড়িতে৷ ধীরে-ধীরে ব্যাপারটা মুছেই যাচ্ছিল৷ একদিন আচমকাই পিকম্যানের ফোন পেলাম৷ জরুরি তলব৷ নিজে থেকেই আমাকে কিছু গোপন কথা বলতে চায় সে৷ সকাল-সকাল সাবওয়ের ধারে তার বাড়িতে পৌঁছে গেলাম৷ পয়সাকড়ির তার অভাব নেই৷ ছবি রীতিমতো ভালো দামেই বিক্রি হয়৷ তাও এমন নির্জন একটা সাবওয়ের একপাশে বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে কেন আছে সেটাই রহস্য৷ যাইহোক লোকজনও খুব একটা ঘাঁটাতে সাহস পায় না তাকে৷ পিকম্যানের দোতলা বাড়িটায় প্রথম যেদিন ঢুকেছিলাম সেদিন থেকেই বিষণ্ণ একটা ভাব চেপে ধরেছিল আমায়৷ যেন বহু বছরের মৃত অভিশাপ কেউ বাড়িটার নীচে চাপা দিয়ে রেখেছে৷ এই শেষ কথাটার খানিকটা যে সত্যি হতে পারে তা বুঝেছিলাম পিকম্যানের সাথে আলাপ হবার পরে৷ বাড়িটার নীচে সত্যি একটা ছোট ঘর আছে৷ তবে সে ঘরখানায় কোনওদিন আমাকে নিয়ে যায়নি সে৷

আজ বাড়ির দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই কিন্তু দেখতে পেলাম তাকে৷ মনে হলো চোখেমুখে কী যেন এক আতঙ্কের ছায়া নেমেছে৷ আমাকে দেখে প্রথমে এক গাল হাসার চেষ্টা করল, যদিও ভারী বেমানান লাগল সেটা৷ আমি নিজেই একটা হাত তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘আজ এত জরুরি তলব? নতুন কোনও ছবি?’

‘না৷ ছবি নয়৷’

‘তাহলে?’

‘তোমাকে কিছু দেখানোর আছে আমার৷’

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাচ্ছিলাম আমি৷ পিকম্যান থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘না-না, উপরে নয়৷ আজ নীচের ঘরেই বসব৷’

‘মানে তোমার সেই গোপন ঘরে?’ আমি অবাক হয়ে গেলাম৷

‘গোপন বলে কিছু নেই, হয়তো তোমার ভালোর জন্যই… সে যাক গে, নীচে চল আগে৷’

নীচের সিঁড়ি বেয়ে দু-জনে বেসমেন্টে নেমে এলাম৷ দরজাটা ভেজানো ছিল৷ সম্ভবত একটু আগেই ঘরে সময় কাটিয়ে গেছে সে৷ ঠেলা মেরে সেটা খুলে ফেলে আমাকে ভিতরে আসতে বলল সে৷ আমি গুটিগুটি পায়ে ভিতরে ঢুকে এলাম৷ ঘরটা আলো-আঁধারি৷ জানলা নেই বলে সূর্যের আলোও হয়তো দেখেনি কখনও৷ ইলেকট্রিকের আলো যেটুকু জ্বলছে তাতে ঘরের মাঝখানে একটা হলদে আলোর বৃত্ত তৈরি হয়েছে৷ সেই বৃত্তের ঠিক মাঝখানে রাখা আছে একটা ক্যানভাস৷ সেটা একটা কাপড় দিয়ে আপাদমস্তক ঢাকা৷ ফলে কী যে আঁকা আছে তা বুঝতে পারলাম না৷ অন্য কতগুলো ক্যানভাস ঘরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা ছিল৷ সেগুলোও দেখতে পেলাম না৷

‘আজই আঁকাটা শেষ করলাম, বুঝলে?’

‘তো? কী আঁকলে?’

আমার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে পড়ল পিকম্যান৷ কী যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল৷ সাথে-সাথে পিছন ঘুরে একটানে সরিয়ে ফেলল ঢাকা চাদরটা৷ আমি মুখ তুলে তাকালাম সদ্য আঁকা ছবিটার দিকে৷ নাহ, সেরকম নতুন কিছু নয়, সেই দানবীয় ছবি৷ গোটা ক্যানভাস জুড়ে লাল আর হিংস্র হলদে রঙের ছড়াছড়ি৷ একটা মানুষের বুকের উপরে চড়ে বসেছে অতিকায় একটা প্রাণী৷ তার সমস্ত শরীর নীলরঙে ঢাকা, মুখের একদম উপরের দিকে জ্বলজ্বল করছে উজ্জ্বল আগুনের মতো বড় একটা চোখ৷ নীলাভ বুকের উপর ভেজা চামড়া ঠেলে বেরিয়ে আসছে কালচে লকলকে শিরাগুলো৷ জীবন্ত অভিশাপের মতো ছবির ভিতর থেকে যেন বাস্তব হয়ে উঠতে চাইছে দানবটা৷ অন্য কোনও শিল্পীর আঁকা হলে এতক্ষণে এ ছবি ছেলে ভুলানো কমিকসের বইতে স্থান পেত৷ কিন্তু ঘোর অবাস্তব নারকীয় এই দৃশ্যও পিকম্যানের তুলিতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে৷ এও কি সম্ভব? দুঃস্বপ্নের মতো যে দৃশ্য কল্পনা করাও কষ্টকর তা কেবল মাত্র তুলির টানে এত জীবন্ত হয়ে ওঠে কী করে? ছবিটার ঠিক নীচের দিকে একটা ছোট কাগজ আটকানো আছে৷ সেটা যে কী তা এতদিন পিকম্যানের সাথে মেলামেশা করে জানতে পেরেছি৷ ছবি আঁকার আগে ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড কেমন হবে তার একটা খসড়া সাধারণত এঁকে নেন আর্টিস্টরা৷ সেটা দেখে-দেখে তারপর আসল ছবি আঁকতে হয়৷ অনেকটা ব্লুপ্রিন্টের মতো ব্যাপারটা৷

‘সেদিন জিজ্ঞেস করছিলে না আমার ছবিগুলো এত জীবন্ত হয় কী করে?’ আমার ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে পিকম্যান৷

‘সেদিন শুধু নয়, আজও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে৷ যে জিনিস কোনওদিন নিজের চোখে দেখোনি তা এত নিখুঁত করে আঁকো কী করে?’

উত্তর দেবার আগে কয়েক মিনিট চুপ করে থাকল সে, তারপর ধীরে-ধীরে বলল, ‘কী করে ধরে নিলে যে চোখে দেখিনি?’

তোমাকে আজ বলছি এলিওট৷ সেদিন এই কথাটায় একরকম জোর করেই হেসে উঠেছিলাম আমি৷ খানিকটা হয়তো পরিস্থিতিটাকে হালকা করার জন্যই, হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ‘মানে এসব ভয়ানক পিশাচদের তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাও?’

সে কোনও উত্তর দেয় না৷ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে ছবিখানার দিকে৷ কিছুক্ষণ থেকে আমারও অদ্ভুত একটা কথা মনে হচ্ছে৷ ছবিতে যে মানুষটার বুকের উপর চড়ে বসেছে দানবটা তার সাথে পিকম্যানের চেহারার বেশ মিল আছে৷ তবে কি ছবিতে নিজেকেই তুলে ধরতে চেয়েছে সে?

উদ্ভট ভাবনা ভাবতে-ভাবতে লোকটা হয়তো বেশ খানিকটা ছিটিয়াল হয়ে পড়েছে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা, ছোটবেলার কথা মনে পড়ে না তোমার?’

‘না৷’

‘একেবারেই না?’

‘না৷’

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ৷ বেশ বুঝতে পারছি সে কিছু বলতে চায় আমায়৷ অথচ বলা উচিত হবে কি না ভেবেই সংকোচ করছে৷ আমি তার পিঠে একটা হাত রেখে বললাম, ‘বলবে কিছু?’

সে ইতস্তত করে বলল, ‘সব কথা হয়তো বলতে পারব না তোমাকে, শুধু এটুকু বলতে পারি যে আমার জীবনটা আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক নয়৷’

‘স্বাভাবিক নয় বলতে?’

‘মানে আমি অভিশপ্ত৷’

‘অভিশাপ! ওহ৷ এইসব আজগুবি ভয়াবহ ছবি আঁকতে-আঁকতেই মাথাটা খারাপ হয়েছে তোমার৷’

‘ঠিক উল্টোটা৷ ওই ছবিগুলো না চাইতেই এঁকে ফেলি আমি, ক্যানভাসে তুলি ছোঁয়ানোর সাথে-সাথে একসাথে মাথায় ভিড় করে আসে ওগুলোই৷ সবকিছু যদি তুমি জানতে… যাইহোক একটা কথা দাও আমাকে৷’

‘কী কথা?’

‘আমার সাথে সবরকম মেলামেশা বন্ধ করে দেবে তুমি৷’

কথাটা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷ লোকটা সত্যি-সত্যি এতটা পাগল তা আমার জানা ছিল না৷ এমনিতেই তো লোকজন মেশে না তার সাথে, তার উপর আমার সাথেও কথা বন্ধ করে সারাদিন যদি এই পৈশাচিক ছবি নিয়ে মেতে থাকে তাহলে আর রক্ষে থাকবে না, বললাম, ‘তা কী করে হয়? তোমাকে নিয়ে আর্টিকেলটা এখনও শেষ হয়নি, তোমার ছেলেবেলা সম্পর্কে তো জানতেই পারিনি কিছু৷’

‘যাহোক কিছু একটা বানিয়ে লিখে দাও, কেউ দেখতে যাবে না৷’

‘ধুর, একি গল্প যে বানিয়ে কিছু লিখে দেব?’

পিকম্যানের মুখে অন্ধকার নামল, সে আবার দু-মিনিট ভেবে নিয়ে বলল, ‘বেশ তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করবে তুমি, দেরি করবে না৷’

আমি ঘরের চারিদিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ব্যঙ্গের সুরে বললাম, ‘ব্যাপার কী বল তো? হঠাৎ করে আমাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছ কেন?’

সে মাথা নীচু করে থাকল৷ কোনও উত্তর দিল না৷ বেশ খানিকটা রাগ হল আমার৷ যদিও সেটা মুখে আসতে দিলাম না৷ এইসব পাগলাটে আর্টিস্টদের মতিগতি বোঝা দায়৷ আমারও অবশ্য কাজ বেশি কিছু বাকি নেই, তার আঁকা সব ছবিই ইতিমধ্যে দেখে ফেলেছি৷ এখন শুধু টাইপরাইটারে টাইপ করাটা বাকি৷ সাথে পিকম্যানের একটা ছবি দরকার৷ সে কাজটা আজই সেরে ফেলতাম কিন্তু ক্যামেরাটা আনা হয়নি৷ সেদিনের মতো উঠে পড়ব কি না ভাবছি এমন সময় দোতলা থেকে কিসের যেন আওয়াজ এল৷ যেন ভারী পাথরকে একদিক থেকে আরেকদিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ৷ মুহূর্তে পিকম্যানের হাবভাব পালটে গেল৷ তড়িঘড়ি উঠে পড়ল সে৷ দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলল, ‘তুমি একটু বস৷ আমি আসছি৷’

কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে৷ আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলাম৷ সে নীচে নেমে এল না৷ আমি উঠে পড়লাম৷ ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেলাম ছবিটার দিকে৷ রং এখনও কাঁচা তাই হাত দিয়ে দেখার উপায় নেই৷ একদৃষ্টে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম সেদিকে৷ সেই পুরনো প্রশ্নটা আবার মাথার ভিতর খোঁচা দিতে লাগল৷ এত অবাস্তব অথচ নিখুঁত ছবি কি আঁকা সম্ভব? পিকম্যানের চার থেকে সাড়ে চার বছরের ভিতরে ঠিক কী ঘটেছিল?

ছবি থেকে চোখ সরাতে গিয়েও আমি থেমে গেলাম৷ ছবিটার ঠিক নীচে সেই খসড়া করা কাগজটা গোঁজা আছে৷ কীরকম যেন কৌতূহল হল৷ হয়তো ওই খসড়াতেই লুকিয়ে আছে পিকম্যানের সিক্রেট৷ রুমালে হাত মুছে নিয়ে কাগজটা তুলে নিলাম আমি৷ সাধারণ কাগজের থেকে বেশ মোটা সেটা৷ দু’ভাঁজ করা৷ ধীরে-ধীরে সেই ভাঁজটা খুলে কাগজটা চোখের সামনে মেলা ধরলাম আমি৷

এলিওট পুলিশ আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল যে উধাও হওয়ার ঠিক আগে কেন আমি আর পিকম্যানের সাথে যোগাযোগ রাখিনি৷ এমনকী, আমার প্রায় শেষ হয়ে আসা আর্টিকেলটা পর্যন্ত ছুঁড়ে ফেলেছি ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে৷ সে প্রশ্নের উত্তর পুলিশকে সঙ্গত কারণেই দিইনি আমি৷ আজ তোমাকে দিচ্ছি৷ কারণ সেই কাগজখানা—ভাঁজ খুলে সেদিন যা দেখেছিলাম তা আমার জীবনে চিরকালের মতো এক বদল এনে দিয়েছে৷ আমি অন্ধকারে আর থাকতে পারি না, ফাঁকা রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারি না, সিঁড়ির তলাটা দৌড়ে পার হই৷ আর পিকম্যানের সেই স্টাডিতে ফিরে যাওয়ার থেকে তো গিলোটিনে মাথা দেওয়াটাও আমি হাসতে হাসতে মেনে নেব৷ জানতে চাও কী ছিল সেই কাগজে? নাহ, আদৌ খসড়া ছিল না সেটা৷ খসড়ার দরকার হত না পিকম্যানের৷ ছবির নীচে বাঁধা সেই মোটা কাগজটা ছিল আসলে ক্যামেরায় তোলা একটা ফোটোগ্রাফ৷ হ্যাঁ, ঠিক ছবিটার মতোই, সেই হিংস্র নারকীয় প্রাণীটা চেপে বসেছে পিকম্যানের বুকে৷ টিপে ধরেছে তার গলাটা, লুকানো ক্যামেরায় সেই ছবিটা তুলেই ক্যানভাসে রংতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছে পিকম্যান৷ সেই রঙে বাস্তব হয়ে উঠেছে তার মডেল৷ কারণ সে জলজ্যান্ত বাস্তব৷

এর বেশি কিছু আমি জানি না৷ সেই মুহূর্তের পর থেকে ওমুখো আর হইনি আমি৷ পিকম্যান কোথায় নিখোঁজ হয়েছে তাও জানি না৷ এ চিঠিটার পরিণতি কী হওয়া উচিত আশা করি তুমি ভালোই জানো৷ ভালো থেকো৷

ইতি

রান্ডালফ কার্টার

অনূদিত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *