পাসপোর্ট ফোটোর মতো
দু’দিন বললে অবশ্যই বেশি হয়ে যাবে, কিন্তু পৌনে দু’দিন তো বটেই। বিমান পথে পৌনে দু’দিন। অস্নাত, অনিদ্রিত, অশায়িত প্রায় কুড়ি ঘণ্টা।
হিসাবটা এইরকম। কলকাতার বাড়ি থেকে বেরলাম শুক্রবার রাত সাড়ে আটটায়। সিঙ্গাপুর- হংকং হয়ে সানফ্রানসিসকো বিমানবন্দর থেকে বার্কলে শহরে পুত্রের বাসায় পৌঁছতে শনিবার রাত সাড়ে ন’টা, তখন কলকাতায় রবিবার সকাল দশটা। হিসাব করলে দাঁড়ায় সাড়ে সাঁইত্রিশ ঘণ্টা।
এই বিস্তর সময়ের অধিকাংশ সময়ই বিমানের অভ্যন্তরে। বিমানবন্দরে যেটুকু সময় তার অবশ্য আকর্ষণ আছে। রঙিন আলোর বাহার, দোকান-পসরা, বার-রেস্তোরাঁ, যাত্রীর ব্যস্ততা, মোটামুটি সময় কেটে যায়।
কিন্তু বিমানের অভ্যন্তরে নির্দিষ্ট চার বর্গফুট ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে শারীরিক ক্লেশ যতটা হয়, মানসিক ক্লান্তি তার চেয়ে কম নয়। নিজেকে কেমন অপ্রয়োজনীয়, অপদার্থ মনে হয়। মাঝে-মধ্যে খাদ্য ও পানীয় আসে। খাদ্য অঢেল, কিন্তু আমার রুচির সঙ্গে মেলে না, তখন এক মুঠো ডাল-ভাত, একটু আলু বা মাছ ভাজা হলে বর্তে যেতাম। সেই সময় নুন-তেল মশলাহীন সেদ্ধ মাছ। খেজুরের রসসিক্ত সামুদ্রিক শামুক ও শ্যাওলা কিংবা পিপারমেন্টের স্বাদে-গন্ধে ভরা প্যাস্ট্রি—খুব সামান্য সামান্য করে মুখে তুলে চাখা যায় কিন্তু খাওয়া যায় না। আমার তো গা গুলিয়ে ওঠে।
পানীয় অঢেল নয়, তবে চাইলে দেয়। বারবার চাইতে হয়। কিন্তু খালি পেটে আর কতটা পানীয় গ্রহণ করা যায়? পানীয় অবশ্য সব রকমেরই আছে, কিন্তু কোনওটাই খুব উচ্চমানের নয়।
খাদ্য-পানীয় রেখে যাওয়ার জন্য প্রত্যেকের সামনের চেয়ারের পিছনে একটা করে টেবিল রাখা আছে। সেটি সামনের চেয়ারের গায়ে ভাঁজ করা থাকে, প্রয়োজনমতো টেনে টেবিলের মতো ব্যবহার করা যায়। তবে আমার মতো খুব বলবান বা ভুঁড়িমান ব্যক্তির ভুঁড়িতে ঠেকে যাওয়ায় অনেক সময় এই টেবিল খোলা যায় না, খোলা গেলেও সযত্নলালিত প্রিয় ভুঁড়িতে টেবিল চেপে বসে যায়। দশ ঘণ্টা পরেও ভুঁড়ির চামড়ার গায়ে ভাল দাগ থাকে, হিন্দি সিনেমায় চাবুকাহত নির্দোষ নায়কের পৃষ্ঠদেশে যে রকম দেখা যায়।
এ রকম অতি ক্ষুদ্রাকার টেবিলের পরিকল্পনা কার মাথায় প্রথম এসেছিল সেটা জানা কঠিন, হয়তো চেষ্টা করলেও জানা যাবে না। কিন্তু নিউজার্সিবাসিনী এক সুরসিকা মহিলা একদা আমাকে একটা কথা বলেছিলেন। ভদ্রমহিলা দূর বিমানযাত্রায় আমার পার্শ্ববর্তিনী ছিলেন। টেবিলের সঙ্গে আমার ভুঁড়ির কসরত দেখার পর তিনি আমাকে জানান যে, এই টেবিলের বুদ্ধি যার মাথায় এসেছিল, তারই মামা গুজিয়া আবিষ্কার করেছিলেন। গুজিয়া, পাঠক-পাঠিকা নিশ্চয় জানেন যে, ক্ষুদ্রতম আকারের চিনি-চুরচুর মিষ্টি, পুজো-আর্চায় বাতাসা বা নকুলদানার বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের অল্প বয়সে দাম ছিল পুরনো দু’পয়সা, এখন বোধহয় পঞ্চাশ পয়সা বা এক টাকা। অনেকদিন দেখিনি, হয়তো আজকাল পাওয়াই যায় না।
গুজিয়ার জন্য দুঃখ করে লাভ নেই, আপাতত বিমানভ্রমণে ফিরে আসি। আন্তর্জাতিক বিমানযাত্রায় আতলান্তিক বা প্রশান্ত মহাসাগরের এপারে-ওপারে যে পরিমাণ অনাহার, ধকল ও ক্যালোরি ব্যয় হয়, কেউ যদি মাসে দু’বার ‘রাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড’ করে, তার পনেরো পাউন্ড ওজন কমবেই। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, প্রত্যেক বছরেই আমার এ রকম হয়।
অনেকদিন আগে একবার, সেই প্রথমবার, মার্কিন দেশ থেকে পাঁচ সপ্তাহ ভ্ৰমণান্তে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত হয়ে ফিরেছিলাম। তখন ওজন নিয়ে মাথা ঘামাতাম না, সে-বয়স তখনও হয়নি। তবে ওজন নিশ্চয়ই অনেক কমে গিয়েছিল। শার্টের কাঁধ, প্যান্টের কোমর সব কেমন ঢিলেঢালা হয়ে গিয়েছিল।
তা, ওই অবস্থায় তো দমদম বিমানবন্দরে এসে নামলাম। আমার সহধর্মিণী আরও অনেকের সঙ্গে বিমানবন্দরে আমাকে বরণ করতে গিয়েছিলেন। আমার চেহারার ওই অবস্থা দেখে আমার খুব কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “এ কী হাল হয়েছে তোমার? তোমাকে না তোমার পাসপোর্ট ফোটোর মতো দেখাচ্ছে।” এই মন্তব্যের অর্থ বুঝতে কারও কষ্ট হলে নিজের পাসপোর্ট ফোটোর সঙ্গে নিজের চেহারা আয়নায় মেলাবেন।