2 of 2

পান্নার রং – উৎপল ভট্টাচার্য

পান্নার রং – উৎপল ভট্টাচার্য

খবরটা ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতোই। জাস্টিস মৈত্র আবার বিয়ে করছেন। নিউ আলিপুরের এ-অঞ্চলটায় অভিজাত পরিবারের বাস। প্রায় একশো ফুট চওড়া রাস্তা কালিঘাট স্টেশনের পিছন থেকে শুরু হয়ে সোজা চলে গেছে বেহালা পর্যন্ত। দু-ধারে নানা ছাঁদের বড়-বড় বাড়ি। সুসজ্জিত দোকানপাট। রাত্রিবেলা মনে হয় যেন ইন্দ্রপুরী। আর এই রাস্তার ওপরেই বেহালা-কালিঘাটের মাঝামাঝি জায়গায় জাস্টিস মৈত্রের বাড়ি। সহজেই আর-দশটা বাড়ি থেকে আলাদা।

গেট থেকে বাড়িটা অনেকটা ভেতরে। সরু কুচিপাথর ফেলা রাস্তাটা সোজা গিয়ে দু-ভাগ হয়ে গাড়ি-বারান্দার সঙ্গে মিশে গেছে। মাঝখানে বাগান। রাস্তার দু-পাশেও বাগান। বাগান বলতে শুধু শৌখিন ফুলের বাগিচাই নয়, নানারকম কৃষিকাজও আছে। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই মনে হবে, এ-বাড়ির মনিবের বাগানের শখ আছে।

সত্যিই তাই। জাস্টিস মৈত্র সারাদিন বাগান নিয়ে পড়ে থাকেন। বছরখানেক হল রিটায়ার করেছেন। নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই। গ্যাস্ট্রিকের একটু দোষ আছে। ডাক্তারদের মতে তাঁর স্বাস্থ্য ভালো নয়। চেহারা দেখলে কিন্তু বোঝার উপায় নেই। বছর পঞ্চান্ন বয়স হবে। পৌনে ছ’ফিট লম্বা। গৌরবর্ণ। কোঁকড়ানো চুল পিছন দিকে ওলটানো। রগের দু-পাশে কিছু-কিছু পেকেছে মাত্র। এককথায় সুপুরুষ জাস্টিস মৈত্র। এবং যৌবনে যে অতিশয় সুপুরুষ ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। এই জাস্টিস মৈত্রেরই বিয়ে।

জাস্টিস মৈত্রের স্ত্রী বছর-দশেক আগে মারা গেছেন। তাঁর দুটি সন্তান। ছেলে অজয়। মেয়ে রীনা। অজয়ের বয়স বছর চব্বিশ হবে। মেয়ে রীনার বয়সও একুশ বছর। এম. এ. পড়ছে।

বাবাকে নিয়ে কানাঘুষো ওরাও শুনেছে। কিন্তু বাবা ওদের যথেষ্ট স্নেহ করলেও, তাঁর সামনে মুখ তুলে কথা বলার সাহস ওদের কারুরই নেই। তাই ওরা এ-বিয়ে নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি।

কিন্তু সত্যি-সত্যিই বিয়ে হল। তখন ওরা দু-ভাইবোন পুজোর ছুটি কাটাচ্ছে মামার বাড়িতে। সেখানে থেকেই শুনল, প্রখ্যাত শিল্পী কুমারী অমিতা চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে ওদের বাবার। এই অমিতা চৌধুরী সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছে তারা। মহিলা মোটেই চরিত্রবতী নন। সেইজন্যই অনেক দুর্নাম অমিতা চৌধুরীর। কিন্তু শিল্পী হিসেবে ভারতজোড়া খ্যাতি সত্যিই হিংসে করার মতো। তাঁর আঁকা কিছু ছবি অজয় দেখেছে। সত্যিই সুন্দর! বিশেষত ল্যান্ডস্কেপ-গুলো। অতুলনীয়। ছবিগুলো অনেক চড়া দামে বিক্রিও হয়। বহু ধনীর ড্রইংরুমে অমিতা চৌধুরীর ছবির দেখা পাওয়া যায়।

পুজোর ছুটি মামার বাড়িতে কাটিয়ে অজয় আর রীনা ফিরে এল বাড়ি। বাবা ওদের কিছু বললেন না। ওরাও কিছু জানতে চাইল না।

ছ’মাস কেটে গেল। ইতিমধ্যে অজয় আর রীনার সঙ্গে ওদের নতুন মায়ের দু-একবার দেখা হলেও কথাবার্তা হয়নি। এ-বিষয়ে কোনও পক্ষেরই তেমন উৎসাহ দেখা যায়নি।

সেদিন সকালবেলা থেকেই বৃষ্টি পড়ছিল টিপটিপ করে। বিকেলেও থামবার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। অজয় কলেজে গেল না—বিকেলবেলা ক্লাবেও গেল না। সত্যি বলতে কী, কোনওখানেই আর যেতে ইচ্ছে করে না ওর। বন্ধুবান্ধবদের অর্থপূর্ণ হাসি আর দৃষ্টিপাত গায়ে যেন বিষ ছড়িয়ে দেয়।

রীনাও আজকাল কোথাও যেতে চায় না। কারণ একই। আজ ওর বান্ধবী নমিতা নেহাত ধরে পড়ায় ওর জন্মদিনে ওদের বাড়ি গেছে।

অজয় শুয়ে-শুয়ে ওই মাসের মেডিকেল জার্নালখানা ওলটাছিল। দেওয়ালঘড়িতে ঢং-ঢং করে রাত ন’টা বাজল।

এমনসময়ে ভৃত্য কালিপদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে চিৎকার করে বলল, খোকাবাবু, শিগগির চলুন। কর্তাবাবু যেন কীরকম করছেন।

ধড়ফড় করে উঠে বসল অজয়—বলল, কী হয়েছে?

—তা জানি না। দেখলাম, কর্তাবাবু বিছানায় পড়ে কীরকম দাঁত-মুখ বাঁকিয়ে কাতরাচ্ছেন। জিগ্যেস করলুম, ‘কী অসুবিধে হচ্ছে?’ তা জবাব দিলেন না। তাই ভয় পেয়ে আপনাকে ডাকতে এলুম।

—কেন, ইয়ে—মানে কী বললে?

অজয়ের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কালিপদ বলল, আজ্ঞে, গিন্নিমা তো ঘণ্টাখানেক আগে এক বাবুর সঙ্গে গাড়িতে করে চলে গেছেন। আর আজকের রান্না গিন্নিমা করেছেন। আমাকে বলে গেছেন, ‘সাড়ে আটটায় বাবুকে খাবার দিয়ো। আর ন’টার সময় খেতে দিয়ো ওষুধটা। আমার ফিরতে একটু দেরি হবে।’ তা খাবার দেওয়ার সময়ে বাবুকে তো ভালোই দেখেছি। ওষুধটা খাওয়াতে গিয়ে অমন অবস্থা দেখে এখানে এলুম।

—হুম।—বলে অজয় বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

ঘরে ঢুকেই অজয় দেখল, ওর বাবা বিছানার ওপর উঠে বসেছেন।

অজয়কে দেখে জাস্টিস মৈত্র বললেন, এই যে অজয়, কালিপদকে একটু পাঠিয়ে দাও তো।

অজয় বলল, আপনার শরীর কেমন আছে, বাবা? একটু আগে—।

অজয়কে কথা শেষ করতে না দিয়েই জাস্টিস মৈত্র বলে উঠলেন, ও কিছু না—কিছু না। খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে। তাই পেনটা একটু বেড়েছিল মাত্র।

ইতিমধ্যে কালিপদ ওষুধের শিশি আর গ্লাস হাতে করে এসে ঢুকল। তার হাত থেকে শিশি আর গ্লাসটা নিয়ে অজয় একদাগ ওষুধ ঢেলে জাস্টিস মৈত্রের হাতে দিল। জাস্টিস মৈত্র এক ঢোকে ওষুধটা খেয়ে খালি গ্লাসটা অজয়ের হাতে দিলেন। একটু পরে জাস্টিস মৈত্র বললেন, আলোটা নিভিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিস রে, কালিপদ। আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে।

ধীরে-ধীরে শুয়ে পড়লেন জাস্টিস মৈত্র।

এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অজয় মাথা নিচু করে বেরিয়ে এল ঘর থেকে।

—কিন্তু কাকাবাবু, ব্যাপারটা গোড়া থেকেই কেমন যেন গোলমেলে মনে হচ্ছে আমার। —বলল অরুণ।

কথা হচ্ছিল লালবাজারে সি. আই. ডি. ডিপার্টমেন্টের মিস্টার চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুপুত্র অরুণ রায়ের—মিস্টার চৌধুরীর নিজস্ব অফিস-ঘরে।

—মানে? কী বলতে চাও তুমি?—অরুণকে পালটা প্রশ্ন করলেন মিস্টার চৌধুরী।

—বলতে চাই যে, অজয় মৈত্র জাস্টিস মৈত্রকে—অর্থাৎ ওর বাবাকে কখনওই খুন করেনি। —দৃঢ় স্বরে বলল অরুণ।

মিস্টার চৌধুরী : ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন অরুণের দিকে—তারপর ঈষৎ বিরক্তি মাখানো স্বরে বললেন, আচ্ছা, ঘটনাটা তোমাকে বলি, শোনো। গত বুধবার বেলা দশটায় সবে অফিসে এসে বসেছি। এমনসময় একজন সার্জেন্ট একটা চিঠি দিয়ে বলল, খুব জরুরি চিঠি। তক্ষুনি পড়ে দেখতে। জিগ্যেস করলাম, কে দিয়েছে এটা?

সার্জেন্ট বলল, এক ভদ্রমহিলা।

—তাঁকে নিয়ে এসো এখানে।

সার্জেন্ট অভিবাদন করে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল সার্জেন্ট—বলল, মহিলাটি নেই।

—নেই!

—না। ট্যাক্সি করে এসেছিলেন ভদ্রমহিলা। গাড়ির ভেতর থেকেই হাত বাড়িয়ে চিঠিটা আমার হাতে দিয়েছেন।

—ওঃ। আচ্ছা, তাঁকে দেখতে কেমন?

—কাপড় দিয়ে মাথা ও মুখের নীচের দিকটা ঢাকা থাকায় আমি অতটা খেয়াল করিনি। তবে অনুমান, কুড়ি-বাইশ বছরের সুন্দরী তরুণী।

মিস্টার চৌধুরী বলেন, সার্জেন্টকে যেতে বলে আমি চিঠিটা খুলে পড়লাম। চিঠির বিষয়বস্তু সংক্ষেপে হচ্ছে এই : লেখিকা জাস্টিস মৈত্রের শুভাকাঙ্খিনী। জাস্টিস মৈত্র গতকাল রাতে কোনও এক সময়ে মারা গেছেন। যদিও হার্টফেল করেছেন বলে সবাই মনে করে, কিন্তু লেখিকার দৃঢ় সন্দেহ যে, বিষই জাস্টিস মৈত্রের মৃত্যুর কারণ। তাই তিনি এ-বিষয়ে যথাযথ তদন্ত করতে আমাকে অনুরোধ করেছেন। এবং তা অবিলম্বেই। তা না হলে হয়তো শব পোড়ানো হয়ে যাবে। যাই হোক, আমি অকুস্থলে গেলাম। তদন্ত করলাম। বুঝলাম, লেখিকার অনুমান সত্যি। অর্থাৎ, জাস্টিস মৈত্র বিষের প্রভাবেই মারা গেছেন। কেসটা দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার এবং জাস্টিস মৈত্রের ছেলে অজয় মৈত্রই যে খুনি, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত।—এই পর্যন্ত বলে মিস্টার চৌধুরী চুপ করলেন।

—কিন্তু আমার মনে হয়…।—একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে অরুণ বলল, আপনি যদি আবার একটু ভালো করে চিন্তা করেন, তাহলে দেখবেন খুনি অজয় নয়, খুনি হচ্ছে—।

অরুণকে বাধা দিয়ে মিস্টার চৌধুরী বললেন, জানি, জাস্টিস মৈত্রের বাড়িতে তোমার যাতায়াত আছে। আর অজয় হচ্ছে তোমার বন্ধু। অজয়ের বোন রীনার সঙ্গে তোমার আলাপ আছে বোধহয়?

এই কথায় অরুণ একটু অস্বস্তি বোধ করল। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, আছে।

—ওর অনুরোধেই বোধহয় তুমি এসেছ?

—হ্যাঁ।

—ওর চিঠিটাও বোধহয় ওরই লেখা, কী বলো?

এবারে অরুণ মাথা নেড়ে সায় দিল।

—হুম! আমিও তাই অনুমান করেছিলাম। রীনা মৈত্র ঠিকই বুঝেছিল যে, ওর বাবাকে বিষ খাইয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু ও বোঝেনি যে, ওর ভাই-ই কু-কীর্তির নায়ক। বুঝতে পারলে বোধহয় আমার কাছে চিঠি লিখে তদন্তের প্রার্থনা জানাত না। কিন্তু যখন দেখল যে, ওর ভাই এ-ব্যাপারে জড়িত, তখনই ও তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে, তাই না? কিন্তু অজয়ের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো এতই অব্যর্থ যে, ও যে দোষী, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রথমত, বডি এগজামিন করে জানা গেছে যে, জাস্টিস মৈত্রের লিভার আর কিডনিতে এমন পরিমাণ আর্সেনিক পাওয়া গেছে, যা একজন মানুষকে মারবার পক্ষে যথেষ্ট। আর অজয় তো মেডিকেল স্টুডেন্ট। ওর পক্ষে আর্সেনিক সংগ্রহ করা মোটেই কঠিন কাজ নয়। তা ছাড়া অজয় কোনওদিন ওর বাবাকে ওষুধ দেয়নি। কিন্তু ঘটনার দিন রাতে অজয় নিজের হাতে ওর বাবাকে ওষুধ খাইয়েছে। একটা ওজর অবশ্য দেখিয়েছিল অজয়। সেটা হল, ঘটনার দিন রাতে নাকি ভৃত্য কালিপদ ওকে ডাকতেই ও বাবার ঘরে গিয়েছিল। এবং ওষুধের শিশিটা ও কালিপদর হাত থেকে নিয়েই গ্লাসে ওষুধ ঢেলে বাবার হাতে দিয়েছিল। কিন্তু আমার মনে হয়, অজয়ের মতো চালাক ছেলের পক্ষে ওর বাবার চোখকে আর ভৃত্য কালিপদর চোখকে ফাঁকি দেওয়া মোটেই অসম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, চাকরবাকরদের কাছে শুনলাম, জাস্টিস মৈত্রের মৃত্যুর দিন-কুড়ি আগে তাঁর সঙ্গে অজয়ের বচসা হয়। অজয় শ’ পাঁচেক টাকা চেয়েছিল জাস্টিস মৈত্রের কাছে। জাস্টিস মৈত্র নাকি অজয়কে টাকা দেননি। জাস্টিস মৈত্র কানাঘুষোয় শুনেছিলেন, অজয় নাকি আজকাল কলেজে যায় না। এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়। অসৎ-বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেছে। তৃতীয়ত, অজয় ওর বাবার উইলের কথা জানত। মোট পনেরো লক্ষ টাকার সম্পত্তির অর্ধেক পাবেন মিসেস মৈত্র। আর বাকি অর্ধেক সমান ভাগে পাবে ভাই-বোন। এই ব্যবস্থায় স্বভাবতই অজয় ক্ষুব্ধ হয়েছিল। কারণ ও নতুন মাকে কখনওই সহ্য করতে পারেনি।

খানিকটা থেমে মিস্টার চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন : কাজেই দেখতে পাচ্ছ, অরুণ, এতগুলো প্রমাণ পেয়েই আমি অজয়কে গ্রেপ্তার করেছি। এখন তোমার শখের তদন্ত কী বলে, শুনি?

অরুণ ওর চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বলতে লাগল দেখুন কাকাবাবু, মৃতদেহের কিডনিতে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। কিন্তু আমরা জানি, সাদা আর্সেনিক জলের সঙ্গে মেশে না। কাজেই অজয় ওর বাবাকে তরল ওষুধের সঙ্গে আর্সেনিক খাওয়াতে পারে না। অবশ্য আর্সেনিকের একটা যৌগিক পদার্থ জলের সঙ্গে সহজেই মেশে। কিন্তু ওটা যদি কাউকে খাওয়ানো যায়, সেক্ষেত্রে তার কিডনিতে আর্সেনিক নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে না। তাহলে কী করে মৃতের শরীরে আর্সেনিক এল?

কোনও জবাব দিলেন না মিস্টার চৌধুরী।

অরুণ আবার বলতে লাগল : অটোপ্সির রিপোর্ট শুধু বলছে, মৃতদেহে আর্সেনিক ছিল। কিন্তু কী করে তা মৃতদেহে এল বা কোন জাতীয় আর্সেনিক, তা বলেনি। তাহলে এইসব পদার্থগুলোর সম্বন্ধে একটু খোঁজ নেওয়া যাক। সাদা আর্সেনিককে বাদ দিতে পারি। কিন্তু সোডিয়াম আর্সেনাইড? এটাকে বাদ দিতে পারি না। এটি জাস্টিস মৈত্রর বাড়িতে আসত। কারণ, জাস্টিস মৈত্রের বাগানের শখ ছিল। আর আগাছা ধ্বংসের জন্য ওটা দরকার। তবে কি সোডিয়াম আর্সেনাইড জাস্টিস মৈত্রের মৃত্যুর কারণ? কিন্তু নাঃ, এই পদার্থটির দ্বারা আগাছাই ধ্বংস করা চলে—মানুষ মারা যায় না। তারপর আছে কপার আর্সেনাইডও। আমার দৃঢ় ধারণা যে, জাস্টিস মৈত্রকে বেশি পরিমাণে কপার আর্সেনিক খাইয়েই মারা হয়েছে।

ঈষৎ ক্রুদ্ধস্বরে মিস্টার চৌধুরী বললেন, দ্যাখো অরুণ, ধারণা বা কল্পনা দিয়ে এসব ব্যাপারের সমাধান হয় না—প্রমাণ করতে হয়।

অরুণ রায় মৃদু হেসে টেবিলে আঙুল দিয়ে টোকা দিতে-দিতে বলতে লাগল : খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, মিসেস মৈত্র—অর্থাৎ, শিল্পী অমিতা দেবী—শুধু শিল্পীই নন, আরও অনেক গুণে গুণী। একটি বিশেষ ক্ষেত্রে তিনি এমন এক ব্যক্তির খপ্পরে পড়েছিলেন, যার মুখ বন্ধ করতে গিয়ে আকণ্ঠ ধারে ডুবে যেতে হয়েছিল। তাই তিনি প্রখ্যাত ধনী জাস্টিস মৈত্রকে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু টাকাপয়সার ব্যাপারে জাস্টিস মৈত্র তেমন উদার ছিলেন না। এদিকে সেই ব্যক্তি অমিতা দেবীকে ভয় দেখিয়েছিল। বলেছিল, ‘আগুন যদি নেভাতে চাও, প্রচুর জল ঢালো।’ অর্থাৎ, এসব ব্যাপার আপনি যদি একটু খোঁজ নেন, তাহলেই জানতে পারবেন।

—এটা এমন কিছু প্রমাণ নয়। পুলিশ এত বোকা নয়। মিসেস মৈত্রের ধারের কথা তারা জানে। তাই বলে তিনিই যে খুনি, তার প্রমাণ কী? কেউ ধার-দেনা করলেই সে খুনি হতে পারে? অদ্ভুত!

অরুণ আবার একটু হাসল—বলল, অদ্ভুতই বটে। বিশেষ করে ধূর্ত খুনিরা একটু অদ্ভুতই হয়। জাস্টিস মৈত্রের মৃত্যুর রাতে খাবারের তালিকায় পালং শাক দেখেই আমার মনে কৌতূহল জাগে। এমন অসময়ে পালং শাক কেন? বিশেষত গ্যাস্ট্রিকের রুগির পক্ষে পালং শাক খুব উপযোগী নয়। তারপর যখন আমি অমিতা দেবীর আঁকা একটা ছবি দেখলাম, তখন আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। অতি উজ্জ্বল সবুজ রংয়ের আকাশ, ঠিক পান্নার রংয়ের মতো। আর এমন সবুজ রং তখনই হয়, যখন সে-রংয়ের সঙ্গে অ্যাসিটো-আর্সেনাইড অফ কপার মেশানো হয়। যে-দোকান থেকে মিসেস মৈত্র আঁকার সাজ-সরঞ্জাম কেনেন, সেখানে খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন, শেষ কবে তিনি ওই দ্রব্যটি কেনেন। তা ছাড়া ওই দ্রব্যটিই জাস্টিস মৈত্রের ড্রয়িংরুমে রয়েছে। আর পালং শাক হল, দেখতে সবুজ, স্বাদে কিছুটা তেতোও বটে। কপার আর্সেনাইডও তাই। খোঁজ নিলে আরও জানতে পারবেন, মিসেস মৈত্রের নির্দেশ অনুযায়ীই সেদিন জাস্টিস মৈত্রকে পালং শাক খেতে দেওয়া হয়েছিল। এবং সে-রাতের রান্নাও মিসেস মৈত্র নিজের হাতেই করেছিলেন। আর সে-রাতে জাস্টিস মৈত্রের খাওয়ার সময়ে মিসেস মৈত্রের বাড়িতে না থাকা একটা দোষ কাটাবার বাহানা মাত্র। বাড়ি থেকে বেরুবার আগেই মিসেস মৈত্র একফাঁকে পালং শাকে আর্সেনিক মিশিয়ে দিয়েছিলেন।

কথা শেষ করে অরুণ রায় উঠে দাঁড়াল। মিস্টার চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন—অরুণের পিঠে মৃদু আঘাত করে বললেন, তোমার সূক্ষ্ম দৃষ্টি প্রশংসনীয়, অরুণ। আমি অজয়কে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।

অরুণের মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠল।

মাসিক রহস্য পত্রিকা

জানুয়ারি (পৌষ), ১৯৮৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *