পাঞ্জাব এবং বাংলা : ছাত্র এবং রাজনীতি
পাঞ্জাবি ছাত্ৰসম্মেলনের লাহোর অধিবেশনে ভাষণ, ১৯ অক্টোবর, ১৯২৯
পাঞ্জাবের ভগিনী এবং ভ্রাতাগণ,
পবিত্র ‘পঞ্চনদের দেশ’-এ আমার প্রথম আগমন উপলক্ষে আপনারা আমাকে যে উষ্ণ এবং আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়েছেন তার জন্য আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনারা অনুগ্রহ করে আমাকে যে সম্মান এবং অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, জানি আমি তার যোগ্য নই এবং আজ আমার একমাত্র বাসনা এই যে, যে দয়া এবং আতিথেয়তার সঙ্গে আমাকে এখানে অভ্যর্থনা করা হয়েছে, আমি যেন তার আর-কিছুটা যোগ্য হতে পারি।
আপনাদের কাছে কিছু বলতে সুদূর কলকাতা থেকে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আপনাদের ডাকে সাড়া দিতে আজ আমি প্রস্তুত হয়ে এখানে আপনাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এত লোক থাকতে আমাকে কেন ডেকেছেন? সে কি এই কারণে যে, নিজেদের সাধারণ সমস্যার সমাধান করতে পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমকে মিলিত হতেই হবে? সে কি এই কারণে যে, বাংলা, যে প্রথমে বিদেশীর পদানত হয়েছিল এবং পাঞ্জাব, যে সকলের শেষে পরাধীন হয়েছিল, পরস্পরের প্রয়োজন বোধ করছে? অথবা কারণটা কি এমন কিছু, যা আমার এবং আপনাদের উভয়ের মধ্যেই আছে—আমরা একই চিন্তাধারা এবং আকাঙক্ষার শরিক?
এবং অদৃষ্টের কী পরিহাস যে, লাহোরে ছাত্রদের এই সমাবেশে আপনারা আমাকে ডেকেছেন—যাকে অন্য এক বিশ্ববিদ্যালয় একদিন বহিষ্কার করেছিল? যদি আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা অভিযোগ করেন যে, বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, কারণ অদ্ভুত সব ব্যক্তি এবং নতুন সব ধ্যান-ধারণা জগতে জনপ্রিয় হচ্ছে, তা হলে কি আপনারা আপত্তি করতে পারেন? আমার অতীত ইতিহাস সম্পূর্ণরূপে জেনে যদি আপনারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন, তা হলে আমি কী বলতে যাচ্ছি তা সত্যিই আপনাদের অনুমান করতে পারা উচিত।
বন্ধুগণ, বাংলার যতীন্দ্রনাথ দাস এবং তাঁর সঙ্গে যাঁরা যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, তাঁরা যখন পাঞ্জাবের কারাগারে ছিলেন তখন পাঞ্জাব এবং বিশেষ করে পাঞ্জাবের যুবকরা তাঁদের জন্য যা করেছেন, তার জন্য আমি যদি প্রথমেই এই সুযোগে আমার হৃদয়ে যে কৃতজ্ঞ অনুভূতির সঞ্চার হচ্ছে, জনসমক্ষে তা প্রকাশ করি—যত ক্ষীণ কণ্ঠেই হোক না কেন—তা হলে আপনারা আমাকে মার্জনা করবেন। তাঁদের আত্মপক্ষ সমর্থনের ব্যবস্থা, যতদিন তাঁরা অনশন ধর্মঘট করছিলেন, ততদিন তাঁদের সম্পর্কে চূড়ান্ত উদ্বেগ এবং সহানুভূতি প্রদর্শন এবং যতীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় এবং পরবর্তীকালে তাঁর উপর বর্ষিত ভালবাসা এবং সম্মান বাংলার হৃদয়কে গভীরভাবে মথিত করেছে।
লাহোরে তাঁরা যা করেছিলেন তাতেই সন্তুষ্ট না থেকে ডিফেন্স কমিটির সদস্যগণ এই মহান শহিদের মরদেহাবশেষ বহন করে আমাদের হাতে তুলে দিতে কলকাতা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। আমরা ভাবপ্রবণ লোক এবং আপনাদের হৃদয়ের বিশালতা আমাদের কাছে আপনাদের যেভাবে আদরণীয় করেছে তা বর্ণনাতীত। বাংলার অন্ধকারতম দিনগুলির একটিতে বাংলার জন্য পাঞ্জাব যা করেছে তার জন্য বাংলা চিরদিন পাঞ্জাবকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে।
সেই মহান শহিদের উল্লেখ করতে গিয়ে আপনাদের এক বিশিষ্ট নেতা, ড. আলম, কলকাতায় আমাদের কাছে এক দিন বলছিলেন সূর্য কীভাবে পূর্ব দিকে উঠে পশ্চিমে অস্ত গিয়েছিল এবং সূর্যাস্তের পরে চন্দ্র কীভাবে পশ্চিমে উঠে পূর্বদিকে ফিরে এসেছিল। এইভাবেই যতীন্দ্রনাথ বেঁচে ছিলেন এবং এইভাবেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। জীবিতাবস্থায় তিনি কলকাতা থেকে লাহোরে গিয়েছিলেন এবং তাঁর নশ্বর দেহাবশেষ কলকাতায় ফিরে এসেছিল। তাঁর দেহাবশেষ নিষ্প্রাণ মৃত্তিকারূপে ফিরে এসেছিল, ফিরে এসেছিল পবিত্র, মহৎ এবং স্বর্গীয় কোনও বস্তুর প্রতীকরূপে। যতীন্দ্রনাথ আজ মৃত নন। তিনি পরম পবিত্র, প্রশান্ত এক বিকিরণকারী তারকারূপে স্বর্গে বিরাজিত, যার রশ্মি উত্তরপুরুষের ত্যাগে এবং তাঁর স্বর্গীয় কষ্টভোগে। তিনি বেঁচে আছেন এক স্বপ্ন হয়ে, আদর্শ হয়ে—মানুষের মধ্যে যা পবিত্রতম এবং মহত্তম তার প্রতীক হয়ে। এবং আমার বিশ্বাস এই যে, আত্মোৎসর্গের ভিতর দিয়ে তিনি কেবল ভারতের আত্মাকেই জাগ্রত করেননি, পরন্তু, তিনি যে-প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং যে-প্রদেশে দেহত্যাগ করেছিলেন সেই দুটি প্রদেশের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য গ্রন্থি রচনা করে গেছেন। তাই যে-নগর “তপস্যাক্ষেত্র” হয়েছে—এই আধুনিক “দধীচি”-র প্রায়শ্চিত্তের ক্ষেত্র হয়েছে, আপনাদের সেই মহান নগরকে আমি ঈর্ষা করি।
আমরা ক্রমশ স্বাধীনতার প্রভাতের দিকে যত এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের কৃচ্ছ্রসাধনার এবং দুঃখের পাত্র তত পূর্ণ হচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক যে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে অন্যান্য স্থানের স্বৈরাচারীদের মতো আমাদের শাসকরাও নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর হয়ে উঠবে। এবং তারা যদি ক্রমশ সভ্যতার সমস্ত ভান পরিত্যাগ করে বিনা বাধায় লৌহমুষ্ঠি ব্যবহার করতে শালীনতার মুখোশ খুলে ফেলে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এই মুহূর্তে পাঞ্জাব এবং বাংলা সর্বাপেক্ষা অধিকমাত্রায় নির্যাতন ভোগ করছে। ব্যাপারটা সত্যিই অভিনন্দনযোগ্য, কারণ এর ফলে আমরা স্বরাজের জন্য কার্যকরভাবে যোগ্যতা অর্জন করছি। নির্যাতন দ্বারা ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্তর মতো বীরদের আত্মাকে দমন করা যায় না। পক্ষান্তরে, এই ধরনের নির্যাতন, অপমান এবং দুঃখের ভিতর দিয়েই বীরের জন্ম হয়। অতএব আসুন, আমরা নির্যাতনকে সর্বান্তঃকরণে অভ্যর্থনা জানাই এবং নির্যাতন এলে আমরা তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করি। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে এবং পাঠকদের নৈতিক উন্নতি সাধন করতে বাংলা সাহিত্য পাঞ্জাবের প্রাচীন ইতিহাস থেকে কতটা গ্রহণ করেছে আপনারা তা জানেন না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সহ আমাদের মহান কবিরা আপনাদের বীরদের কাহিনী ভিত্তি করে কাব্য রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ এবং এই সব কবিদের কেউ কেউ আজ প্রতিটি বাঙালির ঘরে অতি পরিচিত। সুচারু বাংলায়, অনূদিত আমাদের সন্তদের বাণী লক্ষ লক্ষ বাঙালিকে সান্ত্বনা এবং অনুপ্রেরণা দেয়। কৃষ্টির ক্ষেত্রে এই যোগাযোগের অনুরূপ অবস্থা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও হয়েছে, এবং দেখতে পাচ্ছি আপনাদের রাজনৈতিক তীর্থযাত্রীরা আমাদের রাজনৈতিক তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে কেবলমাত্র ভারতবর্ষের কারাগারেই নয়, সদূর বর্মা এবং সমুদ্রের ওপারে সভ্যতাবর্জিত আন্দামানেও মিলিত হচ্ছেন।
বন্ধুগণ, আমি যদি এই আলোচনায় রাজনৈতিক প্রশ্নের উল্লেখ এবং তার জবাব দেবার চেষ্টা করি, তা হলে আমি দুঃখ প্রকাশ করব না। আমি জানি এই দেশে এমন অনেক লোক আছেন—এমন কি অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও—যাঁরা মনে করেন যে, “পরাধীন জাতির কোনও রাজনীতি নেই” এবং, বিশেষ করে, ছাত্রদের রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকা উচিত নয়। কিন্তু আমার নিজের অভিমত এই যে, পরাধীন জাতির রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নেই। একটি পরাধীন দেশে আপনি যে-সমস্যার কথাই ভাবুন, উপযুক্তরূপে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সমস্যাটি মূলত রাজনৈতিক। পরলোকগত দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের ভাষায় জীবন এক পরিপূর্ণ সত্তা—এবং তাই অর্থনীতি অথবা শিক্ষা থেকে রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন না। মানুষের জীবনকে খন্ড খণ্ড অংশে বিভক্ত করা যায় না। জাতীয় জীবনের সকল দিক অথবা পর্যায় পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং সকল সম্পর্ক যেন একত্রগ্রথিত। ব্যাপারটা যখন এই, দেখা যাবে যে পরাধীন জাতির মধ্যে সকল অশুভ এবং সকল ক্রটির মূলে আছে রাজনৈতিক কারণ—অর্থাৎ রাজনৈতিক দাসত্ব। ফলে আমাদের রাজনৈতিক মুক্তি কী করে অর্জন করতে হবে এই সবাধিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাটি সম্পর্কে ছাত্ররা অন্ধ হয়ে থাকতে পারে না।
সাধারণভাবে জাতীয় কাজকর্মের উপর যদি এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত না হয়, তবে রাজনীতিতে যোগদানের উপর বিশেষ এক নিষেধাজ্ঞা কেন আরোপ করা হবে আমি তা বুঝতে পারি না। সর্বপ্রকার জাতীয় কাজকর্মের উপর নিষেধাজ্ঞার অর্থ বুঝতে পারি, কিন্তু কেবলমাত্র রাজনৈতিক কাজকর্মের উপর নিষেধাজ্ঞা অর্থহীন। এই পরাধীন দেশে সব সমস্যাই যদি মূলত রাজনৈতিক সমস্যা হয়, তবে সমস্ত জাতীয় কাজকর্মই চরিত্রের দিক থেকে প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক। কোনও স্বাধীন দেশেই রাজনীতিতে যোগদানের উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই—পরন্তু, ছাত্রদের রাজনীতিতে যোগদানের উৎসাহ দেওয়া হয়। ভেবেচিন্তে এই উৎসাহ দেওয়া হয়, কারণ ছাত্রদের ভিতর থেকেই জন্ম নেয় রাজনৈতিক চিন্তাবিদ এবং রাজনীতিক। ভারতবর্ষে ছাত্ররা যদি রাজনীতিতে যোগ না দেয় তা হলে আমরা রাজনৈতিক কর্মী সংগ্রহ করব কোথা থেকে এবং তাঁদের প্রশিক্ষণ দেব কোথায়? অধিকন্তু, এ-কথা স্বীকার করতে হবে যে, চরিত্র এবং পৌরুষের বিকাশের জন্য রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কর্মহীন চিন্তা চরিত্রগঠনের পক্ষে যথেষ্ট নয় এবং এই কারণে চরিত্রের বিকাশের জন্য রাজনৈতিক, সামাজিক, শৈল্পিক ইত্যাদি স্বাস্থ্যকর কর্মে যোগ দেওয়া প্রয়োজন। গ্রন্থকীট, সুবর্ণপদকধারী এবং অফিসের করণিক উৎপাদনের প্রচেষ্টা করা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উচিত নয়—বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত চরিত্রবান মানুষ তৈরি করা, যাঁরা তাঁদের জাতির জন্য জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহত্ত্ব অর্জন করে মহৎ হবেন।
ভারতবর্ষের সর্বত্র প্রকৃত ছাত্র আন্দোলনের বৃদ্ধি বর্তমান সময়ের সর্বাপেক্ষা উৎসাহব্যঞ্জক লক্ষণসমূহের অন্যতম। আমি এই আন্দোলনকে বৃহত্তর যুব আন্দোলনের একটি পর্যায় বলে মনে করি। আজকের ছাত্ৰসম্মেলন এবং অতীতের ছাত্ৰসম্মেলনগুলির মধ্যে অনেক পার্থক্য। শেষোক্ত সম্মেলনগুলি সাধারণত অনুষ্ঠিত হত সরকারি উদ্যোগে এবং তার তোরণে দেখা যেত এই নীতিবাক্য—“তারা রাজনীতি সম্পর্কে কথা বলবে না”। এই সম্মেলনগুলি এক দিক থেকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসের প্রথম দিকের অধিবেশনগুলির সঙ্গে তুলনীয়, যেখানে প্রথম প্রস্তাব পাস করা হত সম্রাটের প্রতি আমাদের আনুগত্য ঘোষণা করে। সৌভাগ্যক্রমে শুধু ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ক্ষেত্রেই নয়, ছাত্র আন্দোলনের ক্ষেত্রেও আমরা সেই যুগ পেরিয়ে এসেছি। বর্তমান কালের ছাত্ৰসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় অধিকতর স্বাধীন পরিবেশে এবং তাতে যাঁরা যোগ দেন—তাঁরা, ভারতীয় দণ্ডবিধির বাধানিষেধ সাপেক্ষে, ইচ্ছানুযায়ী চিন্তা করতে এবং কথা বলতে পারেন।
এক অস্থিরতার অনুভূতি, বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অধৈর্য, এক নতুন এবং উন্নততর শাসন প্রবর্তনের বাসনা—বর্তমান যুব আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য। এক দায়িত্ববোধ এবং আত্মনির্ভরতার চেতনা এই আন্দোলনকে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছে। বর্তমান কালের যুবকরা আর বয়োজ্যেষ্ঠদের হাতে দায়িত্ব ন্যস্ত করে সন্তুষ্ট বোধ করেন না। তাঁরা বরং অনুভব করেন যে, দেশ এবং দেশের ভবিষ্যতের উপর পূর্ববর্তী প্রজন্ম অপেক্ষা তাঁদের অধিকারই বেশি এবং সেই কারণে দেশের ভবিষ্যতের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে গ্রহণের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করা তাঁদের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। ছাত্র আন্দোলন বৃহত্তর যুব আন্দোলনের একটি পর্ব বলে এই আন্দোলন যুব আন্দোলনের মতো একই দৃষ্টিভঙ্গি, মনস্তত্ত্ব এবং উদ্দেশ্য দ্বারা অনুপ্রাণিত।
যাঁরা একটি আদর্শে অনুপ্রাণিত—অর্থাৎ চরিত্র এবং ব্যক্তিত্বের বিকাশের দ্বারা সর্বাপেক্ষা কার্যকর এবং প্রয়োজনীয়ভাবে নিজের দেশের সেবা করতে চান—সেই সব দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, পরিণতবুদ্ধি পুরুষ এবং নারীর আন্দোলন আর আজকের ছাত্র আন্দোলন এক নয়। এই আন্দোলনের কার্যকলাপের দুটি ধারা আছে, অথবা থাকা উচিত। প্রথমত, এর কাজ হবে যে সকল সমস্যা কেবলমাত্র সম্পূর্ণরূপে ছাত্রসমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত সেগুলি নিয়ে কাজ করা এবং ছাত্রদের শারীরিক, বৌদ্ধিক এবং নৈতিক পুনরুজ্জীবন ঘটানোর প্রয়াস করা। দ্বিতীয়ত, ছাত্রদের ভবিষ্যৎ নাগরিকরূপে বিবেচনা করে জীবনসংগ্রামের জন্য তাঁদের প্রস্তুত করে তোলার প্রয়াস করা, এবং এই উদ্দেশ্যে জীবনের রঙ্গভূমিতে প্রবেশ করে তাঁদের যেসব সমস্যা এবং কার্যকলাপের সম্মুখীন হতে হবে তার পূর্বাস্বাদন করানো।
ছাত্র আন্দোলনের প্রথম দিকটি, আমি এইমাত্র যার উল্লেখ করলাম, সাধারণ অবস্থায় বর্তমান শাসকদের অসন্তোষের কারণ নাও হতে পারে। কিন্তু আন্দোলনের অপর দিকটি সম্ভবত নিরুৎসাহিত, নিন্দিত এমন কি কখনও কখনও বাধাপ্রাপ্ত হবে। প্রথম ধারায় আপনারা কোন কাজ হাতে নেবেন তার বিস্তৃত কর্মসূচী প্রদানের প্রচেষ্টা আমার পক্ষে বাঞ্ছনীয়ও নয়, প্রয়োজনীয়ও নয়। এটা আংশিকভাবে আপনাদের বিশেষ প্রয়োজন এবং ত্রুটির উপর এবং অংশত ওই সব প্রয়োজন মেটাতে এবং ত্রুটি দূর করতে শিক্ষাবিষয়ক কর্তৃপক্ষ যে-ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তার উপর নির্ভর করে। প্রতিটি ছাত্রের প্রয়োজন এক সবল এবং সুস্থ শরীর, নিদোষ চরিত্র এবং প্রয়োজনীয় তথ্য এবং সুস্থ, প্রাণবন্ত কল্পনায় ভরা মস্তিষ্ক। কর্তৃপক্ষের অবলম্বিত ব্যবস্থা যদি শরীর, চরিত্র এবং মেধার যথাযথ বৃদ্ধির সহায়ক না হয়, তা হলে সেই বৃদ্ধি যাতে নিশ্চিত হয় তার সুযোগ আপনাদের করে দিতে হবে। এবং কর্তৃপক্ষ যদি এই কাজে আপনাদের প্রচেষ্টাকে অভ্যর্থনা জানান তা হলে আপনাদের পক্ষে সবচেয়ে ভাল হয়—কিন্তু তাঁরা যদি তা না করেন, তবে তাঁদের বাদ দিয়ে আপনারা নিজের পথে এগিয়ে যান। আপনাদের জীবন আপনাদের নিজেদের এবং, শত হলেও, এর বিকাশের দায়িত্ব অন্যের চেয়ে আপনাদের বেশি।
এই প্রসঙ্গে আমার একটি সুপারিশ সম্পর্কে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। আমি চাই সম্পূর্ণরূপে ছাত্রসমাজের সুবিধার জন্য ছাত্র সংগঠনগুলি নিজের নিজের এলাকায় সমবায় স্বদেশী ভাণ্ডার খুলুন। ছাত্ররা নিজেরা এই ভাণ্ডারগুলি দক্ষতার সঙ্গে চালাতে পারলে এর দ্বারা দ্বিবিধ কার্য সাধিত হবে। এক দিকে ছাত্রদের স্বদেশী দ্রব্য সস্তায় মিলবে এবং তার ফলে দেশীয় শিল্প প্রোৎসাহিত হবে। অপর দিকে, ছাত্ররা সমবায় ভাণ্ডার পরিচালনার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন এবং লাভের অর্থ ছাত্রসমাজের মঙ্গলের জন্য কাজে লাগাতে পারবেন। ছাত্রসমাজের মঙ্গলের কাজে অগ্রগতির জন্য আপনাদের কর্মসূচীতে অন্যান্য দফাগুলি হবে শরীরচর্চা সমিতি, ব্যায়ামাগার, পাঠচক্র, বিতর্ক সমিতি, সাময়িক পত্রিকা, সঙ্গীত সংঘ, পাঠাগার এবং পাঠগৃহ, সমাজসেবা সমিতি ইত্যাদি।
অপরটি এবং সম্ভবত ছাত্র আন্দোলনের অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল, ভবিষ্যৎ নাগরিকদের প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণ হবে বৌদ্ধিক এবং ব্যবহারিক উভয়বিধ। ছাত্রদের সামনে আমাদের আদর্শ সমাজের একটি স্বপ্ন তুলে ধরতে হবে, যে-স্বপ্নকে তাঁরা তাঁদের জীবদ্দশায় সার্থক করে তুলবার চেষ্টা করবেন। একই সঙ্গে তাঁরা নিজেদের জন্য এমন এক কর্মসূচী স্থির করবেন, যা অনুসরণ করতে তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন—যার ফলে ছাত্র হিসাবে তাঁদের কর্তব্য সম্পাদনের সঙ্গে-সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়োত্তর জীবিকার জন্য তাঁরা নিজেকে প্রস্তুত করবেন। ক্রিয়াকলাপের এই ক্ষেত্রেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁদের সংঘাতের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সংঘাত সত্যিই ঘটবে কিনা তার অনেকটাই নির্ভর করবে শিক্ষা সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের মনোভাবের উপর। দৃভাগ্যক্রমে সংঘাত যদি আসে তবে তার প্রতিকার নেই এবং ছাত্রদের চিন্তা এবং কর্মের ভিতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়োত্তর জীবিকার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্ভীক এবং আত্মনির্ভর হয়ে চিরতরে নিজেদের মনস্থির করতে হবে।
আমরা সকলে কী আদর্শ পোষণ করব, সেবিষয়ে আপনাদের জানাবার আগে আপনাদের অনুমতি নিয়ে আমি ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণ করব, যা আদৌ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এশিয়াকে ইউরোপীয়দের পদদলিত দেখে মনে বেদনা এবং অপমান সঞ্চারিত হয় না এমন কোনও এশিয়াবাসী আজ দূর্লভ। কিন্তু আমি চাই এশিয়া সর্বদাই এই অবস্থায় ছিল এমন ধারণা আপনারা চিরতরে মন থেকে মুছে ফেলুন। ইউরোপ আজ প্রভু হতে পারে, কিন্তু একদিন প্রভুত্ব ছিল এশিয়ার দখলে। ইতিহাস বলছে প্রাচীন কালে এশিয়া কীভাবে ইউরোপের এক বিরাট অংশ জয় করে তার অধিকারে রেখেছিল এবং তখন ইউরোপ এশিয়ার ভয়ে প্রচণ্ড ভীত ছিল। আজ চাকা ঘুরে গেছে কিন্তু ভাগ্যের চাকা এখনও ঘুরছে এবং হতাশার কোনও কারণ নেই। এশিয়া এই মুহুর্তে ক্রীতদাসত্বের জোয়াল ছুড়ে ফেলতে ব্যস্ত এবং সে দিন আর বেশি দূরে নেই যখন পুনর্যৌবনপ্রাপ্ত এশিয়া শক্তি এবং গৌরবে প্রদীপ্ত হয়ে অতীতের অন্ধকার থেকে মাথা তুলে দাঁড়াবে এবং স্বাধীন দেশের সভায় নিজের বৈধ স্থান অধিকার করবে। প্রতারক প্রতীচ্য কখনও কখনও অবিনশ্বর প্রাচ্যকে “স্থাণু” বলে দোষারোপ করে, যেমন তুরস্ককে এক সময় ইউরোপে “রুগ্ণ মানুষ” বলা হত। কিন্তু সাধারণভাবে এশিয়া এবং বিশেষ করে তুরস্ক সম্পর্কে এই দোষারোপ আর প্রযোজ্য নয়। জাপান থেকে তুরস্ক এবং সাইবেরিয়া থেকে সিংহল, সমগ্র প্রাচ্য আজ আন্দোলিত। সর্বত্রই পরিবর্তন হচ্ছে, অগ্রগতি হচ্ছে। কর্তৃত্ব, প্রথা এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছে। নিজে যতদিন চায় প্রাচ্য ততদিন অপরিবর্তনশীল থাকবে, কিন্তু একবার এগিয়ে যাবার সংকল্প গ্রহণ করলে সে এমন কি পাশ্চাত্য দেশগুলির চেয়েও দ্রুত গতিতে উন্নতি করতে পারবে। বর্তমান সময়ে এশিয়ায় এটাই ঘটছে।
মাঝে-মাঝে আমাদের প্রশ্ন করা হয়, এশিয়ায় এবং বিশেষ করে ভারতবর্ষে যে-কর্মকাণ্ড এবং আন্দোলন দেখা যায়, তা কি প্রকৃত জীবনের লক্ষণ, না নিতান্তই বাইরের কোনও উদ্দীপক বস্তুর প্রতিক্রিয়া এবং যে-আন্দোলন আমরা দেখি তা যে মৃত পেশির প্রতিবর্তী ক্রিয়া নয় সে-বিষয়ে আমাদের নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস এই যে, জীবনের প্রমাণ সৃজনশীল কর্মে এবং যখন আমরা দেখব বর্তমান আন্দোলন মৌলিকত্ব এবং সৃজনশীল প্রতিভার সাক্ষ্য দিচ্ছে তখন আমরা নিশ্চিত হব যে, জাতি হিসাবে আমরা সত্যই জীবিত। আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা যে-নবজাগরণ প্রত্যক্ষ করছি, তা খাঁটি অন্তরের জাগরণ।
বর্তমান ভারতে আমরা বিবিধ ভাবধারার আবর্তের মধ্যে রয়েছি। সকল দিক থেকে বিবিধ ভিন্নমুখী স্রোত বইছে। অদ্ভুত এক মিশ্রণ চলছে এবং বিবিধ প্রকার ভাবধারার এই বিভ্রান্তির মধ্যে ভাল এবং মন্দ, ন্যায় এবং অন্যায়ের পার্থক্য বোঝা সাধারণ লোকের পক্ষে সম্ভব নয়।
কিন্তু আমরা যদি দেশকে পুনর্যৌবন দিয়ে তাকে ঠিক পথে পরিচালিত করতে চাই, তা হলে লক্ষ্য সম্পর্কে এবং কোন পথে সেই লক্ষ্যে উপনীত হব সে সম্পর্কে অবশ্যই আমাদের স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
ভারতীয় সভ্যতা সবে অন্ধকার যুগ থেকে বেরিয়ে এসে এক নতুন জীবন শুরু করছে। ফোনেশিয়া এবং ব্যাবিলনের সভ্যতার মতো এই সভ্যতার মৃত্যু হবে কি না এক সময় প্রকৃতই সেই বিপদ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এই সভ্যতা পুনরায় কালের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করেছে। যে পুনর্যৌবন দানের কাজ শুরু হয়েছে তাকে যদি অক্ষুন্ন রাখতে চাই, তবে চিন্তার জগতে আমাদের ভাবাদর্শে বিপ্লব আনতে হবে এবং জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ঘটাতে হবে রক্তের মিশ্রণ। আমরা যদি ইতিহাসের রায় এবং স্যার ফ্লিন্ডার্স পেট্রিকের মতো চিন্তাবিদদের সুচিন্তিত অভিমত গ্রহণ করতে অস্বীকার না করি, তা হলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, কেবলমাত্র এই উপায়েই প্রাচীন এবং জীর্ণ সভ্যতাকে পুনর্যৌবন দেওয়া সম্ভব। আমার এই অভিমত আপনাদের নিকট গ্রাহ্য না হলে সভ্যতার উত্থান এবং পতনের পশ্চাতে যে-নিয়ম কাজ করছে নিজেরা অনুসন্ধান করে সেটি আপনাদের আবিষ্কার করতে হবে। একবার এই নিয়মটি আবিষ্কার করতে পারলে আমাদের এই প্রাচীন দেশে এক নতুন, স্বাস্থ্যকর এবং উন্নতিশীল জাতিগঠন করতে হলে আমাদের কী করা প্রয়োজন সে-সম্পর্কে আমাদের দেশবাসীকে পরামর্শ দিতে আমরা সক্ষম হব। ভাবনার রাজ্যে বিপ্লব আনতে হলে প্রথমে আমাদের সামনে এমন এক আদর্শ তুলে ধরতে হবে, যা আমাদের সমগ্র জীবন উদ্দীপ্ত করবে। সেই আদর্শ হল স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতা এমন একটি শব্দ যা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত, এবং এমন কি আমাদের দেশেও স্বাধীনতা সম্পর্কে ধারণা বিবর্তনের পথ পেরিয়ে এসেছে। স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি সার্বিক স্বাধীনতা—অথাৎ ব্যক্তির স্বাধীনতা এবং সেই সঙ্গে সমাজের স্বাধীনতা, পুরুষের এবং নারীর স্বাধীনতা, ধনীর স্বাধীনতা এবং দরিদ্রেরও স্বাধীনতা, প্রত্যেক ব্যক্তি এবং প্রত্যেক শ্রেণীর স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক দাসত্ব থেকে মুক্তি নয়, সেই সঙ্গে সম্পদের সমবন্টন, জাতিভেদ এবং সামাজিক অবিচার দূরীকরণ এবং সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ধ্বংস করা। কঠোরহৃদয় পুরুষ এবং নারীর কাছে এই আদর্শ অবাস্তব মনে হতে পারে, কিন্তু কেবলমাত্র এই আদর্শই আত্মার ক্ষুধা তৃপ্ত করতে পারে।
আমাদের জাতীয় জীবনের যতগুলি অবস্থা আছে স্বাধীনতারও আছে ততগুলি দিক। এমন সব ব্যক্তি আছেন যাঁরা স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে, শুধু স্বাধীনতার বিশেষ কয়েকটি দিকের কথা ভাবেন। স্বাধীনতা সম্পর্কে এই সংকীর্ণ ধারণা অতিক্রম করে স্বাধীনতার পরিপূর্ণ এবং সার্বিক রূপটি হৃদয়ঙ্গম করতে আমাদের কয়েক দশক লেগেছে। আমরা যদি স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বাধীনতাকে ভাল না বেসে প্রকৃতই স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতাকে ভালবাসি, তা হলে একথা অনুধাবনের সময় এসেছে যে, প্রকৃত স্বাধীনতার অর্থ সকল প্রকার দাসত্ব থেকে মুক্তি এবং শুধু ব্যক্তিবিশেষের মুক্তি নয়—সমগ্র সমাজের মুক্তি। আমার কাছে এটিই এই যুগের আদর্শ এবং যে-স্বপ্ন আমার আত্মাকে অধিকার করেছে, তা হল সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং বন্ধনমুক্ত ভারতবর্ষের স্বপ্ন।
আমাদের কাছে স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র উপায় স্বাধীন মানুষ হিসাবে চিন্তা করা এবং অনুভব করা। আমাদের অন্তরে পরিপূর্ণ বিপ্লব আসুক এবং আমরা স্বাধীনতার আসরে সম্পূর্ণরূপে মত্ত হয়ে উঠি। কেবলমাত্র স্বাধীনতায় উন্মত্ত নারী-পুরুষরাই মানবসমাজকে মুক্ত করতে সক্ষম হবে। আমাদের ভিতরে ‘স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছা’ যখন জাগ্রত হবে, তখন আমরা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কর্মসমুদ্রে ঝাঁপ দিতে এগিয়ে যাব। সতর্কবাণী আর আমাদের বাধা দেবে না এবং সত্য ও গৌরবের হাতছানি আমাদের ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে।
বন্ধুগণ, আমার ভাবনা, অনুভূতি, জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে স্বপ্ন এবং বর্তমানে আমার সমস্ত কর্মের পিছনে চালকশক্তি সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলবার চেষ্টা করেছি। এর প্রতি আপনারা আকৃষ্ট হবেন কি না তা জানি না। কিন্তু আমার কাছে একটি জিনিস সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট—জীবনের শুধু একটিই উদ্দেশ্য, আর তা হল সকল প্রকার দাসত্ব থেকে মুক্তি। স্বাধীনতার ক্ষুধা আত্মার সঙ্গীত—এবং নবজাত শিশুর প্রথম ক্রন্দন সেই বন্ধনের বিরুদ্ধে, যে বন্ধনে সে নিজেকে আবদ্ধ দেখতে পায়। আপনারা নিজেদের এবং দেশবাসীর অন্তরে স্বাধীনতার এই তীব্র বাসনাকে জাগ্রত করুন এবং আমি নিশ্চিত যে অনতিবিলম্বে ভারতবর্ষ স্বাধীন হবে।
ভারতবর্ষ স্বাধীন হবেই এ-বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। রাতের পরে যেমন দিন আসে, আমার কাছে এটা তেমনই নিশ্চিত। কিন্তু আসুন, আমরা এমন এক ভারতের স্বপ্ন দেখি—যার জন্য আমাদের যথাসর্বস্ব—এমন কি প্রাণ পর্যন্ত দান করা সার্থক হবে এবং যার জন্য আমরা আমাদের প্রিয়তম এবং নিকটতম জনকে উৎসর্গ করতে পারি। স্বাধীনতা সম্পর্কে আমার নিজের ধারণা আমি আপনাদের কাছে উপস্থিত করেছি এবং যে-ভারতবর্ষকে আমি চাই, তার চিত্র আপনাদের সামনে আঁকবার চেষ্টা করেছি ; সম্পূর্ণ স্বাধীন এক ভারতবর্ষ পৃথিবীতে তার নিজের স্বাধীনতার বাণী প্রচার করুক। অন্ধ স্বদেশপ্রেমিক বলে আখ্যাত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও আমার স্বদেশবাসীকে আমি বলব যে, ‘সফল করে তুলতে হবে’ এমন একটি ব্রত ভারতের আছে এবং এর জন্যই ভারত এখনও জীবিত আছে। এই ‘ব্রত’ শব্দটির সঙ্গে অতীন্দ্রিয়তার কোনও সম্পর্ক নেই। মানবজীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই পৃথিবীর কৃষ্টি এবং সভ্যতায় ভারতের মৌলিক কিছু দেবার আছে। নিজের বর্তমান হীনাবস্থা এবং দাসত্বের মধ্যেও ভারতের অবদান তুচ্ছ নয়। একবার নিজের পথে এবং নিজের প্রয়োজনানুযায়ী বিকাশের স্বাধীনতা পেলে তার অবদান কত বিরাট হবে একবার কল্পনা করুন। এ-দেশে এমন ব্যক্তি আছেন, এবং যাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বিখ্যাত এবং শ্রদ্ধেয়—যাঁরা সার্বিকভাবে স্বাধীনতার নীতি প্রয়োগের ব্যাপারে একমত হবেন না। তাঁদের খুশি করতে না পারলে আমরা দুঃখিত, কিন্তু যে-নীতি সত্য, ন্যায় এবং সমতার উপর প্রতিষ্ঠিত, তাকে আমরা কোনও অবস্থাতেই পরিত্যাগ করতে পারি না। অন্যরা আমাদের সঙ্গে আসুন বা না আসুন, আমরা আমাদের নিজেদের পথেই চলব—তবে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, মুষ্টিমেয় কয়েকজন আমাদের পরিত্যাগ করলেও হাজার-হাজার, এমন কি লক্ষ-লক্ষ লোক শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতার সেনাদলে যোগ দেবেন। আমরা যেন দাসত্ব, অন্যায় এবং অসাম্যের সঙ্গে আপস না করি। বন্ধুগণ, সকল স্বাধীনতাপ্রেমীর নিজেদের একটি সুখী ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে এক স্বাধীনতার সেনাবাহিনী গড়ে তোলার সময় এসে গেছে।
এই সেনাবাহিনী শুধু স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্যই সেনা পাঠাবে না, স্বাধীনতার নতুন ধর্মবিশ্বাস প্রচারের জন্যও প্রচারকদের পাঠাবে। আপনাদের ভিতর থেকেই এই সব প্রচারক এবং সেনা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের কর্মসূচীতে অবশ্যই এক দিকে থাকবে নিবিড় এবং ব্যাপক প্রচারকার্য এবং অপর দিকে থাকবে দেশব্যাপী এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। আমাদের প্রচারকদের কৃষক এবং কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে গিয়ে এই নতুন বাণী প্রচার করতে হবে। তাঁদের যুবকদের অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং দেশের সর্বত্র যুবকসংঘ সংগঠিত করতে হবে। কিন্তু সর্বশেষে বললেও গুরুত্বে যা কম নয়—তাঁদের দেশের সমগ্র নারীদের জাগরিত করতে হবে—কারণ পুরুষের সমান অংশীদার হিসাবে সমাজে এবং রাষ্ট্রে নিজের স্থান অধিকার করতে নারীদের এগিয়ে আসতেই হবে।
বন্ধুগণ, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কর্মিদলে যোগ দেওয়ার জন্য আপনাদের অনেকে নিশ্চয় এখন নিজেদের প্রশিক্ষিত করছেন। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নিঃসন্দেহে এই দেশের সর্বোচ্চ জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং একে কেন্দ্র করেই আমাদের সকল আশা। কিন্তু তার শক্তি, প্রভাব এবং ক্ষমতা নির্ভর করে, অথবা করা উচিত, শ্রমিক আন্দোলন, যুব আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, নারী আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন ইত্যাদি আন্দোলনের উপর। আমরা যদি আমাদের শ্রমিক, কৃষক, অনুন্নত সম্প্রদায়, যুবক, ছাত্র এবং নারীদের মুক্ত করতে সফল হই, তবে আমরা দেশে এমন এক শক্তি জাগ্রত করতে সক্ষম হব, যা আমাদের রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে এক শক্তিশালী অস্ত্র করে তুলবে। অতএব আপনারা যদি সর্বাপেক্ষা কার্যকরভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সেবা করতে চান, তা হলে একই সঙ্গে আমি যে-সব আন্দোলনের উল্লেখ করেছি, সেই সব সম্মিলিত আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
চীন আমাদের প্রতিবেশী—তাই চীনের সাম্প্রতিক ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা যাক। দেখা যাক নিজেদের মাতৃভূমির জন্য চীনের ছাত্ররা কী করেছেন। ভারতে আমরা কি একই কাজ করতে পারি না? আধুনিক চীনের নবজাগরণ প্রায় সম্পূর্ণরূপে চীনের ছাত্র এবং ছাত্রী উভয়ের কার্যকলাপের জন্য। এক দিকে তাঁরা স্বাধীনতার নতুন বাণী প্রচার করতে গ্রামে, শহরে এবং কলকারখানায় গিয়েছেন এবং অপর দিকে এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সমগ্র দেশকে তাঁরা সংগঠিত করেছেন। ভারতবর্ষেও আমাদের একই কাজ করতে হবে। স্বাধীনতার পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। স্বাধীনতার পথ কন্টকাকীর্ণ তাতে সন্দেহ নেই, তবে এটি এমন পথ যা গৌরব এবং অমরত্বের অঙ্গনে পৌঁছে দেয়। আসুন, আমরা অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করি, যুগ যুগ ধরে যে-শৃঙ্খলে আমরা আবদ্ধ, তা ভেঙে ফেলি এবং প্রকৃত তীর্থ্যাত্রীর মতো কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতার নির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাই। স্বাধীনতার অর্থ জীবন এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মৃত্যুর অর্থ সর্বোচ্চ অক্ষয় গৌরব। অতএব আসুন, আমরা স্বাধীন হওয়ার জন্য অথবা অন্ততপক্ষে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মৃত্যুবরণের সংকল্প গ্রহণ করি—এবং আমরা যে মহান যতীন্দ্রনাথ দাসের স্বদেশবাসী হওয়ার যোগ্য, আমাদের কর্ম এবং চরিত্ৰদ্বারা তা দেখিয়ে দিই। বন্দেমাতরম্!