পাড়াপড়শি

পাড়াপড়শি

কতরকম পাড়াপড়শির মধ্যিখানে জীবনটা কেটেছে ভেবেও আশ্চর্য লাগে। ছোটবেলায় একসময় আমরা পদ্মপুকুর রোডে থাকতাম। পাশের বাড়িতে আমাদের পাতানো কাকাবাবুরা থাকতেন। তার ওপাশের বাড়িটা বেশ বড়, তিনতলা, গোলাপি রং করা, মস্ত সবুজ ফটক, তার ওপর মধুমালতীর ঝাড়। ফটক প্রায় সবসময় বন্ধ থাকত। কিন্তু রোজ দুপুরে দেড়টা-দুটোর সময় ওই বাড়ি থেকে পুরুষ কণ্ঠে লোমহর্ষক চিৎকার শোনা যেত, ‘ওরে বাবা রে! গেলুম রে! মেরে ফেললে রে! আর তো আমি নেই রে!’

প্রথমে যখন আমরা ওই পাড়াতে বাস করতে এসেছিলাম, আমাদের বাড়ির ছেলেরা ভেবেছিল ওবাড়িতে বুঝি ডাকাত পড়েছে। তাই লাঠি-সোঁটা নিয়ে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সামনের খোলার চালের বাড়ি থেকে বুড়ি ধোপানি ডেকে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছেন দাদাবাবুরা? ওবাড়িতে গোটাপাঁচেক মেয়েছেলে আর একটা ঘরজামাই ছাড়া কেউ থাকে না। ও কিছু না, রোজ এমন হয়। একটু না পেটালে সামলাবে কী করে?’

বাস্তবিকই বিকেলবেলা বড় ফটক একটু ফাঁক হল আর মিহি করে কুঁচনো শান্তিপুরে ধুতি, গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি, চকচকে পাম্পশু, ওপর হাতে মোটা তাগা, গলায় বিছে হার, আট আঙুলে আটটি পাথর বসানো আংটি পরে, সোনাবাঁধানো শিঙের ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে, কোঁকড়া চুলে টেরি কেটে, ফরসা লম্বা চওড়া ঘরজামাইটি গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আর চারদিকে আতরের গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে, হাওয়া খেতে যেত।

কখন ফিরত তাও দেখিনি আর বাড়ির সেই পাঁচজন মেয়েছেলেকেও কখনও দেখিনি। শুধু একজন ষণ্ডামতো ঝি রোজ সকালে থলি-চুপড়ি নিয়ে হন্‌হন্‌ করে বাজারে যেত আর বড় বড় গলদা চিংড়ি, কাটা পোনা, ফুলকপি, মটরশুঁটি, দই-রাবড়ির ভাঁড়, মিষ্টির বাক্স, ভাল ভাল ফল ইত্যাদি কিনে, হন্‌হন্‌ করে বাড়ি ফিরত। কেউ কথা বললেও উত্তর দিত না। প্রায় চার বছর ওপাড়ায় ছিলাম কিন্তু এর বেশি দেখিওনি, শুনিওনি। ওদের নাম পর্যন্ত জানতে পারিনি।

অবিশ্যি ওদের বাড়ির খবরের অভাবটা ধোপার বাড়ি থেকে পুষিয়ে নেওয়া যেত। তাদের জীবনে গোপনীয়তার অবকাশও ছিল না, জায়গাও ছিল না। আমাদের রাস্তাটার পদ্মপুকুর ঠিকানা হলেও, আসলে ছিল সদর রাস্তা থেকে বেরিয়ে আসা নিরিবিলি একটা গলি।

গলিটা আবার খানিকটা খোলা জমিকে বেড় দিয়ে গেছিল। সেই জমির এক কোণে, আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে, রাস্তার উলটো দিকে, ধোপাদের খানকতক পাঁচিল-ঘেরা ঘর। ইটের দেওয়াল, খোলার চাল, নারকেল গাছ, পেয়ারা গাছ, বেল গাছ ইত্যাদি। ওইখানেই ওদের বসবাস, ভাটিখানা, খোলা জমিতে কাপড় শুকোনো, যাবতীয় কাজকর্ম চলত।

বুড়ো ধোপা, ধোপানি, কয়েকটা ছেলে-বউ, নাতি-নাতনি, গাধা ইত্যাদি নিয়ে যন্ত্রের মতো ওদের সংসার কল চলত। সবাই উদয়াস্ত খাটত, মিলেমিশে থাকত, কাজকর্মও বোধহয় সুষ্ঠুভাবে ভাগ করা ছিল। হাড়পাজি নাতি-নাতনিগুলোর গলা ছাড়া, কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যেত না।

ওদের জীবনটা বইয়ের খোলা পাতার মতো ছিল। আমাদের ঘর থেকে একটু তাকালেই ওদের রান্নাঘরের হাঁড়িতে কী চড়েছে, তা পর্যন্ত দেখা যেত। বুড়ো আর ছেলেরা কাপড় কাচত, ইস্ত্রি করত। বুড়ি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ময়লা কাপড় সংগ্রহ আর কাচা কাপড় বিলি করত। বউরা সারাদিন ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। নাতি-নাতনিরা করপোরেশনের স্কুলে পড়ত। বাড়িটা থেকে সারাদিন একটা মৌচাকের মতো মৃদু গুঞ্জন শোনা যেত। বুড়ির সদাই হাসিমুখ।

একদিন এ নিয়মের ব্যতিক্রম হল। ভোর থেকে বোপর বাড়িতে চ্যাঁচামেচি হট্টগোল বকাবকি যাওয়া-আসা। কাজের চাকা বন্ধ। আমরা অবাক হলাম। একটু বেলায় বুড়ি ধোপানি এসে মায়ের কাছে কেঁদে পড়ল। ‘মা, হয় একটা ওষুধ দাও, নয় একটা মাদুলি-টাদুলি দাও। আমাদের সর্বনাশ হয়েছে!’ বলতে ভুলে গেছি আমার মা ছিলেন ওদের বেসরকারি কবরেজ! সময়-অসময় ওরা মার কাছ থেকে একটু জোলাপ, কী ত্রিফলার জল, কী পুরনো ঘি, কী কাশির ওষুধ চেয়ে নিয়ে যেত। মায়ের ওপর ভারী বিশ্বাস।

আজ মা বললেন, ‘দেখো, আমি তো আর ডাক্তার নই। বাড়াবাড়ি কিছু হয়ে থাকলে, মোড়ের ডাক্তারবাবুকে ডাকো, নয়তো হাসপাতালে নিয়ে যাও।’ বুড়ি কেঁদে বলল, ‘তেমন ব্যামো নয়, মা। তা হলে তো ভাবনাই ছেল না! পইপই করে বড়-বউটাকে বলি রেত থাকতে নেয়ে উঠে, খোলা চুলে, বেলতলাতে যাসনি। তা কে কার কথা শোনে। এখন ভূতে পেয়েছে! আমার অমন লক্ষ্মী বউয়ের কী হাল হয়েছে দেখতে হয়।’

ভূতে পেয়েছে শুনে আমরা যে যার পড়াশুনা, কাজকর্ম ফেলে ছুটে এলাম। ‘ও খনার মা, কী করে জানলে ভূতে পেয়েছে?’ সে বলল, ‘ওমা, তাও জানবনি? ভোরে উঠে রোজকার মতো মাড়ের গামলা তৈরি করে, মাথায় তুলে, খোলা চুলে, বেলতলা দিয়ে হেঁটে এল। আক্কেলখানা দেখ!’

তা ওর শ্বশুর বলল, ‘তৈরি হয়েছে?’ বউ মুখের ওপর বলল, ‘হয়েছে কি না দেখই না!’ এই বলে সমস্ত গরম মাড়টি বুড়োর মুখের ওপর ঢেলে দিল! সেই ইস্তক, ঘোমটা ফেলে বসে বসে কেমন ফিকফিক করে হাসছে, দেখে এসো দিদিরা! ডাক্তার এয়েছিল, গুরুঠাকুর এয়েছিল। কেউ কিচ্ছু করতে পারেনি। এখন ওঝা ডাকতে গেছে।’

এই বলে চোখ মুছতে মুছতে বুড়ি বাড়ি গেল। ওঝা আসতে সন্ধে হল। সারাদিন বাড়িতে হাঁড়ি চড়ল না। ওদের বাড়ির উঠোনে হ্যাজাক জ্বলল। কতক দেখতে পেলাম, কতক আন্দাজ করলাম। বউকে এনে উঠোনের মধ্যিখানে চাটাইয়ের ওপরে বসাল। সে তখনও ফিকফিক করে হাসছে। তারপর তার নাকের তলায় কড়া গোছের কিছু পোড়ানো হল। আমাদের পর্যন্ত হাঁচি পেতে লাগল। ভূত তবু ছাড়ল না।

ততক্ষণে কাকাবাবুর বাড়ির প্রায় সবাই আমাদের দোতলার বারান্দায় জড়ো হয়েছে। গলায় আট-দশটা বড় বড় পুঁতির আর পাথরের মালা পরা, মাথায় ফাট্টা বাঁধা, আলখাল্লা গায়ে দাড়িওয়ালা বুড়ো ওঝা যতই বলে, ‘বল্‌, ওকে ছেড়ে যাবি?’

বউ মাথা দুলিয়ে বলে, ‘যাঁব না, যাঁব না! তুঁই কিঁ কঁরবি কঁর!’ ওঝা তখন দস্তুরমতো রেগেমেগে একটা নতুন নারকেল ঝাঁটা এনে বউটাকে আগাপাশতলা পেটাতে আরম্ভ করল।

বউও তারস্বরে চ্যাঁচাতে লাগল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়রান হয়ে বলল, ‘ওঁরে বাবা! ছাঁড়ান দে! আমি যাঁচ্ছি! যাঁচ্ছি!’

ওঝা বলল, ‘তা হলে বাউরিপাড়ার পুকুরপাড়ের তেঁতুল গাছের ডাল ভেঙে দিয়ে চলে যাস্‌, তবে বুঝব সত্যি গেছিস!’ বউটা আচ্ছন্নের মতো শুয়ে পড়ল।

কে যেন সেখানে ছুটে গিয়ে দেখে এসে বলল, ‘ভেঙেছে! ভেঙেছে!’

আর বউও ভালমানুষের মতো উঠে বসে, চারদিকে এত লোকজন দেখে, ঘোমটা টেনে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেল। এর সবটা আমরা দেখিনি। বাকিটা পরদিন ঠাকুরের বাতাসা ভোগের প্রসাদ নিয়ে, খনার মা এসে হাসিমুখে বলে গেছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *