পার্ক রোডের সেই বাড়ি

পার্ক রোডের সেই বাড়ি

যদিও ঠিক তা নয়, তবু ও একা। বার্নপুরের পার্ক রোডের এই বাড়িতে চন্দনা নিঃসঙ্গ। এত নিরিবিলি নির্জনতা এখানে— এই পার্ক রোডের সাত নম্বর বাংলোয় যে, সারাটা দিন পাখির ডাক শুনছে চন্দনা, সারাটা দিন। আর সারা সকাল এবং দুপুর চড়ুইয়ের কিচির-মিচির। খড়খুটো-ঠোঁটে চড়ুইগুলো ফুড়ুৎ করে ঘরে এসে ঢুকছে চন্দনার ঘরেই—স্কাইলাইটের খুপরিতে তারা বাসা বাঁধবে। কিন্তু পার্ক রোডের সাত নম্বর বাংলোর ফিট্‌ফাট সাজানো ঘরে বাসা বাঁধা শক্ত। ঝুল-ঝাড়া বাঁশটা হাতে করে মালি ঘরে আসবে, বাহাদুর ফ্লোর ঝাঁট দিয়ে যাবে— যেন পালিশ ধরিয়ে দিয়ে যাবে সিমেন্টেও। আর তারপর, তখন সকাল আটটাই হোক, কি বেলা দশটা—কাচের দরজাগুলো সব বন্ধ হয়ে যাবে, জানলার সমস্ত শার্সি। অর্থাৎ, আলো আসবে, রোদ্দুর নয়; স্কাইলাইটের অল্প একটু ফাঁক দিয়ে পাখির ডাক, কিন্তু চড়ুই নয়। মাসি আসবেন এমন সময় একবার। তাঁর ঘাসের চটিতে শব্দ ওঠে না, উঠবে না কোনওদিনই। আসবেন, দাঁড়াবেন, ঘরের চারদিকে তাকাবেন যেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখে নিচ্ছেন। ফ্যানের সুইচটা অন্ করে দিয়ে একটি চেয়ারে বসতেও পারেন, নাও পারেন।

—তোর ঘরে সাফিসিয়েন্ট লাইট, চন্দনা! আমার ঘরটা সকালে তেমন আলোই পায় না! জিনিসপত্র বড় বেশি। আলমারিটা আর ড্রেসিং টেবিলটা যদি সরাতে পারতাম!

—সরাবেন? চন্দনা গ্রামার-বই থেকে চোখ তুলে হাসবার চেষ্টা করল। যদি এই হাসি এবং কথায় মাসি অন্তত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন এবং অ্যাপ্রোপ্রিয়েট প্রিপজিশনের আচমকা প্রশ্ন ক’রে না বসেন।

—সরাব? কোথায় সরাব! জায়গাই কই, বল? ড্রয়িংরুম আর ডাইনিং-রুমে ওসব রাখা যায় না—রাখা চলে না। আর, তোর এই ঘর— তাও তো অসুবিধে! না, এই বাংলোটায় বড় জায়গা কম!

মাসি যদি বসে থাকেন, এবার উঠে দাঁড়াবেন এবং ফ্যানের সুইচ অফ্‌ করতে ভুলবেন না। ক’ পা এগিয়ে এসে সোজা বাথ-রুমের দরজা খুলে দেবেন। আর খুলে দিয়েই সিঁটকে উঠবেন, ও পাশের দরজা বন্ধ কেন? ড্যাম্প্‌—উঃ, কী ড্যাম্প্‌ তোর বাথ-রুমে, চন্দনা! বেসিনে এত দাগ কিসের? বাথ-টবের জল ছাড়া নেই। ন্যাস্টি, ন্যাস্টি মেয়ে কোথাকার! য়ু মাস্ট লার্ন অল দিজ! নিট্‌নেস্ শিখতে হয়। কী তুমি ডোমেস্টিক সায়েন্স পড়েছ? তোমাদের ম্যাট্রিকে কিছু শেখানো হয় না! কিচ্ছু না!

চন্দনাও উঠে বাথ-রুমে এসে দাঁড়িয়েছে। তাড়াতাড়ি পাশের দরজাটা খুলে দিল। রোদে ভেসে গেল ঘর। গ্যারেজের সামনে ফুলগাছের তলায় জমাদার বসে বসে কলাই-করা মগে সম্ভবত চা খাচ্ছিল। তার পাশেই কুকুরটা শুয়ে।

—জমাদার!

—জি, মা! জমাদার ছুটে এল। মেমসাহেব বলার রেওয়াজ নেই এ বাড়িতে। তাই।

—সাফ কিয়া থা এহি গোসলখানা?

—বন্ধ থা দরওয়াজা।

—জলদি সাফ করো। আচ্ছাসে।

মাসি নাক ঢেকে চলে গেলে চন্দনা পাশের দরজা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। এখন একটুক্ষণ সে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। ক’ পা হাঁটতে পারে ঘাসে, বালিতে। যদিও পায়ে তার বাথ-স্লিপার, তবু এই মাটির ছোঁয়া সে পেতে পারে ইচ্ছে করলেই। কারণ, কিছুক্ষণ আর মাসি তাকে ডাকবেন না, এদিকে আসবেন না! তিনি এখন স্নানে চলে গেলেন। স্নান ক’রে যখন ফিরবেন, তখন তাঁর গায়ে সাবানের মিষ্টি একটা গন্ধ ভুরভুর করবে। চুলেও হেয়ার অয়েলের মৃদু সৌরভ। এবং তারপর পার্ক রোডের সাত নম্বর বাড়ি ভরে সেই আশ্চর্য সৌরভ একটু একটু ক’রে ছড়িয়ে পড়বে। প্যান্‌ট্রি থেকে ভেসে আসবে খুটখাট শব্দ, ঘিয়ের গন্ধ কিংবা পায়েসের। অথবা চিকেন সুপের। মালি ডেটল জল স্প্রে করবে ঘরে ঘরে। বাগান থেকে নিজের হাতেই রং মিলিয়ে ফুল তুলবেন মাসি। ক’টি ফুল তাঁর ঠাকুরের পটের সামনে রুপোর ছোট্ট থালাটিতে রেখে দেবেন এবং ধুপ জ্বালিয়ে দেবেন; দামি ধূপ— যার গন্ধ মাসির ঘর থেকে ড্রয়িংরুমে, ডাইনিং-হলেও ভেসে আসবে, ভেসে যাবে বারান্দাতেও; তারপর বাকি ফুল ডাইনিং টেবিলে এবং ড্রয়িং-রুমের ফুলদানিতে সাজিয়ে রেখে তবে মাসি বসবেন।

বসবেন বারান্দায়, বেতের চেয়ারে— যে চেয়ারে বসে ব্রেক্‌ফাস্ট শেষ ক’রে মেসোমশাই ফ্যাক্টরিতে চলে গেছেন। চন্দনাকেও পাশে বসতে হবে! যুগল ট্রে রেখে যাবে বেতের গোল টেবিলে। চা ঢেলে দেবে চন্দনা, রুটিতে মাখন লাগিয়ে দেবে; নয়তো ক’টা বিস্কুট পিরিচে ধরে দেবে। মাসি দেখবেন, চন্দনার কোনো খুঁতটি সার্ভ করার সময় ধরা পড়ে কিনা। মাসির চা— কিন্তু চন্দনার জন্যে এক পেয়ালা দুধ আর সন্দেশ।

পার্ক রোডের সাত নম্বর বাংলোয় এসে ওর চা খাওয়া বন্ধ হয়েছে। মাসি বলেন, এটা মেসোমশাইয়ের নিষেধ। অত ডেলিকেট চেহারার মেয়েদের স্বাস্থ্যের পক্ষে চা খারাপ। দুধ খাও—দুধ, ডিম। প্রোটিন খেলে ফ্যাট হবে। মেয়েদের পক্ষে ফ্যাট এসেন্‌শিয়াল। ওটা তো স্টোরেজ! বাচ্চাকাচ্চা হলে শরীর ভেঙে পড়বে না!

এই সময় সাইকেলের ঘণ্টি এবং সেই পিয়ন। সেলাম বাজিয়ে ডাক রেখে যায়। ডাকের দিকে তাকিয়ে বসে থাকার উপায় নেই চন্দনার, তা যতই কেননা দিদিদের চিঠির জন্যে মন ছটফট করুক। মাসি বলবেন, অত অধৈর্য কেন! চিঠি এলে বাড়িতেই এসেছে, পাবে ঠিক সময় মতন। এ ছাড়া আরও একটা কারণ আছে— যে কারণের জন্যে ডাকের দিকে তাকিয়ে থাকার উপায় নেই তার। মাসি ভাববেন, লজ্জা নেই তার ছিটেফোঁটাও।

কাজেই, অন্যদিকে হয়তো বাগানের দিকে, কিংবা ক’টা কাক যেখানে ঠোঁট ঠোকাঠুকি করছে, সেইদিকে তাকিয়ে মুখ বুজে ভীষণ অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকতে হয় চন্দনাকে। মাসি খাম ছেঁড়েন।

—সীতারা হাজারীবাগ যাচ্ছে এবার পুজোতে। মিঠুটা নাকি বড় দুষ্ট হয়েছে! মাসি চিঠি পড়তে পড়তে আপন মনে হাসেন আর বলেন।

চন্দনা মনে মনে ছটফট করতে থাকে। আর কি লিখেছে দিদি? আর কী আছে ওই চিঠিতে? পাইকপাড়ার সেই টিনের বাড়ির আর কী কী খবর? কার কার কথা!

মাসি তখনও চিঠি পড়ে পড়ে হেসে উঠছেন, মিঠু পরিমলকে ‘বুবু’ বলে ডাকে, চাঁদকে বলে তাঁদ। শয়তান, শয়তান হবে মেয়েটা! বুঝলি চন্দনা মিঠুটা ভীষণ পাজি হবে! কিন্তু এ ভাল নয়! ও বাড়ি ওদের বদলান দরকার! টিনের বাড়ি, কাঠের সিঁড়ি। কচি মেয়ে নিয়ে ও বাড়িতে কি কেউ থাকতে পারে? তুই লিখে দে তো চন্দনা সীতাকে লেখ— পরিমলকেও লেখ— আগামী মাসেই যেন বাড়ি বদলায়। আজই তুই লিখবি মনে করে— দুপুরেই। আমায় দেখিয়ে ফেলবি! মাসি থামলেন এবং শেষ পর্যন্ত চিঠিটা এগিয়ে দিলেন।

চিঠিটা নিল চন্দনা। কিন্তু অভিমানে চোখে জল এসেছে। দিদির চিঠি— তাকে নয়, মাসিকে। মিঠুর কথা— কিন্তু তাকে ডেকে শোনাচ্ছে না, মাসিকে শোনাচ্ছে। আর আশ্চর্য লোক জামাইবাবু! চন্দনা বলে কাউকে যেন তিনি কোনোকালেও চিনতেন না। কেউ নয় চন্দনা তার। চার মাস আগে এক কলম চিঠি দিয়েছিলেন— তারপর ভুলে গেছেন।

যদি মনে করা যায় চোখের জল লুকোতে, তবে তাই, নয়তো এ সময় মাসি একটি পান খান বলেই, চন্দনা আস্তে আস্তে উঠে ডাইনিং-হলে এসে ঢোকে। কত কম খয়ের, কত কুঁচি কুঁচি ক’রে কাটা সুপুরি এবং ক’টি পাতি-জর্দা দিলে মাসির মুখের মতন পান হবে, চন্দনার তা জানা হয়ে গেছে আজকাল। পানসাজার এই অবসরে মনটাকে একটু ছড়িয়ে দেয় চন্দনা। পাইকপাড়ার মণীন্দ্র রোডের সেই মাঠকোঠা বাড়ি। এতক্ষণ সে বাড়িতে রোদ পুরনো হয়ে গেল। কলতলায় এঁটো-কাঁটা জমতে শুরু করেছে। সুধাদি আর হিমাংশুদা অফিস বেরুচ্ছেন, উমা হাঁসফাঁস করছে আশাদির মেয়ে সামলাতে। উঠনে কাক নেমে এসেছে ভাঙা ডিমের খোলা ঠুকরোতে। দিদি বোধ হয় সেই একচিলতে রান্নাঘরেই মিঠুকে কোলে নিয়ে চার দফায় চায়ের জল চড়াচ্ছে। আর, জামাইবাবু নিশ্চয়ই দোতলার ঘরে খিল বন্ধ ক’রে লেখায় মত্ত। তবু যদি লিখত! হয়তো সারা সকালে একটি পাতাও লেখেনি—চার দফা চা, এক প্যাকেট সিগারেট শেষ হয়ে গেল। এর পর নাইতে নেমে দিদির ওপর যত চোটপাট। অমনি মানুষ জামাইবাবু! বাইরে থেকে মনে হয়, বড় শান্ত, নিরীহ; ঠোঁট বুঝি খুলতেই জানে না? কিন্তু চন্দনা জানে— বাড়িতে লোকটার জন্যে সর্বক্ষণ তটস্থ থাকতে হয়। শরীর নিয়ে সর্বক্ষণ খুঁত-খুঁত—মাসির চেয়ে এক কাঠি বেশি নোংরা বাতিক। তিন পরিবারের সেই বাড়িতে অত ঝক্‌মকে থাকা কি চলে! অত সাফসুফ! জামাইবাবু তা বোঝেন না। আভা যদি আনাজ ফেলে, তো উমা ভাতের মাড়, দিদি চায়ের পাতা। আর এতেই ওটুকু বাড়ির নর্দমা ভরে উঠবে জঞ্জালে। সেই জঞ্জাল ঠুকরোতে কাক আসবে, চড়ুই জুটবে। কখনও কখনও ছাগল অথবা কুকুরও ঢুকে পড়ে বাড়িতে। এ নিয়ে হৈহৈ আছে। উমা, আভা, পূর্ণিমা আর দিদির হাসাহাসি আছে— দু কলি গান, দু’চারটে ঠাট্টা ইয়ার্কি। কখনও-সখনও উমা-আভার হুল্লোড় কিংবা ঝগড়া। চন্দনাও সেখানে লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামত; একটা বেজে যাবার পরও কয়লা ভাঙত, শাড়ি-সেমিজ কাচত কলতলায় বসে, আর উঁচু গলায় উমার সঙ্গে স্কুলের কি কোনও সিনেমার গল্প করত। ঝগড়াও।

পাইকপাড়ার মণীন্দ্র রোডের সেই তিন পরিবারের বাড়িতে ভিড় ছিল, জঞ্জাল ছিল, দুর্গন্ধ বেরুত মেথর রোজ না এলে—ঝগড়াঝাঁটি ছিল। আর সেখানে লণ্ঠন জ্বালাতে হত কেরোসিনে, তার শিস উঠত, তেমন হাওয়া ছিল না নিচে, মশা ছিল ঝাঁকে ঝাঁকে; তবু—তবু সে বাড়ি, চন্দনার মনে হয়, সেই পাইকপাড়ার বাড়িই বেশ ছিল। পার্ক রোডের এই সাত নম্বর বাংলোর চেয়ে সেখানেই যেন হাত-পা ছড়িয়ে, মন এলিয়ে বেঁচে ছিল ও, বেশ ছিল!

আর এখানে—

পান সেজে মাসির কাছে ফিরে আসতে যতটুকু সময় গেল, তার মধ্যেই ডাক দেখা শেষ হয়েছে তাঁর। এবং মাসির মুখ দেখেই চন্দনা বুঝে নিয়েছে, আজকের ডাকে আবার একখানা চিঠি এসেছে।

গত দু মাস থেকে শুরু হয়েছে; প্রথমটায় তবু কখনও-সখনও আসত, এখন প্রায় রোজই। যত আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের কলকাতা, বর্ধমান, দিল্লি, পাটনা, লক্ষ্ণৌ সব জায়গা থেকে চিঠি আসতে শুরু হয়েছে। মাসিই বাধ্য করেছেন। বিয়েটা চুকিয়ে তিনি হাত পরিষ্কার ক’রে ফেলতে চান। কেননা তাঁর শরীর ইদানীং খারাপ যাচ্ছে ভীষণ। একটা আশঙ্কা এবং নিরাশা ভর করেছে তাঁর মনে। যত দিন আছেন, যত দায়িত্ব— এমন অনেক দায়িত্ব আছে, যা তিনি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছেন— সব ঠিকঠাক পালন ক’রে যেতে চান। এখানে, এ বিষয়ে তিনি নিজের একটিমাত্র ছেলে এবং বোনঝি, ভাশুর-পো, ভাশুর-ঝির মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখতে চান না। রাখেন নি কখনও।

এ বিষয়ে তাঁর গর্ব আছে। স্পষ্ট মুখে তিনি তা স্বীকার করেন। শিক্ষা এবং মনের উদারতায় এটা সম্ভব হয়েছে, সম্ভব হয়। শিক্ষা— ঠিক ঠিক পেলে, কি না হয় মানুষে! এম এ পাস করেছিলেন মাসি ফিলজফিতে। স্কুলের টিচারি করেছেন প্রথমে, পরে প্রফেসারি— শেষে বিয়ে। আর বিয়ে করেছেন যাঁকে— সেই স্বামীর গর্বে তিনি সতত গর্বিতা। স্বামীর মনের উদার পটে তিনি যেন ডানা মেলে উড়ছেন একটি পাখির মতন। ঘুমিয়ে আছেন প্রগাঢ় প্রশান্ত আকাশের তলায়। মেসোমশাই যদি এতটা ভাল না হতেন, মাসির ভাষায়, এত জেনারাস, জেন্টল, সেল্‌ফ-স্যাক্রিফাইসিং— তা হলে মাসির পক্ষেও হয়তো এমন নিঃস্বার্থ থাকা সম্ভব হত না! কাজেই মাসি সব সময় বলেন, সকলের কাছেই, শিক্ষা এবং ভাল পরিবেশে মানুষ সব হতে পারে— সব। এ বাড়িতে পার্ক রোডের সাত নম্বর বাংলোয় তাই সব সময় তুমি পরিচ্ছন্নতা পাবে, পাবে শালীনতা এবং আচার আচরণে শিষ্টতা। গোলমাল, কথা-কাটাকাটি, খিলখিল হাসি কিংবা চাঞ্চল্যের নামে চপলতার এখানে প্রশ্রয়ই নেই। এখানে শান্তি, এখানে চুপ, এখানে নিরিবিলি এবং একাকিত্ব।

তা বলে তোমার মনের স্বাধীনতায়—ঠিক যেখানে স্বাধীনতার প্রয়োজন, সেখানেও কেউ কখনও হাত দেবে না। মেসোমশাই মনের লিবার্টিতে হস্তক্ষেপ একেবারেই পছন্দ করেন না। বলতে গেলে, একটা যুগ তিনি বিলেতে কাটিয়েছেন; এখনও স্নান করেন রাত্রে, শীতে, গ্রীষ্মে— সর্ব সময়। সব সময় ঠিক ঠিক বেশভূষা ক’রে থাকেন। ডাইনিং টেবলের ম্যানার্স এখনও পালন ক’রে চলেছেন। এগুলো যেন তাঁর জীবনের অঙ্গ, একটা লব্ধ অভ্যাস। এবং তা তিনি রক্ষা করবেন। তেমনি রক্ষা করবেন বিলাতের সেই লিবারেল আবহাওয়া! এটা তাঁর মনের আভিজাত্য এবং সুখ।

এর ফলে মাসিকেও কোনো কোনো বিষয়ে বড় বেশি উদার হতে হয়েছে। আর, ডাকের একটা চিঠি এখন তিনি অনায়াসেই চন্দনার দিকে এগিয়ে দিতে পারেন।

—দিল্লি থেকে এসেছে। পড় চিঠিটা।

অতঃপর মাসি পান মুখে দিয়ে, ঘাসের চটিতে শব্দ না তুলেই সোজা তরকারির বাগানে চলে যান। চন্দনা নীল রঙের খামটা হাতে ক’রে একবার কেঁপে ওঠে। বুকটা ধুকধুক করে। আর কেন যেন অযথাই ক’বার চোখের পাতা পড়ে, দুটি চুল গালের কাছে উড়ে এসে শিরশিরিয়ে তোলে। পার্ক রোডের সাত নম্বর বাড়ি দুপুরে গাছগাছালি-আড়াল-করা পুকুরের মত ছায়াময়। নিটোল স্তব্ধতায় ঘেরা। অনেক অন্তরাল পেরিয়ে তবে আলোর হাল্কা আভাটুকু ঘরে আসতে পারে। এখানে চোখের পাতা চাইতে কষ্ট নেই। কেমন একরকম ঠাণ্ডা ঘরের বাতাস। ফ্যান ঘুরছে মাথার ওপর। অতি মৃদু একটানা শব্দ। যেন ঘরে একটা ভোমরা পাক দিয়ে দিয়ে উড়ছে। আর চন্দনার টেবিলে টাইমপিসের টিক্‌টিক্‌। ভারি পর্দার অতি মৃদু খস্‌খস্‌। নরম বিছানায় শুয়ে এলোমেলো হয়েও এ ঘরে এমন দুপুরে মনে হবে, চন্দনা বুঝি নেই। বকের পালকের মত সাদা দেওয়ালের গায়ে যে ছায়া, স্কাইলাইটের ঝোলানো দড়ির মধ্যে যতটুকু কাঁপন, ততটুকু অস্তিত্ব ফিরে পেতেও চন্দনাকে বুকে বালিশ টেনে অনেক— অনেকক্ষণ ছটফট করতে হয়। তারপর সে গন্ধ পায়— নিজের মাথার বালিশেই গন্ধ-তেলের সুবাস একটু একটু ক’রে নাকে যায়, ক্লোরোফিল দিয়ে দু দফা দাঁত মাজার স্বাদটুকুও যেন জিভের স্বাদে ফিরে আসে। আর গলা-বুক দিয়ে একটু বুঝি ট্যাঙ্কম পাউডারের ফিকে গন্ধ! নিজেকে ফিরে পেয়েও বালিশে মুখ গুঁজে থাকে চন্দনা। অন্ধকারেই মনটাকে আবার ছড়িয়ে দিতে পারে সেই মন, যা তার মাথার চুলের মতন একেবারে নিজস্ব, তার বুকের মতন সব-চোখের আড়াল-করা। চিঠিটার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই সময় ভাবা চলে। দিল্লির সেই চিঠির কথা। সেই ছেলেটির কথা। কী যেন নাম? বিকাশ—বিকাশ সেন। না, সেন নয়; সরকার। আগের ছেলেটি ছিল সেন; তার আগেরটি মজুমদার এবং তারও আগে ঘোষ, মিত্র ধর, পাল, চৌধুরী— এমন কি এক মুখার্জিও এসে গেছে। ইন্টার-কাস্টে আপত্তি ছিল না মাসির। কিন্তু যারা এসে চলে গেছে, তাদের জন্যে আজকের এই দুপুর নয়। আজকের দুপুরটুকু বিকাশ সরকারের। পার্ক রোডের সাত নম্বর বাড়িতে হয়তো শুধু আজকের দিনটিতেই সে বেঁচে থাকবে— একটি ঘরে, একজনের মনে। চন্দনা আঁচ করবার চেষ্টা করে ছেলেটি দেখতে কেমন হতে পারে! কার মতন! জামাইবাবুর মতন লম্বা, রোগা, আধ-ময়লা? বিশ্রী—বিশ্রী হবে তা হলে। কেননা, চন্দনা নিজে বেশ ফর্সা; এবং মাসি যাই বলুন, বেশ পুরন্ত। সে লম্বা নয়; ঠিক বেঁটে যে, তাও না—মাঝারি। গড়ন ভাল। হাত আর পা দুটি তো আশ্চর্য সুন্দর তার! পার্ক রোডের সাত নম্বর বাড়িতে এসে প্রত্যহ মুখে, হাতে পায়ে গ্লিসারিন দিতে হয়েছে। চটি পায়ে ঘুরতে হয়েছে সারা বাড়ি— কয়লা ভাঙতে হয় নি এবং শাড়ি-সেমিজ কাচতে হয় নি কখনও। কাজেই, লুকনো সৌন্দর্যটুকু ফুটে উঠেছে—ফুটে উঠছে দিন দিন। এখন, তার হাতে এই বালা, আঙুলে এই আংটি গলায় ওই সরু হার খুব সুন্দর মানায়! পাইকপাড়ার বাড়িতে তার কিছু ছিল না। কাজেই, মানাবার মতন সে সাজতে পারেনি। দিদির আটপৌরে শাড়ি পরেছে, যাতে কর্কশতাটুকু গায়ে ফুটেছে— রূপ ফোটেনি। বার্নপুরের পার্ক রোডের এই নিস্তব্ধ পুকুরে এতদিনে সব ফুটছে। ঠিক পদ্মফুলের মতন। আর এই নির্জনতায় তার মনও পাপড়ি মেলছে। বিকাশ সরকারের খুঁটিনাটি তাই ও ভাবতে পারে; ভাবতে পারছে। মনে হয়, ছেলেটি দেখতে ভালই হবে। অন্তত তাই হওয়া উচিত; যখন, যখন সে— অর্থাৎ বিকাশ সরকার জানাচ্ছে, মিলিটারিতে চাকরি তার। মিলিটারিতে চাকরি হলেও, ভগবান বাঁচিয়েছেন, যুদ্ধের চাকরি নয়। যুদ্ধই বা এখন আর কোথায়! মাইনে আড়াইশ। আড়াইশ— এক সময়ে চন্দনার ধারণা ছিল, অনেক, অনেক টাকা। এখন আর সে ধারণা নেই। কলকাতায়— বালিগঞ্জে চন্দনার যে মাসতুতো দাদা থাকে এবং আর এক দিদি— তাদের— শুধু তাদের দুজনের জন্যেই মাসিকে মাসে নগদ দেড়শ টাকা বাড়ি ভাড়া গুনতে হয়। তারা মাসির নিজের বলেই যে এত টাকা লাগে, তা নয়; তার কমে হয় না, হতে পারে না। বিকাশ সরকারের আড়াইশ টাকায় কি হবে? কি ক’রে চলবে? চন্দনা একটুক্ষণ ছটফট করলে। তারপর মনে হল, পাইকপাড়ায় জামাইবাবু সওয়া শ’ টাকা মাইনে পায় খবরের কাগজের বাজে চাকরিতে। তাদের তো চলছে। অবশ্য সে চলা যেন না চলাই। ধার করে, মাথা বিকিয়ে, দরকারের গয়নাগাটি বিক্রি ক’রে। তবু দেখ— দিদি হাসিমুখে চালিয়ে যাচ্ছে, জামাইবাবুও নির্বিকার। তাই, যদিও আড়াইশ টাকা তেমন ভাল নয়, তবু ওতেই টেনে-টুনে চালাতে হবে। আর বিকাশকে, চন্দনা ঠিক করে ফেলল, কখনই ও সিগারেটে টাকা উড়োতে দেবে না। তার চেয়ে তিন মাস অন্তর একটি করে পাঞ্জাবি দামি কাপড়ের একটি করে ধুতি তাঁতের ও কিনে দেবে। মাখন খাওয়াবে রোজ; আর অন্তত এক কাপ করে খাঁটি দুধ।

বিকাশ সরকারকে পছন্দ করে— যেন দোকানে একটি শাড়ি পছন্দ করে ও কার্ডবোর্ডের বাক্সে বন্ধ করে দাম চুকিয়ে পথে নামল। খুশি-খুশি মন— কেউ দেখছে না, জানছে না, কী ঐশ্বর্য আছে তার লুকানো আজ, এই দুপুরে।

চন্দনার ইচ্ছে ছিল না; তবু উঠতে হল। বাথ-রুমে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলে। ডাইনিং-হলে গেল, জল খেল এক গ্লাস। চুপি চুপি ক কুচি সুপরি দিল মুখে। তারপর নিজের ঘরে ফিরে এসে বসল। বসল টেবিলের কিনারায় বুক লাগিয়ে। খাতা টেনে নিলে। টাস্কটা করতে হবে এইবার— এই নিরিবিলি দুপুরেও।

ট্রান্‌স্লেশনের প্রথম লাইনে চোখ দিয়েই মনটা আবার পিছলে গেল— সরে গেল বই থেকে। ‘দিল্লির কুতুবমিনার একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ!” দিল্লি— দিল্লি— দিল্লি। চন্দনার মধ্যে আবার সেই শিরশির। বিকাশ সরকারই যেন একটি মিনার— চন্দনার মনে সেও যেন একটি স্মৃতিস্তম্ভ। আজকের দুপুরের মতন সেই মিনারের নিচে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে, প্রত্যাশায়, স্বপ্নে সে সব ভুলে গেছে। ভুলে যেতে বসেছে। মেসোমশাই কখন যে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে চলে গেছেন ফ্যাক্টরিতে— চন্দনা জানতেও পারেনি। এ সময় তাঁকে এক গ্লাস ঘোল করে দিতে হচ্ছে ক’দিন। চন্দনা ভুলে গেছে ঘোল করে দিতে; হয়তো যুগলই আজ ঘোল করে দিয়েছে এবং মাসি ঘুমিয়ে পড়েছেন— কেউ আর তাঁকে ডাকেনি।

চন্দনা উঠে পড়ল। এই ছায়া-ভরা ঘরে টাইমপিসের টিক্‌টিক্‌ আর পাখার একটানা মৃদু আওয়াজে সে কিছুতেই ট্রান্‌স্লেশনে মন বসাতে পারবে না! তার চেয়ে বারান্দাই ভাল। রোদে, পাখির কিচিরমিচির তবু— তবু বা মনটা বালিশের ওয়াড়ের মতন গন্ধ ছুঁয়ে থাকবে না।

বারান্দায় বেতের চেয়ার টেনে বসল চন্দনা। সকালের সেই টেবিল খাতা, ট্রান্‌স্লেশন, বই সাজিয়ে। মেঘ-মেঘ করেছে বাইরেও। হাওয়া ভিজে-ভিজে। বারান্দায় পাতাবাহারের টবগুলো থেকে কেমন একটা গন্ধ আসছে মাটির। বাগানে জবা গাছের ডাল-পাতা কাঁপছে, অপরাজিতার ডগায় ক’টি প্রজাপতি উড়ছে একভাবেই। একটি ঘুঘু এল, উড়ে বসল শিরীষ গাছের ডালে। মাঠে চড়ুই নেমেছে। ক’টি পায়রাও। শিমগাছের মাচায় কাক। একটা তিতিরও এসে জুটেছে এই দুপুরে মেঘলা ছায়ায়।

পার্ক রোডের সাত নম্বর বাংলোর পেছন দিকের বাগানে ওরা এমনিভাবেই রোজ ও দুপুরে আসে। কিন্তু এমন সুন্দর মনে হয় না রোজ। কোনও কোনও দিন হয়, কখনও কখনও।

জিভ দিয়ে একটা শব্দ করলে, কিংবা দু পা এগিয়ে হাততালি দিলেই এক্ষুনি সব এ উড়ে যাবে। ফর ফর করে পাখা নেড়ে পালিয়ে যাবে। অন্যদিন হলে চন্দনা উড়িয়ে দিত; আজ আর দিল না। বরং মাঠ থেকে বারান্দায় উঠে এল চড়ুই দুটি। গালে হাত রেখে বসে বসে তাই দেখল চন্দনা। যেন এটা আর পার্ক রোডের সাত নম্বর বাড়ি নয়, দিল্লির লোদি রোডের কোনও বাড়ি— যে বাড়িতে দুপুরে নিরিরিলি বসে কাক, চড়ুই, তিতির সব ও দেখতে পারে; সকলকে ও কাছে আসতে দিতে পারে।

ভিজে হাওয়া ছিল এতক্ষণ— এবার বৃষ্টি এল। বড় বড় ফোঁটা। কাক ডেকে ডেকে উড়ে গেল, পাখার ঝাপ্‌টানিতে পালক খসিয়ে পায়রা দুটিও পলাতক। চড়ুই কটি ফুলগাছের পাতার আড়ালে ঠাঁই নিলে, তিতিরটা বুঝি অনেক আগেই চলে। গেছে। মাঠ ফাঁকা।

সন্ধের পর চন্দনা যখন তার নিজের ঘরে টেবিলের কিনারায় বুক ছুঁইয়ে বসে, হিস্ট্রির পাতায় তার চোখ— তখন পাশের ডাইনিং-রুমে কথা হচ্ছিল। দুই ঘরের মধ্যকার ভারি পর্দাটা আধগোটানো। মাসিকে চন্দনা দেখতে পাচ্ছে না। মেসোমশাইকেও নয়। না দেখলেও বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। মেসোমশাই দুধের কাপ সামনে নিয়ে বসে আছেন। পাশের একটি চেয়ারে মাসি। আর মাসিই বলছেন— তাঁর কথা এমন ফাঁকা ঘরে বেশ স্পষ্টই শোনা যাচ্ছে। চন্দনা কান পেতে শুনছে সেই কথা।

—মিলিটারি স্টোর্স অ্যাকাউন্টসের চাকরি, তার আর প্রসপেক্ট কী? মাসির গলা।

—ঠিক জানি না। আছে বোধ হয় কিছু। মেসোমশাইয়ের মৃদু গলায় জবাব।

—আবার ‘বোধ হয়’ কেন! কি থাকতে পারে, ভাব—ভেবে বল। আমার ধারণা, কিচ্ছু নেই। বড় জোর আড়াই শ’ থেকে তিন শ’!

—ওইরকমই হবে!

—অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশনও কী এমন! ইন্টার্‌মিডিয়েট পাস। আই-এ পাস ছেলে, চাকরি করে উন্নতি করতে পারে— তার চান্স কোথায়?

মেসোমশাই চুপ। খস্ করে একটা শব্দ হল। চন্দনা বুঝতে পারলে, তিনি সিগারেট ধরালেন। এবং এবার উঠে সোজা বারান্দায় গিয়ে পায়চারি শুরু করবেন।

—চন্দনার পছন্দ হয়েছে নাকি। জিজ্ঞেস করেছ? মেসোমশাই এইবার উঠে দাঁড়াচ্ছেন।

—না, করি নি এখনও। আমার নিজের এতে মত নেই।

নেই। নেই। চন্দনা বইয়ের পাতা থেকে মুখ তুলে দেওয়ালে তাকাল। ঘড়িতে এবং ক্যালেন্ডারে। দেওয়ালে আর আলনায়। বিছানায়। কিছু নেই। কোথাও আর সে নেই। পার্ক রোডের সাত নম্বর বাড়ির এই ঘরটি আবার শূন্যতায় ভরে গেছে। বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি। বারান্দা ছড়িয়ে স্নান আলো। দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে কখনও কখনও। আর মাঠের ফাঁকে— অন্ধকারে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ে চলেছে একটানা। খুব আস্তে করে মাসিই হয়তো রেডিও খুলে দিয়েছেন, ন’ ভাল্‌ভের রেডিও। যেন গুন্‌গুন্‌ করে কেউ কাঁদছে… ‘ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরাণসখা বন্ধু হে আমার।’ এবং সন্ধ্যাবেলার ধূপ জ্বলছে। মাসি জ্বালিয়েছেন। তার গন্ধ।

চন্দনা যেন অনেক রাতে ঘুম ভেঙে দেখছে– অসাড় একটি স্টেশনে তার গাড়ি থেমে গেছে। সব নিঝুম, নিস্তব্ধ। চারপাশে অপরিচয়ের ঠাসবুনন পর্দা; কেউ নেই, কেউ আসছে না কারও পায়ের শব্দ নেই। শুধু একটানা ঝিরঝির বৃষ্টি।

রাত্রে খেতে বসে অনেক কষ্টে একটি মাছের টুকরো মুখে তুলেছিল চন্দনা। তারপর ওর প্লেটে মুরগির চার টুকরো মাংসের সঙ্গে গলার নালি এক টুকরো পড়েছে।

—আমি ভেবে দেখলুম, আই এ পাস ছেলের অ্যাকাউন্টসে কোনও প্রস্‌পেক্ট নেই। হওয়া অসম্ভব। না কি, চন্দনা কি বল তুমি? তোমার কী মত?

মুখ নিচু করেছে চন্দনা! প্লেটের চার টুকরো মাংসের মধ্যে সেই গলার অংশটুকুই ওর চোখে পড়েছে কেবল এবং মনে হচ্ছে— বেশ ভাল করে ওই গলাটুকু কাটা হয়েছে এবং তাতে মসলা, ভাল ঘি, দেড় টাকা সেরের টম্যাটো— সবই ঠিক ঠিক পড়েছে।

—না করে দি কি বল?

চন্দনা মুখ নিচু করে আস্তে— খুব আস্তে মাথা হেলাল।

বারোটা বেজে গেছে কখন। এখন বোধ হয় একটা। মশারির মধ্যে নরম বিছানায় শুয়ে চন্দনা চোখ খুলে রেখেছে। এত ঘন অন্ধকারে একা একা চোখ খোলা যায়। এই নিস্তব্ধতায় নিজের বুকে, গালে, চোখে নিজের হাত দেওয়া যায়। স্পর্শ করে নিজেকেই নিজে বোঝা যায়। বোঝানো যায়।

দিল্লির মিনার ইতিহাস-বইয়ের ছেঁড়া পাতার মতন উড়ে গেছে। বিকাশ সরকারের জন্যে তিন মাস অন্তর পাঞ্জাবি আর তাঁতের ধুতি কেনার সুখটুকু আর তার হাতে নেই। এখন তার হাতে— হাতের পাশের বালিশের কিনারায় বেডসুইচটা পড়ে আছে। শব্দ না করেও সে সুইচ টেপা যায় এবং মুহূর্তে এ ঘর আলো হয়ে উঠতে পারে। চন্দনা সেই আলোর মধ্যে ইচ্ছে করলেই শুয়ে থাকতে পারে। চাই কি, এখন কলম টেনে সে একটা চিঠি লিখতে পারে উমাকে চুপি চুপি। ভাই উমা, চিঠি লিখছি তোকে— দিদিকে তুই বলিস, আমায় যেন একবার নিয়ে যায় পাইকপাড়ার বাড়িতে। এখানে আমার ভাল লাগে না। কথা বলার কেউ নেই। একা শুই— একটি ঘরে। বড় ভয় করে।

ভয় সত্যিই করছে চন্দনার। অন্ধকারের জন্য নয়। একলা শুয়ে আছে বলে যে, তাও নয়। তবু ভয়। এই ভয় বাইরের বৃষ্টির মতন ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে। নির্জনতার, নিস্তব্ধতার এই ভয়; এবং আশ্চর্য কোন বেদনার। একাকিত্বের দুঃসহ মুহূর্তগুলির অবিরাম ঢেউ গুনে যাবার ক্লান্তি।

টাইম্‌পিস টিকটিক করে বেজে চলেছে। বেজে চলবে। একটু সেন্ট দিয়েছিল ব্লাউজের বুকে, সেই বিকেলে কাপড় ছাড়ার সময়— এখনও তার গন্ধ আছে— বালিশ তেমনি নরম, চুল তেমনি গন্ধ তেলে মাখামাখি, কানের দুলটি ফুটছে, গলার হার বুকে ব্লাউজে জড়িয়ে গেছে। ক ফোঁটা ঘাম কপালে গলায় জমে উঠেছে।

তবু ঘুমুতেই হবে চন্দনাকে। এবং ভোরে উঠতে হবে। যখন ফরসা হবে আকাশ। দরজা খুলে দিতে হবে বারান্দার। তখন বারান্দার কোণে কুকুরটা ঘুমুবে। কাক ডাকবে, মেহেদি-বেড়ার ওপর চড়ুইগুলি এসে জুটবে সেই সকালেই। পাখির ডাক শুরু হয়ে যাবে তখন থেকেই।

পাখির ডাক শুনে শুনে বেলা বাড়বে চন্দনার— যতক্ষণ না মাসি ওঠেন! এবং তার আগেই চন্দনাকে পড়ার টেবিলে বসতে হবে। খড়-কুটো ঠোঁটে চড়ুইগুলো ফুড়ুত করে উড়ে এসে ঢুকবে চন্দনার ঘরে, বাসা বাঁধার আয়োজন করতে।

কিন্তু পার্ক রোডের সাত নম্বর বাংলোর ফিট্‌ফাট সাজানা ঘরে বাসা বাঁধা সহজ নয়। ঝাল-ঝাড়া বাঁশটা হাতে করে মালি এসে ঢুকবে। বেলা আটটাই হোক, কি দশটাই হোক, কাচের দরজা, শার্সি বন্ধ হয়ে যাবে। আলো আসবে, রোদ্দুর নয়— পাখির ডাক ভেসে আসবে স্কাই-লাইটের অল্প একটু ফাঁক দিয়ে, চড়ুই নয়। পার্ক রোডের সাত নম্বর বাড়িতে খড়-কুটো দিয়ে বাসা বাঁধার জায়গা নেই, মাঠ-ঘাটের আলো আর ধুলোর আমন্ত্রণ নেই।

তাই কালকের ডাকে কিংবা পরশুর ডাকে আর-এক কোনও দত্ত অথবা বসু কিংবা দে-র চিঠি আসবে। মাসি সেটা পড়বেন। চন্দনা পাশে বসে থাকতে থাকতে উঠে আসবে পান সাজার ছুতো করে এবং সন্ধেবেলায় মাসি সারা দিনের খুঁটনো বিচারের পর রায় দেবেন।

চন্দনা জেনে ফেলেছে, অনেক গাছপাতা সরিয়ে— অনেক অন্তরাল, অনেক ফিল্‌টারেশনের পরও স্পেক্‌ট্রামের আভা নিয়ে যতদিন না কেউ আসছে— কোনও আলো, ততদিন পার্ক রোডের সাত নম্বর বাড়িতে এই ছায়াচ্ছন্ন স্নিগ্ধতায় তাকে চুপ করে বসে অপেক্ষা করতে হবে। এবং আরও নরম, আরও কোমল করতে হবে মুখ, হাত, পা সাবানের ফেনা আর গ্লিসারিন মেখে। আর, পাখির ডাক শুনে শুনে তার সকাল ও দুপুর কাটবে। কুল-কাঁটা বুকে নিয়ে রাত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *