1 of 2

পাহাড়ী গোলাপ – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

পাহাড়ী গোলাপ – রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়

অনেকদিন পরে পুরাতন খদ্দেরকে দেখে মিসেস বড়ুয়া খুশি হলেন।

মিষ্টি হেসে বললেন, মিস্টার বরুণ বিশ্বাস না? নমস্কার!

ঠিকই চিনেছেন!—বরুণও মৃদু হাসল। বললে, আপনার স্মরণশক্তি আশ্চর্যরকম প্রখর।

চেনা অতিথিদের ভুললে আমার সরাইখানা চলবে কি করে বলুন? মিসেস বড়ুয়া বললেন।

তা বটে। প্রায় দেড় যুগ আগে স্বামী দেবাশিস বড়ুয়া যখন মুসৌরীতে এই ‘হিলম্যান’ হোটেল খুলে বসেছিলেন, অনিতা বড়ুয়া তখন তরুণী। হোটেল পরিচালনা ব্যাপারে তখন থেকেই তিনি স্বামীর সহকারিণী। আজ কয়েক বছর হল দেবাশিস বড়ুয়া পরলোকে হোটেল খুলতে গেছেন। হিলম্যানের পুরো মালিকানা আর দায়িত্ব এখন মিসেস বড়ুয়ার। খদ্দেরদের প্রতি অমায়িক ব্যবহার, আন্তরিক যত্ন তো আছেই, তাঁর সরাইখানায় কেউ একদিনের জন্যে এলেও অনিতা তাকে সহজে ভোলেন না। এই কারণে সিজন্‌ টাইমে অন্য হাটেলের তুলনায় তাঁর হিলম্যান-এ ভিড় বেশি হয়।

পুরাতন আত্মীয়তার সুরে অনিতা বললেন, এবার কতদিন পরে এলেন!

বরুণ বললে, হ্যাঁ, তা অনেকদিন হল। এগারো বছর বাদে! ঘর-টর পাওয়া যাবে তো?

আপনার জন্যে সব সময় ঘর খোলা!

অনিতা বড়ুয়া এখন আর তন্বী তরুণী নেই। চল্লিশ পার হয়ে মোটাও হয়েছেন, চুলে কপোলি ছোঁয়া লেগেছে। তবু মুখের হাসি আর চোখের চাউনিতে তরুণ বয়সের মাদকতা রয়েছে। নিজেই চাবি নিয়ে বললেন, আসুন—

কাঠের সিঁড়ি দিয়ে দোতলার বারান্দায় উঠে একেবারে শেষ ঘরখানার সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। দরজায় চাবি লাগিয়ে বরুণকে বললেন, এটা সরাইখানার বেস্ট কামরা, আর এটাই আপনার পুরোন ঘর। কোন অসুবিধে হবে না।

দরজা খুলে দিয়ে অনিতা বললেন, চা নিচে খাবার টেবিলে খাবেন, না রুক্‌মা দিয়ে যাবে?

রুক্‌মা!

ভেতরে ভেতরে বরুণ যেন চমকে উঠল।

অনিতা বললেন, সে-রুক্‌মা নয়, এখানকার পাহাড়ী বস্তিতে অমন অনেক রুক্‌মা আছে।

অনেকটা সহজ হয়ে উঠল বরুণ। বললে, স্নান সেরে খাবার টেবিলেই যাচ্ছি।

আচ্ছা।

হেসে অনিতা চলে গেলেন। বরুশ ঘরে ঢুকল। হাতের সুটকেশটা নামিয়ে রেখে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল। হ্যাঁ, এই ঘরখানাই বটে! হোটেলের অন্যান্য ঘরগুলোর তুলনায় এখানা আকারে বেশ বড়ই হবে। কাঠের ফ্লোর, কাঠের দেয়াল। শুধু ফায়ার-প্লেস ইটের। দু-দিকে দুটো দুটো চারটে জানলা। পুবের জানলার সার্শি দিয়ে সকালের দুধে-ধোওয়া উষ্ণ বোদ মেঝেয় ছড়িয়ে পড়ে। আর, উত্তরের জানলা—

দ্রুতপায়ে এগিয়ে, বরুণ উত্তরের একটা জানলার সার্শি খুলে বাইরে তাকালে। জানলার ঠিক নিচেই খাদ—সেই অতলান্ত খাদ! ঝুঁকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। ক্ষিপ্র হাতে বরুণ জানলা বন্ধ করে দিলে। একটা পাহাড়ের মাথায় বলে হিলম্যান হোটেলটাকে মন্দ দেখায় না। চারপাশের নিসর্গ শোভাও দেখতে ভাল লাগে। কিন্তু এই ঘরখানাকে একেবারে খাদের ধারে তৈরি না করলেই বা কী ক্ষতি হত?

অবশ্য ঘরের পোজিশন আর সাজানো-গোছানোর দিক দিয়ে এ ঘরখানা হোটেলের সেরা কামরা ঠিকই, তবু বরুণের মনে হল মিসেস বড়ুয়া তার থাকার জন্যে অন্য কামরার ব্যবস্থা করলেই যেন ভাল হত।

সে কি ভাবতে পেরেছিল দীর্ঘ এগারো বছর পরে আবার এই ঘরেই তাকে পা দিতে হবে?

সেপ্টেম্বরের শেষ। মুসৌরীর পাহাড়ী অঞ্চলে ঠাণ্ডাটা জাঁকিয়ে পড়েছে। তবু বরুণ স্নান করলে। ট্রেন-জার্নির পর স্নান করাই ওর বরাবরের অভ্যাস।

গরম জলে স্নান করে, দাড়ি কামিয়ে, পোশাক বদলে বরুণ যখন চায়ের টেবিলে যাবার জন্যে রেডি হল, তখন শরীরের সঙ্গে মেজাজটাও তার বেশ হালকা হয়ে গেছে।

বেলা পড়ে আসছে। উত্তরের জানলার কাচের সার্শি দিয়ে পশ্চিম আকাশের সমচতুষ্কোণ একটা টুকরো চোখে পড়ে। হিন্দী রঙিন ফিল্মের মত রঙচঙে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে বরুণ একতলায় নেমে গেল।

টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম সাজিয়ে, অনিতা নিজেই অপেক্ষা করছিলেন। হোটেলে বোডার তখন খুব কম। দু-চারজন যারা আছে, তারা চা-পান শেষ করে বেড়াতে বেরিয়েছে।

চেয়ারে বসতে বসতে বরুণ বললে, আপনি নিজে চা বানাচ্ছেন যে! লোকজন কেউ নেই?

চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে অনিতা বললেন, এ সময়টা খদ্দের কম বলে লোকজন কমিয়ে দিয়েছি। কেবল একজন বেয়ারা। আর রুক্‌মা বলে যে মেয়েটা আছে, সে এখন কিচেনে।

আবার রুক্‌মা! চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে বরুণ এক সেকেন্ড থেমে রইল। তারপর অন্য প্রসঙ্গে ঘুরে গেল। বললে, আপনার সরাইখানা এতদিনেও কিছু বদলায়নি দেখছি! সবই আগের মত রয়েছে, ওই জাপানী টি-পটটা পর্যন্ত।

কেকের প্লেট বরুণের দিকে সরিয়ে দিয়ে অনিতা হেসে বললেন, কিছুই বড় একটা বদলায় না, শুধু মানুষ বদলে যায়। এই আমাকেই দেখুন না, আগের চেয়ে কত মোটা হয়েছি, বুড়িয়ে গেছি!

এ আপনার বুড়িয়ে যাওয়া নয়, বাড়িয়ে বলা।—বরুণও হেসে জবাব দিলে, সময়ের ধর্মই হচ্ছে বদলে যাওয়া। আমাকেও কি এখনো যুবক মনে হয়?

বরুণের কাপ দ্বিতীয়বার ভর্তি করে দিলেন অনিতা। তারপর প্রশ্ন করলেন, এবার ক’দিন থাকবেন?

বলতে পারছি নে। ব্যবসাদার মানুষ আমি—যতক্ষণ ব্যবসা, ততক্ষণই থাকা।

এবার কিসের বিজনেস?

এখানকার নতুন হসপিট্যালের জন্যে স্টিল ফার্নিচার আর সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতির অডার যোগাড় করতে এসেছি। কর্তাদের তোয়াজ করতে অন্তত চার-পাঁচটা দিন লাগবে বোধ হয়।

চা-পর্ব শেষ করে আরেকটা সিগারেট-ধরালে বরুণ। মিসেস বড়ুয়া জিজ্ঞেস করলেন, আজ রাতে কি খাবেন? কোন স্পেশাল ডিশ?

ফরমাস না করে আপনার অভিরুচির ওপর ছেড়ে দিলাম। —চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল বরুণ।

অনিতা বললেন, বেড়াতে বেরোচ্ছেন?

নাঃ, টায়ার্ড লাগছে। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নেব। আমি কিন্তু দশটার আগে ডিনারে বসি না।

আমার মনে আছে। আপনার ডিনার দশটাতেই রেডি থাকবে।

সত্যিই ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল বরুণের। ঘরে এসে দেখল, উত্তরের জানলায় ফ্রেমে-আঁটা আকাশ থেকে সমস্ত রঙের বাহার মুছে গেছে। ফায়ারপ্লেসের আগুন-তাপে ঘরখানায় উষ্ণ আরাম ছড়ান।

ইটালিয়ান কম্বলখানা গায়ে টেনে নরম বিছানায় বরুণ এক ঘুম ঘুমিয়ে নিল।

ঘুম যখন ভাঙল, তখন নটা বেজে গেছে। শরীরে এখনো কেমন একটা আলস্যের জড়তা লেগে আছে। অতএব সুটকেশটা খোলা যাক। মার্তেল ব্র্যান্ডির বোতল তার সঙ্গেই থাকে। বিশেষত টুরে বেরোলে।

বারান্দায় বেরিয়ে বরুণ গলা চড়িয়ে গরম পানির ফরমাস করলে। খানিক পরেই পাহাড়ী চাকরটা এসে গরম জলের পাত্র টেবিলে নামিয়ে রেখে গেল। সঙ্গে গ্লাস। বোতল খুলে বরুণ গ্লাসে এক ইঞ্চিটাক ঢাললে। গরম জলের পাত্রের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে, ফুলদানির দিকে চোখ পড়ল। সেই ড্রাগন-আঁকা তামার ফুলদানিটা না? আশ্চর্য, এগারো বছর আগে ওই টেবিলে এই ফুলদানিটাই ছিল! ছিল তো ছিল। দুনিয়ায় অনেক জিনিসই এগারো কেন, একশো এগারো বছর ধরে ছিল এবং আছে। তাতে কি এল গেল?

গ্লাসে গরম জল মিশিয়ে বরুণ একটা লম্বা চুমুক দিলে। সিগারেট ধরালে। তারপর টেবিল থেকে একখানা বিলিতি ম্যাগাজিন খুলে বসল।

গ্লাসটা দ্বিতীয় চুমুকেই খালি হয়ে গেল। দ্বিতীয়বার ব্র্যান্ডি নিল বরুণ। গরম জল নিতে গিয়ে ফুলদানিটা আবার নজরে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বরুণ চোখ সরিয়ে নিল। তার মনে হল, মিসেস বড়ুয়ার রুচি নিতান্ত পুরোন পচা! এমন কী নিয়ম আছে, এগারো বছর ধরে একই ফুলদানি একই টেবিলে রাখতে হবে? ওই ফুলদানিটা তো কারো স্বামী নয় যে বদলানো চলবে না!

হঠাৎ খেয়াল হল বরুণের, এরই মধ্যে সে বার তিন-চার ফুলদানিটার দিকে তাকিয়েছে। হাসি পেয়ে গেল তার। এই বয়সে ড্রাগন দেখে ভয় পেলো নাকি সে? মনে পড়ল অনিতা বড়ুয়ার কথা, ‘কিছুই বড়-একটা বদলায় না, শুধু মানুষ বদলে যায়।’

বরুণ তৃতীয় পেগ ঢাললে। গ্লাসটা যখন শেষ করলে, তখন দশটা দশ। বোতলটা সরিয়ে রেখে সে একতলায় নেমে গেল। ডিনারের টাইম হয়েছে।

টেবিলে প্লেট সাজিয়ে বসে আছেন অনিতা। বকশ এসে বসতেই কিচেনের দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাক দিলেন, রুক্‌মা! খানা লাও।

বরুণ কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। অথচ নেশা তার হয়নি। তিন পেগে তার নেশা হয় না। বড়জোর চোখ দুটো একটু লালচে হয়।

ধূমায়িত সূপের পাত্র দুহাতে ধরে মোটাসোটা মাঝবয়সী একটি পাহাড়ী খ্রীলোক খাবার ঘরে এল। এই তাহলে রুক্‌মা। অনিতা বলেছিলেন বটে এখানকার পাহাড়ী বস্তিতে অনেক রুক্‌মা আছে।

খেতে খেতে সে বললে, পাহাড়ী মেয়েদের মধ্যে রুক্‌মা নামটা খুব কমন বুঝি?

অনিতা বললেন, হ্যাঁ, তাই। রুক্‌মা ওদের প্রিয় নাম।

বরুণ জিজ্ঞেস করলে, আচ্ছা, আপনার সে-রুক্‌মার খবর কি মিসেস বড়ুয়া? কোন খোঁজ-টোজ পেয়েছিলেন তার?

মিসেস বড়ুয়া বললেন, না। বিস্তর খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল, কিন্তু মেয়েটাকে আর পাওয়া গেল না। কোথায় যে গায়েব হয়ে গেল, কে জানে!

বরুণের অস্বস্তি ভাব এক মুহর্তে কেটে গেল।

পুলিশ ভাল করে তদন্ত করেনি?

প্রশ্নটা এত সহজে কৱল বরুণ, যেন কথার পিঠে কথা।

করেছিল বৈকি! কোন সন্ধান না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। আরেকখানা গরম কাটলেট দিই?

গরম কাটলেট? ফাইন! দিন না।

বরুণের মেজাজ ভারি প্রফুল্ল মনে হল। কাটলেট চিবোতে চিবোতে বললে, ব্যাপারটা কিন্তু রীতিমত রহস্যময়। শার্লক হোমসের গল্পের মত, তাই না? একটা জলজ্যান্ত মেয়ে উবে গেল! আচ্ছা, আপনার কি ধারণা?

অনিতা বললেন, ব্যাপারটা আমার ধারণার বাইরে। তবে পাহাড়ী বস্তির লোকেরা বলে, কোন ট্যুরিস্ট সাহেব নাকি রুক্‌মাকে ধরে নিয়ে গেছে।

তাই নাকি? ভারি ইন্টারেস্টিং তো?

শব্দ করে হেসে উঠল বরুণ। হেসে বললে, তবে মেয়েটার চেহারা যা ছিল, তাতে ট্যুরিস্ট সাহেবকে দোষ দেওয়া যায় না।

ডিনার শেষ করে বরুণ উঠে পড়তে যাচ্ছিল, অনিতা বললেন, উঠবেন না! আপেলের পুডিং আছে—আপনার ফেবারিট ডিশ!

অবাক হয়ে বরুণ বললে, ধন্যবাদ! কিন্তু সে যে এগারো বছর আগের কথা! এখনো আপনার মনে আছে?

অনিতা পুডিংয়ের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে মৃদু হেসে বললেন, এগারো বছর আগের এই সরাইখানাকে আপনিই কি ভুলতে পেরেছেন?

চামচে করে একটু পুডিং মুখে তুলতে গিয়ে বরুণ এক সেকেন্ড থেমে গেল। তারপর আবার খেতে লাগল।

নিজের রুমে বরুণ যখন ফিরে এল, কাছাকাছি কোন চার্চের ঘড়িতে রাত এগারোটা বাজছে। সারা হোটেল নিঝুম। কোন বোর্ডারের ঘরে সাড়াশব্দ নেই। ডিনার-টেবিলে বরুণই শেষজন।

কাচের জানলার বাইরে আকাশ ও পৃথিবী এখন একই রঙের—শ্লেটের মত গাঢ় ধূসর। পাহাড়ী অঞ্চলের শীতার্ত রাত এরই মধ্যে নিশুতি হয়ে এসেছে। শব্দ বলতে থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে শুধু দমকা হওয়ার এলোমেলো প্রলাপ।

দরজায় ছিটকিনি তুলে দিয়ে বরুণ এসে বসল ফায়ারপ্লেসের ধারে। ঠাণ্ডা বেশ জমিয়ে পড়েছে। তা পড়ুক, এখনই শুয়ে পড়বার তাড়া কিসের? কিছুক্ষণ বসে বসে মৌজ করে সিগারেট টানা যাক। ইচ্ছে হলে একটা ছোট পেগ ব্র্যান্ডিও নিতে পারে।

কি যেন বললেন অনিতা বড়ুয়া? এগারো বছর আগের এই সরাইখানাকে আপনিই কি ভুলতে পেরেছেন?

পেরেছিল বৈকি। এগরোটা বছর ধরে বরুণ তো দিব্যি ভুলে গিয়েছিল। মুসৌরীতে আরো হোটেল থাকতেও কেন যে এই হিলম্যান-এ এসে উঠল, তা সে নিজেও জানে না। আর, দোতলার বারান্দার এই শেষ ঘরে পা দিয়ে আবার সব মনে পড়ে গেল নতুন করে।

কিন্তু এগারো বছর বাদে হিলম্যান হোটেল তাকে আবার টানলো কেন? কেন আবার! এ হোটেলের আরাম আর মিসেস বড়ুয়ার যত্নই তার কারণ। ধরো, ফুট-স্যালাড আর অ্যাপল্‌পুডিং—তার প্রিয় খাদ্য অপর কোন হোটেলে না-চাইতেই পাওয়া যেত কি? চাইলেও হয়তো মিলতো না।

টেবিল থেকে অ্যাস-পটটা নিতে গিয়ে ফুলদানিটা আবার চোখে পড়ে গেল বরুণের। ড্রাগন খোদাই-করা সেই তামার ফ্লাওয়ার ভাস!

আশ্চর্য, সব মনে পড়ছে তার। স্পষ্ট মনে পড়ছে! যেন গত সপ্তাহের ঘটনা। বরুণ তা হলে সত্যিই ভুলে যায়নি। চাপা পড়ে ছিল বিস্মৃতির কবরে। কবর ফুঁড়ে আবার বেঁচে উঠেছে পুরান স্মৃতি।

আগের বার সে যখন এখানে এসেছিল, সেটা সেপ্টেম্বর ছিল না, ছিল মার্চের গোড়ার দিক। শীত তখনো এই পাহাড়ী অঞ্চলে জাঁকিয়ে রাজত্ব করছে। ভি. আই. পি.’দের জন্যে সরকারী ভবনের একদিকটা আরো বাড়ানো হবে, গৃহসজ্জার কনট্রাক্ট ধরতে তার মুসৌরীতে আসা ওই প্রথম। পাহাড়ের ওপর বেশ ছবির মত দেখতে হিলম্যান হোটেল তার ভাল লেগে গিয়েছিল। মালিক দেবাশিস বড়ুয়া তখন বেঁচে। বরুণ একটু নিরিবিলি থাকা পছন্দ করে শুনে, তিনি দোতলার বারান্দার এই শেষ ঘরখানাই তার জন্যে খুলে দিয়েছিলেন।

ঘরখানা একেবারে একটেরে বলে সত্যিই নিরিবিলি। অন্য বোর্ডারদের সঙ্গে সম্পর্ক খুবই কম। এই খাটখানা তখন ঘরের এইখানেই ছিল। বড় সোফাটা, ড্রেসিং আয়নাটা আর সেন্টার টেবিলখানা তখন যেখানে ছিল, এগারো বছর বাদে ঠিক সেই জায়গাতেই রয়েছে। ড্রাগনওয়ালা তিব্বতী ফুলদানিটাও। এমন কি, বরফে-ঢাকা পাহাড়ের একটা এনলার্জ-করা বাঁধানো ফোটো পুবের দেওয়ালের হুকে তেমনি করেই ঝুলছে।

কিছুই বদলায়নি!

হ্যাঁ, এই ঘরেই রুক্‌মাকে সে প্রথম দেখেছিল। সকালবেলা বেড-টি নিয়ে এসে, তার ঘুম ভাঙিয়েছিল রুক্‌মা। ডেকেছিল, চায় লায়া বাবুজী!

একটু মোটা অথচ মেয়েলি গলার আওয়াজে বরুণ ঘুম-চোখে তাকাল। মেয়েটা গালে টোল পড়িয়ে মিষ্টি করে হাসল। আবার বললে, চায় লায়া বাবুজী! পিও!

ঘুম-চোখে একপলক তাকিয়েই বরুণের চোখ থেকে ঘুম চলে গেল। একটা জীবন্ত পাহাড়ী গোলাপ ফুটে রয়েছে তার ঘরে!

পাহাড়ী মেয়েদের বয়স ধরা মুস্কিল। কিন্তু এ মেয়েটাকে দেখে বোঝা যায়, বয়সটা বিশ-বাইশের বেশি হতে পারে না—এমনই মসৃণ লালিত্য তার গায়ের ফর্সা গোলাপী চামড়ায়। ঘন সবুজ ছিটের ফ্রক পরনে, গায়ে লাল পশমের সোয়েটার। মাথায় সাদা ফুটকি-দেওয়া একটা নীল সিল্কের রুমাল বাঁধা, তারই তলা দিয়ে লালচে কটা চুলের একজোড়া খাটো বিনুনি উপচে-ওঠা বুকের দুপাশে ঝুলছে। অস্পষ্ট ভুরুর নিচে ছোট ছোট চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। পাতলা গোলাপী ঠোঁটের ফাঁকে ক্ষুদে ক্ষুদে হলদেটে দাঁতের সারি।

বরুণ চেয়েই রইল।

মেয়েটা শুধু পাহাড়ী সৌন্দর্যের একটা ছবি নয়, পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবন দিয়ে গড়া—টাটকা তাজা যৌবন।

বন্য সরলতার সঙ্গে মেয়েটা বললে, কেয়া দেখতা বাবুজী? চায় পিও!

নিজেকে সামলে নিয়ে বরুণ গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলে, কেয়া নাম হায়?

ফিক করে হেসে ফেলে মেয়েটা বললে, রুক্‌মা।

রুক্‌মার সঙ্গে বরুণের সেই প্রথম আলাপ। এগারো বছর আগে।

তার পর থেকে বরুণ যতক্ষণ হোটেলে থাকত, তার ফাইফরমাসের অন্ত ছিল না। জল দাও, চা আনো, কফি বানাও, ‘বিস্তারা’র চাদর আর বালিশের ওয়াড় বদলে দাও, আরো কতরকম। ঘড়ি ঘড়ি রুক্‌মাকে ডেকে পাঠাত। ডেকে পাঠাত আর ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে রুক্‌মাকে দেখত। রুক্‌মাকে দেখত আর কি এক জ্বালায় জ্বলত। যে-জ্বালায় শুধু নওজোয়ান পুরুষ জ্বলে। কত বয়স তখন বরুণের? বড়জোর ত্রিশ-বত্রিশ!

সারা ভারতবর্ষ জুড়ে মাকড়সার জালের মত রেল-লাইন ছড়িয়ে আছে। সেই লাইন ধরে স্টেশনে স্টেশনে ঘুরছে বরুণ। কোথাও দুদিন, কোথাও পাঁচদিন। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কেবল অর্ডার ধরেছে, ব্যবসা করেছে, টাকা গুণেছে। টাকার যে উল্টো পিঠ আছে, জীবনের যে আরেকটা দিক আছে, ভাববার অবসর হয়নি। কখনো পুরুষের চোখ দিয়ে দেখেনি যে, দুনিয়ায় মেয়ে বলে একশ্রেণীর বিচিত্র প্রাণী আছে। পুরুষের মন দিয়ে কখনো ভাবেনি যে, তারও যুবক-জীবনে একটি মেয়ের প্রয়োজন আছে। কোনদিন অনুভব করেনি তারও একটা অদ্ভুত ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, যা ডিনারে বা চা-কফিতে তৃপ্ত বার নয়।

পুরুষের সেই দৃষ্টি, সেই মন, আর সেই অনুভূতি বরুণের জীবনে জাগিয়ে তুলেছিল মুসৌরী পাহাড়ের মেয়ে রুক্‌মা! জ্বলন্ত যৌবনবতী রুক্‌মা!

সে কি আজকের কথা? এগারো বছর পূর্বের এক মার্চের। অথচ সবই মনে পড়ে যাচ্ছে।

নিতান্ত বন্য, নিতান্ত সরল ছিল রুক্‌মা। অল্পেই ভারি খুশি হয়ে যেত।

একদিন তার জামায় একটু সেন্ট লাগিয়ে দিয়েছিল বরুণ। বারবার জামাটা শুঁকে তার খেন তৃপ্তি হয়নি। গোলাপী ঠোঁটের ফাঁকে হলদেটে দাঁতের সারি দেখিয়ে বললে, আ! কিতনা আচ্ছা ফুলকা খুশবু!

বোধ হয় এই ভেবে সে অবাক হয়েছিল যে, ছোট্ট শিশির ভেতর থেকে টাটকা ফুলের সুগন্ধ বেরোল কেমন করে?

আরেক দিন।

বিকেলে চায়ের পর বরুণ একটা সিগারেট ধরিয়েছে, রুক্‌মা এল চায়ের ট্রে নিয়ে যেতে। ‘টোস্টেড’ তামাকের গন্ধ পেয়ে মেয়েটা বলে বসল, এ বাবুজী, একঠো চুরুট দেও না।

বরুণ জিজ্ঞেস করলে, কেয়া করো গে?

রুক্‌মা অসঙ্কোচে জবাব দিলে, হাম পিয়ে গা।

মজা লাগল বরুণের। একটা সিগারেট দিয়ে বললে, পিও!

সিগারেটটা একবার নাকের কাছে ধরে রুক্‌মা বলে উঠল, কিতনা আচ্ছা! আভি নেহি, রাতমে খানা খানেকে বাদ পিয়েগা।

সিগারেটটা রুক্‌মা তার টাইট সোয়েটারের মধ্যে বুকের কাছে রেখে দিলে।

সেদিকে তাকিয়ে বরুণ বললে, আচ্ছা সোয়েটার মালুম হোতা! তুম বানায়া?

একটু যেন গর্বের সঙ্গে রুক্‌মা বললে, নেহি, মেরা মা বানায়া। ইসমে ভি আচ্ছা বানাতা। বাজারমে বিক্‌তা হ্যায়। সাত রূপেয়া, দশ রূপেয়া, বারা রূপেয়া!

হাঁ!—ইচ্ছে করে অবাক হয়ে বরুশ বললে।

রুক্‌মা বরুণের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বললে, দেখো না, কিতনা আচ্ছা!

তারপর বিনা দ্বিধায় ফস করে বরুণের একখানা হাত নিজের বুকের ওপর রাখল। হকচকিয়ে গেল বরুণ। তার আঙুলের চাপ লাগছে রুক্‌মার পুরস্ত নরম বুকে। কয়েক সেকেন্ড বাদেই হাত টেনে নিলে সে।

কেয়া হুয়া?—অবাক হয়ে প্রশ্ন করলে রুক্‌মা।

নিজের আঙুলে ফুঁ দিতে দিতে বরুণ বললে, জ্বল গিয়া!

জ্বল গিয়া! ক্যায়সে?

আগমে।

আরো অবাক হল রুক্‌মা। বললে, কাঁহা আগ?

রুক্‌মার চোখে চোখ রেখে বরুণ বলে বসল, তুমারা জওয়ানীমে।

বন্য সরল পাহাড়ী মেয়েও লজ্জা পায়। রুক্‌মার গালের রাঙা আপেল-রঙ তার সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ছোট ছোট জ্বলজ্বলে চোখ দুটো তেরছা করে শুধু বললে, হট্‌!

তারপর তাড়াতাড়ি চায়ের ট্রে তুলে নিয়ে পালিয়ে গেল।

রুক্‌মা চলে গেল, কিন্তু রেখে গেল একটা বিষের জ্বালা। সে-বিষ বরুণের হাতের আঙুল থেকে ক্রমে সারা দেহের রক্তবাহী শিরায় শিরায় সঞ্চারিত হতে থাকল।

আর, ঘটনাটা ঘটল সেই রাতেই।

বোর্ডারদের মধ্যে সবশেষে ডিনার খেতে নামে বরুণ। দশটা অবধি তার নিজস্ব সময়। কয়েক পেগ ‘হট ড্রিঙ্কস নিয়ে একা একা কাটায়। তারপর ডিনারে বসে। সে-রাতে একটা ভাল হুইস্কির বোতল ছিল সঙ্গে। তিন পেগের কিছু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। তারপর নেমে গেল একতলায়।

ডিনার-টেবিলে পরিবেশন করলে রুক্‌মা। আগের মতই সহজ ভাবে। বিকেলের কথা সে হয়তো ভুলেই গেছে। কিন্তু বরুশ কি ভুলতে পেরেছিল সেই বিষের জ্বালা? ভোলা তো দূরের কথা, জ্বালাটা যেন নেশার মত ক্রমশ তাকে অস্থির করে তুলছিল।

ডিনারের পর কফির অর্ডার দিয়ে ঘরে ফিরে গেল বরুণ। সিগারেট ধরালে। হোটেল হিলম্যান এখন চুপচাপ। বোর্ডাররা যে-যার বিছানায় গায়ে কম্বল টেনেছে। পাহাড়ী অঞ্চলের রাত এগারোটা বাজতে না বাজতেই নিশুতি। আকাশে শ্লেটের রঙ। শীতের দমকা হাওয়ায় আজ ঝোড়ো মওতা।

ফায়ার-প্লেসের ধারে বসেছিল বরুণ। ঘরের দরজায় টোকা পড়ল।

ক্যওন?—বরুণ জিজ্ঞেস করলে।

বাইরে থেকে জবাব এল, রুক্‌মা। কফি লায়া বাবুজী।

দরজা ভেজানোই ছিল, বরুণ বললে, আও।

দু-হাতে ট্রে ধরে রক্‌মা ঘরে এল, টেবিলে রেখে কফি তৈরি করতে লাগল। তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বরুণ উঠে দরজাটায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। আর দাঁড়িয়ে রইল বন্ধ দরজার সামনে।

রুক্‌মা একটু চমকে উঠে বললে, উ কেয়া কিয়া? দরোয়াজা খুল দেও।

নেহি। —বরুণ অদ্ভুতভাবে হাসলে।

রুক্‌মার মুখে এবার বিরক্তি ফুটল। বললে, কেয়া তামাসা করতা বাবুজী! খুল দেও দরোয়াজা। হাম ঘর চ্যলা যায়েগা।

কেমন যেন অস্বাভাবিক গলায় বরুণ বলতে লাগল, রুক্‌মাশুনো! রাত আঁধেরা, অ্যওর বাহারমে বহুৎ জাড়া! মৎ ঘর যাও, আজ রাতমে তুম ইহা ঠ্যায়রো!

পুরুষের দৃষ্টি নারীর চিনতে দেরি হয় না। বন্য পাহাড়ী হলেও রুক্‌মা মেয়ে। বরুণের চোখের দিকে তাকিয়ে, তার ভেতরকার আদিম জন্তুটাকে চিনতে রুক্‌মার এক মুহূর্তও দেরি হল না। গুহাশায়ী জন্তুটা হঠাৎ আজ গুহার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার রাক্ষুসে চেহারাটা দেখে সাহসী পাহাড়ী মেয়ে রুক্‌মাও ভয় পেয়ে গেল।

বরুণ আস্তে আস্তে এগোচ্ছে, আর রুক্‌মা এক-পা এক-পা করে ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে। পিছোতে পিছোতে সোফার ওপর পড়ে গেল রুক্‌মা, আর তৎক্ষণাৎ রুশ ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। দু-হাতে সেই পুঞ্জ পুঞ্জ যৌবন দিয়ে গড়া দেহটা তুলে নিয়ে খাটের পুরু গদীর ওপর ছুঁড়ে ফেললে। বলিষ্ঠ হাতের একটানে ছিড়ে গেল সোয়েটার, টুকরো হয়ে গেল ভেতরের জ্যাকেট, ফালা ফালা হয়ে গেল ছিটের ফ্রক। চিৎকার করে উঠতে গেল রুক্‌মা, তার আগেই লোলুপ একজোড়া ঠোঁট রুক্‌মার পাতলা লালচে ঠোঁট দুখানা চেপে ধরলে।

পারল না—সে-রাতে রুক্‌মা কিছুতেই ঠেকাতে পারল না বরুণকে। আদিম প্রবৃত্তির হাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল পাহাড়ী গোলাপ!

শীতের ঝোড়ো হাওয়া তখন আরো প্রমত্ত হয়েছে!

রাতের ঘড়ির সময়ের কাঁটা আরো ক’টা ঘর পার হয়ে গেল, বরুণের খেয়াল ছিল না। গলাটা শুকিয়ে উঠেছে। ছোট একটা পেগ হুইস্কি নিয়ে বরুণ নিট খেয়ে ফেললে। তারপর সোফায় বসে, সিগারেট ধরিয়ে, মুখ তুলতেই দেখল, বিছানায় রক্‌মা উঠে বসেছে।

তার গোটা চেহারাই এখন বদলে গেছে। ও যেন আগের সেই রুক্‌মা নয়। ছেঁড়া সোয়েটারের ফাঁকে রক্তচিহ্ন আঁকা বাম স্তনটা বেরিয়ে আছে। ফালি-করা ফ্রকের ভেতর থেকে একটা ধবধবে সুপুষ্ট ঊরু সম্পূর্ণ অনাবৃত। মাথার রুমাল খসে পড়েছে। একগোছা চুল একটা চোখ ঢেকে মুখের ওপর নেমে এসেছে। আরেকটা ছোট জ্বলজ্বলে চোখ যেন একটুকরো জলন্ত কয়লা। মুখ থেকে পাকা আপেলের রঙ কে যেন মুছে দিয়েছে। সারা মুখখানায় মার্বেল পাথরের শ্বেত কাঠিন্য।

বরুণ সিগারেট টানতে ভুলে গেল।

আস্তে আস্তে খাট থেকে নামল রুক্‌মা। বরুণের দিকে এক চোখের জ্বলন্ত দৃষ্টি ফেলে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর সাপের মত হিসহিস স্বরে বলতে লাগল, তুম বদমাস! তুম খারাপ আদমি হ্যায়! হামকো খারাব কর দিয়া। হম ইসকো বদলা লেগা—জরুর বদলা লেগা!

বরুণ নরম গলায় বললে, রুক্‌মা, কিঁউ গোসসা করতা? যো হে গিয়া, উসকো যানে দেও।

তিক্ত ঘৃণায় রুক্‌মা বলে উঠল, নেহি, কভি নেহি। কাল সবেরে যম সব কোইকো বোলেগা তুম কিতনা বদমাস—কিতনা শয়তান হ্যায়।

তারপর পাহাড়ী ভাষায় বিড়বিড় করে গাল পাড়তে লাগল।

মনে মনে প্রমাদ গুণলে বরুণ। সর্বনাশ! মেয়েটা তাকে ব্ল্যাকমেল করবে? নাকি ব্ল্যাকমেলিংয়ের ভয় দেখিয়ে দেহের দাম আদায় করতে চায়?

পার্স থেকে একখানা একশো টাকার নোট বার করে বরুণ বললে, রুক্‌মা, তুমকো হাম প্যার করতা! ইয়ে লেও—

নোটখানা ছোঁ মেরে নিয়ে, রুক্‌মা তার ওপর থুথু ফেললে। তারপর নোট ছুঁড়ে ফেলে, প্রচণ্ড আক্রোশে ভারী তিব্বতী ফুলদানিটা তুলে বরুণের দিকে লক্ষ্য করলে। সঙ্গে সঙ্গে বরুণ তার হাত চেপে ধরে ফুলদানিটা ছিনিয়ে নিলে।

কিন্তু পাহাড়ী রক্তে তখন আগুন ধরে গেছে। ক্রুদ্ধ বনবিড়ালীর মত হিংস্র হয়ে উঠেছে মেয়েটা। হাতের কাছে হুইস্কির বোতলটা পেয়ে, সেটা নিয়েই সে আবার আক্রমণ করলে। এবারেও বরুণ তার হাত মুচড়ে বোতল কেড়ে নিলে।

ব্যর্থ আক্রোশে রক্‌মা বলে উঠল, তুমকো হাম নেহি ছোড়গা—আভি সব কোইকো বোলেগা তুম বদমাস—তুম হামকো খারাব কিয়া হ্যায়।

রুক্‌মা দরজার দিকে ছুটে গেল। কিন্তু তার আগেই বরুশ দরজা আগলে দাঁড়িয়েছে।

হাঁপাতে হাঁপাতে রুক্‌মা বললে, হট যা বদমাস!

বরুণ নড়ল না।

মাথা ঝাঁকিয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে রুক্‌মা আবার বললে, যা, হট যা—নেহি তো হাম চিল্লায়গা!

বরুণ তবু অনড়। তার রক্ত টগবগ করে ফুটছে।

রুক্‌মা এবার মরিয়া হয়ে চিৎকার করে উঠতে গেল। কিন্তু গলা চিরে চিৎকার বোররাতে না বেরোতেই বলিষ্ঠ দুখানা হাতের কঠিন আঙুলগুলো তার কণ্ঠনালীকে সাঁড়াশির মত চেপে ধরল। রুক্‌মা প্রাণপণে ছাড়াতে চেষ্টা করল। পারল না। আঙুলের সাঁড়াশি তার কণ্ঠনালীর ওপর দুদিক থেকে চাপ দিতে লাগল। জোরে—আরো জোরে—আরো আরো জোরে—

রুক্‌মার ছোট ছোট চোখ দুটো বড় হয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইল। হলদেটে দাঁতের ফাঁকে জিভখানা অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে ঝুলে পড়ল। তারপর ছটফট করতে করতে একসময় স্থির হয়ে গেল রুক্‌মা। আঙুলের সাঁড়াশি শিথিল হতেই তার দেহ একটা বস্তার মত ধপ করে পড়ে গেল মেঝেয় কার্পেটের ওপর।

সেদিকে তাকিয়ে বরুশ পুতুলের মত কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল মনে নেই। মাথার ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেছে। কি ঘটে গেল, কিছুই ধারণা করতে পারছে না। হঠাৎ কে যেন তাকে ধাক্কা মেরে জাগিয়ে তুললে। তৎক্ষণাৎ মেঝেয় বসে পড়ে সে রুকমার গায়ে নাড়া দিয়ে দেখলে, হাতের নাড়ী টিপলে, বুকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করলে। না, নাড়ীতে স্পন্দন নেই, বুক ধুকধুক করছে না। রুক্‌মার জীবনের ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে!

ভয়ের একটা হিমস্রোত বরুণের শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যেতে লাগল। রুক্‌মাকে সে খুন করে ফেলেছে!

এখন? এখন কি করবে সে? কি করা উচিত?

প্রাণী মাত্রেরই যে সহজাত আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি থাকে, সেই প্রবৃত্তি তার কানে কানে বললে, এখন নিজেকে বাঁচাতে হবে! যে মরবার সে মরেছে, কিন্তু তাকে বাঁচতেই হবে।

বরুণ নিজেকে অনেকখানি শক্ত করলে। মুখ তুলে তাকাতে চোখ পড়ল উত্তরের জানলার দিকে। কাচের সার্শিতে শীতের ঝোড়ো হাওয়া ধাক্কা দিচ্ছে। যেন কিছু বলতে চায় বরুণকে। কি বলতে চায়? বুঝেছে, বরুণ তা বুঝেছে! উঠে গিয়ে উত্তরের কাচের সার্শি খুলে দিলে সে। একঝলক হিমশীতল হওয়া যেন বরফের কুচি ছিটিয়ে দিলে তার মুখ চোখে। বরুণ ফিরে এল রুক্‌মার কাছে। দু-হাতে তুলে নিলে তার দেহটা, তারপর আবার জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চার ফুট সমচতুষ্কোণ ফ্রেঞ্চউইণ্ডো। গরাদ নেই, গ্রীল নেই। যেন বরুণের সুবিধের জন্যেই নেই। এক মুহূর্ত ভেবে, বরুণ রুক্‌মার নিস্পন্দ দেহটা জানলা গলিয়ে অন্ধকারে ছেড়ে দিলে। অতলান্ত খাদের কোন অতলে গিয়ে পৌঁছল রুক্‌মা, কে জানে!

ব্যস, নিশ্চিন্ত!

কাচের সার্শি আবার বন্ধ করে দিলে বরুণ।

কাল যদি পুলিশ আসে, আসুক। ততক্ষণে রুক্‌মার দেহের টুকরোগুলো খাদের বুননা জন্তুগুলোর পেটে হজম হয়ে গেছে!

তারপর এগারো বছর ধরে অনেক ঘুরেছে বিজনেসম্যান বরুণ। মাকড়সার জালের মত ভারতবর্ষের রেললাইনের ধারে বহু স্টেশনে নেমে পড়েছে, বহু সরাইখানায় রাত কাটিয়েছে, বহু নারীসঙ্গের স্বাদ পেয়েছে। আর, তাদেরই ভিড়ে কবে কখন হারিয়ে গেছে মুসৌরীর পাহাড়ী মেয়ে রুক্‌মা। সারা জীবনেও তাকে মনে পড়ত না, যদি এগারো বছর বাদে আবার মুসৌরীতে আসতে না হত। এই হিলম্যান হোটেলের দোতলার শেষ ঘরখানায় পা দিয়ে আবার মনে পড়ে গেল—পুরোন ফিল্মের মত সবই মনে পড়ে গেল! এমন কি, আজকের মত সে-রাতের শীতের হাওয়ায় ঝড় উঠেছিল, তাও!

কিন্তু কেনই বা মনে করা? কি হবে মনে করে? রুক্‌মা মরেছে, ফুরিয়ে গেছে। তার নিয়তি তাকে টেনেছিল ওই অতলান্ত খাদে। একটা পাহাড়ী বস্তির মেয়ের দেহের দাম কত হতে পারে? বরুণ তো ঢের বেশিই দিতে চেয়েছিল। তবু সে ব্ল্যাকমেলের ভয় দেখাল কেন? কেন সে চেষ্টা করল প্রতিহিংসা নিতে? কোথায় রইল তার প্রতিহিংসা? বরুশ তো তাকে মারতে চায়নি, সে মরবে বলেই এসেছিল তার জ্বলন্ত যৌবন নিয়ে। বরুণ কি কবে?

কিন্তু আর নয়। আর ভাবতে ভাল লাগছে না। চুলোয় যাক রুক্‌মা। তার মৃত্যু-রহস্য যখন সে ছাড়া পৃথিবীর দ্বিতীয় ব্যক্তি জানে না, তখন কেন আর মাথা ঘামানো? অতএব জীবন থেকে মুছে ফেলে দাও রুক্‌মাকে—মুছে ফেলে দাও এগারো বছর পূর্বের মার্চের একটা বিশ্রী রাত!

কিন্তু সেই বিশ্রী রাতটা মুছতে গিয়ে মোছা যাচ্ছে না। আজকের এই সেপ্টেম্বর-রাতটা ঠিক সেই রকম। তেমনি ঠাণ্ডা, তেমনি ঝোড়ো। পাগলাটে শীতের হাওয়া ঠিক তেমনি করেই উত্তরের কাচের সার্শিতে ধাক্কা দিচ্ছে। যেন বলছে, আমায় চিনতে পারছ? আমি এগারো বছর আগের সেই বিশ্রী রাতের সাক্ষী।

ড্যাম ইট! হলই বা সাক্ষী। বরুণের কিছু আসে যায় না। রুক্‌মা বেঁচে থাকলে না হয়। থাকত! কিন্তু মরা মানুষ তো ফিরে আসে না! সুতরাং যা কিছু অস্বস্তি, মন থেকে দূর করে দাও। নিশ্চিন্ত, একেবারে নিশ্চিন্ত!

চার্চের ঘড়িতে ঢং করে একটা শব্দ হল। সাড়ে এগারোটা।

আজকের রাতটা বড় বেশি অন্ধকার, বড় বেশি নিশুতি। রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডাটাও বাড়ছে। এক কাপ গরম কফি খেলে হত। ডিনারের পর আজ আর কফির অর্ডার দেওয়া হয়নি। ভুল হয়ে গেছে! এতক্ষণে ডাইনিং রুম, কিচেন বন্ধ হয়ে গেছে নিশ্চয়। ইস, কী ভুল হয়ে গেছে।

দরজায় টোকা পড়ল।

অবাক হয়ে বরুণ জিজ্ঞেস করলে, কৌন?

বন্ধ দরজার বাইরে থেকে জবাব এল, রুক্‌মা। কফি লায়া বাবুজী।

দারুণ খুশি হয়ে গেল বরুন। শীতের সময় শোবার আগে এক কাপ কফি খাওয়া তার বরাবরের অভ্যাস। মিসেস বড়ুয়া ঠিক মনে রেখে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ তাঁকে!

ফায়ারপ্লেসের পাশ থেকে উঠে গিয়ে, বরুণ দরজা খুলে দিলে। আর খুলে দিয়েই দু-পা পিছিয়ে এল।

আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকল রুক্‌মা। হাতে কফির ট্রে নেই। কিন্তু এ কোন রুক্‌মা? এ তো কিছুক্ষণ আগে দেখা তামাটে রঙের মাঝবয়সী রুক্‌মা নয়, এ রক্‌মাকে বরুন দেখেছিল এগারো বছর আগে! এ যে সেই জ্বলন্ত যৌবনবতী রুক্‌মা! আদিম প্রবৃত্তির হাতে বিভিন্ন সেই পাহাড়ী গোলাপ!

ছেঁড়া সোয়েটারের ফাঁকে রক্তচিহ্ন-আঁকা বাম স্তনটা বেরিয়ে আছে। ফালা ফালা করে চেরা ফ্রকের বাইরে ধবধবে সুপুষ্ট একটা ঊরু সম্পূর্ণ অনাবৃত। এলোমেলো লালচে চুলের একগোছা একটা চোখ ঢেকে দিয়ে মুখের ওপর নেমে এসেছে। আরেকটা ছোট চোখে জ্বলন্ত কয়লার আগুন!

কিন্তু এ কি করে সম্ভব? মরা মানুষ কি ফিরে আসে? ফিরে আসতে পারে?

বরুণের বিস্ফারিত চোখ সেই জ্বলন্ত অঙ্গার চোখের দিকে। রুক্‌মার এক চোখের অপলক তীব্র দৃষ্টি বরুণের দিকে।

একটা ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা হিমস্রোত বরুণের শিরদাঁড়া বেয়ে শিরশির করে নামছে। সারা দেহ কাঁপছে থরথর করে। চিৎকার করতে চাইল সে, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না।

পলকহীন এক চোখের লক্ষ্য বরুণের দিকে রেখে, রুক্‌মা এক-পা এক-পা করে এগোচ্ছে। আর, বরুণ এক-পা এক-পা করে পিছু হটছে। ঠিক যেমন করে এগারো বছর আগে সেই মার্চের রাতে রুক্‌মা আস্তে আস্তে পিছু হটেছিল।

শীতের ঝোড়ো হাওয়া তখন উত্তরের কাচের সার্শিতে ধাক্কা দিয়ে বরুণকে বলছে, এস, আরো সরে এস, একেবারে জানলার ধারে—খুলে দাও কাচের সার্শি, তারপর দেখ অতলান্ত খাদ কী গভীর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *