পার ঘাট

পার ঘাট

আমাদের একটা বাড়ি ছিল। বাড়িটা খুব পুরোনো। আমরা থাকতে থাকতে সেটা আরো পুরোনো হল। বেশ বড়ো বাড়ি। এমাথা থেকে ওমাথা। কিছু কিছু ঘরে সারা দিন চিন চিন করে বালি ঝরে পড়ত। ভেন্টিলেটারে চড়াই পাখির বাসা সারা দিন তাদের কিঁচ কিঁচ, কাঁচি দিয়ে কাপড় কাটার শব্দের মতো ডাক। বাড়িটার পেছনে ছিল গঙ্গা। সারাদিন ভিজে ভিজে বাতাস। দেয়ালে দেয়ালে নোনাধরা। যেন নানা দেশের ম্যাপ। আমরা ভাইবোনেরা নানা দেশ খুঁজে পেতুম সেই ম্যাপে। কোনোটা অস্ট্রেলিয়া, কোনোটা গ্রেট ব্রিটেন, জাপান। গঙ্গার দিকে ঝোপঝাপ একটা বাগান ছিল। বর্ষার গঙ্গায় যখন ভরা জোয়ার, তখন বাগানে জল চলে আসত। ছোটো ছোটো ঝোপঝাপ গাছগুলো সব ডুবে যেত জলে। একটা কদম গাছ ছিল। মনে হত, নাইতে নেমেছে জলে। এক গাছ গোল গোল ফুল। আমরা কল্পনার চোখে সেই গাছে শ্রীকৃষ্ণকে যেন দেখতে পেতুম, ডালে বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন। বাগানটা জলে ডুবে গেলে আমরা পায়ে সরষের তেল মেখে সেই জলে ছপছপ করে খেলতে নামতুম। মাঝে মাঝে হলুদ সাপ জলে লাট খেত। আমরা একটুও ভয় পেতুম না। জানা ছিল জলে বিষধর সাপ থাকে না। অনেক মাছ ঢুকে পড়ত বাগানে। বেশির বাগই আড় ট্যাংরা। ছোটো ছোটো চিংড়ি তিড়িংবিড়িং করে লাফাত। জল নেমে গেল পলি পড়ে থাকত। মিহি চিকচিকে। বিজ বিজ করত ছোটো ছোটো কাঁকড়া। দু-একটা চিংড়িও লাফাত। পাতার ঝোপে অসহায় আড় ট্যাংরা। আমরা কোনোটাই ধরতুম না। আড় ট্যাংরা তো খেতেই নেই। ওরা নোংরা খায়। একবার একটা বিশাল ময়াল সাপ কোথা থেকে চলে এসেছিল। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, সাপটা খুব ভালো মানুষ। ওকে ভয় পাওয়া উচিত হবে না। বাগানের এককোণে ঝাঁকড়া একাট বকুলের ছায়ায় ছোটো, একানে একটা ঘর ছিল। এক সময় এক সাধু থাকতেন ওই ঘরে। জোয়ারের জল ওই ঘরে ঢুকে পড়ত। একটা পাথরের বেদি ছিল। বেদিটা জলে ডুবু ডুবু হয়ে থাকত। আমরা তার ওপর উঠে খেলা করতুম। জলে ভরা ঘরে কথা বললে বেশ গমগম করত। আমাদের মজা লাগত। সাপটা ওই ঘরেই আশ্রয় নিয়েছিল। পুরো একটা দিন ছিল। আমরা দুধ খেতে দিয়েছিলুম। খেয়েছিল। মনে হয় পেট ভরেনি। অতবড়ো সাপ। ছোটো এক বাটি দুধ। কী হবে! নস্যি। ছোটো একটা ছাগল দিলে গিলে ফেলত। ময়ালটা দিনের জোয়ারে এসে রাতের জোয়ারে চলে গেল। সেই থেকে ঘরটার নাম হয়ে গেল ময়াল গুহা। বাগানটায় এত কিছু ছিল, তবু আমরা নির্ভয়ে যেতুম। কেউ আমাদের কিছু বলতেন না। বাবা বলতেন, বিপদের মুখে এগিয়ে যাওয়া উচিত। তা নাহলে মানুষ ভীতু হয়ে যায়। জীবন জিনিসটা খুব সহজ নয়। কত কী হবে! কত কী ঘটবে!

আমাদের সেই বাড়িটার নিচের তলায় অনেক ঘর ছিল। সেই ঘরগুলো আমরা ব্যবহার করতুম না। করার প্রয়োজন হত না। তালাবন্ধ পড়ে থাকত বারো মাস। আমরা থাকতুম দোতলায়। আমাদের একতলায় ইঁদারার মতো বড়ো একটা কুয়ো ছিল। সেই কুয়োর সঙ্গে সুড়ঙ্গপথে গঙ্গার যোগ ছিল। গঙ্গায় জোয়ার এলে, জোয়ারের জল কুয়োয় এসে ঢুকত। হুড়হুড় করে ভরে যেত। বর্ষায় উপচে পড়ত। তখন ঘটি, বাটি ডুবিয়ে জল তোলা যেত, দড়ি বালতির প্রয়োজন হত না। বাড়িটা এমন কায়দায় তৈরি ছিল, ঘরের মধ্যে ঘর, তার মধ্যে ঘর। সে বেশ মজা। আমাদের লুকোচুরি খেলার খুব সুবিধে হত। কে কোথায় লুকিয়ে আছি সহজে ধরা যেত না। অনেক ঘরের কোন ঘরে? সেই ঘরটা আবার কোন ঘরে ঢুকে আছে!

ছাতটা খুব বিশাল ছিল। খেলার মাঠের মতো। পশ্চিমে গঙ্গা। ছাতে উঠলে ওপারটা পরিষ্কার দেখা যেত অনেক দূর পর্যন্ত। ঘাট, মন্দির, বাগানবাড়ি। ছাতে একটা চমৎকার ঘর ছিল। সেই ঘরে সাদা চাদর পাতা একটা বিছানা ছিল। কারো শরীর খারাপ, মন খারাপ হলে, কোনো কারণে রাগ হলে, এই ঘরে এসে শুয়ে থাকত। সবাই বলত গোঁসা ঘর। আমরা যখন কানমলা বা চড়চাপড় একটা দুটো খেতুম, খেতুম যে না, তা তো নয়, ছোটোদের একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করবেই, আর বড়োদের ধৈর্য কম হবেই, আর বাঁদর, গাধা, উল্লুক বলবেই। তাতেও রাগ না কমলে, কান ধরে টান, গালে ছোটোমতো একটা চড়। তাইতেও রাগ না কমলে মাথায় গাঁট্টার তেহাই। চড়-চাপড় বা ছাগল, গাধা, বাঁদর বললে, আমাদের তেমন রাগ হত না। হনুমান বললে খুশিই হতুম! জানতুম, ওটা রাগ নয়, ভীষণ একটা আদর। উল্লুক শব্দটায় আমাদের ঘোরতর আপত্তি ছিল। জিনিসটাকে আমরা কখনো কোথাও দেখিনি। আমাদের বাগানে হনুমান আসত। রাস্তায় বাঁদর নাচাত। স্কুলের মাঠে গাধাও চরত। উল্লুক জিনিসটা আমরা চোখে দেখিনি। উল্লুকের ‘লুক’ কেমন জানা ছিল না। ভাল্লুক হলে আপত্তি ছিল না। ভাল ‘লুক’ মানে ভাল্লুক। উৎকট লুক মানে উল্লুক। উল্লুকের সঙ্গে কানমলা খুবই অপমানজনক। যেমন ঝোলে গাঁদাল পাতা। আর উল্লুক কথাটা বেশি ব্যবহার করতেন আমাদের কাকা আর মাস্টারমশাই। যাকে বলতেন, সে অমনি গোঁসাঘরে গিয়ে আশ্রয় নিত। অতবড়ো বাড়ি। অত ছেলে-মেয়ে, লোকজন। গোঁসাঘরে কে চলে গেল তখনই কারো খেয়াল হত না। ধরা পড়ত খাওয়ার সময়। গুণেগুণে পাত পড়ত। একটা কেন খালি! খোঁজ কোথায় গেল। প্রথমেই গোঁসাঘরে অনুসন্ধান। উপুড় হয়ে পড়ে আছে বিছানায়।

চল, মা ডাকছে, খেতে দিয়েছে।

যা, যা খাব না।

চল।

যাব না আ আ।

কথায় আছে, ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। হাত ধরে টানতে গেল। খামচাখামচি, ঝটাপটি। কেস আরও খারাপ দিকে চলে গেল। সে ফিরে গিয়ে যা নয় তাই বলে নালিশ করে দিলে, আমাকে লাথি মেরেছে। গালে আঁচড়ে দিয়েছে। বলেছে, যা যা, মা আমার সব করবে। মায়ের মেজাজ সেই সময় ভালো থাকলে কিছু নয়। মা নিজেই গিয়ে, অভিমান ভাঙিয়ে নিয়ে আসবে। অভিমানীর তখন এক আলাদা ডাঁট, যেন জামাই বসছেন খেতে। সবচেয়ে বড়ো মাছের টুকরোটা তার পাতে। চার চামচে চাটনি বেশি! মানে বেশ আদর, বেশি খাতির। তিনি যেন খেতে বসে সকলকে ধন্য করছেন। আর যদি মায়ের মেজাজ চড়া থাকে, তাহলে হয়ে গেল। মা সমান ঝাঁঝিয়ে বলবে, না খাবে, না খাবে। ক’দিন আর না খেয়ে থাকবে! পেটের জ্বালা ধরলে ঠিক নেমে আসবে। আমার দিদি একবার টানা তিন দিন ওই গোঁসাঘরে ছিল। দিদির কানের একটা দুল অসাবধানে কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। মা দিদিকে বলেছিল, পেতনি। এই পেতনি কথাটা দিদি খুব অপছন্দ করত। বাঁদরি বললে তেমন রাগ করত না। দিদিকে দেখতে তো খুব সুন্দর ছিল। তাই পেতনি বললে ভীষণ রেগে যেত। আর মা দিদিকে মাসে অন্তত একবার পেতনি বলবেই। ভূত বললেও হয়। ভূতরা নাকি সবাই পুরুষ। দিদি গোঁসাঘরে চলে গেল। খাওয়ার সময় মা বললে, ‘যা, মহারানিকে ডেকে আন।’ ডাকতে গেলুম। দিদি ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘পেতনিরা ভাত খায় না। মাঝরাতে পেঁচা ধরে খায়। যা, তোর মাকে বলগে যা।’ আমি এসে মাকে বললুম। একটু বাড়িয়েই বললুম, ‘তোমার মেয়েকে তুমিই ডেকে আনো। আমাকে মিচকেপটাশ, দালাল, এইসব বলেছে।’ মা বললে, ‘তা তো বলবেই। কী যুগ পড়েছে দেখতে হবে তো। অন্যায় করব আবার চোখও রাঙাব। যদ্দিন ইচ্ছে, তদ্দিন না খেয়ে থাক। পেটের জ্বালা ধরলে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে আসবে।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কথাটা দিদিকে গিয়ে রিপোর্ট করে দিলুম। একটা শব্দ বেশি যোগ করে। ল্যাজের জায়গায় বললুম, ‘কুকুরের মতো ল্যাজ নাড়তে নাড়তে আসবে।’ ব্যাপারটা খুব ঘোরালো হয়ে গেল। দিদির ঝাড়া দু-দিন উপোস, মায়েরও দু-দিন। মেয়ে না খেলে মা খায় কী করে! শেষে দিদি দেয়ালে লিখলে ‘আর একবার সাধিলেই খাইব।’ তিন দিনের দিন জ্যাঠাইমা স্পেশ্যাল রান্না করে মা আর মেয়েকে পাশাপাশি বসিয়ে আদর করে খাওয়ালেন। সরু চালের ভাত, মাছের ঝোল। আমড়ার অম্বল। পোস্ত। আমরা সবাই জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগলুম দু-জনের অনশন ভঙ্গের দৃশ্য। কাকিমা আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন, মহাত্মা গান্ধী দিনের পর দিন অনশন করতেন। ভঙ্গের দিন রামধুন গাওয়া হত। তোরাও সবাই মিলে গা, রঘুপতি রাঘব রাজারাম। মা আর মেয়ের সে কী ভাব! মেয়ের পাত থেকে মা কাঁচা লঙ্কা তুলে নিচ্ছে!

অনেক খাট-পালঙ্ক ছিল, তবু আমাদের শোয়ার ব্যবস্থা ছিল মেঝেতে। বাবা বলতেন, ছাত্র-ছাত্রীরা সব ব্রহ্মচর্য পালন করবে। একটু কষ্টে থাকবে। সাধারণ খাবার খাবে। বাবুগিরি করবে না। সত্যকথা বলবে। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠবে। দুপুরে ঘুমোবে না। ছোটো ছোটো করে চুল ছাঁটবে। দশ আনা ছ আনা ছাঁট চলবে না। তার মানে কিছু বড়ো কিছু ছোটো চলবে না। সব সমান মাপ। সেই ছাঁটের নাম ছিল, কদমছাঁট। একটা বিশাল বড়ো ঘর ছিল। সেইটাকে বলা হত দক্ষিণের ঘর। সেই ঘরে মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত লম্বা, সাতটা জানলা আর তিনটে দরজা ছিল। সেই ঘরটাকে বলা হত হল-ঘর। সেই দূর অতীতে যাঁরা বাড়িটা তৈরি করিয়েছিলেন, তাঁরা এই হলঘরে বসে, নাচ, গান, বাজনা করতেন। সেই ঘরের মেঝেতে মা একটা ঢালাও বিছানা করে দিতেন। একটা করে মাথার বালিশ। তাঁবুর মতো বিশাল এক মশারি, টান টান করে খাটানো। সেই বিছানায় আমরা সব কটা ভাইবোন পাশাপাশি। মাঝেমধ্যে গৃহযুদ্ধের মতো মশারির মধ্যে আমাদের মশারি যুদ্ধ হত। শুরুটা হত খুব সামান্য ভাবে। পায়ে পায়ে লড়াই। শেষে হাতাহাতি। সব শেষে মশারির দড়ি ফড়ি ছিঁড়ে প্রলয়কান্ড। সেইখানেই শেষ নয়। শেষের পরেও একটা শেষ থাকত, যেটাকে বলে অবশেষ। সেই অবশেষে বড়োদের আগমন। প্রথম যে শুরু করেছিল তাকে সনাক্তকরণ। বিচার। সাক্ষীসাবুদ। আত্মপক্ষ সমর্থনে দোষীর হাঁউমাউ। সব শেষে বিচারকের রায়, বাঁদরটার সাতদিন সব খেলাধুলো বন্ধ। সকাল থেকে রাত শুধু পড়বে আর কড়া কড়া অঙ্ক কষবে।

সেই মেঝের বিছানায় বালিশের মাথা রেখে শুতে শুতে দিদি একদিন আবিষ্কার করলে, ঘরটার নীচে যে তালাবন্ধ ঘরটা, সেই ঘরে কে যেন একটানা সংস্কৃত মন্ত্র পড়ে চলেছে। তখন অনেক রাত। দিদি আমাকে ফিশফিশ করে ডাকছে, ‘বিলু, বিলু, বালিশে কান পেতে শোন।’ হ্যাঁ, সত্যিই তাই। কে একজন ভারী গলায় মন্ত্র পড়ছে। পরপর তিনদিন একই সমযে আমরা সেই শব্দটা শুনলম। মাঝরাত থেকে শুরু করে সেই ভোররাত পর্যন্ত। দিদি খুব সাহসী ছিল। চারদিনের দিন দিদি বললে, ‘চল বিলু আমরা দেখে আসি। ব্যাপারটা কি!’

আমি বললুম, ‘আমার ভীষণ ভয় করবে।’

‘ভয় করবে? তুই না ছেলে? চল, পা টিপে টিপে, টর্চ হাতে যাব। আমি তো আছি।’ পাঁচ সেলের টর্চ হাতে দিদি আগে আগে, পায়ে পায়ে আমি। দিদির ফ্রকের পেছনটা ধরে আছি। মনে হচ্ছে, ঘুরে ঘুরে প্যাঁচানো সিঁড়ি দিয়ে অন্ধকারের পাতকুয়ায় নেমে চলেছি। আলোর রেখা ধরে। নীচেটা হিম হিম। সাত-শো ঝিঁঝি পোকা একসঙ্গে ডাকছে। অন্ধকার যেন কাঁপছে। বাইরে, গঙ্গার দিকের বাগানে কদমের ডালে বসে ডাকছে প্যাঁচা, যেন রাতের অন্ধকার করাত দিয়ে কাটছে। গাছের পাতায় বাতাসের ঝুপঝাপ শব্দ। লম্বা একটি গলি। দু-পাশে রক। সারি সারি তালা বন্ধ ঘর। ওপর থেকে যে-ঘরটায় মন্ত্রপাঠ হচ্ছিল বলে ধারণা, সেই ঘরের দরজায় কিন্তু বিশাল একটা পেতলের তালা ঝুলছে দেখা গেল। ভয়ে বুকটা ছাঁত করে উঠল! দিদি পা টিপেটিপে এগোচ্ছে। নিজে দরজায় কান রাখল। অনেকক্ষণ ধরে কি শুনল! আমাকে ইশারায় ডেকে কান পেতে শুনতে বলল। ঘরের ভেতরে সত্যিই অদ্ভুত একটা শব্দ হচ্ছে। যেন দশ-বারোটা ভুমো ভোমরা একসঙ্গে ভোন ভোন করছে। গভীর, গম্ভীর, ওঁকারধ্বনির মতো। দিদি টর্চ নিবিয়ে রেখেছে। ঘোর অন্ধকারে গায়ে গা লাগিয়ে, কান পেতে দু-জনে শুনছি। ভীষণ ভয় করছে। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, শীত করছে। দরজার পাশেই একটা জানলা ছিল। ভেতর থেকে বন্ধ! দিদি কি মনে করে জানলাটা ঠেলতেই একটা পাল্লা দড়াম করে খুলে গেল। এত সহজে খুলে যাবে আমরা ভাবতেও পারিনি। সুন্দর একটা গন্ধ বেরিয়ে এল খোলা জানলা দিয়ে! অন্ধকারে উঁকি মেরে মনে হল, ঘরের মেঝেতে কেউ বসে আছেন। সাদা মতো। শব্দটা সেই মূর্তি থেকেই আসছে। দিদি ঝট করে টর্চলাইটটা টিপল। হঠাৎ আলোয় ঘরটা যেন চমকে উঠল। আমরা অবাক হয়ে দেখলুম, ঘরের মেঝেতে একটা আসন পাতা রয়েছে, আর কোথাও কিছু নেই। মানুষের মূর্তি আমাদের চোখের ভুল। দিদি যেই টর্চটা নেবালো, সঙ্গেসঙ্গে মনে হল মূর্তিটা আছে। আলোয় নেই, অন্ধকারে আছে। ভয়ে শরীর পাথরের মতো হয়ে গেছে। দিদিও বেশ ভয় পেয়ে গেছে। ছুটে পালিয়ে আসতে পারছি না। পা দুটো যেন মেঝেতে থাম হয়ে গেছে। হঠাৎ কে যেন খুব ভারি গলায় পরিষ্কার বললে, ‘যাও, শুয়ে পড়ো।’ আমরা কাঁপতে কাঁপতে ওপরে এসে, দু-জনে জড়ামড়ি করে শুয়ে পড়লুম।

পরের দিন সকালে গিয়ে দেখি, জানলাটা বন্ধ হয়ে গেছে। দিদি মাকে জিজ্ঞেস করলে, ‘ওই ঘরটা কোনো দিন খোলো না কেন মা!’

‘ওই ঘরে বসে তোর দাদু সাধনা করতেন। মৃত্যুর সময় বলে গিয়েছিলেন, বারোটা বছর ওই ঘর যেন খোলা না হয়। কেউ যেন না ঢোকে। এখন দু-বছর বাকি আছে। দু’বছর পরে ওই ঘর খুলে পুজো হবে।’

এদিকে আমাদের কী হল, রাতের ঘুম চলে গেল। মাঝ রাতে বাড়ির সবাই যখন সুখে ঘুমোচ্ছে, তখন আমি আর দিদি টর্চ হাতে পা টিপে টিপে, আস্তে আস্তে নীচে নেমে যেতুম। সেই ঘর। সেই শব্দ। আমাদের আর ভয় করত না। জানলাটা খোলামাত্রই সুন্দর একটা গন্ধ। অন্ধকার আসনে শ্বেতমূর্তি। আমরা অপেক্ষা করে থাকতুম যদি কোনো কন্ঠস্বর আসে। সেই প্রথম দিনের মতো, ‘যাও শুয়ে পড়ো।’

এসেছিল কন্ঠস্বর। সে এক ভয়ংকর ইঙ্গিত। ‘তোমাদের বাড়িটা থাকবে না। গঙ্গা গ্রাস করবে।’

আমরা সে-কথা বিশ্বাস করিনি। এতকালের এত বড়ো একটা বাড়ি জলে চলে যাবে। দিদি মাকে বললে। মা বললে বাবাকে। বাবা জ্যাঠামশাইকে। জ্যাঠামশাই কাকাবাবুকে। সবাই বললেন, ‘গঙ্গা যদি নেনই আমাদের তো কিছু করার নেই। গঙ্গার সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা আমাদের নেই।’

সত্যিই তাই। প্রবল জোয়ারে একটু একটু করে পাড় ভাঙতে ভাঙতে প্রথমে গেল সেই সাধুর কুঠিয়া। ভাদ্রমাসের অমাবস্যার রাত। ভাদ্রমাসে গঙ্গায় ষাঁড়াষাঁড়ির বান আসে। বিশাল তার শক্তি। পরপর দুটো ঢেউ আসে। একটা ষাঁড় আর একটা ষাঁড়ি। সেই রাতে বান এল। প্রথম ঢেউয়ের আঘাতেই কুঠিয়ার পাড় ভেঙে গেল। দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে ঘরটা ধসে পড়ল ধুস করে। আমরা আমাদের ছাতে দাঁড়িয়ে দেখলুম। বেদিঅলা অমন সুন্দর ঘরটা ঝুপ করে জলে পড়ে গেল। ঘোলা জল পাক মেরে ছুটে চলেছে দক্ষিণ থেকে উত্তরে। সেই বছরেই বাগানটার তিনের চার অংশ গঙ্গায় চলে গেল। বাবা একজন ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে আনলেন। তিনি সব দেখে বললেন, কিছু করার নেই। গঙ্গা পূব দিকে সরে আসছে। পশ্চিমে চর। পুবে ভাঙন। তিন লাখ টাকা খরচ করে বাঁধাতে পারেন, তবে টাকাটা জলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

মাঝরাতে আমি আর দিদি একদিন সেই ঘরের জানলা খুলে দাদুর অস্পষ্ট, ঝাপসা মূর্তিকে বললুম, ‘আমাদের এমন সুন্দর বাড়িটা গঙ্গায় চলে যাবে? আপনি কিছু করবেন না! আমাদের কদমগাছ, বকুলগাছ, বেলগাছ, পিটুলিগাছ! খেলার মাঠের মতো অত বড় ছাদ! দক্ষিণের হল ঘর। ঘরের ভেতর ঘর।’

কোনো উত্তর নেই।

‘আপনি অত বড়ো সাধক। ইচ্ছে করলে আপনি সব পারবেন।’

কোনো উত্তর নেই।

‘আর দু-বছর পরে আপনার ঘর তাহলে কে খুলবে!’

এইবার পরিষ্কার শোনা গেল, ‘আমার ঘর খুলবেন মা গঙ্গা। আমার সাধন, আমার আত্মা তিনি ভাসিয়ে নিয়ে যাবেন সাগরে।’

সেই দিনের কথা মনে আছে। আমরা বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছি। তিন চারটে লরিতে আমাদের সব মাল উঠেছে। আমাদের এক-শো বছরের বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি দূরে, ঘিঞ্জি একটা জায়গায়, যেখানে অনেক লোক, সারাদিন অনেক গাড়ি, দোকানপাট, কলকোলাহল। যেখানে গাছ নেই, পরিষ্কার বাতাস নেই। সারাদিন একটা কারখানার চিমনি ভুসভুস করে ভুসো ধোঁয়া ছাড়ে আকাশে।

কতদিন হয়ে গেল, সেইসব দিনের কথা। যেখানে আমাদের বাড়িটা ছিল সেখানে এখন গঙ্গা। একটা ফেরিঘাট হয়েছে। কতযাত্রী রোজ এপার-ওপার করে। আর দাদুর ঘরটা যেখানে ছিল, সেইখানে হয়েছে টিকিটঘর। পারে যাওয়ার টিকিট মেলে সেই ঘরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *