পাত্রী চাই
দুতিন দিন পরপরই খবরের কাগজের অফিস থেকে এক বান্ডিল চিঠি আসছে। প্রত্যেক চিঠির সঙ্গেই পাত্রীর রঙিন ছবি। কোনো কোনো বাবামা মেযের দুতিনটি ছবিও পাঠিয়েছেন। শুভশ্রী দেবী বিকেলের ডাকে আসা চিঠিপত্রগুলো একটু নাড়াচাড়া করতে করতেই একটু হেসে বলেন, এর সিকি ভাগ মেয়ে দেখে বিয়ে ঠিক করতে হলে তো আমার ছেলেটা বুড়ো হয়ে যাবে।
সৌমিত্রবাবু টিভিতে স্টেফি গ্রাফের খেলা দেখতে দেখতেই সিগারেটে একটা টান দিয়ে একটু হেসে বলেন, খবরের কাগজে কী লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়েছ মনে নেই?
বিজ্ঞাপন কি আমি লিখেছি? রাধা যেমন লিখেছে, আমি তেমনই…
ঠিক সেই সময় শ্রীরাধা পর্দা সরিযে ড্রইংরুমে ঢুকেই শুভশ্রী দেবীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী নতুন মা, আমি কী করেছি?
তোর নতুন কাকা বলছিল, কি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল…
দাঁড়াও, দাঁড়াও, আমি এক্ষুনি বলছি।
শ্রীরাধা প্রায় এক লাফে পাশের ঘর থেকে খবরের কাগজখানা এনেই পড়তে শুরু করে। পাত্রী চাই। দক্ষিণ কলকাতার অভিজাত কায়স্থ (দত্ত) পরিবারের একমাত্র সন্তান। সুদর্শন স্বাস্থ্যবান সঙ্গীতপ্রিয আদর্শবান কলকাতার M. B. B. S. ও চণ্ডীগড় TI এর M S. পাত্রের (২৮) সুন্দরী শিক্ষিতা রুচিসম্পন্না পাত্রী চাই। পাত্র কোনোরকম যৌতুক বা উপহার গ্রহণে অক্ষম। সত্বর ছবি সহ লিখুন–বক্স নং..
শ্রীরাধা এক নিঃশ্বাসে বিজ্ঞাপনটা পড়েই সৌমিত্রবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, নতুন কাকা, কিছু ভুল হয়েছে কি?
না, না, তুই ঠিকই লিখেছিস। উনি একটু থেমে একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, তোর নতুন মা আর তোর ঋষিদা যা চায়, তুই তাই লিখেছিস।
তবে? শ্রীরাধা অবাক হয়ে গেল।
এত চিঠি এসেছে দেখে তোর নতুন মা অবাক হয়ে যাচ্ছে। তাই বলছিলাম যে, এমন বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে যে দুপাঁচ হাজার মেয়ের বাবা চিঠি লিখলেও তো অবাক হবার কিছু নেই।
শ্রীরাধা সঙ্গে সঙ্গে বলে, বিজ্ঞাপনে কী অব লিখেছিঃ ঋষিদার মতো ছেলে আর একটা খুঁজে বের করো তো
শুভশ্রী দেবী হাসতে হাসতে বলেন, তোর তো ধারণা, তোর ঝমিদার মতো ছেলে এ পৃথিবীতে আর নেই।
সত্যিই তাই। ঋষিদা ইজ ঋষিদা।
সৌমিত্রবাবু সিগারেটে শেষ টান দিয়ে একটু চাপা হাসি হেসে বলেন, সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই ঋষি আসবে। এর মধ্যে তোমরা দুজনে মিলে অন্তত চারপাঁচটা মেয়ে ঠিক করো যাদের আমরা দেখতে যাব।
শুভশ্রী দেবী চিঠিপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়েই শ্রীরাধাকে বলেন, চল রাধা, আমরা ও ঘরে যাই
চলো।
ও ঘরে গিয়েই শুভশ্রী দেবী বিকেলের ডাকে আসা চিঠিপত্রগুলো শ্রীরাধার হাতে দিয়ে বলেন, দ্যাখ তো, এব মধ্যে কাউকে তোর পছন্দ হয় কি না।
শ্রীরাধা প্রথম খামটা খুলে ছবিটা দেখেই মনে মনে বলে, ইস! কী রুপের ছিরি
আগের কদিনের আসা চিঠিপত্র আর ছবিগুলো দেখতে-দেখতেই শুভশ্রী দেবীর কানে আসে শ্রীরাধার মন্তব্য–বাবারে বাবা! এ তো জলহস্তী! এর সঙ্গে বিয়ে দিলে ঋষিদা নির্ঘাত চৈতন্যদেবের মত সংসার ত্যাগ করবে।
ওব মন্তব্য শুনে শুভশ্রী দেবী চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলেন, তোর ঋযিদা সন্ন্যাসী হয়ে যাকে নিয়ে সংসারী হতে পারবে, সেইরকম কি আছে, তাই বল
শ্রীরাধা ওর কথা কানে না তুলেই আরো দুএকটা ছবি দেখার পর আপন মনেই মন্তব্য কবে, কী সব রূপের ছিরি! এদের ছবি দেখেই তো আমার গা ঘিনঘিন করছে।
তাবপর আরো কয়েকটা ছবি দেখার পর হঠাৎ একটা ছবি শুভশ্রী দেবীর সামনে ধরেই শ্রীরাধা বলে, দেখ, দেখনতুন মা, মেয়েটার রুচি দেখ। ঋষিদা তত এর হাতের জলও খেতে পারবে না।
ওর হাত থেকে ছবিটা কেড়ে নিয়েই শুভশ্রী দেবী বলেন, তুই স্বর্গ থেকে একটা অপ্সরী ধরে আন। তা না হলে কাউকেই তোর পছন্দ হবে না।
শ্রীবাধা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয়, দরকার হলে ঋষিদা চিরকুমার থাকবে কিন্তু এইসব পেত্নীদেব কাউকে সে কখনই বিয়ে করবে না।
বড় বাস্তা দিয়ে ট্রামেবাসে যাতায়াত করার সময় লোকে ঠিক চারু এভিন্যুকে চিনতে পারে না। মোটামুটি শত খানেক বাডি; এই পাড়ার প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকে শুধু জানাশুনাই নেই, প্রায় আত্মীয়ের সম্পর্ক। চৌরঙ্গি পাড়ার মিঃ বর্মন এখানে বর্মনদা বর্মনকাকু, বেডিওটিভি,খববেব কাগজ খ্যাত বিখ্যাত সাংবাদিক শ্যামল বসু এখানে শ্যামলদা, সাহেবী স্কুলের গুরুগম্ভীর মিস এ পাড়ার শ্যামলী বৌদি। এ পাড়ায় কেউ মিঃ ব্যানার্জি, মিসেস দত্ত না, ওঁরা এখানে বিমলকাকু আর ডলিমাসি।
কলকাতার মানচিত্রে খুঁজে পাওয়া মুশকিল হলেও এ পাড়া নিয়ে বাসিন্দাদের গর্বের শেষ নেই। এই পাড়ার ব্যাপারে বন্ধুবান্ধব একটু ভাট্টা করলেই মিঃ বর্মন হাসতে হাসতে বলেন, তোরা ভুলে যাস না, চারু এভিন হচ্ছে কলকাতার নিউ ইয়র্ক। এখানে সব রাস্তা শুধু নর্থসাউথ ইস্টওয়েস্টই না, সবই নাইনটি ডিগ্রি অ্যাংণেলে। তোরা যে চৌরঙ্গি নিয়ে গর্ব করিস সেও তো ধনুকের মতো বেঁকে গেছে।
আজকের বয়স্করা গর্ব কবে ছেলেমেয়েদের বলেন, আমবা প্রত্যেকবার পরীক্ষা দিতে যাবার সময় কবিশেখর কালিদাস রায়কে প্রণাম করে যেতাম। পরীক্ষা দিয়ে বিকেলবেলায় বাড়ি ফেরার সময় দেখতাম, উনি বাড়ির সামনের ঐ ছোট্ট চাতালে ইজিচেয়ার পেতে বসে আমাদের জন্য হাঁ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
হারে, চিন্ময়, আজ কেমন হলো?
ভালোই।
কোনো পেপারটা বেশি ভালো হল?
সেকেন্ড পেপার।
কবিশেখর যেন আপন মনেই বলেন, অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই সেকেন্ড পেপারে বেশি নম্বর পায়।
চিন্ময় দত্ত বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই কবিশেখর একটু গলা চড়িয়ে ডাক দেন, এই গোবিন্দ।
গোবিন্দ সামনে এসে দাঁড়াতেই উনি জিজ্ঞেস করেন, সব কোশ্চেন লিখেছিস?
মেন কোশ্চেনগুলো লিখেছি কিন্তু শর্টনোটগুলো পারলাম না।
কবিশেখর একটু চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করেন, কেন? ওগুলোতেই তো নম্বর তোলা সহজ।
জেঠু, জাজনগর কোথায়?
একটু হেসে উনি জবাব দেন, মুসলমান আমলে উড়িষ্যার নাম হয় জাজনগর।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আচ্ছা জেঠু, বান্দা কে?
কবিশেখর বলেন, শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিং খুন হবার পর বান্দা শিখদের রাজনৈতিক নেতা হন। পরবর্তীকালে মুঘল বাদশা এর দুই ছেলেকে ওর চোখের সামনে হত্যা করেই ক্ষান্ত হন না; ওরা বান্দাকে হাতির পায়ের তলায় পিষে মারে।
গোবিন্দ একগাল হাসি হেসে বলে, জেই, আপনি ইতিহাসের সবকিছু জানেন!
কবিশেখর একটু হেসে বলেন, মাস্টারি করতে হলে সব বিষয়ই একটু আধটু জানতে হয়।
নবপল্লীর পূজা প্যান্ডেলে অমিয়র স্ত্রী শিখাকে দেখেই শ্যামল একটু হেসে বলে, অনেক ভাগ্য করে এ পাড়ায় বউ হয়ে এসেছ, বুঝলে?
শিখা কোনো জবাব দেয় না; শুধু একটু হাসে।
এই পূজা প্যান্ডেলে কদিন এলেই বুঝবে, এখানে আমরা সবাই সবার আত্মীয়। তোমার শ্বশুরশাশুড়ীকে আমি তো জন্ম থেকেই মেজ জেঠু-মেজ মা বলে জানি। সৌমিত্রদার স্ত্রী আমাদের এ পাড়ায় নতুন বৌমা নতুন মাসি নতুন বৌদি।
শ্যামল একটু হেসে বলে, আমি অবশ্য বলি, নতুন বৌঠান।
হ্যাঁ, আমিও ওঁকে নতুন মাসি বলি।
শ্যামল শিখার কথা কানে না তুলেই হাত দিয়ে হলদে দোতলা বাড়িটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, ওটা কার বাড়ি জানো?
ভানু ব্যানার্জির।
দুনিয়ার মানুষ ওঁকে চিনতো বিখ্যাত অভিনেতা বলে কিন্তু আমরা ওঁকে চিনেছি সৎ, আদর্শবান, পরোপকারী ও অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত বলে। বিজয়া নববর্ষের দিন বাবামাকে প্রণাম করেই ছুটে যেতাম ভানু মামা নীলিমা মামীকে প্রণাম করতে।
শিখা চুপ করে ওর কথা শোনে।।
শ্যামল একবার নিঃশ্বাস নিয়েই বলে, ভানু মামা মারা যাবার দিন এ পাড়ার কচিকাঁচা থেকে বুড়োবুড়িরা কী কান্নাকাটি করেছিলেন, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
অমিয় এর মধ্যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, ওরা খেয়াল করেনি। শ্যামলের কথা। শুনে সে বলে, সত্যি, সে দিনের কথা কোনোদিন ভুলব না।
শিখা মাথার ঘোমটা একটু সামনের দিকে টেনে দিয়েই বলে, নীলিমা মামীও খুব ভালো।
শ্যামল কিছু বলার আগেই অমিয় ওর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে, নীলিমা মামী ভালো। মানে, অসম্ভব ভালো। অত বিখ্যাত অভিনেতার স্ত্রী ও নিজে অত বড় গাইয়ে হওয়া সত্ত্বেও কী অমায়িক আর ভদ্র!
এ পাড়ার ছেলেমেয়েদের মধ্যেও ভারি মজার সম্পর্ক। চন্দন, বিনু বাবলুরা রোজ সন্ধের পর ঐ মোড়ের মাথায় বাড়জ্যের বাড়ির পিঁড়িতে বসে আড্ডা দেয়। গ্যারেজের মধ্যে কেষ্টদার দোকান থেকে অনুরাগ বেরুতেই চন্দন ডাক দেয়, এই অনু, শোন!
আমূল স্পের টিন হাতে নিয়ে অনুরাগ ওদের সামনে এসেই বলে, বল।
তোর কেক খেলাম।
বাবলু সঙ্গে সঙ্গে বলে, হারে অনু, তুই ওদের কেক দিয়েছিস আর আমাদের দিলি না?
এর আগের বার যখন কেক করেছিলাম, তখনই তো তুই খেয়েছিস।
চন্দন বাবলুর হাঁটুতে একটা থাপ্পড় মেরে বলে, তুই চুপ কর। আমাকে বলতে দে।
অনুরাগ বলে, বল, বল, কি বলবি। আমি পড়তে পড়তে উঠে এসেছি।
চন্দন চাপা হাসি হেসে বলে, তোর তৈরি কেক আমরা খাচ্ছি, সেই ভালো কিন্তু ভুল করেও কখনো স্বামীকে খাওয়াবি না। ঐ কেক খাওয়ার পরদিনই তোর স্বামী তোকে ঠিক ডিভোর্স করবে।
ওর কথায় সবাই হেসে ওঠে।
অনুরাগ বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েই হাসতে হাসতে বলে, সামনের মাঘেই তো তোর বিয়ে। তোর বউয়ের কাছে আমি সব ফাস করে দেব। তখন মজা বুঝবি!
ঐ মোটা ফাল্গুনীকে আমি ভালোবাসতাম, এ কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
পাড়ার এই পরিবেশেই সৌমিত্রবাবু বড় হয়েছেন। শুভশ্রী দেবীও তো এখানে তিরিশ বছর কাটিয়ে দিলেন। প্রায় সামনাসামনি বাড়ির মানিকবাবু সৌমিত্রবাবুর প্রিয় রাঙাদা। দুচার বছরের বড় হলেও রাঙাদা ওঁর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। ঐ রাঙাদার সঙ্গেই উনি জীবনের প্রথম টেস্ট ম্যাচ দেখেছেন, স্টাররঙমহলে কত বিখ্যাত অভিনেতাঅভিনেত্রীর অভিনয় দেখেছেন। আরো কত কি!
একটু ভালোমন্দ রান্না করলেই রাঙা বৌদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু গলা চড়িয়ে বলেন, এই শুভশ্রী, আনন্দ ঠাকুরপোর জন্য একটু মাছ পাঠাচ্ছি।
শুভশ্রী হাসতে হাসতে বলেন, এ বাড়িতে কি শুধু তোমার আনন্দ ঠাকুরপোই থাকে?
উনিও হাসতে হাসতে বলেন, ভুলে যাও কেন, আনন্দ ঠাকুরপো আমার একমাত্র বয়ফ্রেন্ড!
তারপর ঋষি হবার পর মানিকবাবুর স্ত্রী মাধুরী দেবীকে দেখলেই ও খিল খিল করে হেসে ওর কোলে যেত। মানিকবাবুর বড় মেয়ে অনুরাধা বলতো, মা, ভাইয়াকে বাড়ি নিয়ে চল।
এই অনুরাধার জন্যই মাধুরী দেবী ঋষিকে বাড়ি নিয়ে যেতেন। ঋষিও মহানন্দে সারাটা দিন কাটাতো।
কবছর পর ঋষি স্কুল যাতায়াত শুরু করল। ও স্কুল থেকে নেমেই এক দৌড়ে বাড়ির সামনে এসেই চিৎকার করতো, রাঙামা, আমার ছুটি হয়ে গেছে।
মাধুরী দেবী দোতলায় দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলেন, এক দৌড়ে উপরে উঠে এসো। আমি তোমার জন্য কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি।
উল্টো দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শুভশ্রী একটু হেসে মাধুরী দেবীকে বলেন, এ ছেলেটা বোধহয় ভুল করে আমার পেটে জন্মেছে।
উনি ঋষিকে কোলে তুলে নিয়ে ভিতরে যাবার আগে হাসতে হাসতে বলেন তুই আর তোর বর যে আমার ছোট মেয়েটাকে কেড়ে নিয়েছিস?
অনুরাধা জন্মের বছর খানেক পর সৌমিত্রবাবুর সঙ্গে শুভশ্রীর বিয়ে হয়। অনুরাধা নতুন কাকা নতুন কাকিমার অসম্ভব ভক্ত হলেও শ্রীরাধার মতো ওদের কাছে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর দিনরাত্তির কাটায়নি। অবশ্য তার কারণ ছিল, শ্রীরাধা যখন মাত্র তিন মাসের, তখন ওর মার একটা বড় অপারেশন হয়। তিন সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে এলেও ঐটুকু শিশুর সব দায়িত্ব পালন করা অসম্ভব ছিল। ডাক্তারেরও নিষেধ ছিল। তখন দীর্ঘদিন শ্রীরাধা শুভশ্রীর কাছেই থেকেছে। ও যত বড় হয়েছে, এ বাড়ির সঙ্গে ওর সম্পর্ক তত গম্ভীর হয়েছে।
ছোটবেলায় শ্রীরাধা কিছুতেই নতুন কাকিমা বলতে পারতো না। তারপর আস্তে আস্তে নতুন মা বলতে শুরু করে।
দেখতে দেখতে গঙ্গা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেল।
অনুরাধা বিয়ের পর পরই কানাডা চলে গেল। ঋষি মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করেই এম এস পড়ার জন্য চণ্ডীগড় গেল। শ্রীরাধা ইউনিভার্সিটিতে এম এ পড়ে।
এখন?
এ বাড়ির সব ব্যাপারেই শ্রীরাধার কথাই শেষ কথা।
নতুন কাকা, এই জামাটা তুমি আর পরবে না।
নিজের জামাটার দিকে একবার তাকিয়েই সৌমিত্রবাবু বলেন, কেন রে রাধা? জামাটা তো ভালোই আছে।
কাঁচতে কাঁচতে রঙ কত ফেড হয়ে গেছে দেখেছ?
কোনো উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই শ্রীরাধা অত্যন্ত গুরুগম্ভীর হয়ে চরম সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়, তোমার অনেক ভালো ভালো জামা আছে। তোমাকে আর এই জামাটা পরতে হবে না।
শুভশ্রী দেবী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, রাধা, তুই ঠিক বলেছিস!
সৌমিত্রবাবু একটু হেসে আত্মসমর্পণ করেন, ঠিক আছে; এই জামাটা আর পরব না।
শুভশ্রী দেবীর মা প্রায়ই নাতির খোঁজখরব নেবার জন্য এ বাড়িতে এসে মেয়েকে জিজ্ঞেস করেন, হারে, ঋষির চিঠি এসেছে?
শুভশ্রী কোনো জবাব দেবার আগেই শ্রীরাধা হাসতে হাসতে বলে, ও দিদ, তোমার নাতি আজকাল তোমাকে কোনো লাভলেটার লিখছে না।
উনি এক গাল হাসি হেসে জবাব দেন, আমাদের দুজনেব প্রাইভেট অ্যাফেয়ার্সে তোর এত উৎসাহ কেন?
শ্রীরাধাও হাসতে হাসতে বলে, তুমি যাই বল দিদা, তোমার অমন পেটুক লোভ বয়ফ্রেন্ডের নাম যে ঋষি রাখলে কেন, তা আমার মাথায় আসে না।
আমার নাচ দেখে যে ওর তপোভঙ্গ হয়েছে, তাই তো ও আমার ঋষি!
গঙ্গার জল আরো গড়িয়ে যায়।
শ্রীরাধা গত বছরই এম এ পাস করেছে। মানিকবাবু মেয়ের বিয়ে দেবার আগ্রহ প্রকাশ করতেই ও সোজা বলে দিয়েছে, আমি এখন বিয়েটিয়ে করব না। রিসার্চ করব।
এদিকে ঋষি এম এস পাস করতেই ওর বাবামা ছেলের বিয়ে দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। চাকরিবাকরি বা প্রাইভেট প্রাকটিশ শুরু করার আগে, বিয়ে করতে ঋষিরও আপত্তি নেই; তবে ওর বাবামা খুব ভালো করেই জানেন, ঋষি বিয়েতে কোনো যৌতুক বা উপহার কিছুতেই নেবে না।
যাই হোক, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার পর এত চিঠিপত্র ও মেয়ের ছবি এলেও একজনকেও শ্রীরাধার পছন্দ হল না। দুএকটি মেয়ের ব্যাপারে শুভশ্রী দেবী একটু আগ্রহ দেখালেও উনি স্বামীকে বললেন, কোনো মেয়েকেই তেমন ভালো লাগল না। তবে দু একটি মেয়েকে দেখা যেতে পারে।
শ্রীরাধা সঙ্গে সঙ্গে বলে, তোমরা কেন ঐ ঝামেলায় যাচ্ছো? রবিবার ঋষিদা এলে সব চিঠিপত্তর আর ছবি তার হাতে তুলে দিও। তারপর সে যাকে ইচ্ছে, বিয়ে করুক।
সৌমিত্রবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সেই ভালো।
শুভশ্রী দেবী পাশ ফিরে বললেন, হ্যাঁরে, রাধা, চিঠি আর ছবিগুলো সাবধানে রেখে দে।
ভয় নেই নতুন মা, এইসব অপ্সরীদের ছবি আমি অযত্নে রাখব না।
শ্রীরাধা হাসতে হাসতে ও ঘরে চলে যায়।
রবিবার।
মানিকবাবু অফিসের কাজে বাঙ্গালোর গিয়েছিলেন বলে সৌমিত্র রাঙা বৌদিকে নিয়ে স্টেশনে গেলেন। ঋষিকে নিয়ে বাড়ি আসার পর হইহুঁল্লোড়ের মধ্যেই ঘণ্টা খানেক কেটে গেল। তারপর মাধুরী দেবী বাড়ি চলে যেতেই শুভশ্রী দেবী বললেন, হ্যাঁরে, রাধা, ঐ ছবিগুলো ঋষিকে দেখা তো!
শ্রীরাধা বলে, ঋষিদা, ও ঘরে চলো।
দশপনেরো মিনিট পর শুভশ্রী দেবী পর্দা সরিয়ে ও ঘরে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়ান।
ঋষি দুহাত দিয়ে শ্রীরাধার মুখখানা ধরে বলে, অন্য কোনো মেয়েকে নিয়ে ঘর করব বলেই কী গত দশ বারো বছর ধরে তোমার ছবি পার্সে নিয়ে ঘুরছি?
শুভশ্রী দেবী এক লাফে স্বামীর কাছে ছুটে গিয়ে বলেন, তুমি এক্ষুনি ঠাকুর মশায়ের কাছে যাও। ঋষির বিয়ের দিন দেখতে হবে।
সৌমিত্রবাবু হতবাক হয়ে কোনোমতে বলেন, কিন্তু…
শুভশ্রী দেবী এক গাল খুশির হাসি হেসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার ছেলে শ্রীরাধাকেই বিয়ে করবে।
তাই নাকি?
তবে আর বলছি কী?
সৌমিত্রবাবু বারান্দায় গিয়ে পাগলের মতো চিৎকার করেন, রাঙা বৌদি, শিগগির এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে এসো।