পাতিলেবু

পাতিলেবু

ধূর্জটিনারায়ণ তলাপাত্রর অফিস ছোট, কিন্তু খরচ করে সাজানো। খরচ বেশ ভালোই হয়েছে। তবে খরচ করে ধূর্জটিনারায়ণ দুরকম সুবিধে পেয়েছেন। প্রথম সুবিধে হাতেকলমে, দ্বিতীয়টি কৌশলগত।

আগে প্রথম সুবিধেটির কথা বলা যাক।

অফিস দেখতে সুন্দর হয়েছে। সাজানোর কাজ করেছেন ইন্টিরিয়র ডিজাইনার হরিমতি শর্মা। এই মহিলা অফিসঘর সজ্জায় সবিশেষ নাম করেছেন। তিন বছর আগে হংকং-এর এক ইন্টিরিয়র ফেস্টিভালে তিনি ‘অফিস সুন্দরী’ খেতাব পান। খেতাবে নগদ টাকা ছিল না, শুধু সার্টিফিকেট ছিল। তাতেই হরিমতির কাজ হয়েছে। রেট ডবল হয়ে গেছে। হরিমতির বৈশিষ্ট্য হল, তিনি অফিস সজ্জায় এফেক্ট দেন। কখনও গুহা এফেক্ট, কখনও পাখির বাসা এফেক্ট, কখনও নৌকো এফেক্ট। নৌকো এফেক্টে ঘরের দেওয়ালে টাঙানো থাকে মাছধরার জাল। বসের টেবিলের পাশে রাখা হয় নৌকোর ওরিজিনাল হাল। পার্টিকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, এতে ডিজাইনও হল, আবার প্রতীকও হল। অফিসের হাল থাকে বসের হাতে। তাই বসের টেবিলের পাশে হাল। এই ব্যাখ্যায় পার্টি খুশি হয়। ওরিজিনাল নৌকোর হাল আনার ব্যাপারে দরদাম করে না। মোটা বিল পাস হয়ে যায়।

হরিমতি ধূর্জটিনারায়ণের অফিসে দিয়েছেন পাতিলেবু এফেক্ট। টসটসে পাতিলেবুর মতো দেওয়ালে চাপা হলুদ সবুজ রং। জানালায় হলুদ সবুজ পরদা। চেয়ারে হলুদ সবুজ রঙের গদি। টেবিলে হলুদ সবুজ রঙের টেবিল টপ। ঘরে জ্বলছে হালকা সবুজ আলো। সেই আলোর ভেতরে হলুদের শেড। এসি চলছে খুসখুস করে। ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব। বেশিক্ষণ থাকলে ঠান্ডা ভাবে পাতিলেবুর গন্ধ পাওয়া যায়। কাজ শেষ হওয়ার পর ধূর্জটিনারায়ণ মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘এটা কী করে সম্ভব হল! ঠান্ডায় লেবুর গন্ধ! আপনি কি এসি মেশিনের ভেতর পাতিলেবু টিপে দিয়েছেন মিসেস শর্মা?’

হরিমতি গম্ভীরভাবে বলেছিলেন, ‘না, পাতিলেবু টিপে দিইনি। এটা আসল গন্ধ নয়। এটা হ্যালুসিনেশন।’

‘হ্যালুসিনেশন! সেটা কীরকম?’ ধূর্জটিনারায়ণের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়।

হরিমতি হংকং থেকে খেতাব আনার আগে সর্বদা হাসিমুখে থাকতেন। হাসিমুখে ক্লায়েন্টকে ম্যানেজ করতে সুবিধে। পুরস্কার পাওয়ার পর গম্ভীর হয়ে গেছেন। গম্ভীর অবস্থাতেই বললেন, ‘স্মেল হ্যালুসিনেশন। গন্ধের বিভ্রান্তি। ঘরের ইন্টিরিয়র এই বিভ্রান্তি তৈরি করছে। আমি যখন পাখির বাসা এফেক্ট দিই তখন অফিসে গাছপালা, ফুল-ফলের গন্ধ পাওয়া যায়। গুহা হলে এক ধরনের পাথুরে ভেজা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নাকে লাগবে। খুব তীব্র কিছু নয়, হালকা, কিন্তু লাগবে। এটাও সেরকম।’

ধূর্জটিনারায়ণ গদগদ গলায় বললেন, ‘আহা! অপূর্ব! অনবদ্য!’

হরিমতি আরও গম্ভীর হয়ে যান। বলেন, ‘এর জন্য কিন্তু আলাদা পেমেন্ট লাগবে।’

ধূর্জটিনারায়ণ আকাশ থেকে পড়েন। বলেন, ‘বিভ্রান্তির জন্য আলাদা খরচ।’

হরিমতি বলেন, ‘অবশ্যই আলাদা খরচ। যে-কোনও সাজসজ্জার মূল কথা হল বিভ্রান্তি। সাজসজ্জার নিজের কোনও দাম নেই, তার দাম বিভ্রান্তিতে। যার যত বিভ্রান্তি তার দাম তত বেশি। এই যে মেয়েরা সাজগোজ করে, সে তো বিভ্রান্ত করার জন্যই। ওরিজিনাল চেহারাকে আড়াল করে বিভ্রান্ত করে। আপনি যে এত খরচ করে অফিস সাজালেন তার উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য একটাই— ক্লায়েন্টকে বিভ্রান্ত করা। আপনি যা যা বলবেন, ক্লায়েন্ট যেন তাতে বিভ্রান্ত হয় এবং সোনামুখ করে মেনে নেয়। তাই তো?’

অব্যর্থ যুক্তি। ধূর্জটিনারায়ণ অনেক ভেবেও এই যুক্তি খণ্ডন করতে পারেননি। বরং এই যুক্তিকে তিনি অফিসঘর সাজানোর দ্বিতীয় সুবিধে হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কাজের কৌশলের সঙ্গে ‘বিভ্রান্তি’কে জড়িয়ে নিয়েছেন।

ধূর্জটিনারায়ণ তাঁর পাতিলেবু অফিসে বসে আছেন। টেবিলের ওপর খোলা ল্যাপটপ। ধূর্জটিনারায়ণের ভুরু কুঁচকে আছে, কপালে ভাঁজ। তিনি অল্প অল্প মাথা নাড়ছেন। মনে হচ্ছে, ল্যাপটপে কিছু খুঁজছেন। খুঁজছেন, কিন্তু পাচ্ছেন না। খোঁজার সময় কিছু না পেলে মানুষের চোখমুখের ভঙ্গি এরকম হয়। খানিকটা বিরক্তি, খানিকটা রাগ, খানিকটা হতাশা। ধূর্জটিনারায়ণ তলাপাত্র ‘হতাশা’ অংশটা গোপন করে রেখেছেন। তিনি এমন একটা ব্যবসা করেন যেখানে পার্টিকে মনের সব অভিব্যক্তি দেখানো চলে, কিন্তু হতাশা দেখানো চলে না।

ধূর্জটিনারায়ণ তলাপাত্র ল্যাপটপে কী খুঁজছেন? কিছুই খুঁজছেন না। তিনি ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েও নেই। তাকিয়ে আছেন একটা ডায়েরির দিকে। নধর সাইজের ডায়েরি। ডায়েরি ল্যাপটপের আড়ালে এমনভাবে রাখা যে উলটো দিক থেকে চট করে কেউ বুঝতে পারবে না। আসলে ধূর্জটিনারায়ণ কম্পিউটারে সহজ নন। তাঁর বিশ্বাস, এই যন্ত্রের মধ্যে এক ধরনের স্বেচ্ছাচারী ভাব আছে। নিজের খুশিমতো চলতে চায়। একে বাগে রাখবার প্রক্রিয়া জটিল। এই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে গিয়ে অনেক সময় মূল কাজ পণ্ড হয়ে যায়। আবার কম্পিউটার না রেখে উপায়ও নেই। দিন দিন কম্পিউটারের প্রতি বাঙালির হ্যাংলামো বাড়ছে। এখন আর মুদি দোকানের হাতে লেখা কাগজে মুসুর ডাল, পাঁচ ফোড়নের হিসেব বিশ্বাস হতে চায় না। শপিংমলের কম্পিউটারে লেখা হলে মনের ভেতর গদগদ ভাব তৈরি হয়। মনে হয়, ঠকলেও ক্ষতি নেই। কম্পিউটারের কাছে ঠকা একটা গর্বের ব্যাপার।

ধূর্জটিনারায়ণের ডায়েরি মেইনটেইন করবার অন্য কারণ হল, কাটাকুটি। তাঁর বিশ্বাস যে-কোনও লেখালিখিতেই কাটাকুটি অতি প্রয়োজনীয় একটা ঘটনা। কাটাকুটি মাঝেমধ্যে দেখতে হয়। দেখলে আগের ভাবনার সঙ্গে পরের ভাবনার তুলনা করা যায়। ঠিক, ভুল বোঝা যায়। নিজেকে শুধরানো যায়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও কাটাকুটিতে বিশ্বাস করতেন। সেই কাটাকুটি নিয়ে কম ‘আহারে উহুরে’ হয়নি। আইনস্টাইনের কাটাকুটি নিয়ে গোপনে গবেষণা হয়েছে। ‘ই ইজুকালটু এম সি স্কোয়্যার’ লেখার সময় তিনি ‘ই’-এর জায়গায় ‘এফ’ লিখেছিলেন কিনা তাই নিয়ে গবেষণা। মহান বিজ্ঞানীর কাটাকুটি তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছিল। ‘এফ’ কিছু হেলাফেলার জিনিস নয়। ‘ই’ যেমন ‘এনার্জি’, ‘এফ’ তেমন ‘ফোর্স’। গোপন গবেষণার খবর সবসময় পাওয়া যায় না। এটাও পাওয়া যায়নি। তবে রবীন্দ্রনাথ বা আইনস্টাইন কেউ কম্পিউটার ব্যবহার করেননি। ভাগ্যিস করেননি। কম্পিউটারে সব আছে, কাটাকুটির প্রভিশন নেই। লেখা মানে লেখা, মোছা মানে মোছা। সেখানে মাঝামাঝি কিছু হয় না।

ধূর্জটিনারায়ণ গভীর মনোযোগসহকারে ডায়েরির পাতা ওল্টাচ্ছেন। তালিকায় মোট একশো আঠেরোটা নাম। না, একশো ষোলোটা। দুটো নাম আজ সকালে কাটা গেছে। একশো ষোলোটা নামের পাশেই ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর, মেল আইডি। সঙ্গে নোট। যে-কোনও ধরনের নোটই সাধারণত কয়েক লাইনের হয়। এখানে একটা করে শব্দ। যেমন কমল মল্লিকের নামের পাশে লেখা ‘গান’। উদয়ন সেনশর্মার পাশে ‘কুস্তি’। সুচয়ন সমাদ্দারের গায়ে ‘কবিতা’। গৌরী নাগ পেয়েছেন ‘নারীমুক্তি ও নারী চেতনা’। কবু বসাকের ঘাড়ে ‘পকেটমার’। এইভাবে কোনও নামের পাশে ‘সমাজসেবা’, কোনও নামের পাশে ‘ডাকাতি’, ‘চন্দ্রগ্রহণ’, ‘শিল্প-কৃষি’, ‘বজ্রপাত’। এ ছাড়া আছে ‘প্রতিশ্রুতি’, ‘ধানের পোকা’, ‘হাঁচি-কাশি’, ‘মূল্যবৃদ্ধি’।

তালিকায় কাটাকুটি অজস্র। যেমন উদয়ন সেনশর্মা এখন যে ‘কুস্তি’ পেয়েছেন সেটা এসেছে তিনবার কাটাকুটির পর। একবার লেখা ছিল ‘সংগ্রাম’, তারপর হল ‘লোকসঙ্গীত’, পরে এল ‘দুর্যোগ’। ফাইনাল এসে থেমেছে ‘কুস্তি’তে। রাধাকান্ত পত্রনবিশের ‘চিটিংবাজ’-নিয়েও একই ব্যাপার। গোড়ায় ছিল ‘গল্পকার’, সেটা কেটে হল ‘শিল্প-কৃষি’। তাও আবার বাদ দিয়ে হয়েছে ‘রাস্তাঘাট’। শেষ পর্যন্ত ‘চিটিংবাজ’-এ এসে ঠেকেছে। ‘চিটিংবাজ’ও বেশিক্ষণ থাকবে কিনা সন্দেহ। ইতিমধ্যে নামের পাশে ছোট অক্ষরে ‘শিক্ষক’ লিখে একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন পড়ে গেছে। একই প্রক্রিয়ায় ‘সমাজসেবা’র আগে ‘ধর্ষণ’ লিখে কাটা হয়েছিল। ‘পকেটমার’ এসেছে ‘নেতা’ এবং ‘মহাকাশ’ বাতিল হওয়ার পর। ‘ভিক্ষুক’ বাদ গিয়ে হয়েছে ‘গান’। ‘বজ্রপাত’ জায়গা পেয়েছে ‘ভক্তিরস’ এবং ‘ধর্মকর্ম’কে সরিয়ে।

জটিল এই নোট দেখে কিছু বোঝা কঠিন। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, উন্মাদের কাণ্ড। একই লোকের পাশে কুস্তি এবং লোক-সঙ্গীত কীভাবে লেখা হয়? শিল্প-কৃষি বা গল্পকারের সঙ্গে চিটিংবাজের সম্পর্ক কী? যে এখন ‘সমাজসেবা’য় সে কীভাবে আগে ‘ধর্ষণ’ পেয়েছিল! খুবই আশ্চর্যের এবং সন্দেহের। গোটা তালিকাটাই কোডের মতো। ধূর্জটিনারায়ণ তলাপাত্র ছাড়া সেই কোড কেউ বুঝতে পারবে না।

কথাটা ঠিক। ধূর্জটিনারায়ণ ছাড়া এ জিনিস কারও বোঝা অসাধ্য। সত্যি কথা বলতে কী, তিনি নিজেও মাঝেমধ্যে খেই হারিয়ে ফেলেন। এখনও কি তাই হয়েছে?

টেবিলের উলটো দিকে বসে আছেন উর্বশী মালাকার। এতক্ষণ ছটফট করছিলেন। এবার কাতর গলায় বললেন, ‘দাদা, হবে তো?’

ধূর্জটিনারায়ণ কোনও জবাব দিলেন না। সম্ভবত শুনতেই পেলেন না। উর্বশী মালাকারের বয়েস পঞ্চাশের ওপর। বয়সের তুলনায় মেকআপ বেশি। সেই মেকআপ ধরে রাখতে পারছেন না। টেনশনে ঘামছেন। কপাল, গাল, গলার পাউডার গলে গলে পড়ছে। বেশি বয়সের সাজগোজের এই এক সমস্যা। গাদাগুচ্ছের রংচং মেখে বয়স আড়াল করা যায়, টেনশন আড়াল করা যায় না।

মহিলা কাঁপা গলায় বললেন, ‘না পেলে বিরাট বিপদে পড়ব ভাই। আমাদের সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে। স্টেজ, সাউন্ড, লাইট, ফুলের মালা।’

মহিলা টেনশনে ‘দাদা’, ‘ভাই’ গুলিয়ে ফেলছেন।

ধূর্জটিনারায়ণ হালকা বিরক্ত গলায় বললেন, ‘আহা, দেখছেন তো খুঁজছি। এরকম একটা আনকমন বিষয়, সময় লাগবে মিসেস মালাকার। সময় লাগবে। এ তো আর রাস্তার চাউমিন বা এগরোল নয়, যে বলবেন আর বানিয়ে সার্ভ করব।’

উর্বশী কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, ‘আসলে তিন মাস আগে সেমিনারের সাবজেক্ট ঠিক হয়েছিল। তখন বিষয়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিউজ পেপার, টিভি চ্যানেলগুলোতে হইচই হয়েছে। একটা বাচ্চা মেয়ের… খুব খারাপ ঘটনা…। তখন মনে হয়েছিল, কিছু বলা প্রয়োজন। তবে আমরা সাবজেক্টটাকে একটা ঘটনায় বেঁধে রাখিনি। আরও ব্যাপ্তি দিয়েছি। বড় চেহারায় ধরতে চেয়েছি। অনেক বড় বড় শ্রোতা আমাদের প্রাোগ্রামগুলোতে আসেন।’

ধূর্জটিনারায়ণ মুখ দিয়ে চুক চুক আওয়াজ করে বললেন, ‘এটাই তো ভুল করেছেন। খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলের সাবজেক্ট তিনদিনেই বাসি হয়ে যায়। তারপর নতুন বিষয় আসে। নতুন ইস্যু। পাবলিক এক জিনিসের ঘ্যানঘ্যানানি পছন্দ করেন না। এই লাইনে তো আমার কম দিন হল না। আবার অন্য বিপদও আছে। তিনদিন আগে যেটা খারাপ ছিল, তিনদিন পরে দেখা যাবে সেটাই ভালো। তিনদিন আগে মিডিয়া যা নিয়ে নাক সিঁটকোচ্ছিল, তিনদিন পরে তাই নিয়েই মিডিয়া আহা বাহা করছে। আজ যাতে প্রতিবাদ, কাল তাতে সমর্থন। কাল যাতে রাগ, আজ তাতে প্রেম। আর এই ইস্যু তো তিন মাস হয়ে গেছে!’

ধূর্জটিনারায়ণ লেকচার দিতে পেরে খুশি হলেন। এই ধরনের লেকচারে ক্লায়েন্ট স্বস্তি পায়। সে ভাবে ভুল লোকের কাছে আসেনি। ঠিক লোকের কাছে এসেছে। একে দিয়ে কাজ হবে। মানুষের এটাই সবথেকে দুর্বল জায়গা। সে সব সময় ‘ঠিক লোক’ খোঁজে। মুচি থেকে প্রফেসর, বাড়ির লোক থেকে কাজের লোক, বস থেকে অধস্তন। ঠিক লোক খুঁজতে খুঁজতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বুঝতে পারে, সব ভুল হয়ে গেছে। তার আগে যা কাজ করাবার করিয়ে নিতে হয়।

উর্বশী রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বললেন, ‘আমারই দোষ। দুম করে আমেরিকায় ছেলের কাছে চলে গেলাম। নাতনির পক্স। বউমা বলল, আপনি আসুন মা, একুশ দিন কাজকর্ম ছেড়ে বসে থাকতে পারব না। যাওয়ার সময় সমিতির অন্য মেম্বারদের বললাম, তোমরা সেমিনারটা করে ফ্যালো। সবাই বলল, তা কী করে হবে? সমিতির সেক্রেটারি না থাকলে প্রাোগ্রাম হবে কী করে? তুমি ফিরে এসো, তারপর হবে। সেমিনার তো পচে যাচ্ছে না।’

ধূর্জটিনারায়ণ ডায়েরি থেকে মুখ না-তুলে বললেন, ‘সেমিনার না পচুক, সাবজেক্ট তো পচে গেছে। সাবজেক্ট বদলে দিন। আলোচনা যে শুধু ছোট ছেলেমেয়েদের ইয়ে নিয়ে করতে হবে তা তো নয়। আপনি ছোট ছেলেমেয়েদের মনস্তত্ব নিয়ে করুন। আজকাল মনস্তত্ব খুব খাচ্ছে। সাড়ে তিন বছরের মেয়ের হতাশা, আড়াই বছরের ছেলের বিষাদ, সাড়ে চার বছরের একাকিত্ব। ইন থিঙ্ক।’

উর্বশী মালাকার হতাশ গলায় বললেন, ‘ওইটাই তো হবে না ভাই। স্পনসরদের কাছ থেকে টাকাপয়সা নেওয়া হয়ে গেছে। তিন মাস আগেই দিয়ে দিয়েছে। তখন সাবজেক্ট শুনে রাজি হয়ে গিয়েছিল। জানেনই তো এই ধরনের প্রাোগ্রাম করেই আমাদের মতো ছোট ছোট অর্গানাইজেশনগুলো টিকে থাকে। স্পনসর পেতে যে কত অসুবিধে হয়। তা ছাড়া তখন বিষয়টার একটা মানে ছিল। যাকে বলে সোশ্যাল রেলিভান্স। শুনে ওরাও রাজি হয়ে গেল। অ্যামাউন্ট ভালোই দিয়েছেন। এক বিষয়ের জন্য টাকা নিয়ে আমরা অন্য বিষয়ের জন্য সেটা কীভাবে খরচ করব?’

ধূর্জটিনারায়ণ মুচকি হেসে বললেন, ‘তাহলে তো সবই করে ফেলেছেন। স্টেজ, আলো, ফুলের মালা, টাকাপয়সা তোলা কিছুই বাদ নেই। শুধু সেমিনারে বক্তার নামটা ঠিক করেননি। তাই তো?’

উর্বশী মালাকার উৎসাহী গলায় বললেন, ‘করেছিলাম ভাই। আমি বাইরে চলে যাওয়ার আগেই কথা-টথা বলে ফাইনাল করে গিয়েছিলাম। ভদ্রলোক তখন রাজি হয়েছিলেন। এখন বলছেন, বাড়িতে নাকি আপত্তি করছে। আমি বললাম, সে কী! তখন তো রাজি হয়েছিলেন! উনি বললেন, তখন সময়টা অন্যরকম ছিল। এখন বলছে এই বিষয়ে কথা বললে নাম খারাপ হবে। আমাকে মাপ করবেন।’

ধূর্জটিনারায়ণ বিজ্ঞের মতো হেসে বললেন, ‘তাই আমার শরণাপন্ন হয়েছেন। তাই তো?’

উর্বশী মালাকার খড়কুটো চেপে ধরার মতো করে বললেন, ‘ঠিক তাই দাদা। তপা আপনার ফোন নম্বর দিল।’

ধূর্জটিনারায়ণ ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘তপা! তপা কে?’

‘আমার ভাইঝি। তপা মিত্র। টিভিতে কাজ করে। দিনরাত চ্যানেল। নম্বর দিয়ে বলল, পিসি এই ভদ্রলোককে ধরো। উনি তোমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন। আমাদেরও কয়েকবার করেছেন।’

টিভি চ্যানেলের কথা শুনে ধূর্জটিনারায়ণ নড়েচড়ে উঠলেন। নিজেকে পালটে গদগদ হেসে বললেন, ‘আপনার ভাইঝি টিভিতে আছে! আরে ম্যাডাম, কথাটা তো আপনি আগে বলবেন! দেখুন দেখি…ছিছি…আগে জানলে…ছিছি…’

ধূর্জটিনারায়ণের হাসি দেখে উর্বশী খানিকটা স্বস্তি পান। তিনিও জোর করে হাসেন। বললেন, ‘বলতাম, টেনশনে ভুলে গেছি। আসলে কী জানেন ভাই, আমার জন্যই তো সেমিনারটা পিছিয়ে গেছে। আমি যদি মেয়ের ওখানে না যেতাম তাহলে এত ঝামেলা হত না। দোষ আমার। তাই এখন সামলাতেও হচ্ছে আমাকে।’

ধূর্জটিনারায়ণ এসব কথা না শুনে বললেন, ‘কী খাবেন? চা? কফি? ঠান্ডা দিতে বলি?’

উর্বশী মালাকার এতটাই চিন্তিত হয়ে আছেন যে, ধূর্জটিনারায়ণের এই পরিবর্তন খুব একটা খেয়াল করলেন না। তিনি বললেন, ‘না, না, ওসবের দরকার নেই। আপনি দাদা, আগে গেস্ট ঠিক করে দিন। টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমরা পেমেন্ট দিতে রাজি আছি।’

ধূর্জটিনারায়ণ দুপাশে নাটকীয় ভঙ্গিতে হাত ছড়িয়ে বললেন, ‘আপনি যখন আমার কাছে এসে পড়েছেন তখন আর চিন্তা নেই ম্যাডাম। আমাকে দায়িত্ব দিয়ে কেউ কখনও বিপদে পড়েনি। আপনি আপনার ভাইঝিকে জিগ্যেস করবেন। সেবার একটা কাণ্ড হয়েছিল। মেট্রোরেলে এক অল্পবয়সি মেয়ের গায়ে কে যেন হাত দিল। মেয়েটি ঘুরিয়ে মারল চড়। সপাটে চড় যাকে বলে। কিন্তু চড় লাগল ভুল লোকের গালে। আসল লোক সেই ফাঁকে গেল সটকে। চড়-খাওয়া লোক তো খেপে আগুন। পুলিশে ডায়েরি করল। মানহানির মামলা করল। তাই নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড। পক্ষে-বিপক্ষে মিটিং, মিছিল, লেকচার, গণসঙ্গীত। ওরা আমাকে গান গাইতে দেয় না…।’

কথাটা বলে খুব এক চোট হাসতে লাগলেন ধূর্জটিনারায়ণ।

উর্বশী বিড়বিড় করে বললেন, ‘আবছা আবছা মনে পড়ছে যেন।’

ধূর্জটিনারায়ণ হাসি থামিয়ে বললেন, ‘মনে পড়বেই। খবরের কাগজগুলোতে ক’দিন খুব হইচই হল। টিভি চ্যানেলে তর্কের ঝড়। পাবলিক প্লেসে কি কাউকে চড় মারা যায়? গেলে কীভাবে মারা যায়? চড় মারবার আইন কী? ভুল লোককে চড় মারার ক্ষতিপূরণই বা কত? এই সুযোগ কেউ ছাড়ে? চ্যানেলগুলো ঝটাপট লোক এনে বসিয়ে দিল। টক শো। অত্যাচারিত মহিলা, নিপীড়িত পুরুষ, সরকার পক্ষ, বিরোধী পক্ষ, নারীবাদী, নারীবিরোধী, পুলিশ, উকিল— অতিথি তালিকায় কেউ বাদ নেই। একেকদিন একেকরকম গেস্ট। আপনার ভাইঝির চ্যানেল থেকে একদিন ফোন করে আমায় বলল, তলাদা, আমাদের একজন চড় স্পেশ্যালিস্ট লাগবে। হাতে একদিন মাত্র সময়। আমার তো মাথায় হাত। চড় স্পেশ্যালিস্ট! ওরা বলল, হ্যাঁ, চড় স্পেশ্যালিস্ট। সবরকম গেস্ট হয়ে গেছে, চড় স্পেশ্যালিস্ট হয়নি। কাণ্ডটা একবার বুঝুন ম্যাডাম। চড় স্পেশ্যালিস্ট কোথা থেকে পাই?’

উর্বশী চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘কী করলেন? না বলে দিলেন?’

ধূর্জটিনারায়ণ হেসে বললেন, ‘তা বললে চলবে কেন? কোম্পানি খুলে যখন বসেছি, অর্ডার অনুযায়ী জিনিস তো সাপ্লাই দিতে হবে।’

উর্বশী মুগ্ধ গলায় বিড়বিড় করে বললেন, ‘তা তো বটেই, তা তো বটেই।’

‘ভেবেচিন্তে দেখলাম, চড় মারধর ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ছে। সুতরাং গেস্ট খুঁজতে হবে ওই লাইনে। বক্সিং, ক্যারাটে, জুডো ক্লাবগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। ওদের কাউকে যদি চড় বিশেষজ্ঞ হিসেবে বসানো যায়। তারা তো শুনে রেগে কাঁই। বলল, চড়ের মতো তুচ্ছ বিষয়ের সঙ্গে নিজেদের নাম জড়াতে বলছেন— এ তো অপমান করছেন? আমি পড়লাম অথৈ জলে। এদিকে রাতদিন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে গেছে। টিভির ভাষায় যাকে বলে প্রাোমো। বারবার ঘোষণা করছে—অমুক দিন সন্ধে সাতটায় ঝগড়াঝাঁটি হাতাহাতি প্রাোগ্রামে চড়কাণ্ড দিয়ে আলোচনা। এই প্রথম কোনও টিভি চ্যানেলের আলোচনায় অংশ নেবেন একজন বিশিষ্ট চড় বিশেষজ্ঞ। বুঝুন ম্যাডাম, কী বিপদে পড়লাম। স্নান-খাওয়া মাথায় উঠল। রাতে ঘুম হয় না। গিন্নি রাগারাগি করতে লাগল। বলল, এই ব্যবসায় যাওয়াটাই ভুল হয়েছে। আমি বললাম, এখন তো বললে হবে না। যখন নেমেছি, তখন একটা কিছু করতে হবে।’

এত পর্যন্ত বলে ধূর্জটিনারায়ণ থামলেন। বেল টিপে পিওনকে ডেকে লেবুর শরবতের অর্ডার দিলেন। ক্লায়েন্টকে তোষামোদ করার জন্য ধূর্জটিনারায়ণ মাঝেমধ্যে পাতিলেবুর শরবত খাওয়ান। পাতিলেবু এফেক্টের অফিস বলে পাতিলেবুর শরবত।

উর্বশী বললেন, ‘তারপর? চড় বিশেষজ্ঞ পেলেন?’

‘কী করব? পেতে তো হবেই। একজন তবলচিকে ফোন করলাম। ছোকরাকে বহু প্রাোগ্রাম দিয়েছি। বললাম, বাপু তোমাকে টিভিতে বসতে হবে। সে তো খুব খুশি। ভাবল, গানের সঙ্গে বাজাতে হবে? আমি বললাম, গানবাজনার কোনও ব্যাপার নেই। চড় নিয়ে লেকচার দেবে। শুনে সেই ছোকরা তো আর্তনাদ করে উঠল। আমাকে ছেড়ে দিন, আমাকে ছেড়ে দিন, আমি পারব না। আমি জীবনে বহু চড় খেয়েছি, কাউকে চড় মারিনি। আমি চড় ঘুসি কিল কিচ্ছু জানি না। আমি বললাম, দেব এক থাপ্পড়। পারবে না মানে? তোমার ঘাড় পারবে। তবলা মানেই চড়-চাপড়। তুমি পারবে না তো কে পারবে? সেই ছেলেকে ঠেলে রাতদিন টিভি চ্যানেলে পাঠিয়ে দিলাম। ভয়ে ভয়ে ছিলাম। ধেড়িয়ে না দেয়। কিন্তু ছেলের পারফরমেন্স হল মারাত্মক। একটা টক শো করেই হিট। তারপর থেকে এই চ্যানেল ডাকে, ওই চ্যানেল ডাকে। লক্ষ্ণৌ না আমেদাবাদের কোন এক ইউনিভার্সিটি থেকে লেকচার দেওয়ার জন্য ডাক পর্যন্ত পেয়ে গেল। র‌্যাপ এক্সপার্ট। লেকচারের সঙ্গে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন। যাওয়ার আগে আমাকে প্রণাম করে বলল, দাদা, তবলা বাজিয়ে এত খ্যাতি কখনও পাইনি। আপনি আমাকে যে সম্মান দিলেন তা কোনওদিন ভুলব না। আমি বললাম, বাপু আমি দিইনি, টিভি দিয়েছে। ওই যে ঘরের কোনায় টিভি সেট রয়েছে পারলে ওখানে গিয়ে কপাল ঠেকাও।’

ধূর্জটিনারায়ণ থামলে উর্বশী মালাকার কাতরকণ্ঠে বললেন, ‘এবার আমাকে এরকম একটা কিছু করে দিন মিস্টার তলাপাত্র।’

পিওন লেবুর শরবত দিয়ে গেল। ধূর্জটিনারায়ণ ডায়েরি সরিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘করে দেব। দায়িত্ব যখন নিয়েছি অবশ্যই করে দেব। তার ওপর আপনি টিভি চ্যানেলের রেফারেন্সে এসেছেন। আপনার কাজ না করলে আমার চলবে কেন? নিন, শরবতটা খেয়ে নিন। আমার এখানে পাতিলেবুর শরবত হল স্পেশ্যাল আইটেম। তবে কী জানেন ম্যাডাম, আপনাদের বিষয়টা ডিফিকাল্ট। অবশ্য ডিফিকাল্ট না হলে আমার কাছে আসবেনই বা কেন? যাই হোক চিন্তা করবেন না। আমার এদিক-ওদিক সিস্টেম আছে, দরকার হলে সেই সিস্টেম কাজে লাগাব।’

কথাটা সত্যি। ধূর্জটিনারায়ণের সিস্টেম আছে। তার ডায়েরির জটিল এবং দুর্বোধ্য ‘কোড’ ভাঙলেই সেই সিস্টেম বোঝা যাবে।

ধূর্জটিনারায়ণ তলাপাত্রর সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। এই ব্যবসা তিনি পেয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে। প্রপিতামহ নলিনীনারায়ণ তলাপাত্রর কারবার ছিল খড়ের। বগুলা (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে বিদ্যাধরী, কৃষ্ণপুর খাল হয়ে গুণ টানা নৌকোয় বাগবাজার ঘাটে রাশিকৃত খড় আসত। সেই খড় কলকাতার বিভিন্ন খাটালে সাপ্লাই হত। তখন কলকাতায় দু-পা অন্তর অন্তর খাটাল। খড়ের বেজায় চাহিদা। বিচালি করে গরু-মোষকে দেওয়া হয়। তারা আধখানা চোখ বুজে বিচালি খায় এবং পুরো চোখ বুজে জাবর কাটে।

ধূর্জটিনারায়ণের প্রপিতামহের মৃত্যুর পর ধূর্জটিনারায়ণের পিতামহ জ্ঞানেশনারায়ণ ব্যবসার দায়িত্ব নিলেন। দেশভাগের ডামাডোলে তখন খড়ের চালানে টান পড়েছে। সেই ব্যবসা বদলে জ্ঞানেশনারায়ণ শুরু করলেন গুড়ের কাজ। মূলত ভেলি গুড়। ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠল। উত্তর ভারত থেকে আসা গুড় সাপ্লাই দিয়েও কুলিয়ে উঠতে পারতেন না জ্ঞানেশনারায়ণ। টাকার ওপর টাকা, তার ওপর আরও টাকা। লোকে বলত, ‘জ্ঞানেশের টাকায় গণেশ। গণেশ ঠাকুর টাকায় বসে গুড় খান।’ লোকে যা-ই বলুক, গুড়ের টাকা জ্ঞানেশনারায়ণ শুধু নিজের ভোগবিলাসে রাখেননি। দানধ্যানে ব্যয় করেছেন, ধর্মকর্মে ব্যয় করেছেন। পরের দিকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। ভারতীয় ধ্রুপদ সঙ্গীতের উন্নতিকল্পে টাকা ঢালেন। তাঁর জীবনাবসানে বিখ্যাত খেয়ালশিল্পী ওস্তাদ সামসুর খাঁ শোকপ্রকাশ করে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। সেই শোকবার্তা আজও বাড়ির দেওয়ালে বাঁধানো অবস্থায় ঝুলছে।

জ্ঞানেশনারায়ণের মৃত্যুতে ব্যবসায় দায়িত্ব পেলেন ধূর্জটিনারায়ণের পিতা অন্নদানারায়ণ তলাপাত্র। তিনি খড় বা গুড় কোনওটাই রাখলেন না। তখন তিনি তারুণ্যের তেজে টগবগ করে ফুটছেন। নতুন কিছু ভাবতে হবে। দেশ আর পরাধীন নয়, দেশ স্বাধীন। তরুণ প্রজন্ম যদি এই সময় নতুন কিছু না ভাবে তাহলে কে ভাববে? জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক। খড়, ভেলি গুড় ভাসিয়ে অন্নদানারায়ণ গুল-কয়লা সাপ্লাইয়ের ব্যবসা ধরলেন। সেই সময় দেশজুড়ে গুল-কয়লার রমরমা। ব্যবসাও রমরম করে চলতে লাগল।

পিতার মৃত্যুর পর ধূর্জটিনারায়ণ গুল-কয়লা বাদ দিলেন, তবে সাপ্লাই লাইন ছাড়লেন না। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া খড়, ভেলি গুড় এবং গুল-কয়লার টাকায় এটা-সেটা করার পর মন দিলেন ‘গেস্ট সাপ্লাই’ ব্যবসায়। সেই ব্যবসা হইহই করে চলছে। চলবেই তো। টিভি চ্যানেলগুলোতে এখন ‘গেস্ট’দের চাহিদা তুঙ্গে। বড়, ছোট, মেজো, সেজো, রাঙা, ন’—আঠারো-উনিশটা চ্যানেলে সারাদিন আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা, হাতাহাতি, মারামারি লেগেই রয়েছে। বিষয়ের শেষ নেই। রাজনীতি থেকে দুর্নীতি, ধর্ষণ থেকে বর্ষণ, হাসি থেকে বাঁশি। আজ আলোচনার বিষয় বজ্রপাত তো কাল বিষয় চিটিংবাজ। আজ নারীমুক্তি তো কাল ছেঁদো যুক্তি। আজ পকেটমার তো কাল সাহিত্য পুরস্কার। আজ হাঁচিকাশি তো কাল খুনির ফাঁসি। আজ সংগ্রাম তো কাল ল্যাংড়া আম। আজ কালোবাজারি তো কাল আন্না হাজারি। আলোচনায় এক্সপার্ট চাই। তাঁরা কথা বলবেন। চিৎকার করে গলার শির ফোলাবেন। উলটো দিকে কেউ থাকলে ঝগড়া করবেন। না থাকলেও ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন। সব মিলিয়ে আলোচনা জমিয়ে দেবেন। টিভির কর্মকর্তাদের একটু রেস্ট নেওয়ার জো নেই। সারাদিন ‘গেস্ট’ পাকড়াতে হয়। মানীগুণী অতিথি চাই। কিন্তু কোথায় এত ‘গেস্ট’! যে-ক’জন আছেন তাঁরা চ্যানেলে ছুটে বেড়াচ্ছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম। থামবার উপায় নেই। চাইলেও থামতে দিচ্ছে কে? দিলে চলবেই বা কী করে? চাহিদার থেকে জোগান যে কম। তা ছাড়া বিষয়ও হাজাররকম। এত বিষয়ের বিশেষজ্ঞ কোথায়? টিভি কর্মকর্তারা পড়ছেন অথৈ জলে।

সেই জল থেকে টেনে তুলতেই ধূর্জটিনারায়ণ তলাপাত্রর এই ব্যবসা। বংশের ‘সাপ্লাই’ ধারা বজায় রইল আবার ব্যবসার বিষয় আধুনিকও হল। খড়, ভেলি গুড়, গুল-কয়লার পর মানীগুণী অতিথি সাপ্লাই। আর-পাঁচটা ব্যবসার মতো এখানেও ধূর্জটিনারায়ণ ‘এদিক সেদিক’ সিস্টেম চালু করেছেন। সেই সিস্টেম সাঙ্কেতিক কোডের মতো লিখে রেখেছেন ডায়েরিতে। বিশেষজ্ঞ খোঁজার ঝামেলায় না গিয়ে মাঝেমধ্যে নিজেই বিশেষজ্ঞ তৈরি করে ফেলেন। তা ছাড়া উপায় নেই? খড়, ভেলি গুড়, গুল-কয়লাতেও ভেজাল ছিল। এখানেও তাই। কিছু ওরিজিনাল জ্ঞানীগুণীর পাশে কিছু ভেজাল মান্যিগণ্যি। আর তাতেই ব্যবসা বাড়ছে তড়বড়িয়ে।

টিভির পরদায় ‘অতিথি’ হতে ইচ্ছুক এমন লোকেদের লম্বা তালিকা রয়েছে ধূর্জটিনারায়ণের। এদের মধ্যে কারও কারও কাছে বিষয় অতি তুচ্ছ। পরদায় মুখ দেখানোই আসল। এদের নামের পাশে বসেছে সাবজেক্ট। সেই সাবজেক্ট বদলে যায় দরকার মতো। আজ যে কুস্তি নিয়ে ঝগড়া করতে এক চ্যানেলে বসেছেন, কালই তিনি লোকসঙ্গীত নিয়ে কথা বলেছেন অন্য চ্যানেলে। নারীজাতির সম্ভ্রম নিয়ে যে মহিলা সন্ধেবেলা গলা ফাটিয়েছেন, গভীর রাতে তিনিই মেয়েদের সেক্স অ্যাপিলের পক্ষে সওয়াল করেছেন অন্যত্র। সাহিত্যিক হিসেবে যিনি জীবনের গভীর দর্শন সম্পর্কে সোমবার গুরুগম্ভীর ভাষণ দিলেন, তিনিই পকেটমার হয়ে জীবনযন্ত্রণার কাহিনি শোনালেন শনিবার। আসল বিশেষজ্ঞর পাশে নকল বিশেষজ্ঞ সাপ্লাই করে টিভিকর্তা আর দর্শকদের বিভ্রান্ত করাই ধূর্জটিনারায়ণ তলাপাত্রর ব্যবসার চাবিকাঠি। সাফল্যের রহস্যও বলা যেতে পারে। যার অনেকটাই অফিস ইন্টিরিয়র হরিমতি শর্মার কাছ থেকে আত্মস্থ করা।

এই ধূর্জটিনারায়ণের কাছেই এসেছেন উর্বশী মালাকার। টিভি চ্যানেলের ‘হাতাহাতি মারামারি’ টক শো-র জন্য নয়, তাদের নারী সমিতির সেমিনারের জন্য। সেমিনারের বিষয় গোলমেলে। নারী সমিতি যখন ভেবেছিল, তখন ‘জমজমাট’ ছিল। এখন মিইয়ে গেছে। কিন্তু উপায় কী? বিষয় বদলানোর সুযোগ যখন নেই তখন ‘বক্তা’ লাগবেই। উর্বশী মালাকারকে পাতিলেবুর শরবত খাইয়ে, একদিন সময় চেয়ে বিদায় দিলেন ধূর্জটিনারায়ণ। কাজটায় টাকাপয়সা তেমন নেই, কিন্তু গুড উইলের ব্যাপার আছে। এই ধরনের কাজ করা মানে নাম ছড়াবে। লোকের মুখে-মুখে ছড়াবে। চড়ের পর অনেকগুলো কাজ এসেছিল। তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুচেতনা যেমন ছিল, তেমন ল্যাং মারবার উপকারিতাও ছিল। মিসেস মালাকারের কাজ করে দিতে পারলেও আসবে। তার ওপর আবার টিভি চ্যানেলের রেফারেন্স। সুতরাং কোমর বেঁধে নামতে হবে।

কোমর বেঁধেই নামলেন ধূর্জটিনারায়ণ। ডায়েরি দেখে শুরু করলেন টেলিফোন। একটার পর একটা। লিস্টে যা আছে, যত আছে। গান, কবিতা, নারীচেতনা, শিল্প-কৃষি, বজ্রপাত, মূল্যবৃদ্ধি, ধর্ষণ, কাউকে বাদ দিলেন না। কিন্তু লাভ হল না। যে শুনছে সে-ই আঁতকে উঠছে। শুধু আঁতকে নয়, এরকম একটা বিষয়ের ওপর বলার অনুরোধে কেউ কেউ অপমানিতও হলেন। ওরিজিনাল, ভেজাল সবার এক অবস্থা। নমুনা হিসেবে শেষ দুটি টেলিফোন সংলাপ তুলে ধরা যাক।

প্রথমটি ছিল ওরিজিনাল। অর্থাৎ সত্যিকারে মানীগুণী অতিথি তারাদাসবাবু।

ধূর্জটিনারায়ণ (গদগদ গলায়) : নমস্কার, কেমন আছেন স্যার?

তারাদাসবাবু (গলায় উৎসাহ) : আরে ধূর্জটি, আছ কেমন? আমি ভালো নেই রে ভাই। একেবারে ভালো নেই।

ধূর্জটি (গলায় বানানো উদ্বেগ) : কেন? কী হল স্যার? বাতের ব্যথা? দাঁত?

তারাদাসবাবু (গলায় ছদ্ম ক্লান্তি) : আর বোলো না ভাই, সেমিনারে সেমিনারে পাগল হয়ে গেলাম। জেরবার হয়ে গেলাম। আজ দিল্লি, কাল মুম্বই, পরশু হায়দরাবাদ। কলকাতায় তো লেগেই আছে। কোনও ইউনিভার্সিটি বাদ নেই। লেকচার আর লেকচার। এরপর আর ভালো থাকি কী করে বলো ভায়া? সামনের বছর সানফ্রান্সিসকো যাওয়ার একটা ডাক পাব শুনছি। সে এক কেলেঙ্কারি হবে। পেপার রেডি করতে হবে। বাংলার ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভূগোল আর সাহিত্যের পরম্পরা নিয়ে তুল্যমূল্য বিচার। কঠিন বিষয়। ভাবছি পালবংশ দিয়ে শুরু করব। কেমন হবে? তোমার বউদি কী বলে জানো?

ধূর্জটি (বোকা বোকা গলায়) : বউদি কী বলেন?

তারাদাসবাবু (হাসি সহযোগে) : বলে এরকমটা হবে জানলে সে নাকি আমাকে বিবাহই করত না। লেকচার দেওয়া বরের থেকে গাধা বর অনেক ভালো। সংসারের কাজে লাগত। হা হা হা।

ধূর্জটি (বানানো হেসে) : তা আর কী হবে স্যার, এত বড় পণ্ডিত মানুষ আপনি, আপনাকে নিয়ে টানাটানি তো হবেই।

তারাদাসবাবু (সিরিয়াস) : আরে বাপু, টানাটানির সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিও চলে হে। পণ্ডিতদের মধ্যে হিংসুটি কি কম? এই দ্যাখো না, আমার সানফ্রানসিসকো ট্যুর আটকাবার জন্য ইতিমধ্যেই একটা গ্রুপ লবি শুরু করেছে। আমিও ছাড়ব না। সামনের উইকে দিল্লি যাচ্ছি। মিনিস্ট্রিতে বসে থেকে চিঠি নিয়ে তবে আসব।

ধূর্জটি (আগ্রহ সহকারে) : স্যার, সেরকম হলে আমাকে বলবেন। আমিও আপনার সঙ্গে দিল্লি যাব। মিনিস্ট্রি অফিসে ধরনা দেব। আপনার মতো পণ্ডিত মানুষের জন্য ধরনা দেওয়াও গর্বের স্যার।

তারাদাসবাবু : অবশ্যই বলব। তোমরাই তো আমার কাছের লোক। সাধারণ, ছাপোষা। খেটে-খাওয়া মানুষ তোমরা। গজদন্ত মিনারে বসে থাকা বড় বড় লোক দেখে জীবন তেতো হয়ে গেছে ভায়া। তাদের আমি পরিত্যাগ করেছি। যাই হোক, কাজের কথা বলো। আমি কিন্তু আগেই বলে রাখছি ধূর্জটি। টিভিতে যেতে বোলো না। হাতে মোটে সময় নেই। আর টিভিতে বসে বকবক অর্থহীন একটা কাজ। ইডিয়ট বক্সে ইডিয়ট হয়ে বসে থাকা। এই কাজ তো কম করলাম না ভায়া। এবার আমায় বাদ দাও।

ধূর্জটি : তা বললে আমাদের চলবে কী করে স্যার? আপনারা যদি না বসেন, আমরা খাব কী? চ্যানেলগুলো তো মরা নদীর মতো শুকিয়ে যাবে। শনিবার একটা প্রাোগ্রাম স্যার করে দিতেই হবে। আমার আবদার স্যার।

তারাদাসবাবু (বানানো রাগ দেখিয়ে) : উফ, তোমার ফোন ধরাটাই দেখছি ভুল হল ধূর্জটি। তুমি আমাকে জ্বালিয়ে মারবে। ঠিক আছে ঠিক আছে, এই লাস্ট, লাস্ট কিন্তু, লাস্ট বলে দিলাম। কী নিয়ে প্রাোগ্রাম? কোথায়? কখন? উফ, তুমি যে কী করো না ধূর্জটি…তোমার বউদি শুনলে…।’

ধূর্জটিনারায়ণ মনে মনে বললেন, ‘ন্যাকা, টিভির নাম শুনে মুখে নাল ঝরছে।’ মুখে বললেন, ‘টিভি নয় স্যার, হলে বসে সেমিনার। আপনি একক বক্তা। ঘণ্টাখানেক বলবেন।’

তারাদাসবাবু (হতাশ গলায়) : সেমিনার!

ধূর্জটিনারায়ণ (হেসে) : চিন্তা করবেন না স্যার, পেমেন্ট আছে। এর আগেও তো এই ধরনের সেমিনারে আপনাকে আমি পেমেন্ট দিয়েছি। সমস্যা হল, আপনাদের মতো মানুষকে তো আর মুখে পেমেন্টের কথা বলা যায় না, অসম্মান করা হয়, ট্যাক্সি ভাড়া বলে আপনাদের হাতে খাম ধরিয়ে দিতে হয়। ঠিক আছে স্যার ট্যাক্সি ভাড়া শুনতে যদি আপনার আপত্তি থাকে, তাহলে অন্য কিছুও বলা যেতে পারে। ধরুন চিঠি, ধরুন কবিতা, ধরুন গবেষণার মুখবন্ধ। আপনি যেমনভাবে চাইবেন। মনে আছে একবার আপনার পাঞ্জাবির পকেটে টুক করে টাকার খাম ফেলতে গিয়ে আপনি পকেটমার ভেবে এক কর্মকর্তার হাত চেপে ধরেছিলেন…মনে আছে?…হা হা হা…স্যার, পাঁচ থাকবে। ঠিক আছে সাড়ে পাঁচ…।

তারাদাসবাবু (টাকার কথা শুনে স্বস্তি। উদাসীনভাবে) : বিষয় কী? লেখাপড়া করে তো যেতে হবে। তুমি তো জানোই ধূর্জটি লেখাপড়া না করে আমি কোথাও যাই না। সেবার তোমার ওই কী যেন চ্যানেলটার নাম…সেখানে সাবজেক্ট ছিল জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ে। আমি তো জ্ঞান আর আলো দুটো বিষয় নিয়েই বই ঘেঁটে গেলাম। সেই লেকচারে আলোর গতিবেগ নিয়ে বলাটা খুব ইমপর্টান্ট ছিল। সেই হিসেব করে আলো কীভাবে ছড়িয়ে পড়বে তার একটা অনুমান দর্শকদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলাম। সবাই খুব ভালো বলেছিল। যাক, এবার তোমার বিষয়টা বলো।

ধূর্জটি (এক মুহূর্ত থেমে, ঢোক গিলে) : স্যার বিষয় হল, মানবসভ্যতায় হিসির ভূমিকা।

তারাদাসবাবু (চমকে) : কীসের! কীসের ভূমিকা বললে?

ধূর্জটি (নার্ভাস ভঙ্গিতে) : ইয়ে মানে হিসির স্যার। ইউরিন। তবে বড়দের নয়, ছোটদের হিসি। ওই যে স্যার কয়েকমাস আগে ছোটদের বিছানায় ইয়ে করা নিয়ে খুব হইচই হল না?…(এবার উৎসাহ দেওয়ার গলায়) আপনি স্যার আপনার মতো বলবেন…যেমন বলেন আর কী…রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা-টবিতা দিয়ে বলবেন…কী যে ভালো লাগে স্যার…(এবার পটানোর গলায়) একবার কয়েক লাইন গানও গেয়েছিলেন…মনে আছে?…আমার আছে…আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে…আহা! মনে আছে স্যার?…আমার মনে আছে… হিসিতেও তাই করবেন…ও বিষয়ে স্টকে কোনও গান থাকলে…রবীন্দ্রনাথ তো সব সাবজেক্টে লিখেছেন…তাই না?…গলা আপনার খুবই ভালো স্যার…আমি দেখেছি, পণ্ডিত মানুষদের গলা সবসময় ভালো হয়…ভগবান যাকে দেন উজাড় করে দেন…স্যার টাকাটা বাড়িয়ে ছ’হাজার করে দিই?…হিসি তো সাবজেক্ট হিসেবে কঠিন…আপনার খাটাখাটনি আছে…তার ওপর মানবসভ্যতার সঙ্গে তাকে জড়াতে হবে…।’

তারাদাসবাবু (চিৎকার করে) : স্টপ। স্টপ ইট।

এবার বানানো বিশেষজ্ঞ। ছেলের নাম সুচারু।

ধূর্জটিনারায়ণ (অনেকটা সহজভাবে) : হ্যালো, সুচারু বলছ? আছ কেমন হে?

সুচারু (গদগদভাবে) : ভালো আছি দাদা। আপনি কেমন আছেন? বউদি? অম্বলটা কমেছে?

ধূর্জটিনারায়ণ (একটা প্রশ্নেরও উত্তর না দিয়ে, হাই তুলে) : আমাকে তো আর ফোন-টোন কিছু করো না। ভুলেই গেলে নাকি?

সুচারু (হে হে ভঙ্গিতে) : কী যে বলেন দাদা! আমি আপনাকে ভুলে যাব? এই যে লোকে আমাকে সামান্য চিনেছে সে তো দাদা আপনার কল্যাণেই। সেদিন বাসে তো কন্ডাক্টর ভাড়া নিতেই চায় না। বলল, কাল আপনাকে টিভিতে দেখেছি, প্রাইভেট টিউশনের বিরুদ্ধে যেভাবে বলছিলেন…আমি তো মেয়েকে পড়াতে গিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছি…না, না, আপনার ভাড়া দিতে হবে না…বাসসুদ্ধু মানুষ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি তো লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়। মাটিতে নয়, বাসে।

ধূর্জটিনারায়ণ (মাঝপথে থামিয়ে) : আচ্ছা, গত মাসে তোমাকে যেন কী একটা সাবজেক্টে টিভিতে বসিয়েছিলাম?

সুচারু (অতি উৎসাহে) : সন্ধেবেলা চ্যানেলের আজকের ঝগড়া অনুষ্ঠানে তো? দাদা, সেদিন বিষয় ছিল ধানের পোকা। তার আগের দিন বসেছিলাম, হাঁটুর ব্যথা নিয়ে।

ধূর্জটিনারায়ণ (শীতল গলায়) : শোনো সুচারু, তোমাকে একটা সেমিনারে যেতে হবে। টিভিতে নয়, হলের সভা। ধুতি-পাঞ্জাবি পরে একটু ভারিক্কি চেহারায় যাবে। শ’পাঁচেক টাকা পেমেন্ট পাবে। আমাকে কমিশন হিসেবে দেড়শো দিয়ে যাবে।

সুচারু (খুশি মনে) : কী নিয়ে বলব দাদা?

ধূর্জটিনারায়ণ : হিসি নিয়ে। ছোটদের হিসি। তবে আলোচনা প্লেইন হিসি নিয়ে হবে না, হবে মানবসভ্যতার হিসির ভূমিকা নিয়ে।

সুচারু (আঁতকে উঠে) : দাদা পারব না। ইমপসিবল। আমাকে ছেড়ে দিন।

ধূর্জটিনারায়ণ (রেগে গিয়ে) : কেন পারবে না?

সুচারু (কাতর গলায়) : এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।

ধূর্জটিনারায়ণ (আরও রেগে, চিবিয়ে চিবিয়ে) : জানো না মানে! তুমি হিসি করো না? মানব কাকে বলে পড়োনি ছোটবেলায়? সভ্যতা সম্পর্কে ধারণা নেই কোনও? তুমি কি জংলি ভূত?

সুচারু (প্রায় কেঁদে ফেলে) : দাদা, আলাদা আলাদা করে জানি, তিনটে একসঙ্গে জানি না। কেউ জানে বলেও মনে হয় না।

ধূর্জটিনারায়ণ (উত্তেজিত) : বলার সঙ্গে জানার কী সম্পর্ক? এই যে তুমি হাঁটুর পোকা না ধানের ব্যথা নিয়ে ভাষণ দিলে, সেটা কি জেনেবুঝে দিয়েছ? না দেওয়ার কোনও যোগ্যতা ছিল তোমার? তুমি চাষিও নয়, ডাক্তারও নয়। তুমি কিছুই নয়। তুমি একজন আকাট মুখ্যু। তবু তুমি চান্স পেয়েছ। মনে রাখবে, চান্সটাই আসল। আজকালকার দিনে অযোগ্যদেরই চান্স হয়। যোগ্যরা ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়। কাল থেকে তুমিও ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াবে।

রাগে কাঁপতে কাঁপতে ধূর্জটিনারায়ণ ফোন কেটে দিলেন।

দুদিন কেটে গেছে। দু’গালে হাত দিয়ে বসে আছেন ধূর্জটিনারায়ণ। তাঁর চুল এলোমেলো। চোখ লাল। একদিনের জায়গায় তিনদিন কেটে গেছে। ধূর্জটিনারায়ণ ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। টেলিফোন করে আর লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন। হতাশ হয়ে পড়েছেন। তিনি ঠিক করেছেন, ব্যবসা তুলে কোথাও চলে যাবেন। এ তো ভয়ংকর অবস্থা। আসল নকল কোনও ‘গেস্ট’ই রাজি হচ্ছে না। টাকাতেও হচ্ছে না, ধমকেও হচ্ছে না। আবদারেও হচ্ছে না, অনুরোধেও হচ্ছে না। এতদিন একসঙ্গে কাজ করার পরও পালাচ্ছে সবাই। হায়রে!

বিষয়টা সত্যি গড়বড়ে। তাও প্লেইন হলে একটা কথা ছিল। মানব সভ্যতা-টভ্যতা জড়িয়ে ক্লায়েন্ট বিষয় জটিল করে ফেলেছে। কিন্তু কিছু তো একটা করতে হবে। সেটা কী? কাউকে আরও জোর ধমক দিয়ে ঘাড় ধরে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? না, থাক। আলোচনা, সমালোচনা, পর্যালোচনা জোর করে হয় না। শেষ পর্যন্ত স্টেজে উঠে ভেবড়ে গেলে সর্বনাশ। মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে হবে। ধূর্জটিনারায়ণ চোখ বুজে লম্বা শ্বাস নিলেন। পাতিলেবুর গন্ধ কই! বিভ্রান্তি কি ফুরিয়ে গেল!

দরজায় খুটখুট আওয়াজ। চোখ খুললেন ধূর্জটিনারায়ণ। তবলা। রাস্তার উল্টো দিকে ফুটপাথে বংশীর চায়ের দোকান। তবলা বংশীর আট বছরের পুত্র। তবলার ভালো নাম রাঘব। ধূর্জটিনারায়ণ রাঘব নামে ডাকেন না। তাঁর মতে, বংশীর পুত্রের নাম তবলা, হারমোনিয়াম, খঞ্জনি ধরনের কিছু হওয়াই ভালো।

‘আয় তবলা।’

ধূর্জটিনারায়ণ ছোট ছেলেমেয়েদের পছন্দ করেন। এই ছেলেটিকে অতিরিক্ত পছন্দ করেন। তবলার লেখাপড়ার যাবতীয় দায়দায়িত্ব তিনি নিয়েছেন। স্কুল, বইখাতা, জামা, জুতোর সব খরচ তাঁর। রোজ সন্ধেবেলা পড়ানোর জন্য একজন শিক্ষিকার ব্যবস্থাও করেছেন। বংশীকে ডেকে বলে দিয়েছেন, ‘ছেলেকে দিয়ে দোকানে কাজ করালে পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেব। পুলিশ আসার আগে পশ্চাৎদেশে দুটো লাথি ঝাড়ব।’

তবলা রোজই একবার করে ধূর্জটিনারায়ণের অফিসে ঢুঁ মারে। তার অফিসে এলে সে খেলনা, বিস্কুট, টফি লজেন্স পায়। না পেলেও আসে। কেউ না থাকলে উলটো দিকের চেয়ারে আরাম করে বসে। ধূর্জটিনারায়ণ কাজ করতে করতে তার সঙ্গে টুকটাক কথা বলেন।

‘কীরে বেটা, পাতিলেবুর গন্ধ পাচ্ছিস?’

তবলা গম্ভীরভাবে বলে, ‘পাচ্ছি না।’

‘সে কীরে! আমি তো পাচ্ছি? তোর কি সর্দি হল নাকি?’

‘আমার সর্দি হয়নি। তুমি বোকা তাই তুমি গন্ধ পাচ্ছ।’

ধূর্জটিনারায়ণ চোখ পাকিয়ে বলেন, ‘আমি বোকা! এত খরচ করে পাতিলেবু অফিস বানালাম আর তুই বলছিস আমি বোকা।’

তবলা হলুদ-সবুজ গদি লাগানো চেয়ারে নোংরা জুতো-পরা পা তুলে আরাম করে বসে। বলে, ‘পাতিলেবু দিয়ে কেউ অফিস বানায়? তুমি এমনি বোকা নয়, তুমি হলে পাতিলেবু বোকা।’

ধূর্জটিনারায়ণ ‘হো-হো’ আওয়াজে হেসে ওঠেন। বলেন, ‘আমাকে বোকা বলেছিস, আজ তোকে কিচ্ছু দেব না।’

তবলা মাথা চুলকোতে চুলকোতে বলে, ‘দিতে হবে না। বয়ে গেছে। তাও তুমি বোকা।’

এই ছেলেকে অতিরিক্ত পছন্দ না-করে উপায় কী?

আজ তবলাকে দেখে মাথায় কেমন যেন একটা ঝলক খেলে গেল ধূর্জটিনারায়ণের! তবলা রোজকার মতো চেয়ারে বসার পর গলা নামিয়ে ধূর্জটিনারায়ণ বললেন, ‘তবলা, আমার একটা কাজ করে দিবি?’

তবলা উদাসীন ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি আমার একটা কাজ করে দেবে?’

ধূর্জটিনারায়ণ ভুঁরু কুচকে বললেন, ‘কী কাজ?’

‘আগে বলো করে দেবে?’

ধূর্জটিনারায়ণ একটু ভাবলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে করে দেব। বল কী কাজ।’

তবলা চেয়ারে দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ল। ফিসফিস করে বলল, ‘গোলুকে স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করে দাও।’

ধূর্জটিনারায়ণ অবাক হয়ে বললেন, ‘গোলু! সেটা কে?’

তবলা বিরাট গোপন কিছু বলছে এই ভঙ্গিতে বলল, ‘গোলু পার্কে থাকে। বাবা-মা কেউ নেই। সারাদিন খেলে আর খিদে পেলে ঘুমিয়ে পড়ে।’

ধূর্জটিনারায়ণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘ওই ছেলে তোর কে হয়?’

তবলা বলল, ‘কেউ হয় না। আমার থেকে একটু ছোট। আগে বলো স্কুলে ভরতি করে দেবে? আমাদের স্কুলে দুপুরে ভাত দেয়। গোলুকেও দেবে।’

ধূর্জটিনারায়ণ বললেন, ‘ঠিক আছে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। শুধু স্কুল নয়, বইখাতাও পেয়ে যাবে।’

তবলা চেয়ারে আরাম করে বসে বলল, ‘ট্যাংকস।’ তবলার ‘থ’ এবং ‘ট’ উচ্চারণে গোলমাল আছে।

ধূর্জটিনারায়ণ বললেন, ‘এবার আমার কথাটা মন দিয়ে শোন। শনিবার সন্ধেবেলা আমার সঙ্গে এক জায়গায় যাবি।’

‘কোথায়? পার্কে?’

‘না, পার্কে নয়, স্টেজে উঠবি। স্টেজ জানিস তো? ফাংশন হয়। নীচে সবাই বসে থাকে, ওপরে গানবাজনা হয়?’

তবলা তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘ই স্টেজ জানব না? আমাদের স্কুলে পেরাইজ দিল। ই স্টেজে সবাই উঠল। এবার আমি পরীক্ষায় ভালো করলে আমিও পেরাইজ নিতে স্টেজে উঠব।’

ধূর্জটিনারায়ণ বললেন, ‘পেরাইজ নয়, প্রাইজ। শনিবার তুই স্টেজে উঠবি।’

তবলা উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘গান গাইব? হও ধর মেতে বীর? আমাদের স্কুলে হয়েছে।’

ধূর্জটিনারায়ণ মিনিটখানেক চুপ করে থাকলেন। তারপর খানিকটা আনমনে বললেন, ‘না, গান নয়, তুই হবি গেস্ট। অতিথি। বেশি করে জল খেয়ে যাবি। আমি বলব ওয়ান টু থ্রি। স্টেজ অন্ধকার হয়ে যাবে। তখন তুই চেয়ার থেকে নেমে পিছন ফিরে…।’

বাকিটুকু শুনে তবলা হাততালি দিয়ে হিহি করে হেসে উঠল। বলল, ‘আমি হব জেস্ট, আমি হব অতিতি।’

তবলার উচ্চারণে ইংরেজির ‘গে’ এবং বাংলার ‘থ’-তে কোনও গোলমাল নেই। সে সহজেই ‘গেস্ট’ এবং ‘অতিথি’ বলতে পারে। আজ উত্তেজনায় গোলমাল করে ফেলেছে।

তবলার হাসির মাঝখানেই উর্বশী মালাকারকে মোবাইলে ধরলেন ধূর্জটিনারায়ণ। ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘আপনার গেস্ট পাওয়া গেছে মিসেস মালাকার। বয়স খুবই কম। মাত্র আট। নাম তবলা। মানবসভ্যতায় ইয়ের ভূমিকা সম্পর্কিত আলোচনায় তবলা কিছু বলবে না। শুধু পারফর্ম করবে। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, তার পারফরমেন্সে হইহই পড়ে যাবে। খবরের কাগজ, টিভি ঝাঁপিয়ে পড়বে। আপনার ইন্টারভিউ, তবলার ইন্টারভিউ, জ্ঞানীগুণী শ্রোতাদের ইন্টারভিউ। সব মিলিয়ে সেমিনার উইল বি আ গ্র্যান্ড সাকসেস। আপনাদের স্পনসররা খুব খুশি হবেন। আপনি কি রাজি? তাড়া নেই, ভাবুন। ভেবে জানান।’

ফোন ছেড়ে তবলার দিকে তাকিয়ে হাসলেন ধূর্জটিনারায়ণ। বললেন, ‘বুঝলি তবলা, ঠিক করেছি, ব্যবসাটা বদলে ফেলব। তবে সাপ্লাই লাইন ছাড়ব না। কী করা যায় বল তো? তোর বাবার মতো চায়ের দোকান দিলে কেমন হয়? খদ্দেরকে চা সাপ্লাই?’

তবলা কান চুলকোতে চুলকোতে বলল, ‘খুব খারাপ হয়।’

ধূর্জটিনারায়ণ তলাপাত্র লম্বা করে শ্বাস নিলেন। এই তো গন্ধ ফিরে এসেছে! ভুরভুর করছে পাতিলেবুর গন্ধ! হরিমতি শর্মা কাজ জানে বটে! সময়মতো বিভ্রান্তিকে সত্যি করে দিতে পারে।

ধূর্জটিনারায়ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এই সেমিনারই তাঁর গেস্ট সাপ্লাইয়ের শেষ কাজ হবে। এরপর থেকে তিনি পাতিলেবু সাপ্লাই শুরু করবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *