পাশের বাড়ি – লীলা মজুমদার
ইচ্ছে না হয় ব্যাপারটা আগাগোড়া অবিশ্বাস করতে পার, স্বচ্ছন্দে বলতে পার আমি একটা মিথ্যাবাদী ঠগ জোচ্চোর। তাতে আমার কিছুই এসে যাবে না, যা যা ঘটেছিল সে আমি একশো বার বলব। আসলে আমি নিজেও ভূতে বিশ্বাস করি না।
বুঝলে, মার মেজো মাসিরা হলেন গিয়ে বড়োলোক; বালিগঞ্জে বিরাট বাড়ি, তার চারদিকে গাছপালা, সবুজ ঘাসের লন, পাতাবাহারের সারি। মস্ত—মস্ত শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধানো ঘর, তার সাজসজ্জা দেখে তাক লেগে যায়। তা ছাড়া মেজো মাসিদের ক্যায়সা চাল, হেঁটে কখনো বাড়ির বার হন না, জলটা গড়িয়ে খান না। কিন্তু কী ভালো সব টেনিস খেলেন, পিয়ানো বাজান। আর কী ভালো খাওয়া—দাওয়া ওঁদের বাড়িতে। আসলে সেই লোভেই আজ গিয়েছিলাম, নইলে ওঁদের বাড়িতে এই খাকি হাফপ্যান্ট পড়ে আমি! রামঃ!
যাই হোক, ওঁদের পাশের বাড়িটার দারুণ দুর্নাম। কেউ ওখানে পঁচিশ—ত্রিশ বছর বাস করেনি, বাগান—টাগান আগাছায় ঢাকা, দেয়ালে অশ্বত্থগাছ, আস্তাবলে বাদুড়ের আস্তানা। দিনের বেলাতেই সব ঘুপসি অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে গন্ধ, আর তার উপর সন্ধেবেলায় নাকি দোতলার ভাঙা জানালার ধারে একজন টাকওয়ালা ভীষণ মোটা ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তার চেহারা নাকি অবিকল এখনকার মালিকদের ঠাকুরদাদার মতো দেখতে। অথচ সে বুড়ো তো প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে মরে—ঝরে সাবাড়! আর মালিকরা থাকে দিল্লিতে।
নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ ভয়ের চোটে কেউ আর ও—বাড়িমুখো হয় না। আমার কথা অবিশ্যি আলাদা। আমি ভূতে—টুতে বিশ্বাস করি না। রাতে একা অন্ধকারে ছাদে বেড়িয়ে আসি। সত্যি কথা বলতে কী ওই এক বেড়াল ছাড়া আমি কিছুতেই ভয় পাই না। শুধু বেড়াল দেখলেই কীরকম গা—শির শির করে।
যাই হোক, বিকেলে সকলে মিলে ওঁদের দক্ষিণের বারান্দায় বেতের চেয়ার—টেবিলে বসে মাংসের শিঙাড়া, মুরগির স্যান্ডউইচ, ক্ষীরের পান্তুয়া, গোলাপি কেক আরও কত কী যে সাঁটালাম তার হিসেব নেই। কিন্তু তারপরেই হল মুশকিল। কোথায় এবার গুটিগুটি বাড়ি যাব, তা নয়। গান, বাজনা, নাচ, কবিতা বলা শুরু হল। হাঁপিয়ে উঠি আর কী! শেষটায় কি না আমাকে নিয়ে টানাটানি। আমিও কিছুতেই রাজি হব না! মা—র মেসোমশাই আবার ঠাট্টা করে বললেন, ‘ওঃ গান—বাজনা হল গিয়ে মেয়েদের কাজ, আর উনি ভারি লায়েক হয়েছেন। আচ্ছা দেখি তো তুই কেমন পুরুষ বাচ্চা; যা তো দেখি একলা একলা ওই ভূতের বাড়িতে, তবেই বুঝব কত সাহস!’ আর সবাই তাই শুনে হ্যা হ্যা করে হেসেই কুটোপাটি!
শুনলে কথা! রাগে আমার গা জ্বলে গেল, উঠে বললাম, ‘কি ভয় দেখাচ্ছ আমাকে? ভূত—ফুত আমি বিশ্বাস করি না। এই দেখ গেলাম।’ বলেই বাগান পার হয়ে টেনে দৌড় মারলাম। এক মিনিটে পাঁচিল টপকে ওবাড়ি!
হাঁটু ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েই মনে হল ভূত না মানলেও, কাজটা ভালো হয়নি। কীরকম যেন থমথমে চুপচাপ। দুষ্টু লোকদেরপক্ষেও ওইখানে লুকিয়ে থাকা কিছুই আশ্চর্য নয়।
যাই হোক টিটকিরি আমার কোনোকালেই সহ্য হয় না, কাজেই না এসে উপায়ও ছিল না। গুটিগুটি এগুলাম। তখনও একেবারে অন্ধকার হয়নি, একটু একটু আলো রয়েছে। দেখলাম দরজা জানলা ভেঙে ঝুলে রয়েছে, শ্বেতপাথরের সাদা—কালো মেঝে ফুঁড়ে বটগাছ গজিয়েছে, চারদিকে সাংঘাতিক মাকড়সার জাল। তার উপর আবার কীরকম একটা হাওয়া বইতে শুরু করেছে, ভাঙা দরজা জানলা খটখট করছে, মাকড়সার জাল দুলছে, দোতলা থেকে কী অদ্ভুত সব আওয়াজ আসছে মানুষ হাঁটার মতো, বাক্সপ্যাঁটরা টানাটানি করার মতো। অথচ মস্ত কাঠের সিঁড়িটা ভেঙে নীচে পড়ে আছে। এদিক দিয়ে ওপরে উঠবার জো নেই। চাকরদের ঘোরানো সিঁড়িও ভাঙা।
মিথ্যা বলব না, বুকটা একটু ঢিপঢিপ করছিল। ঘর থেকে বেরিয়ে আবার বাইরে এলাম। এমন সময় দেখি চাকরদের সিঁড়িটার পাশেই একাট গাছ—ছাঁটা কাঁচি হাতে একজন উড়ে মালি। উঃ, হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। তা হলে বাড়িটা একদম খালি নয়, জানলায় হয়তো ওকেই দেখা যায়, আঁকড়ে—মাকড়ে হয়তো দোতলায় ওঠে।
মালি কাছে এসে হেসে বলল, ‘কি খোকাবাবু ভয় পেলে নাকি? আমার নাম অধিকারী, হেথায় কাজ করি।’ আমি বললাম, ‘দূর, ভয় পাব কেন? কিসের ভয় পাব? সে বলল, ‘না ভয়ের চোটে কেউ আজকাল এই পাশে আসেই না, তাই বললাম।’ আমি হেসে বললাম—’যাঃ, আমি ভূত—টুত বিশ্বাস করি না।’ অধিকারী লোকটা ভারি ভালো, আমাকে সমস্ত বাড়িটা দেখাল। দুঃখ করতে লাগল কর্তারা আসে না, সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে—ঝাড়লণ্ঠনগুলো ভেঙে পড়ছে, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মেহগিনি কাঠের আসবাবে সব পোকা ধরেছে, রোদে জলে মস্ত—মস্ত ছবিগুলোর রং চটে যাচ্ছে। বাস্তবিক কিছুই আর বাকি নেই দেখলাম। একা একজন মালি আর কত করতে পারে!
বাগানেও সব হিমালয় থেকে আনা ধুতরো ফুলগুলোতে আর ফুল হয় না, কুর্চিগাছ মরে গেছে, আমগাছে ঘুণ ধরেছে, বলতে বলতে অধিকারী কেঁদে ফেলে আর কী—’কেউ দেখতেও আসে না।’
শেষে উঠোনের কোণে ওর নিজের ঘরে নিয়ে গেল। পরিষ্কার তকতকে দাওয়ায় বসিয়ে ডাব খাওয়াল, ভাবছিলাম লোকেরা যে কি ভীতুই হয়! কী দেখে যে ভূত দ্যাখে ভেবে হাসিও পাচ্ছিল। তারার আলোয় চারদিক ফুটফুট করছিল। আমার পাশে বসে অধিকারী বলল, ‘কেউ এ বাড়ি আসে না কেন বল দিকিনি? সেকালে কত জাঁকজমক ছিল। গাড়িতে গাড়িতে ভিড় হয়ে থাকত, গাড়োয়ানরা, সইসরা এখানে বসে ডাব খেত, তামাক খেত, চারদিক গমগম করত।’ আমি তাকে বললাম, ‘ওরা বলে কি না এ বাড়িতে ভূত আছে তাই ভয়ের চোটে আসে না।’ শুনে অধিকারী বেজায় চটে গেল, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভূত? এ বাড়িতে আবার ভূত কোথায়? নিজের বাড়ির জানলায় বড়োকর্তা নিজে দাঁড়ালেও লোকে ভূতের ভয় পাবে? বললেই হল ভূত! আমি তোমাকে বলছি খোকাবাবু, একশো বছর ধরে এবাড়ির কাজ করছি, একদিনের জন্যও দেশে যাইনি, কিন্তু কই একবারও তো চোখে ভূত দেখলাম না?’ বলে একবার চারদিকে চেয়ে বলল, ‘যাই, আমার আবার চাঁদ উঠবার পর আর থাকবার জো নেই।’ বলেই, সে তোমরা বিশ্বাস কর আর নাই কর, লোকটা আমার চোখের সামনে মিলিয়ে গেল। দেশলাই কাঠিতে ফুঁ দিলে আগুনটা যেমন মিলিয়ে যায়, ঠিক সেইরকম করে। চারদিকে বাতাস বইতে লাগল, দরজা—জানালা দুলতে লাগল, পুবদিকে চাঁদ উঠলে লাগল, আর আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ভাঙা সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এই দেখ এখনও হাঁপাচ্ছি।