পাশবিক – অনীশ দেব

পাশবিক – অনীশ দেব

এ জাতীয় দৃশ্যের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না।

মনসুখ ভাটিয়ার আমন্ত্রণ পেয়ে এসেছি। সুতরাং তাঁর দেখা পাওয়াটা প্রত্যাশিত। কিন্তু ভাবিনি, একটা প্রকাণ্ড হিংস্র জন্তু নিয়ে ভাটিয়া সাহেব এরকম বিচিত্রভাবে ব্যস্ত থাকবেন। আর ব্যস্ত থাকার জন্যই আমাকে প্রথমটা তিনি খেয়াল করেননি। হাঁটুগেড়ে বসে একটা বড় মাপের লোহার ফাইল নিয়ে একান্ত মনোযোগে ঘষে চলেছেন জন্তুটার ঝকঝকে ধারালো দাঁতগুলো—একটার পর একটা। বাছুরের আকৃতির লোমশ কালো প্রাণীটা অদ্ভুতভাবে দাঁত খিঁচিয়ে পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দু-সারি নৃশংস দাঁত যেন সাদা করাতের ফলা। দাঁতের ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ছে আঠালো লালা। আর শোনা যাচ্ছে একটা চাপা ক্রূর গোঙানি। মনসুখ ভাটিয়া কিন্তু অত্যন্ত নির্বিকার মুখে নিজের কাজ করে চলেছেন। যেন কোন ছোট ছেলেকে ভোরবেলা দাঁত মাজিয়ে দিচ্ছেন বুরুশ দিয়ে।

অচেনা আগন্তুক দেখে চাপা ক্রুর গোঙানি পরিণত হল সাবধানী গর্জনে। এবং তখনই মনসুখ আমার উপস্থিতি টের পেলেন। ঘাড় ঘুরিয়ে আমাকে দেখেই ফাইল রেখে ত্রস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আসুন মানিজারবাবু, গরীবখানায় পায়ের ধুলো দিতে আজ্ঞা হোক।

প্রাণীটার মুখের চেহারা এখন স্বাভাবিক হতেই সেটাকে কুকুর বলে চিনতে পারলাম। তবে আকার ও প্রকার দেখে কুকুরের বদলে বাঘের কথাটাই আগে মনে পড়ে। লাল জিভটা বেরিয়ে আছে দাঁতের ফাঁক দিয়ে। তা থেকে ঘাম ঝরছে।

ভাটিয়া সাহেব কুকুরটার পাশেই একটা চেয়ারে বসলেন। ডান হাতটা ঘোরাফেরা করতে লাগল ওটার লোমশ কালো পিঠে। ভাটিয়া সাহেবের গায়ের যা রং, তাতে কুকুরের পিঠে রাখা তার ডান হাতটা যেন সরাসরি অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই প্রবল শীতেও পরনে শুধুমাত্র ধোপদুরস্ত পাজামা ও পাঞ্জাবি। গা থেকে ভুরভুর করে বিদেশী সুবাস ভেসে আসছে। গলায় মোটা সোনার চেন আর একটা রং-বেরঙের পুঁতির মালা। মালার লকেট হল বহুদিন ধরে শুকিয়ে রাখা একটা কালচে নখ—মানুষের নখ।

আমি তাঁর মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলাম।

মনসুখ ভাটিয়ার গরীবখানায় কোন আয়োজনেরই কমতি নেই। সামনের টেবিলে হুইস্কির খোলা বোতলও পেলাম। গেলাসে পানীয়ের পরিমাণ প্রায় আধাআধি। ঘরের দেওয়াল আধুনিক পদ্ধতিতে ডিসটেম্পার করা। দরজা-জানলায় রঙিন কাপড়ের পর্দা। মাথার ওপরে ঝুলছে অপ্রয়োজনীয় ঝাড়লণ্ঠন। অপ্রয়োজনীয়, কারণ পঁচিশ বাই পঁচিশ ঘরে আরও অন্তত গোটা তিনেক উজ্জ্বল আলো জ্বলছে। ঘরের মোজেইক করা চকচকে মেঝে সেই আলোর পঞ্চাশ ভাগ ফিরিয়ে দিচ্ছে প্রতিফলনের মাধ্যমে।

মানিজারবাবু নোতুন জায়গা কেমন লাগছে?

মনসুখ ভাটিয়ার এই প্রশ্নটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, মাত্র কয়েক সপ্তাহ হল আমি স্থানীয় কোলিয়ারী অফিসে অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার হয়ে এসেছি। এর মধ্যেই জানতে পেরেছি, মনসুখ ভাটিয়া হলেন কয়লার চোরাকারবারীদের চাঁই। এবং শেষতম কারণ, আজ রাতে তিনি আমাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে ডেকে পাঠিয়েছেন। উদ্দেশ্য এখনও জানি না, তবে শিগগিরই হয়তো জানতে পারব।

মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলাম, জায়গা তো ভালই লাগছে, তবে কাজের চাপ খুব বেশি।

ভাটিয়া সাহেব হাসলেন। সে হাসিতে কোন শব্দ নেই, শুধু দাঁতের ঝিলিক আর রোগা কালো শরীরের ঝাঁকুনি। অবশেষে একসময় নিঃশব্দ হাসি থামিয়ে বললেন, কাজের চাপ তো আপনি খুদ্‌ জোর করে ঘাড়ে লিচ্ছেন। নিজেও পড়েশান হচ্ছেন, হাজারো কারবারীকেও পড়েশান করছেন—

বক্তব্যের অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট। আর তার সঙ্গে হুমকিরও কি সামান্য ইশারা নেই?

মোটামুটি ভাবে আমার কাজ হল খনি থেকে তোলা কয়লা দিনের শেষে ওজন করে ট্রাকে চাপিয়ে হিসেব মত বিভিন্ন গোডাউনে চালান দেওয়া। আমার মত আরও অনেক অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার একই কাজে নিযুক্ত রয়েছেন। প্রথম দিন কাজ বুঝে নেওয়ার পর একজন ব্যাচিলার এ. এম. নরেন সাহা আমার খুব অন্তরঙ্গ হয়ে পড়েছিল। তারপর তিন-চার দিনের মধ্যেই সে যেন আমার বন্ধু হয়ে গেল। একদিন সন্ধের পর সে আমাকে প্রায় জোর করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক দেহাতী ভাটিখানায়। আমাকে অনেক পীড়াপীড়ি করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে নিজেই তুলে নিয়েছিল দিশী মদের বোতল আর ভাঁড়। চুমুক লাগাতে লাগাতে নরেন সাহা অনেক কথাই বলেছে।

মিস্টার রায়, আপনি এখানে নতুন লোক। একটু সামলে চলবেন।

অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছি, কেন? এ কোলিয়ারী কি অন্য কোলিয়ারীর চেয়ে ভয়ঙ্কর কিছু?

ফোলা ফোলা দুটো শ্যামবর্ণ হাত নিজের হাঁটুর ওপর রেখেছে নরেন সায়। লক্ষ্য করলাম, তার ডান হাতে পাশাপাশি তিনটে আংটি। রুপোয় বাঁধানো পলা, গোমেদ এবং নীলা। বুঝলাম, বয়েসের কোঠা চল্লিশ পেরোলেও নরেন সাহা ঘোর জ্যোতিষ-ভক্ত। মুখের ওপর একবার হাত বুলিয়ে সে জবাব দিল, হ্যাঁ, বিপজ্জনক। কারণ অন্য কোলিয়ারীতে তো আর মনসুখ ভাটিয়া নেই!

এরপর বাড়ি ফেরার পথে আরও শুনলাম, চোরাপথে কয়লা কিভাবে লোপাট হয়। কারা সেই চোরা-ব্যবসার নায়ক। সবাই তাদের চেনে, কিন্তু কিছু বলতে সাহস পায় না।

কেন, পুলিশ কোন স্টেপ নেয় না?

পুলিশ!—নরেন সাহা গলা ফাটিয়ে হেসে উঠেছে, আরে ভায়া, নেহাৎ কিছু লোককে উর্দী পরিয়ে চাকরি দিতে হবে, তাই দেওয়া। ও বেচারীরা এসব ঝামেলায় মাথা গলালে মাথা লোপাট হয়ে যাবে।

শীতের হাওয়া ছুঁচের মত এসে বিঁধেছে গায়ে। দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চোখে পড়ছে কিছু আলোর শিখা। হাইডেল পাওয়ার স্টেশনের বিজলী এখনও সব রাস্তাঘাটে জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। চাঁদের আলোয় পাথরের টুকরো ছড়ানো মেঠো পথ ধরে আমি আর নরেন সাহা এগিয়ে চলেছি কোয়ার্টারের দিকে। রাস্তার একদিকে এবড়ো-খেবড়ো পাথরের ঢিবি। আর কোথাও কোথাও শাল-শিরীষ-শিশু গাছে হালকা জটলা। এদিকেই কিছুটা এগিয়ে খোলা জায়গায় ওপেন-ক্রাস্ট মাইনিং চলছে। ঘনঘন ব্লাস্টিং করা হয় বলে শুনেছি।

নরেন সাহা তার একটা ভারী হাত আমার কাঁধে রাখল। বলল, মনসুখ ভাটিয়া এ অঞ্চলে এসেছে মাত্র বছর পাঁচেক, তার মধ্যে গাড়ি-বাড়ি সব হাঁকিয়ে বসে আছে। গত পাঁচ বছরে ও যা করেছে, পুরোন ঘাগু কারবারীরা বিশ বছরেও তা পারেনি। এখন চোরাকারবারের সিংহভাগটাই বলতে গেলে ওরহাতের মুঠোয়। সব ক’টা ম্যানেজার, অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার ভাটিয়ার কাছ থেকে ঘুষ খায়। কারণ ঘুষ না খেলে জান খেতে হবে। তবে এ শর্মা এখনও মাথা নোয়ায়নি। —নিজের বুকে আঙুল ঠুকলো নরেন সাহা।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই এক রক্ত হিম করা চিৎকার শীতের বাতাস কাঁপিয়ে দিল। প্রতিটি পাথরের স্তূপ সেই চিৎকারের প্রতিধ্বনি তুলে তাকে আরও ছমছমে করে তুলল। আকাশে, বাতাসে, এমন কি গাছের পাতায় পর্যন্ত ওই হিংস্র চিৎকার যেন থরথর করে কাঁপছে।

দুজনেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু সে এক মুহূর্ত। পরক্ষণেই নরেন সাহা আমার হাত ধরে টান মারল প্রচণ্ড ঝটকায়।

শিগগির মিস্টার রায়! শিগগির কোয়ার্টারে চলুন!

আমরা ছুটতে শুরু করলাম অন্ধের মত। অচেনা জায়গায় এবড়ো-খেবড়ো জমির ওপর দিয়ে ছুটতে খুবই অসুবিধে হচ্ছে। কিন্তু গতি হ্রাস করার উপায় নেই। নরেন সাহাও তার স্থূলকায় শরীর নিয়ে প্রাণপণে ছুটে চলেছে। আমাদের ঘন নিশ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

ছুটন্ত অবস্থাতেই সেই চিৎকার দ্বিতীয়বার শুনতে পেলাম। যেন কোন অপার্থিব আত্মা মুক্তি চাইছে নরকের বন্দীশালা থেকে।

দূরে কোয়ার্টারের টিমটিমে বিজলীবাতি নজরে পড়ল। পা ক্রমে অসম্ভব ভারী হয়ে আসছে। নরেন সাহা কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে, কিন্তু ছুটে আসছে সমান তালে।

প্রথমে নরেন সাহার কোয়ার্টার। ফলে তারই দরজায় এসে দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। কাঁপা হাতে দরজার তালা খুলল নরেন সাহা। তারপর দুজনে ভেতরে ঢুকতেই দরজায় খিল এঁটে দিল। আমরা বিছানার ওপর বসে হাঁপাতে লাগলাম।

অনেকক্ষণ পর শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হলে নরেন সাহা বলল, খুব কপালজোরে বেঁচে গেছি।

ওটা কিসের চিৎকার?—আমি উত্তেজিত ভাবে প্রশ্ন করলাম।

মনসুখ ভাটিয়ার কুকুর। তবে লোকমুখে তার কীর্তিকলাপ যা শুনি, তাতে কালো নেকড়ে বললেও ভুল হয় না। কুকুরটা নাকি রাত-বিরেতে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ায়। সাঁওতাল কামিনদের ধারণা, ওটা নাকি অপদেবতা। ওটার চলাফেরা কেউ টের পায় না, শুধু মাঝে মাঝে শোনা যায় ওই রক্ত হিম করা চিৎকার। এক কাজ করুন, আপনি আজকের রাতটা আমার কোয়ার্টারেই থেকে যান—

যুক্তিসঙ্গত ভেবেই নরেন সাহার প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলাম।

সে রাতে আরো অনেক খবর জানতে পেরেছি নরেন সাহার কাছ থেকে। খনি থেকে তোলা কয়লা ওজন হয়ে চালান যাবার পথেই নাকি চুরিটা বেশি হয়। কখনো কখনো খালি ট্রাক ওজন করাবার সময় চোরাকারবারীদের টাকা খাওয়া কুলি-কামিন ম্যানেজার ট্রাকের ওপর বড় বড় পাথরের চাঁই চাপিয়ে ওজন নেয়। পরে ওই ওজনের কয়লা সরিয়ে ফেলা হয় ট্রাক থেকে। নরেন সাহা বহুবার আমন্ত্রিত হয়েছে মনসুখ ভাটিয়ার কাছ থেকে। কারণ সে কঠোর চোখে নজর রাখে ওজনদারির সময়। কোন গরমিল বা বেচাল দেখলেই রিপোর্ট করে অফিসে। এবং সোচ্চারে নিজের সততা ও সাফল্যের কথা জাহির করে বেড়ায়। ভাটিয়া সাহেবের আমন্ত্রণে নির্ভয়ে সাড়া দিয়েছে নরেন সাহা, কিন্তু তার অন্যায় প্রস্তাবে কখনও রাজী হয়নি। সেই কারণেই গত পাঁচ বছর ধরে তার প্রমোশন বন্ধ হয়ে আছে। ভাটিয়া সাহেব ওপরওয়ালাদের মহলে কলকাঠি নেড়ে রেখেছেন। তবুও সে হার স্বীকার করেনি।

ঘরের আলো জ্বেলেই আমরা কথাবার্তা বলছিলাম। রাত প্রায় এগারোটা হলেও আমাদের কারো চোখেই ঘুম নামেনি। আমি স্তব্ধ বিস্ময়ে কোলিয়ারীর রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনছি আর মনে মনে নরেন সাহার তারিফ করছি। সাহস আছে বটে লোকটার। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালাম, নিজের আদর্শ বজায় রাখার মত মনের জোর যেন আমার থাকে।

এমন সময় হঠাৎই আলো নিভে গেল। বুঝলাম লোডশেডিং এই দূর জেলাতেও তার রাজত্ব বিস্তার করে ফেলেছে। পরিবেশের জমাট নিস্তব্ধতা নতুন করে আবার অনুভব করলাম। অন্ধকারের মধ্যেই নরেন সাহা বলে উঠল, জানেন, দিন পনেরো আগে একজন মাইনিং ইঞ্জিনীয়ার উধাও হয়ে গেছে? আর মাস দুয়েক আগে রোপওয়ে ছিঁড়ে পড়ে একজন চীফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট মারা যায়।

এখানে রোপওয়েতে করে কয়লা আনা-নেওয়া করা হয়। মাথার ওপর দিয়ে রোপওয়ে চলে। লোহার ক্যারেজগুলো খনি থেকে তোলা কয়লা বয়ে নিয়ে যায় ডাম্পিং গ্রাউণ্ডে, আর ফেরার সময় নিয়ে আসে বালি। কয়লাখনির যেসব পিট বা টানেল থেকে কয়লা বের করে নেওয়া হয়ে গেছে, সেই বালি দিয়ে ওইসব পিটগুলো ভর্তি করে দেওয়া হয়—যাতে খনির ছাদ ধসে না পড়ে। রোপওয়ের ক্যারেজ ছিঁড়ে পড়াটা বেশ অস্বাভাবিক ঘটনা। তবে অস্বাভাবিক ঘটনাকেই তো দুর্ঘটনা বলে।

নরেন সাহা গম্ভীর গলায় বলল, যদিও কোন প্রমাণ আমার হাতে নেই, তবু বলব, এই ঘটনাগুলোর পেছনে মানুষের হাত আছে। —কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নরেন সাহা আবার বলল, যদি সৎপথে থেকে চলেন, তাহলে মনসুখ ভাটিয়ার নেমন্তন্ন আপনিও পাবেন। তারপর যা ভাল বুঝবেন, তাই করবেন।

হঠাৎই অন্ধকারে একটা খসখস শব্দ কানে এল। নরেন সাহার কোয়ার্টারকে ঘিরে শব্দটা যেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি ফিসফিস করে বললাম, ওটা কিসের শব্দ?

জানি না। তবে রোজ রাতে শব্দটা আমি শুনতে পাই—সারা রাত ধরে। আর এটুকু জানি, এখন যদি আমি বাইরে বেরোই, তাহলে আর ফিরে আসব না। পরদিন লোক বলবে, এ-এম নরেন সাহা উধাও হয়ে গেছে।

একটা থমথমে ভাব আমাদের ঘিরে ধরল। খসখস শব্দটা হয়ে চলেছে ক্রমাগত। আমি পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলে উঠলাম, আপনি উধাও হবেন না। আপনার হাতের পলা, গোমেদ আর নীলা আপনাকে রক্ষা করবে।

একথায় আমরা দুজনেই অন্ধকারে হেসে উঠেছি। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না।

কালো কুকুরটার চাপা গর্জনে বাস্তবে ফিরে এলাম। নরেন সাহার কথামত নেমন্তন্ন আমি পেয়েছি। আর উদ্দেশ্যটাও ক্রমে ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। গলার স্বরকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বললাম, মিস্টার ভাটিয়া, নিজের পড়েশানি তো বুঝতে পারছি, কিন্তু তাতে হাজার কারবারী কিভাবে পড়েশান হচ্ছে, সেটা তো ঠিক বুঝতে পারলাম না।

কিছুক্ষণ নীরবতা। বোতলের তরল হুইস্কি নেমে এল গেলাসে। গেলাস পূর্ণ হল। এবং মনসুখ ভাটিয়ার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট তাকে এক চুমুকে নিঃশেষ করল। তোবড়ানো কালো মুখ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, চোখ শ্বাপদের মত চঞ্চল। কুকুরের পিঠ থেকে হাত তুলে গলার লকেটে—অর্থাৎ শুকনো নখটায় হাত দিল। সেটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। আর নজর আমার চোখে স্থির।

প্রথমটায় আমি অস্বস্তি পেয়েছি। তারপর অনুভব করেছি, শরীরটা যেন অবশ-অসাড় হয়ে আসছে। আমি কি সম্মোহিত হয়ে পড়ছি?

কমলি, কমলি—! ভাটিয়া সাহ্বে চোখ না সরিয়েই ডেকে উঠলেন, রায়সাহাব কা খানা লাগাও!

আমি সমস্ত মনের জোর কেন্দ্রীভূত করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ভাটিয়া সাহেবকে বোঝানো দরকার, আমি ভয় পাইনি। বললাম, তার দরকার নেই। আমি খাব না।

আবার সেই নিঃশব্দ হাসি। পানের রসে রাঙানো ঠোঁট বেঁকে গেল তাচ্ছিল্যে। কুকুরের পিঠ চাপড়ে বললেন ভাটিয়া, বসে পড়ন, রায়বাবু। মনসুখ ভাটিয়ার দাওতে কেউ খানা না খেয়ে যায় না। নোরিন্দার সাহাও খানা খেয়েছিল, তবে ঘুষ খায়নি।

নরেন সাহার কথা বলছেন ভাটিয়া। সুতরাং আমার মনোভাবও তিনি বেশ স্পষ্ট ধরে ফেলেছেন, তাতে সন্দেহ নেই।

রায়বাবু—অনেক নরম ও সহজ হল ভাটিয়া সাহেবের স্বর, বিনা শৌচে-সমঝে কোন কাজ করতে যাবেন না। তাতে অন্‌জাম্‌ ভাল হয় না, আপনি আরো দু-চারদিন ভেবে দেখুন। তাতে পড়েশানি ভি হবে না, নুকসান ভি হবে না। কি বলিস, ভুলো?

শেষ কথাটা হিংস্র জন্তুটাকে লক্ষ্য করে। এই বিকটদর্শন দানবের নাম ভুলো? এটা ভাটিয়া সাহেবের কথায় সামান্য নড়ে উঠল, তারপর মাথা নোয়ালো। তখনই অবাক হলাম। কুকুরটার ডান কানে ফুটো করে লাগানো রয়েছে একজোড়া সোনার মাকড়ি। চোখ ফিরিয়ে মনসুখ ভাটিয়ার দিকে তাকালাম। একই দৃশ্য। ডান কানে একজোড়া সোনার মাকড়ি! এ কি অদ্ভুত শখ!

এমন সময় এক হাত ঘোমটা টানা লাল পেড়ে সাধারণ শাড়ি পরিহিতা এক মহিলা ঘরে এলেন। খাবারের প্লেট সাজিয়ে দিলেন সামনের টেবিলে। চেষ্টা করেও তার মুখ দেখতে পেলাম না। এরই নাম কি কমলি? এঁর সঙ্গে ভাটিয়ার কি সম্পর্ক?

মহিলা জড়োসড়ো ভঙ্গিতে একপাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে দেশজ বাংলা ও হিন্দি মিশিয়ে ভাটিয়াকে প্রশ্ন করলেন, তাঁর খানা লাগাবেন কিনা। উত্তরে ভাটিয়া শুধু তিন সেকেণ্ড খর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন অবগুণ্ঠিতার দিকে। মহিলা ভীষণ ভয় পেয়ে এস্তা কাঠবেড়ালীর মত বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।

আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও খাওয়া শুরু করলাম। এই মুহূর্তে ভাটিয়াকে চটালে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা। মনসুখ ভাটিয়া লোহার ফাইলটা তুলে নিল। ভুলোও সঙ্গে সঙ্গে আগের মত দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়াল। মনিবের প্রতিটি ইঙ্গিতের অর্থ যেন তার চেনা।

মাঝে মাঝে ভুলোর দাঁতে শান দিয়ে দিই,—ফাইল ঘষতে ঘষতে বললেন মনসুখ, খতরনাক জায়গা—এখানে জিন্দা থাকতে গেলে লড়তে হয়।

আমি খেয়ে চলেছি, এবং আড়চোখে দুটি প্রাণীকে লক্ষ্য করছি। ভুলোর চোখ ধকধক করে জ্বলছে।

হঠাৎই অন্দরের একটা জানলার দিকে আমার নজর গেল, রঙিন পর্দা সামান্য সরিয়ে জানলায় উঁকি মারছেন কমলি নামের সেই মহিলা। চুপি চুপি ইশারা করে কিছু একটা যেন বলতে চাইছেন আমাকে। আমি নিজের আচরণ অসহনীয় সংযমে স্বাভাবিক রাখলাম। কৌতূহল ক্রমে বাড়ছে। মহিলা কি কোন বিপদের ইঙ্গিত দিচ্ছেন আমাকে?

এমন সময় হাতের কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ভাটিয়া। বললেন, আপনি বসুন, আমি আসছি। তারপর কুকুরসমেত অন্দরের দিকে রওনা হলেন। জানলার অস্পষ্ট মুখটা চকিতে সরে গেল।

কোথাও পেণ্ডুলাম ঘড়িতে রাত আটটার সঙ্কেত বাজল। অর্থাৎ কোলিয়ারী এলাকায় এটা গভীর রাত। চটপট খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালাম। এমন সময় বিদ্যুৎ ঝলকের মত ঘরে ঢুকলেন কমলি। কাপ-প্লেট-গ্লাস সব গুছিয়ে নিতে নিতে চাপা গলায় বলে উঠলেন, এখান থেকে পালাও, বাবুজী। নইলে জিন তোমাকে শেষ করে দিবে!

কথাটা বলেই মহিলা যেন ছিটকে বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু তার ফাঁকে ঘোমটা সরে গিয়ে এক বীভৎস দৃশ্য আমার চোখের সামনে প্রকাশ পেয়েছে। কমলির মুখের বাঁ দিকটা—গাল, গলা, কাঁধ—পুরোন ক্ষতের দাগে ভরা। মোটা সাদা সাদা নৃশংস দাগ। মাংসপেশীগুলো সেখানে কুঁচকে ভাঁজ হয়ে গেছে। একি কোন অগ্নিকাণ্ডের ফল?

প্রায় পরক্ষণেই ঘরে এসে ঢুকল ভুলো। গভীর চোখে তাকিয়ে আমাকে দেখতে লাগল। চেহারায় যেন আরো বড়সড় দেখাচ্ছে। চোখের দৃষ্টি যেন নির্ভুলভাবে আমার মনের ভাবনা জরিপ করতে চায়।

আমি একটু ভয় পেলাম। মনসুখ ভাটিয়া কোথায়? কুকুরটা হঠাৎ করে কিছু করে বসবে না তো? ভাবছি, ভাটিয়া ঘরে এলেই তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দেব, এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবে লোডশেডিং হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একটা জান্তব গন্ধ ধাক্কা মারল আমার নাকে। একটা খসখস শব্দ শুনতে পেলাম। ঘন অন্ধকারের ভেতরে শত খোঁজাখুঁজি করেও ভুলোর জ্বলন্ত চোখ দুটোর কোন হদিশ পেলাম না। অথচ ওর উপস্থিতি আমি টের পাচ্ছি। এক অজানা আতঙ্কে আমার শরীর কাঁপতে লাগল। মনে পড়ে গেল সেই ভয়ঙ্কর চাঁদনী রাতের চিৎকারের কথা।

রায়সাহাব, ভয় পেলেন নাকি?

মনসুখ ভাটিয়া কখন ঘরে এসেছেন কে জানে! কি করে আমার মনের কথা টের পেলেন, তাও জানি না। অন্ধকারে আমি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে গেছি।

কোন ডর নেই। বাড়ি চলে যান। আমার কথাটা ভেবে দেখবেন একটু। —মনসুখ ভাটিয়ার স্বর কেমন জড়ানো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। হয়তো নেশার ফলেই।

আমি সদর দরজার অবয়ব আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম, সেদিকে পা বাড়ালাম ইতস্তত করে। মনে হল যেন পেছন থেকে মনসুখ ভাটিয়া হাসছেন। অথচ হাসির কোন শব্দ আমি শুনিনি।

কোয়ার্টারে ফেরার পথে বারদুয়েক সেই রক্ত জমাট করা চিৎকার শুনেছি। প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে একরকম ছুটেই গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছেছি। তারপর আশ্বস্ত হয়েছি।

রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কুকুরটাকে স্বপ্ন দেখলাম। ওটা আমাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

পরদিন সকালে রাস্তায় বেরিয়েই দুঃসংবাদটা শুনতে পেলাম। এ-এম নরেন সাহাকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আমার মনটা কু-ডাক ডেকে উঠল। নরেন সাহাকে বোধ হয় আর কোন দিনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কিছুটা এগিয়ে এক তেরাস্তার মোড়ে দেখি জনাকয়েক সাঁওতাল দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে লাল কাপড়, লাল ফতুয়া পরা একটি লোক। মাথায় লাল ফেট্টি বাঁধা। মুখে দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। কানে ইয়া ইয়া দুটো মাকড়ি। গলায় জড়িবুটির মালা। কপালে সিঁদুর মাখা। বিড়বিড় করে সে কিসব মন্ত্র পড়ছে। সাঁওতাল কজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে ভক্তিভরে তার কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে। দুটো মুরগী-গলা কাটা অবস্থায় ধুলোয় পড়ে ছটফট করছে।

ওদের একজনের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম, ‘মানিজার’ সাবের উধাও হওয়ার খবরটা ওরা শুনেছে। এখানে ওরা মুরগী বলি দিয়ে ‘বোঙার’ কাছে মানত করছে। যে ‘জিন’ এইসব জোয়ান লোকগুলোকে উধাও করছে, তাকে যেন,‘বোঙা’ শান্ত করে দেয়।

লাল পোশাক পরা গুণীন মন্ত্র পড়ে পুজোর কাজ সারছে।

একটু পরে ওরা চলে গেলে আমি গুণীনের সঙ্গে আলাপ জমালাম। মুরগী দুটো তেরাস্তার সংযোগস্থলে পড়ে রইল।

ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললাম, এই পুজো দিলে জিন চলে যাবে?

গুণীন বলল, না বাবু, যাবে না। জিন যে চালাচ্ছে, তাকে খতম করতে হবে।

আমি তার কথার অর্থ ঠিক ধরতে পারলাম না। তারপর কি ভেবে মনসুখ ভাটিয়ার কথা জিজ্ঞেস করলাম। দুটো টাকা গুণীনের হতে দিতেই সে আমাকে একটা ঘষা তামার পয়সা দিল, তার সঙ্গে বাঁধা একটুকরো শেকড়। বলল, জিন তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না, বাবু। —একটুখানি চুপ করে থেকে সে আবার মুখ খুলল, বাবু, মনসুখ ভাটিয়া মন্তর জানে। ও আগে সোঁদর বনে ‘বরদার’ ছিল…

ক্রমে যা জানতে পারলাম তার সারাংশ হচ্ছে এই: সুন্দরবনের কাঠ চুরি করে জীবিকা নির্বাহ করে স্থানীয় অধিবাসীদের এক বিরাট অংশ। নৌকো নিয়ে একদল যখন জঙ্গলে ঢোকে, তখন তাদের সঙ্গে থাকে একজন গুণীন, যাকে বলা হয় বরদার। সে কাঠ কাটার এলাকা ঘিরে বাণ মেরে দেয়, যাতে কোন জন্তু জানোয়ার সেই গণ্ডী দেওয়া এলাকায় ঢুকতে না পারে। ফলে চোরা-কাঠুরিয়াদের হিংস্র জন্তুর হাতে প্রাণ হারাবার ভয় থাকে না। এর বিনিময়ে বরদারকে তারা চোরাই কাঠের ভাগ দেয়। মনসুখ ভাটিয়া সেখানে আর একজন বরদারকে খুন করে পালিয়ে আসে।

আমার মনে পড়ল, ভাটিয়ার গলায় ঝোলানো শুকনো কালো নখটার কথা।

ওর আসল নাম কেউ জানে না। কি করে এখানে এসে পড়ল, তাও খুব স্পষ্ট নয়। বড়লোক হওয়ার আগে ও নাকি এখানে স্থানীয় আদিবাসীদের জড়ি-বুটির ওষুধ দিত। ওকে গুণীন বলে সবাই মানতো। ফলে এখনো আদিবাসীরা ওর আদেশের নড়চড় করতে ভয় পায়। তবে আমার কোন ভয় নেই। ওই তামার পয়সা ও শেকড়ই আমাকে রক্ষা করবে। জিনের গায়ে ওদুটো ছুঁড়ে মারলেই সে নাকি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তৎক্ষণাৎ।

মনসুখ ভাটিয়া সম্পর্কে এইসব রোমাঞ্চকর তথ্য শুনে বেশ অবাকই হলাম। বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে দু-চারটে চেনামুখের সঙ্গে দেখা হল। তারা জানাল, পুলিশ নরেন সাহার খোঁজখবর করছে।

কোয়ার্টারে ফিরে অল্প সময়ের মধ্যে তৈরি হয়ে অফিসে বেরিয়ে পড়লাম। বুঝলাম, ভাটিয়া সাহেবের কথায় রাজী না হলে আমার অবস্থাও হবে নরেন সাহার মত। এই রকম আনমনা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছি, হঠাৎই একটা চেনা শাড়ি ও ঘোমটা আমার নজরে পড়ল।

অফিসে যেতে হলে শনি-মঙ্গলের হাট পেরিয়ে যেতে হয়। আজ মঙ্গলবার। হাট বসেছে। সেই হাটেই এক তরকারিওয়ালার কাছ থেকে কি যেন কিনছেন গত রাতের সেই মহিলা। কমলি।

মনসুখ ভাটিয়া সম্পর্কে যত তথ্য জানা সম্ভব, সবই আমাকে জানতে হবে। নইলে তাঁর মোকাবিলা আমি করতে পারব না। সুতরাং চারপাশে একবার নজর চালিয়ে সোজা গিয়ে দাঁড়ালাম কমলির পাশে। ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের সাহায্যে উনি যেন আমার উপস্থিতি টের পেলেন। তরকারির দাম মিটিয়ে হনহন করে এগিয়ে চললেন একটা অপেক্ষাকৃত নির্জন অংশের দিকে।

দুটো ঝুপসি অশথ গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে উনি চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও, বাবু?

মনসুখ ভাটিয়া আপনার কে হয়?

মরদ!

উত্তর শুনে আমি চমকে উঠেছি। ইনি মনসুখ ভাটিয়ার স্ত্রী? অথচ বেশবাস অত্যন্ত সাধারণ। হঠাৎ দেখলে, কেউ ভাটিয়ার ঝি ভেবে ভুল করবে। চিন্তা করে দেখলাম, চটপট খবর আদায় করতে গেলে, নরেন সাহার প্রসঙ্গ তোলা দরকার। সুতরাং সেকথাই তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম।

একহাত ঘোমটার আড়ালে কমলি ভাটিয়া চমকে উঠলেন। মুখে কাপড় চাপা দিয়ে চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, জানতাম, এমনি কিছু একটা হবে। কাল রাতে ভুলোর দাঁতে পালিশ দেওয়ার বহর দেখেই বুঝেছি। তবে আমি আপনার জন্য ভয় পেয়েছিলাম।

আমি তখন বললাম যে আমারও প্রাণ সংশয়। এ ধরনের ভয়াবহ ঘটনার প্রতিকার করা দরকার। আমি তাঁর সাহায্য চাই। তারপর সাঁওতাল গুণীনের কাছে তাঁর স্বামী সম্পর্কে যেসব কথা শুনেছি, সমস্ত খুলে বললাম।

নরেন সাহার নিখোঁজ-সংবাদ ও আমার অনুনয়ে নরম হলেন মহিলা। বললেন, বড়লোক হওয়ার আগে আমরা সাঁওতালদের গাঁয়ে থাকতাম। তখন ওই শেতল গুণীনের সঙ্গে আমার স্বামীর সম্পর্ক ভাল ছিল। ফলে তাকে অনেক কথাই বলেছে…

তারপর জানতে পারলাম আর এক ভয়াবহ প্রসঙ্গ। সুন্দরবনে কমলির বাবাকেই খুন করেছিলেন মনসুখ। সে নাকি মেয়ের সঙ্গে এক ‘বদ্‌’ বরদারের বিয়ে দিতে চায়নি। ‘বরদার’ বাপকে খুন করে মেয়ে কমলিকে নিয়ে ভেঙ্গে পড়েন মনসুখ। ওঁর ওপরে কম অত্যাচার চালায়নি গত দশ বছরে। তারপর এখানে এসে ক্রমে ক্রমে কয়লার চোরাকারবারে ঢুকলেন। কাঁচা পয়সা হাতে পেয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেল। তারপর ভুলোকে কিনে বসলেন এক সাহেবের কাছ থেকে। তারপর নতুন করে শুরু হল তন্ত্রসাধনা। কমলি বাধা দিতে চেয়েছেন, এবং তার ফলও পেয়েছেন হাতে হাতে। মুখের বাঁ দিকে তারই চিহ্ন আমি পেয়েছি।

কে করেছে এরকম সর্বনাশ? ওই কুকুরটা?—উত্তেজিত হয়ে আমি জানতে চেয়েছি।

না, বাবু—

তবে কি আপনার স্বামী?

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কমলি ভাটিয়া বললেন, দুজনে!

তারপর দ্রুতপায়ে সরে যাবার আগে বলে গেলেন, তুমি এখান থেকে পালাও, বাবুজী! জিনকে আটকানোর ক্ষমতা আমার নেই!

উনি চলে যাবার পরও বেশ কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ওঁর জবাবের অর্থ কি? দুজনেই? তার মানে?

বেশ চিন্তাকুল অবস্থাতেই অফিসে পৌঁছলাম। লক্ষ্য করলাম, নিখোঁজ নরেন সাহাকে নিয়ে কারোরই যেন মাথা-ব্যথা নেই। ব্যাপারটা যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক। তবে টের পেলাম, কুলিমজুরদের মধ্যে নতুন করে একটা আতঙ্ক যেন ছায়া ফেলছে।

কমলি ভাটিয়া ও শেতল গুণীনের কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরছিলাম। ওঁদের কথা যদি সত্যিও হয়, তাতে কোন লাভ নেই। পুলিশ প্রমাণ চাইবে। তাছাড়া এখানকার পুলিশ ভয়ে হোক আর টাকার লোভেই হোক, মনসুখ ভাটিয়ার তাঁবেদারী করে। তাহলে আমার এখন কর্তব্য কি?

ভাবনায় ডুবে ছিলাম বলেই কালো অ্যাম্বাসাডার গাড়িটাকে একেবারে খেয়াল করিনি। গাড়িতে স্টিয়ারিংয়ে বসে ভাটিয়াসাহেব। পোশাক গত রাতের মতই, তবে দু’চোখে কুটিল সন্দেহ।

আমার গা ঘেঁষে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে তিনি বলে উঠলে, আসুন রায়বাবু। একবার আমার ডেরায় যেতে হবে। একটা মজার জিনিস আপনাকে দেখাবো—

হাত বাড়িয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিলেন তিনি। আমার বুক দুরু দুরু করে উঠল। সূর্য ডুবে আঁধার নেমে এসেছে। কাঁচা সড়কের ওপর দ্বিতীয় কোন মানুষ নজরে পড়ছে না। জিনের ভয়ে সবাই বুঝি তাড়াতাড়ি আস্তানায় ফিরে গেছে।

আসুন রায়সাহেব, উঠে আসুন। —মনসুখের স্বর অধৈর্য হয়ে উঠেছে।

পকেটে হাত দিয়ে শেতল গুণীনের রক্ষাকবচটা একবার অনুভব করলাম। তারপর উঠে বসলাম মনসুখ সাহেবের পাশে। উনি গাড়ি ছুটিয়ে দিলেন। জানলা দিয়ে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস এসে আমার হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিতে লাগল। ভাটিয়ার মুখে কোন কথা নেই। শীতল দুটো চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছেন সামনের সড়কের দিকে। তাঁর মুখ থেকে ভেসে আসছে মদের গন্ধ।

একটা জিনিস বুঝতে পারলাম, বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে লোপাট করার মতলব ভাটিয়ার নেই। কারণ তাতে লোক জানাজানির সম্ভাবনা এবং পুলিশ হয়তো সরাসরি প্রমাণ পেয়ে আর বিশেষ নিষ্ক্রিয় থাকতে পারবে না। কিন্তু সত্যিই কি সে ভরসা আছে?

এই রকম এলোমেলো চিন্তা করতে করতেই পৌঁছে গেলাম মনসুখ ভাটিয়ার বাড়িতে। বাড়ির সামনেটা অন্ধকার—শুধু চাঁদের আলো যেটুকু জোছনা বিছিয়েছে। পথের দু’পাশে বাগান। গাড়ি থামিয়ে আমাকে সঙ্গে করে বাড়িতে ঢুকলেন মনসুখ। ঘড়িতে সময় প্রায় সাড়ে ছ’টা গড়িয়ে গেছে।

গতকালের ঘরে এসে বসলাম। আজ বাতির বাহার সামান্য কম। কিন্তু তাতেও ভুলোকে আবিষ্কার করতে কোন ভুল হল না। একটা চেয়ারের পাশে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি অন্দরের জানলার দিকে একবার নজর চালালাম। কমলি নেই।

একটা আজব জিনিস ভুলো কোথা থেকে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে। ভাটিয়া হালকা গলায় বললেন, তারপর উঠে গিয়ে কোণের একটা টেবিলের তলা থেকে কালো মত কি একটা জিনিস নিয়ে এলেন। ঠকাস করে আমার সামনে টেবিলের ওপর ফেলে দিয়ে বললেন, দেখুন তো রায়সাহেব, চিনতে পারেন কিনা?

আমার মাথায় যেন বজ্রপাত হল। ভাবনা-চিন্তা-বুদ্ধি সব ওলোট-পালোট হয়ে গেল। এক তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে এল আমার ঠোঁট চিরে। চোখজোড়া কি ঠিকরে বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে?

টেবিলের ওপরে পড়ে রয়েছে একটা কাটা হাত। কালো রঙের আঙুলগুলো ফোলা ফোলা। আর তিনটে আঙুলে পাশাপাশি তিনটে পাথর বসানো আংটি। পলা, গোমেদ ও নীলা। জ্যোতিষ শাস্ত্র নরেন সাহাকে বাঁচাতে পারেনি।

আমার মুখে কোন কথা নেই। মনসুখ ভাটিয়া হাতটা তুলে নিয়ে ‘লুঃ’ বলে ভুলোর দিকে ছুঁড়ে দিলেন। কুকুরটা হিংস্র দাঁতের পাটি বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ল হাতটার ওপর। ওটাকে দাঁতে-নখে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল। ওঃ, সে কি বীভৎস দৃশ্য!

ভুলো যখন কষ্ট করে নিয়ে এসেছে, তখন এই হাতটা ওরই পাওনা, কি বোলেন রায়বাবু। ও…হ্যাঁ, শুনলাম নাকি নোরিন্দর সাহাকে পাওয়া যাচ্ছে না? একেবারে লোপাট হয়ে গেছে?

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, আমি এখুনি পুলিশে খবর দেব। লোকে জানুক নরেন সাহাকে কে খুন করেছে।

বিচিত্র হাসিতে ফেটে পড়লেন ভাটিয়া। সে হাসিতে বুক কেঁপে ওঠে, মস্তিষ্কে হিম-আতঙ্ক বাসা বাঁধে।

এক সময় স্বাভাবিক হয়ে তিনি কঠোর গলায় বললেন, আপনার কথায় কেউ বিশওয়াস করবে না, রায়সাহাব। কারণ ততক্ষণে ভুলো এ হাত লোপাট করে দিবে। —কথা শেষ করে আবার সেই নৃশংস হাসি।

নিজেকে ঘোরতর বিপন্ন জেনেও আমি পাগলের মত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম। চিৎকার করে বললাম, মনসুখ ভাটিয়া, তোমার সব খবর আমি জানি। তোমাকে আর আমি ভয় পাই না। তুমি সোঁদর বনের বরদার ছিলে। সেখানে শ্বশুরকে খুন করেছ। তারপর এখানে এসে চোরাকারবারে নেমেছ, আর দরকার মত মানুষ খুন করে বেড়াচ্ছ! শেতল গুণীন আমাকে সব বলেছে। কমলি ভাটিয়ার কাছেও সব কথা শুনেছি। দাঁড়াও, তোমার হিসেব আমি শেষ করছি!

ঘরের মধ্যে যেন ভূমিকম্প হয়ে গেল। বয়ে গেল অসমশক্তিশালী সাইক্লোন। সব কিছু যেন দুরন্ত গতিতে ওলোট-পালোট হয়ে যাচ্ছে। এক অদ্ভুত গর্জন করে উঠলেন মনসুখ ভাটিয়া, কমলি! শালী বেতমিজ আওরত!

নরেন সাহার হাতটা আংটিসমেত শেষ করে ফেলেছে ভুলো। উঠে দাঁড়িয়ে সেও একটা চাপা গর্জন করে উঠল। তার চোখ ধকধক করে জ্বলছে। আমাকে অবাক করে এক লাফে অন্দরের দিকে চলে গেলেন মনসুখ। বিদ্যুঝলকের মত ভুলোও তাঁর পিছু নিল। ঘরে আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ছুটে পালাব কিনা, সেটাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।

এমন সময় ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকলেন কমলি। প্রায় কান্নাভাঙা স্বরে বললেন, বাবু, পালাও জলদি! পালাও!

পাশের কোন একটা ঘর থেকে বিচিত্র সুরে শব্দোচ্চারণের বিচিত্র ধ্বনি আমার কানে আসছে। সঙ্গে থেকে থেকে হিংস্র গর্জন। দূর থেকে ভেসে আসছে ওপেন-ক্রাস্ট মাইনিংয়ের ব্লাস্টিংয়ের শব্দ। গুড়ুম! কমলি ঝটিতে উধাও হয়ে গেলেন ঘর থেকে। আমার কানে ভাসছে শুধু দুটি কথা, বাবু, পালাও!

হঠাৎই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল ভুলো। সে একা! কিন্তু এ কোন্‌ ভুলো? আকারে সে প্রায় দেড় গুণ বেড়ে গেছে। চোখের মণিতে জ্বলন্ত ভাবটা নেই। মুখের অভিব্যক্তিতে এক আশ্চর্য ক্রূর হিংসার ছাপ। তার কানদুটো নড়ছে। সেই সঙ্গে সোনার মাকড়ি জোড়াও।

এমন সময় ঘরের সমস্ত আলো নিভে গেল। লোডশেডিং? আমি মুহূর্তের মধ্যে সদর দরজা লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করলাম। পেছন থেকে ভেসে এল রক্ত বরফ করে দেওয়া এক চিৎকার! সে চিৎকারে প্রতিশোধের আগুন ও উল্লাস যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে। আমি প্রাণপণে ছুটে চলেছি। পলকে বাগান পেরিয়ে সড়কে পা দিলাম। রাস্তা খাঁ খাঁ করছে। চতুর্দিক অন্ধকার। শুধু চাঁদের ফ্যাকাশে আলো দিকনির্ণয়ের একমাত্র সম্বল। আমি ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগলাম। পেছন ফিরে দেখার সাহস হচ্ছে না। শুধু কানে আসছে ব্লাস্টিংয়ের শব্দ আর ভয়াবহ জন্তুটার অলৌকিক চিৎকার।

বেশ কিছুটা পথ ছুটে শরীর ক্লান্ত হয়ে এল। কোয়ার্টার এখনো অনেক দূরে। বুঝতে পারছি, আমি অসম প্রতিযোগিতায় নাম লিখিয়েছি। ভারী পায়ে ছুটতে ছুটতে একসময় পেছন ফিরে তাকালাম এবং যে দৃশ্য দেখলাম, তা বোধ হয় কোনদিন ভোলার নয়।

ভয়ঙ্কর দানবটা মানুষের মত শুধুমাত্র পেছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে ছুটে আসছে অবিশ্বাস্য গতিতে। আমাদের দূরত্ব অনেক কমে এসেছে। চাঁদের আলোতেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কুকুরটার গলায় ঝুলছে মনসুখ ভাটিয়ার রং-বেরঙের পুঁতির মালা। লকেটের নখটা চোখে পড়ছে না।

আমার পা দুটো পাথরের স্তম্ভের মত বসে গেল রাস্তার ওপরে। নড়বার এতটুকু ক্ষমতা আমার নেই। প্রচণ্ড কনকনে বাতাস আমি আর অনুভব করতে পারছি না। অদূরে পাথরের ছোটবড় টিবি আমারই মত নিশ্চল। শুধু কতকগুলো ঝাঁকড়া গাছের মাথা এপাশ ওপাশ দুলছে।

পৈশাচিক হাসিতে খলখল করে ফেটে পড়ল অতিকায় কালো জন্তুটা। আমার মাথার ভেতরে সবকিছু যেন গোলমাল হয়ে গেছে। আমি কি সম্মোহিত হয়ে পড়ছি? আর সবাই কি একই রকম পরিস্থিতিতে পড়েই রাতারাতি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে? আমার মনে পড়ল নরেন সাহার কথা, কমলি ভাটিয়ার কথা, শেতল গুণীনের কথা—

একই সঙ্গে পকেটের তামার পয়সা ও শেকড়ের টুকরোটা হাতে ঠেকল। আতঙ্ক ও নৃশংসতার সমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে আমি ওই তুচ্ছ বস্তু দুটোকেই আঁকড়ে ধরলাম। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, যুক্তি-অযুক্তি সবই এখন তালগোল পাকিয়ে গেছে। ভয়ঙ্কর পিশাচটা খুব কাছে এসে পড়েছে। নাকে আসছে একটা জান্তব দুর্গন্ধ ও সেই সঙ্গে কড়া মদের গন্ধ। আমি আর দেরি না করে আমার পয়সা ও শেকড়টা ছুঁড়ে মারলাম অতিকায় কুকুটার গায়ে। এবং তৎক্ষণাই ঘটে গেল এক অলৌকিক ঘটনা।

কুকুরটা দপ করে আগুনে জ্বলে উঠল। লকলকে সবুজ আগুন। দুপায়ে ভর করে ধেয়ে আসছিল, এখন সশব্দে পড়ে গেল কঠিন সড়কের ওপর। সবুজ আগুনের অপার্থিব লেলিহান শিখায় সে ছটফট করতে লাগল। অবশেষে তার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল এক সুদীর্ঘ ভয়ঙ্কর চিৎকার। তারপর অস্পষ্ট খসখসে স্বরে সে মরণ আর্তনাদ করে উঠল, ইয়া আল্লা-আ-আ-আ!

এ যে মনসুখ ভাটিয়ারই বিকৃত কণ্ঠস্বর!

আমি আবার ছুটতে শুরু করলাম পাগলের মত। এই শীতেও আমার শরীর ঘামছে। পেছন থেকে ভেসে আসছে চাপা অস্ফুট গোঙানি। আগুনের সবুজ শিখা যেন হাজারো জিভ দিয়ে কালো দানবটাকে চেটেপুটে শেষ করছে। আবার শুনতে পেলাম ব্লাস্টিংয়ের শব্দ। আমি যথাসম্ভব গতি বাড়িয়ে দিলাম।

পরদিন খবর পেলাম, মনসুখ ভাটিয়া মারা গেছেন এবং তাঁর কুকুর ভুলো কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে।

কমলি ভাটিয়ার কথা মনে করেই তাঁদের বাড়িতে গেলাম। লোকে লোকারণ্য। চোখ বুজে অক্ষত শরীরে শুয়ে আছেন মনসুখ। ঠিক যেন ঘুমিয়ে রয়েছেন। তবে তাঁর গলায় সেই রঙিন মালাটি নেই। কমলি লাজ-লজ্জা ত্যাগ করে সকলের চোখের সামনেই বুকভাঙা কান্নায় বারবার আছড়ে পড়ছেন সেই মৃতদেহের ওপর।

জটলার মধ্যে হঠাৎ শেতল গুণীনকে দেখতে পেয়ে তাকে একপাশে ডেকে নিলাম। গত রাতের সমস্ত ঘটনা খুলে বললাম। তারপর রক্ষাকবচের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে পাঁচটা টাকা দিলাম তার হাতে।

সে বলল, বাবু, মনসুখ শরীর চালান জানতো। নিজের ‘জান’কে ঢুকিয়ে দিত কুকুরের ভেতর। তখন সে কুকুরের চোখ দিয়ে দেখত। আর বুরা কাম করত। ওই রঙিন মালা ছিল ওর মন্তরের মালা—

কোয়ার্টারে ফেরার পথে মনসুখ ভাটিয়ার কথাই ভাবছিলাম। সোনার মাকড়ি দুটো কি ওঁর সঙ্গে কুকুরের শরীরের যোগসূত্র রক্ষা করত? শরীর-চালান করার পর কুকুরটা আয়তনে বেড়ে ওঠার কারণ বোধ হয় জন্তুটার শরীরে তখন দুটো আত্মা বাসা বাঁধত। আর মনসুখের অসাড় দেহ পড়ে থাকত বাড়িতে। কুকুরটা তখন মানুষের আচার আচরণ, বুদ্ধি ও জান্তব হিংস্রতা, দুই মিলিয়ে রাতের আঁধারে শত্রু নিধন করত। তবে কাল রাতের ঘটনা বাস্তব বলে এখন আর বিশ্বাস হতে চায় না।

শেতল গুণীনই পরে আমাকে বলেছিল, মনসুখ ভাটিয়ার আসল নাম ছিল হোসেন আলি। সেই জন্যেই মরণের মুহূর্তে সে ‘আল্লার’ মার্জনা ভিক্ষা চেয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলেছিল প্রাণপণ চিৎকারে। তবে আল্লা তাকে মার্জনা করেছেন কিনা কে জানে!

লেখক পরিচিতি

ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়: জন্ম: ১৮৪৭ সালে, ২৪ পরগনার শ্যামনগরের নিকটবর্তী রাহুতা গ্রামে। প্রথম জীবনে স্কুলে শিক্ষকতা এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র উপজীবিকায় বিচরণশীল। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হয়ে তিনি দুবার ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসূত্রে বাস করেছেন। খাঁটি ব্যঙ্গকৌতুক রসস্রষ্টা হিসেবে সাহিত্যের দরবারে আসেন ১৮৯২ সাল থেকে। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ: কঙ্কাবতী, ফোকলা দিগম্বর, ভূত ও মানুষ, ডমরু চরিত প্রমুখ ছাড়াও কয়েকখানি ইংরাজী প্রবন্ধের বইও আছে। মাতৃভাষা ছাড়াও ফার্সী, ওড়িয়া ইত্যাদি আরো কয়েকটি ভাষায় ইনি দক্ষ ছিলেন। ১৯১৯ সালে ত্রৈলোক্যনাথের মৃত্যু ঘটে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জন্ম: ৭ই মে ১৮৬১ সালে, কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। স্কুল-কলেজের বাঁধাধরা শিক্ষা গ্রহণ না করলেও বহু-বিচিত্র বিষয়ে গভীর অধ্যয়নের দ্বারা তাঁর অসামান্য প্রতিভা ও তীক্ষ্ণ মণীষা পরিস্ফুট হয়েছিল। মাত্র আঠারো বছর বয়সে ১৮৭৮ সালে তাঁর প্রথম বই ‘কবিকাহিনী’ ছাপা হয়। তারপর গল্প-উপন্যাস, ব্যঙ্গকৌতুক, দিনলিপি, ভ্রমণকাহিনী, ধর্মোপদেশ, শিক্ষা, রাজনীতি, শব্দ, ছন্দ, ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য, বিজ্ঞান, নাটক, গদ্যকবিতা, প্রহসন, রূপকনাটক, কবিতা, গান প্রমুখ হেন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেননি। ১৯১৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান। বিশ্ববিজয়ী এই মনীষীর মহাপ্রয়ান ঘটে ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট।

নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত: জন্ম: ১৮৬১ সাল। আদি নিবাস হালিশহর, ২৪ পরগণা। লেখাপড়ার পালা সাঙ্গ করে প্রথম কয়েক বছর লাহোরে শিক্ষকতা করেন। তারপর সাহিত্যিক ও সাংবাদিক জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা: লাহোরের ‘ফিনিক্স’ ও ‘ট্রিবিউন’, এলাহাবাদের সাপ্তাহিক ‘ইন্ডিয়ান পিপ্‌ল্‌’। কিছুকাল ‘প্রদীপ’ ও ‘প্রভাত’ পত্রিকাও সম্পাদনা করে ছিলেন। প্রথম জীবনে ‘স্বপন সঙ্গীত’ গীতিকাব্য, পরে ‘সাহিত্য’ ও ‘ভারতী’ পত্রিকায় বহু ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেন। তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি দ্বারভাঙা মহারাজের অর্থসাহায্যে বিদ্যাপতি ও গোবিন্দদাস ঝা’র পদাবলীর সম্পাদন ও সংকলন প্রকাশ। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘পর্বতবাসিনী’, ‘অমর সিংহ’, ‘লীলা’ এবং ‘জীবন ও মৃত্যু’। ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি পরলোকগমন করেন।

প্রমথ চৌধুরী: জন্ম: ১৮৬৫ সালে, পাবনা জেলার হরিপুর গ্রামের জমিদার বংশের সন্তান। ইংরাজী সাহিত্যে এম-এ’র বিলাত থেকে ব্যারিস্টারী পাশ করে আসেন। ইংরাজী ও ফরাসী সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন তিনি। বাংলা সাহিত্যে তাঁর বিশেষ দান—সাহিত্যে চলিত ভাষাকে মর্যাদা দান এবং সাহিত্যপত্র ‘সবুজপত্র’ প্রকাশ। ছদ্মনাম ‘বীরবল’। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘সনেট পঞ্চাশৎ’, ‘চার-ইয়ারি কথা’, ‘নীললোহিত’ প্রভৃতি। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সত্যেন্দ্রনাথের কন্যা ইন্দিরা দেবীকে বিবাহ করেন তিনি। ১৯৪৬ সালে তিনি পরলোকগমন করেন।

দীনেন্দ্রকুমার রায়: জন্ম: ১৮৬৯ সাল। আদি নিবাস: নদীয়া জেলার মেহেরপুর। লেখাপড়ার পালা সাঙ্গ করে প্রথম জীবনে শিক্ষকতাকে পেশা গ্রহণ করেন। কিছুকাল শ্রীঅরবিন্দ-র বাংলার শিক্ষক হয়ে তিনি বরোদায় অবস্থান করেন। শিক্ষকতা করার সময়েই গোয়েন্দা কাহিনী ইত্যাদি রচনা করতে শুরু করেন।একই সঙ্গে তৎকালীন ‘ভারতী’ পত্রিকায় গ্রামের ছবি নিয়ে লিখলেন ‘পল্লীচিত্র’ ‘পল্লীবৈচিত্র্য’ নামে দুটি বই। দীনেন্দ্রকুমার সুলেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন এই গ্রন্থ দুটির মাধ্যমেই। উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত ‘নন্দনকানন’ পত্রিকার ইনি সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীকালে ‘রহস্য লহরী’ নামে একটি ডিকেটটিভ কাহিনীর সিরিজ বার করেন। ‘নন্দন কানন’ এবং ‘রহস্য লহরী’র রচনা নিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা তিনশ’র ওপর। ১৯৪৩ সালের জুন মাসে তাঁর লোকান্তর ঘটে।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর: জন্ম: ১৮৭১ সালের ৭ই আগস্ট কলকাতার জোড়াসাঁকোয়। ঠাকুরবাড়ির প্রথানুযায়ী গৃহশিক্ষকের কাছেই প্রধানত তাঁর শিক্ষাজীবন। ঠাকুরবাড়িতে শিক্ষার অন্যতম অঙ্গ ছিল শিল্পচর্চা। চিত্রশিল্পে স্বাভাবিক প্রবণতা থাকার জন্যে তিনি শিল্পচর্চায় মনোযোগী হন এবং অনতিকালের মধ্যে চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি পৃথিবীবিখ্যাত হন। একই সঙ্গে লেখক হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: শকুন্তলা, নালক, ভূতপত্‌রীর দেশ, ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা, রাজকাহিনী, পথে-বিপথে প্রমুখ। বিষয়বস্তু, ভাষাশৈলী ও রসসঞ্চারে বহুবিচিত্র এই মানুষটি পরলোকগমন করেন ৫ই ডিসেম্বর ১৯৫১ সালে।

পাঁচকড়ি দে: জন্ম: ১৮৭৩ সাল। ভবানীপুরের এক স্কুলে লেখাপড়া করেন। পরবর্তীকালে ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখে তিনি বিত্তশালী হন। তাঁর রচিত নীলবসনা সুন্দরী, হত্যাকারী কে? মনোরমা, মায়াবী, হরতনের নওলা ইত্যাদি প্রায় তিরিশখানি গ্রন্থ একসময় পাঠক সাধারণের হাতে হাতে ফিরত। তাঁর কয়েকখানি বই বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৪৫ সালে ৭২ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

পরশুরাম (রাজশেখর বসু): জন্ম: ১৬ই মার্চ, ১৮৮০ সালে বর্ধমান জেলার বামুনপাড়ায় মাতুলালয়ে। ১৯০০ সালে রসায়ন শাস্ত্রে এম· এ· পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। বেঙ্গল কেমিকেলের সঙ্গে আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে ‘পরশুরাম’ ছদ্মনামে রসরচনার জন্যে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯৫৫ সালে ‘কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প’ গ্রন্থের জন্যে রবীন্দ্র পুরস্কার ও ১৯৫৮-তে ‘আনন্দ বাঈ’ ইত্যাদি গল্প গ্রন্থের জন্যে পেয়েছেন অকাদেমি পুরস্কার। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন। ২৭শে এপ্রিল ১৯৬০-এ তিনি পরলোকগমন করেন।

হেমেন্দ্রকুমার রায়: জন্ম: ১৮৮৮ সালে। শিক্ষাজীবন শেষ করার আগেই শুরু করেন সাহিত্যজীবন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বড়দের জন্যে গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ দিয়ে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত শিশু ও কিশোর সাহিত্যের দিকেই ঝুঁকে পড়েন তিনি। বিশের দশকে কিশোরপত্রিকা ‘মৌচাক’-এ অভিযান কাহিনী ‘যখের ধন’ দিয়ে শুরু করলেন তাঁর যাত্রা। তারপর লিখলেন অসংখ্যা গোয়েন্দা কাহিনী এবং অভিযান কাহিনীও। এক সময় ‘নাচঘর’ মাসিক পত্রিকাটিও সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। বিখ্যাত গ্রন্থ: যখের ধন, আবার যখের ধন, জয়ন্তের কীর্তি, মানুষ পিশাচ, শনিমঙ্গল রহস্য, সাজাহানের ময়ূর, পদ্মরাগ বুদ্ধ ইত্যাদি। ১৯৬৩ সালে হেমেন্দ্রকুমারের মৃত্যু ঘটে।

মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়: জন্ম: ১৮৮৮ সাল। আদি নিবাস বিক্রমপুর—ঢাকা। অল্প বয়স থেকেই তিনি সাহিত্যসেবা শুরু করেন। সাহিত্যপত্র ‘ভারতী’র সম্পাদক ছিলেন বহুকাল। সেই সময়ে বিশিষ্ট লেখক হিসেবেও তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: মনে মনে মহুয়া, জাপানী ফানুস, জলছবি, ভুতুড়ে কাণ্ড, গল্প কথা, আলপনা প্রভৃতি। নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের সংস্রবে এসে নৃত্যাদি পরিচালনায়ও তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথের জামাই ছিলেন তিনি। ১৯২৯ সালে তিনি লোকান্তরিত হন।

বিশ্বপতি চৌধুরী: জন্ম: ১৮৮৯ সাল। অধ্যাপনাই ছিল জীবনের পেশা। সাহিত্যজীবন শুরু করেন সবরকম পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের লেখা লিখে। মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় পরিকল্পিত ‘বসুধারা’ সাহিত্য পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হয়েছিলেন। ছোটদের বার্ষিকী ‘ঝিকিমিকি’ও বেলোয় এঁরই সম্পাদনায়। লেখা ছাড়াও ছবি আঁকতেন। বিশেষ করে কার্টুন। অনেক পত্রিকার প্রচ্ছদও এঁকেছেন। বিখ্যাত গ্রন্থ: ঘরের ডাক, বহুরূপী (হাসির গল্পের সংকলন), ব্যথা, কাব্যে রবীন্দ্রনাথ, কথা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি। সুরসিক, সুবক্তা ও মজলিসী মানুষ হিসেবেও খ্যাতি ছিল এঁর। ১৯৭৬ সালে এই লেখকের মৃত্যু ঘটে।

প্রেমাঙ্কুর আতর্থী: জন্ম: ১লা জানুয়ারী, ১৮৯০ সালে। উচ্চশিক্ষা না পেলেও নিজের চেষ্টায় বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন। বহু পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনিই ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক। এ ছাড়া বহু চিত্রের সকল পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘মহাস্থবির জাতক’ ‘চাষার মেয়ে’, ‘বাজীকর’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। মৃত্যু: ১৩ই অক্টোবর ১৯৬৪।

ফণীন্দ্রনাথ পাল; জন্ম: ১৮৯১ সাল। দীর্ঘকাল ‘যমুনা’ ও ‘গল্পলহরী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের প্রথম আবির্ভাব তাঁর সম্পাদিত ‘যমুনা’ পত্রিকায়। সম্পাদনার ফাঁকে ফাঁকে অনেকগুলি গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। তার মধ্যে স্বামীর ভিটা, সুকুমার, বন্ধুর বৌ, ইন্দুমতী প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৩৪৬ সালে তিনি পরলোকগমন করেন।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়: জন্ম: ১২ই সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ সাল। পৈতৃক নিবাস ব্যারাকপুর-বনগ্রাম, ২৪ পরগণা। বি· এ· পাশ করে তিনি শিক্ষকতা কর্মে নিযুক্ত হন। তাঁর রচনায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে গ্রাম বাংলার দুঃখ, দারিদ্র্য, স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা ও পল্লীপ্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। ‘পথের পাঁচালী’ ছাড়াও তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ: অপরাজিত, দৃষ্টিপ্রদীপ, আরণ্যক, ইছামতী, দেবযান, আদর্শ হিন্দু হোটেল, চাঁদের পাহাড়, বনে পাহাড়ে ইত্যাদি অসংখ্য গ্রন্থ। ‘ইছামতী’ গ্রন্থের জন্যে তাঁকে রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯৫০ সালে ১লা নভেম্বর তাঁর মৃত্যু ঘটে।

খগেন্দ্রনাথ মিত্র: জন্ম: ২রা জানুয়ারী, ১৮৯৬ সাল। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে বি·এ· পাশ করেন। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, মহিলা প্রমুখ সাহিত্যপত্রে অসংখ্য বড়দের লেখা লিখলেও মূলত ইনি শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই খ্যাত হন। সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক ছোটদের মহল ও নতুন মাসিক। বার্ষিক শিশুসাথী, মানিকমালা, সপ্তডিঙা। এবং দৈনিক কিশোর (কিশোরেই প্রথম চলিত বাংলায় খবর প্রচারিত হয়েছিল)। প্রকাশিত প্রখ্যাত গ্রন্থ: ভোম্বল সর্দার, সুমন্ত, বাংলার ডাকাত, বনে-জঙ্গলে, ব্রেজিলের বন, শতাব্দীর শিশুসাহিত্য, রবীন্দ্র শিশুসাহিত্য পরিক্রমা। পুরস্কার: মৌচাক, ভুবনেশ্বরী পদক, ‘সুমন্ত’ গ্রন্থের জন্যে জাতীয় পুরস্কার। ভোম্বল সর্দার বইখানি রুশ ভাষায় অনূদিত হয়। ১৯৭৮ সালে ১২ই ফেব্রুয়ারী তিনি পরলোকগমন করেন।

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়: জন্ম: ২৩শে আগস্ট ১৮৯৮ সালে বীরভূম জেলার লাভপুরে। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করার পর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আই· এ পড়ার সময় রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। প্রায় ১৩০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘আরোগ্য নিকেতন’ গ্রন্থের জন্যে ১৯৫৫ সালে সাহিত্য অকাদেমি ও ১৯৫৬ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার। আর ‘গণদেবতা’র জন্যে ১৯৬৬-তে পেয়েছেন জ্ঞানপীঠ। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ তিনি লোকান্তরিত হন।

তুষারকান্তি ঘোষ: জন্ম: ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৮৯৮ সাল। আদি নিবাস যশোহর জিলায়। প্রথমে হিন্দু স্কুল, পরে বঙ্গবাসী ও বিদ্যাসাগর কলেজে পড়াশুনো করেন। মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষের পুত্র এই মানুষটি জীবনের প্রথম পর্ব থেকেই নিজেকে সংবাদপত্র-জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলেন। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘যুগান্তর’, ‘অমৃত’ প্রমুখ পত্র-পত্রিকার সম্পাদনা করার ফাঁকে ফাঁকে কয়েকখানি গ্রন্থও তিনি রচনা করেন। ‘বিচিত্র কাহিনী’, ‘চিত্র-বিচিত্র’, ‘আরও বিচিত্র কাহিনী’ প্রমুখ গ্রন্থ তাঁর সাহিত্যপ্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন। সাংবাদিক জগতের বহু প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত। ব্যক্তিগত জীবনে ইনি যেমন সুরসিক তেমনি সুবক্তা।

শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়: জন্ম: ৩০শে মার্চ, ১৮৯৯ সালে, পিতার কর্মস্থল বিহারের পূর্ণিয়ায়। ১৯১৫ সালে মুঙ্গের জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে ১৯১৯-এ বি এ পাশ করেন। ১৯২৬-এ পাটনা থেকে আইন পাস করেন। ১৯২৯ থেকে ওকালতি ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। সাধারণ গল্প-উপন্যাস-কবিতা ছাড়াও সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ ও ভূতান্বেষী বরদাকে নিয়ে তিনি বহু সার্থক গল্প-উপন্যাস রচনা করেন। ১৯৬৭ সালে ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’ গ্রন্থের জন্যে রবীন্দ্র পুরস্কার পান। ১৯৭০-এ ২২শে সেপ্টেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

সজনীকান্ত দাস: জন্ম: ১৯০০ সাল। দেশ: রায়পুর, বীরভূম। শিক্ষা: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট। সমালোচনা সাহিত্যে এবং সম্পাদনায় বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ‘বঙ্গশ্রী’ ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদনা ছাড়াও ‘প্রবাসী’ প্রমুখ বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদনা-বিভাগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘আত্মস্মৃতি’, ‘পঁচিশে বৈশাখ’, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘মানস সরোবর’, ‘রাজহংস’ প্রভৃতি। ১৯৬২ সালে পরলোকগমন করেন।

শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়: জন্ম: ২১শে মার্চ ১৯০১ সালে বর্ধমান জেলার অণ্ডালে, মাতুলালয়ে। ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’ যুগের অন্যতম স্রষ্টা শৈলজানন্দ প্রথম জীবনে কবিতা লিখেছেন। সারা জীবনে তিনি শ’দেড়েক উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ রচনা করেন। শৈলজানন্দের ‘কয়লাকুঠির দেশে’ ‘শহর থেকে দূরে’ প্রভৃতি বহুলপঠিত গ্রন্থ। তাঁর বহু উপন্যাস ছায়াছবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তিনি নিজেও বহু ছবি পরিচালনা করেছেন। ২রা জানুয়ারী ১৯৭৬-এ তাঁর মৃত্যু হয়।

প্রমথনাথ বিশী: জন্ম: ১৯০১ সালে ১১ই জুন রাজশাহী জেলার নাটোর মহকুমার জোয়াড়ি গ্রামে। ১৯৩৩-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাইভেটে এম এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। কবিতা দিয়েই তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরু। গদ্য-পদ্যে সমান দক্ষ প্রমথনাথ বিশী বই লিখেছেন প্রায় ৯০টি। ১৯৬০ সালে ‘কেরী সাহেবের মুন্সী’ গ্রন্থের জন্যে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। ১৯৮৫ সালে তিনি লোকান্তরিত হন।

মনোজ বসু: জন্ম: ২৫শে জুলাই ১৯০১ সালে যশোহর জেলার ডোঙ্গাঘাটায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেছেন। ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম ছোট গল্পের বই ‘বনমর্মর’ প্রকাশিত হয়। বহু গ্রন্থ রচয়িতা মনোজ বসু ১৯৬৬ সালে ‘নিশিকুটুম্ব’ উপন্যাসের জন্যে অকাদেমি পুরস্কার পান। ২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৮৭ সালে লেখক পরলোকগমন করেন।

সরোজকুমার রায়চৌধুরী: জন্ম: ১৯০৩ সাল। দেশ: মুর্শিদাবাদ জিলার মালিহাটী গ্রাম। শিক্ষা জীবন শেষ করে সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকেই পেশা করে নিয়েছিলেন। একসময়ে দৈনিক কৃষক-এর এবং মাসিক বর্তমানের সম্পাদক ছিলেন। এরই ফাঁকে চলে সাহিত্য জীবন। বিখ্যাত বই: কালো ঘোড়া (চলচ্চিত্রায়িত), শতাব্দীর অভিশাপ, শৃঙ্খল, অনুষ্টুপ ছন্দ, কৃশানু, বসন্ত রজনী। ছোটদের লেখাও বেশ-কিছু লিখেছেন তিনি। গ্রন্থ: ডাকাতের সর্দার, গল্প আমার গল্প নয়। ১৯৭২ সালে এই লেখকের মৃত্যু ঘটে।

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত: জন্ম: ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে নোয়াখালিতে। ১৩২৮ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসের ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় নীহারিকা দেবী ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর ‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ’ গ্রন্থটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ‘কল্লোল যুগ’ বইটি বাংলা সাহিত্যে একটি স্থায়ী স্মৃতিচারণীরূপে সমাদৃত। ১৯৭৫-এ ‘উত্তরায়ণ’ কাব্যগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার। ২৯শে জানুয়ারী ১৯৭৬-এ পরলোকগমন করেন।

প্রেমেন্দ্র মিত্র: জন্ম: ১৯০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, বারাণসীতে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে উত্তর প্রদেশে। কলকাতা ও ঢাকায় পড়াশুনো করেছেন। বিচিত্র জীবিকা, শেষ পর্যন্ত লেখক। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক হয়েছিলেন। আকাশবাণীতে প্রথমে প্রযোজক, পরে ‘সাহিত্য-শলাহকর’রূপে যুক্ত ছিলেন। প্রায় শ’দেড়েক বই লিখেছেন। তাঁর কিশোর সাহিত্যও জনপ্রিয়। ‘সাগর থেকে ফেরা’ গ্রন্থের জন্যে ১৯৫৭ ও ১৯৫৮ সালে পেয়েছেন অকাদেমি ও রবীন্দ্র পুরস্কার। এ ছাড়াও সাহিত্য জীবনে অন্যান্য বহু পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হয়েছেন। ৩রা মে ১৯৮৮ সালে লেখক লোকান্তরিত হন।

লীলা মজুমদার; জন্ম: ২৬শে ফেব্রুয়ারী ১৯০৮ সালে, কলকাতায়। শিক্ষা: ইংরাজী সাহিত্যে এম· এ। অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন জায়গায়, একসময়ে শান্তিনিকেতনেও কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বংশগত ঐতিহ্যের ধারক এই লেখিকা সাহিত্যজীবন শুরু করেন অল্প বয়সেই। বর্তমানে প্রখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদিকা। বিখ্যাত গ্রন্থ: দিনদুপুরে, পদিপিসির বর্মি বাক্স, হলদে পাখির পালক, বাতাসবাড়ি, গুপির গুপ্ত খাতা, অবনীন্দ্রনাথ, খেরোর খাতা, সব ভুতুড়ে প্রমুখ। রবীন্দ্র পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার।

গজেন্দ্রকুমার মিত্র: জন্ম: ১৯০৮ সালে ১১ই নভেম্বর, কলকাতা। বারাণসী ও কলকাতায় শিক্ষা। ১৯২৮-এ ‘ঋত্বিক’ পত্রিকায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। আর এই বছরে প্রথম সম্পাদনা করেছেন ‘বিজয়’ সাপ্তাহিক পত্রিকা। ১৯৫৯-এ ‘কলকাতার কাছেই’ উপন্যাসের জন্যে পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার আর ১৯৬৫-তে পেয়েছেন ‘পৌষ ফাগুনের পালা’র জন্যে রবীন্দ্র পুরস্কার।

প্রণব রায়: জন্ম: ডিসেম্বর ১৯০৮ সাল। পড়াশুনো করেছেন প্রথমে ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল, পরে সিটি কলেজ। ‘রোমাঞ্চ’, ‘নাগরিক’, ‘নরনারী’, ‘কল্লোল’ প্রমুখ বহু সাপ্তাহিক-মাসিকপত্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন প্রথম জীবনে। পরে কাজী নজরুলের ডাকে গীতিকার হিসেবে যুক্ত হলেন এইচ এম ভি-তে। তারও পরে চলচ্চিত্রে। প্রায় দু হাজার গান লেখা ছাড়াও অসংখ্য ছবির কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছেন। প্রযোজক-পরিচালকও হয়েছিলেন কয়েকখানি ছবিতে। গানের জগতে নির্বাসিত মানুষটি ‘রোমাঞ্চ’র ডাককে কিন্তু উপেক্ষা করতে পারেননি, লিখেছেন অসংখ্য গল্প ও উপন্যাস। ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট’, ‘চৈতিবাঈয়ের মামলা’, ‘শঙ্খচূড়’, ‘রাজকন্যা’, ‘বহুরূপী প্রমুখ গ্রন্থ যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৭৫ সালের আগস্টে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তাঁর শেষ বই ‘শেষ মুহূর্ত’ হতে পাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই!

ভবানী মুখোপাধ্যায়: জন্ম: ২২শে ডিসেম্বর ১৯০৯ সাল। শিক্ষাজীবন কলকাতা ও দিল্লী। পেশায় সরকারী চাকুরে। ছাত্রজীবন থেকে সাহিত্যের সকল শাখাতেই বিচরণ করেছেন। মৌলিক গ্রন্থ: স্বর্গ হতে বিদায়, কালো রাত, ছায়া মাধবী, যথা পূর্বং প্রমুখ ছাড়াও অনুদিত গ্রন্থ: বিপ্লবী যৌবন, মাদার রাশিয়া, জার্মানীর ছোট গল্প, ট্রেজার আইল্যান্ড, বিশ্বসাহিত্যের লেখক। জর্জ বার্নার্ড শ, অস্কার ওয়াইল্ড, শরৎচন্দ্র প্রমুখ কয়েকটি জীবনীগ্রন্থও তিনি রচনা করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন নিরহঙ্কার, অমায়িক ও মজলিসী। ১৯৯১ সালের ৫ই জুলাই তিনি পরলোকগমন করেন।

নীহাররঞ্জন গুপ্ত: জন্ম: ১৯১১ সাল। আদি নিবাস যশোহর। ডাক্তারী পাশ করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে ভারতীয় সেনাদলে যোগ দিয়েছিলেন এবং মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। যুদ্ধের পর স্নাতকোত্তর শিক্ষা লাভের জন্যে লন্ডনে যান। দেশে ফিরে, চিকিৎসক হিসেবে যথেষ্ট পশার ও প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও সাহিত্যজীবনের নেশা থেকে তিনি কোনদিনই বিরত থাকে নি। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘রাজকুমার’ বেরিয়েছিল ‘শিশুসাথী’ পত্রিকায়। তবে কিরীটীকে নিয়ে লেখা ‘কালো ভ্রমর’ই তাঁকে খ্যাতির তুঙ্গে তুলেছিল। কম-বেশি একশোখানি গ্রন্থের জনক তিনি। তাঁর বহু কাহিনী চলচ্চিত্রায়িত হয় এবং ‘উল্কা’, ‘মায়ামৃগ’ প্রমুখ অনেকগুলি নাটক মঞ্চ সাফল্য লাভ করে। ১৯৮৬ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ তাঁর লোকান্তর ঘটে।

হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়: জন্ম: ২৩শে মার্চ, ১৯১৬ সালে ব্রহ্মদেশে। লেখাপড়ার শুরু সেখানেই এবং কৃতিত্বের সঙ্গে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। ভারতে একটি ইন্সিওরেন্স কোম্পানিতে কর্মগ্রহণ করেন। সাহিত্য জীবনের উন্মেষ ছেলেবেলা থেকেই, কবিতা দিয়ে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ইরাবতী, উপকূল, আরাকান, নারী ও নগরী ইত্যাদি। মতিলাল পুরস্কার ও তারাশঙ্কর স্মৃতি পুরস্কারে ভূষিত। ছোটদের জন্যও তিনি লিখেছেন প্রচুর। লেখা ছাড়াও নেশা ছিল অভিনয়ে। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ চলচ্চিত্রে তিনি দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহনের ভূমিকায় নামেন। ২০শে জানুয়ারী ১৯৮১ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়; জন্ম: মার্চ, ১৯১৭ সাল। দেশ: বাঁকুড়া। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ। পেশা: সরকারী চাকুরে। সাহিত্য জীবনের শুরু কবিতা দিয়ে। ছোটদের এবং বড়দের উভয় সাহিত্যেই সমান দক্ষ। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘মৈনাক’, ‘পারুলদি’, ‘জাল’ ‘ছাতুবাবুর ছাতা’, ‘পাতিরামের হাতি’ ইত্যাদি। ১৯৭৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র: জন্ম: ৩০শে জানুয়ারী ১৯১৭ সালে ফরিদপুর জেলার সদরদিতে। স্থানীয় ভাঙ্গা হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ থেকে বি এ পাস করেন। ১৯৩৬ সালে দেশ পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘মূক’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ থেকে আমৃত্যু আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বহু গ্রন্থ রচয়িতা নরেন্দ্রনাথ মিত্র ১৪ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ সালে পরলোকগমন করেন।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়: জন্ম: ১৯১৮ সালে, দিনাজপুরের বালিয়াডাঙ্গাতে। ১৯৪১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম এ পাস করেন। অধ্যাপনা দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। ছাত্রাবস্থায় কবিতা লিখে সাহিত্যজীবনের সূত্রপাত। পরবর্তী জীবনে গল্প, উপন্যাস, নাটক রচনা করে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ৮ই নভেম্বর ১৯৭০-এ লোকান্তর ঘটে এই লেখকের।

সত্যজিৎ রায়: জন্ম: ২রা মে ১৯২১ সালে, কলকাতার গড়পারে। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, পিতা সুকুমার রায়ের সুযোগ্য সন্তান সত্যজিৎ রায়ের শিক্ষা প্রথমে শান্তিনিকেতনে, পরে কলকাতায়। প্রথম জীবনে ছবি আঁকার মধ্যেই ব্যাপৃত ছিলেন তিনি, পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রশিল্পে নিয়োগ করলেন নিজেকে। দেশ-বিদেশ থেকে নিয়ে এলেন অসংখ্য পুরস্কার বিপুল সম্মান। এরই ফাঁকে বংশানুক্রমিক ধারা অনুযায়ী কিশোর সাহিত্যের সেবার কথাও ভোলেননি। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, বিজ্ঞানভিত্তিক কাহিনী ইত্যাদি লিখে চললেন। এবং সেই সঙ্গে অন্যতম সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠান থেকে পুনঃপ্রচার শুরু করলেন ‘সন্দেশ’ পত্রিকার। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা চল্লিশ ছাড়িয়েছে। সম্প্রতি চলচ্চিত্র পুরস্কার ‘অস্কার’, ভারত সরকার প্রদত্ত ‘ভারতরত্ন’ উপাধিতে ভূষিত হবার কিছুকাল পরেই তাঁর লোকান্তর ঘটে ২৩শে এপ্রিল, ১৯৯২ সালে।

বিমল কর: জন্ম: ১৯শে সেপ্টেম্বর ১৯২১ সালে ২৪ পরগনা জেলার টাকির কাছে একগ্রামে। শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। স্কুলজীবন কলকাতার বাইরে। ১৯৪৫-এ পাস করেছেন বি এ। ১৯৪২ থেকে ৪৩ পর্যন্ত নানা ধরনের কাজ করে ১৯৪৬ থেকে ৫২ পর্যন্ত কাজ করেছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। ১৯৫২ সালের নভেম্বর মাসে দেশ পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘বরফ সাহেবের মেয়ে’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ থেকে ৮২ পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন দেশ-এর সঙ্গে। ১৯৭৫-এ ‘অসময়’ উপন্যাসের জন্যে পেয়েছেন অকাদেমি পুরস্কার। এছাড়াও পরবর্তীকালে পেয়েছেন অন্যান্য বহু সাহিত্য পুরস্কার। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: দেওয়াল, অসময়, পূর্ণ-অপূর্ণ প্রভৃতি।

সমরেশ বসু: জন্ম: ১৯২৪ সালে। বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাপূর্ণ জীবন। ১৯৪৬ সালের শারদীয়া সংখ্যা পরিচয় পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ‘আদাব’ প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নয়নপুরের মাটি’। আর প্রথম পুস্তকাকারে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘উত্তরঙ্গ’। কালকূট ছদ্মনামে ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ প্রকাশিত হলে বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন। কালকূট ছদ্মনামে রচিত ‘শাম্ব’ উপন্যাসের জন্যে ১৯৮০-তে পেয়েছেন অকাদেমি পুরস্কার। ১২ই মার্চ, ১৯৮৮ সালে পঞ্চাশাধিক গ্রন্থের জনক এই লেখকের লোকান্তর ঘটে।

শিশির লাহিড়ী: জন্ম: ১লা অক্টোবর ১৯২৪ সাল। সাহিত্যে এম এ। প্রথম ছাপা গল্প ‘প্রিয়নাথের মৃত্যু’ ১৯৪৮ সালে। দীপ্তেন সান্যাল সম্পাদিত ‘অচলপত্রের’ নিয়মিত লেখক ছিলেন ওই সময়ে। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত অজ্ঞাতবাসে থাকার পর পুনরায় লেখক জীবনে ফিরে আসেন ‘পুতুলের মৃত্যু’ নিয়ে দেশ পত্রিকায়। দেশ ছাড়াও অন্যান্য সাপ্তাহিক-মাসিকপত্রে অসংখ্য গল্প-উপন্যাস লিখেছেন। প্রকাশিত কিশোর গ্রন্থ: তারা সাতজন, বড়দের: শেষ প্রহরে শান্তি।

মহাশ্বেতা দেবী: জন্ম: ১৪ই জানুয়ারি ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে, ঢাকায়। শান্তিনিকেতনে ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেছেন। তাঁর ‘ঝাঁসীর রানী’ ‘নটী’ প্রভৃতি গ্রন্থ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৭৯ সালে ‘অরণ্যের অধিকার’ গ্রন্থের জন্যে অকাদেমি পুরস্কার পান। কাজ: লেখা, সাংবাদিকতা ও আদিবাসী সমাজসেবা।

মঞ্জিল সেন: জন্ম: ১৯২৬ সাল, কলকাতায়। আদি নিবাস ঢাকা জিলার বিক্রমপুর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। কলেজ জীবন থেকে মূলত শিশু ও কিশোর সাহিত্যের ওপরই লিখে আসছেন। বইয়ের সংখ্যা তিরিশের ওপর। সাহিত্য-স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বহু পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য বই: রাতের আতঙ্ক, সেরা ভূতের গল্প, গোয়েন্দা রহস্য, চিতার বাবা, রাজস্থান রহস্য, টিলাগড় রহস্য প্রমুখ।

রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়: জন্ম: ১৯২৭ সাল, কলকাতায়। দেশ: হাওড়া জিলার কল্যাণপুর গ্রামে। লেখকজীবনের সূত্রপাত ছাত্রাবস্থা থেকেই। স্বনামে এবং বেনামে নামী-দামী সব পত্র-পত্রিকাতেই লিখেছেন। ১৯৪৫ সালে সাহিত্যপত্র ‘কথাচয়ন’-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হয়েছিলেন। তারপর ১৯৫২ সাল থেকে ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণের পর দীর্ঘকাল লেখার জগৎ থেকে সরে দাঁড়ান। তাঁর রচিত বহু গল্পই বেতার-নাট্যায়িত হয়েছে চলচ্চিত্রিতও হয়েছে একটি কাহিনী। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: স্বর্ণময়ীর ঠিকানা, দর্পণে অন্য মুখ, সোনার আংটি উধাও, গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা প্রভৃতি।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ: জন্ম: ১৪ই অক্টোবর ১৯৩০ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার খোশবাসপুর গ্রামে। আশৈশব সাহিত্যচর্চার পরিবেশে মানুষ। ১৯৫০-৫৬ সাল পর্যন্ত রাঢ় বাংলায় আলকাপের দলের সঙ্গে ঘুরেছেন। ষাটের দশকের গোড়ায় সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ। উপন্যাস ও গল্পের বইয়ের সংখ্যা প্রায় নব্বইটি। ছোটদের লেখাও লেখেন। শতাধিক গল্প ও প্রবন্ধ লেখক মুস্তাফা সিরাজ বর্তমানে আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। সাহিত্য-স্বীকৃতি হিসেবে কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছেন ইতিমধ্যে।

অদ্রীশ বর্ধন: জন্ম: ১৯৩২ সালে কলকাতায়। বিজ্ঞানের স্নাতক। ছেলেবেলা থেকেই রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনীর প্রতি প্রবল আকর্ষণ। প্রথম লেখা বেরোয় ‘শুকতারা’য়। তারপর ‘রোমাঞ্চ’ ও অন্যান্য পত্রিকায় নিয়মিত। অসংখ্য ছোটগল্প এবং উপন্যাস লিখেছেন তিনি। এদেশে কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর প্রথম পত্রিকা ‘আশ্চর্য!’-র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক হলেন ১৯৬১ সালে। বেশ কয়েক বছর সুনামের সঙ্গে পত্রিকা চলে, তারপর অনিবার্য কারণে বন্ধ হয়ে যাবার পর বের করলেন ‘ফ্যান্টাস্টিক’। প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা শতখানেক। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ: কাচের জানলা।

শোভন সোম: জন্ম: ১৯৩২। শিক্ষা: বিশ্বভারতীর চারুকলা ডিপ্লোমা, কলকাতার এম এ, রবীন্দ্রভারতীর ডি লিট। পেশা: রবীন্দ্রভারতীর শিল্প-ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ও ডীন। ছাপার অক্ষরে কবিতা দিয়ে সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯৪৬-এ। বর্তমানে প্রাবন্ধিক ও শিল্প-সমালোচক হিসেবে বিশেষ পরিচিত। প্রকাশিত গ্রন্থ: স্বরবিদ্ধ (কবিতা), টোপ (রহস্য উপন্যাস) ছাড়াও ‘শিল্প ও শিল্পীসমাজ’, ‘তিন শিল্পী’, ‘বাংলা শিল্প-সমালোচনার ধারা’, ‘চিত্ৰভাবন’, ‘রামকিঙ্কর’ এবং হিন্দিতে ‘শিল্পবোধ’ ও ‘মিট্টি কী কলা।’

আনন্দ বাগচী: জন্ম: ১৯৩২ সালে, পাবনায়। শৈশব কেটেছে উত্তরবঙ্গে। দীর্ঘ ১৬ বছর অধ্যাপনার পর ১৯৭৭ থেকে ‘দেশ’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। কাব্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও মূলত কথাসাহিত্যে বিশিষ্ট মৌলিকতার জন্যেই সুচিহ্নিত। তাঁর প্রথম সাড়াজাগানো গল্প ‘গোপন কথা’ বেরিয়েছে ১৯৬৫ সালের দেশ পত্রিকায়। চকখড়ি, বিকেলের রং, রাজযোটক, শ্রেষ্ঠ গল্প, উজ্জ্বল ছুরির নীচে, স্বগত সন্ধ্যা, চালচিত্র প্রভৃতি গ্রন্থ রচয়িতা আনন্দ বাগচী রম্যরচনা লেখেন ‘ত্রিলোচন কলমচী’ ছদ্মনামে। ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকায় গোয়েন্দা ও রহস্য কাহিনীও লিখেছেন প্রচুর। প্রথম রহস্যোপন্যাস ‘যাদুঘর’।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: জন্ম: ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ। টিউশানি দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। বর্তমানে দেশ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। ১৯৬৬-র শারদীয়া দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’। ‘একা এবং কয়েকজন’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। সনাতন পাঠক, নীললোহিত এবং নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামেও লিখে থাকেন। ১৯৮৩-তে ‘সেই সময়’ উপন্যাসের জন্যে পেয়েছেন বঙ্কিম পুরস্কার। এ ছাড়াও আরও কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার।

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: জন্ম: ১৯৩৫ সালে, ময়মনসিংহ জেলায়। পিতার রেলের চাকরির জন্যে তাঁর শৈশব কেটেছে নানা জায়গায়। কলকাতার কলেজ থেকে বি-এ। স্নাতকোত্তর পড়াশুনো করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। স্কুল শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবনের শুরু। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। বর্তমানে দেশ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: মানবজমিন, দূরবীন ইত্যাদি। সাহিত্য স্বীকৃতি হিসেবে আনন্দ পুরস্কার প্রমুখ কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত।

মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়: জন্ম: ১৯৩৬ সালে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে কৃতিত্বের সঙ্গে এম এ পাস করার পর তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েই অধ্যাপনায় রত। অসংখ্য মৌলিক লেখা লিখলেও ছেলেবেলা থেকেই বিদেশী সাহিত্যের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। অনুবাদক-সাহিত্যিক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করেছেন। সাহিত্যের অনেক শাখাতেই তিনি বিচরণশীল। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছোটদের উপযোগী লেখা, বিজ্ঞানভিত্তিক রচনা ইত্যাদি নানান ধরনের বই তিনি লিখেছেন।

শেখর বসু: জন্ম: ১৯৪০ সাল। শিক্ষাজীবন কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ। পেশা সাংবাদিকতা। বর্তমানে আনন্দবাজার পত্রিকা প্রতিষ্ঠানে নিযুক্ত। ‘শাস্ত্র বিরোধী ছোটগল্প আন্দোলন’-এর অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। ছোটদের জন্যেও লিখেছেন প্রচুর। ১৯৭৯ সালে ইউরোপ সফরের সময় ভিয়েনায় নেতাজী সহধর্মিনী শ্রীমতী এমিলি শেঙ্কেল বসুর দীর্ঘ একটি সাক্ষাৎকার নেন এবং লেখেন ‘নেতাজীর সহধর্মিনী’ নামে বিখ্যাত গ্রন্থ। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘অন্যরকম’। ছোটদের জন্যে প্রথম উপন্যাস ‘সোনার বিস্কুট’। একাধিক সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন লেখক।

মনোজ সেন: জন্ম: ১৯৪১ সাল। শিক্ষা: কলকাতায়। পেশায় ইঞ্জিনীয়ার। নেশা হিসেবে রেখেছেন সাহিত্যকে। অবসর পেলেই পড়াশুনো করেন আর লেখেন। প্রথম প্রকাশিত গল্প: ‘রোমাঞ্চ’ পত্রিকায় ‘সরল অঙ্কের ব্যাপার’। রহস্য, গোয়েন্দা আর ভৌতিক কাহিনী লিখতে ভালোবাসেন এবং লেখেনও শুধুমাত্র তাইই। বহু উপন্যাস এবং গল্প লিখলেও পুস্তকাকারে একখানিও প্রকাশিত হয়নি।

হীরেন চট্টোপাধ্যায়: জন্ম: ১৯৪৪ সালে। বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম এ ও পি এইচ ডি। বর্তমানে প্রেসিডেন্সী কলেজের অধ্যাপক। সাহিত্যজীবন শুরু হয় স্কুলজীবন থেকে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ক্রন্দসী’। অন্যান্য গ্রন্থ ‘ভূতের চেয়ে ভয়ঙ্কর’, ‘ইয়েতি অভিশাপ’, ‘শৈলশহরের রহস্য’ প্রভৃতি। কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে এঁর লেখা বহু নাটক প্রচারিত হয়।

অনীশ দেব: জন্ম: ২২ শে অক্টোবর ১৯৫১ সালে, কলকাতায়। প্রথম পড়াশুনো হিন্দু স্কুলে, পরে ১৯৭৬ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম টেক ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনায় রত। সাহিত্য জীবন শুরু স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকে। ভালোবাসেন রহস্য রোমাঞ্চ গল্প লিখতে এবং কল্পবিজ্ঞান কাহিনী রচনা করতে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: গোলাপ বাগানে ঝড়, রক্তে অমানুষ, বিজ্ঞানের হরেকরকম, সংকলিত গ্রন্থ ‘সেরা কল্পবিজ্ঞান’ প্রমুখ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *