পাগল [দ্য ম্যাডম্যান]

পাগল [দ্য ম্যাডম্যান]

নীতিগর্ভ রূপক কাহিনী কবিতা 

তুমি জানতে চাও কীভাবে আমি পাগল হয়েছিলাম। ঘটনাটা ঘটেছিল এভাবে : অনেক ঈশ্বরের জন্মেরও বহু আগে, একদিন গভীর ঘুম থেকে আমি জেগে উঠলাম এবং দেখতে পেলাম আমার সমস্ত মুখোশ চুরি হয়ে গেছে। সাতটি মুখোশ আমি তৈরি করেছি এবং সাত জীবনে তা পরিধানও করেছি। মুখোশহীন অবস্থায় আমি জনাকীর্ণ রাস্তা দিয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড়েছিলাম, ‘চোর, চোর, অভিশপ্ত চোর।’ 

নারী ও পুরুষেরা আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল এবং কেউ কেউ ভয় পেয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল। 

যখন আমি বাজার এলাকায় পৌঁছালাম তখন দেখতে পেলাম একজন যুবক একটা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, ‘সে একজন পাগল।’ আমি তাকে লক্ষ্য করে উপরের দিকে তাকালাম, সূর্য আমার নগ্নমুখে চুমু খেল এবং আমার আত্মা ভালোবাসায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল সূর্যের কারণে এবং আমি আর মুখোশ পরতে চাইনি। মোহগ্রস্তের মতো আমি আর্তনাদ করলাম, ‘আশীর্বাদপ্রাপ্ত হোক, আশীর্বাদপ্রাপ্ত হোক সেই চোরেরা, যারা আমার মুখোশগুলো চুরি করেছে।’ 

এভাবে আমি পাগলে পরিণত হলাম। 

এবং আমি দেখতে পেলাম আমার পাগলামির ভেতরে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দুটোই আছে, একাকিত্বের স্বাধীনতা এবং উপলব্ধি থেকে নিরাপত্তা, কারণ, যারা আমাদেরকে বুঝতে পারে, কিছু একটাকে তারা আমাদের ভেতরে ক্রীতদাসে পরিণত করে। 

সুতরাং আমাকে আমার নিরাপত্তা সম্পর্কে খুব বেশি গর্বিত হতে দিও না। এমনকি জেলখানায়ও এক চোর অন্য চোর থেকে নিরাপদ। 

.

ঈশ্বর 

প্রাচীনকালে যখন প্রথম কথা বলার শিহরণ এল আমার ঠোঁটে, তখন পবিত্র পাহাড়ে চড়লাম এবং ঈশ্বরের উদ্দেশে বললাম: ‘প্রভু আমি আপনার দাস, আপনার গোপন ইচ্ছা হল আমার আইন এবং আমি আপনাকে চিরকালের জন্য মান্য করব।’ কিন্তু ঈশ্বর কোনো উত্তর দিলেন না, পরাক্রমশীল ঝড়ের মতো পাহাড় অতিক্রম করে গেলেন। 

এবং হাজার বছর পর আমি পবিত্র পাহাড়ে চড়লাম এবং আবার ঈশ্বরকে বললাম, ‘সৃষ্টিকর্তা, আমি আপনার সৃষ্টি। মাটি থেকে আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং আপনার কাছে আমি আমার সবকিছুর জন্য ঋণী।’ 

এবং ঈশ্বর কোনো উত্তর দিলেন না, কিন্তু এক হাজার দ্রুত পাখার মতো পাহাড় অতিক্রম করে গেলেন। 

এবং হাজার বছর পর আমি পবিত্র পাহাড়ে চড়লাম। ঈশ্বরের উদ্দেশে আবার বললাম, ‘পিতা, আমি আপনার পুত্র। করুণা ও ভালোবাসার ভেতরে আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন এবং ভালোবাসা ও প্রার্থনার মাধ্যমে আমি আপনার সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হব।’ এবং ঈশ্বর কোনো উত্তর দিলেন না এবং দূরবর্তী পাহাড়কে ধোঁয়াশার অবগুণ্ঠন পরানোর মতো পাহাড় অতিক্রম করে গেলেন। 

এবং হাজার বছর পর আমি আবার পবিত্র পাহাড়ে চড়লাম এবং ঈশ্বরের উদ্দেশে বললাম, ‘হে আমার ঈশ্বর, আমার উদ্দেশ্য এবং আমার পরিপূর্ণতা, আমি হলাম আপনার গতকাল এবং আপনি চিহ্নিত করেন আমার আগামীকাল। আমি হলাম মাটির ভেতরে আপনার শিকড় এবং আপনি আমার ফুলগুলিকে আকাশে মূর্ত করে তুলুন এবং এক্ষত্রে আমরা বেড়ে উঠি সূর্যের মুখোমুখি।’ 

তারপর ঈশ্বর আমাকে খুশি করতে বিশেষভাবে সচেষ্ট হলেন এবং আমার কানে ফিফিস করে মিষ্টি কথা বললেন এবং সমুদ্র যেভাবে একটা ছোটনদীকে জড়িয়ে ধরে নিজের তলদেশে দৌড়ায়, সেভাবেই ঈশ্বর আমাকে জড়িয়ে ধরেন। 

এবং যখন আমি উপত্যকায় অবতরণ করলাম, সাদামাটা ঈশ্বরও তখন সেখানে ছিলেন। 

.

আমার বন্ধু 

বন্ধু আমার, আমাকে যা মনে হয় পোশাক পরিধান করি—যত্নে বোনা আমি তা নই। তবে যা-ই মনে হোক আমি একটা একটা পোশাক, যা রক্ষা করে তোমার সন্দেহ থেকে আমাকে এবং আমার অবহেলা থেকে তোমাকে। 

বন্ধু আমার, আমার ভেতরের ‘আমি’ বসবাস করে নৈঃশব্দের গৃহে এবং সেখানে সে থাকবে চিরকাল, উপলব্ধিহীন ও অনভিগম্য। 

আমি বিশ্বাস করব না তোমাকে যা আমি বলি অথবা আমি যা করি সে-সম্পর্কে—কারণ আমার কথারা অস্তিত্বহীন কিন্তু তা চিন্তা ধারণ করে ধ্বনির ভেতর এবং আমার কর্মকাণ্ড সক্রিয় উদ্যোগের ভেতরে ধারণ করে আকাঙ্ক্ষা। 

যখন তুমি বলো, ‘বাতাস প্রবাহিত হয় পূর্বদিকে।’ আমি বলি, ‘হ্যাঁ ওটা পূর্বদিকেই প্রবাহিত হচ্ছে। কারণ, আমি জানবনা যে আমার মন বাতাসের ওপর বসবাস করে না, বসবাস করে সমুদ্রের ওপর।’ 

তুমি উপলব্ধি করতে পারো না আমার সমুদ্রযাত্রা বিষয়ক চিন্তাভাবনা, পারো না আমাকে বোঝাতে তোমার উপলব্ধিগুলি। সে কারণে সমুদ্রে আমি একা হব। 

যখন এটা দিন তখন তুমি আমার সঙ্গে আছ হে বন্ধু আমার, আমার সঙ্গে এটা হল রাত্রি, যদিও আমি কথা বলি জোছনাস্রোত নিয়ে যা পাহাড় এবং রক্তবর্ণ ছায়ার ওপর নাচে, এবং চুরি করে সেই পথ যা উপত্যকা অতিক্রম করে যায়, কারণ তুমি আমার অন্ধকারাচ্ছন্নতার গান শুনতে পারনা, পারনা আমার সেই পাখাগুলিকে দেখতে যা নক্ষত্রকে আঘাত করে। আমি রাত্রির সঙ্গে থাকব একাকী। 

যখন তুমি তোমার স্বর্গে আরোহণ করবে, আমি তখন অবতরণ করব আমার নরকে। এমনকি তখন তুমি আমাকে আহ্বান জানাবে সেতুবিহীন জলবেষ্টিত উপসাগর অতিক্রম করতে ‘আমার সঙ্গী আমার কমরেড’ বলে, এবং আমিও তোমাকে ডাকব, ‘আমার সঙ্গী আমার কমরেড’, কারণ আমি আমার নরকে তোমাকে দেখব না। অগ্নিশিখা তোমার দৃষ্টিশক্তি পুড়িয়ে ফেলবে এবং ধোঁয়া আচ্ছন্ন করবে তোমার নাসারন্ধ্র। তারপরও আমি আমার নরককে ভালোবাসি। তোমার নরক পরিদর্শন আনন্দের হোক। আমি নরকে একাই থাকব। 

তুমি ভালোবাসো সত্য, সৌন্দর্য এবং ন্যায়নিষ্ঠা। আমি তোমার কসম খেয়ে বলছি, এটা উত্তম এবং আমার মনে হয় আমি এসব ভালোবাসি। কিন্তু আমার হৃদয়ে আমি তোমার ভালোবাসাকে লক্ষ্য করে হাসি, যদিও আমি তোমাকে পাবো না আমার এই হাসি উপভোগ করতে। সুতরাং আমি একাই হাসব। 

বন্ধু আমার, মূর্তরূপে সুন্দরের প্রকাশ ভালো, সতর্ক এবং প্রাজ্ঞ। না, তুমি যথাযথ- এবং আমিও, সুতরাং তার সঙ্গে কথা বলো বিচক্ষণতার সঙ্গে এবং সতর্কভাবে, যদিও আমি একজন পাগল কিন্তু আমি আমার পাগলামিকে মুখোশ পরাই। আমি পাগল হব এবং তাও একাকী। 

বন্ধু আমার, মূর্তরূপে সুন্দরের প্রকাশ ঘটাবে না, কিন্তু কীভাবে আমি তা তোমাকে বোঝাব? আমার পথ তোমার পথ নয়, যদিও আমরা একসঙ্গে হাঁটি, হাতে হাত ধরে। 

.

কাকতাড়ুয়া 

একবার আমি এক কাকতাড়ুয়াকে বলেছিলাম ‘তুমি অবশ্যই এই নির্জন মাঠে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে ক্লান্ত।’

 সে বলল, ‘অন্যকে ঘাবড়ে দেওয়ার আনন্দ খুবই গভীর এবং টেকসই এবং আমি এতে কখনও ক্লান্ত হই না।’ 

এক মিনিট চিন্তা করে আমি বললাম, ‘এটা সত্য, কারণ আমিও ঐ আনন্দ সম্পর্কে জানি।’ 

সে বলল, ‘শুধুমাত্র তারাই এটা জানতে পারে যারা খড়কুটো বিষয়ক অলীক কল্পনা মস্তিষ্কে প্রবেশ করায়।’ 

তারপর সে আমার প্রশংসা করেছিল, না আমার মর্যাদা নষ্ট করেছিল, সেসব না-জেনেই আমি তাকে পরিত্যাগ করলাম। 

এর মধ্যে এক বছর পেরিয়ে গেছে এবং এসময়ে সে দার্শনিকে পরিণত হয়েছে। 

এবং আমি যখন তাকে আবার অতিক্রম করে যাচ্ছিলাম দেখতে পেলাম দুটি কাক তার টুপির নিচে একটা বাসা তৈরি করছে। 

.

নিদ্রাচর 

শহরের যে-অঞ্চলে আমি জন্মেছিলাম সেখানে এক মহিলা ও তার কন্যা বসবাস করত, যারা ঘুমের ভেতরে হেঁটে বেড়াত। 

একরাতে যখন নীরবতা পৃথিবীকে জড়িয়ে ধরেছে তখন মহিলা এবং তার কন্যা ঘুমন্ত অবস্থায় হাঁটতে শুরু করল এবং তাদের সাক্ষাৎ ঘটল ধোঁয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা বাগানের ভেতরে। 

মা তখন তার কন্যাকে বলল, ‘শেষপর্যন্ত তুমিই আমার শত্রু। তুমিই হলে সেইজন যার দ্বারা আমার যৌবন ধ্বংস হয়েছিল- আমার ধ্বংসস্তূপের ওপর নির্মিত হয়েছিল তোমার জীবন। আমি কি তোমাকে হত্যা করব?’ 

এবং কন্যা বলল, ‘ হে ঘৃণিত নারী, স্বার্থপর এবং বুড়ো! তুমি আমার স্বাধীন সত্তা ও আমার মাঝখানে দাঁড়িয়েছ। কে বলবে যে তোমার বিবর্ণ জীবনের প্রতিধ্বনি হচ্ছে আমার জীবন! তুমি কি মারা যাবে।’ 

সেই মুহূর্তে একটা মোরগ ডেকে উঠল এবং দুজনেরই ঘুম ভেঙে গেল। মা খুব কোমল স্বরে কন্যাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কি তুমি ছিলে প্রিয় কন্যা আমার?’ কন্যাও ভদ্রভাবে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, মা।’ 

.

বিচক্ষণ কুকুর 

একদিন একদল বিড়ালের সঙ্গে রাস্তায় এক বিচক্ষণ কুকুরের দেখা হল। 

সে কাছে এসে দেখল তারা খুবই একাগ্রচিত্তে নিজের কাজ করছে এবং তার প্রতি মোটেও মনোযোগ দিচ্ছে না। সে থামল। 

এই দলের ভেতরে একটা বিশাল ও গম্ভীর বিড়াল ছিল এবং সে তাদের দিকে তাকাল এবং বলল, ‘ভাইয়েরা আমার, প্রার্থনা করো এবং যখন তোমরা বারবার প্রার্থনা করেছ এবং যখন সন্দেহের কোনোকিছু নেই, যথাযথই এটা হবে একটা বর্ষার ইঁদুর। এবং কুকুর এটা শুনে মনে-মনে হাসল এবং তাদের দিকে ঘুরে বলল, — হে অন্ধ, বোকা বিড়ালেরা, এটা কি লেখা হয়নি এবং আমি এটা জানি না এবং আমার পিতাও আমার আগে জানতেন না যে প্রার্থনা ও বিশ্বাসের জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন এবং সনির্বন্ধ প্ৰাৰ্থনা প্রয়োজন ইঁদুর নয়, হাড়ের জন্য।’ 

.

দুই তপস্বী 

এক নির্জন পাহাড়ের ওপরে বসবাস করত দুই তপস্বী যারা প্রার্থনা করত ঈশ্বরের এবং ভালোবাসত পরস্পরকে। 

এই দুই তপস্বীর একটাই মাটির পাত্র ছিল এবং তারা দুজনেই এটার মালিক ছিল। 

একদিন এক খারাপ আত্মা বয়স্ক তপস্বীর হৃদয়ে প্রবেশ করল এবং সে তরুণ তপস্বীর কাছে এসে বলল, ‘বহুদিন হয়েছে আমরা একত্রে বসবাস করছি। এখন সময় এসেছে আলাদা হওয়ার। চলো আমাদের যাকিছু আছে ভাগাভাগি করা যাক।’ 

তরুণ তপস্বী খুবই বেদনা অনুভব করল এবং বলল, ‘আমি খুবই দুঃখ পেয়েছি ভাই যে আপনি আমাকে পরিত্যাগ করে যাবেন। কিন্তু যদি আপনি যেতেই চান’, সেক্ষেত্রে সে মাটির পাত্রটি নিয়ে এল এবং তাকে দিয়ে বলল, ‘আমরা এটাকে ভাগ করতে পারব না ভাই। এটা আপনি নিয়ে যান।’ 

বয়স্ক তপস্বী তখন বলল, ‘দান! এটা আমি গ্রহণ করবনা। আমি কিছুই নেব না কিন্তু আমার যা কিছু আছে তা অবশ্যই নেব। অবশ্যই পাত্রটিকে ভাগ করতে হবে।’ 

তরুণ তপস্বী বলল,- পাত্রটি যদি ভেঙেই যায় তাহলে তা আপনার কিংবা আমার কারও কোনো কাজে আসবে? যদি আপনি খুশি হন তাহলে চলুন লটারি করি।’ 

কিন্তু বয়স্ক তপস্বী আবার বলল, ‘আমি ন্যায্যতা আশা করব এবং নিজের জিনিস বুঝে নেব এবং আমি যদি ন্যায়পরায়ণতার ওপর আস্থা না রাখি তাহলে ব্যর্থ হবে আমার সুযোগ। সুতরাং পাত্রটিকে অবশ্যই ভাগাভাগি করতে হবে।’ 

তারপর তরুণ তপস্বী আর কোনো কারণ না দেখিয়ে বলল, ‘তাহলে চলুন পাত্রটা ভেঙে ফেলি।’ 

কিন্তু বয়স্ক তপস্বীর চেহারায় অন্ধকার নেমে এল এবং সে আর্তনাদ করে উঠল, ‘হে অভিশপ্ত কাপুরুষ, তুমি লড়াই করবে না?’ 

.

দান এবং গ্রহণ 

একসময় এক লোক বসবাস করত, যার উপত্যকা পরিপূর্ণ ছিল অসংখ্য সুঁচে। একদিন যিশুর মাতা তার কাছে এল এবং জিজ্ঞাসা করল : বন্ধু, আমার পুত্রের পোশাকটা ছিঁড়ে গেছে এবং সে মন্দিরে যাওয়ার আগেই আমাকে পোশাকটা সারতে হবে। তুমি কি আমাকে একটা সূচ দেবে না?’ 

এবং লোকটি তাকে কোনো সুঁচ দিল না কিন্তু সে যশুির মাতাকে একটা শেখানো বক্তৃতা শোনাল—দান এবং গ্রহণের ওপর, মন্দিরে যাওয়ার আগে তার পুত্রের কাছে তা বহন করে নিয়ে যেতে। 

.

সাতটি সত্তা 

রাত্রির নীরবতায় আমি যখন আধাঘুমন্ত অবস্থায় থাকি তখন আমার সাতটি সত্তা একত্রে বসে এবং ফিসফিস করে তারা কথা বলে 

প্রথম সত্তা : এখানে এই পাগলের সঙ্গে আমি এতগুলি বছর বসবাস করেছি। আমার করার কিছুই ছিল না কিন্তু আমি নবায়ন করেছি তার দুঃখ দিনের মাধ্যমে এবং পুনরায় সৃষ্টি করেছি তার বেদনাবোধ রাত্রির সাহায্যে। আমি আর আমার ভাগ্যকে মেনে নিতে পারছি না এবং এখন আমি বিদ্রোহ করব। 

দ্বিতীয় সত্তা : তুমি আমার চেয়ে ভালো অবস্থায় আছ ভাই, কারণ আমাকে দেওয়া হয়েছে তার উৎফুল্ল সত্তা। আমি তার হাসির সঙ্গে হাসি এবং গান গাই তার সুখী সময়গুলিতে এবং তার তিনটি পাখাযুক্ত পায়ের সঙ্গে নৃত্য করি তার উজ্জ্বলতর চিন্তার সময়। আমি আমার ক্লান্তিকর অস্তিত্বের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করব। 

তৃতীয় সত্তা : আমি হলাম তার ভালোবাসা- শাসিত সত্তা, বন্য আবেগের উজ্জ্বলতর শিখা এবং অভূতপূর্ব আকাঙ্ক্ষা। আমার কী হবে? এটা হচ্ছি আমি অর্থাৎ সেই ভালোবাসা পীড়িত সত্তা যে এই পাগলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। 

চতুর্থ সত্তা : তোমাদের সবার ভেতরে আমি হলাম সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত, কারণ, আমাকে কিছুই দেওয়া হয়নি, কদর্য ঘৃণা এবং ধ্বংসাত্মক মনোভাব ছাড়া। আমি হলাম প্রচণ্ড ঝড়ের মতো সত্তা, যার একাংশের জন্ম হয়েছে নরকের কৃষ্ণবর্ণ গুহায়, সে এই পাগলের সেবা করতে প্রতিবাদ জানাবে। 

পঞ্চম সত্তা : এটা হচ্ছি আমি, যে সত্তা চিন্তা করে। এটা হল কল্পনাপ্রবণ সত্তা। ক্ষুধা- তৃষ্ণার সত্তা। এটা হল সর্বনাশা সত্তা, যা সৃষ্টি হয়নি এবং যা অজানা এরকম বস্তুর সন্ধানে এই সত্তা বিশ্রাম ছাড়াই বিপর্যয়ে বিঘ্নিত হয়। এটা হচ্ছি আমি, তুমি নও। কে বিদ্ৰোহ করবে? 

ষষ্ঠ সত্তা : আমি হলাম কর্মময় সত্তা, দয়ার্দ্র শ্রমিক, যে ধৈর্যের হাত ও আকাঙ্ক্ষার দৃষ্টি নিয়ে দিনগুলিকে বিভিন্ন প্রতিমূর্তিতে তৈরি করে এবং আদলহীন উপাদানগুলিকে প্রদান করে নতুন এবং চিরন্তন আদল— এটা হলাম আমি, একাকী, নির্জন- যে এই ক্লান্তিহীন পাগলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। 

সপ্তম সত্তা : কী বিস্ময়কর, তোমরা প্রত্যেকই এই লোকটার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, কারণ তোমাদের প্রত্যেকের রয়েছে পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য যা পূর্ণ করতে হবে। আহ! যদি আমি তোমাদের একজন হতে পারতাম, একটি আত্মা যে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু আমি হলাম অস্তিত্বহীন সত্তা, যে বধির হয়ে বসে থাকে, শূন্য, কোথাও নেই, কখনও নেই, যখন তোমরা জীবন পুননির্মাণে ব্যস্ত। এটা কি তোমরা অথবা আমি, তোমাদের প্রতিবেশী, যার বিদ্রোহ করা উচিত? 

যখন সপ্তম আত্মা একথা বলল, তখন অন্য ছয় আত্মা করুণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল এবং রাত্রি গভীর হওয়ার সাথে সাথে একজনের পর একজন একটা নতুন এবং সুখী আত্মসমর্পণের সঙ্গে জড়াজড়ি করে ঘুমাতে গেল। 

কিন্তু সপ্তম আত্মা তাদেরকে দেখতে থাকল এবং স্থিরদৃষ্টিতে তাকাল সেই অস্তিত্বহীনতার দিকে, যা সবকিছুর পেছনে থাকে। 

.

যুদ্ধ 

একরাতে রাজপ্রাসাদে ভোজ-উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল এবং সেখানে একটা লোক এল এবং রাজকুমারের সামনে বিনীতভাবে শ্রদ্ধা প্রকাশ করল। ভোজ-উৎসবে আগত ব্যক্তিরা তার দিকে তাকাল এবং তারা দেখতে পেল তার একটি চোখ নেই এবং সেটা কেবলই একটা গর্ত এবং তা থেকে রক্ত ঝরছে। রাজকুমার তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার এ অবস্থা কী করে ঘটেছে? লোকটা উত্তরে বলল, হে রাজকুমার, আমি একজন পেশাদার চোর, আজ রাতে যেহেতু চাঁদ নেই, আমি মুদ্রা বিনিময়কারীর দোকানে চুরি করতে গিয়েছিলাম এবং জানালা দিয়ে ভেতরেও ঢুকেছিলাম, কিন্তু আমি ভুল করে তাঁতির দোকানে ঢুকে পড়েছিলাম। অন্ধকারে আমি দৌড়ে গিয়েছিলাম তার তাঁতের কাছে এবং আমার চোখ তুলে ফেলা হয়েছিল। হে রাজকুমার, আমি এখন ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি।’ 

তারপর রাজকুমার তাঁতিকে ডেকে আনতে লোক পাঠালেন এবং সে এল এবং এটা ছিল হুকুম, তার একটা চোখ তুলে নেওয়া উচিত। 

তাঁতি বলল, ‘ হে রাজকুমার, আপনার আদেশ যথাযথ। এটা ঠিক যে আমার একটা চোখ তুলে নেওয়া হবে এবং দুঃখের বিষয় হল দুটো চোখই আমার দরকার, কারণ কাপড় বোনার সময় আমাকে কাপড়ের দুটো প্রান্তই দেখতে হয়। কিন্তু আমার এক প্রতিবেশী আছে, সে একজন মুচি, তারও দুটো চোখ আছে, কিন্তু তার ব্যবসায় দুটো চোখের কোনো প্রয়োজন নেই।’ 

তারপর রাজকুমার মুচিকে ডেকে আনতে লোক পাঠালেন। মুচি এল এবং তারা মুচির দুই চোখের একটা তুলে নিল এবং ন্যায়বিচারে সবাই সন্তুষ্ট হল। 

.

শেয়াল 

সূর্যালোকে এক শেয়াল নিজের ছায়ার দিকে তাকাল এবং বলল, ‘আজ আমি মধ্যাহ্নভোজ করব একটা উট দিয়ে।’ সমস্ত সকাল ধরে সে একটা উট খোঁজাখুঁজি করল। কিন্তু দুপুরবেলায় সে নিজের ছায়া দেখল আবার এবং বলল, ‘উটের বদলে একটা ইঁদুরই ভালো।’ 

.

বিচক্ষণ রাজা 

একসময় দূরবর্তী শহর উইরানী-এর শাসনকর্তা ছিলেন এক রাজা। তিনি ছিলেন পরাক্রমশালী এবং বিচক্ষণ এবং তার পরাক্রমশীলতার জন্য মানুষ তাকে ভয় পেত এবং ভালোবাসত তার বিজ্ঞতার জন্য। 

শহরের কেন্দ্রে ছিল একটা কুয়া, যার পানি ছিল ঠান্ডা এবং অতিস্বচ্ছ, যা থেকে সমস্ত শহরবাসী পানি পান করত, এমনকি রাজা ও তার সভাসদরাও, কারণ এটা ছাড়া আর কোনো কুয়া ছিলনা। 

একরাতে যখন শহরবাসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন এক ডাইনি শহরে প্রবেশ করে এবং সাত ফোঁটা অদ্ভুত তরল পদার্থ কুয়ার পানিতে ঢেলে দেয় এবং বলে, ‘এখন থেকে যে এই কুয়ার পানি পান করবে সে পাগলে পরিণত হবে।’ 

।পরবর্তী সকালে সমস্ত শহরবাসী রাজা এবং তার প্রাসাদ-সরকারকে রক্ষা করল এবং কুয়ার পানি পান করে তারা পাগলে পরিণত হল, ডাইনি যেরকম ভবিষৎবাণী করেছিল। সারাদিন জনগণ শহরের সংকীর্ণ রাস্তা এবং বাজার এলাকায় ঘোরাঘুরি করল কিন্তু পরস্পর ফিসফিস করা ছাড়া আর কিছুই করল না। তারা ফিসফিস করে একে অন্যকে বলল, ‘এই রাজা পাগল। আমাদের রাজা এবং তার প্রাসাদ-সরকার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছে। নিশ্চিতভাবেই একজন পাগল আমাদেরকে শাসন করতে পারে না। আমাদের উচিত রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করা।’ 

সন্ধ্যায় রাজা নির্দেশ দিলেন একটা হাতল ছাড়া সোনালি পানপাত্র আনতে এবং কুয়া থেকে পানি এনে তা পূর্ণ করতে। যখন পানপাত্র তার সামনে আনা হল তিনি তা থেকে পান করে তারা গভীর তৃষ্ণা মেটালেন এবং তার প্রসাদ-সরকারকেও দিলেন পান করতে। 

এবং দূরবর্তী শহর উইরানীতে তখন শুরু হয় আনন্দ-উৎসব, কারণ এর রাজা এবং এর প্রাসাদ-সরকার আবার তাদের কাণ্ডজ্ঞান ফিরে পেয়েছিলেন। 

.

লক্ষ্য 

সারাইখানার এক টেবিলে তিন লোকের দেখা হল। একজন হচ্ছে তাঁতি, একজন কাঠমিস্ত্রি এবং একজন চাষি। 

তাঁতি বলল, ‘দুই স্বর্ণমুদ্রার বিনময়ে আমি আজ একটা চমৎকার লিলেনের অবগুণ্ঠন বিক্রি করলাম। চলো আমরা সবাই মিলে মদ্যপান করি।’ 

‘এবং আমি’ কাঠমিস্ত্রি বলল, ‘আমি আমার শ্রেষ্ঠ কফিনটা বিক্রি করলাম। সুতরাং মদের সঙ্গে আমরা একটা বড় রোস্টও খাব।’ 

চাষি বলল, ‘আমি একটা কবর খুঁড়েছিলাম, আমার পৃষ্ঠপোষক আমাকে দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিয়েছে। সুতরাং একটা মধুমিশ্রিত কেকও আমরা খাব।’ 

এবং সমস্ত সন্ধ্যাজুড়ে সরাইখানাটা খুবই ব্যস্ত ছিল, কারণ তারা প্রায়ই মদ, মাংস ও কেকের জন্য ডাকাডাকি করছিল এবং উল্লসিত হয়েছিল তারা। 

সরাইখানার তত্ত্বাবধায়ক নিজের হাতদুটি পরস্পরের সাথে ঘষলেন এবং তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন, কারণ তার অতিথিরা মুক্তহস্তে খরচ করছে। 

যখন তারা সরাইখানা পরিত্যাগ করে গেল তখন চাঁদ মাথার ওপরে এবং তারা একত্রে রাস্তা দিয়ে গান গাইতে এবং চিৎকার করতে করতে হাঁটতে লাগল। 

সরাইখানার তত্ত্বাবধায়ক এবং তার স্ত্রী সরাইখানার দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকল তাদের দিকে। 

স্ত্রী বলল, ‘আহ এই ভদ্রলোকদের কী রকম খরচের হাত এবং কী পরিমাণ হাসিখুশি তারা! তারা যদি শুধুমাত্র আমাদের জন্য প্রতিদিন এরকম ভাগ্য বহন করে আনত, তাহলে আমাদের সরাইখানার তত্ত্বাবধায়ক হওয়ার প্রয়োজন পড়ত না এবং এরকম কঠিন পরিশ্রমও করতে হত না। আমরা তাকে লেখাপড়া শেখাতে পারতাম এবং সে যাজক হতে পারত।’ 

.

নতুন আনন্দ 

গতরাতে আমি একটা নতুন আনন্দ আবিষ্কার করলাম এবং তার প্রথম মহড়া দেওয়ার সময় একজন দেবদূত ও একজন দানব এসে আমার বাড়িতে ভিড় করল। আমার দরজার সামনেই তাদের সাক্ষাৎ ঘটল এবং তারা পরস্পরের সঙ্গে লড়াই করল আমার নতুন সৃষ্টি করা আনন্দের ওপর। তাদের একজন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘এটা একটা পাপ – অন্যজন বলল, ‘এটা একটা সদ্গুণ।’ 

.

অন্য ভাষা 

আমার জন্মের তিনদিন পর আমি সিল্কের দোলনায় শুয়েছিলাম এবং বিস্ময় ও আতঙ্কে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম আমার চারপাশের নতুন পৃথিবীর দিকে। আমার মা আমার দুধ- মাকে (স্তন্যদান করার জন্য নিযুক্ত ধাত্রী) বললেন, ‘আমার বাচ্চাটা কেমন আছে?’ 

আমার দুধ-মা উত্তরে বললেন, ‘ম্যাডাম, সে ভালোই আছে। আমি তাকে তিনবার খাবার দিয়েছি এবং এর আগে আমি এত বড়সড় ও হাসিখুশি বাচ্চা কখনও দেখিনি। 

আমি ক্রুদ্ধ হলাম এবং আর্তনাদ করে উঠলাম, ‘এটা সত্য নয় মা, কারণ আমার বিছানাটা শক্ত এবং যে দুধ আমি চুষে খাই তা আমার মুখে তেতো লাগে এবং এই স্তনের গন্ধ নোংরা লাগে আমার নাকে এবং আমি খুব শোচনীয় অবস্থায় আছি।’ 

আমার মা আমার কথা বুঝতে পারেন না, এমনকি আমার দুধ-মাও নয়, কারণ যে-ভাষায় আমি কথা বলেছিলাম তা ছিল সেই পৃথিবীর ভাষা, যেখান থেকে আমি এসেছিলাম। এবং আমার জীবনের একুশতম দিনে আমি ক্রিশ্চান হয়েছিলাম। যাজক আমার মাকে বলেছিল, ‘ম্যাডাম, বস্তুতপক্ষে আপনার খুশি হওয়া উচিত, কারণ আপনার ছেলে ক্রিশ্চান হয়েই জন্মেছে।’ 

আমি বিস্মিত হলাম এবং যাজককে বললাম, ‘তাহলে স্বর্গে আপনার মায়ের উচিত অসুখী হওয়া, কারণ আপনি ক্রিশ্চান হয়ে জন্মাননি।’ 

কিন্তু যাজকও আমার ভাষা বুঝতে পারল না। 

.

এবং সাতটি চন্দ্রমাস পেরিয়ে যাওয়ার পর একদিন এক গণক আমাকে পর্যবেক্ষণ করলেন এবং আমার মাকে বললেন, ‘আপনার ছেলে রাষ্ট্রনায়ক হবে এবং হবে জননেতা।’ কিন্তু আমি আর্তনাদ করে উঠলাম, ‘এটা একটা ভুল ভবিষ্যৎবাণী, কারণ আমি হব সংগীতজ্ঞ, অন্য কিছুই না কেবলই সংগীতজ্ঞ।’ কিন্তু এই বয়সেও আমার ভাষা কেউ বুঝতে পারল না এবং আমার বিস্ময় মহাবিস্ময়ে পরিণত হল। 

.

তেত্রিশ বছর পর আমার মা, দুধ-মা এবং যাজক মারা গেছেন। (তাদের আত্মার ওপর ঈশ্বরের ছায়া পড়ুক) সেই গণক এখনও বেঁচে আছে এবং গতকাল মন্দিরের সিঁড়ির কাছে আমি তার সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে সে বলল, ‘আমি সবসময়ই জানতাম তুমি বিশাল সংগীতজ্ঞ হবে। এমনকি তোমার শিশুবয়সে আমি এ- সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণীও উচ্চারণ করেছিলাম।’ 

এবং আমি তা বিশ্বাস করলাম, কারণ ইতিমধ্যেই আমি আমার অন্য পৃথিবীর ভাষা ভুলে গেছি। 

.

ডালিম 

একসময় যখন আমি ডালিমের হৃদয়ে বসবাস করতাম তখন শুনেছিলাম একটা বীজ বলছে, — কোনো একদিন আমি বৃক্ষে পরিণত হব এবং বাতাস আমার শাখাগুলিতে গান গাইবে, সূর্যালোক নৃত্য করবে আমার পাতায় পাতায় এবং সমুদ্রের যাবতীয় গানের মাধ্যমে আমি মজবুত ও সুন্দর হয়ে উঠব।’ 

।তারপর অন্য বীজ বলল, ‘আমি যখন তোমার মতো ছোট ছিলাম আমি কল্পনায় এরকম দৃশ্য দেখতাম, কিন্তু এখন আমি ওজন ও পরিমাপ করতে পারি এবং আমি লক্ষ্য করি আমার আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ হয়েছে।’ 

তৃতীয় বীজ তখন বলল, ‘আমি আমাদের ভেতরে কিছুই দেখতে পাই না। ভবিষ্যতের জন্য সেটা একটা প্রতিশ্রুতি।’ 

চতুর্থ বীজ বলল, ‘কিন্তু কোনো মহত্তর ভবিষ্যৎ ছাড়া কী পরিমাণ উপহাসের জীবন আমাদের।’ 

পঞ্চম বীজ বলল, ‘আমরা কী হব তা নিয়ে তর্ক করো কেন। বিশেষ করে যখন আমরা নিজেই জানি না আমরা কারা।’ 

কিন্তু ষষ্ঠ বীজ উত্তরে বলল, ‘আমরা যা-ই হই না কেন, তার ধারাবাহিকতাই আমরা রক্ষা করব। 

সপ্তম বীজ বলল, ‘আমার একটা স্বচ্ছ ধারণা আছে কীভাবে সবকিছু হয়ে উঠবে, কিন্তু আমি তা কথায় প্রকাশ করতে পারিনা।’ 

তারপর অষ্টম বীজ বলল এবং তারপর নবম বীজ, তারপর দশম এবং তারপর অনেকগুলি বীজ এবং যতক্ষণ-না সবার বলা শেষ হল আমি কোনোকিছুই পার্থক্য করতে পারলাম না, কারণ তখন অনেক কণ্ঠস্বর। 

সেইদিন থেকে আমি জায়গা পরিবর্তন করে আশ্রয় নিলাম একটা নাশপাতির হৃদয়ে যেখানে বীজের সংখ্যা মাত্র কয়েকটি এবং তারা প্রায়ই নীরব থাকে। 

.

দুটি খাঁচা 

আমার বাবার বাগানে দুটো খাঁচা ছিল। তার একটাতে ছিল একটা সিংহ, যে ছিল আমার পিতার ক্রীতদাস, তাকে আনা হয়েছিল নিনেভ মরুভূমি থেকে। অন্য খাঁচাতে ছিল একটা চড়াই পাখি, যে কখনও গান গায় না। 

প্রতিদিন সকালে চড়াই পাখি সিংহকে ডেকে বলত, ‘সুন্দর সকাল হে আমার বন্দি ভ্রাতা।’ 

.

তিনটি পিঁপড়ে 

একটা লোকের নাকের ওপর তিনটি পিঁপড়ের দেখা হয়, যে সূর্যালোকে ঘুমন্ত অবস্থায় শুয়েছিল। পিঁপড়েগুলি একে অন্যকে অভিবাদন জানানোর পর প্রত্যেকেই তার গোত্রের রীতি অনুযায়ী কথা বলছিল। 

প্রথম পিঁপড়ে বলল, ‘এই পাহাড় এবং সমতলভূমি খুবই অনুর্বর আমি জেনেছি। সারাদিন আমি সন্ধান করেছি যে কোনো ধরনের একটি শস্যকণা এবং কোনাকিছুই আমি খুঁজে পাইনি।’ 

দ্বিতীয় পিঁপড়েটি তখন বলল, ‘আমিও কিছু খুঁজে পাইনি, যদিও বনের ভেতরের ফাঁকা জায়গা এবং প্রত্যেকটি কোনা পরিদর্শন করে দেখেছি। আমি বিশ্বাস করি যা আমার লোকেরা বলে থাকে : কোমল এবং চলাচলরত ভূমি যেখানে, সেখানে কিছু জন্মায় না।’ তারপর তৃতীয় পিঁপড়েটি তার মাথা তুলল এবং বলল, ‘বন্ধুরা আমার, এখন সর্বময় ক্ষমতাসম্পন্ন পিঁপড়ের নাকের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। পরাক্রমশালী এবং চিরন্তন পিঁপড়ে, যার শরীর খুবই বিশাল এবং সে কারণে আমরা তাকে দেখতে পাইনা, যার ছায়াও খুব বিশাল সে কারণে আমরা তার সন্ধান করতে পারি না, যার কণ্ঠস্বর খুবই উঁচু সে কারণে আমরা শুনতেও পাই না এবং সে হল সর্ব উপস্থিতি। 

তৃতীয় পিঁপড়েটি যখন একথা বলল তখন অন্য পিঁপড়েরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল। 

সেই মুহূর্তে লোকটা নড়েচড়ে উঠল এবং ঘুমের ভেতরেই হাত তুলে তার নাক চুলকালো এবং পিঁপড়ে তিনটে অভিশপ্ত পিঁপড়েতে পরিণত হয়েছিল। 

.

গোর-খোদক 

একবার আমি আমার এক ক্রীতদাসকে সমাহিত করছিলাম। তখন গোর-খোদক এল এবং বলল, ‘মানুষেরা দলবেঁধে একজনকে সমাহিত করতে আসে। আপনি একা এসেছেন এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে।’ 

আমি বললাম, ‘তুমি আমাকে চূড়ান্তভাবে খুশি করেছ, কিন্তু কেন তুমি আমাকে পছন্দ করলে?’ 

সে বলল, ‘কারণ তারা কাঁদতে কাঁদতে আসে এবং কাঁদতে কাঁদতে যায়— একমাত্ৰ আপনিই হাসতে হাসতে এসেছেন এবং হাসতে হাসতে যাবেন। 

.

মন্দিরের সিঁড়ির ওপর 

গতকাল মন্দিরের মার্বেল পাথরের সিঁড়ির ওপর একজন নারীকে দুজন পুরুষের মাঝখানে বসে থাকতে দেখেছিলাম। তার মুখের একদিক ছিল মলিন এবং অন্যদিক ছিল লজ্জায় আরক্তিম। 

.

আশীর্বাদকৃত নগরী 

আমার যৌবনে আমাকে বলা হয়েছিল যে, কোনো একটা নির্দিষ্ট শহরে প্রত্যেকেই বসবাস করত বাইবেলের নিয়ম অনুসারে। আমি বললাম, ‘আমি সেই নগরীর সন্ধান করব এবং সেই নগরীর সুখী অবস্থাও।’ 

নগরীটা ছিল বহুদূরে। আমি সেই নগরীতে যাওয়ার বিশাল প্রস্তুতি নিলাম এবং চল্লিশ দিন পর সেই নগরী আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠল এবং আমি একচল্লিশ দিনের দিন নগরীতে প্রবেশ করলাম। 

এবং দ্যাখো দ্যাখো, সমস্ত নগরবাসীরই এক চোখ এবং এক হাত নেই। আমি বিস্মিত হলাম এবং মনে মনে বললাম, ‘এরা সবাই তো এই পবিত্র নগরীর বাসিন্দা কিন্তু তাদের এক চোখ এবং এক হাত নেই কেন?’ 

তারপর আমি লক্ষ্য করলাম তারাও খুব বিস্মিত হয়েছে আমাকে দেখে, কারণ আমার দুটো চোখ, দুটো হাত। তারা যখন কথা বলছিল তখন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটাই কি সেই আশীর্বাদকৃত নগরী যেখানে প্রতিটি মানুষ বাইবেলের নিয়ম অনুসারে জীবনযাপন করে?’ তারা উত্তরে বলল, ‘হ্যাঁ, এটাই সেই নগরী।’ 

আমি বললাম, ‘আপনাদের কী হয়েছে? কোথায় আপনাদের ডান চোখ এবং ডান হাত?’ সমস্ত লোক এবার ঘুরে দাঁড়াল এবং তারা বলল, ‘আসুন এবং দেখুন।’ তারা আমাকে নগরীর মাঝখানে অবস্থিত মন্দিরে নিয়ে গেল এবং মন্দিরের ভেতরে আমি দেখতে পেলাম হাত এবং চোখের স্তূপ। সবই শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। তখন আমি বললাম, ‘হায়, কোন সেই দখলকারী যে আপনাদের ওপর এই নিষ্ঠুর আচরণ করেছে? তারা ফিসফিস করতে শুরু করল এবং তাদের ভেতর থেকে বয়স্ক এক ব্যক্তি সামনে এগিয়ে এসে বলল, ‘আমরা নিজেই একাজ করেছি। ঈশ্বর আমাদেরকেই জয়ী করেছেন আমাদের ভেতরে যে দানব বসবাস করে তার ওপর। 

লোকটি আমাকে নেতৃত্ব ছিল একটা উঁচু বেদি পর্যন্ত এবং প্রত্যেকেই আমাদেরকে অনুসরণ করল। সে আমাকে দেখাল বেদির পাথরে খোদাইকৃত লেখা এবং আমি পড়লাম : যদি তার ডান চোখ তোমাকে অসন্তুষ্ট করে তাহলে তা তুলে নাও এবং তার কাছ থেকে এনে তা জড়ো করো। এটা তোমার জন্য লাভজনক, কারণ তোমাদের একজন সদস্যের একটি অঙ্গ লোপ পেল। এর অর্থ এই নয় যে তার পুরো শরীর নরকে সংগৃহীত হবে। যদি তার ডান হাত তোমার কাছে কোনো অপরাধ করে তাহলে তাকে কেটে ফ্যালো এবং তার কাছ থেকে তা এনে জড়ো করো, কারণ এটা তোমার জন্য লাভজনক, কারণ তোমাদের একজন সদস্যের একটি অঙ্গ লোপ পেল এবং এর অর্থ এই নয় যে, তার পুরো শরীর নরকে সংগৃহীত হওয়া উচিত।’ 

তারপর আমি উপলব্ধি করলাম এবং সমস্ত জনগণের দিকে ফিরে আর্তনাদ করে উঠলাম, ‘তোমাদের ভেতরে কি একজনও নারী কিংবা পুরুষ নেই, যার দুটো হাত এবং দুটো চোখ আছে?’ 

এবং তারা উত্তরে আমাকে বলল, ‘না, একজনও নেই। সেখানে কেউ নেই, যদিও তারা বাইবেল পড়া এবং ঐশী আদেশ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে খুবই অপরিপক্ক। 

মন্দির থেকে বেরিয়ে আমি তখনই ঐ আশীর্বাদকৃত নগরী পরিত্যাগ করেছিলাম, কারণ আমি মোটেও অপরিপক্ক নই এবং আমি বাইবেল পড়তে পারি।’ .

ভালো ঈশ্বর এবং মন্দ ঈশ্বর 

ভালো ঈশ্বর ও মন্দ ঈশ্বরের দেখা হয়েছিল পাহাড়ের চূড়ায়। 

ভালো ঈশ্বর বললেন, ‘আপনার মঙ্গল হোক ভাই। 

মন্দ ঈশ্বর কোনো উত্তর দিলেন না। 

ভালো ঈশ্বর আবার বললেন, ‘মনে হচ্ছে আজ আপনার মন ভালো নেই।’ 

মন্দ ঈশ্বর বললেন, ‘হ্যাঁ, কারণ আমি প্রায়ই আপনার জন্য একটা ভুল করে ফেলি। আপনার নাম ধরে ডাকি এবং এমন আচরণ করি যেন আমিই আপনি এবং এটা আমাকে পীড়াদায়ক আনন্দ দান করে।’ 

এবং ভালো ঈশ্বর বললেন, ‘আমিও আপনার জন্য এ-ধরনের ভুল করি এবং আপনার নাম ধরে ডাকি।’ 

মন্দ ঈশ্বর মানুষের বোকামিকে অভিশাপ দিতে দিতে চলে গেল। 

.

পরাজয় 

পরাজয়— আমার পরাজয়, আমার নির্জনতা, আমার উদাসীনতা,
হাজার বিজয়োল্লাসের চেয়েও তুমি আমার প্রিয়তর। 
এবং পৃথিবীর যাবতীয় গৌরবের চেয়ে তুমি অধিক মধুর। 

পরাজয়, আমার পরাজয়— আমার আত্মজ্ঞান 
এবং আমার বিরুদ্ধচারণ, 
তোমার মাধ্যমেই আমি জানি যে আমি তরুণ এবং আমার পদযুগ দ্রুতগতিসম্পন্ন 
এবং শুকিয়ে যাওয়া জলপাই পাতার দ্বারা তা প্রতারিত হবে না। 
এবং তোমার ভেতরে আমি খুঁজে পেয়েছি একাকিত্ব এবং 
দূরবর্তী ও ঘৃণিত হওয়ার আনন্দ। 

পরাজয়, আমার পরাজয়, আমার জ্বলজ্বলে তরবারি এবং আমার ঢাল,
তোমার চোখে আমি যা পড়েছি তা সিংহাসনে বসবে এবং 
পরিণত হবে ক্রীতদাসে এবং উপলব্ধিতে। 
এবং তা আঁকড়ে ধরবে কিন্তু তা পরিপূর্ণ করে তুলবে একজনকে 
এবং একটা পাকা ফলের মতো ঝরে পড়বে এবং তা পরিণত হবে খাবারে। 

পরাজয়, আমার পরাজয়, আমার দৃঢ়চেতা সঙ্গী, 
তুমি আমার গান শুনবে এবং আমার কান্না ও নীরবতা, 
এবং শুধুমাত্র তুমিই কথা বলবে আমার সঙ্গে 
এবং আঘাত করবে তোমার পাখা দিয়ে, 
সমুদ্র ও পাহাড়ের প্ররোচনা পোড়াবে রাত্রিকে এবং তুমি একাকি চড়বে আমার
খাড়া হয়ে ওঠা ধূসর আত্মার ওপর। 

পরাজয়, আমার পরাজয়, আমার মৃত্যুহীন মনোবল, 
আমি এবং তুমি একত্রে ঝড়ের সঙ্গে হেসে উঠব। 
এবং একত্রে আমরা কবর খুঁড়ব যা আমাদের ভেতরে মারা যায় তার জন্য। 
এবং আমরা একটা ইচ্ছা নিয়ে সূর্যালোকে দাঁড়াব 
এবং আমরা হয়ে উঠব ভয়ংকর। 

.

রাত্রি এবং পাগল 

‘আমি হলাম তোমার মতো হে রাত্রি, অন্ধকার এবং নগ্ন। আমি অগ্নিশিখার আলোতে পথ চলি, যা রয়েছে আমার দিবাস্বপ্নের ওপরে, যখনই আমার পা ভূমি স্পর্শ করে তখনই একটা ওকগাছ সামনে এগিয়ে আসে।’ 

‘না, তোমার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা আমার মতো নয়, হে পাগল, কারণ এখনও তুমি পেছনের দিকে তাকিয়ে থাকো তোমার বিশাল পদচিহ্নের দিকে যা তুমি বালির ওপর পরিত্যাগ করে এসেছ।’ 

‘আমি তোমার মতো হে নীরব ও গভীর রাত্রি এবং আমার একাকিত্বের হৃদয়ে এক ঈশ্বরী শুয়ে আছে শিশুর বিছানায় এবং তার ভেতরে কে নরকস্পর্শ করে জন্ম নেবে স্বর্গে।’ 

‘না, তোমার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা আমার মতো নয় হে পাগল, কারণ যন্ত্রণা পাওয়ার আগেই তুমি ঠকঠক করে কাঁপতে থাক এবং নরকের সংগীত তোমাকে ভীত করে তোলে।’ 

‘হে রাত্রি, আমি হলাম তোমার মতো, বন্য এবং ভয়াবহ, কারণ আমার কর্ণকুহর বিজিত জাতির কান্না এবং ভুলে যাওয়া ভূমির দীর্ঘশ্বাসে কোলাহলমুখর।’ 

‘না। তোমার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা আমার মতো নয় হে পাগল, কারণ তুমি এখনও তোমার সহযোদ্ধার জন্য গ্রহণ করো ক্ষুদ্র আত্মা এবং তার কিম্ভূতকিমাকার আত্মা কখনও তোমার বন্ধু হবে না।’ 

‘আমি হলাম তোমার মতো হে রাত্রি, নিষ্ঠুর এবং ভয়ংকর কারণ সমুদ্রে ভস্মীভূত জাহাজের কারণে আমার হৃদয় উন্মাতাল এবং আমার ওষ্ঠদ্বয় খুন হওয়া সৈনিকের রক্তে ভেজা।’ 

‘না তোমার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা আমার মতো নয় হে পাগল, কারণ তোমার এখনও আকাঙ্ক্ষা আছে এবং তুমি কোনোদিন স্বয়ং আইনে পরিণত হবে না। 

হে রাত্রি, আমি তোমার মতো হর্ষোৎফুল্ল এবং আনন্দিত; কারণ যে আমার ছায়ায় বসবাস করে, সে এখন পান করে আমার সেই মদ যা কেউ স্পর্শ করেনি, এবং সে-ই আমাকে অনুসরণ করে সহর্ষে পাপ করতে করতে।’ 

‘না তোমার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা আমার মতো নয় হে পাগল, কারণ তোমার আত্মা সাত ভাঁজের অবগুণ্ঠনে মোড়ানো এবং তুমি তোমার দুর্বল হাতে তার হৃদয় ধরতে পারো না।’ 

‘আমি হলাম তোমার মতো হে রাত্রি, ধৈর্যশীল এবং প্রবল আবেগপ্রবণ, কারণ আমার বক্ষে এক হাজার মৃত প্রেমাস্পদকে সমাহিত করা হয়েছে বিবর্ণ চুমুর কাফন পরিয়ে। 

‘হ্যাঁ সত্যিই হে পাগল, তোমার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা আমার মতো? এবং তুমি আরোহণ করতে পারো না ঝড়ের ওপরে ঘোড়ার মতো এবং আঁকড়ে ধরতে পারো না উজ্জ্বলতাকে তরবারির মতো। 

‘তোমার মতো হে রাত্রি, তোমার মতো, পরাক্রমশালী এবং উচ্চতাসম্পন্ন এবং আমার সিংহাসন নির্মিত হয় পতিত ঈশ্বরদের স্তূপের ওপর এবং আমার আগে দিনকে অতিক্রম করতে গিয়ে চুমু খাও আমার বসনপ্রান্তে, কিন্তু স্থিরদৃষ্টিতে কখনও আমার মুখের দিকে তাকাবে না।’ 

‘তোমার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা আমার মতো, হে আমার চূড়ান্ত অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়ের শিশু? এবং তুমি চিন্তা করো আমার সেইসব যা বশ্যতা স্বীকার করেনি, এবং তুমি কথা বলো আমার বিশালতম ভাষায়।’ 

‘হ্যাঁ, আমরা দুজন জমজ ভাই, হে রাত্রি, তুমি চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করো শূন্যতাকে এবং আমি প্রকাশ করি আমার আত্মাকে।’ 

.

অবয়ব 

হাজার সমর্থনপুষ্ট একটা অবয়ব দেখেছি আমি এবং একটি অবয়ব যার ছিল শুধু একটিমাত্র সমর্থন, যেন এটা ছিল একটা ছাঁচের ভেতরে। 

আমি একটা অবয়ব দেখেছি যার দীপ্তি আমি দেখতে পারবো সতর্কতার সাথে কুৎসিতের নিচে এবং একটি অবয়ব যার উজ্জ্বলতা আমি তুলে ধরেছিলাম এটা কত সুন্দর তা দেখতে। 

আমি দেখেছি একটা বৃদ্ধ অবয়ব অসংখ্য রেখায় পরিপূর্ণ কিন্তু তা কিছুই নয় এবং একটি পেলব অবয়ব যেখানে সবকিছুই খোঁদাই করা ছিল। 

আমি অবয়বগুলি চিনি, কারণ আমি আমার নিজের পোশাকের দিকে তাকাই যা আমার নিজের চোখ বয়ন করেছে এবং লক্ষ্য করে দেখি তার নিচে রয়েছে বাস্তবতা। 

.

বৃহত্তর সমুদ্র 

আমি এবং আমার আত্মা বৃহত্তর সমুদ্রে গিয়েছিলাম স্নান করতে এবং আমরা তীরে পৌঁছে একটা গোপন ও নির্জন জায়গার সন্ধান করছিলাম। 

কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম একটা লোক একটা ধূসর পাথরের ওপর বসে আছে এবং তার ব্যাগ থেকে একচিমটি লবণ তুলছে এবং তা ছুড়ে মারছে সমুদ্রের পানিতে। আমার আত্মা বলল, ‘সে হচ্ছে দুঃখবাদী। সুতরাং এ জায়গা থেকে চল, আমরা এখানে স্নান করতে পারি না।’ 

আমরা একটা খাঁড়িতে না-পৌঁছানো পর্যন্ত হাঁটতে লাগালাম। সেখােেন গিয়ে দেখলাম একটা সাদা পাথরের ওপর দণ্ডায়মান এক লোকের হাতে একটা রত্নখচতি বাক্স, যা থেকে সে তুলে আনছে চিনি এবং তা ছুড়ে দিচ্ছে সমুদ্রের পানিতে। 

আমার আত্মা বলে উঠল, ‘সে হল একজন আশাবাদী এবং আমাদের নগ্ন শরীর তার দেখা উচিত নয়।’ 

আবার আমরা হাঁটতে লাগলাম এবং দেখতে পেলাম সমুদ্র সৈকতে এক লোক মরা মাছ তুলে নিচ্ছে হাতে এবং তা আবার ফেলে দিচ্ছে সমুদ্রের পানিতে। 

‘তার সামনে আমরা স্নান করতে পারি না’, আমার আত্মা বলল, ‘সে হল একজন জনহিতৈষী।’ 

আমরা তাকে অতিক্রম করে গেলাম। 

তারপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে দেখতে পেলাম একটা লোক বালির ওপর তার ছায়ার সন্ধান করছে। বিশাল বিশাল ঢেউ আসছে এবং মুছে যাচ্ছে তার ছায়া। কিন্তু সে অনুসন্ধান করছে বারবার। 

আমার আত্মা বলল, ‘তিনি একজন আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি, চলো আমরা তাকে পরিত্যাগ করি।’ 

আমরা হাঁটতে লাগলাম যতক্ষণ না একটা ছোট্ট উপসাগর আমাদের দৃষ্টিসীমার ভেতরে এল। আমরা দেখতে পেলাম এক লোক সমুদ্রের ফেনা সরিয়ে নিয়ে রাখছে মর্মরসদৃশ পাথরে তৈরি পাত্রে। 

আমার আত্মা বলল, ‘সে একজন আদর্শবাদী। অবশ্যই আমাদের নগ্নতা তার দেখা উচিত নয়।’ 

এবং আমরা হাঁটতে হাঁটতে কিছু পথ পেরিয়ে গেলাম। হঠাৎ আমরা শুনতে পেলাম কেউ একজন কাঁদছে, ‘এটা একটা সমুদ্র। এটা একটা গভীর সমুদ্র। এটা একটা বিশাল এবং পরাক্রমশালী সমুদ্র।’ আমরা যখন সেখানে পৌঁছালাম এবং দেখলাম এক লোক, যার পেছনদিকটা সমুদ্রের দিকে ফেরানো এবং তার কানে সে ধরে রেখেছে একটা খোলস- শুনছে এর মর্মরধ্বনি। 

এবং আমার আত্মা বলল, ‘চলো এগিয়ে যাওয়া যাক। সে হল একজন বাস্তববাদী, সে তার পেছনদিকটা সমুদ্রের দিকে ঘুরিয়ে বসে আছে, কারণ সে সমুদ্রকে আঁকড়ে ধরতে পারে না এবং সে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছে একটা খোলসের টুকরোর সঙ্গে।’ 

সুতরাং আমরা তাকে অতিক্রম করে গেলাম এবং আগাছায় ভরা একটা পাথুরে জায়গায় দেখলাম এক লোক নিজের মাথা বালিতে সমাহিত করে রেখেছে। আমি আমার আত্মাকে বললাম, ‘আমরা এখানে স্নান করতে পারি, কারণ সে আমাদের দেখতে পাবে না।’ আমার আত্মা বলল, ‘না, সে হচ্ছে এদের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক। সে হচ্ছে বিশুদ্ধতার সমর্থক।’ 

তারপর আমার আত্মার মুখমণ্ডলের ওপর বেদনার ছায়া নেমে এল, এমনকি তার কণ্ঠস্বরেও এবং সে বলল, ‘চলো এখান থেকে চলে যাই, কোথাও কোনো গোপন এবং নির্জন জায়গা নেই যেখানে আমরা স্নান করতে পারি। আমি এই বাতাসকে আমার সোনালি চুল উড়িতে নিতে দেবনা অথবা উন্মুক্ত করব না আমার শুভ্র বক্ষদেশ এই বাতাসে অথবা আলোকে দেব না উন্মোচন করতে আমার ঐশ্বরিক নগ্নতাকে।’

তারপর আমরা এই সমুদ্র পরিত্যাগ করে আরও বৃহত্তর সমুদ্রের সন্ধান করতে লাগলাম। 

.

জ্যোতির্বিদ 

আমি এবং আমার বন্ধু দেখলাম মন্দিরের ছায়ায় এক অন্ধ লোক একাকী বসে আছে। আমার বন্ধু বলল, ‘ঐ দ্যাখো আমাদের ভূমির সবচেয়ে জ্ঞানী মানুষটা।’ 

তারপর আমি আমার বন্ধুকে পরিত্যাগ করে অন্ধ লোকটির কাছে গেলাম এবং তাকে অভিবাদন জানালাম। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম, ‘আমার প্রশ্নের জন্য ক্ষমা করবেন, কিন্তু কখন আপনি অন্ধ হলেন?’ 

তিনি বললেন, ‘আমি জন্ম থেকেই অন্ধ।’ 

আমি বলললাম, ‘বিচক্ষণতার কোন পথ আপনি অনুসরণ করে থাকেন?’ 

তিনি বললেন, ‘আমি একজন জ্যোতির্বিদ।’ 

তারপর তিনি নিজের বুকে হাত রেখে বললেন, ‘আমি সবকিছুই দেখি সূর্য এবং চন্দ্র এবং নক্ষত্র।’ 

.

বিশাল আকাঙ্ক্ষা 

এখানে আমার ভাই পাহাড় এবং আমার বোন সমুদ্রের মাঝখানে আমি বসে আছি।

নির্জনতায় আমরা তিনজন মূলত একজন এবং ভালোবাসা আমাদেরকে গভীর শক্তিশালী এবং বিস্ময়কর বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। না, এটা আমার বোনের ভালোবাসার গভীরতার চেয়েও গভীরতর এবং আমার ভাইয়ের ভালোবাসার শক্তিমত্তার চেয়েও অধিক শক্তিশালী এবং আমার পাগলামির বিস্ময়ের চেয়েও অধিক বিস্ময়কর। 

অপরিমেয় কালের ওপর বহু অপরিমেয় কাল পার হয়ে গেছে যখন, তখন প্রথম ধূসর সকাল আমাদেরকে পরস্পরের কাছে দৃশ্যমান করে তুলল। যদিও আমরা বহু জন্ম ও পরিপূর্ণতা এবং বহু পৃথিবীর মৃত্যু দেখেছি, কিন্তু তারপরও আমরা উৎসুক এবং তরুণ। আমরা উৎসুক এবং তরুণ এবং আমরা সঙ্গীহীন এবং আমাদেরকে কখনও পরিদর্শন করা হয়নি, যদিও আমরা নিরবচ্ছিন্নভাবে শুয়ে থাকি আধা-আলিঙ্গনের ভেতরে এবং আমাদের এই অবস্থাকে আয়েশহীন বলা যায়। এবং সেখানে নিয়ন্ত্রিত আকাঙ্ক্ষা ও অনিঃশেষিত আবেগের জন্য কীরকম স্বস্তি আছে? কোথা থেকে আসবে সেই অগ্নিবর্ষী ঈশ্বর আমার বোনের বিছানাকে উষ্ণতায় ভরে দিতে? এবং বোন সেই জলধারাকে বহন করে আনবে আমার ভাইয়ের আগুন নেভাতে? এবং কোন সেই নারী যে আদেশ দেবে আমার হৃদয়কে? রাত্রির এই প্রশান্তির ভেতরে আমার বোন ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করবে অগ্নিঈশ্বরের অজ্ঞাত নাম এবং আমার ভাই আহ্বান জানাবে শীতলতার দূরবর্তী ঈশ্বরীকে। কিন্তু আমার ঘুমের মধ্যে আমি কাকে আহ্বান জানাব তা আমি জানি না। 

এখানে আমার ভাই পাহাড় এবং বোন সমুদ্রের মাঝখানে আমি বসে আছি। নির্জনতায় আমরা তিনজন মূলত একজন এবং ভালোবাসা আমাদেরকে গভীর শক্তিশালী এবং বিস্ময়কর বন্ধনে বেঁধে রেখেছে। 

.

ঘাসের ছুরি 

ঘাসের একটা ছুরি শরৎকালের একটা পাতাকে বলল, ‘তুমি অসম্ভব শব্দ করেছ! তুমি ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছ আমার শীতের স্বপ্নগুলিকে।’ 

পাতাটা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, ‘নীচু জন্মের এবং নীচুস্তরে বসবাস। সুরহীন, বিরক্তিকর জিনিস। উপরের বাতাসে তুমি বাঁচবে না এবং তুমি বলতে পারো না গানের শব্দ কেমন। তারপর শরতের সেই পাতাটা মাটিতে শুয়ে পড়ল এবং ঘুমিয়ে গেল এবং বসন্ত এলে সে আবার জেগে উঠল এবং সে ছিল একটা ঘাসের ছুরি। 

এবং যখন শরৎকাল ছিল এবং তার শীতকাল ঘুমিয়েছিল তার ওপরে এবং তারপর বাতাসে পাতা ঝরে পড়েছিল এবং সে নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করেছিল, ‘শরতের পত্রগুচ্ছ, এরা খুবই শব্দ তৈরি করেছে এবং তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে আমার শীতের স্বপ্নগুলি।’ 

.

চোখ 

একদিন চোখ বলল, ‘আমি দেখি এইসব উপত্যকারও ওপরে একটা পাহাড়, নীল ধোঁয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা। এটা কি সুন্দর নয়?’ 

কান এটা শুনল এবং একাগ্রচিত্তে শোনার কিছুক্ষণ পর বলল, ‘কিন্তু কোথায় এরকম পাহাড়? আমি এরকম পাহাড়ের কথা শুনি নাই’ 

তারপর হাত বলল, ‘আমি অনুভব ও স্পর্শ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি এবং আমি কোনো পাহাড় খুঁজে পাইনি।’ 

এবং নাক বলল, ‘ওখানে কোনো পাহাড় নেই। আমি কোনো গন্ধ পাই না।’ 

তারপর চোখটা অন্যদিকে ঘুরল এবং তারা প্রত্যেকেই একত্রে কথা বলতে শুরু করল চোখের এই বিস্ময়কর বিভ্রম সম্পর্কে। তারা বলল, ‘চোখের নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছে।’ 

.

দুই বিদ্বান 

একসময় প্রাচীন নগরী আফকার-এ দুজন বিদ্বান লোক বসবাস করত, যারা পরস্পরকে ঘৃণা এবং পরস্পরের পাণ্ডিত্য সম্পর্কে কটু মন্তব্য করত। কারণ একজন ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করত, অন্যজন ছিল বিশ্বাসী। 

একদিন বাজার এলাকায় তাদের দুজনের দেখা হয়ে গেল এবং তাদের অনুসারীরা বিরোধে জড়িয়ে পড়ল। বিতর্ক শুরু হল ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বহীনতা সম্পর্কে এবং কয়েক ঘণ্টা কলহের পর তারা বিচ্ছিন্ন হল। 

সন্ধ্যায় অবিশ্বাসী মন্দিরে গেল এবং বেদির সম্মুখে প্রণত হল এবং ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা চাইল তার অতীতের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য। 

একই সময়ে অন্য বিদ্বান ব্যক্তি, যে সবসময় ঈশ্বরের সমর্থন করত, সে ঐশ্বরিক গ্রন্থ পুড়িয়ে ফেলল, কারণ সে অবিশ্বাসীতে পরিণত হয়েছিল। 

.

যখন আমার বেদনার জন্ম হল 

যখন আমার বেদনার জন্ম হল, তখন আমি যত্নের সঙ্গে তার পরিচর্যা করলাম এবং তাকে পাহারা দিতে থাকলাম অত্যন্ত স্নেহপরায়ণতার সঙ্গে। 

এবং আমার বেদনা বেড়ে উঠতে লাগল সমস্ত জীবন্ত প্রাণের মতো, শক্তিশালী এবং সুন্দর এবং বিস্ময়কর উজ্জ্বলতায় পরিপূর্ণ। 

এবং আমরা একে অন্যকে ভালোবাসলাম, আমার বেদনা এবং আমি। আমরা ভালোবাসলাম আমাদের পৃথিবীকে, কারণ বেদনার ছিল দয়ালু হৃদয় এবং আমি ছিলাম আমার বেদনার সঙ্গে দয়ার্দ্র। 

যখন আমরা কথা বললাম, অর্থাৎ আমার বেদনা এবং আমি—আমাদের দিনগুলি পাখাযুক্ত এবং রাত্রিগুলি স্বপ্নের বেষ্টনী দিয়ে ঘেরা, কারণ বেদনার ছিল একটা বাকপটু জিভ এবং বেদনার সঙ্গে আমার বাচনভঙ্গি ছিল সুন্দর। 

যখন আমরা একত্রে গান গাইলাম, আমার বেদনা এবং আমি, আমাদের প্রতিবেশীরা তাদের জানালায় বসে তা শুনল, কারণ আমাদের গান ছিল সমুদ্রের মতো গভীর এবং তার সুর ছিল বিস্ময়কর স্মৃতিগুচ্ছে পরিপূর্ণ। 

এবং যখন আমরা একত্রে হাঁটলাম, আমার বেদনা এবং আমি, তখন মানুষ কোমল অথচ স্থিরদৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাল এবং ফিসফিস করে কথা বলতে থাকল, যা চূড়ান্তভাবে মিষ্টি। সেখানে তারাও ছিল, যারা হিংসার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকাল, কারণ বেদনা একটি মহৎ বিষয় এবং আমি আমার বেদনা নিয়ে গর্বিত ছিলাম। 

কিন্তু আমার বেদনার মৃত্যু হল অন্যান্য জীবন্ত প্রাণের মতোই এবং একা আমি পরিত্যক্ত হলাম আমার গভীর চিন্তা ও বিবেচনার কাছে। 

এখন যখন আমি কথা বলি, তখন আমার কথারা খুবই ভারী হয়ে আমার কানে প্রবেশ করে। 

যখন আমি গান গাই, তখন আমার প্রতিবেশীরা তা শুনতে আসে না। 

এবং আমি যখন রাস্তায় হাঁটি কেউ আমার দিকে তাকায় না। শুধুমাত্র আমার ঘুমের ভেতরে আমি একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাই যে করুণামিশ্রিত সুরে বলছে, ‘দ্যাখো, এখানে শুয়ে আছে একজন মানুষ যার বেদনা এখন মৃত।’

.

যখন আমার আনন্দের জন্ম হল 

যখন আমার আনন্দের জন্ম হল তখন আমি তাকে তুলে ধরলাম আমার বাহুর ওপর এবং বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম,’এসো হে আমার প্রতিবেশীরা, এসো এবং দ্যাখো, আমার আনন্দের আজ জন্ম হয়েছে। এসো এবং লক্ষ্য করো এই আনন্দময়তা যা সূর্যালোকে হাসছে।’ 

কিন্তু আমার প্রতিবেশীদের কেউই এল না আমার আনন্দকে দেখতে এবং এ কারণে আমার বিস্ময় ছিল ভয়াবহ। 

এবং সাতটি চন্দ্রমাস জুড়ে প্রতিদিন আমি বাড়ির ছাদ থেকে আমার আনন্দ ঘোষণা করলাম এবং কেউ তা মনোযোগ দিয়ে শুনল না। আমি এবং আমার আনন্দ একা হয়ে গেলাম, সন্ধানহীন এবং পরিদর্শনহীন। 

তারপর আমার আনন্দ মলিন এবং ক্লান্ত হয়ে গেল, কারণ আমি ছাড়া আর অন্য কোনো হৃদয় ছিল না, যে এই ভালোবাসাকে তুলে ধরে এবং কোনো ওষ্ঠ ছিলনা যে এই ভালোবাসার ওষ্ঠকে চুম্বন করে। 

তারপর আমার আনন্দের মৃত্যু হল বিচ্ছিন্নতার ভেতরে। 

এবং এখন আমি শুধুমাত্র আমার মৃত আনন্দকে স্মরণ করি আমার মৃত বেদনার ভেতরে। কিন্তু স্মৃতি হচ্ছে একটা শরতের পাতা, যা মুহূর্তের জন্য ফিসফিস করে বাতাসে এবং তারপর তা আরও অধিক শোনা যায়। 

.

উৎকৃষ্ট পৃথিবী 

হারিয়ে যাওয়া আত্মার ঈশ্বর, তুমি ঈশ্বরদের ভেতরে সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছ। এখন আমার কথা শোনো : স্নেহপরায়ণ নিয়তি আমাদেরকে পর্যবেক্ষণ করছে, পাগল বিস্মিত করছে আত্মাকে। 

এখন আমার কথা শোনো : আমি একটা উৎকৃষ্ট প্রতিযোগিতার মাঝখানে বসবাস করি, যা সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ 

আমি হলাম মনুষ্য বিশৃঙ্খলা, দ্বিধাগ্রস্ত উপাদানের একটি নীহারিকা, আমি চলাচল করি একটা পৃথিবীর ভেতরে যা সম্পূর্ণ করা হয়েছে— সম্পূর্ণকৃত আইন এবং শুদ্ধ নির্দেশের মানুষ; যাদের চিন্তাভাবনা হরেক রকমের, যাদের স্বপ্নগুলি আয়োজনকৃত এবং যাদের দূরদৃষ্টি তালিকাভুক্ত এবং নিবন্ধিত। 

হে ঈশ্বর তাদের পুণ্যগুলি পরিমাপকৃত, পাপগুলি ওজনকৃত, এমনকি গণনাহীন জিনিসগুলি যা না-পাপ না-পুণ্যের অনুজ্জ্বল গোধূলিবেলায় চলাচল করে এবং তা নথিবদ্ধ ও তালিকাভুক্ত। 

এখানে দিন এবং রাত্রিগুলি বিভক্ত হয় আচরণের ঋতুতে এবং শাসিত হয় শুদ্ধতার অভিযোগহীন আইন দ্বারা। 

খাও, পান করো, ঘুমাও, কারও নগ্নতাকে ঢাকো এবং তারপর ক্লান্ত হও সঠিক সময়ে। কাজ করো, খেলো, গান গাও, নাচো এবং তারপর স্থির হয়ে শুয়ে পড়ো যখন ঘড়ি সময়কে ভীতিগ্রস্ত করে তোলে। 

এইভাবে চিন্তা করো, অধিক অনুভব করো এবং তারপর ক্ষান্ত হও চিন্তা ও অনুভব করা থেকে যখন একটি অবশ্যম্ভাবী নক্ষত্র উদিত হয় ঐখানে দিগন্তের ওপরে। 

হাসতে হাসতে প্রতিবেশীর সম্পদ হরণ কর, উপহার প্রদান কর দুই হাতে মার্জিত ঢেউ তুলে, প্রশংসা করো বিচক্ষণতার সঙ্গে, অভিযোগ তুলে ধরো সতর্কভাবে, কথা দিয়ে ধ্বংস করো একটি আত্মা, ভস্মীভূত করো শ্বাসপ্রশ্বাস দিয়ে একটা শরীর এবং তারপর হাত ধুয়ে ফ্যালো দিনের কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হলে। 

ভালোবাসো একটা নির্দেশ হিসেবে যা প্রতিষ্ঠিত, আপ্যায়ন করো কারও শ্রেষ্ঠ আত্মাকে পূর্বধারণাকৃত পদ্ধতিতে। ঈশ্বরের প্রার্থনা করো যথাযথভাবে, ষড়যন্ত্রে ব্যবহার করো অশুভ আত্মার চাতুরী এবং তারপর সবকিছু ভুলে যাও যেভাবে স্মৃতিরা মরে গিয়েছিল। অলীক কল্পনায় ভেসে যাও প্রেরণার বশবর্তী হয়ে, ধ্যান করো বিবেচনার সাথে, সুখী হও মধুরভাবে, যাতনা ভোগ করো সৎভাবে, তারপর তোমার কাপ খালি করে ফ্যালো, কারণ আগামীকাল তা পূর্ণ হতে পারে। 

হে ঈশ্বর, এই সবকিছু ভবিষ্যৎ চিন্তার সাহায্যে ধারণ করা হয়েছিল, জন্ম হয়েছিল দৃঢ়সংকল্পের ভেতরে, পরিচর্যা করা হয়েছিল যথার্থতার সঙ্গে, শাসিত হয়েছিল আইনের সাহায্যে এবং তারপর হত্যা ও সমাহিত করা হয়েছিল একটা ব্যবস্থাকৃত পদ্ধতির পর। এটা হচ্ছে শ্রেষ্ঠ পৃথিবী, উৎকর্ষতার নিখুঁত পৃথিবী, সর্বময় বিস্ময়ের পৃথিবী, ঈশ্বরের বাগানের সবচেয়ে পাকা ফল, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের শ্রেষ্ঠ চিন্তা। 

কিন্তু কেন আমার এখানে থাকা উচিত, হে ঈশ্বর, আমি অপরিপূর্ণ আবেগের একটা সবুজ বীজ, একটি উন্মাদ ঝড় যা সন্ধান করে না পূর্ব ও পশ্চিম, একটি ভস্মীভূত গ্রহের একটি বিভ্রান্ত টুকরো। 

কেন আমি এখানে, হে হারিয়ে যাওয়া আত্মার ঈশ্বর, যার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা ঈশ্বরদের ভেতরেই হারিয়ে গেছে। 

.

ক্রুশবিদ্ধ করে মারা 

আমি মানুষের কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, ‘আমাকে ক্রুশবিদ্ধ করে মেরে ফেলা হবে।’ 

এবং তারা বলল, ‘কেন তোমার রক্ত আমাদের মাথার ওপরে ওঠা উচিত?’ এবং আমি বললাম, ‘পাগলকে ক্রুশবিদ্ধ করে না মারলে তোমরা কীভাবে সম্মানিত হবে? 

এবং তারা মনোযোগী হয়েছিল এবং আমি ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলাম এবং আমার এভাবে মারা যাওয়া আমাকে শান্তি দিয়েছিল। 

পৃথিবী ও স্বর্গের মাঝখানে আমাকে যখন ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তখন তারা মাথা তুলেছিল আমাকে দেখতে এবং তারা সম্মানিত হয়েছিল। কারণ আগে কখনও তাদের মাথা এভাবে উত্তোলিত হয়নি। 

কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে থাকার সময় একজন বলল, ‘তোমার সৌন্দর্য প্রকাশের ক্ষমতা প্রায়শ্চিত্তের সন্ধান করছে।’ 

এবং অন্যজন আর্তনাদ করে উঠল, ‘কী কারণে তুমি আত্মত্যাগ করছ?’ 

এবং তৃতীয় একব্যক্তি বলল, ‘এই মূল্যে তুমি কি একটা মর্যাদাসম্পন্ন পৃথিবী কেনার কথা ভাবছ?’ 

তারপর চতুর্থ ব্যক্তি বলল, ‘লক্ষ্য করো কীভাবে সে হাসে! এরকম বেদনা কি ক্ষমা পাবে?’ 

এবং আমি প্রত্যেকের কথার জবাব দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম : 

শুধুমাত্র স্মরণে রেখ যে আমি হেসেছিলাম। আমি প্রায়শ্চিত্ত করিনি, করিনি আত্মত্যাগ- এমনকি মর্যাদাসম্পন্ন কোনো পৃথিবীর আকাঙ্ক্ষাও নয় এবং আমার ক্ষমা করারও কিছু নেই। আমি তৃষ্ণার্ত এবং আমি সনির্বন্ধ প্রার্থনা করছি তোমাদের কাছে, আমাকে আমার রক্ত দাও পান করার জন্য। কারণ সেখানে কী আছে যা একজন পাগলের তৃষ্ণা মেটাতে পারে তার নিজের রক্ত ছাড়া? আমি ছিলাম বধির এবং আমি তোমাদের বাতাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম সুখের কথা। আমি ছিলাম বন্দি তোমাদের দিন ও রাত্রির মাঝখানে—এবং সন্ধান করেছিলাম বৃহত্তর দিন ও রাত্রির দরজা। 

এবং এখন আমি যাই- যেভাবে অন্যেরা ইতিমধ্যেই ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে এবং চলে গেছে। এবং মনে করনা আমরা ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মরার ব্যাপারে ক্লান্ত। কারণ আমরা অবশ্যই ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা যাব অধিকতর বৃহত্তর মানুষের দ্বারা, বৃহত্তর পৃথিবী ও বৃহত্তর স্বর্গের মাঝখানে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *