পার্বতীপুরের রাজকুমার
পার্বতীপুর স্টেশনে নেমেই সুজয়ের গাটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল৷ দু’চোখের কোন জ্বালা করতে লাগল৷ একটু একটু আঙুলের ডগাও ভোঁতা ভোঁতা লাগল৷ জুন মাসের দুপুর, গনগন করছে রোদ, তাও সুজয়ের হঠাৎ শীত লাগল৷ জ্বর আসবার সময়ে এই রকম হয়৷
স্টেশনটা ছোটখাটো, অতি সাধারণ৷ বাবা ট্রেন থেকে মালপত্র নামাচ্ছেন, মা আর দিদি একপাশে দাঁড়িয়ে বাক্স-প্যাঁটরা গুনছে৷ সুজয় একটু দূরে সরে গেল৷ ধ্যুৎ, বেড়াতে এসে জ্বর হবার কোনো মানে হয়! মা টের পেলেই বিছানায় শুইয়ে রাখবেন৷
কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে ওরা উঠল ওভারব্রিজে৷ মাঝামাঝি আসবার পর সুজয়ের মনে হল ব্রিজটা কোথায় যেন ভাঙা৷ তক্ষুনি কুলিটি বলল, ‘দেখবেন বাবু, সাবধান, সামনে দুটা কাঠ ভাঙা আছে৷’ সুজয় অবাক হয়ে গেল—ওই কথাটা হঠাৎ তার মনে হল কেন? সে তো ভাঙা জায়গাটা দেখতে পায়নি৷ দুখানা তক্তা নেই সেখানে, কেউ অন্যমনস্ক থাকলে গলে নীচে পড়ে যেতে পারে৷
স্টেশনের বাইরে একটিমাত্র নীল রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, আর কয়েকখানা সাইকেল রিকশা৷
বাবা বললেন, ‘ওই যে আমাদের জন্য গাড়ি পাঠিয়েছে৷’
বাবার বন্ধু রঞ্জিতকাকুর মামাবাড়ি পার্বতীপুরে৷ রঞ্জিতকাকুর মামারা একসময়ে এখানকার জমিদার ছিলেন৷ এখন তো আর জমিদারি নেই, কিন্তু সেই আমলের একটা প্রকাণ্ড বাড়ি আছে৷ বড়বড় দুটো দিঘি আর ফলের বাগান আছে৷ রঞ্জিতকাকু প্রায়ই পার্বতীপুরের এই বাড়ির গল্প করতেন তাই বাবা একদিন বলেছিলেন, ‘ব্যবস্থা করে দাও না, আমরা ওখানে কিছুদিন থেকে আসি৷’
রঞ্জিতকাকু বলেছিলেন, কোনোই অসুবিধে নেই৷ তাঁর এক মামা এখনো সেখানে থাকেন, অন্য মামারা থাকেন কলকাতায়৷ গ্রামে আর আসতে চান না৷ কিন্তু তাঁর মেজমামা এখানেই থাকতে ভালোবাসেন৷ তিনি এ বাড়ির দেখাশোনা করেন৷
রঞ্জিতকাকু তাঁর মেজমামাকে চিঠি লিখে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন৷ তিনি নিজেও সঙ্গে আসবেন ঠিক করেছিলেন, কিন্তু শেষমুহূর্তে আটকে গেছেন কাজে৷
একটা মস্ত বড় গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে নীল রঙের গাড়িটা৷ সুজয় বেশির ভাগ গাছই চেনে না, কিন্তু এটা অশ্বত্থ গাছ তা সে চিনতে পেরেছে৷ পার্বতীপুর স্টেশনের বাইরে এরকম একটা গাছ থাকবে তাও যেন সে জানত!
সুজয়ের একই সঙ্গে শীতও করছে, গরমও লাগছে৷
গাড়ি থেকে একজন লম্বা, শুকনো চেহারার লোক নেমে বিনীতভাবে হাতজোড় করে বলল, ‘মেজবাবু নিজে আসতে পারেননি৷ আপনাদের ট্রেনে আসতে কোনোরকম অসুবিধে হয়নি তো? দয়া করে গাড়িতে উঠে বসুন৷’
লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে সুজয়ের মনে হল লোকটা মিথ্যা কথা বলছে!
গাড়িটা স্টার্ট নেবার সময় প্রচুর শব্দ করল৷ এমন ফটফট দুমদাম শব্দ যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল৷ কয়েকটা বাচ্চা ছেলে গাড়িটার গায়ে হাত বুলোচ্ছিল, তারা ওই শব্দ শুনে দূরে সরে গেল ভয়ে৷
একটুখানি পাকা রাস্তার পরই গাড়িটা নেমে পড়ল মাঠের মধ্যে৷ সেইখান দিয়েই চলতে লাগল ধুমধামের সঙ্গে৷ গাড়িটা লাফাচ্ছে যেন ঘোড়ার মতন!
ড্রাইভার মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘গতবছর বন্যায় এদিককার রাস্তা সব ভেঙে গেছে তো৷ গাড়ি চালাবার উপায় নেই৷’
বাবা বললেন, ‘তাহলে গাড়ি আনলেন কেন? আমরা কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়ে না হয় হেঁটেই যেতুম৷ বেশি দূর তো নয়৷’
ড্রাইভার বলল, ‘না বেশি দূর নয়, এই মাত্র মাইল পাঁচেক৷ বাবা বললেন, ‘অ্যাঁ? রঞ্জিত যে বলেছিল স্টেশনের কাছেই বাড়ি!’ ড্রাইভার বলল, ‘হ্যাঁ, আগে খুব কাছে ছিল, এখন যে রেল স্টেশনটা দূরে সরে গেছে৷’
সুজয় বসে আছে ড্রাইভারের পাশে, তার এসব কোনো কথাই বিশ্বাস হচ্ছে না৷
মিনিট দশেক যাবার পরেই গাড়িটা ক্যাঁকর-কোঁ ভুররর-ভট শব্দ করে একেবারে থেমে গেল৷ ড্রাইভার নেমে গিয়ে, বনেট খুলে খুটখাট আরম্ভ করল৷
মা বাবার দিকে ফিরে বললেন, ‘আমি বলেছিলুম পুরী যেতে৷ শুনলে না তো আমার কথা!’
ড্রাইভার উঁকি মেরে বলল, ‘উপায় নেই, ঠেলতে হবে!’ সবাই নেমে পড়ল গাড়ি থেকে৷ রোদ একেবারে ঝাঁঝাঁ করছে, তবে গতকালই বোধহয় বৃষ্টি হয়েছিল, মাঠের এখানে-সেখানে জল জমে আছে৷ মা তো কাদার মধ্যেই পা দিয়ে ফেললেন৷ ড্রাইভার বলল, ‘সাবধান, দেখবেন, এখানে বড্ড সাপ-খোপের উপদ্রব৷ কালই একজনকে সাপে কেটেছে৷’
দিদি তাই শুনে এক লাফ দিল৷
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সাপে কেটেছে মানে সাপে কামড়েছে?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷’
‘কোথায়? এই মাঠে?’
‘মাঠে তো সাপের কামড়ে প্রায়ই এক-আধজন মরে৷ কাল একজন মরেছে আমাদের রাজবাড়িতেই৷’
মা বললেন, ‘স্টেশনটা তো বেশ কাছে৷ ফিরে গেলে হয় না?’
বাবা বললেন, ‘আহা, আগেই অত ভয় পাচ্ছ কেন?’
মাঠের সামনে একটা উঁচু বাঁধ৷ গাড়িটা অনেক কষ্টে ঠেলে তোলা হল ওপরে৷ সবাই দারুণ ভাবে হাঁপাতে লাগল৷ সুজয়ের শরীরটা কাঁপছে৷ ঠিক ম্যালেরিয়া রুগির মতো৷
ড্রাইভার বলল, ‘এবার উঠে বসুন, আর চিন্তা নেই৷’
গাড়ি চলতে শুরু করল আবার৷ সুজয়ের মনে হল গাড়িটা আসলে খারাপ হয়নি৷ লোকটি ইচ্ছে করে ঠেলাল ওদের দিয়ে৷ মাঠটা পার করে দিল এই ভাবে৷
বাঁধের ওপরে বেশ ভালো রাস্তা৷ একটু বাদেই সেটা গিয়ে মিশেছে পাকা রাস্তায়৷ তারপর আবার মিনিট দশেক চলার পর একটা মোড় এল৷ রাস্তার মাঝখানটা গোল করে বাঁধানো৷ তার সামনে, বাঁদিকে আর ডানদিকে তিনটে রাস্তা বেরিয়ে গেছে৷ গাড়িটা বাঁদিকে বেঁকতেই সুজয় বলে উঠল, ‘ডানদিকে৷’ মা, বাবা, দিদি সবাই তার দিকে তাকাল৷ ড্রাইভারও ঘচ করে ব্রেক কষে সুজয়ের দিকে চেয়ে রইল৷
সুজয় দৃঢ়ভাবে বলল, ‘এবারে ডানদিকে যেতে হবে৷’
ড্রাইভারটি কাঁচুমাচু ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ আমারই ভুল হয়ে গেছে৷ এদিকে তো বেশি আসা হয় না!’
পেছনের সিট থেকে দিদি মুখ ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কী করে জানলি রে?’
সুজয় কোনো উত্তর দিল না৷ দিদি তার ঘাড় ছুঁয়েছে৷ কিন্তু চমকে উঠল না তো! সুজয়ের তো এখন জ্বরে পুড়ে যাবার কথা৷ তবে কি তার জ্বর হয়নি?
রাস্তাটা আবার ডানদিকে বাঁক নিয়েছে৷ সেখানে মোড় ফেরবার আগেই সুজয় আবার বলে উঠল, ‘আমরা এসে গেছি৷’ বাবা বললেন, ‘বাঃ, পাঁচ মাইল দূর বলল যে!’ ড্রাইভার এবার রীতিমতন ভয়ে ভয়ে সুজয়ের দিকে চোরা চাহনি দিল৷
গাড়িটা ডানদিকে ঘোরার একটু পরেই দেখা গেল গাছপালার আড়ালে একটা বিশাল বাড়ি৷ জমিদার বাড়িকে গ্রামের লোক রাজবাড়ি বলে৷ সত্যি রাজবাড়ির মতন দেখতে৷ সামনে প্রকাণ্ড লোহার গেট, দু’পাশে দুটি গম্বুজ৷ গেটের পর সুরকি বিছানো পথ, তার দু’দিকে নানারকম ফুলের গাছ আর পাথরের পরি৷ তারপর বাড়িটা যেন দুর্গের মতন৷
গেট দিয়ে গাড়িটা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সুজয় বলল, ‘বাবা এই বাড়িতে আমি আগে এসেছি৷’
বাবা বললেন, ‘সে কি? তুই কি করে আগে আসবি এখানে? আমি নিজেই কখনো আসিনি৷’
সুজয় বলল, ‘এই জায়গাটা আমার খুব চেনা৷ এই বাড়িটাও৷’
দিদি বলল, ‘এরকম অনেক বাড়ি ছবিতে দেখা যায়৷ দেখলেই মনে হয় চেনা চেনা৷’
সুজয় বলল, ‘না, সেরকম নয়, এই জায়গায় আগে এসেছি৷’
মা বললেন, ‘আমরা কেউ আসিনি৷ তুই কি একা এসেছিস?’
গাড়িটা এসে থামল বাড়ির সামনে৷ থাক থাক সিঁড়ি উঠে গেছে৷ তারপর পেতলের বল্টু লাগানো একটা মস্ত বড় কাঠের দরজা৷ গাড়ির আওয়াজ পেয়েও কেউ বাইরে বেরিয়ে এল না৷
ড্রাইভারটি সুজয়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে রইল৷ সুজয় বলল, ‘কি হল, কাউকে দরজা খুলতে বলুন!’ সে চমকে গিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই৷’ তারপর সে তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে ধাক্কা দিল দরজায়! বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেবার পর দরজা খুলে একজন লাঠিয়াল বেরিয়ে এল৷
বাবা বললেন, ‘আশ্চর্য তো! লাঠিয়াল বাইরে পাহারা দেবার বদলে দরজা বন্ধ করে ভেতরে বসে আছে!’
লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মেজবাবু কোথায়?’
লোকটি বাবার দিকে চেয়ে রইল, কোনো উত্তর দিল না৷
সুজয় বলল, ‘এই লোকটি বোবা!’
ড্রাইভার প্রায় আঁতকে উঠল সুজয়ের কথা শুনে৷ ফ্যাকাশে মুখে বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন?’
এবারে মা আর বাবা খুব অবাক হয়েছেন! দিদি বলল৷ ‘সত্যি?’
ড্রাইভার বলল, ‘হ্যাঁ, রঘু কথা বলতে পারে না৷ এই রঘু, মালপত্তর তোল৷’
লোকটি লাঠি নামিয়ে রেখে দু’হাতে দুটো সুটকেস তুলে ভেতরে চলে গেল৷
ড্রাইভার বলল, ‘আসুন, ওপরে চলুন৷’
মা বেশ বিরক্ত হয়েছেন৷ বাড়িতে অতিথি এলে বাড়ির লোক কেউ অভ্যর্থনা করতে আসবে না?
রঞ্জিতবাবু অবশ্য বলেছিলেন যে তাঁর মেজমামা বিয়ে করেননি, বাড়িতে অন্য লোক আর বিশেষ কেউ নেই৷
দোতলায় অনেকগুলি ঘর তালাবন্ধ৷ সুজয় ড্রাইভারের আগে আগে এগিয়ে গেল৷ তারপর বারান্দা ঘুরেই ডানদিকের প্রথম ঘরটার দরজা ঠেলে খুলে ফেলল৷ যেন সে জানত যে এই ঘরটাই তাদের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে৷
শুধু তাই নয়, সুজয় এরপর বলল, ‘মা, তোমাদের এই ঘর, আমি আর দিদি থাকব তিনতলায়৷ চল দিদি, আমাদের ঘরটা দেখে আসি!’
বাবা বললেন, ‘কী ব্যাপার বল তো খোকা? তুই এসব কী বলছিস?’
সুজয় মৃদুমৃদু হাসতে লাগল, তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, তাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে৷
বাবা তার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ‘এই খোকা৷ কী হয়েছে তোর?’
সুজয় বলল, ‘কী জানি বুঝতে পারছি না৷ আমার সব কিছুই মনে হচ্ছে আগে থেকে জানা! এ বাড়িতে আগে আমি থেকেছি!’
মা বললেন, ‘ছেলেটা খেপে গেল নাকি? এ বাড়িতে ও আগে আসবে কী করে?’
ড্রাইভারটি অস্ফুটভাবে বলল, ‘ছোটবাবু! ছোটবাবু!’ তারপরেই সে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল!
বাবা তাকে ডেকে বললেন, ‘এই যে, আপনি চলে যাচ্ছেন—আপনার বাবুর সঙ্গে দেখা হল না—৷’
‘বাবুর তো শরীর খারাপ৷ উনি ঘর থেকে বেরুচ্ছেন না—’
‘ঠিক আছে৷ ওঁর ঘরেই আমরা যাব৷’
‘উনি বলেছেন সন্ধেবেলা দেখা করবেন৷ আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না৷ ডাকলেই রঘু আসবে৷’
‘ওই লোকটি তো বোবা! যারা বোবা হয়, তারা কালাও হয়৷ ডাকলে ও শুনবে কী করে?’
‘না না, শুনতে পায়৷ কথা বলতে পারে না৷ আপনারা বিশ্রাম করুন! আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি৷’
মা এবারে প্রকাশ্যেই বলে ফেললেন, ‘এ বাড়িতে আমার একটুও থাকতে ভালো লাগছে না বাপু৷ রঞ্জিতবাবু এ কোন জায়গায় পাঠালেন আমাদের?’
‘রঞ্জিত তো বলেছিল আমাদের খুব ভালো লাগবে৷ ওর মেজমামা আমাদের খুব খাতির করবেন৷ তিনি খুব আমুদে লোক৷’
‘কোথায়! তিনি তো একবার দেখাও করলেন না!’
‘শুনছি তো অসুস্থ৷ রঞ্জিতের চিঠির উত্তরে তিনি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে আমাদের আসতে বলেছেন৷’
‘তাতে তো জানাননি যে তিনি অসুস্থ! ওকি! ওকি! ছেলেটার কি হল?’
সুজয় তখন থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে৷ তার চোখ বুজে গেছে৷
বাবা ভয় পেয়ে গিয়ে বললেন, ‘খোকা, খোকা, অমন করছিস কেন?’
সুজয় বলল, ‘আমি ওপরে যাব৷’ তারপরেই সে এক দৌড় লাগাল৷ ‘ওকি? ওকি?’ বাবা, মা, দিদিও ছুটলেন তার পেছন পেছন৷
সুজয় দৌড়তে দৌড়তে উঠে এল তিনতলায়৷ সেখানে ড্রাইভার আর রঘু দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘরের দরজার সামনে৷ দু-জনেরই মুখ শুকনো৷ সুজয়কে দেখে তারা বেশ ভয় পেয়েছে৷
সুজয় হুকুমের সুরে বলল, ‘সরে যাও৷ দরজা খোলো৷’ ড্রাইভার হাত জোড় করে বলল, ‘ছোটবাবু! ছোটবাবু! আমার কোনো দোষ নেই!’
সুজয় এক ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল৷ একজন মাঝবয়সি লোক একটা সিল্কের ড্রেসিং গাউন পরে মাথা আঁচড়াচ্ছিল৷ আওয়াজ শুনে ফিরে তাকাল৷ লোকটির মাথায় টাক৷ মুখে কাঁচা-পাকা লম্বা দাড়ি৷
সুজয়কে দেখে লোকটিও বেশ ভয় পেয়ে গেল৷ এক-পা এক-পা করে পিছিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘এ কে? এ কে?’ সুজয়ের বাবা-মাও ততক্ষণে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ সুজয়ও তাঁদের দিকে ফিরে বলল, ‘এই লোকটা মেজবাবু নয়৷ এ একটা বদমাশ! আগে নায়েবের কাজ করত৷’
সিল্কের জোব্বা-পরা লোকটাও ড্রাইভারের মতন বলে উঠল, ‘ছোটবাবু! ছোটবাবু!’
সুজয় প্রায় লাফিয়ে গিয়ে লোকটার দাড়ি ধরে এক টান দিতেই সেই দাড়ি খুলে এল হাতে৷ নকল দাড়ি!
লোকটা বিকট সুরে চিৎকার করতে লাগল, ‘ওরে বাবা রে! মেরে ফেললে রে!! ভূত! ভূত!! ছোটবাবু ছেড়ে দাও আমাকে! আমি সব স্বীকার করছি!’
ড্রাইভার বলল, ‘ছোটবাবু ঠিকই বলেছেন৷ এ মেজবাবু নয়, এ ছিল আগে এ বাড়ির নায়েব৷’
রঘু আর ড্রাইভার এসে দুমদুম করে লোকটিকে ঘুসি মারতে লাগল৷ সে মাটিতে পড়ে কাতরাতে লাগল৷
এরপর আস্তে আস্তে সব জানা গেল৷ দিন দশেক আগে এ বাড়ির মেজবাবু হঠাৎ মারা গেছেন৷ অন্য ভাইরা সবাই কলকাতায় থাকেন৷ তাঁরা সে খবর জানতে পারেননি, ওই নায়েবই ইচ্ছে করে জানায়নি৷ তার বদলে সে নিজেই মেজবাবু সেজে এ বাড়ি থেকে সব জিনিসপত্র সরাবার মতলবে ছিল৷ বাড়ির মধ্যে বাইরের লোক বিশেষ কেউ ঢোকে না৷ ড্রাইভার আর রঘুকে সে ভয় দেখিয়ে নিজের দলে রেখেছিল৷
নায়েব লোকটি বদমাশ হলেও মোটেই সাহসী ছিল না৷ সুজয়কে দেখেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল—পরে সব কথা নিজেই স্বীকার করল৷
বাবা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘খোকাকে দেখে তোমরা সবাই ভয় পাচ্ছিলে কেন? ছোটবাবু বলছিলে কেন?’ নায়েব আর ড্রাইভার জানাল যে এ বাড়িতে যিনি বড়বাবু ছিলেন তাঁর এক ছেলে ছিল ঠিক সুজয়ের বয়সি, দেখতেও অবিকল একরকম৷ বছরখানেক আগে সে কলকাতা থেকে এখানে বেড়াতে এসে সাপের কামড়ে মারা যায়৷ সেই ঘটনার পর থেকেই বাবুরা আর এ বাড়িতে আসেন না৷ মেজবাবু একলাই এখানে থাকতেন৷ সুজয়কে দেখে আর তার কথাবার্তার ধরনে ওরা সবাই ভেবেছিল সেই ছোটবাবুই আবার ফিরে এসেছেন!
বাবা বললেন, ‘কেউ মরে গেলে আবার ফিরে আসে কি করে? তোমাদের এইটুকুও বুদ্ধি নেই?’
ড্রাইভার বলল, ‘ছোটবাবুকে তো পোড়ানো হয়নি৷ এ দেশের নিয়ম হচ্ছে, কাউকে সাপে কামড়ালে তার দেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে হয়৷ তাই করা হয়েছিল৷ লখীন্দর যেমন বেঁচে ফিরে এসেছিলেন, সেই রকম ছোটবাবুও নিশ্চয়ই ফিরে এসেছেন!
বাবা সুজয়ের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘যাঃ এ তো আমাদের ছেলে৷ এ তোমাদের ছোটবাবু হবে কী করে?’
কিন্তু সুজয় কী করে এখানকার রাস্তাঘাট, এই বাড়ির সব আগে থেকে চিনল? কী করেই বা জানল যে রঘু বোবা, আর নায়েবই মেজোবাবু সেজে আছে! কিছুই বোঝা গেল না৷ সুজয় নিজেও সে কথা বলতে পারল না৷
সুজয়ের শরীরে আর কাঁপুনি নেই৷ জ্বরভাবও ছেড়ে গেছে৷ আগের কথা তার আর কিছুই মনে নেই!
—