পালোয়ানী চুরি (অথবা যেমন চোর, তেমনই পুলিশ!)

পালোয়ানী চুরি (অথবা যেমন চোর, তেমনই পুলিশ!) 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

যে রাত্রিতে এই চুরি হয়, সেই রাত্রি বা তাহার পরদিবস প্রাতঃকাল হইতে আমাকে এই চুরির অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইতে না হইলেও পর দিবস বৈকাল হইতে আমাকে এই মোকদ্দমার অনুসন্ধান করিতে গমন করিতে হয়। 

ঘটনাস্থল তালতলা। সন্ধ্যার কিয়ৎ পূর্ব্বে আমি ঘটনাস্থলে উপনীত হইয়া, অনুসন্ধানকারী অপরাপর কর্মচারীগণের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম। 

সেই স্থান গমন করিয়াই বাড়ীর অবস্থা একবার স্বচক্ষে উত্তমরূপে দেখিয়া লইলাম। 

এই বাড়ী গলির ভিতর হইলেও, বেশ বড় বাড়ী। 

রাস্তা হইতে উত্তর মুখে একটি বড় দরজা দিয়া সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে হয়। 

সেই দ্বারের দুই পার্শ্বে দুইটি দ্বিতল গৃহ। সেই গৃহদ্বয়কে দুইটি ছোট ছোট বাড়ী বলিলেও বলিতে পারা যায়।

সেই দ্বার পার হইলে একটি প্রকাণ্ড প্রাঙ্গণের ভিতরে গিয়া উপনীত হইতে হয়। সেই স্থানটি প্রাঙ্গণ হইলেও উহার মধ্যে স্থানে স্থানে নানাবিধ লতা, গুল্ম এবং পুষ্পমণ্ডিত বৃক্ষ সকল রক্ষিত হইয়া উদ্যানবৎ সেই স্থানের শোভা বৃদ্ধি করিতেছে। 

সেই প্রাঙ্গণ বা উদ্যানের পরই ইষ্টকনির্ম্মিত প্ৰকাণ্ড সৌধ আপন মস্তক উন্নত করিয়া স্থিরভাবে দণ্ডায়মান রহিয়াছে। যাঁহার বাড়ী, তিনি এইস্থানে বাস করিয়া থাকেন। 

দ্বারের দুই পার্শ্বে যে দুইটি দ্বিতল গৃহের কথা বলিয়াছি, তাহার একটি নিম্নতল, দ্বারবান এবং কয়েক জন পরিচারকের থাকিবার স্থান। 

নিম্নতলের অপরটি চারিজন পালোয়ানের দ্বারা অধিকৃত। 

গৃহাধিকারী মুসলমান হইলেও সহরের ভিতর তাঁহার বেশ নাম আছে, তিনি অধিকাংশ লোকের নিকটই পরিচিত। ইনি নিজে উপার্জ্জন করিয়া যেরূপ অর্থের সংস্থান করিয়াছেন এবং করিতেছেন, তাহা মুসলমান কেন, এদেশীয় অনেক লোকের অদৃষ্টে প্রায়ই ঘটে না। 

জ্ঞান উপার্জ্জনে এবং অর্থ উপার্জ্জনে তাঁহার যেরূপ অনুরাগ, শারীরিক-বল-লাভের নিমিত্তও তিনি সেইরূপ যত্ন করিয়া থাকেন। 

পূর্ব্বে যে চারিজন পালোয়ানের কথা উল্লিখিত হইয়াছে, তাহারা সকলেই হিন্দু-শিখ, সকলেই গৃহস্বামীর বেতনভোগী। ইহাদিগের ভরণ পোষণ, বেতন প্রভৃতির নিমিত্ত গৃহস্বামী মাসে মাসে বিস্তর অর্থ ব্যয় করিয়া থাকেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ইহাদিগের প্রায় কোন কার্য্যই করিতে হয় না। উত্তমরূপে আহারাদি করিয়া, চারি পায়ার উপর শয়ন করিয়া বাইস্ ঘণ্টাকাল বিশ্রাম করাই ইহাদিগের কার্য্য। অবশিষ্ট দুই ঘণ্টামাত্র কেবল ইহাদিগকে নিম্ন লিখিত রূপ একটু পরিশ্রম করিতে হয়। 

কিরূপে মুদ্গার ভাঁজিতে হয়, কিরূপে কুস্তি করিতে হয়, প্রাতঃ এবং সন্ধ্যাকালে কেবলমাত্র এক এক ঘণ্টা কাল তাহাই গৃহস্বামীকে শিখাইতে হয়। কোন কোন দিবস বা কোমর বাঁধিয়া মল্লভূমে উপনীত হইয়া, তাঁহার সহিত কুস্তি করিয়া, কুস্তির কৌশল সকল তাঁহাকে শিখাইতে হয়। ইহা ব্যতীত সমস্ত দিবসের মধ্যে উহাদিগের আর কোন কাৰ্য্যই নাই। 

যে বাড়ীতে চুরি হইয়াছে, সেই বাড়ীর অবস্থা এইরূপ। এখন দেখা যাক, চুরির অবস্থাই বা কি প্রকার! 

যে সকল কৰ্ম্মচারী সেই সময় সেই স্থানে অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিয়া, নিম্ন-লিখিত কয়েকটি বিষয় অবগত হইতে পারিলাম। 

১ম। পশ্চিম দেশীয় একজন মুসলমান জমিদারের সহিত গৃহস্বামীর সবিশেষ বন্ধুত্ব আছে। বিশিষ্ট কোন কাৰ্য্যবশতঃ সেই জমিদার মহাশয়কে কলিকাতায় আগমন করিতে হইয়াছিল। 

২য়। কলিকাতার অপর কোন স্থানে জমিদার মহাশয়ের থাকিবার উপযুক্ত স্থান না থাকায় এবং গৃহস্বামীর সহিত বন্ধুত্ব সূত্রে বিশেষরূপে আবদ্ধ থাকায়, কিছু দিবসের নিমিত্ত তাঁহাকে এই স্থানেই বাস করিতে হয়। 

৩য়। জমিদার মহাশয়ের সহিত যে সকল লোকজন এবং পরিচারক ছিল, তাহারাও তাঁহার সহিত এক স্থানেই অবস্থান করিতেছিল। 

৪র্থ। বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার সদর দরজার পার্শ্বে যে ঘরের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তাহারই দ্বিতলের উপর জমিদার মহাশয়ের থাকিবার স্থান নির্ধারিত হইয়াছিল। 

৫ম। যে স্থানে পুরাতন টাকা বা মোহর পাইতেন, সেই স্থান হইতে উহা সংগ্রহ করিয়া রাখা, জমিদার মহাশয়ের প্রধান সখ। 

৬ষ্ঠ। বহুকাল হইতে এইরূপ সংগ্রহ করিয়া তিনি অনেকগুলি প্রাচীনকালের টাকা এবং মোহর সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন। 

৭ম। এইরূপে যে সকল পুরাতন মুদ্রা জমিদার মহাশয় কর্তৃক সংগৃহীত হইয়াছিল, তাহা যে কেবল এই দেশীয় মুদ্রা, তাহা নহে; ভিন্ন ভিন্ন দেশীয় ভিন্ন ভিন্ন মুদ্রাও যতদূর সম্ভব, তিনি সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন। 

৮ম। এইরূপে সংগৃহীত পুরাতন মুদ্রাগুলির উপর জমিদার মহাশয়ের এরূপ মমতা জন্মিয়াছিল যে, তিনি যখন যে স্থানে গমন করিতেন, সেই স্থানেই তিনি উহা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতেন। এমন কি, এক দিবসের নিমিত্তও তাঁহাকে স্থানান্তরে গমন করিতে হইলে, তিনি উহা আপন বাড়ীতে পরিত্যাগ করিয়া যাইতেন না। 

৯ম। কলিকাতায় আসিবার সময়ও তিনি নিজের বাড়ীতে রাখিয়া আসেন নাই, সমস্তই সঙ্গে করিয়া আনিয়াছিলেন।

১০। যে গৃহে তাঁহার থাকিবার স্থান নির্দ্দিষ্ট হইয়াছিল, সেই গৃহের ভিতরই একটি বড় রকম টিন বাক্সের ভিতর একটি ক্যাশ বাক্সে, উহা সযতনে রক্ষিত হইয়াছিল। 

১১শ। সেই বড় টিনবাক্সের চাবি কখন জমিদার মহাশয়ের নিকট থাকিত না, একজন পরিচারক সর্ব্বদা সেই চাবি আপনার নিকটেই রাখিত। 

১২শ। যে টিনের ক্যাশ বাক্সের ভিতর সেই সকল বহুমূল্য মুদ্রা রক্ষিত থাকিত, সেই ক্যাশ বাক্সের চাবি জমিদার মহাশয় সৰ্ব্বদাই আপনার নিকট রাখিতেন, পরিচারক বা অপর কোন ব্যক্তির হস্তে উহা কখনও তিনি প্রদান করিতেন না। কিন্তু সেই ক্যাশ বাক্সটি সর্ব্বদা পূৰ্ব্ব-কথিত টিনের বড় বাক্সের ভিতর থাকিত। ক্যাশ বাক্সের প্রয়োজন হইলে, বড় বাক্সের ভিতর হইতে উহা বাহির করিয়া পরিচারক জমিদার মহাশয়ের নিকট রাখিয়া দিত, এবং জমিদার মহাশয়ের কাৰ্য্য শেষ হইয়া গেলে, পুনরায় উহা বড় বাক্সের ভিতর রক্ষিত হইত। 

১৩শ। কলিকাতায় আসিবার পর আংটী প্রভৃতি আরও কতকগুলি বহুমূল্য অলঙ্কার জমিদার মহাশয় সেই ক্যাশ বাক্সের ভিতর রাখিয়া দিতেন। 

১৪শ। সেই বাক্সের ভিতর যে সেই সকল বহুমূল্য দ্রব্য রক্ষিত হইত, তাহা তাঁহার পরিচারকগণ, অনুচরগণ এবং গৃহস্বামীর ভৃত্যগণ প্রভৃতি সকলেই জানিত। 

১৫শ। যে গৃহে জমিদার মহাশয়ের থাকিবার স্থান নিৰ্দ্ধারিত হইয়াছিল, সেই গৃহে গমন করিতে হইলে, একটি সোপানাবলী অবলম্বন করিয়া উঠিতে হয়। একটি ছোট দরজার ভিতর হইতে আরম্ভ হইয়া, ভিতরে ভিতরে সেই সোপানাবলী উপরে উঠিয়াছে। নিম্নের ছোট দরজাটি ভিতর হইতে বন্ধ করিয়া দিলে, উপরে উঠিবার আর কোনরূপ উপায় থাকে না। যে রাত্রিতে চুরি হয়, সেই দিবস রাত্রিকালে সেই দরজা ভিতর হইতে নিয়মিতরূপে বন্ধ করিয়া হয়, এবং পর দিবস অতি প্রত্যূষে সেই দরজা নিয়মিতরূপে বদ্ধ অবস্থাতেই দেখিতে পাওয়া যায়। 

১৬শ। যে সোপানাবলী ভিতরে ভিতরে উপরে উঠিয়াছে, তাহা এক স্থানের একটি জানালার নিকট দিয়া গমন করিয়াছে। সেই জানালা বাড়ীর বাহিরে রাস্তার দিকে নহে, বাড়ীর ভিতরে প্রাঙ্গণের দিকে। 

১৭শ। প্রাতঃকালে জমিদার মহাশয় নিদ্রা হইতে গাত্রোত্থান করিয়াই দেখিতে পাইলেন যে, তাঁহার থাকিবার ঘরের মধ্যে যে বড় টিনের বাক্সটি ছিল, তাহা সেই স্থানে ভগ্নাবস্থায় পড়িয়া রহিয়াছে; কিন্তু তাহার মধ্যস্থিত যে ক্যাশ বাক্সে মুদ্রাদি রক্ষিত ছিল, মুদ্রাদির সহিত সেই ক্যাশ বাক্সটি মাত্র অপহৃত হইয়াছে। 

১৮শ। বাড়ীর প্রাঙ্গণের ভিতর প্রথমে প্রবেশ করিতে না পারিলে, কোন ব্যক্তি জানালা ভাঙ্গিয়া, কোন ক্রমেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে পারে না। বাড়ী প্রবেশের সদর দরজা কোন্ সময় বন্ধ করা হইয়াছিল এবং কাহাদ্বারা কোন্ সময় উহা প্রথম উদ্ঘাটিত হয়, দ্বারবান্ সন্তোষজনকরূপে তাহা কাহাকেও বলিতে পারে না। এমন কি রাত্রিকালে সেই দরজা সে বন্ধ করিয়াছিল, কি না, তাহাও স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারিল না। 

বাড়ীর অবস্থা সকল উপরি লিখিত মত অবগত হইয়া, এখন অনুসন্ধানের কোন্ পন্থা অবলম্বন করা যাইতে পারে, তাহাই চিন্তা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

এই মোকদ্দমার অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার পূর্ব্বে নিম্নলিখিত কয়েকটি বিষয় আমার মনে আসিয়া উপস্থিত হইল।

১। যেরূপ অবস্থায় এই চুরি হইয়াছে, এবং বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার সদর দ্বার রাত্রিকালে যদি নিয়মিত রূপে বন্ধ করা হইয়া থাকে, তাহা হইলে বাড়ীর ভিতরস্থিত লোক ব্যতীত অপর কাহারও দ্বারা এই চুরি হইবার সম্ভাবনা নাই। অথচ জমিদার এবং গৃহস্বামীর প্রত্যেক পরিচারকের মধ্যে এরূপ কোন ব্যক্তি নাই যে, জমিদার মহাশয়ের অর্থাদি কোথায় রক্ষিত হয়, তাহা অবগত নহে! 

এইরূপ অবস্থায় আমাদিগের সম্পূর্ণ সন্দেহ, পরিচারকগণের উপরই প্রায় পতিত হইয়া থাকে। কিন্তু এদিকে গৃহস্বামী কহিতেছেন যে তাঁহার পরিচারকদিগের দ্বারা একার্য্য কখনই হইতে পারে না; কারণ, তাহাদিগের মধ্যে অবিশ্বাসী চাকর কেহই নাই। পালোয়ানদিগের দ্বারাও একার্য্য হইতে পারে না, কারণ, একে ইহারা শিখ-বংশ-সম্ভূত, তাহাতে বীরত্বই ইহাদিগের ব্যবসা; তদ্ব্যতীত অনেক দিবস পর্য্যন্ত তাহারা গৃহস্বামীর গৃহে অবস্থিতি করিতেছে। ইহার মধ্যে তাহাদিগের প্রকৃতির কোনরূপ বৈলক্ষণ্য-ভাব কখনও দৃষ্টি গোচর হয় নাই; সুতরাং তাহাদিগের দ্বারা এই নীচ কার্য্য যে হইতে পারিবে, তাহা গৃহস্বামীর বিশ্বাস হয় না। দ্বাররা গণ বহু দিবসের বিশ্বাসী এবং পুরাতন চাকর, সুতরাং একার্য্য করিতে তাহারাও কখন অগ্রবর্তী হইবে না। 

অপর দিকে জমিদার মহাশয় বলিতেছেন যে, তাঁহার যে সকল অনুচর এবং পরিচারক তাঁহার সহিত আগমন করিয়াছে, তাহাদিগের মধ্যে অবিশ্বাসী লোক কেহই নাই। তাহারা বহুদিবস হইতে তাঁহার আশ্রয়ে বাস করিতেছে এবং অনেক স্থানে তাঁহার সহিত ভ্রমণ করিয়াছে; কিন্তু অবিশ্বাসীর কোন কার্য্য ইহাদিগের দ্বারা কখনই সাধিত হয় নাই। বিশেষতঃ যে পরিমিত অর্থ এবং দ্রব্যাদি লইয়া জমিদার মহাশয় এবার কলিকাতায় আগমন করিয়াছেন, তাহা অপেক্ষা অধিক পরিমিত অর্থ এবং দ্রব্যাদি লইয়া সময় সময় এই সকল লোকদিগের সহিত কত স্থানে গমন করিয়াছেন, কিন্তু কখনও কোন দ্রব্য অপহৃত হয় নাই। অধিকন্তু যে সকল ব্যক্তি জমিদার মহাশয়ের সহিত গমন করিয়াছে, তাহারা সকলেই উত্তমরূপে অবগত আছে যে, জমিদার মহাশয়ের সহিত পুনরায় তাহাদিগকে প্রত্যাগমন করিতে হইবে। এরূপ অবস্থায় অপহৃত দ্রব্য সকল তাহারা কি প্রকারে লইয়া যাইতে সমর্থ হইবে? বিশেষতঃ কলিকাতাতেও উহাদিগের বিশেষ আত্মীয় বা পরিচিত এমন কোন লোক দেখিতে পাইতেছি না, যাহাদিগের নিকট উহারা অপহৃত দ্রব্য সকল বিশ্বাস করিয়া রাখিয়া যাইতে পারে। 

২। রাত্রিকালে দ্বারবাদিগের অমনোযোগ প্রযুক্ত যদি সদর দরজা প্রকৃতই বন্ধ না হইয়া থাকে, তাহা হইলে বাহিরের লোক দ্বারা এই চুরি হওয়া একবারে অসম্ভব নহে। কিন্তু ভিতরের কোন লোক কোনরূপ সহকারিতা না করিলে, বাহিরের লোক কি প্রকারে জানিতে পারিবে, বহুমূল্য দ্রব্যাদির সহিত ক্যাশ বাক্স কোথায় এবং কিরূপে রক্ষিত হইয়াছে? 

৩। আরও এক কথা, যে স্থানে দণ্ডায়মান হইয়া, চোরে জানালা ভাঙ্গিয়াছে, সেই স্থানে বাহিরের কোন লোক রাত্রিকালে দণ্ডায়মান হইয়া সবলে জানালা ভাঙ্গিতে সমর্থ হয় কি না সন্দেহ। কারণ, সেই স্থানের নিকটেই পালোয়ানগণ এবং দ্বারবানগণ শয়ন করিয়া থাকে। 

এইরূপ অবস্থায় পতিত হইয়া, এই চুরি বাহিরের লোকদিগের দ্বারা হইয়াছে, কিম্বা ভিতরের লোকদিগের দ্বারা হইয়াছে, তাহা সহজে স্থির করা আমাদিগের পক্ষে একবারে অসম্ভব হইয়া পড়িল। কোন্ উপায় অবলম্বন করিয়া এই অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইব, অতঃপর সেই চিন্তাতেই আমাদিগের সময় অতিবাহিত হইতে লাগিল। 

যে স্থানে বসিয়া আমি অপরাপর কর্ম্মচারীগণের নিকট হইতে প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণিত বিষয় সকল অবগত হইতে ছিলাম, পরিশেষে সেই স্থান হইতে গাত্রোত্থান করিয়া, সেই ভগ্ন জানালাটির অবস্থা প্রথমেই উত্তমরূপে দেখিলাম। দেখিলাম যে, জানালাটি নিতান্ত ক্ষুদ্র। আরও দেখিলাম যে, জানালাটি প্রকৃতরূপে ভাঙ্গে নাই; উহার চতুষ্কোণের কয়েক খানি ইট খুলিয়া জানালাটি দেওয়াল হইতে একবারে বাহির করিয়া লইয়াছে; এবং তাহারই নিকটবর্তী স্থানে উহা রাখিয়া দিয়াছে। জানালাটিকে এইরূপে স্থানান্তরিত করায়, সেইস্থান দিয়া একটি লোকের ভিতরে প্রবিষ্ট হইবার পক্ষে সবিশেষ সুবিধা হইয়াছে। 

জানালার অবস্থা দৃষ্টি করিয়া পরিশেষে উপরে উঠিলাম। দেখিলাম যে, টিনের বড় বাক্সটি প্রকৃতই ভাঙ্গিয়া ফেলিয়াছে, এবং তাহার মধ্যস্থিত ক্যাশ বাক্সটি অপহৃত হইয়াছে। 

ভগ্নাবস্থায় যদি ক্যাশ বাক্সটি পাওয়া যায়, এই ভাবিয়া উপরের ঘর কয়েকটি এবং নিম্নের দরজায় পালোয়ান প্রভৃতির দ্বারা অধিকৃত ঘর সকল উত্তমরূপে দেখিলাম; কিন্তু ক্যাশ বাক্সের কোন চিহ্ন সেখানে দেখিতে পাইলাম না। 

ইহার পরেই আমার অনুসন্ধানের স্থল, পূর্ব্ববর্ণিত সেই প্রাঙ্গণ এবং তন্মধ্যবর্তী পুষ্পোদ্যান হইল। পুষ্পোদ্যানের এক প্রান্ত হইতে অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়া ক্রমে অগ্রবর্তী হইতে লাগিলাম। এইরূপ কিছুদূর গমন করিতে করিতে লতাপুষ্প সমন্বিত একটি স্থানের দিকে আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। সেই স্থানটি উত্তমরূপে দেখিবার মানসে তাহার ভিতর প্রবেশ করিলাম। একগাছি যষ্টির দ্বারা লতা-গুল্ম সকল স্থানান্তরিত করিয়া দেখিতে দেখিতে একটি কৃষ্ণবর্ণ পদার্থের উপর আমার দৃষ্টি পতিত হইল। যাহা ভাবিয়াছিলাম, উহার নিকটে গিয়া তাহাই দেখিতে পাইলাম। দেখিলাম যে, সেই অপহৃত ক্যাশ বাক্সটি ভগ্নাবস্থায় সেই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। কিন্তু তাহার মধ্যে যে সকল বহুমূল্য দ্রব্যাদি ছিল, তাহার চিহ্নমাত্রও নাই। 

ক্যাশ বাক্স ভগ্নাবস্থায় উদ্যানের মধ্যে পাওয়া গিয়াছে, এই সংবাদ প্রচারিত হইবামাত্র, গৃহস্বামী এবং তাঁহার পারিষদ্বর্গ, জমিদার মহাশয় এবং তাঁহার অনুচরবর্গ, সকলেই আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। দ্বারবাণ এবং পালোয়ানগণ প্রভৃতি অপরাপর ব্যক্তিগণ যাহারা সেই সময় সেই বাড়ীতে উপস্থিত ছিল, তাহারাও সেই স্থানে আসিয়া উপস্থিত হইল। 

বাড়ীর প্রাঙ্গণ-মধ্যস্থিত উদ্যানের ভিতর সেই বাক্স ভগ্নাবস্থায় পাওয়া গিয়াছে, এই কথা শ্রবণ করিয়া এবং ভগ্ন বাক্স দর্শন করিয়া সকলে আরও বিস্মিত হইয়া পড়িলেন। 

আমাদিগের মনে পূর্ব্বে যেরূপ সন্দেহের উদয় হইয়াছিল, এখন জমিদার মহাশয়ের এবং গৃহস্বামীর মনে পর্যন্তও সেই সন্দেহ উপস্থিত হইল। তখন তাঁহারা উভয়েই কহিলেন,—“ক্রমে যেরূপ অবস্থা দাঁড়াইতেছে, তাহাতে বাটীর অভ্যন্তরস্থ লোকের দ্বারা এই কার্য্য হইয়াছে বলিয়া অনুমান হইতেছে; কিন্তু পরিচারকদিগের মধ্যে এরূপ অবিশ্বাসী লোক আছে বলিয়া বোধ হয় না।’ 

গৃহস্বামী এবং জমিদার মহাশয় যাহাই বলুন না কেন, সেই ক্যাশ বাক্স প্রাপ্ত হইবার পর হইতেই, আমাদিগের মনে এরূপ ধারণা হইল যে, এই চুরি বাটীর মধ্যস্থিত কোন লোক ব্যতীত অপর কাহারও দ্বারা হয় নাই। কিন্তু গৃহস্বামী এবং জমিদার মহাশয় যখন তাঁহাদিগের পরিচারকবর্গের উপর কোনরূপ সন্দেহ করিতেছেন না, তখন আমরাই বা তাহাদিগকে লইয়া কি প্রকারে অনুসন্ধান করিতে প্রবৃত্ত হই? 

গৃহস্বামী এবং জমিদার মহাশয় কোনরূপ অসন্তুষ্ট হইতে না পারেন, অথচ বাড়ীর পরিচারকবর্গের মধ্যে কিরূপ অনুসন্ধান আরম্ভ করিলে অপহৃত দ্রব্যের সন্ধান হইবার সম্ভাবনা, কৰ্ম্মচারীবর্গ মিলিয়া তাহারই পরামর্শ করিতে নিযুক্ত হইলেন। কিন্তু কোনরূপ ভাবিয়া চিন্তিয়া তাহা কিছুমাত্র স্থির করিয়া উঠিতে পারিলেন না। তথাপি অনুসন্ধানের আশাও একবারে পরিত্যক্ত হইল না। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

গৃহস্বামী এবং জমিদার মহাশয়ের পরিচারকবর্গের সংখ্যা এত অধিক যে, তাহারা সকলে বাড়ীতে উপস্থিত আছে কি না, তাহা সহজে স্থির করা একবারে অসম্ভব হইয়া পড়িল। তখন অনন্যোপায় হইয়া, কাহার কতগুলি পরিচারক, তাহার একটি সম্পূর্ণ তালিকা প্রস্তুত করিলাম। 

তালিকা প্রস্তুত হইলে, উহার সহিত একে একে মিলাইয়া দেখিতে লাগিলাম যে, সকলেই সেই সময় জমিদার মহাশয়ের বাড়ীতে উপস্থিত আছে, কিনা। এই উপায়ে ক্রমে জানিতে পারিলাম যে, একজন মুসলমান পরিচারক সেই সময় সেই স্থানে উপস্থিত নাই। 

সেই পরিচারকের নাম হেয়াত-বক্স। গৃহস্বামীর যতগুলি খানসামা আছে, এই ব্যক্তি তাহাদিগের মধ্যে একজন। ইহার বাসস্থান গাজিপুর জেলার মধ্যস্থিত একখানি ক্ষুদ্র পল্লীগ্রামে। অনেক পূর্ব্বে কলিকাতায় মেদিবাগানে উহার বাসা ছিল, কিন্তু আজ কয়েক বৎসর পর্য্যন্ত সে আপন বাসা উঠাইয়া দিয়া, অপরাপর পরিচারকদিগের সহিত আপন মনিবের বাড়ীতেই অবস্থিতি করিতেছে। গত দুই দিবসের মধ্যে কোন পরিচারক তাহাকে কৰ্ম্ম করিতে দেখে নাই, বা দুই দিবস হইতে, সে যে কোথায় গমন করিয়াছে, তাহাও কেহ বলিতে পারে না। 

হেয়াত-বক্স গৃহস্বামীর খানসামা, সুতরাং বাড়ীর অবস্থা সে উত্তমরূপেই অবগত আছে; অধিকন্তু জমিদার মহাশয় যে সময় হইতে এই স্থানে আগমন করিয়াছেন, প্রয়োজন হইলেই, সে সময় হইতে সে জমিদার মহাশয়ের গৃহে গমন করিয়া থাকে। সুতরাং সেই গৃহের মধ্যে জমিদার মহাশয়ের কোথায় কি আছে, তাহাও সে উত্তমরূপে অবগত আছে। এরূপ অবস্থায় সে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়ায়, স্বভাবতঃ তাহারই উপর বিশেষরূপ সন্দেহ সকলেরই হইবার সম্ভাবনা। সম্ভাবনা কেন, ক্রমে সকল কৰ্ম্মচারীই তাহাকে সন্দেহ করিলেন। সকলেই কহিলেন, “এ চুরি হেয়াত-বক্স ব্যতীত অপর আর কোন ব্যক্তির দ্বারা হইবার সম্ভাবনা নাই, বা অপর কোন ব্যক্তি দ্বারা যদি এই কাৰ্য্য হইয়াই থাকে, তাহা হইলেও হেয়াত-বক্স যে, তাহার সহিত সম্মিলিত আছে, তাহার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই।” 

হেয়াত-বক্সের উপর সকলেরই সন্দেহ হইল সত্য; কিন্তু একজন কৰ্ম্মচারী কহিল, 

কিন্তু একজন কৰ্ম্মচারী কহিল, “এই চুরি যদি হেয়াত—বক্সের দ্বারাই হইয়া থাকে, তাহা হইলে চুরির একদিবস পূর্ব্ব হইতে সে নিরুদ্দেশ হইবে কেন? আর নিরুদ্দেশ হইলেও দ্বারবান্ রাত্রিকালে যদি সদর দ্বার বন্ধ করিয়া থাকে, তাহা হইলে চুরির রাত্রিতে সে কি প্রকারে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিতে সমর্থ হইল?” 

উত্তরে আর একজন কর্মচারী কহিলেন,—“রাত্রিকালে বাড়ীর সদর দ্বার বন্ধ ছিল, কি খোলা ছিল, তাহারও স্থিরতা নাই। কারণ, দ্বারবান্ এ সম্বন্ধে কোনরূপ নিশ্চিত কথা বলিতে পারে না। যদি দ্বার খোলা থাকে, তাহা হইলে রাত্রিকালে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করার পক্ষে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতাই নাই। আর যদি দ্বার বন্ধই থাকে, তাহা হইলে হেয়াত-বক্সের পক্ষে এই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করা একবারে অসম্ভব বলা যাইতে পারে না। কারণ, যে ব্যক্তি বহুদিবস হইতে এই বাড়ীর ভিতর বাস করিতেছে, সে এই বাড়ীর অবস্থা যেরূপ অবগত আছে, আমরা তাহা কোন প্রকারেই জানিতে পারি না। হয় ত সদর দ্বার বন্ধ থাকিলেও অপর কোন স্থান দিয়া সহজেই এই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিবার কোন উপায় আছে, যাহা এ পর্যন্ত আমাদিগের নয়নগোচর হয় নাই। আর যদি সেরূপ কোন উপায় নাও থাকে, তাহা হইলে দ্বার বন্ধ হইবার পূর্ব্বে রাত্রিকালে যদি সে এই বৃহৎ বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিয়াই থাকে, তাহাই বা কে দেখিয়াছে? এরূপ অবস্থায় হেয়াত-বক্সের দ্বারা যে, এই কার্য্য হইতে পারে না, তাহাই বা কি প্রকারে অনুমান করা যাইতে পারে?’ 

যে সময় আমরা বাড়ীর ভিতর পূর্ব্ব-কথিত অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলাম, সেই সময় বাড়ীর কয়েকজন কৰ্ম্মচারী বাড়ীর বাহিরে অর্থাৎ বাড়ীর চতুঃপার্শ্ববর্তী স্থানে যে সকল লোকজন বাস করে, তাহাদিগের মধ্যে অনুসন্ধানে নিযুক্ত ছিলেন। 

যে সময় হেয়াত-বক্স উপলক্ষে পুলিশ-কৰ্ম্মচারীদের মধ্যে নানা প্রকার তর্ক উপস্থিত হইল, সেই সময় বাড়ীর বাহিরে অনুসন্ধানে নিযুক্ত, পূর্ব্ব-কথিত কর্মচারীগণের মধ্য হইতে একজন কৰ্ম্মচারী আসিয়া কহিলেন, “এই বাড়ীর অতি সন্নিকটে জুম্মন নামক একজন প্রসিদ্ধ সিঁদেল চোর বাস করিত। অদ্য দুই দিবস হইতে কাহাকেও কিছু না বলিয়া সে কোথায় গমন করিয়াছে। যে বাড়ীতে সে বাস করিত, সেই বাড়ীর কোন লোক বা তাহার নিকটবর্ত্তী কোন ব্যক্তি বলিতে পারিল না যে, জুম্মন কোথায় গমন করিয়াছে।” 

কর্ম্মচারীর নিকট হইতে এই কথা জানিতে পারিয়া, আমাদিগের মনে আর এক বিষম ভাবনার উদয় হইল। মনে হইল, হেয়াত-বক্স দুই দিবস হইতে নিরুদ্দেশ, জুম্মনেরও দুই দিবস হইতে সন্ধান নাই; এরূপ অবস্থায় দুই জন একত্র হইয়া কি এই কার্য্যে প্রবৃত্ত হইল? আমাদিগের এই অনুমান যদি প্রকৃত হয়, তাহা হইলে ইহাদিগের অনুসন্ধানের নিমিত্ত কোথায় গমন করিব? হেয়াত-বক্সের বাসস্থান গাজিপুর জেলার অন্তর্গত কোন ক্ষুদ্র গ্রামে, তাহা পাঠকগণ পূৰ্ব্বেই অবগত হইয়াছেন। এদিকে জুম্মনের বাসস্থান নদীয়া জেলার অন্তর্গত একখানি গণ্ডগ্রামে। 

যখন দুই জনের বাসস্থান ভিন্ন ভিন্ন দুই দিকে, তখন তাহাদিগের অনুসন্ধানে, তাহাদিগের দেশে গমন করিতে হইলে, দুই জন কর্মচারীর প্রয়োজন। কারণ, একজন কর্মচারীকে দুই স্থানে গমন করিতে হইলে, সেই কার্য্য অল্প সময়ের মধ্যে কিছুতেই তিনি সম্পন্ন করিতে পারিবেন না; অধিকন্তু নিরর্থক অধিক সময় নষ্ট হইয়া গেলে, সেই কাৰ্য্য সহজে শেষ হইবে না। আর যদি কোন গতিতে পরিশেষে উহা নির্ব্বাহ হয়, তাহা হইলেও বিশেষরূপ কৰ্ম্মভোগ করিবার প্রয়োজন হইয়া পড়িবে। 

মনে মনে এইরূপ ভাবিলাম সত্য, কিন্তু উহাদিগের নিমিত্ত, উহাদিগের বাসস্থানে এই অবস্থায় লোক পাঠান কৰ্ত্তব্য কি না, তাহা সহজে স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। 

সেই দিবস সন্ধ্যার পর আমার ঊর্দ্ধ তর কর্ম্মচারীর সহিত সাক্ষাৎ করিয়া, অনুসন্ধানে এ পর্য্যন্ত যাহা কিছু অবগত হইতে পারিয়াছিলাম, তাহার আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত তাঁহার নিকট বর্ণন করিলাম। তিনি সমস্ত ব্যাপার উত্তমরূপে শ্রবণ করিয়া হেয়াত-বক্স এবং জুম্মন, উভয়ের অনুসন্ধান করা নিতান্ত আবশ্যক মনে করিলেন। এবং তাহাদিগের দেশে দুই জন কর্ম্মচারীকে পাঠাইয়া দেওয়াও তিনি একান্ত কর্তব্য বিবেচনা করিলেন। জুম্মনের দেশে গমন করিবার ভার আমার উপর অর্পিত হইল, হেয়াত-বক্সের দেশে গমন করিবার নিমিত্ত পশ্চিম দেশবাসী একজন মুসলমান কর্মচারীর উপর আদেশ প্রদত্ত হইল। 

ঊর্দ্ধতন কর্মচারীর নিকট হইতে আদেশ প্রাপ্ত হইয়া আমরা সহর পরিত্যাগ করিয়া মফস্বলে গমন করিবার উদ্যোগে প্রবৃত্ত হইলাম। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

জুম্মনের বাসস্থান নদীয়া জেলার অন্তর্গত পাইকপাড়া নামক স্থানে। সেই স্থানে গমন করিতে হইলে ইষ্টারণ বেঙ্গল রেলওয়ে লাইনের কৃষ্ণগঞ্জ নামক ষ্টেসনে গিয়া নামিতে হয়। আমি কলিকাতা হইতে বহির্গত হইয়া কৃষ্ণগঞ্জ ষ্টেসনে গিয়া উপনীত হইলাম, এবং পরিশেষে সেই স্থান হইতে পদব্ৰজে বহির্গত হইয়া তালদই নামক স্থানে উপস্থিত হইলাম। তালদই গ্রামের নিম্ন দিয়া ইছামতী নদী প্রবাহিত। 

যে সময় লৌহবর্ম্ম নিৰ্ম্মিত না হইয়াছিল, সেই সময় নদীয়া জেলার উত্তরাংশের লোকদিগকে এই ইছামতী নদী বাহিয়া কলিকাতায় আসিতে হইত। সেই সময় তালদই একটি ক্ষুদ্র বন্দর ছিল, সুতরাং সেই স্থানের নাম সকলেই অবগত ছিলেন। বর্তমান সময়ে লৌহবর্গ প্রস্তুতের সঙ্গে সঙ্গে নদী বাহিয়া লোকজনের যাতায়াত কমিয়াছে, সুতরাং তালদইয়ের নামও ক্রমে লোপ পাইতে বসিয়াছে। 

আমি সেই তালদইয়ের নিম্নে ইছামতী নদী পার হইয়া অপর পার্শ্বে নাথপুর নামক একখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র গণ্ডগ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। আমি যে সময় সেই গ্রামে গিয়া উপনীত হইয়াছিলাম, সেই সময় সেই গ্রামের নাম প্রায় কেহই জানিত না; কিন্তু শিক্ষিত ব্যক্তিমাত্রই আজ কাল সেই ক্ষুদ্র গ্রামের নাম বিশেষরূপে অবগত আছেন। 

যে বাঙ্গালী জাতি আজ কাল নিতান্ত ভীরু বলিয়া পাশ্চাত্য জাতিগণের নিকট বিশেষরূপে ঘৃণিত, যে জাতীয় লোকদিগকে ইংরাজগণ কেবলমাত্র বচন-বাগীশ বলিয়া উপহাস করিয়া থাকেন, সেই ভীরু বাঙ্গালিকুলে জন্ম গ্রহণ করিয়া, যে ব্যক্তি আজ আমাদিগের মুখোজ্জ্বল করিয়াছেন, যাঁহার নাম সমস্ত ইউরোপ খণ্ডের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রাপ্ত পর্যন্ত প্রতিধ্বনিত হইতেছে, ইউরোপীয় প্রধান প্রধান অধিকাংশ বীরগণ আজ কাল যে বাঙ্গালীর নিকট মস্তক অবনত করিতেছে, সেই প্রসিদ্ধ বাঙ্গালী বীর পুরুষের জন্মস্থান এই গ্রামে। পাঠকগণ বোধ হয়, বুঝিতে পারিয়াছেন, আমি কোন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করিতেছি। ব্রেজিল দেশীয় সৈন্যগণের বর্তমান সর্ব্বপধান নেতা বাবু সুরেশচন্দ্র বিশ্বাসেরই জন্মস্থান এই ক্ষুদ্র নাথপুর গ্রামে। 

এই নাথপুর গ্রামের অতি সন্নিকটেই পূৰ্ব্বকথিত পাইকপাড়া গ্রাম। পাইকপাড়া গ্রামে উপনীত হইয়া জুম্মন সেখের অনুসন্ধান করিলাম, কিন্তু তাহাকে সেই স্থানে প্রাপ্ত হইলাম না। গ্রামের লোকদিগের নিকট হইতে অবগত হইলাম যে, প্রায় দশ বৎসর অতীত হইল, জুম্মন গ্রাম পরিত্যাগ করিয়া, কলিকাতায় আগমন করিয়াছে। তাহার পর গ্রামস্থ কোন ব্যক্তি তাহাকে আর কখনও গ্রামে দেখেন নাই। গ্রামের ভিতর তাহার পুত্র প্রভৃতি আপনার লোকও কেহই নাই। কিন্তু লোক-পরম্পরায় তাঁহারা শুনিয়াছেন যে, জুম্মন মধ্যে মধ্যে চাকদহের নিকটবর্তী একখানি ক্ষুদ্র গ্রামে আসিয়া থাকে। 

যাহা অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমি পাইকপাড়া গ্রামে গমন করিয়াছিলাম, নিতান্ত অল্প সময়ের মধ্যে আমার সে কাৰ্য্য শেষ হইয়া গেল সত্য; কিন্তু সেই গ্রামের পূর্ব্ব বৃত্তান্ত সকল শ্রবণ করিয়া সেই গ্রামের পূৰ্ব্বাবস্থা অবগত হইবার নিমিত্ত আমার মনে নিতান্ত কৌতূহল আসিয়া উপস্থিত হইল। যতদূর সম্ভব, আমার সে কৌতূহল কিয়ৎ পরিমাণে পরিতৃপ্ত করিলাম। পাঠকদিগকে এই স্থানে তাহার একটু আভাষ দেওয়া, বোধ হয়, আমার কর্তব্য কর্ম্ম। 

দারোগার দপ্তরের পাঠকবর্গের মধ্যে অনেকেই, বোধ হয়, নদীয়া জেলার প্রসিদ্ধ ডাকাইত বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথের কথা অবগত আছেন। সেই বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথের প্রধান আড্ডা ছিল—– এই পাইকপাড়া গ্রামে। এই স্থানেই প্রায় সর্ব্বদা তাহারা অবস্থিতি করিত; এবং সেই স্থানেই তাহারা কাছারী-গৃহ নিৰ্ম্মাণ করিয়া জমিদারের কাছারীর মত কাছারী করিত। তাহাদের অধীনস্থ ডাকাইতগণ যে কোন স্থানে ডাকাইতি করিয়া যাহা কিছু আনয়ন করিত, ডাকাইতিদলের পদমর্যাদা অনুসারে সেই কাছারী-গৃহে বসিয়া তাহা বণ্টন করিয়া লওয়া হইত। যে দিবস যে স্থানে ডাকাইতি করিতে হইবে, তাহার পরামর্শ-স্থল এই কাছারী বাড়ী। টাকা পাঠাইয়া দিবার নিমিত্ত কাহাকে পত্র লিখিতে হইবে, এবং প্রার্থিত টাকা পাঠাইয়া না দিলে তাহার বাড়ীতে যে সময়ে ডাকাইতি করিতে হইবে, তাহার পরামর্শ প্রভৃতির স্থান—উক্ত কাছারী-গৃহ। জমিদারী কাছারীর ন্যায় রীতিমত খাতাপত্র, যথারীতি আমলাবর্গ প্রভৃতি লইয়া, এই ইংরাজ রাজত্বের সময়, এইরূপ প্রকাশ্যভাবে বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ ডাকাইতি করিত; কিন্তু কোন পুলিশ—কৰ্ম্মচারী তাহাদিগকে সাহস করিয়া ধরিতে পারিত না, বা এ প্রদেশীয় কোন লোক এ বিষয়ের কোনরূপ সন্ধান কাহাকেও প্রদান করিতে সাহসী হইতেন না। সুতরাং নির্বিবাদে বসিয়া বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ এই স্থানে বসিয়া রাজত্ব করিত। আমি যে সময় সেই স্থানে গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় গ্রামস্থ কয়েকজন বৃদ্ধ লোক একটি উচ্চ স্থান আমাকে দেখাইয়া দিয়া বলিয়াছিল,—“এই স্থানে বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথের কাছারী-গৃহ স্থাপিত ছিল।” 

শুনিতে পাওয়া যায় যে, বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ ধনশালী ব্যক্তিগণের ধন লুণ্ঠন করিয়া তাহার কিয়দংশ নির্ধনকে প্রদান করিত, কিয়দংশ বা কন্যাদায়গ্রস্ত ব্রাহ্মণকে কন্যাবিবাহের নিমিত্ত প্রদান করিত, কিয়দংশ বা মাতৃ-পিতৃ-হীন দরিদ্রদিগের মাতৃ-পিতৃ-শ্রাদ্ধ উপলক্ষে ব্যয়িত হইত। এই প্রকার নানারূপ সৎকার্য্য করিলেও তাহাদিগের নিষ্ঠুর কার্যের অনেক কথা শুনিতে পাওয়া যায়। দৃষ্টান্তস্থলে এক দিবসের একটি ঘটনা এই স্থানে উল্লিখিত হইল মাত্র। 

কোন স্থানে ডাকাইতি করিতে যাইবার সময় এক দিবস রাত্রিকালে দলবল সহিত তাহারা ইছামতী নদী-তীরে উপস্থিত হয়। সেই গভীর রাত্রিতে কাবাসডাঙ্গা সাকিনের সিদ্ধেশ্বর সাঁৎলা নামীয় এক ব্যক্তি তাহার নৌকা লইয়া মৎস্য ধরিতে ছিল। এদেশীয় ধীবরগণের নিয়ম আছে যে, গভীর রাত্রিতে মৎস্য ধরিবার সময় যদি কোন ব্যক্তি তাহাকে দূর হইতে ডাকিতে থাকে, তাহা হইলে কিছুতেই সে উত্তর প্রদান করিবে না, বা কোনরূপে কথা কহিবে না। এমন কি, তাহার গুরুদেবও যদি তাহাকে দূর হইতে আহ্বান করে, তাহা হইলেও সে নিরুত্তর থাকিবে। 

সিদ্ধেশ্বর গভীর রজনীতে ইছামতী নদীতে মৎস্য ধরিবার সময় বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ স্বদলবলে সেই স্থানে উপনীত হইয়া তাহাদিগকে পার করিয়া দিবার নিমিত্ত বার বার ডাকিতে লাগিল। সিদ্ধেশ্বর উহাদিগের ডাক শুনিতে পাইয়াও কোনরূপ উত্তর প্রদান করিল না। সিদ্ধেশ্বরের এই অপরাধের নিমিত্ত ডাকাত দলপতিদ্বয়—বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া, উচ্চৈঃস্বরে সেই মৎস্য-ধৃতকারীকে কহিল,—“তুই এখনও আমাদিগের কথার কোনরূপ উত্তর প্রদান করিলি নে? তুই কি আমাদিগকে জানিস না, বা বৈদ্যনাথ বিশ্বনাথের নাম কখন শ্রবণ করিনি? তোকে কিরূপ দণ্ড প্রদান করি, তাহা তুই এখনই দেখিতে পাইবি।” 

বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথের নাম শুনিয়া সিদ্ধেশ্বরের মস্তক ঘুরিয়া গেল, তাহার মৎস্য ধরাও ঘুরিয়া গেল, সে নিতান্ত ভীত অন্তঃকরণে আপনার নৌকা বাহিয়া যে স্থানে দলবল লইয়া বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ দণ্ডায়মান ছিল, ধীরে ধীরে সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল। 

সিদ্ধেশ্বরকে দেখিবামাত্রই বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ চিনিতে পারিল, এবং নিতান্ত কর্কশ স্বরে তাহাকে কহিল,—“কি রে সিধে! তুই কি কালা হইয়াছিস যে, আমাদিগের ডাক এতক্ষণ শুনিতে পা’স্ নাই, বা আমাদিগকে পার করিতে হইবে বলিয়া তুই আমাদিগের নিকট আসিতে অসম্মত?’ 

উত্তরে সিদ্ধেশ্বর মিথ্যা কথা কহিল, যে কারণে সে উত্তর প্রদান করিতেছিল না, তাহা গোপন করিয়া কহিল, “না মহাশয়! আপনাদিগকে পার করিতে আমি অসম্মত নহি! আজ কাল আমি কাণে একটু কম শুনিয়া থাকি, তাই প্রথম প্রথম আপনাদিগের ডাক আমার কর্ণগোচর হয় নাই। পরিশেষে আপনাদিগের ডাক যেমন আমি শুনিতে পাইলাম, অমনি আমি আপনাদিগের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। এখন আমাকে কি করিতে হইবে, কোন্ কোন্ ব্যক্তিকে পার করিতে হইবে? আসুন, এখনই আমি তাহাদিগকে পার করিয়া দিতেছি।” 

সিদ্ধেশ্বরের কথা শুনিয়া, বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ উভয়েই কহিল, “তুমি আজ কাল কম শুনিতেছ, আচ্ছা, যাহাতে এখন হইতে তুমি কম না শুনিয়া রীতিমত শুনিতে পাও, আমরা তাহার উপায় করিয়া দিতেছি।” এই বলিয়া ডাকাইত সদ্দারদ্বয় একজন অনুচরকে কহিল, “সিদ্ধেশ্বরের-কর্ণদ্বয় অত্যন্ত বড় হইয়া পড়িয়াছে। এই নিমিত্ত কোন কথা সহজে কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। তুমি উহার কর্ণদ্বয় উত্তমরূপে কাটিয়া দেও, তাহা হইলে কোন কথা কৰ্ণ—কুহরে প্রবেশ করিতে আর কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা প্রাপ্ত হইবে না, তাহা হইলে সিদ্ধেশ্বর অনায়াসেই সকল কথা শুনিতে পাইবে।” 

দলপতিদ্বয়ের আদেশ পাইবামাত্র অনুচর সেই আদেশ প্রতিপালিত করিল, একখানি তীক্ষ্ণ ছুরিকাদ্বারা উভয় কর্ণ আমূল কাটিয়া ইছামতীর পরিষ্কার জলে নিক্ষেপ করিল। সিদ্ধেশ্বর রক্তাক্ত কলেবরে কর্ণদ্বয় হস্তদ্বয় দ্বারা আবৃত করিয়া সেই ইছামতী তীরে বসিয়া রোদন করিতে লাগিল। ডাকাইতগণ তাহার নৌকা লইয়া অনায়াসেই ইছামতী পার হইয়া গেল। 

এই অনুসন্ধান উপলক্ষে যে সময় আমি সেই প্রদেশে গমন করিয়াছিলাম, সেই সময় পর্য্যন্ত সিদ্ধেশ্বর জীবিত ছিল। দেশের সমস্ত লোকই তাহাকে কাণকাটা সিদ্ধেশ্বর বলিয়া ডাকিত। কিন্তু আর সে জীবিত নাই, প্রায় পাঁচ বৎসর অতীত হইল, সে ইহজীবন পরিত্যাগ করিয়া বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথের অত্যাচারের একটি প্রধান চিহ্ন বিনষ্ট করিয়া ফেলিয়াছে। 

ডাকাইত-দলপতিদ্বয় পরিশেষে ধৃত হয়। বিচারে তাহাদিগের প্রাণদণ্ডের আদেশ হওয়ায় তাহাদিগকে ফাঁসি দেওয়া হয়। যে স্থানে আপামর সাধারণকে ফাঁসি দেওয়া হইয়া থাকে, ইহাদিগের ফাঁসি সেই স্থানে হয় নাই। যে যে স্থানে ইহাদিগের কার্যক্ষেত্র ছিল, সেই সেই স্থানেই একটি একটি বৃক্ষে উহাদিগের ফাঁসি দেওয়া হয়। বৈদ্যনাথ এবং বিশ্বনাথ উভয়কে এক বৃক্ষে ফাঁসি দেওয়া হয় নাই, স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র বৃক্ষে উহাদিগের ফাঁসি দেওয়া হয়। যে দুই বৃক্ষে ডাকাইতদলপতিদ্বয় লম্বিত হইয়াছিল, সেই বৃক্ষদ্বয় এখন পর্য্যন্ত বর্তমান আছে। সেই বৃক্ষদ্বয় ফাঁসিগাছ বলিয়া এখন পৰ্যন্ত প্রসিদ্ধ। 

কাবাসডাঙ্গা গ্রামে আমার অনুসন্ধানের কাৰ্য্য শেষ হইয়া গেলে, আমি সেই স্থান হইতে বহির্গত হইয়া, পুনরায় কৃষ্ণগঞ্জ স্টেসনে আসিয়া উপনীত হইলাম এবং রেলের গাড়িতে আরোহণ করিয়া চাকদহ ষ্টেসনে গিয়া উপনীত হইলাম। চাকদহের নিকটবর্তী যে ক্ষুদ্র গ্রামে জুম্মন মধ্যে মধ্যে গমন করিত, পরিশেষে সেই ক্ষুদ্র গ্রামে গিয়া উপনীত হইলাম। ইহা প্রায় বার তের বৎসরের ঘটনা, সুতরাং সেই ক্ষুদ্র গ্রামখানির নাম আমার মনে নাই, এবং যে পুস্তকে এই মোকদ্দমার ব্যাপার লিখিয়া রাখিয়াছিলাম, সেই পুস্তক খানিও অনুসন্ধান করিয়া প্রাপ্ত হইলাম না। কিন্তু সেই গ্রামের একটু পরিচর প্রদান করিলে, সেই প্রদেশীয় পাঠকগণ উক্ত গ্রামের নাম অবগত হইতে পারিবেন। 

যে ঘটনার নিমিত্ত এই ক্ষুদ্র গ্রামখানি প্রসিদ্ধ, সেরূপ ঘটনার বিষয় পাঠকগণের মধ্যে অনেকেই ইতিপূর্বে কখনও শ্রবণ করিয়াছেন বলিয়া আমার বোধ হয় না। অথবা এখন শ্রবণ করিলেও, যাঁহারা ইহার অবস্থা বিশেষরূপে অবগত আছেন, তাঁহারা ব্যতীত অন্যান্য সকলে যে সহজে বিশ্বাস করিবেন, তাহাও আমার মনে হয় না। 

পাঠকগণ! আপনারা কখনও শ্রবণ করিয়াছেন কি, যে, বাঙ্গালী স্ত্রীলোক কখনও ডাকাইত-দলের নেতৃত্ব করিতে পারে? অথচ ইহা অধিক পুরাতন ঘটনা নহে; ত্রিশ চল্লিশ বৎসরের ঘটনামাত্র। সেই ক্ষুদ্র গ্রামে বামা ধোবানী নামে একটি বিধবা স্ত্রীলোক বাস করিত। সে একটি ডাকাইত দলের সর্ব্বপ্রধান নেত্রী ছিল। যে গৃহে সে বাস করিত, সেই গৃহ নানাবিধ অস্ত্রশস্ত্রে বিশেষরূপে সজ্জিত থাকিত। সেই সকল অস্ত্রাদি লইয়া সে রাত্রিকালে ডাকাইতদিগের সহিত নিজেই ডাকাইতি করিতে গমন করিত। এরূপ প্রবাদ যে, যখন সে আলুলায়িত-কেশে অস্ত্রহস্তে দণ্ডায়মান হইত, তখন কোন ব্যক্তি সাহস করিয়া তাহার সম্মুখীন হইতে পারিত না। অনেক সময় অনেক লোক একত্র হইয়া বামাকে ধরিবার চেষ্টাও করিয়াছেন, কিন্তু অবলীলাক্রমে সে সকলকে পরাস্ত করিয়া নির্ব্বিবাদে চলিয়া আসিয়াছে। 

এক সময়ে চাকদহ প্রদেশে উপর্যুপরি অনেকগুলি ডাকাইতি হয়। সেই সময় বামাকে ধরিবার নিমিত্ত পুলিশ বিধিমত চেষ্টা করেন, কিন্তু প্রথমতঃ তাহাকে কোনরূপেই ধরিতে সমর্থ হন না। ডাকাইতি করিয়া সমস্ত রাত্রি জাগরণের পর সে এক দিবস দিবাভাগে নিজ গৃহে অঘোরনিদ্রায় অভিভূতা ছিল, সেই সময় সুযোগ পাইয়া, পুলিশকর্ম্মচারীগণ তদবস্থায় তাহাকে ধৃত করেন। তাহার গৃহ হইতে বিস্তর অস্ত্র এবং লুণ্ঠিত দ্রব্য বাহির হয়। এই বার বামা কোনরূপে পরিত্রাণ পাইল না, তৎকৃত দুষ্কৃতি-সমূহের উপযুক্ত দণ্ড এই বারেই তাহাকে পাইতে হইল। 

এই বামা ধোবানীর বাসস্থান যে গ্রামে, পুরাতন চোর জুম্মনের অনুসন্ধান করিতে আমাকে সেই গ্রামেই গমন করিতে হয়। কিন্তু সেই স্থানে তাহার কিছুমাত্র সন্ধান না পাইয়া পরিশেষে আমি কলিকাতায় প্রত্যাগমন করি। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

যে দিবস আমি কলিকাতায় আসিয়া উপনীত হইলাম, তাহার দুই দিবস পরে পশ্চিমদেশবাসী মুসলমান কর্মচারীও গাজিপুর হইতে প্রত্যাগমন করিলেন। তাঁহাকেও আমার মত বিফল মনোরথ হইয়া প্রত্যাগমন করিতে হয়। 

আমরা উভয়েই কলিকাতায় প্রত্যাগমন করিয়া দেখি, যাহাদিগের অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত আমরা কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া অপর স্থানে গমন করিয়াছিলাম, তাহাদিগের উভয়কেই অপরাপর কর্মচারীগণ কলিকাতাতেই প্রাপ্ত হইয়াছেন। এবং তাহাদিগের সম্বন্ধে বিশেষরূপ অনুসন্ধান করিয়া সকলেই স্থির করিয়াছেন যে, তাহাদিগের মধ্যে কাহারও কর্তৃক এই চুরিকার্য সম্পন্ন হয় নাই। 

হেয়াত-বক্স সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিয়া অপরাপর কর্মচারীগণ জানিতে পারিয়াছিলেন যে, যদিও সেই বাটার সকলেই ইহা জানিত যে, হেয়াত-বক্স গৃহস্বামীর বাড়ীতেই রাত্রিযাপন করিয়া থাকে, কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে হেয়াত-বক্স মনিবের বাড়ীতে রাত্রি কাটাইত না। তাহার একটি গুপ্ত-প্রণয়িনী ছিল, তাহারই বাড়ীতে সে রাত্রি অতিবাহিত করিত। চুরি হইবার এক দিবস পূর্ব্বে সে তাহার প্রণয়িনীর বাড়ীতে নিয়মিতরূপে গমন করিয়া দেখে যে, সে বিসূচিকা রোগে আক্রান্ত হইয়া ভয়ানক যন্ত্রণা অনুভব করিতেছে। এই অবস্থা দেখিয়া হেয়াত-বক্স আর স্থির থাকিতে না পারিয়া তাহার চিকিৎসার বন্দোবস্ত করে এবং শুশ্রূষাকারী অপর ব্যক্তি না থাকায়, নিজেই তাহার শুশ্রূযায় নিযুক্ত হয়। এই কারণ বশতঃ সে তিন চারি দিবস তাহার মনিবের বাড়ীতে কর্ম্ম করিতে আসিতে অসমৰ্থ হয়। 

জুম্মন যে বাড়ীতে বাস করিত, তিন দিবস পরে আপনিই আসিয়া সেই বাড়ীতে উপস্থিত হয়। বাড়ীতে আসিবামাত্র, সেই সংবাদ অনুসন্ধানকারী পুলিশ-কৰ্ম্মচারীগণের নিকট আসিয়া উপস্থিত হয়। এই সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র তাঁহারা জুম্মনের বাড়ীতে গিয়া উপনীত হন, এবং দেখিতে পান যে, জুম্মন আপনার গৃহেই বসিয়া আছে। 

গত তিন দিন পৰ্য্যন্ত সে কোথায় ছিল, এই কথা তাহাকে জিজ্ঞাসা করায়, সে অম্লান বদনে স্বীকার করিল যে, সহর ছাড়িয়া মফস্বলের একটি স্থানে সে সিঁদ দিয়া চুরি করিতে গিয়াছিল। এই নিমিত্ত তিন দিবস কাল সে সহরে উপস্থিত ছিল না। 

জুম্মনের এই কথা শুনিয়া কৰ্ম্মচারীগণ তাহার গৃহের ভিতর উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখেন, কিন্তু কোনরূপ অপহৃত দ্রব্য প্রাপ্ত হন না। 

সে কোথায় চুরি করিতে গিয়াছিল, এ কথা স্পষ্ট করিয়া কর্মচারীগণের নিকট প্রকাশ করে না। সুতরাং তাহার কথা কতদূর সত্য, বা মিথ্যা, তাহা পরিষ্কাররূপে জানিতে পারা যায় না। কিন্তু কৰ্ম্মচারীগণের মনে বিশ্বাস হয় যে, যে চুরির অনুসন্ধানে তাঁহারা নিযুক্ত, সেই চুরিতে জুম্মন কোনরূপে সংসৃষ্ট নহে। 

যে সামান্য সূত্র অবলম্বনে আমরা এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত হইয়াছিলাম, সহজেই সে সূত্র ছিন্ন হইয়া গেল। আমরাও অন্য কোন পন্থা অবলম্বনের অপর কোন উপায় দেখিতে না পাইয়া, যে বাড়ী হইতে এই চুরি হইয়াছিল, সেই বাড়ীতে বসিয়া বসিয়া গৃহস্বামী এবং জমিদার মহাশয়ের পরিচারকদিগের মধ্যেই অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম এবং তাহাদিগকে নানা প্রকার জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলাম। 

এইরূপে ঘটনাস্থলে বসিয়া বসিয়াই কয়েকদিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। কিন্তু আমাদের কর্তব্য কিছুই স্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না। তথাপি আশাও একবারে পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হইলাম না। কোন্ পন্থা অবলম্বন করিলে সফল হইব, কেহই তাহা ঠিক করিতে পারিলেন না। 

এইরূপে কয়েকদিবস অতিবাহিত হইয়া যাইবার পর, একটি সামান্য বিষয়ে আমার নয়ন আকৃষ্ট হইল। এ বিষয়টি এত সামান্য যে, উহার দ্বারা যে কোনরূপ ফল প্রাপ্ত হইব, তাহা মনে হইল না। তথাপি যে বিষয়ে মনে সন্দেহ হয়, সেই সম্বন্ধে একটু অনুসন্ধান করা আমাদিগের কর্তব্য-কৰ্ম্ম বলিয়াই সেই সূত্র ধরিয়া পুনরায় অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলাম। 

সেই সামান্য সূত্রটি এই :—

ঘটনাস্থলে বসিয়া অনুসন্ধান করিবার সময় বাড়ীর পরিচারকদিগের মধ্যে যখন যাহাকে ডাকিতেছিলাম, তৎক্ষণাৎ সে আসিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইতেছিল, এবং তাহাকে আমাদিগের জিজ্ঞাস্য বিষয় সকল জিজ্ঞাসা করিলে, সে তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিয়া, পরিশেষে, আমাদিগের অনুমতি লইয়া আপন কার্যে গমন করিতেছিল। কিন্তু আমাদিগের বিনা আহ্বানে কোন পরিচারকই আমাদিগের নিকট উপস্থিত থাকিয়া, আমাদিগের অনুসন্ধান-প্রণালী অবলোকন বা আমাদিগের কথাবার্তা সকল শ্রবণ করিতে সাহসী হইতেছিল না। 

পালোয়ানগণের নিয়ম কিন্তু সেরূপ দেখিলাম না। যে সময় হইতে আমরা সর্ব্বপ্রথমে অনুসন্ধান আরম্ভ করি, সেই সময় হইতেই তাহাদিগের মধ্যে কেহ না কেহ সৰ্ব্বদাই আমাদিগের নিকট উপস্থিত থাকিত, এবং আমাদিগের কথাবার্তা সবিশেষ মনোযোগের সহিত শ্রবণ করিত। তদ্ব্যতীত আমাদিগের যখন যে দ্রব্যের প্রয়োজন হইত, নিতান্ত আজ্ঞাবহ ভৃত্যের ন্যায় তাহারা সেই কার্য্য সম্পন্ন করিত। অধিকন্তু কর্মচারীগণের মধ্যে যিনি ধূম পান করিতেন, মুহূর্তে মুহূর্তে তাঁহার নিমিত্ত তামাকু প্রস্তুত করিয়া আনিত। যিনি তাম্বুল ভক্ষণ করিতেন, তাঁহার নিমিত্ত সর্ব্বদাই তাম্বুল প্রস্তত করিয়া দিতে লাগিল। 

এই সামান্য ঘটনা লক্ষ্য করিয়া আমার মনে কেমন এক সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল। ভাবিলাম,—বিনা—যাচ্ঞায় নিজের পয়সা খরচ করিয়া আমাদিগের মন যোগাইতে উহারা এরূপ ব্যগ্র কেন? 

যে কারণে পালোয়ানদিগের উপর আমার মনে সন্দেহ আসিয়া উপস্থিত হইল, সেই সামান্য কারণের বিষয় আমি অপর আর একজন কৰ্ম্মচারীকে কহিলাম। আমার কথা শুনিয়া তিনিও আমার মতের পোষকতা করিলেন। তখন আমরা উভয়ে পরামর্শ করিয়া এই স্থির করিলাম যে, আমরা এ বিষয়ে ভালরূপ বুঝিতে পারি বা না পারি, বা আমাদিগের অনুমান যুক্তি-সঙ্গত হউক বা না হউক, এবং জমিদার মহাশয় এ বিষয়ে আমাদিগের সাহায্য করুন বা না করুন, আমরা কিন্তু পালোয়ানদিগকে লইয়া একবার উত্তমরূপে অনুসন্ধান করিয়া দেখিব। দেখিব যে, আমাদিগের যুক্তির উপর কোনরূপে ভিত্তি স্থাপন করিতে পারি, কি না। 

মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া, পালোয়ানদিগের মধ্যে যাহাতে একটু অল্পবুদ্ধি বলিয়া বোধ হইল, কোন কার্য্যের ভান করিয়া তাহাকে সঙ্গে লইয়া সেই স্থান হইতে বহির্গত হইলাম। কিয়দ্দূর গমন করিয়া একটি নির্জ্জন স্থানে তাহাকে লইয়া উপবেশন করিলাম। বলা বাহুল্য যে, যে কর্ম্মচারী আমার সহিত একমত হইয়া এই কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, তিনিও আমার সহিত সেই নিৰ্জ্জন স্থানে গিয়া উপবেশন করিলেন। যে সময় আমরা এই পালোয়ানকে সঙ্গে করিয়া লইয়া গেলাম, সেই সময় লায়না সিং উপস্থিত ছিল না। মনিবের কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে সে পূর্ব্বেই কোথায় গমন করিয়াছিল। 

যাহা হউক, সেই স্থানে উপবেশন করিতে দেখিয়া সেই পালোয়ান আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিল,—“মহাশয়! আপনারা আমাকে এখানে আনিলেন কেন?” 

আমি। তোমাকে এখানে কেন আনিলাম, তাহা তুমি এখনও বুঝিতে পার নাই কি? 

পালোয়ান। না মহাশয়! আমি তাহার কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। 

আমি। আজ কয়েক দিবস হইল, তোমাদিগের বাড়ীতে চুরি হইয়া গিয়াছে, আমরা তাহার অনুসন্ধান করিতেছি। কিন্তু তোমাদিগকে এ পর্যন্ত কোন কথা জিজ্ঞাসা করি নাই। কেন জিজ্ঞাসা করি নাই, তাহার কারণ, তুমি এখনি বুঝিতে পারিবে। 

পালোয়ান। এমন কি কারণ আছে, যাহা আমি এখনি বুঝিতে পারিব। 

আমি। যে পর্য্যন্ত আমরা এই চুরির প্রকৃত অবস্থা বুঝিতে পারি নাই, সেই পর্য্যন্ত আমরা তোমাদিগকে কোন কথা বলি নাই। এখন সকল অবস্থা জানিতে পারিয়াছি বলিয়াই, তোমাকে এখানে আনয়ন করিয়াছি। দেখি, তুমি প্রকৃত কথা বলিয়া নিজের প্রাণ বাঁচাইতে ইচ্ছা কর, কি মিথ্যা কথা বলিয়া তোমার সঙ্গীগণের সহিত কারাগারে গমন করিতে বাসনা কর। 

পালোয়ান। আপনি কি বলিতেছেন, তাহার কিছুই আমি বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না। আপনার বিশ্বাস কি, এই চুরি আমাদিগের দ্বারা হইয়াছে? 

আমি। বিশ্বাস কেন, এই চুরি যে তোমাদিগের দ্বারা হইয়াছে, তাহার বিশেষরূপ প্রমাণ আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি। তদ্ব্যতীত তোমাদিগের মধ্যে একজন সকল কথা আমাদিগকে স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিয়াছে। 

পালোয়ান। আমাদিগের মধ্যে একজন সকল কথা আপনাদিগের নিকট প্রকাশ করিয়াছে, কহিতেছেন। কিন্তু কে আপনাদিগের নিকট সকল কথা স্বীকার করিল? 

আমি। তোমরা যে চারিজন পালোয়ান এই বাড়ীতে বাস করিয়া থাক, তাহাদিগের মধ্যে একজনের নাম লায়না সিং, তাহা তুমি নিশ্চয় জান। 

পালোয়ান। লায়না সিংকে আর আমি চিনি না? 

আমি। তাহাকে আজ দেখিয়াছ কি? 

পালোয়ান। না মহাশয়! তাহাকে আজ দেখি নাই। 

আমি। সে কোথায় গিয়াছে, তাহা তুমি জান কি?

পালোয়ান। না মহাশয়! তা আমি জানি না। 

আমি। তুমি যদি না জান, তাহা হইলে আমি তোমাকে সমস্ত ব্যাপার বলিয়া দিতেছি, তাহা হইলেই তুমি সকল কথা জানিতে পারিরে। লায়না সিং এখন থানায় আছে। কিরূপে তোমরা এই চুরি করিয়াছ, তাহার সমস্ত কথা সে আমাদিগকে বলিয়া দিয়াছে। 

পালোয়ান। লায়না সিং সকল কথা বলিয়াছে? কি বলিয়াছে মহাশয়? সে কাহার কাহার নাম করিয়াছে?

আমি। যে যে ব্যক্তির নাম করিয়াছে, তাহার সকল কথা আমরা তোমার নিকট বলিব কেন? সে যে তোমার নাম বাদ দেয় নাই, তাহাই তোমাকে বলিতে পারি। এখন দেখি, তুমি প্রকৃত কথা বল, কি না। 

পালোয়ান। লায়না সিং যখন আমার নাম করিয়াছে, তখন আমার উপায় কি হইবে মহাশয়? আমি কিরূপে বাঁচিতে পারিব? 

আমি। যদি এখনও তুমি প্রকৃত কথা বল, তাহা হইলে যাহাতে তুমি বাঁচিতে পার, তাহার চেষ্টা করিব। নতুবা জানিও, কোনরূপেই তোমার নিস্তার নাই। 

পালোয়ান। আমি যাহা বলিব, তাহা আপনারা বিশ্বাস করিবেন কিরূপে? আমি প্রকৃত কথা বলিতেছি, কি মিথ্যা কথা বলিতেছি, তাহা আপনারা বুঝিতে পারিবেন কি প্রকারে? 

আমি। সে ক্ষমতা আমাদিগের আছে; তোমার কথা শুনিলেই আমরা বুঝিতে পারিব যে, তুমি সত্য কথা বলিতেছ, কি মিথ্যা কথা কহিতেছ। তদ্ব্যতীত লায়না সিংহের নিকট সকল কথা শুনিয়া প্রকৃত ব্যাপার যে কি, তাহা আমরা অবগত আছি। এখন তুমি সত্য কথা বলিবে, কি মিথ্যা কথা বলিবে, তাহা শ্রবণমাত্রই আমরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিব। 

পালোয়ান। লায়না সিং কি প্রকৃত আমার নাম করিয়াছে? 

আমি। আমি কি তোমার নিকট মিথ্যা কথা বলিতেছি? তুমি যাহা যাহা করিয়াছ, তাহার সমস্ত কথা সে বলিয়া দিয়াছে বলিয়াই, আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি। যদি বাঁচিতে চাও, তাহা হইলে প্রকৃত কথা বল। নতুবা তোমার যাহা অভিরুচি হয়, তাহাই তুমি করিতে পার; কিন্তু পরিশেষে তুমি আমাদিগকে বলিতে পারিবে না,—“মহাশয় আমাকে রক্ষা করুন।” 

পালোয়ান। যখন আপনারা সমস্ত কথা অবগত হইতে পারিয়াছেন, তখন আর আমি মিথ্যা কথা কহিব না। তাহাতে আমার অদৃষ্টে যাহাই হয়, হউক। কি কি কথা জানিতে চাহেন, তাহা আমাকে জিজ্ঞাসা করুন। আমি যত দূর অবগত আছি, তাহার প্রকৃত উত্তর আপনাকে প্রদান করিতেছি। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

পালোয়ানের কথা শুনিয়া আমি এক এক করিয়া তাহাকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম। পালোয়ানও তাহার যথাযথ উত্তর প্রদান করিল। আমাদিগের উভয়ের মধ্যে যে প্রকার কথাবার্তা হইয়াছিল, তাহার কথঞ্চিৎ আভাষ নিম্নে প্রদত্ত হইল। 

আমি। তুমি কতদিবস হইতে বর্তমান কৰ্ম্মে নিযুক্ত হইয়াছ? 

পালোয়ান। প্রায় দুই বৎসর হইতে। 

আমি। জমিদার মহাশয় যে দিবস তোমার মনিবের বাড়ীতে আগমন করেন, সে দিবস তুমি কোথায় ছিলে?

পালোয়ান। বাড়ীতে ছিলাম, বাড়ী হইতে প্রায়ই আমরা কোন স্থানে গমন করি না। 

আমি। জমিদার মহাশয় তাঁহার ক্যাশ বাক্স যে স্থানে রাখিতেন, তাহা তোমরা অবগত হইতে পারিয়াছিলে কি?

পালোয়ান। বাড়ীর সমস্ত লোকই তাহা জানিত। কারণ, জমিদার মহাশয় লুক্কায়িত ভাবে তাঁহার ক্যাশ বাক্স কখনই রাখিতেন না। 

20 

আমি। সেই ক্যাশ বাক্সের ভিতর কি কি দ্রব্য ছিল, তাহা তোমরা অবগত ছিলে কি? 

পালোয়ান। কি কি দ্রব্য ছিল, তাহা ঠিক আমি জানিতাম না; কিন্তু উহার ভিতর যে, তাঁহার বহুমূল্য দ্রব্যাদি রক্ষিত হইত, তাহা সকলেই জানিত। 

আমি। যে রাত্রিতে এই চুরি হয়, সেই রাত্রিতে তুমি কোথায় ছিলে? 

পালোয়ান। বাড়ীতেই ছিলাম। 

আমি। তোমরা ব্যতীত বাহিরের অন্য কোন ব্যক্তি এই চুরিতে নিযুক্ত ছিল কি? 

পালোয়ান। না মহাশয়। বাহিরের কোন লোক ইহার ভিতর ছিল না। 

আমি। জুম্মন সেখ কোনরূপে ইহার ভিতর সম্মিলিত আছে কি? 

পালোয়ান। না। 

আমি। তোমরা কোন্ কোন্ ব্যক্তি এই চুরিতে নিযুক্ত আছ? 

পালোয়ান। আমরা চারিজন পালোয়ান মিলিয়াই এই কার্য্য করিয়াছি। 

আমি। দ্বারবান, কি বাড়ীর আর কোন পরিচারক, এই কার্য্যে তোমাদিগের সহিত মিলিত আছে কি?

পালোয়ান। আমরা চারিজন ব্যতীত অপর কেহই ইহা অবগত নহে। 

আমি। জানালা ভাঙ্গিয়া কে গৃহের ভিতর প্রবেশের পথ করিয়াছিল? 

পালোয়ান। আমরা সকলে মিলিয়াই জানালা ভাঙ্গি। 

আমি। কোন্ দ্রব্যের দ্বারা তোমরা জানালার চারিকোণের ইট খুলিয়াছিলে? 

পালোয়ান। একটি সাবলের দ্বারা। 

আমি। সেই সাবল তোমরা কোথায় পাইলে? 

পালোয়ান। মালীর সাবল। বাড়ীর বাগানের ভিতর মালীর যে সকল যন্ত্রাদি আছে, তাহারই মধ্যে হইতে সাবল খানি লওয়া হয়। আর কার্য্য শেষ হইয়া গেলে, পুনরায় উহা সেই স্থানে রাখা হয়। 

আমি। তোমরা চারিজন পালোয়ানে মিলিয়া এই চুরি করিয়াছ বলিতেছ, কিন্তু তোমরা চারিজনেই কি গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিলে? 

পালোয়ান। না মহাশয়! আমরা চারিজনেই গৃহের ভিতর প্রবেশ করি নাই। দুই জন গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, আমরা দুই জন বাহিরে ছিলাম। 

আমি। কে কে গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল? 

পালোয়ান। লায়না সিং এবং অপর আর এক ব্যক্তি। 

আমি। তোমরা বাহিরে ছিলে কেন? 

পালোয়ান। আমরা পাহারায় ছিলাম। 

আমি। লায়না সিং এবং অপর আর একজন পালোয়ান, যাহারা গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়াছিল, তাহারা ক্যাশ বাক্স লইয়া বাহিরে আসিলে পরে তোমরা কি করিলে? 

পালোয়ান। আমরা সেই বাক্সসহ সকলেই আমাদিগের থাকিবার গৃহের ভিতর প্রবেশ করিলাম। সেই গৃহের ভিতর উক্ত বাক্স ভাঙ্গা হয়। ভগ্ন বাক্স ফুল বাগানের ভিতর ফেলিয়া দেওয়া হয়। 

আমি। বাক্সের ভিতর যে সকল দ্রব্যাদি ছিল, তাহার কিরূপ অংশ করিয়া লওয়া হয়? 

পালোয়ান। সেই সময় তাংশ করিয়া কোন দ্রব্যই লওয়া হয় নাই। কারণ, লায়না সিংহ জানিত যে, এই চুরির নিমিত্ত নিশ্চয়ই গোলযোগ হইবে। সুতরাং এরূপ অবস্থার অপহৃত দ্রব্য সকল বণ্টন করিয়া লওয়া উচিত নহে। সকলের নিকট অপহৃত দ্রব্য থাকিলে পুলিশ কোন না কোন প্রকারে জানিতে পারিবে। এরূপ হইলে আমাদিগের বিপদ ঘটিবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। ‘এখন সমস্ত দ্রব্যাদি এক স্থানে লুকাইয়া রাখা হউক, সমস্ত গোলযোগ মিটিয়া যাইবার পর, আমরা উহা অংশ করিয়া লইব।’ লায়না সিংহের এই প্রস্তাবে আমরা সম্মত হইলে, সেই দ্রব্যগুলি একখানি কাপড়ে বাঁধিয়া লইয়া সে বাড়ী হইতে বহির্গত হইয়া গেল, এবং প্রায় দুই ঘণ্টা পরে প্রত্যাগমন করিয়া কহিল,—“সমস্ত দ্রব্যাদি আমি এরূপ স্থানে রাখিয়া আসিয়াছি যে, আমি নিজে বাহির করিয়া না দিলে, অপর কোন ব্যক্তি উহা কিছুতেই প্রাপ্ত হইবে না।”

আমি। ইহার পর দ্রব্যাদি কবে বাহির করিয়া আনা হয়? 

পালোয়ান। আজ পর্য্যন্ত সেই সকল দ্রব্য বাহির করিয়া আনা হয় নাই, বা অংশ করিয়া লওয়াও হয় নাই। আপনাদিগের গোলযোগ শেষ না হইলে উহা কি প্রকারে বাহির করা হইতে পারে? 

আমি। সেই সকল দ্রব্য কোন্ স্থানে রাখিয়াছে? 

পালোয়ান। তাহা আমি জানি না। 

আমি। লায়না সিংহ যখন সেই সকল দ্রব্য লইয়া বাহির হইয়া যায়, তখন তাহার সহিত আর কোন্ ব্যক্তি গমন করিয়াছিল? 

পালোয়ান। এ কথা আমি পূৰ্ব্বেই আপনাকে বলিয়াছি, তাহার সহিত আর কেহ গমন করে নাই। সে একাকীই গমন করিয়াছিল। 

আমি। সেই সকল দ্রব্য কোথায় রাখিয়া আসিয়াছে, তাহা সে তোমাদিগের কাহার কাহার নিকট বলিয়াছিল?

পালোয়ান। আমার নিকট বলে নাই, বা অপর কাহাকেও বলিতে আমি শুনি নাই। আমার বিশ্বাস যে, সে কাহারও নিকট তাহা প্রকাশ করে নাই। উহার উপর যদি আমাদিগের কোনরূপ অবিশ্বাস থাকিত, তাহা হইলে আমরা কেহ না কেহ উহার সঙ্গে গমন করিতাম, বা সেই সকল দ্রব্য কোথায় রাখিয়া আসিয়াছে, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতাম। 

আমি। তুমি যে সকল কথা এখন আমার নিকট বলিতেছ, তাহার সমস্ত কথাই কি প্রকৃত? 

পালোয়ান। হাঁ। আমি একটিও মিথ্যা কথা কহি নাই। 

আমি। তোমার সব কথা আমি লিখিয়া লইতে পারি? 

পালোয়ান। অনায়াসে আপনি লিখিয়া লইতে পারেন। আমি যাহা কহিলাম, ইহা ব্যতীত অপর কোন মিথ্যা কথা আপনি আমার নিকট পাইবেন না। 

আমি। তুমি যে সকল কথা কহিলে, তদ্ব্যতীত এখন আর কোন বিষয় তোমার বলিবার আছে কি, যাহা তুমি এ পর্যন্ত আমার নিকট প্রকাশ কর নাই? 

পালোয়ান। আমার আর কোন কথা বলিবার নাই। তবে একটিমাত্র কথা আমার এই বলিবার আছে যে, এই বিপদ হইতে আপনি আমাকে রক্ষা করিবেন কি? 

আমি। সে কথা আমি পূৰ্ব্বেই তোমাকে বলিয়াছি। এক কথা বার বার বলিয়া আর লাভ কি? 

পালোয়ানের এই সমস্ত কথা আদ্যোপান্ত সবিশেষ মনোযোগের সহিত প্রথমে শ্রবণ করিয়া পরিশেষে উহা একখানি কাগজে লিখিয়া লইলাম। লেখা শেষ হইলে, পুনরায় তাহা পালোয়ানকে পড়াইয়া শুনাইলাম। আদ্যোপান্ত সমস্ত শ্রবণ করিয়া পালোয়ান কহিল, “আপনি যাহা লিখিয়াছেন, তাহা ঠিক হইয়াছে।” 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

পালোয়ানের নিকট হইতে এই সকল বিষয় অবগত হইয়া, এই অনুসন্ধানে নিযুক্ত কৰ্ম্মচারীগণের মনে মনে আশার সঞ্চার হইল। এখন সকলেই মনে করিলেন যে, এই মোকদ্দমার অপহৃত দ্রব্যের পুনরুদ্ধার হইতে আর বিলম্ব হইবে না। 

যে দিবস প্রথম পালোয়ান আমার নিকট সমস্ত কথা স্বীকার করিল, সেই দিবসই লায়না সিং প্রভৃতি অপরাপর পালোয়ানগণ সকলেই ধৃত হইল। উহাদিগকে লইয়া অপরাপর কর্ম্মচারীগণ বিশেষরূপে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। প্রথম প্রথম অপর তিন জনেই সমস্ত কথা অস্বীকার করিল এবং কহিল, প্রথম পালোয়ান যে সকল কথা বলিয়াছে, তাহার সমস্তই মিথ্যা। এই চুরি তাহাদিগের দ্বারা হয় নাই, বা তাহারা এ বিষয়ের কিছুমাত্র অবগত নহে। 

পালোয়ান তিন জন যদিও এইরূপে আমাদিগকে বুঝাইবার চেষ্টা করিল সত্য, কিন্তু আমরা সে সকল কথা কোন ক্রমেই বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। প্রথম পালোয়ান আমাদিগকে যাহা বলিয়াছিল, তাহাই প্রকৃত বলিয়া আমাদিগের সম্পূর্ণরূপ বিশ্বাস হইল। 

লায়না সিং প্রভৃতি পালোয়ানত্রয় যখন দেখিল যে, আমরা তাহাদিগের কথা কোন ক্রমেই বিশ্বাস করিলাম না, অথচ তাহাদিগকে কোনরূপেই নিষ্কৃতি প্রদান করিলাম না, তখন তাহারা একে একে সকল কথা স্বীকার করিল এবং প্রথম পালোয়ান যেরূপ বলিয়াছিল, সেইরূপই কহিল। কিন্তু অপহৃত দ্রব্য সম্বন্ধে তাহারা যে প্রকৃত কথা কহিল, তাহা আমার বিশ্বাস হইল না। 

লায়না সিং কহিল,—“যে রাত্রিতে আমরা চুরি করি, সেই রাত্রিতেই অপহৃত দ্রব্যগুলি বাড়ীর বাহিরে একস্থানে লুকাইয়া রাখি। পরিশেষে যখন দেখিতে পাই যে, আপনি বাড়ীর ভিতর সমস্ত স্থানে অনুসন্ধান করিতেছেন, তখন আমার মনে ভয় হয়; মনে করি—যদি আপনি এইরূপে বাড়ীর বহির্ভাগস্থ স্থানে অনুসন্ধান করেন, তাহা হইলে সমস্ত দ্রব্যই বাহির হইয়া পড়িবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। মনে মনে এইরূপ ভাবিয়া সময়মত আমি সেই দ্রব্য সকল প্রথম স্থান হইতে উঠাইয়া লই, এবং অপর কোন দূরবর্তী স্থানে উহা লুকাইয়া রাখিবার মানসে গমন করি। কিন্তু কিয়দ্দূর গমন করিলেই, মনে অতিশয় ভয়ের উদ্রেক হইল, সুতরাং সেই সকল দ্রব্য নিকটে রাখিতে কোনরূপেই সাহস হইল না। তখন মনে মনে সংকল্প করিলাম যে, এই সকল দ্রব্যের আর মায়া করিব না। লোভের বশীভূত হইয়া ইহা যদি কোন স্থানে রাখিয়া দিই, তাহা হইলে ধৃত হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। সুতরাং ইহার মায়া একবারে পরিত্যাগ করাই মঙ্গল। এই ভাবিয়া সেই সকল দ্রব্যাদির সহিত আমি গঙ্গার পুলের উপর গিয়া উপস্থিত হইলাম, এবং পুলের উপর হইতে উহা গঙ্গার গর্ভে নিক্ষেপ করিলাম।” 

লায়না সিংহের এ কথা আমরা বিশ্বাস করিলাম না, অথচ কোনরূপে তাহার নিকট হইতে প্রকৃত কথা বাহির করিতেও সমর্থ হইলাম না। 

এইরূপ অবস্থাতেই আসামীগণকে মাজিষ্ট্রেটের নিকট প্রেরণ করা হইল। উহাদিগের নিজের স্বীকৃতি ভিন্ন অপর প্রমাণ আর কিছুই ছিল না। লায়না সিং প্রভৃতি তিন জন মাজিষ্ট্রেটের নিকট সেইরূপে স্বীকারও করিল না, অধিকন্তু কহিল,—“পুলিশের অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া, আপন আপন প্রাণ রক্ষার নিমিত্ত তাহাদিগের নিকট মিথ্যা কথা কহিয়াছিলাম। প্রকৃত প্রস্তাবে এ চুরি আমাদিগের দ্বারা হয় নাই।” তিনজন পালোয়ান সমস্ত কথা অস্বীকার করিল সত্য, কিন্তু প্রথম পালোয়ান আমাদিগের নিকট যাহা বলিয়াছিল, মাজিষ্ট্রেট সাহেবের নিকট প্রথম দিবস সে তাহাই কহিল। 

উহাদিগের বিপক্ষে আর কোনরূপ প্রমাণ যদি সংগৃহীত হইতে পারে, এই অভিপ্রায়ে মাজিষ্ট্রেট সাহেব কয়েক দিবসের নিমিত্ত উহাদিগকে হাজতে রাখিলেন। আমরা সেই কয় দিবস পুনর্ব্বার অনুসন্ধান করিতে লাগিলাম। 

উহাদিগের বিপক্ষে আর কোনরূপ প্রমাণ সংগৃহীত হইল না; অধিকন্তু প্রথম পালোয়ান পূর্ব্বে যাহা বলিয়াছিল, তাহাও আর বলিল না। পরিশেষে সেও কহিল,—”পুলিশের অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া আমি মিথ্যা কথা কহিয়াছিলাম। আমাদিগের উপর যে অভিযোগ আনীত হইয়াছে, তৎসম্বন্ধে কিছুই আমি অবগত নহি।” 

এইরূপ অবস্থায় মাজিষ্ট্রেট সাহেব উহাদিগের আর কিছুই করিতে পারিলেন না। প্রমাণ অভাবে বাধ্য হইয়া পরিশেষে তিনি সকলকেই অব্যাহতি প্রদান করিলেন। 

পালোয়ানগণ হাসিতে হাসিতে বিচারালয় হইতে প্রস্থান করিল। 

এই মোকদ্দমার অপহৃত দ্রব্যের পুনরুদ্ধার করিতে আমি সমর্থ না হইলেও আমার মনে ধ্রুব বিশ্বাস জন্মিয়াছিল যে, সেই চারি জন পালোয়ান ব্যতীত এই চুরি অপর কাহারও দ্বারা হয় নাই। 

যে সময় পালোয়ানগণ হাসিতে হাসিতে আদালত গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া গেল সেই সময় আমিও ভাবিলাম,—“বিচারে ইহারা নিষ্কৃতি লাভ করিল সত্য, কিন্তু আমি অপহৃত দ্রব্যের আশা একবারে পরিত্যাগ করিতে পারিব না। যে পর্য্যন্ত ইহারা কলিকাতায় থাকিবে, সেই পৰ্য্যন্ত আমিও গোপন ভাবে ইহাদিগের উপর বিশেষরূপ লক্ষ্য রাখিব।” 

এই ভাবিয়া আমিও আমার বাসায় গমন করিলাম। পালোয়ানগণ পুনরায় আমাকে দেখিলে কোনরূপে চিনিতে না পারে, এইরূপ ভাবে বেশ পরিবর্তন করিয়া পুনরায় আমি তাহাদিগের উদ্দেশে চলিলাম। দেখিলাম যে, উহারা চারিজনেই আপনার মনিবের বাড়ীতে গমন করিয়া উপবিষ্ট আছে এবং মনের আনন্দে নানারূপ গল্প করিতেছে। 

এই ব্যাপার দেখিয়া আমি আর সেই বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিলাম না, বাড়ীর বাহিরে একস্থানে চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। আমার আন্তরিক ইচ্ছা যে, উহারা যখন বাড়ীর বাহির হইবে, আমিও ছায়ার ন্যায় উহাদিগের অনুগমন করিব। এইরূপে উহাদিগের অলক্ষিত-ভাবে, ভিন্ন ভিন্ন সাজে এবং ভিন্ন ভিন্ন চালে যদি আমি উহাদিগের অনুগমন করিতে পারি, তাহা হইলে অপহৃত দ্রব্যের সন্ধান হইলেও হইতে পারে। কারণ, সেই সকল অপহৃত দ্রব্য উহারা বাড়ীর বাহিরে কোন স্থানে, বা কাহারও নিকট যে রাখিয়া দিয়াছে, সে বিষয়ে আমার অণুমাত্র সন্দেহ নাই। এরূপ অবস্থায় এখন উহারা সেই সকল দ্রব্য সেই স্থান হইতে আনিয়া পরস্পর বণ্টন করিয়া নিশ্চয়ই লইবে। সুতরাং উহাদিগের অনুবর্ত্তী হইতে পারিলে সমস্তই অবগত হইতে পারিব। 

মনে মনে যাহা ভাবিয়াছিলাম, কার্য্যেও ঠিক সেইরূপ করিলাম। আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া গুপ্তবেশে রাত্রিদিন উহাদিগের অলক্ষিত-ভাবে, উহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ভ্রমণ করিতে করিতে ঈশ্বর আমার উপর সদয় হইলেন; আমার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইল। সমস্ত কৰ্ম্মচারী মিলিয়া বিশেষরূপ পরিশ্রম করিয়া যে অপহৃত দ্রব্যের পুনরুদ্ধার করিতে সমর্থ হন নাই, আজ আমি একাকীই সেই কার্য্য সম্পূর্ণ করিলাম। 

কিরূপে আমার কার্য্য শেষ হইল এবং কিরূপে এই সকল অপহৃত দ্রব্যের পুনরুদ্ধার করিতে আমি সমর্থ হইলাম, তাহা এই স্থানে বিস্তৃতরূপে বিবৃত না করিয়া, সেই সময়ে প্রকাশিত একখানি সংবাদ-পত্র হইতে এই ঘটনা সম্বন্ধীয় বিবরণের কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া দিলাম। উহা পাঠ করিলেই পাঠকগণ সমস্ত ব্যাপার উত্তমরূপে অবগত হইতে পারিবেন, এবং ইহার সত্যাসত্যও নির্ণয় করিতে সমর্থ হইবেন। 

“A CLEVER ARREST. 

It will be remember that Liena Singh a Sheikh who had been in the employ of *** as a Pulwan, and who was charged by *** Zaminder, with the theft of certain jewellery, cash and valuable documents, to the value of Rs. 20,000 was discharged on Friday last, by the officiating Chief Presidency Magistrate, on the ground that the evidence was very unsatisfactory against him and also because the prosecuter as well as his servant Kirthee Khan, who was examined at the original hearing, had left for up-coun—try. Liena Singh after he was discharged, with the three other Sheikhs, who had like—wise been charged with the same offence, did not escape the eye of the Detective Police, who were in disguise. Between 7 and 8 on Saturday night, he repaired to the water—reservoir opposite the High Court, and unobserved as he thought, went into the water and took out a box which he had secreted there. He carefully wrapped the box in a piece of cloth and concealed it on his person. He then went to Howrah and waiting for an opportunity purchased a ticket for the mufussil. Babu Priya Nath Mookerjee of the Detective Police, who was upon his track in disguise, now came upon the scene, and questioned the defendeant whether he was not the identical man who was discharged in the Police Court, the day previous, with three other Sheikhs, on a charge. House—breaking by night and with theft of considerable property. Defendant having been taken by surprise, showed symptoms of uneasiness, and clenched his box. The Detective repeated his question, and asked what was concealed on his person. Defendant see—ing that matters were assuming a serious aspect, attempted to take to his heels, but was secured by the Detective Police, who were in disguise round him. The matter will be again placed before the officiating Chief Presidency Magistrate. Almost all of the whole of the property was discovered in the box which was in the possession of the Defendant. 

THE ENGLISHMAN,
Dated 22nd April।884.” 

হাইকোর্টের সম্মুখে বৃহৎ জলাধারের ভিতর সেই পালোয়ান চুরি করিয়া, সেই বাক্স লুকাইয়া রাখিয়াছিল। যখন সেই স্থান হইতে উহা বাহির করিয়া পলাইতেছিল, সেই সময় হাবড়া রেলওয়ে ষ্টেসনে আমা কর্তৃক ধৃত হইয়াছিল। 

বলা বাহুল্য, এই মোকদ্দমায় পরিশেষে আসামীগণ উপযুক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিল। 

[ ভাদ্র, ১৩০৩] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *