পাশের বাড়ি
সকালে ওই বাড়িটায় আবার গেল প্রীতম। কলিংবেল দুইবার বাজানোর পরেই সেই মহিলা এলেন যার সঙ্গে প্রথম গতকাল রাত্রে এই বাড়িতে এসেছিল ও।
ওহ আপনি। আসুন। সারারাত জেগে থাকার ছাপ ওনার চোখেমুখে। ফর্সা মুখটায় ক্লান্তির প্রলেপ। নাইটির ওপর হাউজকোট চাপানো। ওনার সঙ্গে ঘরে ঢুকল ও। সেই প্রৌঢ় এখন দেওয়ালে হেলান দিয়ে ডিভানে পা ছড়িয়ে বসে আছেন।
—কেমন আছেন এখন? জিগ্যেস করল প্রীতম।
ভদ্রলোক উত্তর না দিয়ে সামান্য বিস্ময় নিয়ে শুধু তাকালেন প্রীতমের দিকে।
আসলে গতকাল মাঝরাতে কলিংবেলটা দু-তিনবার অধৈর্যভাবে বেজে উঠতেই ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসেছিল প্রীতম। লাইট জ্বালিয়ে ঘুম চোখে দরজা খুলতেই বেজায় ঘাবড়েছিল। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে। চেনা। উলটো দিকের বাড়িতেই থাকেন। নাইটি পরা। চোখে মুখে ভয়।
—হ্যাঁ, বলুন?
—আমি আসলে খুবই লজ্জিত মাঝরাতে আপনাকে এভাবে ডিস্টার্ব করার জন্য। আমি আপনাদের জাস্ট উলটো দিকের…।
—জানি। কী হয়েছে বলুন?
—আমার হাজব্যান্ডের টেমপারেচারটা খুব বেড়ে গেছে। কী করব বুঝতে পারছি না। এত রাত্রে ডক্টরই বা কোথায়…। আমি মানে…। থেমে গিয়ে নিজের ঠোঁট কামড়েছিলেন মহিলা টেনশনে।
—আরে ভয়ের কিছু নেই, চলুন দেখছি। চোখ রগড়ে বলেছিল প্রীতম। ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে মহিলার সঙ্গে রাস্তা ক্রস করেছিল।
একতলা ছিমছাম বাড়ি। মাধবীলতায় ঢাকা গেটের ফলকে লেখা ‘দুইজন’। গ্রিলের গেট খুলে ঘরে ঢুকেছিল দু’জন। ড্রয়িংরুমে ডিভানে কম করে ষাটের ওপর বয়সের একজন মানুষ গায়ে বালাপোশ ঢাকা দিয়ে কুঁকড়ে শুয়ে। কপালে জলপট্টি। অল্প গোঁঙাচ্ছেন। প্রীতম অবাক হয়ে মহিলার দিকে তাকাতেই উনি বলে উঠেছিলেন, আমার হাজব্যান্ড। কয়েকদিন ধরেই চলছিল জ্বরটা, আজ স্নান করতে বারণ করেছিলাম। শোনেননি।
—কেন?
—উনি আমার কথা শোনেন না। মহিলার গলায় ক্লান্ত বিরক্তি।
—আআহহহ…মঞ্জুউউউহহ…উহহ…নিজের কপালের ওপর হাত রেখেছিলেন ভদ্রলোক।
—বাড়িতে কোনও জ্বরের ওষুধ নেই?
—ছিল, উনি ফেলে দিয়েছেন।
—ফেলে দিয়েছেন! কেন? প্রতীমের মুখ থেকে আপসেই বেরিয়ে এসেছিল কথাটা।
—আমি জানি না। উনিই বলতে পারবেন। ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন মহিলা।
ভদ্রলোকের হাতে হাত রেখেছিল প্রীতম। প্রচণ্ড গরম। মহিলা বলেছিলেন, একশো চার।
প্রীতম বলল, একটু ওয়েট করুন, আমি এক্ষুনি আসছি। বলে প্রায় দৌড়ে আবার রাস্তা ক্রস করে নিজের ঘরে এসে ড্রয়ার খুলে ঘেঁটে শেষ পর্যন্ত দুটো ক্যালপল পেয়ে গেছিল। আবার ফিরে এসেছিল এই বাড়িতে। মহিলা জলপট্টি পাল্টাচ্ছিলেন। এই নিন, এখন একটা খাইয়ে দিন।
—আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। মাঝরাতে এভাবে ডিস্টার্ব করলাম বলে দুঃখিত।
—না না, ঠিক আছে। প্রবলেম তো যে কোনও কারোরই হতে পারে। আপনি ওষুধটা খাইয়ে দিন। দরকার পড়লে নিঃসংকোচে ডাকবেন।
—থ্যাঙ্কয়ু…গুডনাইট।
বাড়ি ফিরে আসার পর আজ সকালে আবার সেই বাড়িতেই গেল প্রীতম।
মহিলা বললেন, এই ছেলেটিই তোমাকে কাল রাত্রে জ্বরের ওষুধ দিয়েছিল। মল্লিক বাড়ির নীচে ভাড়া থাকে।
—অ। নমস্কার। হ্যাঁ, ভালো আছি। বসুন।
—আমাকে আপনি বা নমস্কার কোনওটাই বলবেন না প্লিজ। ডিভানের উলটো দিকের সোফায় বসতে বসতে বলল প্রীতম।
—হুম তা ঠিক। তুমি আমার থেকে অনেকটাই ছোট। বলে গলায় খানিকটা কফ ঝাড়লেন উনি। প্রীতম ভাবছিল এই লোকটার বয়স মহিলার থেকে বোধহয় দু’গুণ বেশি হবে। বিয়ে হল কী করে কে জানে!
—কী নাম তোমার? ঘড়ঘড়ে গলায় জিগ্যেস করলেন ভদ্রলোক।
—প্রীতম ব্যানার্জি।
—হুম। কী করা হয়?
আমি সি এস পড়ছি। চাকরিও করি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে। ডালহৌসিতে অফিস।
বাহ, বেশ। এখানে তো বোধহয় ভাড়া থাকো?
হ্যাঁ। আমার বাড়ি শক্তিগড়ে। এই মাসকয়েক হল এখানে ভাড়া এসেছি।
—তা ভালোই করেছ। এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি। পড়াশোনার পক্ষে ভালো।
—হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আমি আসলে আগে কলকাতায় একটা মেসে ছিলাম কিছুদিন। একদম ভালো লাগছিল না। তারপর আমার এক বন্ধু, এই উত্তরপাড়াতেই থাকে। ওর যোগাযোগে খুব কম ভাড়ায় লাকিলি বাড়িটা পেয়ে গেলাম।
—আমরাও খুব বেশিদিন আসিনি। এই বছর দেড়েক হল সবে। বললেন মহিলা।
—ও আচ্ছা, বলে প্রীতম তাকাল মহিলার দিকে। চল্লিশের মতো বয়স। দারুণ দেখতে। ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা। একবার তাকালে যে কারুরই চোখ সরাতে সময় লাগবে। মহিলাকে বেশ কয়েকদিন সকালে রিক্সায় করে বেরোতে দেখেছে। ভদ্রলোককে আজই প্রথম দেখল ও।
—বসুন, চা বানাচ্ছি। বললেন মহিলা।
—এই রে আমাকে ‘আপনি’ বলছেন! এটা ঠিক না। বলে সামান্য হাসল প্রীতম।
মহিলা মুখে কিছু না বলে শুধু মুচকি হাসলেন। মিষ্টি হাসিটা। হাজব্যান্ডকে জিগ্যেস করলেন, তুমি কি আর এক কাপ খাবে?
—না।
—একটু খেলে ভালো লাগবে। সর্দি হয়েছে তো।
—আহ বললাম তো খাব না। কেন বিরক্ত করছ?
মহিলা চলে গেলেন। বিরক্ত করার মতন কি বলেছিলেন উনি বুঝতে পারল না প্রীতম। ভদ্রলোকের ভুরু কুঁচকেই থাকল।
প্রীতম চুপ। বাড়ির গেটের সামনে দুবার রিকশার প্যাঁক প্যাঁক শুনে উনি আবার চটলেন। ওই…ওই হারামজাদা এসে গেছে। ওফ, যত্ত ছোট লোকদের আড্ডা এই বাড়িতে!
রিকশাওয়ালা কেন হারামজাদা হবে আর আড্ডাটাই বা কোথায় হল ধরতে পারল না প্রীতম। মহিলা পাশের ঘর থেকে হর্নের শব্দ শুনে বারান্দায় গিয়ে বললেন, আজ যাব না গনেশ। দাদাবাবুর শরীর ভালো নেই।
উনি ঘরে ফিরতে প্রীতম বলল, জেঠুকে একবার ডক্টর দেখিয়ে নিলে ভালো হতো।
—বলেছিলাম। উনি যাবেন না।
—কী হবে গিয়ে? আর তো এমনিতেও বেশিদিন নেই আমি।
—এ হে…এমন বলবেন না। আসলে রাতবিরেতে যদি আবার বাড়াবাড়ি হয় আবার…পর্যন্ত বলে থেমে গেল প্রীতম। বাকিটুকু ধরে নিলেন মহিলা। কেন আমি আছি তো সারা রাত ছুটোছুটির জন্য। বলে উনি আবার পাশের ঘরে চলে গেলেন। স্বামী-স্ত্রীর ঝামেলার মাঝখানে পড়ে প্রীতম কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। ভাবতে ভাবতে চা চলে এল। মহিলা সুন্দর কাপ ডিশে প্রীতমকে চা বিস্কিট দিয়ে নিজে চেয়ারে বসলেন। তারপর টুকটাক কথা। প্রীতম নিজের কথা বাড়ির কথা জানাল এবং জানল যে ভদ্রলোকের নাম অভ্র বিশ্বাস। রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিসট্রেট। ওনার ওয়াইফের নাম মঞ্জুশ্রী। একটা নাম করা ফার্মাসিটিকাল কোম্পানির কেমিষ্ট। এখানে আসার আগে থাকতেন দমদম-এ। কিন্তু পলিউশনে ভদ্রলোকের ব্রিদিং ট্রাবল শুরু হওয়ায় ডক্টরের সাজেশনে এই উত্তরপাড়ায় বাড়ি কিনে চলে আসেন। একটিই ছেলে। নাম ঋক। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়র। প্রীতমের থেকে বয়েসে খানিকটা ছোট। জার্মানিতে সেটেলড।
মহিলা বললেন, আচ্ছা আপনার চেনাশোনা কাছাকাছি কোনও ভালো নার্সিংহোম জানা আছে?
—কেন বলুন তো?
—ওর হার্নিয়া অপারেশন করানো খুব দরকার। মাঝে মধ্যেই ব্যথা ওঠে। কিন্তু উনি করাবেন না।
—হুম…শ্রীরামপুরে সেবা নার্সিংহোমের নাম শুনেছেন?
—হ্যাঁ। শুনেছি ভালো।
—ওখানে আমার এক বন্ধু তিমির চক্রবর্তী জুনিয়র ডক্টর হিসেবে যুক্ত আছে। যদি বলেন তো ওর সঙ্গে কথা বলতে পারি। বলব?
এবার ভদ্রলোক বললেন, না নাহ…ও সব দরকার নেই। আমি দিব্বি আছি। ফালতু এই বয়েসে কাটা ছেঁড়া…। আর কদ্দিনই বা বাঁচব…।
—ধেৎ… কীই যে বলেন…! যে কদ্দিনই থাকুন, সুস্থভাবে বাঁচাই তো ভালো, তাই না?
—হুম…ঠিক আছে এই নিয়ে পরে কথা হবে, বলে উনি প্রসঙ্গ এড়ালেন। প্রীতমও আর কথা বাড়াল না।
—আমি এবার উঠি জেঠু। উঠে দাঁড়াল প্রীতম।
—হ্যাঁ, এসো।
ওনার স্ত্রী প্রীতমের সঙ্গে বারান্দায় এলেন। গ্রিলের তালা খুলতে খুলতে বললেন, থ্যাঙ্কস এগেইন।
—এ বাবা থ্যাঙ্কসের কী আছে? পায়ে চটি গলিয়ে প্রীতম বলল।
—এই যে আমার হয়ে ওনাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করলে, সেই জন্য। একটু দেখো কেমন, যদি রাজি করাতে পারো। আমার কথা তো শোনেন না।
—শিওর। আচ্ছা আসছি বউদি।
—আরে সব্বোনাশ…! উনি জেঠু আর আমি বউদি! উদি শুনলে আবার চটবেন।
—এই রে…তাহলে?
—হি হি…না-না এমনিই বললাম। তোমার যা মন চায় তাই ডেকো, বলে উনি হাসলেন। ‘বউদি’ ডাকটায় যে উনি খুবই খুশি হয়েছেন, সেটা আড়াল করলেন না।
দুই
দিন দশ পনেরোর মধ্যেই প্রীতমের সঙ্গে বেশ ভালো জমে গেল ফ্যামিলিটার। দু-এক দিন পর পরেই ওই বাড়িতে নেমন্তন্ন। বউদি রাঁধেও দারুণ। অভ্র বিশ্বাসকে প্রথমে যতটা খিটখিটে ভেবেছিল ততটা নয়। বরং মুড ভালো থাকলে উনি বেশ মজাদার। বুক সেলফে যেসব দেশি বিদেশি সাহিত্যগুলো আছে তার বেশির ভাগই ওনার পড়া। অগাধ পড়াশুনো। স্মৃতিও তুখোড়। এই আটষট্টি বছর বয়েসেও রোজ বিকেলে পাড়ার লাইব্রেরিতে যান। সন্ধে পর্যন্ত পড়েন। টানটান চেহারা। একমাথা সাদা চুল। সঙ্গে মানানসই ব্যক্তিত্ব। চাকরিসূত্রে বহু জায়গা ঘুরেছেন। সেইসব অভিজ্ঞতার গল্পও খুব সুন্দর গুছিয়ে বলতে পারেন। এমনকী প্রীতমের ওনাকে ‘জেঠু’ আর ওনার স্ত্রীকে ‘বউদি’ ডাকাটাও মেনে নিয়েছেন দিব্বি। সবই ঠিক আছে, শুধু বউদি সামনে আসলেই ওনার যত জড়তা, কখনো কমবেশি খিটখিটে। এর কারণটা বুঝে পায় না প্রীতম। মাঝেমধ্যে অকারণেই ঝামেলা করে লোকটা। কী যে সুখ পায়! এই তো সেদিনই, সন্ধেবেলা জেঠু আর ও মিলে গল্প করছিল, বউদি অফিস থেকে ফিরে জেঠুকে স্বাভাবিক ভাবেই জিগ্যেস করলেন, ওষুধগুলো খেয়েছ?
—কেন?
—এমনই। খেয়েছ কি না জানতে চাইছি।
—কী শুনলে খুশি হবে বলো?
বউদি কয়েক সেকেন্ড অপলক তাকিয়ে রইলেন জেঠুর দিকে। তারপর আর কিছু না বলে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। প্রীতম বুঝে গেল, বলল, জেঠু, আমি তাহলে উঠছি আজকে।
ভেতর থেকে বউদি উত্তর দিলেন, চা বসাচ্ছি। খেয়ে যেও।
—না না, আজ থাক। এই সবে অফিস থেকে এলেন।
—চুপ করে বসো। যা বলছি। ওই ঘর থেকে উত্তর এল;
—আরে বসো বসো। তোমার বউদি অফিস থেকেই এসেছে, সারা রাত্তির মেল ট্রেন চালিয়ে তো আর আসেনি। অভ্র পিন মারলেন। অগত্যা বসতে হল। উনি কেন অকারণ পিনটা মারলেন, সেটা বোঝার চেষ্টা করল প্রীতম। একটু পরেই বউদি এলেন। হাতে চায়ের ট্রে-টা নিয়ে টেবিলে রাখলেন। বউদি মাথায় তোয়ালে জড়ানো। স্লিভলেস নাইটি পরা। তাকাতে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল প্রীতমের। গোটা ঘরটা সাবানের মিষ্টি গন্ধে ভর্তি। তোমরা চা খাও। আমি মাথাটা মুছে আসছি। অভ্র কিছু বললেন না। প্রীতম মাথা নীচু করে ঘাড় নাড়ল। চোখ পড়ল বউদির নিটোল ধবধবে ফর্সা হাতদুটোর ওপর। চায়ের কাপে তাড়াতাড়ি চুমুক দিতে গিয়ে জিভ পুড়ে খাক। মুখ বিকৃত করে ফেলল প্রীতম। বউদি কী বুঝলেন কে জানে, ফিক করে হেসে ফেলে মৃদু গলায় বললেন, আস্ত পাগল একটা। বলে চলে গেলেন। মাথায় ঝিম লাগল প্রীতমের।
জেঠু বেশ স্বাভাবিক ভাবেই জিগ্যেস করলেন, তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?
—চলছে।
—কলকাতার বাইরে চাকরি হলে কি চলে যাবে?
—হ্যাঁ। কোনও অসুবিধা নেই।
—হু..ম। তা ভালো।
এবার প্রীতম জিগ্যেস করল, আপনার ছেলে কেমন আছে?
—আছে, ভালোই আছে। বহাল তবিয়তেই আছে। খানিক অবজ্ঞা ছিটিয়েই বললেন উনি। হয়তো একমাত্র ছেলের বিদেশে থাকার অভিমান। তোমার বউদিই তার খবর বলতে পারবেন। বলে ঝোলানো গোঁফের তলায় ঠোঁট দুটো সামান্য বাঁকালেন। সংসার বড় বিচিত্র, বুঝলে প্রীতম। এখন বুঝবে না। আমার মতন বয়েস হোক। চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে কথাটা বলে বিস্কুটটা তুলতে গেলেন উনি। বিস্কুটের ভিজে অংশটা টপাক করে খসে পড়ল চায়ের কাপে। হাতে ধরা শুকনো বাকিটা দিয়ে ওইটুকু তুলতে গিয়ে পুরোটাই খসে পড়ে ভাসতে থাকল। বিরক্তিতে বিড়বিড় করে কী সব বলে উনি কাপটা সরিয়ে রাখলেন। অসম্ভব হাসিটা কীভাবে চাপবে বুঝতে পারছিল না প্রীতম। এই সময় বউদি এসে বাঁচালেন। তোমার বন্ধু ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছ জেঠুর ব্যাপারে?
—ওহ…হ্যাঁ হ্যাঁ, বলেছি তো। আপনি আমাকে জেঠুর প্রেসক্রিশন আর রিপোর্টগুলো দিয়ে দেবেন। ও দেখতে চেয়েছে।
—সব ফাইল করাই আছে। আজই নিয়ে যেও।
সাবানের সঙ্গে এখন একটা সুন্দর পাউডারের গন্ধ মিশেছে। তার সঙ্গে সব ছাপিয়ে আরও কেমন একটা অজানা গন্ধ। শরীর শরীর। একেবারে অন্যরকম। ভীষণ মন কেমন করা! উফ…গন্ধটাকে এক কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।…নাহহ…।
—আমি যাই।
—এক মিনিট দাঁড়াও। ফাইলটা নিয়ে যাও।
—হ্যাঁ দিন। আমি কালকেই কথা বলে নেব।
তিন
সকাল থেকে রাত্তির, রাত্তির থেকে সকাল সারা দিন সারা রাত একটা অদ্ভুত ভালোলাগা জড়িয়ে থাকে প্রীতমকে। একটা অবশ ঘোর গোটা শরীর-মন জুড়ে। একটা ভীষণ কিছু করে ফেলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেইটা কী তা জানা নেই। দুইজন লেখা বাড়িটা সারাক্ষণ নেশার মতো টানে। ঘুম হয় না। গতকাল রাত্রেও এপাশ-ওপাশ, কোল বালিশের জায়গা বদল, ভোর রাতে স্বপ্ন। দু’চোখে, মনে, মাথায় একটি চেনা নারীর শরীরের হাঁটাচলা, কথা বলা…হাসি…। বড্ড কাছে মনে হয়, কিন্তু হাত বাড়াতে গেলেই এক আলোকবর্ষ।
পরদিন রবিবার সকাল সাড়ে দশটায় অভ্র বিশ্বাস গুম হয়ে ডিভানে বসে আছেন। সোফায় প্রীতম আর চেয়ারে বউদি।
—কাল রাত্রে ঘুমাওনি নাকি? বউদি জিগ্যেস করলেন।
—অ্যাঁ…নন…না না…ওই পড়ছিলাম, রাত হয়ে গেল। কোনও মতে ম্যানেজ দিল প্রীতম।
—অত রাত কোরো না। শরীর খারাপ হবে। ভোর বেলা উঠে পড়বে।
—হুম…। আচ্ছা।
—এবার বলো, ডাক্তারের সঙ্গে কথা হয়েছে?
—হ্যাঁ। ডাক্তার বললেন জেঠুর ইমিডিয়েট অপরাশেন করানো দরকার।
—আরে না নাহ…ওই সব ঝামেলায় আমি নেই। ফালতু ফালতু কাটাকুটি… যত্তসব। অভ্র প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন।
—কিন্তু জেঠু, না করলে পরে আপনারই প্রবলেম হবে। আর তেমন মেজর কিছু অপারেশন তো না। কয়েকদিন পরেই ছেড়ে দেয় বলল। ব্যাস ঝামেলা থেকে মুক্তি।
—আ…র মুক্তি…হু…হ!…ঠিক আছে দেখছি, বসো। টয়লেট থেকে আসছি, বলে অভ্র উঠলেন।
প্রীতম বউদির দিকে তাকাল। বউদি দু-হাত পিছনে তুলে খোঁপা বাঁধছে। আজও স্লিভলেস নাইটি। কী বলতে গেছিল, ভুলে গেল প্রীতম। তাকিয়ে থাকল।
—কী…ই? ভুরু নাচিয়ে ঠোঁট টিপে হাসল বউদি। কী ব্যাপার?
—অ্যাঁ…ওহ হ্যাঁ…হ্যাঁ…বলছিলাম যে….।
থাক খুব হয়েছে আর বলে কাজ নেই। পাজি ছেলে একটা।
—পাজি…আমি!….কেন?
—তুমিই জানো…হি হি।
প্রীতম ঘাবড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টাল। ওহ…হ্যাঁ, আপনাকে একটা কথা জিগ্যেস করব?
—শিওর। পারমিশন নেওয়ার কী আছে? নড়েচড়ে বসলেন মঞ্জুশ্রী।
—আসলে ভাবছি দিন দুই কোথাও গিয়ে ঘুরে আসব। ভালো লাগছে না। শুধু অফিস আর বাড়ি।
—ও…, তা কোথায় যাবে ভাবছ?
—সেইটাই আপনাকে জিগ্যেস করছি। আপনারা তো অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। কোনো কাছাকাছি জায়গা সাজেস্ট করুন না।
—কে কে যাবে সঙ্গে?
—আমার তো আমি ছাড়া আর কেউ নেই।
—তাই-ই…আচ্ছা।
—হুম।
—যদি আমি যাই? নেবে? বলে হাসলেন বউদি।
—আপনি! বুকের ভেতর কী যেন ধড়াস করে পড়ার শব্দ হল।
—কেন? নেবে না বুঝি?
এবার কী বলবে ভেবে পেল না প্রীতম। জিভ টাকরায় আটকে গেছে।
—অত ভয় পেতে হবে না রে বাবা। আমি যাব না। খুশি? আর আমি তো বুড়ি হয়ে গেছি। আমাকে নেবেই বা কেন? বলে আড়মোড়া ভাঙলেন। গোটা শরীর সিরসির করে উঠল প্রীতমের। ও-ও হেসে উত্তর দিল কে বলেছে আপনি বুড়ি?
—কেন, বুড়ি নই?
—একটুও না।
—কেন? আমাকে বুড়িদের মতন লাগে না দেখতে? সামান্য চিকচিকে হল মঞ্জুশ্রীর চোখ।
—মোটেই না। সেই জন্যই তো বউদি বলি।
—যাহ…কী যে বলো না! হি হি…। বুড়ি বলেই তো আমাকে এখনও ‘আপনি’ বলো। কিছুতেই ‘তুমি’ বললে না। বলে কিশোরীর মতন হেসে উঠলেন বউদি। বসো ম্যাগি খেয়ে যাও।
—না না, আমি এবার উঠব।
—এই ছেলে তো খালি পালাই পালাই করে। চুপ করে বসো। আমার সঙ্গে গল্প করতে কি খুব খারাপ লাগে?
—যাহ…কী-ই যে বলেন না!
—নাকি তোমার মতন সুন্দর দেখতে নয় বলে…
—ধেৎ! লজ্জা পেল প্রীতম। ভেতরে গেঞ্জি ভিজে উঠেছিল ঘামে। তারপর বলেই ফেলল, আপনি যা দেখতে!
—থাক, আর মিথ্যে কথা বলতে হবে না।
—আরে সত্যি বলছি। খু-ব সুন্দর। বলে ফেলেই সামান্য জিভ কেটে মাথা নীচু করে চুপ। জীবনে এই প্রথম কোনও মেয়েকে সরাসরি সুন্দর বলল প্রীতম। নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।
হি হি হি করে হেসে উঠলেন বউদি শরীর উচ্ছল করে। তোমার গার্লফ্রেন্ডকে বোলো। ধরে পিটুনি দেবে তোমায়।
—আমার কোনও গার্লফ্রেন্ডই নেই।
—এই, একদম বাজে কথা বলবে না আমাকে।
—সত্যিই…। জোর দিয়ে বলল প্রীতম। কেউ নেই।
—সে কী…এমন হিরোর কেউ হিরোইন নেই? বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে।…এই আমাকে মিথ্যে বলছ না তো? মহিলা কেমন যেন নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন মনে হল প্রীতমের।
—কোনও কালেই ছিল না।
—আহারে… কেন?
—জানি না।…আমার ভয় লাগে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে।
—ভয়…কীসের? এই তো দিব্বি আমার সঙ্গে গল্প করছ।
—আপনি কি আমার…পর্যন্ত বলেই ব্রেক কষতে গেল প্রীতম। কিন্তু তার আগেই ফাউল হয়ে গেছে।
হি হি হি…আবার কিশোরীর মতন হেসে উঠলেন বউদি। তারপর বললেন, তুমি খুব সরল প্রীতম। এখনকার দিনে তোমার মতন ছেলে রেয়ার। তোমাকে যে পাবে সে সুখী হবে দেখো।
—জেঠু টয়লেট থেকে এল না কেন এখনও? প্রীতম প্রসঙ্গ পাল্টাল।
—তোমার জেঠু আসলে পটি গেছেন। ওখানে ওনার কম করে একঘণ্টা লাগে। কন্সটিপেশন আছে তো।
—ও। তা’লে আমি এখন যাই।
—না খেয়েই?
—পরে খাব।
আচ্ছা, ঠিক আছে। আর হ্যাঁ, শোনো আমার একটা কথা রাখবে?
—কী?
—আমাকে এই ‘আপনি’ বলা ছেড়ে ‘তুমি’ বলবে এবার থেকে। প্লিজ..প্লি…জ।
—এই রে…জেঠু তো আমার থেকে অনেক বড়!
—আমি কি জেঠুর কথা বলেছি? আমার কথা বলছি।
—তার মানে জেঠুকে ‘আপনি’ আর আপনাকে ‘তুমি’? কিন্তু যদি কখনও গুলিয়ে যায়?
—হি হি, বেশ মজা হবে। প্লিজ আমার এই কথাটা রেখ। বলতে বলতে হাতের চাবির গোছা নিয়ে সামনে এগিয়ে এলেন বউদি। প্রীতমের বুকের ঢিবঢিব মুহূর্তে ধুপধাপ হয়ে গেল। কী যেন একটা বলতে গিয়ে বিষম খেল।
—দেখো কাণ্ড, ছেলে শুকনো বিষম খাচ্ছে! জল খাও। প্রীতমের নাকে, মুখে, গোটা শরীর জুড়ে আবার সেই আনচান করা অজানা গন্ধটা।
কোনও মতে দুপুরটা বিছানায় গড়িয়ে সময় কাটিয়ে বিকেল নামতেই উঠে পড়ল প্রীতম। ওই বাড়ি যাবে। জেঠু এতক্ষণে নিশ্চই লাইব্রেরি চলে গেছে। বউদি একা। চটপট গায়ে জামাপ্যান্ট গলিয়ে ডিও মেখে বেরোতে গিয়ে দেখল ওই বাড়ির সামনে রিক্সা দাঁড়িয়ে। মানে গণেশ এসেছে। কাজকম্ম কিছু করাচ্ছে বোধ হয় বউদি। প্রীতমকে দেখলে নিশ্চই ওকে ছেড়ে দেবে। তারপর…? অনেক গভীরে কল্পনায় মুহূর্তে কিছু একটা ভেসে উঠতেই সামান্য কেঁপে উঠল প্রীতম। প্রায় ভাসতে ভাসতেই রাস্তা পার করে ওই বাড়ি পৌঁছল। গ্রিলের গেটটায় আজ তালা দেওয়া নেই। বেখেয়াল? চটি খুলে বারান্দায় উঠতেই থমকে গেল প্রীতম। ঘরের জানলা দরজায় পর্দা ফেলা। ফ্যানের হাওয়ায় প্রীতম একঝলক দেখল বউদি সোফাতে আয়েস করে বসে আছেন আর মেঝেতে গনেশ বসে সবজি কুটছে আর বউদি সামান্য নীচু গলায় কী যেন বলছে ওকে।
শুনল প্রীতম। বউদি বললেন, তুমি কিন্তু এবারও আমাকে একই সিডি এনে দিয়েছ গণেশ। ব্যাপার কী?
—এই রে, এবারেও একই সিডি হয়ে গেছে! যাহহ…মিনমিন করে উত্তর দিল গণেশ। দোকানদারটাকে এবার ঝাড় দিতে হবে। আসলে বুলু সিডি বোধহয় ওর কাছে আর নতুন নেই। সে জন্য।
—তো অন্য দোকান থেকে আনবে। দোকানের কী অভাব আছে? একটা কাজ যদি তোমাকে দিয়ে ঠিকমতো হয়…! ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মঞ্জুশ্রী।
পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল প্রীতম। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। বারান্দায় পা দুটো আটকে গেছিল। কোনও মতে ঘষটে গ্রিলের গেটের সামনে এসে বেরোতে গিয়ে শব্দ হয়ে গেল।
—কে? ভেতর থেকে জিগ্যেস করলেন মঞ্জুশ্রী।
উত্তর দিল না প্রীতম।
মঞ্জুশ্রী বাইরে বেরিয়ে এসে প্রীতমকে দেখে সামান্য চমকালেন। পরক্ষণেই মেকআপ দিয়ে বললেন, ওমা তুমি। কখন এলে? বোঝো কাণ্ড, আজ গেটে তালা দিতেই ভুলে গেছি। এসো।
প্রীতম অন্যদিকে তাকিয়ে দাঁত চেপে বলল, পরে আসব। তারপর উত্তরের অপেক্ষা না করে হনহন করে হাঁটা লাগাল। ঘরে ঢোকার আগে মুখের ভেতর এতক্ষণ ধরে জমে ওঠা থুতুর দলাটাকে থক করে ফেলল নর্দমায়।
চার
দুই দিনের মধ্যে অফিস কিংবা ইন্সটিটিউট কোথাও গেল না প্রীতম। শুধু নিজের ঘরের মধ্যে থাকল। সারাক্ষণ একটা তীব্র ঘৃণাবোধ, আর তার থেকেও বড় একটা কিছু গুড়োগুড়ো হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা আর সহ্য হচ্ছিল না। এই পাড়া ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবছিল। মোবাইলে দু-একবার ফোন এসেছিল ওই মহিলার। তোলেনি প্রীতম। চেহারাটা চোখের সামনে ভাসলেই মাথায় আগুন ধরে যাচ্ছিল। কবে যে ছাড়তে পারবে…ভুলতে পারবে এই সব কিছু…।
আজ দুপুরে বিছানায় শুয়ে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছিল, হঠাৎ কলিংবেল। দু-তিন বার। উঠতে হল। দরজা খুলতে সামনে মঞ্জুশ্রী, তোমার জেঠুর পেইনটা আবার ভীষণ বেড়েছে। নীচু গলায় বললেন উনি।
—তো আমি কী করতে পারি বলুন? একেবারে কাঠ গলায় প্রশ্নটা করল প্রীতম।
এর উত্তর খুঁজে না পেয়ে অবাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকলেন মঞ্জুশ্রী। তারপর মাথা সামান্য নীচে ঝুঁকিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন…তুমি…!
—আমি ডক্টরের ফোন নম্বরটা দিয়ে দিচ্ছি। দরকার হলে কথা বলে নেবেন, বলে ঘরের ভেতর ঢুকে মোবাইল থেকে তিমিরের নাম্বারটা নিয়ে কাগজে লিখে আবার দরজার সামনে এসে দেখল মঞ্জুশ্রী ধীর পায়ে রাস্তা পার করছেন।
বিকেল সাড়ে চারটের সময় তিমির এসে বলল, অপারেশন হয়ে গেছে। পেশেন্ট ঠিক আছে। মঞ্জুশ্রী করিডরে রাখা বেঞ্চে বসেছিলেন আর প্রীতম খানিক দূরে দাঁড়িয়ে। এতক্ষণে প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি কথাও হয়নি দুজনের। তিমিরের কথা শুনে দুজনেই ওর সামনে এলে মঞ্জুশ্রী বললেন, থ্যাঙ্কস ডক্টর।
—ওয়েলকাম। এই প্রীতম, একবার এদিকে শোন। এক্সকিউজ মি ম্যাডাম।
—ওহ শিওর।
প্রীতমকে করিডরের শেষে নিয়ে গিয়ে তিমির জিগ্যেস করল, এই ফ্যামিলি তোর কেউ হয়?
—না তো, তোকে আগে বলেছি। আমি যেখানে থাকি তার উলটো দিকের বাড়িতে থাকে। নেবার আর কি।
—আচ্ছা। এরা কি হাজব্যান্ড-ওয়াইফ?
—হ্যাঁ।
—শিওর?
—তুই এজ ডিফারেন্স দেখে ডাউট করছিস তো?
—না। অন্য কারণে জিগ্যেস করছি। আচ্ছা, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই নিঃসন্তান?…তাই তো?
—ধুসস…একটা ছেলে আছে। অ্যাবরডে থাকে। তোর সব প্রেডিকশানই ভুল।
—তুই শিওর?
—কীই মুশকিল…! সব কথাতেই শিওর শিওর জিগ্যেস করছিস কেন?
—সাধে কী আর করছি রে ভাই। তুই কি জানিস এই ভদ্রলোক সম্ভবত ইম্পোটেন্ট।
—কীই…কী যা তা বলছিস! তা ছাড়া এই বয়েসে তো সবাইই…।
—আরে বাবা আমি এখনের কথা বলছি না। অপারেশনের সময় স্যারের সঙ্গে আমিও তো ছিলাম। স্যার-ই দেখালেন পেশেন্টের প্রি-পিউজ ইন্ট্যাক্ট।
—তো?
—তো জেনারেলি যাদের ইরেকশন হয়ই না, কিংবা পারশিয়াল ইম্পোটেন্সি থাকে তাদেরই এমনটা হয়, বুঝেছিস।
প্রীতম কোনও উত্তর না দিয়ে শুধু হাঁ করে তাকিয়ে থাকল তিমিরের দিকে।
—কী রে? কী ভাবছিস?
—উঁহহ…না…মানে, তাহলে ওদের ছেলেটা? বেখেয়ালে বোকার মতো প্রশ্নটা করেই ফেলল।
—সে তোর সুন্দরী বউদিই জানে। হা-হা…যাক গে শোন এখনে চলি। পরে কথা হবে। চলে গেল তিমির। প্রীতম চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল কিছুক্ষণ। প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর। কেন যে তখন ওই মহিলাকে ফিরিয়ে দেওয়ার পরেও আবার ওই বুড়োটার কথা মনে করে তিমিরকে ফোন করেছিল। তিমির বলেছিল এক্ষুনি নার্সিংহোমে নিয়ে আসতে। অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থাও করেছিল প্রীতম। নার্সিংহোমে সিনিয়র ডক্টর দেখেই বলেছিলেন ইমিডিয়েট অপারেশন করতে হবে। কেন যে আবার এই ফ্যামিলিটার সঙ্গে নিজেকে জড়াতে গেল? শা…হ! ঘেন্না লাগছে ওই মেয়েছেলেটার কাছে যেতে। দাঁড়িয়েই থাকল ও। অনেকক্ষণ পর মঞ্জুশ্রীই এসে দাঁড়ালেন পাশে।
—কী হয়েছে প্রীতম?
প্রীতম উত্তর দিল না। অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল। বিকেল নামছে।
—প্লিজ বলবে? এনিথিং রং? তোমার জেঠু ঠিক আছে তো?
—আপনার হাজব্যান্ড ঠিক আছে। দয়া করে আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না প্লিজ।…প্লি…জ!
—এভাবে বলছ কেন?
—কীভাবে বললে আপনার বুঝতে সুবিধা হয় বলুন?
—প্রীতম তুমি নিশ্চয়ই কিছু হাইড করছ আমার কাছে।
—আমি? হাইড করছি?…আপনার কাছে? মাপ করবেন। আপনার মতন মিথ্যে বলার স্বভাব আমার নেই।
আমি তোমার কাছে কী মিথ্যে বলেছি?
—ছাড়ুন এইসব কথা আলোচনা করতে আমার রুচিতে বাধছে।
—না বলো তুমি। বলতেই হবে। প্রীতমের হাতটা আলতো করে ধরলেন মঞ্জুশ্রী।
হাতটা ছাড়িয়ে নিল প্রীতম।
—আমি জানি তুমি সেদিন শুনতে পেয়ে গেছ যে আমি গণেশকে দিয়ে ব্লু ফিল্মের সিডি আনাই। আমাকে খারাপও ভাবছ খুব। ভাব। চিরকাল আমাকে সবাই তাই-ই ভেবেছে। কিন্তু আমারও যে কিছু বলার আছে সেটা…।
—প্লিজ, আপাদের পারসোনাল লাইফে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। তবে একটা কথা জানাতে চাই।
—বলো। মৃদুস্বরে বললেন মঞ্জুশ্রী।
—আপনাদের একমাত্র ছেলে তো বিদেশে থাকে। অথচ আপনার হাজব্যান্ড ইম্পোটেন্ট। কী মজার কাণ্ড বলুন। মুখ বিকৃত করে নিঃশব্দে হেসে শব্দগুলো কেটে কেটে বলল প্রীতম। সারা শরীর চিড়বিড় করে জ্বলছে।
আর কিছু বললেন না মঞ্জুশ্রী। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে সামনে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়লেন।
চলে যাচ্ছিল প্রীতম, পিছন থেকে মঞ্জুশ্রী ভাঙা গলায় বললেন, আমাকে একটু জল খাওয়াতে পারো?…প্লিজ!
লাউঞ্জে পাশাপাশি বসে দুজনে। প্রীতম শুধু শুনছে।—’আমার বাড়ি ছিল বালুরঘাটে। বাবা ছিলেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। মা লেকচারার। আমিই এক মেয়ে। বাবা বেশিরভাগ সময়েই বাইরে বাইরে থাকত। গার্জেন বলতে শুধু মা। আমাদের পাড়ার একটা ক্লাব ছিল। ওরা বিভিন্ন সোস্যালওয়ার্ক করত। আমি অ্যাকটিভ মেম্বার ছিলাম। অভ্র বিশ্বাস তখন ওখানকার এস ডি ও। সরকারি পারমিশন বা অন্যান্য কাজে মাঝেমাঝেই ওনার কাছে যেতে হত। আমিই যেতাম বেশিরভাগ সময়। দারুণ পারসোনালিটি, হ্যান্ডসাম লুকিং, আর সব থেকে বড়, ওনার সুন্দর মন ছিল। যাতায়াত করতে করতে শুধু কাজ ছাড়া একটা বন্ধুত্বের সম্পর্কও তৈরি হয়ে গেছিল দুজনের মধ্যে। সাহিত্য, রাজনীতি, আমার পড়াশোনা…অনেক বিষয় নিয়ে গল্প হত। বেশ কয়েকবার আমাদের বাড়িতেও এসেছিলেন উনি।
আমি মাঝেমধ্যেই ওনাকে জিগ্যেস করতাম, বিয়ে করবেন কবে? উনি ঠাট্টা মস্করা করে এড়িয়ে যেতেন। কখনও বলতেন, তোমার মতন একটা সুন্দরী পাত্রী পেলেই করে ফেলব। কিন্তু আসল কারণটা অজানাই থেকে যেত। তবে আমার যে একজন স্টেডি বয়ফ্রেন্ড আছে সেটা উনি জানতেন। আমিই বলেছিলাম তাকে। তুনীর নাম ছিল তার। সে বলত আমাকে ছাড়া বাঁচবে না…এই পর্যন্ত বলে মঞ্জুশ্রী একটু থেমে খুব সামান্য হাসলেন নিজের মনে। তারপর আবার বললেন, তারপর সে যখন আমাকে ছেড়ে চলে গেল, আমি তখন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। কাকে জানাব? মা-বাবাকে বললে আমায় যে কী করবে ভগবান জানেন, কিংবা হয়তো নিজেরাই এই শক সহ্য করতে না পেরে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবেন। সেই ভয়ে তাদেরও বলতে পারছি না। বন্ধুবান্ধবদের কাছে জানাতে লজ্জা করছে। যদি খবরটা সবাই জেনে যায়, ফ্যামিলির মান ইজ্জত সব যাবে। আর কোনও উপায় না দেখে সোজা চলে গেলাম ওনার কাছে। সব বললাম। উনি চুপ করে শুনলেন, তারপর আমাকে জিগ্যেস করলেন, তুমি কী করবে ঠিক করেছ? বললাম, জানি না। উনি বললেন, অ্যাবরশন হয়তো এই সময় ফেটাল হতে পারে।
সত্যি বলতে এই এত কিছুর পরেও অ্যাবরশনে আমারও ভেতর থেকে একটা তীব্র না ছিল। যুক্তিতে নয়, হয়তো…হয়তো প্রথম মাতৃত্বের রোমাঞ্চ…কিংবা একটা প্রতিবাদ…কিছু একটা হবে। আমিও চাইনি। উনি আচমকা বললেন, আমাকে বিয়ে করবে? আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। উনি বললেন, জানি এইটা অ্যাবসার্ড ব্যাপার। কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কোনও সল্যুশন এক্ষুনি মাথায় আসছে না। তুমি ভাব। সময় নিয়ে ভাব। আমি আর ভাবিনি। ভাবতে চাইনি, পারিওনি। বিয়ে হয়ে গেল আমাদের গোপনে। উনি তখন ফর্টি টু আর আমি সেভেন্টিন প্লাস। লিগাল ম্যাটারটা উনিই সামলেছিলেন। বাড়িতে একটা চিঠি লিখে রেখে পালালাম। তবে ওনার সঙ্গে বিয়ের কথাটা লিখিনি। বারণ করেছিলেন, কারণ ট্রান্সফার না হওয়া পর্যন্ত ওনাকে বালুরঘাটেই থাকতে হতো। অফিসে দীর্ঘ ছুটি নিয়ে আমাকে নিয়ে চলে এলেন কলকাতায় এক বন্ধুর বাড়িতে। সেই ছুটির মধ্যে কীভাবে জানি না নিজের ট্রান্সফারও করিয়ে নিলেন সিউরিতে। সেই বছরই নভেম্বরে বুবাই হল। এই পর্যন্ত বলে আবার থামলেন বউদি। প্রীতম স্থির হয়ে বসে শুনে যাচ্ছে। চোখের পাতাও পড়ছে বিলম্বে।…বিশ্বাস করো প্রীতম, ওই একটা বছর…জীবনের ওই একটা বছর আমার কাছে সব থেকে সুখের ছিল। কী যে খেয়াল রাখতেন আমাদের দু’জনের। আমার সব দুঃখ ধুয়ে গেছিল। ভেবেছিলাম বয়েসের পার্থক্য থাকুক গিয়ে, এমন মানুষ পাওয়া সত্যি ভাগ্যের। কিন্তু বছর দেড়েক যাওয়ার পর আমার শরীর যখন ওকে চাইতে শুরু করল, কিছুতেই সাড়া পেতাম না। আমি ভাবতাম ওনার সংকোচ, কিন্তু তারপর একদিন…একদিন জেনেই গেলাম যা আজ তুমি জানলে। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ। দীর্ঘ উপন্যাসের একটা অধ্যায় শেষ হওয়ার পর পৃষ্ঠা ওল্টানোর সময়টুকু যেন।
ওনাকে বললাম, আপনিও এইভাবে ঠকালেন আমাকে! উনি অস্বীকার করলেন। বললেন, ভালোবাসা মানে শুধুই শরীর? এমনি বন্ধুর মতো কি ভাবা যায় না? কিন্তু এইসব কথা তো আসলে নিজের অক্ষমতাকে ঢাকার চেষ্টা। ভেবেছিলাম আবার চলে যাব, কিংবা শেষ করে দেব নিজেকে। পারলাম না, ছেলেটার জন্য। ওর তো কোনও দোষ নেই। কী সরল বিশ্বাস বাবা-মার ওপর! থেকেই গেলাম। সবকিছু প্রাণপণ ভুলতে চেয়ে আবার পড়াশোনা শুরু করলাম নতুন করে। মাস্টার্স পাশও করে গেলাম ভালোমতো। চাকরি পেলাম। আর এই ফাঁকে বুবাইটাও কখন বড় হতে হতে এক সময় বিদেশেও চলে গেল। কখন যে এত বড় হয়ে গেল, টেরই পাইনি।…হয়তো আর আসবেও না কোনও দিন। আমিও চাই না আসুক। যে বিশ্বাস নিয়ে আছে তাই নিয়েই থাকুক।…আবার কয়েক মুহূর্তের নীরবতা।…আমি শুধু সারাটা জীবন ভালোবাসা মুছতে…মুছতে…টেনে টেনে শব্দগুলো বলতে গিয়ে বউদির চিবুক কেঁপে উঠল থিরথির করে।
প্রীতম তাকিয়ে ছিল অপলক। পড়ে আসা বিকেলের আলোতে মঞ্জুশ্রীর দু-চোখ থেকে, হয়তো বহুকাল পর, গড়িয়ে আসা দু-ফোটা জলবিন্দু চিবুকের কানায় টলটল করছে। প্রীতমের হঠাৎ ভীষণ ইচ্ছে হল ওই বিন্দু দুটো নিজের আঙুলে তুলে নিতে।