পাতী অরণ্যে এক উপদেবতা
‘অপসৃত হোক গুপ্তির জঞ্জাল’—এই বলে দীপু সরে দাঁড়াল। মুখে একটু লজ্জা, একটু বা গর্ব-মেশানো হাসি। দারুণ কিছু একটা করেছে এমনই ভাব। দীপু শুধু লম্বাতেই অনেকখানি নয়, ওর হিলহিলে কাঠামোয় ইদানীং বেশ বস্তু জমা হয়েছে। ফলে আর একটু হলেও ও দশাসই হয়ে যাবে। হিরোর চেয়ে ভিলেনের ভূমিকাতেই মানাবে বেশি। তা, এখনও ততটা হয়নি। এখনও হিরো-হিরো ভাবটা বজায় রয়েছে। দীপু সরে দাঁড়াতে পেছনে যে ছিল প্রকাশিত হল। রাহুমুক্ত চন্দ্রমার মতো। যদিও দীপুকে ঠিক রাহু বলা যায় না, রাহুর পক্ষে বড্ড বেশি সুকুমার। পেছনের মানুষ বা মানুষীটিও কোনও অর্থেই চাঁদের মতো নয়। বরং যেন ঘাসের মতো, ধানগাছের মতো, যখন শিষ ধরেছে, যখন প্রথম ধরেছে কলি। ‘এই হল টিংকু,’ দীপু বলল। একটু হেসে, একটু লতিয়ে, ধানগাছেরই মতো একটু দুলে, অতএব টিংকু অবনত হচ্ছে। প্রণাম করবে। ঢিপ করে নয়। সে সব হত কিছুকাল আগে যখন প্রণাম নিয়ে প্রণত ও প্রণম্যর মধ্যে কোনও সংশয় ছিল না। এখন শুধু একটু নত হওয়া, একটু ভঙ্গি। সবাই জানে মাঝপথে আটকে যাবে। ‘থাক থাক হয়েছে,’ ‘আরে ও কী হচ্ছে?’ ‘এখন কি আর ও সব চলে?’ ঠিক কোন পর্যায়ে সুস্বাগত বাধাটা আসবে শুধু জানা নেই। কাজেই টিংকু নামের মেয়েটি স্লো মোশনে অবনত হচ্ছে।
রঞ্জা উঠে দাঁড়াচ্ছিল। ছিল সে চেয়ারে। টেবিলে তার বইপত্র। কলমের টুপি খোলা। লম্বা চিঠির কাগজ বুকে কিছু অক্ষর নিয়ে টেবিলের উপর প্রতীক্ষায়। তার উপরে বই। চিঠি আর বই, বই আর চিঠির মধ্যে সে ঘোরাফেরা করছিল। দীপুর সাড়া পেয়ে সে তার সাধের ঘুরন চেয়ারে ঘুরে গিয়েছিল দরজার মুখোমুখি। তার মানুষটিকে পুরোপুরি নিজের কাঠামোর অন্তরালে রেখে যখন দীপু এগোচ্ছিল, তখন রঞ্জা ঈষৎ ঊর্ধ্বমুখ। এখন, ‘এই হল টিংকু’র পর পর্যায়ে সে বসে থাকাটা যথাযথ মনে করছে না। উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার মুখে বিস্ময়। দেহে বিস্ময়। তার ভঙ্গিতে বিস্ময়। সে এখন দণ্ডায়মান বিস্ময়প্রতিমা। এবং সে ধানগাছের মতো নয়। আর নেই। সে বরং একটা ঋজু অথচ ভেতরে ভেতরে ভাঙতে-থাকা প্রশ্ন। ‘তবে অঞ্জলি উদ্যত কেন পলাশে?’ এই প্রশ্ন সে যেন ভেতরে ভেতরে তৈরি করছে আজকাল। টগবগ করে ফুটতে ফুটতে প্রশ্নটা পাক হচ্ছে। বেশ চিট হবে তাতে। তুললে চকচকে আঠালো সুতোর মতো ঝুলতে থাকবে, তারপরে শক্ত তীক্ষণ হয়ে যাবে। তখন তাকে জ্যা-মুক্ত করা হবে। ছুটে যাবে সেটা এখানে, ওখানে, সেখানে। ‘তবে অঞ্জলি উদ্যত কেন…’
লিখতে যতটুকু সময় লাগে, শব্দ লাগে, তার চেয়ে অনেক কম সময়ে, কম শব্দে দীপুর মনের মধ্যে দিয়েও কতকগুলো প্রশ্ন, কতকগুলো সংশয় ছুটোছুটি করে চলে গেল। দিদিকে এমন অবাক দেখায় কেন? একেবারে যেন হাঁ। যেন আকাশ থেকে পড়া। কিংবা যেন হঠাৎ বিনা মেঘে বাজই পড়েছে চড়াৎ করে? আগে বলা হয়নি ঠিকই। কিন্তু না বললেও এটাই তো স্বাভাবিক ছিল। যে কোনওদিন, যে কোনও লগ্নে। দিদিকে এত বিচলিত দেখাচ্ছে কেন? দিদি কি প্রস্তুত ছিল না? আলাদা করে কোনও প্রস্তুতির দরকার ছিল দিদির? সেই দিদি যে বলে ‘রেডিনেস ইজ অল।’ বলে, না বলত? দীপু ঠিক বুঝতে পারছে না। তার এই বিভ্রম ছড়িয়ে যাচ্ছে আশেপাশের বায়ুকণিকায়, সেগুলো যেন চার্জড্ হয়ে যাচ্ছে। চার্জড্ হয়ে গিয়ে স্পর্শ করছে টিংকুকে, ঘরের বস্তুগুলোকে। সব কিছুই কেমন শিউরে শিউরে উঠছে। টিংকু শিউরোচ্ছে নিচু হতে হতে, টেবিলের উপর কাগজ, বইয়ের স্তূপ সব কিছুতেই সূক্ষ্ম একটা শিহরণ।
রঞ্জা দাঁড়িয়ে আছে, চোখের জমিতে সেই ধাক্কা-লাগা বিস্ময়। সে একহাত কনুই থেকে মুড়ে একটু উপরে তুলেছে। আঙুলগুলো বিস্ফারিত হয়ে রয়েছে। অন্য হাত, ডান হাত প্রলম্বিত হয়ে গায়ের সঙ্গে লগ্ন, হাতের পাতা সামান্য একটু সামনে প্রসারিত। যেন বুদ্ধের বরাভয় মুদ্রা। বরাভয়। কিন্তু পাথরের বরাভয়। তাই আশ্বস্ত হতে পারছে না কেউ। না দীপু, না টিংকু, না এই ঘরের বাতাসে বদ্ধ এবং বাইরে প্রসর্পিত তাদের জীবন।
‘বসো, বোস’ দুজনের দিকে পর পর তাকিয়ে বলল রঞ্জা। মুখে সেই হাসি। বুদ্ধের মতো, কিন্তু পাথরের বুদ্ধ। খুব অল্প, একটুখানি, ঠোঁটের প্রান্তে লেগে রয়েছে মথুরার বুদ্ধের মতো। রঞ্জা চলে যাচ্ছে ঘর থেকে স্বপ্নচালিতবৎ। ধীরে ধীরে, টেনে টেনে, যেন সে পথ চেনে না। শূন্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু ভরসাহারা। হাত ধরে কেউ নিয়ে যাবে সে নিশ্চয়তা সে প্রাণের মধ্যে অনুভব করছে না।
দিদি কি ভেবেছিল তার জীবনে কেউ আসবে না? ডিমের আকারের চায়ের টেবিলে চা ছেঁকে দিচ্ছি দিদি দীপ্রকে, দীপুকে। দিদি আর দীপু তাড়াতাড়ি খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার রাত্রে। রাত ধরো ন’টায়। টিভি চলছে। শব্দটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু চিত্র। ইচ্ছে হলে দেখো, নইলে দেখো না। দেখার দরকারও নেই। কারণ এখন কথা। এখন শব্দের জাল বুনে তুলছে দুজনে। দীপ্র আর রঞ্জা। হেলায়। এমনই অনায়াসপটুত্ব যে মুখ খুললেই এলাচ-ভুরভুর শব্দরা পেছনে আঁকশি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে আঁকশিওলা আরও শব্দ আমন্ত্রণ করে। ‘আজকে খুব মজা হয়েছে জানো দিদি…’ তোর তো রোজই মজা, নিত্যদিন মজারা তোর আশেপাশে ঘুরঘুর করে তুই তাদের খপ খপ করে ধরবি ব’লে…‘আরে শোনোই না।’ একটা লোক আজকে একশ’ পঁচিশ টাকার টোপ ফেলে দশ হাজার পঁচিশ বোধহয় গেঁথে তুলতে চেয়েছিল। টেলার-এর সামনে হঠাৎ দেখি চারদিকে ফরফর করে পাঁচ টাকার নোট উড়ছে বর্ষায় পাখাঅলা পিঁপড়ের মতো। কার টাকা? কার টাকা? আপনার হাত থেকে? আপনার ব্যাগ থেকে? উঁহু, আমার পাঁচ টাকার নোট ছিল না বলতে বলতে ব্যাগটা বুকে চেপে ভদ্রমহিলা কঠিন মুখ করে সরে দাঁড়ালেন। তখন একটা লোক বলল যে ফেলেছে সে চালে ভুল করে ফেলেছে দিদি! ভেবেছিল আপনি থতমত খেয়ে উড়ন্ত টাকাগুলো ধরতে যাবেন আর সে সেই ফাঁকে আপনার হাতের তাড়াটা টেনে নিয়ে ভোঁ-কাট্টা হয়ে যাবে। ভদ্রমহিলা কী বললেন জানিস?—আপনিই সেই টোপ ফেলা লোকটা নন তো? বলে হনহন হনহন করে ছাতা বাগিয়ে চলে গেলেন। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ’….‘সেই লোকটার কী অবস্থা হল?’… ‘লোকটা? মুখখানা বেগুনি করে বলল দেখলেন তো দাদা, দেখলেন তো! কক্ষনো মেয়েছেলের উপকার করতে নেই, বলে দেবা ন জানন্তি ; ছিঃ!’… নোটগুলোর কী হল?’ ‘নোটগুলো? কেউ আর কুড়োতে সাহস পেল না, আমার ইচ্ছে হচ্ছিল কুড়িয়ে নিই, সিগ্রেটের খরচটা হয়ে যেত, হাঃ হাঃ। ….নিশ্চয়ই ওই লোকটাই! দেখিস নি? ট্রামেবাসে পকেটমার হলে কিছু লোক কীরকম কী হল, কেমন করে হল, আচ্ছা করে ধোলাই দিতে হচ্ছে, এইসব আরম্ভ করে। ওই লোকগুলো আসলে পকেটমারেরই দলের লোক। ভদ্রমহিলা শুধু শুধু সন্দেহ করেননি। আরে বাবা মেয়েদের ইনস্টিংট! দেবতারা না জানতে পারেন, মহিলারা ঠিক জেনে ফেলেন।’
রঞ্জাবতী বাথরুমে ছিল। প্রাণপণে মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছিল। দিচ্ছে তো দিচ্ছেই। ঝাপটা দিচ্ছে। কানের পেছনে, গলায়, ঘাড়ে জল হাত বুলোচ্ছে। সামনের অর্ধেক চুল ভিজে গেল। তবু সেই চিনচিনে ঝিনঝিনে গরম যেতে চায় না। মাথায় মুখে হঠাৎ যেন কে এক মালসা ধিকিধিকি আগুন ছুঁড়ে দিয়েছে। কানের ভেতর থেকে সাপের নিশ্বাসের মতো হলকা বেরোচ্ছে। সে আবার ঝাপটা দিল, আরও জোরে। চোখ টনটন করে উঠল এত জোরে।
টিংকু বলছিল, ‘আমার ভীষণ খারাপ লাগছে। আমি বরং চলে যাই।’
—‘সে কী? আরে অত ঘাবড়াবার কী আছে?’
—‘তুমি কিছু বলোনি?’
—‘না।’
—‘কিচ্ছু না?’
—‘কিচ্ছু না। কোনও দিন ঘুণ্ণাক্ষরেও না।’
—‘খুব অন্যায় করেছ, ভুল করেছ,’ টিংকু চোখ নিচু করে ফেলল। আসন্ন কোনও অপমানের আশঙ্কায় তার চোখে জল আসছে।
—‘দূর, অত ভয় পাবার কিছু নেই। দিদি কত মাই ডিয়ার। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। দিদি একমনে পড়াশুনো করছিল তো। হঠাৎ। হঠাৎ ব্যাপারটা ঠিক…’
—‘তাই-ই তো বলছি। বলে আনলে কী হত?’ টিংকুর কথার মধ্যে ঠোঁট ফুলে আছে যেন।
—‘আমি যাই টিংকু, দেখি একটু,’ পা বাড়াল দীপ্র। কিন্তু তার কথার মধ্যে কোনও প্রত্যয় নেই, চলার মধ্যে কোনও পৌরুষ নেই। কলঘরের বন্ধ দরজার বাইরে থেকে সে জোর করে গলায় উৎসাহ এনে ডাকতে থাকল,
—‘দিদি! কী হল রে! কিছু হয়েছে? হঠাৎ শরীর-টরির খারাপ হল, না, কি?’
কোনও জবাব নেই। শুধু জোরে জল পড়ার শব্দ। দিদি কি এই হিমের সন্ধেবেলায় চান করছে না কি? সাড়া দিচ্ছে না কেন? দিদি কি অজ্ঞান হয়ে গেল?
রঞ্জাবতী তখন প্রাণপণে নিজের ঘুরন্ত মাথাটাকে টোকা দিয়ে দিয়ে আঙুলের ঠেকায় লাটিম থামাবার মতো করে থামাতে চাইছিল। তার মাথার মধ্যে থমথমে গনগনে গলায় কে যেন বলছিল—সবাই যাবে? সবাই-ই এইভাবে যাবে তবে? তার জন্য? তার জন্য তবে কী? আহত আড়াল? শুধু স্বস্তি পাঠ? গনগনে আগুনের শিখার তাপে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত সচন্দন ধানদুর্বো পরিতৃপ্ত শিরগুলিতে অর্পণ? তার জন্য এই থাকবে? কী থাকবে, কী যাবে নিরুপায় মস্তিষ্কের মধ্যে সেই প্রশ্ন দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছিল। কোনটা, কতটা, কখন, কিছুই সে ভাল করে বুঝতে পারছিল না, এত উদভ্রান্ত। তাই তার কান দিয়ে হলকা বেরোচ্ছিল। সে জবাব দিতে পারছিল না কিছুতেই।
শেষকালে নিদারুণ ভয় পেয়ে দীপু যখন দরজায় ধাক্কা মারতে লাগল, তখনই হঠাৎ চিচিং ফাঁক হয়ে খুলে গেল দরজা। দিদি। ভিজে ভিজে দিদি। মুখময় জল চিক চিক। সামনের চুলগুলো সপসপে, জল ঝরছে। কানের লতি থেকে জলের ফোঁটা দুলছে। দিদি।
—‘দিদি।’ চাপা আর্ত গলায় ডাকল দীপু।
—‘চল্।’
—‘হঠাৎ শরীর-টরির খারাপ হল না কি?’
—‘চল্।’—দিদি দীপুর কাঁধ ছুঁয়ে। তাকে আলতো করে টান দিয়ে ঘরে যাচ্ছে। ঘরে টেবিলে দিদির বইপত্তর। ঘুরন্ত-চেয়ারে দিদির ছুটির দুপুরের মনোযোগ। ঘরে টিংকু। নতুন ঘাস।
রঞ্জা কেমন বীরাঙ্গনার মতো ঘরে ঢুকল। যেন ঘরে সশস্ত্র সেনাদল আছে। ঢুকলেই সে গ্রেপ্তার হবে, কিংবা শত শত বুলেট এসে ঝাঁঝরা করে দেবে তাকে। তবু সে সেই বিপদকে অগ্রাহ্য করে ঢুকে যাচ্ছে। পুরোপুরি নিরস্ত্র। মাথায় আধভেজা চুলের করুণ শিরস্ত্রাণ। ভিজে চিবুক দুমড়োনো বর্শার মতো বিফল উঁচিয়ে আছে। ঠোঁটের হাসি ভীত, সতর্ক, নিষ্প্রাণ। চোখ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। তার দীর্ঘ শরীর যেন ভেতরে ভেতরে কোর্ট মার্শালের জন্য সমর্পিত। পেছনে দীপু। তাকে এখন চোরের মতো দেখাচ্ছে। ঘরের মধ্যে টিংকু উঠে দাঁড়াল।
—‘বসো বসো’ রঞ্জাবতী উদারভাবে বলল, মনে মনে বলল, ‘এসেছ যখন!’
—‘দিদি, টিংকুর কথা তোমায় আগে বলা হয় নি’, অপরাধীর মতো দীপু বলল।
—‘তাই তো দেখছি’—রঞ্জার হাসিমুখের ভেতরে তীক্ষ্ণ শ্লেষ, না বলে যদি অ্যাদ্দিন চলল, তো এখনও চললেই তো পারত।
—‘আসলে খুব বেশিদিনের আলাপ নয়। এই গত অক্টোবর থেকে…ওর বাবার স্ট্রোক হতে ও পেনশনটা নিতে আসছিল…আলাপ হয়ে গেল…’
শুচিস্মিতা হয়ে রয়েছে রঞ্জাবতী, কথা বলছে না।
টিংকু বলল—‘আপনার কথা অনেক শুনেছি। অনেক দিন থেকেই আসবার ইচ্ছে। হয়ে উঠছিল না।’
ভদ্রতা না খোসামোদ? রঞ্জা মনে মনে জিজ্ঞেস করল। কিছু বলতেই হয়, সে বলল,
—‘ভালই করেছ। তোমার বাবা ভাল আছেন?’
—‘হ্যাঁ, বাবা এবারটা সামলে উঠেছেন। আমার ছোট বোন আছে। দিদি নেই।’
ঘুরে ফিরে খোসামোদের বৃত্তের মধ্যে চলে আসছে কথাগুলো। দিদির অভাবটা পূরণ করবার জন্যেই তাহলে ওর দীপ্রর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। দীপ্রর দিদিকে পাবার জন্য। ধরা যাক ব্যাংকে দেখা। ‘এই যে আপনার টাকাটা।’ দীপ্র বলছে। ‘থ্যাংকিউ’ জবাব। ‘আচ্ছা ইনি মানে পেনশন হোল্ডার আসছেন না ক’ মাস হল দেখছি। কিছু হয়েছে?’
—‘হ্যাঁ স্ট্রোক।’
—‘ইস্স্। এখন কেমন আছেন?’
—‘ভাল। আচ্ছা আপনার নাম কী?’
—‘আমি দীপ্র সেন। আপনি?’
—‘আমি টিংকু, টিংকু খাস্তগীর। আচ্ছা আপনার দিদি আছে দীপ্রবাবু?’
—‘হ্যাঁ, কেন বলুন তো?’
—‘তাহলে আপনার সঙ্গে ভাব করব। আমার দিদি নেই তো!’
এবম্বিধ সংলাপ মনে ভেসে উঠতেই এক চিলতে তেতো হাসি রঞ্জার মুখে ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল।
—‘কী খাবে? চা না কফি?’
—‘কিছু না। আপনি বসুন।’
আহা, কী মধুর! টিংকু খাস্তগীর (?) দীপ্রর দিদিকে দর্শন করতেই এসেছে। আর কোনও স্বার্থ নেই। নেই কোনও কৌতূহল!
—‘সবারই কফি আনি! তোমরা বসো!’ রঞ্জা আবার বেরিয়ে যাবার সুযোগ পেল।
পনেরো মিনিট পার হয়ে গেলে দীপু রান্নাঘরের দিকে গেল। দিদি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দীপুর দিকে পিছন ফিরে। জল ফুটে যাচ্ছে।
—‘দিদি!’
ভীষণ চমকে উঠে রঞ্জা গ্যাসের নব বন্ধ করে দিল, মন দিয়ে কফি করছে এবার। তাক থেকে বিস্কুটের টিন নামাল। নানখাটাই করে রাখে দিদি ওটাতে।
—‘দিদি আমার হাতে দাও, নিয়ে যাচ্ছি।’ সব কিছু সাজিয়ে সামনে থেকে রঞ্জা সরে দাঁড়াল।
দীপ্রকে বলল—‘তুই এগো, আমি যাচ্ছি পেছন পেছন।’
—‘কী অসাধারণ!’ নানখাটাইয়ে কামড় দিয়ে বলল টিংকু।
এই একটা কথা হয়েছে অসা-ধারণ। উপন্যাস অসাধারণ, ছবি মানে ফিল্ম্ অসাধারণ, বিস্কুট অসাধারণ। আর কী কী অসাধারণ হতে পারে? অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স্টাকে কতদূর টেনে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে? রঞ্জা কফিতে চুমুক দিয়েই মুখটা বিকৃত করে ফেলল, বড্ড গরম। আনমনা ছিল কি?
পরে টিংকু দীপ্রকে বলেছিল—‘আসলে মুখ বিকৃতির কারণটা কফি না, আমি। কফিটা উপলক্ষ।’ কে জানে, হতে পারে! মেয়েদের ইন্স্টিংট, অসাধারণ। দীপু বলল, ‘টিংকুর বাবা-মা, দাদা তোমার সঙ্গে আলাপ করতে চান দিদি।’
—‘আমার সঙ্গে!’ কেমন অবাক হয়ে বলল, রঞ্জা, তারপর বলল —‘তোমার বাবা এখন চলাফেরা করতে পারেন? আসতে পারবেন?’ অর্থাৎ রঞ্জা যাচ্ছে না। টিংকুর পিতৃকুলকেই আসতে হবে, সেই সাবেক কালের মতো। কন্যাদায় যখন তাঁদের। কন্যা নিজে বর সংগ্রহ করে নিলেও এই লজ্জাকর প্রথা, বরের দিদি-টিদির কাছে জোড়হস্ত হওয়া—এটা এই ভদ্রমহিলা নিজে একজন উচ্চশিক্ষিত এবং নিশ্চয়ই নারীবাদীও, সব শিক্ষিত মহিলাদেরই নারীবাদী হবার কথা, ইনি নিজে এই প্রথাটা টিকিয়ে রাখবার সপক্ষে কথা কয়ে ফেললেন। কোনও সামাজিক সংস্কারই নিজের জীবনে খাটাতে পারলেন না। বাঃ।
দীপু অপ্রতিভ হয়ে বলল— ‘উনি অল্পস্বল্প বেরোন ঠিকই। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তোমাকেই নিয়ে যাব একদিন।’
—‘আমি তো পাঁজি-টাঁজি দেখতে পারি না। নেইও’—এদিক ওদিক যেন পাঁজি খুঁজতে খুঁজতে বলে উঠল রঞ্জা। টিংকুর মুখ লালচে। দীপুর মুখ সাদাটে। রঞ্জার মুখ কেমন ভ্যাবলা মতো। ‘তোরা পুরুষ-টুরুত দেখে ঠিক করে নে না।’— রঞ্জা ওদের মুখের রঙ বদল লক্ষ করেছে কিনা বোঝা গেল না।
টিংকু উঠে দাঁড়াল। বলল—‘আচ্ছা আজ আসছি।’ তার গলায় রাগ, কান্না, হতাশা জমে আছে। নম্র, নত, দোলায়িত ধানের শিষ নেই এখন। স্মার্ট, সোজা, আত্মগরিমায় প্রদীপ্ত। টিংকুর পেছন পেছন দীপুও বেরিয়ে যায়।
—‘পৌঁছে দিয়ে আসি’—নিরীহ ভঙ্গিতে বললেও ভেতরে রাগ, হতাশা, হয়তো কান্নাও। যে দিদিকে দেখাতে এনেছিল সে দিদিকে দেখানো হল না। টিংকুর ঘাসোপম রূপটাও বড় ভাল লাগছিল, পাল্টে গেল কেমন।
বেশ খানিকটা পথ নীরব। শেষে দীপুই বলল—‘আসলে দিদি খুব হতভম্ব হয়ে গেছে। আমার উচিত ছিল বলে কয়ে নিয়ে যাওয়া।’ টিংকু কোনও জবাব দিল না। একটু পরে দীপু বলল—‘তুমি ঠিকই বলেছিলে, আমারই ভুল। ভেবেছিলাম সারপ্রাইজ দেব একটা।’ এখনও টিংকু কিছু বলল না। কিন্তু টিংকুর বাস চলে গেল, টিংকু উঠল না। এটা ভাল লক্ষণ। এর মানে দীপ্রর সঙ্গে হেঁটে যাওয়াটা টিংকু পছন্দ করছে। অর্থাৎ টিংকুর রাগ-অভিমান যা-ই হয়ে থাক না কেন, সেটা সামলে নেওয়া দুঃসাধ্য হবে না। বাস চলে গেল, মিনি চলে গেল একটা, পেভমেন্ট ধরে টিংকু হেঁটে চলেছে। তার পাশে একটু পেছন পেছন আসছে দীপু।
একটু ইতস্তত করে সে আবারও বলল—‘এখনই কোনও ওপিনিয়ন ফর্ম করে ফেলো না।’ টিংকু হেঁটে যাচ্ছে। কোনও জবাব দিচ্ছে না। রাস্তায় ভিড়। কখনও আড়ালে পড়ে যাচ্ছে টিংকু। আবার এঁকেবেঁকে তার সমলয় কক্ষে এসে পড়ছে দীপু। একটা অটো। বিনা বাক্যবায়ে অটোতে চড়ে বসল টিংকু। মুখ বাড়িয়ে বলল,
—‘ওপিনয়ন তো নয়ই। কোন ডিসীশনও নিচ্ছি না এক্ষুণি এক্ষুণি।
চলে গেল। ঠ্যাং-গড়াগড়, ঠ্যাং-গড়াগড় করতে করতে অটো চলে গেল দীপুর বুকের উপর দিয়ে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল দীপু সেইখানে, ঠিক সেই বিন্দুতে, বহুক্ষণ, কতক্ষণ সে জানে না। ফিরতে আরম্ভ করল তখন, যখন বোধোদয় হল নারীজাতি আদতে এক। কী টিংকু, কী রঞ্জা। ধরণধারণ এক রকম একেবারে। এই হইচই করছে, আদরে-আনন্দে গলে পড়ছে, সরলা বালিকা যেন, মুগ্ধা মনোমোহিনী, কোন মুহূর্তে নিষ্ঠুর ক্রূর, বাঘিনীর মতো হুড়মুড়িয়ে এসে ঘাড়ে থাবা মারবে কিচ্ছু বলা যায় না। এই প্রচণ্ড ভোগী। সিনেমা যাচ্ছে, নাচের টিকিট কাটছে, দেশ ভ্রমণে যাবার জন্যে এক পায়ে খাড়া। আবার দেখো সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, উদাসীন, হাসছে যেন এখুনি মরণসাগর পার হবে, কথা বলছে যেন শঙ্খমালার দেশ থেকে। অদ্ভুত!!!
ভূভারতে আর কোনও নামের মেয়ে জুটল না? টিংকু? সেই কবে কাবুলিওয়ালা নামে একটা ছবি হয়েছিল, ছোট্ট মিনির ভূমিকায় অভিনয় করেছিল টিংকু ঠাকুর বলে একটা গাবলু-গুবলু বাচ্চা। সেই থেকে এ বাংলায় প্রতি দশ জনের একজনের নাম হচ্ছে টিংকু। আচ্ছা টুকলিফাইং জাত বটে। উঠতে টুকলি বসতে টুকলি, মরতে বসেও বোধহয় টুকলি করবে! ফোঁশ করে একটা গরম নিশ্বাস ফেলল রঞ্জা। এত গরম যে নিজেরই হাতের পাতার উল্টো পিঠে পড়তে মনে হল আরেকটু হলেই ফোস্কা পড়ে যেত। সোজা হয়ে চলা, পরিষ্কার ভাবে কথা বলা এসব জিনিস শ্বশুরবাড়ি প্রথমে আসবার সময়ে শতকরা নিরানব্বই জন মেয়ে কেমন প্যাঁটরায় পুরে আসে! কেন রে বাবা! দুদিন বাদেই তো ফোঁশ করবি। মুখোশ গলিয়ে আসিস কেন? ওই যে একটা উচ্চারণের অযোগ্য শব্দ আছে! ব্রীড়া! কোন কাল থেকে যত রাজ্যের গুরুজন আর নাটক-নভেল সবাই মিলে আচ্ছা করে শিখিয়ে আসছে ব্রীড়াময়ী। তাই স্বাভাবিক হাসি, স্বাভাবিক কথা-বার্তা, স্বাভাবিক সব কিছু ব্ৰীড়ার আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে হবে। অপুর বউ যখন এসেছিল! তাকে অবশ্য রঞ্জাই এনেছিল। মুখই তোলে না। কথা বলতে গেলেই চোখের পাতা কাঁপে। গলার স্বর শোনা যায় না। দু’বছর যেতে না যেতে, একটা বাচ্চা হতে না হতেই সেই মেয়ে ফুলে ফেঁপে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে—কী কাণ্ড! যে পাঁচটা বছর এখানে ছিল নাকের জলে, চোখের জলে করে ছেড়েছে রঞ্জাকে। ভাগ্যে, অপুটা বদলি হয়ে গেল। ভাগ্যে ওদের চট করে কলকাতায় পোস্টিং দেয় না। নইলে ওই আশি কেজির রণরঙ্গিণীকে আবার ভোর সকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত সংসার রঙ্গমঞ্চে মহড়া দিতে দেখতে হলেই তো হয়েছিল। অপু, অপু নিজেই বা কী? বউয়ের হাঁক ডাক শুনে তার মন্তব্য—‘এতদিনে বাড়িটা জমেছে। বুঝলি দিদি, মা বাবা গিয়ে থেকে মরে ছিল, মনে হচ্ছে মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার হয়েছে।’ বলছে আর নিজের ঊরু চাপড়ে হাহা-হোহো করে হাসছে। হাসির উপলক্ষ কী? না বউয়ের সঙ্গে কাজের লোকের ধুন্ধুমার ঝগড়া।
—‘প্রাণ সঞ্চার? প্রাণ বলতে তুই কি বুঝিস তার উপর সবটা নির্ভর করছে’, রঞ্জা শেষ পর্যন্ত বলেছিল, ‘বাবা মা যাওয়ার পর থেকে বাড়িতে প্রাণ ছিল না? তিনটে বালক-বালিকা আর একটা তরুণী নিঃশব্দে নিয়ম মাফিক তাদের পড়াশোনা, খেলাধুলো কাজকর্ম করে যাচ্ছে, তার মানে তাদের প্রাণ নেই!’
—‘সরি দিদি, সে অর্থে সত্যিই বলিনি। প্রাণ মানে বেশ সাড়া-শব্দ জানান দেওয়া আর কি যে এখানে কেউ থাকে।’
—‘মা-বাবা থাকতে সে রকম সাড়াশব্দ ছিল বলছিস?’
—‘বাঃ, বাবার পিটুনি মনে আছে? দুই ভাই বোনে কাজিয়া হলেই বাবা কী রকম লাঠিয়াল হয়ে যেত। আর বাবা-মার দাম্পত্য ঝগড়া খুব নিচু টোনে হত কি? বাসন-মাজার অনিলার সঙ্গে মায়ের…
—‘কী জানি?’ রঞ্জা উদাস গলায়, উত্তর দিয়েছিল, ‘অনিলাকে অনর্থক কামাইয়ের জন্য যে বকত সে ছিল কর্ত্রী। দু’ একটা তিরস্কারের শব্দই তার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। আর বাবা-মায়ের দাম্পত্য ঝগড়া? তোদের মনে আছে? আমার তো মনেই পড়ে না, যদিও তোদের আগে এসেছি। বাবা যে বড় ছেলে বলে যে কদিন বেঁচে ছিলেন অতিরিক্ত আদরটুকু তোকেই দিয়ে গেলেন রে অপু! একদিন নীপুর সঙ্গে মারামারি করেছিলি বলে রাম ঠ্যাঙানি খেয়েছিলি বটে! তা সেটাই মনে রাখলি? আমার বাবার জন্মে আমি এ বাড়িতে এ রকম অশ্লীল চিৎকার শুনিনি।’ রঞ্জা কাগজ পড়ছিল, কাগজে মুখ ডুবিয়ে ফেলল। অনুমান করতে পারল অপুর মুখের রঙ বদলে যাচ্ছে। মুখের রঙ বদলে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বুকের রঙ-ও। রঙ-বদলের সময়ে মনে থাকে না অতীত জীবনের বর্ণ গন্ধের কথা। একটা ডিম চারটে ভাগ করে খাওয়া, দুধ-সাগুর মধ্যে গোলাপজলের সুগন্ধ। দিদির হাত ধরে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি যাবার পথে সঙ্ দেখা, জেলেপাড়ার সঙ। দিদির হাত ধরে প্যারা-টাইফয়েড পেরোনো, চিকেন পক্স পেরোনো। বাবার প্যান্ট কেটে প্রথম ফুলপ্যান্ট। একই শার্টের ফাটা কলার উল্টে বসিয়ে নতুন করে দিচ্ছে দিদি। আশ্বিনের আকাশের রঙ, বর্ষার গাছ-গাছালির রঙ। কিছুই মনে থাকে না। অতীত তার রূপরস নিয়ে বেমালুম গায়েব। বর্তমানের রঙটা কিছু কড়া। বড্ড বেশি কালচার্ড! কানে কত ডেসিবেল সয় কালচার্ডদের কে জানে। আসলে ওল্ড মেড! ক্কে বলল? কে বলল কথাটা? অপু? অপুর বউ? না অপুর সেই ভালগার শালী?
বুকের মধ্যে ওল্ড মেড শব্দের পাথর পুরে আয়না থেকে আয়নায় ঘুরে বেড়াল রঞ্জা। জানলার সার্সি, বাথরুম-আয়না, দেওয়াল-আয়না, হাত-আয়না। আয়নার মধ্যে তখন বিষাদও মধুর ছিল। কেমন এক উত্তেজক একাকিত্ব। সবে কিছুদিন আগে অপেক্ষা করে করে হতাশ উদ্দালক বিয়ে করেছে, উদ্দালক যার আবদার রাখলে ওল্ড মেড শুনতে হত না, উদ্দালক, যাকে ঠাট্টা করে ভাইবোনেরা দিদির তিন নম্বর বলত। ওল্ড মেড কথাটার মধ্যে একটা অবাঞ্ছিত গন্ধ আছে। কেউ নেয়নি, কেউ চায়নি তাই। কারুর মনে ধরেনি। অপু তোরা তো জানিস তা নয়। অপু, নীপু, দীপু! তোদের ফেলে যাওয়া গেল না। নীপু একটা সদ্যতরুণী মেয়ে, তাকে দাদা আর ছোট ভাইয়ের হেফাজতে ফেলে দুধে-আলতায় পা রাখা গেল না। যেত, যদি অপু তুই বুঝতিস, বুঝে জোর করতিস। বুঝতিস ঠিকই। কথার কথা বলতিসও ঠিকই। কিন্তু সে তো তোর মুখের বলা। বলতে বলতেই তোর মুখ শুকিয়ে উঠত। আর যদি কেউ চায়নি, কেউ নেয় নি এমনও হত! তাতেই বা কী! যদি কোনও পুরুষ তাকে না চায় তাহলে কি সে মেয়ে মূল্যহীন? দিদি হিসেবেও। যে দিদির হাত ধরে পুজো, মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি, যে দিদির হাতে খিচুড়ি-পায়েস, যে দিদির হাত ধরে চিকেন পক্সের রাত, সেই দিদি! মূল্যহীন! ওল্ড মেড! এই শব্দবন্ধের মধ্যে তোমাদের আক্ষেপ থাকা উচিত ছিল, কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত ছিল, মায়া থাকা উচিত ছিল, ব্যঙ্গ আসে কী করে? ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, তাচ্ছিল্য এ সব? আর সেই তিন নম্বর? উদ্দালক? সে কী? সে কেন? এক নম্বর, দু নম্বরকে বুঝতে পারা যায়। কিন্তু তিন নম্বরকে না। কোনও দিনও না। ওকে বোঝা গেল না, এই জাতীয় কোনও মায়াময় না বোঝা নয়। সোজাসুজি সাদা সাপ্টা গদ্যময় বোঝা গেল না। এক নম্বর ছিল পতু। পতাকী। দু’তিন বাড়ি পরে থাকত। ছোট থেকেই বাড়িতে খুব আসত। বাবা মারা যেতে পতু হল মায়ের অন্ধের নড়ি। বাবার অফিসের পি এফ-এর টাকা আনতে যেতে হবে পতু। লাইফ ইনশিওরেন্সের টাকা আনতে যেতে হবে, পতু। দীপুর তেড়েফুঁড়ে জ্বর এসেছে ডাক্তার ডাকবে পতু। যত বলে রঞ্জা ‘মা আমি তো আছি। আমি যাচ্ছি।’
—‘তুই? তুই একা? এ কি মেয়েদের কাজ?’
—‘যদি আর কেউ না থাকে তো মেয়েদেরই করতে শিখতে হয় মা, বোঝ না কেন!’
—‘চল। তুইও চল, কিন্তু পতুও চলুক।’
তাই পতাকী ভ্যাবলা চোখে চাইতে চাইতে একদিন খপ করে হাতখানা ধরে ফেলল। রঞ্জা। রঞ্জা। যেন গুড়ে মাছি পড়েছে। —‘রঞ্জা আমি তোমাকে বি-বিয়ে করব।’ হায়! হায়! রঞ্জাকে বিয়ে করবি কী রে? তোর বাপ কত আশা করে বসে আছে ছেলের বিয়েতে সোফা সেট, ফ্রিজ, মোটর সাইকেল নেবে নগদ ছাড়াও। খরচ করে বছরের পর বছর সি এ পড়াচ্ছে। রঞ্জাকে ঘরে তুলতে গেলে, বাবা-মা, পিসি, জেঠা সব যে হাউ-মাউ করে ঘরখানাই ভেঙে দেবে।
—‘তা হয় না পতাকীদা, আমাদের অবস্থায় বিয়ে করা চলে না। এইসব ছোটদের আমায় দেখতে হবে।’
—‘আমি দেখব রঞ্জা।’
—‘তুমি? এখনও তো বাবার পয়সায় সিগারেট খাও। মায়ের পয়সায় সিনেমা যাও।’
—‘রঞ্জা, তুমি বড় ঠোঁটকাটা।’
—‘একটা দোষ না কি আমার? আরও আছে। অনেক অনেক। লক্ষ করো। বেরিয়ে পড়বে। এখন যাই, হ্যাঁ?’
মা যখন শেষ শয্যায় বড্ড পতু পতু করেছিল। অপুকে দিয়ে ডাকতে পাঠাল রঞ্জা। এল জুতো মশমশিয়ে, সিল্কের পাঞ্জাবিতে হিরের বোতাম ঝলকাতে ঝলকাতে।
—‘বলুন মাসিমা।’
—‘পতু, তুমি বড় দায়িত্ববান ছেলে, বড় ভাল, আমায় একটা কথা দেবে?’
—‘কী কথা মাসিমা? সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয় দেব।’
—‘আমি আর বেশিদিন নেই। তোমার পাঞ্জাবিতে ও কী পতু? চোখ যেন ধাঁধিয়ে যাচ্ছে।’
—‘লাহা বাড়ি থেকে আশীর্বাদ করে গেল যে মাসিমা, আজ সকালেই। এই আষাঢ়েই বিয়ে। বলুক, কী বলছিলেন।’
—‘কিছু না পতু, এই অনাথ ছেলেমেয়েগুলোকে একটু দেখো।’
পতুকে দেখতে হয়নি। বাবার অফিসে এতদিনে কাজটা জুটল। টাকাকড়ি, ফিকসড্ ডিপজিট সব রঞ্জা একাই সামলাতে পেরেছিল। তার তখন কুড়ি একুশ। অপুর পনেরো, নীপুর তেরো আর দীপুর সাত।
দু নম্বরকেও বোঝা যায়। বাসে ট্রামে আলাপ। বাড়িতে আসতে শুরু করল। তা আসুক। দু’ভাই বোনকে ইংরিজি ট্রানস্লেশন দেখিয়ে দেয়, রঞ্জাকে ভাল ভাল বই পড়ায়। দীপুকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় যায়। রঞ্জা মনে মনে ভাবতে শুরু করেছে অরূপ তো বেশ একা। মামার বাড়ি থাকে। মা বাবা নেই, ভাই বোন নেই। তাদের বাড়িতে থাকতে কোনও আপত্তি হবার কথা নয়। অরূপের নিজের তো অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা একসঙ্গে পেয়ে গেছে এমনি ভাব। হবি তো হ’ লোভী মানুষের সামনে মিড্ল-ইস্টের পেট্রো ডলারের থলি পড়ল ঝুপ করে। অরূপ চলে গেল মধ্যপ্রাচ্য, সেখান থেকে কনট্র্যাক্টের পর কনট্র্যাক্ট শেষ করে অবশেষে সব পথ এসে মিলে যায় যেখানে সেই মার্কিন দেশে। ততদিনে রঞ্জাদের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক কোন দিন ছিল কি না, সেটুকুও কারও মনে নেই।
কিন্তু উদ্দালক? উদ্দালক যে আলাদা! সে পতাকী নয়। সে তো অরূপও নয়! উদ্দালক যে একেবারে রঞ্জার নিজের, রঞ্জার আপন, সেই মানুষটি যাকে খুঁজে পেলে বোঝা যায় খোঁজা শেষ হল। উদ্দালকের সঙ্গে যে কথা ছিল! সে যে কথা দিয়েছিল! উদ্দালক, উদ্দালক, তুমি এ কী করলে? এমন কেন করলে? এরা যে আমাকে ওল্ড মেড বলছে। বলছে বড্ড বেশি কালচার্ড। ওভার-রিফাইন্ড। প্রশংসায় বলছে না। সমীহে বলছে না, তাচ্ছিল্যে বলছে, আক্রোশে বলছে। উদ্দালক তুমি কোথায় গেলে? উধাও হয়ে হারিয়ে গেলে! অত প্রবল ভাবে যে থাকে সে কী করে আবার জীবন থেকে এমন নিঃশেষে হারিয়ে যায়?
দরজা বন্ধ করার শব্দ হল। খুব জোরে। খিলটা কেউ তুলে দিল আক্রোশের সঙ্গে। আচ্ছা, আচ্ছা, আক্রোশ নয়, অভিমান। এবার তাহলে দীপুর পালা। চোদ্দ বছরের ছোট ভাইটি আমার। ছোট্ট। একেবারে তুলতুলে বেড়ালছানার মতো। কোলে করে মানুষ করতে হয়েছে। সাত বছরে যে ছেলের মা চলে যায় সে কেমন কুঁকড়ে ছোট্টটি হয়ে যায়। সবাই দেখে বলত রিকেট না কী রে? এমন পুঁয়ে পাওয়ার মতো। হাতে করে তেল ডলে ডলে, গরস পাকিয়ে খাইয়ে খাইয়ে অনেক যত্নে বড় করা। তবু তেমন চৌখস হল কই? অপুর মতো, নীপুর মতো! কষ্টেসৃষ্টে বি. কমটা করল কোন মতে, তারপর লাগাতার ধর্না দিয়ে যাচ্ছে। যত তার মুখ শুকোয়, তত দিদির আদর বাড়ে, হাসি খুশি মজা। ছুটি পেলেই বেড়াতে যাওয়া। হোটেলে খাওয়া।
—‘দীপু রে, নতুন শাকাহারী হোটেল খুলেছে থিয়েটার রোডের কাছে, নাকি খুব ভাল।’
—‘চলরে দীপু, আর কোথাও না হোক বকখালি ঘুরে আসি।’ ‘বকখালিতে যাব না রে দিদি, কর্মখালি আছে কোথাও? কর্মখালি থাকে তো বল।’ ধুত্তেরি কর্মাকর্ম সব বিধির হাতে, মিছেই ভেবে মরি! যখন হবার হবে ক’বার কবে, এখন বাইয়া চলো তরী রে!’ ‘উঃ দিদি, তুই না!’ ‘সত্যি বলছি রে দীপু, ঠিক হবে। সব ঠিক হয়ে যাবে, শুধু শুধু উৎকণ্ঠায় দুশ্চিন্তায় ভুগে এমন দিনগুলো কেন নষ্ট করবি, বল?’ সেই হল। চমৎকার হল। টাই-ফাই হাঁকিয়ে দীপু কেমন ব্যাংক করে বেড়াচ্ছে দেখো। টু-হুইলার কিনল বলে! এখন বন্ধুরটা ধার করে চলছে। এবার কিনে ফেলবে। রঞ্জা অর্ধেক দেবে, দীপু অর্ধেক। কথা হয়েই আছে। আর এবার তো টিংকু এসে গেছে, টু-হুইলার না হলে তো আর চলবেই না। মানই থাকবে না আর। প্রেমিকের পিছনে বসে চুল আঁচল উড়িয়ে, এক মুখ হাসি ছড়িয়ে বোঁ-ও-ও করে হাইওয়ে দিয়ে! না হলে হয়! দীপু দীপু শোন ভাই। আমি তো ওরকম করতে চাইনি! একটু আন্দাজ দিসনি কেন! আমি অপুকে ছেড়ে দিয়েছিলাম, নীপুকে ছাড়তে পেরেছিলাম। জেনেছিলাম ছাড়তে হবে। প্রথম থেকেই তৈরি ছিলাম। তোর বেলায় আমি তৈরি ছিলাম না। সত্যি বলছি। দু’হাতে করে তেল ডলে ডলে বড় করা। দীপু অঙ্ক নিয়ে আমার কাছে বোস, বোস বলছি, আচ্ছা তোর বাংলা রচনা, ইংরিজি এসে স-ব আমি লিখে দেব। ওরকম গোঁজ হয়ে থাকিস না! সেই ভাই সাতাশ আটাশ বছর বয়স হয়ে গেল, চাকরি পায় না, দিদিকে চক্ষে হারায়। পুরীতে, শান্তিনিকেতনে বারবার দুজনে ঝুলি কাঁধে বেরিয়ে পড়া, শ্মশানে, মশানে। ঘাটে আঘাটায়। আবার চলে যায় দূরদূরান্তে। অমরনাথ, আন্দামান আইল্যান্ডস্। সুরাট, অমরকন্টক। চলে যায় চাম্বা, মাউন্ট আবু, কোদাইকানাল। রঞ্জা, তুমি তবে ভাই বেকার থাকায় বেশ খুশিই ছিলে! তোমার কব্জায় ছিল বেশ। না? বুদ্ধিশুদ্ধি কম, তেমন করিৎ-কর্মা চৌখস না, নিজেরটা গুছিয়ে নিতে অক্ষম, ভেবেছিলে চিরকাল তোমার তাঁবে থাকবে।
সত্যি ভেবেছিলাম। তাঁবে না থাকুক। সঙ্গী থাকবে সে আমার। ভিতরে ভিতরে এমনই একটা আশ্বাস দৃঢ় হয়ে বসছিল। ঠিকই। দীপু আর আমি। রঞ্জা আর তার চোদ্দ বছরের ছোট ভাই এই বাড়িটাতে সুন্দর করে হেসে-হেসে সংসার করে। বর-বউ না হলে কি সংসার হয় না? রঞ্জা তো সেই কোনকাল থেকে, পনেরো বছর বয়স থেকে ভাই বোনকে নিয়ে সংসার করে আসছে। কোন বিচারে সেটা সংসার হবে না বলে? বলো তোমরা? বাজার করা নেই, না মাসকাবারি নেই! বিছানা ঝাড়া রান্না বান্না। কাগজ-পত্রিকা। সময়ে বেরোনো। সময়ে-ফেরা। এঁটো হাতে আড্ডা গল্প চলছে তো চলছেই। ভিডিও-ক্যাসেট, বইমেলা, শাড়ির দোকান, সোয়েটার বোনা, কোনটা নেই? সেটাকে সংসার ভেবে রঞ্জা ভুল করেছিল? উঠতে দিদি, বসতে দিদি। ‘দিদি আমার প্রথম মাইনের শাড়ি।’ ‘এ কী করেছিস রে! এ যে অনেক দাম রে দীপু!’ ‘তোর চেয়ে বেশি দামি তো না! দিদি! দিদিমণি! দিদিভাই! এটা প্রথম মাইনের, তারপরে দ্বিতীয় মাইনের, তুই যে সেই শোকেসে দেখে বলেছিলি!’ মনে রেখে দিয়েছিস ভাইটি আমার! কবে পার্ক স্ট্রিট দিয়ে বেড়াতে যেতে-যেতে কোন দোকানের কাচের ওপারে কী শাড়ি ঝুলছিল। ‘ওরে দিদি ফ্লু-কে কখনও লাইটলি নিতে নেই। একদম বিছানায়। ভাপ নাও। আর কষে ঝাল দিয়ে মাংস-রুটি খাও। মুখে ভাল লাগছে না তো কী! পেটে খিদে আছে তো!’ ‘আমার পাশে একটু বোস না দিদি?!’ ‘তুই পড়া করছিস, কাল পরীক্ষা। আজ এখন বসব কী রে?’ ‘লক্ষ্মীটি দিদি, আমি কিচ্ছু করব না। পড়ব শুধু, তুই বোস।’ দিদির আঁচল মুঠোয় পাকিয়ে বসে অ্যাকাউন্টেন্সি পড়ছে ধাড়ি ছেলে। পরদিন পরীক্ষা। তাকে সঙ্গী ভেবে রঞ্জা ভুল করেছিল? ভুল। ভুলই তো! জীবন ধর্ম রঞ্জাকে পাশ কাটিয়ে গেল বলে কি আর ছ’ ফুট লম্বা একত্রিশ-বত্রিশ বছর বয়সের মোটর সাইকেল-কিনব-কিনব যুবাপুরুষকেও পাশ কাটিয়ে যাবে? যাবে না। তাই রাস্তার মোড়ে, ব্যাংকের কাউন্টারে, বাসের জানলায় ঘাস-ঘাস, ফুল-ফুল, লতা-লতা টিংকুরা দুই ভ্রূর মাঝখানে ছোট্ট টিপ পরে দাঁড়িয়ে থাকে। বসে থাকে। একদিন না একদিন ঠিক চোখাচোখি হয়ে যায়, হতে হতে, ঠিক ঘোর লেগে যায়। তারপর আর সব অবিকল অপুর মত, অপুরই মতো হবে তো!
দীপু আমি জানি, জানতাম সবই। তবু ভাবিনি। হয়তো আমার ভুল, আমার দোষ। টেবিলে কনুই দিয়ে মাথায় হাত এভাবেই বসে থাকে রঞ্জা। দড়াম করে খিল তুলে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে এভাবেই তাকে দেখে দীপ্র। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করে। তারপর নিঃশব্দে চলে যায়। টিংকুর সবুজ শাড়ি ভেদ করে দিদি ঢুকে পড়ছে। প্রচণ্ড রাগ, ক্ষোভ, হতাশা সত্ত্বেও। দিদি ঢুকে পড়ছে মাথার ভিতরে। দীপু তার প্রিয়ভঙ্গিতে নিজের ঘরের তক্তপোশে গিয়ে শুয়ে পড়ল। দুটো হাত কনুই ভেঙে পেছনে জড়ো করা, তার ওপরে মাথা। কড়িকাঠে দৃষ্টি। একটা পায়ের ওপর আর একটা পা। ভঙ্গিটা দেখলেই বুঝতে হবে দীপু কঠিন সমস্যায় পড়েছে।
সমস্যাই বটে। কী বলে গেল মেয়েটা! ডিসিশনটাও নিচ্ছে না এখ্খুনি এখ্খুনি। বাঃ! সব মেয়ের ভিতরেই তাহলে একটা ঘৃণ্য ঝগড়াটি থাকে। কোমরে আঁচল জড়িয়ে যে সুযোগ পেলেই মুখ নাড়া দেবে! বউদিকে দেখেছিল। বাপরে কী গলার জোর! চোখ তো রীতিমতো ঘুরত। ছোড়দি এ বাড়িতে থাকতে দাদার সঙ্গে খুব ঝগড়া করত। তবে তার মধ্যে ওই কুৎসিত ব্যাপারটা থাকত না। শ্বশুরবাড়ি তো বহু দূর। মুম্বই। সেখানে বরের সঙ্গে একা থাকে। কে জানে কী করে। তা এই ধনী, টিংকুরানি যিনি প্রভাতের শুকতারা সুদূর শৈল-শিখরান্তের মতো দেখা দিয়েছিলেন। ছোট্ট টিপ। মিষ্টি চুলের ফের। ঠোঁটে মধুর মধুর বংশী বাজে হাসি। এই সমস্ত ভেদ করে রাগী বেড়াল দাঁতে নখে ফ্যাচাক করে এইটুকুতেই বেরিয়ে এল? এইটুকুতেই! আচ্ছা এইটুকু কি না ব্যাপারটা বিচার করা যাক। দিদি খুব সম্ভব পড়ছিল। একেবারে অনন্যমনা হয়ে পড়ছিল। দিদির এই বিশেষত্বটা আছে। যখন কিছু করে খুব মন দিয়ে করে। যেন ডুবে যায়। ডুব ডুব ডুব রূপসাগরে এরকম একটা ভাব আছে দিদির। গাদিয়াড়া গিয়ে জলের দিকে চেয়ে অমনি হয়ে গিয়েছিল। যেন জলে ডুবে গেছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে কিছু। কিংবা শুধু দেখছে জলের তলার রাজ্য-অরণ্য-প্রাণী। এটা দিদির আছে। দিদি সেইভাবেই পড়ছিল। পরে একবার সুযোগ পেলে টুক করে দেখে নিতে হবে কী পড়ছিল দিদি। কোনও পত্রিকা, না বই। বই হলে গল্প উপন্যাস না কবিতা না কী। সব লেখাই নিশ্চয় সমান মনোযোগ আকর্ষণ করে না। যাই হোক্ দিদি নিবিষ্ট হয়ে পড়ছিল। পাকামি করে দীপু ‘সুধীন দত্ত’ বলল, ‘এই হল টিংকু’ এটাও বলল। যে দিদির সঙ্গে অত ঘনিষ্ঠতা, ন্যাংটো বয়সে মা, ইস্কুল পালানো ছেলের দিদিমণি, বেকারের মমতাময়ী সখী, এবং শ্মশানে রাজদ্বারে উৎসবে সর্বত্র বন্ধু, বন্ধু, বন্ধু, সেই দিদিকে সে টিংকুর কথা বলেনি। বলেনি কী ভাবে প্রথম আলাপ, প্রথম সিনেমা, প্রথম উট্রাম ঘাট, প্রথম টিংকুর বাবা-মা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিচ্ছুটি বলেনি, জানতে দেয়নি। বলল বটে সারপ্রাইজ দেবে। কিন্তু আনপ্লেজেন্ট সারপ্রাইজ হয়ে গেল। গায়ের সঙ্গে শাড়ির মতো লেপ্টে থাকা ছোট ভাই জীবনসঙ্গিনী খুঁজে পেয়েছে, প্রেম করে বেড়াচ্ছে, এত বড় খবরটা দিদির কাছে সুইস ব্যাঙ্কের লুকোনো অ্যাকাউন্ট করে রেখে দেওয়াটা কি ঠিক? হঠাৎ জীবনসঙ্গিনী কথাটা বুমেরাং-এর মতো ছিটকে এসে দীপ্রর বুকে আঘাত করল। জীবনসঙ্গিনী কে? তার এখন বত্রিশ বছর বয়স। এই বয়সটার মধ্যে সে কতবার ভেঙে ভেঙে গড়ে উঠেছে, কতবার গড়ে আবার ভেঙে গেছে, সেই জিরো আওয়ার থেকে বত্রিশ ইনটু বারো ইনটু চব্বিশ ঘণ্টা কে সঙ্গিনী ছিল? কে ছিল সেই অভয় বরদাত্রী? দিদি। সে যদি ছেষট্টি বছর বাঁচে তাহলে এই মুহুর্তে টিংকুকে বিয়ে করলেও সে কিন্তু অর্ধেকটা জীবনের সঙ্গিনী হচ্ছে, যে অর্ধেকটা অবন্ধুর, যে অর্ধেকটা ফলে-ফুলে ভরা অধিত্যকা, সমস্ত সংগ্রাম পিছনে পড়ে আছে। সেই সংগ্রামের সময়ের বেশি গুরুত্বপূর্ণ জীবনটায়ও একজন জীবনসঙ্গিনী ছিল। সবার থাকে না। তার ছিল। বড় চমৎকার ভাবে ছিল। সেই দিদিকে সে কিচ্ছু বলেনি। সে দিদিকে একেবারে এক ধাক্কায় মুছে ফেলতে চেয়েছে। এটাই সত্য। এই বিকট সত্যটা এখন তার মুখের দিকে ছৌনাচের রাবণরাজার মুখোশ হয়ে কটমট করে চেয়ে রয়েছে।
‘দিদি-ই-ই-ই একটা বুকফাটা ডাক দিল দীপু। মনে মনে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে দিদির দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। আমি যখন তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই। ‘দিদি-ই’ আস্তে ডাক দিল।
রঞ্জা উঠে দাঁড়াল। তার দীর্ঘ শরীরটা কেমন নমনীয় হয়ে গেছে। যেন ভেতরে হাড় নেই, সব কার্টিলেজ। সে কোনও মুদ্রা করেনি। হাত দুটো দুপাশে ঝুলছে। তবু দীপুর মনে হল দিদি রক্তমাংসের বরাভয়। এতক্ষণে হল। দীপু নত হয়ে বসেছে, তার হাতে ভিক্ষাপাত্র। দিদি দু’ হাত ভরে ঢেলে দিচ্ছে, ঢেলেই দিচ্ছে, চিরকাল যেমন দিয়ে এসেছে। তেমনই কি তারও চেয়ে বেশি। বড় করুণ সেই ভিক্ষাদান। দিদি তার শেষ সম্বলটুকু তার পাত্রে ঢেলে দিচ্ছে।
‘দিদি-ই!’ হাহাকার করে উঠল দীপু।
‘কীরে। কী দিদি দিদি করছিস তখন থেকে, খাবি চল,’ প্রসন্ন মুখে বলল রঞ্জা।
—‘তুই পড়ছিলি, ডিসটার্ব করলুম।’ বলতে বলতে বইটা তুলে নিল দীপু পেজমার্কে আঙুল রেখে খুলে ফেলল। ‘ক্রয়েটজার সোনাটা’, তলস্তয়। ‘খুব ভাল নাকি রে বইটা?’
—রঞ্জা কিছু বলল না। দীপু চেয়ে আছে দেখে বলল, ‘ভাল কি না জানি না রে দীপু। রিভীলিং। কীভাবে আমরা অহং-এ আবৃত থেকে মিথ্যা দেখি। মিথ্যা জানি। প্রিয়তম জনকে নিজের হাতে খুন করি। এই।’ দীপু কেঁপে উঠল। বলে উঠল, ‘দিদি দিদি, ফরগিভ মি। আমায় ক্ষমা কর দিদি।’ রঞ্জা যেন ভেতরে ভেতরে একটা শক খেয়েছে। এ কি কাকতালীয়? যদি তাই হয়, কী অদ্ভুত! ক্রয়েটজার সোনাটার শেষ উক্তি দীপু কেন বলল? কী করে বলল? তাহলে খুন করার আগেই যদি চৈতন্যোদয় হয় তবে তার চেয়ে আনন্দের ঘটনা এ পৃথিবীতে কখনও কোথাও ঘটেছে?
সে আস্তে বলল, ‘ক্ষমা কেন রে দীপু? আমি একটু হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলাম। তুই যদি ঘুণাক্ষরেও…আমারও বোঝা উচিত ছিল..বড় হয়েছিস…যথেষ্ট …চাকরির কনফার্মেশন হয়ে গেল… এবার তো সেট্ল করার সময়…’
—‘দিদি,’ আর্তগলায় দীপু বলল— ‘দিদি, তুইও তো বড় হয়েছিস যথেষ্ট, চাকরিতে কনফার্মেশন ছেড়ে কত উন্নতি… তোরও তো’। ‘বুড়ো হয়েছি, বড় নয়। যথেষ্ট। অনেক। একদিকে উন্নতি তো অন্য দিকে অবনতি। ডিসকোয়ালিফিকেশন। সময় আমাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছে।’ রঞ্জা যেন ফুঁপিয়ে উঠল। অথচ সে সোজা দীপুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। চোখ দুটো একটু নামানো, কিন্তু দেখা যাচ্ছে চোখের কোলে কোনও জল-টল নেই।
দিদির কপালে কাশের গুচ্ছ। দুই ভুরুর মাঝামাঝি একটা লম্বা রেখা। মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয়, মাঝে মাঝে মিলিয়ে যায়। পড়ার চশমা খুলে রেখেছে। পেছনে চোখ দুটি ক্লান্ত। চোখের পাতায় ক্লান্তির কালিমা। ক্লান্তি এবং ক্লান্তি।
ঝরঝর করে পাতা ঝরে পড়ছে। একটা করে দমকা হাওয়ার ঝাপটা আসে আর শূন্য থেকে শূন্যতর হয়ে যায় হেমন্তের বন। সেই ঝরাপাতার স্তূপ মাড়িয়ে মাড়িয়ে কোন নিরুদ্দেশের যাত্রী চলেছে। উড়ে কুন্তল, উড়ে অঞ্চল, উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল। মত্ত বোল। শঙ্খধ্বনি ভেসে আসছে, কে যেন জোকার দিচ্ছে। কেন? কেন? সই করা বিয়েতে শাঁখ বাজে কেন, উলু দেয় কেন? আলপনা! আলপনাও দিয়েছে অপুর বউ সেই মত্তমাতঙ্গী। গোল পদ্মের মাঝখানে পাথরের থালায় দুধ-আলতা কেন গো? এইসব না হলে হয় না? এক জোড়া নর-নারী মিলিত হবার সামাজিক আইনগত ছাড়পত্র পেল। তা বেশ তো? এ সব কেন? আহা সাধ। সব মেয়েরই সিঁথিময়ূর পরতে সাধ যায়, সাধ যায় দুধে-আলতায় পা ভিজোতে, তাকে মনে করে শাঁখ বাজবে, উলু বাজবে, কপালে বরণডালা ঠেকবে, সব্বার এই সাধ গো দিদি। কে বলল? নীপু বলল। জানবে, ও জানবে। ও মেয়ে, ও বউ, ওরও একদিন বিয়ে হয়েছিল, ঘটা-পটা করে না হোক, সপ্তপদীর আলপনা এঁকে, অগ্নিতে লাজাঞ্জলি দিয়ে হয়েছিল। অপুরও হয়েছিল। রণরঙ্গিনী তখন শান্তরসের রসিকাটি হয়ে প্রবেশ করেছিলেন। মাসিমা ছিলেন, বরণ করেছিলেন। আহা, আমাদের হয়েছিল, টিংকু-দীপুর কেন হবে না গো? করুণায় সব বিগলিত হয়ে জাহ্নবী যমুনার মতো বইতে থাকে।
ফুলের গন্ধে যেন বান ডেকেছে। কী করেছিস রে তোরা? কোথা থেকে এত! চম্পা, চম্পা, তীব্রগন্ধী রোশনাই-ভরা রঙ চাঁপায় ছেয়ে গেছে ঘর, থোকা থোকা চাঁপা, আর রজনীগন্ধা! ওহ, যেন কাল রজনীতে আস্ত একখানা ঝড়ই বয়ে গেছে রজনীগন্ধা বনে। ওই সব রজনীগন্ধার ঝাড় দীপুর ঘরে এসে আছড়ে পড়েছে, ঢলাঢলি করছে। দরজা বন্ধ করে রেখেছিল। সবাই মিলে থালা ভরে বাটি ভরে খাওয়া-দাওয়ার পরই হাট করে খুলে দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে দুকূল পাগল-করা গন্ধের বন্যায় ভেসে গেল সব। আর সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল বিসমিল্লা। ব্যাস, যেখানে যেটুকু বাঁধ ছিল, সব, স-ব ভেসে গেল। ওরে তোরা কী জানিস এখানে একজন আছে নিয়তি যাকে চিরটা কাল রূপসরোবরের তীরে হাত পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। যার ইন্দ্রিয়গুলো তোদের মতো ভোগে মর্চে-পড়ে-যাওয়া নয়। বঞ্চনায়, ত্যাগে শিল্প-রস-সুধার নিত্য অভিষিঞ্চনে ধারালো হয়ে আছে, সূক্ষ্ম সুরশ্রুতিগুলোও তার চেতনায় ধরা পড়ে যায়! রঞ্জা সমস্ত শরীরে একটা প্রবল গতি নিয়ে তার নিজের ঘরে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল। বিদায় জানাল না। শুভরাত্রি, শুভ কামনা, আশীর্বাদ কিছু না, কিচ্ছু না। সে দরজা বন্ধ করে দিল। জানলা বন্ধ করে দিল। প্রবল বেগে পাখা চালিয়ে দিল। আলো নিভিয়ে দিল। তারপর মেঝের উপর ঝড়ে-ভেঙে পড়া রজনীগন্ধার ডাঁটির মতো লুটিয়ে রইল। পাখার হাওয়ায় তার শাড়ি উড়তে লাগল।
ওরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। অপু নীপুর দিকে, নীপু অপুর বউয়ের দিকে। অপুর বউ টিংকুর দিকে, টিংকু দেওয়ালের দিকে, দীপু নীপুর দিকে, তারপর টিংকুর দিকে, তারপর মাটির দিকে।
শেষে নীপু বলল, ‘কী হল? হঠাৎ?’
দীপু বলল—‘দেখব? ডাকব?’ টিংকু শিউরে উঠল। অপুর বউ তার দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে বলল, ‘খেপেছ? ডাকবে কাকে? যে উঠে গিয়ে হঠাৎ করে দোর দিল, ডাকলে তার কী মূর্তি দেখতে হবে ভেবেছো?’
অপু বলল, ‘আঃ!’
অপুর বউ তার গোল মুখ আরও গোল করে বলল, ‘সঙ্কোচ কাকে? টিংকুকে? টিংকু তো এখন এ বাড়িরই একজন হয়ে গেল। আর সামলাতে তো হবে তাকেই।’
নীপু বলল, ‘দীপ তোরা ঘরে যা। টিংকু যাও ভাই।’
টিংকু চৌকাঠের এপারে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। দীপু তার পেছনে, মুখ ব্যথায় পরিম্লান। কার জন্য এ বেদনা দীপ্র? দিদির জন্যে? নিজের জন্যে? টিংকুর জন্যে? টিংকুর জন্যেই হবে হয়ত। এই বাড়িতে আজ তার প্রথম দিন। তা ছাড়া সামলাতে তো হবে তাকেই। যার জন্যেই হোক, বিসমিল্লার মিঞা মল্লার যে সৌরভ ছড়াচ্ছে, চম্পাবতী রজনীগন্ধারা যে সঙ্গীত বাজাচ্ছে তা সমস্তই জিভে বিস্বাদ ঠেকছে। আলুনি। অপুর বউয়ের গায়ে জোর খুব। সে ঠেলে দিল দীপুকে সামনে। দীপুর ঠেলা লাগল টিংকুর গায়ে। টিংকু টাল সামলাতে চৌকাঠ পার হল, দরজায় হাত রাখল। অপুর বউ বলল, ‘যাও।’ নীপু বলল, ‘দীপু যা, আর দেরি করিসনি,’ বলে সে-ও দীপুকে একটু মৃদু ঠেলা দিল, তারপর সান্ত্বনা দিতে বলল, ‘ভাবিসনি। আমরা তো আছি। দেখছি।’
দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
দরজার এপারে নীপু আস্তে আস্তে দিদির দরজার গায়ে কান পাতল। বেশ কিছুক্ষণ। অপু বলল, ‘কিছু শুনতে পাচ্ছিস?’
“উঁহু। শুধু পাখাটার চিক চিক শব্দ।’ অপুর বউ বলল, ‘যাক, তাহলে পাখার সঙ্গে দড়ি বেঁধে ঝুলে পড়েনি।’
নীপু চোখ বড় বড় করে বলল, ‘বৌদি!!’
অপু সজোরে বলল ‘ছিঃ।’
অপুর বউ বলল ‘দ্যাখো, আমি মুখ খুললে কিন্তু ব্যাপারটা ভাল হবে না। রয়ে বসে ছিছিক্কার করো। তোমাদের দিদিকে আমার চেয়ে বেশি কেউ চেনে না। ভাইয়ের ফুলশয্যে দেখে…’
অপু বলল, ‘চুপ! চুপ করবে তুমি। উঃ!’ ‘ভায়েরা ওঁর আঁচল ধরে বরাবরের মতো থুবড়ো হয়ে বসে থাকলে উনি ঠিক থাকতেন। ভায়ের বউ সইতে পারেন না। আমাকেও পারেননি। টিংকুকেও পারবেন না। কুরুক্ষেত্র শুরু হল বলে দিচ্ছি আজ থেকে। এখন এই রাত্তির এগারোটা বেজে সাতাশ মিনিট থেকে। দেখে নিও।’ সে দাঁড়াল না। ধম ধম করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। নীপু বলল, ‘কী ভয়ানক সমস্যা! দাদা, দিদি এমনি করে ধৈর্য, আত্মসংযম হারিয়ে ফেললে কী হবে?’ অপু অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘কী আর হবে! আমি গেছি! দীপুও যাবে। অন্য কোথাও চলে যেতে হবে।’
‘তারপর দিদি একা?’
—‘একা তাই তো! অপু কেমন মুশকিলে পড়ে গেল। নীপু ধরা গলায় বলল, ‘কত সহজে বলতে পারলি দাদা, কোথাও চলে যাবে দীপু। দিদির কী হবে? দিদি দীপুকে ছেলের মতো মানুষ করেছে। দীপু তো দিদির ছেলেই। আমাদের জন্যেও সব, স-ব দিয়েছে দিদি। কিন্তু দীপুর জন্যে দিদির…’ গলায় শব্দ আটকে যেতে লাগল নীপুর। অপু নরম গলায় বলল, ‘আমি ভাবতুম, দীপু বিয়ে করবে না। ভাল’ই হবে সেটা দিদির পক্ষে। খুব স্বার্থপরের মতো ভাবনাটা আমি জানি। কিন্তু ভেবেছিলুম। খবরটা শুনে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলুম। তারপর এসে দেখি দিদি বাজার হাট করে, গয়না-টয়না গড়িয়ে, এক কাণ্ডই বাধিয়েছে। তখন খচখচানিটা চলেই গিয়েছিল। কেয়াটা বড্ড মুখরা, হয়তো টিংকুর সঙ্গে দিদি পারবে। কিন্তু…’
‘পারতেই হবে। টিংকুকে, দীপুকে মানিয়ে নিতে হবে, এ ছাড়া কোনও উপায় নেই। দাদা, তোরা এইভাবে ভাব। আর কোনও বিকল্প নেই। আমি বোঝাব, দিদিকে বোঝাব।’ দীপু দিদির ঘরের দিকে যাচ্ছিল। অপু তার হাত ধরল, বলল, ‘আজ না নীপু, এখন না। এখন ছেড়ে দে।’
চৌকাঠের ওপারে দীপু আর টিংকু মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। চুপচাপ। পাথরের পুতুলের মতো। ঘরে ঢুকেই বোতাম টিপে মিঞা কি মল্লার থামিয়ে দিয়েছিল দীপু। হঠাৎ টিংকু বিদ্যুৎদ্বেগে পেছন ফিরে খাটের উপর ফুল সরাতে লাগল। গোছা গোছা চাঁপা, ঝাড়-ঝাড় রজনীগন্ধা খুব উত্তেজিতভাবে সব সরিয়ে এক পাশে জড়ো করতে লাগল। দীপু বলল, ‘কী করছ? কী করছ টিংকু?’ সে বাধা দিতে গেল। টিংকু জলভরা চোখে বিদ্যুৎ হেনে বলল, ‘ঠিকই করছি। ফুল-টুল, রোম্যান্স আমার জন্যে নয়। আমাদের জন্যে শুধু সাদামাটা একটা বিছানা…এই যথেষ্ট! এই যথেষ্ট’ সে দুহাতে মুখ ঢেকে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকল।
ফুলগুলো আবর্জনার স্তূপের মতো ঘরের একপাশে গাদাগাদি রইল। তাদের গন্ধটা যেন চটকে গিয়ে কেমন বিশ্রী লাগতে লাগল। দীপু বলল, ‘টিংকু, টিংকু, অত চট করে ভেঙে পড়ছ কেন, সামনে অনেক দিন পড়ে আছে।’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আছে। কিন্তু এইটা প্রথম। প্রথম দিন। প্রথম দিনটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে বাকি দিনগুলো কেমন হবে!’
‘তা নাও হতে পারে টিংকু,’ অসহায়ের মতো বলল, দীপু, ‘একটু আশাবাদী হও। আমাকেও একটু আশা দাও!’ তার গলায় ভিক্ষা, অনুনয়। জবাবে টিংকু কাঁদতে কাঁদতে তার বুকের উপর ভেঙে পড়ল। এবং যুবক-যুবতীর দেহসংস্পর্শের এমনই রসায়ন যে মহাশ্মশানের পশ্চাৎপটেও অপরিমেয় বিদ্যুৎ চমকায়।
রঞ্জার মনে হচ্ছিল সে বাবার মৃত্যুর দিনটাতে, মায়ের মৃত্যুর দিনটাতে ফিরে গেছে। তেমনই চরাচরব্যাপী অন্ধকার। শ্মশানভূমিতে বাসি মড়ার চিমসোনি গন্ধ। অসুখের গন্ধ। ওষুধের গন্ধ। মরণের গন্ধ। কিন্তু এ কেমন মরণ? জীয়ন্তে শিরদাঁড়া দিয়ে হিমের স্রোত নামছে। পেটের মধ্যে যেন এক ফাঁকা গহ্বর, ভয়, মাথায় গরম উনুন। কেউ নেই। কেউ কোথাও নেই। রঞ্জা একা। রঞ্জা তুমি একা। এই জীবন একটা দীর্ঘ সময়ব্যাপী কিচ্ছু না। ভয়ঙ্কর সব গুহার ছাদ থেকে কালো কালো কিচ্ছু না ঝুলছে। রঞ্জা দাঁড়াতে পারছে না, গুহার ছাদে মাথা ঠুকে যাবে। সে হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে চাইলে কিচ্ছু নার ভয়াবহ লতাগুলো ঝুলতে ঝুলতে তার সামনে এসে পেণ্ডুলামের মতো দুলতে থাকে। সে শুয়ে থাকতেও পারে না, কেমন ক্লেদাক্ত পিচ্ছিল মাটি। আর সবার উপরে তার মাথায় যেন রাবণের চিতা জ্বলতে থাকে। হঠাৎ এ কী হল? রঞ্জা যন্ত্রণায় মেঝেতে নিজেকে রগড়াতে থাকে, মাথা ঠুকতে থাকে। পাতা ঝরতে থাকে। ঝরারই সময় যে। ঝরতে ঝরতে অবশেষে তার অশান্ত শরীরটা চাপা পড়তে থাকে একটু একটু করে। শনশন হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। তেপান্তরের মাঠে বরফ পড়ছে। জনপ্রাণীও দেখা যায় না। বরফে, ঝরা পাতায় ক্রমশ চাপা পড়তে পড়তে ভূতগ্রস্ত সে বুকে হেঁটে এগিয়ে যায় মহাশূন্যতার কিনারের দিকে।
নীপু সারারাত ছটফট করেছে কেয়ার পাশে শুয়ে শুয়ে। সে বোম্বাই থেকে একা এসেছে। ছেলের পরীক্ষা এসে গেছে। বরের কাজ। সে একাই ছোট ভাইয়ের বিয়ের খবর শুনে আহ্লাদে আটখানা হয়ে চলে এসেছে। এই বাড়িতে ঢুকতেই যেন শত সহস্র মায়া-মমতার লতানো শেকড় তাকে চারদিক থেকে আঁকড়ে ধরে। সে দূরে থাকে, অনেক বাদে বাদে আসতে পায়। সে জন্যেই হয়তো এই বাড়ির মায়াময় দুঃখময়, সুখময়, আনন্দময় অতীত তার সমস্ত বর্ণ গন্ধ নিয়ে নীপার মনের মধ্যে জীবিত আছে। দিদি ভরসা, দিদি আশ্রয়। দিদি যতক্ষণ আছে কিছু ভাবতে হবে না। কোমল মুখ লাবণ্যের দিদি, চিবুকে টুলটুলে ঘাম, ডুরে শাড়ি। দিদির হাতে আদর মাখামাখি। আবার দিদি কঠোর, চোখে তিরস্কার, কালো শাড়ি, চুল উড়ছে। দিদির সমস্ত অবয়বে শাসন। দিদির বিনুনি দুলছে, পায়ে চটি, কপালে কুমকুম, চলরে আমরা সিনেমা দেখে আসি। দিদির ঘাড়ের কাছে নরম খোঁপা, নীল শাড়ি, মুখে চাঁদের হাসি, জুঁইয়ের আতর, দিদি-উদ্দালকদা। নীপা হঠাৎ চমকে উঠে বসে। সে সাবধানে বিছানা থেকে নেমে জানলার কাছে যায়। ঘোলা জলে ফটকিরি দিয়ে আঁধার কাটাচ্ছে কেউ। ব্রাহ্ম মুহূর্ত হবেও বা। সাবধানে নীপা দরজা খোলে। প্যাসেজ পার হয়ে দিদির ঘরের সামনে দাঁড়ায়। উল্টোদিকে পর্দা উড়ছে। বসবার ঘরের চৌকিতে দাদা ঘুমিয়ে কাদা। সে সন্তর্পণে কান পাতে। ঘরের মধ্যে একটা গোঙানির মতো শব্দ। ভয় পেয়ে আরও গভীর করে শোনার চেষ্টা করে সে। ‘তোরা বেরিয়ে যা, বেরিয়ে যা। বাস্টার্ডস! সোয়াইন!’ ‘দিদি,’ ভয়ে আকুল হয়ে নীপা দরজায় ধাক্কা মারে।’ ‘দি দি! দিদি!’ কোনও সাড়া নেই। অনেক চেষ্টায় বন্ধ জানলার খড়খড়ি খানিকটা তুলে সে দেখে দিদি মেঝের উপর এলিয়ে আছে। একখণ্ড ছেঁড়া কাগজের মতো। তার চোখ বোজা। মনে হয় সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে প্রলাপ বকছে। অন্ধকারে আর কিছু বোঝা যাচ্ছে না। দিদি কিছু খায়-টায়নি তো?
সে আবার জানলা ছেড়ে এসে দরজায় ধাক্কা দিল। ‘দিদি।’
এবার দরজা খুলে গেল। দিদির প্রেত। আগের রাতেই দিদিকে জীবন্ত দেখেছিল নীপা। এখন কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সেই দিদি প্রেত হয়ে গেছে। নীপা দিদিকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরল ‘দিদি, আমার সঙ্গে বম্বে যাবি? দিদি প্লিজ!’ সে ভিতরে ঢুকে এল। পেছনে দরজাটা ভেজিয়ে দিল চেপে। হঠাৎ রঞ্জার দু’ চোখ বেয়ে শীর্ণ জলের স্রোত নামতে লাগল। সে বলল ‘আমার কোনও জায়গা নেই যাবার। কোথাও, পৃথিবীর কোথাও আমার জন্যে জায়গা রাখেনি কেউ।’ নীপা বলল, ‘দিদি, আমি তো বলছি আমার সঙ্গে বম্বে চল।’ ‘সেটা তোর জায়গা নীপু, ভরে ফেলেছিস নিজেকে দিয়ে, আমায় ধরবে না। নীপু, আমায় আর কেউ ভোলাতে পারবে না, এতদিনে আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম আমার কেউ নেই, কিছু নেই, কোনও স্থান নেই, আমি কিচ্ছু পাইনি। কিছু পারিনি। কিছু না। কিচ্ছু না। একেবারে বৃথা। ব্যর্থ!’ নীপা বলতে গেল ‘এরকম করে বলিসনি দিদি। এটা ভুল।’ কিন্তু সেই দৃঢ় উপলব্ধির সামনে দাঁড়িয়ে সে কিছু বলতে পারল না। মনে হল সব কথাই খুব হালকা, খুব ছেঁদো, বাজে সান্ত্বনা বাক্য শোনাবে। শূন্যতার এই অতল গহ্বর সে ছুঁতেই পারছে না।
দীপুরা বেড়াতে চলে গেছে। অপু কর্মস্থলে ফিরে গেছে। নীপা আবারও বলল, ‘দিদি, আমার সঙ্গে চল।’
রঞ্জা ম্লান হেসে বলল, ‘তোর দেরি হয়ে যাচ্ছে নীপু, ওদের অসুবিধে হচ্ছে। আমি ঠিক আছি।’
বহু চেষ্টা চরিত্র করেও দিদিকে রাজি করাতে না পেরে নীপা ক্ষুন্ন উদ্বিগ্ন মনে চলে গেল। রঞ্জা তখন বিছানা ছেড়ে উঠল। ফ্রিজ খালি করে, সুইচ অফ করে দিল। সব জানলা দরজা একটা একটা করে বন্ধ করল। প্রত্যেক দরজায় একটা করে তালা লাগাল। তারপর পাতলা একটা ব্যাগে কিছু জামা কাপড় ভরে নিয়ে, সদরে তালা দিয়ে বেরিয়ে গেল। পাশের বাড়ির কাকিমার কাছে চাবির গোছাটা জমা রাখল। অফিসের ঠিকানায় একটা চিঠি ফেলল। তারপর তার চেনা কে ভদ্রমহিলার কাছ থেকে আর একটা চাবির গোছা সংগ্রহ করে ট্রেনে উঠল।
কোন ট্রেন কোথাকার ট্রেন এসব প্রাসঙ্গিক নয়। প্রাসঙ্গিক হল যে কোনও সময়েই যে কোনও ট্রেনেই মানুষের ভিড়। বড্ড ভিড়। অনাত্মীয় ভিড়। অনেকে আছে, তবু কেউ নেই এই জ্ঞানের মধ্যে স্বস্তি আছে অবশ্যই। কিন্তু শান্তি কই! চার্মিনারের উৎকট গন্ধ নাকের সামনে। পাশে টেরিলিনের ভেতরে ঘামের বোঁটকা গন্ধ আটকা পড়ে এক অদ্ভুত আঁশটে তীব্রতা সংগ্রহ করেছে। কালো দাঁত, শিরা-ওঠা হাতে মলিন ব্যাগ। আবার মোটা গাল, ভাঁজে অহঙ্কার, বোকামি, চোখে ধূর্ততা। ইতর ভিড়। দ্যাখে। আবার কিছুই দ্যাখে না রঞ্জা। চোখ অবধি পৌঁছয়। মাথায় পৌঁছয় না সব দৃশ্যাবলী। শব্দাবলী। কী নিবিড় বিরক্তি! একে কি বৈরাগ্য বলে? না বোধ হয়। যাবতীয় আসবাব, বাড়িঘর, তথাকথিত আপনজন, চেনা রাস্তা ঘাট এবং ফুল, গন্ধ, গান এ সব কিছুর প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণায় রঞ্জা এখন নিজেকে গৃহহারা করেছে। কোথাও একটা যাচ্ছে বটে, কিন্তু লক্ষ্য স্থির নেই। সে পালিয়ে যাচ্ছে। সব কিছুর থেকে, সবার কাছ থেকে। কিন্তু হায়, নিজের কাছ থেকে যে পালানো যায় না! তাই সাইকেল রিকশা যখন তাকে গন্তব্যের কথা জিজ্ঞেস করল, তখন সে প্রথমে কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। তারপরে মনে পড়ল ; ব্যাগ থেকে নোটবই বার করে খুঁটিয়ে বলল, ঠিকানাটা। ঝরঝরে ভাঙা বাড়িটা। ভাঙা গেট ঠেলে ঢুকতে ঢুকতে রঞ্জা ভাবল, ওরই মতো। জীর্ণ, বয়স্ক। একদিন অনেককে আশ্রয় দিয়েছে। তারা ভাবেনি এই আশ্রয় একদিন নিজেই নিরাশ্রয় হয়ে পড়বে। মালি বুধন বলল, ‘উপরের ঘর দুখানা সাফা রাখি মাইজি। নীচে থাকা যায় না।’ মোটামুটি ঝাড়পোঁছ করা হলেও অব্যবহারের ছ্যাতলা যেন ঘরগুলোর গায়ে লেগে রয়েছে। চারদিকে তাকিয়ে রঞ্জা বলল, ‘এই ভাল।’ সন্ধ্যা হয়ে আসছে, শেজ বাতি দিয়ে গেল বুধনের বউ। আগে ছিল শুধু আঁধার। এখন বড় বড় কালো কালো ছায়া ঘরময় ঘুরতে ফিরতে লাগল। বুকের ভেতরে ভূতের বাসা। বাইরেও তবে তাই-ই হোক।
ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে সুজনি, মাথার বালিশ, গায়ের চাদর, টেবিল-ঢাকা বার হল। আর একটা ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে চায়ের বাসন, স্টোভ। বুধন বলল, ‘আমরা তো চা খাই না। কাল বাজার থেকে এনে বিকেলবেলা দেব।’ খুব লজ্জিত মুখে সে তার বউয়ের রান্না মোটা রুটি আর ভিণ্ডি নিয়ে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘পয়সা টাকা কিছু দিয়ে রাখুন মা, কাল বাজার থেকে সব আনব।’ তাকে টাকা দিতে দিতে সে ভাবল কালকে পর্যন্ত, কাল বিকেল পর্যন্ত চা খাবার জন্যে, বাজার থেকে সংগৃহীত খাদ্য দ্রব্য এসব খাবার জন্যে বেঁচে থাকতে হবে। কী ভয়ানক!
বুধন চলে গেলে দরজা বন্ধ করে দিয়ে শূন্য দেওয়ালে ছায়া ফেলতে ফেলতে জানলার ধারে রাখা তক্তাপোশ সে শুয়ে পড়ল। সে মুখে চোখে জল দিয়েছে, হাত পা ধুয়েছে, ক্ষুনিবৃত্তি করেছে কলের মতো, কিন্তু জামাকাপড় বদলায়নি। যেমন ছিল শুয়ে পড়েছে। শাড়ির ভাঁজে ট্রেনের ময়লা, ব্লাউজে ঘামের ছোপ। জামা কাপড়গুলো তার শরীরে এঁটে বসে আছে। কিন্তু তার চৈতন্য নেই। সে শুয়ে আছে যেন একটা শবদেহ। নিঃগাড় ঘুমের জন্যেও তার কোন আকিঞ্চন নেই। আসলে আসুক, না আসলে নেই নেই। সে আসলে প্রস্তুত শেষ সর্বনাশের জন্যে। এমন কি সর্বনাশকেই সে আহ্বান করছে। যদি এই জীর্ণ বাড়ির ছাদটা তার উপর ভেঙে পড়ে? যদি উদরের ভেতরের শূন্যতা আস্তে আস্তে হৃৎপিণ্ডে এসে পৌঁছয়? শেষ হয়ে যাক। অনেক দিন আগেই শেষ হয়ে গেছে সে বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারেনি।
খুব ভোরবেলায় তার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম, না ঘোর সে জানে না। মনে হচ্ছে সারা রাত্তিরই জেগে থেকে মেরুদণ্ডে হিমবাহ অনুভব করেছে। কিন্তু কিছুটা সময় যেন স্মৃতি থেকে খসে গেছে, যে সময়ের মধ্যে আস্তে আস্তে আকাশের রঙ বদলেছে, ফুটে উঠেছে বাইরের দৃশ্যপট, এবং সমস্ত চরাচরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পাখিরা পরস্পরকে ডাকাডাকি করতে লেগেছে। বস্তুত, এই পাখির ডাকই তাকে জাগিয়ে তুলেছে। কচি শিশুর কলকলানির মতো ডাকাডাকি। চোখ বুজিয়ে বুজিয়েই তার মনে হচ্ছিল কে যেন তার মুখের দিকে চেয়ে নিঃশব্দে ভীষণ হাসছে। খুব চেনা লোক অনেক দিন পর পিছন থেকে টু দিয়ে সামনে এসে যেমন হাসে! যেমন হাসি দিয়ে ডাকে! চোখ খুলতেই জানলা দিয়ে প্রকাণ্ড একটা তারা দেখতে পেল সে। একটা অবাক কাণ্ড। সাদা, আলোময় একটা দিব্য বেলুনের মতো জানলার মাঝখানে ঝুলে আছে। এত বড় শুকতারা সে জীবনে কখনও দেখেনি। কিন্তু এটা শুধু প্রথম দেখার মনে হওয়া। দেখতে দেখতে দেখতে দেখতে তার যেন আবছা ভাবে মনে পড়তে লাগল দেখেছিল, সে দেখেছিল। অনেক কাল, অনেক যুগ আগে, কোনও এক পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে এই হাস্যকৌতুকময় তারার মুখোমুখি হয়েছিল সে। সে কি পৃথিবীর প্রথম ভোরে? প্রথমটা সে একেবারে হারিয়ে গিয়েছিল। বুঝতে পারছিল না কোথায় আছে। এমন কি সে কে। কী তার নামরূপ। সে পূর্ব জন্মের স্মৃতির পাতা উল্টে উল্টে নিজের পরিচয় খুঁজে বার করবার চেষ্টা করছিল। যখন পাহাড়ের চুড়োয় সে এবং ওই তারা। তারপরে হঠাৎ মনে পড়ল। এ জন্মের পরিচয়, এই মুহূর্তের পূর্ব-ইতিহাস সব মনে পড়ল। ব্যথা কমবার কড়া ডোজ খেয়ে ঘুমিয়ে ওঠবার পর যেমন আস্তে আস্তে ব্যথাটা আবার জানান দেয়, তেমনি। মুখ হাত ধুয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাগানে গেল। সে পালাচ্ছে। গেট খুলে রাস্তায়, রাস্তা পার হয়ে মাঠে। মাঠের মধ্যে দিয়ে সে হাঁটতে থাকল ভাবতে ভাবতে পৃথিবী তাহলে যুগের পর যুগ লাট্টুর মতো একই কক্ষপথ পরিক্রমা করে চলে শুধু তার ভেতরে কিছু প্রাণী নাটক করবে, দেখবে এবং শুনবে বলে! রাতের শিশিরে ভিজে মাঠ। লাল, বন্ধুর মাটি। মাঝে মাঝে ঘাসের ঝুঁটি, দিগন্ত বিরাট। এবং যতদূর চাও কোত্থাও কেউ নেই। ভোর আকাশের ফিকে তারারা হঠাৎ হঠাৎ দপ দপ করে উঠছে। তারপর একটা দুটো করে গাছ আরম্ভ হল। ক্রমশ আরও গাছ, আরও গাছ। শাল মহুলের বন। লম্বা লম্বা থোকা থোকা পত্রগুচ্ছ-ভরা বিশাল বিশাল বনস্পতি চারদিক থেকে তার সঙ্গে সঙ্গে একই অভিযানে চলতে লাগল। অনেক অনেক পরে রোদটা রীতিমতো গায়ে বিঁধতে নিতান্ত অনিচ্ছায় সে ফিরতে লাগল। একদিনে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে না জেনে। কীই বা লক্ষ্য? তা-ও তো স্পষ্ট করে জানা নেই! জঙ্গলের প্রান্ত থেকে দেখতে দেখতে পেল তার ভিলার গেটের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ফুটকির মতো। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ওই দেখতে পেয়েছে তাকে। ছোট্ট একটা দাঁড়ির মতো বুধন আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাচ্ছে। মাথায় গামছার ফেট্টি। হাঁটু অব্দি কষে মালকোঁচা মারা ধুতি। সাদা ধুতি, কালো বুধন, লাল গামছা, আলতা-সাদা ফুলে-ভরা লতার ফ্রেম পেছনে রেখে বুধন। মুখের দুপাশে হাত রেখে সে ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে চেঁচাচ্ছে ‘মা-আঁ-আ, মা-আ-আ।’ বাগানে কেঠো চেয়ার পেতেছে। পুরনো বেঙ্গল পটারির বড় মাপের কাপে কালচে রঙের চা পরিবেশন করেছে বুধন। রঞ্জা জিজ্ঞেস করেনি, কিন্তু সে খুব উৎসাহের সঙ্গে বলে যাচ্ছে এত সকাল-সকাল কোথা থেকে, কেমন করে চা জোগাড় হল। লাঠি বিস্কুটের সঙ্গে নিশ্চিন্তে চা খেতে দেখছে সে রঞ্জাকে। তারপরে দেখতে দেখতে হঠাৎই কেমন ভয়ের গলায় সে বলে উঠল, ‘মাইজি, জঙ্গলে ডাকু আছে, অত ভোর ভোর অত দূর একলা একলা যাওয়া ঠিক না।’ রঞ্জা বলল, ‘আমার কাছে তো ডাকাতি করার মতো কিছু নেই বুধন।’ মনে মনে বলল, ‘একা একা যেতে না পারলে যাবই বা কোথায়?’ তখন বুধন চোখ ভয়ে বড় বড় করে বলল, ‘শুধু ডাকু না মা, জঙ্গলে দেও আছে। বাপ রে।’
এবং নিজেকে পরিপূর্ণ একা জেনে, কোনও ভয়ের পরোয়া না করে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে পথ ভাঙে, টিলা পেরিয়ে যায় এক বিপন্ন অস্তিত্ব। পায়ের তলায় ঝুরঝুর করে ভেঙে গুঁড়িয়ে যায় লাল মাটি। লুকোনো গর্ত থেকে লাল পিঁপড়েরা সারে সারে বেরিয়ে এসে তার গুল্ফে কামড় বসায়। দুটো ঘাস দাঁতে চাবিয়ে লালমতো জ্বলুনির জায়গাটায় ঘষে দিয়ে, ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আরও অনেক দূর চলে যায় সে। উঁচু বাঁধের উপর দিয়ে ট্রেন চলেছে, পেছনে ধোঁয়ার স্তম্ভ টাল খেয়ে শুয়ে পড়েছে, অন্য দিকে মাথায় হলুদ লাল ফুল গুঁজে কালো পাথরের মেয়েরা সারি বেঁধে দুলতে দুলতে চলে যায়। প্রজাপতি ওড়ে, ফড়িং লাফায়। চলমান এই পৃথিবীর মধ্যে সত্যিকার গতিহীন, স্থাবর একমাত্র সে, যতই দু’ পায়ে চলুক। শাল মহুল পিয়ালের এই বনও দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সে-ও তো অন্যরকম তালের চলা চলে, ডালে ডালে। পাতায়, পাতায়। স্থবির সে নয়। বহু পুরনো বাকলের গাছও নতুন পাতায় ঝলমল করে মরশুমে, যখন শাল সেগুনে মঞ্জরী আসে তখন কেউ কি তার বয়স শুধোয়? শিমূল-পলাশ-মাদার-অশোকের ভেরী যখন বাজতে থাকে তখন সদ্য তরুণ মানুষের হৃদয় তরুণতর প্রাণের, জীবন্ততর অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়ার উন্মাদনা অনুভব করে। সেই ভিতরপানে নিতুই চলা জঙ্গলের অভ্যন্তরটিই কেমন করে পছন্দ হয়ে যায় তার। দেখে, এখানে প্রশান্ত মনে খেলা করে উঁচু উঁচু গাছ। স্তূপীকৃত শালপাতার উপর বসে পড়লে কেমন একটা সুখানুভূতি হয় শরীরের ভিতে। চারপাশে যেন অপার্থিব প্রাণীর পা। পা মাটিতে পুঁতে ঊর্ধ্বমুখে সব দাঁড়িয়ে আছে।
দু-তিন দিন যাবার পর বুধন আবার সাবধান করে দেয়। তবু রঞ্জা দমে না। মানুষ কিংবা দৈত্য, কেউই আর কোনও ক্ষতি করতে পারবে না তার। কিছুই যে আর হারাবার নেই! দুপুরবেলা বড় গরম। সকালে রোদ ওঠবামাত্র হাওয়া তাততে আরম্ভ করে। তাই খুব ভোরে বলতে গেলে মাঝরাত গড়িয়ে গেলেই, জঙ্গলে চলে আসে রঞ্জা। পাঁশুটে রঙের আকাশটা পুরো গায়ে জড়িয়ে। পাশ দিয়ে কাঠবিড়ালিরা দৌড়ে চলে যায়। কান খাড়া করে লাফিয়ে পালায় খরগোশ। আলোছায়ার জাফরির মধ্যে দিয়ে হেঁটে বেড়ায় সবুজ, হলুদ, খয়েরি, কালো পাখি। জঙ্গলের মধ্যে তাদের ডাকের ধার কমে গেছে। তারা যেন সমীহ করছে এই আলো-ছায়াকে, এই বিশাল বিশাল দৈর্ঘ্যকে, এই বিস্তারকে। কিন্তু মৃদু চাপা সুরের একটা জাল বোনাবুনি নিরন্তর চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। এখানে যদি কেউ বলল, চিঁউ চিঁউ, তো ওদিক থেকে আর কেউ বলে উঠবে চিঁক চিঁক। শর শর করে শব্দের ঢেউ তুলে কেউ এদিক দিয়ে চলে গেল তো, মিষ্টি সুরে কেউ দূর থেকে ক্রমাগত ডেকে যাবে কুব কুব কুব কুব কুব কুব। একবার ধরলে আর থামতে চাইবে না। কোথাও থেকে কামার পাখিও আওয়াজ করবে ঠুক ঠুক, ঠক ঠক, ঠুক ঠুক, ঠক ঠক। সকালে এই রকম। বিকেল বেলা রোদ পড়তে দেরি হয় কিন্তু রোদ্দুরে গেরুয়া রঙ ধরতে না ধরতেই রঞ্জা বেরিয়ে পড়ে। গেরুয়া যখন কমলা, তখন সে-ও বন ধরে ফেলেছে।
এইভাবেই যখন শালবনের বুকের ধুক ধুক তার অনেকটা রপ্ত হয়ে এসেছে, তখন একদিন সে দেখল সূর্য অস্ত যেতে যেতে দূরের বনে শাল্মলী তরুশ্রেণীর মাথায় আটকে গেল। গাছের মাথায় মাথায় যেন সে চাক বেঁধেছে। আর পশ্চিমে যাবে না। তার লাল রঙে সেই প্রচণ্ড আঁচ নেই। কিন্তু কেমন মৃদু, মদির মেদুর ঝাঁজ। দেখতে দেখতে তার চোখের মণির মধ্যে সেই লাল যেন নরম তুলতুলে তুলোর শলাকার মতো ঢুকে গেল। ছড়িয়ে পড়ল তন্তুতে তন্তুতে। কাঁচা শাল পাতার পুরু গদিতে সে বড় আরামে শুয়ে পড়ল। বড় সমর্পণে। অনেক উঁচুতে আঁকাবাঁকা ডালপালা আর পত্রালির মধ্যে দিয়ে সূর্যের ফেলা-যাওয়া গোলাপি-বেগুনি রঙে রাঙানো আকাশ। আস্তে আস্তে সেই বেগুনি ধূপছায়া, ধূসর হতে হতে, মধুর নীলবর্ণে আগাগোড়া রঞ্জিত হয়ে গেল। রঞ্জা আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল। যেন তার প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ শরীরের ভেতরের হৃৎপিণ্ড যকৃৎ, প্লীহা, পাকস্থলী, ফুসফুস, এমন কি শিরা, ধমনী, লসিকা গ্রন্থিগুলি পর্যন্ত নিবিড় ঘুমে ঢলে পড়েছে। এইভাবে কতক্ষণ কে জানে। সুযুপ্তি নীরব বিদ্রোহী। সময়ের ধার ধারে না। কিন্তু বোধহয়, যতক্ষণ তার প্রয়োজন ছিল তাজা হবার জন্য ততক্ষণই। কারণ তার চেতনা একটু মৃদু আলসেমি করেই হঠাৎ একেবারে পুরোপুরি জাগ্রত হয়ে উঠল। তার শরীরে তখন কোনও জড়তা নেই। গ্লানি নেই। গভীর ঘুম থেকে জেগে উঠে সে তখন পৃথিবীর প্রথম মানুষ। কিন্তু তার নামরূপ নেই, পরিচয় তৈরি হয়নি। জঙ্গলটাকেও সে চিনতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে সে একটা কুপের মধ্যে, একমাত্র আকাশের নক্ষত্র দীপিকাই তাকে জানিয়ে দিচ্ছে সে এখনও মর্ত্যেই। আশ্চর্য হয়ে সে বুঝতে পারল চার পাশের গাছগুলো আর আলাদা আলাদা নেই। তাকে ঘিরে তারা জমাট বেঁধে গেছে। নিচ্ছিদ্র। নিরন্তর। সবাই একত্র হয়ে জেগে উঠেছে। বোধহয় এখন মাঝরাত, যা নিশা সর্বভূতানাম্। কাঁচা শালপাতা আর মহুলের তীব্র গন্ধ এতটাই ঘন, ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তারপর সে অনুভব করল কেউ তাকে ঘিরে ধরছে, উপুড় হয়ে পড়ছে তার উপর। ভার নেই, অথচ স্পর্শ আছে তার। সেই স্পর্শে তার চোখের পাতা, ওষ্ঠাধর স্তনবৃন্ত, নাভি, জানু সন্ধি তীব্র আনন্দে শিউরে শিউরে উঠছে। আকাশে কে হঠাৎ দ্যুতিমান জড়োয়া হার ছিঁড়ে ফেলল একখানা। সেই হিরের মতো জ্যোতিষ্করা তার শয্যা লক্ষ করে বহু সহস্র হুলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি হয়ে নেমে আসতে লাগল। এবং সে অকস্মাৎ বুঝতে পারল দেও, শাল, মহুল, সপ্তপর্ণী, শাল্মলীর ভিতর ঘরে যে কতকাল থেকে একলা একলা বিহার করে আসছে, বুধন-কথিত সেই দেও আজ সত্যিকারের একলা আরেকজনকে পেয়ে তার অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে।
রবিবার সকালবেলা। আগের দিন প্রচণ্ড কালবোশেখি হয়ে গেছে। কয়েক দিন চোত মাসের জ্বলি-জ্বলি গরমের পর স্নিগ্ধ বাতাস। সাদা টার্কিশ তোয়ালে দিয়ে জোরে জোরে তার শ্যাম্পু করা চুলের গোছা মুছছিল টিংকু। সে দীপুকে ধমক দিয়ে যাচ্ছে দাড়ি কামাবার জন্য। রবিবারের অজুহাতে এদিকে দীপু গড়িমসি করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে। এখুনি দুজনে মিলে বাজার করতে যাবে। উপরন্তু আজ অতিরিক্ত কাজ আলো পাখা পরিষ্কার করা, সব ঘরের ঝুলঝাড়া। টিংকুরও কাজ। পর্দা, বিছানার চাদর-বালিশের ওয়াড় পাল্টাবে। তারপর রবিবার সকালের মেনু রান্না হবে। স্রেফ ভাতে ভাত। সুগন্ধ চালের ভাত। আর আলু-উচ্ছে ভাতে, মটর ডাল, বড়ি-বেগুন ভাতে, পোস্ত ভাতে, এবং গোটা গোটা কষকষে কাঁচা লঙ্কা। এটা টিংকুর বাপের বাড়ির রীতি, সে-ই চালু করেছে। বিকেল বেলা দুজনে বেড়াতে যাবে, টিপটপ সেজে, কিন্তু কোথায় যাবে ঠিক করবে না আগে থেকে। বাড়ির দরজা পেরিয়ে পথে নামবার আগে পর্যন্ত না। যেদিকে ইচ্ছে যাবে। যেখানে ইচ্ছে যাবে। যা খুশি। এটা চালু করেছে দীপু। টিংকুর হিসেব-কষা মনকে সে প্রতি রবিবার হারানো ছড়ানো পাগল করে দিতে চায়। ঠিক আছে। তাই হোক। কিন্তু তুমি দাড়িটা জলদি জলদি কামিয়ে নাও দীপু। আর কত দেরি করবে? এই তকরারের মাঝমধ্যিখানে হঠাৎ দীপু চকিত হয়ে বলে উঠল, ‘দিদি, দিদি আসছে।’ সে এক লাফে খবরের কাগজটা লণ্ডভণ্ড করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। টিংকুর হাত থেকে তোয়ালে খসে গেছে। সে পুতুলের মতো দরজার দিকে ফিরল। হাতে একটা পাতলা সুটকেস, রঞ্জা ঢুকছে, যেন সে প্রতিদিন ঠিক এই সময়ে এইভাবেই ফেরে। সুটকেসটা দীপুর বাড়ানো হাতে চালান করে দিয়ে সে অদ্ভুত একটা হাসির উদ্ভাসে একেবারে এক মাইল শান্তি কল্যাণ ছড়িয়ে নিতান্ত সহজ যোগে বলল—‘এক কাপ ভাল দেখে চা খাওয়া তো টিংকু।’