পাতালকুঠুরী লণ্ডভণ্ড
প্রয়াত হ্যারি প্রাইস পল্টারগাইস্টদের সম্পর্কে বলেছিলেন এরা রীতিমত অভিশপ্ত প্রেতাত্মা, ভয়ঙ্কর এদের আচরণ। সাধারণ ভূতেরাও নানা ধরনের সমস্যা তৈরি করে। কখনও এরা দেখতে ভীতিকর, বদখত, প্রচুর শব্দ করে, তবে এদের মধ্যে অনেকই আছে যারা মানুষের বিশেষ করে যাদের বাড়িতে বা এলাকায় থাকে তাদের ক্ষতি করে না। কখনও কখনও তো রীতিমত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে।
কিন্তু পল্টারগাইস্টদের কাছে এসব প্রত্যাশা করা বৃথা। এরা ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে অভ্যস্ত, এমনকী এই আচরণের পেছনে গ্রহণযোগ্য কোন কারণও থাকে না। প্ৰচণ্ড প্রতিহিংসাপরায়ণও। বলা হয় সাধারণ ভূতেরা কেবল কোথাও উদয় হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেও এরা রীতিমত উপদ্রব চালায়।
নানা ধরনের পরিবেশেই পল্টারগাইস্টদের আনাগোনার খবর পাওয়া যায়। স্বাভাবিকভাবেই সমাধিক্ষেত্রগুলোও এর ব্যতিক্রম নয়।
তবে এর সঙ্গে আবার বিভিন্ন গোরস্থানে দেখা দেয়া নিরপরাধ কিছু প্রেতাত্মাকে গুলিয়ে ফেলবেন না যেন। মেরি কটনের সেই শিশু শিকারদের কথা বলা যেতে পারে। নিজের চার সন্তানসহ গোটা পনেরো শিশুকে হত্যার অভিযোগে ফাঁসি হয় ডারহামের পশ্চিম অকল্যাণ্ডের মেরি কটনের। যেসব গোরস্থান ও সমাধিক্ষেত্রে এই শিশুদের গোর দেয়া হয় সেসব জায়গায় তাদের ভূতের দেখা মেলে। এমনই এক দুর্ভাগা ছোট্ট ভূত একবার গ্রামের পোস্টম্যানকে অনুসরণ করতে থাকে। পরনে ছিল গোর দেয়ার সময়কার পোশাকটি। একপর্যায়ে পোস্টম্যানের পিছু পিছু তার বাড়ি হাজির হয়। তারপর ঢুকে পড়ে ভদ্রলোকের ছোট্ট শিশুটি যে কামরায় ঘুমিয়ে ছিল সেখানে। আতঙ্কিত পোস্টম্যান ও এই দুর্ভাগা ছোট্ট মেয়ের অশরীরীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে সদাশয় এক মহিলা। ভুতুড়ে এক বাড়িতে বাস করা ওই বুড়ো মহিলা প্রেতাত্মাদের সঙ্গ পেয়ে অভ্যস্ত। মহিলা পরে বলে, ‘অন্ধকার পাতালকুঠুরী খুব ঠাণ্ডা, সেখানে নিঃসঙ্গও ছিল মেয়েটা। ওকে একটু আরাম দেয়ার চেষ্টা করেছি আমি। তোমাকে আর বিরক্ত করবে না সে।’ সত্যি ছোট্ট ওই ভূতকে আর দেখা যায়নি। ধারণা করা হয় বুড়ির ভুতুড়ে বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিল সে।
এই পল্টারগাইস্টরা সাধারণ শান্ত প্রেতাত্মাদেরও বেশ ঝামেলায় ফেলে। বলা হয় কোন কোন গোরস্থানের পারিবারিক ভল্ট বা পাতালকুঠুরীগুলোতে মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা।
এবার যে ঘটনাটি বলব সেটা রেকর্ড করা হয় ইংল্যাণ্ডের সাফোক কাউন্টির স্টেনটন গ্রামের এক সমাধিক্ষেত্র থেকে ১৮১৫ সালে।
একদিন ভল্ট খুলতেই দেখা যায় কাঠের পাটাতনে আটকানো কাঠের ঢাকনি দেয়া কিছু সীসার কফিনের জায়গা বদল হয়ে গিয়েছে। গ্রামবাসীরা ভয় পেয়ে গেল। কফিনগুলো আগের জায়গায় রেখে পাতালকুঠুরী আটকে দেয়া হলো। কিছুদিন পর একজনকে সমাধিস্থ করতে গিয়ে একই সমস্যা চোখে পড়ল গ্রামবাসীর। দু’বছর বাদে যখন আবার খোলা হলো ভল্ট, আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। অন্যান্যবারের মত কফিনগুলো শুধু এলোমেলো অবস্থায়ই নেই, আটজন মানুষ বইতে হয় এমন একটা ওজনদার কফিন ভল্টের দিকে যাওয়া সিঁড়ির ওপর এনে রাখা। কে করল তবে কাজটা?
দু’একজন অতি বুদ্ধিমান দাবি করল পাতাল নদীর জলস্রোতের কারণে এটা হতে পারে। কিন্তু সেরকম কোন আলামত চোখে পড়ল না। তাছাড়া এরকম পানির তোড়েও সীসার কফিন নড়ার কথা নয়।
তবে এ ধরনের ঘটনার সবচেয়ে বড় প্রমাণটি পাওয়া যায় ওয়েস্ট ইণ্ডিজের বার্বাডোজে, ক্রাইস্ট চার্চের সঙ্গে যুক্ত ছোট্ট এক গোরস্থানে। দ্বীপটির সবচেয়ে দক্ষিণের বাতিঘরটির কাছেই এর অবস্থান। ব্রিজটাউন থেকে সড়ক পথে দূরত্ব আধ ঘণ্টা।
সাগর সমতল থেকে শ’খানেক ফুট উচ্চতায় ভল্টটি। পাথর কেটে ভেতরে বানানো হয়েছে। এর মেঝে, দেয়াল স্বাভাবিকভাবেই পাথরের। ওটা আটকানো নীল ডেভনশায়ার মার্বেল পাথরের টুকরো বা স্ল্যাব দিয়ে। জিনিসটা এতটাই ভারী যে কয়েকজন লোক লাগে তুলতে।
বার্বাডোজের প্রাচীন কয়েকটি পরিবারের সম্পত্তি এই ভল্ট। ওয়ালরণ্ডদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এটি। তাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্র ধরে পায় ইলিয়টরা। রাজার সভাসদের সদস্য ছিল এই পরিবারগুলোর কর্তাব্যক্তিরা। প্রচুর দাস ছিল তাদের। দ্বীপ শাসন করত তারাই।
১৭২৪ সালে বার্বাডোজ কাউন্সিলের সদস্য জেমস ইলিয়ট মারা যান ৩৪ বছর বয়সে। তাঁর দুর্ভাগা স্ত্রী টমাস ওয়ালরণ্ডের মেয়ে এলিজাবেথ স্বামীর দেহাবশেষ নিয়ে আসেন তাঁদের পারিবারিক ভল্টে। পাথরের ফলকে খোদাই করার ব্যবস্থা করেন কয়েকটা বাক্য, ‘সাহসী, পরোপকারী একজন মানুষ ছিলেন তিনি। ১৪ মে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় তাঁকে। পরিচিত সবাই তাঁর এই অকাল মৃত্যুতে ব্যথিত, পীড়িত।’
১৭২৪ সালে এখানে কয়টা কফিন ছিল তার রেকর্ড ছিল না। তবে শতকের বাকি সময়টা মোটামুটি নতুন কাউকে সমাধিস্থ করা হয়নি। ১৮০৭ সালের জুলাইয়ে গির্জার যাজকের কাছে একটা দরখাস্ত পেশ করা হয়, তাতে ইলিয়টদের আত্মীয়া মিসেস থমাসিনা গডার্ডকে এই ভল্টে সমাহিত করার আবেদন করা হয়। গির্জার পক্ষ থেকে অনুমতি দেয়া হয়।
শ্রমিকরা তখনই অক্ষত সিলগুলো ভেঙে ফেলে। নিগ্রো দাসরা বিশাল মার্বেল পাথরের খণ্ডটা সরাতেই সবার চোখ ছানাবড়া। ভেতরটা শূন্য। ইলিয়ট বা ওয়ালরওদের কারও কফিনই নেই। অনেক তল্লাশি চালিয়েও ওগুলোর খোঁজ মিলল না। যা হোক, মিসেস গর্ডাডকে সমাধিস্থ করার কাজ এতে আটকে থাকল না। ৩১ জুলাই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন পাতালকুঠুরীতে।
তারপর ভল্টটির মালিকানা পায় চেজ পরিবার। ধনী, ক্ষমতাধর এক পরিবার। ওই সময়ে ওয়েস্ট ইণ্ডিজের অন্যান্য অভিজাত ইয়োরোপীয় পরিবারগুলোর মত বেশ কিছু বাগান এবং দাসের মালিক ছিল পরিবারটি। ভল্টের প্রবেশ পথের ওপরে চেজ পরিবারের প্রতীকচিহ্ন খোদাই করে দেয়া হলো। ওটা দেখতে পাবেন এখনও।
প্রথম চেজ হিসাবে সমাধিস্থলটিতে গোর দেয়া হয় ম্যারি অ্যানা মারিয়াকে, এলাকার মান্যগণ্য ব্যক্তি টমাস চেজের কিশোরী বোন সে। ১৮০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যায় ছোট্ট মেয়েটি। একটা সীসার কফিনে পুরে তাকে আনা হলো। সমাধিস্থ করতে ভল্ট খোলা হলে দেখা গেল মিসেস গডার্ডের কাঠের কফিনটি আগের জায়গাতেই আছে।
১৮১২ সালের ৬ জুলাই পাতালকুঠুরী আবার খোলা হয় টমাস চেজের আরেক বোন ডোরকাস চেজকে কবর দিতে। এবার নিহতের সঙ্গে আসা আত্মীয়-স্বজন ভেতরের অবস্থা দেখে থ হয়ে গেল। অ্যানা মারিয়ার মৃতদেহসহ সীসার কফিনটা খাড়া হয়ে আছে। কফিনের মাথার অংশটা নিচের দিকে। আর যেখানে রাখা ছিল তার উল্টো পাশে আছে এখন। মিসেস গডার্ডের বিশাল কাঠের কফিনটারও যেন হাত-পা গজিয়েছে। জায়গা বদলেছে ওটাও।
হতবাক দলটা কফিনগুলোকে আগের অবস্থানে রেখে ডোরকাস চেজকে সমাধিস্থ করার কাজ সম্পন্ন করল। এবার ভল্টের মুখে মার্বেল পাথরের স্ল্যাবটা রেখে যাজক ও অন্যদের উপস্থিতিতে সিলমোহর মেরে দেয়া হলো।
ওই বছরই আবার খুলতে হলো সমাধিক্ষেত্রটি। এবার টমাস চেজের জন্য। তবে ভেতরে কোন অসামঞ্জস্য পাওয়া গেল না।
১৮১৮ সালে বেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বার্বাডোজ। বেশ কয়েকবার বিদ্রোহ করে কৃষ্ণাঙ্গ দাসরা। সংখ্যায় এত বেশি ছিল যে শ্বেতাঙ্গ-মালিকদের পক্ষে তাদের সামলানো বেশ মুশকিল হয়ে পড়েছিল। ওই সময় মারা যাওয়া শ্বেতাঙ্গদের একজন চেজ পরিবারের এক আত্মীয়া। ১৮১৮ সালের সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখ এখানে গোর দেয়ার জন্য আনা হলো স্যামুয়েল ব্রিউস্টার এমেসকে। তার মৃতদেহ রাখার জন্য ভল্ট খোলা হতেই দেখা যায় ভারী সীসার কফিনগুলোর একটাও আগের জায়গায় নেই। শুধু তাই না, দেখে মনে হচ্ছে ওগুলো প্রচণ্ড ক্রোধে ছুঁড়ে ফেলেছে কেউ।
১৮১৯ সালের ৯ জুলাই মিস থমাসিনা ক্লার্কের মৃতদেহ আনা হয় ভল্টে সমাধিস্থ করত। আবারও চমক। কফিনগুলো মোটেই আগের জায়গায় নেই। যাজক ড. টি. এইচ. অরডারসন এবার বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন বিষয়টিকে। তিনি আরেকটা বিষয় খেয়াল করলেন, সমস্যা মূলত হয়েছে সীসার কফিনে, কাঠের কফিনগুলো মোটামুটি আগের জায়গাতেই আছে।
কৃষ্ণাঙ্গ দাসরা এসে ওগুলোকে আবার ঠিকঠাক করল। এসময়ই একটা বিষয় জানা গেল, ১৮০৭ সালে গোর দেয়া মিসেস গডার্ডের কাঠের কফিনটা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। ওটাকে বেঁধে মিসেস ক্লার্কের কফিন ও দেয়ালের মধ্যখানে রাখা হলো।
এই পর্যায়ে এসে সত্যি বিচলিত হয়ে পড়লেন চার্চের যাজক এবং চেজ পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা বিষয়টি দৃষ্টিগোচর করলেন বার্বাডোজের গভর্নর লর্ড কম্বারমেয়ারের। পেনিনসুলা যুদ্ধে ওয়েলিংটনের অধীনে একটা ক্যাভালরির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সালামানকাতে দারুণ বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে পদকও পান। সাহসী এই সৈনিক ঠিক করলেন রহস্যময় এই ঘটনাটা পরীক্ষা করে দেখবেন নিজে উপস্থিত থেকে। তাঁর প্রথমে মনে হচ্ছিল কৃষ্ণাঙ্গ দাসরা এর পেছনে থাকতে পারে। তবে কেন এটা করবে, বুঝতে পারছিলেন না। তাঁর এডিসি মেজর ফিঞ্চসহ নিজেই সমাধিস্থলে উপস্থিত হলেন গভর্নর।
তাঁদের এবং যাজকের উপস্থিতিতে কফিনগুলো সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হলো, আর ওগুলোর সঠিক অবস্থান একটা কাগজে এঁকে নিলেন মেজর ফিঞ্চ। ওটা সংরক্ষণ করা হলো। ভল্টের মেঝেতে বালু ছিটিয়ে দেয়া হলো। ভারী মার্বেল পাথরের স্ল্যাবটা দিয়ে আটকে দেয়া হলো প্রবেশদ্বার। রাজমিস্ত্রী ও সরকারি লোকেরা নরম সিমেন্টে বেশ কিছু গোপন সিল এবং চিহ্ন দিয়ে রাখল।
গভর্নর লর্ড কম্বারমেয়ারের ইচ্ছা ছিল চেজ পরিবারের কেউ মারা গেলে তবেই ভল্ট খুলবেন। তবে নয় মাস পেরিয়ে গেলেও যখন মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেল না তখন কম্বারমেয়ার পাতালকুঠুরীতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিলেন।
এলড্রিজদের বাগানে ১৮২০ সালের ১৮ এপ্রিল একটা মিটিং হলো। গির্জার পাশেই জায়গাটি। কোন কোন সূত্রের দাবি ভল্টের ভেতরে প্রচণ্ড একটা শব্দ শোনার গুজবেই এই সভা। অন্য সূত্রের মত, গভর্নরসহ বাকি লোকজন এতটাই কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন যে আর অপেক্ষা করার ধৈর্য তাঁদের ছিল না।
ওই দিনই গভর্নর, এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি নাথান লুকাস, মেজর ফিঞ্চ, যাজক এবং এই বিষয়ে আগ্রহী রবার্ট বউচার ক্লার্ক ও রোলাণ্ড কটন হাজির হলেন পাতালকুঠুরীর সামনে। প্রথমেই গত বছরের জুলাইয়ে রেখে যাওয়া গোপন সব সিল ও চিহ্ন পরীক্ষা করে দেখা গেল ওগুলো অক্ষতই আছে। তেমনি সমাধিস্থলটির প্রবেশদ্বারে কারও হস্তক্ষেপের কোন চিহ্নই মিলল না। কম্বারমেয়ার ও তাঁর সঙ্গীরা নিশ্চিত হলেন যে কারও পক্ষেই সমাধির ভেতরে ঢোকা সম্ভব হয়নি। ‘ঘাসের একটা ডগা কিংবা অন্য কিছুও ঢোকার সুযোগ ছিল না,’ পরে তাঁর ডায়ারিতে লেখেন নাথান লুকাস, ‘কোন ধরনের চাতুরী কিংবা ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনাই নেই।’
তখন দুপুর। পাশের বাগানে কঠোর পরিশ্রম করে আসা কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকেরা কাজ সেরে ফিরছিল। তাদের আট- দশজনকে নেয়া হলো গোরস্থানে ভল্ট খোলার কষ্টসাধ্য কাজটি করার জন্য।
পাতালকুঠুরীতে ঢুকতেই সেখানে ভয়ানক বিশৃঙ্খলা টের পাওয়া গেল। বিশাল সীসার কফিনগুলো, যেগুলোর কোন কোনটা তুলতে ছয়জন মানুষের প্রয়োজন, ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ভল্টের ভেতরে। দেয়ালে গিয়ে আছড়ে পড়েছে কয়েকটা। কোনটা খাড়া হয়ে আছে। কাঠের কফিনগুলো তাদের আগের অবস্থানেই আছে। মিসেস গডার্ডের জোড়া লাগানো কফিনটাও নড়ানো হয়নি। মেজর ফিঞ্চ ভল্টের ভেতরের কফিনের এবারের অবস্থানও এঁকে নিলেন। রহস্যময় এই ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ এক দলিল হয়ে থাকল যা।
গোটা পাতালকুঠুরী এরপর ভালভাবে পরীক্ষা করা হলো। গত জুলাইয়ে যখন আটকানো হয় ভল্টটা তখন যে বালু ফেলা হয়েছিল তাতেও কোন চিহ্ন মিলল না। ভেতরের প্রতিটি দেয়াল পরীক্ষা করলেন লুকাস। একজন রাজমিস্ত্রী এরপর ওই দেয়ালগুলো আবার তন্ন তন্ন করে খুঁজল। কিন্তু পাথরের মধ্যে ফাঁপা কোন জায়গাই পাওয়া গেল না।
কেউ একজন তখন বলল একটা ভূমিকম্পই এর জন্য দায়ী। কিন্তু ভূমিকম্প, যেটার প্রভাবে কিনা সীসার ভারী সব কফিন ছিটকে গিয়ে দেয়ালে পড়েছে, সেটা নিশ্চয় যেনতেন কিছু নয়। এতে গোটা বার্বাডোজের না হলেও অন্তত এই এলাকার সব বাড়ি-ঘর ধূলিসাৎ হওয়ার কথা। তাই এই তত্ত্বটা ধোপে টিকল না। যেমন টিকল না পানির স্রোত বা অপ্রত্যাশিত পাতাল বন্যার তত্ত্বটা। কারণ ১৮২০ সালের ১৮ এপ্রিল ভল্টের ভেতরটা ছিল শুকনো খটখটে। তাছাড়া এই ঘটনার জন্য প্রচণ্ড পানির তোড় প্রয়োজনে। তাই যদি হবে, তাহলে কাঠের কফিনগুলো আগের জায়গায় থাকল কীভাবে?
নাথান লুকাস লেখেন, তিনি এবং উপস্থিত বাকি সবাই রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে যান ব্যাপারটায়।
‘নিঃসন্দেহে চোরদের এতে কোন ভূমিকা নেই,’ নাথান লেখেন, ‘তেমনি কৃষ্ণাঙ্গদেরও হাত থাকা অসম্ভব। কারণ কুসংস্কারের কারণেই গোরস্থানের ভেতরে ঢুকতে ভয় পায় তারা। কিন্তু এখানে একটা অস্বাভাবিক শক্তির উপস্থিতি টের’ পাওয়া গিয়েছে। আমি নিজে এর সাক্ষী।’
একটা সরকারি রিপোর্ট প্রকাশের পর গভর্নরের এই তদন্ত নিয়ে গোটা বার্বাডোজে দারুণ আলোড়ন পড়ে যায়। চেজদের অনুরোধে ভল্ট থেকে সব কফিন সরিয়ে অপর একটা গোরস্থানে সমাহিত করা হয়। পরিত্যক্ত হয় ভুতুড়ে এই পাতালকুঠুরী। সরকার ওটাকে খুলে দেয়ার নির্দেশ দেন। এখন ওটা খোলাই আছে।
যদিও ঘটনাটা ওই এলাকায় তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে, এর ব্যাপারে সংবাদপত্রে কিছু আসেনি। তেমনি চার্চের গোর রেজিস্টারেও এ সম্পর্কে কিছু লেখা হয়নি। অথচ ওটা নথিবদ্ধ করেন যাজক অরডারসন। এই কাহিনীটা অনেকেই বলেছেন, তবে নাথান লুকাসের ডায়ারির বর্ণনাটাই সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য।
অনেকটা এ ধরনের আরেকটি ঘটনার কথা শোনা যায় বাল্টিক সাগরের ওয়েসেল দ্বীপের আরেনসবার্গ গোরস্থানে। ওটা ১৮৪৪ সালে। বার্বাডোজের ঘটনার সঙ্গে এর বেশ মিল আছে।
এক নারী ও তার দেবরের মধ্যে ছিল খুব খারাপ সম্পর্ক। একই বাড়িতেই থাকত তারা। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই ঝগড়া ছিল প্রাত্যহিক ব্যাপার।
প্রাত্যহিক ব্যাপার। অদ্ভুত ঘটনা, কয়েকদিনের ব্যবধানে মৃত্যু হয় তাদের। মৃত্যুশয্যায় দেবর বলে যায় ভাবীর সঙ্গে একই সমাধিক্ষেত্রে যেন গোর দেয়া না হয় তাকে। কারণ অন্য দুনিয়ায়ও তাদের ঘৃণার বিন্দুমাত্র উপশম হবে না বলে ধারণা তার। কিন্তু এই কথাকে পাত্তা না দিয়ে পারিবারিক ভল্টে ভাবীর পাশেই সমাধিস্থ করা হলো দেবরটিকে। তারপরই সিল করে দেয়া ভল্টের ভেতর থেকে ভয়ঙ্কর এক শব্দ শোনা গেল। এতটাই বীভৎস ছিল মানুষের চিৎকার আর ধাতব পদার্থ ঠোকাঠুকির ওই শব্দ যে ভল্ট খুলে দেখতে বাধ্য হলো পরিবারের সদস্যরা। দুটো কফিনই শুধু যে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে তা নয়, দুটোর অবস্থান এমন জায়গায় যে মনে হচ্ছে একটা আরেকটার সঙ্গে লড়াইয়ে মত্ত ছিল। তাদের ঠিকঠাক করে ভল্ট আটকানোর পর আবার একই ঘটনা ঘটল। তবে ভদ্রমহিলার বুড়ো স্বামী জীবনের শেষ কয়টা দিন তাঁর ম্যানর হাউসে শান্তিতেই কাটান বিচক্ষণ এক সিদ্ধান্তের কারণে। ভাই আর স্ত্রীর কফিনের মাঝখানে শক্তিশালী একটা দেয়াল তুলে দেন। এতে গোটা ভল্টেই শান্তি ফিরে আসে।
কৃষ্ণাঙ্গদের বিশ্বাস জাম্বি নামের এক অশুভ আত্মা কফিনের এই ঝামেলার জন্য দায়ী। ওয়াকিং ডেড বা জোম্বি শব্দটা থেকেই জাম্বির উৎপত্তি। এ ধরনের অতৃপ্ত আত্মারা রাতের বেলা ঘুরে বেড়ায় আর নানা ধরনের ঝামেলা পাকায়। অবশ্য চেজদের ওই ভল্টের ঘটনার জন্য জাম্বিরাই দায়ী তার কোন প্রমাণ নেই।