পাঠসভা
‘তাহলে আমারও একটা প্রশ্ন আছে’ বলে হলের একেবারে পিছনে তর্জনী তুলে উঠে দাঁড়ালেন এক ভদ্রলোক। শুধু সিট থেকে নয়, মানুষটি যেন ভেসে উঠলেন অরিন্দমের স্মৃতির সমুদ্র থেকে। অরিন্দম খুব নজর করে দেখল ওঁকে, দেওয়ালে ঝোলানো পোট্রেট দেখার স্টাইলে। ফলে ‘হ্যাঁ, কী প্রশ্ন? এইটুকু বলতেই ওর বিশ সেকেণ্ড সময় লেগে গেল। ভদ্রলোকও মনে হল ওই অনুমতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই স্বাভাবিক মনে করছেন। লেখক অরিন্দম সেনের সামনে নিজেকে মেলে ধরাটাও যেন ওঁর প্রশ্নের অঙ্গ।
‘হ্যাঁ, কী প্রশ্ন?’ বলেই অরিন্দম ফের স্মৃতির মধ্যে ডুবে খুঁজতে শুরু করল বাল্যের দেখা সেই ইয়েন ম্যাকলিনকে। হলের শেষ সারিতে বসা—আর এইমাত্র উঠে দাঁড়ানো–প্রৌঢ় ইয়েন ম্যাকলিনের সঙ্গে যাঁর সাদৃশ্য একবারে মুছে যায়নি। সাদা শার্টের ওপর ছাই ছাই টুইডের জ্যাকেট। আর গলায় নীল মাফলার—ইয়েন ম্যাকলিন এখনও যৌবনের সেই বাবুটিই। শুধু কোঁকড়া সোনালি চুল আর গোঁফ-দাড়িগুলো ঝলমলে রুপোলি হয়ে গেছে। আর নীলমণি চোখ দুটোর ওপর একজোড়া খয়েরি চশমা বসেছে। ক্যালকাটা পোট্রেটস’ নামের এককালের নামকরা বইয়ের লেখক ইয়েন ম্যাকলিনকে ওর বুক রিডিং সেশনের শ্রোতারা বিশেষ একটা চিনল বলে মনে হল না, কিন্তু অরিন্দমের একটা স্বস্তি ঘটল। যাক, প্রকাশক তাহলে ইয়েনকে একটা সৌজন্য কপি পাঠাতে ভুল করেনি।
অরিন্দম একবার সরাসরি তাকাল ইয়েন ম্যাকলিনের চোখের দিকে, প্রশ্নের অপেক্ষায়। ম্যাকলিন অরিন্দমের সদ্য প্রকাশিত, সভাস্থলে সদ্য পঠিত এবং কিছুকাল যাবৎ ইংল্যাণ্ডের সাহিত্যমহলে ঝড়-তোলা উপন্যাস ‘আ থেফট ইন দ্য প্যালেস’-এর কপিটা হাতে নাড়তে নাড়তে বললেন, সেন, আমার প্রশ্ন আসলে দুটো। আপনি কি দুটোরই উত্তর দেবেন?
অরিন্দম সহজ গলায় বলল, নিশ্চয়ই। ম্যাকলিন বললেন, আমার প্রথম প্রশ্নটাকে অপমানজনক মনে করবেন না অনুগ্রহ করে, কারণ এমন প্রশ্ন কোনো লেখককে করা যায় না, তবু করছি।
অরিন্দমের আর তর সইছিল না। বলল, মান-অপমানের কথা আমি ভাবছি না। আপনি প্রশ্নটাই করুন।
ম্যাকলিন বললেন, এ উপন্যাসটা আপনি লিখলেন কেন?
ল্যাংকাস্টার পোস্ট হোটেলের সভাকক্ষের শ্রোতারা এই প্রথম একযোগে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল শেষের সারিতে দাঁড়ানো প্রশ্নকর্তাকে। সামান্য কেউ কেউ হয়তো ওঁকে চিনেও ফেলল, কিন্তু অবাক হল প্রত্যেকে। অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অব স্মল থিংগস’-এর পর যে ভারতীয় উপন্যাসটি ইউরোপে ঢেউ তুলছে তার লেখককে কি এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা যায়? অমন ইংরেজি গদ্য যার হাতে সে তত জন্ম-লেখক। একজন প্রবীণ সমালোচক তো প্রায় উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন ম্যাকলিনের প্রতিবাদ জানাতে, যখন সভাস্থলকে দ্বিতীয়বার চমকে দিল অরিন্দমের সংক্ষিপ্ত জবাব।
অরিন্দম বলল, প্রতিশোধ!
ক্রমে একটা চাপা গুঞ্জন ছড়াতে থাকল হলে—প্রতিশোধ… প্রতিশোধ… কার প্রতিশোধ?…কেন? কীসের জন্য?…
মিনিটখানেক চুপ থেকে থেকে অরিন্দম ফের বলল, হ্যাঁ, ‘আ থেফট ইন দ্য প্যালেস’ কোনোদিনই লেখা হত না সাতাশ বছর আগে ইয়েন ম্যাকলিন তাঁর ‘ক্যালকাটা পোট্রেটস’ না লিখলে।
এবার লাঠিতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ‘টাইমজ’ পত্রিকার প্রবীণ, ডাকসাইটে সমালোচক মাইকেল বার্নস : সেন, আমি ম্যাকলিনের ক্যালকাটা পোট্রেটস’-এরও সমালোচনা লিখেছিলাম সে-সময়। বইটা কোনো উপন্যাস বা কাহিনি নয়। কলকাতায় দীর্ঘ সময় থেকে সেখানকার অজস্র মানুষজনের জীবনকথা জেনে একটা চমৎকার দলিল তৈরি করেছিলেন ম্যাকলিন। কিন্তু সে-বইয়ের সঙ্গে আপনার বইয়ের কী সম্পর্ক?
অরিন্দম একটু চুপ করে রইল। শেষে বলল, প্রথম সম্পর্ক এটাই যে, দু-টি বইয়ের চরিত্র মোটামুটি এক, স্থান-কাল এক, কেবল কথক বদলে গেছে। এবং আমার যে নায়িকা সে সম্পূর্ণ বাদ পড়েছে ইয়েন ম্যাকলিনের কলকাতা মুখচ্ছবিতে।
ফের একপ্রস্থ গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল হলে, সবাই ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল পিছনের সারির প্রশ্নকর্তাকে, যিনি তখনও সেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। শেষে হল নীরব হতে তিনি ফের জিজ্ঞেস করলেন, আপনার উপন্যাস নায়িকা তিস্তার চোখে দেখা হলে নায়ক ব্রায়ানের প্রতি এতটা নির্দয় হতে পারত না। যদি আপনার দাবি এটাই হয় যে, এ উপন্যাস বাস্তবের ভিত্তিতে লেখা তাহলে আমায় বলতেই হচ্ছে বালক-কথক সুমিতের তখনও বয়সই হয়নি ব্রায়ানকে বোঝার। আর ক্যালকাটা পোট্রেটস’ থেকে আপনার নায়িকা তিস্তা বাদ পড়েছিলেন ইয়েন ম্যাকলিনের কারচুপিতে নয়, তাঁর নিজের আরোপিত শর্তে। ব্যস, আমার এইটুকুই বলার। বলে ঝপ করে নিজের সিটে বসে পড়লেন ম্যাকলিন। আর সবাই বুঝল উপন্যাস পাঠের অপূর্ব সুরেলা পরিবেশটা হঠাৎ কীরকম গম্ভীর ও ব্যক্তিগত হয়ে গেছে।
সম্ভবত হাওয়াটাকে হালকা করার জন্যই অরিন্দম ফের ম্যাকলিনের উদ্দেশে বলল, আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নটা কিন্তু এখনও করেননি, মি. ম্যাকলিন?
ইয়েন ম্যাকলিন এবার একটু কাশলেন, তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি এও জানি না যে, একজন ঔপন্যাসিককে এরকম ব্যক্তিগত প্রশ্ন জনসমক্ষে করা যায় কি না, তবু এভাবেই করছি; কারণ আপনি তো একটা গভীর ব্যক্তিগত বিষয়কে বাইরেই টেনে এনেছেন আপনার উপন্যাসের মাধ্যমে।
ফের অধীর বোধ করে সাহেবের কথার মধ্যেই অরিন্দম বলে বসল, সাহিত্যজগৎ ও ব্যক্তিগত জগতের মধ্যে খুব বেশি ফারাক রাখায় আমি বিশ্বাসী নই, আপনি অক্লেশে আপনার প্রশ্ন করতে পারেন।
ইয়েন ম্যাকলিন বললেন, আপনার নায়িকা তিস্তা তিন বছর ধরে দৈনিক একটা করে চিঠি লিখেছে ব্রায়ানকে। যা সে পোস্ট করেনি কোনোদিন। চোদ্দো বছরের সুমিতকে সেই সব চিঠি তুলে দিয়ে সে কলকাতার বাড়ি ছেড়ে গিরিডি চলে যায়। তার শর্ত ছিল একুশ বছরে পা দেওয়ার আগে সুমিত যেন একটি চিঠিও না পড়ে। কিন্তু একুশে পা দেবার আগেই লুকিয়ে রাখা চিঠির বাক্সটা সত্যি সত্যি হারিয়ে ফেলে সুমিত। আর এভাবে লিখতে লিখতে তিন বছর কেটে যায় কখন জানতেও পারেনি। সে-ঘোর কেটেছিল যখন তিস্তার হারিয়ে যাওয়া চিঠির বাক্সটা দৈবাৎ খুঁজে পায় ওর কাকার সেরেস্তায়। কাগজের বস্তায়। তখন প্রথমবার সেইসব চিঠি পড়ে ও কী দেখল না, ওর নিজের লেখা তিস্তার বয়ানের চিঠি-গুলোর সঙ্গে তিস্তার চিঠিগুলোর আকাশ-পাতাল দূরত্ব। সুমিত বুঝল ও তিস্তার মনের কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। একটা লজ্জা ও হীনম্মন্যতা পেয়ে বসল ওকে, ও সঙ্কল্প করল একদিন না একদিন ও একটা উপন্যাস লিখে ব্রায়ানের ওপর প্রতিশোধ নেবে? আমি এ পর্যন্ত যা বললাম তা ঠিক?
অরিন্দম শান্ত স্বরে বলল, বিলক্ষণ! ইয়েন ম্যাকলিন জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আজকের এই সাহিত্য সভায় এইটুকু অন্তত স্বচ্ছভাবে জানিয়ে যান ‘আ থেফট ইন দ্য প্যালেস’ কীসের প্রতিশোধ? ইয়েন ম্যাকলিন তাঁর
‘ক্যালকাটা পোট্রেটস’-এ আপনার নায়িকা তিস্তার পিছনের রক্ত-মাংসের নন্দিনী সম্পর্কে নীরব বলে, না তিস্তার নিজের চিঠিগুলো পড়ে সুমিতের বোধোদয় হল বলে যে, প্রেমের সূক্ষ্মধারা বিষয়ে সে নিতান্তই মূখ? অর্থাৎ অরিন্দম সেনের রাগ ও অভিমান কার প্রতি? ব্রায়ান চরিত্রের পিছনে ইয়েন ম্যাকলিন, না সুমিত চরিত্রের পিছনে অরিন্দম সেন?
উপন্যাসের অংশবিশেষ পড়ার সময়ে থেকেই হাতে বই ধরে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়েই ছিল অরিন্দম। ম্যাকলিনের শেষ প্রশ্নটা শুনতে শুনতে হাতের বইটা টেবিলে নামিয়ে রেখেছিল। এবার উত্তর দেবার মুখে ফের বইটা হাতে তুলে নিল ও এবং পাতা উলটিয়ে উলটিয়ে উৎসর্গপত্রে এসে ফের একবার নামটা দেখল—নন্দিনী মুখোপাধ্যায়, তারপর মাইকের কাছে মুখ নিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল, না, আপনি ভুল করছেন মিস্টার ম্যাকলিন। আমার প্রতিশোধের লক্ষ্য আমি বা আপনি কেউ নই। কেবল নন্দিনী মুখোপাধ্যায়, আমার উপন্যাসের নায়িকা তিস্তা।
ফের যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল সভায়। ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদিকা শার্লি ডকিং ঠাট্টাচ্ছলে বললেন, তাহলে কি মি. সেন একজন মিসোজিনিস্ট? নারীবিদ্বেষী?
সঙ্গে সঙ্গে অরিন্দম উত্তর করল, নারীবিদ্বেষী নই, বলতে পারেন দুরারোগ্য রকম নারীমুগ্ধ।
তখন ফের একরোল হাসি গড়াল সভায়। দেখা গেল গার্ডিয়ান’-এর নবীন প্রতিবেদক গর্ডন সাইকস খসখস করে দ্রুত কীসব লিখছেন একটা চিরকুটে। হাসির ঢেউ স্তিমিত হতে সে পড়তে শুরু করল চিরকুটটা—মিস্টার সেন, ‘আ থেফট ইন দ্য প্যালেস’ কলকাতায় এক সাবেক পরিবারের ঘটনা। নায়ক ব্রায়ান একটা বই লিখবে বলে সেখানে ছ-মাস অতিথি ছিল। রক্ষণশীল পরিবারের সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে তার প্রেম হয়, যা পরিবারের কেউ কোনোদিন জানতে পারেনি। এক পাশের বাড়ির বালক সুমিত বাদে, যে চিলেকোঠায় পাহারাদারিও করেছে, যখন লুকিয়ে ওরা মিলিত হয়েছে ওখানে। প্রাসাদের চুরি কি এটাই? নাকি এর অন্য কোনো ব্যাখ্যাও হতে পারে?
অরিন্দম ফের পাতা ওলটাতে লাগল ওর হাতে-ধরা বইটার। তারপর এক জায়গায় থেমে গিয়ে পড়তে লাগল—’সুমিত ভাবতে ভালোবাসে যে তিস্তা ওকে চিঠিগুলো নিজের হাতে তুলে দিয়েছে। ও ভাবতে ভালোবাসে যে তিস্তা ওর অন্তরঙ্গ জীবন সম্পূর্ণ মেলে ধরতে চায় ওর বালক অনুরাগীর সামনে। সুমিতের তখন মনে পড়ে চিলেকোঠার দরজার ছিদ্র দিয়ে দেখা সেইসব দৃশ্য। তিস্তা তার পরিধান ত্যাগ করলে আরোই রহস্যময়ী হয়ে ওঠে। ওভাবে না দেখলে সুমিত কল্পনাও করতে পারত না তিস্তা সত্যি সত্যি কারও সামনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভেতরে দুটো লোক—তিস্তা আর ব্রায়ান, কিন্তু সুমিত চোখ ভরে দেখে শুধু তিস্তাকেই। দেখতে দেখতে সুমিতের মনে হয় ব্রায়ান আসলে ও নিজেই, তাই ব্রায়ানের সুঠাম সুন্দর উজ্জ্বল শরীরে যখন ঢাকা পড়ে তিস্তার দেহ, সুমিত ছিদ্র থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বুজে থাকে। আর মনে মনে আবিষ্কার করে তিস্তাকে।’–এতদূর পড়ে অরিন্দম থামল এবং শ্রেতাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আশা করি আপনারা বুঝতে পারছেন যে, উপন্যাসের প্রেমটা ব্রায়ান-তিস্তার বাস্তব প্রেম নয়, সুমিত-তিস্তার সম্পূর্ণ কাল্পনিক, একপেশে প্রেম। বিয়ের প্রস্তাব তিস্তার পরিবারের থেকে প্রত্যাখ্যান হতে ব্রায়ান যখন সার্পেন্টাইন লেনের বাড়ি ছেড়ে চলে গেল, সেদিন সবচেয়ে বড়ো স্বস্তির শ্বাসটা ফেলেছিল সুমিত। সবচেয়ে বেদনার কান্নাটাও হয়তো কেঁদেছিল ও। কারণ ও-ই তো তিস্তার মন-চুরির একমাত্র সাক্ষী। প্রাসাদের প্রধান চুরি এটাই। আর …
উদগ্রীব গর্ডন সাইকস এবং মাইকেল বার্নস যুগ্মস্বরে বললেন, আর অন্য চুরি।
অরিন্দম বলল, এই চুরিটা উপন্যাসে নেই, আমার হৃদয়ের মণিকোঠায় আছে। প্রবীণ মাইকেল বার্নসের উৎকণ্ঠার স্বর শোনা গেল, কীরকম, সেন!
অরিন্দম বলল, দ্বিতীয় এবং সম্ভবত গৃঢ় চুরিটা হল যেদিন আমি ছাদ টপকে নন্দিনীদের চিলেকোঠায় হানা দিয়ে ওর চিঠির গোটা বাক্সটা তুলে আনলাম আমাদের চিলেকোঠায়।
এক আর্ত বিস্ময়ধ্বনি হঠাৎ ছিটকে বেরোল সভার পিছন থেকে। সবাই পিছনে ফিরে দেখল ইয়েন ম্যাকলিন দু-হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় কাঁপছেন। কিন্তু অরিন্দমের আর থেমে পড়ার জো নেই। ও বলতেই থাকল, উপন্যাসে বালক সুমিত সাত বছর অপেক্ষায় ছিল তিস্তার চিঠি খোলার জন্য। আমার জীবনে তেমনটা হয়নি। জীবনেও আর বিয়ে করব না বলে নন্দিনী যেদিন সার্পেন্টাইন লেন ছেড়ে ওর পিসিমার কাছে চলে যায় গিরিডিতে সেদিন ওর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ওর চিঠিগুলো সরিয়েছে বাড়ির লোকেরাই। আমায় বলল, সুমিত, মানুষটাকে তাড়াবার পর ওরা আমার চিঠিগুলোও নষ্ট করে দিল; এখানে আমি আর একটা রাতও থাকতে চাই না। তখন আমার বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে কথাটা, না, না, অন্য কেউ না। আমিই চুরি করেছি। তোমার চিঠিগুলো। কিন্তু বলতে পারলাম না কিছুতেই, চিঠিগুলো যে তখনও আমার পড়া হয়নি।
অরিন্দম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দেখল ইয়েন ম্যাকলিনও সোজা হয়ে বসেছেন ওর নতুন কোনো স্বীকারোক্তির আশায়। অরিন্দম ওর স্মৃতির ভাবালুতা কিছুটা সংবরণ করে খুব
স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, আর চিঠিগুলো পড়াই আমার কাল হল। ওই অল্প বয়সে এত ঈর্ষা আমার কোত্থেকে এল কে জানে! এত প্রেম, এত ভালোবাসা মেয়েটা ওর তন্বী শরীরের কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল? আর তখন, সেই প্রথম, আমি প্রেমে পড়ি। নন্দিনীর ওই হাজারখানেক চিঠিই আমার নিয়তি হল, ওর মতো রোজ অন্তত একটা করে কাল্পনিক প্রেমপত্র লেখা অভ্যাস করলাম। উপন্যাসের সুমিতের মতো তিস্তার বয়ানে নয়, একান্তভাবে নিজের বয়ানে নন্দিনীকে। একসময় ক্রমে এও বুঝলাম যে, নিছক আবেগ ও অনুভূতি চিঠিকে জীবন দেয় না, দেয় লেখার স্টাইল। যে স্টাইলের কথা বারবার নন্দিনী বলেছে ওর চিঠিতে ব্রায়ানকে। এক জায়গায় যেমন লিখেছে,
ব্রায়ান, দেড় বছর হল তোমার কণ্ঠস্বর শুনিনি, তোমার ভাষা শুনিনি, তোমার লেখা একছত্র চিঠিও পাইনি। তাই মনে হয় স্টাইল জিনিসটাই যেন জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চললে আমি একদিন সত্যি সত্যি পাগল হয়ে যাব।
অরিন্দম একটু নীরব হয়ে দাঁড়াল এখানে, এবং এই প্রথম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় আনমনে বলল, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে যখন বুঝলাম মানুষ ইয়েন ম্যাকলিন আমার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে ওঁর স্টাইল, ওঁর ফেলে যাওয়া ব্যক্তিত্বের আবেশ। আমার চিঠি লেখা বন্ধ হল, আমার পড়াশোনা চুলোয় যেতে বসল, আমি এক শীতের দুপুরে ট্রেনে চেপে বসলাম গিরিডির পথে। যদূর মনে পড়ে তখন আমি কলেজের প্রথম কিংবা দ্বিতীয় বর্ষে। যে বয়সে মনে হয় বাল্যস্মৃতিগুলো হঠাৎ করে খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে। আমার শরীর জুড়ে তখন নন্দিনীকে দেখার আকাঙ্ক্ষা, একটা গোপন বাসনা তাকে পাওয়ারও।
হঠাৎ সামনের সারি থেকে শার্লি ডকিং জিজ্ঞেস করলেন, এই পাওয়ার কথাটা মনে পড়ছে আপনার বইতে আছে।
অরিন্দম মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। তবে সেইভাবে নেই। উপন্যাসে আছে সুমিত স্বীকারোক্তি করছে তিস্তার কাছে। ঘটনা হল আমি নন্দিনীকে দেখলাম সম্পূর্ণ স্মৃতিহীন অবস্থায়। আমার মুখ, আমার নাম তার কিছুই মনে নেই, তার সারাদিনের কাজ হল কুকুর, বেড়াল, পাখিদের খাওয়ানো এবং রাতে গুনগুন করে পাঁচের দশকের সিনেমার গান গাওয়া। নন্দিনী তখনও ছবির মতো সুন্দর, কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসা নিবেদন করার সুযোগ পেলাম না। ওর চিঠির গোছাগুলো ওর কোলে চাপিয়ে দিয়ে সেই রাতেই ট্রেন ধরি কলকাতার। সারারাত ট্রেনে শুধু একটাই শব্দ মনে মনে আউড়েছি—আমার একটা প্রতিশোধ চাই। অথচ তখনও জানি না কার বিরুদ্ধে, কেন, কীভাবে।
সেই কারণ, লক্ষ্য ও ধরন আমাকে ধরিয়ে দিল সাতাশ বছর আগে ম্যাকলিনের বই ‘ক্যালকাটা পোট্রেটস’।
কথা শেষ করে পোডিয়মে রাখা জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে তাতে একটা বড়ো চুমুক দিল অরিন্দম।
.
পাঠসভা শেষে যে ককটেল চালু হল সেটাই সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছিল অরিন্দমের পক্ষে। শ্যাম্পেন হাতে ধরে এক একজন বুদ্ধিজীবীর এক একরকম প্রশ্ন। ওর পাবলিশার হার্পার কলিন্স ওকে আগে থেকেই সতর্ক করেছিল যে, লণ্ডনের সমালোচকরা তিরিশ গজ দূরে থাকলেই লেখক নিরাপদ। তার চেয়ে কমে এসে গেলে সমূহ বিপদ। তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে এটা মোক্ষম শিখেছেন সলমন রুশদি, অরুন্ধতী রায়, বিক্রম শেঠরা। কাজেই…
অরিন্দম ওর শ্যাম্পেন ধরে এসবই ভাবছিল যখন বুড়ো মাইকেল বার্নস বেশ ক-পেগ হুইস্কিতে চুর হয়ে টলতে টলতে এসে ধরলেন ওকে। ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, তোমার উপন্যাসের জন্য ধন্যবাদ, সেন। আরও একটা ধন্যবাদ একটা রহস্যমোচনের জন্য।
অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, কেন, কীসের রহস্যমোচন?
ঠোঁট থেকে গেলাস নামাতে নামাতে বার্নস বললেন, কেন, ইয়েন ম্যাকলিনের উপন্যাস না লেখার রহস্য। ওর ‘ক্যালকাটা পোট্রেটস’ পড়ে তো আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি একটা উপন্যাসের রসদ নষ্ট করলে প্রবন্ধের বই লিখে। তাও তো তিস্তার রোমান্টিক সংসর্গের কোনো উল্লেখই ছিল না ওতে। তাতে ও কী বলেছিল জানো, সেন?
অরিন্দম যথাসম্ভব উৎকর্ণ হয়ে বলল, কী বলেছিলেন?
-বলেছিল, মিস্টার বার্নস, প্রবন্ধেই আমি রাখঢাক করে বলতে পেরেছি আমার কলকাতার গাথা। উপন্যাসে সম্পূর্ণ সত্য না বলে পারা যায় না।
অরিন্দম জিজ্ঞেস করল, তাহলে উপন্যাসই বা লিখলেন না কেন ম্যাকলিন? আপনি জিজ্ঞেস করেননি?
বার্নস বললেন, করিনি আবার! বললে, এ উপন্যাস শুধু একটাই পরিপ্রেক্ষিতে লেখা যায়। সেটা আমারও নয়, কাহিনির সম্ভাব্য নায়িকারও নয়। আমার বইয়ের ওই ছোট্ট ছেলেটি যে সারাক্ষণ দরজা-জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে জগৎ দেখে। নিতান্তই বালক বলে সে বোঝে কম, কিন্তু জানে অনেক।
অরিন্দম বলল, তাহলে ওই ছেলের চোখেই বা কেন লিখলেন না?
বার্নস হেসে বললেন, কারণ ও বলেছিল, কথা দেওয়া আছে কাকে যেন!
অরিন্দম জিজ্ঞেস না করে পারল না, তাহলে এইজন্যই কি আপনি পোস্ট রিডিং সেশনে ‘ক্যালকাটা পোট্রেটস’ আর ‘আ থেফট ইন দ্য প্যালেস’-এর সম্পর্কের কথা তুলেছিলেন?
এবার আর বার্নস কোনো উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে হাসলেন। তারপর হঠাৎ একসময় অরিন্দমের পিঠে ফের এক চাপড় দিয়ে বললেন, চলি, সেন। তবে এটা মনে রেখো যে, যেটা ম্যাকলিনের ক্ষতি সেটাই আজ তোমার লাভ। তোমার প্রেক্ষিতটা ও চাইলেই আগের থেকে আত্মসাৎ করতে পারত।
ডিনার শেষ করে ল্যাংকাস্টার পোস্ট থেকে বেরিয়ে অরিন্দম ট্যাক্সির অপেক্ষায় ছিল ওয়ারিক অ্যাভেনিউ যাবে বলে। হঠাৎ অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে ইয়েন ম্যাকলিন ওর সামনে পড়লেন—সেন, তুমি চাইলে আমার সঙ্গে একটু হাঁটতে পারো সেন্টা জনস উড-এ আমার ডেরা অব্দি। তারপর না হয় আমি ড্রাইভ করে পৌঁছে দেব যেখানে তুমি আছ।
অরিন্দম বলল, আমি আছি ওয়ারিক অ্যাভেনিউয়ের ওয়ারিংটন ক্রেসেন্টে। সেটা কী খুব দূর হবে আপনার ওখান থেকে?
ম্যাকলিন উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠলেন, ওহ। ও তো বলতে গেলে পাশের পাড়া। তুমি নির্দ্বিধায় এখন আমার সঙ্গে পথ চলতে পারো।
আর কথা শেষ হতেই বসন্তের রাতে, চাঁদের আলোয় দু-জনে পথ চলতে লাগল ঠিক সেই রকম মুখর নৈ:শব্দে যেমনভাবে বহুকাল আগে ওরা হাঁটত পুরোনো মধ্য কলকাতার অলিগলি বেয়ে। যখন যেতে যেতে আচমকা জিজ্ঞেস করে বসতেন ম্যাকলিন, তোমার কী মনে হয় নন্দিনী আমার ভালোবাসে?
অরিন্দম বুঝতে পারত না মাঝে মাঝেই সাহেব ওকে এই প্রশ্নটা করে কেন। কাউকে না ভালোবেসে মেয়েরা কি…না! রাস্তায় যেতে যেতে রাতের বেলা দরজার ঘেঁদা দিয়ে দেখা ওইসব দৃশ্যের কথা ওর ভালো লাগত না। ও তাই জবাব না দিয়ে চুপ করে রইত। আর সাহেবও তখন নীরব হয়ে পড়ত।
আজও ইয়েন ম্যাকলিনের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কীরকম রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছিল অরিন্দমের। মনে হচ্ছিল যেকোনো মুহূর্তে সাহেব বলে বসবেন, তোমার কী মনে হয় নন্দিনী আজও আমায় ভালোবাসে? কিন্তু বাস্তবে তেমন কিছুই বললেন না ম্যাকলিন, কেবল মাঝে মাঝে মুখ তুলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে রাস্তা চলতে থাকলেন।
শেষে কথা শুরু করতে হল অরিন্দমকেই। রাস্তা পার হওয়ার জন্য ট্রাফিক লাইটে দাঁড়িয়ে হ্যালোজেনের আলোতে ঝলমল সাণ্ডারল্যাণ্ড অ্যাভিনিউয়ের ওপর অরিন্দম জিজ্ঞেস করে বসল, ইয়েন, আমার উপন্যাসটা আপনার কেমন লেগেছে জিজ্ঞেস করতে পারি?
রাস্তা পার হতে হতে প্রায় আনমনে ম্যাকলিন বললেন, ওহ, তোমার উপন্যাসটা আমার কাছে একটা আবিষ্কারের মতো হয়েছে!
আবিষ্কার!–একটু চমকেই গিয়েছিল অরিন্দম।
ম্যাকলিন বললেন, হ্যাঁ আবিষ্কারই। কারণ বালক সুমিতের দৃষ্টিভঙ্গিতে তুমি যে উপন্যাস গেঁথেছ সেটা প্রেমের উপন্যাসই, কিন্তু বড়ো রাগী।
রাগী?–ফের একটু অবার হয়েছে অরিন্দম।
-হ্যাঁ, রাগীই। কারণ যে বালকটাকে আমি চিনতাম কলকাতায় তার মধ্যে যে এত রাগ, ক্ষোভ, অভিমান তার বিন্দুবিসর্গও আমি আঁচ করতে পারিনি।
–কেন, আপনার কী ধারণা ছিল আমার সম্পর্কে তখন? ‘ক্যালকাটা পোট্রেটস’-এ তো গুটিকয়েক আঁচড়েই আমাকে খারিজ করে দিয়েছিল।
ইয়েন একটু সরে এসে হাত রাখলেন অরিন্দমের পিঠে। ঈষৎ নত সুরে বললেন, কী করতাম বলো? তোমার কথা লিখতে গেলেই অবধারিতভাবে নন্দিনীর কথা এসে যাচ্ছিল। আমাকে থামতেই হয়েছে যৎশিগগির।
—আর যদি লিখতেন সবিস্তারে তাহলে এক ভিন্ন আমি ধরা পড়তাম আপনার লেখায়? যার রাগ, অভিমান, ক্ষোভ নেই? তাহলে ওই দিনগুলোয় আপনি কী জেনেছিলেন আমায়?
ইয়েন ম্যাকলিন হঠাৎ একটা বাড়ির সামনে থেমে বললেন, এই আমার ডেরা। চলো, ভেতরে যাই।
অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংসের লিফটে উঠতে উঠতে ম্যাকলিন বললেন, তোমার উপন্যাস পড়ে হঠাৎ করে এটাই শিখলাম যে, বালক-বালিকারা চরিত্র হিসেবে অনেক জটিল। হয়তো প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে একটু বেশিই। এবং তারা পূর্ণবয়স্কদের মতনই সমান নিষ্ঠুর।
লিফট থেকে বেরুতে বেরুতে অরিন্দম বলল, হ্যাঁ, আমার সুমিত একটু বেশি নিষ্ঠুর। তবে ব্রায়ানের মতো নয়।
ওঁর ফ্ল্যাটের দরজা খুলতে খুলতে ইয়েন ম্যাকলিন মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন অরিন্দমকে। তারপর দু-জনে ঘরের ভেতরে ঢুকে আসতে বললেন, ভেবো না তোমার উপন্যাসের জবাব আমার কাছে নেই। হয়তো সেটা বলব বলেই এতদূর হাঁটিয়ে আনলাম। এবার জুতো-জ্যাকেট খুলে ওই সোফাটায় বসো। আমি একটু কফি বানিয়ে আনি।
চমৎকার ফ্ল্যাট ম্যাকলিনের, ব্যাচেলার্স ডেন বলতে যা বোঝায়। দেওয়ালজোড়া বই, কলকাতার কিছু ফটো-প্রিন্ট ঝুলছে এখানে-ওখানে, নানা ধরনের গান-বাজনার এল পি সিডিতে সাজানো তাক, লেখার টেবিলে ফ্রেমে বাঁধানো একটা সাদা-কালো ছবি। অরিন্দম টাই, জ্যাকেট, জুতো, মাফলার খুলতে খুলতে টেবিলের পাশে আসতেই থ’ মেরে গেল। ছবিটা নন্দিনীদের ছাদে ইয়েনের তোলা নন্দিনী আর অরিন্দমের ছবি। কালে কালে অনেকটাই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে, কিন্তু যুবতী ও বালকের সেই উজ্জ্বল হাসি আজও অমলিন। অরিন্দম ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ছবিটা দেখল, আর ভাবল, এই বালকের এত অভিমান, কে আঁচ করতে পারে? তাহলে কি…
অরিন্দমের চিন্তায় ছেদ পড়ল ম্যাকলিনের কথায়—এই নাও তোমার কফি, সেন। আর এই নাও আমার জবাব। বলে টাইপস্ক্রিপ্টে প্রায় আটশো পাতার একটি পান্ডুলিপি ওর হাতে তুলে দিলেন সাহেব। অরিন্দম কফিটা টেবিলে নামিয়ে লেখাটার শিরোনামের দিকে তাকাল। টাইপ-করা পান্ডুলিপির শিরোনাম কিন্তু কলমের আঁচড়ে বাঁধা—’সিনজ ফ্রম আ বয়হুড’। বাল্যকালের দৃশ্যাবলি।
ম্যাকলিন একটা সিগার অফার করলেন অরিন্দমকে। ‘নো, থ্যাঙ্কস’ বলে লেখাটা নিয়ে ও প্রায় শুয়ে পড়ল আরামকেদারায়। আনমনে ক-টা চুমুক দিল কফিতে, আর একটু একটু করে ডুবে গেল ম্যাকলিনের অপ্রকাশিত উপন্যাসে। আরও স্পষ্ট করে বললে, ডুবে গেল নিজের বাল্যে।
যখন শেষ হল পড়া, অরিন্দমের চোখ টাটাচ্ছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে নরম রোদ এসে পড়েছে ইয়েনের নিদ্রিত, বিষণ্ণ মুখে। আর ব্যথায় অবশ হয়ে আছে অরিন্দমের বুক। বহুদিন পর এত মন ভারী করা, মন ভালো করা, কষ্টের লেখা পড়া হল ওর। বালক দীপুর চোখে এক অপূর্ব, নিষিদ্ধ প্রেম। দরজার ছিদ্র দিয়ে দেখা দেহজ মিলন (সর্বনাশ, ইয়েন ও নন্দিনী তাহলে জানত ও ওদের দেখে ওই অবস্থায়।), নাটমন্দিরের বারান্দায় বসে নন্দিনীর কবুল করা, ‘আই লাভ ইউ, ইয়েন’, পড়ার ঘরে নন্দিনীকে ইয়েনের তালিম কী করে ভালো প্রেমপত্র লিখতে হয়, ভাইফোঁটার দিন ইয়েনকে ফোঁটা দিতে গিয়ে নন্দিনীর হাত থেকে থালা পড়ে যাওয়া, ইয়েনের বিবাহ প্রস্তাব জানার পর বাড়ির মা বা দাদা, কাকার হাতে নন্দিনীর প্রহার, নন্দিনীর বন্দিদশা, ইয়েনের বহিষ্কার, তারপর দিনের পর দিন দীপুর একলা-একলা গিয়ে বসা নন্দিনীদের চিলেকোঠায়, দরজার ছিদ্রে চোখ রেখে ওর বিশ্বব্রহ্মান্ড কল্পনা, বাড়ির গুরুজনদের হাতে প্রহার, তবু সুযোগ পেলেই ওর চিলেকোঠায় চড়াও হওয়া, দীপুর জ্বর, স্নায়ুর রোগ, হঠাৎ একদিন ভুল বকতে শুরু করা, এবং সেই ভুল বকার মধ্যে নন্দিনীদের চিলেকোঠায় দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া, ডাক্তারদের ওকে অ্যাকিউট ট্রমা কেস ঘোষণা, রোজ রোজ এসে নন্দিনীর শুশ্রুষা ওকে, সেরে উঠে যোড়শ জন্মদিনে নন্দিনীকে দীপুর প্রেম নিবেদন, নন্দিনীর প্রত্যাখ্যান এবং অবশেষে দীপুর ফের মনোরোগে তলিয়ে যাওয়া। উপন্যাসের শেষ দশ পাতা সম্পূর্ণ অসংলগ্ন, দুর্বোধ্য প্রলাপ মাত্র। ফলে রচনাটা শেষ হল কি হল না বোঝা কঠিন।
অরিন্দম পান্ডুলিপি শেষ করে বহুক্ষণ পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে রইল। ওর ধন্ধ জেগেছে ‘আ থেফট ইন দ্য প্যালেস’-এর সুমিত আর ‘সিনজ ফ্রম দ্য বয়হুড’-এর দীপুর মধ্যে ও নিজে সত্যিকারের কোনটা। বয়হুড’-এর পরবর্তী অংশের ঘটনাগুলো ইয়েন ম্যাকলিনের কল্পনা, সেসব কোনোদিন ঘটেনি অরিন্দমের জীবনে, অথচ এই মুহূর্তে সেগুলোকে প্রগাঢ় সত্য বলে ধারণা হচ্ছে ওর। প্যালেস’-এর ঘটনাগুলো বাস্তব, কিন্তু তাতে এক মনস্তত্ত্ব ভর করেছে কঠিনভাবে। যে মনস্তত্ত্ব ও মানসিকতার অনেকটা হয়তো কল্পনা। অরিন্দম কি সত্যিই সে-ভাবে ঘৃণা করেছে ইয়েন ম্যাকলিনকে কিংবা নিজেকে কিংবা নন্দিনীকে, যাতে কি না প্রতিশোধ নেওয়ার প্রবৃত্তি হয়? সেও কি অরিন্দমের কল্পনা নয়?
ইয়েন ম্যাকলিন জেগেছেন। তখনও অরিন্দমকে বই ধরে বসে থাকতে দেখে বললেন, সে কী! তুমি ঘুমোওনি?
পান্ডুলিপিটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে অরিন্দম বলল, না। তবে এবার ঘুমোব। তার আগে আপনাকে সেই প্রশ্নটাই করতে চাই যা কোনো লেখককে করা যায় না। কারণ তা অপমানজনক। তবু করছি, কারণ এই প্রশ্ন আপনিও আমায় করেছেন কাল।
অধৈর্য হয়ে ইয়েন ম্যাকলিন বললে, লেখকের মান-অপমান নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। তুমি প্রশ্নটা করো।
অরিন্দম বলল, আপনি এই উপন্যাসটা লিখলেন কেন?
ম্যাকলিন বললেন, প্রতিশোধ নিতে!
অরিন্দম চমকে গেছে সাহেবের উত্তরে, প্রতিশোধ? কার বিরুদ্ধে?
—নিজের।
—নিজের বিরুদ্ধে? কেন?
—আমি একটা উপন্যাস লেখার বৃত্তি নিয়ে তোমাদের ওখানে গিয়েছিলাম। পরে বুঝলাম জীবন এক ভয়ংকর গবেষণাগার। ভাবিনি ভালোবাসার অ্যাসিড ছিটিয়ে এতখানি ক্ষতি করে বসব কারও।
অরিন্দম কিছুটা বিমর্ষ হয়ে জিজ্ঞেস করল, নন্দিনীর সঙ্গে ভালোবাসাও কি সেই পরিকল্পনার অঙ্গ?
ইয়েন ম্যাকলিন জড়ানো কণ্ঠস্বরে বললেন, তাও বলতে পারো। হয়তো তাই।
–তাহলে প্রকাশ করলেন না কেন কাজটা?
ম্যাকলিন ওঁর রাতের বেলা নিভিয়ে-রাখা সিগারটা ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিলেন। তারপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললেন, মাইকেল বার্নস যখন বললেন এ এক সাড়াজাগানো কাজ হতে পারে, আমি ভয় পেলাম। মনে হলে আমার দ্বিতীয় সর্বনাশ হবে। দ্বিতীয় পাপও। আমাদের প্রথম চুম্বনের প্রাকমুহূর্তে নন্দিনী একটা কথাই বারবার বলেছিল যা আমি আজও ভুলিনি, ডার্লিং, প্রমিস করো আমাদের এইসব কথা কোনোদিনও লিখবে না তোমার লেখায়। যখন জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেন? বলল, মন্দিরের বারান্দায় বসে বলছি—তাহলে আমি সত্যিই মরে যাব।
এরপর ফের নীরব হয়ে পড়ল ফ্ল্যাটটা। ম্যাকলিন উঠে সকালের কফি বানাতে গেল আর অদ্ভুত এক ক্লান্তিতে ঘুমে ঢলে পড়ল অরিন্দম।