পাথরমহল
পরিত্যক্ত কবরস্থানে
মাঠাবুরু পাহাড়ের পিছনে সূর্য তখন ডুবছে। সামনে হাঁটুডোবা জল। সরু নদীটার ওপারে শাল, মহুয়ার অরণ্য। জায়গাটায় জনবসতি কম। এমনিতেই সমস্ত দিন নিরিবিলি, নিস্তব্ধ। এখন পড়ন্ত বিকেলে চারিদিক যেন নিঃসাড়। থমথম করছে।
নদীর ধারে বড়ো বড়ো গাছপালার আড়ালে একটা পুরনো কবরস্থান। কবরস্থানটা পরিত্যক্ত। শহরের বাইরে এই কবরস্থানে কেউ এখন আর কবর দিতে আসে না। চোরকাটা আর বুনো গাছের ঝোপে ভর্তি।
সেদিন পড়ন্তবেলায় হঠাৎ এই পরিত্যক্ত কবরস্থানেই একটা কালো কফিন কাঁধে করে কয়েকজন লোক এল। সাধারণত কবর দেবার সময় শবদেহের সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই আসে। কিন্তু এই মৃতদেহের সঙ্গে লোক ছিল খুব অল্প। আর যারা ছিল তারাও যেন কেমন ভয়ে কাঁটা হয়ে ছিল। যেন কোনো গোপন ব্যাপার তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলতে এসেছে। এমনকি স্বয়ং পাদ্রিসাহেবের চোখেমুখেও অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠেছে।
কবর আগেই কাটা হয়েছিল। দড়ি বেঁধে খুব তাড়াতাড়ি কফিনটা নামিয়ে দেওয়া হলো। তখন পাশের ইউক্যালিপটাস গাছটার ওপর একঝাক পাখি কিচিরমিচির করে উঠল। যেন তারাও কিছু বলতে চাইল।
প্রথামতো যে কজন লোক দাঁড়িয়েছিল তারা নিচে কফিনের ওপর একমুঠো করে মাটি ছুঁড়ে দিল। তখন গম্ভীর গলায় পাদ্রিসাহেব পড়ছিলেন–যেহেতু সর্বশক্তিমান ঈশ্বর আপন পরম দয়াতে প্রসন্ন হইয়া এক্ষণে পরলোকগত আমাদের প্রিয় ভ্রাতার আত্মাকে–
প্রিয় ভ্রাতা কথাটি উচ্চারণ করতে গিয়ে পাদ্রিসাহেবের গলার স্বর হঠাৎ আটকে গেল। তিনি দুবার স্বর পরিষ্কার করে নিয়ে ফের পড়তে লাগলেন–প্রিয় ভ্রাতার আত্মাকে আপনার নিকট লইয়াছেন, অতএব আমরা তাহার শরীর ভূমিতে সমর্পণ করি, মৃত্তিকাতে মৃত্তিকা, ভস্মেতে ভস্ম, ধূলাতে ধূলা, এই সত্য ও নিশ্চিত ভরসায় যে, আমাদের প্রভু যীশুখৃস্ট দ্বারা অনন্ত জীবন পুনরুত্থান হইবে।
পরে সকলে চোখ বন্ধ করে হাত জোড় করে পাদ্রির সঙ্গে গলা মিলিয়ে সমবেত কণ্ঠে এই কটি কথা উচ্চারণ করল–
হে প্রভু, আমাদের প্রতি দয়া করো।
হে খৃস্ট, আমাদের প্রতি দয়া করো।
হে ত্রাতা, আমাদের প্রতি দয়া করো।
যারা এর আগে পাদ্রিসাহেবের প্রার্থনা শুনেছে তারা লক্ষ্য করল আজ আর তার সেই ভরাট গম্ভীর গলা নয়, পরিবর্তে যেন ক্ষীণ স্বর তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিচ্ছিল। অথচ সে স্বর কিছুতেই অঞরুদ্ধ নয়।
কেন এই কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন?
শুধু পাদ্রিসাহেবেই নন, যারা উপস্থিত ছিল তারা কেউই প্রার্থনা মন দিয়ে শুনছিল না। প্রার্থনা শেষ হতেই কবরে মাটি ভর্তি করেই তাড়াতাড়ি কবরস্থান থেকে বেরিয়ে এল। যেন এখান থেকে চলে যেতে পারলেই বাঁচা যায়।
আরও আশ্চর্য ব্যাপার বাইরে বেরিয়ে এসে তারা কেউ মৃতের বিষয়ে একটি কথাও আলোচনা করল না। প্রত্যেকেই শুধু নিজের জামার ওপর চোখ বুজিয়ে ক্রুশচিহ্ন আঁকল। তারপর দ্রুত যে যার বাড়ির উদ্দেশে পা চালাল।
পরিত্যক্ত নির্জন কবরস্থানে পড়ন্তবেলায় মাত্র কয়েক মিনিটের এই অনুষ্ঠানটি বাইরের যদি কেউ দেখত তা হলে সে অবাক হতো। অবাক হতো এই ভেবে যে, অনুষ্ঠানটি এমন গোঁজামিল দিয়ে সারা হলো কেন? কোনোরকমে মৃতদেহটি মাটি দিয়ে পালাতে পারলেই যেন সবাই বাঁচে। এত ভয় কিসের? প্রিয় ভ্রাতার আত্মা বলতে গিয়েই বা পাদ্রির স্বর আটকে যাচ্ছিল কেন?
এসবের উত্তর কে দেবে? এ নিয়ে কাউকে প্রশ্ন করাও যাবে না। কাজেই যা চুপচাপ হয়ে গেল তা চাপা থাকাই ভালো।
.
অদৃশ্য কুকুরের গর্জন
বিচিত্র জায়গা পশ্চিমবঙ্গের এই মালভূমি অঞ্চল। সেদিনের মানভূম, সিংভূম ছাড়াও গোটা পুরুলিয়া জেলা, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূম ও বর্ধমান জেলার অংশবিশেষ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চল।
পুরুলিয়া জেলার দক্ষিণাংশ ছাড়া গোটা জেলা এই মালভূমির মধ্যে। গ্রানাইট জাতীয় শিলায় তৈরি এই অঞ্চলের পাহাড়গুলো বেশ উঁচু উঁচু। অযযাধ্যা পাহাড়, পাঞ্চেৎ পাহাড়, বাঘমুণ্ডি পাহাড়, পঞ্চকূট পাহাড়, রঘুনাথপুরের চণ্ডী পাহাড়–পাহাড়ের যেন আর শেষ নেই। গোর্গাবুরু অযোধ্যা পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু চুড়ো।
হ্যাঁ, গোর্গাবুরু। সারা মানভূমে বিচিত্র সব পাহড়ের নাম কড়াকুবুরু, মাঠাবুরু, গজবুরু। জায়গার নামও আর-পাঁচটা নামের মতো নয়। চরসা গ্রাম যদিও চেনা-চেনা মনে হয়, কিন্তু সিধিয়াটাড়? এ যেন কোনো রহস্যময় জায়গার নাম। কেন এই নাম তারও ব্যাখ্যা আছে। সাঁওতালি ভাষায় ব্লাড় মানে রুক্ষ। আসলে এই অঞ্চলটাই রুক্ষ। শস্যশ্যামল গাঙ্গেয় অববাহিকার কোমলতা এখানে নেই। এখানে পাহাড়ই সব। মাঘ মাসের প্রথম দিনটিতে যেমন সাঁওতালদের নতুন বছর আরম্ভ, তেমনি পাহাড়-পুজোরও দিন। পাহাড়-পুজো! ভাবতে পারা যায়? জীবনের প্রয়োজনে পাহাড়ের গাছপালা, ফল-মূল আর বন্যপ্রাণী–সবই পাহাড়-দেবতার সৃষ্টি। সেই পাহাড়ের দেবতাকে তুষ্ট করার জন্যে করতে হয় পুজো। তাই এইসব অঞ্চলের অনেক কিছুই সাধারণ জীবনের সঙ্গে মেলে না। যেখানে শক্ত কঠিন নীরস পাহাড়কে দেবতা বলে পুজো করা হয় সেখানে এমন অনেক কিছুই ঘটে যা কল্পনা করা কঠিন। নইলে সমাধিক্ষেত্রে কবর দিতে গিয়ে অমন গোঁজামিলের ঘটনা ঘটে?
হাওড়া থেকে রাত্রের আদ্রা-চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার পুরুলিয়ায় পোঁছয় পরদিন সকালে। স্টেশন থেকে রিকশায় বাসস্ট্যন্ড। সেখান থেকে বাসে করে মাঠামোড়। মাঠামোড় থেকে মাঠা বনবাংলো কয়েক মিনিটের পথ।
একদিন বিকেলের দিকে ঐ বাংলোতে এসে পৌঁছলে জনা তিনেকের একটি ছোট দল। পিঠে তাদের রু্যাক আর হাতে একটা করে ভি. আই. পি. মার্কা মাঝারি ব্রিফকেস। ঠিক ছিল তারা কয়েকদিন পুরুলিয়ায় থেকে মাঠাবুরুর পাহাড়-পুজো দেখে যাবে। মাঠা বানবাংলোয় থাকতে পারলে জায়গাটা কাছে হবে, তাছাড়া শহরের বাইরে একেবারে পাহাড়ের কোলে শালের বনের মধ্যে একটা নিরিবিলি নিঝুম বাংলোতে থাকার অভিজ্ঞতাও হবে।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এই বনবাংলোটা। অল্প কয়েকটা দোকানপাট, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সাঁওতাল পল্লী। তাই নিয়ে এই মাঠা অঞ্চল। তবু এখানকার এই বাংলোয় বছরের নানা সময়ে অল্প হলেও লোক আসে। বুকিং-এর জন্যে রীতিমতো লিখতে হয় পুরুলিয়ায় ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসারের (বন দফতর) কাছে। নিছক বেড়াতে আসা ছাড়া এখানে আসার আর তেমন কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। দু-চার দিন থেকেই তারা চলে যায়। যেখানে মানুষজন নেই বললেই হয় সেখানে শুধু পাহাড়, রুক্ষ অসমতল পথপ্রান্তর, শাল-মহুয়ার অরণ্য আর সন্ধ্যে হতেই জীবজন্তুর ডাক শুনে কত দিন থাকা যায়!
এরা তিন বন্ধু টগা, চপল আর বিকু। সকলেরই বয়েস কুড়ি থেকে বাইশ। যাকে বলে তরতাজা যুবক।
এখানে আসার উদ্দেশ্য পাহাড়-পুজো দেখা ছাড়াও অ্যাডভেঞ্চার করা। অ্যাডভেঞ্চার বলতে যা বোঝায় তা পশ্চিম বাংলার গন্ধমাখা এই মানভূম, পুরুলিয়ায় আর কোথায় পাবে? নিতান্তই শান্ত, জনবসতিবিরল, নিঝাট জায়গা। তবু একঘেয়ে কলকাতা শহর আর ভালো লাগছিল না। তাই বেরিয়ে পড়েছিল কলকাতা থেকে দূরে নির্জন কোনো জায়গার সন্ধানে। সেইদিক দিয়ে পুরুলিয়ার এই জায়গাটি বেশ পছন্দ হয়ে গেল। বিশেষ করে এই মাঠা বনবাংলোটি। অ্যাডভেঞ্চার করার সুযোগ নেই বটে, তবু অজানা, অচেনা নির্জন এই পাহাড়ে জায়গাটা অ্যাডভেঞ্চারের বেশ উপযুক্ত কল্পনা করেও আনন্দ।
অনেকখানি জায়গা জুড়ে কম্পাউন্ড। তারই মধ্যে বাংলো। ফুলে-পাতায় ঢাকা গেটের ভেতরে মোরাম বিছানো রাস্তা। দুপাশে ফুলের বাগান। কম্পাউন্ডের মধ্যে একটা বকুল গাছ। কম্পাউন্ডের পিছনে উঁচু-নিচু পাথুরে পথ কোথায় কোন গ্রামের দিকে চলে গেছে।
এখন পাহাড়ের পিছনে সূর্য ডুবছে। চারিদিক স্তব্ধ। কম্পাউন্ডের মধ্যে সিমেন্ট-বাঁধানো বেঞ্চিতে বসে টগা মুগ্ধস্বরে বলে উঠল, ফাইন!
চপল বলল, সত্যি এমন দৃশ্য কলকাতায় দেখা যায় না।
পাশেই দাঁড়িয়েছিল বিকু। তাকে যেন একটু অস্থির বলে মনে হচ্ছিল। দুবন্ধুকেই সূর্যডোবার দৃশ্যে মুগ্ধ দেখে বিরক্ত হয়ে বললে, একটা কথা মনে করিয়ে দিই, আমাদের ঘরের জানালার ছিটকিনিটা কিন্তু ভাঙা। আর জানলাটা আবার পিছনের দিকেই।
টগা বলল, থাম তো। তোর স্বভাবই হচ্ছে যে কোনো ব্যাপারে শুরুতেই তাল কেটে দেওয়া। ভালো জিনিস নিজেও এনজয় করতে পারিস না, অন্যদেরও করতে দিস না।
বিকু কিছুমাত্র রাগ না করে বলল, কী করব ভাই, আমি তোদের মতো কবি-দার্শনিক নই। আমি প্র্যাকটিকাল। এখানে যে ঘরটা আমাদের দেওয়া হলো তা ভালো করে না দেখেই তোদের পছন্দ হয়ে গেল কিন্তু আমার হয়নি।
কেন? ভুরু বেঁকিয়ে জিগ্যেস করল চপল। যথেষ্ট বড়ো ঘর, একসঙ্গে আমরা থাকতে পারব, এটাই কি যথেষ্ট নয়?
বিকু বললে, কিন্তু ঘরের সিকিউরিটি নেই। সবচেয়ে পুরনো ঘর এটা। দরজাটা নড়বড়ে। জানলার ছিটকিনি নেই। বিদেশ-বিভুই। বিপদ ঘটতে কতক্ষণ?
চপল বলল, বিপদ! তুই কি ভাবছিস জানলা ভেঙে চোর ঢুকবে?
চোর কেন অনেক কিছুই ঢুকতে পারে।
দুজনেই অবাক হয়ে বিকুর দিকে তাকাল।
অনেক কিছুই ঢুকতে পারে মানে?
বিকু উত্তর দিল না।
ও বোধহয় ভূত-প্রেতের কথা বলতে চাইছে। বিদ্রূপ করে বলল টগা।
বিকু এবারও উত্তর দিল না। বিরক্ত হয়ে ভেতরে চলে গেল।
ক্রমে অন্ধকার নেমে এল পাহাড়গুলোর গা বেয়ে। পাখির দল ঝাক বেঁধে উড়ল বনের এক মাথা থেকে অন্য মাথায়। চারিদিক নিঝুম হয়ে এল। ওরা দুজনে ভেতরে চলল।
বনবাংলোটা একতলা হলেও অনেকখানি জায়গা জুড়ে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই একটা বেশ বড়োসড়ো চৌকোনো ঘর। গোটা চারেক সোফা, গোটা দুই কৌচ রয়েছে। মাঝখানে একটা সেন্টার টেবিলে খবরের কাগজ থেকে আরম্ভ করে ইংরেজি-বাংলা পত্র-পত্রিকা। দেওয়ালে নানা দেশের ছবি। সব দেশই যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে–বেরিয়ে পড়ো, বেরিয়ে পড়ো ঘর থেকে। দেখে যাও আমাদের….প্রকৃতির অফুরন্ত ভাণ্ডার। দেখলেই বোঝা যায় এটা ড্রয়িংরুম। বাংলোর অতিথিরা এখানে বসে আলাপ-পরিচয় করে। কিন্তু এই মুহূর্তে ড্রয়িংরুম ফাঁকা। বোধহয় বাবুরা বাইরে বেড়াতে গেছে। এখনও ফেরেনি।
ফতুয়া-পরা মাঝবয়সী একটা লোক বারান্দা থেকে সুইচ টিপে আলো জ্বালাতে জ্বালাতে এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকল। সামনেই এদের দেখে হকচকিয়ে গেল। কাছে এসে মাথা চুলকে বললে, বেরিয়েছিলেন?
চপল বলল, না। বাইরে বসেছিলাম।
হ্যাঁ, বেরোবেন আর কোথায়? এ তো আর পুরুলিয়া টাউন নয়। একমুঠো জায়গা। শুধুই পাহাড়। আপনাদের সঙ্গে মেলামেশা করার যুগ্যি লোক তো নেই।
তবু তো লোক আসে এখানে। বলল টগা।নইলে আর বাংলোটা রাখা হয়েছে কেন?
লোকটা বলল, হ্যাঁ, লোক আসে। তবে দু-তিন দিনের বেশি থাকে না।
চপল জিগ্যেস করল, কেয়ারটেকারবাবু আর তুমি ছাড়া আর কজন থাকে?
আর আছে জমাদার। ঝাড়পোঁছ, ধোওয়া-মোছা করে। রাঁধুনি-বাবুর্চি আছে।
আর বোর্ডার?
লোকটা ঠোঁট উল্টে বলল, যতগুলো ঘর আছে তার অর্ধেকও যদি বোর্ডার থাকত তাহলে বাংলোর চেহারা ফিরে যেত। তাছাড়া কিজন্যেই-বা লোক আসবে? পাহাড় ছাড়া আর তো কিছু নেই। আর বছরে একদিন পাহাড়-পুজো। সে কাহিনীই বা কজন জানে?
একটু থেমে টগা জিগ্যেস করল, তোমায় কী করতে হয়?
বাজার-দোকান করা। আর আপনাদের দেখাশোনা করা।
তোমার নাম কী?
আজ্ঞা, মহেন্দ্র শতপথী।
তুমি ওড়িয়া?
আজ্ঞা।
এখানে কতদিন আছ?
দুবছর হয়নি এখনও। আপনারা চা খাবেন তো?
তা খেলে মন্দ হয় না। কিন্তু আমাদের আর-একজন।
কাছেই কোথাও আছেন নিশ্চয়ই। আপনারা ঘরে গিয়ে বসুন। আমি তিন কাপ চা দিয়ে আসছি। বলে মহেন্দ্র বাইরের বারান্দার আলো জ্বালাতে গেল।
এরা ড্রয়িংরুম থেকে ভেতরে ঢুকল। টানা বারান্দা। দুপাশে পর্দা ফেলা ঘর। ঘর যত সেই তুলনায় বোর্ডার যে বেশি নেই তা তো মহেন্দ্রর মুখেই শোনা গেল। বাঁ দিকের কোণের একটা ঘরে আলো জ্বলছিল। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা একজন ভদ্রলোক কিছু খাতাপত্র নিয়ে, সেই ঘরে ঢুকছিলেন, দূর থেকে এদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অগত্যা এরা নিজের ঘরে না ঢুকে ভদ্রতা করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেল।
ভদ্রলোকের নাম সদাশিব রায়। এই বাংলোর ম্যানেজারগোছের। কেউ কেউ বলে– কেয়ারটেকার। আসলে বাংলোর সব দায়িত্ব তার ওপরে। বয়েস চল্লিশের কাছে। ছোটো ছোটো চুল। মুখে না-কামানো দাড়ি। বেশ আলাপী মানুষ।
হেসে বললেন, বেরিয়েছিলেন?
নাঃ। প্রথম দিন। আলসেমি হচ্ছিল। কম্পাউন্ডের মধ্যেই বসেছিলাম। বললে চপল।
হা। বেরোলে বেলাবেলি বেরোবেন। আর অন্ধকার হবার আগেই ফিরে আসবেন।
টগা একটু অবাক হয়ে বলল, কেন? এখানে সেরকম কোনো ভয় আছে নাকি?
সদাশিববাবু হেসে বললেন, ভয় কোথায় নেই বলুন। নতুন জায়গা হলে অনভ্যস্ত চোখে অনেক কিছুই অস্বাভাবিক ঠেকে–তাছাড়া পাহাড়ি জায়গা তো। এসব অঞ্চলে যারা থাকে তারা শহর-বাজারের শিক্ষা পায়নি–নানা কুসংস্কার। যাকগে ওসব কথা। একটু চা খাবেন তো?
মহেন্দ্র আমাদের ঘরে চা দিয়ে আসবে। আচ্ছা, এখানে বোর্ডার কতজন আছে?
সদাশিব চোখ বুজিয়ে হিসেব করে বললেন, আপনাদের নিয়ে সাতজন। আর একজন আসবেন।
কখন আসবেন?
সদাশিববাবু বললেন, আর একটু পরে।
টগা অবাক হয়ে বলল, অতদূর পুরুলিয়া থেকে রাত্রেও লোক আসে?
সাধারণত রাতে কেউ আসে না। কিন্তু ইনি আসবেন। আর আগাম টাকা পাঠিয়েছেন যাতে স্টেশন থেকে আসার জন্যে গাড়ি রাখা হয়।
চপল হেসে বলল, তাহলে তো ভি. আই. পি. লোক।
সদাশিববাবু বললেন, ভি. আই. পি. কিনা জানি না, তবে তিনি বাঙ্গালোর থেকে আসছেন। একজন উঁচুদরের পাদ্রি। এই প্রথম নয়, এর আগেও এসেছেন।
এখানে চার্চ-টার্চ আছে নাকি?
সদাশিববাবু হেসে বললেন, চার্চ কোথায় নেই বলুন।
টগা বলল, চার্চ যখন আছে তখন পাদ্রিও তো আছে।
তা তো আছেই। প্রতি বছর খ্রিস্টমাস ডে-তে, ইংরিজির নববর্ষের দিনে, গুডফ্রাইডেতে বেশ ঘটা করে চার্চে প্রেয়ার হয়।
এখানকার, খৃস্টানরা কি সবাই বাঙালি?
বাঙালিই বেশি। সেই সঙ্গে অবাঙালিও আছে। আর আছে আদিবাসীরা। এই যে মহেন্দ্র এখানে তিনকাপ চা দিয়ে যাও।
চপল বলল, আমাদের আর একজন আছে—
হ্যাঁ, বিকাশবাবু। এই তো একটু আগে আমার কাছে এসেছিলেন।
কেন?
একটা হাতুড়ি আর পেরেকের খোঁজে।
হাতুড়ি-পেরেক!
হ্যাঁ, আপনাদের ঘরের একটা জানলার ছিটকিনি খুলে গেছে না ঢিলে হয়ে গেছে, তাই। বললাম, কাল সকালেই ছুতোর ডেকে ব্যবস্থা করে দেব, তো উনি সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চাইলেন না। বলে একটু হাসলেন।
টগাও একটু হেসে বলল, ও ঐরকমই। একটু বেশি হুঁশিয়ার।
বিদেশে একটু বেশি হুঁশিয়ার হওয়া কিন্তু ভালো। তা হলে ওঁর চা-টা—
মহেন্দ্র বলল, ঘরে দিয়ে এসেছি।
বেশ।
টগা বলল, পাদ্রির কথা বলছিলেন, তা অত দূর থেকে এই পাণ্ডব-বর্জিত দেশে তাঁর আসার কারণ?
সদাশিববাবু দু হাতের ভঙ্গি করে বললেন, জানি না। একটু চুপ করে থেকে বললেন, এবার নিয়ে উনি তিন-তিন বার এলেন। কিন্তু কেন আসেন তা বলেন না।
আপনি জিগ্যেস করেন না?
সদাশিববাবু বললেন, কোনো বোর্ডারকে কি জিগ্যেস করা যায়, যদি তিনি নিজে না বলেন? এমনিতেই নিজে থেকে কোনো কথা বলতে চান না। এর আগে দেখেছি এখানে এসেই বেরিয়ে যেতেন। ফিরতেন সন্ধ্যেবেলা। ওঁর মতো অত বয়েসের লোকের পক্ষে এত পরিশ্রম করা কঠিন ব্যাপার। অলৌকিক কোনো ক্ষমতা না থাকলে পারতেন না।
এখানে থাকতেন কত দিন?
সাত-আট দিনের বেশি নয়।
এই কদিন তিনি কী করতেন আপনি জানতেন না?
সদাশিববাবু মাথা নাড়লেন। আমি কেন? কেউ জানত না। আমিও কোনো আগ্রহ দেখাতাম না।
এরপর কিছুক্ষণ তিনজনেই নিঃশব্দে চা খেতে লাগল।
চপল বলল, আচ্ছা সদাশিববাবু, আপনি তো এখানে অনেক দিন আছেন, রহস্যজনক কোনো ব্যাপার কখনও ঘটতে দেখেছেন?
সদাশিববাবু হেসে বললেন, এখনও গোটা একদিন হয়নি আপনারা এসেছেন। এর মধ্যেই রহস্যের গন্ধ পেলেন নাকি?
চপল একটি অপ্রস্তুতে পড়ল। হাসবার চেষ্টা করে বলল, আসলে এখানকার পরিবেশটাই যেন কিরকম। সবসময়ে মনে হচ্ছে কিছু যেন ঘটবে।
সদাশিববাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, তা বটে।
টগা একটু ঝুঁকে পড়ে কৌতূহলের সঙ্গে জিগ্যেস করল, আপনিও তাহলে সেরকম কিছু ফিল করেন?
না, তেমন কিছু নয়। তবে এইসব বহু প্রাচীন নির্জন জায়গায়, যেখানে প্রকৃত ভৌগোলিক কিংবা ঐতিহাসিক তত্ত্ব মানুষ এখনও পুরোপুরি আবিষ্কার করতে পারেনি, বিজ্ঞানের আলো যেখানে এসে তেমন পড়েনি, হাজার কুসংস্কার জড়িয়ে মানুষ যেখানে কতকগুলো অলৌকিক কিংবদন্তির মধ্যে ডুবে আছে সেখানে রহস্যজনক ঘটনা না ঘটলেই অবাক হতে হয়।
তারপর একটু হেসে বললেন, নইলে এত জায়গা থাকতে পাদ্রিসাহেব সুদূর বাঙ্গালোর থেকে এরকম চুপিচুপি এখানেই বা আসতে যাবেন কেন?
চপল বলল, সত্যিই তো কেন আসেন এখানে?
সদাশিববাবু বললেন, তার উত্তর অন্তত আমার জানা নেই।
কথায় কথায় রাত আটটা বেজে গেল। সদাশিববাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা এসে ঢুকল তাদের পাঁচ নম্বর ঘরে। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে বিকাশ ওরফে বিকু শুয়েছিল। শুয়েই রইল।
টগা বলল, ঘুমুচ্ছিস নাকি?
বিরক্ত হয়ে বিকু বলল, সন্ধ্যে থেকে পড়ে পড়ে ঘুমোই তারপর সারারাত জেগে থাকি– এত বোকা আমি নই।
ও বাবা, জানলায় ছিটকিনি লাগানো হয়ে গেছে। টগা ঠাট্টা করে হাসল।
বিকু বলল, ছিটকিনি-ভাঙা জানলা নিয়ে আমি শুতে পারি না।
কেন? চোর ঢুকবে?
শুধু চোর কেন, অনেক কিছুই ঢুকতে পারে।
চপল কি বলতে যাচ্ছিল, এমনি সময়ে দূরে সাইকেল-রিকশার হর্ন শোনা গেল।
বাবা, এত রাত্তিরে কে আবার আসছে এখানে?
কে আসছে টগা, চপল জানে ভালো করেই। টগা বলল, তাকে এখনই একবার দেখতে ইচ্ছে করছে।
চপল বলল, সেটা বড় বাড়াবাড়ি হবে। ঐ যে মহেন্দ্র ব্যস্তভাবে ছুটল বিশেষ ব্যক্তিটির মোটঘাট আনতে। আর সদাশিববাবু পাক খাচ্ছেন অফিসঘরের সামনে। রিসিভ করতে যাবার জন্যে মন চাইছে না, আবার নিশ্চিন্তে বসেও থাকতে পারছেন না।
রাত নটার সময়ে মহেন্দ্র এসে জেনে গেল তাদের রাতের খাবার ঘরে দেবে, না, ওরা ডাইনিংহলে যাবে।
টগা ওদের ডাইনিংহলে যাবার ইচ্ছে জানাল। উদ্দেশ্য–যদি পাদ্রিসাহেবও খেতে আসেন।
পাদ্রিসাহেব যে সকলের কাছ থেকে তফাত রেখে চলতে চান টগার তা বুঝতে দেরি হয়েছিল।
রাতের খাওয়া শেষ হলো। যে যার ঘরে চলে গেল। দরজায় দরজায় খিল পড়ল। মহেন্দ্র শতপথী বাংলোর দরজাগুলো ভালো করে পরীক্ষা করে অল্প দূরে ইঁদারার পাশ দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।
তারপর সব চুপচাপ। গোটা বনবাংলো সুপ্তির কোলে ঢলে পড়ল।
.
রাত তখন গভীর।
একে নির্জন পাহাড়ি এলাকা, তার ওপর শীতকাল। সমস্ত জায়গাটা থমথম করছে।
হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার–ঠিক যেন একটা পাগলা কুকুরের ভয়ংকর চাপা গর্জন পশ্চিম দিকের পাহাড় কাঁপিয়ে এদিকে ছুটে এল। একবার নয়–তিন-তিন বার। তারপরই প্রতিধ্বনির রেশ রেখে থেমে গেল।
এদের তিনজনেরই ঘুম ভেঙে গেল। বিকু ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, কিসের শব্দ?
চপল তাকাল টগার মুখের দিকে।
টগা বলল, বুঝতে পারলাম না।
ততক্ষণে ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলোর লনে। সবার চোখেমুখেই আতংকের ছাপ। এরা ঘর থেকে বেরিয়ে এল।
আপনারাও শুনেছেন তো?
ঐ ডাক না শুনে উপায় নেই। বদ্ধ কালাও লাফিয়ে উঠবে।
সকলের মুখেই একটি প্রশ্ন–কিসের গর্জন ওটা? কোথা থেকে এল?
সদাশিববাবুকে দেখে এরা এগিয়ে গেল। চপল বল, আপনি তো এখানে অনেক দিন। আছেন। এর আগে শুনেছেন কখনও?
মাঝে মাঝে শুনেছি। খুব সহজভাবে বললেন সদাশিববাবু।
কিসের গর্জন ওটা?
সদাশিববাবু তেমনি শান্ত স্বরে বললেন, তা বলতে পারব না। শুধু আমি কেন, এ অঞ্চলের কেউই বলতে পারে না।
এ তো মহা মুশকিল হলো। এরকম গর্জন তো কোথাও শুনিনি। এ যে দেখছি বেড়াতে এসে প্রাণটি খুইয়ে যেতে হবে।
সদাশিববাবু ভীতস্ত বোর্ডারদের শান্ত করে বললেন, আমি বলছি কোনো ভয় নেই। এর আগেও ওরকম শব্দ শোনা গেছে। কোনো বিপদ হয়নি। রাত আড়াইটে বাজল। আপনারা শুতে যান।
একে একে সবাই যে যার ঘরে শুতে চলে গেল। টগারাও চলে গেল। চপল শুধু বলল, সবাই বেরিয়েছিল। শুধু পাদ্রিসাহেব বেরোননি।
.
পাহাড়-পুজোর মেলায়
পরের দিন সকালে মিষ্টি রোদে ঝলমল করে উঠল মাঠাবুরু। গত রাত্রে যে গা-ছমছমে ভাব ছিল আজ সকালে তার রেশমাত্র নেই। সেই অলৌকিক কুকুরের ডাক যা তারা সকলেই শুনেছিল, সকালের তাজা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল যেন দুঃস্বপ্ন–অবাস্তব।
আজ পাহাড় পুজোর দিন। নীরস পাহাড়ও যে মানুষকে কিছু দেয়—তা সে গাছপালাই হোক, ফলমূলই হোক কিংবা বন্যপ্রাণী, তারই জন্যে কৃতজ্ঞতা জানাতে আদিবাসীরা করে পাহাড়-পুজো। আজ তাই ভোর থেকেই দূর-দূরান্ত গ্রাম থেকে দলে দলে আসছে আদিবাসীরা। মেলা বসে গেছে ইতিমধ্যে সামনের মাঠে। রঙিন চুড়ি, পুঁতির মালা, লিপস্টিক, আর্শি, কানের দুল, টিপের পাতা, মাটির পুতুল ছাড়াও কোদাল, গাঁইতি, হাঁড়ি, কড়া, কী নেই মেলায়? ঝালদা, বিহার থেকেও দোকানিরা এসেছে। কিন্তু আসল লক্ষ্য পুজো। মাঠের শেষে শালের অরণ্যের মধ্যে দিয়ে ধাপে ধাপে উঠতে হবে পাহাড়ে। প্রায় হাজার ফুট ওপরে খোলা আকাশের নিচে বাবার থান। থানে সাজানো পোড়া মাটির ঘোড়া। সেই কোন সকাল থেকে শুরু হয়েছে ভক্তদের আসা-যাওয়া। কাঁধে তাদের মানত করা ছাগল কিংবা মোরগ। বলি হবে বাবার থানে। আবার কারও কারও হাতে থাকে খড়ের মোড়কে পায়রা। বলি দেবার জন্যে নয়, বাবার সামনে, বাবাকে সাক্ষী করে পাহাড়ের ওপর থেকে উড়িয়ে দেয় সকলের জন্যে মঙ্গল কামনা করে। অন্য দিকে পুজো দিয়ে ভক্তরা নেমে আসে মুণ্ডুহীন ছাগল কিংবা মোরগ নিয়ে মহা উল্লাসে। বলির এই মাংস দিয়েই আজ তাদের হবে আনন্দভোজ। তারপর সন্ধ্যে থেকে শুরু হবে ধামসা, মাদলের সঙ্গে নাচগান। তখন মাঠাবুরুর আর এক রূপ।
ওরা তিনজনও পাহাড়ে উঠেছে। বাবার থানের কাছে বেজায় ভিড় দেখে ওরা ওদিকে গেল না। নিচে যেমন মেলা বসেছে, পাহাড়ের ওপরেও তেমনি মেলা। তবে ওপরের মেলায় না দেবদেবীর মূর্তির দোকানই বেশি। নাড়ুগোপাল থেকে কালী, ছিন্নমস্তা সব কিছুই আছে।
টগা বলল, এখানে অনেকক্ষণ ধরে দেখার কিছু নেই। নেমে চল।
চপল বলল, পাহাড়ের ওপর রোদটাও বড়ো চনচনে।
বিকু বলল, আমি তো আগেই বলেছি জায়গাটা বাজে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে দুপুরেই পুরুলিয়া চলে যাব। তারপর নিজেদের জায়গা কলকাতায়।
চপল, টগা এ কথার কোনো উত্তর দিল না। ঘুরতে ঘুরতে তারা পাহাড়ের অন্য দিকে চলে গেল। এদিকে দোকানপাট তেমন নেই। কাজেই ভিড় নেই। কয়েকটা কেন্দু আর সেগুন গাছ। তারই তলায় কিছু লোক জড়ো হয়েছে। নিচু হয়ে কী যেন দেখছে। বোধহয় কেউ কিছু বিক্রি করছে। কোনো নিষিদ্ধ জিনিস কি? নইলে দোকান করেনি কেন?
কৌতূহলী হয়ে এরা গাছতলায় এসে দাঁড়াল। একটা তিব্বতী ছেলে। কেমন যেন ভীতু ভীতু চোখ। রুক্ষু চুল। গায়ে একটা ময়লা ছেঁড়া সোয়েটার। পেটের দায়ে সুদূর তিব্বত কিংবা নেপাল থেকে এসেছে। অ্যান্টিকের অস্থায়ী দোকান পেতেছে। খবরের কাগজের ওপর সাজানো হরেকরকমের পুরনো জিনিস–যা এ যুগের সাধারণ মানুষ চোখেও দেখেনি কোনোকালে।
এই অ্যান্টিকের ওপর খুব আগ্রহ টগার। কেনই-বা না থাকবে। কতকাল আগের পুরনো দুষ্প্রাপ্য জিনিস সব। এখন যেন ইতিহাস হয়ে গেছে। তাছাড়া এই বিশেষ অ্যান্টিকে মনে হয় এমন কিছু নিষিদ্ধ জিনিস আছে যা একসময়ে ব্যবহার করত তান্ত্রিক, ওঝারা। ভূত, প্রেতের কারবারিরা, পিশাচ-সিদ্ধরা।
টগা আঙুল দিয়ে একটা মূর্তির বিকট মুখ দেখিয়ে জিগ্যেস করল, ওটা কার মুখ?
ছেলেটি তিব্বতী হলেও টগার প্রশ্নটা বুঝল। জড়ানো স্বরে বলল, মহাকাল।
মহাকালের নাম অনেকেই জানে। নেপালের এক ভয়ংকর দেবতা।
কিছুক্ষণ থেকে বাবার থানের কাছে একটা চাপা হল্লা শোনা যাচ্ছিল। এখন যেন সেটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। টগার মন সেদিকে ছিল না। সে অ্যান্টিকগুলো দেখছিল। হরিণের শিঙের একটা মূর্তি তার খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু বেজায় দাম–
আরে ওটা কি?
জিনিসটা প্রকাশ্যে রাখা ছিল না। ঝুলির ভেতর ঢোকানো ছিল। প্রায় অর্ধেকটা বেরিয়ে ছিল। সেটা দেখেই টগা চমকে উঠল। একটা ভয়ংকর জানোয়ারের মুখ। অনেকটা কুকুরের মতো–চোয়ালের দুপাশ থেকে ঝকঝকে দাঁত হিংস্র উত্তেজনায় বেরিয়ে এসেছে। লালা ঝরছে দুপাশের কষ বেয়ে। প্রায় এক হাত লম্বা কালো পাথরের মূর্তিটা। মূর্তি নয়, যেন জ্যান্ত একটা জন্তু। এটা কি শিল্পী নিছক কল্পনা করে তৈরি করেছে না বাস্তবে কিছু দেখে?
দেখি, দেখি ভাই ওটা।
দোকানি কেন যেন একটু ইতস্তত করে ওটা বের করতে যাচ্ছিল, হঠাৎ এমনি সময়ে দুদ্দাড় করে লোকে ছুটে নিচে নামতে লাগল। এরা দেখল পুলিশ তাড়া করেছে। সঙ্গে সঙ্গে তিব্বতী যুবকটিও তার দোকান গুটিয়ে একটা পুটলির মধ্যে সব জিনিসগুলো ঢুকিয়ে তড়বড় করে নিচে নামতে লাগল। কি যে হলো টগারা কিছুই বুঝতে পারল না। পুলিশের কখন যে কী মর্জি হয়–
ওরা পাহাড়ের এদিক-ওদিক উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছে, হঠাৎ দেখল লম্বা কালো একজন বৃদ্ধ, পরনে কালো প্যান্ট, কালো কোট, টাই, টুপি, এইমাত্র পাহাড়ে উঠে ব্যস্ত হয়ে কী যেন খুঁজছেন। চোখে কালো রোদচশমা।
চপল বলল, আমার মনে হচ্ছে এই বৃদ্ধটি এখানকার নন।
টগা বলল, আমি আরও বলে দিচ্ছি শোন, ইনি একজন পাদ্রি। এবং আসছেন দক্ষিণ ভারতের কোনো জায়গা থেকে।
বিকু বলল, পাদ্রিই যে কী করে জানলি?
গলায় ক্রুশ ঝুলছে।
তাহলে আমিও বলে দিচ্ছি ইনি এখানে এসেছেন মাত্র গতকাল রাতে। উঠেছেন বনবাংলোয়।
তিনজনেই জোরে হেসে উঠল।
চুপ! ভদ্রলোক এদিকে আসছেন।
ভদ্রলোক কাছে এসে দাঁড়ালেন।
এক্সকিউজ মি। আপনারা নিশ্চয় বাইরে থেকে এসেছেন?
টগা মজা করে বলল, আশ্চর্য! কী করে জানলেন?
সে কথার উত্তর না দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আই অ্যাম ডিক ফার্নান্ডেজ ফ্রম বাঙ্গালোর। যদিও আমি এখানে অনেকবার এসেছি। আচ্ছা, এখানে কি কোনো তিব্বতী ছেলেকে দেখলেন যে অ্যান্টিক নিয়ে বসেছিল?
টগা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, একটু আগে বসেছিল ঐ গাছতলাটার নিচে।
এরই মধ্যে উঠে গেল?
তাই তো দেখলাম।
আচ্ছা, ওর কাছে কোনো জীবজন্তুর মুখ ছিল?
ছিল বৈকি।
বৃদ্ধ যেন আরও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
কোনদিকে গেল?
এই দিক দিয়ে নেমে গেল।
মিস্টার ফার্নান্ডেজ একটু ভাবলেন। তারপর তিব্বতী ছেলেটা যে পথে নেমে গিয়েছিল সেই পথে দ্রুত নেমে গেলেন। তার পা দুটো বয়েসের ভারে আর পাথরে ঠোক্কর লেগে টলছিল। মনে হচ্ছিল এই বুঝি পড়ে গেলেন–কিন্তু পড়লেন না।
.
ফার্নান্ডেজ দ্রুত চোখের আড়ালে চলে গেলেও তিনজন কেমন হতভম্বর মতো সেই দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা যেন খানিকটা ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে দিয়ে গেল।
বিকু বলল, আমায় যদি তোমরা বৃদ্ধটির সম্বন্ধে জিগ্যেস করো, তাহলে নির্দ্বিধায় আমি বলব, লোকটি পাগল।
চপল বলল, মোটেই নয়। পাগল হলে এই আশি বছর বয়েসে কেউ বাঙ্গালোর থেকে এখানে বেড়াতে আসতে পারে? বেড়াবার আর জায়গা পেল না? আসলে ভালো করেই জানে এখানে এমন কিছু সম্পদ আছে যা অন্য কেউ জানে না।
টগা বলল, লোকটি যে সাধারণ মানুষ নয় সেটা সহজেই বোঝা যায়। উনি বারে বারে অকারণে এখানে ছুটে আসেন না। সদাশিববাবুও বললেন, এখানে এসে সারা দিন তিনি কোথায় থাকেন, কী করেন তা তিনিও আজ পর্যন্ত জানতে পারেননি। রহস্যটা এখানেই।
বিকু বলল, কেস জটিল। এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেজিয়ে লাভ নেই। তার চেয়ে চলো ঐ চায়ের স্টলটায় বসে চা খেতে খেতে কথা বলা যাক।
টগা আড়ালে চপলের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। অর্থাৎ বিকুর মতো ছেলের মনেও রহস্যের ঘোর লেগেছে।
পাহাড় থেকে একটু নেমে এসে তিনজন বসল তিন কাপ চা নিয়ে।
এ-কথা ওকথার পর টগা বলল, পাদ্রিসাহেব সম্বন্ধে এ পর্যন্ত যা শুনেছি আর আজ তাকে দেখে আমি কয়েকটা পয়েন্ট পেয়েছি। যেমন এক, কোনো বিশেষ গোপন আকর্ষণে তিনি বাঙ্গালোর থেকে এখানে ছুটে আসেন এই বয়েসেও। দুই, বিষয়টা এতই গোপন যে তিনি কাউকেই কিছু বলেন না। তিন, কালো চশমায় চোখ ঢেকে রাখেন। চার, অলৌকিক কুকুরের ডাক সম্বন্ধে তিনি অনেক কিছু জানেন। পাঁচ, পাহাড়ের ওপরের তিব্বতী ছেলেটাকে তিনি চেনেন। যে কোনো উদ্দেশ্যেই তাকে দরকার। মনে হয়, ছেলেটার কাছে যে কুকুরের মূর্তিটা আছে সেটাই তার প্রধান আকর্ষণ।
বিকু অবাক হয়ে বলল, কেন?
টগা একটু হাসল। বলল, তা ঠিক বলতে পারব না। তবে আমি নিশ্চিত ঐ কুকুরের ডাক শুধুই কোনো একটা কুকুরের ডাক নয়। ঐ ডাকের মধ্যে মিশে আছে অলৌকিক কোনো ভয়ংকর কণ্ঠস্বর। পাদ্রিসাহেবও তা বোঝেন। আগেও তিনি ঐ গর্জন শুনেছেন বলেই কাল রাত্তিরে সবাই যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল তিনি বেরোননি। আজ সকালে তিনি ঐ তিব্বতী ছেলেটার খোঁজেই পাহাড়ে উঠেছিলেন।
টগার কথা শেষ হলে সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। শুধু বিকুই পার্স খুলে সকলের চায়ের পয়সা মিটিয়ে দিয়ে বলল, আর এখানে দেরি করে লাভ নেই। বাংলোয় চলো।
টগা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, শোন বিকু, তুই যদি আজই কলকাতায় ফিরে যেতে চাস তো চলে যা। আমি কিন্তু থাকব।
চপল বলল, বাঃ রে! তুই থাকবি আর আমি থাকব না? রহস্যের সন্ধান যখন পেয়েছি
বিকু বলল, কলকাতায় আমি ফিরছি না। ঐ পাদ্রিসাহেবের ব্যাপারটা কী আমাকেও জানতে হবে। আমার মনে হয় এখানে বসে না গেজিয়ে বাংলোয় গিয়ে পাদ্রিসাহেবের সঙ্গে আলাপ জমানোটাই কাজের কাজ হবে।
অন্য সময়ে বিকুকে এরা বড়ো একটা পাত্তা দেয় না। কিন্তু এখন এই শেষ কথাটা খুবই যুক্তিযুক্ত বলে ওদের মনে হলো। ওরা পাহাড় থেকে নেমে চুপচাপ বাংলোর দিকে এগিয়ে চলল।
.
সদাশিববাবু কেমন লোক?
ওরা ব্রেকফাস্ট সেরেই পাহাড়ে গিয়েছিল। কাজেই একটা বড় কাজ হয়ে গেছে।
এখন সকাল প্রায় নটা। হাতে অফুরন্ত সময়। সময় কাটাবার উপযুক্ত উপায় পাদ্রিসাহেবের সঙ্গে গল্প করা। গল্প করতে করতে যদি পাদ্রিসাহেবের পেট থেকে কথা বার করা যায়! আর সেই উদ্দেশ্যেই তো ওরা তাড়াতাড়ি বাংলোতে ফিরে এসেছে।
কিন্তু পোড়া কপাল। পাদ্রিসাহেবের ঘরের সামনে গিয়ে দেখা গেল দরজায় তালা ঝুলছে। এটাই তো স্বাভাবিক!
তা হলে?
এমনি সময়ে ওদিকের অফিস-ঘর থেকে সদাশিববাবু ডাকলেন, তপেন্দুবাবু!
তপেন্দু অর্থাৎ টগা হাত তুলে সাড়া দিল। বাংলোর খাতায় এদের ভালো নামগুলো লেখা হয়ে আছে।
পাদ্রিসাহেব নেই। কাজেই অগতির গতি সদাশিববাবু। কাল রাত্তিরে যতটুকু কথাবার্তা হয়েছে তাতে তারা বুঝেছে মানুষটি ভালো। আর এখানকার অনেক কিছুই জানেন। টগার ইচ্ছে, একবার চেষ্টা করে দেখা যদি কোনো কথা বের করা যায়।
সকালে বেরিয়েছিলেন?
টগা বলল, হ্যাঁ, পাহাড়ে উঠেছিলাম।
কেমন লাগল পাহাড়-পুজো?
ভিড় দেখে পুজোর দিকে আর এগোইনি। এদিক-ওদিক ঘুরলাম। তবে পাদ্রিসাহেবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। শুধু দেখাই।
কীরকম?
নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলেন কোনো তিব্বতী ছেলেকে অ্যান্টিক বেচতে দেখেছি কিনা। তার খবর দিতেই তিনি ছেলেটার খোঁজে তাড়াতাড়ি নেমে গেলেন।
এ ছাড়া আর কোনো কথা বলেননি?
না। হঠাৎ গায়ে পড়ে আমাদের সঙ্গে আলাপই বা করবেন কেন? আমরা এসেছি জানবেনই বা কী করে?
সদাশিববাবু বললেন, কাল রাত্রেই জেনেছেন।
কী করে জানলেন?
ওঁর এবার একটু বড়ো ঘর দরকার বলে আপনাদের ঘরটাই নিতে চাইলেন। তখনই আপনাদের কথা বলতে হলো।
তাতে উনি কী বললেন? টগা জিগ্যেস করল।
বুড়ো মানুষ তো। কৌতূহলটা বেশি। তাই কজন এসেছেন, কোথা থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন, কতদিন থাকবেন জিগ্যেস করলেন। একটু চা খান।
চপল বলল, পাহাড়ে চা খেয়ে আসছি।
তা হোক। শীতের দিন, চা খেতে খেতে গল্প করা যাবে।
মহেন্দ্র শতপথী কাঁধে গামছা ফেলে দুবালতি টাটকা জল পাদ্রিসাহেবের দরজার সামনে রেখে কিচেনের দিকে যাচ্ছিল, সদাশিববাবু চার কাপ চায়ের অর্ডার দিলেন। তারপরেই য়েন কিছু মনে পড়ল, একটু বসুন, আমি আসছি, বলেই উঠে গেলেন।
এরা তিনজন চুপচাপ বসে রইল।
চপল খোলা জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইল দূরের পাহাড়গুলোর দিকে। তার মনে হতে লাগল গাছপালায় ঢাকা ঐ পাহাড়গুলোর পাথরে পাথরে যেন রহস্য কত কাল ধরে দানা বেঁধে আছে।
বিকু লক্ষ্য করছিল মহেন্দ্রকে। চায়ের ট্রে হাতে করেই ওদিকের বারান্দায় একজন গুণ্ডামতো লোকের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলছে।
কী এত কথা? চুরি-ডাকাতির ষড়যন্ত্র চলছে না তো?
আর টগা তাকিয়েছিল ফার্নান্ডেজের ঘরের দিকে। সব জানলাগুলো বন্ধ, এমনকি ভেতর দিকের জানলাগুলোও।
টগা অবাক হলো। এত সতর্কতা কিসের?
খুব হচ্ছা করল ঘরটার চারপাশ ঘুরে দেখে। সেইরকম মনে করে উঠতে যাচ্ছিল, এমনি সময়ে সদাশিববাবু ঢুকলেন। পিছনে মহেন্দ্র শতপথী। টগার আর ঘরটা ঘুরে দেখা হলো না।
চা খেতে খেতে সদাশিববাবু বললেন, পাহাড়-পুজো তো দেখলেন। এবার কী দেখবেন?
টগা বলল, পুজো আর দেখা হলো কই? শুধু লোকের ভিড়। ভিড় দেখার জন্যে তো এখানে আসিনি।
তাহলে কি ফিরেই যাবেন?
চপল বলল, এখানে আর কিছু তো দেখার নেই?
আছে বৈকি। সিধিয়ার্টাড়ের সতীমেলার থান।
সে আবার কোথায়?
সদাশিববাবু বললেন, এখান থেকে মাইল দশেক দূরে সিধিয়ার্টাড়। টাড় মানে রুক্ষ। এর কাছেই চরসা গ্রাম। সেই গ্রামের বধূ সরলাদেবী স্বামীর সঙ্গে এক চিতায় পুড়ে পুণ্যবতী সতী হয়েছিলেন। সেই সতীর স্মরণেই প্রতি বছর এই সময়ে ওখানে মেলা বসে। যেখানে চিতা জ্বলেছিল সেখানে একটা বেদি তৈরি করা হয়েছিল। তার ওপর ওড়ে লাল নিশান। গ্রামের বৌ-রা সেই বেদিতে স্বামীর কল্যাণে সিঁদুর লেপে দেয়। বহু নারী-পুরুষ আসে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে।
টগা বলল, সতী মাথায় থাকুন। ও জায়গা দেখবার আগ্রহ আমার মোটেও নেই।
হ্যাঁ, বরঞ্চ অন্য কোনো জায়গা যদি কাছেপিঠে থাকে, চপল বলল।
সদাশিববাবু হতাশ হয়ে বললেন, না, তেমন দ্রষ্টব্য জায়গার কথা তো আমি জানি না।
এরপর নিঃশব্দেই চা খাওয়া শেষ হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না। বিকুই নীরবতা ভাঙল। হেসে বলল, টগা একমনে কী এমন ভাবছে?
সদাশিববাবুও টগার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, তপেন্দুবাবু কাল রাতের সেই কুকুর ডাকের কথা ভুলতে পারছেন না বোধহয়।
টগা গম্ভীরভাবে বলল, ও যে ভোলার ব্যাপার নয় সদাশিববাবু। যদি আমি নিজে কানে না শুনতাম তা হলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না। কিন্তু যাক সে কথা। আমি ভাবছিলাম মিস্টার ফার্নান্ডেজের কথা। আচ্ছা, এবার উনি বড়ো ঘর চেয়েছিলেন কেন? মানুষ তো একা।
সদাশিববাবু যেন একটু অবাক হলেন। বললেন, তাই তো। কথাটা তো আমি ভেবে দেখিনি।
টগা বলল, সদশিববাবু, মাত্র এক রাত্তির এখানে কাটিয়েই আমি বুঝতে পেরেছি এখানে রহস্যজনক কিছু আছেই। আর সেই রহস্যের সঙ্গে প্রধানত জড়িয়ে আছে দুটি জিনিস। এক কোনো পশুর অলৌকিক গর্জন আর দুই–প্রায় আশি বছরের ঐ বুড়ো পাদ্রির অস্বাভাবিক ঘোরাঘুরি, দাপাদাপি।
সদাশিববাবু আঁৎকে উঠলেন। বললেন, চুপ চুপ, পাদ্রিসাহেব শুনতে পেলে এমন কাণ্ড বাধাবেন–
টগা সে কথায় কান না দিয়ে বলল, এই দুটো রহস্য ভেদ না করে আমরা এখান থেকে নড়ছি না। আর সত্যিই যদি এই রহস্য ভেদ করতে হয়, তাহলে সব আগে দরকার হবে আপনার সাহায্য। কেননা আপনি এখানে অনেক দিন আছেন অনেক কিছুই জানেন। অথচ আমাদের কাছে বলতে চাচ্ছেন না।
টগার এইরকম সোজাসুজি কথায় সদাশিববাবু যেন ধরা পড়ে গেলেন। ইতস্তত করে বললেন, ঠিক আছে। সন্ধ্যেবেলায় আসবেন। তখন কাজ থাকে না, আমি যতটুকু জানি তা বলব। তবে মিস্টার ফার্নান্ডেজ সম্বন্ধে আমি বেশি কিছুই জানি না তা বলে রাখলাম।
টগা সে কথা যেন শুনতে পেল না। বলল, আর একটা কথা। এখানে যিনি স্থানীয় পাদ্রি আছেন তাঁর সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দিতে হবে।
সদাশিববাবু বললেন, এখানে একজন পাদ্রি আছেন বটে তবে তার সঙ্গে বিশেষ আলাপ নেই। আমি চার্চে যাই না। চার্চের কেউ বড়ো একটা এদিকে আসেন না। তবু আলাপ করিয়ে দেবার চেষ্টা করব। ঐ লাঞ্চের ঘণ্টা পড়ল। আপনাদের তো স্নানও হয়নি। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে ডাইনিংহলে আসুন।
ওঠবার সময় টগা বলল, কাল রাত্রে সেই কুকুরের ডাকটা পশ্চিমের ঐ পাহাড়টার দিক থেকে আসেনি?
তাই তো মনে হয়েছিল।
নিজেদের ঘরে ফিরে আসতে আসতে টগা আর একবার পাদ্রিসাহেবের ঘরের দিকে তাকাল। না, তিনি এখনও ফেরেননি।
.
পাথরমহলের পথে
দুপুরে লাঞ্চ সেরে ওরা তিনজন ঘরে এসে ঢুকল। বিকু তৎক্ষণাৎ লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। ছুটির দিনে দুপুরে ফার্স্ট ক্লাস একখানি ঘুম দিতে না পারলে তার চলে না। চপল বিছানায় বসে দেশলাই-এর কাঠি দিয়ে আরাম করে কান পরিষ্কার করছিল। কেবল ছটফট করছিল টগা। রহস্য ভেদ করতে গেলে কি পেট ভরে খাওয়া আর কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম দিলে চলে?
এই চল না একটু ঘুরে আসি।
বিকু কোনো উত্তরই দিলো না।
চপল বলল, এই দুপুর রোদে কোথায় যাবি?
দুপুর রোদ! শীতের দিনে পাহাড়ে রোদ যে কত আরামের
তেমন শীত এখনও পড়েনি। তাছাড়া কাল রাতে ঘুমটা ভালো জমেনি। কী যে ছাই একটা বিশ্রী ডাক শোনা গেল, ব্যস ঘুম গেল চটে। এখন মেক আপ দিতে হবে।
সেই ডাকটা সম্বন্ধে জানতে কৌতূহল হয় না?
হবে না কেন? তা বলে সারা দুপুর পাহাড়ে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ালেই কি কৌতূহল মিটবে?
টগা বলল, সত্যি যদি রহস্য বলে কিছু থাকে তা হলে পশ্চিমের ঐ পাহাড়গুলোর কাছেই আছে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কল্পনায় রহস্য ভেদ করা যায় না। আচ্ছা, তোরা ঘুমো। আমি একটু ঘুরে আসি।
চপল বলল, নতুন জায়গা। গোঁয়ার্তুমি করে বেশি দূর যাস নে। তাছাড়া এখানে সন্ধ্যে নামে তাড়াতাড়ি।
টগা সে কথায় কান না দিয়ে বেরিয়ে গেল।
ঠিক কোথায় যাচ্ছে জানে না। কিন্তু কোন দিকে যাচ্ছে জানে। তার দৃঢ় বিশ্বাস পশ্চিম দিকে ঐ যে পাহাড়টা গাছপালায় কালো হয়ে আছে তারই কোনো গহ্বর থেকে কুকুরের সেই অস্বাভাবিক গর্জন শোনা গিয়েছিল। কিন্তু কেমন সেই জন্তু যা মাত্র একবারই ডাকে? কত জনে হয়তো একবছর-দুবছরে মাত্র একবারই ডাক শুনেছে। কিন্তু সে ডাক যে জীবন্ত কোনো প্রাণীর তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
টগার মাথার ভেতর কেমন সব গোলমাল হয়ে গেল। কিসের গর্জন ওটা? কুকুরের মতো। কিন্তু কুকুরের গর্জন কি অত ভয়ংকর হয়? যদি মেনেও নেওয়া যায় ওটা কুকুরেরই ডাক তাহলে কত বড়ো সেই কুকুরটা যার গর্জন পাহাড়-টিলা কাঁপিয়ে এত দূর পর্যন্ত এসে পৌঁছয়?
আচ্ছা কুকুরের গর্জনের সঙ্গে কি অন্য কোনো প্রাণীর স্বরও মিশেছিল? অনেকটা যেন অতিপ্রাকৃত জগতের মানুষের মতো?
আশ্চর্য, গত রাতে সেই ডাক শোনার পর থেকে সে যতটা ভাবছে, চপল, বিকু বা বাংলোর অন্য কেউ তারা কিছুই ভাবছে না।
টগা সেই দুর্গম পাথুরে পথ ধরে, ছোটো-বড়ো ঢিবি টপকে হেঁটেই চলেছে। শীতের দিন বলে ক্লান্তি নেই।
কিন্তু ভয়ংকর সেই ডাকের চেয়েও অদ্ভুত মানুষ ঐ পাদ্রিটি। পাদ্রিদের ওপর সাধারণত মানুষের শ্রদ্ধা হয়। পাদ্রিদের দেখে মনে হয় তারা যেন সংসারের যাবতীয় লোভ, হিংসা, স্বার্থপরতার অনেক ঊর্ধ্বে। কিন্তু বাঙ্গাললারের এই ডিক ফার্নান্ডেজকে দেখলে পাদ্রি বলে মোটেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে না। কেন? তার কারণ বোধহয় লোকটি ধূর্ত, মতলববাজ। কারও সঙ্গে মিশতে চান না। সব সময়ে যেন কালো চশমা পরে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চান। শুধু তাই নয়, এই যে মানুষটা সকালে বেরিয়ে সেই রাত্তিরে ফেরেন–সারাদিন কী করেন? কোথায় থাকেন?
এদিকে এই পাহাড়ি জায়গায় এমন ঘর-বাড়ি চোখে পড়ছে না যে সেখানে তিনি থাকবেন। তাহলে তার থাকবার একমাত্র জায়গা পুরুলিয়া কিংবা পুরুলিয়ার কাছগছি কোথাও। তাই যদি হয় তাহলে তিনি মরতে এত দূরে এই বাংলোয় থাকতে এলেন কেন? নিশ্চয় পাহাড় পুজো দেখাই তার উদ্দেশ্য নয়।
হঠাৎ টগার হুশ হলো। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরে দেখল–কোথায় কত দূরে তাদের বনবাংলোটা? দেখাই যাচ্ছে না। আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে, ইচ্ছে করে আসেনি, কেউ যেন ঠেলে নিয়ে এসেছে।
কিন্তু কী লাভ হলো এত দূরে এসে? গাছ নেই, পালা নেই, মানুষজনের সাড়া নেই, শুধু পাথরের রাজ্য। এদিকে শীতের বেলা ফুরিয়ে আসছে।…
হঠাৎ টগার নজরে পড়ল অনেক দূরে একটা ভাঙা বাড়ির মতো কী যেন রয়েছে। আর তার গা বেয়ে সরু হয়ে বেরোচ্ছে ধোঁয়া।
টগা অবাক হলো। এই জনমানবশূন্য পাথুরে রাজ্যে ধোঁয়া আসছে কোথা থেকে?
খুব ইচ্ছে করছিল আরও একটু জোরে হেঁটে ভাঙা বাড়িটা দেখে আসে। অন্তত বুঝতে পারে সত্যি বাড়ি, নাকি চোখের ভুল! বাড়ি হলে কিসের বাড়ি? কিন্তু এই সন্ধ্যের মুখে অত দূরে যেতে সাহস হলো না। ফিরতে হলো। একটা কথা মনে হলো। এই পাথুরে রাজ্যে তো মানুষের থাকার আশ্রয়ই নেই। তাহলে আদিবাসীদের বাস কোন দিকে? সকালের সেই তিব্বতী ছেলেটাই বা কোন দিকে গেল!
টগা আর একবার পিছন ফিরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে তার দৃষ্টি নিশ্চল হয়ে গেল। অবাক কাণ্ড! দেখল বেশ কিছুটা দূরে টুপি মাথায়, কোট-প্যান্ট পরা কঞ্চির মতো সোজা একজন বৃদ্ধ টপাটপ পাথর টপকে এগিয়ে আসছেন। বুঝতে বাকি রইল না লোকটি কে? শুধু বুঝতে পারল না সারাদিন মানুষটা কোথায় ছিলেন?
যাই হোক, আর দেরি না করে টগা বাংলোমুখো পা চালাল। কিন্তু মিনিট দশেক হাঁটার পরই বুঝতে পারল পাথরের রাজ্যে পথ চিনে বাড়ি ফেরা কত কঠিন। কাছে-পিঠে, সামনে পিছনে এমন কোনো চিহ্ন নেই যা দেখে পথ চিনবে। পথ? এই ছড়ানো পাথর, নুড়ি আর ঘাসের মধ্যে পথ কোথায়? অনেক দুর্গম জায়গায় পায়ে চলা পথও থাকে। এখানে তাও নেই। তাহলে ঐ বুড়ো মানুষটি কোন পথ ধরে অত দূর গেলেন?
যাই হোক, শেষ পর্যন্ত টগলা বনবাংলোয় এসে পৌঁছল। ওকে দেখে চপল, বিকু জিগ্যেস করল, কোথায় ছিলি সারা দুপুর?
বেড়াচ্ছিলাম। ছোট্ট উত্তর দিয়েই টগা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। নিচু গলায় জিগ্যেস করল, পাদ্রিসাহেব এখনও ফেরেননি তো?
চপল বলল, অনেকক্ষণ ফিরেছেন।
টগা চমকে উঠল, সে কী! আমি তো দেখলাম—
বিকু বলল, তা ঘণ্টাখানেকের উপর হলো উনি এসেছেন।
টগা নিজের মনে সময়ের হিসেব করে নিয়ে বলল, ঘণ্টাখানেক আগে! অসম্ভব! তাহলে কাকে দেখলাম অনেক দূরে, কোট-প্যান্ট পরা, টুপি মাথায়, এক-একটা পাথর টপকে দিব্যি এগিয়ে আসছে? সে কি অন্য কেউ? নাকি পাথরমহলের ইন্দ্রজাল?
.
নীলকর সাহেবদের কথা
সদাশিববাবু বলেছিলেন বটে সন্ধ্যের সময়ে তেমন কাজ থাকে না, সেই সময়ে অফিসঘরে আসতে–গল্পগুজব করা যাবে। কিন্তু দেখা গেল সদাশিববাবু তখন টিভি খুলে বসে আছেন আর বোর্ডাররা নিউজ শোনার জন্য সেখানেই জাঁকিয়ে বসেছে।
টগা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সদাশিববাবুর কাছ থেকে কিছু জানতে চায়। বিশেষ করে আজ দুপুরে ঐ জনশূন্য পাথুরে রাজ্যে গিয়ে দূর থেকে ভাঙা বাড়ি, বাড়ির পিছনে ধোঁয়া আর ওখানে পাদ্রিসাহেবকে দেখে তার সন্দেহ দৃঢ় হয়েছে যে, ওখানে গভীর রহস্য কিছু আছেই।
আচ্ছা, যদি ভুল দেখে না থাকে তাহলে ঐ বুড়ো পাদ্রিসাহেবের পক্ষে কী করে সম্ভব হলো অত তাড়াতাড়ি বাংলোয় ফিরে আসা? এ যে অমানুষিক ব্যাপার! সত্যি ফিরে এসেছে তো? ভেবে পাদ্রিসাহেবের ঘরের দিকে তাকাতেই দেখল কে একজন অন্ধকারে পাদ্রিসাহেবের ঘর থেকে চকিতে বেরিয়ে গেল। চিনতে দেরি হলো না। মহেন্দ্র শতপথী।
আশ্চর্য! পাদ্রিসাহেবের ঘরে এই সময়ে মহেন্দ্র কী করছিল?
টগাও যথাসম্ভব অন্ধকারে নিজেকে গোপন করে মহেন্দ্রর ঘরের দিকে গেল।
মহেন্দ্র!
মহেন্দ্র চমকে উঠল। আপনি বাবু এখানে?
কয়েকটা কথা জিগ্যেস করব। ঠিক ঠিক উত্তর দিও।
টগার গলার স্বরে মহেন্দ্ৰ ভড়কে গেল। কোনরকমে বলল, বলুন।
পাদ্রিসাহেব কেমন লোক ঠিক করে বলো তো।
মহেন্দ্র ইতস্তত করে বলল, কী করে বলব? কদিনই বা দেখছি।
তুমি ভালো করেই ওঁকে জান। একটু আগে ওঁর ঘরে কী কথা হচ্ছিল সত্যি করে বল।
মহেন্দ্ৰ ভয় পেয়ে গেল। ভাবল কলকাতার এই বাবু নিশ্চয় আড়াল থেকে তাদের কথা শুনেছে। তাই হাতজোড় করে বলল, বিশ্বাস করুন বাবু, আমি রাজী হইনি।
কিসে রাজী হওনি?
আজ্ঞে ও পাদ্রি নয়, আস্ত শয়তান। আদিবাসীদের ঘর থেকে একটা ছোটো ছেলেকে ধরে এনে দিতে বলেছিল। ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আনতে বলেছিল। ওষুধের সঙ্গে একশোটা টাকা দিতে চেয়েছিল। আমি রাজী হইনি। তাইতে খুব রেগে মারতে এসেছিল। আমি পালিয়ে এসেছি।
টগা স্তম্ভিত হয়ে গেল। বলল, ছেলে নিয়ে কী করবে?
জানি না বাবু। তবে—
তবে কী?
ঐ পাথরমহলে অনেক কিছু ঘটে বলে শুনেছি। ওখানে নাকি একটা ভয়ংকর দেবতা আছে–যেনার সঙ্গী, রাতে যেনাদের নাম করতে নেই।
টগা চুপ করে শুনল। তারপর বলল, তুমি ঠিক বলছ?
জগরনাথের নামে দিব্যি। একটু থেমে বলল, আপনি আজ দুপুরে পাথরমহলের দিকে গিয়েছিলেন। আর যাবেন না।
কে বলেছে ওদিকে গিয়েছিলাম?
সে আর নাই শুনলেন। আপনি এখন যান। পাদ্রিসাহেব যদি দেখে ফেলেন আপনার সাথে কথা বলছি তাহলে মেরে ফেলবে। আপনার ওপর খুব রাগ।
টগা বলল, কেন? আমি তার কী করেছি?
তা আমি জানি না।
মেরে ফেলা অত সহজ নয়। তুমি একটা খবর আমাকে জানাতে চেষ্টা কর কী আছে ঐ পাথরমহলে? আর আদিবাসীদের ছেলে নিয়ে কী করতে চায় পাদ্রিসাহেব?
জানবার চেষ্টা করব। আর আমি যা বললাম তা কাউকে বলবেন না।
তারপর হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে বলল, আপনি ইঁদারার পাশ দিয়ে চলে যান বাবু। নইলে পাদ্রিসাহেব হয়তো দেখে ফেলবেন।
মহেন্দ্রের সঙ্গে কথা বলে টগা বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। মহেন্দ্র যা যা বলল, তা কি সব সত্যি? কোন ভয়ংকর দেবতা আছেন ঐ পাথরমহলে? পাদ্রিসাহেবের সঙ্গে ঐ জায়গার সম্পর্কই বা কী? কেনই বা তিনি আদিবাসী ছেলের খোঁজ করছেন? কী করবেন তাকে নিয়ে?
এইসব ভাবতে ভাবতেই গা ঢুকল সদাশিববাবুর অফিসঘরে। সেখানে তখন চপল আর বিকু চাড়া আর কেউ ছিল না।
টগাকে দেখে সদাশিববাবু হেসে বললেন, কোথায় ছিলেন এতক্ষণ ভাই? আপনার সঙ্গে তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়ে আছে।
টগা বলল, পাদ্রিসাহেবের ঘরের কাছে ঘুরছিলাম। দেখা হলে আলাপ করতাম।
সদাশিববাবু যেন চমকে উঠলেন। বললেন, ওঁর ঘরের কাছে ঘুরছিলেন! সর্বনাশ! দেখতে পেলে রক্ষে রাখতেন না।
টগা হেসে বলল, কেন? আলাপ করা বুঝি পছন্দ করেন না?
সদাশিববাবু বললেন, মোটেই করেন না। মেজাজও খুব। বুঝলেন না একে বাঙ্গালোরের পাদ্রি, তার ওপর টু পাইস আছে।
টগা খুব সাবধানে ভেবে ভেবে প্রশ্ন করছিল। বলল, আজ দুপুরে কি উনি বেরিয়েছিলেন?
ও বাবা! বেরোনোই তো ওঁর কাজ।
ফিরলেন কখন?
সেটা লক্ষ্য করিনি।
আচ্ছা, উনি বড়ো ঘর চাইছিলেন কেন?
জানি না। তবে মনে হয় কিছু রাখবেন। কারণ ছুতোর মিস্ত্রিরও খোঁজ করছিলেন।
চপল বলল, তা হলে বোধহয় এবার এখানে বেশ কিছুদিন থাকবেন?
সেইরকমই মনে হচ্ছে।
টগা বলল, এবার আসল ব্যাপারটা সম্বন্ধে জিগ্যেস করি।
বলুন। যদি জানা থাকে তাহলে সত্য উত্তর পাবেন। বলে পকেট থেকে সিগারেট ধরালেন।
চলবে?
নাঃ। তিনজনেই একসঙ্গে উত্তর দিলো।
এই একটা জিনিস লক্ষ্য করছি ইয়ং ছেলেরা অনেকেই সিগারেট খাচ্ছে না। খুব ভালো।
টগা বলল, কালকে রাত্তিরের সেই অদ্ভুত গর্জনটা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। আচ্ছা, শব্দটা ঠিক কোন দিক থেকে আসে বলে মনে হয়?
এ প্রশ্ন তো আগেও করেছেন। উত্তরও দিয়েছি। আবার বলছি, আন্দাজ করি পশ্চিম দিকে যে টিলা-পাহাড়গুলো আছে, ঐ দিক থেকেই আসে।
টগা দেওয়ালে ভালো করে ঠেসান দিয়ে বলল, ওটা কী ব্যাপার খোঁজখবর করতে ইচ্ছে করে না? হাজার হোক বিজ্ঞানের যুগে তো আমরা বাস করছি।
সদাশিববাবু হাত নেড়ে বললেন, না মশাই। অত কৌতূহল আমার নেই। শুধু আমি কেন, কাছে-পিঠে তো অনেকেই বংশানুক্রমে বাস করেন। তাঁরা কেউ রহস্যভেদ করতে গেছেন? ও মশাই, রহস্য রহস্যই থাক। ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।
এতক্ষণে বিকু বলল, আমারও তাই মত। এই দেখুন না, টগা আজ দুপুরে ঐ দিকে গিয়েছিল।
সদাশিববাবু চমকে উঠলেন, অ্যাঁ!
টগা হেসে বলল, ওর কথা বাদ দিন। আচ্ছা, এখানে তো বেশিরভাগ আদিবাসী। তারা ঐ গর্জনটাকে কীভাবে নেয়?
তারা? তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ঐ শব্দটা অশুভ। কোনো ক্রুদ্ধ দেবতার গর্জন। আর সেই দেবতা থাকেন ঐদিকের পাহাড়ে। তারা মনে করে ঐ গর্জনের পরিণতি একদিন মারাত্মক হয়ে উঠবেই এখানকার মানুষদের জীবনে। যে রাতে গর্জন শোনা যায় পরের দিনই ওরা সেই দেবতার উদ্দেশ্যে মুর্গি বলি দেয়। কৃপা ভিক্ষা করে।
এই পর্যন্ত বলে সদাশিববাবু থামলেন। তারপর বেল বাজিয়ে শতপথীকে ডাকলেন। শতপথী এসে দাঁড়াল। টগা তার মুখের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। হঠাৎ যেন কিসের ভয়ে তার মুখের সমস্ত রক্ত নিঃশেষ হয়ে গেছে। সদাশিববাবু অত লক্ষ্য করলেন না। তিনি ফের চার কাপ চা দিতে বললেন।
টগা জিগ্যেস করল, এখানে পাথরমহল কোন জায়গাটাকে বলে?
সদাশিববাবু বললেন, এ নামটা শুনলেন কোথা থেকে?
শতপথী চলে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। করুণ চোখে টগার দিকে তাকাল।
টগা মিথ্যে কথাই বলল। আজই দুপুরে বেরিয়েছিলাম ঐদিকে। বেশ লাগছিল। একজন আদিবাসীকে জিগ্যেস করে জানলাম ঐ জায়গাটাকেই পাথরমহল বলে।
সদশিববাবু একটু হেসে বললেন, তবে আর কি, উত্তর তো পেয়েই গেছেন। কী রে! তুই হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস কেন?
মহেন্দ্র যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেল।
টগা ইতস্তত করে বলল, উত্তর পেয়েছি বটে কিন্তু খটকা আছে।
কীরকম?
মহল কথাটাই গোল বাধাচ্ছে। আমরা নবাবী আমলে অনেকবার মহল কথাটা পেয়েছি। তাতে নির্দিষ্ট কোনো জায়গাকে বোঝায়। যেমন তাজমহল, শিশমহল, রঙমহল। তাই আমার ধারণা পাথরমহল বলতেও কোনো অঞ্চল নয়, নির্দিষ্ট জায়গা বোঝায়। আমার কৌতূহল সেই বিশেষ জায়গাটা কোথায়? কী ছিল সেখানে? আর এর উত্তর একমাত্র আপনিই দিতে পারেন।
সদাশিববাবু মনে মনে খুশি হলেন। মাথা চুলকে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন, এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার পশ্চিমে পাহাড়ের কোলে অনেকখানি জায়গা জুড়ে বড়ো বড়ো কয়েকটা বাড়ির চিহ্ন পড়ে আছে। বাড়িগুলোর যে অংশগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখলে নাকি মনে হয় যেন আগাগোড়া পাথরের তৈরি। কেউ বলে ওগুলো বাঘমুণ্ডির রাজাঠাকুর বয়ার সিংহের কাছারিবাড়ি। কেউ বলে নীলকর সাহেবদের ঘাঁটি।
নীলকর! হঠাৎ বিকু বলে উঠল, এই ব্যাপারটা খুব শুনেছি। কিন্তু ঠিক জানি না। আগে নাকি নীলের চাষ হতো। এখন হয় না কেন?
সদাশিববাবু কিছু বলার আগেই টগা বলে উঠল, ডাই অর্থাৎ নীল রং তৈরির জন্য একসময়ে এই নীল গাছের চাষ হতো খুব। সাহেবরা এদেশে এসে এই নীলের চাষ করে বড়োলোক হয়ে গিয়েছে।
চপল বলল, সে নীল উঠে গেল কেন?
টগাই উত্তর দিলো, এখন কেমিক্যাল ডাই বেরিয়ে গেছে।
সদাশিববাবু বললেন, সে সময়ে এই নীল চাষ নিয়ে যে বিরাট কর্মযজ্ঞ হতো তা ভাঙাচোরা নীলকুঠিগুলো দেখলেই বোঝা যায়। চাষীদের ওপর কম অত্যাচার করেছে সাহেবরা! দীনবন্ধু মিত্র তাই নিয়েই নীলদর্পণ নামে নাটক লিখে ফেললেন। সেই নাটক দেখতে দেখতে বিদ্যাসাগরমশাই রাগে সাহেবের দিকে চটিই ছুঁড়ে মারলেন। ভুলেই গিয়েছিলেন ওটা অভিনয় হচ্ছিল। এসব তো ইতিহাস!
টগা বলল, সেই পাথরমহলে কেউ এখন থাকে?
সদাশিববাবু হাসলেন। বললেন, যদি কেউ থাকে তাহলে তারা সাহেবদের হাতে খুন হওয়া হতভাগ্য চাষীদের আত্মা।
এই পর্যন্ত বলে সদাশিববাবু থামলেন। বললেন, রাত হয়েছে। আজ আর নয়।
মহেন্দ্র ঘরে ঢুকল চায়ের কাপ নিয়ে যাবার জন্য।
টগা বলল, আর একটা কথা জিগ্যেস করব।
সদাশিব নিঃশব্দে হাসলেন।
বলুন।
বাঙ্গালোর থেকে আসা বৃদ্ধ পাদ্রিটিকে আপনার কীরকম লাগে? কেন তিনি মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন?
সদাশিববাবু বললেন, জানি না।
আচ্ছা, আমাদের সম্বন্ধে তাঁর কৌতূহল কেন?
তাও জানি না ভাই। একবার শুধু জিগ্যেস করেছিলেন কোথায় কোথায় ঘুরবে ওরা? বলেছিলাম জানি না। এই পর্যন্ত।
টগা বলল, খুব ইচ্ছে ছিল একবার ওঁর মুখোমুখি হওয়া। দেখা যাক—
ঠিক সেই মুহূর্তেই যে লম্বা, শীর্ণ, বৃদ্ধ, প্যান্ট-শার্ট পরা মূর্তিটি উত্তেজিতভাবে দরজার সামনে এসে দাঁড়াল, বুঝতে বাকি রইল না তিনিই বাঙ্গালোরের পাদ্রিসাহেব। রাতের বেলাতেও তার চোখে কালো চশমা!
চাপা খসখসে গলায় তিনি বললেন, মিস্টার ম্যানেজার, অনুগ্রহ করে আমার রাতের খাবারটা ঘরে পৌঁছে দিতে বলবেন? অনেক রাত হয়েছে।
সদাশিববাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সে কী! মহেন্দ্র এখনও আপনার খাবার দেয়নি?
ও এখন আমাকে অবজ্ঞা করে।
মহেন্দ্র তখনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পাদ্রিসাহেব শুধু একবার টগাদের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখে নিলেন। কালো চশমার মধ্যে দিয়েই তার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আগুনের মতো জ্বলে উঠল।
.
দুই পাদ্রি
ভোরবেলায় উঠে টগা কোথায় বেড়াতে গিয়েছিল। ফিরল যখন বেলা প্রায় নটা। বিকু তখনও ঘুমোচ্ছিল। চপল বলল, বাবাঃ, এতক্ষণ ধরে কোথায় বেড়ালি?
জায়গাটা একটু ঘুরে দেখছিলাম। দূরে একটা পাহাড় আছে। দেখলাম তার রঙটা অদ্ভুত ধরনের কালো। দেখলে কেমন যেন ভয় করে।
চপল সে কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলল, এদিকে একটা কাণ্ড হয়েছে।
কী হলো আবার?
বাঙ্গালোর থেকে পাদ্রি এসেছে শুনে এখানকার চার্চের পাদ্রি সকালবেলাতেই আলাপ করার জন্যে ছুটে এসেছেন।
সে তো ভালো কথা।
ভালো আর হলো কই? আমাদের পাদ্রিসাহেব বললেন, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া তিনি কারও সঙ্গেই দেখা করেন না। এখানকার চার্চের পাদ্রি খুব লজ্জা পেলেন। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিলেন। সদাশিববাবুও মিস্টার ফার্নান্ডাজেকে বিশেষ করে অনুরোধ করলেন শুধু পাঁচ মিনিটের জন্যে দেখা করতে। কিন্তু কোনো ফল হলো না। এখন তুই আলাপ করতে চেয়েছিলি শুনে তোর জন্যে বসে আছেন।
আমার জন্যে বসে আছেন! কোথায়?
সদাশিববাবুর অফিস-ঘরে।
টগা তখনই ছুটল।
সাদাসিধে সরল মানুষটি। বৃদ্ধ হয়েছেন। মুখে শুভ্র দাড়ির সঙ্গে শুভ্র হাসি। দেখলেই শ্রদ্ধা হয়। নাম বিনয় মজুমদার। গলায় কালো কারে ঝুলছে পবিত্র ক্রুশচিহ্ন। এখানে যে ছোটোখাটো চার্চটি আছে সেখানেই প্রার্থনা করেন প্রতি রবিবার। এখানে খ্রিস্টান পরিবার বেশি নেই, থাকবার কথাও নয়। তবে যে কজন আছেন তাঁরা নিয়মিত চার্চে যান। সুদূর বাঙ্গালোর থেকে একজন অবাঙালি পাদ্রি এসেছেন অখ্যাত, অল্প পরিচিত এই মাঠাবুরু অঞ্চলে, এ কি কম কথা! এর আগেও তিনি যখন এখানে পায়ের ধুলো দিয়েছিলেন তখন দেখা করতে পারেননি। যেদিন দেখা করতে এসেছিলেন তার আগেই তিনি চলে গিয়েছিলেন।
একজন পাদ্রি হয়ে সুদূর বাঙ্গালোর থেকে এতদূর এলেন বার তিনেক, তবু কোনোবারই স্থানীয় চার্চে গেলেন না, এখানকার খ্রিস্টানদের সঙ্গে আলাপ করলেন না, এমনকি চার্চটিও দেখলেন না–এ ক্ষোভ এঁদের সবার মনে থাকলেও খুব ইচ্ছে ছিল এবার তাকে এখানকার খ্রিস্টান সমাজ থেকে সংবর্ধনা দেবে। কিন্তু কী আশ্চর্য! ভদ্রলোক নিজে পাদ্রি হয়েও আর একজন পাদ্রির সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলেন না! বিনয় মজুমদার এর জন্যে মনে মনে দুঃখ পেলেও টগার কাছে তার জন্যে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন না। উলটে বললেন, দোষ তো আমারই। আগে থেকে না জানিয়ে এলে এই সব ব্যস্ত ভি. আই. পি. মানুষের কি দেখা পাওয়া যায়?(অথচ মিস্টার ফার্নান্ডেজ তখন দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরেই রয়েছেন।)
বিনয় মজুমদার একবারও জানতে চাইলেন না কী উদ্দেশে মিস্টার ফার্নান্ডেজ এখানে এসেছেন। অহেতুক কৌতূহল প্রকাশ করাটা যে অভদ্রতা এই বৃদ্ধ পাদ্রি তা জানেন।
যাই হোক, খুব অল্প সময়ের মধ্যে টগার সঙ্গে আলাপ করে তিনি খুশি হলেন। এমনকি চার্চে তার কোয়ার্টারে যাবার নেমন্তন্ন পর্যন্ত করলেন।
টগা মনে মনে এই সুযোগটাই খুঁজছিল। বলল, আমি আজই বিকেলে যাব। আপনার মতো অভিজ্ঞ মানুষের সঙ্গ পেলে এখানকার বিষয় অনেক কিছু জানতে পারি।
একটু হতাশ হয়ে বিনয়বাবু বললেন, এখানে এমন কী ইতিহাস আছে যা বলে আপনার মতো কলকাতার একজন আধুনিক ছেলের কৌতূহল নিবারণ করব? ঠিক আছে। আপনি আসুন তো। তবে বিকেলে যদি আসেন অবশ্যই টর্চ সঙ্গে নেবেন। অন্ধকার হয়ে গেলে পথঘাট নানা কারণে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
বলে বিনয়বাবু মাথায় হ্যাট পরে বাইরে এসে সাইকেলে চেপে বসলেন।
বিনয়বাবু চলে যেতেই আর এক কাণ্ড! মিস্টার ফার্নান্ডেজ খুব চেঁচামেচি করে মহেন্দ্রকে ডাকলেন। ভয়ে ভয়ে মহেন্দ্র গিয়ে দাঁড়াল। পাদ্রিসাহেব কৈফিয়ৎ চাইলেন, কেন তার ঘুম ভাঙানো হয়েছে?
নিরপরাধ মহেন্দ্র যখন জানাল এখানকার পাদ্রিবাবা দেখা করতে এসেছেন বলেই ম্যানেজারবাবু তাকে ডাকতে বলেছিলেন, তখন রাগে অন্ধ হয়ে ফার্নান্ডেজ সদাশিববাবুর কাছে একরকম ছুটে গিয়ে বললেন, আপনাদের এই ভৃত্যটি বড়োই দুর্বিনীত, অবাধ্য। তা ছাড়া সে প্রায়ই আমার ঘরে ঢুকে তত্ত্ব-তালাশ করে। একে তাড়িয়ে দিন। নইলে আমি এখানে থাকব না।
সদাশিববাবু এমনিতে খুব ধীর, শান্ত মানুষ। কিন্তু ফার্নান্ডেজের মেজাজ, অকারণে নির্দোষ মহেন্দ্রের ওপর দোষারোপ তিনি বরদাস্ত করতে পারলেন না। বললেন, মহেন্দ্র এখানে অনেকের চেয়ে পুরনো লোক। কাজেই কেউ ভয় দেখালেও তাকে এখান থেকে আমি সরাব না।
তাই নাকি? আচ্ছা–কিন্তু Angry Hound যদি নিজেই সরাতে ইচ্ছে করেন? বলে একটানে চশমাটা খুলে ফেললেন। চশমা খোলা অবস্থায় তাকে বড়ো একটা দেখা যায় না। এই মুহূর্তে তার লাল লাল চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে সদাশিববাবু আঁৎকে উঠলেন। ও তো মানুষের চোখ নয়, হিংস্র কুকুর জাতীয় কোনো পশুর।
মিস্টার ফার্নান্ডেজ তাড়াতাড়ি চশমাটা পরে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
.
সারমেয়রাজ
বিকেল হতে না হতেই টগা বিনয়বাবুর কোয়ার্টারে চলে এল। খুব একটা দূরে নয়। খুঁজতেও অসুবিধে হয়নি। এখানে সবাই তাঁকে পাদ্রিবাবা বলে। খুব শ্রদ্ধা-ভক্তিও করে।
জায়গাটা এককথায় বেশ মনোরম। উঁচু-নিচু রুক্ষ পাথুরে বটে তবু অনেকখানি সমতল জায়গা আছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শালগাছ, আর একরকম কী পাহাড়ি গাছ–নাম জানা নেই। কাছেই চার্চ। প্রতিবছর রঙ ফেরানো হয়। চারিদিকে ফুলের বাগান। বাগানের পরিচর্যার জন্য মালী আছে। চার্চের বাইরে বাগানের ধারে ধারে লোহার বেঞ্চ। জায়গাটি নিস্তব্ধ।
বাঃ! চমৎকার জায়গাটা তো।
বিনয়বাবু দাড়িতে হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধ হাসলেন।
কিন্তু সামনেই ফাস্ট এড বক্সটা মোটেই মানাচ্ছে না।
বিনয়বাবু বললেন, ওটা শোভাবর্ধনের জন্যে নয়, প্রয়োজনে। পাশেই ছোটো একটা ঘরকে 0.T. হিসেবে ব্যবহার করা হয়। চলনসই একজন ডাক্তারও আছেন! বুঝতেই পারছেন শুধু প্রেয়ার করলেই তো চলে না। রোগ-ব্যাধি আছে। তাকে তো অস্বীকার করা যায় না। বলে হাসলেন একটু।
টগার শুনে ভালো লাগল। এবার অন্য প্রসঙ্গ তুলল, শুনেছি আর একটা চার্চ নাকি আছে?
বিনয়বাবু বললেন, এর চেয়েও পুরনো একটা চার্চ ছিল ডাচদের আমলের। সেটা এখন ভেঙে পড়েছে। অব্যবহার্য। তার সঙ্গেই ছিল একটা সিমেট্রি। প্রধানত ডাচদের জন্যে। কখনও কখনও ইংরেজদের বডি সমাহিত করা হতো বটে। কিন্তু নেটিভদের বা আদিবাসী খ্রিস্টানদের দেহের ঠাই হতো না, সেইজন্যে ওটা এখন পরিত্যক্ত কবরস্থান। নতুন বা চলতি কবরখানাটা একটু দূরে।
কথা বলতে বলতেই চা আর স্যান্ডুইচ এসে গেল।
বিনয়বাবু যে মিস্টার ফার্নান্ডেজের কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পেয়েছেন সে বিষয়ে একটি কথাও তুললেন না। কোনো অজুহাতে নিন্দাও করলেন না। নিন্দা করা যেন তার স্বভাবের বাইরে।
বিনয়বাবু অন্য দু-চারটে কথা বলে জিগ্যেস করলেন, কী জানতে চান বলুন।
টগা সময় নষ্ট না করে সোজাসুজি জিগ্যেস করল, সেদিন রাত্তিরে এক ধরনের ভয়ংকর কুকুরের ডাক শুনেছিলেন তো?
প্রথমেই এই ধরনের প্রশ্ন সম্ভবত বিনয়বাবু আশা করেননি। একটু ইতস্তত করে বললেন, আপনি কি সারমেয়রাজ-এর কথা জিগ্যেস করছেন?
টগা বলল, দেখুন Angry Hound কি সারমেয়রাজ তার কিছুই জানি না। শুধু
দাঁড়ান দাঁড়ান। কি বললেন, Angry Hound? এ নামটা আবার কোথায় পেলেন?
বাঙ্গালোরের পাদ্রিসাহেব মিস্টার ফার্নান্ডেজ কথায় কথায় বলে ফেলেছিলেন। Angry Hound বলতে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তা জানি না। তবে আন্দাজ করেছিলাম কুকুরের গর্জন প্রসঙ্গেই কথাটা বলেছিলেন। আর বলেছিলেন ঐ একবারই।
বিনয়বাবু চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, না, ঐরকম নাম আমি শুনিনি। আমি কেন–আমরা কেউই শুনিনি। হতে পারে অন্য জায়গায় ঐ নামটাই প্রচলিত।
টগা একটু আশ্চর্য হয়ে বলল, কার নাম, কী বৃত্তান্ত একটু খুলে বলবেন?
বিনয়বাবু ধীরে ধীরে বললেন, হ্যাঁ, সেই অদ্ভুত গর্জন আমিও শুনেছি। অনেকদিন পরপর দু-একবার শোনা যায়। এখানকার সাধারণ লোক বলে ওটা ক্রুদ্ধ দেবতার গর্জন। বলি চাইছেন। ঐ হুংকার শুনলে সে বছর কিছু না কিছু ক্ষতি হবেই। কিন্তু মজা এই–তেমন কোনো ক্ষতি এতকালের মধ্যে হয়নি, আর সেই ক্রুদ্ধ দেবতাটি কে জানেন? ভয়ঙ্কর একটি শিকারী কুকুর।
টগা বলল, যাকে মিস্টার ফার্নান্ডেজ বলেছিলেন Angry Hound আর আপনি বললেন সারমেয়রাজ অর্থাৎ কুকুরের রাজা।
রাইট!
সত্যিই জীবন্ত কোনো কুকুর আছে নাকি? থাকলে তার কাজ কী? ঠিকানাই বা কী?
দাঁড়ান ভাই, অত ব্যস্ত হবেন না। আপনি যখন আমার কাছে জানতে এসেছেন তখন যতটুকু যা জানি তাই বলছি।
বিনয়বাবু একটু থামলেন। তারপর বলতে লাগলেন, এখানে আসার ঢের আগে, আমার যৌবনকালে কলকাতার একটু পুরনো বই-এর দোকানে একটা অতি পুরনো ইংরিজি বই পেয়েছিলাম। বইটার নাম The God and Goddess of the uncivilized class অর্থাৎ অসভ্য জাতির দেবদেবীরা। এই বইটার মধ্যে একটা অধ্যায় ছিল–Ghost in the guise of Dog–অর্থাৎ কুকুররূপী ভূত। আমাদের দেশে এবং বিদেশে ভয়ংকর সব ভূতের গল্পে কালো বেড়ালের একটা বিশেষ ভূমিকা দেখা গেছে। কিন্তু কুকুর-ভূতের কথা শুনিনি। ঐ বইটাতেই প্রথম পড়লাম।
টগা বলল, এই কুকুর-ভূতদের কোথায় দেখা মেলে?
বিনয়বাবু বললেন, বিশেষ করে ছোটোখাটো পাহাড়ের রেঞ্জ যেখানে আছে সেখানেই এদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়–আর তা ভারতের যে কোনো জায়গায় হতে পারে। সেইজন্যেই বোধহয় মিস্টার ফার্নান্ডেজ তার জ্ঞনমতো বলেছিলেন Angry Hound। আমাদের এখানে তার পরিচয় সারমেয়রাজ।
খুব ইনটারেস্টিং লাগছে। উৎসাহিত হয়ে টগা বলল। কিন্তু এই কুকুর-দেবতা বা কুকুর ভূতের ক্রিয়াকলাপ কী? শুধুই কিংবদন্তির মধ্যে বেঁচে আছে, না কুকুরের চেহারা নিয়ে থাকে? কারাই বা তার পুজো করে? কীভাবে করে? সেই গর্জনটাই বা কিসের?
এবার বিনয়বাবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তপেন্দুবাবু, খোলাখুলি বলি। এখানকার বেশির ভাগ মানুষ সংস্কারাচ্ছন্ন। তাদের বিশ্বাস এখান থেকে মাইল তিনেক পশ্চিমে যে পাহাড়ের রেঞ্জ দেখা যায়–সেখানে রহস্যময় ভয়ংকর কিছু ব্যাপার আছে বহুকাল থেকে। সেটা যে ঠিক কী তা আমি বলতে পারব না। বাস্তবে কোনো কুকুরের অস্তিত্ব আছে কিনা তাও আমি জানি না। আবার এও ভাবি যদি কুকুর নাই থাকে তাহলে সারমেয়রাজ নাম প্রচার হলো কেন? গর্জনটাই বা কিসের? সবই অনুমান। কারণ আমি কখনও সেখানে যাইনি। যাবার ইচ্ছেও নেই।
এইভাবে বিনয়বাবু যেন অনেক কিছু এড়িয়ে গেলেন।
টগার হঠাৎ মহেন্দ্রর একটা কথা মনে পড়ে গেল। বলল, আচ্ছা, একটু আগে আপনি বললেন, এই ভূতটি কিংবা দেবতাটি মাঝে মাঝে বলি চান। এটা আপনি বিশ্বাস করেন?
প্রশান্ত হেসে পাদ্রিবাবা বললেন, আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা থাক। বই-এ পড়েছিলাম এঁরাও মাঝে মাঝে ক্ষুধিত হন। ক্ষুধিত হলেই গর্জন করেন। সে সময়ে কেউ যদি শিশু মাংস দিতে পারে তার ওপর তিনি খুশি হন। তাকে সর্বশক্তিমান করে দেন।
টগা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেল। মনে মনে বলল, এইজনেই বুঝি ফার্নান্ডেজের আদিবাসীদের একটা ছেলের দরকার পড়েছিল?
বিনয়বাবু জিগ্যেস করলে, আপনার আর কিছু প্রশ্ন আছে?
টগা বলল, আপনার মতো জ্ঞানী মানুষের কাছে বসে থেকে আরও অনেক কিছু জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু আপনার সময়ের দাম আছে। তবু জিগ্যেস করি–আজ না হয় আপনার বয়েস হয়েছে। কিন্তু অল্প বয়েসে কখনও ব্যাপারটা স্বচক্ষে দেখে আসতে ইচ্ছে করেনি?
বিনয়বাবু স্বচ্ছন্দে মাথা নেড়ে বললেন, না।
কেন?
বিনয়বাবু বললেন, দেখুন, মানুষ যতই অহংকার করুক তার জ্ঞানের পুঁজি কিন্তু খুব অল্প। এই পৃথিবীতে কত-না অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে, তার কতটুকু মানুষ সমাধান করতে পেরেছে! সব রহস্য জেনে ফেলে লাভই বা কী? আর জানাটা কি খুব সহজসাধ্য? মোটেই না। হিমালয়ের এক-একটা শৃঙ্গ আবিষ্কার করা যায় কিন্তু হিমালয়ের বিশাল দেহে গভীর জঙ্গলে এখনও কত রকম হিংস্র, নিরীহ প্রাণী লুকিয়ে আছে, তা কি সব আবিষ্কৃত হয়েছে বলে মনে করেন? না, হয়নি। তাতে মানুষের কোনো ক্ষতিও হয়নি।
একটু থেমে বললেন, পশ্চিম পাহাড়-অঞ্চলে এখনও বিরাট বিরাট বাড়ির ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে বলে শুনেছি। ওখানে নাকি এক সময়ে অত্যাচারী নীলকর সাহেবরা ছিল। অকথ্য অত্যাচার করেছে তারা গরিব দুর্বল চাষীদের ওপর। অনেক চাষীকে মরতে হয়েছে। কেউ কেউ বলে তাদের আত্মা এখনও প্রতিশোধ নেবার জন্যে ঘুরে বেড়ায় ঐ অঞ্চলে। আবার টম সাহেবের কথাও শুনেছি। তার নাকি বিরাট একটা হাউন্ড বা শিকারী কুকুর ছিল। চাষীদের পিছনে হাউন্ডটাকে লেলিয়ে দিত। হাউন্ডটা তাদের দাঁতে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলত।
তারপর একদিন নীলচাষীরা হৈ হৈ করে গিয়ে হাউন্ডটার খাঁচায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সেদিন টম সাহেব গুলি করে অনেক নীলচাষীকে মেরেছিল কিন্তু আগুনের হাত থেকে টমও বাঁচেনি, তার শয়তান কুকুরটাও না। বই-এ লেখা না থাকলেও এখানকার অনেকে বিশ্বাস করে সেই হাউন্ডটার প্রেতাত্মা নাকি এখনও পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায় মানুষের রক্তপানের নেশায়।
এই পর্যন্ত বলে বিনয়বাবু একটু থামলেন। বললেন, এসব আমি যেমন বিশ্বাস করি না তেমনি অবিশ্বাস করার সাধ্যও আমার নেই তপেন্দুবাবু। তাই ভাবি, কিছু কিছু রহস্য না হয় অমীমাংসিতই থাক। ক্ষতি কী?
টগা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাবার সময় আমার শেষ প্রশ্ন–যদিও মিস্টার ফার্নান্ডেজের সঙ্গে আপনার দেখা হয়নি তবু তাঁর সম্বন্ধে আপনার ধারণা কিরকম?
হঠাৎ এ কথায় বিনয়বাবুর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। কঠিন গলায় বললেন, শুনুন, তিনি আমার সঙ্গে দেখা করেননি সেটা ওঁর মতো লোকের পক্ষে কিছু অস্বাভাবিক নয়। ভদ্রলোকটি নামেই একজন পাদ্রি। আসলে একজন বিপজ্জনক মানুষ। আপনি আমার ছেলের মতো তাই পরামর্শ দিচ্ছি যতটা সম্ভব ওঁকে এড়িয়ে চলবেন। এখানে উনি মাঝে মাঝে যে আসেন সেটা যে কতটা অসৎ উদ্দেশ্যে তা ভাবতে পারবেন না।
টগা অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, আপনি তার সঙ্গে একটি কথাও না বলে তাকে জানলেন কি করে?
একটু অপেক্ষা করুন। বলে বিনয়বাবু ভেতরে চেলে গেলেন। একটু পরে ফিরলেন একটা খাম হাতে করে।
বাঙ্গালোর চার্চ থেকে এই টেলিগ্রামটা আমার নামে এসেছিল। পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন কেন তার সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করতে গিয়েছিলাম।
টগা পড়ে ফেলল। তারপর টেলিগ্রামটা ফেরত দিয়ে বলল, এখন আমার কাছে সব। পরিষ্কার হয়ে গেল। ধন্যবাদ আপনাকে। বলে টগা বেরিয়ে গেল।
.
অ্যাংরি হাউন্ড
পাদ্রিবাবার কাছ থেকে ফিরে এসে টগা খুব অন্যমনস্ক হয়ে রইল। অনেকরকম চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে লাগল। দেখল সদাশিববাবুর কথার সঙ্গে বিনয়বাবুর কথার অনেক মিল। তবে বৃদ্ধ বিনয়বাবু এই অঞ্চলের রহস্য নিয়ে অনেক কিছু পড়াশোনা করেছেন। তবু তিনিও পরিষ্কার বলতে পারলেন না সারমেয়রাজ বলে বাস্তবে কিছু আছে, না ওটা টম সাহেবের শিকারী কুকুরের প্রেতাত্মা! না কি কুকুরের গর্জনটা প্রাকৃতিক একটা হঠাৎ শব্দ মাত্র! আসলে রহস্য নিয়ে তিনি মাথা ঘামাতে চান না। তিনি চান রহস্যটা রহস্যই থাক।
বাস্তবে কুকুর-দেবতা বা কুকুর-ভূত থাক বা না থাক পুরনো ইংরিজি বই পড়ে জেনেছেন এই সারমেয়টি মাঝে মাঝে শিশু-রক্তের জন্যে তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে আর তখনই গর্জন করে। বিনয়বাবুর এই কথার সঙ্গে অদ্ভুত মিল পাওয়া গেল বন-বাংলোর মহেন্দ্র শতপথীর কথার। ফার্নান্ডেজ সাহেব নাকি ওকে আদিবাসীদের একটা ছোটো ছেলে যোগাড় করে দিতে বলেছিলেন। ফার্নান্ডেজ সাহেব যে সেই নীলকুঠিতে অন্তত একবার গিয়েছিলেন টগা তার প্রমাণ পেয়েছে। কাজেই সেই রাত্রে সেই ভয়ংকর গর্জন শোনার পর Angry Hound বা সারমেয়রাজ এর কাছে বলি দেবার জন্যেই যে ফার্নান্ডেজ সাহেব আদিবাসী-শিশুর খোঁজ করছিলেন তাতে আর সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব তথ্য ছাড়াও বিনয়বাবু তাকে যে টেলিগ্রামটি দেখিয়েছিলেন, সেটা পড়ে টগা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। কী উদ্দেশ্যে তার এখানে আসা সে বিষয়ে ইঙ্গিত আর সেইসঙ্গে ফার্নান্ডেজের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন বাঙ্গালোরের চার্চের কর্তৃপক্ষ। আর এইজন্যেই বিনয়বাবুর মতো একজন বৃদ্ধ পাদ্রি নিজে এসেছিলেন আলাপ করতে।
এই হলো পরিস্থিতি। এর মধ্যে টগাদের কি কোনো কর্তব্য আছে?
না, কখনই না। তবে টগার একান্ত ইচ্ছে আর কেউ সঙ্গে থাক বা না থাক, সে একবার ঐ নীলকুঠির বাড়িতে যাবেই। স্বচক্ষে একবার দেখে আসতে চায়। আর তা যত শীগগির সম্ভব।
.
চিন্তায়-ভাবনায় টগার ভালো করে ঘুম হচ্ছিল না। হঠাৎ নিস্তব্ধ রাতে তার মনে হলো কোনো ঘরের দরজা খুব সাবধানে খোলা হলো। তারপর ফের দরজা বন্ধ করার শব্দ। তারপর অতি ধীর চাপা পদশব্দ…তারপর আবার সব চুপচাপ।
একটু পরে দূরে কোনো দরজায় ঠক ঠক শব্দ। কেউ যেন সাবধানে দরজা খুলতে বলছে…
টগার মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। উঠে বসল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল দরজার দিকে…।
ঠিক তখনই বাংলোবাড়ির ইঁদারার পিছন থেকে ভেসে এল মৃত্যু-যাতনায়-কাতর মর্মভেদী আর্তনাদ। টগা খিল খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। অন্ধকার বারান্দা। সুইচটা কোথায় খেয়াল হলো না। তাই অন্ধকারেই এগিয়ে গেল ইঁদারা লক্ষ্য করে। ততক্ষণে ঘরে ঘরে আলো জ্বলে উঠেছে। এস্ত ভীত বোর্ডাররা আগের দিনের মতোই বেরিয়ে এসেছে।
উঃ কী ভয়ংকর শব্দ! কিসের শব্দ? অন্যজন উত্তর দিলো, মনে হলো কেউ খুন হচ্ছে।
খুন! তৃতীয়জন চমকে উঠল।
কে খুন হলো?
টগা বলল, ইঁদারার দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখুন।
ততক্ষণে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কেউ আর ইঁদারার দিকে এগোতে চায় না।
এই যে তপেন্দুবাবু, আমি জানি আপনি সব থেকে আগে এগিয়ে আসবেন। আর্তনাদ বলেই তো মনে হলো। আপনার কী মনে হয়?
আমারও তাই মনে হচ্ছে।
কিন্তু থেমে গেল কেন?
হয়তো সব শেষ হয়ে গেল।
সদাশিববাবু সহ অন্য সকলে একসঙ্গে চমকে উঠল।
খুন!
সদাশিববাবু অনেকক্ষণ কথা বলতে পারলেন না। দু-চারজন বলল, কে খুন হলো? টগা আঙুল দিয়ে হাঁদারাটা দেখিয়ে দিলে বলল, আমার ধারণা ঐ দিকে গেলে দেখতে পাবেন।
ব্যস! কারো মুখে আর কথা নেই। তারপর একে একে প্রায় সকলেই যে যার ঘরের দিকে গা বাঁচিয়ে চলে গেল। রইল শুধু চপল আর বিকু।
আসুন সদাশিববাবু, দেখা যাক হতভাগ্যটা কে।
সদাশিববাবু কাঁপা-গলায় বললেন, কেমন যেন নার্ভাস হয়ে পড়ছি।
তা তো হবেনই। যদি সত্যিই খুন হয়ে থাকে তা হলে ম্যানেজার হিসেবে সব দায়িত্ব। আপনার।
ঘরের সামনেই পড়ে ছিল মহেন্দ্র শতপথী। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল কণ্ঠনালী। টগা হাঁটু গেড়ে বসে দেহটা পরীক্ষা করে বলল, মহেন্দ্রর প্রাণ কিন্তু এখনও আছে। এক্ষুণি ডাক্তার দেখিয়ে রক্ত বন্ধ করতে পারলে হয়তো বেঁচে যাবে।
কিন্তু এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাব তপেন্দুবাবু? হাসপাতালও তো কাছে নয়।
টগা বলল, এক্ষুণি একবার চার্চের কোয়ার্টারে বিনয়বাবুর কাছে খবর পাঠান। ওঁর কাছে ফাস্ট এড দেবার ব্যবস্থা আছে দেখেছি। তিনি খবর পেলে কিছু একটা ব্যবস্থা করবেনই।
খুব ভালো কথা বলেছেন। বলেই সদাশিববাবু তখনই দুজন লোক পাঠিয়ে দিলেন।
চপল বলল, সবাইকে দেখলাম। মিস্টার ফার্নান্ডেজকে তত বেরোতে দেখলাম না।
উনি হয়তো টের পাননি। যা ঘুম! বললেন সদাশিববাবু।
চলুন দেখি।
সদাশিববাবু বললেন, আমি কিন্তু দরজা ঠেলতে পারব না তপেন্দুবাবু। তাঁরা ঘুম ভাঙানো নিয়ে যা অশান্তি একবার হয়ে গেছে–
টগা বললে, আপনাকে কিছুই করতে হবে না। যা করবার আমিই করব।
শেষ পর্যন্ত কাউকেই হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি করতে হলো না। টগা যেন জানতই, এইভাবে বন্ধ দরজাটা একটু ঠেলল। সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা খুলে গেল।
মিস্টার ফার্নান্ডেজ!
অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়েই টগা হাঁকল। কিন্তু সাড়া পাওয়া গেল না।
কী ব্যাপার? এত রাতে উনি গেলেন কোথায়?
গেছেন নিজের খুব পরিচিত জায়গায়। বলে টগা একটু হাসল। যাবার আগে সামান্য একটু কাজ সেরেই গেছেন। চলুন, মহেন্দ্র কেমন আছে দেখি গে।
.
আধঘণ্টার মধ্যেই ঐ গভীর রাতে বৃদ্ধ পাদ্রিবাবা নিজেই লোকজন, স্ট্রেচার, ওষুধপত্তর নিয়ে হাজির হলেন। টর্চের আলো ফেলে মহেন্দ্রর গলার ক্ষতস্থান পরীক্ষা করতে করতে বলে উঠলেন, তপেন্দুবাবু, লুক। আঘাতটা দেখে কি মনে হয় টুটিতে দাঁতের কামড়?
সকলেই বলে উঠল, হ্যাঁ, স্পষ্ট দাঁতের দাগ।
এই অবস্থাতেও বিনয়বাবু হাসলেন একটু। বললেন, এই হলো আপনাদের Angry Hound এর রাগের নমুনা। মিস্টার ফার্নান্ডেজ তো নিজেকে Angry Hound-এর প্রতিনিধি মনে করেন।
টগা চমকে উঠল। এও কী সম্ভব! মিস্টার ফার্নান্ডেজের মতো একজন বৃদ্ধ লোক– অন্যেরা কিছু বুঝল না। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।
বিনয়বাবু প্রাথমিকভাবে ক্ষত থেকে রক্ত বন্ধ করার ব্যবস্থা করে মহেন্দ্রকে রাতের মতো চার্চে নিয়ে গেলেন।
.
পাথরমহল
বিকু এল না। বলল, পাগল! শেষ পর্যন্ত প্রেতপুরীতে মরতে যাব! ততক্ষণ ঘুমোলে কাজ হবে।
চপল বলল, তাই ঘুমো।
ঘুম তো দরকার। গত রাত্রে মহেন্দ্রর ওপর আক্রমণ, টুটিতে কামড় দিয়ে ফার্নান্ডেজের এই বৃদ্ধ বয়েসেও পাঁচিল টপকে পাথরমহলের দিকে পলায়ন, পাদ্রিবাবার সেবা ইত্যাদি সব অপ্রত্যাশিত ঘটনায় রাতে কারো ভালো ঘুম হয়নি। তবু টগা আর চপল অদম্য কৌতূহলে আর অসাধারণ সাহস বুকে করে সক্কালবেলাতেই বেরিয়ে পড়ল সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা পাথরমহলের দিকে।
পিছনের সূর্য ক্রমে মাথার উপর উঠে এল। পাথরের পর পাথর টপকে চলেছে দুজন। সঙ্গে কয়েক বোতল জল আর কিছু শুকনো খাবার। একসময়ে তারা এসে দেখল মরুভূমির যেমন চারদিকে ধু ধু বালি ছাড়া আর কিছু নেই, এখানেও তেমনি। ছোট-বড় পাথর ছাড়া আর কিছু নেই।
তারপর আধঘণ্টা এগোতেই চোখে পড়ল দূরে কালো পাহাড়ের নিচে একটা লম্বা উঁচু পাঁচিল। আর তার ভেতরে একটা ভাঙা দোতলা বাড়ি। বাড়িটার দোতলার একদিকের বারান্দা ভেঙে ঝুলছে। গোটা বাড়ি ঢাকা পড়ে আছে লতা-পাতা-আগাছায়।
বাড়ির কাছে এসে যখন তারা পৌঁছল তখন ওদের আনন্দর সীমা নেই। এই জায়গাটা ঘিরেই কত কালের কত জল্পনা-কল্পনা। কেউ বলে এটা ছিল রাজবাড়ি। কেউ বলে এটা অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের আস্তানা। এখানেই নাকি থাকে কুকুর-দেবতা বা কুকুর-ভূত– ফার্নান্ডেজ যাকে বলেন Angry Hound, পাদ্রিবাবা বলেন, সারমেয়রাজ। যিনিই হন– মাঝে মাঝে তিনি শিশুরক্তের তৃষ্ণায় হুংকার ছাড়েন। সেই বুক-কাঁপানো ডাক শোনা যায় বন-বাংলোয় বসেও। অথচ কেউ আসতে সাহস পায় না। আজ কলকাতার দুটি ছেলে শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছল।
কিন্তু কোথায় তিনি? তাকে খুঁজে বের করতেই হবে।
বাড়ির ভেতরে ঢোকবার আগে ওরা প্রথমে বাড়িটা–না, গোটা বাড়িটা বলতে যা বোঝায় এখন আর তা নয়, ধসে পড়া ইটের স্তূপ–ঘুরে দেখল। বোঝা গেল একসময়ে বিরাট জায়গা জুড়ে ছিল দোতলা বাড়িটা। সামনে থেকে দেখলে মনে হয় পাথরের বাড়ি। ওপরে যে ঘরগুলো এখনও মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে তার বড়ো বড়ো জানলাগুলোর কতকগুলো খোলা, কতকগুলো বন্ধ। এইসব পুরনো শূন্য ঘরে সাধারণত পায়রার বাসা থাকে। কিন্তু এখানে তেমন লক্ষণ নেই।
পাহাড়ি জায়গায় কি পায়রা থাকে না? চপল জিগ্যেস করল।
টগা প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল।
ওরা ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পিছন দিকে এসে পড়ল। এ দিকটা আরও পরিত্যক্ত। চোরকাটা ভর্তি জমি কবে যে এদিককার রকে ওঠার সিঁড়িটা পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলেছে তার ঠিক নেই।
বাড়ির এই পিছন দিকেও কয়েকটা ঘর আছে। সবগুলিরই জরাজীর্ণ অবস্থা। হঠাৎ তারই একটা ঘর থেকে একটা লোক বেরিয়ে এল। বয়েসের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে। মাথাভর্তি জট পাকানো পাকা চুল। হাতে একটা লাঠি। গায়ে একটা ময়লা ফতুয়া। আর আশ্চর্য…পরনে ধুতি বা লুঙ্গি নয়, সাহেবদের মতো খাকি হাফপ্যান্ট। প্যান্টটা বড় ঢিলে। যেন অন্যের প্যান্ট পরেছে।
বুড়ো লাঠি ঠক ঠক করতে করতে এগিয়ে এসে পরিষ্কার বাংলায় বলল, বাবুদের কোথা থেকে আসা হচ্ছে?
আলাপ জমতে দেরি হলো না। তারা যে কলকাতা থেকে শুধু এই পাথরমহলটাই দেখতে এসেছে তা শুনে বুড়ো খুশি হলো। কেননা এই জায়গা দেখবার জন্যে দূর থেকে কেউ বড়ো একটা আসে না।
বুড়োর নাম মুকুন্দ। হ্যাঁ, শুধুই মুকুন্দ বলল। পদবি জানা নেই। না, তার কেউ নেই আজ। একাই থাকে এখানে। তার কাছ থেকেই জানা গেল একসময়ে এই বাড়িটা ছিল নীলকর সাহেবদের। খাঁটি সাহেব যাকে বলে। কী মেজাজ! নীলচাষীদের কুকুর-শেয়ালের মতো দেখত। বুটের নিচে দাবিয়ে রাখত তাদের।
তুমি তাদের দেখেছ?
দেখিনি? সাহেবদের মধ্যে জাত-সাহেব ছিল টম সাহেব। তারই বাগানে কাজ করত মুকুন্দ। খাস মালী। ওর মতো গোলাপের তোড়া বাঁধতে আর কেউ পারত না। তাই টম সাহেব তাকে খুব পছন্দ করত। কিন্তু বড়ো অত্যাচার করত সাহেব নীলচাষীদের উপর। তারপর একদিন নীলচাষীরা ক্ষেপে উঠল। মারমুখো হয়ে আক্রমণ করল কুঠিবাড়ি। টম সাহেব তার বাঘের মতো কুত্তাটাকে লেলিয়ে দিলো তাদের দিকে। কুত্তাটা একটার পর একটা চাষীর টুটি ছিঁড়তে লাগল। ওরা তখন দিলো এই বাড়িটায় আগুন ধরিয়ে। জ্যান্ত পুড়ে মরল টম সাহেব আর তার কুত্তাটা।
একটু থেমে মুকুন্দ বলতে লাগল, এসব তো সেদিনের কথা। তারপর নীলচাষ উঠে গেল। সাহেবরা একে একে এলাকা ছেড়ে চলে গেল। নীলের জমিতে শুরু হলো আম জাম-কাঁঠালের চাষ।…তারপর আরও কত বছর কাটল। সেইসব বন-বাগানও শেষ হয়ে গেল। তৈরি হলো চাষের জমি। সবই এই দুটো চোখে দেখলাম খোকাবাবুরা।…
কথা বলতে বলতে মুকুন্দ বাড়িটার পাশ দিয়ে হাঁটছিল।
সেই জমি থেকে লাঙলের মুখে উঠল কত কংকাল।
কংকাল!
হ্যাঁ, চাষীদের জোর করেও যখন নীলের চাষ করাতে পারত না তখন মেরে ঐসব জমির নিচে পুঁতে দিত সাহেবরা। আমি যত্ন করে সেগুলো তুলে রেখে দিয়েছি।
চমকে উঠল ওরা। বলে কী মুকুন্দ!
কোথায় রেখেছ?
দেখবেন? সব গুনে গুনে রাখা আছে। হয়তো কোনোদিন কাউকে হিসেব দিতে হবে।
না-না দরকার নেই। তুমি বরঞ্চ অন্য যদি কিছু দেখাবার থাকে তো দেখাও।
হ্যাঁ, দেখাব বইকি। কেউ তো আসে না। আপনারা এসেছেন কত দূর থেকে ঐ যে ছাতলাধরা ভাঙা একতলা মস্ত ঘরটা-ওটা ছিল নীলের গুদাম। আর ঐ যে উঁচু-মতো দেখছেন, ওটা ছিল নীলের চৌবাচ্চার চিমনি। দিন-রাত গলগল করে ধোঁওয়া বেরোত। আর ঐ ভাঙা চৌবাচ্চাতে নীল ভেজানো হতো।
চৌবাচ্চার নিচের দিকে কিসের দাগ?
ওখানে ছিল মোটা মোটা তামার পাত।
তামার পাত!
হ্যাঁ। সব গেছে।
চুরি?
না বাবু, একজন ভদ্দরলোক। বুড়ো। যিশুর শিষ্য। আস্ত শয়তান। কবছর অন্তর কোথা থেকে এসে সে-সব পাত খুলে নিয়ে যায়। শুধু তামার পাতই নয়, এই বাড়ির কোথায় কোন ঘরের মাটির নিচে সাহেবদের সোনাদানা থাকত ঐ বুড়োটা তাও জানত। সব নিয়ে গেছে।
টগা অবাক হয়ে চপলের দিকে তাকাল। তারপর মুকুন্দকে বললে, তোমরা বাধা দিতে পারনি?
মুকুন্দ কেমন একরকমভাবে হাসল। এত বয়েসেও হলদে হলদে বিশ্রী দাঁতগুলো বেরিয়ে এল। বলল, আমি ছাড়া আর কে আছে এ তল্লাটে বাবু? তা একাই লড়তে গিয়েছিলাম। বুড়োটা আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার ধরে ডেকে বলল, মুকুন্দ, তুমি আমায় চিনতে পারছ না? আমি যে টম সাহেবের নাতি! এই কুঠিবাড়িতে যা কিছু আছে সবকিছুর দাবিদার এখন আমি। তা শুনে আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। কিন্তু আমি জানি ও মিথ্যে কথা বলছে। ও চোর। আর তার জন্যে ওকে শাস্তি পেতেই হবে।
এই পর্যন্ত বলে বুড়ো মুকুন্দ হাঁপাতে লাগল।
কষ্ট হচ্ছে তোমার মুকুন্দ?
না। এবার তো আপনারা ওপরে যাবেন? যান। সাবধানে যাবেন।
তুমি যাবে না?
না বাবু, আমি সাহেবদের ভৃত্য ছিলাম। ওপরে যাওয়া আমার বারণ।
তা হলে আমাদের বুঝিয়ে দেবে কে?
বোঝাবার কিছু নেই। শুধু দেখেই নেমে আসবেন। যে ঘরগুলো তালা দেওয়া সেগুলোর দিকে তাকাবার দরকার নেই।
তুমি এখন কোথায় চললে?
কোথায় আর যাব? এ বাড়ি ছেড়ে আমার তো যাবার উপায় নেই। এখানেই আছি।
.
মুকুন্দরহস্য
ভাঙাচোরা সিঁড়িতে ভয়ে ভয়ে পা রেখে ওরা দোতলায় উঠে এল। দোতলায় উঠতেই দুজনকে চমকে দিয়ে গোটা বাড়িটা দুলে উঠল। একবার–দুবার–তিনবার–
ভূমিকম্প নাকি?
না, ভূমিকম্প যে নয় তা দরজা-জানলাগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা গেল। সেগুলো অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
তাহলে বাড়িটা অমন কেঁপে উঠল কেন?
চপলের মুখ শুকিয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে তাকাল টগার দিকে। টানা বারান্দা দিয়ে চলতে চলতে বলল, এটা কিরকম হলো?
টগা উত্তর দিলো না। চপল ফের জিগ্যেস করল, এটা কি ভূমিকম্প?
টগা বলল, না।
তা হলে?
টগা নিরুত্তর।
চপল ফের জিগ্যেস করল, কিছু বলছিস না কেন?
বলার কিছু নেই।
তার মানে?
পুরনো বাড়ি মাঝে মাঝে এইরকম কাপে। এই দিক দিয়ে আয়।
কেন?
দেখছিস না চেয়ারগুলো?
পর পর এত চেয়ার কেন?
সাহেবরা এই বারান্দায় বসে পাহাড়ের শোভা দেখত বোধহয়।
সে তো কোন যুগের কথা! তা বলে আজও চেয়ার পাতা থাকবে?
টগা গম্ভীরভাবে বলল, এই মুহূর্তেও তারা হয়তো চেয়ারে বসে দেখছে…এখন অবাক হয়ে আমাদের দেখছে…ভাবছে কী সাহস! ওরা আগের মতোই পা ছড়িয়ে বসে আছে চেয়ারে। তাই ধারে আসতে বললাম। পায়ে পা না লাগে…
কী যে বলিস! ওরা এখনও চেয়ারে পা ছড়িয়ে বসে আছে!
টগা বলল, ভালো করে লক্ষ্য করে দ্যাখ। সরু সরু হাড্ডিসার পায়ের ছায়া পড়েছে। দেখেছিস? না-না, দাঁড়াসনে। এগিয়ে যেতে যেতে দ্যাখ।
ওসব কথা বলিসনে টগা। ভয়ে ভয়ে বলল চপল।
টগা বলল, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? বেশ, আড়চোখে চেয়ারগুলো লক্ষ্য কর। পুরনো উইধরা পায়াভাঙা। কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পুরনো চেয়ার এত পরিষ্কার থাকে কি করে? নিশ্চয় রোজ কেউ ঝাড়পোঁচ করে? কে করে? মুকুন্দ ছাড়া আর কোনো মানুষ দেখতে পেলি? তাছাড়া মুকুন্দ দোতলায় ওঠে না। কী রে আমার হাত ধরছিস কেন? হাত যে তোর বরফের মতো ঠাণ্ডা!
টগা, আমি ফিরে যাব।
একা যেতে পারবি না।
তুইও চল।
আমি সব দেখে যাব।
তবে আমি নিচে চললাম।
যেতে পারবি তো?
চপল উত্তর দিতে পারল না। টলতে টলতে কোনোরকমে সিঁড়ির দিকে গেল বটে কিন্তু সিঁড়ি খুঁজে পেল বলে মনে হলো না।
চপল!
সাড়া পেল না টগা।
এই মরেছে গেল কোথায়? টগা এদিক-ওদিক খুঁজতে লাগল। চপল!
পাশ দিয়ে সরু সিঁড়ি কোথায় যেন চলে গেছে। চপল ভুল করে এদিকে যায়নি তো? এই ভেবে টগা সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। সিঁড়িটা এঁকেবেঁকে একটা বড়ো ঘর পর্যন্ত গিয়েছে। ফাটা দেওয়াল। কড়ি-বরগা ঝুলছে। জানলাগুলো কবে থেকে বন্ধ হয়ে আছে।
কই? এখানে তো চপল নেই।
কিন্তু কেউ আছেই। ঐ তো পিছনে চাপা পায়ের শব্দ…এগিয়ে আসছে।
চপল? চপল কি মজা করে ভয় দেখাচ্ছে? চট করে ঘুরে দাঁড়াল টগা। না, কেউ নেই।
কিন্তু কেউ তার পিছনে আছেই তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। ভয়ে টগার সারা গা কাঁটা দিয়ে উঠল। না, পালাতে হবে। এ বড়ো মারাত্মক জায়গা। কিন্তু, চপল যে নেই?
চপল নিশ্চয় নিচেই গেছে।
কিন্তু ও সিঁড়ি দিয়ে নামেনি।
হয়তো ভুল করে অন্য কোনো পথ দিয়ে নেমে গেছে।
টগা এগোতে লাগল। বিরাট ঘর। গোটা দুই ভাঙা ইজিচেয়ার। টানা পাখার কড়া কড়িকাঠের সঙ্গে এখনও লেগে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত একটি পায়রাও চোখে পড়েনি। এত পুরনো বাড়ি হলেও দেওয়ালে মাকড়সার চিহ্নমাত্র নেই। টগা কিছুতেই যেন ঘরটার শেষপ্রান্তে পৌঁছতে পারছে না। যেন শেষ নেই। শেষ পর্যন্ত শেষ হলো–যেখানে শুরু হয়েছে আবার সরু সরু সিঁড়ি।
ও! এই দিক দিয়েও তা হলে নিচে নামা যায়। টগা নামতে লাগল সাবধানে। বড্ড অন্ধকার। মিনিট তিন-চার নামার পর সিঁড়িটা যেন হঠাৎ ফুরিয়ে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে পড়ল ভিজে মাটিতে। কিন্তু মাথাটা লাগল ঠক করে জোরে শক্ত কোনো কিছুর সঙ্গে।
সেটাকে শক্ত করে দু-হাতে ধরে কোনোক্রমে উঠে দাঁড়াল টগা।
এত বড়ো–কি এটা?
ঘুলঘুলি দিয়ে সরু একফালি রোদ এসে পড়েছিল, চমকে উঠল টগা। মানুষের মতো উঁচু পাথরের একটা বিরাট কুকুর দু-পায়ের উপর ভর দিয়ে মুখ উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেন এক্ষুণি হুংকার ছাড়বে! আর তার মুখে লেগে রয়েছে রক্ত। হয় রক্তপান করেছে, নয় রক্তবমি করেছে। চোখের মণি দুটো কী পাথরের, কে জানে। মনে হচ্ছিল যেন জ্বলছে। টগা পালাতে গেল। কিন্তু দাঁড়াতে পারল না। শেষে হামাগুড়ি দিয়ে সেই ঘুপচি ঘরের অন্য প্রান্ত দিয়ে নামতে লাগল।
অন্ধকার—স্যাঁতসেঁতে সিঁড়ি। গড়িয়ে গড়িয়ে চলল টাগা। এই মুহূর্তে চপলের কথা মনে এল। তারপরই হঠাৎ ধপ করে কোথায় যেন পড়ল। আর তখনই কানে এল পাশেই কে যেন কাতরাচ্ছে, উঃ, বাবা গো!
চপল!
হু। পড়ে গেছি ওপর থেকে।
লাগেনি তো?
না, কিন্তু পিঠে কী বিধছে। উঠতে পারছি না।
এখানে একটা বন্ধ দরজা আছে বলে মনে হচ্ছে। দেখি যদি খোলা যায়।
টগা হামাগুড়ি দিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তারপর টানাটানি করে কোনোরকমে দরজাটা খুলল। খুলতেই এক ঝলক আলো ঘরে এসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। শিউরে উঠল চপল। পাটকাঠি যেমন গোছা করে সাজিয়ে রাখে তেমনি করে গোছা বাঁধা রয়েছে নরকংকাল ঘরের এক কোণে। চপল ওপর থেকে পড়েছিল সেই কংকালের ওপরে।
অতি কষ্টে দুজনে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। এটা বাড়ির পিছনের দিকের বারান্দার একটা ঘর। এরই পাশাপাশি কোনো একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল মুকুন্দ। কিন্তু
কিন্তু সেটা কোন ঘর খুঁজে পাওয়া গেল না। সব ঘরগুলোই বাইরে থেকে ওপরে নিচে তালা বন্ধ। সব তালাই মর্চে পড়া! বহু দিন খোলা হয়নি।
আশ্চর্য, মুকুন্দ গেল কোথায়?
চপল বলল, মুকুন্দকে আর দরকার কী? তাড়াতাড়ি আমরা ফিরে যাই চলো।
টগা বলল, ওর সঙ্গে দেখা করে যাওয়া উচিত।
তা উচিত। কিন্তু সে গেল কোথায়?
আয়, এখানে ঘাসের ওপর বসে একটু অপেক্ষা করা যাক।
বসে বিশ্রাম করতে করতে চপল জানাল কিভাবে অন্ধকারে কার পায়ের শব্দ টগার মনে করে, সেই শব্দ অনুসরণ করে চলতে চলতে একটা গর্তের মধ্যে দিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিল।
তারপর টগা শোনাল কীভাবে দর্শন পেয়েছিল সারমেয়রাজের। তবে জ্যান্ত সারমেয় নয়, পাথরের মূর্তি।
যাক! তবু তো তুই দেখলি।
হা। তুই দেখবি?
রক্ষে করো। এখন অনেক পথ হাঁটতে হবে। ওঠো ওঠো–
হঠাৎ লক্ষ্য পড়ল বারান্দায় জীর্ণ দড়িতে মেলা রয়েছে একটা খাকি হাফ প্যান্ট, একটা ময়লা ফতুয়া। এসবই যে মুকুন্দের তাতে সন্দেহ নেই। এগুলোই তো একটু আগে পরেছিল। এসব খুলে রেখে সে গেল কোথায়?
ঐ দ্যাখো ওর হাতের লাঠিটা।
টগা দেখল লাঠিটা বেশ যত্ন করে বারান্দার দেওয়ালে ঠেসানো। যেন কেউ এইমাত্র লাঠিটা বাইরের দেওয়ালে ঠেসিয়ে রেখে ভেতরে ঢুকেছে।
দুজনে একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। বুঝতে কিছু বাকি রইল না। তারপর জোরে হাঁটতে লাগল।
.
শেষকৃত্য
শেষ-বিকেলে ওরা যখন পাদ্রিবাবার চার্চের কাছাকাছি এসে পড়ল তখন দেখল জনা চারেক লোক একটা কফিন কাঁধে করে নিঃশব্দে প্রায় দৌড়চ্ছে। সঙ্গে কয়েকজন ছাড়া শবযাত্রীও নেই। তবে পাদ্রিবাবা বিনয়বাবু আছেন। অবশ্য তার তো না থাকলেই নয়। শেষ প্রেয়ারটা তাকেই করতে হবে।
কিন্তু এদিকে কেন? নতুন বেরিয়াল ফিল্ডটা তো অন্য দিকে?
হঠাৎ দেখা গেল শবযাত্রীদের পিছন থেকে বিকু হাত নেড়ে ডাকছে।
আশ্চর্য! বিকু শবযাত্রীদের দলে কেন?
না, শুধু বিকুই নয়, বানবাংলোর আরও কেউ কেউ রয়েছে। আরে ঐ তো সদাশিববাবুও!
সদাশিববাবু থমথমে মুখে ইশারায় ওদের ডাকলেন।
নিঃশব্দে টগা, চপল ওঁর কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
গতি বাড়ছে। যেন সকো, শয়তান যদি আবার জেগে ও তো এখন ব্যবহার
কি ব্যাপার?
সদাশিববাবু গম্ভীর মুখে চাপা গলায় বললেন, মিস্টার ফার্নান্ডেজ
সে কী কখন!
সদাশিববাবু বললেন, রাতে মহেন্দ্রর গলায় ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো কামড়ে দিয়ে পাঁচিল টপকে পালাচ্ছিলেন। পালাতে পারেননি। পড়ে গিয়ে মারা যান। হ্যাঁ, তার মধ্যে অশেষ শক্তিসম্পন্ন evil spirit–অশুভ শক্তি ছিল। কিন্তু তবু বয়েস হয়েছিল তো। তা ছাড়া পাপের পরিণতি এই-ই হয়।
ওরা ততক্ষণে সমাধিক্ষেত্রের কাছাকাছি এসে পড়েছে। যতই কাছাকাছি আসছে ততই ওদের গতি বাড়ছে। যেন সন্ধ্যে হবার আগেই কফিনটাকে মাটির নিচে নামিয়ে পালিয়ে আসতে পারে। বলা তো যায় না শয়তান যদি আবার জেগে ওঠে!
টগা জিগ্যেস করল, কিন্তু পুরনো সমাধিতে কেন? এটা তো এখন ব্যবহার করা হয় না।
সদাশিববাবু বললেন, সকালে ওঁর বডিটা পাবার পর পাদ্রিবাবাকে খবর দেওয়া হয়। স্থানীয় খ্রিস্টানরা অনেকেই আসেন। সকলেই মিস্টার ফার্নান্ডেজের ক্ষত-বিক্ষত দেহ–বিশেষ করে রক্তাক্ত ভয়ংকর মুখটা দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেন। ক্ষ্যাপা কুকুরের মতো মহেন্দ্রর টুটি কামড়ানো আর সেইসঙ্গে কিছু কিছু ঘটনায় তারা মনে করে নেন ইনি কোনো পাদ্রি হতে পারেন না। ইনি ছদ্মবেশী শয়তান। কাজেই মাটি দেওয়ার ব্যাপারে একজন পাদ্রির উপযুক্ত সম্মান এঁকে দেওয়া যায় না।
তখন তর্ক ওঠে–তবু তো উনি একজন খ্রিস্টান। অতএব শেষ সময়ে যেটুকু সম্মান প্রাপ্য সেটুকু দিতে হবেই।
অন্যেরা রাজী হলো। কিন্তু জানিয়ে দিলো নতুন বেরিয়াল ফিল্ডে ওঁকে সমাহিত করা হবে না। ওঁর জন্যে উপযুক্ত জায়গা সেই পুরনো পরিত্যক্ত নিষিদ্ধ সমাধিক্ষত্র।
মর্চে-পড়া তালা ভেঙে, লোহার গেট খুলে একরকম চুপিচুপি কফিন নিয়ে মাত্র জন কয়েক মানুষ সমাধিক্ষেত্রে ঢুকল। মাটি কাটাই ছিল। বাকি কাজটুকু সেরে ফিরতে আধঘণ্টার বেশি সময় লাগল না।
কোনোরকমে একটা ভয়ংকর, হিংস্র অশুভ আত্মার শেষ কাজটুকু সেরে এরা যখন বাইরে এসে দাঁড়াল তখন মাঠাবুরু পাহাড়ের পিছনে সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে চারিদিকে।
[শারদীয়া ১৪১০]