দ্বিতীয় খণ্ড (আমার গুরু, আমার স্বর্গত পিতাকে)
2 of 6

পালঙ্কে বাঘ

পালঙ্কে বাঘ

বছর কয়েক আগে পালঙ্ক থেকে পড়ে গিয়ে সুধীরবাবু আশি বছরে কোমর ভাঙলেন। তা না হলে বয়েসের তুলনায় বেশ ঋজুই ছিলেন। সত্তরে সহধর্মিণীকে হারিয়ে জীবনটাকে মোটামুটি বেশ একতারায় বেঁধে ফেলেছিলেন। মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় দুটি সম্বল—স্ত্রী আর কোমর। কোমর কমজোর হয়ে পড়ায়, সুধীরবাবু ইদানীং বড় অসহায় হয়ে পড়েছেন।

খাট আর পালঙ্কে, মনে হয়, অনেক তফাত। খাট হল নেহাতই একটা শয়নোপযোগী পাটাতন। চারটে পায়া, মাথার দিকে উচ্চতায় সামান্য বড় একটা বোর্ড, পায়ের দিকে ওর চেয়ে খাটো একটি বোর্ড বা প্যানেল লাগানো। অনেকটা কেঠো দম্পত্তির মতো। মাথার দিকে স্বামী, উচ্চতায় সামান্য বড়, পদতলে স্ত্রী, মাপে কিঞ্চিৎ খাটো। মধ্যে একটি সমতল বিচরণ-ভূমি। সেই ভূমিতে একটি ছোবড়ার গদি, গদির ওপর একটি তোশক, তোশকের ওপর একটি চাদর। চাদরে কিছু ফুল পাতা থাকতে পারে। সেই উপত্যকায় কখনও-কখনও হরিণ-হরিণী, কখনও বাঘ-বাঘিনী। যখন যেমন মেজাজ, তার ওপর নির্ভর করছে সম্পর্ক। তবে সবই সীমায় ঘেরা, রাগ করে সরে শুতে হলেও সেই চার ফুটের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে। ঠ্যাং ছুঁড়তে হলেও মেপে, বিঘত ব্যবধানে খাটের সীমানা। ক্রোধের পরিমাণ বেশি হলে খাটও চাঁটের বদলায় চাঁট ছুঁড়বে।

খাটের দুটো মাথা যেকোনও সময় হাতুড়ি ঠুকে খুলে ফেলা যায়। পাশের ঠ্যাঙা কাঠ দুটো খোলার সময় সাবধান না হলেই পায়ে আঙুলে পড়ে নখ থেঁতো করে ‘লিভ উইদাউট পে’ করে দিতে পারে। ঘাটে-ঘাটে বসানো থাকে ফালা-ফালা কাঠের দুটো চালি। খাট খোলার আগে ও দুটোকে টেনে তুলতে হয়। একদিকে তুললে আর একদিকে ঠোঁট কামড়ে থাকে। একা টেনে তোলা দু:সাধ্য ব্যাপার। হাত চিমটে রক্ত জমে যেতে পারে। সভ্য মানুষও গালাগাল দিতে পারেন সংযম হারিয়ে। খাট সেন্ট পারসেন্ট একটা দিশি ব্যাপার। হাতুড়ে বিজ্ঞানে তৈরি। জুড়তেও হাতুড়ি লাগে, খুলতেও হাতুড়ি লাগে।

খাটে অনেক ভেজাল থাকে। শালের পায়ায় সেগুনের প্যানেল। একালের কাষ্ঠ-বিজ্ঞানীরা ব্লো-ল্যাম্প আর চক-পালিশের কেরামতিতে যেকোনও খেলো কাঠে সেগুনের শোভা এনে অনভিজ্ঞ ক্রেতার গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে পারেন। আমি জনৈক যথোচিত সেয়ানা ক্রেতার তৈরি খাট কেনার কায়দা দেখে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। সঙ্গে প্রমাণ মাপের একটি হুলোসহ নিউবেঙ্গল ফার্নিচার শপে প্রবেশ করলেন। মাল খেয়ে মোটা মালদার হাবুবাবু এগিয়ে এলেন। বলুন, স্যার, কী ডিজাইনের খাট চাই? ইংলিশ চাই না বেঙ্গলি চাই।

সায়েন্সের যুগ। আজকাল খাটের উচ্চতা শয়নকারীর হার্টের কন্ডিসান দেখে ডাক্তারবাবুরা প্রেসক্রিপসানে লিখে দিয়ে থাকেন। এত ফুট হাইট। নট মোর দ্যান দ্যাট।

হাবুবাবু বললেন, দ্যাটস নো প্রবলেম। পছন্দ করুন। উঁচু হলে করাত মেরে নামিয়ে দেব। এখানে যা দেখছেন, সব একনম্বর টিক।

ক্রেতা কোল থেকে হুলো নামালেন। দুধে জল মাপা যন্ত্র নামাবার মতো। নে হুলো আঁচড়া। এক অ্যাঁচড়েই হলদিকাঠ বেরিয়ে পড়ল। হাবুবাবু দেড় হাজার হেঁকেছিলেন। মিউমিউ করো বললেন, কাঠ হল স্যার মেয়েদের জাত, বিয়ে না করলে নেচার বোঝা যায় না। একমাত্র হুলোতেই ধরতে পারে।

তা এমন সাবধানী ক্রেতা আর কজন আছেন? তা ছাড়া শয়নের খাট আর মরণের খাট দুটোই নিজেকে কিনতে হয় না। একটি আসে স্ত্রীর সঙ্গে, আর অন্যটি কেউ-না-কেউ কিনে আনেন দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে। ব্যাচেলারদের কথা অবশ্য আলাদা।

এ যুগে অধিকাংশ মানুষই ভাড়াটে। বাড়িওয়ালা হওয়ার সৌভাগ্য হয় কজনের। ভাড়াটে মানেই যাযাবর। আজ বেহালায় তো কাল বাগুইআটিতে। খাট খোলো আর খাট জোড়ো। তখনই বোঝা যায়, খাট কত ছোটলোক! খাটিয়ার চেয়েও নীচ স্বভাবের।

আকার-আকৃতি দেখলে মানুষের স্বভাবচরিত্র নাকি বোঝা যায়। এই শাস্ত্রটিকে বলা হয় অবয়ব বিজ্ঞান, ফ্রেনোলজি। আকৃতি দিয়েই বোঝা যায়, খাট বস্তুটিও কি স্বভাবের। চরিত্রে পরম দার্শনিক। কারণ খাটের বর্গভূমিতেই মানুষের শৈশবের প্রক্ষালন, যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী। এই ছোবড়া ভূমিতেই বাজে প্রেমের বাঁশরি, আবার রণদামামা, সব শেষে, শেষ-আর্তনাদ—এবার তবে আসিরে খেঁদি, ঠ্যাং ধরে চাতালে নামা। পকেটে শেষ পঞ্চাশ, খাটিয়া আনা। খাট দার্শনিক হবে না তো কি মানুষ হবে।

চারপাশে চারটে লগবগে ছতরি। ছতরি-বিজ্ঞান এক অতি কুচুটে বিজ্ঞান। খুললে লাগে না, লাগালে খোলে না। বিকল দাম্পত্য জীবনের মতো। জোড় লেগে গেলে চলল কেরানি থেকে অফিসার। অফিসার থেকে সিনিয়ার অফিসার। ডাল-ভাত, মাছের ঝোল ভাত। মুরগির ঝোল ভাত। অবসর, পেনশান। আবার ডাল ভাত। অবশেষে ছাড়াছাড়ি। ছতরি চলল নেচে নেচে, বলো হরি, হরিবোল। স্ত্রী একবার সেঁটে গেলে, দাঁতের মতো। মোক্ষম টানে উৎপাটন না করলে, সঙ্গের বিশ্বস্ত সাথী। মাঝেসাঝে একটু ট্রাবল দিতে পারে। ওষুধও আছে, গাম কিওর।

আর যদি চিড় খেল তো ওই ছতরির মতোই। হিঞ্জে ঢোকাতে যাও, এমনই কল, অবিকল গ্যাঁড়াকল। ছেঁচড়ে ঢোকাতে হবে। ওপর থেকে নীচে। ড্রেনপাইপ ধরে চোর নামার কায়দায় ছতরি নামবে গা ঘেঁষে। একবারের চেষ্টায় ঘাটে ঘাটে কিছুতেই মিলবে না।

যে দুটো বিমের ওপর চালি ঝোলে, সে দুটো খুব দু:সাহসী না হলে ফিট করা দু:সাধ্য ব্যাপার। মেল ফিমেল কব্জা। চোয়ালে-চোয়ালে ঢোকার কায়দায়; একটার বুক বেয়ে আর একটায় প্রবেশ। রবার্ট ব্রুসের ধৈর্য চাই। ভাগ্যে থাকলে ঢুকবে, নয়তো ফসকাবে। ফসকানো মানেই ভারী কাঠ মেঝেতে পড়বেই। হাত-পা ছড়বেই। রক্তারক্তি হবেই। যত ফসকাবে, তত জুয়াড়ির মতো গোঁ চেপে যাবে। হয় এসপার, নয় ওসপার। খাট ঘাড়ে পড়ে আর পালঙ্ক থেকে মানুষ পড়ে। এই হল পালঙ্কের বৈশিষ্ট্য। সুধীরবাবুর পালঙ্কের বর্ণনা পরে হবে। বন্ধুরা জিগ্যেস করলেন, তুমি পড়লে কী করে।

আপনি হেসে বললেন, প্রাণের মায়া আছে তো ভাই!

সকলেই একসঙ্গে প্রশ্ন করলেন, তার মানে?

ভাই বাঘে তাড়া করলে, তোমরা কী করতে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *