পানিমুড়ার কবলে

পানিমুড়ার কবলে

আমাদের বাড়ির পেছনে একটা বড়ো পুকুরের ওপাশে একটু একটু জঙ্গল শুরু হয়ে গেছে। সেই জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় মুসলমানদের একটা কবরখানা। তারপর থেকে বেশ ঘন জঙ্গল।

সে বছর আমার বাবা কলকাতা থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেলেন আলিপুরদুয়ার। আমাদের বাড়ি পাওয়া গেল শহর ছাড়িয়ে অনেকটা দূরে। বছরের মাঝখানে আমাকে চলে আসতে হল বলে এখানকার স্কুলে আমি ভরতি হতে পারলাম না। নতুন বছরে ভরতি হতে হবে।

তাই দুপুর বেলা আমার কিছুই করার থাকে না। বাবা অফিস চলে যান, মা খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়েন। আমার একদম ঘুমোতে ইচ্ছে করে না দুপুরে। একটাও নতুন গল্পের বই নেই, আর পড়ার বই তো বেশিক্ষণ ভালো লাগে না পড়তে। তাই আমি চুপি চুপি বাড়ির পেছনে পুকুরটার পাড়ে চলে যাই।

একা একা জঙ্গলে যেতে আমার ঠিক সাহস হয় না। এখানকার জঙ্গলে বাঘ আছে, কিন্তু আমার তো বন্দুক নেই। আমার তিরধনুক আছে অবশ্য, তা দিয়ে বাঘ মারা যায় না। তবু আমি জঙ্গলের মধ্যে একটু একটু গেছি দু-একবার। কিন্তু ওই কবরখানাটার পাশ দিয়ে যেতেই বেশি গা ছমছম করে। বাবার অফিসের পিয়োন মুনাব্বর খাঁ বলেছিল, ওই কবরখানায় নাকি ভূত আছে। আমি এদিক-ওদিক তাকাই, কখনো ভূত দেখতে পাই না। কিন্তু কীরকম যেন একটা বোটকা গন্ধ পাই। আর থাকতে ইচ্ছে করে না, একছুটে ফিরে আসি। আমার যদি আর একটা বন্ধু থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা দু-জনে মিলে ভূত দেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু এখানে এসে এখন যে আমার কোনো নতুন বন্ধু হয়নি। একা একা ভূত দেখতে যেতে বড্ড খারাপ লাগে।

আমি তাই পুকুরটার ধারে গিয়ে বসে থাকি। ছোটো ছোটো ইটের টুকরো বা পাথর ছুড়ে মারি জলের মধ্যে।

পুকুরটা বিরাট বড়ো, আর এখন বর্ষাকাল বলে কানায় কানায় ভরা। দুপুর বেলা পুকুরটা দেখলে খুব গভীর মনে হয়। কোথাও কোনো লোকজন নেই, আমি শুধু একা। এক-এক সময় আমার মনে হয়, আমাকে যেন কেউ দেখছে। যদিও কোথাও আর কেউ নেই, তবু যেন মনে হয়, আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে কেউ আমাকে লক্ষ করছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে চারিদিক চেয়ে দেখি, আর কাউকে দেখতে পাই না।

এই পুকুরটায় বেশ মাছ আছে। মাঝে মাঝে তারা ঘাই মারে, অমনি জলের উপরে গোল গোল ঢেউ ওঠে। কিন্তু একদিন হঠাৎ দেখলাম, পুকুরের ঠিক মাঝখানটায় জল ফুলে ফুলে উঠছে। যেন ঠিক ওইখানটায় কোনো বিরাট কিছু প্রাণী দাপাদাপি করছে। এত বড়ো তো মাছ হতে পারে না। কিন্তু কিছুই দেখতে পেলাম না।

তারপর থেকে আমি সবসময় পুকুরের মাঝখানটায় তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আর কিছু দেখা যায় না। আবার পুকুরটা শান্ত আর গম্ভীর!

পুকুরের ঘাটটা অনেক দিনের পুরোনো। পাথর দিয়ে তৈরি, কিন্তু কয়েক জায়গায় ভেঙে ভেঙে গেছে। সেই ভাঙা জায়গাগুলোয় গর্ত হয়ে সেখানে জল জমে থাকে, সেই জলেও ছোটো ছোটো মাছ দেখা যায়।

আমি ঘাটের কাছে এসে সেই মাছগুলো ধরার চেষ্টা করি। আমার তো বঁড়শি নেই, আর বঁড়শি দিয়ে আমি মাছ ধরতেও জানি না। তাই হাত দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করি। এক ধরনের মাছ, জলের তলায় মাটিতে চুপচাপ শুয়ে থাকে। ওগুলোর নাম বেলে মাছ। সেই মাছগুলো আমাকে কাছাকাছি দেখেও ভয় পায় না। মাছগুলো অবশ্য দারুণ চালাক। আমি আস্তে আস্তে জলের মধ্যে হাত ডুবিয়ে ওদের ধরার চেষ্টা করি, ওদের একেবারে গায়ের কাছে হাত দেবার পর সুড়ুৎ করে পালিয়ে যায়। পাথরের তলার মধ্যেও অনেকখানি গর্ত আছে, সেইখানে লুকিয়ে পড়ে।

মাছ ধরার ঝোঁকে আমি জলের মধ্যে নেমে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় কে যেন ডাকল এই বাবলু!

আমি চমকে উঠলাম, সঙ্গেসঙ্গে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই তো! তাহলে আমায় কে ডাকল? স্পষ্ট শুনলাম, অনেকটা ঠিক আমার মায়ের মতন গলা। মা তো ঘুমোচ্ছেন, তাহলে কে ডাকল। খুব কাছ থেকে! মা-ই কী আমাকে ডেকে চট করে কোথাও লুকিয়ে পড়লেন!

জল থেকে উঠে এসে আমি ঘাটের চারপাশে খুঁজলাম। কেউ নেই। কাছেই একটা মস্ত কদম ফুলের গাছ, সেখানে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে। তাও নেই। অমনি আমার খুব ভয় করতে লাগল। কেউ কোথাও নেই, তাহলে আমায় ডাকল কে? আমি যে স্পষ্ট শুনেছি! দৌড়ে চলে এলাম বাড়িতে। দোতলায় এসে দেখলাম, মা অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। আমি তবু মাকে ডেকে তুলে জিজ্ঞেস করলাম, মা, তুমি কি এইমাত্র পুকুরঘাটে গিয়েছিলে?

মা তো অবাক। বিছানার উপর উঠে বসে বললেন, কেন, পুকুরঘাটে যাব কেন? তুই বুঝি গিয়েছিলি?

আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি সেখানে খেলা করছিলাম, মনে হল পেছন থেকে কে আমাকে ডাকল। ঠিক তোমার মতন গলা।

মা বললেন, তুই বানিয়ে বানিয়ে এসব কথা বলছিস!

—না, মা! আমি স্পষ্ট শুনলাম।

মা রেগে গিয়ে বললেন, তুই কেন পুকুরঘাটে গিয়েছিলি একলা একলা? দুপুর বেলা কেউ একলা যায়?

—কেন, কী হয় তাতে?

—না, কক্ষনো দুপুরে একলা জলের ধারে যেতে নেই! আর কোনোদিন যাবি না। তোর পড়াশুনো নেই?

—পড়াশুনো তো হয়ে গেছে!

—তাহলেও যাবি না! খবরদার।

মা আমাকে টেনে নিয়ে তার পাশে শুইয়ে দিলেন। পুকুর ধারে যে কেউ আমার নাম ধরে ডেকেছে, মা একথা বিশ্বাসই করলেন না।

বাবার অফিসের পিয়োন মুনাব্বর খাঁ প্রায়ই সন্ধ্যে বেলা আমাদের বাড়িতে আসে কীসব অফিসের কাজ নিয়ে। মুনাব্বর খাঁ খুব দারুণ দারুণ গল্প বলতে পারে। সে-ই তো আমাকে কবরখানার ভূতের তিনটে গল্প বলেছিল।

সেদিন সন্ধ্যে বেলা আমি মুনাব্বর খাঁকে জিজ্ঞেস করলাম। এই পুকুরটার মধ্যে কত বড়ো মাছ আছে বলো তো? তুমি জান?

মুনাব্বর খাঁ জিজ্ঞেস করলেন, কেন বল তো খোকাবাবু? আমি বললাম, একদিন দুপুর বেলা আমি দেখেছিলাম পুকুরের ঠিক মাঝখানে একটা প্রকান্ড জিনিস জলের মধ্যে দাপাদাপি করছিল। সেটা যদি মাছ হয়, তাহলে নিশ্চয়ই সেটা এই ঘরের সমান হবে।

মুনাব্বর খাঁ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর বলল, খোকাবাবু, দুপুর বেলা পুকুরের ধারে কক্ষনো একলা যেয়ো না। যেতে নেই।

—কেন, গেলে কী হয়?

—অনেকরকম বিপদ হয়। তুমি জান না, এইসব পুরোনো পুকুরে পানিমুড়া থাকে?

—পানিমুড়া কী?

—পানিমুড়া জান না? পানিমুড়া হচ্ছে জলের ভূত!

—ধ্যাৎ! জলের মধ্যে আবার ভূত থাকে নাকি?

—ওমা, তুমি পানিমুড়ার কথা শোননি? এ তো সবাই জানে। পানিমুড়া বড়োদের কিছু বলে না। কিন্তু ছোটোদের জলের তলায় টেনে নিয়ে যায়।

—মুনাব্বর খাঁ, তুমি পানিমুড়া দেখেছ?

—হ্যাঁ, তিনবার দেখেছি। তাদের মাথাটা হয় কুমিরের মতন, আর গা-টা মানুষের মতন। এই সব পুকুর জান তো, খুব পুরোনো, আগেকার দিনের রাজাদের আমলের। এইসব পুকুরের মাঝখানে গাদ্দি থাকে।

—গাদ্দি কী?

—গাদ্দি মানে সুড়ঙ্গ। সেই সুড়ঙ্গ চলে গেছে অনেক দূরে, একেবারে পাতাল পর্যন্ত। যারা পানিতে ডুবে মরে, পানিমুড়া ভূত হয়ে যায়, ওই সুড়ঙ্গের মধ্যে থাকে। মাঝে মাঝে ওপরে উঠে আসে। পানিমুড়াদের সঙ্গে আবার কবরখানার ভূতদের খুব ঝগড়া। পানিমুড়ারা ওপরে উঠে এলেই কবরখানার ভূতরা তাদের তাড়া করে যায়। আমি একবার দেখেছিলাম একটা পানিমুড়া আর একটা কবরখানার ভূত খুব ঝটাপটি করে লড়াই করছে!

এই সময় মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, কীসের গল্প হচ্ছে?

আমি বললাম, মা, তুমি পানিমুড়া ভূত দেখেছ কখনো? মুনাব্বর খাঁ দেখেছে!

মা বললেন, বসে বসে বুঝি ভূতের গল্প হচ্ছে এই সন্ধ্যে বেলা! মুনাব্বর তুমি বাবলুকে বানিয়ে বানিয়ে ওসব গল্প বোলো না। ভূত বলে আবার কিছু আছে নাকি? কিচ্ছু নেই! ভূত হচ্ছে মানুষের কল্পনা।

মুনাব্বর বলল, না, মেমসাব! আমি নিজের চক্ষে দেখেছি।

মা হেসে বললেন, ছাই দেখেছ!

আমার মায়ের খুব সাহস। মা একদিন রাত্তির বেলা একা একা কবরখানায় গিয়েছিলেন ভূত দেখার জন্য। কিচ্ছু দেখতে পাননি। মাকে দেখে ভূতেরা ভয় পেয়েছিল। বাবা বলেছিলেন তোমার হাতে টর্চ ছিল তো, সেই আলো দেখে ভূতেরা পালিয়ে গেছে। তুমি অন্ধকারে একবার গিয়ে দেখো তো!

মা বলেছিলেন, ওখানে অনেক সাপখোপ আছে। অন্ধকারে গেলে যদি সাপে কামড়ায়? আমি ভূতের ভয় পাই না, কিন্তু সাপকে ভয় করি।

দু-তিন দিন আমি আর পুকুর ধারে যাইনি। কিন্তু আমার মন ছটফট করে। দুপুর বেলা কী শুয়ে থাকতে ভালো লাগে কারুর। মা ঘুমিয়ে পড়েন, আমার যে ঘুম আসে না! পড়া গল্পের বইগুলিই আরও কয়েকবার করে পড়তে লাগলাম।

তারপর আবার একদিন, মা ঘুমিয়ে পড়ার পর আমি চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লাম আবার। আজ আমার সঙ্গে একটা ছোটো লাঠি। যদি ভূত-টুত আসে তাহলে লাঠি দিয়ে মারব।

পুকুরের কাছে এসে দেখি, ঘাটের ওপর একটা লোক বসে আছে। লোকটার গায়ে একটা লাল রঙের ডোরাকাটা গেঞ্জি আর মাথায় এমন টাক যে একটাও চুল নেই। লোকটা জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে জলে ঢেউ তুলছে। সারা গা ভেজা। লোকটা এল কোথা থেকে? আমাদের এই পুকুরে তো বাইরের কোনো লোক স্নান করতে আসে না!

আমি খুব কাছে চলে আসার পর লোকটি পেছন ফিরে তাকিয়ে আমাকে দেখল। দেখেই যেন দারুণ ভয় পেয়ে গেল। সঙ্গেসঙ্গে সে এক লাফ মেরে জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল। তারপর ডুবে গেল।

আমিও খুব অবাক হয়ে গেলাম। লোকটা আমাকে দেখে ওরকম ভয় পেল কেন? আমার হাতের লাঠিটা দেখে? চোর-টোর নয় তো? যদি চোর হয়, লোকটা তাহলে সাঁতার কেটে পুকুরের ওপাশে উঠে জঙ্গল দিয়ে পালাবে। আমি জলের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

কিন্তু লোকটা সেই যে ডুব দিয়েছে, আর উঠছে না। এতক্ষণ কেউ ডুব দিয়ে থাকতে পারে! আমি মনে মনে এক দুই তিন করে পাঁচ-শো পর্যন্ত গুনে ফেললাম, তবু লোকটাকে আর দেখা গেল না। এই রে, লোকটা মরে গেল না তো? আমাকে দেখে ভয় পেয়ে জলের মধ্যে লাফিয়ে পড়েছে, হয়তো লোকটা সাঁতারই জানে না।

তাহলে কী এক্ষুনি ছুটে গিয়ে লোকজন ডাকা উচিত? কিন্তু আমার কথা যদি কেউ বিশ্বাস না-করে? আরও একটুক্ষণ দেখবার জন্য আমি জলের পাশে এসে দাঁড়ালাম। তখন আমার মনে হল, ওটা ভূত নয় তো? ও-ই কী পানিমুড়া? কিন্তু একদম মানুষের মতন দেখতে। মুনাব্বর খাঁ যে বলেছিল, পানিমুড়ার মুখটা কুমিরের মতন! এ যে একদম মানুষের মতন। শুধু টাক মাথা। শুধু তাই নয়, লোকটা যখন আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল তখন দেখেছি, ওর চোখের ওপর ভুরুও নেই। সারাগায়ে কোনো লোমও নেই। মুনাব্বর নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলেছিল। সে পানিমুড়া কোনোদিন দেখেনি।

তক্ষুনি ফিরে গিয়ে মাকে খবর দেব ভাবছি, এক সময় জলের মধ্যে একটা হাত উঁচু হয়ে উঠল। শুধু একটা হাত। আমি ভাবলাম, লোকটা এবার উঠে আসবে। তা বলে পানিমুড়া নয়। কোনো চোরই নিশ্চয়ই।

শুধু হাতটাই উঁচু হয়ে রইল, আর কিছু না। লোকটার মাথাও দেখা গেল না। তারপর মনে হল, সেই হাতটা যেন আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই হাতে লম্বা লম্বা আঙুল, তাতে বিচ্ছিরি নখ। হাতটা ক্রমশ ঘাটের দিয়ে এগিয়ে আসছে।

হাতটা ঘাটের অনেক কাছে এসে আঙুল নাড়তে লাগল। ঠিক যেন আমায় ডাকছে।

আমি চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে?

তখন আমার মনে হল, ওটা ভুত নয় তো ?…

তখন দেখলাম, জলের মধ্যে দুটো চোখ, আমার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টে। চোখ দুটো মাছের মতন, পলক পড়ে না। কিন্তু মাছের নয়, চোখ দুটো সেই লোকটার! আমার একবার ইচ্ছে হল, পালিয়ে যাই।

আবার ভাবলাম, দেখি-না শেষপর্যন্ত কী হয়। আমার তো হাতে লাঠি আছে।

এবার সেই হাতটা খুব কাছে চলে এল। মনে হল যেন আমার পা চেপে ধরবে। এই সময় কে যেন পেছন থেকে আমার নাম ধরে ডাকল, বাবলু! বাবলু!

কিন্তু তখন আমার পেছনে তাকাবার সময় নেই। আমি লাঠি দিয়ে খুব জোরে মারলাম সেই হাতটার ওপর। ঠিক লাগল কিনা বুঝতে পারলাম না, হাতটা জলের মধ্যে ডুবে গেল।

আবার কেউ আমার নাম ধরে ডাকল, বাবলু, বাবলু!

পেছন দিকে তাকিয়ে দেখলাম কেউ নেই। সামনে জলের ওপর সেই হাতটা আবার উঁচু হয়ে উঠেছে।

আমি লাঠি দিয়ে যেই আবার মারতে গেলাম, অমনি সেই হাতটা লাঠিখানা চেপে ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিল, আমি ঝপাং করে জলের মধ্যে পড়ে গেলাম!

জলে পড়েই মনে হল, আমি আর বাঁচব না। আমি যে সাঁতার জানি না! পানিমুড়া আমার পা ধরে সুড়ঙ্গে টেনে নিয়ে যাবে। আমি একবার চেঁচিয়ে উঠলাম, ওমা—! মা!

জলের মধ্যে আমি হাবুডুবু খেতে লাগলাম। দম আটকে আসছে। পানিমুড়া এখনও আমার পা ধরেনি। আমি ছটফট করছি বলে খুঁজে পাচ্ছে না বোধ হয়।

এরই মধ্যে একবার কোনোরকমে জল থেকে একটু মাথা উঁচু করে দেখলাম, মাঠ দিয়ে ছুটে আসছেন আমার মা। আমি চিৎকার করতে চাইলাম, মা—কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরুলো না। আমি তলিয়ে যেতে লাগলাম। মা পাড় থেকেই এক লাফ দিয়ে জলে পড়লেন।

চোখ মেলে দেখলাম, আমি আমাদের বাড়ির বাইরের ঘরে শুয়ে আছি। মা আর আমাদের রাঁধুনি আমার গায়ে গরম জলের সেঁক দিচ্ছে। আমি চোখ মেলতেই মা বললেন, আমি বলেছিলাম না, ওর পেটে বেশি জল ঢোকেনি। এই তো সব ঠিক হয়ে গেছে!

মা ঠিক সময়ে গিয়ে না-পড়লে কী যে হত, ভাবতেও আমার আজও গা কাঁপে। মা ওখানে গেছেন কী করে সেটাও একটা আশ্চর্য ব্যাপার। পরে শুনেছি সেকথা। মা ঘুমিয়ে ছিলেন, এমন সময় তাঁর কানের কাছে কে যেন ডাকল, মা, মা! ঠিক আমার গলা। মা চোখ মেলে দেখলেন, কেউ নেই। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন।

তখন বাইরে থেকে আবার সেই মা—মা ডাক শোনা গেল। তারপর পুকুরঘাট থেকে।

আমি জলে পড়ার সময় মা—মা বলে ডেকেছিলাম ঠিকই। কিন্তু এত দূর থেকে মায়ের তো সেটা শুনতে পাওয়ার কথা নয়। তবু মা শুনতে পেয়েছিলেন।

মা আবার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললেন, বাবলু, তোকে আমি একা একা পুকুরঘাটে যেতে বারণ করেছিলাম, তবু গেলি কেন? কেন জলে নেমেছিলি?

আমি বললাম, মা, আমাকে পানিমুড়া টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

মা বললেন, বাজে কথা।

আমি বললাম, না, সত্যি!

মা বললেন, মোটেই না! তুই পা পিছলে জলে পড়ে গিয়েছিলি!

মা কিছুতেই পানিমুড়ার কথা বিশ্বাস করলেন না। আমাদের রাঁধুনি বলল, হ্যাঁগো দিদি, এসব পুরোনো পুকুরে অনেক ভয়ের জিনিস থাকে।

মা বললেন, সাঁতার না-জানলে লোকে জল দেখে ওরকম অনেক ভয়ের জিনিস বানায়। আমি কাল থেকেই বাবলুকে সাঁতার শেখাব।

এরপর সাতদিনের মধ্যে আমি সাঁতার শিখে গেলাম। পানিমুড়াকে আর কখনো দেখিনি। তবে আমি সাঁতার কাটতে যেতাম নদীতে, ওই পুকুরে আর নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *