পালাবদল
১
১৯৪৬-এর মাঝামাঝি সময়ে, মার মৃত্যুর মাস ছয়েক পর, আব্বা জামালপুর আশেক মাহমুদ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিশেবে যোগ দিলেন। জামালপুরে গিয়ে একসময় উঠে গেলাম কলেজের অধ্যক্ষের কোয়ার্টারে। বিস্তীর্ণ এক প্রান্তরের পুবদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আশেক মাহমুদ কলেজ—আগাগোড়া রুপোলি করোগেটেড টিনে তৈরি ইংরেজি ই-প্যাটার্নের একটা লম্বা বাড়ি। কলেজের সামনে একটা বিশাল খোলা মাঠ, তারপর একটা বড়সড় ইটখোলা— আগামীতে কলেজের দালান বানানোর জন্যে আগুনে পুড়িয়ে সেখানে পাহাড়প্রমাণ ইট তৈরি হচ্ছে। ইটখোলা ছাড়িয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলে পড়তে হবে একটা মেঠো রাস্তায়, সেখান থেকে ডানদিকে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে ঢাকা- জগন্নাথগঞ্জ রেললাইন। এই জগন্নাথগঞ্জ থেকে জাহাজে চড়ে যমুনা পেরিয়ে ট্রেনে উঠলে সোজা চলে যাওয়া যায় কলকাতায়। রাস্তাটা যেখানে রেললাইন পেরিয়ে এগিয়ে গেছে সেখানে লাল ইটের একটা ছোট্ট গুমটিঘর। সেখানে দেখা যায় একজন রেলকর্মীকে, সারাদিন ঘরের ভেতরে বা বাইরে উদ্দেশ্যহীনভাবে বসে আছে, মাঝেমধ্যে তার পোষা ছাগলগুলোকে ঘাস বা কাঁঠালপাতা খেতে দিয়ে এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে আর চেনাজানা মানুষ পেলে রেলগেট ধরে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। তাঁর মূল কাজ একটিই—ট্রেন আসার আগে রেলগেট বন্ধ করে হাতের ইশারায় রাস্তার লোকজনকে ঠেকানো আর ট্রেন কাছে এলে সবুজ নিশান উড়িয়ে তাকে অভয় দিয়ে রেলক্রসিং পার করে দেওয়া। ওই লাল ঘরটাকে কেন গুমটিঘর বলা হত আমি ঠিক জানতাম না, কিন্তু নামটা শুনলেই আমার মনের মধ্যে অনেকরকম ভাবনা এসে জমা হয়ে যেত। গুমটিঘর নামটার পেছনে অজানা ও রহস্যময় কিছু আছে বলে আমার মনে হত। বিস্ময়ের অনুভূতি নিয়ে আমি ঘরটার দিকে তাকাতাম।
গুমটিঘরটা নিয়ে আরও একটা রহস্য কাজ করত আমার মনে। আমি ততদিনে ক্ষুদিরামের গল্প শুনে ফেলেছি। গুমটিঘরটার কাছে গেলে আমার কেবলই মনে হত এমনি একটা গুমটিঘরের কাছাকাছি কোনো-এক জায়গায় হয়ত ক্ষুদিরাম বড়লাটকে মারার জন্যে রেললাইনের ওপর বোমা পেতে রেখেছিল আর ঐ মেঠো রাস্তাটার ধারে কোনো-এক জায়গায় কোনো মুদির দোকানে খাবার কেনার সময় হয়ত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল
রেললাইনে উঠে ডানদিকে তাকালে দেখা যেত লাইনটা বিলের পাশ দিয়ে সরলরেখায় এগিয়ে একসময় বহুদূরের আবছা-সবুজ গ্রামের ভেতর অস্পষ্ট হয়ে হারিয়ে গেছে। আমরা রেললাইনের কাঠের স্লিপার থেকে স্লিপারে পা ফেলে হাঁটতে হাঁটতে একেকদিন দূরের ঝাপসা গ্রামটাকেও পার হয়ে চলে যেতাম। এভাবে হাঁটার মধ্যে একটা নেশা আছে। শুরু করলে আর থামা যায় না। হাঁটার ঘোরে কখন-যে মাইলকে মাইল চলে যেতাম বুঝতে পারতাম না।
.
রেললাইনের বাঁ-ধার ধরে একটা মস্ত বিল। একদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল বিলের ধারে। ব্যাপারটা একেবারেই অন্য ধরনের। তখন আশ্বিন মাস। গুমটিঘর থেকে কিছুটা দূরে রেললাইনের ধারের বিলের পানি বেশকিছুটা কমে এসেছে। তবু বিলের মাঝখানে তার উচ্চতা বুক-পানির নিচে নয়। আমরা জনাকয় বন্ধু বিলের পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছি, হঠাৎ দেখলাম একজন কালো মোটাসোটা ভদ্রলোক ধুতি তুলে শব্দ করে গটগটিয়ে বিলের পানিতে নেমে গেলেন। আমরা যখন অবাক হয়ে ভাবছি, কথা নেই বার্তা নেই ভদ্রলোক হঠাৎ ওভাবে পানির ভেতর এগিয়ে যাচ্ছেন কেন, ঠিক তখনই তিনি আমাদের দিকে একটা লাজুক হাসি ছুড়ে দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁড়ে গলায় বললেন : ‘ওরে, তোরা আমার দিকে তাকাইশ নারে’, বলেই আমাদের পুরো হতবাক করে পরনের ধুতিটা মাথায় তুলে নির্বিকারভাবে বিলের পানিতে কোমর পর্যন্ত ডুবিয়ে হাঁটতে লাগলেন। হঠাৎ একজন ধোপদুরস্ত ভদ্রলোকের এমন দিগম্বর চেহারা দেখে আমরা বাক্যহীন হয়ে পড়লাম এবং যা করতে তিনি নিষেধ করলেন তা আরও বেশি করে করতে লাগলাম।
২
জামালপুরের যে-কয়েকটা জিনিশকে আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম, আমাদের ছোট্ট ছবির মতো গভর্নমেন্ট স্কুল তার একটা। তবে ওই স্কুলটার চেয়েও যা আরও বেশি করে আমার মন কাড়ত তা হল স্কুলের পাশ দিয়ে খলখল করে বয়ে যাওয়া তীব্রস্রোতা ব্রহ্মপুত্র। এ ব্রহ্মপুত্র হল আদি ব্রহ্মপুত্র নদ—জামালপুর ময়মনসিংহের পাশ দিয়ে বয়ে ভৈরববাজারের কাছে এসে লাঙ্গলবন্ধে মেঘনার সঙ্গে মিশেছে। শীতকালে নদীটাতে বড় আকারের চর পড়ে যেত, কিন্তু বর্ষায় তা পানিতে ভরে গিয়ে প্রায় আমাদের স্কুল পর্যন্ত উঁচু হয়ে উঠত। ব্রহ্মপুত্রের ধার বরাবর তখন মাইলখানেক লম্বা বড় আকারের শিরীষগাছের সারি ছিল, সেগুলোর গোটাদুই ছিল আমাদের স্কুলের সীমানার ভেতর। গাছদুটোর একটা ছিল নদীর দিকে হেলেপড়া, তার গোড়ায় ছিল একটা বিশাল খোড়ল। আমি টিফিনে আর ছুটির পরে ওই খোড়লের মধ্যে বসে গাছের খুব নিচ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া সেই উচ্ছল নদীকে অনুভব করতাম। বড় বড় ঘূর্ণি তুলে ছুটে যাওয়া সেই হিংস্র নদীর উদ্দাম খরস্রোত আমার রক্তে তীব্র উন্মাদনা জাগিয়ে তুলত। আমি আমার ভেতরে সেই পরাক্রান্ত নদীর উচ্ছ্রিত ক্রূর গতিধারাকে অনুভব করতাম।
৩
আগেই বলেছি শৈশব কৈশোর যৌবন বার্ধক্যের মতো বুদ্ধিও আমার জীবনে এসেছিল দেরি করে। সে-যে কত দেরি তা ভাবলেও লজ্জা লাগে। আমার অসহ্য বোকামিতে ক্ষিপ্ত হয়ে আব্বা একসময় আমার নাম দিয়েছিলেন ‘ভোপ্পা’। বহুদিন ওটাই ছিল আমার একমাত্র নাম। ‘ভোপ্পা’ শব্দটাকে কোনো ডিকশনারিতে আপনারা পাবেন না। এর কোনো মানেও নেই। আগেই বলেছি আমি ছিলাম মোটাসোটা আর নির্বোধ। এরকম একটা ভোম্বোলমার্কা ছেলের অসহ্য নির্বুদ্ধিতা দেখে দুঃসহ রাগের মাথায় যে অমর্যাদাকর সুবৃহৎ শব্দটি বলে খেঁকিয়ে ওঠা যায় ‘ভোপ্পা’ হল তাই। ‘তুই একটা কী? কীরে একটা তুই? তুই একটা ভো, একটা ভোপ, একটা ভোপ্পা, বুঝলি ভোপ্পা, হ্যাঁ ভোপ্পা’—এমনি ক্ষুব্ধ, ক্ষুব্ধতর, ক্ষুব্ধতম মুহূর্তের উজ্জ্বল উদ্ভাবন এটা।
তবে আব্বা আমাকে ভোপা-টোপ্পা যাই বলুন, আমার সঠিক নামটি দিয়েছিলেন আমাদের প্রাণকৃষ্ণ স্যার। আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। স্যার ছিলেন ক্লাসটিচার। সেদিন ফার্স্টপিরিয়ডে ছাত্রদের বেতন নিয়েছেন তিনি। টিফিনের সময় একটা ফাঁকা ঘরে টেবিলের ওপর টাকাগুলো রেখে বসেছেন, হিসাব মেলাবেন। আমি অধ্যক্ষের ছেলে, সচ্ছল পরিবারের সন্তান, বিশ্বাস করা নিরাপদ, তাই আমাকে ডেকে টাকাগুলো গুনতে বসিয়ে দিলেন। আমি মন দিয়ে টাকাগুলো গুনে যোগ দিলাম। কিন্তু যোগ ঠিক হল কি না মেলাতে গিয়েই দেখি যোগফল আলাদা হচ্ছে। এরপর যতবার মেলাতে গেলাম ততবারই টাকার যোগফল আলাদা হতে লাগল। লজ্জায় অপমানে আমি ঘেমে লাল হয়ে উঠলাম। অসহ্য হয়ে প্রাণকৃষ্ণ স্যার বলে উঠলেন : ‘অপদার্থ’। এভাবে অপদার্থ শব্দটা আমার ভাগ্যের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে গেল। আমার এমন সঠিক নাম দেওয়ার জন্যে আজও আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
৪
আমার এই প্রতিভাদীপ্ত বুদ্ধিহীনতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল একেবারে ছেলেবেলাতেই, সেই করটিয়ার দিনগুলোয়। আমাদের বাসায় ষোলো-সতেরো বছরের একটা ছেলে কাজ করত, নাম জাভেদ (আমরা বলতাম ‘জাবেদ’)। বছর- কয়েক পরে সে সেনাবাহিনীতে চলে যায়। আমাদের বাড়িতে সেদিন অনেক লোক খাবে, বড়সড় রান্না হচ্ছে। জাভেদ কলেজ-হোস্টেল থেকে একটা বিশাল সাইজের ডালের ঘুঁটনি জোগাড় করে তাই দিয়ে বিরাট একটা ডেগচিতে ডাল ঘুটছে। অন্যদের সঙ্গে আমিও পাশে দাঁড়িয়ে জাভেদের কাজ দেখছি। হঠাৎ ঘুঁটনিটার জটিল জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য আমাকে অস্থির করে তুলল। কেন যেন মনে হল এটা বিজ্ঞানবিষয়ক কোনো জটিল যন্ত্র বা উন্নততম প্রযুক্তির কোনো অসাধারণ উদাহরণ হবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম : ‘এটা কী জাবেদ?’ জাভেদ উত্তর দেবার আগেই আমি সর্বজ্ঞের হাসি হেসে বলে উঠলাম : ‘বুঝেছি, বুঝেছি, এটা একটা কম্পাস।’ আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল দিকচিহ্নহীন সমুদ্রে উৎকণ্ঠিত নাবিকেরা যেন এমনি একটা রহস্যময় দুরূহ যন্ত্র দিয়েই পথের দিশা খুঁজে বেড়ায়। আমাকে নির্জলা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ‘এটা একটা কম্পাস’ বলতে দেখে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আমি ঠিক বুঝলাম না কেন তারা হাসছে। কম্পাসটা দীর্ঘদিনের জন্যে আমার দিনরাত্রির অবমাননা আর লাঞ্ছনার প্রতীক হয়ে রইল। কোথাও বোকার মতো আমাকে কিছু বলতে দেখলেই সবাই বলে উঠত : ‘বুঝছি বুঝছি, এটা একটা কম্পাস।’ মানে ‘বোঝা গেছে বুদ্ধির বহর। এবার যাও এখান থেকে।
আমার বোকামির আর-একটা বড় ঘটনা ঘটেছিল জামালপুরে, ‘৪৭ সালের চৌদ্দই আগস্টে, পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিনে। আমার বয়স তখন আট বছর। আমরা বাসার কয়েকজন গায়ে পাজামা-শেরওয়ানি আর মাথায় জিন্নাহ টুপি চাপিয়ে আনন্দ-উৎসব করতে করতে ব্রহ্মপুত্র নদীর পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। আমাদের সাথে রয়েছে জাভেদ। আগস্ট মাসের ভরা নদীতে তখন স্রোত বেশ তীব্র। নদীর দিকে তাকিয়ে দেখি নদীর মাঝ বরাবর লাইন ধরা অনেকগুলো লম্বা বাঁশের মাথা পানির ওপর সরু সরু মাথা জাগিয়ে নদীর তীব্র স্রোতে পাগলের মতো নড়াচড়া করছে। এসব যে জেলেরা পুঁতে রেখেছে আমি তা জানতাম না। আমি হাঁ করে খুঁটিগুলোর অবিরাম মাথা-নাড়া দেখে চললাম। আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না এমন গভীর পানির ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে ওরা পাগলের মতো নড়ছে কী করে! কিংবা এমন বিশাল নদীর ভেতর থেকে এগুলো মাথা উঁচিয়ে রয়েছেই-বা কী করে। ওগুলো কি এই নদীর তলেই লাইন ধরে জন্মেছে? তাইবা কী করে হয়? আমি এর রহস্য বুঝে উঠতে পারলাম না। একসময় সেগুলো দেখিয়ে জাভেদকে জিজ্ঞেস করলাম : ‘এভাবে নড়ছে এগুলো কী?’ জাভেদ আমার বোকামিতে বিরক্ত হয়ে জবাব দিল : ঘোড়ার ডিম (মানে, রাখ এসব, রাস্তার লোকদের হৈহুল্লোড় দেখ)। কিন্তু জাভেদের মুখের ‘ঘোড়ার ডিম’ কথাটা আমার মনে এক অলীক রহস্য ঘনিয়ে তুলল। তখনও আমি ঘোড়ার ডিম জিনিশটা দেখিনি; অনেকবার অনেকের মুখে নাম শুনেছি কেবল। আমি সত্যিসত্যি বিশ্বাস করে বসলাম ওটাই আমার না-দেখা সেই রহস্যময় ঘোড়ার ডিম। পরের তিন- চার বছর, মানে আমার এগারো-বারো বছর পর্যন্ত আমি সত্যিসত্যি জানতাম স্রোতের পানির মধ্যথেকে যে-বাঁশগুলোর সরু চোখা মাথা উঁচিয়ে পাগলের মতো অনবরত নড়ে, ওগুলোই হল ঘোড়ার ডিম। এই ছিল বারো বছর পর্যন্ত আমার মানসিক পরিণতির অবস্থা।
আমার নির্বুদ্ধিতার সবচেয়ে নামজাদা ঘটনা ঘটেছিল পাবনায়। সেটা বলার জন্যেই এতগুলো বোকামির ভূমিকা। তবে অন্যগুলোর তুলনায় এই বোকামিটা নিয়ে সান্ত্বনা এখানেই যে এটার কথা আজ পর্যন্ত আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। একদিন আব্বা আমাকে পাঁচটা টাকা দিলেন বাসার পেছনের গেটের জন্যে একটা বড়সড় তালা কিনে আনতে। আমি বাজারে বিভিন্ন দোকানে তালা কিনতে গিয়ে লক্ষ করলাম সবাই আমাকে তালার সঙ্গে একজোড়া চাবিও দিতে চাচ্ছে। কিন্তু আমাকে তো চাবি নিতে বলা হয়নি! (তালা আমি ভালোভাবেই চিনতাম কিন্তু তালার চাবি কি তালার সঙ্গেই আসে না অন্য কোনোভাবে সে-ধারণা স্পষ্ট ছিল না।) তাদের আগ্রহ দেখে আমার দুচোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন জেগে উঠল আমার সন্দেহ হল দোকানদারেরা হয়ত তালার সঙ্গে একজোড়া বাড়তি চাবিও গছিয়ে দিয়ে আমার কাছ থেকে বেশি দাম হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে। আমি বাসায় ফিরে আব্বাকে জানালাম, সবাই তালার সঙ্গে যে একজোড়া চাবি দিতে চাচ্ছে, ওগুলোও আনব কী না। আমার কথা শুনে আব্বা রাগে এমন স্তব্ধ আর বাক্যহীন হয়ে গেলেন যে আমাকে সেদিন আর কিছুই শুনতে হল না।
৫
একটা গল্প বলে জামালপুরের কথা শেষ করি। একদিন বেড়াতে গেছি এক বাড়িতে। যেয়ে দেখি আমারই বয়সের একটা ছেলে বাড়িটার সামনের শান- বাঁধানো জায়গায় একটা লাল টুকটুকে মোটরগাড়ি চালাচ্ছে। মোটরটা আসলে গাড়ি নয়, খেলনা। গাড়ির সিটের সামনেই দুটো প্যাডেল বসানো—তাতে পা দিয়ে সাইকেলের মতো করে গাড়িটা চালাচ্ছে সে। কিন্তু পা-দুটো ড্যাশবোর্ডের নিচে থাকায় কীভাবে চালাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে তার ইচ্ছামতো ইঞ্জিনের গাড়ির মতোই যেন চলছে ওটা। কখনও সামনে যাচ্ছে, কখনও পেছনে, কখনও ডানে, কখনও বাঁয়ে। ছোট্ট লাল টুকটুকে অত সুন্দর গাড়ি আমি এর আগে দেখিনি। আমার দুচোখের মুগ্ধতা আর শেষ হয় না। ছেলেটাকে আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান শিশু বলে মনে হল। আমারই মতো সে অথচ আমার চেয়ে ওপরে, কত সুখী। বিমর্ষভাবে মনে হল, আমার যদি অমনি একটা গাড়ি থাকত। সবাইকে অবাক করে সবার সামনে দিয়ে ওভাবেই চালিয়ে বেড়াতে পারতাম! ছেলেটার জন্যে মনে মনে ঈর্ষা হতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই বাড়িটা থেকে চলে এসেছিলাম, কিন্তু গাড়িটাকে কোনোদিন ভুলতে পারিনি। গাড়িটা একটা লাল টুকটুকে রক্ত-গোলাপের মতো আজও আমার চোখের সামনে ফুটে আছে। আমি জানি আজ যদি ওই ছেলেটার সঙ্গে আমার দেখা হয় আর তার কাছে জানতে চাই ওই গড়িটার কথা তার মনে আছে কীনা, সে হয়ত সত্যি সত্যি মনে করতে পারবে না। ছেলেটার মতো গাড়িটাকে ঐ বয়সে পেলে হয়ত ওটার কথা একইভাবে আজ আমিও ভুলে যেতাম।