পাত্রী

পাত্রী

কে ও? শিবাই নাকি রে?

যে আজ্ঞে। শিবাই-ই বটি।

তা পাত্রী পছন্দ হল?

না জামাইদা, এটাও লাগসই নয়। দাঁত উঁচু।

দাঁত উঁচু? তা কত উঁচু? মুখ বন্ধ হয় না?

তা হয়।

আজকাল তো শুনি উঁচু দাঁতের বেশ কদর হয়েছে নাকি? ফিলম আর সিরিয়ালে নাকি উঁচু দাঁতের বেশ কদর।

আপনি তো ওসব দেখেন টেখেন না, তবে জানলেন কীভাবে?

দেখার সময় কোথায় যে দেখব? তবে ভচ্চার্য ঠাকুরমশাই বলেছিলেন বটে, অঘোর হে, আজকাল উঁচু দাঁতের ছড়াছড়ি।

ঠাকুরমশাই? নিমুবাবুর বাড়িতে ঠাকুরমশাইকে দেখেছি বটে বারকয়েক, টিভির সামনে বসে ঘাড় কাত করে রোজ সন্ধেবেলা তোফা ঘুম দেন।

ফাঁকে ফাঁকে দেখেন আর কী। তার ঘরদোর কেমন দেখলি?

আজ্ঞে ওসব ভালো, পাকা একতলা। বাড়িতে টিউবওয়েল। গুনে দেখলাম, বাড়ির হাতায় অন্তত শ-দেড়েক সুপুরি গাছ। দুটো পুকুর। আমবাগান। জমি-জিরেত।

লাগিয়ে দিলে পারতি।

দাঁতে আটকায় যে! না-হলে লাগিয়েই দিতাম।

মেয়ের যেমন দাঁত উঁচু, তেমনি তোর আবার নাক উঁচু। বলি দামড়া, বয়েসটা খেয়াল আছে? ছত্রিশ পেরোলি কিন্তু!

আমার আর বিয়ে হওয়ার নয়। বিয়ে না হয় না হোক, যেমন তেমন একটা ধরে আনলে আমার হবে না। ভাবিয়ে তুললি। আয় বারান্দার চৌকিতে বসে একটু ভাবি। জ্যোৎস্নাটা খুব ফিনকি দিয়েছে আজ। তোর সঙ্গে গিয়েছিল কে?

গদাই, পবন আর মেসোমশাই।

তারা কী বলে?

মেসোমশাইয়ের কথা আর কবেন না। যাকে দেখে তাকেই পছন্দ। পবন আর গদাই বলল, চলবে না।

তাহলে এগারো নম্বরেরটাও আউট।

যে-আজ্ঞে।

দশ নম্বরটার যে কী দোষ ছিল?

সেটা তো আপনিই বাতিল করলেন, মনে নাই?

নাকি? ওঃ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। পাত্রীর ভৌম দোষ ছিল। বড়ো মুশকিলেই পড়া গেল রে! তোর মা, বাপ, দিদি সবাই যে তোর বিয়ের জন্য বড়ো পাগল হয়ে পড়েছে। জুতসই পাত্রীই পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ পথে ঘাটে কত সুন্দরী মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী ব্যাপার বল তো?

দেখেন জামাইদাদা, আমার মেয়েছেলে দেখার চোখও নাই, রোখও নাই। আমি কাজ-কারবার নিয়ে ঝাটে জড়িয়ে আছি। আপনারা সবাই ধরে-পাকড়ে পড়লেন বলে, ঘাড় কাত করতে হয়েছে। বলি কী, এবার আমাকে রেহাই দেন।

কস কীরে ডাকাত, তোর বিয়ে দিতে না পারলে যে, আমার অন্নজল বন্ধ হবে।

ললাটের লিখন বলেও তো একটা কথা আছে। আমি ভেবে দেখলাম এইভাবে মেয়ে দেখে বেড়ানোটাও ঠিক হচ্ছে না। মেয়েগুলোরও তো একরকম অপমানই হচ্ছে। এটাও ঠিক না। আর এই বিয়ে-বিয়ে হুল্লোড়ে আমার কাজ-কারবারেও লোকসান হচ্ছে। বিষাণগড়ের ইটভাঁটিতে গন্ডগোল, ন্যাজাতের কারখানার ওভারহল করা দরকার, বৈদ্যপুরের বিস্তর পাওনা উশুল করা পড়ে আছে।

তা বললে কী হয় রে পাগল? তোর বুড়ো বাপ-মা যে তোর ভরসাতেই বেঁচে আছে। কাজ-কারবারের জন্য ভয় নেই। ও দু-দিনেই সামলে নিতে পারবি। আর কটা দিন থেকে যা। শনিবারে বিষ্ণুপুরের মেয়েটাকে দেখে নিলেই হয়।

ও আপনারা দেখেন।

শুনেছি এ-মেয়েটা বড়োই ভালো। দেখতে শুনতে সুন্দর, লেখাপড়া জানে, তার ওপর নাকি ভারি বুদ্ধিমতী। বুদ্ধিমতী মেয়ে পাওয়া ভাগ্যের কথা।

আমাকে ছেড়ে দেন। কাজ-কারবার লাটে উঠবে এরকম চলতে থাকলে।

একটা কথা কবি?

কী কথা?

চন্ডীপুরের মেয়েটাকে তোর পছন্দ হল না কেন?

সে তো বলেই দিয়েছি।

তেমন ভেঙে বলিসনি। আরও একটা কথা।

বলেন।

তোর মেসোমশাই দিনকয়েক আগে আমাকে বলেন, শিবাই মেয়ে পছন্দ করবে কী, ও তো কোনো মেয়ের দিকে তাকিয়েই দেখে না। হয় মাথা নীচু করে বসে থাকে, নইলে জানলার বাইরে তাকিয়ে মাটঘাট, গাছপালা আর গোরু-ছাগল দেখে।

তাই নাকি?

কথাটা একেবারে মিথ্যেও নয়।

বলিস কী? পাত্রী ফেলে গোরু দেখিস, এ তোর কেমন স্বভাব?

মায়া-মতিভ্রমকে যে বড়ো ভয় পাই দাদা।

বুঝিয়ে বল।

খাজিরগঞ্জের লালকমলকে মনে পড়ে? ওই যার কব্রিাজি ওষুধের কারবার।

তা মনে থাকবে না কেন? লালকমলের বাতের মালিশের খুব নাম।

সে-ই। লালকমল হরিশ্চন্দ্রপুরে নিজের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে প্রথম দর্শনেই কাত হয়ে পড়ল। তেমন মেয়ে নাকি ভূ-ভারতে নেই। বিয়ের পর রংটং উঠে যাওয়ার পর বউয়ের চেহারা যা বেরোল তা কহতব্য নয়। সে নয় চেহারা ভগবানের দান বলে সে-কথা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু মেয়েটার চোখে নাকি মায়াদয়া ঝরে পড়ছিল, আর ঠোঁটে করুণার হাসি। বিয়ের পর আর সেসব খুঁজে পাওয়া গেল না। বজ্জাত মেয়েছেলেটা এখন লালকমলের ঘাড়ে মুষলের মতো চেপে বসে তার প্রাণ ছিবড়ে করে ছাড়ছে। দেখা হলেই লালু বড়ো কান্নাকাটি করে। ওইটেই বড়ো ভয় পাই। কার দিকে তাকিয়ে মতিভ্রম হয় বলা তো যায় না। তাই তাকানোর বখেরায় আর নেই।

এ তো বড়ো গন্ডগোলের কথা রে শিবাই, না তাকিয়ে বুঝবি কী করে কার দাঁত উঁচু, কে ট্যারা, কে কালো। বা কুচ্ছিত।

তাকানোর দরকার কী? আর সবাই তো ড্যাব ড্যাব করে দেখছে। তাই তো বলছি, আমার দেখা না-দেখা সমান। আপনারা ধরেবেঁধে জুতে দিলে কিছু করার থাকবে না। কিন্তু বউ যদি বাড়িতে অশান্তি করে তবে। আপনাদের দায়িত্ব।

হুঁ। বড়ো ভাবনায় ফেললি দেখছি। মনে হচ্ছে তোর বিয়ের মতলব নেই।

সে কথা তো কেউ কানেই তুলছে না। আমি তো বলেই আসছি যে, সংসারধর্ম আমার জন্য না। তাই বললে কী হয় রে পাগলা? তোর বাবা-মা, দিদিরা যে আমাকে উস্তম-পুস্তম করে ছাড়ছে বয়েসের ছেলে, বিয়ে না দিলে যে বুড়ো বয়েসে আধপাগলা হয়ে ঘুরে বেড়াবে। তা বিয়েতেই বা তোর এত আপত্তি হচ্ছে কেন? ফকির-বৈরাগী-কাঙাল–কে না বিয়ে বসেছে বল তো? বয়োধর্ম বলেও তো কথা আছে? তার ওপর রোজগারপাতি ঠাকুরের ইচ্ছায় তো মন্দ করছিস না। কয়েক লাখ টাকার কারবার। তা এ-সবেরই বা কী বিলিব্যবস্থা হবে বল তো? তোরটা খাবে কে?

দশ ভূতে লুটে খাবে। তাই-বা মন্দ কী? আমার কাজটুকু আমি করে যাচ্ছি, ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কী আছে?

আমার সঙ্গে যখন তোর দিদির বিয়ে হয় তখন তুই কতটুকুন ছিলিস মনে আছে? মাত্র পাঁচ বছর বয়স তখন তোর। সেই থেকে তোকে এত বড়োটি হতে দেখলাম। কিন্তু তোর মতিগতি যে ভালো বুঝতে পারি, তা নয়। সব কথা খোলসা করে বলিসও না। স্বভাব চাপা হলে অন্য সকলের মুশকিল হয়।

আমার মতিগতি কিন্তু জটিল-কুটিল না। আসলে আমি বিয়ে ব্যাপারটায় তেমন আগ্রহ বোধ করি না। কাজ-কারবার নিয়ে মেতে থাকতে ভালোবাসি।

দাঁড়া। একটা কথা মনে পড়ল হঠাৎ।

কী কথা?

শীতলকুচিতে তোর একটা ঠেক ছিল-না?

ছিল। পানের বরজ করে বড়োলোক হওয়ার বাই চেপেছিল মাথায়।

হ্যাঁ। বছর দুই চেষ্টাও করলি।

ওসব পুরোনো কথা তুলে কী হবে?

তখন কানাঘুসো শুনেছিলাম, মহীতোষ রায় নামে এক ভদ্রলোকের মেয়ের সঙ্গে তোর নাকি একটা খটামটি লেগেছিল।

ঠিকই শুনেছিলেন।

ব্যাপারটা কী খুলে বলবি?

হঠাৎ সেই বৃত্তান্ত শুনতে চান কেন?

সেই মেয়েটার সঙ্গে তোর ঝগড়াটা কীসের?

ও বাদ দেন। মেয়েমানুষদের সঙ্গে ঝগড়ায় গেলে মুশকিল। আমি তেমন রোখাচোখা মানুষও তো না।

ঝগড়াটা কী নিয়ে?

সে তো চুকেবুকে গেছে।

মনে করে দেখ তো, মেয়েটার নাম কি মাধবী রায়?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে কে বলল? মাধবীর নাম তো আপনার জানার কথাই নয়।

শীতলকুচির লক্ষ্মীভান্ডার তো আমার কাছ থেকেই মাল নেয়।

তাই নাকি?

আমাকে মাসে একবার-দুবার যেতেই হয়। গোরাচাঁদ সিংহ রায় শীতলকুচির মস্ত মহাজন। লক্ষ্মীভান্ডার এর মালিক।

চিনি। আমি যার কাছ থেকে পানের বরজ কিনেছিলাম সেই মহেশ রায়ের ভায়রাভাই হল গোরাচাঁদ। লক্ষ্মীভান্ডারের তখন এমন ফলাও অবস্থা ছিল না।

তা কথায় কথায় গোরাচাঁদকে বলেছিলাম তোর কথা। তখন গোরাই বলল তুই মাধবীর সঙ্গে কী একটা গন্ডগোলে শীতলকুচি ছেড়ে চলে এসেছিলি। গন্ডগোলটা কীসের তা অবশ্য সে বলতে পারল না।

বলার মতো কিছু নয়। তখন খুব বোকা ছিলাম তো, অভিজ্ঞতাও হয়নি। তাই অপমানটা হজম করে চলে আসতে হয়। তবে ওসব আমি তো আর মনে রাখিনি। যা হয়ে গেছে তা নিয়ে ভেবে কী হবে বলুন?

ঝগড়াটা কী নিয়ে?

শুনলে হাসবেন।

বলেই দেখ না।

বলতে বাধো বাধো ঠেকে। শত হলেও আপনি গুরুজন। ওসব কথা বলতে গেলে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবে।

তোকে আমি সাঁতার কাটতে শিখিয়েছি, সাইকেলে চড়তে শিখিয়েছি, আমার কাঁধেও চড়েছিস অনেক। আমার কাছে তোর লজ্জা কীসের? বয়েসকালে যদি কিছু করেও ফেলে থাকিস সেটা বয়েসের ধর্ম। সকলেরই একটু-আধটু বেপরোয়া ঘটনা ঘটে।

শীতলকুচিতে আমি একটু কুসঙ্গে পড়ে যাই। সন্ন্যাসীচরণ প্রতিহারের বাড়িতে একখানা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকি। প্রথম চোটেই পানের বরজ থেকে বেশ কয়েক হাজার টাকা নাফা হয়েছিল। বয়েস কম, হাতে খোলামকুচির মতো টাকা, বুঝতেই পারেন।

তা পারি।

কয়েকজন মোসাহেব বন্ধু জুটে গেল। তারা আমাকে মদটদ খাওয়াত। আমারও ফিকে মতো নেশার রং ধরে গেল। রোজই সন্ধের পর আমার ঘরে পাঁচ-সাতজন জুটে যেত। তাদের মধ্যে একজন ছিল অবনী ঘোষ। অবনীর চেহারা ভালো ছিল, পেটে বিদ্যেও ছিল, আবার উড়নচন্ডীও ছিল। তবে সে একটু আলাদা রকমের ছিল, অন্যদের মতো আমার মোসাহেবি করত না। কিন্তু আমার পয়সায় নিয়মিত মদ খেত, কারণ তার বিশেষ পয়সা ছিল না। গন্ডগোলটা এই অবনীকে নিয়েই।

তাই নাকি?

মাধবীর সঙ্গে নাকি অবনীর বিয়ের সব ঠিকঠাক। সেসব আমার জানার কথাও তো নয়। কিন্তু একদিন সকালবেলায় বরজে রওনা হচ্ছি, হঠাৎ ফর্সা, চোখে চশমাঅলা একটা মেয়ে হাজির। সঙ্গে গাঁয়ের কয়েকজন মাতব্বর।

তাদের মধ্যে কি গোরাচাঁদও ছিল?

না। তবে তার বাবা প্রতাপচাঁদও ছিল। তারা এসেই আমাকে মাতাল, বদমাশ, দুশ্চরিত্র, আরও অনেক কথা বলে প্রচন্ড চেঁচামেচি বাঁধিয়ে দিল।

মাধবীও কি গালাগাল করছিল?

তা তো বটেই। কী রাগ মেয়েটার। বলল, আমি নাকি গাঁয়ের ছেলেদের নেশাভাং ধরাচ্ছি, ছেলেদের মরালিটি নষ্ট করে দিচ্ছি। আরও কত কী! ভগবান জানেন, আমার মাতাল বন্ধুরা সবাই অভ্যস্ত মাতাল, আর তারাই আমাকে মদদ খেতে শিখিয়ে নিয়ে তারপর আমার ঘাড় ভেঙে মদ খেত। কিন্তু আমার কথা কে আর কানে তোলে বলুন? ফটিক দাস নামে একটা গুণ্ডাগোছের লোক তো আমাকে কয়েকটা চড়চাপড়ও মেরেছিল। ভয়ে আমি তখন জবুথবু।

তারপর কী হল?

কী আর হবে? চারদিকে ভিড় জমে গেল। সবাই ছিছিক্কার করছে। একমাত্র সন্ন্যাসী প্রতিহারই আমার পক্ষ নিয়ে দু-চার কথা বলেছিল। সে মাধবীকেই বলল, অবনীকে শিববাবু মদ ধরিয়েছে এ-কথা গাঁয়ের গাছও বিশ্বাস করবে না। অবনী তো চোদ্দো বছর বয়স থেকে মদ খায়, সবাই জানে। কিন্তু তার কথা কেউ কানেই তুলল না। আমার ওপর হুকুম জারি হল, গাঁ ছেড়ে চলে যেতে হবে।

তুই কবুল করলি?

না করে উপায়? আমি ভাইয়ের লোক, উড়ে গিয়ে জুড়ে বসেছি, সহায়-সম্বল তো কিছু নেই। তবে ঘটনায় একটা উপকার কিন্তু হল জামাইদা। সেদিন থেকে আজ অবধি আর মদ ছুঁইনি।

সব ঘটনারই ভালো-মন্দ দুটো দিক থাকে। বরজটা কি বিক্রি করলি নাকি?

না, ওখানেই তো আসল প্যাঁচ।

তার মানে?

খেটেখুটে ব্যাবসাটা দাঁড় করানোয় সকলেরই চোখ টাটাচ্ছিল। বরজটার দিকে তখন অনেকের নজর। ঘটনার পর মাসখানেক থেকে চেষ্টা করছিলাম বিক্রির। কেউ কিনল না। বরং মাসখানেকের মাথায় আমাকে একরকম প্রাণের ভয় দেখিয়েই তাড়ানো হল। বরজটা, শুনেছি, মহীতোষ রায় দখল করেছিল। আমি তারপর আর ওসব। নিয়ে মাথা ঘামাইনি।

শেষ অবধি অবনী ঘোষের সঙ্গে মাধবী রায়ের বিয়ে হয়েছিল কি না খবর নিসনি?

সে খবরে আর আমার দরকার কী বলুন? অবনী ঘোষ আমার জীবন থেকে মুছে গেছে। শীতলকুচিও। ঘেন্নায় আর ও-মুখো কখনো হইনি।

মাধবীর তখন বয়স কত?

ষোলো-সতেরো হবে বোধ হয়। মেয়েদের বয়সের কোনো আন্দাজ আমার নেই। সাত-আট বছর আগেকার কথা।

তোর কি মনে হয় ওই গন্ডগোলটা আসলে ষড়যন্ত্র?

তা তো বটেই। যে-একমাস ছিলাম তারপরেও, তখন আর অবনী ঘোষ বা অন্য মোসাহেবরা আমার ছায়াও মাড়ায়নি।

গোরাচাঁদ অবশ্য আমাকে এত ভেঙে কিছু বলেনি। তবে এটা ঠিক যে, শীতলকুচিতে মহীতোষ রায়ের প্রবল প্রতাপ। বিষয়-সম্পত্তিও মেলা।

হ্যাঁ। আমার কিছু করার ছিল না দাদা, লাখ দুই-তিন টাকা জলে গেল, এই যা।

তোর কাছে দলিলপত্র আছে?

বরজের দলিল? তা আছে। তবে দলিল দিয়ে কিছু হওয়ার নয়। মামলা করলে সেই মামলা গড়াতে থাকবে, টাকা খরচ হবে জলের মতো, কাজের কাজ কিছুই হবে না। তাই আমি মামলা-মোকদ্দমায় যাইনি। লোকসানটা সয়ে নিয়ে নতুন রোখ নিয়ে আবার ব্যাবসা করেছি।

তোর ব্যাবসার মাথা আছে সবাই জানে। কিন্তু তবু বরজটা এত সহজে বেহাত হতে না দিলেও পারতিস। ও-বরজের এখন অনেক দাম।

কী করতে পারতাম বলুন? লাঠিবাজি করে তো সুবিধে হত না। বরং তাতে নিজেই হয়তো খুন হয়ে যেতাম।

তা বটে। তবে নবকেষ্ট অন্য কথা বলে।

কে নবকেষ্ট?

সন্ন্যাসী প্রতিহারের ছেলে।

আপনি তাকে পেলেন কোথায়?

কেন, সে তো এখন শীতলকুচির লক্ষ্মী ভান্ডারের ম্যানেজার। তাকে চিনব না কেন?

সে আপনাকে কী বলেছে?

তেমন গুহ্য কথা কিছু নয়। এই কথা বলছিল যে, মাধবীর সঙ্গে অবনী ঘোষের একটা বিয়ের কথা হয়েছিল। বটে, তবে পাকা কোনো কথা নয়। অবনী ঘোষ যে খুব ভালো ছেলে নয়, এটা সবাই জানে। তবে তার বাবা কেতন ঘোষের কাছে মহীতোষের একটু দায় ছিল। কেতন ঘোষ এক সময়ে মহীতোষের দুঃসময়ে তাকে খুব সাহায্য করেছিল। একরকম তার দয়াতেই মহীতোষ ফের নিজের পায়ে দাঁড়ায়। সেই কৃতজ্ঞতা থেকেই এই বিয়ের কথা হয়। ধরেবেঁধে মেয়েটাকে হয়তো অবনীর সঙ্গেই বিয়ে দিতে হত। মেয়েটা কিন্তু রাজি ছিল না।

সে-সব তো আমার জানার কথা নয়। তবে অবনী ঘোষ কিন্তু লোক খারাপ ছিল না। মদ-টদ খেত বটে, কিন্তু আর তেমন কোনো দোষ দেখিনি। কুঁড়ে আর ভীতু ছিল, তা সে তো আমাদের অনেকেই।

শেষ অবধি মাধবী কিন্তু অবনীকে বিয়ে করেনি। অবনীর বিয়ে হয়েছে বৈকুণ্ঠপুরের সাধন দাসের মেয়ে বৈষ্ণবীর সঙ্গে।

ও বাবা, আপনি অনেক খবর রাখেন দেখছি।

উড়ো কথা কানে এলে কী করব বল, তবে তুই যে দেখছি অবনী ঘোষের বড়ো সাউকার হয়েছিস, তোর বিপদের সময় তো অবনী ঘোষ তোর পাশে এসে দাঁড়ায়নি। তবে তাকে ভালো লোক বলে মনে করছিস কেন?

ওই তো বললাম, লোকটা ভীতু, কিন্তু খারাপ বললে অন্যায় হবে।

কেতন ঘোষ ছিল দাপুটে লোক। কিন্তু চরিত্র ভালো ছিল না। ছেলেরও সেরকমই হওয়ার কথা। কেতন নিজের বিষয়-সম্পত্তি ফুর্তি করে প্রায় উড়িয়েই দিয়েছিল। যা খুদকুঁড়ো ছিল তা ফুকে দিয়েছে অবনী। তবে পেটে বিদ্যে ছিল বলে, বরাতজোরে একটা চাকরি পেয়ে গেছে। সরকারি কেরানি।

আপনি অনেক খবর রাখেন। আমিই এতসব জানতাম না।

জানবার চেষ্টা করিসনি বলে জানিস না।

কিন্তু আপনিই বা এতসব খতেন নিয়েছেন কেন? শীতলকুচির বৃত্তান্ত তো তামাদি হয়ে গেছে।

তাই নাকি? কিন্তু আমার তো তা মনে হচ্ছে না রে শিবাই।

তবে আপনার মনে হচ্ছেটা কী?

এই যে তোর বিয়ের অনিচ্ছে, পাত্রী দেখতে গিয়ে জানলা দিয়ে গোরু-ছাগল দেখা, নানারকম খুঁতখুঁতুনি তুলে সম্বন্ধ নাকচ করে দেওয়া, এইসব দেখেই মনে একটু ধন্ধ এসেছিল। কিছু মনে করিস না বাপু, শীতলকুচিতে গিয়ে একটু খোঁড়াখুঁড়ি করতেই কিছু ঘটনা বেরিয়ে পড়ল। এত সব কোনোদিন ভেঙে তো বলিসনি। আমার মনে টিকটিক হচ্ছিলই।

দূর কী যে বলেন।

ঠিকই বলি রে শিবাই। যতই ঢাকাচাপা দিস না কেন, আসল কথা বুঝতে আমার বাকি নেই।

রাত হতে চলল জামাইদা, এবার উঠি।

তাড়া কীসের? ভটভটিয়া আছে, তিন মাইল রাস্তা লহমায় পেরিয়ে যাবি। সবে ঝাঁপি খুলছি, সাপ বেরোক, তার আগেই পালালে কী চলে?

ঠিক আছে, বলেন।

তুই ভাবিস না যে, শুধু উড়ো খবরের ভরসায় তাকে এতকথা বলছি। কারো সঙ্গে কথা কইতে বাকি রাখিনি।

সর্বনাশ কার, কার সঙ্গে কথা কইলেন?

অবনী ঘোষ, মহীতোষ, এমনকী মাধবীকেও বাদ রাখিনি।

আমাকে ডোবালেন যে।

অন্ধকার বলে বুঝতে পারছি না যে, তোর মুখখানা রাঙা হয়ে উঠল কি না।

এসব না করলেই ভালো করতেন। যা উড়েপুড়ে গেছে তাকে আর কুড়িয়ে এনে কী হবে?

উড়েপুড়েই যদি গিয়ে থাকে তাহলে গাঁয়ের একটা সুন্দরী মেয়ে তেইশ বছর বয়েস অবধি বিয়ে না করে বসে আছে কেন বলবি?

বিয়ে করেনি সে তার ইচ্ছে। কাজটা ভালো করেনি সে। অবনী ঘোষের বাগদত্তা ছিল, তার উচিত ছিল তাকেই বিয়ে করা।

মনের সায় না থাকলেও? আর বাগদত্তাই বা কোন হিসেবে? মাধবীর তো মতামতই নেয়নি ওর বাপ। দুজনের ভাবসাবও ছিল না।

না থাকলে অবনী ঘোষের হয়ে ঝগড়া করতে এসেছিল কেন?

মোটেই অবনীর হয়ে ঝগড়া করেনি। সে চেয়েছিল যাতে তুই হুড়ো খেয়ে মদ ছাড়িস। তার মনের কথা তুই টের পাসনি, এত বোকা তুই নোস। ঝগড়া করতে এসেছিল তোর ভালোর জন্যই। তবে সিচুয়েশনটা যে, ওরকম বিচ্ছিরি দাঁড়াবে তা বুঝতে পারেনি। সেইজন্য পরে কান্নাকাটি করেছিল খুব। এখনও কাঁদে।

তাতে আমার আর কিছু যায় আসে না দাদা।

যায় আসে বলেই না, আজ অবধি তোর আর কোনো মেয়ে পছন্দ হল না। সত্যি কথা বল তো, মাধবী। তোর সঙ্গে ঝগড়া করার আগে কতবার ভাব করতে চেয়েছিল? তুই তাকে পাত্তাই দিলি না।

পাত্তা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে কেন? সে তো আমার চোখে পরস্ত্রী।

তোর মাথা। কোনো হিসেবেই মাধবী পরস্ত্রী ছিল না। আজও নয়।

মাধবীর কথা তুলছেন কেন জামাইদা? আপনার মতলবখানা কী?

গত রোববার তোর দিদিকে নিয়ে আমি শীতলকুচিতে গিয়েছিলাম।

সর্বনাশ!

সর্বনাশের জন্যই এইবার তৈরি হ। তোর দিদির মাধবীকে ভারি পছন্দ হয়েছে। তার ওপর যখন শুনল, এত বয়স অবধি মেয়েটা বিয়ে না করে একজনের জন্য অপেক্ষা করে আছে, তখন তো কেঁদেই ফেলল। মহীতোষ এখন পারলে আমাদের হাতে-পায়ে ধরে। বলছিল, মেয়েটা বিয়ে করবে না বলে ধনুকভাঙা পণ করে বসে আছে, আমি মরেও শান্তি পাব না।

কাজটা ভালো করেননি জামাইদা। আমাকে বড়ো লজ্জায় ফেললেন।

দামড়া কোথাকার। শুধু একটা ভুল ধারণার ওপর একটা মেয়েকে এত কষ্ট দিতে হয়? অবনী ঘোষ তো কবেই বিয়ে করে সংসার পেতে বসে গেছে। তোর অঙ্ক তো মেলেনি।

সব অঙ্ক কি মেলে দাদা?

এই অঙ্কটা মিলিয়ে দে ভাই। আর পাত্রী দেখার নামে আমাদের মিছে হয়রান করে মারিস না।

আজ উঠি জামাইদা।

না। উঠলে হবে না। মুচলেকা দিয়ে যা। কোনোদিন তো আমার সঙ্গে অবাধ্যতা করিসনি। আজ কী করবি?

জ্বালালেন। দিদি যখন আসরে নেমে পড়েছে তখন আমার জীবন অতিষ্ঠ করে মারবে।

মত দিলি তো!

না দিয়ে উপায় কী বলুন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *