পাপ
ভাই আপনাকে একটা ভয়ংকর পাপের গল্প বলি। পাপটা আমি করেছিলাম। নিজের ইচ্ছায় করিনি। স্ত্রীর কারণে করেছিলাম। স্ত্রীদের কারণে অনেক পাপ পৃথিবীতে হয়েছে। মানুষের আদি পাপও বিবি হাওয়ার কারণে হয়েছিল। আপনাকে এই সব কথা বলা। অর্থহীন। আপনি জ্ঞানী মানুষ, আদি পাপের গল্প আপনি জানবেন না তো কে জানবে। যাই হোক মূল গল্পটা বলি।
আমি তখন মাধবখালি ইউনিয়নে মাস্টারী করি। গ্রামের নাম ধলা। ধলা গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। নতুন বিবাহ করেছি। স্ত্রী সঙ্গে থাকেন। আমার বয়স তখন পঁচিশের মত হবে। আমার স্ত্রী নিতান্তই বালিকা। পনেরো-যোলমত বয়স। ধলা গ্রামে আমরা প্রথম সংসার পাতলাম। স্কুলের কাছেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে আমার টিনের ঘর। আমরা সুখেই ছিলাম। ফুলির গাছগাছালির খুব শখ। সে গাছপালা দিয়ে বাড়ি ভরে ফেলল। ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি ফুলি আমার স্ত্রীর ডাক নাম। ভাল নাম নাসিমা খাতুন।
বুঝলেন ভাই সাহেব, ধলা বড় সুন্দর গ্রাম। একেবারে নদীর তীরে গ্রাম। নদীর নাম কাঞ্চন। মাছ খুবই সস্তা। জেলেরা নদী থেকে ধরে টাটকা মাছ বাড়িতে দিয়ে যায়। তার স্বাদই অন্য রকম। পনেরো বছর আগের কথা বলছি। এখনো সেখানকার পাবদা মাছের স্বাদ মুখে লেগে আছে। শীতের সময় বোয়াল মাছ থাকতো তেলে ভর্তি।
ধলা গ্রামের মানুষজনও খুব মিশুক। আজকাল গ্রাম বলতেই ভিলেজ পলিটিক্সের কথা মনে আসে। দলাদলি মারামারি কাটাকাটি। ধলা গ্রামে এই সব কিছুই ছিল না। শিক্ষক হিসেবে আমার অন্য রকম মর্যাদা ছিল। যে কোন বিয়ে শাদীতে আদর করে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেত। গ্রাম্য সালিসীতে আমার বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হতো। দুই বছর খুব সুখে কাটলো। তারপরই সংগ্রাম শুরু হল। আপনারা বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ। গ্রামের লোকের কাছে সংগ্রাম।
ধলা গ্রাম অনেক ভিতরের দিকে। পাক বাহিনী কোন দিন ধলা গ্রামে আসবে আমরা চিন্তাই করিনি। কিন্তু জুন মাসের দিকে পাক বাহিনীর গানবোট কাঞ্চন নদী দিয়ে চলাচল শুরু করলো। মাধবখালী ইউনিয়নে মিলিটারি ঘাঁটি করলো। শুরু করলো অত্যাচার। তাদের অত্যাচারের কথা আপনাকে নতুন করে বলার কিছু নাই। আপনি আমার চেয়ে হাজার গুণে বেশি জানেন। আমি শুধু একটা ঘটনা বলি। কাঞ্চন নদীর এক পাড়ে ধলা গ্রাম, অন্য পাড়ে চর হাজরা। জুন মাসের ১৯ তারিখ চর হাজরা গ্রামে মিলিটারির গানবোট ভিড়লো। চর হাজরার বিশিষ্ট মাতবর ইয়াকুব আলী সাহেব মিলিটারীদের খুব সমাদর করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ভাই সাহেব, আপনি এর অন্য অর্থ করবেন না। তখন তাদের সমাদর করে নেয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সবাইর হাত-পা ছিল বাঁধা। ইয়াকুব আলী সাহেব মিলিটারীদের খুব আদর যত্ন করলেন। ডাব পেড়ে খাওয়ালেন। দুপুরে খানা খাওয়ার জন্যে খাসি জবেহ করলেন। মিলিটারীরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলো। খানাপিনা করলো। যাবার সময় ইয়াকুব আলী সাহেবের দুই মেয়ে আর ছেলের বউকে তুলে নিয়ে চলে গেল। আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। এখন গল্পের মত মনে হয়। কিন্তু এটা বাস্তব সত্য। আমার নিজের দেখা। সেই দিনের খানায় শরিক হওয়ার জন্যে ইয়াকুব আলী সাহেব আমাকে দাওয়াত। দিয়েছিলেন। নিয়ে যাবার জন্যে নৌকা পাঠিয়েছিলেন। আমি গিয়েছিলাম।
চর হাজরার ঘটনার পরে আমরা ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লাম। গজবের হাত থেকে বাঁচার জন্যে মসজিদে কোরআন খতম দেয়া হলো। গ্রাম বন্ধ করা হল। এক লাখ চব্বিশ হাজার বার সুরা এখলাস পাঠ করা হল। কি যে অশান্তিতে আমাদের দিন গিয়েছে ভাই সাহেব, আপনাকে কি বলব। রাতে এক ফোঁটা ঘুম হতো না। আমার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। সাত মাস চলছে। হাতে নাই একটা পয়সা। স্কুলের বেতন বন্ধ। গ্রামের বাড়ি থেকে যে টাকা পয়সা পাঠাবে সে উপায়ও নাই। দেশে যোগাযোগ বলতে তখন কিছুই নাই। কেউ কারো খেজ জানে না। কি যে বিপদে পড়লাম। সোবহানাল্লাহ।
বিপদের উপর বিপদ-জুলাই মাসের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনী দেখা দিল। নৌকায় করে আসে, দুই একটা ফুটফাট করে উধাও হয়ে যায়। বিপদে পড়ি আমরা। মিলিটারী এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালায়ে দিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর তখন আর কোন নাড়াচাড়া পাওয়া যায় না। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে অবস্থার পরিবর্তন হল। মুক্তিবাহিনী তখন শুধু আর ফুটফাট করে না। রীতিমত যুদ্ধ করে। ভাল যুদ্ধ। বললে। বিশ্বাস করবেন না, এরা কাঞ্চন নদীতে মিলিটারীর একটা লঞ্চ ডুবায়ে দিল। লঞ্চ ডুবার ঘটনা ঘটলো সেপ্টেম্বর মাসের ছাব্বিশ তারিখ। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল। ভাই সাহেব হয়তো শুনেছেন। বলা হয়েছিল শতাধিক মিলিটারীর প্রাণ সংহার হয়েছে। এটা অবশ্য ঠিক না। মিলিটারী অল্পই ছিল। বেশির ভাগই ছিল রাজাকার। রাজাকারগুলা সাঁতরে পাড়ে উঠেছে, গ্রামের লোকরাই তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস ভাই সাহেব। যুদ্ধ অত সাধারণ মানুষকেও হিংস্র করে ফেলে। এটা আমার নিজের চোখে দেখা।
এখন মূল গল্পটা আপনাকে বলি। সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখের ঘটনা। মাগরেবের নামাজ পড়ে বারান্দায় বসে আছি। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। ইংরেজীতে যাকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস। একা একা বৃষ্টি দেখছি। আমার স্ত্রী শোবার ঘরে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। তার শরীর খুব খারাপ। দুদিন ধরে কিছুই খেতে পারছে না। যা খায় বমি করে দেয়। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। কোন কিছু না ধরে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। ডাক্তার যে দেখাব সে উপায় নেই। ডাক্তার পাব কই? মাধবখালিতে একজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন–বাবু নলিনী কুমা’র রায়। ভাল ডাক্তার। মিলিটারী মাধবখালীতে এসে প্রথম দিনই তাকে মেরে ফেলেছে।
যে কথা বলছিলাম, আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছি। মন অত্যন্ত খারাপ।
বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগলো। একসময় প্রায় ঝড়ের মত শুরু হলো। বাড়ি-ঘর কাঁপতে শুরু করলো। আমি একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পুরানো নড়বড়ে বাড়ি। ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বিপদে পড়ব। কাছেই মোক্তার সাহেবের পাকা দালান। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে উঠব কিনা ভাবছি। তখন ফুলি আমকে ভেতর থেকে ডাকলো। আমি অন্ধকার ঘরে ঢুকলাম। ফুলি ফিস ফিস করে বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।
আমি বললাম, কি কথা?
ফুলি বলল, আমার কাছে আগে বোস। আমি বসলাম। ফুলি বলল, আমি যদি তোমার কাছে কোন জিনিস চাই তুমি কি আমাকে দিবে?
আমি বললাম, ক্ষমতার ভিতরে থাকলে অবশ্যই দিব। আকাশের চাঁদ চাইলে তো দিতে পারবো না। জিনিসটা কি?
তুমি আগে আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।
আমি তার কপালে হাত রেখে বললাম, প্রতিজ্ঞা করলাম। এখন বল ব্যাপার কি?
হারিকেনটা জ্বালাও।
হারিকেন জ্বালালাম। দেখি তার বালিশের কাছে একটা কোরআন শরীফ। আমাকে বলল, আল্লাহর পাক কালাম ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুমি কথা রাখবে।
আমি ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলাম। ব্যাপারটা কি? পোয়াতি অবস্থায় মেয়েদের মধ্যে অনেক পাগলামী ভর করে। আমি ভাবলাম এ রকমই কিছু হবে। দেখা যাবে আসল ব্যাপার কিছু না। আমি কোরআন শরীফে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম। তারপর বললাম, এখন বল আমাকে করতে হবে কি?
একটা মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে।
তার মানে?
একটা মানুষ আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তার জীবন রক্ষা করতে হবে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। কে তোমার কাছে আশ্রয় নিল?
ফুলি থেমে থেমে চাপা গলায় যা বলল তাতে আমার কলিজা শুকায়ে গেল। দুদিন আগে মিলিটারির লঞ্চডুবি হয়েছে। একটা মিলিটারী নাকি সাঁতরে কুলে উঠেছে। আমাদের বাড়ির পেছন দিকে কলা গাছের ঝোঁপের আড়ালে বসে ছিল। ফুলিকে দেখে বহেনজি বলে ডাক দিয়ে কেঁদে উঠেছে। ফুলি তাকে আশ্রয় দিয়েছে।
আমি হতভম্ব গলায় বললাম, দুদিন ধরে একটা মিলিটারী আমার বাড়িতে আছে? ফুলি বলল, হু।
সত্যি কথা বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি। এখন তুমি তাকে মাধবখালী নিয়ে যাও। মাধবখালীতে মিলিটারী ক্যাম্প আছে। আজ ঝড় বৃষ্টির রাত আছে। অন্ধকারে অন্ধকারে চলে যাও। কেউ টের পাবে না।
তোমার কি মাথাটা খারাপ?
আমার মাথা খারাপ হোক আর যাই হোক তুমি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছ।
আমি মিলিটারী নিয়ে রওনা হব, পথে আমাকে ধরবে মুক্তিবাহিনী। দুইজনকেই গুলী করে মা’রবে।
এই রকম ঝড় বৃষ্টির রাতে কেউ বের হবে না। তুমি রওনা হয়ে যাও।
ব্যাটা আছে কোথায়?
আস, তোমাকে দেখাই।
সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র কি আছে?
কিছুই নাই। খালি হাতে সাঁতরে পাড়ে উঠেছে।
আমি মোটেই ভরসা পেলাম না। অস্ত্র থাকুক আর না থাকুক মিলিটারী বলে কথা। জেনেশুনে এ রকম বিপদজনক শত্রু শুধুমাত্র মেয়েছেলেদের পক্ষেই ঘরে রাখা সম্ভব। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, হারামজাদা কই?
ফুলি আমাকে দেখাতে নিয়ে গেল। এমনিতে সে কোন কিছু না ধরে উঠে দাঁড়াতে পারে না। আজ দেখি হারিকেন হাতে গটগট করে যাচ্ছে।
রান্নাঘরের পাশে ভাড়ার ঘর জাতীয় ছোট একটা ঘর আছে। সেখানে চাল, ডাল পেঁয়াজ-টিয়াজ থাকে। ফুলি আমাকে সেই ঘরের কাছে নিয়ে গেল। দেখি ঘরটা তালাবদ্ধ। একটা মাস্টারলক তালা ঝুলছে। ফুলি তালা খুলল। হারিকেন উঁচু করে ধরলো। দেখি ঘরের কোনায় কম্বল বিছানো। কম্বলের উপর নিতান্তই অল্প বয়েসী একটা ছেলে বসে আছে। তার পরনে আমার লুঙ্গি, আমার পাঞ্জাবি। ঘরের এক কোনায় পানির জগ-গ্লাস। পাকিস্তানী মিলিটারীর সাহসের কত গল্প শুনেছি। এখন উল্টা জিনিস দেখলাম। ছেলেটা আমাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠলো। গুটিসুটি মেরে গেল। ফুলি তাকে ইশারায় বলল, ভয় নাই।
আমি হারামজাদাকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। এত কাছ থেকে আগে কোনদিন মিলিটারী দেখিনি। এই প্রথম দেখছি। লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরা বলেই বোধ হয় একে দেখাচ্ছে খুব সাধারণ বাঙ্গালীর মত। শুধু রঙটা বেশী ফর্সা আর নাক মুখ কাটা কাটা। আমি ফুলিকে বললাম, এর নাম কি?
ফুলি গড়গড় করে বলল, এর নাম দিলদার। লেফটেন্যান্ট। বাড়ি হল বালাকোটে। রেশমী নামের ওদের গায়ের একটি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব। যুদ্ধের পর দেশে ফিরে গিয়ে সে মেয়েটাকে বিয়ে করবে। রেশমী যে কত সুন্দর তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। অবিকল ডানাকাটা পরী। রেশমীর ছবি দেখবে? দিলদারের পকেটে সবসময় রেশমীর ছবি। বালিশের নিচে এই ছবি না রাখলে সে ঘুমুতে পারে না।
কারো ছবি দেখারই আমার কোন শখ ছিল না। আমার মাথা তখন ঘুরছে। একি সমস্যায় পড়লাম। ফুলি তারপরেও ছবি দেখালো। ঘাগরা পরা একটা মেয়ে। মুখ হাসি হাসি। ফুলি বলল, মেয়েটা সুন্দর কেমন, দেখলে?
আমি বললাম, হু।
এখন তুমি ওকে মাধবখালি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা কর। আজ রাতেই কর।
দেখি।
দেখাদেখির কিছুনা। তুমি রওনা হও।
মাধবখালিতো পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। নৌকা লাগবে।
নৌকার ব্যবস্থা কর। ওকে পার করার জন্যে আজ রাতই সবচে ভাল। ভয়ে বেচারা অস্থির হয়ে গেছে। পানি ছাড়া কিছু খেতে পারছে না।
আমি শুকনা গলায় বললাম, দেখি কি করা যায়।
ফুলি মিলিটারীর দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, তোমার আর কোন ভয় নাই। আমার স্বামী তোমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিবে। তুমি এখন চারটা ভাত খাও। মিলিটারী বাংলা ভাষার কি বুঝল কে জানে। সে শুধু বলল, শুকরিয়া বহেনজি। লাখো শুকরিয়া।
ফুলি ভাত বেড়ে নিয়ে এলো। তাকে খাওয়াতে বসলো। আমাকে বলল, তুমি দেরি করো না–চলে যাও।
.
আমি ছাতা হাতে বাড়ি থেকে বের হলাম। তখনো ঝুম বৃষ্টি চলছে। তবে বাতাস কমে গেছে। আমি দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি। কি করা যায় কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। স্ত্রীকে কথা দিয়েছি। আল্লার পাক কালাম ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা দরকার। ছেলেটার জন্যে মায়াও লাগছে। বাচ্চা ছেলে। এরা হুকুমের চাকর। উপরওয়ালার হুকুমে চলতে হয়। তাছাড়া বেচারা জীবনই শুরু করে নাই। দেশে ফিরে বিয়ে শাদি করবে। সুন্দর সংসার হবে। আবার অন্যদিকও আছে। একে মাধবখালি পৌঁছে দিলে ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়বে। নৌকার মাঝিই বলে দিবে। কোন কিছুই চাপা থাকে না। তারপর রাজাকার হিসেবে আমার বিচার হবে। দেশের মানুষ আমার গায়ে থু দিবে। পাকিস্তানী মিলিটারী শুধু যে আমাদের পরম শত্রু তা না, এরা সাক্ষাত শয়তান। এদের কোন ক্ষমা নাই।
আমি নৌকার খোঁজে গেলাম না। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে খবর দিলাম। রাত দু’টার সময় তারা এসে দিলদারকে ধরে নিয়ে গেল। দিলদার আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলল, বহেনজি। তারপরই চুপ করে গেল। আমার স্ত্রী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। দিলদারকে সেই রাতেই গুলী করে মারা হল। মৃত্যুর আগেও সে কয়েকবার আমার স্ত্রীকে ডাকল, বহেনজি। বহেনজি।
আমার স্ত্রী মারা গেল সন্তান হতে গিয়ে। একদিক দিয়ে ভালই হল। বেঁচে থাকলে সারাজীবন স্বামীকে ঘৃণা করে বাঁচতো। সে বাঁচা তো মৃত্যুর চেয়ে খারাপ।
.
বুঝলেন ভাই সাহেব, যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। যুদ্ধে শুধু পাপের চাষ হয়। আমার মত সাধারণ একটা মানুষ কতগুলো পাপ করলো চিন্তা করে দেখেন। রোজ হাশরে আমার বিচার হবে। আল্লাহ পাক পাপ-পূণ্য কিভাবে বিচার করেন, আমাকে কি শাস্তি দেন এটা আমার দেখার খুব ইচ্ছা।