পাতালের মাতুল

পাতালের মাতুল

কথা শুনলে গায়ে জ্বালা ধরে গাঁয়ের লোকের।

যত নালিশই আসুক ডলফের নামে, মা তা হেসে উড়িয়ে দেন, ‘ও ছেলে আমার তেমন নয় গো! দুটো দিন যেতে দাও বাছারা, ওর বুদ্ধিটা একটু পাকুক, তখন দেখো, ও একটা নাম-করা মানুষ হবে দেশের মধ্যে। একটু ক্ষ্যামা-ঘেন্না এই কয়টা দিন তোমরা না-করলে, আর কে করবে বলো!’

বিধবা অনাথা মেয়েমানুষটাকে কী আর বলা যায় মুখের উপর? বেগুন বেচা মুখ করে সবাই চলে যায় হেলিগার গিন্নির সমুখ থেকে। গজগজ করে আড়ালে আড়ালে, ‘শাসন নেই, শিক্ষা নেই। বুদ্ধি যখন পাকবে, ও ছেলে হবে ডাকু। এই পনেরো-ষোলো বছরেই যা নমুনা ছাড়ছে বাছাধন! কারও বাগানে একটা আপেল পাকবার জো নেই, ও গিয়ে রাতের আঁধারে তা পেড়ে এনেছে। কারও মোরগ উঠোনের বাইরে আসবার জো নেই, ও তাকে ভোগে লাগিয়েছে শিককাবাব করে। বুদ্ধি পাকলে?— হুঁঃ’

অনাথা হেলিগার গিন্নির মুখ চেয়ে গাঁয়ের লোক বাধ্য হয়েই দস্যি ছেলেটাকে ক্ষ্যামা-ঘেন্না করে। তবে সদাই তারা সচেষ্ট থাকে ওর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে। সদাই চোখ-কান মেলে রাখে, যাতে নিজেদের ছেলেগুলোও উচ্ছন্নে না-যায় ওর সঙ্গে মিশে। উপায় কী? সাবধান থাকতেই হবে কয়টা বছর, যতদিন বুদ্ধি না-পাকে ডলফের।

সবাই ডলফের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলে, কেবল এক বুড়ো গ্রুট ছাড়া। গির্জার চাকরি করে গ্রুট। গাঁয়ে কেউ মরলে গ্রুটই তার কবর খোঁড়ে। কাজেই তার একটু আলাদারকম খাতির আছেই গাঁয়ের ভিতর। সেই খাতিরটুকু সম্বল করে বুড়ো লেগে গেল, কী করে ছেলেটাকে কোনো একটা কাজে ভিড়িয়ে দেওয়া যায়, সেই চেষ্টায়।

ডাক্তার নিপারসেন হচ্ছেন গাঁয়ের একমাত্র ডাক্তার। ওষুধপত্র তাঁর তত নেই, যত আছে মোটা মোটা ডাক্তারি কেতাব। যখনই কোনো রোগী আসুক, দেখতে পাবে ডাক্তারটি বসে আছেন সেইসব কেতাবেরই কোনো একখানায় তন্ময় হয়ে। রোগী দাঁড়িয়ে বা বসে নিজের ব্যারামের বৃত্তান্ত বলে গেল। ডাক্তারের চোখ কিন্তু বই ছেড়ে রোগীর দিকে একবারও তাকিয়ে দেখল না। বৃত্তান্তটা শেষ হলে একটা হাঁক শোনা গেল— ডাক্তার ডাকছেন তাঁর সহকারীকে, ওষুধ দেবার জন্য।

সহকারী একজন চিরদিনই রাখেন ডাক্তার নিপারসেন। একাধারে সে ছাত্র ও কম্পাউন্ডার। গাঁয়েরই কোনো গরিবের ছেলেকে তিনি বহাল করেন এ কাজে। উদয়াস্ত সে খাটে। বড়ি পাকায়, মলম বানায়, পাঁচ মিশেলি ওষুধে জল ঢেলে ঢেলে লাল নীল সাদা ওষুধ তৈরি করে হরেকরকম। বিনিময়ে খেতে ও শুতে পায় ডাক্তারের বাড়িতে, আর পায় ভবিষ্যতের জন্য দরাজ প্রতিশ্রুতি— ‘তোকে আমি পুরোদস্তুর ডাক্তার বানিয়ে দেব। আমি মরলে আমারই জায়গা তুই দখল করতে পারবি এ গাঁয়ে’ ইত্যাদি।

ছাত্র কম্পাউন্ডার এ যাবৎ অনেক এসেছে, নিপারসেনের কাছে, কেউ এক বছর কেউ দুই বছরের বেশি টেকেনি। একঘেয়েমির জন্যই হোক অথবা পেট ভরে খেতে না-পাওয়ার জন্যই হোক, উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পাকাপোক্ত প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সবাই পালিয়েছে একে একে। গ্রুট শুনতে পেল, আবার কম্পাউন্ডারের সিংহাসন খালি হয়েছে নিপারসেনের ডাক্তারখানায়। সে গিয়ে ধরে পড়ল ডাক্তারকে, ‘ডলফ হেলিগারকেই নিতে হবে মশাই! ওর বাবা আমার দোস্ত ছিল। আমার খাতিরে ছেলেটার একটা হিল্লে করে দিন আপনি।’

ডাক্তারের কাজ মানুষকে কবরে পাঠানো, গ্রুটের কাজ মানুষের জন্য কবর খোঁড়া। কাজেই পরোক্ষভাবে দু-জনকে সহকর্মী না-বলা যাবে কেন? অন্তত গ্রুট তো নিশ্চয়ই ডাক্তারকে মনে করে সহকর্মী, তা নইলে কীসের জোরে সে খাতির দাবি করে তাঁর কাছে?

সে যাই হোক, খানিকটা গাঁই-গুঁই করে শেষপর্যন্ত ডলফকেই চাকরি দিলেন ডাক্তার। পাড়াপড়শি মন খুলে আশীর্বাদ করল ডাক্তার আর গ্রুট দু-জনকেই।

নিপারসেন ডাক্তারের চাকরি যখন নিয়েছে ডলফ, দিনের বেলাটা অন্তত গাঁয়ের বাড়িগুলো রেহাই পাবে ওর দৌরাত্ম্য থেকে।

আশীর্বাদ করলেন হেলিগার গিন্নিও। তাঁর এতকালের আশা বুঝি সফল হবার পথ ধরেছে এইবার। নিপারসেন তো বলেইছেন ডলফকে ডাক্তার করে দেবেন। তা ডাক্তারের চেয়ে মান্যগণ্য লোক আর কে থাকতে পারে পাড়াগাঁ জায়গায়? তিনি পড়শিদের ডেকে ডেকে বলতে লাগলেন, ‘দেখলে তো? আমি বলিনি যে ও একটা নাম-করা মানুষ হবে দেশের মধ্যে?’

দিন কাটে। ডলফ নাম-করা মানুষ হবার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। খেটে যাচ্ছে ভূতের মতো। না-খেটে উপায় নেই। ডাক্তারটি কড়া মনিব। বড়ি পাকানো, মলম বানানো, পাঁচ মিশেলি ওষুধে জল ঢেলে ঢেলে লাল নীল সাদা হরেকরকম মিকচার তৈরি করা— এসব ব্যাপারে এক মিনিটের ঢিলেমি দেখলে নিপারসেন গর্জে ওঠেন, ‘তবেই হয়েছ তুমি ডাক্তার! কাজে ফাঁকি দিতে চাও যদি, বেরিয়ে যাও আমার ডাক্তারখানা থেকে।’

হায়! বেরিয়ে যাওয়ার উপায় যদি থাকত, ডলফ কি এক মিনিট দেরি করত বেরিয়ে যেতে? এ কাজ তার একদম ভালো লাগে না! এযাবৎ তার দিন কেটেছে মাঠে-ঘাটে দস্যিপনা করে করে। কখনো কোনো পড়শির ঘোড়ার সওয়ার হয়ে দেশবিদেশ ছুটে বেড়াচ্ছে ঝড়ের বেগে, কখনো বা হডসন নদের দুর্বার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে সাঁতার কাটছে এপার-ওপার, আবার এমনও কোনো কোনো দিন ঘটে গিয়েছে যে, কোনো বন্ধুর বাবার বন্দুকটা কোনো ফিকিরে হাতিয়ে নিয়ে সে গিয়ে ডুব মেরেছে গহন অরণ্যে। হরিণ-টরিণ তুচ্ছ প্রাণীর তো কথাই নেই, দুর্দান্ত বাইসন বা জাগুয়ার সামনে পড়লেও সে তা মোকাবিলা করতে ভয় পায়নি সেদিন।

সেই ডলফ কিনা বুক-সমান-উঁচু টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে পিল বানাচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। জীবনে ধিক্কার এসে গিয়েছে ওর। কবে সে এ শিক্ষানবিশিতে লাথি মেরে বেরিয়ে পড়ত রাস্তায়, যদি না তার লজ্জা করত অনাথা মায়ের দুঃখের অন্নে ভাগ বসাবার জন্য সেই মায়েরই কুঁড়েতে ফিরে যেতে।

লজ্জা করবে, পারবে না ডলফ মায়ের মনে কষ্ট দিতে। মা যে দিন গুনছে, কবে ডলফ ডাক্তার হয়ে বেরুবে, কবে সে দশজনের একজন হয়ে মাথা উঁচু করে বেড়াবে এই গ্রামে! ডলফ ভাগ্যকে অভিশাপ দেয়। তবু দিনের পর দিন পিল বানাতেই থাকে নিপারসেনের টেবিলে দাঁড়িয়ে।

বললে লোকে হয়তো বিশ্বাস করবে না, এইভাবে চব্বিশ ঘণ্টা নিজেকে শাপান্ত করতে করতেও পরিপূর্ণ চারটি বছর নিপারসেনের ডাক্তারখানায় কাটিয়ে দিল ডলফ হেলিগার। ডাক্তারি সে থোড়াই শিখেছে, ডাক্তার হওয়া তার ভাগ্যে আছে, এমন আশা ভুলক্রমেও সে কখনো করে না।

কুড়ি বছর বয়স হল ডলফের। গাঁট্টা জোয়ান সে এই বয়সেই। আর এই সময়ই ঘটল একটা ঘটনা।

দেদার পয়সা জমিয়েছেন নিপারসেন এই গাঁয়ে ডাক্তারি করে করে। কী করা যায় সে পয়সা দিয়ে? গাঁ থেকে মাইল তিন দূরে একটা বাড়ি সস্তায় বিক্রি হচ্ছে শুনে ঝট করে তিনি তা কিনে ফেললেন।

কিনবার পরে তাঁর চক্ষুস্থির। বাড়িটা যে হানাবাড়ি, সে খবর তো তাঁকে আগে কেউ বলেনি!

নিপারসেনের মতলব ছিল, বাড়িতে আপাতত এক ঘর চাষিকে তিনি বসাবেন। বাড়ির লাগোয়া জমিগুলো আবাদ করবে তারা। আধাআধি বখরা দেবে ফসলের ফি-বছর। কিন্তু দেখ বরাতের ফের, কোনো চাষি ওবাড়িতে বসবাস করতে রাজি হয় না। এমনকী লাঙল নিয়ে ও-বাড়ির জমিতে ঢুকতেও তারা নারাজ। ‘কাঁচা মুণ্ডটা যমের হাতে কে তুলে দেবে মশাই?’— সাফ জবাব দেয় সবাই।

ডাক্তার যখন বাড়ি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন, ডলফ এল একটা প্রস্তাব নিয়ে, ‘বলেন যদি, আমি গিয়ে বাড়িটাতে বাস করি কিছুদিন। ভূত আমার করবে কী? আমি ওখানে বাস করেও জ্যান্ত আছি— এটা যখন দেখবে চাষিরা, সাহস পাবে ওদিকে ভিড়তে।’

নিপারসেন তো লুফে নিলেন এ প্রস্তাব। নিজে তিনি যথেষ্ট বিশ্বাস রাখেন যে, ভূতেরা ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারে মানুষের। বাড়ি কেনার অর্থটা বিলকুল লোকসান হতে বসেছে দেখেও নিজে গিয়ে ওখানে বাস করার কল্পনা একমুহূর্তের জন্যও মগজে আসেনি তাঁর। হাজার হোক পয়সা লোকসান হলে তা একদিন কোনো না-কোনোভাবে পূরণ হতেও পারে, কিন্তু জান লোকসান হয়ে গেলে তা আর পূরণ হবার ভরসা নেই কোনোদিন। তবে ডলফ যেতে চাইছে, যাক না! হাজার হোক, নিজের জীবনে অন্যের জীবনে বহুত ফারাক। হ্যাঁ, যায় যদি তো যাক।

কিন্তু ডলফ? সে যেতে চায় কেন? সে কি বিশ্বাস করে না ভূতে?

তা করে। পাড়াগাঁয়ের ছেলে, জ্ঞান হওয়ার পরে থেকেই ভগবানে আর ভূতে সমানভাবেই বিশ্বাস করতে শিখেছে। হ্যাঁ, বিশ্বাস করে, তবে ভয় করে না। করে না এই কারণে যে, ভয় বস্তুটাই তার অস্থি মজ্জায় কোথাও নেই। ভূত আছে, থাকুক, একটা শক্তসমর্থ মানুষের সে কী ক্ষতি করবে? আর বলতে কী, ভূতের অস্তিত্বে ষোলো আনা বিশ্বাস আছে বলেই ডলফ যেতে চাইছে হানাবাড়িতে। স্রেফ একঘেয়ে জীবনে একটুখানি বৈচিত্র্যের আশায়। পিল পাকিয়ে পাকিয়ে জীবনটাই যে বিস্বাদ লাগছে তার কাছে!

ডাক্তারের কাছে একটি শুধু অনুরোধ রাখল ডলফ তার মায়ের কাছে এ খবর এক্ষুনি যেন না-পৌঁছায়। যাক কিছুদিন। সব লোক যখন জানবে, মাও জানবেন আস্তে আস্তে। গোড়ায় জানতে পারলে মা একটা কান্নাকাটি জুড়ে দেবেন, একটা বিষম বাগড়া পড়ে যাবে ব্যাপারটাতে।

তাই হল। যথাসময়ে একদিন সন্ধ্যার পরে নিঃশব্দে হানাবাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেল ডলফ। সঙ্গে গেলেন ডাক্তার নিজে তাঁর রাঁধুনিটিকে নিয়ে। বাড়িটা দেখিয়ে শুনিয়ে দেবার জন্য আর কী! একটা ঘর খুলে ডলফকে তার ভিতর স্থিতু করে দিয়ে ওঁরা দু-জন ফিরে আসবেন। ডাক্তারের হাতে লণ্ঠন, রাঁধুনির হাতে একটা মোমবাতি, ডলফের বগলে একখানা কম্বল।

তিন মাইল পথ, এক ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেল সবাই। জায়গাটা এমন, দিনের বেলাও একা সেখানে গেলে গা-ছমছম করার কথা। চারদিকেই ছোটো ছোটো পাহাড়। মাঝ বরাবর একটা নীচু উপত্যকায় ওই একটিমাত্র বাড়ি। যথেষ্ট পুরোনো বটে, তবে ভেঙেচুরে পড়েনি এখনও। আসবাবপত্র অনেকই রয়েছে, তবে সবই কেমন সেকেলে ধরনের। ওলন্দাজেরা যখন উত্তর আমেরিকার এই অঞ্চলটাতে প্রথম আসে উপনিবেশ গড়ে তুলবার জন্য, সেই যুগের।

বলাবাহুল্য ডলফেরাও ওলন্দাজ। এ ফ্যাশানের খাট বিছানা টেবিল চেয়ার গাঁয়ের ধনীদের বাড়িতে সে আগেও দেখেছে। কাজেই এ বাড়ির পরিবেশটা তার ঘরোয়া বলেই মনে হল। সেও একটা স্বস্তি।

অনেক লম্বা লম্বা বারান্দা পেরিয়ে, অনেক সরু সরু সিঁড়ি মাড়িয়ে ডাক্তার ডলফকে এনে তুললেন একখানা বৃহৎ শয়নকক্ষে! একপাশে বৃহৎ খাট, তাতে ছেঁড়া গদি। অন্যপাশে বৃহৎ অগ্নিকুণ্ড, তাতে আগুন নেই। কোথা থেকেই বা থাকবে? মাঝখানে একখানা বৃহৎ সোফা, তার উপরে আচ্ছাদনের কোনো বালাই নেই। শক্ত কাঠে ধুলো জমে আছে রাশি রাশি।

ডলফ কম্বল বিছিয়ে ফেলল ছেঁড়া গদির উপরে। রাঁধুনি মোমটা জ্বেলে অগ্নিকুণ্ডের মাথায় বসিয়ে দিল। ডাক্তার বললেন, ‘দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ো। কেমন?’

এই বলেই লণ্ঠন এবং রাঁধুনি নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। ডলফ ঘরের দরজায় খিল এঁটে দিল এবং শুয়ে পড়ল হানাবাড়ির ছেঁড়া গদিতে। ভূতের কথাই ভাবছে সে, তাতে সন্দেহ নেই। তবে সে ভাবনার সঙ্গে ভয়ের সংস্রব আদৌ নেই। যা আছে, তা হল কৌতূহল। গাঁয়ে ঘরে ভূত হচ্ছে একটা পহেলা নম্বরের আলোচ্য বিষয়। যদিও এমন কোনো লোকের সঙ্গে ডলফের আজও পরিচয় ঘটেনি, যে নাকি নিজের চোখে ভূত দেখেছে। আজ যদি ডলফ নিজের চোখে তো দেখতে পায়, সে অবশ্যই নিজের বরাতের প্রশংসা করতে পারবে।

ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল ডলফ।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল তার হিসাব কে দেবে? হঠাৎই ভেঙে গেল ঘুম। মোম তখনও জ্বলছে। সেই আলোতে ডলফ দেখল, এসেছে ভূত, সত্যিই এসেছে। ঘরে আর সে একা নয়। দরজা যদিও আগের মতোই খিল বন্ধ রয়েছে, তবু এক দশাসই লম্বা-চওড়া আধবয়সি পুরুষের আবির্ভাব ঘটেছে হাড্ডিসার সোফার উপরে। পোশাক তার পুরোনো কালের ওলন্দাজদের মতোই। লালচে চুল দাড়ির বেষ্টনীর ভিতরে পাকাটে মুখখানা তার বড়োই যেন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।

বেশ মনোযোগ দিয়ে দু-জনে দু-জনকে দেখছে। ভূত দেখছে ডলফকে, ডলফ দেখছে ভূতকে। ডলফ ভাবছে, ভূতটা যখন এসেইছে, কথা বলে না কেন? কিংবা ভয় দেখাবার মতলবে যদি এসে থাকে, ভেংচি-টেংচি কাটে না কেন? পরক্ষণেই তার মনে পড়ে গেল ভূতের তো রক্তমাংসের দেহ নেই, যা দেখা যাচ্ছে, তা ছায়া বই আর কিছু নয়। ছায়া কথা কইবে কেমন করে? আর ভেংচি, ভয় দেখাবার জন্য ও হয়তো আসেইনি আদৌ।

তবে? ওর সঙ্গে আলাপ জমানো যায় কেমন করে?

খানিকটা ইতস্তত করে বেশ মোলায়েম সুরেই ডলফ বলল, ‘দেখুন মিস্টার ভূত, আপনি যখন দয়া করে দেখা দিয়েছেন এ অধমকে, তখন অবশ্যই ধরে নিতে পারি যে, আমার কাছে কোনো দরকার আছে আপনার। সে দরকারের কথাটা চটপট বলে ফেললে ভালো হয় না কি? রাত এখনও খানিকটা আছে বোধ হয়। আর একটু ঘুমুতে চাই।’

নাঃ, জবাব নেই, মিস্টার ভূতের তরফ থেকে।

অতঃপর কী করা যেতে পারে, তাই ভাবছে ডলফ। এমন সময়ে ভূতটা উঠে দাঁড়াল সোফা ছেড়ে। হেঁটে গেল দুই পা, দরজার দিকেই গেল। তারপর থামল, আর পিছন ফিরে তাকাল ডলফের দিকে। ডলফ যেন দেখল, ভূতের মাথাটা নড়ছে অল্প অল্প, যেন সে ইশারায় ডাকছে ডলফকে সঙ্গে আসবার জন্য।

ডলফ উঠে বসল বিছানার উপরে।

ভূত আবার দুই পা হাঁটল, আবার থামল, আবার ইশারা করল তেমনিভাবে।

নিশ্চয়ই ভূত এইটাই চাইছে যে, ডলফ অনুসরণ করুক তার?

মতলব কী ভূতটার? ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে ডলফের। সে উঠে দাঁড়াল খাট থেকে, দুই পা সেও এগিয়ে গেল ভূতের দিকে। এবারে ভূতের মাথা বেশ জোরে জোরে নড়ছে, বেশ খুশি খুশি ভাব তার।

ভয়? ডলফ ও চিজটার সঙ্গে পরিচিত নয়। ভূত কেন তাকে সঙ্গে আসতে বলছে, জানবার জন্য দারুণ ব্যস্ত হয়েছে ও।

ভূত দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আবার ইশারা করল ওকে, তারপর কী কাণ্ড! বেমালুম উবে গেল ডলফের চোখের সামনেই। ডলফ চোখ কচলাচ্ছে। সত্যিই উবে গেল নাকি? নাকি চোখের ভুল হচ্ছে ডলফের?

না, ভুল তার হয়নি। সত্যিই নেই ভূতটা।

অর্থাৎ সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ঘরে ঢোকার বেলায়ও বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে সে ঢুকেছিল। বেরুবার বেলায়ও বন্ধ দরজা তার গতি রোধ করতে পারেনি। কিন্তু বেরিয়ে যাওয়ার আগেও সে তৃতীয় বার ইশারা করে গিয়েছে ডলফকে। ডলফ কি ভয় পাবে তার সঙ্গে যেতে? আরে তাই কখনো হয় নাকি? ভয়? ছি^ঃ!

যেহেতু বন্ধ দরজার ভিতর দিয়ে বেরুনো ডলফের পক্ষে সম্ভব নয়, তাই সে খুলে ফেলল দরজাটা। বাঃ! ওই যে মিস্টার ভূত, ঠিক দুই পা সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন তার প্রতীক্ষায়!

তারপর সরু সরু সিঁড়ি আর লম্বা লম্বা বারান্দা বেয়ে বেয়ে অনেকক্ষণ ধরে ভূতের অনুসরণ করল ডলফ। অবশেষে ভূত থামল আর একটা দরজায়। তারপর আবার চট করে উবে গেল ওর সমুখ থেকে।

এবার আর ভেবে দেখবার কিছু নেই, ডলফ দরজাটা খুলে ফেলল। ঠিক! ওই তো দাঁড়িয়ে আছে ভূত। ডলফকে দেখেই সে আবার চলতে শুরু করল। এবার আর তারা বাড়ির ভিতরে নেই। খোলা উঠোন, তারপরে খানিকটা মাঠ। অনেক পথ পেরিয়ে বিশাল এক ইঁদারার পাশে গিয়ে দাঁড়াল ভূত।

ডলফও আছে ভূতের পিছনেই।

ভূত আবারও ফিরে তাকাল ডলফের পানে। জ্যোছনায় ঝকঝক করছে চারিধার। ভূতের মুখখানা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ডলফ। কী করুণ আবেদন বেচারা ভূতের মুখে-চোখে! কিছু একটা সাহায্য যে ডলফের কাছে ও চাইছে, তাতে তো আর কোনো সন্দেহই নেই!

কী সাহায্য হতে পারে সেটা? হায়, বেচারা ভূত! তার তো কথা কইবার সামর্থ্য নেই!

এইবার আর এক কাণ্ড! ভূতটা ইঁদারার ভিতরে নেমে যাচ্ছে যে! আরে, কোথায় যায় ও? কোথায় যায়?

ডলফের দিকেই দুই চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ভূতটা ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে ইঁদারায়। এইবার তার কোমরের নীচের সবটা অদৃশ্য হয়ে গেল। এইবার বুক। এইবার কাঁধ—

আর একটা মিনতিভরা ইশারা, তারপর ভূত অদৃশ্য।

ভূতটা পাগল নাকি? ওর ওই শেষ ইশারা শিরোধার্য করে ডলফও ইঁদারায় নামবে, এরকমটা যদি ও প্রত্যাশা করে থাকে, তবে ডলফ বলবে, ভূতটা নেহাতই ভূত। ওর কোনো আক্কেল নেই।

না, নামবে না ডলফ নিশ্চয়ই। তবে ইঁদারার উপর থেকে ঝুঁকে পড়ে যতটা সম্ভব দেখে নেবে ওর নীচের অবস্থাটা। ভূত কি এখনও নামছে, না উবে গিয়েছে?

উঁচু গাঁথুনি দিয়ে ঘেরা রয়েছে ইঁদারার মুখ। ডলফ এসে সেই গাঁথুনির উপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ল। চাঁদের আলোতে ইঁদারার নীচের দিকটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। জল চকচক করছে জ্যোছনায়, তবে বহু বহু নীচে। আর ভূত? বেমালুম হাওয়া! সে ওই পাতালে ডুব মেরেছে নিয্যস। এই পাতালেই থাকে না কি ও? অমন ইট পাথরের মোকাম পছন্দ নয় ওর!

যাক সে কথা, এ রাত্রে ডলফের আর কিছু করবার নেই। সে গুটি গুটি ফিরে গেল বাড়ির ভিতরে, তার শোবার ঘরে। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল, যেন সে দড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে ইঁদারার ভিতরে, যাচ্ছে— যাচ্ছে— একদম পাতালে নেমে যাচ্ছে—

কী যেন একটা কী পাতাল থেকে তুলে আনবার জরুরি তাগিদ রয়েছে তার। না আনলে যেন কিছুতেই চলবে না। জিনিসটা যেন তারই, তার ছাড়া আর কারুর নয় যেন—

তারপর স্বপ্নেই সে আবার দেখল, সেই বিষণ্ণ-বদন ভূতটাকে। সে যেন ঠোঁট নাড়ছে, ডলফের কানে যেন ভূতের কথা স্পষ্ট ধরা পড়ছে, ‘ওটা তোমারই। একটু মেহনত করে তুমি ওটা তুলে আনো বাবা! তুমি তো ভীতু নও।’

ঘুম ভাঙতেই ডলফ দেখল, রাত ভোর থেকে এসেছে। সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল বাড়িটা থেকে, লোকজন জেগে ওঠার আগেই নিপারসেনের ডাক্তারখানায় তাকে পৌঁছোতে হবে। সে যে হানাবাড়িতে রাত্রিযাপন করেছে— এটা আপাতত কাউকে জানানো চলবে না।

‘না, কিছু দেখিনি। অঘোরে ঘুমিয়েছি সারা রাত’— ডাক্তারের নানা প্রশ্নের জবাবে সাফ জবাব দিয়ে যাচ্ছে ডলফ, ‘ভূত তো দূরে থাকুক, একটা ছারপোকা পর্যন্ত কামড়ায়নি স্যার!’

বরাত ভালো ডলফের, দিনের ভিতর একসময় গ্রুট এল ডাক্তারের বাড়িতে বেড়াতে। ডলফ কোনোদিন যা করেনি, তাই করল আজ। মুখটা কাঁচুমাচু করে গ্রুটকে বলল, ‘কাকা, বড্ড মুশকিলে পড়েছি, কিছু পয়সা আমায় দেবে?’

কোনোদিন যে পয়সা চায় না, সে আজ চায় কেন? গ্রুট অবাক। তবু, গ্রুট ভালোবাসে ছেলেটাকে। বিমুখ করতে পারল না তাকে। পকেটে যা ছিল, সব ঝেড়ে ডলফকে দিয়ে দিল।

সন্ধ্যা হতে না-হতেই ডলফ বেরিয়ে পড়ল একটা মোমবাতি নিয়ে। আজ তো আর পথ দেখাবার জন্য ডাক্তার বা রাঁধুনির যাওয়ার দরকার নেই তার সঙ্গে।

ডলফ বেরুল, কিন্তু সোজাসুজি হানাবাড়ির দিকে না-গিয়ে উঠল গিয়ে গাঁয়ের মুদিখানার দোকানটাতে। ওরা গেরস্তালির হরেকরকম জিনিসই মজুত রাখে সারা বছর। কার কখন কী দরকার হয়ে পড়ে, বলা যায় কী!

আজ ডলফের দরকার কয়েক গাছা মজবুত দড়ি। ডাক্তারের গোরু বাঁধবার দড়িগুলো বিলকুল পচে গিয়েছে। একটা একটা করে ছয়গাছা দড়ি সে বেছে নিল। দাম মিটিয়ে দিল গ্রুটের পয়সা দিয়ে।

হানাবাড়িতে পৌঁছে ডলফের কাজ হল আজ, ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়া নয়, ইঁদারার পাশে বসে খাটো দড়িগুলো জোড়া দিয়ে দিয়ে একটা পেল্লায় লম্বা দড়ি বানানো। তা ছাড়াও, সেই পেল্লায় লম্বা দড়ির মাঝে মাঝে এক-একটা গেরো দেওয়া। নামবার সময় ওইসব গেরোতে হাত রাখা চলবে এক-আধ মিনিটের জন্য, গেরোতে পা বাঁধিয়ে জিরোনোও চলবে দরকার মতো।

ইঁদারা থেকে সামান্য দূরে একটা বাবলা গাছ। কালই তা লক্ষ করেছিল ডলফ। সেই গাছের গুঁড়িতে শক্ত করে দড়ির এক মাথা বেঁধে ফেলল সে। তারপর দড়ি ঝুলিয়ে দিল ইঁদারার ভিতর। জলের তলাতেও দড়ি নেমে গেল অনেকদূর। এইবার ডলফ জামাকাপড় ছেড়ে রাখল বাবলার তলায়, আর ‘জয় যিশু’ বলে নেমে পড়ল দড়ি ধরে।

শীতের দিন নয়, তবু শীত-শীত করছে বই কী! কেমন যেন শিউরে শিউরে উঠছে দেহের ভিতরে। শীত? না ভয়? ভয়? ধ্যুৎ! কিন্তু শীতও না। তবে কী এটা?

যা খুশি তা হোক, ডলফ সড়সড় করে নামছে। মাঝে মাঝে জিরিয়ে নিচ্ছে দড়ির গিঁট ধরে ধরে, যাতে নতুন দড়ির ঘষায় হাতের চামড়া ছড়ে না-যায়। কিন্তু কতক্ষণ আর? নামতে শুরু করার একটু পরেই ডলফ দেখল সে জল ছুঁয়েছে। যদিও উপর থেকে মনে হয়েছিল, গভীর ইঁদারার তলায় পৌঁছুতে সময় লাগবে অনেক।

বরাত ভালো, কুয়োর জল গরম। যতক্ষণ খুশি ও থাকতে পারবে এ জলে। কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে।

জল গভীরও। দশ-বারো ফুট তো বটেই। ডলফ দড়ি ছেড়ে দিয়ে ডুব দিল জলে। পচা গন্ধ অবশ্য জলটাতে। তা সে তো স্বাভাবিক! কেউ নাড়ে-চাড়ে না এ-জল!

ডুব! ডুব! ডুবিয়ে হডসনের তলা থেকে মাটি তুলে আনে ডলফ, দশ-বারো ফুট জলের তলায় পৌঁছে মাটি হাতড়ে দেখা তার পক্ষে শক্ত কত! প্রথম বার গোলপানা একটা কী পিছল জিনিস হাতে ঠেকতেই সেটা তুলে নিয়ে ভুস করে জলের উপরে ভেসে উঠল ডলফ!

চাঁদের আলোতে জিনিসটা দাঁত বার করে হেসে উঠল ডলফকে দেখে। কী সর্বনাশ! মড়ার মাথা একটা, সাদা হাড় শ্যাওলায় সবুজ হয়ে গিয়েছে এখানে-ওখানে।

এমন চমকে উঠেছিল ডলফ যে মড়ার মাথাটা তার হাত থেকে ফসকে জলে পড়ে গেল আবার। সে ভাবতে লাগল, জলে ভাসতে ভাসতে অনেক কথাই মাথায় আসছে তার।

ভূতমশাইয়ের মতলবখানা এবার যেন বোঝা যাচ্ছে একটু একটু। এইখানে ইঁদারার জলে পড়ে আছে তার হাড়গোড়গুলো। গির্জার আঙিনায় কবর না-পাওয়ার দরুন আত্মা শান্তি পাচ্ছে না তার। ডলফকে ডেকে আনার ভিতরে ভূতের উদ্দেশ্য ছিল এই যে, ও তার হাড়গুলোকে তুলে নিয়ে খ্রিস্ট ধর্মের বিধানমতে কবর দিক।

বড়ো চাট্টিখানা কথা নয় মিস্টার ভূত! বহুত ঝামেলার ব্যাপার ওটা।

তবু, নেমে যখন আসাই গিয়েছে, নিঃসন্দেহ হয়ে নেওয়া ভালো। মাথাটাই ডলফ পেয়েছে এযাবৎ। ধড়টাও এখানেই আছে তো? এমন যদি হয় যে ধড়টা এখানে নেই। শুধু কাটা মুণ্ডটাই পড়ে আছে। তাহলে ডলফ এক্ষুনি সেটাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। লুকিয়ে রাখতে পারে অন্য কোথাও দুই-একদিন, তারপর গ্রুটকে খোশামোদে রাজি করিয়ে গির্জার হাতায় একটা গর্ত করে—

সে পরের কথা। আগে জানা দরকার সত্যিকার অবস্থাটা। ডলফ আবার ডুব দিল। যাচ্চলে! একটা আংটার ভিতর হাত ঢুকে গেল ডলফের। কীসের আংটা হতে পারে? বালতির? কড়ার? সিন্দুকের ডালার?

না, সিন্দুক নয়, জিনিসটা হালকা। অনায়াসে এক হাতেই ওটা উঁচু করে তুলে ফেলল ডলফ। জলের উপরে ভেসে উঠে দেখল, একটা বালতির মতোই বস্তু, মাঝারি আকারের। কী থাকতে পারে এতে? বালতির মুখে একখানা থালা চাপা দেওয়া রয়েছে, সরু তার দিয়ে তা আবার বালতির সঙ্গে মজবুত করে বাঁধা।

কী থাকতে পারে এর ভিতর?

বালতিটা দড়ির শেষ মাথায় বেঁধে ফেলল ডলফ, ওঠার সময় উপরে নিয়ে যাবে। তারপরে হাড়গোড়ের সন্ধানে আবার দিল ডুব। উঠল বই কী! বড়ো-ছোটো নানা আকারের হাড়ের টুকরো উঠতে লাগল একটার-পরে-একটা। মানুষটাকে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ইঁদারায় ফেলে দিয়েছিল কোনো ডাকুর দল। কী জন্য? ওই বালতিটার জন্যই কি?

হাড়গুলো আপাতত থাকুক। বালতিটা নিয়ে যাওয়া যাক। রহস্যের সমাধান হয়তো ওরই ভিতরে আছে।

ডলফ আগে নিজে উপরে উঠল দড়ি বেয়ে। তারপরে বালতিসুদ্ধ দড়িটাও তুলল টেনে। প্রথম কাজ জামা পরে নেওয়া, তারপর বালতি আর দড়ি নিয়ে বাড়ির ভিতর ঢুকে পড়া। সেখানে দরজা বন্ধ করে বালতি খুলে দেখা—

খুলে যখন দেখল, ডলফের চক্ষু স্থির! এক বালতি মোহর বালতির ভিতর। আর একটা পিতলের মজবুত কৌটো, সেটা খুলতে রীতিমতো বেগ পেতে হল ডলফকে। এমনভাবে তা বন্ধ করা, যাতে জল ঢুকতে না-পারে কৌটোতে।

তবু অনেক চেষ্টায় তা খুলে ফেলল ডলফ। আর কিছু নয়, একখানা চিঠি। ওলন্দাজ ভাষায় তাতে লেখা—

‘মাত্র আঠারো বছর বয়সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিলাম পয়সা করবার জন্য। ক্যালিফোর্নিয়ায় নদীর চড়ায় বালি ধুয়ে ধুয়ে সোনার কণা বার করেছি, প্রায় কুড়ি বছর ধরে। তারপর শহরে গিয়ে বেচলাম সেই সোনার কণাগুলি। মন্দ দাম হল না। তারপর শুরু করলাম লগনির ব্যাবসা, চড়া সুদে। বছর দশেক রইলাম সে ব্যাবসা নিয়ে। তারপর বাড়ির জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠল, ব্যাবসা গুটিয়ে ফেলে এক বালতি মোহর কিনে ফেললাম সর্বস্বের বিনিময়ে।

বাড়ি এসে দেখি আপনার জন সব মরে গিয়েছে, তবে একটা ছোটো বোন নাকি বেঁচে আছে হডসনের কূলে ক্যাটস্কিল পাহাড়ের আনাচেকানাচে কোনো এক জায়গায়। তার স্বামীর নাম গুস্টেড হেলিগার—’

এই পর্যন্ত পড়েই চমকে আঁতকে একেবারে লাফিয়ে উঠল ডলফ। গুস্টেড হেলিগার তো তারই বাবার নাম! এ চিঠি যার লেখা, সে তা হলে সাক্ষাৎ ডলফের মামা? হ্যাঁ, মনে পড়ছে তো! তার মা তো মাঝে মাঝেই তার এক নিরুদ্দেশ মামার গল্প করে থাকে। কী নাম ভালো? স্পিগেল! ফিলিয়ান ভ্যান্ডার স্পিগেল!

চিঠির নীচেও এই যে নাম সই রয়েছ ‘ফিলিয়ান ভ্যান্ডার স্পিগেল’!

নিজের উত্তেজনা নিজেই কোনোরকমে শান্ত করল ডলফ। তারপরে পড়ে ফেলল চিঠির বাকি অংশটা। খুঁজতে খুঁজতে স্পিগেল এই বাড়ি পর্যন্ত এসে পড়েছিল। হঠাৎ ঝড়-বাদলা শুরু হল বলে আশ্রয় নিল এই বাড়িতে রাতটার জন্য। কিন্তু তাইতেই হল সর্বনাশ। মালিকেরা কেউ উপস্থিত ছিল না এখানে, ছিল একপাল চাকরবাকর। তারা কেমন করে যেন টের পেয়ে গেল যে বালতিতে সোনা ভরতি।

আর তারা যে টের পেয়েছে, তা বুঝতেও পারল স্পিগেল। তার মনে নিশ্চিত ধারণা হল যে, রাতের ভিতরেই তাকে খুন করে ওই চাকরেরা তার সোনা লুঠ করবে।

‘কী করব? কেমন করে রক্ষা পাব এ সংকটে?’— এই ভাবতে ভাবতে স্পিগেল লিখে ফেলেছিল এই চিঠিটা। ‘কেমন করে রক্ষা পাব’— এই কথাতেই চিঠি শেষ।

না, রক্ষা সে পায়নি।

চিঠি লেখার পরের ঘটনাগুলো ডলফ অনুমান করেই নিল। চিঠি কৌটোয় বন্ধ করে বালতিতে রেখে সেই তুমুল ঝড়-বাদলার বাড়ির আশ্রয় ছেড়ে হয়তো বেরিয়ে পড়েছিল মামা। চাকরগুলোও হয়তো সঙ্গে সঙ্গে ধাওয়া করেছিল পিছনে। পালাবার মুখে বালতিটা লুকিয়ে ফেলবার জন্যই হয়তো বেশি ব্যস্ত হয়েছিল স্পিগেল। তাই ইঁদারাটা দেখতে পেয়ে ওটা ফেলে দিয়েছিল তারই ভিতরে।

তারপরে চাকরগুলোও হয়তো তাকে ধরে ফেলেছিল, আর মোহর না-পাওয়ার দরুন রাগের মাথায় স্পিগেলকে খুন করে ফেলে দিয়েছিল ওই ইঁদারাতেই।

সে যাই হোক, মামার অর্থ ভাগনেই পেয়েছে। পাতাল থেকে তুলে এনে মামাকে যথাশাস্ত্র কবর দেবেই ডলফ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *