পাগলের কাণ্ডজ্ঞান
এবারের কাণ্ডজ্ঞান পাগলের কাণ্ডজ্ঞান। এ বিষয়ে কারও মনে যদি কোনও সংশয় থাকে অনুগ্রহ করে এ-সপ্তাহে কাণ্ডজ্ঞান পড়বেন না।
এক পাগল ভদ্রলোক তাঁর বাড়ির রাস্তার দিকের বারান্দায় বসে একটি জলভরা গামলায় ছিপ ফেলে মাছ ধরছিলেন। পথ দিয়ে যেতে যেতে এই দৃশ্য দেখে কৌতূহলী একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মশায়, ক’টা ধরা পড়ল?’ এর উত্তরে ওই পাগল ভদ্রলোক কী বলেছিলেন তা নিয়ে কিঞ্চিৎ মতভেদ আছে। একটি বিখ্যাত শিশুকাহিনীতে আছে, ওই পাগল ভদ্রলোক দাঁত খিঁচিয়ে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আপনাকে নিয়ে তিনটে। এর আগে আর দুটো বোকা ধরেছি।’
অন্য একটি ততোধিক বিখ্যাত গল্প অনুসারে প্রশ্ন শুনে পাগল ভদ্রলোক লজ্জায় জিব কেটে বলেছিলেন, ‘কী বলছেন দাদা, বারান্দায় গামলার মধ্যে মাছ আসবে কী করে? পাগল নাকি?’
গল্প দুটি দু’রকম। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই বারান্দায় মৎস্যশিকারী পাগল ভদ্রলোককে আপাতদৃষ্টিতে যতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন মনে হয়েছিল, তিনি আসলে তা নন।
এ অবশ্য গল্পের পাগলের কথা কিন্তু বাস্তবজীবনেও সত্যিকারের পাগলের কাণ্ডজ্ঞান কিছু কম নয়।
পাগল দু’রকম। রাস্তার পাগল ও ঘরের পাগল। প্রথমে রাস্তার পাগলের কথা বলি। রাস্তার পাগল মানে ঘরের বাইরের মুক্ত পাগল। প্রত্যেক রাস্তায়, মোড়ে, চৌমাথায়, বাজারে অন্তত একজন করে পাগল আছে। একজন থাকলে অবশ্য বিশেষ কোনও অসুবিধা হয় না, বরং এলাকাটি মোটামুটি বেশ জমজমাট থাকে। কিন্তু পাগলের সংখ্যা একের বেশি হয়ে গেলে অনেক সময় গোলমাল বেধে যায়। একজন পাগল আরেকজন পাগলকে কদাচিৎ সহ্য করতে পারে। নিরীহ, নির্বিরোধী পাগল ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে অনর্গল বিড়বিড় করছে, কারওর ক্ষতি করছে না, তাকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তার পাগলামির বহিঃপ্রকাশ অতি সামান্যই। পাঁচ-সাত মিনিট পর পর রাস্তার যে কোনও মহিলাকে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করে, ‘হ্যালো, জাপান যাচ্ছেন কবে?’
সংগত কারণেই পাড়ার লোকেরা এই লোকটির নাম দিয়েছিল জাপানি পাগল। লোকটি এ পাড়ার লোক নয়, তার পূর্বজীবনের কথা বিশেষ কেউ জানে না। কেউ কেউ বলে স্পাই, কারও ধারণা খবরের কাগজের রিপোর্টার। ভালই ছিল লোকটা। হঠাৎ কোথা থেকে এই পাড়াতেই এক চঞ্চল উন্মাদ এসে উপস্থিত হয়েছে। সে অতিদ্রুত গলির এ-মাথা থেকে ও-মাথা পায়চারি করছে, আর প্রায় প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করছে, ‘টাইম কত?’ কেউ যদি সময় কত বলল, সে গম্ভীর হয়ে তাকে বলছে, ‘তা হলে তো খুব দেরি হয়ে গেল?’ অনেক সময়ই অচেনা ব্যক্তিরা এই রকম বাক্যালাপে একটু ঘাবড়ে যান।
তবুও মোটামুটি চলছিল, কিন্তু গোলমাল বাধল সেদিন, যখন দু’জনেরই খদ্দের এক হয়ে গেল। প্রথমজন যখন এক মহিলাকে কবে জাপান যাবেন বলে প্রশ্ন করছে, দ্বিতীয়জন তার কাছেই টাইম জানতে এল। মহিলাটি অন্য পাড়ার, তিনি দ্রুত পদক্ষেপে গলি ত্যাগ করলেন। কিন্তু দুই পাগল পরস্পরের দিকে রোষকষায়িত লোচনে বহুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর প্রথম পাগল বেশ শান্ত হয়ে হাতজোড় করে বলল, ‘দাদা, এইটুকু ছোট গলি, এখানে দু’জন পাগলের স্থান হবে না’। দ্বিতীয় পাগল কী বুঝল কে জানে, সেই যে পাড়া ছেড়ে চলে গেল আর এল না। প্রথম পাগল এখনও রোদবৃষ্টিতে সেই একই ল্যাম্পপোস্টে দাঁড়িয়ে থাকে এবং কিছুক্ষণ পর পর সম্ভাব্য জাপানযাত্ৰিণীদের কাছে তাদের যাত্রার তারিখ জানতে চেয়ে মিষ্টি হাসে।
দ্বিতীয় পাগলটি অবশ্য এর মধ্যে বড় রাস্তায় পৌঁছে গেছে এবং পাগলামির কলাকৌশল বদল করেছে। এখন সে ট্রাফিক কন্ট্রোল করে। কর্তব্যরত হোমগার্ড বা ট্রাফিক পুলিশকে সাহায্য করার যথাসাধ্য চেষ্টা করে।
কে যেন বলেছিলেন, সমস্ত পাগলেরই মনের বাসনা হল ট্রাফিক কন্ট্রোল করা, এইটাই হল উন্মাদনার সিদ্ধিলাভের শেষ সোপান। কোথা থেকে একটা ছোট লাঠি কুড়িয়ে নেয় এরা, কখনও এক টুকরো কাপড় বা চট জোগাড় করে। কখনও পতাকা উড়িয়ে রেললাইনের পয়েন্টসম্যানের মতো, কখনও ছড়ি নাচিয়ে ড্রিলমাস্টারের মতো এরা ট্রাফিক দমন করে। এইরকম একজন পাগল একজন ঘুমন্ত ট্রাফিক পুলিশের সহায়তায় গত শনিবার সন্ধ্যায় পার্কস্ট্রিটের মোড়ে এমন জটলা পাকিয়ে দিয়েছিল, সেই ট্রাফিকের জট হ্যারিসন রোড পর্যন্ত আটকিয়ে দেয়।
কিন্তু এই দ্বিতীয় পাগলও কাণ্ডজ্ঞানহীন নয়। তার আছে পরিমিতি বোধ, তার আছে এলাকা বোধ। ট্রাফিকের জট পুরো পাকিয়ে গেলে, শিশুর হাতের গুলিসুতোর মতো যখন গাড়িগুলো একেবারে জড়িয়ে যায়, যখন মিনিবাস আর ট্যাক্সিগুলো মর্মভেদী আর্তনাদ করতে থাকে, সে তখন রাস্তা থেকে উঠে আসে, ফুটপাথের উপরে পানের দোকানের আয়নায় নিজেকে লজ্জিতভাবে দেখতে থাকে।
ট্রাফিকবিলাসী পাগলদের এলাকা বোধের কোনও তুলনা নেই। আমাদের পূর্ববর্ণিত পাগল লোকটি বাঙালি যুবক, পার্কস্ট্রিটের মোড় পর্যন্ত সে যাবে, তার ওপারে কখনও সে যাবে না। রিপন স্ট্রিটে, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ট্রাফিকের দায়িত্ব অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পাগলের, সে আবার তার পাড়া ছেড়ে কোনও বাঙালি পাড়ায় যাবে না। মল্লিকবাজারে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে একজন বিহারি মুসলমান পাগল, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে ছেঁড়া জুতো হাতে চিনেম্যান পাগলকে গাড়ি দমন করতে দেখেছি। আর হিন্দুস্থানি হলে তো কথাই নেই, হাওড়া স্টেশন থেকে সোজা নেমে বড়বাজারে; তার আবার ঠেলাগাড়ি, রিকশা এইসবের কন্ট্রোল করার দিকেই ঝোঁক। প্রচণ্ড অধ্যবসায় সহকারে আশিটা স্থাণু ঠেলাগাড়িকে দুই ইঞ্চি দুই ইঞ্চি করে ঠেলে ফাঁক করে, একদিন খুব ভোরবেলা দেখেছি, হিন্দুস্থানি এক পাগল দুটো গলির মুখ সম্পূর্ণ আটকিয়ে বন্ধ করে দিল। তারপর সেই আশিটা ঠেলাগাড়ির ফাঁক বুজিয়ে গলির মুখ খোলা, সে এক অসম্ভব অবস্থা।
তবু রাস্তার পাগল ভাল। রাস্তার পাগল দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তাকে রাতদিন পাবলিকের সঙ্গে মেলামেশা করে চলতে হয়, অনেক ঘা খেয়েছে সে, তাকে না ঘাঁটালে সে কখনওই খুব বিপজ্জনক হবে না।
কিন্তু ঘরের পাগল সাংঘাতিক হতে পারে। বন্ধুর বাড়ির দরজার কলিংবেল টিপে অপেক্ষা করছেন, এমন সময় পাশের বাড়ির পাগল পা টিপে টিপে পিছনে এসে আচমকা আপনার গলা টিপে ধরল, এ রকম অনায়াসেই হতে পারে।
ঘরের পাগল শুধু বাড়িতে নয়, অফিসেও আছে। একটা অফিসের খ্যাতি ও প্রতিপত্তি নির্ভর করে সেই অফিসে কতজন নির্ভরযোগ্য পাগল আছে তার উপরে। অনেকে হয়তো জানেন না বহু পুলিশের দারোগা পাগল। দু’জন উন্মাদ বড়বাবু আর একজন পোস্টমাস্টারকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। বহুতল বাড়িগুলির লিফটম্যানদের মধ্যে অন্তত শতকরা পঁচিশজন পাগল, কেবল টেনে টেনে ভুরুর লোম (নিজের) ছিঁড়ছে আর বিড়বিড় করছে অথবা মিটমিট করে হাসছে, সাততলা বললে তেরোতলায় নামিয়ে দিচ্ছে।
কিন্তু তবুও লিফট ওঠানামা করছে, থানা-পুলিশ অফিস-কাছারি যা হোক করে চলছে, ডাক বিলি হচ্ছে। পাগলের কাণ্ডজ্ঞান আছে বলেই না এসব সম্ভব হচ্ছে।
দুঃখের বিষয়, রাজ্য বিদুৎ পর্ষদে বা হরিণঘাটা দুধের ডেয়ারিতে কোনও পাগল নেই, তাই তাদের আজ এত বেহাল, এত দুরবস্থা।