পিঁজরাপোল

পিঁজরাপোল 

মাঠের অনেক দূরে দূরে সবুজ ঘাসের সন্ধানে কয়েকটা মোষ আর গোরু চরতে বেরিয়েছে। 

চারা অশথ গাছের ছায়ায় বসে মারু মিয়া হাঁকে : এই ইধার। 

কিন্তু মোষ আর গোরু কেউ কান পাতে না। হাতের পাঁচন-বাড়ি নিয়ে মারু মিয়া উঠে পড়ল।

জানোয়ারগুলো হাল-হকিকত কিছু জানে না। দুপুরের ঝামালে যদি অসুখ বাড়ে, ভেটারনারী ইন্সপেক্টর ধমক দেবে তাকেই। কাল থেকে সে আর এই আহাম্মকী করবে না। বড় বেয়াড়া হোয়ে উঠছে পিঁজরাপোলের মোষ আর গোরুগুলো। দারুণ রৌদ্রের ভেতর মারু মিয়া কয়েক বিঘা দৌড়ে মোষ আর কতগুলো গোরু তাড়িয়ে নিয়ে এলো। 

একটা মিশমিশে কালো গাইয়ের দিকে সে তাকায়। নাইট খেতাবধারী এক আসাদ আলীর গাই। কোন খারাপ রোগের জন্য পিঁজরাপোলে পাঠিয়ে দিয়েছে। মাসে মাসে খরচাও পাঠায়। এই গাই আর তাঁর গোয়ালে ফিরবে না। না-হক পয়সা বরবাদ। তবু বড় লোকের খেয়াল! ভারী বদ্ গাইটা। মারু মিয়া বিরক্ত হয়। মাঝে মাঝে পাঁচন চালায় কশাইয়ের মত। এত রৌদ্রে মানুষের শরীরে কাঁহাতক সয়। এই গাইটার উপর মায়াও তার কম নয়। এখনও বাচ্চা বিয়োনোর বয়স আছে। হয়ত একদিন বাছুর হবে। পিঁজরাপোলের দুধে বড়লোক হওয়ার কোন আশা নেই। তবু মনিবের আড়ালে গাঁয়ের গেরস্থদের কাছ থেকে দু-চার পয়সা যা আসে। 

মারু মিয়া গলায় দড়ি লাগিয়ে তাড়াতাড়ি গাইটাকে শায়েস্তা করল। 

অন্যান্য মোষ-গোরু একসঙ্গে জমাট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। 

মাঠ আজ অসহ্য। তাই মারু মিয়া সকাল সকাল পিজরাপোলে ফিরে যেতে চায়। 

কয়েক বিঘা পরেই পিঁজরাপোল। কাছেই স্টেশন। দু-পারে মাঠ আর মাঠের কোলে কোলে গ্রাম। হাওয়া আর রৌদ্রের অভাব হয় না কোনদিন এই জগতে। 

মারু মিয়ার তাই ভাল লাগে জায়গাটা। জীবনের প্রথম দিকে সে অনেক কলকারখানায় কাজ করেছে। তার মন টেকে নি। একফোঁটা আলো-বাতাসের দাম সেখানে চড়া। সুদীর্ঘ কুড়ি বছর এইখানে কেটে গেলো। 

সত্যি পিঁজরাপোলটার অবস্থিতি মনোরম জায়গায়। প্রায় এক শত বিঘা জুড়ে সুন্দর কম্পাউণ্ড। তিন দিকে গোরু-মোষ থাকার কুঠ্‌রি। দক্ষিণ দিকে খোলা। একটা ছোট মাঠ। বাগান আর পাতকুয়া আছে মাঝখানে। পশ্চিম দিকের কোণ ঘেঁসে ছোট ঝিল, আরো একটা সুন্দর বাংলো। মহারাজা গণ্ডেরীরাম, এই পিজরাপোলের প্রতিষ্ঠাতা, মাঝে মাঝে পরিদর্শনে আসেন। খেয়াল মত দু-এক দিন এখানে কাটিয়ে যান। 

মারু মিয়ার কাছেই শোনা, গণ্ডেরীরামের একটা সাদা গাই ছিল। হঠাৎ মারা যায়। তার পরই তিনি পশুদের প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রথমে কয়েকটা বুড়ো মোষ আর গোরু নিয়ে পিঁজরাপোলের সূত্রপাত। ধীরে ধীরে বহু প্রসারণ ঘটেছে। আজ প্রায় পাঁচ শ’ রোগী। দুর্বল, ভগ্নস্বাস্থ্য মোষ-গোরুর আবাসভূমি এই পিঁজরাপোল। আরো নাকি প্রসারণ চলবে। মহারাজা পাঁচ শ’ বিঘা জমি কিনেছেন। পিঁজরাপোলের ট্রাস্ট গঠিত হোয়েছে। হিন্দু মুসলমান আরো সম্প্রদায়ের লোক নিয়ে বিরাট প্রতিষ্ঠান গড়বেন গণ্ডেরীরাম। ‘জীবে দয়া করো’, ‘অহিংসা পরমধর্ম’, আরো আরো বৌদ্ধ-অবৌদ্ধ বাণীর পিণ্ডাত্মা মহারাজা পাথরে খোদাই করিয়েছেন। সেগুলো অচিরেই পিঁজরাপোলের মাটি পবিত্র করবে। নূতন শিলালিপি বাগান বাড়ীর একদিকে স্তুপীকৃত। গণ্ডেরীরাম এ-যুগের অশোক। 

ট্রাস্টীর আর একজন সভ্য, প্রথম জীবনে খান বাহাদুর পরে নাইট, গওস মাহমুদ। তিনিও এই প্রতিষ্ঠানের উৎসাহী উপদেষ্টা। মারু মিয়া নাইটকে দেখেছিল। মোগলাই চেরা বনেদিয়ানার ছাপ লেবাসেই স্পষ্ট। তবু ভালো, তার কওমের একজন খাদেম এসেছে এখানে। মারু মিয়া বড় আনন্দিত হোয়েছিল। কিন্তু মারু মিয়ার মানস জগতের বিধাতারূপে শওকত ওসমান জানে, সে ভেবেছিল তার বেতন বাড়বে একদিন। এক কুড়ি টাকায় সে এই প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে। আরো কুড়ি বছর পরে পিঁজরাপোল বেড়েছে। কিন্তু মারু মিয়ার বেতন তেমি অচল দাঁড়িয়ে আছে। 

পশুদের অঞ্চলেই চাকরদের কোয়ার্টার। তারা সংখ্যায় প্রায় পনর জন। মারু মিয়ার তদারকে কুড়ি-পঁচিশটী মোষ ও গোরু। বুড়ো মানুষ বলে তার সঙ্গীরা ভগ্নস্বাস্থ্য গোরুগুলোর খবরদারি নিজেরা গ্রহণ করে। কিন্তু মারু মিয়া কোন দিকে সোয়াস্তি পায় না। শরীর বলহীন। ষাট বছর বয়সেও সে মেহনত করতে পারে, আল্লার কাছে শুকরিয়া। 

ট্যাঙ্কে পানি খেতে পশুগুলো মুখ নিচু করে। মারু মিয়া খুব শিগগীর তাড়া দেয়। এত পিয়াসা পশুগুলোর! নিজেও আঁজলা করে কূয়া থেকে পানি খায়। 

কুঠ্‌রির ভেতর পশুগুলো বন্ধ করে মারু মিয়া হাঁফ ছাড়ে। নিজের কুঠ্‌রির দিকে এগিয়ে যায়।

কিন্তু কাজের হাত থেকে নিস্তার নেই। চার-পাঁচ জন মুসলমান চাকর আছে পিঁজরাপোলে। তারা এক জায়গায় রান্না করে, থাকে অবশ্য পাশাপাশি কুঠ্‌রিতে। স্যার মাহমুদ বলেছেন, চাকরদের আলাদা কোয়ার্টার শিগগীর তৈরী করা দরকার। এই সব কুঠ্‌রিতে পিঁজরাপোলের নূতন রোগী থাকবে। রোগী অর্থাৎ পশু-রোগী। স্যার মাহমুদ অবশ্য ঠিকই বলেছেন। কারণ এই কুঠ্‌রি পশুদের জন্যই তৈরী হোয়েছিল। গণ্ডেরীরামের আদেশে এখন চাকরেরা দখল করেছে। 

কুঠ্‌রিতে প্রবেশ ক’রে মারু মিয়া দেখে, তার একজন সঙ্গী দিব্যি ঘুমোচ্ছে। এই দুপুরে কাজের গাফিলতি ক’রে ঘুমোনো উচিত! 

মারু মিয়া ডাকে : এই বাসেদ, উঠো ভেইয়া। 

বাসেদ তেরিয়া ছোকরা, বয়স জোর কুড়ি। বেশ গাঁট্টা জোয়ান। হাই তুলে, মারু মিয়ার দিকে তাকায়। নিদ্রা জড়িত বিরক্তির সুরেই বলে : দুপুরের ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলে? 

মারু মিয়া : কাম না কারি হো? 

বাসেদ : কাম কা এয়সী ত্যায়সী। দুপুরে ঘুমোবো, তা হবে না। ভারী কাজ, ভারী মাইনে ঘুমোনো বারণ? 

মারু মিয়া ঘাম মুছতে মুছতে বলে : সরকার কা পয়সা খাই হো, না কাম কারি হো? 

মেঝের উপর খড় বিছানো, তার উপর মাদুর পাতা। বাসেদ উঠে বসে, তারপর বলে : বড়ো- মিয়া সরকার কোন্? ও শালা সরকার? খানে দেতা হ্যায়? বিশ রুপেয়া মে জরু-বাচ্চা খা সাক্তা হ্যায়? জেয়সা পয়সা ঐসা কাম। 

মারু মিয়া বয়োজ্যেষ্ঠ, তাই সবাই বড়োমিয়া ব’লে ডাকে। মারু মিয়া জবাব দেয় না। সরকারের বিরুদ্ধে কিছু মন্তব্য করলে তার খারাপ লাগে। অবশ্য কোন প্রতিবাদ করে না। 

—আগার নোরি ছুট জায়েগা? 

বাসেদ হাসে, তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে : জায়েগা তো জায়েগা। 

বাসেদ বড় অপ্রিয় সত্যভাষী। তাই পিঁজরাপোলের চাকররা অনেকে পছন্দ করে না। মারু মিয়ার সঙ্গে তার খুব খাতির। 

মারু মিয়া বলে : তব উঠতা হ্যায়? 

বাসেদ জবাব দেয় : খড় কুঁচোনো বাকী আছে। আজ আমি বেরোইনি, বড়োমিয়া। এত রোদ্দুরে মানুষ বেরোয়? 

বাসেদ বেরিয়ে গেল। 

ঘুমে মারু মিয়ার চোখ জড়িয়ে আসে। সে ঘুমায় না। একটা মশারি সেলাই করতে বসে। রেল- লাইনের খাদের পাশে হোগলা বন। তাই এই অঞ্চলে বড় মশা। রাতে আদুল গায়ে ঘুমোনো যায় না। কিন্তু চাকরেরা সবাই উলঙ্গ গায়ে ঘুমোয়। মশারির বিলাসিতা তাদের পোষায় না। 

এই মশারিটা স্যার আসাদ আলীর গাইয়ের জন্য বরাদ্দ। কয়েক জায়গা ছিঁড়ে গিয়েছে। তাই মারু মিয়া সেলাই করতে বসে। 

আধঘণ্টা পরে বাসেদ ফিরে এলো। হাতে তার পাঁচ-ছটা ডিম। 

মারু মিয়া জিজ্ঞেস করে : আণ্ডা হো? 

বাসেদ চুপ থাকে না। খড়ের গুদামে যেতেই একটা বুনো মুর্গী উড়ে গেলো। উপরের মাচানে চড়ল। একটা খড়ের বাসায় এতগুলো ডিম। বেশ মজাসে ভাজা খাব আজ। 

মারু মিয়া সন্দেহ প্রকাশ করে। চারিদিকে বন-বাদাড়, গোখুর সাপের ডিম হওয়া বিচিত্র নয়।

বাসেদ বলে : তবে ভেঙে দেখা যাক্। 

উঠানে মারু মিয়া ও বাসেদ একটা ডিম ভাঙল। ছোট গোখুর সাপের ছানা বেরিয়ে এলো তখনি।

বাপ-শব্দ করে, একপাশে সরে বাসেদ একটা লাঠি দিয়ে সাপের কচি মাথা চেপে ধরল।

ছটাই গোখুর সাপের ডিম। 

বাসেদ চিন্তিত থাকে খানিকক্ষণ। সাপের হাতেই জানটা যাবে কোনদিন। একদম বেখাড়ে মওত হবে। বড়োমিয়া, কুঠ্‌রিতে চলো। 

মারু মিয়া মশারি সেলাই করতে থাকে। 

বাসেদ বলে : ভাল ক’রে সেলাই করো। আজ শোব দুজনে। মানুষ পায় না মশারি। গোরু-হুঁ।

মারু মিয়া বাসেদের দিকে চায়। তাহলে জমাদার মেরে ফেলবে। 

চাকরদের উপর তিনজন কলম-পিষিয়ে বাবু। তার উপর গণ্ডেরীরাম। 

মারু মিয়ার সেজন্য ভয় হয়। . 

বাসেদ বেপরোয়া। 

—তুমি চুপ করো বড়োমিয়া। গা-ঢাকা আঁধার হোলে আমি মশারি খুলে আনব। ভোর বেলা আবার দিয়ে আসব। আমাদের মশা খায়, গাই-গোরু মশারির ভেতর। শালাদের জামাই না জরু? 

মারু মিয়া এই বেপরোয়া জোয়ানকে ভালবাসে। বাৎসল্যরসের পরিচয় মাত্র। খুব বেশী যায়গায় মতের অমিল থাকলেও তারা ঝগড়া করে না। 

মারু মিয়া মুচকে মুচ্‌কে হাসে। 

এখন রান্না বাকী আছে। বাসেদ কাঠ আর কয়লা ভাঙতে শুরু করে। বড়োমিয়াকে সে কোন ভারী কাজ করতে দেয় না। 

বাসেদ কয়লা ভাঙার সময় গুন্ গুন্ শব্দে গান করে। 

গণ্ডেরীরামের পিঁজরাপোল বেড়ে চলছে ক্রমশঃ। প্রায় এক শ’ কুঠ্‌রি তৈরী হোয়েছে। চাকরদের কোয়ার্টার অবশ্য বদলায় নি। বাবুদের নূতন কোয়ার্টার গড়ে উঠল রাতারাতি। 

সকলের মুখে গণ্ডেরীরাম আর তাঁর অংশীদার গওস মাহমুদের নাম ছড়িয়ে পড়ে। 

দয়াবতার। হুহু করে পানির মত আর কে টাকা খরচ করতে পারে? একজন ভ্যাটারনারী সার্জন পর্যন্ত দু’শ টাকা মাইনেয় নিয়োগ করা হোয়েছে। নূতন লন, বাগান আরো গড়ে উঠছে চারদিকে। 

মারু মিয়া কুড়ি বছর আগে এই পিঁজরাপোলে চাকরি গ্রহণ করে। তার কাছে এই রং-ফেরা খুব বিচিত্র ঠেকে। 

ঘোড়া পর্যন্ত পিঁজরাপোলে স্থান পেয়েছে। 

গণ্ডেরীরামের দিকে যদি আল্লা মুখ তুলে না চান, তাহলে তাঁর দয়াময় নাম মিথ্যে হোয়ে যায়। মন চেনার জন্য ঠিক লোককে তিনি ধন দিয়েছেন। 

ফেঁপে উঠছেন গণ্ডেরীরাম, আর ফেঁপে উঠছে পিঁজরাপোল। গওস মাহমুদ তাঁর নূতন অংশীদার রূপে গুণাংশও পেয়েছেন ষোল আনা। স্বর্ণ-সোহাগার পরম মিলন। 

গণ্ডেরীরাম কয়েকদিনের জন্য পিঁজরাপোলের বাংলোয় অবস্থান করছেন। দুদিনের বেশী তিনি এখানে থাকেন না। তাঁর জীবনে এই প্রথম ব্যতিক্রম। 

মনিবের চোখের উপর কেউ সোয়াস্তি বোধ করে না। কাজে ফাঁকি চলে না। 

তাই কলম-পিষিয়ে বাবু থেকে চাকরেরা পর্যন্ত কানাঘুষা করে : এতদিন বিলম্বের কারন?

খবরটা অবশ্য চাপা থাকে না। লেখাপড়া-জানা বাবুরাই ঢাক খোলে। তারপর শত কান।

মারু মিয়া বাসেদকে জিজ্ঞেস করে : সরকার এত্তা রোজ হিয়া কেউ ঠায়েরতা হ্যায়?

বাসেদ হাসে, পরে বলে : উনি পিঁজরাপোলে থাকবেন। তেইশ নম্বরের বুঢ্‌ঢ়া ভয়েসটা মরেছে, সেখানে জায়গা করে দাও। আমি খড় খোল রোজ দিয়ে আসব। 

—কিয়া বকতে হো। কোই শোন্ লেগা ত? 

বাসেদ বুড়ো আঙুল উচিয়ে বলে : শুনুক না। 

মারু মিয়া প্রাথমিক বিরক্তিভাব চেপে বলে : কিয়া হুয়া? 

—তোমার সরকারের পাটকলে গুলি চলেছে। তাই এখানে পালিয়ে বসে আছে। জান্-কে খাতির। দেখে আসবে বাংলোর গেটে বন্দুক পাহারা আছে। আজকাল আর পুরানো চাল নেই। 

গুলি চলার কথা শুনে মারু মিয়া অবাক্ হয়। কারখানায় গুলি চলবে? তার বিশ্বাস হয় না। তাই অবোধের মত বাসেদকে জিজ্ঞেস করে : কিঁউ গুলি চলা? 

বাসেদ অবজ্ঞায় মুখ বাঁকায়।—তুমি বুঝবে না বড়োমিয়া, কেন গুলি চলে। দুনিয়ায় মানুষ হোয়ে এসেছি। পেট আছে, চাল আছে, চুলো আছে। খেতে হবে না? কিন্তু তোমার মনিব খেতে দিচ্ছে কৈ? তারা দাবী জানাবে না? তাদের মাগ-ছেলে নেই? কিন্তু তাদের কথা শোনে কে? জোর যার মুলুক তার। গুলি তো গুলি, বোমা চালাবে কোনদিন। 

মারু মিয়া সব কথা পরিষ্কার বুঝতে পারে না। মনিব এমন করতে পারে? 

বাসেদকে জিজ্ঞেস করে : আদমী মরা হ্যায়? 

—রাগ করো না বড়োমিয়া। তুমি একদম বুঢ্‌ঢ়া বয়েল। মানুষ মরবে না? একদিন তুমি আমি হয়ত অম্নি করে মরব। 

কুঠ্‌রির মেঝের উপর বসে মারু মিয়া মুখ ভারী করে। 

“হুযুর কা এনা মেহেরবানি, জানোয়ার কা তরফ দেখতা। আর আমী কা উপর জুলুম? বাসেদ হো হো করে হাসে। মারু মিয়া বিরক্ত হয়। মানুষ, মৃত্যু-সংবাদে হাসতে পারে, এমন পাষাণ! 

বাসেদ ঢোক গিলে বলে : মানুষ কোথা দেখলে? তুমি মানুষ, না আমি মানুষ? 

দু-জনে গুম হোয়ে বসে থাকে। আর কোন কথা চলে না। বাসেদ দুঃখিত হয়। বুড়ো মানুষকে কড়া কথা না বলাই ভাল ছিলো। এই গুমোট ভাব কেটে যায় জমাদারের আবির্ভাবে। সে বলে : এই তৈরী হো যাও। হুযুর লোগ আতা হ্যায়। 

দুই জনে তাড়াতাড়ি কাপড় জামা খোঁজে। তখন আলাপ বিনিময় হয়। 

গণ্ডেরীরাম ও গওস মাহমুদ পরিদর্শনে বেরিয়েছেন। বাসেদ ও মারু মিয়া কুঠ্‌রির বাইরে দাঁড়ায়। গণ্ডেরীরাম এবং তাঁর কর্মচারিবর্গ তাদের সম্মুখে। মহারাজার পরণে গেরুয়া বসন। মাহমুদ সাহেবকে আচকান আর সাদা কিস্তী টুপিতে বেশ মানিয়েছে। থুতনির উপর কয়েকগাছা দাড়ি বাতাসে উড়ছে। তিনি হাত ফেরাচ্ছেন এই তৃণ-বিরল জঙ্গলে। 

গণ্ডেরীরাম মারু মিয়াকে জিজ্ঞেস করেন : বুঢ়ঢ়া, কুছ তকলিফ নেহি? 

মারু মিয়া কথা বলতে থতমত খায়। হুযুর মায়ি বাপ। 

আর কোন কথা তার মুখ দিয়ে বেরোয় না। যখন কথা বলার শক্তি সঞ্চিত হোলো, গণ্ডেরীরামের চোখ অন্যদিকে, তিনি এগিয়ে গেছেন। বুকের ফরিয়াদ বুকেই জমাট বেঁধে থাকে। 

আবার কুঠ্‌রিতে ফিরে আসে তারা। 

বাসেদ বলে : বড়ো মিয়া, তুমি তলিফের কথা বলে না কেন? 

—কিয়া কহেগা? 

—ঘোড়ার আণ্ডা কহেগা। এককুড়ি টাকায় চলে না। নিজে খাই কী, আর বাড়ী- 

—সাহেব চলা গিয়া। হাম কিয়া করে গা? 

—তুমি একটা বুঢ্‌ঢ়া বয়েল-বুড়ো দাড়া। 

বাসেদ ভারী রাগান্বিত হয়। তাকে জিজ্ঞেস করলে, গণ্ডেরীরাম আজ দশ কথা শুনে যেতেন। বড়োমিয়া সুযোগ পেয়েও সব হারাল। 

—বুঢ্‌ঢ়া বয়েল। 

.

কিছুদিন পরে। 

স্যার আসাদ আলির গাইয়ের একটা সাদা বাছুর পিঁজরাপোলের মাঠে ঘুরে বেড়ায়। মার আশে পাশে দৌড়ায় আর লাফায়। 

মারু মিয়া ঘাসের উপর বসে বাছুরের খেলা দেখে। সাদা বরফের মত গায়ের রং। কচি লোমের উপর পড়ন্ত দিনের আলোক বিচিত্র রঙের মোহ ছড়িয়ে যায়। বৃদ্ধের চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হোয়ে উঠে।

পিঁজরাপোলের দুধ বিক্রি হয় না, সব বাছুরে খায়। ধর্ম-ভীরু বড়োমিয়ার সাহস বেশী নয়। একমাস দুধ-দোহন উচিত নয়। মাস শেষ হ’তে আরো পাঁচ দিন মাত্র বাকী। 

বাছুরটা দেখে মনে হয় না, দুধ-বাছুর। আড়ংই অন্য রকম। ভাগলপুরী গাভীর সন্তান বংশ-মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। 

গাইটার খুব যত্ন করে বড়ো মিয়া। বাছুর হওয়ার পর গায়ের ঘা আরো বেড়ে গেছে। ডাক্তার রোগের নাম বলেনি, তবে ক্ষতস্থান ছুঁতে বারণ করেছে। যেদিন ইন্‌জেকশান দিয়ে যায়, সেদিন গাইটা বড় ছটফট করে। বাছুর কাছে গেলে পর্যন্ত শিং দিয়ে গুঁতোয়। 

খড়-খোল আজকাল মারু মিয়া নিজের হাতে পরিবেশন করে। অনেক রাত্রি পর্যন্ত গরুর কুঠ্‌রি- ছাড়া হয় না। বাসেদ গরুর যত্ন নিতে বড়ো মিয়াকে খুব অনুরোধ করে। 

অবশ্য বাসেদের জন্য তার প্রাণের কন্দর উন্মুক্ত থাকলেও বাইরে কঠিন বড়ো মিয়া। বাসেদের সঙ্গে বড় কম কথা বলে। এই নিস্তব্ধতা প্রথমে বাসেদের মনে ক্ষোভ সঞ্চার করেছিল। এখন সে আর বেশী জায়গা দেয় না মনে। হৃদ্যতায় না হোক, খোদার দিন কেটে যায় কোন রকমে। 

আর একটি ঘটনার আঁচড়ে বড়ো মিয়া মুষড়ে পড়ল। 

খড়-খোল দিয়ে একপ্রহর রাত্রির পর সে কুঠ্‌রিতে ফিরছিল। 

কম্পাউণ্ডের মাঠের একদিকে কয়েকটা আম গাছের সারি। পূর্ণিমার দিনে এই বন-বীথির তলায় এক ফালিও জোছনা পড়ে না, ভারী অন্ধকার। পাশ দিয়ে রাস্তা। পিজরাপোলের লোকেরাই যাতায়াত করে। সাপের ভয়ে অনেকে এই দিকে পা বাড়ায় না। শুধু গাভীর স্নেহেই বড়ো মিয়া আজকাল রাত্রে এই পথে হাঁটে। জিন-পরীর ভয় তার নেই। ভয় কেবল সাপের। 

মাঝ-পথে সে এসেছে, আম গাছের একপাশ থেকে মনে হোলো এক ছায়া সরে গেল। আবছা অন্ধকারে তা বোঝা যায়। 

বড়োমিয়া চুপ করে দাঁড়ালো। একটু দূর থেকে ফিসফিস্ শব্দ শোনা যায়। সাপের শিস নয়, মানুষের অস্পষ্ট ভাষণ। 

অষ্টমীর চাঁদ আকাশের কিনারায় ঢলে পড়েছে। সতর্ক চোখের দৃষ্টি দিয়ে বড়ো মিয়া দেখে যে, আম-বীথির উত্তর দিকে দু’টি ছায়া মূর্তি। ধীরপদে সে এগোতে লাগল। কৌতূহলের নেশার কাছে বড়ো মিয়ার সর্প-ভীতি হার মেনেছে। 

গাঢ় আলিঙ্গনাবদ্ধ দু’টি ছায়ামূর্তি আরো একটু দূরে সরে মাটির উপর আসন গ্রহণ করল। বড়ো মিয়া ধীরপদে এগোতে থাকে। হঠাৎ ঝরা পাতার শব্দে বনভূমি চকিত নিঃশ্বাস ফেলে নৈশ বাতাসে। প্রেতগ্রস্ত মনে হয় চারিদিক। 

বড়োমিয়া হাঁকে : কে? 

একটা ছায়ামূর্তি নিঃশব্দেই সরে গেলো। আর একটা ছায়ামূর্তি ভীরু নয়। সে দাঁড়িয়ে বলে : চুপ করো বড়ো মিয়া, আমি বাসেদ। 

দু’জনে আবার পথে এসে দাঁড়ায়। 

বড়ো মিয়া বলে : কি করছিলে? 

—কিছু না। 

বড়ো মিয়া জোর গলায় বলে : কুচ নেই কিয়া? হাম আন্ধা হ্যায়? 

তবে শোন, বড়োমিয়া। ওই কলম-পিষিয়ে বাবু যাদের মেয়েদের বিয়ে হয় না, বিয়ে দিতে পারে না, তাদের একজন। এই মেয়েটা কিন্তু ভালো। ওকে আমি ভালবেসে ফেলেছি। 

বড়ো মিয়া কানে আঙুল দেয় আর কী। বলে : কি বলছ? 

বাসেদ জবাব দিতে দেরী করে না। সত্যি বড়ো মিয়া আল্লার কিরে। দোষটা কী? ওদের বিয়ে হয় না, আমাদের কাছে কেউ থাকে না। আর বিয়ে হবে কি করে? ওই ইংরেজী-জানা বাবুরা আমাদের দিকে ত চায় না। কিন্তু এই মেয়েটি খুব ভালো। আমি ওকে ভালবেসে ফেলেছি। 

বড়ো মিয়া গুম হোয়ে থাকে। 

শেষে রুক্ষকণ্ঠে বলে : বদ্‌কার আওরত। 

.

কিন্তু মারু মিয়ার পেটে পাথর হজম হয়। সে বাসেদকে হজম করেছে কেবল স্নেহের আতিশয্যে। বাসেদ নিশ্চিন্ত। সে প্রায়ই কুঠ্‌রিতে থাকে না সারা রাত্রি। ভোররাত্রে ফেরে। কিন্তু কাজের বেলা সে শিথিল-গ্রন্থি নয়। 

একদিন রাত্রি দশটার সময় কুঠ্‌রিতে একটা লোক নিয়ে সে হাজির। 

—বড়ো মিয়া, চেয়ে দেখো। 

মারু মিয়া তার চোখের দিকে চায়। 

—এই গোয়ালা ঠিক করে এনেছি। ভোর-ভোর দুধ দুয়ে রাখব। এ নিয়ে যাবে। আগাম দশ টাকা দিয়েছে। 

একটা দশ টাকার নোট বড়োমিয়ার সামনে ধরল সে। 

বড়ো মিয়ার অসোয়াস্তি লাগে। কিন্তু দ্বিরুক্তি করে না। 

বাসেদ আত্মপ্রসন্ন দৃষ্টিতে বড়ো মিয়ার দিকে চেয়ে বলে : আজ থেকে খুব ভোরে উঠতে হবে। গোয়ালা ভাই, তুমি আসতে দেরী করো না। পানির দরে দুধ পাচ্ছ। 

গোয়ালা বিদায় গ্রহণ করে। মারু মিয়া দশ টাকার নোট-হাতে ভাবে, বাসেদ ভারী চালাক ছোকরা। তাকে দিয়ে এই কাজ কোনকালে সম্ভব হোত না। অথচ সেও মনে করত, দুধ লুকিয়ে বিক্রি করলে কাঁচা পয়সা হাতে আসে। 

বাসেদ হাসে। কেমন বড়ো মিয়া? আমাকে কিন্তু বেশী ভাগ দিতে হবে না। আপনার খুশী। গাইটা আপনার কি না। 

—নেহি, ও বাত নেহি। আধা-আধা, বাচ্চা। 

পিতার চোখ দিয়ে মারু বাসেদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ভাগে আধা-আধি কারবার। 

তবু বড়ো মিয়ার বুকের ভার নামে না। বাসেদকে তার খুব ভাল লাগে না আর। অথচ প্রথম 

পরিচয়ে দু-জনের ভেতর একটা হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিলো। আজ তার রেশ মাত্র নেই। 

 সেদিন রাত্রির চতুর্থ প্রহরের অন্ধকারে বাসেদ দুধ দু’য়ে আনল। গোয়ালা আসতে বিলম্ব করে নি।

বাসেদ বলল : আম বাগানের পাঁচিলের পাশ দিয়ে যেয়ো। কোন জমাদার বেটার চোখে পড়বে না। আর ওরা এখনো ঘুমুচ্ছে। তাই বলে দেরী করো না কোনদিন। 

মারু মিয়া অনুসন্ধিৎসু।-গোরুর দুধ ক’বার দোহা উচিত?

—দিনে একবারই ভাল। বাছুরের শরীর ভাল থাকে। 

বাসেদ জবাব দেয় : ঘাবড়ে যেয়োনা বড়ো মিয়া। আমার এই বন্ধু খুব পাকা লোক। 

বড়ো মিয়া মাথা দোলায়। বাসেদের কথা অবহেলা করেছে কে? 

পরদিন গোয়ালা আরো পাঁচ টাকা অগ্রিম দিয়ে গেল। বড়ো মিয়া খুব সন্তুষ্ট হয়। 

এর কয়েকদিন পর বড়ো মিয়া একরাত্রে প্রায় দু-সের দুধ দোহন করে রাখে। জমাদারের চোখে বড়োমিয়াও ধুলো দিতে পারে। 

বাসেদ সন্ধ্যায় বেরিয়ে গিয়েছিল। রাত্রি দশটার সময় কুঠ্‌রিতে সে ফিরে এলো। তখনও বড়ো মিয়া খায় নি। কুঠ্‌রিতে টিম টিম করে আলো জ্বলছে। 

—এখনও খাওনি, বড়োমিয়া? 

—নেহি ভেইয়া। আও আজ একসাথ খানা খায়ে। 

বাসেদের মুখে খই ফোটে। চট্‌পট্, পেট চোঁ চোঁ করছে। 

বড়ো মিয়াও শশব্যস্ত। তাড়াতাড়ি আহারাদির সরঞ্জাম করে। 

দু’জনে খেতে বল। 

ডালের বাটিতে চুমুক দিতে দিতে বড়ো মিয়া বলে : আজ উম্‌দা খানা। 

বাসেদ বলে : একে বলো উম্‌দা খানা? পেট ভরে এতে? বড়োমিয়া, কুকুরের খানা এই ভাত আর ডাল। এতেই আপনার মুখে উম্দা বেরোলো? 

—খোদা কা শুকরিয়া। 

বাসেদ ডাল মাখিয়ে ভাত টিপ্‌ছিল। সে জোরসে ভাত মুঠির ভেতর টিপে বলে : শুকরিয়া কা এ্যায়সী ত্যায়সী। এই খাবার খেয়ে আবার মুখ দিয়ে শুকরিয়া বেরোয়। 

বাসেদ ভাতের দফা হালুয়া করে ফেলেছিল। ভাতের প্রাণ থাকলে এতক্ষণ ত্রাহি শব্দ বেরোত। মারু মিয়া চটে যায়। নিঃশব্দে সে ভাত খায়। বাসেদের খাওয়ার আগে সে খাওয়া শেষ করে। তারপর চুলা থেকে এক বাটি সাদা তরল পদার্থ বাসেদের সামনে রেখে বলেঃ আ শুরিয়া কহো। 

বাসেদ মারু মিয়ার দিকে তাকায়। সে যেন একটা রাস্তার পাগল দেখছে। শেষে হাসে।

—ওই নেয়ামটা কী, বড়ো মিয়া? 

—দুধ ভৈল। 

দুধ! বাসেদ একটা ভয়ার্ত শব্দ করে। পরে অন্য সুরে জিজ্ঞাসা করে : বড়ো মিয়া, কোন্ গাইয়ের দুধ?

—হামরা গাইকা। 

চাপাকণ্ঠে কিন্তু তীব্র ঝাঁঝে বাসেদ বলে : ফেলে দাও, আভি ফেঁক দো। 

মারু মিয়ার মগজ আর ঠাণ্ডা থাকে না। 

—তোমরা ছির বিগাড় গিয়া। দুধ ফেঁক দেগা! 

বাসেদের খাওয়া শেষ। সে হাত মুখ ধোয়ার আগে দুধ বাইরে নর্দমায় ঢেলে দিল। 

বড়ো মিয়া বাসেদকে কিছু বলতে চায় না। অস্ফুট স্বগত বলে : -ঐসা পাগল কভি নেহি দেখা।

বাসেদ জবাব দেয় না। কিছু পরে গামছায় হাত-মুখ মুছে বলে : পাগল আমি নই বড়ো মিয়া, তুমি। আরো দুধ আছে হাঁড়িতে? সব ফেলে দাও। 

—নেহি। কেউ ফেঁক দেগা? 

—চেঁচিয়ো না। এখন ঢাক বেজে যাবে। তোমার গোরুর দুধ খাওয়া চলে না। কি অসুখ হোয়েছে জান, ঐ যে গায়ে ঘা? 

এইবার বড়ো মিয়া অনুসন্ধিৎসু নেত্র খোলে। 

—কিয়া বিমারী? 

এতক্ষণে বলছ কিয়া বিমারী। ডাক্তার ত তোমাকে বলতে চায় না। আমাদের বাংলা মুলুকে বলে কুঠ-কুষ্ঠ। 

মারু মিয়া আকাশ থেকে পড়ে। ঐ গোরুটা কুষ্ঠ রোগে ভুগ্‌ছে। তার দুধ খাওয়া কোন মানুষের শরীরের পক্ষেই ভাল নয়! 

বড়ো মিয়া বলে : হামকো কাহে নেহি বোলা? 

—বলে’ কি হবে? দুধ আমরা বিক্রী করব। 

বড়ো মিয়া মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে। কিছু পয়সার লোভ তার ছিল। আজ বাসেদ তার জ্ঞান- নেত্র খুলে দিয়েছে। 

–কালসে দুধ নেহি বেচেগা। 

বাসেদ জবাব দেয় : মাথা গরম করোনা, হুযুর। দুধ বেচব না কেন? ও দুধ আমরা খাব না।

মারু মিয়া ধর্মভীরু লোক। সে রাযী হয় না। উত্তর দিল : কোই আদমী কো খানা নেহি চাহিয়ে। . ঐসা পয়সা হামরা জরুরাৎ না ভৈল। 

—চুপ করো, বড়ো মিয়া। মানুষের জন্য এত দরদ! তোমার মত আমার মত গরীবের জন্য কারও দয়া আছে? গরীবদের কেউ নেই। কোয়ার্টারের ঐ আধ-গরীব বাবুরা পর্যন্ত নয়। 

—তব্ কিয়া করেগা? 

—দুধ বিক্রী করব। পয়সা আসবে, মজাসে দিন চলবে। তবে মনে রেখো, গরীবরা মরবে না। গরীবরা দুধ কিনে খাবে! ক্ষেপে গেছ, বড়ো মিয়া! কিনবে ঐ কোয়ার্টারের বাবুরা, গণ্ডেরীরাম, আর শহরের মাঝামাঝি গেরস্থরা। মরুক ওরা। ওদের আমি সহ্য করতে পারি না। গরীবের ছেলেরা দুধ খেতে পায় না, মায়ের শুকনো মাই চোষে। ওরা চায়ে দুধ খায়। 

বড়ো মিয়া বোবার মত কানদুটো খোলা রাখে। বাসেদ বেয়াড়া। এতদিন গোপনে এই কুষ্ঠ-ক্ষত গোরুর দুধের ব্যবসা চলছে। বেশী গোলমাল করলে বাসেদ তাকে বিপদে ফেলে পালাবে। ভীরু শজারুর মত শুধু দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ক’রে মারু মিয়া অন্ধকারের দিকে চোখ ফেরায়। 

প্রায় দেড়সের দুধ ছিল হাঁড়িতে। শোয়ার আগে মারু মিয়া নর্দমায় ঢেলে দিল। 

ক্লিওপেট্রা দুধে অবগাহন করত। মোগল সম্রাটদের রেণ্ডিরা দুগ্ধ-হাম্মামে রূপ-চর্চার নিকেতন গড়েছিল। 

নর্দমা বয়ে মারু মিয়ার দুধের ক্ষীণ স্রোত ছোটে। নর্দমার চরের উপর সুপ্ত এক ঝাঁক মাছি ভনভন্‌ শব্দে জেগে উঠে আবার অবগাহনে নামে। 

পিঁজরাপোলের আবহাওয়া শান্ত। গণ্ডেরীরামের বাংলো খালি। সঙ্গীনধারী পাহারাদার গণ্ডেরীরামের সঙ্গেই শহরে ফিরে গেছে। 

মানব-জীবনে নাটকের অন্ত নেই। ফাঁকা মাঠে তরুলতা পশুপাখীরা ভিড় করে। নাটকের ছায়া পড়ে না। আসুক দু-এক ঘর গেরস্থ, শুরু হবে জীবনের চঞ্চলতা, দৈনন্দিনতার মধ্যেই নাটকের দৃশ্য আঁকা হোতে থাকবে। 

একটা ঘটনায় পিঁজরাপোল তোলপাড়। 

বাবু-কোয়ার্টারের পুকুরে তাদেরই একটি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। শীতলতার আস্বাদে সেই হতভাগিনী চেয়েছিল সলিল-সমাধি। কিন্তু মানুষের হিংস্রতা পশুর অপেক্ষা ভীষণ। তার দগ্ধ-জীবনের শেষ কামনা কে পূর্ণ হোতে দেবে? পৃথিবীর উত্তপ্ত সূর্য আর ডাক্তারের ছুরির প্রায়শ্চিত্ত এখনও অবশিষ্ট আছে। 

জনরবের ফাঁক ক্রমশঃ বেড়ে যায়। পিঁজরাপোলে সকলের মুখেই ওই আত্মহত্যার কাহিনী।

সেদিন সারাবেলা বাসেদের ছায়া চোখে পড়ল না। মারু মিয়া দুপুরের আহার সেরে বসেছিলো। বাসেদের খানাপিনা বাসনে অপেক্ষা করছে। বাসেদ এলো না। 

মারু মিয়া স্তব্ধ হোয়ে বসে থাকে। বাসেদের জন্য উদ্বিগ্ন হয়। জওয়ান ছেলে; খেয়াল আর সাময়িক উত্তেজনার বশে সেও যদি এই পোড়া জীবনে শীতলতার স্পর্শ চায়। মারু মিয়া তওবাস্তাফের পড়ে। কুল্‌হুআল্লা প’ড়ে তিনবার বুকে ফুঁক দেয়। বাৎসল্যের বন্যা টেনে আনে বুকের পাঁজর থেকে হল্কা নিঃশ্বাস। 

বাসেদ ফিরে এলো সন্ধ্যার একটু আগে। মুখে তার সজীবতার চিহ্নটুকু নেই। চুল উস্কোখুস্কো।

মেঝের ধুলোর উপর সে বসে পড়ে। 

মারু মিয়ার মুখে সহজে কথা বেরোয় না। বাসেদের চেরা দেখে সে নানা আশঙ্কা করে। দুইজনে চুপচাপ। অনেকক্ষণ নিস্তব্ধতার পর মারু মিয়া বলে : বাসেদ, তোমরা খানা পড়া হ্যায়। খালো বেটা। 

বাসেদ জবাব দেয় না। 

মারু মিয়া আরো কি কথা বলতে চায়। তার সাহস হয় না। 

বাসেদ হঠাৎ সুপ্তোত্থিতের মত বলে : না খাব না। খেয়েছি। 

সন্ধ্যা হোয়ে গেল। মারু মিয়া আলো জ্বেলেছে কুঠ্‌রিতে। বাসেদ বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসে থাকে। 

—বড়ো মিয়া, আমি চুলা ধরিয়ে দিচ্ছি। 

বুড়োমানুষ, কত কষ্ট হোয়েছে ওবেলা! কথা-কাজ বাসেদের একসঙ্গে চলে। সে তার কর্তব্য আধঘণ্টার ভেতর সমাপ্ত করল। 

পাক শেষ হোতে রাত্রি বেড়ে গেল। বাসেদ খেতে বসল মাত্র। কিন্তু একগাল ভাত কোনরকমে ঢোক গিলে মাদুরের উপর শুয়ে পড়ল। 

চোখে তার ঘুম নেই। বিরাট শূন্যতায় সমস্ত পৃথিবী ভরা। বাইরের আকাশ বাতাস যেন উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে দৈত্যের মতমুখ-গহ্বর মেলে চেয়ে আছে। প্রশ্ন করছে তাকে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন। অনেক মানুষ আর গোটা পৃথিবীর কাছে জবাবদিহির মত সে দাঁড়িয়ে থাকে। পরক্ষণে তাকে আছাড় দিয়ে মাটির উপর ফেলে দিচ্ছে তারা। চারিদিক শূন্যতার আশ্লেষে সমাহিত। তবু জনহীনতার নিশানা নেই। সারিবাঁধা প্রেতাত্মার দল ফিফিস্ কথা বলে বাতাসে। 

সারারাত্রির জোছনা আকাশে। 

মাঝ রাত্রে বাসেদ মারু মিয়াকে জাগায়। সামনে তার গাঁঠরি-পত্র বাঁধা। 

—বড়ো মিয়া, আমি চলে যাচ্ছি। 

অকস্মাৎ ঘুমভাঙা মারু মিয়া ব্যাপারটা সহজে উপলব্ধি করতে পারে না। 

—কাঁহা যায়েগা? 

বাসেদ ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে : চলে যাচ্ছি নৌকরি ছেড়ে। 

—কিয়া বাচ্‌পানী (ছেলেমানুষী), ও নেহি। 

বাসেদ অনুরোধ-গদগদ সুরে জানায় : বড়ো মিয়া, তুমি আমার বাপের মত। আমি আর একদণ্ড এখানে থাকতে পারব না। যদি থাকি, আমিও মরে যাব। আমাকে অনুরোধ করো না। 

বাসেদ বাইরে এলো। সঙ্গে মারু মিয়া নিঃশব্দচরণ। 

—ও মাহিনাকা তনখা রহ গিয়া। 

—থাক। আমার দরকার নেই। 

বড় মোলায়েম বাসেদের গলা। 

সমগ্র পিঁজরাপোলের জগৎ সুপ্ত। পশুর দল পিঞ্জরে। লেজঝাপ্‌টায় কোনটা মশা তাড়ায়। একটা মোষের গোঙানি শোনা গেল এইমাত্র। 

বাসেদ ধীরে ধীরে পা ফেলে। পিঠে তার গাঁঠরির বোঝা। 

—আর আবার দরকার নেই, বড়ো মিয়া। কষ্ট হবে আপনার। 

বাসেদ বড়ো মিয়াকে কদমবুসী করে। মারু মিয়ার দুই চোখে পানি। কোন কথা বলতে পারে না। শেষে আর্তকণ্ঠে বলে : নেহি, হাম নেহি জানে দেঙ্গে। 

বাসেদ আর দেরী করে না। মাফ কিজিয়ে বড়ো মিয়া। বলে’ সম্মুখ-পথের দিকে এগিয়ে যায়।

আম্র-বীথির উপর দিয়ে চন্দ্রিকার জোয়ার চলছে। নিচে আদিম প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার। আদমের কোন শিশু নেই আজ এইখানে। ঝিল্লী-স্বরে রাত্রির পেয়ালা শুধু ভরে উঠে।

বিষণ্ন-চিত্তে মারু মিয়া একা-একাই তার কুঠরিতে ফিরে এলো। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *