পাঠকের নিবেদন – ১০

পাঠকের নিবেদন

অবধূত যখন তাঁর মরুতীর্থ নিয়ে মুরুব্বিহীন হালে নিঃশব্দে বাংলা সাহিত্যের আসরে প্রবেশ করলেন তখন উভয় বাংলার বাঙালি পাঠক মাত্র যে বিস্মিত হয়েছিলেন সে-কথা নিশ্চয়ই অনেকের স্মরণে আছে। এ তো মরুতীর্থ নয়; এ যে রসে রসে ভরা রসতীর্থ।

হিন্দু তীর্থের প্রতি মুসলমানের কোনও কৌতূহল থাকার কথা নয়, কিন্তু এই গ্রন্থ পড়ে পূর্ব পাকিস্তানি একটি মুসলমান তরুণ আমাকে বলে, সে নিশ্চয়ই হিংলাজ দেখতে যাবে– সে তখন করাচিতে চাকরি করে, তার পক্ষে যাওয়া সুকঠিন ছিল না। আমি শঙ্কিত হয়ে বললুম, অমন কর্মটি করো না। আর্টিস্টের মডেলের সন্ধানে কেউ কখনও বেরোয়! যে ভিখারিণী ছবি তুমি পশুদিন একশো টাকা দিয়ে কিনলে তুমি কি সে ভিখারিণীর সন্ধানে বেরোও, যাকে মডেলরূপে সামনে খাড়া রেখে আর্টিস্ট ছবি এঁকেছিল? বরঞ্চ বলব, তার সঙ্গে দৈবাৎ রাস্তায় দেখা হলে তুমি তো উল্টো ফুটে চলে যাও! কারণ, সে তো তোমার হৃদয়ে কোনও ইথেটিক আনন্দ দিতে পারে না। আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, অবধূত-মহারাজ সাধু ব্যক্তি; সে সাধুতা তিনি লেখক হিসেবেও রক্ষা করেছেন এবং তাঁর পুস্তকে তিনি অতিরঞ্জিত করেননি। কোনও কোনও সাধু-বাবাজি বড় তামাক সেবন করেন; অবধূত কখনও করেছেন কি না বলা কঠিন– অন্তত তাঁর ডেরাতে সে খুশবাই আমি পাইনি কিন্তু একথা বরহক সত্য, তাঁর সৃষ্টিতে গঞ্জিকা-বিলাস বিলকুল নদারদ। কাজেই হিংলাজে গিয়ে তুমি টায়-টায় তাই পাবে, দফে দফে সে-সব জিনিসই পাবে যার বয়ান অবধূত ইমানসে দিয়াছেন, তাঁর ইভেনট্রিতে ফাঁকি পাবে না। এবং পাবে না এবং সেইটেই সবচেয়ে বড় কথা– তাঁর বই পড়ে যে কাব্যরস, যে কলা-সৃষ্টিরস, যে ইসথেটিক ডিলাইট পেয়েছিলে সেই অনবদ্য অমৃত। তার শেষ প্রমাণ, সূর্যোদয় তো আমরা নিত্য নিত্যি দেখি; তবে সূর্যোদয়ের ছবি কিনি কেন?

তা হলে প্রশ্ন, অবধূত কি খাঁটি রিয়ালিস্টিক লেখক?

অবধূত কি বাস্তব জগৎ ছাড়িয়ে যেতে পারেন না? কল্পনার ডানা জুড়ে দিয়ে তিনি যদি আমাদের নভেলকে উড্ডীয়মান না করতে পারেন তবে বাস্তবের কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে কী এমন চরম মোক্ষ লাভ!*

[*যেখানে মানুষের আত্মপ্রকাশে অশ্রদ্ধা সেখানে মানুষ আপনাকে হারায়। তাকে বাস্তব নাম দিতে পারি, কিন্তু মানুষ নিছক বাস্তব নয়। তার অনেকখানি অবাস্তব, অর্থাৎ তা সত্য। রবীন্দ্রনাথ, রচনাবলী, ২৭ খণ্ড, পৃ. ২৮৫।]

এর উত্তর অতিশয় সরল। অবধূত যদি তার কল্পনা, তাঁর সৃজনীশক্তি, তাঁর স্পর্শকাতরতা মরুতীর্থের পাতায় পাতায় ঢেলে না দিয়ে থাকতেন তবে পুস্তকটি রসকষহীন মরুই থেকে যেত। বড়জোর সেটা হত গাইড বুক। গাইড বুক, বড়ই প্রয়োজনীয় বস্তু, কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, আর্ট আরম্ভ হয় ঠিক সেই জায়গা থেকে যেখানে প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়। রাধু মালী কেনেস্তারায় করে নাইবার জন্য যে-জল এনে দেয় তাতে প্রয়োজন মেটে বটে, কিন্তু নন্দলাল কর্তৃক বহুবর্ণে বিচিত্রিত কুম্ভ মস্তকে ধারণ করে যখন তনুঙ্গী মরাল গমনে জল নিয়ে আসে তখন সঙ্গে সঙ্গে আসে আর্টের উপাদান, সেই জলের সঙ্গে সঙ্গে আসে কল্পনার উৎস, সৃষ্টির অনুপ্রেরণা– সেই পুণ্যবারিই মরুতীর্থকে শ্যামল সুন্দর করে তোলে, সে তখন দেয় তৃষ্ণা-হরা সুধাভরা সঙ্গসুধা এবং কে না জানে সঙ্গ ওসাহিত্য বড় কাছাকাছি বাস করে।

কিন্তু ওই মরুতীর্থই তো অবধূতের একমাত্র বা সর্বশ্রেষ্ঠ রসসৃষ্টি নয় যে সুদুমাত্র এইটে বিশ্লেষণ করেই আমরা পুস্তক ও লেখকের প্রকৃত পরিচয় পেয়ে যাব, এবং প্রশ্ন, রসের হাটে ভ্রমণকাহিনী কোন কাতারে বসার হক্ক ধরে, বাজারের বৈচিত্র্য নির্মাণে তার সেবা কতখানি, সে পাবে কোন্ শিরোপা? বিশেষত বাংলা সাহিত্যে? লোকে বলে ঘরমুখো বাঙালি; কাজেই তার কাছ থেকে আর সবকিছুই আশা করা যেতে পারে, শুধু ভ্রমণকাহিনীটি মাফ করে দিতে হয়। তাই যদি হয়, তবে বলব, পালামৌ-র পরই মরুতীর্থ। এবং তার পরও তাকে কেউ আসনচ্যুত করতে পারেনি। বলা বাহুল্য, এসব আলোচনায় আমরা গুরু রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিই।

তবে কি অবধূত শুধু ভ্রমণকাহিনীর কীর্তনিয়া পার এসেলাস?

অধীন সমালোচক নয়, বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকও নয়। তার প্রধান পরিচয়– সে যা মনে করে পাঠকরূপে। সে বই পড়তে ভালোবাসে এবং যদ্যপি ঈশ্বরেচ্ছায়, বা নসিবের গর্দিশে, যাই বলুন, সে ভিন্ন ভিন্ন দেশে যাওয়ার ফলে বাংলা ছাড়াও দু-একটি অতিশয় ধনী তথা খানদানি ভাষার সঙ্গে কিঞ্চিৎ পরিচিত হয়েছে, তথাপি সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আপন মাতৃভাষা বাংলাতেই বই পড়তে। এবং কোনও বই পড়ে– বিশেষ করে সে বইয়ের লেখক যদি অখ্যাতনামা হয়, তাকে যদি নববধূর মতো লজ্জিত শঙ্কিত পদে বাংলা বাসরে প্রবেশ করতে দেখে তবে আঙ্গিনা যেতে তার কল্যাণ কামনা করে, বয়েস ছোট হলে আশীর্বাদ জানায়। আবার বলছি, পাঠক হিসেবে। অবধূত শংকর আদিকে আমি উদ্বাহু হয়ে অযাচিত অভিনন্দন জানাই, বাংলা সাহিত্যে তাঁদের প্রবেশলগ্নেই। পরবর্তীকালে কেউ কেউ আমাকে আরও আশাতীত আনন্দ দিয়েছেন, কেউ কেউ দেননি, কিন্তু সে নিয়ে আমার ক্ষোভ নেই, কারণ এ-দুজনা আমাকে নিরাশ করেননি।

অবধূতের বয়স হয়েছে, তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য। আমিও তদ্বৎ। পূর্বেই নিবেদন করেছি, আমি সমালোচক বা অধ্যাপক নই, তার রচনা সম্বন্ধে আমার লিখবার যেটুকু হক্ক আছে সে শুধু, তিনি লেখক পারু-এসেলাস, আমি তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ পাঠকদের ভিতর পাঠক পার একসেলাস, পাঠকোত্তম। আমি উদ্ধারণপুরের কাছেই বাস করি, এর সঙ্গে আমার আবাল্য পরিচয়। এ ঘাট দিয়ে উভয়ে একসঙ্গে না গেলেও শীঘ্রই আমরাওপারে মিলিত হব। সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে সৃষ্টির চরম রহস্য জেনে নেবার পূর্বেই অবধূতের সৃষ্টি সম্বন্ধে আমার বিস্ময় প্রকাশ করে যাই।

আমার পরিচিত কোনও কোনও কনিষ্ঠের ধারণা– যার উল্লেখ এইমাত্র করলুম যে, অবধূত আসলে ভ্রমণকাহিনী লেখক। বাইরের দিক দিয়ে দেখতে গেলে এ ধারণা ভুল না-ও হতে পারে। কারণ বিশ্বস্তসূত্রে অবগত হয়েছি, গেরুয়াধারীকে সরাসরি প্রশ্ন শুধানো অনুচিত– তিনি দীর্ঘকাল সন্ন্যাসী-শ্ৰমণজনোচিত স্থান পরিবর্তন বা পর্যটন করেছেন, এবং সে-কারণে তাঁর রচনাতে সবসময়ই অল্পবিস্তর আনাগোনা থাকে, এবং পরোক্ষভাবে সেটাকে ডাইনামিক করে তোলে। এটা সদ্গুণ, কিন্তু এটা অবধূতের একমাত্র গুণ তো নয়ই, প্রধানতম গুণও নিশ্চয়ই নয়।

আবার, কোনও কোনও কনিষ্ঠের ধারণা– এরা সাধারণত আমার সমুখে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে অবধূত প্রধানত সন্ন্যাসীদের মধ্যে যে ফঞ্চুড়ি ধাপ্পাবাজি আছে সেটার নিরতিশয় নগ্নরূপ আমাদের সামনে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এটাও পূর্বেকার মতো আংশিক সত্য, সম্পূর্ণ সত্য নয়। ফকুড়ি, ধাপ্পাবাজি, বুজরুকি,* –এরই মোলায়েম নামধরাধরি বাতদৃবির (অবধূতের ভাষায়ও বোধহয় আছে, বসুন্ধরা পূর্বে বীরভোগ্যা ছিলেন; অধুনা তদবিরভোগ্যা)– এসব তো সর্বত্রই আছে, এবং এ-বাবদে সন্ন্যাসীদের নিদারুণ ঢিঢ দিতে পারে হালফিলের গৃহীরা, এবং কলকাতায় তাদের সন্ধানে বিস্তর তলিফ বরদাস্ত করতে হয় না; বস্তুত তাদের অনাহারে প্রাণ অতিষ্ঠ। হাট-বাজারে, মেলা-মজলিশে, সাহিত্য-বিদ্যালয়ে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে বিজ্ঞান, বিশ্বপ্রেম সেখানেই তো বিশ্ব ফকুড়ি- এ তো পাড়ার পদিপিসিও জানে। তার দাওয়াই কী, সে-ও তো অজানা নয়। শুধু অজানা– এ-খাটাশের গলায় ঘন্টা বাধবে কে? অবধূত সমাজ-সংস্কারক নন– ডন কুইটের মতো নাঙ্গা তলওয়ার দিয়ে বেপরওয়া বায়ুযন্ত্র (উউন্ডি-মিল) আক্রমণ করা তারধর্মে নেই। লোকটি বড়ই শান্তিপ্রিয়। শুধু যেখানে বর্বর পশুবল অত্যাচার করতে আসে, এবং সে পশুবল ফঞ্চুড়িতেও সিদ্ধহস্ত সেখানে অবধূত, ফড়ির মুষ্টিযোগ ফড়ি ছাড়া নানাপন্থা বিদ্যতে বিলক্ষণ জানেন বলেই সেটা বীভৎস রূদ্ররূপে দেখাতে জানেন। কিন্তু এটা তাঁর ব্যক্তিগত চরিত্র, শীলের দিক। লেখক হিসেবে এটা তার নগণ্যতম পরিচয়। কারণ লেখক হিসেবে হীরো রূপে তিনি কস্মিনকালেও আত্মপ্রকাশ করতে চাননি।

[*বুজরুকি শব্দটি এসেছে ফারসি বুজরুগ থেকে– অর্থ অতি ভদ্র; মুরকী, সাধুজন, উচ্চ-স্থানীয়; সেইটার অভিনয়, বাংলায় ভণ্ডামি।]

আর্ট ও জীবন নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা করেছেন কবিরাজ গ্যোটে। সে আলোচনা বহুস্থলে এতই সূক্ষ্ম যে আপনার-আমার মতো সাধারণ পাঠক দিশেহারা হয়ে যেতে বাধ্য। তবে সে আলোচনার ভিতর না গিয়ে সরাসরি আর্টের ভিতর জীবন ও কোনও কোনও স্থলে লেখকের জীবনীরও অনুসন্ধান করা যায়। কিন্তু দ্বিতীয়টি সংকট-সঙ্কুল। একটি দৃষ্টান্তই এস্থলে যথেষ্ট। বাঙলা দেশে কেন, পৃথিবীর হাস্যরসিকদের ভিতর পরশুরামের স্থান অতি উচ্চে। অথচ যেসব সৌভাগ্যবান তাকে ব্যক্তিগতভাবে চেনবার সুযোগ পেয়েছেন তারাই জানেন হাস্যরস ঠাট্টা মস্করা দিয়ে তিনি মজলিশ না জমিয়ে বরঞ্চ সুযোগ দিতেন আমাদের মতো রামা-শ্যামাকে। একবার তাঁকে আমি একখানা চিঠিতে লিখি, তাঁর বাড়ির ও পাড়ার ছেলেদের সামনে আমি ম্যাজিক দেখাব, তবে তিনি সে-স্থলে সশরীর উপস্থিত না থাকলেই ভালো। তিনি কাতর কণ্ঠে উত্তর লেখেন, আমাকে গুমড়োমুখো দেখে ভাববেন না, আমার রসবোধ নেই। অবধূতের বেলা ঠিক তার উল্টো। তার লেখাতে ব্যঙ্গ আছে, বিদ্রূপ আছে, যেন হাসতে হাসতে তিনি বুজরুকির মুখোশ একটার পর একটা ছিঁড়ে ফেলছেন; কোনও কোনও স্থলে সেই সুবাদে তিনি বিকট বীভৎস রসেরও অবতারণা করেছেন কিন্তু অকারণে হাস্যরস অবতারণা করতে তাঁকে বড় একটা দেখা যায় না। অথচ অন্তরঙ্গজনের মধ্যে অবধূতের অন্য রূপ। সেখানে তিনি অভিনয়সহ যে বিশুদ্ধ হাস্যরস উপস্থিত করেন সে যে কী স্বচ্ছ, কী চটুল। যেন পার্বত্য নিঝরিণী আপন বেগে পাথর হতে পাথরে লাফাতে লাফাতে এগিয়ে চলেছে তারাই শুধু জানেন যারা তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ। তার একটি অভিনয় এমনই অনবদ্য যে সেটি টেলিভিশনে দেখানো উচিত। কুঁচড়ো চন্নগর অঞ্চলে এক বিশেষ সম্প্রদায়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ভোজন করা অভদ্রতার চূড়ান্ত। নিমন্ত্রণকারী সোনার থালার চতুর্দিকে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন সাজিয়ে নিমন্ত্রিতের সামনে গলবস্ত্র হয়ে, হাত কচলাতে কচলাতে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বার বার শুধু ফরিয়াদ জানাবেন, তিনি অতিশয় দরিদ্র, সামান্যতম অনুব্যঞ্জনের ব্যবস্থা করতেও সম্পূর্ণ অক্ষম; এবং নিমন্ত্রিতজনও অতি-বড়-গাওয়াইয়ার মতো তালের আড়ির সঙ্গে কুআড়ি লাগিয়ে ইস্টিকের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই থালার সামনের পিড়িতে বসাটাও নাকি পবিত্র, যুগ যুগ সঞ্চিত সর্ব ঐতিহ্যভঞ্জনকারী সৎ বেয়াদবির চূড়ান্ত– বলবেন, প্রায় চোখের জল ফেলে, যে, এরকম অত্যুত্তম ব্যবস্থা তার চতুর্দশ পুরুষের কেউ কখনও দেখেনি, এ বাড়ির গৃহিণী রন্ধনে সাক্ষাৎ দ্রৌপদী, আর হবেই-বা না কেন, এরা যে পুরুষানুক্রমে দেশের অভিজাত সম্প্রদায়ের গৌরীশঙ্কর, নীলকণ্ঠ! এহেন রসময় চাপান-ওতর বাস্তবে কতক্ষণ ধরে চলত বা এখনও চলে সে অভিজ্ঞতা আমার নেই, কিন্তু অবধূত মৌজে থাকলে নিদেন আধঘণ্টা, এবং উভয়পক্ষের সেই নিছক কথার তুবড়িবাজি ফুলঝুরি শুধু লেখাতে প্রকাশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ একা অবধূতই দুটি পার্ট একসঙ্গে প্লে করে যান। ক্ষণে গল-বস্ত্র কাঁদো-কাঁদো কাতর নিমন্ত্রণকারী, ক্ষণে চরম আপ্যায়িত, কৃতজ্ঞতার ভারে আজানুজ, আনন্দাশ্রুতে চক্ষুদ্বয়সিক্ত নিমন্ত্রিত।

এবং এখানে এসে সত্যই অবধূতকে জোব্বার খুঁট দিয়ে চোখ মুছতে হয়!

অথচ আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলুম, গেরুয়ার খুঁট না, শৌখিন নিমন্ত্রিতের জেব থেকে বেরিয়ে এল ফুলকাটা-লেস লাগানো হাওড়া-তোড়-হাল্কাসে-হাল্কা বেডশিট সাইজের রুমাল! বিশাস করবেন না, আমি পেলুম ভুরভুরে আতরের খুশবাই। বলা বাহুল্য, নিমন্ত্রিতজন কণামাত্র খাদ্য স্পর্শ করবেন না– ভাবখানা এই, আমাদের কারওরই বাড়িতে অন্নাভাব নেই, তদুপরি খানদানি নবাব মাত্রই ডায়াটে থাকেন।

এই অভিনয় করার পরিপূর্ণ বিধিদত্ত দক্ষতা ছিল অতি বাল্যকাল থেকেই আরেকটি লেখকের– চেখফ। পাঠশালে যাবার সময় থেকেই তিনি বাপ-কাকা পাড়া-প্রতিবেশী সক্কলের অনুকরণ করে অভিনয় করতে পারতেন– কেউ কেউ খুশি হয়ে তাঁকে লেবেনচুস লার্ভুটা উপহারও দিতেন।

এই অভিনয়দক্ষতা আপন কলমে স্থানান্তরিত করতে পারলেই লেখকের সকলং হস্ততলং –লেখা তখনই হয় convincing; তার বিগলিতাৰ্থ অভিনয় করার সময় যেরকম প্রত্যেকের আপন আপন ভাষায় বৈশিষ্ট্য রক্ষা করা অপরিহার্য, লেখার বেলাও তাই। এখানে কর্মটি কঠিনতর। কারণ এখানে অঙ্গভঙ্গি করতে পারবেন না, চোখের জল ফেলে দেখাতে পারবেন না। অর্থাৎ টকি-সিনেমার কাজ গ্রামোফোন রেকর্ড দিয়ে সারতে হচ্ছে। আসলে তার চেয়েও কঠিন, কারণ, কণ্ঠস্বর দিয়ে বহুৎ বেশি ভেল্কিবাজি দেখানো যায়। অনেকের অনেক রকম ভাষা–কেউ-বা স্ল্যাঙ ব্যবহার করে, কারও-বা ইডিয়ম জোরদার, কেউ কথায় কথায় প্রবাদ ছাড়ে, কেউ বলে ভাযের মতো সংস্কৃত-ঘাষা ভাষা, কেউ কিঞ্চিৎ যাবনিক– এ সব-কটা করায়ত্ত না থাকলে ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণির লোকের কথাবার্তা convincing ধরনে প্রকাশ করা যায় না। এ বাবদে বাঙলা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ : মধুসূদনেরবুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো। আমি এ-বিষয় নিয়ে অন্যত্র দীর্ঘ আলোচনা করেছি; এ-স্থলে বলি, এ যেন একটা মিরা। মাইকেল বাল্যাবস্থায় যশোর ছাড়েন, তার পর সেখানে আর কখনও যাননি। তদুপরি অনেক কাল কাটালেন বাঙলার বাইরে। অথচ পরিণত বয়সে এই নাটকে, অর্ধশিক্ষিত, হিন্দু কর্মচারী, তার অশিক্ষিত হিন্দু চাকর, অশিক্ষিত মুসলমান চাষা, তার চেয়েও অগা তার বউ, এবং আরও চার-পাঁচজন সবাই মিলে অন্তত সাত-আট রকমের কথা বলে খুঁটির চেয়েও খাঁটি মধুর যশোরি ভাষায়, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন শেডে।

আলাল, হুতোম, পরশুরাম পেরিয়ে এ-যুগে এলে পাচ্ছি দু জন লেখক যাদের কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের উপভাষার সঙ্গে নিবিড় পরিচয় আছে। অবধূত জানেন খাস কলকাত্তাই কিন্তু এ-কলকাত্তাই হুতোমের কলকাত্তাই নয়, কারণ এর থেকে বহু আরবি-ফারসি শব্দ উধাও হয়ে গিয়েছে, ইংরেজি ও হিন্দি ঢুকেছে এবং অভাব-অনটনের ভিন্ন জীবন প্যাটার্ন নির্মিত হওয়ার ফলে এত নতুন ইডিয়ম সৃষ্ট হচ্ছে এবং গজেন্দ্র মিত্র জানেন কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘরোয়া মেয়েলি ভাষা। যত দিন সাধুভাষা চালু ছিল ততদিন এ দুটোর অল্পই কদর ছিল, কিন্তু চলতি ভাষা– সে-ও প্রধানত কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভাষা– কলুকে পেয়ে আসর জমানোর সঙ্গে সঙ্গে এগুলোর চাহিদা বাড়বেই। জনগণের কথ্য ভাষার শিকড় দিয়ে লিখিত ভাষা যদি নিত্য নিত্য প্রাণরস আহরণ না করে তবে সে একদিন শুকিয়ে গিয়েডেড ল্যান্গুই হয়ে যায়- সংস্কৃত, লাতিনের বেলা যা হয়েছিল, এ-দেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যা হয়েছে। তাই বাংলা থেকে সাধুভাষা বর্জন করে আমরা ভালোই করেছি। ভাষাটির কাঠামো ছিল ঢাকার কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রচলন হল মেট্রপলিস্ কলকাতায়। রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুল ইসলাম এঁদের সকলেই রাঢ়ি ও কর্মভূমি কলকাতায়। এঁরা ঢাকার শব্দ, ইডিয়ম, প্রবাদ, বচন-ভঙ্গি আমদানি করতে পারেন না, আবার কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের এসব মাল–পূর্বে যাকে বলেছি শিকড় দিয়ে প্রাণরস আহরণ করা–সাধুভাষার সঙ্গে ঠিক জুৎসই লাগসই হয় না, ফিট করে না। এখন সে অসুবিধা ঘুচেছে। (ঢাকা মেট্রপলিস্ হতে চলল– সেখানকার লেখকরা যদি সাধুভাষাতে প্রাণরস সঞ্চার করতে পারেন তবে সে-ও নবীন পত্র-পুষ্পে পল্লবিত হবে)।

কিন্তু এহ বাহ্য।

অবধূতের আনাগোনা বাঙলা দেশের বাইরেও বটে। বক্ষ্যমাণ নীলকণ্ঠে যাদের সঙ্গে আমাদের ভবঘুরে প্রতিনিয়ত কথা বলছেন তারা বাঙালি নয়, অথচ বাংলার মারফতেই তাদের চরিত্র convincing করতে হবে। সে আরও কঠিন কর্ম। কিন্তু লেখক যে রকম গোড়ার মজুমদার রায়সাহেবের ঘোড়ার পিঠে চড়া, সুবাসী দিদি কলকাত্তাইদের ফুটিয়ে তুলেছেন, ঠিক তেমনি অবাঙালি অমরনাথজুলিমেম এবং আরও গণ্ডায় গণ্ডায়। ভাষা করায়ত্ত থাকলে হাতিকেও বাংলা বলানো যায়।

অবধূতের প্রতিটি গ্রন্থ পড়ে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, এ-লোকটি কিসের সন্ধানে দুনিয়াটা চষে বেড়ায়? তার পায়ে চক্কর আছে সে তো বুঝি, এবং বলা উচিত কি না জানিনে– তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়ে খবরটা পেয়েছি যে, তিনি তন্ত্রে বিশ্বাস করেন। তন্ত্রশাস্ত্রে যে তাঁর গভীর জ্ঞান আছে সে-তত্ত্ব আবিষ্কার করতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। কিন্তু তান্ত্রিক একবার পথ পেয়ে গেলে তো ঘুরে বেড়ায় না! গ্যোটে বলেছেন, চরিত্রবল বাড়াতে হলে জনসমাজে যাও; জিনিয়াসের সাধনা করতে হলে নির্জনে, একাগ্র মনে। আমার মনে তখনই প্রশ্ন জেগেছে, আর যারা সাধু-সন্ন্যাসীর পিছনে পিছনে ঘোরে?বরদার মহারাজ আমাকে বলেন শ্রীঅরবিন্দ তার সঙ্গে কাজ করার সময় প্রতি শনিবারের সন্ধ্যা থেকে সোমের সকাল অবধি সাধু-সন্ন্যাসীর সন্ধানে নর্মদার পারে পারে (হিমালয়ের পরেই নাকি সেখানে ওঁদের পরিক্রমা-ভূমি) ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি একজন সিদ্ধপুরুষ পেয়েও ছিলেন। সেই সন্ন্যাসীর করুণ কাহিনী পাঠক উপেন বাঁড়ুয্যের অদ্বিতীয় পুস্তক নির্বাসিতের আত্মকথায় পাবেন। একে আনা হয়েছিল বারীন-উল্লাস-উপেনদের চরিত্রবল গড়ে দেবার জন্য। কিছুদিন এঁদের সঙ্গে থাকার পর ইনি প্রত্যেককে সনির্বন্ধ অনুনয়-বিনয় করেন, বিপ্লবীদের ভয়াবহ পন্থা পরিত্যাগ করতে। এঁরা যখন কিছুতেই সম্মত হলেন না তখন তিনি, সেই মুক্ত পুরুষ, শব্দার্থে সজল নয়নে বাগানবাড়ি ছেড়ে চলে যান। যাবার সময় অতিশয় দুঃখের সঙ্গে যে ভবিষ্যদ্বাণী করে যান সেটা আন্দামানে অক্ষরে অক্ষরে ফলে।

আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, কিন্তু কেমন যেন ঠিক বিশ্বাস হয় না, অবধূত খুব সম্ভব এরকম একটি লোকের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বা ঘুরে মরছেন। বিবেকানন্দ এ রকম লোক পাননি বরঞ্চ অন্যেরা, তিনি কিছু পেয়েছেন কি না, তার সন্ধানে লেগে যেত– এবং রামকৃষ্ণ মুক্ত পুরুষ হলেও এ ধরনের লোক নন। তিনি তো সর্বত্রই লোকচক্ষুর সম্মুখে বিরাজিত। তাঁর সন্ধানে বেরুনো নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু তাকে নিয়ে তো আমাদের কাজ চলে না। তিনি জীবন্মুক্ত। ছেলেবেলা থেকেই ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট। আমরা খুঁজি এমন একজন, যিনি পঞ্চাশবার ফেল মারার পর ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন। আমরা ফেল করেছি আড়াইশো বার। তিনিই বুঝবেন আমাদের বেদনাটা কোন্‌খানে। যে সাধক সাধনার পথে খানা-খন্দে পড়ে হাড়-হাড়ি গুঁড়িয়েছেন তিনিই তো শুধু আমাদের খবরদার! হাফি! চিৎকার করে আগে-ভাগে হুশিয়ার করতে পারেন।

কিন্তু কেন এই না-হক্ক মানুষের সন্ধানে হয়রানি?

উত্তরে সর্বদেশের গুণীজ্ঞানী মান-অভিমানী তত্ত্ববিদের সেরা বলেন, ভগবানের মহত্তম সৃষ্টি মানুষ, অতএব মানুষের সন্ধানে বেরুতে হয়। চণ্ডীদাসও বলেছেন সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। উত্তম প্রস্তাব। অবধূতও বলেছেন, এই বক্ষ্যমাণ নীলকণ্ঠেই– হিমালয়ের পথ ঘাট মঠ মন্দির নিয়ে বিস্তর লেখা হয়ে গেছে। সেইসব গ্রন্থ পাঠ করলে হিমালয় সম্বন্ধে জানতে বাকি থাকে না কিছুই। সুতরাং আর একবার হিমালয়ের পরিচয় দিয়ে লাভ কী! তার চেয়ে হিমালয়ের মানুষদের সম্বন্ধে কিছু বলে নিই আমি। অনেকের কাছে হিমালয়ের সব থেকে বড় আকর্ষণ হিমালয়বাসী সন্ন্যাসীরা। আমি চেষ্টা করছি এই সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে কিছু জানতে। (কারণ) অনেকের কাছে সন্ন্যাসীরা পরম পবিত্র রহস্যময় জীববিশেষ।* (এর পর অবধূত আরও তিনটি শব্দ দিয়ে একটি বাক্য রচনা করে মনে মনে প্রশ্ন শুধিয়েছেন বা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কিংবা উভয়ই, কিন্তু সে-প্রশ্ন, সে বিস্ময় নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছেন বটে, কিন্তু তাঁর মতো ভাষার জউরি প্রথম যে একটি শব্দ ব্যবহার করেছেন ওই দিয়েই তিনি কর্ম সমাধান করতে পারতেন, অথচ কেদার দ্রীর পথে গঙ্গা যমুনার এমনই হুহুঙ্কার যে নিদেন তিনটি বার চিৎকার না করলে মানুষ নিজের গলা নিজেই শুনতে পায় না)।

[*শ্রীশ্রীঠাকুরকে অবধূত সাতিশয় শ্রদ্ধা করেন, এ-কথা আমরা জানি কিন্তু ক্ষণে বিশ্বাসী, ক্ষণে agnositic ক্ষণে nihilist, ক্ষণে কী, ক্ষণে কী না– মা কালীই জানেন এই লোকটির ধোকা যায় না, ঠাকুরের সর্বনীতি বাবদে। বলছেন, শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন, সব মতই মত সব পথই পথ। বিদুর বাবার পথটা কী জাতের পথ তা আমি দেখেছি। ও-পথে ভগবানকে পাওয়া যায় না, শয়তানকে পাওয়া যেতে পারে! নীলকণ্ঠে পৃ. ১৬৯/৭০।]

ফারসিতে একটি দোঁহা আছে :

কুনদ হম জিনস্ বৃহস্ পরওয়াজ
কবুতর ব কবুতর বাজ ব বাজ।

The same with same shall take its flight
The dove with dove and kite with kite

স্বজাতির সনে স্বজাতি উড়িবে মিলিত হয়ে
পায়রার সাথে পায়রা; শিকরে শিকরে লয়ে।

অতএব হিমালয়ের হোক বা পৃথিবীর অন্য যে কোনও স্থলেরই হোক, সাধু-সন্ন্যাসীদের চিনতে হলে তাদেরই একজন হতে হয়। অবধূত এ বাবদে তার একাধিক গ্রন্থে এ তত্ত্বটির উল্লেখ করেছেন। এই সর্বজনীন গণতন্ত্র আমাকেও আনন্দ দেয়। লন্ডনের এক প্রাতঃস্মরণীয়া সমাজসংস্কারিকা নারী যখন দেখলেন যে, পতিতাদের জন্য তিনি কোনও সেবাই করে উঠতে পারছেন না, তখন তিনি তাদেরই সমাজে প্রবেশ করলেন। (আশা করি কেউ অন্যায় সন্দেহ করবেন না, যে আমি সাধুসন্ন্যাসী, পীর-দরবেশ ও পতিতাদের একপর্যায়ে ফেলছি। এই অধমের পরিবারের মাত্র শতবর্ষ পূর্বেও রীতি ছিল যে সর্বকনিষ্ঠকে সন্ন্যাস গ্রহণ করে বনে চলে যেতে হত)। মহিলাটি শেষ পর্যন্ত সেখানে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার পর সে-সমাজ ত্যাগ করে যে গ্রন্থ রচনা করেন সেটি অতুলনীয়, অমূল্য।

অবধূত মৌনব্রত, অজগরব্রত, পনছিব্রত* সবই করলেন।

[*অজগর আহার সংগ্রহের জন্য কোনও প্রচেষ্টাই করে না– এর বিরুদ্ধ মতবাদ আমি দক্ষিণ ভারতে শুনেছি। একাধিক গুণী বলেন, সে নাকি বড় মধুর শিষ দিয়ে পশুশাবক, এমনকি অত্যধিক কৌতূহলী বালকবালিকাকে আকর্ষণ করতে পারে।]

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার ব্যামো সঠিক চিনতে পারলেন প্রজ্ঞানাথ। সার্থক তার নাম। প্রজ্ঞাবলে বলে দিলেন তোমার পথ আলাদা। হয় তুমি নিশ্চিত হয়ে ঘুমিয়ে থাকবে, নয়তো ছুটে বেড়াবে। আর যোগাভ্যাস বাবদে বললেন, তোমার জন্য ওই নাক-টেপাটেপি নয়, তোমার ধাতে সইবে না। দূর ছাই বলে ফেলে দিয়ে আবার ছুটে বেড়াবে।

সেই ভালো। নইলে তার অবস্থা বিশ্বকবি বর্ণিতঘোড়ার মতো হয়ে যেত। অন্য সকল প্রাণী কারণ উপস্থিত হলে দৌড়ায়; এ দৌড়ায় বিনা কারণে, যেন তার নিজেরই নিজের কাছ থেকে পালিয়ে যাবার একান্ত শখ। পালাতে পালাতে একেবারে বুঁদ হয়ে যাবে, ঝিম হয়ে যাবে, ভোঁ হয়ে যাবে, তার পর ‘না’ হয়ে যাবে।

‘না’ হয়ে গেলে (নতুং, নাহং, নায়ং লোকঃ) নীলকণ্ঠ লিখত কে!

 কিন্তু আমরা ভুল করছি না তো?

স্পষ্ট দেখতে পারছি তিনটি অবধূত। যে অবধূতকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি, যে অবধূত বই লেখেন এবং যে অবধূত লাষ্ট্রর মতো চক্কর খায়। তিন জনাই কি একই ব্যক্তি? নিশ্চয়ই নয়। অন্তত তৃতীয় অবধূতকে দ্বিতীয় অবধূতের সঙ্গে গোবলেট করলে দু জনারই প্রতি ডাহা অবিচার করা হবে। বহু সার্থক লেখক প্রথম পুরুষে রসসৃষ্টি করেছেন; তাই বলে কি লেখক ও তাঁরআমি চরিত্র একই ব্যক্তি? ডি ফো আর রবিনসন, সুইফট আর গালিভার কি একই ব্যক্তি? এমনকি এই নীলকণ্ঠেই তিনি যে একাধিকবার আত্মচিন্তা করতে করতে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন সে পরিচয়ের সঙ্গে লেখক অবধূতের কি সবসময় মিল আছে?

বিশেষ করে আমি একটি বিষয়ের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ফারসি অলঙ্কারশাস্ত্রে আছে– সার্থক রস-সৃষ্টি করতে হলে চাই শনাখৃত-ই-হদ্দ-হচি। অর্থাৎ শনাক্ত করতে পারা (শনাখৃত) প্রত্যেক বস্তুর (হচিজ) সীমা (হদ্দ)* তার বিগলিতাৰ্থ; প্রচণ্ডতম আত্মসংযম। বার বার ভুলে যাই আমরা সব কিছু বলতে গেলে কিছুই বলা হয় না; বার বার প্রলোভন** আসে, আরও একটুখানি বলে নিই; তা হলে কেচ্ছাটার আরও জেল্লাই বাড়বে। শৈলী ভাষা বাবদে পার্ফেক্ট আর্টিস্ট হাইনে পর্যন্ত প্রথম যৌবনে এ-প্রলোভন থেকে মুক্ত ছিলেন না। তিনি তাঁর শুরু, সংস্কৃতে সুপণ্ডিত, আলঙ্কারিক বারন (ব্যারন্) ফন্ শ্লেগেলের কাছে তার প্রথম কবিতাগুচ্ছ নিয়ে গেলে তিনি বলেছিলেন, এ কী! তোমার বল্লভার গালে অতগুলো তিল দিয়েছ কেন? হায়, আমরা বার বার হদ্দ শনাক্ত করতে পারিনে, ভাবি তিল যখন সৌন্দর্য বৃদ্ধি*** করে তখন এঁকে দিই মানসসুন্দরীর গণ্ডদেশে গণ্ডাদশেক তিল!

[*রসের সৃষ্টিতে সর্বত্রই অত্যুক্তির স্থান আছে, কিন্তু সে অত্যুক্তিও জীবনের পরিমাণ রক্ষা করে তবে নিষ্কৃতি পায়। রবীন্দ্রনাথ, রচনাবলী, ২৭ খণ্ড, পৃ. ২৮৪। পুনরায়, প্রাণের ধর্ম সুমিতি, আর্টের ধর্মও তাই। সমপুস্তক, পৃ. ২৬০।

** লোভ পরিমিতিকে লঙ্ঘন করে, আপন আতিশয্যের সীমা দেখতে পায় না। পৃ. ২৬০।

*** হে শিরাজী, হে সুন্দরী, হে তরুণী সাকী/এমনই হৃদয় মুগ্ধ করিয়াছ তুমি।
তব কপোলের ঐ ক্ষুদ্র তিল লাগি/বোখারা সমরকন্দ দিতে পারি আমি।]

পূর্বে লিখিত কোনও কোনও অনবদ্য গ্রন্থেও অবধূত মাঝে-মধ্যে ভুলে যেতেনস্ট ইটিং হোয়াইল ইট ইজ টেস্টিং!- অর্থাৎ খাঁটি বাঙালির কৃত্রিম উচ্ছ্বাস থেকে তিনি সবসময় নিজেকে মুক্ত রাখতে পারেননি– বস্তুত তাঁর সবচেয়ে মশহুর কেতাবেই সবচেয়ে বেশি চন্দ্রশেখরীয় উদ্ভ্রান্ত উচ্ছ্বাস–কিন্তু নীলকণ্ঠে তিনি যে পার্ফেক্ট ক্যাডেনস্ অব্‌ রেস্ট্রেনস দেখিয়েছেন, সেটি আজকের দিনের কোনও বাঙালি লেখকই দেখাতে পারবেন না। এবং এই হদ্দ শনাক্ত করাটা তিনি নীলকণ্ঠে করেছেন অবহেলে, অক্লেশে। যেন ভানুমতী কড়ে আঙুল দিয়ে লৌহ ত্রিপিটক অদৃশ্য করে দিলেন– ছাতি না ফুলিয়ে, মাসল না বাগিয়ে, ঘেমে নেয়ে কাঁই হয়ে। এই এফর্টলেসনেস পৃথিবীর সর্বকর্মক্ষেত্রেই চরমতম কাম্য।

হেঁটমুণ্ডে শূন্যে ঝুলে আছেন যোগীবর, আরেক উলঙ্গ যোগী গড়াগড়ি দিচ্ছেন বরফের উপর, নায়ক স্বয়ং পেরিয়ে গেলেন মারাত্মক ধস, তার পর সেই স্বর্গীয় সঙ্গীত পাঠক সর্বক্ষণ শুধোচ্ছে কী করে হল, তার পর কী হল? নো রিপ্লাই? সে কি মিসি বাবা! এমনকি কলির কেষ্ট ঠাকুর– অ! কন্ কী করতা? আমাগো লাঙ্গুলবারিয়ায় জিতেন সাধুর নামডাও শোনেন নাই কানে পোড়াকপাল–বসমতী যশোবতী গুজরাতি (জাতে পরেখ—বাংলা পরখ, পরশপাথর থেকে ঠিক পরখ করে চিনে নিয়েছে সচ্চা মাল) ফরাসিতে যাদের বলেভোরাইওর এস্থলেমাজোকিট ভোয়াইওর–* একমাত্র প্যারিসেই যাঁরা অজ্ঞাতবাসে ঘাপটি মেরে থাকেন, তাদেরই এক মহাপ্রভু দৈবযোগে হয়ে গেছেন নীলকণ্ঠে এসে মঠের মোহান্ত– ইনিই তা হলে নীলকণ্ঠের নীল গরল এবং গণ্ডায় গণ্ডায় কত সাধু কত চোট্টা কত সাধারণ জন, কত মাছি কত পিসু। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে স্পর্শ করেছে কেদারনাথ দর্শনাভিলাষিনী পুণ্যশীলা মেমসায়েব জুলি আর তার স্বামী এডেন্। আমি হিন্দু নই, কেদারবদ্রী দর্শন করলে আমার অশেষ পুণ্য হবে, এ-ফতোয়া আমার তরে নয়, কিন্তু মনে করুন, আমি যদি কেদার যাবার জন্য স্বপ্নদেশ পাই, আর ত্রিযুগীনারায়ণ পেরিয়ে গৌরীকুণ্ডে পৌঁছনো মাত্রই ঝাড়া তিন দিন ধরে চলে ঝড়, বজ্রপাত– তাঁবু পর্যন্ত উড়ে চলে যায় হাজার হাজার দৈত্য রে-রে করে চতুর্দিক থেকে ছুটে আসছে যেন-কী! বিধর্মী চলেছে মহামহিম (লর্ড)** কেদারনাথকে দর্শন করতে, এতখানি স্পর্ধা বুঝি নীলকণ্ঠের সহ্য হচ্ছে না।– এবং সর্বশেষেবিরাট এক ধস্ নেমে কেদারনাথের তিন মাইল আগের রামওয়াড়া চটি লোপাট করে নিয়ে গিয়েছে– তখন আমার মনের অবস্থা কী হয়! বেচারি বিদেশিনী যবনী মেমসায়েব জুলির জীবনে এই দুর্দৈবই ঘটেছিল। একেবারে মুষড়ে গিয়ে ভেঙে পড়ে স্বামীকে বললে, চলো ফিরে যাই। তার স্বামী অবধূতকে বলছেন, জুলি মনে করছে, লর্ড কেদারনাথকে দর্শন করতে হলে যতটা পবিত্র হওয়া উচিত, ততটা পবিত্র আমি (স্বামী) নই।

[*সব দেশেই এক রকম লোক আছে যারা পাপাচারের এমনকি অনৈসর্গিক পাপাচারের নিষ্ক্রিয় দর্শকরূপে আপন কাম চরিতার্থ করে। ফরাসিতেদেখা=ভোয়ার, দর্শকভোয়াইওর (আমরা দৃশ থেকেদ্রষ্টা, ইংরেজ to see থেকে seer ভবিষ্যদ্রষ্টা মুনি ঋষির জন্য ব্যবহার করি, ফরাসিতেও সেরকমভোয়ার থেকেভোয়াইওর সদর্থে ব্যবহার হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয়নি– সেখানে Vovant = ভূতভবিষ্যৎ দ্রষ্টা এবং Clairvoyant=clear-seer সমস্যাটিও আমরা চিনি। ফরাসি ভাষায় বাঙালি পড়ুয়া যেন দুম্ করে কোনও ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা মহাজনকেভোরাইওর না বলে বসে! Romain Rolland, on, Cest un grand voyeur! বলে এক গুজরাতি নিরীহ সজ্জন প্যারিসের ফরাসি সমাজকে প্রথমটায় স্তম্ভিত করে দেন। পরে তারা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঠাঠা করে অট্টহাস্য তোলেন এবং এই সম্প্রদায়ের কামনা–শব্দার্থে– পূর্ণ করার জন্য প্যারিসের অন্ধকার অংশে প্রচুর প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু টিকিট এতই আক্রা যে অধীন সরেজমিন তদন্ত করতে পারেনি। এদের অন্যতম প্রোগ্রামে একজন আরেকজনকে বেধড়ক চাবুকও কষায়, পেরেকওয়ালা জুতো দিয়ে লাথি মারে, এবং নানাবিধ দুঃসহ যন্ত্রণা দেয়। এর গাহককে মাজাকিসই ভোয়াইওর বলা হয় এবং একদা আরব ছোঁড়ারা প্রোগ্রামে প্রধান অংশ নিত বলে হয়তো ভোয়াইয়ু শব্দের অর্থ– স্ট্রিট আরব।

**লর্ড কেদারনাথ সম্বন্ধে আমার এক মুখুজ্যে ভাতিজাও লেখে ঠাকুর দেখতে তেমন কিছু না, কিন্তু সন্ধেবেলায় যখন ডিনারের ইভনিং জ্যাকেটটি পরেন তখন বড্ডই মাইডিয়ার দেখায়। তবে কেদার না হয়ে ইনি পথমধ্যের অন্য কোনও লর্ডও হতে পারেন। ]

কেদারবদ্রী-গামীর কাফেলা তো চোখের সামনে দিয়ে যাচ্ছেই– তার এবং মানসাদি বহু তীর্থযাত্রীর বর্ণনা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দিয়েছেননীলকণ্ঠের বহু বহু পূর্বের বিস্তরজরিন-কলম বাঙালি, ইংরেজি, জর্মন, ইতালিয়ান ইত্যাদি লেখক আপন আপন মাতৃভাষায় কিন্তু নীলকণ্ঠে চলেছে অবধূতের বাছাই করা আরেকটি চরিত্রের কাফেলা, হেঁটমুণ্ড সাধক, যশোমতী, মেমসায়েব যাদের কয়েকজনের উল্লেখ এইমাত্র করেছি; কিন্তু হায়, অবধূত, রসসৃষ্টিতে হদ্দ কোথায় সেটা শনাক্ত করে ফেলেছেন এবং আমাদের কৌতূহল যখন চরমে পৌঁছায়, আমরা কলরব তুলে শুধধাই, এটা কী করে হল? তার পর কী হল? তখন তিনি মৃদু হাস্য করে স্টপস্ ইটিং বিকজ ইট ইজ টেস্টিং। মাথা চাপড়ে বলতে ইচ্ছে করেপোড়া কপাল আমাগো। লাঙ্গুলবারিয়ার জীতেন সাধুর লগে লগে আর বেবাকগুলির নামডাক ভি ভালো কইরা বুঝাইয়া কইলা না, কতা!

কটাক্ষ করা এ-পাঠকের উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে, কবিগুরু কি ক্লেরভইয়াসের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন যে, তাঁর পরিনির্বাণের স্বল্পকাল মধ্যেই এই গৌড়ভূমিতে তিন-তিন হাজারি পাঁচ-পাঁচ হাজারি পাতার মনসব নিয়ে পিলপিল করে বেরুবেন উপন্যাসের আমীর-ওমরাহ-কেতাব নয়, পুঁথি নয়, আস্ত এক-একখানা ইটের থান, না তারই পাঁজা হাতে নিয়ে এবং এদেরই উদ্দেশে বলেছিলেন মানবের প্রাণের লয়টাকে দানবের লয়ে সাধনা করা চলছে। কিছুতেই তাল পৌঁছচ্ছে না শমে।* অবধূত শমে পৌঁছতে জানেন। তিনি-নিজেই এক জায়গায় আধারহস্যছলে বলেছেন- কারণ সোজাসুজি ধর্মোপদেশ তিনি দেন না, নীতিও প্রচার করেন না- সাক্ষাৎ অমৃত কি না! খাঁটি অমৃত কি আর তাড়ির মতো ভাঁড় ভাড় খেতে হয়? কারণ এর হদিস্-সবুত রয়েছে তাঁর, আমার, আপনার গুরু রচিত পাতঞ্জলের যোগসূত্রের ন্যায়সাহিত্যের সূত্রাবলিতে : উপকরণের বাহাদুরি তার বহুলতায় অমৃতের সার্থকতা তার অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্যে। আর্টেরও অমৃত আপন সুপরিমিত সামঞ্জস্য।** এ তত্ত্বটি বুঝে নিলে অবধূতের বাংযম পাঠককে গভীরতম আনন্দ দেবে– আপনা কল্পনাজাল বোনার পথ দেখিয়ে দেবে।

[*,** রবীন্দ্রনাথ, সমগ্রন্থ]

এ-বাবদে শেষ প্রশ্ন : নীলকণ্ঠে তথাকথিত অলৌকিক কারখানা, ধর্মের নামে নিকৃষ্টতম পাপাচার, লাঙ্গুলবারিয়ার জীতেন সাধুর পন্থা, মাজোকিস্ট ভোয়াইওর বিদুর বাবার পন্থা পাতার পর পাতায় প্রাচীন নবীন একটার পর আরেকটা সমস্যা যেন পান্ডোরার কৌটো থেকে বেরিয়ে ওই কালীকমলীচটির বেশুমার ছারপোকারই মতো– চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, এবং সর্বাপেক্ষা মহামোক্ষম সমস্যা যেটি স্বয়ং অবধূতই তুলেছেন তিনটি শব্দ দিয়ে, যদ্যপি একটিই যথেষ্ট হত (তাজ্জব মানতে হয়, লোকটা কী সরল, কীনাইফ এরকম সিংহের গহ্বরে মাথা গলায়!) এবং যার উল্লেখ আমি পূর্বেই করেছি সেটি আবার বলি– শোনা জিনিসই মানুষ ফের শুনতে চায় অনেকের কাছে সন্ন্যাসীরা হলেন পরম পবিত্র রহস্যময় জীববিশেষ। তার পর বলছেন, সত্যিই কি তাই! (তিনি অনায়াসে প্রথম শব্দটি মাত্র দিয়ে, তা-ও শেষেরইটি খারিজ করে দিয়ে লিখতে পারতেন, সত্যি!–কারণ ফারসিতে বলে দানিশমন এক ই ব্যস আস্ত বুদ্ধিমানের জন্য একটিমাত্র হরফই যথেষ্ট সমুচাল এন্তের (লজো) তফাজিল-ফজুল– বস্–এন্তের। কিন্তু আমার মতো অগা পাঠকও এন্তের। আমার মাথায় নিদেন তিনটে শব্দের তিনটে ডাঙশ মারলে তবে কি না একটা শব্দ মগজে সিঁধিয়ে ঘিলুর ঘিয়ে ভাজা হয়)।

সে-প্রশ্নের উত্তর? সে-সমস্যার সমাধান? এবং বাদবাকিগুলো?

এবার আর ফোনের মিসিবাবা না– এবারে উচ্চতর পর্যায়ে যাই। বিচারপতি পন্টিস পিলাটুসের (জেস্টিং পাইলেট) সওয়ালে খ্রিস্ট যখন বললেন, আমি এসেছি সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে। তখন পিলাটু শুধোলেনসত্য কী? হোয়াট ইজ টুথ? এবং খ্রিস্ট কোনও উত্তর দেবার পূর্বেই (উত্তর পাবেন কি না তার প্রতীক্ষা না করেই) কেউ কেউ বলেন, স্মিতহাস্য করে বিচারালয় ত্যাগ করলেন।*

[*আসলে পিলাটুস উচ্চশিক্ষিত খানদানি রোমবাসী, ইংরেজ ভাইসরয়দের মতো পরাধীন ইহুদিদের ওপর শাসন করতে এসেছেন জেরুজালেমে। তাবৎ গ্রিকদর্শন তার নখাগ্রদর্শনে এবং সোক্রাতেস যখন প্রশ্নে প্রশ্নে তথাকথিত পণ্ডিতজনকে না-জবাব করে দিতেন এবং পণ্ডিত শেষটায় বিভ্রান্ত হয়ে শুধাত, তা হলে তুমিই বল সত্য কী?–সোক্রাতেস তখন মৃদুহাস্য করে চলে যেতেন বা বলতেন আম্মা জানিনে! এ-সব তত্ত্ব পিলাটুস জানতেন, এবং আরও ভালো করেই জানতেন, ইহুদিদের ভিতর দর্শনের কোনও চর্চা নেই। তাই সত্য-এর স্বরূপ নির্ণয় তিনি রাসৃটিক, সরল-বিশ্বাসী খ্রিস্টের কাছ থেকে চাননি।]

এখানেও তাই। অবধূত শুধোচ্ছেন বা/এবং বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, সত্যি? এবং ওইখানেই দিলেন খতম করে। কিংবা মুলতুবি সিনে ডাইই। কেন?

আবার তা হলে গুরুপদপ্রান্তে বসি। তিনি প্রবলেম ও তস্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ, আকছারই দম্ভে প্রকম্পিত সলুশন্‌-বিজড়িত কাব্য উপন্যাসাদি সম্বন্ধে বলছেন, মেঘদূত কাব্য থেকে একটা তত্ত্ব বের করা যেতে পারে, আমিও এমন কাজ করেছি, কিন্তু সে তত্ত্ব অদৃশ্যভাবে গৌণ।… কাব্য হিসেবে কুমারসম্ভবের যেখানে থামা উচিত সেখানেই ও থেমে গেছে, কিন্তু লজিক হিসেবে প্রবলেম হিসেবে (আমার সমস্যা হিসেবে) ওখানে থামা চলে না। কার্তিক জনুগ্রহণের পর স্বর্গ উদ্ধার করলে তবেই প্রবলেমের শান্তি হয়। কিন্তু আর্টে দরকার নেই প্রবৃলেমকে ঠাণ্ডা করা, নিজের রূপটিকেই সম্পূর্ণ করা তার কাজ। প্রবলেমের গ্রন্থিমোচন ইটেলেটের বাহাদুরি, কিন্তু রূপকে সম্পূর্ণতা দেওয়া সৃষ্টিশক্তিমতী কল্পনার কাজ। আর্ট এই কল্পনার এলেকায় থাকে, লজিকের এলেকায় নয়।* অবধূত এ তত্ত্বটি হৃদয়ঙ্গম করেছেন। নীলকণ্ঠ তার প্রকৃষ্টতম নিদর্শন।

[*পুনরায় ইবসেনের নাটকগুলো তো একদিন কম আদর পায়নি, কিন্তু এখনই কি তার রঙ ফিকে হয়ে আসেনি?সাহিত্যের মাত্রা, সমগ্রন্থ পৃ. ২৬০।]

উত্তম গ্রন্থের চুম্বক দেওয়া, বিশ্লেষণ করা, তুলনাত্মক সাহিত্যের দৃষ্টিবিন্দু থেকে তাকে ওই জায়-এর আর পাঁচখানা বইয়ের সঙ্গে তুলনা করা নিষ্প্রয়োজন; পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় মাত্র। কিন্তু সে-পরিচয় দেওয়ার সময়েও লেখক অবধূতের সর্বকালীন ও আমার জানা মতে তাঁর সর্বাগ্রগণ্য গুণমুগ্ধ পাঠক হিসেবে– এ-পরিচিতি দেবার হক্ক আমার একান্ত, অন্তত সেই কারণেই অধমের মনে ধোকা লাগে, মিছরির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে তার সুতোটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি না তো? কে জানে, আমি যে-সূত্রটি ধরে এ-পরিচিতি পেশ করেছি সেটা অতি অবশ্য সূত্র বটে, কিন্তু হয়তো ওই মিছরির সুতোরই মতো! সুতো চিবিয়ে তো কোনও পাঠক মিছরির রস পাবেন না! সান্ত্বনা এইটুকু যে, বহুশত বছর ধরে অম্মদেশীয় আলঙ্কারিকমণ্ডলী কালিদাসের পরিচিতি দিতে গিয়ে লিখেছেন এবং সেটিকে অজরামর করার হেতু গদ্যে প্রকাশ না করে শ্লোকাংশে বেঁধেছেন, উপমা কালিদাসস্য। তাঁদের মতো অমুকের কাছে যাওপদলালিত্যের জন্য, অমুকের কাছে যাওঅর্থগৌরবের তরে– আর কালিদাস? ওহ্! তার উপমাটি উত্তম; এবং তাদের শেষ সুচিন্তিত আপ্তবাক্য, সর্বগুণসম্পন্ন কবি কিন্তু মাঘ! আজ আমরা জানি, সুদ্ধমাত্র তুলনার বাহাদুরি দেখিয়ে কেউ মহৎ কবি হতে পারেন না– উত্তম তুলনা দিতে পারা গুণটি অলঙ্কারশাস্ত্ৰপেটিকাসতি একটি নিরাড়ম্বর অলঙ্কার মাত্রই, এবং এ সাদামাটা তুলনা-অলঙ্কারের কথা দূরে থাক, সর্বোৎকৃষ্ট অলঙ্কার পরিয়েও কুরূপাকে সুরূপাতে পরিবর্তিত করা যায় না–কালিদাস ছিলেন সর্বগুণসম্পন্ন অলঙ্কারাতীত বিশ্বকর্মা, তুলনা-নির্মাণে দক্ষতা ছিল তাঁর সামান্যতম কৃতিত্ব।…তাই এ-স্থলে আমি যে পরিচিতি দিলুম সেটা হয়তো কালিদাসের বেলায় গোড়াতে যে-রকম হয়েছিল সেই রকম নিতান্তই আত্যন্তিক, ঐকান্তিক, অবান্তর, গুরুত্বহীন পরিচয়। কিন্তু ভরসা রাখি, কালিদাসের মতো বিশ্বকর্মা না হয়েও অবধূত ভবিষ্যতে একদিন কালিদাসের মতো সুবিচার পাবেন, কারণ ন্যায়াধীশ-মহাকালের সম্মুখে সবাই সমান।

মহাকালের দরবারে কালিদাস অবধূত বরাবর– এ কথাটা আমাকে পুনরায় বলতে হল। কারণ আমি জানি, একাধিক জন, এমনকি অবধূতের গুণী গাহকও ঈষৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধোবেন, আমি যে এক নিশ্বাসে চেখ, কালিদাস ইত্যাদি প্রাতঃস্মরণীয়দের সঙ্গে অবধূতের নামোচ্চারণ করি তার অর্থ কি এই যে, আমার মতে এঁরা সবাই সমগোত্রের! এর উত্তর যে কোনও অদ্য দিনের চোদ্দ ক্যারেটের আলঙ্কারিক, যে কোনও বটতলার চতুরানন চতুর-আনী মোক্তার চতুর্মুখে চতুর্ভদ্র সাফাই গাইতে পারবেন কিন্তু আমার এ সবেতে কোনও প্রয়োজন নেই। অধীনের নাক বরাবর অতিশয় সুচিন্তিত তথা অলঙ্কারশাস্ত্রসম্মত নিবেদন মাত্র একটি : অবধূত কেন, তার চেয়ে শতগুণে নিরেস কোনও কবিকেও যদি আজ অধিক পরিচয় করিয়ে দিতে চাই এবং প্রয়োজন-অনুরোধে তৃতীয় পক্ষের দোহাই কেটে তাকে/তাদেরকে আবাহন জানাতে হয়, তবে কি আমি বে-ওফ নাদানের মতো স্মরণ করব পাড়ার আকাট যেদো-মেদোকে? না, গঙ্গাস্বরূপা তৃতীয় কন্যা মাতা কুন্তীদেবীর অনুকরণে স্মরণ করব ধর্মরাজ, পবমেশ্বর, বাসবাধিপতিকে? কালিদাস, চেখফ, রবিকবিকে? না, বিবাহবাসরেরপ্রীতি-উপহার-রচক পোয়েট লরিয়েটকে, দাস্যমনোবৃত্তি-সঞ্জাত অধুনা-বিস্মৃত, ভি.আই.পি. কুলের চরম পদলেহনাবতার ভি.আই.পির ঘোষ কবিকে? অবশ্য, অতি অবশ্য, যদি অবধূত মহাকালের মোকদ্দমা হেরে যান (যদ্যপি আমার বিশ্বাস ধর্ম, বায়ু, ইন্দ্রকে সাক্ষীরূপে না ডেকে যেদো-মেদোকে ডাকলে মক্কেল অবধূত মোকদ্দমা তো হারবেনই, এস্তক সুপ্রিমকোর্টে আপিল করবার তরে সার্টিফিকেট অবধি পাবেন না!) তবে সম্পূর্ণ দোষ আমারই। আমি যে-কেস হাতে নিয়েছি সেটি মর্মান্তিক। কারণ অবধূত আমাকে বাংলা সাহিত্যের হট্টগোলের মাঝখানে তার নাম সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করার জন্যে মোক্তার পাকড়াননি। বস্তুত আমিই সম্পূর্ণ, স্বেচ্ছায়, আপন খুদ, খুশ-এখতেয়ারে, অবধূতের সত্য মূল্য নিরূপণার্থে, সাহিত্য আদালতের নিরপেক্ষ বন্ধু, আমিকু কুরিআত্রারূপে অবতীর্ণ হয়েছি। সে-স্থলে হয়তো অবধূত বাধা দিতে পারতেন কিন্তু তিনি এবাবদে সুবুদ্ধিমান বলে সাহিত্যিক, দেওয়ানি, ফৌজদারি সর্বআদালত এড়িয়ে চলেন। এটিএক্স পার্টি, এক-তরফা মোকদ্দমা।

কিন্তু আদালতের তুলনাটা কথায় কথায় উঠল। বঙ্কিমেররাজসিংহ, রবিকবিরযোগাযোগ কোনও আদালত বিচার করবে না। নীলকণ্ঠও কোনও এজলাসের সম্মুখে দাঁড়াবেন না!* সাহিত্যে সর্বকালের সর্বজনের সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক পাঠক স্বয়ং। আদালতের বাইরে আমিও নগণ্য পাঠক। সে কিরে আমি এ-প্রস্তাবনার প্রস্তাবনাতেই একাধিকবার কেটেছি। এবং আমি অতিবৃদ্ধ পাঠক বলে একাধিক নবীন পাঠক আমাকে শুধোবে,

নীলকণ্ঠ বইখানা ভালো?

অত্যুত্তম।

সর্বোত্তম?

এতাবৎ লিখিত বইয়ের মাঝে সর্বোত্তম, কিন্তু এ-কেতাব সর্বোত্তম হবে না, যদি ইটি সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে তাঁকে অনুপ্রেরণা না যোগায় যে এটাকেও পেরিয়ে গিয়ে তিনি আরও উত্তম কেতাব লিখতে পারেন।

[*বছর কয়েক পূর্বে কিন্তু রসসমুদ্রে এহেন একটা টর্নাডো-ম্যালস্ট্রোম হব-হচ্ছে–হচ্ছের পাঁয়তারা কষছিল এমন সময় জানিনে কার হুকুমে শেষ পর্যন্ত কিছুই হল না। রীতিমত বিল তৈরি হয়েছিল; ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা পুলিশ সায়েব স্থির করে দেবেন, কোন্ নাটক উত্তম, অভিনয় করা যেতে পারে!]

.

এবারে শেষ কথা।

চেনা বামুনের গলে পৈতা কেন মিছে?– ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি। অবধূতের গলায় আমি আবার পৈতে পরাতে যাচ্ছি কেন– বিশেষত তিনি যখন উক্তৃষ্ট রাঢ়ি ব্রাহ্মণ? কিন্তু তিনি যে গেরুয়া পরেন এবং যতদূর জানি, গেরুয়া পৈতে দুটো একসঙ্গে পরা নিষিদ্ধ। তবু যে আমি নবপরিচিতির এই পৈতেটি তার গণ্ডে জড়িয়ে দিচ্ছি তার কারণ তিনি মায়াজালে বন্ধ হয়ে কিছুদিন ধরে আমাদের সঙ্গে বাস করছেন তিনি যা করুন, করুন– আমাদের উচিত তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতি-পরিচিতির পৈতেটি তাঁর সামনে নিবেদন করা। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি আল্লার কসম খেয়ে বলতে পারি, ওই-পৈতেটিও ভস্ম করে তিনি একদিন অন্তর্ধান করবেন–নীলকণ্ঠের কণ্ঠে কিংবা ধূর্জটির জটায়। সেই পৈতেটি এই (এবং একমাত্র এই পৈতেটিই আমার চেনা এক নম্বরের অবধূত, দুই নম্বরের লেখক অবধূত ও তিন নম্বরের গ্রন্থেরআমি অবধূত তিনজনকেই একসঙ্গে পরানো যায়।

তিন অবধূতেরই বোধহয় সবচেয়ে প্রিয় শ্লোক–

ঘৃণা লজ্জা ভয়ং শোকো জুগুপ্সা চেতি পঞ্চমী।
কুলং শীলং তথা জাতিরষ্টো পাশাঃ প্রকীর্তিতাঃ ॥

 ঘৃণা, লজ্জা, ভয়, শোক, নিন্দা করার প্রবৃত্তি, কুল, শীল তথা জাতের বড়াই– এসব থেকে মুক্ত হতে হবে। অত্যুত্তম প্রস্তাব। তাই নীলকণ্ঠে দেখতে পাই, খেতে না পেয়েও তার কষ্ট হচ্ছে না দেখে তিনি উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করছেন- সন্ন্যাসীবর ক্ষুধা জয় করে ফেলেছেন!– পরক্ষণেই আনগ্ন গাত্রে বরফে গড়াগড়ি দিলেও তাঁর শৈত্য বোধ হয় না দেখে তিনি তো সপ্তম স্বর্গে। নীলকণ্ঠের উচ্চতর স্তরে যে দুটি সাক্ষাৎ কৃতান্তদ্বয়, দারুণ অন্নাভাব ও নিদারুণ শৈত্য, এ দুটিই– নামে অবধূত এখন সিদ্ধিতে অবধূত– জয় করে ফেলেছেন! এবারে তিনি টেলিফোন খুঁজছেন, লর্ড কেদারনাথের সঙ্গে একটা রাঁদেভু স্থির করে তাঁর সঙ্গে শেকহ্যান্ড করবেন বলে!

আর লজ্জা ঘৃণা ভয় ইত্যাদি সে তো অবধূত কবে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন– পুস্তকে বিনয়বশত যা বলুক বলুক। আমি পুনরায় এক কোমর গঙ্গাজলে দাঁড়িয়ে পৈতে স্পর্শ করে পাঁচপীরের কসম খেতে রাজি আছি।

কিন্তু হায়, অবধূত এ-পৃথিবীতে এসেছেন অশুভক্ষণে। তাঁর নির্ঘণ্ট দীর্ঘ, তিনি কোন্ কোন পাশ হতে মুক্ত হতে চান, তিনি কোন কোন রিপু জয় করতে চান! অনেকগুলি জয় করতে করতে তো উঠছেন তিনি ঊর্ধ্ব থেকে ঊতর লোকে– চিত্তলোক এবং ইহলোক উভয়েতেই পৌঁছেই গেছেন গরুড়চটি। সম্মুখে আর চড়াই নেই- কেদার ক্রোশমাত্র দূরে। অবধূত নিশ্চিন্ত মনে নিদ্রা দিলেন। কিন্তু, হা-হতোস্মি, সকালে দেখেন এ কী! রাতারাতি হড়হড়িয়ে নেবে গেছেন যাত্রারম্ভস্থল দেবপ্রয়াগে!… আবার আরম্ভ হল নতুন করে রিপুজয় চিত্তজয় অজগর-পন্থা পঞ্ছী-পন্থা মারফত, আরোহণ করলেন না জানি আরও কত উচ্চ ভূমিতে। এবারে রাতারাতি হড়হড়িয়ে চুড়োয়–হ্যাঁ, আমাদের এই কুঁচড়োয়!

কেন? কেন এ-দুর্দৈব?

আমার দৃঢ় বিশ্বাস অবশ্য অবধূত এবং বাঙালি পাঠক আমার সঙ্গে একমত না হলে আমি বিস্মিত হব না– তিন অবধূতে একজোটে যে-সব পাশ ছিন্ন করার মতলব নিয়ে সেগুলোর নির্ঘণ্ট নির্মাণ করেন তখন একটি পাশের কথা বেবাক ভুলে গিয়েছিলেন। সেটি কী?

ইংরেজিতে বলে milk of human kindness। দুঃখীর প্রতি দরদ, অপমানিতের প্রতি সহানুভূতি, অত্যাচারীর প্রতি প্রকাণ্ড আক্রোশ (এমনিতে অবধূত রাগের পাশে বাঁধা পড়েন না)– এককথায় পীড়িত, বঞ্চিত, ধূলিলুণ্ঠিত জনের প্রতি ক্ষণে ক্ষণে তার বুক যেন বেদনাভরে, করুণাভারে ভেঙে পড়ে যেতে চায় (যে অবস্থায় পূর্ব বাংলার মেয়ে বলেছিল, ইচ্ছা করে, হৃদয়রে, গামছা দিয়া বান্ধি) কিন্তু থাক্‌, এটা গুছিয়ে বলবার মতো ভাষা আমার নেই।

এই মিলক্ অব হিউমেন কাইভনেসের পাশ সম্বন্ধে না তিনি সচেতন, না তিনি তপস্যা করেন সেটা ছিন্ন করতে! তবে কি মুক্তপুরুষের হৃদয়ে আমাদের মতো বন্ধুজনের প্রতি করুণাধারা প্রবাহিত হয় না? অবশ্যই হয়। লক্ষগুণ বেশি হয়। কিন্তু তার পূর্বে মুক্ত হওয়ার জন্য এ-পাশও ছিন্ন করতে হয়।

কিন্তু আমি নিরাশ হচ্ছিনে। এই নীলকণ্ঠ হিমালয়েই, এই পথ দিয়ে যাবার সময়ই ক্ষুদ্ৰহৃদয়দৌর্বল্যবশত (Milk of human kindness!) ধর্মপুত্র স্বেচ্ছায়-সঙ্গী সারমেয়টিকে ত্যাগ করতে সম্মত হননি। ধর্মরাজ তৎসত্ত্বেও তার জন্য স্বর্গদ্বার খুলে দেন। সেই ব্যত্যয় কি আবার হতে পারে? নীলকণ্ঠের উপাসক মাত্রই এর উত্তর দিতে ভয় পাবেন। আমি তার উপাসক নই। আমি নিরপেক্ষ তৃতীয়পক্ষ। আমি নির্ভয়ে বলব, এই ক্ষুদ্র হৃদয়-দৌর্বল্য হৃদয়ে ধারণ করেই অবধূত নীলকণ্ঠের হৃদয়ে স্থান পাবেন। কিন্তু খ্রিস্ট সাধুর স্মরণে বলি, মোক্ষ? মোক্ষ নিশ্চয়ই চাই, প্রভু, কিন্তু not just yet! অবধূতের মোক্ষটিও যেন বিলম্বে আসে। কারণ, পূর্বোক্ত খ্রিস্ট সাধু বলেছেন, তখন মুক্ত পুরুষ মৌন হয়ে যান। অবধূত পূর্ণ তিন বছর নীলকণ্ঠে মৌন্বতী ছিলেন আমাদের কোনও ক্ষতি হয়নি, কারণ তার পর তিনি বাংলা সাহিত্য-মজলিশে তাঁর সাধনার ধন সঙ্গীতে পরিবর্তিত করে গান গাইলেন এক যুগ ধরে।

এবারে মৌন হলে সাহিত্যের সাধারণ পাঠক, সাধারণ মানুষ বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ তিনিই গেয়েছেন

জয়, মানুষের জয়!

এই একটিমাত্র জয়ধ্বনি আছে দগ্ধপৃথ্বীতলে, যে জয়ধ্বনিতে কি হিন্দু কি মুসলমান, কি কৃষ্ণ কি শ্বেত সবমানুষ আত্মহারা হয়ে যোগ দেয় ॥

ঈদ দিবস, ১৩৭২
সৈয়দ মুজতবা আলী

[এই সুদীর্ঘ প্রবন্ধটি অবধূত বিরচিত নীলকণ্ঠ হিমালয় ভ্রমণকাহিনীর ভূমিকা।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *