পটলা সমগ্র ১
পটলা সমগ্র ২

পিকনিক

পিকনিক

হোঁৎকা বেশ গম্ভীরভাবে বলে, নাঃ, এবার পিকনিক হইব না ।

কথাটা শুনে আমরা তো হতবাক। পটলার বাক্যি অবশ্য মাঝে মাঝে থমকে যায়, কারণ তার জিবটা বিনা নোটিশে আলটাকরায় আটকে যায়। এ হেন পটলাও বলে, ক-কেন হবে না পিকনিক, বল ?

পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের বাৎসরিক ক্লাবের জন্মের আগে থেকেই হয়ে আসছে। অবশ্য আমাদের ক্লাবের মেম্বার এই পাঁচজনই—হোঁৎকা, পটলা, গোবর্ধন, ফটিক আর এই অধম। আমরা পিকনিকে গিয়েই প্রতিষ্ঠা করি এই ক্লাব। সুতরাং এবার পিকনিক হবে না শুনে ঘাবড়ে গেছি। হোঁৎকা এবারের কোষাধ্যক্ষ। অবশ্য কোষাগারে টাকা কখনই থাকে না। আমরা, পঞ্চপাণ্ডব ক্লাবের সভ্যরা, দিন আনি দিন খাই। আর পটলাই সেটা মূলত আনয়ন করে। হোঁৎকা বলে দেশজ ভাষায়, ফন্ডে ট্যাকা নাই! পিকনিক হইব ক্যামনে?

গোবর্ধনের মামার পাইকেরি কুমড়ো, চালকুমড়ো আর গুড়ের আড়ত। পটলার বাবা কাকার মত দু’হাতে আমদানি তার নেই, তবু গোবর্ধন মামার ওনলি ভাগ্নে। গোবর্ধন বলে, কুমড়া, নলেন গুড় যা লাগে দেব।

হোঁৎকা বলে, কুমড়া সিদ্ধ গুড় দিই খাই পিকনিক হইব? স্রেফ কুমড়ো? কুমড়ো বিচ্যা তরও কুমড়োমার্কা বুদ্ধি হইছে দেহি। মিনিমাম দেড় হাজার টাকা চাই পিকনিকে। ওই ম্যাটাডোর ভ্যান ভাড়া নিব আটশো টাকা, কই পামু?

পটলাই আমাদের বিপদতারণ। সে বলে, ট-টাকার ব্যবস্থা হবে। গাড়ি? মা-ম্যাটাডোর? ফটিক আমাদের ক্লাবের মধ্যে শিল্পী মানুষ। কালোয়াতি গান গায়, এর মধ্যে দু’চারটে গানের টুইশানিও ধরেছে। ফটিকই বলে, ম্যাটাডোর ভ্যান হয়ে যাবে। আমার ছাত্রীর বাবা ওই সিমেন্টের আড়তদার ভুজঙ্গবাবুর একটা ভ্যান আছে, তেল মবিল দিলেই মিলবে।

পয়সার ব্যবস্থা, গাড়ির ব্যবস্থা হতে দেখে এবার হোঁৎকা বলে, তয় চল। কিন্তু কবজিভোর মাংস চাই, নালি হোঁৎকা তগোর এই বাঁধাকপির ঘ্যাট আর মুলো চচ্চড়ি খাতি যাইব না। মাংস উইথ দই-সন্দেশ ।

আমি বলে উঠি, এত জুটবে কী করে?

তাহলে আমি নাই। তরাই যা গিয়া। হোঁৎকা জানিয়ে দেয়।

হোঁৎকা ছাড়া পিকনিক ভাবা যায় না। বাজার করা, ওখানে গিয়ে টিফিন দেওয়া, রান্না করা সব ওই-ই করে। অবশ্য খায় একা তিনজনের খাবার, কিন্তু তবু ওকে চাই-ই।

পটলা বলে, ত-তাই হবে।

আমরা সমস্বরে জয়ধ্বনি দিই, থ্রি চিয়ার্স ফর পটলা…

ট্যাঙ্কে পেট্রোল ঢাললেই যেমন অচল গাড়িও চালু হয়, তেনি টাকা আসতেই হোঁৎকা এবার চালু হয়। এর মধ্যে পিকনিকের জায়গাও ঠিক হয়ে গেছে। ওদিকে কানা দামোদরের ধারে গোবরার মামার বিরাট চাষবাড়ি, সেখানে কুমড়োর চাষই প্রধান। এ ছাড়াও অন্য ফল ফসলও হয়, আর বাগানঘেরা একটা বাড়িও আছে। সেটাতে বিশেষ কেউ থাকে না। তবে জল-কল-বিজলি এসব আছে। রান্নার উনুনও মিলবে। কাজের লোক আছে। সকালে গিয়ে সন্ধ্যার পর ফেরাও যাবে। পিকনিকের একেবারে নাকি আদর্শ নিরিবিলি জায়গা। ওখানেই যাব। ফটিক এসে জানায় ম্যাটাডোরও মিলে গেছে।

হোঁৎকা তখন বাজারের ফর্দ নিয়ে বসেছে। মুরগির মাংস নেওয়া হবে এখান থেকেই । তরিতরকারি, তেল-মশলা, দই-সন্দেশ, মায় ব্রেকফাস্টের ডিম সেদ্ধ-টোস্ট-কলাও রেডি করে নিতে হবে।

হোঁৎকা এসব ভালোই বোঝে। নিজের চাই সবই তিন গুণ পরিমাণে। হোঁৎকা একজন নয়—হিসেবে তিনজন, সেই মত সব নিতে হয় ।

খুব সকালেই ক্লাবে এসে জুটেছি, তখনও সূর্য ওঠেনি। হোঁৎকা গজেনকে নিয়ে তার মালপত্র—টিফিন, লাঞ্চের জিনিস, মাটির ভাঁড় মাংস খাবার জন্য, প্লাস্টিকের গ্লাস, বঁটি, শালপাতা সব হিসাব মত রেডি করছে। ঘড়ি দেখে পটলা বলে, এখনও ফ-ফটিক গাড়ি নে এল না?

গোবর্ধনও এসে হাজির উইথ্ দুটো নধর কুমড়ো। হোঁৎকা বলে, সক্কালেই ‘কুমড়ো’ যাত্রা-

গোবরা বলে, কুমড়ো অযাত্রা নয়, অযাত্রা তোর ওই ডিম-কলা। এগুলো সামনে থেকে ওঠা।

হোঁৎকা কি জবাব দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় ফটিককে গাড়ি নিয়ে আসতে দেখে চাইলাম । ফটিক সেই ভুজঙ্গবাবুর একটা মাল-বওয়া খোলা ম্যাটাডোর ভ্যানই এনেছে।

বলি, বসার জায়গা নেই, ভ্যানের মেঝেতে বসে যেতে হবে ?

গোবরা বলে, শীতকাল, ফেরার সময় যে জমে বরফ হয়ে যাব রে ! পটলা বলে, ঠি-ঠিক কথা।

হোঁৎকা খাবার-দাবার দেখে বেশি উৎসাহী হয়ে পড়েছে। তবে এর মধ্যে কিছু ‘ম্যানেজও’ হয়েছে। মাংসও নিয়েছে বেশি করে, দই-সন্দেশও। হোঁৎকা বলে, বেলা হই গ্যাছে, এহন রোদে যাবি। সকাল সকাল ফিরতি পারলি ঠান্ডা লাগবো না । চল ।

ভ্যানটায় ভুজঙ্গবাবু সিমেন্ট আনা নেওয়া করে, ফলে ভ্যানে বেশ খানিক সিমেন্ট পড়ে আছে। আশপাশের খাঁজেও সিমেন্ট পুরু হয়ে লেগে আছে। হোঁৎকা ততক্ষণে ওর ওপরই ডেকোরেটারের শতরঞ্জি পেতে মালপত্র তুলেছে। কড়াই-হাঁড়ি-হাতা-বালতি-কাঠ-তেল- সবজি সহ উঠেছে গাড়িতে। তারপর উঠেছি আমরা। ভ্যান চালু হয় ৷

কলকাতা ছাড়িয়ে বেশ কিছুদূরে গিয়ে, জি-টি রোড ছেড়ে এবার বাবার রাস্তায় চলেছি অর্থাৎ তারকেশ্বর যাবার পথ ধরে চলেছি আমরা। দু’দিকে ঘন সবুজ কলাবন-বাগান – ধানক্ষেত। মাঝে মাঝে ফুলকপি বাঁধাকপির ক্ষেতও রয়েছে, দু’-একটা গ্রাম-বসতও পড়ে।

হোঁৎকা এর মধ্যে পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে মেম্বারদের চায়ের দোকান থেকে চা-বিস্কুট খাইয়েছে। বলে, মেন টিফিন খাবি ক্যাম্পে গিয়া, এহন চা-বিস্কুট খাই ল। আর কতদূর রে গোবরা হেই তর মামার বাড়ি?

গোবরা বলে, আর বড়জোর ঘন্টা খানেকের পথ।

ভ্যান চলেছে ভাঙা রাস্তা ধরে নাচতে নাচতে। আমরা আনন্দে ভ্যানের মেঝেতে শতরঞ্জিতে বসেই কুলোয় গম আছড়ানোর মত নাচন-কোঁদন করছি। ফটিক কালোয়াতি গান গেয়ে চলেছে—মেরে সঁইয়া না ছোড় মোর—

অবশ্য গানটা সে শুরু করেছে দক্ষিণেশ্বর ব্রিজ থেকে ঘণ্টা দেড়েক আগে। এখনও সঁইয়াকে নিয়ে লোফালুফি করে চলেছে, চলবে শেষ তক।

হোঁৎকা দুটো কলা ম্যানেজ করে কামড়াচ্ছে খোসা ছাড়িয়ে। এমন সময় ঘটনাটা ঘটে যায় ৷ ঘটনা নয়, দুর্ঘটনাই ।

কোনো গ্রামের মধ্য দিয়ে রাস্তাটা-দু’দিকে মাটির বাড়ি। কোনোটা দাঁড়িয়ে আছে, কোনোটার চালচুলো নেই, দু’-একটা জরাজীর্ণ গরু বাঁধা, পচা ডোবায় হাঁস চরছে, পথের ধারেই আধনেংটা ছেলে-বাচ্চারা ঘুরছে আর মুরগির পাল চরছে। হঠাৎ ভ্যানটাকে দেখে ক’টা মুরগি ডানা ঝাপটে এদিকে ওদিকে উড়ে যাচ্ছে, এইভাবে চলছিল। এবার একটা মুরগি উড়ে পালাতে গিয়ে এসে পড়েছে আমাদের ওই নৃত্যরত ভ্যানের চাকার নিচেই। মুরগিটার ওপর দিয়েই ভ্যানটা চলে যায় কিছু বোঝার আগেই। আর তক্ষুণিই ওই গ্রামের আকাশ-বাতাসে এত বড় সর্বনাশা দুর্ঘটনার খবরটা বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়ে। কারা যেন নির্জন গ্রামের মাটি ফুঁড়ে উঠে পড়ে আর হৈ হৈ করে এসে ভ্যানটার সামনে রীতিমত খবরের কাগজে দেখা নেতাদের মত মানবশৃঙ্খল রচনা করে ধাবমান ভ্যানটাকে ধরে ফেলে।

ধর—ধর ওদের, যেন পালাতি না পারে।

আমরাও এবার নেমেছি ভ্যান থেকে। এর মধ্যে এদিক ওদিক থেকে আরও বেশ কিছু লোকজন মেয়েছেলে কৌতূহলী বাচ্চার দল এসে পড়ে। তারস্বরে কান্নার আওয়াজ ওঠে। রাস্তার ওপর মৃত এইটুকু মুরগির জন্যে বুক চাপড়ে কান্না জুড়েছে কোনো মহিলা। একজন শীর্ণ গামছাপরা লোক ক্ষেত থেকে এসে এবার গর্জে ওঠে, আমার মুরগি মেরেছ?

কথাটা অস্বীকার করার উপায় নেই, বলি, চাকার তলে এসে পড়ল, ঘটে গেছে ব্যাপারটা । তা মুরগির জন্য কিছু টাকা দিচ্ছি আমরা। বাচ্চা মুরগি—ধরো ভাই, পঞ্চাশ টাকাই দিচ্ছি। ইচ্ছে করে তো ঘটাইনি এটা।

লোকটা দেখছে টাকাগুলো। এইটুন মুরগির জন্য নগদ পঞ্চাশ টাকা সে আশা করেনি। বৌটাও কান্না ছেড়ে এসে পড়েছে, টাকা দেখে মুরগির শোক ভুলেছে সে। টাকা দিয়ে আমরা বের হতে চাই এখান থেকে।

টাকাটা নিতে যাবে লোকটা, হঠাৎ ভিড় ঠেলে এবার এসে উদয় হয় গোলগাল প্যান্টপরা একটা লোক। সে বলে, টাকা নিবি না গোকুল।

লোকটা থেমে যায়। সেই মূর্তি আমাদের ভ্যানে মালপত্র দেখে বলে, গরিবের সর্বনাশ করে নিজেরা আনন্দে পিকনিক করতে যাবেন? কারো সব্বোনাশ কারো পৌষ মাস! তা হবে না মশায়। শহুরে বাবুদের হাড়ে হাড়ে চিনি। গরিবকে কত আর ঠকাবেন?

জানাই, ঠকাবো কেন? মুরগির দাম তো দিচ্ছি ভাই। পাঁচ-সাতশো গ্রাম মুরগির জন্য পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি। মুরগিটাও ওদের রইল, খেতে পারবেন।

লোকটা এবার বলে, একটা মুরগি বেঁচে থাকলে কত ডিম দিত জানেন? নিদেন দুশো তার থেকে অন্তত পঞ্চাশটা মুরগির বাচ্চা বের হত। পঞ্চাশটা মুরগি থেকে কত ডিম, কত বাচ্চা হত, কত তার দাম, সেদিকে না ভেবে ওকে ভালো মানুষ পেয়ে পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়ছিলেন, ঠকাননি ?

ওর হিসাব এবং ভবিষ্যৎ দৃষ্টি দেখে এবার প্রমাদ গনি। লোকটার ওই অপূর্ব হিসাব এবার মুরগির মালিক-মালকিন তৎসহ গ্রামবাসীরাও মেনে নেয়, ঠিক বলেছিস পাঁচু !

সেই পরোপকারী ভবিষ্যৎদ্রষ্টা তরুণের নাম যে পাঁচু সেটা বুঝে বলি, ঠিক আছে, পঁচাত্তর টাকাই দিচ্ছি ওকে।

এবার সদ্যজ্ঞানপ্রাপ্ত জনতাও ওই হিসাব বুঝে বলে, না—ওতে হবে না ।

লোকজনের সমাগম আরও বাড়ছে। ভ্যানটাকে তারা ঘিরে ফেলেছে, নীচে আমরা ক’টি অসহায় প্রাণী। গোবরা বলে, মুরগির একটা বাচ্চা চাপা দিয়ে এত ঝামেলা ?

পাঁচু বলে, দেশে আইন নেই ভেবেছেন? হাজার টাকা দিতে হবে, তবেই ছাড়ব ভ্যান। হাজার টাকা! কন কি রে মুশয়? হোঁৎকা ঢোঁক গেলে।

এত টাকা আমাদের কাছে নেই। তাই জানাই, এত টাকা কোথায় পাব?

কে ধমকে ওঠে, ফুর্তি করতে বেইরেছেন, ট্যাকা নাই বললে তো ছাড়ব না! ওরে প্রধানমশাইয়ের কাছে নে চল এদের।

অর্থাৎ এবার আরও কঠিন পাল্লাতেই পড়ব। মিনতি করে বলি, ঘটনাটা ঘটে গেছে, শ’খানেক টাকা আছে সঙ্গে, তাই নিয়ে ছেড়ে দিন ভাই। কিন্তু তখন ব্যাপারটা আমজনতার হাতে চলে গেছে। এমন বিনি পয়সায় মজার খোরাক পেয়ে তারাও মেতে উঠেছে। সকলেই রায় দেয়, তাই নে চল ওদের।

হোঁৎকা কি বলতে যায়। একজন গর্জে ওঠে, এ গাঁয়ে ট্যাঁ ফু চলবে না, নাম জানো আমাদের গাঁয়ের? এ গাঁয়ের নাম ঠান্ডাপুর, ডাণ্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেবো। কে শোনায়—আজ মুরগি মেরে পালাবে, কাল এসে মানুষ মারবে? এসব চলবে না। চলো। অ্যাই ভ্যানটাও নে চল ওখানে।

মেঠো পথ ধরে ভ্যানটাকে নিয়ে চলেছে তারা হৈ হৈ করে। ওতে পাঁউরুটি-কলা- ডিমসেদ্ধ-সন্দেশ, ওপাশে চাল-ডাল-সবজি-মাংস, দই-সন্দেশের হাঁড়ি, প্যাকেট সব রয়েছে। কে যেন বলে ওঠে, কত খাবার রে বাবা !

প্রধানের বাড়ি অবধি ভ্যান যায় না, সামনের পুকুরপাড়ে একটা ঝাঁকড়া আমগাছের নীচে মালসমেত ভ্যানটাকে রেখে আমাদের নিয়ে গেল পুকুরের ওদিকে প্রধানের বাড়ি-কাম- অফিসের সামনে।

আজ রবিবার, অফিস ছুটি। প্রধানও বাড়িতে নেই। বেশ সঙ্গতিপন্ন গৃহস্থ। বিরাট বাড়ি। ওদিকের গোয়ালে বেশ কয়েকটা নধর বলদ আর জার্সি গাই রয়েছে। বাড়ির লাগোয়া বাগান । তারপর ঘন সবুজ আলুর ক্ষেত। খামারবাড়ির সামনে একটা ট্রাক্টরও রয়েছে অর্থাৎ পঞ্চায়েতের প্রধান বেশ ধনী ব্যক্তি।

কিন্তু তিনি নেই, গোলমাল শুনে বের হয়ে আসেন প্রধানের ভাইপো। ঝকঝকে লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরা, হাতে সিগ্রেট। তিনি সব শুনে গর্জে ওঠেন, মগের মুলুক পেয়েছেন? হাজার নয়, দুহাজার টাকা দিলে তবে ছাড়ব।

অর্থাৎ মিটার আরও চাপছে। বলি, কোথায় পাব এত টাকা !

তিনিও গর্জে ওঠেন, না হলে আটকে রাখ ওদের। দিনভোর থাক এখানে, কাকা এলে থানায় পাঠাবেন।

দাওয়ায় বসে আছি আমরা, ওদিকে দেখি তখন ভ্যান থেকে কে আমাদের পাঁউরুটি-কলা -ডিমসেদ্ধ-সন্দেশ বের করে দু-চারজনকে দু-চার পিস দিয়ে, বাকি নিয়ে সরে পড়েছে। ওরা খাচ্ছে কলা-ডিম-এদিকে আমরা নীরবে দেখছি। খিদে-তেষ্টাও ভুলে গেছি। তবু মনে হয়, ডিম কলা নিয়েই যদি ছাড়ে ছাড়ুক। টিফিন না হয় নাই হবে তবু ছাড়া পাবো তো!

কিন্তু কে কার কথা শোনে!

ঠায় বসে আছি ওই জনতার পাহারায়। প্রধানের ভাইপোমশায় এর মধ্যে বাড়ি থেকে স্নান সেরে এসেছেন। আর দেখি বাগানের ওদিকে পুকুরপাড়ে গিয়ে মাংস-মালপত্র মায় কড়াই হাঁড়ি দেখে ভ্যান থেকে সব নামানোর কাজ সেরে এবার তিনিই মহা উৎসাহে গাছতলায় পিকনিকের আয়োজন করছেন।

এদিকে খিদেটা এবার জানান দিচ্ছে। বেলাও বাড়ছে। টিফিন তো সাফ, এখন ওদিকে বোধহয় ফুলকপির তরকারি চেপেছে।

হোঁৎকা চুপ করে বসে আছে। পটলা বলে, এখানে ক-কেন আনলি গো-গোবরা, ড-ডাকাতের দেশে, দি-দিনে ডাকাতি করে এরা।

ভাইপো এবার এদিকে এসে আমাদের ডেকে নিয়ে এদিক ওদিক চেয়ে বলেন, শ’ পাঁচেক টাকা আমাকে দেন, আমি ছেড়ে দিচ্ছি আপনাদের। অর্থাৎ ওঁকেই প্রণামী দিতে হবে পাঁচশ টাকা ।

জানাই, এত টাকা তো নেই, কুড়িয়ে-বাড়িয়ে দেড়শ’ মত আছে।

ভাইপো হেসে ওঠেন, ওতে হবে না, বসে থাকো, থানায় পাঠাব পরে।

বলি, তাহলে আমাদের খাবার-দাবার লুঠ করলেন কেন?

ভাইপো বলেন, ও তো পাবলিকে করছে, বলুন ওদের।

অর্থাৎ বলার কিছুই নাই। দেখছি এদিকে বসে ওই পাবলিকের গণভোজনের উৎসব। এবার মাংস চড়েছে, বাতাসে খোশবু ওঠে। বেশ লোকজনও জুটেছে, এ যেন তাদেরই পিকনিক চলেছে। এর মধ্যে কে আবার মাইক এনে হিন্দি গানও শুরু করেছে, কিছু উৎসাহী ছেলে বিনি পয়সার ভোজের গন্ধ পেয়ে নাচানাচিও করছে। পুকুরের ওপারে চলেছে আনন্দের হাট, এপারে আমরা ক’জন বসে আছি। এদের লোকজন পাহারা তোলেনি। হাজার, দু’হাজার টাকার আমদানি হবে তাদের, ভোজ তো জুটেছে, ওটা উপরি। সুতরাং আমাদের ঘিরে রেখেছে যাতে পালাতে না পারি।

খিদেটাও এবার জানান দিচ্ছে মাংসের গন্ধে। বেলা দুটো বেজে গেছে, দানাপানি পড়েনি পেটে। পিকনিক ঠিকই হচ্ছে তবে আমাদের নয়, ওদের। মুরগির বাচ্চার জন্য এত দাম দিতে হবে জানতাম না ৷

তেষ্টাও পেয়েছে। বলতে কে একজন একটা ময়লা বিবর্ণ প্লাস্টিকের জগে টিউবওয়েল থেকে জল ধরে এনে দেয়। তাই খেতে থাকি, যেন জল দিয়ে তেষ্টাই নয়, খিদেও মেটাতে হবে আমাদের। ভয়ে হতাশায় অসহায় রাগে গলাও শুকিয়ে গেছে।

ওদিকে তখন ভোজনপর্ব চলেছে। প্রধানের ভাইপোও বসেছেন, তার জন্য বিশেষ পরিমাণ মাংস, উৎকৃষ্ট দই, সন্দেশের ব্যবস্থা হয়েছে। এদিকে পাহারাদাররা গিয়ে পালা করে খেয়ে আসছে।

হোঁৎকা, গোবরা খিদেয় জ্বলছে। আমাদের অবস্থাও তেমনি, কিন্তু খাবার কথা কেউ বলে না। এরাই এক কড়াই মাংস, দই, সন্দেশ সবই সাবাড় করে শূন্য হাঁড়ি কড়াই বালতি ফেলে রেখে এবার আমাদের ঘিরে জোরদার পাহারা শুরু করে। ওদিকে গাঁয়ের যত কুকুর এসে এঁটো পাতা-ভাত-হাঁড়ি-কড়াই-বালতি চাটছে।

বেলা পড়ে আসছে। হঠাৎ দেখা যায় ধুলো উড়িয়ে মেঠো পথে একটা জিপ আসছে । প্রধানের জিপ। প্রধান মশায় শহরে কি মিটিং সেরে ফিরছেন।

প্রধান মশায় জিপ থেকে নামতেই গ্রামের পাবলিক তখন মুরগি মারার কেসটা সবিস্তারে বর্ণনা করে চলেছে তাঁকে। দশাসই চেহারা প্রধানের, তিনি দেখছেন আমাদের অসহায় মূর্তিগুলোকে। ওদিকে পড়ে আছে শূন্য কড়াই-হাঁড়ি—

হোঁৎকা বলে, মুরগির বাচ্চা চাপা দিইছি, আমাগো থানাতেই পাঠান, দিনভোর উপোসী রাখছে, আমাগো ভ্যানের সব খাবার লুঠ করছে, কয় দু’হাজার টাকা দিতে লাগবো এর পর ? জানাই, টাকা নাই, আপনার ভাইপোও চান পাঁচশো টাকা, এ কি বিচার আপনাদের ?

প্রধানমশায় অবাক হন, সেকি! এইসব কাণ্ড ! ডাক নৃসিংহকে, কোথায় সে? নেতা সাজতে চায়? ডাক তাকে?

কিন্তু এদিক খুঁজে আর ভাইপো সেই নৃসিংহকে পাওয়া যায় না। প্রধানমশায় বলেন, কে কে ছিল দলে? একটা মুরগির বাচ্চা চাপা দিয়েছে, তাই এই কাণ্ড! বল কে কে ছিল ? কারা ভ্যান লুঠ করেছে?

জনতা তখন ধীরে ধীরে পাতলা হচ্ছে। দু-একজনকে ধরে চড়-থাপ্পড় লাগান প্রধানমশায়। মুরগির মালিক তো ব্যাপার দেখে কেটে পড়েছে।

তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নামছে, প্রধানমশায় কোথা থেকে মুড়ি গুড় আর ক্ষেতের কিছু মুলো তুলে আনিয়ে বলেন, এগুলো খাও, সত্যি খুব কষ্ট দিয়েছে তোমাদের। এর বিহিত আমি করবোই, তোমরা কিছু মনে করো না।

ফিরছি ওই স্তোকবাক্য শুনে। গাড়িতে বসে শুকনো মুড়ি আর মুলো চিবোচ্ছি। খোলা ভ্যানে শীতের হিম হাওয়া সর্বাঙ্গে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। খালি পেটে ঠান্ডাটা লাগেও বেশি। দিনভোর আজ উপোস দিয়ে আমাদের খরচায় ওই নিষ্ঠুর জনতার পিকনিক দেখে ফিরছি। কোনো পিকনিকে মুলো মুড়ি আর গুড় দিয়ে লাঞ্চ নিশ্চয়ই হয় না।

পটলা বলে, আর পি-পিকনিকে কাজ নাই ।

হোঁৎকা গর্জে ওঠে, সব ওই গোবরার জন্যি হইছে। কুমড়ো মামার বাগানে না এলি এই সব হইত না। একটা মুরগির বাচ্চার দাম কয় হাজার ট্যাকা ! ধ্যুস! মুলো খাতি আর পারছি না এই ঠান্ডায় ।

হোঁৎকার মত পেটুক ভোজনরসিক শীতের ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে উৎকৃষ্ট লাল মুলোটাকে ছুড়ে ফেলে কি অসহায় রাগে !

এবারে পিকনিকে সত্যিই এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি আমরা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *