পাপি সুইমিং স্কুল
আজ কয়েকদিন হল কাঞ্চনেরা একটা খুব বাড়িতে এসেছে। কাঞ্চনের বাবা যেখানে কাজ করেন, সেই কোম্পানিরই সাবেক আমলের কোয়ার্টার এটা। এত বড় যে, আজকাল কেউই তাতে থাকতে চায় না। চারদিকে বাগান, সেগুলো এখন জঙ্গল হয়ে গেছে। চওড়া বারান্দা ধুলোয় ছেয়ে আছে, দেয়ালে অতিকায় মাকড়শার জাল। পুরনো মরচে-ধরা লোহার গেট খুললে এক কিলোমিটার দূর থেকে তার আর্তনাদ শোনা যায়। শহর কলকাতার ঠিক মাঝখানে এরকম একটা বাড়ি, তেঁতুল ও বাদাম গাছের ছায়ার নীচে প্রাচীন একটা আধা-প্রাসাদ থাকতে পারে, সেটা সত্যিই ভাবা কঠিন।
তবু বাড়িটি আছে, এবং গত কয়েক মাস এখানে কেউ আসেনি। আগের বাসিন্দা যিনি ছিলেন, কাঞ্চনের বাবার উপরওলা, তিনি সাত মাস আগে রিটায়ার করার পর এই বাড়ি ফাঁকাই পড়ে ছিল। কাঞ্চনরা থাকত খুব ছোট একটা বাড়িতে। কাঞ্চনের বাবার অফিসের কর্তৃপক্ষ একদিন কার্তিকবাবুকে, মানে কাঞ্চনের বাবাকে বললেন, তুমি তো অনেকদিন বাড়ি বাড়ি করছ, এই কোয়ার্টারটায় যাও না। খুবই লম্বা-চওড়া, বেশ হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারবে।
কার্তিকবাবু এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন। এতদিন বড় অসুবিধার মধ্যে ছিলেন। যদিও প্রায় পোড়ো বাড়ি, তবু খোলামেলা আর খুবই বিশাল, একটু ভাঙাচোরা, তাতে কিছু আসে যায় না। তিন দিনের মধ্যে দুটো ট্রাক ভরতি করে মালপত্র নিয়ে, সঙ্গে ট্যাক্সিতে কাঞ্চনের মা, কাঞ্চনের কাকা কাঞ্চন আর কার্তিকবাবু নতুন কোয়ার্টারে চলে এলেন।
আসবার পরের দিনই কাঞ্চনের মা কার্তিকবাবুকে বললেন, দ্যাখো, তুমি আর ঠাকুরপো অফিস চলে গেলে এই শুনশান বাড়িতে ওইটুকু কাঞ্চনকে নিয়ে কেমন ভয় ভয় করে। একটা কুকুর এনে দাও, পুষি।
কার্তিকবাবু বললেন, কেন, এটা তো প্রায় অফিস-পাড়া। সামনের রাস্তায় সারা দুপুর হই-হই করে গাড়িঘোড়া যাচ্ছে।
কাঞ্চনের মা একটু রেগে গিয়ে বললেন, সে তো রাস্তায়, এত বড় নিঝুম পুরীর মধ্যে রাস্তার কোনও শব্দই আসে না। কেউ এসে আমাদের গলা টিপে মেরে গেলেও কেউ জানতে পারবে না।
এরপরে আর আলোচনায় না গিয়ে কার্তিকবাবু বললেন, ঠিক আছে, কুকুর এনে দিচ্ছি। কিন্তু বড় কুকুর তো আনা যাবে না, একটা কুকুরছানা নিয়ে আসছি, দুমাস ভাল করে পোষ, দেখবে বিরাট হয়ে যাবে।
কলকাতার গঙ্গার ধারে বিদেশি জাহাজ, শীতল বাতাস এবং মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্যে বিখ্যাত। কিন্তু এসবের চেয়েও অনেক জীবন্ত একটি চিত্র গঙ্গার ঘাটে প্রায়ই দেখা যায়। সে হল অজস্র কুকুরছানা, ছাগলের মতো দড়ি দিয়ে সেগুলি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা, তাদের কারও রং বাদামি, কেউ সাদা, কেউ কুচকুচে কালো, কিন্তু প্রত্যেকের লেজ ফোলা, ঝোলা কান, নরম ঠান্ডা কালো নাক আর ভোররাতের আকাশের মতো ফিকে নীল চোখ। তারা কেউ লাফাচ্ছে, কেউ আপন মনে খেলছে, কেউ বা পাশের সঙ্গীর সঙ্গে ছদ্ম লড়াই করছে। দু-একজন ঘুমোচ্ছে, একটু কুঁ কুঁ করে কঁদছে এক-আধ জন। এর বাইরে এপাশে ওপাশে একটি কি দুটি আছে যারা নরম কিশোর কণ্ঠে ঘেউ ঘেউ করে নিজেদের বীরত্ব জাহির করছে।
একদিন সকালবেলা গঙ্গার ঘাটে গিয়ে এই রকমই ঘেউঘেউকারী একটি বীর কুকুরছানাকে কার্তিকবাবু বেছে নিলেন। কালো রঙের কুকুরছানাটি, তার গলা ও পেটের নীচে ঝকঝকে সাদা, কার্তিকবাবু কাছে যেতেই সে পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে চিত হয়ে আম-আঁঠির ভিতরের কুষির মতো সাদা ও নরম জিব বার করে, জিবের ডগা দিয়ে বার বার জুতোর ফিতে ছুঁতে লাগল। কাঞ্চন সঙ্গে ছিল। সে বলল, বাবা, ও অমন করছে কেন?
কার্তিকবাবু বললেন, ও বলছে, আমাকে নিয়ে চলো, আমি তোমাদের।
এরা সবাই হল পাহাড়ি কুকুরের ছানা। একদল যাযাবর শ্রেণীর লোক বাচ্চাগুলো কলকাতায় নিয়ে আসে বেচার জন্যে। এই সাদাকালো কুকুরছানা, যার নাম ইতিমধ্যে কার্তিকবাবু মনে মনে রেখেছিলেন দাবা, তার মালিক একটু দূরেই একটা মেহগনি গাছের গুঁড়িতে মাথা রেখে অর্ধেক চোখ বুজে একটা বিরাট লম্বা বিড়ি খাচ্ছিল। সে হঠাৎ জোড়াসন হয়ে বসে বলল, বাবু, কুকুরটাকে নিয়ে যাও।
কার্তিকবাবু পাকা লোক। প্রথমে দামদর না করে কিছুতেই দুর্বলতা দেখাবেন না। ইতিমধ্যে কাঞ্চন কিন্তু কুকুরছানাকে কোলে তুলে নিয়েছে, তবুও কার্তিকবাবু যথাসাধ্য নির্লিপ্তমুখে জিজ্ঞাসা করলেন, কত দাম দিতে হবে?
তারপর শুরু হল এক অবিশ্বাস্য প্রতিযোগিতা। কুকুরওলা বলল, আটশো। হাজার টাকাই দাম, তোমার জন্যে দুশো টাকা কমিয়ে দিচ্ছি। কুকুরটাও তোমাকে পছন্দ করেছে।
কার্তিকবাবুও একইরকম, তিনি বললেন, এই রকম জংলি কুকুরছানার দাম পঁচিশ টাকার বেশি হতেই পারে না।
ঠিক আছে, পাঁচশো টাকা দাও। কুকুরওলা বলল।
তিরিশের বেশি এক পয়সাও নয়। কার্তিকবাবু কাঞ্চনের হাত ধরে টানলেন।
তারপর আধঘণ্টা ধরে:
সাড়ে চারশো।
বত্রিশ।
তিনশো।
চল্লিশ।
দুশো।
পঞ্চাশ।
এইভাবে যখন সাড়ে সাতান্ন টাকায় রফা হল, তখন সদ্য দাবানামপ্রাপ্ত কুকুরছানাটি কাঞ্চনের কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে।
কুকুরছানা বাসায় এল। কাঞ্চনের মা, কাঞ্চনের বাবা সবাই তাকে দেখে মুগ্ধ। প্রথম দু-একদিন একটু কাদাকাটি করেছিল, কিন্তু আস্তে আস্তে দাবার আচার, আচরণ, বুদ্ধি ইত্যাদি দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে গেল। বিশেষ করে নিজের লেজ নিজে ধরে নামে যে নতুন খেলাটি দাবার জন্যে কাঞ্চন আবিষ্কার করেছে, যে খেলায় দাবা নিজেরই চারদিকে চক্রাকারে মিনিটের পর মিনিট মুখ দিয়ে লেজ ধরার জন্যে ঘুরতে থাকে, সেরকম কাঞ্চনের বাড়ির লোকেরা কখনও কোথাও দেখেনি।
তবু কুকুর পোষার বিস্তর ঝামেলা। শিকল চাই, বকস চাই, ডগসোপ চাই, জলাতঙ্কের প্রতিষেধক টিকা অবশ্যই চাই। আর সবচেয়ে গোলমেলে ব্যাপার হল: যেখানে শিকল পাওয়া যায়। সেখানে শিকল ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। এক এক জিনিস এক এক জায়গায়। আর ইঞ্জেকশন দেওয়ানো, সে কি সোজা কথা। অনেক ঘুরে ঘুরে শিকল-বকলস, এমনকী কুকুরের সাবান, দুধ খাওয়ার বাটি, শোবার কম্বল সব কিনে আনলেন কাঞ্চনের বাবা, একটা কথা জানা গেল–ছমাস না হলে কুকুরছানার ইঞ্জেকশান লাগে না।
কাঞ্চনদের এই নতুন বাড়িটার সবচেয়ে মজা হল: প্রত্যেকটা ঘরের সঙ্গে একটা করে অতিকায় বাথরুম। আর সেই বাথরুমগুলিতে একটি করে চমৎকার পুরনো আমলের বাথটব। বাইরের ঘরের বাথরুমটা বিশেষ ব্যবহার করা হয় না। ঠিক হল দাবাকে ওখানেই স্নান করানো হবে। দাবা থাকবে শোবার ঘরের মধ্যে, হয়তো বিছানায়-টিছানায়ও উঠবে। সুতরাং কুকুরছানাকে যথেষ্ট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
কুকুরের ডাক্তারবাবুকে ফোন করে কাঞ্চনের বাবা জেনে নিয়েছিলেন, ছোট কুকুরছানাকে সপ্তাহে একদিনের বেশি স্নান করানো ঠিক হবে না। তাই স্থির করা হল প্রত্যেক রবিবার ছানাকে দুপুরবেলায় ডগ-সোপ মাখিয়ে খুব ভাল করে স্নান করানো হবে।
প্রথম রবিবারেই হইচই কাণ্ড। লোডশেডিংয়ের জন্যে কলে জল বেশি পাওয়া যায় না। তবু এরই মধ্যে অনেকটা জল ধরে বাইরের ঘরের বাথটবটা আধাআধি ভরে রেখেছে কাঞ্চন। তার মধ্যে দাবাকে নিয়ে কাঞ্চনের কাকা নামিয়ে দিলেন। দাবার এখন উচ্চতা ছয়সাত ইঞ্চি, আর বাথটবের জলের গভীরতা প্রায় এক ফুট। কাঞ্চন ভয় পেয়ে গেল। চেঁচাতে লাগল। কাকা, ডুবে যাবে, ডুবে যাবে! কাঞ্চনের চেঁচানি শুনেই হোক অথবা জল দেখে ভয়েই হোক, দাবাও কেঁউ কেঁউ করে কেঁদে উঠল। কাঞ্চনের কাকা কিন্তু কিছু না ভেবে নির্বিকারভাবে দাবাকে জলের মধ্যে ছেড়ে দিলেন। দাবা একটু ডুবে গিয়েই ভেসে উঠল, তারপর জলের উপর মাথা উঁচু করে সারা টবময় ঘুরে ঘুরে সামনের দুটো খুদে পা দিয়ে জল কেটে কেটে সাঁতরাতে লাগল এবং তার মুখ দেখে বোঝা গেল সে জলের ব্যাপারটা খুব অপছন্দ করছে না।
দাবার সাঁতার কাটা দেখে হতভম্ব কাঞ্চন হাততালি দিয়ে উঠল। সে নিজেও একটা সাঁতারের স্কুলে যাচ্ছে আজ দেড় মাস হল, কিন্তু বিশেষ কিছুই শিখতে পারেনি, আর দাবা প্রথমদিনেই সাঁতার কাটছে।
অবাক কাঞ্চন কিছুক্ষণ গোল গোল চোখে এই দৃশ্য দেখে তারপর দাবাকে জল থেকে তুলে একটা পুরনো তোয়ালে দিয়ে তাকে মোছাতে মোছাতে কাকাকে জিজ্ঞাসা করল, কাকু, ও সাঁতার শিখল কোথায়?
কাকা বললেন, কুকুরছানারা আবার সাঁতার শিখবে কী! ওটা ওরা একা একাই পারে।
ব্যাপারটা কিন্তু কাঞ্চনের মাথার মধ্যে ঢুকে গেল। একটি সাদা ঝকঝকে পোর্সেলিনের টবের জলে একটা সাদা কালো কুকুরছানা টুকটুক করে সাঁতার কাটছে। চোখ বুজলে চোখ খুললে কাঞ্চন শুধু এই ছবিটাই দেখতে পাচ্ছে। কত লোককে যে কাঞ্চন তার সাঁতারু কুকুরছানার কথা বলেছে। তার ইয়ত্তা নেই। তারা সবাই যে ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব দিয়েছে তা নয়। অনেকে শুধু তাই নাকি, তাই নাকি করেছে; সেটা যে নিতান্তই মন ভোলানো কথা, সেটা বুঝতে কাঞ্চনের অসুবিধা হয়নি। কিন্তু তাতে সে একেবারেই দমে যায়নি।
তার অবশ্য একটা বিশেষ কারণ আছে। কাঞ্চনের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা দেখা দিয়েছে যে, শুধু দাবার মতো প্রতিভাবান কুকুরছানার পক্ষে সম্ভব একা একা সাঁতারের মতো অতি কঠিন বিষয়। আয়ত্ত করা এবং জীবনে প্রথম দিনই জলে নেমে মাত্র একবার ডুবে সাঁতার কাটা। কাঞ্চন তার নিজের সাঁতারের স্কুলের কঠিন অভিজ্ঞতা থেকে জানে, সাঁতার ব্যাপারটা অত সোজা নয়, ছেলের হাতের মোয়া নয়। আর একটা কুকুরছানাকে ওইভাবে টবের মধ্যে ফেলে দিলে ডুবেই মরে যাবে, এ বিষয়ে কাঞ্চনের মনে কোনও সন্দেহ নেই।
কাঞ্চন অনেক ভাবল, অনেক রকম ভাবল। আস্তে আস্তে তার বুদ্ধি খুলতে লাগল। সে ঠিক করল সে একটা কুকুরছানাদের সাঁতারের ইস্কুল করবে। ওই বাইরের ঘরের বাথটবে তাদের সাঁতার শেখানো হবে, দাবা হবে এই সাঁতার-বিদ্যালয়ের ট্রেনার আর কাঞ্চন হবে সেক্রেটারি।
এই কলকাতা শহরে কত কুকুরছানা থাকে লেকের কাছে, পুকুরের কাছে, গঙ্গার কাছে। সাঁতার শেখা তাদের পক্ষে নিতান্ত প্রয়োজন। আর তা ছাড়া বর্ষার সময় কলকাতার প্রায় সব গলিই তো আজকাল নদী হয়ে ওঠে। সুতরাং কুকুরছানাদের জলে ডোবা থেকে বাঁচতে গেলে সাঁতার শিখতেই হবে। সবচেয়ে বড় কথা, জলে নেমে সাঁতরানো শিখলে কুকুরছানারা পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন থাকবে গায়ে ঘা হবে না, পোকা-মাকড় হবে না।
কাঞ্চনের এই অকল্পনীয় প্রস্তাবে, মানে কুকুরছানাদের সাঁতারের স্কুল করার পরিকল্পনায় কাঞ্চন সবচেয়ে বেশি সমর্থন পেল তার কাকার কাছ থেকে। কাঞ্চনের বাবা মুচকি হাসলেন, কিছু মন্তব্য করলেন না। শুধু কাঞ্চনের মা আধা প্রতিবাদ জানালেন, অত জল ঘাঁটলে কাঞ্চনের জ্বর হয়ে যাবে।
তিনদিনের মধ্যে কাঞ্চনের কাকা তার অফিসের কাছ থেকে একটা চমৎকার সাইনবোর্ড তৈরি করিয়ে নিয়ে এলেন। সাইনবোর্ডটা যে খুব বড় তা নয়, কিন্তু সুন্দর কালো বার্নিশ করা কাঠের ফ্রেম দিয়ে ঘেরা, তার মধ্যে সবুজ জমিতে উজ্জ্বল সাদা হরফে বেশ বড় বড় করে গোটা গোটা অক্ষরে ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষায় লেখা
PUPPY SWIMMING SCHOOL
কুকুরছানাদের সাঁতার শিক্ষালয়
এখানে কুকুরছানাদের বিনামূল্যে
টবের জলে সুশিক্ষিত সাঁতারু
কুকুরছানা দ্বারা নিয়মিত
সাঁতার
শেখানো হইয়া
থাকে।
অনুসন্ধান করুন।
পরের দিন সকালবেলা অফিস যাওয়ার আগে কাঞ্চনের কাকা বাড়ির সামনের লোহার গেটটায় সাইনবোর্ডটা টাঙিয়ে দিয়ে গেলেন। রাস্তা দিয়ে যারা যায়, তারাই এই আশ্চর্য সাইনবোর্ড দেখে থমকে দাঁড়ায়, একটু অবাকও হয়। দুপুরে টিফিনের সময়ে অফিসবাবুদের রীতিমতো ভিড় জমে গেল কাঞ্চনদের বাড়ির সামনে। কাঞ্চন তাই দেখে উত্তেজিত হয়ে মাকে ডেকে আনল, মা, দ্যাখো কত লোক আমাদের সাইনবোর্ড পড়ে যাচ্ছে। কাল নিশ্চয় ওরা ওদের কুকুরছানা নিয়ে আসবে আমাদের এখানে স্নান করানোর জন্যে। কাঞ্চনের মা কিছু বললেন না, শুধু একটু হাসলেন।
তারপর আরও সাতদিন চলে গেছে। মজার খবর চাপা থাকে না। লোকমুখে কুকুরছানার সাঁতার শেখার স্কুলের গল্প নানাদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। একটা বড় খবরের কাগজে এ বিষয়ে চমৎকার সংবাদ বেরিয়েছে, তাদের রিপোর্টার কাঞ্চনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন; দাবার ছবিও ছাপা হয়েছে অন্য একটি পত্রিকার শিশুদের পাতায়। ফলে অনতিবিলম্বে দাবা হয়তো সিমলিপালের খৈরির মতো কিংবা আলিপুর চিড়িয়াখানার হাতি বিজলীর মতো বিখ্যাত হয়ে পড়বে। প্রতিদিন সারাদুপুরে লোক উপচে পড়ছে বাড়ির দরজায়। কাঞ্চনের মা আর বড় বাড়িতে একা থাকার ভয়ে কম্পিত নন। বরং সদর দরজার ভিড় সামলাতেই তার সারাদুপুর কেটে যায়।
কাঞ্চনের কিন্তু মনে আনন্দ নেই। এখন পর্যন্ত একজন লোকও তার কুকুরছানা কাঞ্চনদের সাঁতার শিক্ষালয়ে স্নান করাতে নিয়ে আসেনি। দাবার তাতে ক্ৰক্ষেপ নেই। সে নেচে-কুঁদে, লাফিয়ে, লেজ নেড়ে, জলের টবে সাঁতার কেটে সাঁই-সাঁই করে বড় হয়ে যাচ্ছে। সদর দরজায় সাইনবোর্ডটার সামনে লোকের ভিড় বেশি হলে সে ঘেউঘেউ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। লম্বাও হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি, এরই মধ্যে সে নয় ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে।
কিন্তু দাবা তো মানুষ নয়। কাঞ্চন মানুষ, সে এত তাড়াতাড়ি বড় হচ্ছে না। তার বড় হতে অনেক সময় লাগবে। সে এখন দেখছে, দিনের বেলার লোকজন সরে গেলে সন্ধ্যার দিকে এ পাড়ার কয়েকটা রাস্তার কুকুর তাদের সদর দরজার সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনও কখনও তারা। গেটের মধ্যে দিয়ে তাকায়, কখনও কখনও তারা সাইনবোর্ডটার দিকেও তাকায়। কাঞ্চন জানে, এই পরের তাকানোটাই সত্যি। মানুষেরা যাই করুক, এই কুকুরেরা, যখন তাদের ছানাগুলি জন্মাবে, একটু বড় হলেই তাদের নিয়ে আসবে কাঞ্চনের কাছে সাঁতার শেখানোর জন্যে। পাপি সুইমিং স্কুল-এর বাথটব একদিন ভরে যাবে কুকুরছানায়, আর তাদের মায়েরা অপেক্ষা করবে কাঞ্চনদের বাড়ির উঠানে। কুকুরের মায়েরা কেউ যদি সাইনবোর্ডের ভাষা না বুঝতে পারে, তাই কাঞ্চন খুব যত্ন করে একটা বড় ছবি এঁকে সাইনবোর্ডের নীচে টাঙিয়ে দিল। ছবিটা আর কিছুই। নয়, একটা বাথটবের জলের মধ্যে অনেকগুলো কুকুরছানা প্রাণের আনন্দে জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটছে।