পাদটীকা

পাদটীকা

নিষিদ্ধ তালেবান সাম্রাজ্যের বন্দিদশা থেকে অবিশ্বাস্য উপায়ে রিডলি মুক্তি পান দশ দিন পর। মুক্তির পর পরই তিনি হয়ে উঠেন পশ্চিমাসহ সমগ্র বিশ্বের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন আফগানিস্তান সফর রিডলির চোখে তুলে ধরে নতুন এক দিগন্ত। পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমের অর্কেস্ট্রার সুরের মত সমন্বিত প্রচারের বিপক্ষে কথা বলতে শুরু করেন তিনি। তৎকালীন বিশ্বের জনপ্রিয় স্লোগান ও পরাশক্তিদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুঙ্কারকে তিনি আখ্যায়িত করেন ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে। তবে নিরীহ মানবতার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের কালো থাবা তখনো ফ্রাঙ্কেনস্টাইনে রূপ নেয়নি।

তালেবানদের কথা দিয়েছিলেন, মুক্তি পেলে ইসলামের সংবিধান পবিত্র কোরআন পড়ে দেখবেন। নিছক অধ্যয়নের মত করেই তিনি পড়তে শুরু করলেন পবিত্র কোরানের অনুবাদ। কিন্তু কয়েকদিন যেতেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, এ কোন আশ্চর্য গ্রন্থ? পরে বিভিন্ন সময়ে তিনি উল্লেখ করেছেন, ইসলামের নামে তাবত দুনিয়াতে চলমান অসামঞ্জস্যতা, অত্যাচার আর নিগ্রহ শুধুই স্থানভিত্তিক সংস্কৃতি আর পুরুষবাদের প্রতিচ্ছবি। খোদ তালেবানদের পাশবিক অত্যাচার আর নারীকে দমিয়ে রাখার প্রথারও ঘোর সমালোচনা করেন তিনি। সন্ধ্যার আগে মেয়েরা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে পারবে না কিংবা মেয়েশিশুদের জন্য শিক্ষার প্রয়োজন নেই-এসব ধারণা তাঁর মতে কেবলই তালেবানদের ধর্মান্ধতা ও মূর্খতা। তবে তালেবান পরবর্তী স্বাধীন যুগে আফগানিস্তানে যখন সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার খবর নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ায় বাহবা অনুনাদিত হয়, রিডলি তখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। এক রচনায় তিনি উল্লেখ করেন, আফগান মেয়েরা বোরকা খুলে ফেলার বদলে তাদের স্বামীদের কর্মসংস্থান, সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে বেশি চিন্তিত। পশ্চিমা দুনিয়ার প্রদত্ত নারী স্বাধীনতার সংজ্ঞা অধিকাংশ আফগান নারীর নিকট অর্থবহ নয়।

রিডলি পবিত্র কোরআন পাঠের পরে বুঝতে পারেন ইসলামের মর্মার্থ। তুখোড় মদ্যপায়ী রিডলি এক বছর মদ্যপান থেকে দূরে থাকেন। তার বেড়ে উঠার সময় থেকেই জেরির ক্লাব ছিল তার সব থেকে প্রিয় জায়গা। মদ্যপানের এ ক্লাব ছিল তাঁর সুখ দুঃখের নীরব সাক্ষী। কিন্তু সবার অগোচরেই তিনি দূরে থাকেন মদের বোতল থেকে।

অবশেষে তিন বছর পর ২০০৩ সালে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের ঘোষণা দেন। আরেকবার মিডিয়ায় বিপ্লবী রিডলিকে নিয়ে হইচই পড়ে যায়। রিডলি স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্ত বলে সুর তোলেন অনেক বিশেষজ্ঞ। এটি এক ধরনের মানসিক ব্যাধি যেখানে বন্দিশালায় আটক ব্যক্তি তার আটককারীদের জন্য মায়া অনুভব করতে থাকেন। তবে রিডলি এ অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। তাঁর মতে, বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাবার তিন বছর পরে কেউ এ ধরণের মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারে না। তবে এও জানিয়ে দেন, তালেবানদের মহানুভবতা নয়, ইসলামের বক্তব্য, শান্তির বাণী আর নারীদের প্রদত্ত সুমহান মর্যাদাই তাঁকে টেনে নিয়েছে আলোর পথে।

এক সময়ের প্রবল সংগ্রামী নারীবাদী রিডলি ইসলাম গ্রহণ করে নিজেকে আপাদমস্তক বোরকায় জড়িয়ে নেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ওয়াল স্ট্রিটের একজন সফল ব্যবসায়ী ঠিক যেমন স্যুটের বাইরে শুধু গেঞ্জি পরে অফিসে যেতে পারেন না ঠিক তেমনি বোরকাও মুসলমান নারীদের আলাদা পরিচয় বহন করে। বোরকা পরিহিত একজন মুসলিম নারীকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, পুরনো সহকর্মীরাই এখন তাঁকে দেখে তখন সম্মান করে কথা বলেন। আগের মত হাসি ঠাট্টা বা অশ্লীল কথা শুনতে হয় এখন আর। তাঁর মতে এটি এক অসাধারণ অনুভূতি।

মুসলিম নারীদের নির্যাতনের প্রসঙ্গ উঠলেই তিনি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, নারী নির্যাতন কোনো মতবাদ নয়, এটি নির্যাতনকারী পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি মাত্র। ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে বিশ্বের সব স্থানেই নারী নির্যাতনের নমুনার খোঁজ মেলে। এটি শুধু ইসলামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এমনকি আমেরিকা-ইংল্যান্ডেও মেয়েরা স্বামীদের হাতে নিগৃহীত হন। অফিস আদালতে এখনো নারীদের বেতন ভাতা পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। তবে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী শাসিত বিভিন্ন এলাকায় পরিবারের সম্মান রক্ষায় মেয়েসন্তান হত্যা ও মেয়েশিশুদের বর্বর ও অস্বাস্থ্যকর পদ্ধতিতে খতনা করার নিষ্ঠুর প্রথার বিরুদ্ধে তিনি বরাবরই উচ্চকণ্ঠ। ইসলামের কোথাও এসবের স্থান নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব প্রথা মূর্খ লোকদের ধর্মীয় নেতাগিরি আর লোকরঞ্জনবাদের অপ্রয়োজনীয় আস্ফালন।

মুক্তি পাবার কিছুদিন পর রিডলি সানডে এক্সপ্রেসের চাকরিটা ছেড়ে দেন। পরে তিনি দোহাভিত্তিক আল-জাজিরা চ্যানেলে যোগ দেন। প্রবল অহংকারী, রাগী আর স্পষ্টভাষী অতিকথনের অভ্যস্ত রিডলি ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরেও বদলে যাননি এতটুকু। একসময় আলজাজিরার সাংবাদিকতা নীতির সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। ফলে চাকরিটা হারাতে হয় তাঁকে। তবে একরোখা রিডলি মামলা করে বসেন চ্যানেলটির বিরুদ্ধে। অভিযোগ আনেন লিঙ্গ বৈষম্যের। ১৪ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণের মামলাটি জিতেন তিনি ২০০৮ সালে। পরে আরো একবার অপর এক সংবাদ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাতেও তিনি ২৬ হাজার পাউন্ড জিতেন। ইরান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত প্রেস টিভিতেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন তিনি। ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ২০০৮ সালে সাইপ্রাসভিত্তিক গাজা মুক্তি আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি কোনো প্রকার বাধা বিঘ্ন ছাড়াই গাজায় প্রবেশ করেন। সেখানে তকালীন প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়ার সাক্ষাৎকার সংগ্রহ করেন তিনি। পরের বছর এক বিশাল ত্রান সামগ্রী বহরের সাথে তিনি পুনরায় গাজায় প্রবেশ করেন।

রাজনীতি রিডলি একসময় ইংল্যান্ডের চতুর্থ বৃহত্তম দল রেসপেক্ট পার্টিতে যোগ দেন। সেখান থেকে নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেন তিনি। কিন্তু দুই দুইবার নির্বাচনে চতুর্থ হয়ে রাজনীতির মঞ্চে আর খুব একটা আগ্রহ দেখাননি।

পাকিস্তান, তিউনিসিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তা হিসেবে সফর করেন তিনি। একবার তিনি ইউরোপিয়ান মুসলিম মহিলাদের সর্বোচ্চ সংস্থার সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে ভারতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি তাঁকে।

এক দশকের অস্থির বিশ্বে রিডলির অবস্থান

সন্ত্রাস আর প্রতিসন্ত্রাসের পেশী প্রদর্শনের হিংস্র রঙ্গমঞ্চে যখন বিশ্বব্যাপী নিরীহ মুসলমানেরা বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছিল, তখন রিডলি পশ্চিমা নীতিকে একরকম ধুয়ে দেন। একই সাথে অসংলগ্ন কথাবার্তার জন্য নিন্দিত হন তিনি। যেমন, এক ঘটনায় ব্রিটিশ মুসলিমদের পুলিশকে কোনো সাহায্য না করতে অনুরোধ জানান তিনি, যা ব্রিটিশ মুসলমানেরাও পছন্দ করেননি।

তার বন্দিত্বের সময় তালেবানদের দিকে অসংখ্যবার থুতু নিক্ষেপ, ঘৃণা প্রদর্শন আর গালি গালাজ করলেও মুক্তি পাবার পরে তিনি কিছুটা সমব্যথী হয়ে উঠেন। তিনি মনে করেন, সাংবাদিকেরা সবসময় একপেশে বক্তব্য তুলে ধরেন এসব ব্যাপারে। তবে বর্তমান সময়ের জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের ঘোরবিরোধী তিনি। তিনি বলেন, আইএস বিশ্বের তাবত মুসলিমশক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা কোনোকালেই গ্রহণযোগ্য নয়। একসময় লিবিয়া আক্রমণের বিরুদ্ধে কথা বললেও ২০১২ সালে লিবিয়া সফর করে এসে তিনি মত পাল্টান। তিনি মনে করনে, সরকারি গোষ্ঠীর নির্যাতনে মাত্রা এতই বেশি ছিল যে, বিরুদ্ধ দাবানল জ্বলে উঠা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। তার বক্তব্যে লিবিয়ার বিরোধী গোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছিল। তিনি জনপ্রিয় জঙ্গিবাদের আত্মঘাতী হামলার ঘোরবিরোধী। এ সমস্যা সমাধানে পশ্চিমা বিশের প্রচেষ্টাও কুটিপূর্ণ বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি মনে করেন, মুসলিম বিশ্বে চলমান অস্থিরতা আর নির্যাতনের প্রভাবেই জঙ্গিবাদ শিকড় গজিয়ে উঠে। তাই মুসলিম বিশ্বের সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান জঙ্গিবাদ দমনে সহায়ক হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

ইসরায়েল ও ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে রিডলি অন্তরে ভীষণ ঘৃণা পোষণ করেন। ২০০৬ সালে ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের এক সম্মেলনে তিনি ইসরায়েলকে আমেরিকার প্রশিক্ষিত কুকুর বলে আখ্যায়িত করেন। এমনকি তাঁর নিজস্ব রেসপেক্ট পার্টি থেকে ইহুদি সমর্থকদের ঝেটিয়ে বের করবারও হুমকি দেন তিনি।

বিভিন্ন দেশে আমেরিকার ড্রোন হামলায় বেসামরিক লোকজন নিহত হবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছেন তিনি। সমমনা মহিলাদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘শান্তি বাহিনী। পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত এলাকায় যেসব মহিলারা প্রতিনিয়ত ড্রোন হামলার ভয়ে থাকে তাদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে এই শান্তি বাহিনী।

ব্যক্তিগত সাফল্য

তিনি মুসলিম মহিলা সংঘের ইউরোপীয় শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১০ সালে। লন্ডনভিত্তিক বহু বিখ্যাত সংবাদপত্রের সাথে কাজ করেছেন।

একই সাথে তিনি একজন অহিংস আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী, নাগরিক অধিকার রক্ষা ও মহিলাদের প্রতি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছেন।

২০১০ সালে মিলানে প্রতিষ্ঠিত ইউরোপিয়ান মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে সংগঠনটির সহ সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত আছেন।

২০১১ সালে তিনি আরব আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত আছেন। বছর কয়েক আগে সুদানের দারফুরে যে জাতিগত সংঘাত দেখা দেয় তা মিটাতে মুসলমানদের এক উদ্যোগের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি বিশ্ব সাংবাদিক সংস্থা, ইউরোপিয়ান সাংবাদিক সংস্থা ও মহিলা সাংবাদিক সংস্থার সদস্য।

২০০৮ সালে গাজা অভিমুখে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে একটি জাহাজ নৌপথে যাত্রা শুরু করে। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অহিংসবাদী সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও দক্ষিন আফ্রিকার বিখ্যাত আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু। সে সময় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ উদ্যোগের প্রশংসা করে একে গান্ধির অহিংস আন্দোলনের সাথে তুলনা করা হয়। সেই জাহাজে রিডলি সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। পরে জাহাজটিতে ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালিয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দার মুখে পড়ে।

বিশ্বের প্রতিটা দেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা রিডলি সবসময় বলে থাকেন।

রিডলি লেখালেখির পাশাপাশি ফিল্ম ক্যামেরার পিছনেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

তার নির্মিত একাধিক প্রামাণ্যচিত্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ কয়েকবার পুরস্কার পেয়েছে।

 
[সমাপ্ত]

পাদটীকা

পাদটীকা

পাদটীকা
সৈয়দ মুজতবা আলী

গত শতকের শেষ আর এই শতকের গোড়ার দিকে আমাদের দেশের টোলগুলো মড়ক লেগে প্রায় সম্পূর্ণ উজাড় হয়ে যায়। পাঠান-মোগল আমলে যে দুর্দৈব ঘটেনি ইংরাজ রাজত্বে সেটা প্রায় আমাদেরই চোখের সামনে ঘটল। অর্থনৈতিক চাপে পড়ে দেশের কর্তাব্যক্তিরা ছেলে-ভাইপোকে টোলে না পাঠিয়ে ইংরেজি ইস্কুলে পাঠাতে আরম্ভ করলেন। চতুর্দিকে ইংরেজি শিক্ষার জয়-জয়কার পড়ে গেল—সেই ডামাডোলে টোল মরল, আর বিস্তর কাব্যতীর্থ বেদান্তবাগীশ না খেয়ে মারা গেলেন।
এবং তার চেয়েও হৃদয়বিদারক হলো তাঁদের অবস্থা, যাঁরা কোনো গতিকে সংস্কৃত, বাংলার শিক্ষক হয়ে হাই স্কুলগুলোতে স্থান পেলেন। এঁদের আপন আপন বিষয়ে অর্থাৎ, কাব্য, অলংকার, দর্শন ইত্যাদিতে এঁদের পাণ্ডিত্য ছিল অন্য শিক্ষকদের তুলনায় অনেক বেশি, কিন্তু সম্মান এবং পারিশ্রমিক এঁরা পেতেন সবচেয়ে কম। শুনেছি কোনো কোনো স্কুলে পণ্ডিতের মাইনে চাপরাশীর চেয়েও কম ছিল।
আমাদের পণ্ডিতমশাই তর্কালঙ্কার না কাব্যবিশারদ ছিলেন আমার আর ঠিক মনে নেই; কিন্তু এ কথা মনে আছে যে পণ্ডিতসমাজে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রচুর এবং তাঁর পিতৃপিতামহ চতুর্দশ পুরুষ শুধু যে ভারতীয় সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সাধক ছিলেন তা নয়, তাঁরা কখনো পরান্ন ভক্ষণ করেননি—পালপরব শ্রাদ্ধনিমন্ত্রণে পাত পাড়ার তো কথাই ওঠে না।
বাঙলা ভাষার প্রতি পণ্ডিতমশাইয়ের ছিল অবিচল, অকৃত্রিম অশ্রদ্ধা-ঘৃণা বললেও হয়তো বাড়িয়ে বলা হয় না। বাঙলাতে যেটুকু খাঁটি সংস্কৃত বস্তু আছে তিনি মাত্র সেইটুকু পড়াতে রাজি হতেন—অর্থাৎ কৃৎ, তদ্ধিত, সন্ধি এবং সমাস। তাও বাঙলা সমাস না। আমি একদিন বাঙলা রচনায় ‘দোলা-লাগা’, ‘পাখী-জাগা’ উদ্ধৃত করেছিলুম বলে তিনি আমার দিকে দোয়াত ছুড়ে মেরেছিলেন। ক্রিকেট ভালো খেলা—সে দিন কাজে লেগে গিয়েছিল। এবং তারপর মুহূর্তেই বি পূর্বক, আ পূর্বক, ঘ্রাধাতুকে উত্তর দিয়ে সংস্কৃত ব্যাঘ্রকে ঘায়েল করতে পেরেছিলুম বলে তিনি আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, ‘এই দণ্ডেই তুই স্কুল ছেড়ে চতুষ্পাঠীতে যা। সেখানে তোর সত্য বিদ্যা হবে।’
কিন্তু পণ্ডিতমশাই যত না পড়াতেন, তার চেয়ে বকতেন ঢের বেশি এবং টেবিলের উপর পা দু’খানা তুলে দিয়ে ঘুমুতেন সবচেয়ে বেশি। বেশ নাক ডাকিয়ে এবং হেডমাস্টারকে একদম পরোয়া না করে। কারণ হেডমাস্টার তাঁর কাছে ছেলেবেলায় সংস্কৃত পড়েছিলেন এবং তিনি যে লেখাপড়ায় সর্বাঙ্গনিন্দনীয় হস্তীমূর্খ ছিলেন সে কথাটি পণ্ডিতমশাই বারম্বার অহরহ সর্বত্র উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতেন। আমরা সে কাহিনী শুনে বিমলানন্দ উপভোগ করতুম, আর পণ্ডিতমশাইকে খুশি করবার পন্থা বাড়ন্ত হলে ঐ বিষয়টি নূতন করে উত্থাপন করতুম।
আমাকে পণ্ডিতমশাই একটু বেশি স্নেহ করতেন। তার কারণ বিদ্যাসাগরী বাঙলা লেখা ছিল আমার বাই; ‘দোলা-লাগা, ‘পাখী-জাগা’ই আমার বর্ণাশ্রম ধর্ম পালনে একমাত্র গোমাংস ভক্ষণ। পণ্ডিতমশাই যে আমাকে সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন তার প্রমাণ তিনি দিতেন আমার উপর অহরহ নানাপ্রকার কটুকাটব্য বর্ষণ করে। ‘অনার্য’, ‘শাখামৃগ’, দ্রাবিড়সম্ভূত’ কথাগুলো ব্যবহার না করে তিনি আমাকে সাধারণত সম্বোধন করতেন না; তা ছাড়া এমন সব অশ্লীল কথা বলতেন যে তার সঙ্গে তুলনা দেবার মতো জিনিস আমি দেশ বিদেশে কোথাও শুনিনি। তবে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে পণ্ডিতমশাই শ্লীল অশ্লীল উভয় বস্তুই একই সুরে একই পরিমাণে ঝেড়ে যেতেন, সম্পূর্ণ অচেতন, বীতরাগ এবং লাভালাভের আশা বা ভয় না করে! এবং তাঁর অশ্লীলতা মার্জিত না হলেও অত্যন্ত বিদগ্ধরূপেই দেখা দিত বলে আমি বহু অভিজ্ঞতার পর এখনো মনস্থির করতে পারিনি যে, সেগুলো শুনতে পেয়ে আমার লাভ না ক্ষতি, কোনটা বেশি হয়েছে।
পণ্ডিত মহাশয়ের বর্ণ ছিল শ্যাম। তিন মাসে একদিন দাড়ি-গোঁফ কামাতেন এবং পরতেন হাঁটু-জোকা ধুতি। দেহের উত্তমার্ধে একখানা দড়ি প্যাঁচানো থাকতো—অজ্ঞেরা বলত সেটা নাকি দড়ি নয়, চাদর। ক্লাসে ঢুকেই তিনি সেই দড়িখানা টেবিলের উপর রাখতেন, আমাদের দিকে রোষকষায়িত লোচনে তাকাতেন, আমাদের বিদ্যালয়ে না এসে যে চাষ করতে যাওয়াটা সমধিক সমীচীন সে কথাটা দ্বি’সহস্রবারের মতো স্মরণ করিয়ে দিতে দিতে পা দুখানা টেবিলের উপর লম্বমান করতেন। তারপর যে কোনো একটা অজুহাত ধরে আমাদের এক চোট বকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। নিতান্ত যে দিন কোনো অজুহাতই পেতেন না ধর্মসাক্ষী সে কসুর আমাদের নয়—সেদিন দু’চারটে কৃৎ-তদ্ধিত সম্বন্ধে আপন মনে—কিন্তু বেশ জোর গলায় আলোচনা করে উপসংহারে বলতেন; কিন্তু এই মূর্খদের বিদ্যাদান করবার প্রচেষ্টা বন্ধ্যাগমনের মতো নিষ্ফল নয় কি?’ তারপর কখনো আপন গতাসু চতুষ্পাঠীর কথা স্মরণ করে বিড়বিড় করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে অভিশাপ দিতেন, কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে টানাপাখার দিকে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘুমিয়ে পড়তেন।
শুনেছি, ঋগ্বেদে আছে, যমপত্নী যমী যখন যমের মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকাতুরা হয়ে পড়েন তখন দেবতারা তাঁকে কোনো প্রকারে সান্ত্বনা না দিতে পেরে শেষটায় তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাই আমার বিশ্বাস পণ্ডিতমশায়ের টোল কেড়ে নিয়ে দেবতারা তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জ্য অহরহ ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। কারণ এ রকম দিনযামিনী সায়ংপ্রাতঃ শিশিরবসন্তে বেঞ্চি চৌকিতে যতত্রত অকাতরে ঘুমিয়ে পড়তে পারাটা দেবতার দান—এ কথা অস্বীকার করার জো নেই।
বহু বৎসর হয়ে গিয়েছে, সেই ইস্কুলের সামনে সুরমা নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে; কিন্তু আজও যখন তাঁর কথা ব্যাকরণ সম্পর্কে মনে পড়ে তখন তাঁর যে ছবিটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটি তাঁর জাগ্রত অবস্থার নয়; সে ছবিতে দেখি, টেবিলের উপর দু’পা-তোলা, মাথা একদিকে ঝুলে পড়া টিকিতে দোলা-লাগা কাষ্ঠাসন শরশয্যায় শায়িত ভারতীয় ঐতিহ্যের শেষ কুমার ভীষ্মদেব। কিন্তু ছিঃ, আবার ‘দোলা-লাগা’ সমাস ব্যবহার করে পণ্ডিতমশায়ের প্রেতাত্মাকে ব্যথিত করি কেন?
সে সময়ে আসামের চিফ-কমিশনার ছিলেন এন ডি বিটসন বেল। সাহেবটির মাথায় একটু ছিট ছিল। প্রথম পরিচয়ে তিনি সবাইকে বুঝিয়ে বলতেন যে তার নাম, আসলে ‘নন্দদুলাল বাজায় ঘণ্টা’। ‘এনডি’তে হয় ‘নন্দদুলাল’ আর বিটসন বেল অর্থ ‘বাজায় ঘণ্টা’—দুয়ে মিলে হয় ‘নন্দদুলাল বাজায় ঘণ্টা’।
সেই নন্দদুলাল এসে উপস্থিত হলেন আমাদের শহরে।
ক্লাসের জ্যাঠা ছেলে ছিল পদ্মলোচন। সেই একদিন খবর দিল লাট সাহেব আসছেন স্কুল পরিদর্শন করতে—পদ্মর ভগ্নিপতি লাটের টুর ক্লার্ক না কি, সে তাঁর কাছ থেকে পাকা খবর পেয়েছে।
লাটের ইস্কুল আগমন অবিশ্রিত আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা নয়। একদিক দিয়ে যেমন বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ কসুর বিনা-কসুরে লাট আসার উত্তেজনায় খিটখিটে মাস্টারদের কাছ থেকে কপালে কিলটা চড়টা আছে, অন্যদিকে তেমনি লাট চলে যাওয়ার পর তিন দিনের ছুটি।
হেডমাস্টারের মেজাজ যখন সক্কলের প্রাণ ভাজা ভাজা করে ছাই বানিয়ে ফেলার উপক্রম করেছে এমন সময় খবর পাওয়া গেল, শুক্কুরবার দিন হুজুর আসবেন।
ইস্কুল শুরু হওয়ার এক ঘণ্টা আগে আমরা সেদিন হাজিরা দিলুম। হেডমাস্টার ইস্কুলের সর্বত্র চড়কিবাজীর মতন তুর্কি-নাচন নাচছেন। যেদিকে তাকাই সে দিকেই হেডমাস্টার। নিশ্চয়ই তাঁর অনেকগুলো যমজ ভাই আছেন, আর ইস্কুল সামলাবার জন্য সেদিন সব কজনকে রিকুইজিশন করে নিয়ে এসেছেন।
পদ্মলোচন বললে, ‘কমন রুমে গিয়ে মজাটা দেখে আয়।’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘দেখেই আয় না ছাই।’
পদ্ম আর যা করে করুক কখনো বাসি খবর বিলোয় না। হেডমাস্টারের চড়ের ভয় না মেনে কমন রুমের কাছে গিয়ে জানলা দিয়ে দেখি, অবাক কাণ্ড! আমাদের পণ্ডিত মশাই একটা লম্বা হাতা আনকোরা নূতন হলদে রঙের গেঞ্জি পরে বসে আছেন আর বাদবাকি মাস্টাররা কলরব করে সে গেঞ্জিটার প্রশংসা করছেন। নানা মুনি নানা গুণকীর্তন করছেন; কেউ বলছেন, পণ্ডিতমশাই কি বিচক্ষণ লোক, বেজায় সস্তায় দাও মেরেছে (গাঁজা, পণ্ডিতমশায়ের সাংসারিক বুদ্ধি একরত্তি ছিল না), কেউ বলছেন আহা, যা মানিয়েছে (হাতী, পণ্ডিতমশাইকে সার্কাসের সঙের মতো দেখাচ্ছিল), কেউ বলছেন, যা ফিট করেছে (মরে যাই, গেঞ্জির আবার ফিট অফিট কি?)।
শেষটায় পণ্ডিতমশায়ের ইয়ার মৌলভী সায়েব দাড়ি দুলিয়ে বললেন, ‘বুঝলে ভশ্চাচ, এ রকম উমদা গেঞ্জি স্রেফ দু’খানা তৈরি হয়েছিল, তারই একটা কিনেছিল পঞ্চম জর্জ, আর দুসরাটা কিনলে তুমি। এ দুটো বানাতে গিয়ে কোম্পানি দেউলে হয়ে গিয়েছে, আর কারো কপালে এ রকম গেঞ্জি নেই।’
চাপরাশী নিত্যানন্দ দূর থেকে ইশারায় জানাল, ‘বাবু আসছেন।’
তিন লম্ফে ক্লাসে ফিরে গেলুম।
সেকেন্ড পিরিয়ডে বাঙলা। পণ্ডিতমশাই আসতেই আমরা সবাই ত্রিশ গাল হেসে গেঞ্জিটার দিকে তাকিয়ে রইলুম। ইতিমধ্যে রেবতী খবর দিল যে শাস্ত্রে সেলাই করা কাপড় পরা বারণ বলে পণ্ডিতমশাই পাঞ্জাবী শার্ট পরেন না; কিন্তু লাট সায়েব আসছেন, শুধু গায়ে ইস্কুল আসা চলবে না, তাই গেঞ্জি পরে এসেছেন। গেঞ্জি বোনা জিনিস, সেলাই করা কাপড়ের পাপ থেকে পণ্ডিতমশাই কৌশলে নিষ্কৃতি পেয়েছেন।
গেঞ্জি দেখে আমরা এতই মুগ্ধ যে পণ্ডিতমশায়ের গালাগাল, বোয়াল-চোখ সব কিছুর জন্যই আমরা তখন তৈরি কিন্তু কেন জানিনে তিনি তাঁর রুটিন মাফিক কিছুই করলেন না। বকলেন না, চোখ লাল করলেন না, লাট আসছেন, কাজেই টেবিলে ঠ্যাং তোলার কথাও উঠতে পারে না। তিনি চেয়ারের উপর অত্যন্ত বিরস বদনে বসে রইলেন।
পদ্মলোচনের ডর ভয় কম। আহ্লাদে ফেটে গিয়ে বলল, ‘পণ্ডিতমশাই, গেঞ্জিটা কদ্দিয়ে কিনলেন?’ আশ্চর্য, পণ্ডিতমশাই খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলেন না, নির্জীব কণ্ঠে বললেন, ‘পাঁচ সিকে।’
আধ মিনিট যেতে না যেতেই পণ্ডিতমশাই দুহাত দিয়ে ক্ষণে হেথায় চুলকান ক্ষণে হোথায় চুলকান। পিঠের অসম্ভব অসম্ভব জায়গায় কখনো ডান হাত, কখনো বাঁ হাত দিয়ে চুলকানোর চেষ্টা করেন, কখনো মুখ বিকৃত করে গেঞ্জির ভিতর হাত চালান করে পাগলের মতো এখানে ওখানে খ্যাঁস খ্যাঁস করে খামচান।
একে তো জীবন-ভর উত্তমাঙ্গে কিছু পরেননি, তার উপর গেঞ্জি, সেও আবার একদম নূতন কোরা গেঞ্জি।
বাচ্চা ঘোড়ার পিঠে পয়লা জিন লাগালে সে যে-রকম আকাশের দিকে দু’পা তুলে তড়পায়, শেষটায় পণ্ডিতমশায়ের সেই অবস্থা হলো। কখনো করুণ কণ্ঠে অস্ফুট আর্তনাদ করেন, ‘রাধামাধব, এ কী গব্ব-যন্তণা, কখনো এক হাত দিয়ে আরেক হাত চেপে ধরে, দাঁত কিড়মিড় খেয়ে আত্মসম্বরণ করার চেষ্টা করেন—লাট সায়েবের সামনে তো সর্বাঙ্গ আঁচড়ানো যাবে না।
শেষটায় থাকতে না পেরে আমি উঠে বললুম, ‘পণ্ডিত মশাই, আপনি গেঞ্জিটা খুলে ফেলুন। লাট সায়েব এলে আমি জানলা দিয়ে দেখতে পাব। তখন না হয় ফের পরে নেবেন।’
বললেন, ‘ওরে জড়ভরত, গব্ব-যন্তণাটা খুলছি নে, পরার অভ্যেস হয়ে যাবার জন্য।’ আমি হাত জোড় করে বললুম, ‘একদিনে অভ্যেস হবে না পণ্ডিতমশাই, ওটা আপনি খুলে ফেলুন।’
আসলে পণ্ডিতমশাইয়ের মতলব ছিল গেঞ্জিটা খুলে ফেলারই; শুধু আমাদের কারো কাছ থেকে একটু মরাল সাপোর্টের অপেক্ষায় এতক্ষণ বসে ছিলেন। তবু সন্দেহ ভরা চোখে বললেন, ‘তুই তো একটা আস্ত মর্কট—শেষটায় আমাকে ডোবাবি না তো? তুই যদি হুঁশিয়ার না করিস, আর লাট যদি এসে পড়েন?’
আমি ইহলোক পরলোক সর্বলোক তুলে দিব্যি, কিরে, কসম খেলুম।
পণ্ডিতমশাই গেঞ্জিটা খুলে টেবিলের উপর রেখে সেটার দিকে যে দৃষ্টি হানলেন, তাঁর টিকিটি কেউ কেটে ফেললেও তিনি তার দিকে এর চেয়ে বেশি ঘৃণা মাখিয়ে তাকাতে পারতেন না। তারপর লুপ্তদেহটা ফিরে পাওয়ার আনন্দে প্রাণভরে সর্বাঙ্গ খামচালেন। বুক পিঠ ততক্ষণে বেগ্নি রঙের আঁজিতে ভর্তি হয়ে গিয়েছে।
এরপর আর কোনো বিপদ ঘটল না। পণ্ডিতমশাই থেকে থেকে রাধামাধবকে স্মরণ করলেন, আমি জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলুম, আর সবাই গেঞ্জিটার নাম, ধাম, কোন দোকানে কেনা, সস্তা না আক্রা, তাই নিয়ে আলোচনা করল।
আমি সময়মতো ওয়ার্নিং দিলুম। পণ্ডিতমশাই আবার তাঁর ‘গব্বযন্তণাটা’ উত্তমাঙ্গে মেখে নিলেন।
লাট এলেন; সঙ্গে ডেপুটি কমিশনার, ডাইরেক্টর, ইনসপেক্টর, হেডমাস্টার, নিত্যানন্দ—আর লাট সায়েবের এডিসি ফেডিসি না কি সব বারান্দায় জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ‘হ্যালো পানডিট’ বলে সায়েব হাত বাড়ালেন। রাজসম্মান পেয়ে পণ্ডিতমশায়ের সর্ব যন্ত্রণা লাঘব হলো। বারবার ঝুঁকে ঝুঁকে সায়েবকে সেলাম করলেন—এই অনাদৃত পণ্ডিত শ্রেণী সামান্যতম গতানুগতিক সম্মান পেলেও যে কি রকম বিগলিত হতেন তা তাঁদের সে সময়কার চেহারা না দেখলে অনুমান করার উপায় নেই।
হেডমাস্টার পণ্ডিতমশায়ের কৃৎ-তদ্ধিতের বাই জানতেন, তাই নির্ভয়ে ব্যাকরণের সর্বোচ্চ নভঃস্থলে উড্ডীয়মান হয়ে বিহঙ্গ’ শব্দের তত্ত্বানুসন্ধান করলেন। আমরা জন দশেক এক সঙ্গে চেঁচিয়ে বললুম, ‘বিহায়স পূর্বক গম ধাতু খ’ লাট সায়েব হেসে বললেন, ‘ওয়ান এ্যাট ও টাইম, প্লিজ’। লাট সাহেব আমাদের বলল, ‘প্লিজ একি কাণ্ড।’ তখন আবার আর কেউ রা কাড়ে না। হেডমাস্টার শুধালেন ‘বিহঙ্গ’, আমরা চুপ, —তখনো প্লিজের ধকল কাটেনি। শেষটায় ব্যাকরণে নিরেট পাঁঠা যতেটা আমাদের উত্তর আগ শুনে নিয়েছিল বলে ক্লাসে নয়, দেশে নাম করে ফেলল—আমরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম।
লাট সায়েব ততক্ষণে হেডমাস্টারের সঙ্গে ‘পণ্ডিত’ শব্দের মূল নিয়ে ইংরেজিতে আলোচনা জুড়ে দিয়েছেন। হেডমাস্টার কি বলেছিলেন জানিনে, তবে রবীন্দ্রনাথ নাকি পণ্ডিতদের ধর্মে জয়শীলতার প্রতি বিদ্রূপ করে বলেছিলেন, যার সব কিছু পণ্ড হয়ে গিয়েছে সেই পণ্ডিত!
ইংরেজ শাসনের ফলে আমাদের পণ্ডিতদের সর্বনাশ, সর্বস্ব পণ্ডের ইতিহাস হয়তো রবীন্দ্রনাথ জানতেন না,—না হলে ব্যঙ্গ করার পূর্বে হয়তো একটু ভেবে দেখতেন।
সে কথা থাক। লাট সায়েব চলে গিয়েছেন, যাবার পূর্বে পণ্ডিতমশায়ের দিকে একখানা মোলায়েম নড করাতে তিনি গর্বে চৌচির হয়ে ফেটে যাবার উপক্রম। আনন্দের আতিশয্যে নতুন গেঞ্জির চুলকুনির কথা পর্যন্ত ভুল গিয়েছেন। আমরা দু তিনবার স্মরণ করিয়ে দেবার পর গেঞ্জিটা তাঁর শ্রীঅঙ্গ থেকে ডিগ্রেডেড হলো।
তিন দিন ছুটির পর ফের বাঙলা ক্লাস বসেছে। পণ্ডিতমশাই টেবিলের উপর পা তুলে দিয়ে ঘুমুচ্ছেন, না শুধু চোখ বন্ধ করে আছেন ঠিক ঠাহর হয়নি বলে তখনো গোলমাল আরম্ভ হয়নি।
কারো দিকে না তাকিয়েই পণ্ডিতমশাই হঠাৎ ভরা মেঘের ডাক ছেড়ে বললেন, ‘ওরে ও শাখামৃগ!’
নীল যাহার কণ্ঠ তিনি নীলকণ্ঠ—যোগরূঢ়ার্থে শিব। শাখাতে যে মৃগ বিচরণ করে সে শাখামৃগ, অর্থাৎ বাঁদর-ক্লাসরূঢ়ার্থে আমি। উত্তর দিলুম, ‘আজ্ঞে।’
পণ্ডিতমশাই শুধালেন, ‘লাট সায়েবের সঙ্গে কে কে এসেছিল বল তো রে।’
আমি সম্পূর্ণ ফিরিস্তি দিলুম। চাপরাশী নিত্যানন্দকেও বাদ দিলুম না।
বললেন, ‘হলো না। আর কে ছিল?’ বললুম ‘ঐ যে বললুম, এক গাদা এডিসি না প্রাইভেট সেক্রেটারি না আর কিছু সঙ্গে ছিলেন। তাঁরা তো ক্লাসে ঢোকেননি’।
পণ্ডিতমশাই ভরা মেঘের গুরু গুরু ডাক আরো গম্ভীর করে শুধালেন, ‘এক কথা বাহান্ন বার বলছিস কেন রে মূঢ়? আমি কালা না তোর মতো অলম্বুষ?’
আমি কাতর হয়ে বললুম, আর তো কেউ ছিল না পণ্ডিতমশাই, জিজ্ঞেস করুন না পদ্মলোচনকে, সে তো সবাইকে চেনে?’
পণ্ডিতমশাই হঠাৎ চোখ মেরে আমার দিকে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘ওঃ, উনি আবার লেখক হবেন। চোখে দেখতে পাসনে, কানা, দিবান্ধ-রাত্র্যন্ধ হলেও না হয় বুঝতুম। কেন? লাট সায়েবের কুকুরটাকে দেখতে পাসনি? এই পর্যবেক্ষণ শক্তি নিয়ে—
আমি তাড়াতাড়ি বললুম, ‘হাঁ, হাঁ, দেখেছি। ও তো এক সেকেন্ডের তরে ক্লাসে ঢুকেছিল।’
পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘মর্কট এবং সারমেয় কদাচ এক গৃহে অবস্থান করে না। সে কথা যাক। কুকুরটার কি বৈশিষ্ট্য ছিল বল তো?’
ভাগ্যিস মনে পড়ল। বললুম, আজ্ঞে, একটা ঠ্যাং কম ছিল বলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল।’
‘হুঁ’ বলে পণ্ডিতমশাই আবার চোখ বন্ধ করলেন।
অনেকক্ষণ পর বললেন, ‘শোন। শুক্রবার দিন ছুটির পর কাজ ছিল বলে অনেক দেরিতে ঘাটে গিয়ে দেখি আমার নৌকার মাঝি এক অপরিচিতের সঙ্গে আলাপ করছে। লোকটা মুসলমান, মাথায় কিস্তিটুপী। আমাকে অনেক সেলাম টেলাম করে পরিচয় দিল, সে আমাদের গ্রামের মিম্বর উল্লার শালা; লাট সায়েবের আরদালি, সায়েবের সঙ্গে এখানে এসেছে, আজকের দিনটা ছুটি নিয়েছে তার দিদিকে দেখতে যাবে বলে। গাটে আর নৌকা নেই। আমি যদি মেহেরবানি করে একটু স্থান দিই।’
পণ্ডিতমশায়ের বাড়ি নদীর ওপারে, বেশ খানিকটা উজিয়ে। তাই তিনি বর্ষাকালে নৌকোয় যাতায়াত করতেন আর সকলকে অকাতরে লিফট দিতেন।
পণ্ডিতমশায় বললেন, ‘লোকটার সঙ্গে কতাবার্তা হলো। লাট সায়েবের সব খবর জানে, তোর মতো কানা নয়, সব জিনিস দেখে, সব কথা মনে রাখে। লাট সায়েবের কুকুরটার একটা ঠ্যাং কি করে ট্রেনের চাকায় কাটা যায় সে খবরটাও বেশ গুছিয়ে বলল।’
তারপর পণ্ডিতমশাই ফের অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর আপন মনে আস্তে আস্তে বললেন, ‘আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আমরা আটজনা।’
তারপর হঠাৎ কথা ঘুরিয়ে ফেলে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মদনমোহন কি রকম আঁক শেখায় রে?’
মদনমোহনবাবু আমাদের অঙ্কের মাস্টার—পণ্ডিতমশায়ের ছাত্র। বললুম, ‘ভালই পড়ান।’

পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘বেশ বেশ! তবে শোন। মিম্বর উল্লার শালা বলল, লাট সায়েবের কুত্তাটার পিছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচা হয়। এইবার দেখি, কি রকম আঁক শিখেছিস। বলতো দেখি, যদি একটা কুকুরের পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্য কত খরচ হয়?’
আমি ভয় করছিলুম পণ্ডিতমশাই একটা মারাত্মক রকমের আঁক কষতে দেবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম, ‘আজ্ঞে, পঁচিশ টাকা।’ পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘সাধু, সাধু!’
তারপর বললেন, ‘উত্তম প্রস্তাব। অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারণের জন্য আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা। এখন বল তো দেখি, তবে বুজি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?’
আমি হতবাক।
‘বল না।’
আমি মাথা নীচু করে বসে রইলুম। শুধু আমি না, সমস্ত ক্লাস নিস্তব্ধ।
পণ্ডিতমশাই হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘উত্তর দে।’
মূর্খের মতো একবার পণ্ডিতমশায়ের মুখের দিকে মিটমিটিয়ে তাকিয়েছিলুম। দেখি, সে মুখ লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে।
ক্লাসের সব ছেলে বুঝতে পেরেছে—কেউ বাদ যায়নি—পণ্ডিতমশাই আত্ম অবমাননার কি নির্মম পরিহাস সর্বাঙ্গে মাখছেন, আমাদের সাক্ষী রেখে।
পণ্ডিতমশাই যেন উত্তরের প্রতীক্ষায় বসেই আছেন। সেই জগদ্দল নিস্তব্ধতা ভেঙে কতক্ষণ পরে ক্লাস শেষের ঘণ্টা বেজেছিল আমার হিসেব নেই।
এই নিস্তব্ধতার নিপীড়নস্মৃতি আমার মন থেকে কখনো মুছে যাবে না।
‘নিস্তব্ধতা হিরণ্ময়’ ‘Silence is golden’ যে মূর্খ বলেছে তাকে যেন মরার পূর্বে একবার একলা-একলি পাই।

6 Comments
Collapse Comments

chacha kahinir sob golpogulo din.

Bangla Library (Administrator) December 21, 2013 at 9:14 pm

অনেকেই যার যার পছন্দমত লেখাগুলো আগে আগে চাইছেন। কিন্তু সব এক সাথে দেয়ার মত লোকবল/অর্থবল কোনটাই আমাদের নেই। তবে আশা করি ধীরে ধীরে সবই আমরা দিতে পারব। হয়তো একটু সময় লাগবে। সাথে থাকবেন। ধন্যবাদ।

Irin সুলতানা আঁখি August 11, 2021 at 4:30 pm

ধন্যবাদ আপনাদের এই প্রয়াস সব সময় অব্যাহত থাকুক।

#Bangla Library Thank you from the core of the heart . Mar.6.2019 1.30 am, Nyc

Animesh chakraborty August 9, 2021 at 9:02 pm

Pl include Birendra Krishna Bhadra(Birupakhsa) in the writers list

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *