পাহাড়ে মেয়ে (প্রথম অংশ)

পাহাড়ে মেয়ে (প্রথম অংশ) 

প্রথম পরিচ্ছেদ – সূচনা 

এই হত্যার যথাযথ বিবরণ, তাহার অনুসন্ধান প্রভৃতি, বিস্তৃতরূপে সপ্তম বৎসরের ৭৮ম সংখ্যক দারোগার দপ্তরে বর্ণিত আছে। রাজকুমারীনাম্নী একটি চরিত্রহীনা স্ত্রীলোককে হত্যা করা অপরাধে ত্রৈলোক্যনাম্মী অপর আর একটি স্ত্রীলোক চরমদণ্ডে দণ্ডিত হয়। এই হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধানে আমি নিযুক্ত হইবার পূর্ব্বে ইহার বিপক্ষে আমি আরও একটু অনুসন্ধান করিয়াছিলাম; সুতরাং ইহার পূর্ব্ব বৃত্তান্ত আমি বিস্তর অবগত হইতে পারিয়াছিলাম। তথাপি ইহার জীবনচরিত বিশদরূপে জানিবার নিমিত্ত, চরমদণ্ডের আদেশের পর আমি একদিবস কারাগারে গমন করি, এবং তাহাকে সম্বোধন করিয়া কহি,—”দেখ ত্রৈলোক্য! তোমার উপর যেরূপ ভয়ানক রাজদণ্ডের আদেশ হইয়াছে, সেরূপ দণ্ড এ দেশীয় অপর কোন হিন্দুরমণী যে আর কখনও প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহা আমি অবগত নহি। যে মহাপাপের নিমিত্ত তোমাকে এই ভয়ানক দণ্ড গ্রহণ করিতে হইতেছে, সেরূপ মহাপাপ হিন্দুরমণীর মধ্যে বোধ হয়, তুমিই প্রথম প্রবর্ত্তিত করিলে। সে যাহা হউক, তোমার এই অন্তিম সময়ে দুইটি সবিশেষ কার্য্যবশতঃ আজ আমি তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি। প্রথমতঃ, তুমি সবিশেষরূপে অবগত আছ যে, তোমার এই ভয়ানক দণ্ডের মূলীভূত কারণ সকলের অন্যতম কারণই আমি। কারণ, যেরূপ ভাবে আমি এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিয়াছিলাম, সেইরূপ উপায় অবলম্বন করিয়া, যদি আমি এই অনুসন্ধানে লিপ্ত না হইতাম, বা যেরূপ ভাবে আমি তোমাকে প্রতারিত করিয়াছিলাম, সেইরূপ ভাবে তুমি যদি আমা কর্তৃক প্রতারিত না হইতে, তাহা হইলে এই ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কথা সকল বোধ হয়, কিছুই প্রকাশিত হইয়া পড়িত না; সুতরাং তুমিও এই ভয়ানক দণ্ডে দণ্ডিত হইতে না। কাজেই তোমার এই চরমদণ্ডের মূলীভূত কারণ সকলের অন্যতম কারণই আমি। ইহা আমি নিজ মনে উত্তমরূপে অবগত হইয়া, তোমার জীবনের এই শেষ সময়ে তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিবার মানসে আজ আমি তোমার নিকট উপনীত হইয়াছি। আশা করি, যদি ইহাতে আমার কোনরূপ দোষ থাকে, তাহা হইলে তুমি আমাকে ক্ষমা করিবে। কারণ, নিজ ইচ্ছার বশবর্ত্তী বা কোনরূপ লোভ পরতন্ত্র হইয়া আমি এরূপ জঘন্য কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হই নাই, তাহা তুমি বেশ অবগত আছ। কেবলমাত্র আমার কর্তব্যকর্ম্মের বশবর্তী হইয়াই, আমি তোমার এইরূপ বীভৎস পরিণামের মূলীভূত কারণ সমূহের অন্যতম কারণ হইয়াছি। 

“ত্রৈলোক্য! এখন তুমি বেশ বুঝিতে পারিতেছ যে, তোমার মৃত্যু অতি নিকটবর্তী। বোধ হয়, এক সপ্তাহের মধ্যেই রাজ-আদেশে তোমার প্রাণবায়ু বিরামলাভ করিবে। আমার বিশ্বাস, এই অবস্থায় তুমি আর কোনরূপ মিথ্যা কথা বলিয়া তোমার কলুষিত আত্মাকে আরও কলুষিত করিবে না। 

“আমি যে দুইটি কার্য্যের নিমিত্ত আজ তোমার নিকট আগমন করিয়াছি, তাহার প্রথম কার্য্যের বিষয় তোমার নিকট বিবৃত করিলাম। দ্বিতীয় কাৰ্য্যটি যে কি, তাহাই এখন তোমাকে শুনিতে হইবে। কেবল শ্রবণ নহে,—আজ তোমাকে আমার প্রার্থনা পূর্ণ করিতে হইবে। অদ্য আমি তোমার নিকট যে প্রার্থনা করিতে আসিয়াছি, তাহাই তোমার নিকট আমার শেষ প্রার্থনা। আশা করি, আমার এই শেষ প্রার্থনা পূর্ণ করিতে তুমি কোনরূপেই কুণ্ঠিত হইবে না; বরং আমার প্রার্থিত বিষয় বর্ণন করিয়া, অপর অনেকের উৎকণ্ঠা দূর করিবে। আমার সেই শেষ প্রার্থনা আর কিছুই নহে, কেবল তোমার জীবনের স্থূল স্থূল ঘটনাগুলি জানিবার ইচ্ছা মাত্র। আমি জানি, তোমার জীবনের অনেক অংশ ভয়ানক বিভীষিকাময় কার্য্যে পরিপূর্ণ। যে সকল মহাপাপের ফল তুমি আজ প্রাপ্ত হইয়াছ, তাহার অনেক বিষয় আমি অবগত আছি; কিন্তু সমস্ত বিষয় সম্পূর্ণরূপ জানিব বলিয়াই, আজ তোমার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। এখন তুমি আমার প্রার্থনা পূর্ণ করিয়া একদিকে আমার কৌতূহল পরিতৃপ্ত কর,—অপর দিকে স্ত্রীলোকমাত্ৰকেই জানাইয়া দাও যে, পাপ-পথে পদার্পণ করিলে, তাহার ভবিষ্যৎ ফল কি হইতে পারে।” 

আমার কথা শ্রবণ করিয়া ত্রৈলোক্য কহিল, “মহাশয়! আমি আমার জীবনের যৌবনাবস্থা হইতে আরম্ভ করিয়া, দিন দিন যেরূপ রাশি রাশি ভয়ানক পাপ উপার্জ্জন করিয়াছি, তাহার উপযুক্ত দণ্ড আমি প্রাপ্ত হই নাই! এখন আমি জানিতে পারিলাম, ইংরাজ রাজত্বে ভয়ানক পাপীর উপযুক্ত দণ্ড বিধান হয় না। ইংরাজ আইনে মহাপাপীর মহাদণ্ডের বিধান নাই! 

“আমি আমার যৌবনকাল হইতে আরম্ভ করিয়া, যত মহাপাপের প্রশ্রয় দিয়াছি, এবং এ পর্যন্ত যত লোকের প্রাণহত্যা করিয়া, মহাপাপের সঞ্চয় করিয়া আসিয়াছি, তাহার উচিত দণ্ড কি প্রাপ্ত হইলাম? আমার এই সামান্য পাপ-প্রাণকে হত্যা করিলেই কি, আমার কৃত মহাপাপ সকলের দণ্ড হইল? আমার এই দেহের ভিতর যদি সহস্র প্রাণ থাকিত, এবং সেই সকল প্রাণকে লক্ষ লক্ষ প্রকার যন্ত্রণা দিয়া যদি হত্যা করা হইত, তাহা হইলেও আমার কৃত পাপরাশির সহস্রাংশের কিয়ৎ পরিমাণে দণ্ড হইত কি না, বলিতে পারি না। 

“আপনি আমার জীবনের স্থূল স্থুল বিবরণ সকল অবগত হইতে চাহিতেছেন, এরূপ অবস্থায় আপনার অনুরোধ রক্ষা করিতে আমার কিছুমাত্র আপত্তি নাই। আমার যতদূর মনে আছে, বা যতদূর মনে করিতে পরিব, তাহার সমস্ত কথা আমি আপনার নিকট বর্ণন করিতেছি। কিন্তু মহাশয়! আমার কৃত মহাপাপ সকলের কাহিনী আপনি শ্রবণ করিবেন কি? কারণ, আমি যে সকল মহাপাপ করিয়া এ পর্যন্ত আমার জীবন অতিবাহিত করিয়া আসিয়াছি, সেই সকল কাহিনী কেবলমাত্র শ্রবণ করিলেও যে পাপ হয়, তাহারও প্রায়শ্চিত্ত বোধ হয়, এ জগতে নাই। মৃত্যুকালে আমার আর লোক-লজ্জার ভয় কি? আমার জীবনের কাহিনী আমার যতদূর স্মরণ আছে, এবং যতদূর স্মরণ করিয়া বলিতে পারিব, তাহা বলিতেছি। আপনি হউন, বা অপর যে কেহই হউন, যিনি শুনিতে চাহেন, শুনুন।” 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বাল্য-পরিচয় 

“আমার নাম শ্রীমতী ত্রৈলোক্যতারিণী দেবী। বর্দ্ধমান জেলাস্থিত একটি ক্ষুদ্র পল্লীতে ব্রাহ্মণবংশে আমার জন্ম হয়। কোন্ গ্রামে আমার জন্ম, এবং আমার পিতা পিতামহ প্রভৃতির নাম কি, তাহা প্রকাশ করিয়া, সেই বংশের আর মুখোজ্জ্বল করিব না। কিন্তু যাঁহারা আমার পরিচিত, এবং আমি কোন্ বংশ সম্ভূতা, তাহা যাঁহারা সহজে অনুমান করিয়া লইতে পারিবেন, তাঁহাদিগের নিকট আমার নিবেদন, তাঁহারা অনুগ্রহ পূর্ব্বক উহা প্রকাশ না করিয়া, আপনাপন মনের মধ্যেই যেন গুপ্তভাবে রক্ষা করেন। 

“আমার পিতা একজন প্রসিদ্ধ ‘স্বভাব কুলীন’ ব্রাহ্মণ ছিলেন। আমি তাঁহারই একমাত্র দুহিতা। তিনিই আমার নাম রাখিয়াছিলেন, ত্রৈলোক্যতারিণী। বাল্যকালে আমি অতিশয় সুরূপা ছিলাম। গ্রামের ভিতর কোন সুন্দরী কন্যার কথা উঠিলে, প্রথমেই আমার নাম হইত। কিন্তু পরিশেষে সেই রূপই আমার কাল হইয়াছিল। 

“আমি লেখা-পড়া জানিতাম না। আজকাল মেয়েদের মধ্যে অনেকেই লেখা-পড়ায় যেমন অল্প পরিমাণে শিক্ষিতা হয়, আমার অদৃষ্টে তাহা ঘটে নাই। আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময় আমাদিগের পাড়াগাঁয়ের মেয়েরা লেখা-পড়ার নাম পর্যন্ত শ্রবণ করে নাই। 

“আমার বাল্যকাল ক্রমে অতীত হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে ক্রমে আমি বার বৎসরে উপনীত হইলাম। আমাদিগের দেশের প্রথা অনুসারে বালিকাগণের দশ বৎসর বয়ঃক্রম হইতে না হইতেই প্রায় বিবাহ হইয়া থাকে। কিন্তু আমার পিতামাতা আমার বার বৎসর বয়ঃক্রমের মধ্যেও আমার বিবাহের কোনরূপ বন্দোবস্ত করিয়া উঠিতে পারিলেন না। কারণ, আমাদিগের সমান ঘরে সহজে বর পাওয়া দায় হইয়া উঠিল। পিতা গোঁড়া কুলীন ছিলেন। সুতরাং আমাদিগের সমান ঘরের পরিবর্তে অপর কোন ঘরে বা কিছু নীচ ঘরে আমার বিবাহ দিতে পারিলেন না। ক্রমে আরও এক বৎসর অতীত হইয়া গেল। আমি তের বৎসরে উপনীত হইলাম। পিতামাতা আর আমাকে কোন প্রকারেই অবিবাহিতা রাখিতে পারেন না। সুতরাং পিতা খুঁজিয়া খুঁজিয়া পূর্ববঙ্গ হইতে পঞ্চাশ বৎসর বয়স্ক একজন ‘স্বঘর-স্বভাব’ কুলীনকে আনিয়া, তাঁহারই সহিত আমার পরিণয়-কার্য সম্পন্ন করিয়া দিলেন। 

“স্বামীর মুখ দেখিয়াই হৃদয় জ্বলিয়া উঠিল। বহুদিবস হইতে সঞ্চিত পরিণয়ের সুখ-পিপাসা মিটিয়া গেল! কিন্তু পিতামাতা বা অপর গুরুজনের মধ্যে কাহারও নিকট আপন মনের কথা প্রকাশ করিতে পারিলাম না। হৃদয়ের ভিতর মুখ লুকাইয়া কেবল কাঁদিয়া কাঁদিয়াই দিন অতিবাহিত করিতে লাগিলাম। 

“আমার স্বামী কেবল যে বৃদ্ধ, তাহা নহে তিনি আরও দশ বারটি বনিতার স্বামী। এইরূপ অবস্থা দেখিয়া, পিতা যে কিরূপে আমার সহিত তাঁহার বিবাহ দিলেন, তাহা ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। বিবাহ-ব্যবসায়জীবী স্বামী আমার বিবাহের পূর্ব্বেই তাঁহার পাওনাগণ্ডা বুঝিয়া লইয়াছিলেন। তথাপি বিবাহের পর আরও দুই তিন দিবস আমাদিগের বাড়ীতে অবস্থান পূর্ব্বক আরও যাহা কিছু পাইলেন, তাহা গ্রহণ করিয়া আমাকে আমার পিতৃভবনে রাখিয়া আপন দেশাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। দুই তিন বৎসর আর তাঁহার কোন সন্ধানই পাইলাম না। চারি বৎসর পরে একদিন শুনিতে পাইলাম যে, আমার স্বামী আসিয়াছেন। সেই বৃদ্ধ স্বামীর সন্নিকটে গমন করিতে আমার প্রবৃত্তি হইল না, দূর হইতে তাঁহাকে একবার দেখিলাম মাত্র! কিন্তু চিনিতে পারিলাম না। বাড়ীতে থাকিলে, পাছে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে হয়, এই ভয়ে সেই দিবস আমি আমাদিগের বাড়ী পরিত্যাগ করিলাম, এবং আমাদিগের বাড়ীর সংলগ্ন তারা বৈষ্ণবীর বাড়ীতে গিয়া লুকাইয়া রহিলাম। বলা বাহুল্য, রাত্রিকাল ও তারাদিদির সহিত তাহারই বাড়ীতে কাটিয়া গেল। আমার স্বামীও, কি জানি, কি ভাবিয়া, তাঁহার পাথেয় খরচ বুঝিয়া লইয়া, পরদিবস প্রত্যুষেই আমাদিগের বাড়ী হইতে চলিয়া গেলেন। 

“স্বামী আমাদিগের বাড়ী হইতে প্রস্থান করিলে পর, পিতামাতা আমাকে তারাদিদির বাড়ী হইতে ডাকাইয়া আনাইয়া আমাকে সহস্ৰ গালি প্রদান করিলেন, ও পরিশেষে দুই এক ঘা প্রহার করিতেও ত্রুটি করিলেন না। রাত্রিবাসের নিমিত্ত তারাদিদি আমাকে তাহার গৃহে স্থান দিয়াছিল বলিয়া, তাহারও অপমানের কিছু বাকী রহিল না। পিতামাতা কর্তৃক এইরূপ অপমানিত হইয়া আমি মনে মনে স্থির করিলাম, আত্মহত্যা করিয়া পিতামাতার দুর্ব্বাক্য হইতে নিষ্কৃতি লাভ করিব; কিন্তু তারাদিদির পরামর্শে তাহা আর করিতে পারিলাম না। কেমন এক মোহিনীশক্তি অবলম্বন করিয়া তারাদিদি আমার মনের গতি ফিরাইয়া দিল। এই সময় হইতে তারাদিদির সহিত আমার প্রণয় জন্মিতে লাগিল। আমার বেশ অনুমান হইতে লাগিল যে, তারাদিদিও আমাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিয়াছে; সুতরাং আমিও প্রাণের সহিত তাহাকে ভালবাসিতে আরম্ভ করিলাম। এইরূপে রায় এক বৎসরকাল অতীত হইতে না হইতেই বঙ্গদেশ হইতে সংবাদ আসিল, আমার স্বামীর মৃত্যু হইয়াছে। আমি বিধবা হইলাম। 

“আমি বিধবা হইলাম সত্য; কিন্তু হিন্দু-বিধবার ধর্ম্ম কিছুই আমাকে প্রতিপালন করিতে হইল না। জানি না, তারদিদি আমার পিতামাতাকে কি বুঝাইয়া দিল, তাঁহার ও তারাদিদির কথা শুনিয়া তাহারই পরামর্শমত কার্য্য করিলেন। আমার পরিহিত শাড়ী বা অলঙ্কার প্রভৃতি কিছুই পরিত্যাগ বা পরিবর্ত্তন করিতে হইল না। সধবা অবস্থায় যেরূপ সাজে আমি সজ্জিত থাকিতাম, বিধবা অবস্থাতেও আমি সেইরূপ সাজে সজ্জিত থাকিতে লাগিলাম। 

“আমি বিধবা হইলাম সত্য; কিন্তু বৈধব্যযন্ত্রণা যে কি প্রকার, তাহার কিছুই অনুভব করিতে পারিলাম না। সধবাবস্থা ও বিধবাবস্থা উভয় অবস্থাই আমার পক্ষে সমান বোধ হইতে লাগিল। সধবা অবস্থায় আমার মনে যেরূপ সুখ বা দুঃখ ছিল, বিধবা অবস্থাতেও ঠিক সেইরূপই অনুভব করিতে লাগিলাম, তাহার কিছুমাত্র তারতম্য বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না। আহারীয় দ্রব্যের মধ্যে কেবল মৎস্য মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হইল, এবং একসন্ধ্যা ব্যতীত অন্নাহার করিতে পারিতাম না। তাহাও অতি সামান্য দিবসের নিমিত্ত; বোধ হয়, এক বৎসরের অধিক আমাকে সেই নিয়ম প্রতিপালন করিতে হয় নাই। 

“আমার সধবা অবস্থায় তারাদিদি আমাকে যেরূপ ভালবাসিত, বিধবা অবস্থায় যেন তাহার অপেক্ষা অধিক পরিমাণে ভালবাসিতে আরম্ভ করিল, এবং প্রাণের সহিত আমাকে যত্ন করিতে লাগিল। পরিশেষে এরূপ হইয়া উঠিল যে, আমাকে একদণ্ড না দেখিতে পাইলে সে অস্থির হইয়া পড়িত। আমারও ভালবাসা ক্রমে তাহার উপর বদ্ধমূল হইয়া আসিতে লাগিল। আমার মনের সুখ, আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা প্রভৃতি সমস্তই তারাদিদির নিকট বলিলে, মনে যেন সন্তোষের উদয় হইত, এবং তাহার কথা শুনিতে, তাহার নিকট উপদেশ ও পরামর্শ গ্রহণ করিতে মন যেন সৰ্ব্বদাই ব্যস্ত থাকিত। আমি তারাদিদির কথায় দিন দিন কেন এরূপ ভাবে বশীভূত হইয়া পড়িতে লাগিলাম, তাহা কিন্তু আমি নিজেই বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না, বা বুঝিবার চেষ্টাও করিলাম না। তারাদিদি যে কে, তাহার চরিত্রই বা কি প্রকার, তাহার একটু সংক্ষিপ্ত পরিচয় এই স্থানে প্রদান করা, বোধ হয়, নিতান্ত আবশ্যক। আমি তাহার চরিত্র সম্বন্ধে সমস্ত কথা অবগত না থাকিলেও যতদূর অবগত আছি, তাহাই এই স্থানে বর্ণন করিতেছি মাত্র। ইহাতেই আপনারা বুঝিতে পারিবেন, তারাদিদির চরিত্র কি প্রকার।” 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – তারাদিদির পরিচয় 

“তারাদিদি একজন বৈষ্ণবী, কিন্তু বৈষ্ণবের কন্যা কি না, জানি না। শুনিয়াছি, আমাদিগের গ্রামে পূর্ব্বে তাহার বাসস্থান ছিল না; বহুদিবস হইল, অপর কোন স্থান হইতে আসিয়া, এই স্থানে বাস করিতেছে। তারাদিদি এখন প্রবীণা স্ত্রীলোক; তাহার বয়ঃক্রম এখন পঞ্চাশ বৎসরের কম হইবে না। তাহার বর্ণ শ্যাম। নাক, চোখ, মুখ প্রভৃতি প্রায় সমস্ত অবয়বের গঠন মন্দ নহে। পরমা সুন্দরী না হইলেও, তাহার যৌবনকালে বোধ হয়, সে দেখিতে নিতান্ত মন্দ ছিল না। যৌবনকালে কিরূপ সাজ-সজ্জায় সে থাকিত, তাহা জানি না; কিন্তু আমি যে সময়ের কথা বলিতেছি, সেই সময়ে তাহার গলায় তুলসীর মালা, নাকে রসকলি ও হাতে হরিনামের ঝুলি প্রায় সৰ্ব্বদাই দেখিতে পাওয়া যাইত। মুখে হরিনাম সর্ব্বদাই লাগিয়া থাকিত। আমাদিগের বাড়ীর সংলগ্ন তাহার একখানি নিতান্ত সামান্য খড়ের ঘর ছিল। সেই গৃহখানি এরূপ ভাবে আমাদিগের বাড়ীর সহিত সংলগ্ন ছিল যে, যিনি না জানিতেন, তিনি সেই ঘর দেখিয়া কখনই মনে করিতে পারিতেন না যে, সেই গৃহখানি আমাদিগের বাড়ীর সামিল নহে। 

“আমি বাল্যকাল হইতেই তারাদিদির আচার-ব্যবহার ও চালচলন দেখিয়া আসিতেছিলাম, কখনও তাহার ইতরবিশেষ কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। কিন্তু ইদানীন্তনকালে তাহার কিছু ব্যতিক্রম হইতেছে বলিয়া বোধ হইতে লাগিল মাত্র। পূর্ব্বে তারাদিদি সময়ে সময়ে একটি ঘটা হস্তে ভিক্ষা করিতে বাহির হইত, এবং আমাদিগের সকলেরই বিশ্বাস ছিল, ভিক্ষাই তারাদিদির জীবনধারণের একমাত্র উপায়। কিন্তু এক্ষণে আর তাহাকে ভিক্ষায় গমন করিতে দেখিতে পাইতাম না; অথচ তাহার আহারাদির ব্যয়-নির্ব্বাহে কোনরূপ অনাটন হইতেছে, তাহাও বুঝিতে পারিতাম না। অধিকন্তু পূৰ্ব্বাপেক্ষা তাহার সাংসারিক অবস্থা যেন একটু ভাল হইয়াছে বলিয়াই বোধ হইত। 

“আমি তারাদিদির স্বামীকে কখনও দেখি নাই। শুনিয়াছি, তারাদিদির একটি বৈষ্ণব ছিল; কিন্তু আমার জন্মিবার বহুপূর্ব্বে সে নিরুদ্দেশ হইয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছিল। নিরুদ্দেশ হইয়া কেন সে দেশত্যাগী হয়, তাহার কারণ কেহই অবগত ছিল না, বা তারাদিদিকে জিজ্ঞাসা করিলেও, সে তাহার কোনরূপ পরিষ্কার উত্তর প্রদান করিত না। 

“তারাদিদি যদিও আমাদিগের বাড়ীর সংলগ্ন গৃহে বাস করিত, তথাপি গ্রামের ভিতর যেস্থানে কোনরূপ গোলযোগ উপস্থিত হইত, সেই স্থানেই তারাদিদিকে দেখিতে পাওয়া যাইত। গ্রামের স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে যেস্থানে কোনরূপ কলহ উপস্থিত হইত, সেই স্থানেই তারাদিদিকে সর্ব্বাগ্রে দেখিতে পাওয়া যাইত। যেস্থানে বিবাহ প্রভৃতি কোনরূপ শুভ কর্ম্মের সূচনা হইত, বিনা-আহ্বানে তারাদিদি সেই স্থানে গিয়া অগ্রেই উপস্থিত হইত। গ্রামের ভিতর বা গ্রামের সন্নিকটবর্ত্তী অপর কোন গ্রামে এরূপ কোন বিবাহই হয় নাই, যেখানে তারাদিদি সমস্ত রাত্রি বাসর ঘরে না কাটাইয়াছে। এক কথায়, তারাদিদি সকল স্থানেই ও সকল কৰ্ম্মেই থাকিত। তারাদিদিকে গ্রামের কেহই কোন বিষয়ে অবিশ্বাস করিত না; সকলেই বিশ্বাস করিত, এবং সকলের বাড়ীর ভিতরেই তারাদিদি তাহার ইচ্ছানুযায়ী গমনাগমন করিত। তারাদিদির বিপক্ষে কোন কথা আমরা কখনও শুনি নাই, বা ইতিপূর্ব্বে তাহার কোন দোষ আমরা স্বচক্ষে দর্শন করি নাই; কিন্তু আজকাল বৈষ্ণবদিগের ঘরে যে দোষের কথা প্রায়ই শুনিতে পাওয়া যায়, যৌবনে সেই দোষ হইতে তারাদিদি নিষ্কৃতি পায় নাই বলিয়া, সকলেই সন্দেহ করিত মাত্র। 

“আমি তারাদিদিকে প্রাণের সহিত ভালবাসিতাম ও অন্তরের সহিত বিশ্বাস করিতাম বলিয়াই, আমার মহাপাপের উৎপত্তি, এবং এই সর্বনাশের সৃষ্টি হইয়াছে! পরিশেষে সেই মহাপাপের শেষ ফলে আমার ইহ-জীবনের এই বীভৎস পরিণামও হইতে বসিয়াছে! 

“অনিয়মিত দিবস অতিবাহিত হইতে লাগিল, তারাদিদির সহিত আমার প্রণয় ততই ঘনীভূত হইতে লাগিল। এমন কি, সাংসারিক কার্য্য হইতে অবসর পাইলে আমি আর কোন স্থানে তিলার্দ্ধ বিলম্ব করিতে পারিতাম না, তাহারই নিকট গিয়া উপস্থিত হইতাম। আমি তারাদিদিকে যতদূর ভালবাসিতাম, তাহার ব্যবহার দেখিয়াও বোধ হইত, সে আমাকে তাহা অপেক্ষা অধিক ভালবাসে, এবং ততোধিক যত্ন করে। তারাদিদি যে কি নিমিত্ত আমাকে এত ভালবাসা দেখাইত, আর কেনই বা আমাকে এত যত্ন করিত, তাহার অর্থ তখন আমি কিছুমাত্র বুঝিতে পারিতাম না। তারাদিদির সহিত এতটা মেশামিশি করাতে আমার পিতামাতা যেন একটু রাগ করিতেন। সকল সময়েই তারাদিদির বাড়ীতে যাওয়া, তাঁহারা যেন ভালবাসিতেন না, ইহা আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম; কিন্তু পাছে আমি অসন্তুষ্ট হই, এই ভয়ে তাঁহারা আমাকে স্পষ্ট করিয়া কিছু বলিতেন না। আমিও তাহা বুঝিতে পারিয়া যেন বুঝিতাম না; সুতরাং তারাদিদির বাড়ীতে আমার যাতায়াতেও ব্যাঘাত হইত না। তারাদিদির বাড়ীতে সর্ব্বদা যাতায়াত করিবার নিমিত্ত পিতামাতা কেন যে মনে মনে অসন্তুষ্ট হইতেন, তাহার অর্থ কিন্তু আমি তখন কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিতাম না। 

“যে সময় আমি তারাদিদির বাড়ীতে গমন করিতাম, সেই সময় তাহার সহিত স্ত্রীলোক সম্বন্ধীয় কোন গল্প উপস্থিত হইলে বা কোনরূপ পুরাতন প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইলে, নানারূপ যুক্তিপূর্ণ উদাহরণ দিয়া সে আমাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিত যে, ‘পুরুষ ভিন্ন এ জগতে কোন স্ত্রীলোকের কোনরূপ সুখই হইতে পারে না এবং তাহার কোনরূপ উপায়ও হয় না। বৈষ্ণব-ধৰ্ম্ম-প্রচারক মহাত্মাগণ ইহার যথার্থ তত্ত্ব অবগত হইতে পরিয়াছিলেন, সেই নিমিত্তই তাঁহারা বিধি করিয়া দিয়াছেন, আপনার স্বামী পরলোক গমন করিলেও বৈষ্ণবকন্যাগণ অন্য পুরুষের আশ্রয় গ্রহণ করিতে পারে। ইহাতে তাহাদিগের অধর্ম্ম হয় না, বরং ইহকালে পরমসুখ ও পরকালে স্বর্গলাভ হইয়া থাকে।’ 

“সেই সময়ে আমার যেরূপ বয়ঃক্রম ছিল, এবং নিত্য নিত্য যেরূপ সংসারসুখে নিরাশ হইয়া পড়িতেছিলাম, তাহাতে প্রত্যহ তারাদিদির সেইরূপ ভাবের কথা শুনিতে শুনিতে আমারও মন যেন একটু কেমন কেমন হইতে লাগিল। “এই সময় আমার পিতামাতার সংসারে নিতান্ত টানাটানি হইয়াছিল। আমার নিজের কোন দ্রব্যাদির আবশ্যক হইলে তাহার নিমিত্ত সংসার হইতে একটিমাত্র পয়সা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তাবাদিদি ইহা জানিত; সুতরাং এই সময়ে সে আরও একটি নূতন উপায় বাহির করিয়া আমাকে আরও বশীভূতা করিতে সমর্থ হইল। আবশ্যকমত গামছাখানা, কাপড়খানা, টাকাটা সিকিটা ত আমাকে দিতেই লাগিল; তদ্ব্যতীত আমার পিতামাতাকেও সে সবিশেষরূপে সাহায্য করিতে আরম্ভ করিল। আমার পিতামাতা তারাদিদির নিকট হইতে সহজে সাহায্য গ্রহণ করিতে সম্মত না হওয়ায়, সে তাঁহাদিগকে এইরূপে বুঝাইয়াছিল, – ‘আমি এতদিবস পর্য্যন্ত ভিক্ষা করিয়া যাহা কিছু সংস্থান করিয়াছি, তাহা আমার নিকটেই আছে। কিন্তু আমি আর কতদিবস বাঁচিব, এবং আমার মৃত্যুর পরই বা আমার যাহা কিছু আছে, তাহা কে গ্রহণ করিবে? আপনারা ব্রাহ্মণ, বিশেষতঃ এখন আপনারা অত্যন্ত কষ্টে পড়িয়াছেন। আমি বৈষ্ণব, আমার প্রধান কর্তব্যকর্ম্ম কোনরূপে ব্রাহ্মণের সাহায্য করা। এই নিমিত্তই যথাসাধ্য আমি আপনাদিগকে সাহায্য করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। আপনাদিগের এইরূপ দরিদ্রাবস্থা যতদিবস থাকিবে, ততদিবস আপনাদিগের যাহা কিছু আবশ্যক হইবে, তাহা আমার নিকট হইতে গ্রহণ করুন। পরে যখন আপনাদিগের অবস্থার পরিবর্ত্তন হইবে, তখন যদি ইচ্ছা করেন, তাহা হইলে আমার নিকট হইতে এখন যাহা গ্রহণ করিতেছেন, তখন না হয়, তাহার হিসাব করিয়া আমাকে সমস্ত ফিরাইয়া দিবেন। 

“আমার বৃদ্ধ পিতামাতাকে এইরূপে তারাদিদি যাহা বুঝাইল, দুরবস্থায় পড়িয়া সংসার যাত্রানির্ব্বাহে কষ্ট পাইতেছিলেন বলিয়া, তাঁহারাও পরিশেষে তাহাই বুঝিলেন। এখন তারাদিদিই আমাদিগের সংসারের সমস্ত খরচ যোগাইতে লাগিল। এই সময় হইতে আমিও দিনরাত্রি অনবরত তারাদিদির বাড়ীতে গমনাগমন ও সেই স্থানে অবস্থিতি করিতে লাগিলাম। এই সময় হইতে সর্ব্বদা তারাদিদির বাড়ীতে যাতায়াত করিতেছি বলিয়া পিতামাতাকেও আর কোন প্রকার অসন্তেষের ভাব প্রকাশ করিতে দেখিলাম না। এইরূপে ক্রমে দিন অতিবাহিত করিতে আরম্ভ করিলাম তারাদিদির বদান্যতায় পিতামাতার অবস্থারও ক্রমে পরিবর্তন হইতে আরম্ভ হইল। তারাদিদির এত বদান্যতার প্রকৃত কারণ যে কি, তাহা আমি সেই সময় কিছুই বুঝিয়া উঠিতে সমর্থ হইলাম না; আমার পিতামাতাও তাহার কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – পাপের প্রথম সোপান। 

“একদিবস দুইদিবস করিয়া দেখিতে দেখিতে ক্রমে দুই মাস অতীত হইয়া গেল। একদিবস সন্ধ্যার সময় আমি তারাদিদির বাড়ীতে বসিয়া তাহার সহিত নানাপ্রকার হাসি-ঠাট্টা করিতেছি, এমন সময় সেই মায়াবিনী তাহার ভয়ানক মায়া প্রকাশ করিয়া আমাকে অভিভূতা করিল। সে কথায় কথায় আমার মনকে এরূপ বিমোহিত করিয়া তুলিল যে, সেই সময় আমি আমার হিতাহিত জ্ঞান হারাইলাম, ভালমন্দ বুঝিতে একবারে অসমর্থা হইয়া পড়িলাম। সেও আমার মনের বিকৃতি ভাব বুঝিতে পারিয়া, সময় বুঝিয়া একটি লজ্জাকর প্রস্তাবের অবতারণা করিল। বুঝিলাম, তাহার প্রস্তাবিত বিষয় আমার মতের সম্পূর্ণ বিপরীত; তথাপি, আমার আন্তরিক পূর্ণ-অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাহার খাতিরে সেই ঘৃণিত প্রস্তাবে কতক সম্মত হইলাম, সম্পূর্ণরূপে তাহা অনুমোদন করিতে পারিলাম না। মনে ভয়, একবারে অসম্মত হইলে পাছে তারাদিদি আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়, এবং আমাদিগের সংসারের খরচপত্র একবারে বন্ধ করিয়া দেয়। দ্বিতীয় দিবস তারাদিদি পুনরায় সেই প্রস্তাবের অবতারণা করিল। সেই দিবস আমার মনের ভাব আরও নরম হইয়া আসিল; কিন্তু একবারে সম্মত হইতে পারিলাম না। 

“ক্রমে যত দিন গত হইতে লাগিল, তারাদিদিও আমার মনের গতি ক্রমে তত পরিবর্তিত করিয়া আসিতে লাগিল। এইরূপে সপ্তাহকাল অতীত হইতে না হইতেই তারাদিদি আমার মনকে সম্পূর্ণরূপে তাহার আয়ত্তে আনিতে সমর্থা হইল। সপ্তম দিবসে তাহারই উত্তেজনায় আমি আমার মনকে কলুষিত করিলাম, পবিত্র হৃদয়কে অপবিত্র করিলাম, ক্ষণিক সুখে প্রবৃত্ত হইয়া চিরজীবনের নিমিত্ত নিত্যসুখে জলাঞ্জলি দিলাম! হায়! সেই আমার মহাপাতকের প্রথম সোপানে উত্থিত হইবার প্রথম দিন। এখন সেই দিন মনে করিলে, আমার হৃদয়ে ভয়ানক আতঙ্ক আসিয়া উপস্থিত হয়, বিষম অনুতাপ আসিয়া মনকে ভয়ানক যন্ত্রণা দেয়! সেই সময় তারাদিদির প্রলোভনময় বাক্যস্রোতে ভাসিয়া না গিয়া, যদি আমি আমার হৃদয়ের গতি রুদ্ধ করিতে পারিতাম, সর্ব্বনাশী কুহকিনীর প্রলোভনে না ভুলিতাম, তাহা হইলে কি আজ আমার এই দশা হইত! হতভাগিনী আমি, তাই আমি তখন বুঝিয়াও বুঝি নাই, সৰ্ব্বনাশী আমাদিগের নিমিত্ত কেন এত অর্থ জলের ন্যায় ব্যয় করিতেছে, আর কোথা হইতেও বা সেই অর্থরাশি প্রাপ্ত হইতেছে! 

“এই সময় আমি আমার জীবনের এক অধ্যায় শেষ করিয়া অন্য অধ্যায়ে প্রবেশ করিলাম। হৃদয়ের সমস্ত দুঃখ ও ভাবনা দূর করিয়া ‘মহাসুখে’নিবিষ্ট হইলাম। যাহাকে এখন আমি মহাদুঃখ বলিয়া জানিতে পারিয়াছি, তখন তাহাকেই মহাসুখ জ্ঞান করিয়াছিলাম। যাহাকে ভয়ানক বিষ বলিয়া এখন আমি বুঝিতে পারিতেছি, তখন তাহাকেই অমৃত বলিয়া মহাসুখে পান করিয়াছিলাম। যে সর্ব্বনাশী রাক্ষসীর কথায় আমার ইহকাল গিয়াছে, পরকাল নষ্ট হইয়াছে, যে মহাপাপের কথা কর্ণে প্রবেশ করিলে কঠোর প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন হয়, সে কথা সেই রাক্ষসীর মায়ায় সে সময় জানিতে পারি নাই। সেই হতভাগিনীর কথাকেই আমি প্রথমে বেদবাক্য সদৃশ জ্ঞান করিয়াছিলাম বলিয়াই, এখন আমার এই ভয়ানক দশা উপস্থিত হইয়াছে! ইহার পরে আরও যে কি হইবে, তাহা ভাবিতেও পারিতেছি না! 

“জীবনের অন্য অধ্যায়ে প্রবেশ করিবামাত্রই আমার মনের গতি পৃথক হইয়া গেল। তারাদিদিকে যেরূপ ভালবাসিতাম, তখন ‘আর একজনকে’ তাহা অপেক্ষা আরও ভালবাসিতে লাগিলাম। তারাদিদিকে কিয়ৎক্ষণ না দেখিতে পাইলে, মনের মধ্যে যেরূপ কষ্ট হইত, তখন আবার সেই ‘আর একজনকে’ না দেখিতে পাইলে, হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। কিন্তু সৰ্ব্বদা মনে ভয়, আমাদিগের লুক্কায়িত কাণ্ড সকল পাছে কেহ দেখিতে পায়, বা পাছে কেহ জানিতে পারে, অথবা আমার চরিত্রের উপর পাছে কেহ সন্দেহ করে। কিন্তু তারাদিদির এমনই কৌশল, এমনই নূতন নূতন উপায় উদ্ভাবনের ক্ষমতা যে, প্রায় এক বৎসরকাল আমি সেই ‘আর একজনের’ সহিত আমোদ আহ্লাদে বিভোর হইয়া দিনরাত্রি মহাসুখে অতিবাহিত করিতে লাগিলাম, তথাপি কেহই তাহার বিন্দুবিসর্গও জানিতে পারিল না। এমন কি, আমার পিতামাতা পর্যন্তও ঘুণাক্ষরে তাহার বিন্দুবিসর্গও বুঝিতে পারিলেন না। কিন্তু আমার এমনই অদৃষ্ট যে, এইরূপে একবৎসর অতিবাহিত হইতে না হইতেই আমায় সেই প্রাণের দিদির মৃত্যু হইল, এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে আমার অদৃষ্টও ভাঙ্গিয়া গেল। তারাদিদির যাহা কিছু ছিল, মৃত্যুকালে সে আমার পিতামাতাকেই তাহা দিয়া গেল। 

“তারাদিদির মৃত্যুর আট দশদিবস পর হইতেই আমার এত দিবসের সকল গুপ্তকথা ব্যক্ত হইতে আরম্ভ হইল। এক কাণ, দুই কাণ করিয়া আমার পাপের কথা সকলের কাণে কাণে ফিরিতে লাগিল; ক্রমে উহা আমার পিতামাতার কানে পৰ্য্যন্ত আসিয়া উপস্থিত হইল। কেবল যে পরের মুখে তাঁহারা আমার চরিত্রের কথা শুনিলেন তাহা নহে। একদিবস সন্ধ্যার পর তারাদিদির খালি বাড়ীতে আমি আমার সেই ‘আর একজনের’ সহিত অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপে উন্মত্তা আছি, এমন সময়ে আমার মাতা কিরূপে তাহা জানিতে পারেন, এবং পরিশেষে আমার পিতাকে ডাকাইয়া তিনি আমার সেই অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপ তাঁহাকে দেখাইয়া দেন। তিনি পূর্ব্বে লোক-পরম্পরায় যাহা শুনিয়া সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করিতে পারিতেছিলেন না, আজ তিনি তাহা স্বচক্ষে দেখিয়া একেবারে মর্মাহত হইলেন, এবং আমাকে সেই ‘আর একজনের’ সহিত হত্যা করিয়া এই ভয়ানক পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিবেন, ইহাই মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন। কিন্তু স্ত্রীহত্যা মহাপাপ, এই কথা তাঁহার মনে উদিত হওয়ায়, সহসা সেই কার্য্যে তিনি হস্তক্ষেপ করিয়া উঠিতে পারিলেন না। এদিকে ক্রমে অপত্য স্নেহ আসিয়া তাঁহার হৃদয় অধিকার করিতে লাগিল। 

“এই ঘটনার দুই চারিদিবস পরেই আমি জানিতে পারিলাম যে, আমার পিতামাতা আমার সমস্ত ব্যাপার স্বচক্ষে দেখিতে পাইয়াছেন। আরও বুঝিতে পারিলাম, আমার পিতার উদ্দেশ্য ভাল নহে; সুযোগ পাইলে, তিনি আমাদিগের উভয়ের প্রাণ নষ্ট করিতে কুণ্ঠিত হইবেন না। তখন মনে বড় ভয় হইল, প্রাণে মায়া জন্মিল, অথচ সুখের চরমসীমা দেখিতে ইচ্ছা হইল। তখন মনে মনে আর কোন উপায় স্থির করিতে না পারিয়া, সময়মত সকল কথা ‘তাহাকে’ কহিলাম। তখন ‘তিনিও’ তাঁহার দুস্কার্য্যের নিমিত্ত তাঁহার পিতামাতা, ভ্রাতা ভগিনী ও আত্মীয়-স্বজনের জ্বালায় জ্বালাতন, প্রতিবেশীদিগের কঠোর অত্যাচারে প্রপীড়িত; সুতরাং ‘তিনিও’অপর আর কোন উপায় স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। অগত্যা উভয়ে পরামর্শ করিয়া যাহা কিছু সংগ্রহ করিতে পারিলাম, তাহা লইয়া, পিতা, মাতা, আত্মীয়-স্বজন এবং গ্রামের মায়া পরিত্যাগ করিয়া, একদিবস রজনীতে উভয়েই গ্রাম হইতে বহির্গত হইলাম, ও ক্রমাগত সমস্ত রাত্রি চলিয়া অতি প্রত্যূষে একটি রেলওয়ে স্টেশনে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

“হায়! আমি প্রথমে বুঝিতে পারিয়াছিলাম না বলিয়াই, আমি আমার অমূল্য সতীত্বরত্ন হারাইয়াছিলাম! এবং পরিশেষেও বুঝিতে না পারিয়া, সামান্য প্রাণের মায়ায় মুগ্ধ হইয়া অকিঞ্চিৎকর সুখে মন মজাইয়া আত্মীয়-স্বজন ও স্বদেশ পর্য্যন্ত পরিত্যাগ করিয়াছিলাম! আমার দেশ পরিত্যাগ করিবার পূর্ব্বেই যদি আমার পাপের উপযুক্ত দণ্ড গ্রহণ করিতাম, পিতামাতা বা গ্রামের অপর কাহারও হস্তে যদি আমার প্রাণ বিসজ্জিত হইত, তাহা হইলে আজ আমি মহাসুখে আমার আত্মাকে সুখী করিতে পারিতাম! কখনও না কখনও আমার সেই প্রথম অবস্থার পাপ হইতে পরমেশ্বর আমার আত্মাকে মুক্তি প্রদান করিতেন; কিন্তু এখন আর আমার সে আশা নাই। আমার ভয়ানক ভয়ানক রাশি রাশি পাপের প্রায়শ্চিত্ত কোন জগতেই হইবে না।” 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – ক্ষণিক চিন্তা 

যে দিবস অতি প্রত্যূষে আমরা রেলওয়ে ষ্টেসনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম, সেইদিবস দিবা দশটার সময় আমরা রেলযোগে হাবড়া ষ্টেশনে আসিয়া উপনীত হইলাম। সেই স্থান হইতে একখানি ঘোড়ার গাড়ি করিয়া আমরা কলিকাতার ভিতর আগমন করিলাম। যেস্থানে আসিয়া আমাদিগের গাড়ি থামিল, সেই স্থানের নাম সেই সময় আমি জানিতাম না; কিন্তু পরে জানিয়াছিলাম, উহাকে সোণাগাছি বা সোণাগাজি কহে। আমরা গাড়ি হইতে অবতরণ করিয়া ইষ্টক-নির্ম্মিত একটি দ্বিতল বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম। উহার ভিতর গমন করিয়া যাহা দেখিলাম, তাহা পূৰ্ব্বে আমি আর কখনও দেখি নাই, বা কাহারও নিকট শ্রবণ করি নাই। 

“দেখিলাম, সেই বাড়ীর ভিতর উপরে ও নিম্নে ছোট বড় সতের আঠারখানি ঘর আছে। একখানি ঘর ব্যতীত সমস্ত ঘরগুলিই মনুষ্যের দ্বারা অধিকৃত। আমাদিগের দেশে যেরূপ নিয়মের বশীভূত হইয়া সকলে বসবাস করিয়া থাকেন, এ বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল, এখানে সে নিয়ম পালিত হয় না। বাটীর সেই সমস্ত ঘর যে পুরুষমানুষের দ্বারা অধিকৃত, বাড়ীর অবস্থা দেখিয়া তাহা কোনমতেই বোধ হইল না। বোধ হইল, প্রত্যেক ঘরই একটি একটি স্ত্রীলোকের আয়ত্তাধীন, এবং সেই সকল স্ত্রীলোক প্রত্যেকেই যেন স্বাধীনা, কেহ কাহারও কথার বশবর্তিনী নহে। তাহাদিগের মধ্যে ছোট বড় বুঝিবার উপায় নাই। কারণ, কেহ কাহাকেও সম্মান করে না, এবং কেহই একান্নবর্ত্তিনী নহে। অধিবাসী পুরুষের মধ্যে কেবল তথাকার অধিকাংশ স্ত্রীলোকেরই একটি একটি পশ্চিমদেশীয় বেহারা বা চাকর দেখিতে পাইলাম। 

“এইরূপ ব্যাপার দেখিয়া আমি তত অসন্তুষ্ট হইলাম না, বরং কিয়ৎ পরিমাণে আহ্লাদিতই হইলাম কারণ, তারাদিদির মৃত্যুর পর হইতেই আমি সৰ্ব্বদা একাকিনী থাকিতেই ভালবাসিতাম। নির্জ্জনে কেবল ‘তাহার’ সহিত আমোদ-প্রমোদ করা ব্যতীত পৃথিবীতে আমার অপর যে আর কোন সুখ আছে, তাহা আমার মনে স্থান পাইত না। 

“যে একখানি খালি ঘরের কথা আমি পূর্ব্বে বলিয়াছি, সেই ঘরের মধ্যেই আমার বাসস্থান নির্দিষ্ট হইল। ‘তিনি’ আমাকে সেই ঘরের ভিতর রাখিয়া আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া আনিবার নিমিত্ত বাজারে গমন করিলেন। যাইবার সময় একটি বয়স্কা স্ত্রীলোককে আমার নিকট দিয়া গেলেন। তিনি আমার নিকট আসিয়া উপবেশন করিলেন, এবং আমার সহিত নানাপ্রকার গল্প করিতে আরম্ভ করিলেন। ইহার বয়ঃক্রম পঞ্চাশ বৎসরের অধিক হইবে, কিন্তু হঠাৎ দেখিলে চল্লিশ বৎসরের কম বলিয়াই অনুমান হয়। ইহার বর্ণ গৌর, কলেবর স্থূল, হস্তে সোণার কয়েকগাছি চুড়ি, পরিধানে একখানি মিহি কাশির পাছাপেড়ে পরিষ্কার সাদা শাড়ী, নাকের উপর তিলক, হস্তে হরিনামের ঝুলি। পরে জানিতে পারিয়াছিলাম, ইনিই সেই বাড়ীর বাড়ীওয়ালী। 

“বাড়ীওয়ালী আমার নিকট কিয়ৎক্ষণ উপবেশন করিবার পরই, অন্যান্য ঘর হইতে এক এক করিয়া প্রায় সমস্ত স্ত্রীলোকই আমার নিকট আগমন করিল। উহাদিগের মধ্যে কেহবা গৌরাঙ্গী, কেহবা শ্যামাঙ্গী; কিন্তু সকলেই পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন, দুই একখানি সোনার অলঙ্কার এবং ধপে পরিষ্কার বস্ত্র সকলেই পরিধান করিয়াছিল। আমি উহাদিগের চালচলন, বেশভূষা, অঙ্গভঙ্গি প্রভৃতি দেখিয়া বিবেচনা করিলাম যে, ইহারাই সর্ব্বপ্রকার দুঃখ ও কষ্ট হইতে পরিত্রাণ পাইয়া পরমসুখে এই স্থানে বাস করিতেছে। 

“আমি কিরূপ দুঃখ ও কষ্টে পিতামাতার গৃহে বিধবা অবস্থায় বাস করিতেছিলাম, তাহার কিছু কিছু বিবরণ উহারা আমার নিকট শ্রবণ করিয়া কতই দুঃখ প্রকাশ করিতে লাগিল, এবং এখন আমি যাহাতে তাহাদিগের মত স্বাধীনা হইয়া তাহাদিগের ন্যায় সুখ-স্বচ্ছন্দে জীবনের অবশিষ্টকাল অতিবাহিত করিতে পারি, তদ্বিষয়ক কতপ্রকার যুক্তিপূর্ণ উপদেশ প্রদান করিতে লাগিল। 

“দেখিতে দেখিতে দিবা চারিটা বাজিয়া গেল, সেই সময়ে ‘তিনি’ বাজার হইতে ফিরিয়া আসিলেন। বাজার হইতে তিনি যে সকল দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া আপনার সঙ্গে করিয়া আনিলেন, তাহা দেখিয়া আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম। এক কথায়, আমার নূতন ঘর, তিনি অন্যান্য সকলের ঘরের ন্যায় দ্রব্যাদিতে সঞ্চিত করিয়া দিলেন। পালঙ্ক, বিছানা, বালিস, আলমারি, বাক্স, ছবি, কাঁচের বাসন, পিত্তলের বাসন, প্রভৃতি আসবাবে গৃহ পূর্ণ হইয়া গেল। আমার আর কোন দ্রব্যেরই অভাব রহিল না। সঙ্গে সঙ্গে আমার পরিচর্য্যার নিমিত্ত একজন ‘কাহার’ চাকরও নিযুক্ত হইল। 

“আমি আমার পিতামাতার বাড়ীতে যেরূপ দরিদ্রের মত থাকিতাম, যেরূপ কষ্টে দিন অতিবাহিত করিতাম, তাহার তুলনায় আজ আমি রাজরাণীর অবস্থায় প্রবেশ লাভ করিলাম। মনে আর সুখ ধরে না, হৃদয় যেন আহ্লাদে আটখানা হইতে লাগিল। কিন্তু সময় সময় আমার পিতামাতার দুঃখের অবস্থার সহিত আমার অবস্থার তুলনা করিয়া মনে কষ্ট পাইতাম; তবে সেরূপ কষ্টবোধ অতি অল্প সময়ের নিমিত্ত হইত। 

“সন্ধ্যা হইতে হইতেই সেই বাড়ীর অবস্থার পরিবর্তন হইতে আরম্ভ হইল। বাড়ীর সকলেই মনোহারিণী বেশভূষায় সুসজ্জিত হইয়া যেন নূতন রূপ ধারণ করিতে লাগিল। যিনি কৃষ্ণাঙ্গী, তিনি আর এখন কৃষ্ণাঙ্গী রহিলেন না, আপাদ-মস্তকে পাউডার মাখিয়া তিনিও এখন গৌরাঙ্গী হইয়া দাঁড়াইলেন। অলঙ্কারে সকলেই ভূষিতা হইলেন, যাহাদিগের সুবর্ণময় অলঙ্কার নাই, তাহারাও পিত্তলের অলঙ্কারে সেই স্থান পূর্ণ করিয়া দিলেন। সেই সকল অলঙ্কার এরূপ যন্ত্রের সহিত ব্যবহৃত হইয়া থাকে যে, যাহারা না জানেন, তাহারা উহা দেখিয়া হঠাৎ বলিতে সাহসী হয়েন না যে, উহা সুবর্ণ-নির্ম্মিত অলঙ্কার নহে। এইরূপে সুসজ্জিত হইয়া কেহবা উপরের বারন্দায়, কেহবা আপনার ঘরে ও কেহবা নীচের ঘরের জানালা খুলিয়া তাহার নিকট উপবেশন করিল। দিবাভাগে যেস্থান কেবলমাত্র স্ত্রীলোকের পুরী বলিয়া অনুমান হইতেছিল, এখন হইতে সেই স্থানে পুরুষের আগমন আরম্ভ হইতে লাগিল। কেহ পরিচিতের ন্যায়, কেহ অপরিচিতের ন্যায়, কেহ প্রকাশ্যে, কেহ অপ্রকাশ্যে, কেহ একাকী, কেহ বন্ধুবান্ধব সমভিব্যাহারে সেই বাটীর ভিতর প্রবেশ ও বাড়ি হইতে বহির্গত হইতে লাগিল। কোন ঘরে গীতবাদ্য, কোন ঘরে নৃত্যগীত, কোন ঘরে হাসিঠাট্টা ও কোন ঘরে মদ্যপানাদি চলিতে লাগিল। সকলেই যেন আমোদে বিভোর, আহ্লাদে গদ গদ; দেখিয়া বোধ হইতে লাগিল, সকলেই যেন অপার সুখে সুখী। এইরূপে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল। 

“প্রথম রাত্রিতে আমার এই সকল কিছুই ভাল লাগিল না; সমস্ত রাত্রির মধ্যে আমি আমার ঘরের বাহির হইলাম না। রাত্রিদিবসের পরিশ্রম হেতু আমরা উভয়েই অতিশয় ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছিলাম। সুতরাং স্থিরভাবে শয়ন করিয়া রহিলাম; কিন্তু ভালরূপে নিদ্রা হইল না, নানাপ্রকার চিন্তা আমার হৃদয়ে প্রবেশ করিয়া আমার নিদ্রার ব্যাঘাত জন্মাইতে লাগিল। কখনও আমার বৃদ্ধ পিতামাতার নিমিত্ত মন কাঁদিয়া উঠিতে লাগিল, তাঁহাদিগের যত্ন ও ভালবাসার কথা মনে উদিত হওয়ায়, চক্ষু দিয়া জলধারা বহিতে লাগিল। আবার পরক্ষণেই সে জলধারা বইয়া গেল, আমার উপর তাঁহাদিগের কঠোর ব্যবহারের কথা মনে আসিল, আমাকে তাঁহারা হত্যা করিতে চাহিয়াছিলেন বলিয়া, তাঁহাদিগের উপর আমার রাগ হইতে লাগিল। 

“কখনও ভাবিতে লাগিলাম, ইনি ত এখন আমাকে ঘরের বাহির করিলেন, আমাকে যথেষ্ট দ্রব্য-সামগ্রী ক্রয় করিয়া দিলেন; কিন্তু আমার উপর ইহার এখন যেরূপ ভালবাসা আছে, তাহা কি চিরস্থায়ী হইবে? যদি ইনি আমাকে কখনও পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে এই অপরিচিত স্থানে আমার কি দশা হইবে? তখন আমি কোথায় যাইব, এবং কাহার আশ্রয় গ্রহণ করিব? ঈশ্বর না করুন, যদি আমি কখনও কোন রোগগ্রস্ত হই, তাহা হইলেই বা আমার দশা কি হইবে? পিতামাতা ত আর আমাকে গ্রহণ করিতে পারিবেন না; হিন্দু-সমাজ ইহাতে কখনই সম্মতি প্রদান করিবেন না। আর যদি তাঁহারা লোকাপবাদ সহ্য করিয়া, সমাজের দিকে দৃষ্টি না রাখিয়া, বা আমার জীবনের উপর হস্তক্ষেপ না করিয়াও আমাকে গ্রহণ করিতে সম্মত হন, তাহা হইলেই বা আমি সেই স্থানে ফিরিয়া যাইব কোন্ মুখে? প্রতিবেশীর গঞ্জনা, পাড়ার মেয়েদের কাণাঘুষা, শত্রুপক্ষের বিদ্রুপবর্ষী আমোদ-আহ্লাদ আমি ত কখনই সহ্য করিতে পারিব না। স্নানের ঘাটে, বসিবার বৈঠকখানায়, পূজার মন্দিরে, চলিবার পথে, বিবাহের বাসরে, সভায়, মজলিসে, সকল স্থানেই আমার চরিত্রের কথা কাণে কাণে মুখে মুখে ফিরিবে। কেহ কেহবা আমাকে শুনাইয়া শুনাইয়া বলিবে, দেখাইয়া দেখাইয়া হাসিবে; কিন্তু ইহা ত আমি কোন প্রকারেই সহ্য করিতে পারিব না। আমার অদৃষ্টে যাহাই হউক না কেন, যখন ঘরের বাহির হইয়াছি, তখন আমি এই স্থানেই থাকিব। এ বাটীর সকলেই ত সুখে কালযাপন করিতেছে দেখিতেছি, তবে আমিই বা না পারিব কেন? এইরূপে নানাপ্রকার চিন্তা করিতে করিতে সেই রাত্রি অতিবাহিত হইয়া গেল।” 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ষোলকলা পূর্ণ 

“দ্বিতীয় দিবসে কিন্তু আর তত চিন্তা রহিল না, তৃতীয় দিবসে আরও কমিয়া গেল। এইরূপে দশ পনর দিবসের মধ্যে সমস্ত চিন্তাই আমার মন হইতে দূরে পলায়ন করিল; তবে হঠাৎ কখনও কখনও পিতামাতার চিন্তা আমার মনে উদিত হইত বটে; কিন্তু তাহাও জলবিম্বের মত তখনই আবার অগাধ আমোদ-সাগরে মিশিয়া যাইত। 

“এইরূপে দেখিতে দেখিতে ক্রমে তিন মাস অতীত হইয়া গেল। বাটীর সমস্ত লোকের সহিত আমার ভালবাসা জন্মিল, তাহাদের মত আদব-কায়দা, ভাবভঙ্গি, চালচলন প্রভৃতি সমস্তই শিক্ষা করিলাম। ধূমপান করিতে শিখিলাম, ক্রমে সুরাদেবীর আরাধনা করিতেও পরাজুখ হইলাম না। তখন ক্রমে দেবী আমার মস্তকে পদার্পণ করিয়া আমাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন, ও আমার উপর তাঁহার সম্পূর্ণ অধিকার বিস্তার করিয়া চিরদিনই আমার পূজা গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিলেন। 

“- তাঁহার’ সহিত তাঁহার অন্যান্য দুই একটি বন্ধুও ক্রমে আমার ঘরে আসিয়া বসিতে আরম্ভ করিলেন। আমি ভদ্রলোকদিগকে আমার সাধ্যমত যত্ন করিতে কোনক্রমেই ত্রুটি করিতাম না। সুতরাং আমার ঘরে যিনি একবার আসিতেন, তিনি আমার উপর কখন অসন্তুষ্ট হইতেন না। প্রথম প্রথম কিছুদিবস তাঁহার কোন বন্ধুই তাঁহার অবর্তমানে আমার ঘরে আসিতেন না; কিন্তু যখন তাঁহারা আসিতেন, আমাদিগের দুই চারি টাকা মদ্যপানাদিতে খরচ না করাইয়া তাঁহারা প্রতিগমন করিতেন না। বলা বাহুল্য, সেই সমস্ত খরচই আমার ‘তিনি’ প্রদান করিতেন। এ নিয়ম কিন্তু বহুদিবস থাকিল না। ক্রমে সময়ে, অসময়ে, রাত্রিকালে ও দিবাভাগে তাঁহার সহিত একত্র, কখনও বা পৃথক, অর্থাৎ যখন ইচ্ছা তখনই তাঁহারা আমার ঘরে আসিতে আরম্ভ করিলেন। ইহাতে আমারও কোন প্রতিবন্ধক রহিল না; অধিকন্তু, একাকী কেহ কোন সময়ে আমার ঘরে আগমন করিলে, তাহা আমি কোনরূপেই অপরের কর্ণ গোচর হইতে দিতাম না। এই সময় তাঁহারা ‘তাঁহাকে’লুকাইয়া আমাকে কিছু কিছু প্রদান করিতেও পরাঙ্মুখ হইতেন না; আমি তাহা গ্রহণ করিতে কোনপ্রকার আপত্তি করিতাম না। 

“এইরূপে একবৎসরকাল অতীত হইতে না হইতেই আমি যাহা কখন স্বপ্নেও ভাবি নাই, তাহাই হইল। যদিও এখন অনেকেই আমার সহায় হইয়াছিলেন, তথাপি আমার প্রধান এবং যাঁহাকে আমি আন্তরিক একটুও ভালও বাসিতাম, ‘তিনি’ আমাকে পরিত্যাগ করিলেন; বিসূচিকা রোগে হঠাৎ ‘তাঁহার’মৃত্যু হইল। ইহাতে আমার মনে অতিশয় কষ্ট হইল বটে, কিন্তু সে কষ্ট অধিকক্ষণ স্থায়ী হইল না, অবিরত সুরাপান ও অপরের সহিত আমোদ-প্রমোদ করিয়া সেই কষ্টকে আমার মন হইতে সহজেই দূরীকৃত করিতে সমর্থ হইলাম। 

“হায়! তখন আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝিতে পারিয়াছিলাম না যে, আমি দিন দিন কেবল পাপকেই প্রশ্রয় দিতেছি। পাপের কুহকিনী মায়ায় ভুলিয়া তাহাকেই সুখ জনক জ্ঞান করিতেছি, এবং নিত্য নিত্য সেই পাপের তলস্পর্শ সমুদ্রের ভিতর অলক্ষিত ভাবে ক্রমে ক্রমে প্রবিষ্ট হইতেছি। 

“আমি যদিও বিধবা; কিন্তু পূর্ব্বে স্বামীসহবাস আমার অদৃষ্টে ঘটে নাই। যদিও আমি ধর্ম্মের মস্তকে পদাঘাত করিয়াছিলাম, কিন্তু এ পর্যন্ত আমাকে কেহ দ্বিচারিণী বলিতে পারিত না। যদিও আমিও অন্য পুরুষের সহিত আমোদ-আহ্লাদ করিতাম, যদিও তাহাদিগের সহিত কখনও সর্বসমক্ষে, কখনও বা নিৰ্জ্জনে বসিয়া একত্র সুরাপান ও আমোদ-আহ্লাদ করিতে কোনরূপে কুণ্ঠিত হইতাম না, তথাপি সেই একজন ভিন্ন অন্য কাহাকেও এ পর্যন্ত কোন ভাবে আমার হৃদয়ে স্থান প্রদান করি নাই; কিন্তু এখন আমার মহাপাপের পরিণাম স্মরণ করিয়া হৃদয়ে ভয়ানক আতঙ্ক আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে! আর পাপমুখে এখন আমার বলিতেও লজ্জা হইতেছে যে, ‘তাঁহার’ মৃত্যুর পর, আর আমার কিছুই বাকী রহিল না! ক্রমে ক্রমে আমি দ্বিচারিণী, ত্রিচারিণী ও বহুচারিণী হইয়া পড়িলাম। 

“উঃ! প্রথম অবস্থায় বুঝিতে না পারিয়া, আমি কি ভয়ানক কার্য্যই করিয়াছিলাম! হে জগদীশ্বর! এই বিধবা হিন্দু-রমণীর সেই মহাপাপের ভয়ানক যন্ত্রণা হইতে কি কখনও পরিত্রাণ নাই; হে জগৎপিতা! আমি শুনিয়াছি যে, আপনার নিকট সকলেরই ক্ষমা আছে, সকল পাপীকেই আপনি পাপানুযায়ী ক্ষমাও করিয়া থাকেন; কিন্তু জগদীশ! আমি নিজেই বুঝিতে পারিতেছি, আমার দ্বারা যে সকল মহাপাপের অবতারণা হইয়াছে, সেই সকল পাপের কোনপ্রকার ক্ষমা নাই। আমার ন্যায় মহাপাপিনী যদি ক্ষমাযোগ্য হইবে, তাহা হইলে এই জগতে প্রকৃত মহাপাপীর দণ্ড আর কে সহ্য করিবে? সর্বনিয়ন্তা! আপনি যদি আমাকে উপযুক্ত দণ্ড প্রদান না করিবেন, ভয়ানক নরক-যন্ত্রণায় যদি আমাকে দগ্ধীভূত না করিবেন, তবে আর কাহার নিমিত্ত সেই সকল দণ্ডের সৃষ্টি! আমা অপেক্ষা অধিকতর পাপী এ জগতে আর কে হইতে পারে?” 

সপ্তম পরিচ্ছেদ – সুখের ঢেউ 

“আমি পূর্ব্বে একবার ভাবিয়াছিলাম, যদি তিনি আমাকে পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে আমার দশা কি হইবে। কিন্তু এখন দেখিলাম, তাঁহার মৃত্যুর পরও আমার কোনরূপ কষ্ট হইল না, বরং আমার সুখেরই বৃদ্ধি হইতে লাগিল। সম্পদলক্ষ্মী আসিয়া যেন আমাকে আশ্রয় করিতে লাগিলেন। 

“পূৰ্ব্ব হইতেই সোণাগাছি অঞ্চলে জনরব উঠিয়াছিল যে, একটি সুরূপা স্ত্রীলোক ঘর হইতে নূতন বাহির হইয়া আসিয়াছে, এবং সেই সময় হইতেই সোণাগাছি-ভ্রমণকারী অনেক বাবুই আমার নিকট আসিয়া, আমার সহিত প্রেমালাপ করিবার নিমিত্ত সবিশেষরূপ চেষ্টা করিয়া আসিতেছিলেন। কিন্তু এতকাল পর্য্যন্ত তাঁহাদিগের মধ্যে কোন ব্যক্তিই তাঁহাদের বাসনা পূর্ণ করিয়া উঠিতে সমর্থ হন নাই। এখন তাঁহাদিগের আশাপথ প্রশস্ত হইল, আমারও অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন হইল। এখন হইতে রাত্রিদিন আমার ঘরে আমোদ-প্রমোদ চলিতে লাগিল, সুখের তরঙ্গের সঙ্গে সঙ্গে সুরার ঢেউ বহিতে লাগিল। প্রত্যেকেই মনে করিতে লাগিলেন, আমি যদিও কলিকাতার বেশ্যামণ্ডলীর রীত্যনুসারে সকলের সহিত প্রকাশ্যে আমোদ-আহ্লাদ করিয়া থাকি, কিন্তু অন্তরে তাঁহাকে ভিন্ন আর কাহাকেও জানি না। ফলতঃ যাঁহারা আমার ঘরে আসিতেন, তাঁহারা সকলেই আমার মুখের মিষ্ট কথায় ভুলিতেন; কিন্তু আমার অন্তরের ভাব কেহই বুঝিয়া উঠিতে পারিতেন না। ক্রমে তাঁহারা আপনার আশাকে নিবৃত্ত ও লালসাকে চরিতার্থ করিয়া, আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিতে লাগিলেন; আমাকে আমার আশাতিরিক্ত অর্থ সাহায্য করিতেও কেহ কুণ্ঠিত হইলেন না। 

“এইরূপ উপায়ে ক্রমে ক্রমে আমার যথেষ্ট সঙ্গতি হইতে লাগিল; সোণায় আমার অঙ্গ ঢাকিয়া গেল। নাকে, কাণে বড় বড় সাদা সাদা মুক্তা ঝুলিতে লাগিল; অঙ্গুলিতে ও কোন কোন সুবর্ণময় অলঙ্কারের মধ্যে সাদা, লাল, সবুজ প্রভৃতি বর্ণের বড় বড় পাথর ঝমক্‌ করিতে লাগিল। অধিক কি, কলিকাতার ভিতর নিজের একখানি বড়গোছের তেতালা বাড়ীও হইল; উহার দরজায় ছিটের মির্জাই আঁটা, লাল পাকড়ী বাঁধা, দুইজন দ্বারবানও বসিল, এবং বাটীর ভিতর চারি পাঁচজন দাসদাসীও ঘুরিতে লাগিল। এক কথায়, এখন আমার সম্পদ দেখে কে, আমার অলঙ্কারের সম্মুখে দাঁড়ায় কে? এবং আমার বাটীর ভিতর সহজে আসেই বা কে? আমি আর কাহাকেও তোষামোদ করি না, কড়া কথা ভিন্ন আর কাহাকেও মিষ্ট কথা বলি না, এবং যে সে ব্যক্তি আসিয়া আমার বিছানায় বসিতেও পারে না; তথাপি আমার পসারের কিছুমাত্র ক্ষতি না হইয়া, ক্রমেই বৃদ্ধি হইতে লাগিল। 

“এইরূপে প্রায় দশ পনর বৎসর অতীত হইয়া গেল; যৌবন জোয়ারে ভরা নদীর উপর সুখের ঢেউ বহিতে লাগিল। মনে করিলাম, পূর্ণ জোয়ারে এইরূপ চিরকাল সাঁতার দিব, সুখের তরঙ্গে এইরূপ হেলিতে দুলিতে জীবন-নদী পার হইব। 

“যখন আমার জীবনে এইরূপ সুখের তরঙ্গ উঠিতেছে, সেই সময় কালীবাবু নামক একটি বাবুর সহিত আমার বড়ই প্রণয় জন্মিয়াছিল। কালীবাবু বড় লোক ছিলেন না, গরিবের ছেলে, সামান্য দালালী করিয়া আপনার জীবিকা নির্ব্বাহ করিতেন; কিন্তু দেখিতে অতি সুপুরুষ ছিলেন। একদিবস একটি বাবুর সহিত তিনি সর্বপ্রথম আমার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, আমিও সেইদিবস তাঁহাকে প্রথম দেখিয়াছিলাম; কিন্তু তাঁহাকে যে কি ক্ষণে দেখিয়াছিলাম, তাহা বলিতে পারি না। সেই প্রথম দর্শনই আমার সর্ব্বনাশ করিয়াছিল। সেইদিবস হইতেই কালীবাবুর যে ছায়া আমার হৃদয়পটে অঙ্কিত হইয়াছিল, সে ছায়া আর কখনও আমার হৃদয় হইতে অন্তর্হিত হইল না; বরং ক্রমেই উহা আমার হৃদয়ের স্তরে স্তরে প্রবেশলাভ করিল। ক্রমে কালীবাবুর উপর আমার এরূপ হইয়া উঠিল যে, একে মুহূর্ত্তের নিমিত্তও আমি তাঁহাকে আমার নয়নের অন্তরাল করিতে পারিতাম না। অতি অল্প সময়ের নিমিত্তও তিনি কোন স্থানে গমন করিলে, আমার হৃদয় ব্যাকুল হইয়া পড়িত, মন অস্থির হইত; যতক্ষণ তিনি প্রত্যাবর্তন না করিতেন, ততক্ষণ কোনক্রমেই সুস্থ হইতে পারিতাম না। কালীবাবু যে দালালী কার্য্য করিতেন, ক্রমে তাঁহার সেই দালালী কার্য্য করা বন্ধ করিয়া দিলাম। ইতিপূর্ব্বে কালাবীবু কখনও আমাকে এক পয়সা প্রদান করেন নাই, এখন তাঁহার নিজের সমস্ত খরচপত্র পর্যন্ত আমি বহন করিতে লাগিলাম। কেবল তাহা নহে, তাঁহার পরিবারের খরচের নিমিত্তও আমি প্রত্যেক মাসে তাঁহাকে কিছু কিছু পাঠাইয়া দিতে লাগিলাম। কালীবাবুও অন্য কর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়া রাত্রিদিন আমার নিকট থাকিতে লাগিলেন, এবং আমারই হৃদয়ের উপর তাঁহার নিজের কর্তৃত্ব স্থাপন করিয়া পরম সুখে দিনযাপন করিতে লাগিলেন। 

“ক্রমে কালীবাবুই আমার সর্ব্বময় কর্তা হইয়া পড়িলেন। দেনা-পাওনার হিসাব, খরচের টাকা, আলমারি-বাক্সের চাবি প্রভৃতি সমস্তই ক্রমে তাঁহার হস্তে পড়িল। আমার নিজের খরচপত্র প্রভৃতিও সমস্তই তাঁহারই ইচ্ছামত হইতে লাগিল। এইরূপে কিছুদিবস অতীত হইয়া গেল।”

অষ্টম পরিচ্ছেদ – ভাঁটার টান 

‘এইরূপে দুই তিন বৎসর অতীত হইয়া গেল। কালীবাবুর উপর আমার এইরূপ ভালবাসা দেখিয়া অপরাপর সকলে আমার বাড়ীতে আসা একবারে প্রায় বন্ধ করিয়া দিলেন। সুতরাং আমার পূর্ব্বসঞ্চিত অর্থের উপর ক্রমে হস্ত পড়িতে লাগিল। কারণ, যদি কোন অপরিচিত ব্যক্তি হঠাৎ আমার বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইতেন, তিনিও সৰ্ব্বদা কালীবাবুকে আমার নিকট দেখিয়া আস্তে আস্তে আমার বাড়ী পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইতেন, পুনরায় তাঁহাকে আর কখনও দেখিতে পাইতাম না। এদিকে কালীবাবুও আমার উপর এরূপ ভাবে একাধিপত্য স্থাপন করিয়াছিলেন যে, আমি আর কাহারও সহিত কোনরূপ আমোদ-আহ্লাদে প্রবৃত্ত হইলে তিনি আর তাহা সহ্য করিতে পারিতেন না। যে কার্য্য করিলে কালীবাবুর অন্তঃকরণে কষ্ট হয়, সেই সকল কার্য্য করিতে আমারও মনোকষ্ট হইত। সুতরাং সহজেই আমাকে সেই সকল কার্য্য হইতে বিরত হইতে হইত। সম্পূর্ণরূপ আন্তরিক ইচ্ছার সহিতই আমি যে সেই সকল কাৰ্য্য হইতে বিরত হইয়াছিলাম, তাহা নহে। কারণ, এখন আর আমার সে বয়স ছিল না, সে চেহারা ছিল না, সে দিনও ছিল না, সে সমস্তই ক্রমে ক্রমে আমাকে পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গিয়াছিল। যাঁহারা আমাকে প্রণয়ের চক্ষে দেখিতেন, এখন আর তাঁহারা আমাকে সে চক্ষে দেখিতেন না। যাঁহারা আমাকে পূর্ব্বে অন্তরের সহিত যত্ন করিতেন, এখন আর তাঁহারা আমাকে সেরূপ ভাবে যত্ন করিতেন না। আমার নিমিত্ত যাঁহারা জলের মত অর্থ ব্যয় করিয়া আসিয়াছিলেন, এখন তাঁহারা আমার জন্য একটিমাত্র টাকা ব্যয় করিতে কুণ্ঠিত হইতেন। যাঁহারা আমা কর্তৃক অবমানিত এবং তাড়িত হইয়াও রাত্রিদিন আমার গৃহে পড়িয়া থাকিতেন, এখন সাধ্যসাধনা করিলেও, তাঁহারা আর আমার বাটীর নিকট দিয়া গমন করিতেন না। এখন আমার আশা ভরসার মধ্যে কেবলমাত্র কালীবাবু; সম্পদ বিপদের সময়ও তিনি। সুতরাং তিনি যাহাই করুন না কেন, বা যাহাই বলুন না কেন, আমি তাঁহাকে কোন কথা বলিতাম না। 

“বিনা-আয়ে বসিয়া বসিয়া ব্যয় করিলে, কুবেরের ভাণ্ডারও ক্ষয় হইয়া যায়, আমি কোন ছার! আমার সমস্ত অর্থ যেরূপ জোয়ারের মত আসিয়াছিল, এখন ভাঁটার মত চলিয়া যাইতে লাগিল। আমার এবং কালীবাবুর সেই পূর্ব্বের মত আহারের নিমিত্ত খরচ, সেই পূর্ব্বের মত পরিচ্ছদ, ও সেই পূর্ব্বের মত পরিচ্ছদ, ও সেই পূর্ব্বের মত সুরাপানের কিছুমাত্র হ্রাস না পাইয়া, এখন বরং বৃদ্ধিই হইতে লাগিল। তাহার উপর কালীবাবুর দেশে তাহার পরিবারের খরচ আছে; এখানকার নাচ-থিয়েটার আছে; গাড়ীঘোড়া আছে; বাবুগিরি আছে। বিনা- আয়ে এই সকল ব্যয় হইতে থাকিলে, সঞ্চিত অর্থ আর কতদিবস থাকিবে? ক্রমেই তাহার হ্রাস হইয়া আসিতে লাগিল। 

“সেই সময়ে কালীবাবুর দেশ হইতে এক পত্র আসিল যে, তাঁহার স্ত্রী ভয়নাক পীড়িতা, মৃত্যু শয্যায় শায়িতা; মৃত্যুকালে কালীবাবুকে একবার জন্মশোধ দেখিতে তাঁহার নিতান্ত ইচ্ছা। এইরূপ পত্র পাইয়াও কালীবাবু আমাকে ছাড়িয়া যাইতে চাহিলেন না। তিনি প্রায় চারি বৎসর দেশে যান নাই। তাঁহার একটা পুত্র-সন্তানও হইয়াছে, এখন তাহারই বয়ঃক্রম প্রায় সাড়ে তিন বৎসর হইবে। তিনি এ পর্যন্ত তাঁহার সেই পুত্রের মুখও দেখেন নাই। আমি কালীবাবুকে অনেক বুঝাইলাম; তাঁহার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁহার মত করাইলাম, এবং কিছু খরচের টাকা দিয়া তাঁহাকে সাতদিবসের জন্য দেশে পাঠাইয়া দিলাম। আমিও তাঁহার সহিত ষ্টেশন পর্য্যন্ত গমন করিয়া তাঁহাকে রেলে উঠাইয়া দিয়া আসিলাম। কিন্তু গাড়ি না ছাড়িতে ছাড়িতেই আমার মন অস্থির হইতে লাগিল, তাঁহাকে দেখিতে ইচ্ছা হইতে লাগিল। তিনি গমন করিলে পর, মনের কষ্টে দিন কাটাইতে লাগিলাম। কিন্তু সাতদিবস আর আমাকে কষ্টভোগ করিতে হইল না, পঞ্চম দিবসে কালীবাবু তাঁহার সেই পুত্রটির সহিত আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহার নিকট জানিতে পারিলাম, দুইদিবস হইল, তাঁহার স্ত্রীর মৃত্যু হইয়াছ। তাঁহার আর কেহ না থাকায়, তাঁহার যাহা কিছু ছিল, সমস্ত বিক্রয় করিয়া, আপন পুত্রটির সহিত এখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। 

“কালীবাবুর সেই পুত্রটির নাম হরি। হরি দেখিতে তাহার পিতা অপেক্ষাও সুশ্রী, এবং তাহার কথাগুলি অতিশয় মিষ্ট ও সুখশ্রাব্য। আমার সন্তান-সন্ততি জন্মে নাই; সন্তানের যে কি মোহিনী মায়া, তাহা আমি এতদিবস জানিতাম না; এতদিন পুত্র-স্নেহ আমার হৃদয়কে অধিকার করিতে পারে নাই। কিন্তু পরের পুত্রের নিমিত্ত এখন আর আমার তাহাও বাকী রহিল না; হরিকে আমি আমার পুত্রের মত দেখিতে লাগিলাম। ক্রমে ক্রমে তাহাকে অতিশয় ভালবাসিতে লাগিলাম, তাহাকে খাওয়াইলে-পরাইলেই আমার মনে সুখবোধ হইত। রাত্রিদিন তাহাকে আমার নিকটেই রাখিতাম, মুহূর্ত্তের নিমিত্ত চক্ষুর অন্তরাল করিতাম না। এইরূপে আরও কিছুদিন কাটিয়া গেল। 

“কিছুদিন কাটিল সত্য, কিন্তু আমার সঞ্চিত অর্থ যাহা কিছু ছিল, সমস্তই নিঃশেষিত হইয়া গেল! দাসদাসীগণকে জবাব দিলাম, দ্বারবানকে বিদায় করিলাম। ইহাতেও কিন্তু আমার সবিশেষ কিছু সুবিধা হইল না; ক্রমে ক্রমে দুই একখানি করিয়া গহনাগুলিও বন্ধক পড়িতে লাগিল। এই সময় কালীবাবু পুনরায় তাঁহার পূর্ব্বের সেই দালালী কাৰ্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু সময়ের স্রোত একবার চলিয়া গেলে, সেই স্রোত পুনরায় আর ফিরে না। এতদিবসের পরে কালীবাবু তাঁহার সেই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন সত্য, কিন্তু আর কিছুই করিয়া উঠিতে পারিলেন না। তখন তিনি আর কোনরূপ উপায় না দেখিয়া, জুয়াচুরির নানা উপায় বাহির করিলেন, এবং সেই উপায় অবলম্বনেই আমাদিগের সমস্ত ব্যয় নির্ব্বাহ হইতে লাগিল। এই কার্য্যের নিমিত্ত তাঁহার একজন সহকারীর প্রয়োজন হইল; তিনি তাহাও পাইলেন। সে আর কেহই নহে, এই দুরাচারিণী, মহাপাপকারিণী, মায়াবিনী রাক্ষসীই তাঁহার সহায় হইল। তাঁহার ইচ্ছামত আমি সকল দুষ্কার্য্যই করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। 

“কালীবাবু তখন নব্য ইয়ার ছেকারার দলে মিশিলেন; তাহাদিগকে জুটাইয়া আমার বাটীতে আনিতে লাগিলেন। আমার বাটীতে সেই সময় একটি ছোটখাট মদ্যালয় স্থাপিত হইল। যিনি পিতামাতাকে লুকাইয়া পাপের প্রথম দ্বারে উঠিতে ইচ্ছা করিতেন, কালীবাবু তাঁহাকেই আমার বাড়ীতে লইয়া আসিতেন। অধিক রাত্রিতে যাঁহার মদ্যপানের লালসা বলবতী হইত, তিনিই আমার বাড়ীতে পদার্পণ করিতেন। কিন্তু একদিবস যিনি আসিতেন, পরদিবস আর তাঁহাকে দেখিতে পাইতাম না। তিনি যতদিবস বাঁচিতেন, আমার বাটীর নিকটবর্ত্তী আর হইতেন না; অধিকন্তু, তাঁহার বন্ধুবান্ধবকে আমার চরিত্রের কথা বলিয়া সতর্ক করিয়া দিতেন। কেন যে তাঁহারা আমার বাড়ীতে আসিতেন না, এবং অপরকে আসিতে বারণ করিতেন, তাহার কারণ বলিতেছি, শুনুন। 

“যিনি আমার বাড়ীতে মদ্যপান করিতে আসিতেন, তাঁহারই খরচে মদ্য আনীত হইত; ইহাতেও কিছু লাভ করিতাম। যিনি অধিক রাত্রিতে মদ্যপান করিতে আসিতেন, তাঁহাকে আমার ঘরের সঞ্চিত মদ্যই দিতাম। তাহাতে সিকি মদ ও বার আনা জল থাকিত; তিনি তাহাই গ্রহণ করিতেন। কারণ, অধিক রাত্রিতে আর কোন স্থানে মদ্য পাওয়া যাইত না। তখন সকলে একত্র উহা পান করিতাম। কালীবাবু সেই সঙ্গে মদ্য পান করিতেন, এবং ঘন ঘন চুরট টানিতেন। অন্য সময় কালীবাবু অধিক পরিমাণে চুরট খাইতেন না; কিন্তু মদ্যপানের সময় এত অধিক পরিমাণে চুরট খাওয়ার সবিশেষ কারণ ছিল। যাঁহারা কখন ঠকিয়াছেন বা শুনিয়াছেন, তাঁহারাই তাহা বুঝিতে পারিবেন; কিন্তু অন্যে সহজে তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিবেন না বলিয়াই, তাহার কিঞ্চিৎমাত্র আভাস আমি এই স্থানে প্রদান করিতেছি। “চুরটের ছাই অতি অদ্ভুত দ্রব্য। মদ্যের সহিত সেই ছাই মিশ্রিত হইলে যে কিরূপ ভয়ানক নেশা হয়, তাহা বোধ হয়, অনেক মাতালই জানেন। কালীবাবু সেই সুরাপান-অভিলাষী ব্যক্তিগণকে তাঁহাদিগের অজ্ঞাতসারে মদ্যের সহিত সেই ছাই মিশাইয়া খাওয়াইতেন। ইহাতে তাহাদিগের অতিশয় নেশা উপস্থিত হইত, তাঁহারা একবারে অজ্ঞান হইয়া পড়িতেন। তখন আমরা উভয়ে তাঁহাদিগের নিকট যাহা কিছু থাকিত, সমস্তই অপহরণ করিয়া তাঁহাদিগকে বাড়ীর বাহির করিয়া দিতাম। তখন তাঁহারা অচেতন অবস্থায় পথে দুই এক পদ অগ্রসর হইলেই পড়িয়া যাইতেন, এবং পরিশেষে পুলিস কর্তৃক থানায় নীত হইয়া আপন আপন পাপের পরিণাম ফল দর্শন করিতেন। ভদ্রলোকের সন্তান বুঝিতে না পারিয়া, পিতামাতাকে লুকাইয়া এক কৰ্ম্ম করিতে গিয়া, তাহার যথেষ্ট সাজা পাইলেন, এই অপমানে তাঁহারা অতিশয় লজ্জিত হইতেন। তাহার উপর আবার বেশ্যাবাড়ী যাওয়ায় যে তাঁহাদিগের সমস্ত দ্রব্য অপহৃত হইয়াছে, এ কথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে পারিতেন না, মনের যন্ত্রণা মনেই নিবৃত্ত করিতেন। তবে যে সকল ব্যক্তির হিতাহিত জ্ঞান নাই, মান-অপমানের ভয় নাই, ভালমন্দ বিচারের ক্ষমতা নাই, তিনি পাপ কথার কিছুমাত্র লুকাইতেন না; প্রকাশ্যে পুলিসের নিকট নালিস করিতেন যে, তাঁহার সমস্ত দ্রব্য চুরি গিয়াছে; তিনি যে সময় পুলিস কর্তৃক থানায় আনীত হন, সে সময় তাঁহার কিছুমাত্র হুঁস ছিল না। যখন বেহুঁস অবস্থায় প্রকাশ রাস্তায় পড়িয়াছিলেন, তখন কে তাঁহার দ্রব্য চুরি করিল, বা তিনি কোথায় ফেলিয়া দিলেন, ইহার কিছুমাত্র স্থির না হওয়ায়, সে বিষয়ের আর অধিক উচ্চবাচ্য হইত না; সুতরাং আমাদের উপর আর কেহই সবিশেষ সন্দেহ করিতেন না। তবে যদি কেহ আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিতেন, তাহা হইলে আমাদিগের বাড়ীতে তাঁহার আসার বিষয় একবারেই অস্বীকার করিতাম; কখনও বা স্বীকার করিয়া বলিতাম, যখন তিনি চলিয়া গিয়াছেন, তখন তিনি সম্পূর্ণরূপ মাতাল ছিলেন না, এবং সমস্ত দ্রব্যই তাঁহার নিকটে ছিল। 

“এইরূপে আমি আমার বাড়ীতে আগত লোকদিগকে ঠকাইয়া, তাহাদিগের দ্রব্যাদি চুরি করিয়া, কিছুদিবস অতিবাহিত করিলাম সত্য, কিন্তু পাপের পথ আর কতদিন প্রশস্ত থাকিবে? অতি শীঘ্রই আমার সেই পাপময়ী রাস্তা রুদ্ধ হইল। তখন সকলেই আমার ব্যাপার জানিতে পারিলেন। যে উপায়ে আমি লোকদিগকে প্রতারণা করিতাম, তাহা সকলেই অবগত হইলেন। তখন আর কেহই আমার বাড়ীতে আসেন না; আমাদিগের কথায় আর কেহ প্রত্যয় করেন না। ইহার পর আমাদিগের জীবিকানির্বাহের অতিশয় কষ্ট হইতে লাগিল, গহনাগুলি এক একখানা করিয়া সমস্তই বন্ধক দেওয়া, এবং পরে বিক্রীত হইয়া গেল। অধিক কি, তখন ভরসার মধ্যে রহিল, আমার বাড়ীখানা। কিন্তু তাহাও যে রাখিতে পারিব, এরূপ আশা হৃদয় হইতে দিন দিন অন্তর্হিত হইতে লাগিল। কারণ, আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, তখন আর আমার সে বয়স ছিল না, সে সৌন্দর্য্য ছিল না, সে রূপলাবণ্যও ছিল না। আমাকে দেখিবার নিমিত্ত তখন আর কেহই ব্যগ্র হইতেন না। বারান্দায় একবার বাহির হইলে যাহাকে দেখিবার নিমিত্ত রাস্তায় লোক ধরিত না, সে এখন রাস্তায় রাস্তায় বেড়াইলেও কেহ তাহাকে একবারের নিমিত্ত চাহিয়াও দেখেন না! পূর্ব্বে যাহার সুমধুর গীতধ্বনি সুস্বর বাদ্যযন্ত্রের সহিত মিলিত হইয়া যাহার কর্ণকুহরে একবার প্রবেশ করিত, তিনিও স্পন্দনহীন চিত্র-পুত্তলিকার ন্যায় সেই স্থানেই দণ্ডায়মান থাকিতেন—সমস্ত সুখ-দুঃখ, কাৰ্য্য-কলাপ ভুলিয়া দুই দণ্ডকাল একাগ্রমনে তাহা শুনিতেন; কিন্তু এখন সেই লোকের, সেই মুখের গীতধ্বনি যাঁহারই নিকট গীত হইত, তিনিই বিরক্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া উঠিয়া যাইতেন। হায়! হায়! অপূর্ব্ব জগতের কি অদ্ভুত লীলা! 

“যদি আমি পূর্ব্বে ভাবিতাম যে, রূপ-যৌবন কিছুই চিরস্থায়ী নহে, ধন-সম্পদ, দাসদাসী প্রভৃতি কিছুই চিরকাল থাকিবে না, তাহা হইলে আমি কি আমার সেই ক্ষণস্থায়ী সুখকে অবিনশ্বর সুখ জ্ঞান করিয়া আত্মাকে এরূপ কলুষিত করিতাম? না, ধর্ম্মের মস্তকে জলাঞ্জলি দিয়া সেই মহাপাতকী তারাদিদির কুহক-মন্ত্রে ভুলিতাম? না, পাপকে ক্রমে ক্রমে এতদূর প্রশ্রয় দিয়া অসহ্য নরক-যন্ত্রণায় আত্মাকে বিপর্যস্ত করিতে অগ্রসর হইতাম? হায়! আমি কি মূর্খ! – কি পাপিষ্ঠা!! 

“যাহা হউক, আমাদিগের যখন এই উপায় বন্ধ হইল, যখন সকলেই আমাদিগের চাতুরী বুঝিতে পারিলেন, তখন কালীবাবু আমার পরামর্শমত অন্য আর একটি উপায় বাহির করিলেন। সে উপায় অবলম্বন করাতে প্রথম প্রথম আমাদের অবস্থার একটি পরিবর্তন হইল; সমস্ত খরচপত্র বিনা ক্লেশে নির্ব্বাহ করিতে লাগিলাম। সে উপায় যে কি, তাহার কতক, বোধ হয়, এখন প্রকাশ করা মন্দ নহে।” 

নবম পরিচ্ছেদ – বিবাহ সম্বন্ধে 

“একদিবস সন্ধ্যার পর একটি বাবুকে সঙ্গে করিয়া কালীবাবু আমাদিগের বাড়ীতে আসিলেন। তাঁহাকে আমি পূৰ্ব্ব হইতেই জানিতাম, তিনি কালীবাবুর একজন প্রধান পারিষদ। তাঁহার নাম গণেশচন্দ্র। আজ গণেশ আসিয়া আমার ঘরে বসিলেন, কালীবাবু তাঁহার নিকট বসিলেন। আমি এক ছিলিম তামাক সাজিয়া কালীবাবুর হস্তে দিলাম, তিনি উহা টানিতে লাগিলেন। আমিও সেই স্থানে বসিলাম। 

“কালীবাবু কহিলেন ‘গণেশ! তুমি কি ইহার যোগাড় করিতে পারিবে? তোমার সহিত ত বরকর্তার আলাপ নাই; বিশেষতঃ তিনি পাড়াগাঁয়ে লোক। তিনি তোমার কথায় কি প্রকারে বিশ্বাস করিবেন?” 

গণেশ। সে ভাবনা আর আপনার ভাবিতে হইবে না; আমি নিজে ইহার সম্বন্ধ করিতেছি না! আমার সহিত যাঁহার কথাবার্তা চলিতেছে, তিনি সেই গ্রামের একজন অধিবাসী ও বরকর্তার কুটুম্ব। তিনি বহুকাল অবধি কলিকাতায় আছেন, অথচ তিনি ইহার ভিতরের অবস্থা কিছুই অবগত নহেন; তাঁহার মনে কোন পাপ নাই। কেবল একটি ভদ্র-বংশের লোপ হয়, এইজন্য তিনি কায়মনোবাক্যে বরের উপকারের চেষ্টা করিতেছেন। সুতরাং এরূপ ব্যক্তির কথাকে কেহ যে অবিশ্বাস করিবে, তাহার সম্ভাবনা নাই। 

কালী। পাড়াগাঁয়ের লোক কি এতই মূর্খ? তাহাদের দেশে কি উহার বিবাহ হয় না? 

গণেশ। পাড়াগাঁয়ে উহার বিবাহ হইলে কি সে আর কলিকাতায় এরূপ সংগ্রহের চেষ্টা করিত? সেখানে তাহার বিবাহের সম্ভাবনা নাই। কারণ, বরটি সেই গ্রামের একঘর শুদ্ধ শ্রোত্রিয়ের পুত্র। তাহার পূর্ব্ব-পুরুষেরা বরাবর চারি মেলের ভিতর হইতে বাছিয়া বাছিয়া কুলীনের পুত্র আনিয়া সুপাত্রের সহিতই তাঁহাদের কন্যাদির বিবাহ দিয়াছেন। এই নিমিত্ত দেশের ভিতর তাঁহাদের যথেষ্ট নামও আছে। কিন্তু পূর্ব্ব-পুরুষের নাম থাকিলে কি হয়! বরটির বয়স একে চল্লিশের কম হইবে না, তাহাতে আবার সে মূর্খ-লেখাপড়ার নামমাত্রও জানে না; বিষয়-আদিও তাদৃশ নাই; যে কিছু ব্রম্ভোত্তর জমি ও বাগান আছে, তাহাও অতি সামান্য। দেশের মধ্যে এরূপ বরকে দেখিয়া কে তাহার কন্যাকে জলে ফেলিয়া দিবে? বিশেষতঃ বিবাহ করিতে হইলে সময় সময় ইহাদিগকে এক হাজার হইতে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত কন্যার পণ দিতে হয়। তাহা ছাড়া অলঙ্কার আছে, বিবাহের অন্যান্য খরচপত্রাদিও আছে। কিন্তু সে সঙ্গতি ইহাদের কই! সুতরাং কেমন করিয়া দেশের মধ্যে ইহার বিবাহ হইবে? ইহার আর কেহই নাই; থাকিবার মধ্যে একমাত্র বৃদ্ধ মাতা। এখন তাঁহারও ইচ্ছা, সামান্য খরচে পুত্রটির সমান ঘরে বিবাহ হয়। তাহা হইলে তিনি পৌত্রের মুখ দর্শন করিতে পাইবেনই ত; তদ্ব্যতীত সেই বংশের জলপিণ্ডদানের পথও একবারে রুদ্ধ হইবে না। আর এ বিবাহে তিনি যেরূপ বুঝিয়াছেন, তাহাতে তাঁহাদের সবিশেষ সুবিধাই হইতেছে। একে কন্যাটি বড় এবং সুশ্রী তাহাতে ঘর উত্তম, খরচপত্রও তাদৃশ লাগিবে না। 

কালী। তাঁহাদিগকে কিরূপ ভাবে বুঝান হইয়াছে? আমি যে যে প্রকার বলিয়া দিয়াছিলাম, সেই প্রকার হইয়াছে, কি অন্য কোন প্রকার বলা হইয়াছে? 

গণেশ। তাঁহাদিগকে এইরূপ ভাবে বুঝান হইয়াছে যে, ‘ মেয়েটি একজন শুদ্ধ-শ্রোত্রিয়ের কন্যা। তাহাদের অবস্থা নিতান্ত মন্দ হওয়ায়, তাহার একমাত্র বিধবা মাতা তাহাকে কলিকাতায় আনিয়া মেয়ের মামার বাড়ীতে বাস করিতেছেন। মেয়ের মামাও একটি সামান্য কর্ম্ম করেন; সুতরাং তাঁহার অবস্থা এরূপ নহে যে, তিনি তাহাদিগের উভয়ের প্রতিপালন ভার গ্রহণ করেন, ও ভাল পাত্রে ভাগিনেয়ীর বিবাহ দেন। আর তাহাদের বংশের একটু গৌরব থাকা প্রযুক্ত কিছু টাকা পণস্বরূপ লইয়াও তাহার বিবাহ দিতে পারেন না। এখন কন্যাটি বড় হইয়া উঠিয়াছে, – তাহার বয়ঃক্রম এখন প্রায় চৌদ্দ বৎসর হইবে; বিবাহ না দিয়া এত বড় কন্যা ভদ্রলোকের ঘরে আর কি প্রকারে রাখা যায়? এইরূপ নানা কারণে তাঁহার স্থির করিয়াছেন যে, যদি এরূপ একটি পাত্র মিলে যে, তাঁহার সংসারে আর কেহই নাই, এবং কন্যাটি ও তাহার মাতাকে প্রতিপালন করিতে পারেন, তাহা হইলে আপাততঃ অতি সামান্য খরচেই সেই পাত্র কন্যাটিকে পাইতে পারিবেন। খরচ কিছু অধিক হইবে না, তবে কন্যাকে কেবলমাত্র পাঁচশত টাকার গহনা দিতে হইবে; কিন্তু সেও কেবল দেওয়ামাত্র, যেহেতু তাঁহার টাকা, তাঁহারই ঘরে থাকিবে। আর কন্যার নিমিত্ত পণ আদি কিছুই লাগিবে না। তবে কন্যার মাতার পায় তিন শত টাকা দেনা আছে, সেই টাকা কয়েকটি কেবল তাঁহাকে প্রণামী স্বরূপ দিতে হইবে। আর এখানকার লোকজন খাওয়ান প্রভৃতি খরচ তাঁহাকেই করিতে হইবে। কিন্তু তাহা অতি সামান্য; এক বা দেড় শত টাকাতেই যথেষ্ট হইবে।’ আমাদের এইরূপ প্রস্তাবে বরকর্ত্তা সম্মত হইয়াছেন। দুই তিন হাজার টাকা খরচ করিলেও যাঁহার বিবাহ হয় না, প্রায় এক হাজার টাকায় সেই কার্য্য সম্পন্ন হইবে! তাহারও আবার পাঁচ শত টাকার গহনা আপন ঘরেই থাকিবে। বিশেষতঃ মেয়েটি ভাল ও বড়। সুতরাং এরূপ প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার পক্ষে তাঁহার আর কোন প্রতিবন্ধকতাই দেখিতেছি না। তাঁহারা বলিয়া দিয়াছেন যে, তিনদিবস পরে তাঁহারা কন্যাটিকে দেখিতে আসিবেন, ও একবারে আশীর্ব্বাদ করিয়া যাইবেন। এখন কন্যার কি উপায় করিয়াছ? দেখিও, এত যত্ন ও কষ্ট যেন বিফল না হয়! 

কালী। কন্যার ভার ত আর আমার উপর নাই, যে আমি তাহার উপায় দেখিব? সে ভার ত্রৈলোক্যের উপর আছে। “এই কথা শুনিয়া তখন আমি উহাদিগকে বলিলাম, ‘সে ভাবনা আর তোমাদিগের ভাবিতে হইবে না। তাহার সমস্তই ঠিক আছে। এখন ইহার জন্য অন্যান্য যাহা আবশ্যক হইবে, তোমরা শীঘ্র তাহার যোগাড় কর।” 

গণেশ। কি প্রকার কন্যার ঠিক করিয়াছ? 

“তখন আমি উহাদিগকে বলিলাম, ‘আমার বাড়ীর নিকট ওই যে কয়েকখানি খোলার ঘর দেখিতেছ, উহার একখানিতে একটি পঞ্চাশ বৎসর বয়স্কা স্ত্রীলোক বাস করে। তাহার নাম দিগম্বরী। শুনিতে পাই, দিগম্বরী বান্দির মেয়ে, তাহাকে কে চুরি করিয়া কলিকাতায় আনিয়া তাহার ধর্ম্ম নষ্ট করে। সেই পর্যন্ত সে কায়স্থ পরিচয়ে আমাদিগের মত বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করিয়া জীবন ধারণ করিয়া আসিতেছে। পরে যখন তাহার বয়স অধিক হইল, তখন সে ভবিষ্যৎ ভাবিয়া, আর একটি নিতান্ত দরিদ্র বেশ্যার নিকট হইতে বিধুনাম্নী দেড় মাসের বালিকাকে তিন টাকা মূল্যে খরিদ করিয়াছিল, এবং তাহারই রোজগারের উপর নির্ভর করিয়া বৃদ্ধাবস্থা অতিবাহিত করিবার প্রত্যাশায় এতদিন সেই বালিকাটিকে আপন কন্যার মত প্রতিপালন করিয়া আসিতেছে। বিধু দেখিতে এমন মন্দ হয় নাই; যেমন হউক, একটু লেখা পড়াও শিখিয়াছে, এবং তাহার বয়ঃক্রমও তের-চৌদ্দ বৎসর হইয়াছে। আমি দিগম্বরীকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিয়াছি। এখন তাহার অবস্থাও ভাল নহে। সুতরাং সে তৎক্ষণাৎ আমার কথায় আহ্লাদের সহিত স্বীকৃতা হইয়াছে। কিন্তু তাহাকে অর্দ্ধেক অংশ দিতে হইবে। তাহার কমে কিছুতেই সে রাজি হয় না।” 

কালী। তাহাই হইবে। উহাকে অর্দ্ধেকই দিয়া, বক্রী আমরা অংশ করিয়া লইব। আমরা যাহা পাই, তাহাই আমাদিগের লাভ। 

গণেশ। বরকর্তার পক্ষের লোক তিনদিবস পরে কন্যা দেখিতে আসিবেন। এখন কোন ভদ্র-পল্লীতে আমাদের একটি বাড়ী ভাড়া লওয়া নিতান্ত আবশ্যক। এখানে তাঁহাদিগকে কোনক্রমেই আনিতে পারা যায় না। এখানে তাঁহারা আসিলে তাঁহাদিগের মনে নানারূপ সন্দেহ হইতে পারে। বিশেষতঃ, ভবিষ্যতে যদি কোন প্রকার গোলযোগ হয়, তবে আর আমাদিগের ধরা পড়িতে বাকী থাকিবে না। 

“এইরূপ নানাপ্রকার কথাবার্তার পর, গণেশবাবু সে দিবস গমন করিলেন। পরদিবস কালীবাবু ও গণেশবাবু উভয়ে মিলিয়া কোন ভদ্র-পল্লীর ভিতর একখানি ছোটগোছের একতলা বাড়ী একমাসের জন্য ভাড়া করিলেন। যাঁহার বাড়ী, তিনি প্রথমে একমাসের জন্য অপরিচিত লোকের নিকট ভাড়া দিতে অসম্মত হইলেন; কিন্তু পরক্ষণেই নগদ একমাসের ভাড়া পাইয়া আর দ্বিরুক্তি করিলেন না, তখনই বাড়ীর চাবি আনিয়া দিলেন। আর সেইদিবস সন্ধ্যার সময় হইতেই আমি, কালীবাবু, দিগম্বরী ও বিধু সেই নূতন বাটীতে গিয়া বাস করিতে লাগিলাম। তবে সেখানে অধিক দ্রব্যাদি কিছুই লইয়া গেলাম না। কেবল নিতান্ত প্রয়োজনীয় কয়েকটি দ্রব্য ও বিছানাপত্রাদি লইয়া গেলাম। 

“উহার দুইদিবস পরে, সন্ধ্যার পূর্ব্বে বর পক্ষের তিন চারিজন লোক মেয়ে দেখিতে আসিলেন। গণেশবাবু উঁহাদিগকে সঙ্গে করিয়া আনিলেন। উহাদিগের নিমিত্ত উত্তমরূপ জল খাবারের আয়োজন করিলাম; তাঁহারা পরিতোষের সহিত জলপান করিলেন, এবং তাহার পর মেয়ে দেখিতে চাহিলেন। ইহার পূর্ব্বে বিধুকে উত্তমরূপে শিখাইয়া ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলাম। এখন যে স্থানে উঁহারা বলিয়াছিলেন, সেই স্থানে কালীবাবু, কেবলমাত্র একখানি সুন্দর শাটী পরাইয়া বিনা-আভরণে বিধুকে লইয়া গেলেন, এবং আপনার ভাগিনেয়ী পরিচয়ে পরিচিত করিয়া দিলেন। তাঁহারা মেয়ে দেখিয়া যার-পর-নাই সন্তুষ্ট হইলেন, এবং মেয়েকে যাহা যাহা জিজ্ঞাসা করিতে হয়, করিলেন। তাহার উপযুক্ত উত্তর পাইতেও বিলম্ব হইল না। তখন তাঁহারা আর কিছু না বলিয়া একখানি ‘মোহর’দিয়া মেয়েকে আশীর্ব্বাদ করিলেন, এবং একটি দিন দেখিয়া সেই মাসের মধ্যেই বিবাহের দিন স্থির করিলেন। কন্যাপক্ষের লোকেরা যাহা যাহা প্রার্থনা করিলেন, তাঁহারা তাহাই দিতে সম্মত হইয়া সেদিবস চলিয়া গেলেন। পরদিবস কালীবাবু সেই আশীৰ্ব্বাদী সুবর্ণ মুদ্রা বাজারে বিক্রয় করিয়া যথা-নিয়মে সকলকে বণ্টন করিয়া দিলেন। 

সম্পর্ণ 

[ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১২ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *