দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

পাসবই

ভুলো

আলো নিবিয়ে, মশারির চারপাশ গুঁজে, বেশ পরিপাটি করে শুলেন। বাইরে ঝিপঝিপ বৃষ্টি। সেই শব্দ শুনতে-শুনতে ঘুম প্রায় এসে গেছে, হঠাৎ মনে হল, বাথরুমে গিয়েছিলুম, আলোটা নিবিয়েছি তো! আবার ওঠো। টেনে টুনে মশারি খুলে, বিছানা থেকে নামো। থইথই অন্ধকার। হাতড়ে-হাতড়ে শোওয়ার ঘরের সুইচ বোর্ডের কাছে যাও। যাওয়ার পথে অন্ধকারে দিশা হারিয়ে তিনবার তিনটে জিনিসে ঠোক্কর খাও। চেয়ারে পা। আলমারিতে কপাল। জানলার পাল্লায় হাত। ঘরের আলো জ্বেলে, করিডর ধরে বাথরুম। দেখা গেল, আলো নেবানো হয়েছে। নিশ্চিন্ত। এবার আবার শোওয়া যেতে পারে।

ঘরের আলো নিবিয়ে হাতড়ে-হাতড়ে বিছানায় এসে শুতে না শুতেই হঠাৎ মনে হল, ছাতি নিয়ে ওষুধের দোকানে ওষুধ কিনতে গিয়েছিলুম। কিছুটা যাওয়ার পর বৃষ্টি থেমে গেল। তখন ছাতাটা মুড়ে হাতে ঝোলালুম। দোকানে ঢুকে কাউন্টারের পাশে ছাতাটা ঝুলিয়ে রেখে বুক পকেট থেকে প্রেসক্রিপসান বের করলুম। ওষুধ নিলুম। দাম মেটালুম। খুচরো পকেটে ভরলুম। চলে এলুম। ছাতা? ছাতাটার কী হল, আর তো মনে পড়ছে না। ছাতাটা তুলেছিলুম? না, তুলিনি! এই আমার তৃতীয় ছাতা। আবার মশারির পাশ তুলে নেমে এসো। এবার পা পড়ল লেজে। সাপের হলে মরেই যেতুম। পড়ল আমার পোষা কুকুরের বিশাল লেজে। খাটের তলায় গিরগিটির মতো শুয়ে থাকে; কিন্তু নিজের দীর্ঘ লেজ সম্পর্কে ভীষণ কেয়ারলেস। যত্রতত্র ফেলে রাখে অসাবধানে। কুকুরের লেজ, আর মেয়েদের শাড়ির আঁচল। নিজেদের জিনিস অথচ নিজেদেরই হুঁশ থাকে না। রাস্তার লোক চিৎকার করছে, ‘আঁচল তুলুন, আঁচল তুলুন, রিকশার চাকায় জড়িয়ে যাচ্ছে! জনগণ না থাকলে কত রিকশায় কত মহিলার যে বস্ত্রহরণ পালা হত!

আমি ঘুমোতে না পারলেও, আমার কুকুর ঘুমে বেঁহুশ; কারণ বাথরুমের আলো, বর্ষার ছাতা পৃথিবীর এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তাকে মাথা ঘামাতে হয় না। তার জগৎ হল, ইট ড্রিংক অ্যান্ড ডু ঘেউঘউ। একটা চাপা শব্দ করে সে মৃদু প্রতিবাদ জানিয়ে খাটের তলায় গভীর জগতে সরে গেল। আমার আবার সেই অন্ধকার পরিক্রমা শুরু হল। আলোর পর আলো জ্বালাতে-জ্বালাতে অবশেষে খাবার ঘরে। ছাতা ঝেলাবার একটা জায়গা আছে ওখানে। ঘর অন্ধকার। আলোর সুইচে হাত রেখে ভাগ্যপরীক্ষা। জ্বালা মাত্রই জানা যাবে, ছাতা আছে না গেছে। ফ্রিজের মাথার ওপর ধকধক করে জ্বলছে এক জোড়া চোখ। আমাদের পারিবারিক বিড়ালটি কুকুরের ভয়ে ফ্রিজের মাথার ওপর নিরাপদে রাত কাটায়। মাছ আর দুধের স্বপ্ন দেখতে-দেখতে। যা থাকে বরাতে। খুট করে আলো জ্বালালুম। চোখ জুড়িয়ে গেল। গ্রিলে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে আমার ছাতা। ফাঁকি দিয়ে প্রাণের পাখি উড়ে যায়নি।

বিছানায় ফিরে এসে আবার শয়নের চেষ্টা। হঠাৎ মনে পড়ল, ওষুধ খেয়েছি তো! সাত তাড়াতাড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে কিনে তো আনলুম! আজকাল অ্যান্টিবায়োটিকস আবার ঘড়ি-ধরা সময়ে খেতে হয়। ডাক্তারবাবুরা প্রেসক্রিপসানে লিখে দেন সকাল সাতটা, বারোটা, পাঁচটা, বারোটা। যেন রাজধানী এক্সপ্রেস, টাইম টেবল ধরে, পেটের স্টেশানে ইন করবে। অনেক সময় লাস্ট ট্রেনের মতো, লাস্ট ক্যাপসুল পড়ার সময় দাঁড়াল হয়তো রাত দুটো। তখন মাথার কাছে অ্যালার্ম ঘড়ি রেখে শুতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিকস নিয়ে ছেলেখেলা চলে না। ড্রাগ রেজিসটেনস বেড়ে উঠলে আর রক্ষা নেই।

ওষুধ খেয়েছি কি খাইনি, খেয়েছি কি খাইনি করতে-করতে মনে পড়ে গেল, অফিসে একটা ট্র্যাঙ্কল এসেছিল। দিল্লি থেকে তাঁর এক আত্মীয় করছিলেন আমার বড়কর্তাকে। বড়কর্তা তখন বাইরে ছিলেন। ট্রাঙ্ককলের বক্তব্য, এম এল এ হস্টেলে তাঁর শ্যালক আছেন। কাল সকালে দমদমে তাঁকে দিল্লির মরনিং ফ্লাইট ধরাতে হবে। এইটুকু উপকার যেন আমার বড়কর্তা করেন। কারণ তাঁর গাড়ি আছে। আমি এই সাংঘাতিক খবরটাই তাঁকে জানাতে ভুলে গেছি। সর্বনাশ! ভয়ে আতঙ্কে আমার হাত-পা যেন পেটের ভিতর সিঁধিয়ে গেল। কী হবে! চাকরি না গেলেও, ট্র্যানসফার অনিবার্য। মনে হতে লাগল, আমি একটা গোল বলের মতো হয়ে গেছি।

আবার নেমে এলুম বিছানা থেকে। কম পাওয়ারের আলো জ্বেলে খানিক পায়চারি করলুম। কি করা যায়! বড়কর্তা আছেন এক প্রান্তে, আমি আর এক প্রান্তে। নেমে পড়লুম রাস্তায়। মাঝ রাতের গোটাপাঁচেক কুকুর এগিয়ে এসে সর্বাঙ্গ শুঁকে সরে গেল। কামড়ালেও কিছু করার ছিল না। আমাকে যে ভাবেই হোক একটা ফোন করতে হবে। মিনিটদশেক হেঁটে গেলেই আমার পরিচিত এক ভদ্রলোকের বাড়ি। সারা বাড়ি ঘুমে নিঝুম। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিপাকে পড়ে গেলুম। ভদ্রলোকের আবার এক নতুন উপসর্গ এসেছে, নাম ভুলে যাওয়া। ভদ্রলোকের নাম স্বরূপ না অরূপ! যাক, নাম ধরে আর ডাকতে হল না। কলিং বেল আছে। টিপে-টিপে আঙুলের মাথা ব্যথা হয়ে গেল। প্রায় যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি, তখন একটা গম্ভীর গলা শোনা গেল, ‘কে?’

‘আমি নিবারণ।’

গলা ধমকে উঠল, ‘কে নিবারণ, ইয়ারকি হচ্ছে?’

‘আজ্ঞে ইয়ারকি নয়, স্বরূপবাবু আছেন?’

‘কে স্বরূপবাবু?’

বুঝলুম ভুল করেছি। গলাটাকে আরও করুণ করে বললুম, ‘অরূপবাবু আছেন ভাই? বড় বিপদে পড়ে এসেছি।’

‘ডাকাতি করতে?’

‘আজ্ঞে না। বিশ্বাস করুন, আমি সেন্ট পারসেন্ট নিবারণ।’

এক মহিলা কণ্ঠ শোনা গেল, আরে, নিবারণকে চেনো না! আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে তার স্বামী।’

যাব্বাবা! যাক, এই পরিচয়ে যদি দরজা খোলে আমার আপত্তি নেই। দরজা খুলে গেল। সামনেই হয় অরূপবাবু না নয় স্বরূপবাবু। ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, ‘এ কি আপনি? আপনার নামও নিবারণ?’

বড়কর্তার বাড়ির টেলিফোন। বেজেই চলে। বেজেই চলে। শেষে কে একজন ধরলেন। হঠাৎ আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। নিজের পরিচয় দিলে মাঝরাতে ঘুম ভাঙাবার অপরাধে ইনক্রিমেন্ট স্টপ করে দেবেন। ভুলো হলেও বোকা তো আর নই। গভীর গলায় বললুম, ‘কে প্রশান্ত!’

যিনি ধরেছিলেন জিগ্যেস করলেন, ‘কে বলছেন?’

‘আমি দিল্লি থেকে বলছি সুধন্য।’

‘ধরুন।’

আমার বড়কর্তা এলেন, ‘কে সুধন্যদা, কী ব্যাপার এত রাতে?’

‘আর বলো কেন, দুপুর থেকে চেষ্টা করে তোমাকে এখন পেলুম। ভাই, একটু কষ্ট করতে হবে। আর তো ঘুমোলে চলবে না। তোমার গাড়িতে আমার শ্যালককে…’

‘এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে হবে তো। আপনি ভাববেন না। সব অ্যারেঞ্জমেন্ট রেডি। আমি আর যাচ্ছি না। আমার ড্রাইভার হরিহর পাকা লোক। সেই নিয়ে যাবে।’

‘তুমি জানলে কী করে?’

‘কেন, আপনি তো দুপুরে ফোন করে আমার আসিস্ট্যান্ট নিবারণবাবুকে বলে ছিলেন।’

তিনি তোমাকে বলেছিলেন তো।’

‘বলবেন না মানে। না বললে, আমি পিণ্ডি চটকে দেব না।’

‘আচ্ছা, আমি ছাড়ছি।’

তাড়াতাড়ি ফোন নামিয়ে রাখলুম। গৃহস্বামীর দিকে তাকিয়ে বললুম, ‘জল খাওয়াবেন এক গেলাস।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *