পাসপরট
গল্পটি পুব বাঙলার বিশেষ একটি জেলা সম্বন্ধে। মনে করুন তার নাম লোহারা।
পুব বাঙলার সাধারণজন মাত্রেরই দৃঢ়তম বিশ্বাস লোহাভরা জেলার লোকমাত্রই অতিশয় ধুরন্ধর। এদের কেউ একা বা দল বেঁধে ঢাকা স্টেশনে নামলে বিদগ্ধ, হাজির-জবাব কুট্টি পর্যন্ত সন্ত্রস্ত হয়ে এদের রীতিমতো সমঝে চলে। সর্বশেষে বলা হয়, ওই জেলাতে কখনও দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সেখানে স্বয়ং শয়তান সে জেলার যে প্রধান প্রতিভূ সে পর্যন্ত মাছি ধরে ধরে খায়–কারও গোলায় হাত দিতে হিম্মত পায় না।
তামাম পুব বাঙলার চাণক্য-মাকিয়াভেললি যে এদের সম্মুখীন হলে হুশিয়ারির খাতিরে তদ্দণ্ডেই তাঁদের কানাকড়িটি পর্যন্ত স্টেট ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে আসেন সে-তত্ত্বটি লোহাভরাবাসী বিলক্ষণ অবগত আছে বলে তারা সহজে আপন বাসভূমির খবর দেয় না; লোহাভরার পার্শ্ববর্তী কোনও এক জেলার বাসিন্দা বলে পরিচয় দেয়।
***
পারটিশনের ফলে কলকাতা এবং ঢাকাতেও নানা নয়া নয়া সমস্যা দেখা দিল।
ঢাকা সেকরেটারিয়েটে খবর এল আমেরিকা থেকে ভারতের বিস্তর জানোয়ার-দরদী মহাজনরা বাধা দিচ্ছেন, বাদর যেন মারকিন মুলুকে চালান না দেওয়া হয়, মারকিনরা নাকি ডাক্তারি এক্সপেরিমেন্টের অছিলায় এদের ওপর পাশবিক অত্যাচার (ডিভিসেকশন) করে। মারকিন ডাক্তাররা তাই ঢাকাকে অনুরোধ করেছেন, তারা যদি ন্যায্যাধিক মূল্যেও মর্কট সরবরাহ করেন। পশ্চিম ও পুব বাঙলার মর্কটে মর্কটে নাকি রত্তিভর ফারাক নেই এবং এরা কোনও প্রকারের মাইগ্রেশন সারটিফিকেট নিয়ে দেশত্যাগী হয়েছে বলে জানা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সেকরেটারি মহোদয় তিনি আমাকে সংক্ষেপে ইতিহাসটি কীর্তন করেন– তাঁর দফতরের ঝানু-ঝাণ্ড এসিসটেনট তস্য এসিসটেনটদের এত্তেলা দিয়ে তাদের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, এটা ফরেন ইচেনজের সাতিশয় গুরুতর ব্যাপার!
দফতর-ভূশুণ্ডিরা একবাক্যে উত্তর দিলেন : বদর ধরার কৈশল অতিশয় প্যাচাল। এর স্পেশালিস্ট ছিলেন হিন্দুরা। তাঁরা ইন্ডিয়া চলে গেছেন।
অনেক তর্কাতর্কির পর স্থির হল জেলায় জেলায় খবরের কাগজে যেন নিম্নোক্ত বিজ্ঞাপনটি ফলাও করে ছাপানো হয়–
বাঁদর! বাঁদর!! বাঁদর!!!
এতদ্বারা সর্বসাধারণকে জানানো যাইতেছে যে, মারকিন-মুলুকের অনুরোধে এই দেশ হইতে জীবন্ত বাঁদর আমেরিকায় রফতানি করা হইবে। তজ্জন্য উপযুক্ত মূল্য দেওয়া হইবে।
স্বাক্ষর সেকরেটারি
সবুজপুরা, ঢাকা-১১।
আমি সচিব মহোদয়কে শুধালাম, উত্তম ব্যবস্থা। তার পর?
বললেন, যেই না বিজ্ঞাপনটি লোহাভরা জেলায় বেরিয়েছে অমনি দেখা গেল, তাবৎ জেলার লোক লুঙ্গি ফেলে ফেলে গুয়া গাছের ডগায় চড়ে বসে আছে। সবাই মারকিন মুলুকে যাবে। মুশকিল! জানেন তো, লোহাভরার লোকের যা কাত্তিকের মতো চেহারা, তাতে কোনটা বাঁদর কোনটা মানুষ ঠিক ঠাহর করা—
***
ইতিহাস-দার্শনিক শ্রীযুক্ত টইনবি বলেছেন, দেশকালপাত্রের যোগাযোগের ফলে নিত্য নিত্য প্যাটার তৈরি হচ্ছে বটে, কিন্তু সেগুলো আকছারই প্রাচীন প্যাটারনের পুনরাবৃত্তি মাত্র। তফাত ডিটেলে।
অতএব, যখন সবিশেষ অবগত আছি, উভয় বাঙলার দেশকালপাত্রে ফারাক যৎসামান্য তবে পূর্বোল্লিখিত পূর্ববঙ্গীয় প্যাটারনের পুনরাবৃত্তি পশ্চিমবঙ্গে প্রতিভাসিত হবে না কেন? আমরা কিসে কম?
অবশ্য স্বীকার করছি ডিটেলে উনিশ-বিশ হওয়া বিচিত্র নয়।
এবং তাই হয়েছে।
কারণে, কিংবা অকারণে, অথবা বলতে পারেন, কিসমতের মারে এদেশে পাশপর যোগাড় করাটা ক্রমশ কঠিন হতে কঠিনতর হতে লাগল, স্বরাজ পাওয়ার অল্প কিছুকালের মধ্যেই। শেষটায় হাল এমন অবস্থা দাঁড়াল যে তখন কেউ আর নিতান্ত বিপদে না পড়লে ওই সাপের পায়ের সন্ধানে বেরুত না। অবশ্য লক্ষপতি, কালোবাজারি, বিদেশে যার আচার-করা ফরেন কারসি আছে তাদের কথা আলাদা। এসব কাহিনী দফে দফে বয়ান করার প্রয়োজন নেই। খবরের কাগজে অনেক খবর বেরোয় সাদা কালিতে ছাপা। সেগুলো পড়ার জন্য একটি তৃতীয় নয়নের প্রয়োজন–ইংরেজিতে যাকে বলে টু রিড বিটুইন দ্য লাইনজ। যাদের সেটা আছে। আমার নেই তারা আপনাকে-আমাকে অনায়াসে দু কলমফ শেখাতে পারেন। সেকথা থাক।
ইতোমধ্যে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল।
লোকটার নিশ্চয়ই কোমরের জোর, কড়ির ওজন ও বুকের পাটা আছে, নইলে সরকারের সঙ্গে লড়তে যাবে কেন? কটা আদালতে হারার পর লোকটি সুপরিম কোরটে পৌঁছল জানিনে। সেখানে প্রধান বিচারপতি (তৎকালীন) শ্ৰীযুক্ত সুববা রাও যা রায় দিলেন তার বিগলিতাৰ্থ, কোনও ভারতীয় যদি আপন দেশ ছেড়ে বিদেশে যেতে চায় তবে তাকে ঠেকাবার এখৃতেয়ার ভারত সরকারের নেই। সেটা হবে সংবিধান-বিরুদ্ধ।
ব্যস্। আর যাবে কোথায়।
আমাগো দ্যাশে কয়, একেতো ছিল নাচিয়ে বুড়ি তার উপর পেল মৃদঙ্গের তাল।
পুব বাঙলার প্যাটারনে এস্থলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে গাছের মগডালে না চড়ে মেয়েমদ্দে আণ্ডাবাচ্চায় ধাওয়া করল পাসপরট ফরমের জন্য। বাঁদরের জন্য ও-বস্তুর প্রয়োজন নেই তাকে খাঁচায় পুরে প্লেনে ঢুকিয়ে দিলেই হল। মানুষের বেলা জাহাজের কাপতান, প্লেনের টিকিট বেচনেওয়ালা, ভূপৃষ্ঠে বর্ডারের উভয়পক্ষের পুলিশ শুধোত, অভিজ্ঞান-পত্রটি কোথায়?
ইতোমধ্যে নাকি আরও দুজন জজ সাহেবের রায় বেরুল : আইনত নাকি পাসপরটের কোনও প্রয়োজনই নেই। এটা আমি বুঝতে পারিনি, কাজেই এটি নিয়ে তড়িঘড়ি আলোচনা করা আমার শোভা পায় না।(১) পয়লা তো ঝামেলাটা বুঝে নিই।
উপস্থিত একটি কথা বলে রাখি।
আইন অবশ্যই সর্বজনমান্য। কিন্তু কার্যত কী হয়?
আইনত (ডেজুরে) পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই তার নাগরিককে অবাধ চলাফেরা করার ক্ষমতা দেয়, কিন্তু কার্যত (ডে ফাঁকটো) কোনও দেশ দেয় বলে জানি নে।
এই তো হালের কথা। মার্কিন দেশে যে জোর গণতন্ত্রের রাজত্ব সেকথা আমরা সবাই জানি। অন্তত সেই নিয়ে তাদের বড়-ফাটাইয়ের অন্ত নেই। দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম সর্বত্রই তাঁরা যে গণতন্ত্র তথা ব্যক্তিস্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিচ্ছেন একথা তারা বিশ্ববাসীকে অহরহ শোনাচ্ছেন। সত্যি হতে পারে, মিথ্যা হতে পারে, কিংবা হয়তো মারকিনগণ নিজেদের এটা বোঝাবার চেষ্টা করছেন। এবারে সেই হালের কথাতেই আসি।
দার্শনিক বারট্রানড রাসল কিছুদিন হল স্থির করলেন, একটা বেসরকারি আদালত বসিয়ে সেখানে ভিয়েতনামে মারকিন পাপাচারের বিচার করা হবে। ভোলা আদালতে যেরকম যে কোনও মানুষ, হয় আসামি নয় ফরিয়াদি পক্ষে দাঁড়াতে পারে বা আদালতের দোস্ত (আমিকুস কুরিএ) হিসেবে নিরপেক্ষভাবে কথা বলার হক ধরে রাসেলের বেসরকারি বেআইনি (বা অ-আইনিও বলতে পারেন) আদালতেও সেই ব্যবস্থা থাকবে।
এ আদালতে হাওয়া কোন দিকে বইবে সেটা ঠাহর করার জন্য হ্যামলেট নাটকের ভূতের প্রয়োজন হয়নি। তৎসত্ত্বেও মার্কিন জুজুর ভয়ে সব রাষ্ট্রই মুখে কথা চাপলেন। অর্থাৎ সে আদালতের জন্য আসন দিতে (ভেনু) রাজি হন না– তোমার আসন পাতবো কোথায় হে অতিথি–অবশ্য ভিন্নার্থে।
শেষটায় সরল সুইডেন লাজুক কনেটির মতো কবুল পড়ল এবং আখেরে পস্তাল, কিন্তু সেকথা থাক।
সেই উয়োর ক্রাইমস ট্রিবুনালে সাক্ষ্য দিলেন ৭ মে তারিখে এক ভদ্রলোক– এঁর নাম রালফু শ্যোমান। মারকিন নাগরিক, এবং রাসলের খাস নায়েব (পারসনাল সেকরেটারি)। ভিয়েতনামে মারকিনদের পাশবিক অত্যাচারের দফে দফে বয়ান দিয়ে যার সঙ্গে এ রচনার কোনও সম্পর্ক নেই– তিনি বলেন, তিনি স্বয়ং হানয় গিয়েছিলেন এবং অনুমান করেন, যেহেতু তিনি ওই জায়গায় মারকিন সরকারের বিনানুমতিতে গিয়েছিলেন তাই সে সরকার এক্ষণে তার পাসপরট রদ করবে (অর্থাৎ বাতিল বা বাজেয়াপ্ত করে নেবে)।
যদি করে তবে সেটা আইনসঙ্গত কি না, সেটা বিচার করার মতো আইনজ্ঞান আমার কেন, বহু ধুরন্ধরেরও নেই।
(১) এই দেখুন না, কেন্দ্রীয় সরকার পাসপট বাবদে যে আইন এতদিন মেনে চলতেন তারও একটা রেজো দেতত্র (raison detre) নিদেন একটা ভিত ছিল (২) তিনজন মহামান্য জজ সেটা অস্বীকার করলেন (৩) অন্য দুজন মহামান্য জজ ওই তিনজনের সঙ্গে একমত হলেন না। ওদিকে পাসপ দরখাস্তের বন্যায় হিল্পি দিল্লি যায়-যায়। সেটা ঠেকাবার জন্য সরকারকে বাধ্য হয়ে জারি করতে হয়েছে, (৪) অরডনস্ সাময়িক আইন। এ আইনের আয়ুষ্কাল মেরেকেটে ছ মাস। ইতোমধ্যে সরকার এই অরডানটি মেজে-ঘসে (৫) বিলরূপে পরিবর্তন করে পেশ করবেন পারলিমেনটের সন্মুখে।
তখন লাগবে ধুন্ধুমার, ইংরেজিতে যাকে বলে দ্য ফ্যাট উইল বি ইন দ্য ফায়ার। উপরের প্যারায় আমি পাঁচ রকমের দৃষ্টিবিন্দু পরিবেশন করেছিলুম– এবারে পারলিমেনটে জুটবে এসে আরও পাঁচশো!
আমার ঘাড়ে কী ৫০৬টি মাথা যে আমি রা-টি কাড়ব।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
পারলিমেনটে বিস্তর বেদরদ ভোলাইয়ের পর ইস্ত্রি হয়ে বেরুবেন বিলটি তখন আইনরূপে।
আমরা শঙ্খ বাজাব, হুলুধ্বনি দেব।
কিন্তু হায়, এ পোড়ার সংসারে শান্তি কোথায়? এই নয়া তুলতুলে তুলোয় ভরা তাকিয়া-পারা আইনটার ওপর ভর করে যে দুদণ্ড জিরিয়ে নেবেন তারই-বা মোকাফুরসত কোথায়?
আবার এক পাষণ্ড হয়তো হয়তো কেন, নিশ্চয়ই সে আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিমকোর্টে দাঁড়াবে।
এবং এবারও যদি মহামান্য বিচারপতি…?
তা হলে শুরুসে, ফিসে, সেই ঔড্র পদ্ধতিতে :
ক-রে কমললোচন শ্রীহরি,
খ-রে খগ-আসনে মুরারি।
গ-রে…!
————
১. কাগজে রিপোর্ট বেরিয়েছে : Giving their reasons the minority said that there was no compulsion of law that a passport must be obtained before leaving India. আমারই মতো জনৈক সম্পাদক ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি এবং ওই নিয়ে সম্পাদকীয় লিখেছেন।