পার্শ্বচরিত্রে একেনবাবু

পার্শ্বচরিত্রে একেনবাবু

(প্রথমেই বলে রাখি—এটি ঠিক একেনবাবুর গল্প নয়। একেবারে শেষের দিকে উনি একটা গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স দিয়েছেন। আর লেখার ধরন দেখে মনে হচ্ছে কাহিনির রচয়িতাও একেনবাবুর কাহিনিকার বাপিবাবু নন!)

।।১।।

ইটকোনা খুবই ছোট্ট একটা জেলা, জনসংখ্যা বড়োজোর আট হাজার। ভারতবর্ষেই হাজার চারেক গ্রাম আছে, যার জনসংখ্যা ইটকোনার থেকে বেশি। তাই কেন এটাকে জেলার সম্মান দেওয়া হল, সেটা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। আসলে দেশ স্বাধীন হবার সময় ইটকোনার রাজা (জমিদার বলাটাই সঙ্গত হবে) ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে চান এই চুক্তিতে যে ওঁর রাজত্বটাকে ইটকোনা রাজ্য হিসেবে স্বাধীন ভারতের ম্যাপে দেখাতে হবে। এটা একটা অসম্ভব আবদার, পরে রফা হয় যে এটাকে একটা জেলার সম্মান দেওয়া হবে। সেই থেকে ইটকোনা হল ভারতের ক্ষুদ্রতম জেলা।

ইটকোনার পুলিশের বড়োকর্তা হলেন গজেন্দ্র দত্ত, একজন স্থানীয় যাত্ৰা-ব্যক্তিত্ব। বরাবর এই জেলার দায়িত্ব পালন করে গেছেন চরম শাস্তি পাওয়া আইপিএস মর্যাদার কেউ। তবে কিনা এমনিতেই আজকাল এই রাজ্যে আইপিএস অফিসাররা থাকতে চান না, কেন্দ্রে পালাতে চান। তাই সেই পথে প্রশাসন যেতে চায়নি। অথচ যাকে-তাকে দিয়ে তো আর পুলিশের কাজ চালানো যায় না। এমন কাউকে মাথায় বসাতে হবে, যাঁর আইপিএস ক্যাডারের তকমা না থাকলেও একডাকে সবাই তাঁকে চিনবে এবং মান্য করবে। এই অবস্থায় সেলিব্রেটি অর্থাৎ চিত্রতারকা, নাট্য-ব্যক্তিত্ব, খেলোয়াড়, গায়ক– এঁরাই একমাত্র ভরসা!

সেলিব্রেটিদের নিয়ে এই এক্সপেরিমেন্ট প্রথমে শুরু হয়েছিল বিধানসভা, লোকসভা, মন্ত্রীসভা, নানান কমিটি, সাব-কমিটি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। দেখা গেল পরীক্ষাটা দারুণ সাকসেসফুল— পাবলিক খুব খুশি! তাহলে অন্যান্য কাজে নয় কেন? পুলিশ, স্বাস্থ্য, পূর্ত, কৃষি, বন— এইসব জায়গাতেও তো এঁদের ইমেজ কাজে লাগানো যায়! এই কারণেই আট মাস আগে বাছা হয়েছিল ইটকোনা জেলাকে। জেলা হাসপাতালের ডাক্তার করা হয়েছিল খ্যাপা মানিক নামে এক বাউলকে। আপনারা হয়তো ওঁকে চিনবেন না, স্থানীয়রা চিনবেন। বিখ্যাত না হলেও, মোটামুটি পরিচিত মুখ। হাওড়া- ইটকোনা প্যাসেঞ্জার ট্রেনে প্রতিদিন একতারা বাজিয়ে গান গাইতেন। চমৎকার গানের গলা, তার ওপর হোমিওপ্যাথি একটু-আধটু জানতেন। অযোগ্য হবেন না ভেবেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অভদ্রের মতো যে এত চ্যাঁচামেচি শুরু করবে কে জানত! অত্যন্ত বাজে ক্যাম্পেইন—উনি নাকি মানুষকে মারতে পারবেন, বাঁচাতে পারবেন না! শেষমেশ অপমানিত হয়ে খ্যাপা মানিক নিজেই চাকরিটা ছেড়ে দিলেন! ছেড়ে দিয়ে অবশ্য একটু বিপদেই পড়লেন। দেখলেন ইটকোনা প্যাসেঞ্জার ট্রেনের গানের স্লটটা আরেক জন বাউল দখল করে নিয়েছে। কিছুদিন স্টেশনে বসে গাইবার চেষ্টা করলেন। সেখানে রোজগারপাতি বিশেষ হল না বলে এখন আখড়াতেই বসে সময় কাটাচ্ছেন। রাগে-দুঃখে আর গানই গাইছেন না—একটু-আধটু হোমিওপ্যাথি করেই পেটের ভাত জোগাড় করছেন। মোটকথা মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের অতি-সক্রিয়তার ফলে, ইটকোনার ডেলি প্যাসেঞ্জাররা ওঁর গান আর শুনতে পাচ্ছেন না এবং জেলা হাসপাতালেও ডাক্তার নেই!

ভাগ্যক্রমে, লোকেদের বাঁচিয়ে তোলার দায়িত্ব পুলিশের নয়। ঠিক এই কারণেই, নিন্দুকেরা গোলমাল পাকাবার চেষ্টা করলেও প্রায় আট মাস হল যাত্রা- ব্যক্তিত্ব গজেন্দ্ৰ দত্ত পুলিশকর্তা হয়ে আছেন। এখন পর্যন্ত কোনো ঝামেলা হয়নি। গজেন্দ্র দত্তর যাত্রাদল খুব বড়ো নয়, তবে ইটকোনার আশেপাশে অনেক জায়গাতেই উনি পালা করেছেন। দু-এক বার সিনেমাতে ছোটোখাটো পার্টও করেছেন। স্থানীয়রা ওঁকে গজুবাবু বলে চেনেন— পপুলার ফিগার।

গজেন্দ্র দত্তর ডেপুটি হলেন আবদুল করিম। এককালে গজেন্দ্রবাবুর পালার জন্যে নিয়মিত গান বাঁধতেন। স্টেজে না উঠলেও, পেছনে বসে ওঁকে হারমোনিয়াম বাজাতে দেখা যেত। এখনও মাঝেমধ্যে গান বাঁধেন। তাই এ অঞ্চলে ওঁরও কিছুটা পরিচিতি আছে। তার ওপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। এ ছাড়া পুলিশ মন্ত্রী যিনি- তিনি নিজে একজন চিত্রতারকা। রূপালি পর্দার মাধ্যমে বঙ্গের সাধারণ মানুষের সঙ্গে (যার মধ্যে ইটকোনাবাসীরাও পড়েন) তাঁরও নিবিড় যোগাযোগ। অর্থাৎ এই পুলিশি ব্যবস্থাতে সবারই আস্থা থাকা উচিত। এই দু-জন পাবলিক ফিগার ছাড়া, ইটকোনা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আরও একজন আছেন। কনস্টেবল শিবদয়াল। আদতে বিহারের লোক, কিন্তু বহু বছর পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ফোর্সে। একসময় পুলিশি ট্রেনিং নিশ্চয় কিছু নিয়েছিলেন। কিন্তু এখন বিশাল ভুঁড়ি হয়ে যাওয়ায় নড়াচড়া করতে খুব অসুবিধা হয়- দৌড়োদৌড়ির কথা বাদই দিলাম।

একদল বুদ্ধিজীবী আছেন যাঁদের আর কোনো কাজ নেই— স্ট্যাটিস্টিক কপচানো ছাড়া! তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, মাত্র আট হাজার লোকের টাউনে এতগুলো লোককে সরকারি টাকায় পোষা হচ্ছে কেন! তাঁদের হিসেব, ভারতে এক লক্ষ লোক পিছু পুলিশের সংখ্যা মাত্র একশো ত্রিশ জন। তাহলে আট হাজার লোকের পেছনে এক জন পুলিশ থাকলেই তো চলত!

প্রথমত এইসব বুদ্ধিজীবীরা অঙ্ক জানেন না। ওঁদের স্ট্যাটিসটিকস ঠিক ধরলেও সংখ্যাটা হওয়া উচিত ১.০৪, অর্থাৎ এক জনের বেশি। কিন্তু সে তর্ক থাক।দ্বিতীয়ত, তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন ইটকোনা কোনো টাউন নয়, জেলা। জেলাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিতে হবে। জেলার মাথায় থাকেন পুলিশ সুপার। তিনি তো আর একা ফাঁড়িতে বসে থাকতে পারেন না। সঙ্গে এক জন অন্তত ইনস্পেকটর মর্যাদার কারও থাকার দরকার। আবার ইনস্পেকটরের অধীনে কেউ থাকবে না— সেটা ও চলে না। বেশি না হোক অন্তত তিন জন সবসময়েই লাগবে।

এবার ইটকোনা জায়গাটা সম্পর্কে দু-চারটে কথা জানিয়ে রাখি। আগে এখানে বেশিরভাগ বাসিন্দারই জীবিকা ছিল চাষবাস। শিবমন্দির আর মসজিদ-এ দুটো বাদ দিলে পাকাবাড়ি বলতে ছিল একটাই— লাল রঙের রাজবাড়ি। বড়ো রাস্তা থেকে সেই বাড়ির ফটক পর্যন্ত একটা সরু গাড়ি যাবার রাস্তা ছিল। এখন অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সেই সরু রাস্তা ত্রিশ ফুট চওড়া হয়েছে। তিরিশ ফুটি সেই রাস্তার ডান-বাঁ দু-দিক থেকেই আরও বেশ কয়েকটা পাকা রাস্তা বেরিয়েছে। সেগুলোর গা-ঘেঁষে যে সব পাকাবাড়ি উঠেছে— তার সংখ্যা খুব একটা কম নয়। কয়েকটা কল-কারখানাও হয়েছে। নানান জীবিকার লোকেরা এখন ইটকোনায় থাকে। এ ছাড়া আরও একটা রূপান্তর হয়েছে। এখন এটা খানিকটা কলকাতার মতো। যত না লোক এখানে বাস করে, তার অনেক বেশি লোক দিনের বেলায় আসে কাজকর্ম বাজারহাট সারতে। সেই ফ্লোটিং জনসংখ্যার হিসেব কেউ জানে না! এটুকুই বলা যায়— সেটা কম নয়। নইলে এখানে নিয়মিত তিনটে বাজার বসতে পারত না। জামাকাপড়, বাসনকোসনের দোকান, বিউটি পার্লার, ওষুধের দোকান, মিষ্টির দোকান, সেলুন, ব্যাঙ্ক, ইত্যাদি তো আছেই। কিছুদিন হল বিগ বাজারের একটা ছোট্ট ব্রাঞ্চও খোলা হয়েছে। অর্থাৎ অ্যাপ্লায়েন্স কিনতে ইটকোনার বাসিন্দাদের এখন আর বর্ধমান ছুটতে হয় না। আগের টিনের চালওয়ালা চায়ের দোকানগুলো এখনও টিকে আছে বটে, কিন্তু নতুন পয়সাওয়ালা লোকেদের চাহিদা মেটাতে দু-দুটো ভালো রেস্টুরেন্ট হয়েছে। শিক্ষার প্রসার বেড়েছে। আগে যেখানে একটা প্রাইমারি স্কুল টিমটিম করত, এখন সেখানে দু-দুটো মাধ্যমিক, একটা উচ্চ-মাধ্যমিক, আর একটা কলেজ। যাক সে কথা, যেটা বলতে চাই সেটা হল– বাইরে থেকে অনেক লোক এখানে এলেও, ইটকোনা এখনও খুবই নিরুপদ্রব শান্তিপূর্ণ এলাকা। মাঝেমধ্যে হনুমানের একটা দল এসে একটু-আধটু অশান্তি করে— সেই সময়টুকু বাদ দিচ্ছি।

।।২।।

পুলিশকর্তা গজেন্দ্র দত্তর সময় ভালোই কাটছিল। চাকরি নেবার আগে পুলিশ মন্ত্রীর সঙ্গে ওঁর একটা সমঝোতা ছিল যে, চাকরির জন্যে ওঁর যাত্রার কাজ কোনোমতেই ব্যাহত হবে না। যাত্রাই হল ওঁর প্রেম, আর পুলিশের কাজটা হল চাকরি। খুবই ন্যায্য অনুরোধ। মন্ত্রী নিজে একজন তারকা। এখন বয়সের জন্যে অত রোল পান না ঠিকই, কিন্তু বয়স্ক বহুলোকের স্বপ্নে তিনি এখনও স্বমহিমায় বিরাজ করেন। তিনি ভালো করেই জানেন পর্দা বা স্টেজের টান কী অপ্রতিরোধ্য আকার নিতে পারে! নিজেও সুযোগ পেলেই শুটিং করতে বেরিয়ে যান— যত কাজই থাকুক না কেন।

গজেন্দ্র দত্ত পালা লেখেন এবং অভিনয়ও করেন। নতুন একটা পালা ‘বউ পালালে বুদ্ধি বাড়ে (দ্বিতীয় পর্ব)’-এর স্ক্রিপ্ট নিয়ে ক-দিন ধরে খুব হিমশিম খাচ্ছেন। যাত্রার ফিনিশিংটাই হল আসল, আর তিনি শেষ অংশটা কিছুতেই বাগে আনতে পারছেন না। দু-কাপ চা এর মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে, তিন নম্বর কাপে চুমুক দেবার পর যখন কতগুলো জুতসই লাইন প্রায় মাথায় আসব আসব করছে, তখন কনস্টেবল শিবদয়াল হন্তদন্ত হয়ে এসে জানালেন, ‘আহার’ রেস্টুরেন্টের মালিক আনন্দ সিংকে কেউ খুন করেছে।

“তুমি কী করে জানলে খুন হয়েছে?” একটু বিরক্ত হয়েই অন্যমনস্ক গজেন্দ্ৰ

দত্ত প্রশ্ন করলেন।

“জনতা লোক বলছে।” শিবদয়াল বাংলা ভালোই বলেন, মাঝেমধ্যে এক- আধটা হিন্দি শব্দ এসে যায়।

“লোকেরা কী বলছে সেটা তো বড়ো কথা নয়, পুলিশ কী বলছে?”

“সেইজন্যেই তো আপনার কাছে এলাম স্যার।”

এবার গজেন্দ্র দত্তর সংবিৎ ফিরল। খাতা বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন, “করিম সাহেব কোথায়?”

“ওঁকে খবর দিয়েছি, উনি ওখানে চলে গেছেন।”

““ওখানে’ কোথায়?”

“রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টেই বডি পাওয়া গেছে।”

এখন আর বসে থাকা যায় না। “ঠিক আছে, ঠিক আছে, চা-টা শেষ করে আমি যাচ্ছি।” বলে খাতাপত্তর বন্ধ করে ড্রয়ারে ঢোকালেন।

এই আনন্দ সিং লোকটি এ অঞ্চলে মোটেই পপুলার নন, মানে ছিলেন না। এখন তো উনি ডেড। খুবই অভদ্র ব্যবহার করতেন লোকেদের সঙ্গে। কারোর জামাকাপড় দেখে যদি মনে করতেন- নট আপ টু দ্য স্ট্যান্ডার্ড, তাহলে তাকে রেস্টুরেন্টেই ঢুকতে দিতেন না। এ নিয়ে আগে কয়েক বার ঝামেলাও নাকি হয়েছিল। একবার তো ইটকোনা কলেজের প্রফেসর বিক্রম রায় ছাত্রদের নিয়ে পিকেট করেছিলেন! তাতে কিছুদিন একটু কাজ হয়েছিল। গজেন্দ্র দত্ত অবশ্য এই হিস্ট্রিটা জানতেন না। কয়েক দিন আগে বিক্রম রায় এসেছিলেন আনন্দ সিংয়ের নামে এফআইআর করতে। কারণ সেই একই- কলেজের এক গরীব ছাত্র রেস্টুরেন্টে জল খেতে গিয়েছিল, কিন্তু আনন্দ সিং জল দেননি। শুধু তাই নয়, ওঁর হুকুমে গেটের দারোয়ান ঘাড় ধরে ছেলেটাকে রেস্টুরেন্ট থেকে বার করে দিয়েছে!

এ নিয়ে এফআইআর করার কী আছে গজেন্দ্র দত্তর বোধগম্য হয়নি! বিনি পয়সায় জল বিতরণের জন্যে তো কেউ রেস্টুরেন্ট খোলেনি! তবে ঘাড় ধরে বার করে দেওয়াটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়েছে। তখন বিক্রম রায়ের কাছে শুনলেন— পাবলিক প্লেসে ঢুকে জল চাওয়ার অধিকার নাকি সবার আছে— ১৮৬৭ সালের সরাই অ্যাক্ট অনুসারে। যাইহোক, ‘দেখছি,’ ‘দেখব,’ করে তখনকার মতো প্রফেসরকে বিদায় করেছিলেন।

এইটেই হল এই কাজের ঝামেলা! অনেক আইন জানতে হয়। ল’ম্যানের মেজর ক্রিমিনাল অ্যাক্টের একটা পেল্লায় মোটা বই ফাঁড়িতে আছে ঠিকই, কিন্তু পড়ার ফুরসত কোথায়? বছরে দুটো করে পালা নামান— সেগুলো লিখতে, লেখার পরে দলের সবাইকে পার্ট শিখিয়ে রিহার্সাল দিতে দিতেই সময় চলে যায়! আইন নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠলে শিবদয়ালকেই জিজ্ঞেস করেন। বহু বছর ধরে ফাঁড়িতে আছে, অনেক কিছু দেখেছে শুনেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিবদয়ালই পাবলিক সামলায়। চা-টা শেষ করে গজেন্দ্র দত্ত যখন উঠবেন উঠবেন করছেন, আবদুল করিম এসে হাজির। খুবই উত্তেজিত।

“আপনার এক বার যাওয়া দরকার, মনে হচ্ছে খুন। গলা টিপে খুন করা হয়েছে!”

“কী সর্বনাশ! কিন্তু কে খুন করল?”

“সেটাই আমি এখানে আসার পথে ভাবছিলাম। রেস্টুরেন্টে বারো জন কাজ করে। কেউই ওঁকে পছন্দ করত না। মাইনে দিতে দেরি করতেন, অনেক সময় নানান অজুহাতে মাইনে কাটতেন, গালিগালাজ তো যখন-তখন করতেন।”

“তার মানে ওদের যে কেউ খুনটা করতে পারে?”

“তা পারে, কয়েক জন মিলেও করতে পারে। গতকাল দু-জন রাঁধুনি ওঁর ওপর এত রেগে গিয়েছিল যে বিরিয়ানিতে ঠেসে লঙ্কা দিয়েছিল। সেই বিরিয়ানি আবার অর্ডার করেছিল পাড়ার ক্লাব—রাত্রে মোচ্ছবের সময় খাবে বলে। মুখে তুলেই ঝালের চোটে তাদের প্রাণ যায় আর কী! তখনই নাকি ওদের মধ্যে কথা হয়েছিল, আনন্দ সিংকে এবার দেখে নেবে বলে।”

গজেন্দ্র দত্ত একটু চিন্তিত হলেন। ইয়ং ম্যান বলে কথা! খুনোখুনি করা তো ওদের কাছে জলভাত।

“তার মানেটা বুঝলেন তো গজুদা, আরও জনা পঞ্চাশেক সাসপেক্ট বাড়ল।”

করিম গজেন্দ্র দত্তকে গজুদা বলেই সম্বোধন করেন, যদিও ‘স্যার’ বলা উচিত। গজেন্দ্র দত্ত তাতে মাইন্ড করেন না। উনিও পুলিশ মন্ত্রীকে ‘বুলিদি’ বলে ডাকেন। এটাই এন্টারটেনমেন্ট জগতের দস্তুর।

“কম্পিটিশন অ্যাঙ্গেলটাও বাদ দেওয়া যায় না গজুদা।” করিম বললেন।

“তার মানে?”

“‘হার’ চলে যাওয়া মানে ‘বন্ধু’র বিক্রি বাড়ল। এখন সবাই ওখানেই খেতে যাবে।”

“গুড পয়েন্ট। এমনকী এটা ওরা করলেও আমি আশ্চর্য হব না। একদিন ওখানে আমি মাটন রোল খেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বড়োজোর পঁচিশ-ত্রিশ টাকা হবে। বিল দিয়েছিল পঞ্চাশ টাকার! ভাবতে পারো? একেবারে মার্ডার! এদিকে নাম দিয়েছে ‘বন্ধু’, কিন্তু আচরণ ক্রিমিনালদের মতো!”

“তাহলেই বুঝুন। সেখানেও গোটা বারো লোক কাজ করে। ওটা তো আবার কো-অপারেটিভ— সবাই নাকি মালিক! মানে আরও বারো জন যোগ করুন।”

“আচ্ছা ঝামেলা হল তো!” সংখ্যাগুলোকে মনে মনে যোগ করার চেষ্টা করতে করতে বললেন, “চলো, এক বার ক্রাইম সিনটা দেখে আসা যাক।”

।।৩।।

ফাঁড়ি থেকে ‘আহার’ রেস্টুরেন্টের দূরত্ব হাঁটা পথে মিনিট আটেকের বেশি নয়। আনন্দ সিংয়ের বড়ি পড়ে আছে ক্যাশ কাউন্টারের পেছনে-চিত অবস্থায়। দোকানের সবাই রেস্টুরেন্টে বসে উত্তেজিত হয়ে নানান আলোচনা করছে। গজেন্দ্র দত্ত ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়িয়ে ভিড় করে এল।

আবদুল করিমের সন্দেহটা মনে হয় ঠিক, কারণ গলার কালো দাগটা সুস্পষ্ট। তবে চোখের দেখা আর বাস্তব তো এক নয়। দু-বছর আগে গজেন্দ্র দত্ত একটা পালা লিখেছিলেন সেই থিম নিয়েই। নায়ক ভিলেনের গলা টিপে ধরেছিল, খুন করার জন্যে নয়—একটু শুধু রগড়ে দেবার জন্যে। কিন্তু তাতেই ভিলেন নেতিয়ে পড়ল। পুলিশ এসে নায়ককে ধরল। আসলে তার আগেই ভিলেনের বউ ভিলেনকে বিষ খাইয়েছিল। ভিলেন এমনিতেই মরত কয়েক মিনিটের মধ্যে। নায়কের গলা টেপাটা নিতান্তই একটা সাইড ইস্যু। আদালতে নিয়ে গিয়ে শেষে অবশ্য নায়ককে মুক্তি পাইয়ে দিয়েছিলেন। অরিজিনাল লেখা নয়, অম্বিকা অপেরার একটা পুরোনো পালা থেকে কিছুটা কপি করা। চলেছিল ভালো, সবাই বলেছিল খুব রিয়েলিস্টিক। সেই সাকসেসের পর থেকে সব পালাতেই একটুখানি ক্রাইম মশলা হিসেবে লাগাচ্ছেন। ক্রাইম ছাড়া তো জীবন হয় না। লোকে যেটা অ্যাপ্রিশিয়েট করে না সেটা হল যাত্রার মাধ্যমেই জগতকে চেনা ও বোঝা যায়— ওয়ার্ল্ড ইজ এ স্টেজ।

যাক গে, একটা পোস্ট-মর্টেম করা দরকার-ঠিক কীসে মৃত্যু হল সেটা জানতে হবে। হার্ট অ্যাটাক, বিষক্রিয়া- অনেক কিছুই তো হতে পারে! জেলা হাসপাতালে ডাক্তার নেই, নার্স ছুটিতে। থাকার মধ্যে আছেন এক কম্পাউন্ডার আর ঝাড়ুদার। তাদের দিয়ে চলবে না। ফাঁড়ির পাশের ওষুধের দোকানে এক ডাক্তার বসেন, নাম চিরব্রত মিত্র। রোগী-টোগি বিশেষ আসে না, বেশিরভাগ সময়েই চেম্বারে বসে পত্রিকা পড়েন। মনে হয় ওঁর হাতে সময় থাকবে পোস্ট-মর্টেম করার। প্রশ্ন হল, সরকারি আইনকানুন সেটা অ্যালাও করবে কি?

উপরওয়ালাকে ফোন করলেন গজেন্দ্রবাবু। শোনামাত্র তিনি নাকচ করে দিলেন।

“অসম্ভব। এটা করাতে হবে সরকারি করোনারকে দিয়ে। কিন্তু চট করে সেটা হবে না, কয়েক দিন আগে ডায়মন্ড হারবারের কাছে পলিটিক্যাল মারামারিতে ছত্রিশটা লাশ পড়ে আছে। সেগুলো দেখার পর এটাতে হাত দিতে হবে।”

“তার মানে তো স্যার অনেক সময় লাগবে।”

“তা লাগবে।”

“এর মধ্যে যদি খুনি পালিয়ে যায়?”

“পোস্ট-মর্টেমের সঙ্গে খুনি ধরার সম্পর্ক কী? খুন হয়েছে মনে করে তদন্ত চালান।”

“কিন্তু স্যার। খুন তো নাও হতে পারে।”

“তার মানে?”

“মানে স্যার, ধরুন উনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। আর কেউ আমাদের অপদস্থ করার জন্যে গলায় কালো কালির পোঁচ লাগিয়ে চলে গেছে। খুনের সন্দেহে যদি কাউকে গ্রেফতার করি, আর পরে প্রমাণিত হয় খুন হয়নি, সেটা তো ভারি বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।”

“তা অবশ্য ঠিক। এক কাজ করুন, আপনি তো মিনিস্টার ম্যাডামকে চেনেন— আপনাদের লাইনের লোক। তাঁকে বলে দেখুন।”

গজেন্দ্ৰ দত্ত বুলিদিকে বলামাত্র কাজ হল। পুলিশের কর্তার বিধান শুনে, বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, “এইসব আমলাদের দিয়ে আর চলে না—নিয়মের দাস! কাজে গতি না-আনলে পাবলিক মানবে কেন! কী পরিবর্তন এনেছি আমরা! এখুনি তোমার ওই চিরপ্রিয়কে স্পেশাল করোনার করে দিচ্ছি।”

“চিরপ্রিয় নয়, চিরব্রত। চিরব্রত মিত্র, এমবিবিএস।”

“ঠিক আছে, ওই নামেই অ্যাপয়ন্টমেন্ট লেটার যাবে। এখুনি ওকে কাজে লাগাও।”

“মাইনে?”

“মাইনে… ঠিক আছে, বলে দাও প্রতি লাশে চার হাজার টাকা পাবে।”

“মাসে মাত্র চার হাজার!”

“আঃ, মাসে নয়, লাশে। পিস মিল, দশটা কাটলে চল্লিশ হাজার।”

.

রেস্টুরেন্ট থেকেই গজেন্দ্ৰ দত্ত মোবাইলে ডাক্তার চিরব্রতকে ধরলেন। ডাক্তার তো আনন্দে আটখানা। ‘থ্যাংক ইউ দাদা, থ্যাংক ইউ। জগতের শ্রেষ্ঠ কাজটা আমাকে দিয়ে দিলেন।”

“আমি না, বুলিদি। কিন্তু শ্রেষ্ঠ কাজ কেন?” গজেন্দ্র দত্ত একটু আশ্চর্য।

“অ্যাডভান্টেজটা দেখুন। আমাদের মার খেতে হয় পেশেন্ট মারা গেলে। এখানে তো তার চান্সই নেই! মরা পেশেন্টকে তো নতুন করে মারা যায় না। ঠিক হ্যায়, আমি এখুনি কাজে লাগছি।”

এরপর আর ক্রাইম সিনে বসে থাকার অর্থ হয় না। আবদুল করিম আর গজেন্দ্র দত্ত অফিসে ফিরে এলেন। এখনও পর্যন্ত সাসপেক্ট লিস্টে আছে আহারের বারো জন কর্মী আর বন্ধু-র বারো জন এবং ইটকোনা ক্লাবের জনা পঞ্চাশেক ছেলে। অর্থাৎ মোট চুয়াত্তর জন। হঠাৎ গজেন্দ্র দত্ত বললেন, “করিম আমি করছিটা কী!”

“কী বলছেন গজুদা, তার মানে?”

“মানে হল, আমি তো নিজের পালা নিজেই ভুলে যাচ্ছি! এই যে,” বলে ড্রয়ার থেকে ম্যানাস্ক্রিপ্টটা তুলে দেখালেন।

“বউ পালালে বুদ্ধি বাড়ে-র দ্বিতীয় পর্ব?”

“এক্স্যাক্টলি। লোকটা বিয়ে করেনি?”

“করেছিল। তাঁকে খবর দেবার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু বাড়িতে পাওয়া যায়নি। রেস্টুরেন্টেই কে জানি বলছিল, দু-জনের সম্পর্ক নাকি ভালো ছিল না।”

“আনবিলিভেব্ল, এটাও তো বউ পালালে বুদ্ধি বাড়ে দ্বিতীয় পর্বের স্ক্রিপ্ট! তাড়াতাড়ি বউটাকে খুঁজে বার করতে হবে, দেখতে হবে এর মধ্যে কারও সঙ্গে তার ফস্টিনস্টি…”

“আমিও একবার ভেবেছিলাম সেটা। বউ-মাগিটাও তো কাউকে দিয়ে খুন করাতে পারে!”

“আঃ, ‘মাগি’ শব্দটা ব্যবহার কোরো না, লোকেরা হয়তো অফেন্স নেবে।”

“কেন গজুদা, এর থেকে অনেক বাজে কথা তো আমাদের নেতারাই ব্যবহার করেন।”

“সেটা ঠিক, কিন্তু গত পালায় ঠিক ওই কথাটা ব্যবহার করে পাবলিকের গালাগাল খেয়েছি মনে নেই?”

“তার কারণ আপনি ওটা কবিগুরুর মুখে বসিয়েছিলেন।”

“ওই যাঃ, তাই নাকি! আসলে ডায়লগটা জোরদার করতে গিয়ে… যাক সে কথা, তোমার পয়েন্টটা আমি মানছি— খুনের সঙ্গে মানি আর মাগি, সরি, মহিলারা প্রায়ই যুক্ত থাকে।”

“আরেকটা সাসপেক্ট বাড়ল গজুদা, যদি না এই প্রেমিক লোকটা আমাদের সাসপেক্ট লিস্টের মধ্যে একজন হয়।”

“ব্যাপারটা কী জানো করিম, সাসপেক্টের সংখ্যা মনে হয় বাড়তেই থাকবে। আনন্দ সিং লোকটা সবার সঙ্গেই বাজে ব্যবহার করত। একবার খাবার অর্ডার করার পর আমাকেও আধ ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিল। দেরি হচ্ছে কেন জিজ্ঞেস করতেই বলল, ‘দেরি আরও হবে, পছন্দ না-হলে চলে যেতে পারেন।’ আস্পর্ধা দেখো লোকটার! আমিও ছাড়িনি, প্রচুর কথা কাটাকাটি হয়েছিল ওর সঙ্গে। সেই ওর রেস্টুরেন্টে আমার শেষ খাওয়া। তারপর আর ওমুখো হইনি। ইন ফ্যাক্ট, এই পালা-তে ওর মতো একটা ক্যারেক্টারকে ভিলেন বানিয়েছি, শেষে ব্যাটাকে বিস্তর ঠ্যাঙানিও খাইয়েছি। একবার তো ভেবেছিলাম মেরেই ফেলব।”

এইসব কথার মধ্যে ডাক্তারের ফোন এল। প্রিলিমিনারি ফাইন্ডিং হল- শ্বাসরোধের ফলেই মৃত্যু। মৃত্যুর সময় নিশ্চিত করে বলা যাবে না, সম্ভবত গত রাত্রে। কিন্তু আরেকটু কাটাছেঁড়া করতে হবে ফাইনাল রেজাল্টের জন্যে।

.

গত রাত মানে হল বৃহস্পতিবার। ওই দিন রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয় সন্ধ্যা ছ-টা নাগাদ। কর্মচারীরা চলে যাবার পরেই তাহলে ঘটনাটা ঘটেছিল, অথবা ঘটেছিল কর্মচারীরা দোকানে থাকাকালীন— যদি খুনটা তারাই করে থাকে। প্রশ্ন, অন্য সাসপেক্টরা তখন কে কোথায় ছিল? আর প্রধান সাসপেক্টদের বাইরেও তো অজস্র সম্ভাবনা। আনন্দ সিং বহুলোকের সঙ্গেই দুর্ব্যবহার করেছে। ওর মতো লোককে খুন করার ইচ্ছে অনেকেরই থাকতে পারে। তিন জনের পুলিশ ফোর্স নিয়ে কি এর সমাধান সম্ভব!

।।৪।।

গজেন্দ্র দত্তের দিক থেকে চিন্তা করলে এটা অত্যন্ত বাজে একটা সময়। দু-দিন বাদে নতুন পালার রিহার্সাল শুরু হবে। অভিনেতা-অভিনেত্রী সব ঠিক হয়ে গেছে। শুধু একজন অভিনেত্রীর বর ট্র্যান্সফার হয়ে যাওয়ায় তাকে চলে যেতে হচ্ছে। কিন্তু সে একজন সাবস্টিটিউট দিয়ে যাবে। পালা লেখা প্রায় শেষ। রিহার্সাল চলবে দু-সপ্তাহ ধরে। তার পরেই পালা নামবে, বায়না হয়ে গেছে। আর এই অবস্থার মধ্যে এই খুন! মিরাকেল কিছু না ঘটলে এবারের যাত্রাপালা শেষ! গজেন্দ্র দত্ত ফিনিশড!

কিন্তু মিরাকেল ঘটে। ডাক্তার চিরব্রত ফিরে এসে সেটাই গজেন্দ্র দত্তর হাতে তুলে দিলেন। ডেড বডির পাশে পাওয়া গেছে একটা সাদা চক। মাই গড! একরাশ চিন্তা হুড়হুড় করে গজেন্দ্র দত্তর মাথায় ভিড় করল। কাদের পকেটে সাদা চক থাকে? এক্স্যাক্টলি, বাটলার ছাড়াও আরেকটা ইনোসেন্ট টাইপের লোক মাঝে মাঝে খুনি হয়, সে হল প্রফেসর। গজেন্দ্র দত্ত একজন প্রফেসরকে অন্তত জানেন, যিনি আনন্দ সিংকে দেখতে পারতেন না। তিনি হলেন অবহেলিতদের চ্যাম্পিয়ন প্রফেসর বিক্রম রায়। এই অধ্যাপকই নিশ্চয় রেস্টুরেন্ট বন্ধ হবার পর ওখানে ঢুকেছিলেন। একা বা সম্ভবত কয়েকটি ছাত্র নিয়ে চিরশত্রু আনন্দ সিংকে খতম করার উদ্দেশ্যে। শুধু একটা ভুলই করেছিলেন— ফিঙ্গারপ্রিন্ট মোছার জন্যে পকেট থেকে রুমাল বার করার সময় চকটা মাটিতে পড়ে গিয়েছিল!

চকের ওপর কি ফিঙ্গারপ্রিন্ট পড়ে? গজেন্দ্র দত্ত সেটা জানেন না। যদি পড়েও, সেটা নিশ্চয় নষ্ট হয়েছে। চিরব্রতই তো নিজে চকে হাত লাগিয়েছেন, এ ছাড়া শিবদয়াল, আর রেস্টুরেন্টের কয়েকটা লোকও নিশ্চয় সেটাকে ধরেছে।

চিরব্রতকে এ নিয়ে কিছু বললেন না গজেন্দ্র দত্ত। তিনি চলে যেতেই করিমকে বললেন, “আমাদের খুঁজে বার করতে হবে, বিক্রম রায় কাল বিকেল থেকে রাত্রি পর্যন্ত কোথায় ছিলেন। কোনো অ্যালবাই না থাকলে, কেস ক্লোজড।”

করিম বললেন; “গজুদা, আরও কিছু এভিডেন্স চাই। এরা সব ধুরন্ধর লোক। মানবাধিকার কমিশনের পেয়ারের পার্টি। তবে কেসটা ধরেছেন ঠিকই।”

“আজকে আর ওকে কোয়েশ্চেন করতে যাব না। তবে ফ্র্যাঙ্কলি বেশ রিল্যাক্সড বোধ করছি। পালাটা আজ রাত্রেই শেষ করে ফেলি। তোমারও তো দুটো গান বাঁধার কথা। তার কদ্দূর?’

“প্রায় মেরে এনেছি। আজ রাতেই সুর বাঁধা হয়ে যাবে। একটাতে বাউল সুর দেব। খ্যাপা মানিককে বলেছি- ও গেয়ে দেবে, টাকাকড়িও নেবে না।”

“গুড, আজ পালাটার কাজ শেষ হয়ে যাক, কালকে সকালে কলেজে গিয়ে বিক্রম রায়কে সারপ্রাইজ দেব।”

.

পরদিন অফিসে এসে গজেন্দ্রবাবু দেখেন ফাঁড়িতে একটা ভিড়। সবাই উত্তেজিত, শিবলাল তাদের ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে। কী ব্যাপার, সমস্যা হলে তো শিবদয়াল মোবাইলে ফোন করে! গজেন্দ্রবাবুর হঠাৎ খেয়াল হল, কালকে রাত্রে মোবাইল বন্ধ করে কাজ করছিলেন যাতে কেউ ডিস্টার্ব না করতে পারে। সকালে আর সেটা অন করা হয়নি।

গজেন্দ্রবাবু ঢুকতে-না-ঢুকতেই ছাত্ররা ছেঁকে ধরল। আজ সকালে ওঁদের প্রিয় শিক্ষক বিক্রম রায়কে কেউ গলা টিপে খুন করেছে।

“হোয়াট! আজ সকালে?”

“হ্যাঁ, ভোর বেলায় উনি দুধ কিনতে গিয়েছিলেন মন্টুদার দোকানে,” কল্লোল নামে এক ছাত্র বলল। “সেখানে আমিও দুধ আনতে গিয়েছিলাম। তারপর দু-জনেই একসঙ্গে বাড়ি ফিরি। স্যার থাকেন আমাদের পাশের বাড়িতে। ব্যাচেলর মানুষ, নিজেই চা-টা বানিয়ে খান। একটু বেলায় এক মাসি আসেন। তিনিই রান্নাবান্না করেন, ঘরদোর একটু গুছিয়ে দেন। সেই মাসি ঘরে ঢুকে দেখেন স্যার চেয়ারে বসে আছেন। ডাক দিয়ে সাড়া না পাওয়ায় ঠেলে তুলতে গিয়ে দেখেন স্যার ডেড। তখন ছুটে আমাদের বাড়িতে এসে খবরটা দেন।”

“কী সর্বনাশ!”

“হ্যাঁ, গজুদা, এর একটা বিহিত করতে হবে।”

ইতিমধ্যে আবদুল করিম এসে গেছেন।

“আমাদের ডাক্তারবাবু কোথায়? ওঁকে তো আবার লাগবে।” গজেন্দ্ৰ দত্ত করিমকে বললেন।

“এই তো দেখে এলাম চেম্বারে ঢুকছেন। কেন, কী হয়েছে?”

ব্যাপারটা সংক্ষেপে বলে বললেন, “যাও, এদের সঙ্গে ওঁকে নিয়ে প্রফেসরের বাড়ি যাও।”

.

গজেন্দ্র দত্ত মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। আনন্দ সিংয়ের মার্ডারে যে লোকটা সাসপেক্ট ছিল সে-ই খুন হয়ে গেল! অর্থাৎ একটা নয়, পর পর দু-দুটো মার্ডার ঘটে গেল এই শান্তিপূর্ণ ইটকোনায়। ছিদ্রান্বেষী পত্রপত্রিকাগুলো, যাদের একমাত্র কাজ হল প্রশাসনে আসা গায়ক, শিল্পী, খেলোয়াড়দের পেছনে লাগা— তারা আরও অক্সিজেন পেয়ে গেল। একবার মনে হল, এ দুটো খুনের পেছনে কি পত্রিকাগুলোর মালিকদের প্রচ্ছন্ন মদত আছে! এইসব ভাবতে ভাবতে ড্রয়ার থেকে চক-টা বার করে দেখতে লাগলেন গজেন্দ্র দত্ত। প্রথমে নজরে পড়েনি, এখন দেখলেন চকের নীচে একটু যেন কালো দাগ। আরেকটু পরীক্ষার পর সিদ্ধান্তে এলেন ভেতরের বেশ অনেকটা অংশে ওই কালো জিনিসটা ঢুকেছে। গন্ধ শুঁকে বোঝার চেষ্টা করলেন জিনিসটা কী— পোড়া তেল, না অন্য কিছু! তখনই ওঁর খেয়াল হল, নতুন একটা ফ্যাক্টরি হয়েছে চক তৈরির। কী একটা কারণে ফ্যাক্টরিতে এক বার ঢুকেও ছিলেন। তখন মনে হয়েছিল, এই কালিঝুলি মাখা মেশিন থেকে কী করে সাদা সাদা চক তৈরি হয়! তাহলে কি সেখানকার কেউ এর সঙ্গে জড়িত! এটা সম্ভাব্য একটা অ্যাঙ্গেল। কিন্তু এ ব্যাপারে এগোনোর আগে জানা দরকার কত জন লোক সেখানে কাজ করে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে খুব বেশি নয়। শিবদয়ালের সঙ্গে কথা বলে গজেন্দ্র দত্ত কিন্তু বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। অন্তত একশো জন কাজ করে ওই ফ্যাক্টরিতে। সেক্ষেত্রে তাদের যে কেউ খুনটা করতে পারে। তবে একটা প্রশ্ন থাকে— কালি লাগানো চক পকেটে নিয়ে সে খুন করতে যাবে কেন? কোনো সদুত্তর নেই! এটা কি সম্ভব যে, খুনি অতি ধুরন্ধর— পুলিশকে ঘোল খাওয়াতে চকে কালি লাগিয়েছে!

এর মধ্যে আবদুল করিম ফিরে এসেছেন।

“কী দেখলে?”

“দেখার কিছুই নেই, গজুদা। মনে হচ্ছে একই কেস। ডাক্তারবাবু এখনও পরীক্ষা করে যাচ্ছেন। তবে আমি বলি কী, নিশ্চয় একই লোক দুটো খুনই করেছে। খুনের মেথড এক— গলা টিপে খুন। অর্থাৎ খুনি হল এমন একজন যার আনন্দ সিং আর বিক্রম রায়- দু-জনের ওপরেই রাগ আছে।”

“এটা খুবই গুড পয়েন্ট, করিম। তার মানে খুনি একজন ছাত্র হতে পারে।”

“ছাত্র কেন গজুদা?”

“মোচ্ছবে যারা আনন্দ সিংয়ের বিরিয়ানি খেয়ে বেহাল হয়েছিল, তাদের তো অনেকেই ছাত্র ছিল— ছিল না? আর তাদের মধ্যে এমন কেউ নিশ্চয় ছিল যাকে বিক্রম রায় পরীক্ষায় ফেল করিয়েছিলেন!”

“অসম্ভব বলব না, কিন্তু আবার নাও হতে পারে গজুদা। বিক্রম রায়ের চরিত্রদোষ ছিল কিনা, সেটাও জানা দরকার।”

“আবার একটা ভালো পয়েন্ট বললে- লাভ-ট্রায়াঙ্গেল। কিন্তু আনন্দ সিং তাহলে খুন হল কেন?”

“পীরিতির কি কোনো সংখ্যা-সীমা থাকে? ধরুন, এক নারী তিন পুরুষ। তাদের একজন বেপরোয়া।”

“ইটকোনাতে কি সেরকম মানে চরিত্রহীনা কেউ আছে? এখানে তো সবাই গেরস্ত টাইপ।”

এইসব আলোচনার মধ্যে কখন শিবদয়াল এসে হাজির হয়েছে, দু-জনের কেউই টের পাননি।

“আছেন স্যার একজন, বহুত বাজে ম্যাডাম।”

“আঃ, শিবদয়াল, মহিলাদের সম্বন্ধে এরকম উলটোপালটা বদনাম দেওয়া উচিত নয়।”

“ঠিক আছে স্যার, দেব না।”

“তা, তোমার এই ম্যাডামটি কে?” আবদুল করিম জিজ্ঞেস করলেন। “মন্দিরা ম্যাডাম।”

“মন্দিরা গুপ্ত! যিনি সুলভ কো-অপারেটিভ চালু করেছেন?” গজেন্দ্র দত্ত উত্তেজিত গলায় প্রশ্নটা করলেন।

“হ্যাঁ স্যার। উনি অনেকের পেয়ারি বাই।”

“দ্যাটস ইট, করিম। একেবারে ক্লিয়ার।”

“কী ক্লিয়ার, গজুদা?”

“আরে বুঝতে পারছ না মোটিভটা? পিওর অ্যান্ড সিম্পল, টাকা। একেবারে আটঘাট বেঁধে নেমেছে। প্রথমে লাভার বিক্রম রায়কে দিয়ে এফআইআর করিয়ে ওর কম্পিটিটর আনন্দ সিংকে ফাঁসাতে চেয়েছে। আনন্দ ঝামেলায় জড়ালে ‘আহার’-এর খরিদ্দার কমবে, ফলে ওর নিজের রেস্টুরেন্টের ব্যাবসা ফুলেফেঁপে উঠবে। ‘বন্ধু’ রেস্টুরেন্ট তো সুলভ কো-অপারেটিভ-এর, তাই না?”

“তা ঠিক, কিন্তু কো-অপারেটিভের মালিক তো অনেকে!”

“আরে দূর, সবার শেয়ার কখনো এক হতে পারে! মেজরিটি শেয়ার নিশ্চয় এই মন্দিরার! এবার আমার কথাটা শোনো, এফআইআর স্ট্র্যাটেজি যখন কাজ করল না, তখন বিক্রম রায়কে দিয়েই আনন্দ সিংকে খুন করাল। কিন্তু তারপর খেয়াল হল, বিক্রম রায় ধরা পড়লে ওর ইনভল্ভমেন্ট আমরা বুঝে যাব। সেটা বন্ধ করতে অন্য কোনো লাভারকে দিয়ে বিক্রম রায়কে একইভাবে খুন করাল যাতে আমরা কনফিউজড হয়ে যাই। মানতেই হবে খুবই ক্লেভার প্ল্যান! অতএব, এই ক্যারেক্টারটিকে ইন্টারোগেট করা খুবই জরুরি।’

“দারুণ থিংকিং, গজুদা।” আবদুল করিম বললেন। “আর হরেদরে সেই একই ব্যাপার… মানি আর…” মাগি বলতে গিয়ে সামলে নিলেন, বললেন, “মেয়েছেলে।”

“মন্দিরা ম্যাডামের বাড়ির ঠিকানা জানো?” শিবদয়ালকে জিজ্ঞেস করলেন গজেন্দ্র দত্ত।

শিবদয়াল জানেন। খুব একটা দূরেও নয়।

“চলো করিম, শিবদয়াল কিছুক্ষণ ফাঁড়ি সামলাক।”

যাবার পথে ওষুধের দোকান থেকে অ্যান্টাসিড কেনার জন্যে থামলেন। চিন্তায় চিন্তায় ক-দিন হল অম্লভাবটা আবার চাগিয়ে উঠেছে গজেন্দ্র দত্তর। কিন্তু কী কিনবেন? মাইল্ড ওষুধগুলো আজকাল আর কাজ করে না। ভাগ্যক্রমে চিরব্রত ডাক্তার সেখানে ছিলেন।

“কোনটা কিনি বলুন তো? বেশ কড়া দেখে একটা ওষুধ বলুন।” নিজের সমস্যার কথা বলে জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তারকে।

“এইটে নিন,” ড্রয়ার থেকে একটা ওষুধের স্ট্রিপ বার করে দিয়ে বললেন চিরব্রত ডাক্তার। “দিনে একটা করে খাবেন।”

পয়সা দিতে গেলে নিলেন না চিরব্রত।

“না, না, এটা তো কোম্পানির দেওয়া ফ্রি-স্যাম্পল থেকে দিচ্ছি, এ দোকানের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্কই নেই। ওদিকের খবর কী, খুন দুটোর কোনো সমাধান হল?”

“মনে হয় একটা লিংক পেয়েছি। আপনি তো এখন আমাদেরই লোক, বলতে অসুবিধা নেই।” গজেন্দ্র দত্ত সংক্ষেপে মন্দিরা গুপ্তর ব্যাপারটা বললেন।

“ইন্টারেস্টিং! একটু আগেই তো উনি এখানে ওষুধ কিনতে এসেছিলেন, দেখা হয়ে যেত। কিন্তু এখন আর তো পাবেন না।”

“তার মানে!”

“আমাকে তো বললেন কলকাতা যাচ্ছেন। কিছু চাই কিনা জিজ্ঞেসও করলেন।”

“আপনি কি ওঁকে চেনেন ভালো করে?”

“ভালো করে আমরা কে কাকে চিনি গজুবাবু!” চিরব্রত ডাক্তার দার্শনিকের মতো বললেন। “চিনি রোগী হিসেবে।”

“ওঁর ক্যারেক্টার… মানে পুরুষদের ব্যাপারে…”

“কী করে বলি, নিজে যদি না জানি।”

“তা ঠিক।”

“আরেকটা কথা গজুবাবু, আমার লাশকাটার দুটো বিল কি আপনাকে পাঠাব?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, পাঠিয়ে দিন, টাকাটা রিলিজ করিয়ে দিয়ে দেব।”

“বিল আমার করাই আছে।”

“তাহলে দিন।”

চিরব্রত বিলটা দিয়ে বললেন, “একটু তাড়াতাড়ি টাকাটা পেলে ভালো হয়। মেস ছেড়ে দিয়ে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছি, একেবারে হাত খালি।”

 “বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন! বাঃ, কোথায়?”

“ইটকোনায় নয়, নবগ্রামে। এখানে বাড়ি ভাড়া নেবার মতো ক্ষমতা আমার নেই।”

“নবগ্রাম তো কাছেই— ট্রেনে কুড়ি মিনিট। যাক, ভাববেন না, দিন দুয়েকের মধ্যেই টাকাটা পেয়ে যাবেন।” বলে গজেন্দ্র দত্ত করিমকে নিয়ে অফিসে ফিরে এলেন।

.

থানায় ফিরে এসে দেখেন চার-পাঁচ জন অচেনা লোক ক্যামেরা নিয়ে ভিডিয়ো তুলছে আর শিবদয়াল হাত-পা নেড়ে কীসব বলছে। হঠাৎ গজেন্দ্র দত্তকে দেখতে পেয়ে শিবদয়াল বলে উঠল, “ওই তো স্যার এসে গেছেন, ওঁকে জিজ্ঞেস করুন।”

হাতে মাইক্রোফোন দেখেই গজেন্দ্র বুঝতে পারলেন টিভি চ্যানেলের লোক!

গজেন্দ্র দত্তকে দেখে এগিয়ে এসে মুখের সামনে মাইক্রোফোন ধরে একজন জিজ্ঞেস করল, “এই শান্তিপূর্ণ জায়গায় পর পর দুটো মার্ডার হয়ে গেল-এ ব্যাপারে আপনার কী বক্তব্য?”

“আমার কোনো বক্তব্য নেই,” বলে গজেন্দ্রবাবু কাটাবার চেষ্টা করলেন।

“বক্তব্য নেই মানে? তদন্ত চলছে না?” আরেক জনের প্রশ্ন।

“চলছে।”

“কোনো সাসপেক্ট?”

“এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করব না।” গজেন্দ্র দত্ত অন্যদিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢোকার চেষ্টা করলেন।

এমন সময়ে ছোকরা মতো একটা ছেলে পথ আটকে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল, “ওসব তাহলে থাক, আপনার পরের পালাটা কী গজুদা?”

“এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারি,” লাইনের প্রশ্ন শুনে গজেন্দ্র দত্ত খুশি হলেন, ““বউ পালালে বুদ্ধি বাড়ে’-র সেকেন্ড পার্ট।”

“কবে প্রথম শো হচ্ছে?

“পুজোর পর পরই। খুব জমাটি হবে এবার…” আরও দু-চার কথা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই বোঁ করে ঘুরে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছোকরা বলে উঠল, “ইটকোনার পুলিশকর্তার কাছে দু-দুটো খুন বড়ো কথা নয়। সে নিয়ে কথা বলবেন না, কিন্তু নিজের পালা নিয়ে অজস্র কথা বলতে অসুবিধা নেই… ক্যামেরায় সুদর্শন, রিপোর্টার বিক্রমাদিত্য, চ্যানেল সাড়ে এগারো।”

।।৫।।

ভালো ঘুম হল না রাত্রে। ভোর বেলায় করিমকে ফোন করলেন। “শোনো করিম, আজ অফিসে আমি একটু দেরি করে যাব, মন্দিরা গুপ্তকে জেরা করে তারপর পৌঁছোব।” বলেই মনে হল মন্দিরা গুপ্তর যা রেপুটেশন, একা একা যাচ্ছেন দেখে করিম আবার কিছু ভেবে না বসে! তাই যোগ করলেন, “তুমিও চলে এসো। শিবদয়ালকে বলো ফাঁড়ি সামলাতে।”

গজেন দত্ত যখন মন্দিরা গুপ্তর বাড়ির কাছাকাছি এসেছেন, তখন মোবাইলটা বেজে উঠল। করিমের ফোন, “গজুদা, সর্বনাশ!”

“কী সর্বনাশ! কোথায় তুমি?”

“আমি মন্দিরা গুপ্তর বাড়িতে, শি ইজ ডেড!”

“হোয়াট! ডেড?”

“হ্যাঁ, কেউ গলা টিপে ওকে খুন করে রেখে গেছে!”

“ও মাই গড! কী শুরু হয়েছে বলো তো? এ তো দেখছি সিরিয়াল কিলিং চলছে!”

.

তিন-তিনটে খুন। প্রথম জন একটা রেস্টুরেন্টের মালিক, দ্বিতীয় জন এক অধ্যাপক, তৃতীয় জন সুলভ কো-অপারেটিভের মাথা, যাদের একটা রেস্টুরেন্টও আছে। যোগসূত্র নিশ্চয় একটা আছে, কিন্তু সেটা যখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে- তখনই কেমন জানি তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! কে মন্দিরাকে খুন করল? কোনো ব্যর্থ প্রেমিক? কিন্তু তার আগে আরেকটা জিনিস পরিষ্কার হওয়া দরকার, মন্দিরার সঙ্গে প্রফেসর বিক্রমের সত্যিই কি কোনো সম্পর্ক ছিল? মন্দিরার প্রেমের ফাঁদে অনেকেই ধরা পড়তে পারেন, কিন্তু তাদের মধ্যে অধ্যাপক বিক্রম রায় কি ছিলেন? তিনি না থাকলে যে থিওরির ওপর ভরসা করে খুনি খোঁজা হচ্ছিল, সেটাই তো বরবাদ হয়ে যাবে! তবে একটা জিনিস যে বরবাদ হয়ে গেছে সেটা গজেন্দ্ৰ দত্ত বুঝলেন, তাঁর এবারের পালাটা ডকে উঠল। মিরাকেল কিছু না ঘটলে বায়নার টাকা ফেরত দিতে হবে। তার থেকেও ভয়াবহ পরিণতি হচ্ছে, এই খুনগুলোর সমাধান না করতে পারলে দুষ্টু সাংবাদিকগুলো আজেবাজে জিনিস ছাপিয়ে ওঁর চাকরিটা খাবে। অর্থাৎ ওঁর ভাত মারার বন্দোবস্ত প্রায় পাকা হবার দিকে এগোচ্ছে!

এই ভয়টা যে অমূলক নয়, সেটা দুপুর বেলাতেই গজেন্দ্র দত্ত বুঝতে পারলেন। মন্ত্রী বুলিদি নিজেই খুনগুলো নিয়ে উদ্‌বেগ প্রকাশ করলেন। চারিদিক থেকে চাপ আসছে—বিশেষ করে পার্টি অফিস থেকে। এভাবে চললে পরের ইলেকশনে সমস্যা হবে। এমনিতেই গজেন্দ্র দত্তকে চাকরিটা দেবার সময় নানান আপত্তি উঠেছিল। এখন যদি প্রমাণ হয় গজেন্দ্র দত্ত বাস্তবিকই একজন অযোগ্য ব্যক্তি, তাহলে পার্টিতে তারকা-মন্ত্রীর শত্রুরা মন্ত্রীর পেছনেও লাগবে। বিনোদন জগতে মন্ত্রী এখন প্রায় অচল। মন্ত্রিত্ব গেলে বাস্তবিকই ওঁর জীবনধারণের সমস্যা হবে। গজেন্দ্র দত্ত নাহয় যাত্রার পালা নিয়ে এখনও কিছুদিন বাঁচতে পারবেন- কিন্তু মন্ত্রীর কী হবে! ঠ্যালায় পড়লে সবাই ভাবে চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।

গজেন্দ্র দত্ত করিমের সঙ্গে পরামর্শে বসলেন।

“করিম, মনে হচ্ছে আমাদের দিন ফুরোচ্ছে। তাই ভাবছি, সব ছেড়েছুড়ে যাত্রাতেই ফুল-টাইম ফিরে যাব কিনা। তোমার গান দুটোর কী হল? সুর বাঁধা হয়ে গেছে?”

“হয়েছে গজুদা, এর মধ্যে খ্যাপা মানিককে দিয়ে এক বার গাইয়েও নিয়েছি।”

“খ্যাপা আছে কেমন, ওর-ও তো এখন চাকরি-বাকরি নেই।”

“খারাপ খুব একটা নয়, নতুন মোবাইল কিনেছে দেখলাম।”

“বাঃ, তার মানে হোমিওপ্যাথিতে কিছু পশার হয়েছে।”

“কিছু নয়, প্রচুর। লাইন করে লোকে বসে আছে। অত লাইন আমাদের চিরব্রত ডাক্তারের চেম্বারে কোনোদিন দেখিনি।”

“বল কি, তাহলে তো আমার পালায় দুটো লাইন পালটে দিতে হবে…”

“কোন দুটো লাইন?”

“ওই যে— যার নাই কোনো গতি, সে করে হোমিওপ্যাথি।”

“হোমিওপ্যাথির কথা বাদ দিন… প্রতিদিনই তো দেখছেন টেলিভিশনে… আমরা এখন সনাতন যুগে ফিরে আসছি- আয়ুর্বেদিক ভেষজ, টোটকা-তাবিজ, গ্রহদশা কাটানোর জন্যে রত্নধারণ, ইত্যাদিতে। আধুনিক যুগ, মানে অ্যালোপ্যাথির যুগ এখন খতম।”

“তা তো বুঝলাম, এখন যদি যাত্রার যুগকে বিদায় দিয়ে সবাই কবিগানে ফিরে যায়, তাহলে তো আমাদের সর্বনাশ!’

“কবিগান কি যাত্রার আগে হত?”

“কে জানে! কথাটা মনে এল তাই বললাম। চাকরি গেলে কী করব তাই ভাবছি…”

“কিন্তু গজুদা, এত তাড়াতাড়ি আমরা হাল ছাড়ব কেন, আরেকটু ভাবুন না! খুনি ঠিক ধরা পড়ে যাবে। আর শিবদয়ালের সঙ্গেও একটু পরামর্শ করা যাক। ওর তো অনেক এক্সপিরিয়েন্স আছে এ ব্যাপারে।”

.

শিবদয়ালকে পাওয়া গেল চিরব্রত ডাক্তারের চেম্বারে। বেচারার মন খুব খারাপ, দেশে বউয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারছে না বেশ কয়েক দিন ধরে। ডাক্তারের কাছে গেছে মন ভালো করার কোনো ওষুধ আছে কিনা খোঁজ করতে। এর আগেও শিবদয়ালকে চিরব্রত ডিপ্রেশনের ওষুধ দিয়েছেন। কিন্তু সেটা দেবার আগে এক বার জিজ্ঞেস করলেন, “হঠাৎ আবার মনখারাপ কেন?”

“ফোনটা বিগড়ে গিয়েছে।”

“সেটা সারিয়ে নিলেই তো হয়।”

“ওটা আর সারানো যাবে না। নতুন কুছ খরিদ করতে হবে।”

“তা কিনে নিলেই তো পারো একটা।”

“টাকা কোথায় পাব ডাক্তারবাবু, মাইনের তো এই ক-টা টাকা! ঘুষও নিই না।”

সেটা শুনে করিম ধমক দিলেন, “তুমি যেন কত ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির! এই সেদিনই তো দেখলাম একটা ফেরিওয়ালার ঘাড় ভেঙে কিছু বাগালে!”

“ওসব স্যার খুচরো টাকা। এই খুনের চার্জে মালদার কাউকে পাকড়ান না, চাপ দিয়ে বেশ কিছু আদায় হয়ে যাবে।”

“আইডিয়াটা মন্দ নয়,” করিম গজেন্দ্র দত্তকে বললেন।

“আপনারা স্যার বাইরে থেকে এই লাইনে এসেছেন, এই কায়দাগুলো ঠিক জানেন না। পুলিশের চাকরিতে এসব না করলে ভুখা মরতে হবে।” শিবদয়াল একটু সমর্থন পেয়ে যোগ করল।

“মালদার পার্টি পাব কোত্থেকে… মালদার পার্টি মানেই তো পলিটিক্যাল কানেকশন!”

“সেটা একটা সমস্যা,” করিম মানলেন।

এইসব যখন চলছে, চিরব্রত ডাক্তার বললেন, “আচ্ছা, খ্যাপা মানিককে ধরুন না, ও তো বেশ টু-পাইস কামাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।”

গজেন্দ্র দত্ত মনে মনে ভাবলেন, এটাও একটা ভালো আইডিয়া, তবে জুতসই অভিযোগ তো একটা খাড়া করতে হবে। মুখে বললেন, “দেখি।”

চিরব্রত ডাক্তার মুচকি হাসলেন।

.

ফিরে এসে গজেন্দ্র দত্ত, করিম আর শিবদয়াল আলোচনা করে খ্যাপা মানিককে ফাঁসাবার করার একটা ফন্দি বার করলেন। আদালতে সেটা কতটা টিকবে বলা শক্ত! আইডিয়াটা হল… বলা হবে খ্যাপা মানিক হল এরিয়ার কোকেন সাপ্লায়ার। যারা খুন হয়েছেন তাঁদের সবাইকেই কিছু নগদ কিছু ধারে ও কোকেন সাপ্লাই করত। কিন্তু কেউই ঠিকমতো টাকা দিচ্ছিল না, বরং ভয় দেখাচ্ছিল নেশার খোরাক না পেলে কোকেন বিক্রির কথা পুলিশের কাছে ফাঁস করে দেবে! এদের মুখ বন্ধ করতেই খ্যাপা মানিক খুনগুলো করেছে! অভিযোগটা জোরদার করার জন্যে খ্যাপা মানিকের আখড়ায় কিছু কোকেন রাখতে হবে। শিবদয়ালের ওপর সেটা জোগাড় করার ভার পড়ল। না-পেলে সাদা চকের গুঁড়ো রাখলেও ভয় দেখানোর কাজটা অন্তত চলবে।

.

আটটা নাগাদ যাত্রার রিহার্সাল শেষ হলে করিম শিবদয়ালকে নিয়ে খ্যাপা মানিকের ডেরার উদ্দেশে রওনা দিল। খানিক বাদেই গজেন্দ্র দত্তর ফোন বেজে উঠল। করিমের ফোন- খ্যাপা মানিক ডেড!

কী সর্বনাশ!

চিরব্রতকে ফোন করলেন, গজেন্দ্র দত্ত। “এবার খ্যাপা মানিক ডেড। এ কী ঝামেলা হচ্ছে বলুন তো! আপনি আমার সঙ্গে চলুন।”

‘কী বলছেন, কালকে তো ওকেই সাসপেক্ট করার কথা ভাবছিলেন আপনারা!”

।।৬।।

মানসিকভাবে বিধ্বস্ত গজেন্দ্র দত্ত গভীর রাত্রে গোয়েন্দা একেনবাবুকে ফোন করলেন। গোয়েন্দা একেনবাবুর গল্প উনি কলকাতার একটা ম্যাগাজিনে মাঝেমধ্যে পড়েছেন। পড়ে মনে হয়েছে একেনবাবু একজন ব্রিলিয়ান্ট ডিটেকটিভ। নিউ ইয়র্কে থাকেন–অনেক সময় পয়সাকড়ি ছাড়াও সাহায্য করেন। আর সবচেয়ে বড়ো কথা দূরে বসে রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেন।

.

নিউ ইয়র্কে তখন সকাল বেলা। সত্যি গুডম্যান এই একেনবাবু। অনেকক্ষণ ধরে পুরো ব্যাপারটা শুনলেন। তারপর বললেন, “ফলো দ্য মানি স্যার।”

“মানি?”

“হ্যাঁ স্যার, এই মৃত্যুগুলোতে কার লাভ হচ্ছে?”

“মৃত্যুতে লাভ!”

“হ্যাঁ স্যার। যখন কেউ মরছে, কার পকেটে টাকা আসছে?”

“বুঝলাম না, ঠিক কী বলছেন আপনি?”

“মড়া কাটছে কে?”

“চিরব্রত ডাক্তার!”

“এক্স্যাক্টলি স্যার। লাশ প্রতি তিন হাজার! রোগী না থাকলেও, টাকাটা তো বেশ রোজগার হচ্ছে!

“আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না!”

“সেইজন্যেই তো বলা হয় ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।”

“কিন্তু আমি ওকে ধরব কী করে?”

“সেটা আমি এখান থেকে বলতে পারব না। কিন্তু এর পর থেকে মড়া কাটার জন্যে ডাক্তারকে পয়সা দেওয়া বন্ধ করুন। খুনখারাবির জোয়ারটা অন্তত বন্ধ হবে।”

“কিন্তু সেটা কী করা যাবে, মন্ত্রী বুলিদির অ্যাপয়েন্টমেন্ট!”

“তাহলে এক কাজ করুন স্যার, শুধু প্রথম খুনটা কে করেছে— সেটা বার করুন। কারণ হয়তো একমাত্র ওই খুনটাই আপনাদের ডাক্তারবাবু করেননি।”

“কী করে বুঝলেন সেটা?”

“সেটা বুঝলাম স্যার, কারণ তখনও আপনাদের ডাক্তারবাবু লাশকাটার অ্যাপয়েন্টমেন্টটা পাননি।”

“এটা ঠিক বলেছেন।”

“আরেকটা জিনিস মাথায় এল স্যার, ডাক্তারবাবু বিবাহিত?”

“যদ্দূর জানি, না।”

“থাকেন কোথায়?”

“রোজগারপাতি তো বেশি ছিল না, মেসে থাকতেন। তবে ইদানীং একটা বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন। নবগ্রাম বলে একটা জায়গায় থাকেন।”

“একা, না কারোর সঙ্গে?”

“কারও সঙ্গে! কী আশ্চর্য! এটা তো আমার পালা! আনন্দ সিংয়ের বউকে ও পাওয়া যাচ্ছে না!”

“আপনারই যখন পালা স্যার, তাহলে দুয়ে দুয়ে এক করে ফেলুন।”

“থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ,” গজেন্দ্র দত্ত পুলকিত হয়ে বললেন, “এর পরের পালাতে আপনিই হবেন আমার প্রধান চরিত্র!’

“কী যে বলেন স্যার!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *