পাগলা প্লেটো
১
দশরথ স্টেডিয়ামে ইন্ডিয়ান ফুটবল টিমের প্র্যাকটিস আছে৷ সেখানে গিয়ে কোচ ভাইচুং ভুটিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য বেরিয়েছি৷ হোটেলের বাইরে পা দিতেই দেখলাম, কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেছে৷ কাঠমান্ডু শহরে এই একটা অসুবিধে৷ জুলাই-অগস্ট মাসে যখন- তখন আকাশের মুখ গোমড়া হয়ে থাকে৷ এই ঝকঝকে রোদ্দুর—তো এই রিমঝিম বৃষ্টি৷ যে হোটেলে আছি, সেখান থেকে স্টেডিয়ামের দূরত্ব শ’তিনেক মিটার৷ হেঁটেই চলে যাব কিনা ভাবছি৷ আবার ভয়ও পাচ্ছি, সর্বত্র এমন বানরের উৎপাত৷ হোটেলের রিসেপশনিস্ট বেরোনোর সময়ই বলে দিয়েছেন, অসতর্ক হয়ে রাস্তায় হাঁটবেন না৷ খাবারের আশায় বানররা ব্যাগ-ফ্যাগ ছিনতাই করে নিতে পারে৷
কাল রাতে স্থানীয় টিভিতে বানরদের নিয়ে খবর দেখাচ্ছিল৷ নেপালি ভাষা ভালো বুঝিনি৷ তবে শুনে মোটামুটি মনে হল, তিন-চারদিন ধরে কাঠমান্ডুতে নাকি বানরের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে৷ আগে শুধু মন্দির চত্বরগুলোতেই ওদের দেখা যেত৷ বিশেষ করে, স্বয়ম্ভু মন্দির আর পশুপতিনাথ মন্দিরে৷ ইদানীং নাকি হোটেলগুলোতেও ওরা উঁকিঝুঁকি মারছে৷ তিরিশ বছর ধরে বানরদের নিয়ে রিসার্চ করেছেন এমন একজন বিশেষজ্ঞকে টিভিতে নিয়ে এসেছিল৷ উনি বললেন, ‘শুনেছি, কাছাকাছি জঙ্গলগুলো থেকে বানররা দলে দলে শহরে ঢুকে পড়ছে৷ খাবারের অভাবে ওরা জঙ্গল ছাড়ছে, নাকি অন্য কোনো কারণে, তা নিয়ে প্রশাসনের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত৷ না হলে ওদের অত্যাচারে পর্যটন ব্যবসা মার খাবে৷’
দু’দিন হল কাঠমান্ডু এসেছি৷ দু’চারবার রাস্তায় যাতায়াত করার ফাঁকে আমিও লক্ষ করেছি, সত্যিই রাস্তায় রেলিংয়ে, বাড়ির কার্নিশে, এমনকী বাসের ছাদেও বানরদের অবাধ বিচরণ৷ এমনিতে কাঠমান্ডুর বানরেরা সাইজে খুব বড়ো না৷ দেখলেই মনে হয় অপুষ্টিতে ভুগছে৷ কিন্তু শয়তানিতে মাস্টার৷ টিভির বিশেষজ্ঞ আলোচনায় অবশ্য দোষ চাপালেন পর্যটকদের উপরেই৷ বললেন, ট্যুরিস্টরা অনবরত জাঙ্ক ফুড খাওয়ানোর জন্যই নাকি বানরদের স্বাস্থ্য এত খারাপ৷ জাঙ্ক ফুড বলতে বিস্কুট, কেক, ন্যুডলস, চিপস, কোল্ড ড্রিংক৷ মন্দির চত্বরে সহজেই এই খাবারগুলো বানররা পেয়ে যায়৷ তাই খুব অলস হয়ে গেছে৷ এমনিতে বানরদের আয়ু পনেরো বছরের মতো৷ কিন্তু কাঠমান্ডুর বানররা দশ বছরের বেশি বাঁচে না৷
হোটেলের রাস্তায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনস্থির করে নিলাম, রিকশা করেই দশরথ স্টেডিয়ামে যাব৷ একটা রিকশা থামিয়ে উঠতে যাব, এমন সময় পেছন থেকে কে যেন ডাকল, ‘কালকেতু, তুই এখানে?’
ঘুরে তাকিয়ে দেখি, পাগলা প্লেটো৷ পরনে ময়লা একটা ট্র্যাকস্যুট৷ উস্কোখুস্কো চুল৷ কেমন যেন উদভ্রান্তের মতো চেহারা৷ এই পাগলা প্লেটো আমার সঙ্গে স্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত পড়েছে৷ স্কুল লাইফ থেকেই খেলাধুলোয় ওর প্রচণ্ড উৎসাহ৷ বিশেষ করে, ফুটবল৷ নিজে খেলত গোলকিপার পজিশনে৷ কিন্তু ওর খেলোয়াড় জীবনে খুব বেশিদূর এগোয়নি৷ কলেজেই আচমকা থেমে গেছিল৷ প্রায় দশ বছর বাদে ওর সঙ্গে দেখা৷ হনহন করে হেঁটে এসে ও বলল, ‘তোকে এখানে দেখব, আশাই করিনি ভাই৷ বেড়াতে এসেছিস নাকি?’
বললাম, ‘না রে৷ এশিয়া কাপের ম্যাচ খেলার জন্য ইন্ডিয়া টিম এখন এখানে৷ ম্যাচটা আমি কভার করতে এসেছি৷’
পাগলা প্লেটো বলল, ‘আরে, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম, তুই এখন ক্রীড়া সাংবাদিক৷ তা, এখনও ফুটবল রিপোর্টিং নিয়ে পড়ে আছিস বুঝি? হবে না, ফুটবলে ইন্ডিয়ার কিস্যু হবে না৷ তোরা ফালতু সময় নষ্ট করছিস৷ কী জানিস, খেলার মাঠে আমরা ভারতীয়রা এক-একজন খুব ভালো৷ কিন্তু ভারতের হয়ে যখন আমরা টিম হিসাবে খেলি, তখন খুব খারাপ৷ কি, আমি ঠিক বলছি?’
প্রশ্নটা শুনে মনে হল, পাগলা প্লেটো একদম বদলায়নি৷ আগের মতোই আছে৷ স্কুল-কলেজে খেলা নিয়ে কোনো আলোচনা উঠলে ও অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলত৷ সে সব উচ্চমার্গের তত্ত্বকথা৷ ওই বয়সে আমরা সে-সব হজম করতে পারতাম না৷ কথাগুলো বলেই ও জিজ্ঞেস করত, ‘কি, আমি ঠিক বলছি?’ তারপর উত্তরের আশায় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত৷ ‘হ্যাঁ’ বললে কোনো সমস্যা হত না৷ কিন্তু ‘না’ বললেই ঘোরতর বিপদ৷ আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তির জাল বিস্তার করে পাগলা প্লেটো আমাদের মাথা খারাপ করে দিত৷ এই এখন যদি আমি বলি, ‘না, তুই ঠিক বলছিস না৷ তোর কথাই যদি ঠিক হত, তা হলে আমাদের ক্রিকেট টিমটা তিন-তিনবার বিশ্বকাপ জিতত না৷’ তা হলেই সর্বনাশ! ভাইচুং ভুটিয়ার ইন্টারভিউ নেওয়া আমার লাটে উঠবে৷ কাঠমান্ডুর রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাগলা প্লেটো এমন লেকচার দেবে, দশরথ স্টেডিয়ামে আমার আর যাওয়াই হবে না৷
বাঁচার জন্য ঘাড় নেড়ে সমর্থন জানালাম৷ তারপর বললাম, ‘তুই এখানে? অফিসের কাজে নাকি?’
পাগলা প্লেটো হেসে বলল, ‘তোকে কে বলল আমি চাকরি করি? চাকরি-ফাকরি করা মানে…অন্যের জন্য গোলামি করা৷ আমার বাপ-ঠাকুরর্দা যা রেখে গেছেন, তাতে আমার দিব্যি চলে যাচ্ছে৷ তিন-চারদিন আগে আমি এখানে এসেছি৷ উঠেছি কাছেই একজনের গেস্ট হাউসে৷’
‘তাহলে এখানে করছিসটা কী?’
‘রিসার্চ করছি৷ আর সেই সূত্রেই কাঠমান্ডু আসা৷’
কলেজ জীবনের পর পাগলা প্লেটোর সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেছিল৷ ও রিসার্চ করছে শুনে খুব শ্রদ্ধা হল৷
বললাম, ‘কী নিয়ে রিসার্চ?’
‘এটা একটা প্রশ্ন হল কালকেতু! রিসার্চ…অবশ্যই আমার প্রিয় সাবজেক্ট খেলা নিয়ে৷ আমাদের দেশে খেলার জন্য প্রচুর টাকা খরচ হয়৷ কিন্তু, খেলা নিয়ে রিসার্চের জন্য কেউ একটা পয়সাও খরচা করতে চায় না৷ আর এই কারণেই আমরা এত পিছিয়ে৷’
কথাটা সত্যি৷ বললাম, ‘হঠাৎ তোর এই ইচ্ছেটা হল?’
‘হঠাৎ নয়, অনেকদিন ধরেই এই ইচ্ছেটা ছিল৷ কলেজে তুই নিশ্চয়ই দেখেছিস, খেলা নিয়ে আমি কীরকম পড়াশোনা করতাম৷ পাশ করে বেরোনোর পর আমার বাবা আর মা, একমাসের ব্যবধানে মারা গেলেন৷ নিজের বলতে আমার আর কেউ রইল না৷ তুই তো জানিস, ফুটবলার হওয়ার এত ইচ্ছে ছিল…হতে পারলাম না৷ কোচ হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম৷ কেউ সুযোগই দিল না৷ তখনই মনে হল, খেলা নিয়ে রিসার্চ করলে কেমন হয়? রিসার্চ করলে তো আর কারও দয়ায় থাকতে হবে না৷’
ও কী নিয়ে গবেষণা করছে, প্রশ্নটা করতেই প্লেটো বলল, ‘ভেরি সিম্পল৷ কোন খেলাটা আমাদের…মানে ভারতীয়দের খেলা উচিত, আমার রিসার্চ তা নিয়ে৷ এমন একটা দেশজ খেলা নিয়ে রিসার্চ, আমরা একটা সময় যাতে বিশ্বের সেরা ছিলাম, আর এখনও হতে পারি৷’
‘তুই ক্রিকেটের কথা বলছিস?’
‘ধুস, ক্রিকেট কি আমাদের দেশজ খেলা? কী পাগলের মতো কথা বলছিস? ওই খেলাটা তো আমাদের ইংরেজরা শিখিয়েছে৷ মাত্তর দশ-বারোটা দেশ খেলে৷’ ক্রিকেটের প্রসঙ্গটা একেবারে উড়িয়ে দিয়ে পাগলা প্লেটো আরও বলল, ‘আমি আর্চারি…মানে তিরন্দাজি…মানে আমাদের খাঁটি দেশজ খেলার কথা বলছি৷ ভাব তো, সেই পুরাণের আমল থেকে দ্বাপর যুগ পর্যন্ত কত বিশ্বসেরা তিরন্দাজ আমাদের দেশে জন্মেছেন! শ্রীরামচন্দ্র, ভীষ্ম, দ্রোণ, অর্জুন, দুর্যোধন, কর্ণ, রাবণের ছেলে মেঘনাদ…কত নাম বলব? সময়ের চাকা ঘুরিয়ে ইচ্ছে করলে, এই খেলাটায় জোর দিয়ে আমরা তো আরও অর্জুন, আরও কর্ণ, আরও মেঘনাদ তৈরি করতে পারি৷ কথাটা ভেবে, রিসার্চের একটা বিষয় পেয়ে যেতেই, আমি রামায়ণ-মহাভারত নিয়ে পড়াশোনা শুরু করে দিলাম, বুঝলি৷’
শুনে এবার আমার অস্বস্তি হতে লাগল৷ এই রে, পাগলা প্লেটো যদি রামায়ণের গল্প শুরু করে তাহলে নিস্তার নেই৷ আমাকে শুনে যেতে হবে৷ ও ছাড়বে না৷ ইতিমধ্যেই রিকশাটাকে ও ভাগিয়ে দিয়েছে৷ আমাকে আরও বিপদে ফেলল প্রকৃতি৷ টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল৷ রাস্তার ধারে একটা ক্যাফেটোরিয়া দেখিয়ে পাগলা প্লেটো বলল, ‘চল, ওখানে গিয়ে বসি৷ আমার রিসার্চের বিষয়টা হাতে গোনা কয়েকজন মাত্র জানে৷ কিন্তু আমার এক্সপেরিমেন্ট, সম্পর্কে কেউ কিচ্ছু জানে না৷ তোকে বলে যেতে চাই৷ তুই বুঝতে পারবি৷’
রেহাই পাওয়ার জন্য একবার মিনমিন করে বললাম, ‘তোর রিসার্চের বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং৷ পরে কখনও শুনব৷ এখানে আছিস তো ক’দিন৷’
শুনে মুখটা করুণ করে পাগলা প্লেটো বলল, ‘জানি না রে৷ এখানে একটা মারাত্মক ঝামেলায় পড়ে গেছি৷ বুঝতে পারছি না, আর কোনোদিন তোর সঙ্গে দেখা হবে কিনা? যা বলার তোকে এখনই বলে রাখি৷ পারলে কখনও আমাকে নিয়ে লিখিস৷ আমি জানি, তোর লেখা লোকে খুব পড়ে৷’
এর পর ওকে আর এড়ানো যায় না৷ অগত্যা দুজনে মিলে ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে পড়লাম৷ পাগলা প্লেটো কফি আনতে গেল৷ ওর দিকে তাকিয়ে মনটা সহানুভূতিতে ভরে গেল৷ জগতে এমন অনেক মানুষ আছে, যারা সারাজীবন শুধু চেষ্টাই করে যায়৷ যোগ্যতা, আন্তরিকতা আর নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও সফল হয় না৷ পাগলা প্লেটো হচ্ছে সেই ধরনের মানুষ৷ ওর আসল নাম রথীন সমাদ্দার৷ ওকে প্লেটো নামটা দিয়েছিলেন আমাদের কলেজের গেমস ইন চার্জ দালাল স্যার৷ ব্যঙ্গ করেই দিয়েছিলেন, গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর নামে৷ রথীন ওই বয়সেই স্যারের কোচিংয়ের ভুল ধরত৷ বলত, ‘স্যার তিন স্ট্রাইকারকে নিয়ে টিম সাজাচ্ছেন৷ কোনো দরকার নেই৷ দেখবি, ফুটবলে এমন একটা দিন আসবে, যখন স্ট্রাইকারদের সংখ্যা কমে যাবে৷ কোচরা এক স্ট্রাইকার নিয়ে টিম খেলাবে৷’
কথাটা কেউ বোধহয় দালাল স্যারের কানে তুলে দিয়েছিল৷ উনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এত জ্ঞানগর্ভ কথা না বলে, ওকে নিজের খেলায় মন দিতে বল৷ নিজেকে ও কী মনে করছে, ফুটবলের প্লেটো? গাধাটা নিজে রোজ বাজে বাজে গোল খাওয়াচ্ছে, অথচ অন্যের ভুল ধরতে ব্যস্ত৷ এবার কিন্তু ওকে টিম থেকে বাদ দিয়ে দেব৷’
সেই থেকে আড়ালে-আবডালে রথীনের নাম হয়ে গেল প্লেটো৷ দালাল স্যার খুব শিগগিরই ওকে বাদ দেওয়ার সুযোগটা পেয়ে গেছিলেন৷ সেবার ইলিয়ট শিল্ডে আমাদের ফাইনাল খেলা হেরম্বচন্দ্র কলেজের বিরুদ্ধে৷ হাফ টাইমের আগেই আমাদের টিম হাফ ডজন গোলে পিছিয়ে৷ রথীন একটা করে বাজে গোল খাচ্ছে, আর স্যার দাঁত কিড়মিড় করছেন৷ সেই যে ওকে টিম থেকে বসিয়ে দিলেন, আর কখনও ডাকেননি৷ রথীন কিন্তু অত গোল খাওয়ার পরও বিন্দুমাত্র অপরাধবোধে ভোগেনি৷ সেই রাত্তিরে আমার এবং আরও কয়েকজনের বাড়িতে গিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়েছিল, কোন গোল কোন ডিফেন্ডারের দোষে হয়েছে৷ এর পরই ওর প্লেটো নামের আগে পাগলা কথাটা জুড়ে যায়৷
দু’হাতে কফির কাপ নিয়ে এসে পাগলা প্লেটো আমার উলটো দিকে বসল৷ ওর মুখ খুশিতে চকচক করছে৷ সেই দিকে তাকিয়ে আমার মন বলল, এই ছেলেটা কি সত্যিই পাগল? প্রতিভাবানদের মধ্যে একটু-আধটু পাগলামি থাকেই৷ আমাদের যেটা পাগলামি বলে মনে হয়, সেটা আসলে প্রতিভার লক্ষণ৷ জিনিয়াসরা সময়ের অনেক আগে-আগে ভাবে৷ ওকে দেখে মনে পড়ল, সেই কলেজের দিনগুলোয় প্লেটো তো ঠিকই বলত, ‘ফুটবলে এমন একটা দিন আসবে, যখন স্ট্রাইকারদের সংখ্যা যাবে৷ কোচেরা এক স্ট্রাইকার নিয়ে টিম খেলাবে৷’ এখন তো বিশ্বের বড়ো বড়ো টিম লোন স্ট্রাইকার নিয়ে খেলছে৷ একবার শুনিই না, প্লেটো কী বলতে চায়৷ তাই কফিতে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোর রিসার্চ কোন স্টেজে আছে রে?’
পাগলা প্লেটো বলল, ‘প্রায় কমপ্লিট করে ফেলেছি৷ কিন্তু কেউ আমার পেপার নিতে চাইছে না৷ মোদ্দা ব্যাপারটা তোকে বলি৷ কলেজেও তোদের বারবার একটা কথা বলতাম৷ চ্যাম্পিয়ানরাই চ্যাম্পিয়ান হয়৷ কথাটা তোদের মাথায় ঠিক ঢুকত না৷ আমার মতে, যে খেলায় যে দেশের একটা ঐতিহ্য আছে, সেই দেশের উচিত, সেই খেলায় জোর দেওয়া৷ তাতে ফল মিলতে বাধ্য৷ যেমন ধর, ফুটবলে ব্রাজিলের একটা ঐতিহ্য আছে৷ ওই খেলাটায় ওরা জোর দেয় বলেই এতবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ান৷ কি, আমি ঠিক বলছি?’
পালটা যুক্তি অবশ্য দেওয়া যায়৷ কিন্তু, ঠিকই করেছি, কোনো প্রতিবাদ করব না৷ ভাইচুংরা বোধহয় এতক্ষণে প্র্যাকটিসে নেমে গেছে৷ বৃষ্টি বাড়লে বেশিক্ষণ প্র্যাকটিস না করে হোটেলেও ফিরে যেতে পারে৷ সে ক্ষেত্রে ওদের ধরতে হবে হোটেলে গিয়ে৷ সিদ্ধান্তটা নিয়ে পাগলা প্লেটো আর কী বলে, তা শোনার জন্য ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম৷ কফিতে চুমুক দিয়ে ও বলল, ‘আর্চারি…মানে তিরন্দাজি আমাদের চার হাজার বছরের ঐতিহ্য৷ এই খেলাটাকেই আমাদের আঁকড়ে ধরা উচিত৷ এই একটা খেলা আমাদের দেশকে অলিম্পিকের পদক তালিকায় প্রথম কুড়িটা দেশের মধ্যে তুলে নিয়ে যেতে পারে৷ কালকেতু তুই তো রিও অলিম্পিক কভার করতে গেছিলি৷ বল তো, পদক তালিকায় উনিশ নম্বরে কোন দেশটা ছিল?’
ভাগ্যিস মনে ছিল৷ বললাম, ‘নিউজিল্যান্ড৷’
‘ঠিক বলেছিস৷ ওরা চারটে সোনার পদক জিতেছিল বলে প্রথম কুড়ির মধ্যে থাকতে পেরেছিল৷ কেন নিউজিল্যান্ডের তুলনাটা টানলাম, এবার তোকে বলি৷ অলিম্পিক আর্চারিতে অ্যাদ্দিন মোট সোনার পদক ছিল চারটে৷ পরের বার…টোকিও অলিম্পিকে বেড়ে গিয়ে হবে পাঁচ৷ কেননা, মিক্সড ডাবলস বলে একটা ইভেন্ট বাড়ছে৷ যদি সব ক’টা সোনা ভারত জেতে, তা হলে টোকিওতে নির্ঘাত প্রথম কুড়ি-পঁচিশটা দেশের মধ্যে থাকবেই৷ এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস৷ কি, আমি ঠিক বলছি?’
আমতা-আমতা করে বললাম, ‘কোনো দেশের পক্ষে কি একটা খেলায় সবগুলো সোনার পদক জেতা সম্ভব? তোর কী মনে হয়?’
‘আলবাত সম্ভব৷ আমি প্রমাণ দিতে পারি৷ মেদিনীপুরে আমার অ্যাকাডেমিতেই এমন কয়েকজন তৈরি হচ্ছে, যারা তুড়ি মেরে সোনা আনতে সক্ষম৷’
কথাগুলো বলে পাগলা প্লেটো আমায় বিশদ বলতে লাগল, মেদিনীপুরে দেশের বাড়ির কাছে ও একটা আর্চারি অ্যাকাডেমি খুলেছে৷ গত পাঁচ বছর ধরে নিজেই তাদের ট্রেনিং দিচ্ছে৷ অ্যাকাডেমি খোলার আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় একবছর থেকে ও কোচের ডিগ্রি নিয়ে এসেছিল৷ ওর লক্ষ্য, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ান তিরন্দাজ তৈরি করা৷ আমেরিকা থেকে ভালো-ভালো সরঞ্জাম আনিয়েছে৷ ফাইবার গ্লাসের ধনুক, কার্বনের তির৷ ধনুকের দামই এক-একটা লাখ টাকা৷ ছাত্রদের উন্নতি দেখে নাকি পাগলা প্লেটো ভীষণ আশাবাদী৷ প্র্যাকটিসে এখনই ছাত্ররা অলিম্পিক পদকজয়ীদের সমান স্কোর করছে৷ অ্যাকাডেমি চালাতে গিয়ে ইতিমধ্যেই ওর এক কোটি টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে৷
এত টাকা পেলি কোথায়? প্রশ্নটা করতেই পাগলা প্লেটো বলল, ‘কলকাতার শ্যামবাজারে আমাদের যে বিরাট বাড়িটা ছিল, সেটা বিক্রি করে দিয়েছি৷ তুই তো ওখানে বেশ কয়েকবার গেছিস৷ বুঝলি, পুরো টাকাটাই আমি ঢেলেছি অ্যাকাডেমির পেছনে৷ তার জন্য আমার কোনো আক্ষেপ নেই৷ আমার স্বপ্নপূরণ হবে ছাত্রদের মধ্যে কেউ যদি অলিম্পিকে গিয়ে সোনা জিততে পারে৷’
প্লেটোর মাথা কি সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে! ইস, শ্যামবাজারের ওইরকম একটা বনেদি বাড়ি বিক্রি করে দিল! বাড়িটার সামনে বড়ো ফোয়ারার মতো ছিল৷ তার উলটোদিকে ঘোড়ার আস্তাবল৷ আমরা যখন দেখেছি, তখন ওটা গাড়ি রাখার গ্যারেজ হয়ে গেছিল৷ বাড়ি বিক্রির কথাটা শুনে আমার মন খারাপ হয়ে গেল৷ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে পাগলা প্লেটো বলতে লাগল, আমার অ্যাকাডেমি নিয়ে তুই লিখতে পারিস কালকেতু৷ দেখলে ব্যোমকে যাবি৷ রামায়ণের যুগে যে ধরনের ট্রেনিং সেন্টার হত, লোকালয় থেকে অনেক দূরে, আমারটাও ঠিক সেই রকম৷ তোর কি মনে আছে, অস্ত্রবিদ্যায় রাম-লক্ষ্মণদের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য বিশ্বামিত্র মুনি ওদের বনে নিয়ে গেছিলেন? আমার সেন্টারটা তেমনই৷ মেদিনীপুরে নয়াগ্রাম বলে একটা জায়গায় আমাদের আদি বাড়ি৷ তার চারপাশে ঘন বন৷ আমার অ্যাকাডেমিটা সেই বনের ভিতরে৷’
শুনে খটকা লাগল৷ তাই কি? আমি যদ্দূর জানি, রাজা দশরথের কাছ থেকে বিশ্বামিত্র মুনি রামচন্দ্রদের চেয়ে নিয়ে গেছিলেন, তাঁর আশ্রমে রাক্ষসদের উৎপাত বন্ধ করার জন্য৷ কিন্তু, কথাটা বললেই পাগলা প্লেটো প্রতিবাদ করবে, ‘না রে, তুই ঠিক বলছিস না৷ রাক্ষসদের এগেনস্টে রাম-লক্ষ্মণরা কীরকম পারফর্ম করে, সেটা পরখ করার জন্যই বিশ্বামিত্র মুনি ওদের নিয়ে যান৷ ওটাও ট্রেনিংয়ের একটা অঙ্গ৷’
বললাম, ‘তোর অ্যাকাডেমিতে কত ছাত্র আছে?’
‘এখন দশজন৷ সব ঝাক্কাস আর্চার৷ ওদের একজনকে আমি কাঠমান্ডুতেও নিয়ে এসেছি৷ ইচ্ছে করলে তুই তাকে দেখতে আসতে পারিস৷’
‘যাকে এনেছিস, সে কি কোনো কম্পিটিশনে নেমেছে? কী নাম রে?’
‘নাম ফ্যান্টা৷ না, ও কম্পিটিশনে নামেনি৷ ওকে নামতে দেওয়া হয়নি৷’
‘নামতে দেওয়া হয়নি কেন?’
‘আমার আর্চারদের অপরাধ, ওরা মানুষ নয়৷ হনুমান…রেহসাস মাংকি৷ দেখতে একেবারে মানুষের মতো৷ দক্ষতাতেও কম যায় না৷ মেদিনীপুরের জঙ্গলে ওদের আকছার দেখা যায়৷’
শুনে হাঁ করে আমি পাগলা প্লেটোর দিকে তাকিয়ে রইলাম৷
২
কাঠমান্ডু আসার আগে সুদীশ আমায় অনুরোধ করেছিল, ‘ওখানে খাঁটি রুদ্রাক্ষের মালা পাওয়া যায়৷ যদি সময় পাস, আমার জন্য কিনে আনিস কালকেতু৷’
সুদীশ নাগ হল আমার বন্ধু৷ লালবাজারের বিরাট পুলিশ অফিসার৷ রহস্যভেদের ব্যাপারে আমাকে প্রচুর সাহায্য করে৷ ‘যদি সময় পাস’, কথাটা বিনয় করে বলা৷ সুদীশ ভালোমতন জানে, ও কোনো অনুরোধ করলে, আমি সেটা রাখবই৷ ও বলে দিয়েছিল, ‘ভালো রুদ্রাক্ষের মালা পশুপতিনাথ মন্দিরের ভিতর পাওয়া যায়৷ পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ পেলে তবেই নিবি৷ কিন্তু মালা যেন চুরাশিটার কম অথবা একশো ন’টার বেশি রুদ্রাক্ষের না হয়৷’
সাতসকালে সেই রুদ্রাক্ষের মালা কিনতেই বেরিয়েছি৷ বানরের ভয়ে কোনো ব্যাগ সঙ্গে নিইনি৷ এর আগে বারদুয়েক কাঠমান্ডু ঘুরে গেছি৷ কিন্তু কাজের চাপে দু’বারই পশুপতিনাথ মন্দিরে যাওয়ার সময় পাইনি৷ কলকাতায় যে-ই শুনছে অবাক হয়ে গেছে৷ এত বিখ্যাত একটা মন্দিরে যাননি? কী লোক আপনি! পশুপতিনাথ আসলে শিব৷ কত রকমের গাথা এই মন্দির নিয়ে৷ একবার নাকি শিব আর পার্বতী বেড়াতে আসেন হিমালয়ের এই উপত্যকায়৷ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যান৷ দুজনে হরিণের দেহ ধারণ করে এই অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করেন৷ তখন থেকেই শিব পশুদের রক্ষাকর্তা৷ অর্থাৎ কিনা পশুপতিনাথ৷
আর-একটা মিথ আছে এই মন্দির ঘিরে৷ গোমাতা কামধেনু না কি স্বর্গ থেকে এখানে এসে বিশেষ একটা স্থানে রোজ নিজে থেকে দুধ দিয়ে যেতেন৷ কিছু লোক সেটা দেখে কৌতূহলী হন৷ কামধেনু কাকে দুধ দিচ্ছেন? তাঁরা সেই জায়গাটা খুঁড়ে একটা শিবলিঙ্গ আবিষ্কার করেন৷ পরে ধুমধাম করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ তার পর থেকে শিবরাত্রি পালন এই মন্দিরের প্রধান উৎসব৷
মন্দির ঘিরে রকমারি প্রচুর দোকান৷ সেখানেই পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষের খোঁজ করছি সুদীশের জন্য৷ হঠাৎ দেখি, সিঁড়ি দিয়ে পাগলা প্লেটো উঠে আসছে৷ আজ দেখলাম, ওকে একটু ভদ্রসভ্য লাগছে৷ পরনে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি আর পায়জামা৷ মন্দিরে পুজো দেওয়ার জন্য সকালে স্নান করে নিয়েছে৷ মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো৷ গতকাল ওর সঙ্গে কথা বলার সময় লক্ষ করিনি৷ চোখে পড়ল, ওর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলছে৷ মুখোমুখি হতেই পাগলা প্লেটো সেই একই প্রশ্ন করল, ‘তুই এখানে?’
মন্দিরে আসার কারণটা বললাম৷ শুনে প্লেটো বলল, ‘এইমাত্তর আমি একটা কিনলাম৷ এই দ্যাখ, একমুখী রুদ্রাক্ষের মালা৷ মন্দির চত্বরে ঢুকেই দ্বিতীয় দোকান থেকে৷ দেখবি, একজন থুত্থুড়ে বুড়ি বসে বিক্রি করছে৷ দামটা একটু বেশিই নিল৷ কী আর করা যাবে!’
সুদীশ বারবার আমায় বলে দিয়েছিল, একমুখী রুদ্রাক্ষ খুব কম পাওয়া যায়৷ পেলেও তুই কিন্তু কিনবি না৷ কেউ একমুখী রুদ্রাক্ষ ধারণ করলে, সে নাকি দশ দিনের মাথায় সমাজ-সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ তাকে একাকিত্ব গ্রাস করে৷ পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষই বেস্ট৷ শরীরের রক্তচাপ ঠিক রাখতে সাহায্য করে৷ স্নায়ুগুলো সতেজ রাখে৷ কথাগুলো পাগলা প্লেটোকে বলব কিনা ভাবছি৷ এমন সময় ও বলল, আমার হাতে একদম সময় নেই রে৷ বেলা দশটার সময় ফ্যান্টাকে প্র্যাকটিসে নামতে হবে৷ কাঠমান্ডুতে আসার পর থেকে কীরকম যেন অদ্ভুত ব্যবহার করছে৷ কিছুতেই গেস্টহাউসে থাকতে চাইছে না৷ ওর ঘরের দরজা বন্ধ করে আমি চলে এসেছি৷ বেলা একটা পর্যন্ত ওকে প্র্যাকটিস করাতে হবে৷ তুই কখন আসতে পারবি?’
গতকাল ক্যাফেটেরিয়ায় বসে পাগলা প্লেটোকে কথা দিয়েছিলাম, ফ্যান্টার প্র্যাকটিস দেখতে যাব৷ রুদ্রাক্ষ কেনার কাজটা সেই কারণেই সাত সকালে সেরে ফেলতে চাইছিলাম৷ ভারত-নেপাল ম্যাচটা সেই সন্ধে সাতটায়৷ বিকেলের পর খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ব৷ তাই বললাম, ‘ঠিক আছে, তুই যা৷ আমি এগারোটা-সাড়ে এগারোটার মধ্যেই রানা প্যালেসে পৌঁছে যাব৷’
‘প্যালেসটা কোথায় তোর কি মনে আছে?’
‘আছে৷ নারায়ণহিতি প্যালেসের ঠিক উলটোদিকে৷’
‘তোর হোটেল থেকে খুব বেশি দূরে না৷ যে কোনো রিকশাকে বললেই রানা প্যালেসে নিয়ে যাবে৷ শোন ভাই, বিশাল জায়গা জুড়ে প্যালেস৷ ভিতরে ঢুকে থই পাবি না৷ তাই সিকিউরিটিদের জিজ্ঞেস করবি, দরবার হলটা কোথায়? ওখানেই আর্চাররা আজ প্র্যাকটিস করবে৷’ কথাগুলো বলে পাগলা প্লুটো আর দাঁড়াল না৷ হনহন করে মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেল৷
প্রায় আধঘণ্টা খুঁজে মন্দির চত্বরের দোকানেই আমি পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষের মালা পেয়ে গেলাম৷ ছবি তুলে সঙ্গে সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েও দিলাম সুদীশের কাছে৷ মিনিটখানেকের মধ্যে উত্তর ও দিল, ‘ঠিক এই রকমই চাইছিলাম৷’ একটু আগে দোকানদার বলছিল, ‘যা পাচ্ছেন নিয়ে যান স্যার৷ আর কয়েক বছর পর রুদ্রাক্ষের মালা দুষ্প্রাপ্য হয়ে যাবে৷ যে গাছ থেকে এটা পাওয়া যায়, তার কাঠ রেললাইন পাতার কাজে ব্যবহার করা হয়৷ ফলে সেই গাছই নির্মূল হতে চলেছে৷ আশঙ্কার কথা হল, হিমালয় অঞ্চল ছাড়া রুদ্রাক্ষের গাছ আর কোথাও দেখা যায় না৷’
সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি৷ মন্দির থেকে বেরিয়ে একটা খাবারের দোকানে গিয়ে ঢুকলাম৷ গরম গরম পুরি আর জিলিপি ভাজা হচ্ছে৷ দেখেই খিদেটা বেড়ে গেল৷ অর্ডার দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছি৷ দেখি, মন্দির চত্বরের ঢাল দিয়ে স্থানীয় এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে পাগলা প্লেটো নেমে আসছে৷ ওর হাতে গোল পাতায় পুজোর প্রসাদ আর ফুল৷ ভদ্রলোক বোধহয় ওকে কোনো অনুরোধ করছেন৷ প্লেটো রাজি হচ্ছে না৷ পার্কিং প্লেস পর্যন্ত হেঁটে যাওয়ার পথে প্লেটো বার দু-এক দাঁড়িয়ে পড়ল৷ ঘাড় নেড়ে বারবার ও না না করছে৷ ভদ্রলোক প্রায় জোর করেই ওকে একটা মারুতি গাড়িতে তুলে নিলেন৷ কিডন্যাপ করলেন নাকি? গতকাল প্লেটো একবার বলেছিল, মারাত্মক ঝামেলায় পড়েছে৷ আমার সঙ্গে আর দেখা না-ও হতে পারে৷ ইস, আমি জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেছিলাম, ঝামেলাটা কী?
ক্যাফেটোরিয়ায় বসে কাল পাগলা প্লেটো অদ্ভুত-অদ্ভুত কথা বলছিল৷ জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মানুষ থাকতে হঠাৎ হনুমানদের তুই তিরন্দাজির ট্রেনিং দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলি কেন?’
ও বলেছিল, ‘প্রশ্নটা তুই করবি, আমি জানতাম৷ কোরিয়া থেকে ফিরে আমি কিন্তু প্রথমে ষোলো-সাতেরো বছর বয়সি ছেলেদের নিয়েই অ্যাকাডেমিটা শুরু করেছিলাম৷ পরে দেখলাম, সব বেইমান৷ আমার কাছ থেকে সব টেকনিক শিখে সবাই স্টেট আর ন্যাশনাল মিট জিতছে৷ কিন্তু মিডিয়ায় কোথাও আমার নামটা কেউ করছে না৷ কল্যাণ মুখার্জি বলে যে ছেলেটাকে আমি প্রায় বস্তি থেকে তুলে এনে তিরন্দাজি শিখিয়েছিলাম, সে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান হওয়ার পরই দেখলাম, কোচ হিসেবে নাম বলছে এমন একজনের, যাকে আমি সহ্য করতে পারি না৷’
কল্যাণ বলে ছেলেটাকে আমি চিনি৷ বছর কয়েক আগে একবার সাব-জুনিয়রে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল৷ তারপর ছেলেটা হারিয়ে গেল৷ তার মানে, গুরুকে অশ্রদ্ধা করার ফল পেয়ে গেছে৷ সব খেলার কোচদের জীবনে এরকম দুঃখজনক ঘটনা ঘটে৷ পাগলা প্লেটোকে আমি বলেছিলাম, ‘তোর কাজ চ্যাম্পিয়ন দিয়ে যাওয়া৷ কারও কাছে কিছু আশা করিস না৷’
ও বলেছিল, ‘আমার অ্যাকাডেমি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কল্যাণকে আমি চরম শিক্ষা দিয়েছিলাম ভাই৷ আমার ফ্যান্টার সঙ্গে ওকে কম্পিটিশানে নামিয়ে৷ ও হেরে ভুত হয়ে গেছিল৷ তার পর থেকে লজ্জায় ধনুকই ছোঁয়নি৷ এখন যদুবাবুর বাজারে বসে সবজি বিক্রি করে৷’
‘ফ্যান্টাকে তুই পেলি কোথায়?’
‘সে এক আশ্চর্য ঘটনা৷ ভগবান পাইয়ে দেন৷ তোকে আগেই বলেছি, নয়াগ্রামে আমার অ্যাকাডেমির আশেপাশে জঙ্গলে ভরতি৷ প্রচুর হনুমানের বাস৷ মাঝেমধ্যেই লক্ষ করতাম, হনুমানগুলো এসে উৎপাত করে৷ কখনও কারও ধনুক নিয়ে চলে যায়৷ কখনও তির৷ কখনও আবার টার্গেটের উপর বসে থাকে৷ একদিন প্র্যাকটিস করার সময় একজনের তির লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে একটা হনুমানের পেটে ঢুকে যায়৷ সঙ্গে…সঙ্গে ওকে নিয়ে আমি মেদিনীপুরের ভেটেরেনারি হাসপাতালে যাই৷ চোট তেমন গুরুতর ছিল না৷ ডাক্তাররা পেট থেকে তির বের করে দিয়ে সেলাই করে দেন৷ দু’দিন পর হাসপাতাল থেকে বেচারিকে নিয়ে এসে জঙ্গলে ছেড়ে দিই৷ পেটে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় ও গাছে উঠে পড়ে৷’
‘অন্য হনুমানগুলো বদলা নেওয়ার চেষ্টা করেনি?’
‘সাংঘাতিক অ্যাটাক করেছিল৷ প্রায় এক সপ্তাহ আমরা প্র্যাকটিসেই নামতে পারিনি৷ কুড়ি-পচিশজনের একটা দল আমাদের কাউকে মাঠে দেখলেই তাড়া করত৷ ওদের মধ্যে এমন ইউনিটি৷ শেষে গ্রামের মাতব্বরেরা পরামর্শ দিলেন, হনুমান পুজোর আয়োজন করতে৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ সত্যিই তাই হল৷ আমাদের ট্রেনিং কোর্সের গায়েই আমরা বজরঙ্গবলীর একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করলাম৷’
‘তুই বুঝলি কী করে, হনুমানরাও তিরন্দাজি করতে পারবে?’
‘এই ফ্যান্টাই প্রথম ধনুক হাতে নিয়েছিল৷ সে এক ইন্টারেস্টিং ব্যাপার৷ একদিন প্র্যাকটিসের মাঝে বিশ্রাম দিয়ে আমরা ব্রেকফাস্ট সারছিলাম৷ হঠাৎ ক্যান্টিনের জানলা দিয়ে দেখি, পেটে ব্যান্ডেজ বাঁধা সেই হনুমানটা কারও একটা ধনুক হাতে তুলে নিয়েছে৷ ছেলেদের বললাম, এখন কেউ কাছে যাস না৷ দেখি কী করে৷ মাই গুডনেস, দেখি হনুমানটা তির তুলে নিয়ে স্ট্রিংয়ে…মানে ছিলায় বসানোর চেষ্টা করছে৷ তারপর দেখি, সত্যি সত্যি আমাদের মতো তির ছুড়ছে৷ রেহসাস মাঙ্কিরা খুব বুদ্ধিমান হয়৷ মানুষের হুবহু নকল করতে পারে৷ আমরা কেউ ওকে বাধা দিলাম না৷ আমার এক ক্যাম্পে একটা আদিবাসী ছেলে আছে…ওর নাম সুখেন হেমব্রম৷ ওর বাড়িতে পোষা হনুমান আছে৷ মাদারির খেলা দেখিয়ে ও রোজগার করে৷ হেমব্রম ছেলেটা দু’চারদিনের মধ্যেই বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল হনুমানটার সঙ্গে৷ তখন ওর কোনো একটা নাম দিতে হবে৷ ফ্যান্টাস্টিক কাণ্ডকারখানা দেখে ওর নাম আমরা দিলাম ফ্যান্টা৷’
‘ওকে তিরন্দাজ করার আইডিয়াটা তোর মাথায় এল কী করে?’
‘প্রথম প্রথম ওকে আমরা হালকাভাবেই নিয়েছিলাম৷ গ্লাস ফাইবারের ধনুক হাতে দিতাম না৷ ওর জন্য আলাদা বাঁশের ধনুক তৈরি করে দিয়েছিলাম৷ ঠিক ওই সময়টায় ইউটিউবে মাটিল্ডা বলে একটা সিনেমা দেখে আমার মাথায় প্রথম আইডিয়াটা এল৷ মাটিল্ডা সিনেমায় একটা ক্যাঙারু কীভাবে বক্সার হয়ে উঠল, গল্পটা তা নিয়ে৷ নিশ্চয়ই জানিস, অস্ট্রেলিয়ায় প্রচুর ক্যাঙারু দেখতে পাওয়া যায়৷ একটা বক্সিং ক্লাবে রোজ সেই ক্যাঙারুটা বক্সিং দেখতে আসে৷ ওরও ইচ্ছে হল, বক্সিং শিখবে৷ ওর ইচ্ছেটা বুঝতে পেরে, কোচ ওকে বক্সিং শেখাতে লাগল৷ শেষে মাটিল্ডা সত্যিকারের বক্সারদের হারিয়ে একদিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠল৷ সিনেমাটা দেখার পর আমি এত উৎসাহ পেয়েছিলাম যে, আমিও সিরিয়াসলি ফ্যান্টাকে তিরন্দাজি শেখাতে লাগলাম৷’
‘তির ছোড়ার সময় ও কি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে?’
‘শুরুর দিকে পারত না৷ তখন আমি অর্থোপেডিক সার্জেনদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলাম৷ বউবাজারের এক গলিতে ডাঃ গদাধর আইচ বলে এক ভেটেরেনারি সার্জেনের ক্লিনিক আছে৷ উনি বললেন শিরদাঁড়া আর কোমরে অপারেশন করে দিলেই ফ্যান্টা মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা পাবে৷ তবে লাখ পাঁচেক টাকার মতো খরচ করতে হবে৷ কী মনে হল, আমি রাজি হয়ে গেলাম৷ অপারেশন তো হয়ে গেল৷ কিন্তু তার পর লক্ষ করলাম, ফ্যান্টা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে বটে, তবে টানা মিনিট দুয়েকের বেশি না৷ তখন ডাঃ আইচ বললেন, ফিজিওথেরাপি করে ওর কোমর আর পায়ের জোর বাড়াতে হবে৷ অনেক মেহনত করছি ভাই৷ অনেক সময়ও দিয়েছি, ফ্যান্টাকে তিরন্দাজ হিসেবে তৈরি করার জন্য৷ একটাই কারণে, চ্যাম্পিয়ন হলে কল্যাণদের মতো অন্তত বেইমানি করবে না৷’
‘ফ্যান্টা কতদিনের মধ্যে টেকনিকগুলো শিখতে পেরেছিল রে?’
‘বছরখানেকের মধ্যেই৷ আমাকে অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছিল৷ রামায়ণের কিষ্কিন্ধ্যা পর্বটা আমি গুলে খেয়েছিলাম, বুঝলি? আমাদের দেশে তো একসময় বানর তিরন্দাজরা ছিল৷ শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে তারা লঙ্কাতেও গেছিল, রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে৷ রাজা বালী আর তার ভাই সুগ্রীবের কথা তো তোর নিশ্চয়ই মনে আছে৷ বালীর ছেলে অঙ্গদের কথাও৷ তো, বানরসেনারা কীভাবে প্র্যাকটিস করত, কে তাদের শেখাত, সব খুঁজে বের করলাম৷ আর সেইসব টিপস পেয়ে আমি ফ্যান্টাকে শেখাতে লাগলাম৷ কাজটা কত কঠিন, তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস কালকেতু৷ জুলজিস্টদের কাছে গিয়ে মাংকি সাইকোলজিও জানতে হয়েছিল৷ চল, গিয়ে দেখবি, ফ্যান্টা কী অসাধারণ তিরন্দাজ! প্রত্যেকটা তির চোখ বুজে ও বুলস আই-তে ফেলতে পারে৷ একটাও এদিক-ওদিক হবে না৷’
সত্যি বলতে কী, পাগলা প্লেটোর সব কথা আমার বিশ্বাস হয়নি আবার পুরোপুরি উড়িয়েও দিতে পারিনি৷ ওকে যতদূর জানি, আজগুবি কথা বলতে পারে৷ কিন্তু মিথ্যা বলবে না৷ যে তিরন্দাজ প্রতিটা তির বুল আই-তে ফেলতে পারে, সে তুড়ি মেরে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে৷ রিও অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কোরিয়ান কু বোনচ্যান৷ সেও সব কটা তির দশ-এ ফেলতে পারেনি৷ আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে পাগলা প্লেটো বলল, ‘কালকেতু, আর্চারি অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাদের কি তুই একবার রিকোয়েস্ট করবি, যাতে ফ্যান্টাকে কম্পিটিশনে নামতে দেয়৷ তোর কথা ওরা ফেলতে পারবে না৷’
পাগলা প্লেটো আমাকে মুশকিলে ফেলে দিয়েছিল৷ তিরন্দাজির নিয়মকানুন অনেক বদলেছে৷ আগে সর্বোচ্চ সংস্থার নাম ছিল ফিটা৷ এখন নাম হয়ে গেছে ওয়ার্ল্ড আর্চারি ফেডারেশন৷ আগে চারটে দূরত্বে কম্পিটিশন হত৷ তিরিশ, পঞ্চাশ, সত্তর আর নব্বই মিটার৷ এখন অলিম্পিকে মাত্র একটাই ইভেন্ট, সত্তর মিটার দূরত্বের৷ মানে রিকার্ভ ইভেন্ট৷ পাগলা প্লেটো আমাকে অনুরোধ করতে বলছিল বটে, কিন্তু সেটা করা কি আমার পক্ষে সম্ভব? কম্পিটিশনটা তো মানুষদের জন্য৷ কর্তারা হনুমানকে নামতে দেবেন কেন? তবু ওকে নিরাশ করতে মন চায়নি৷ বলেছিলাম, ঠিক আছে, একবার বলে দেখব৷’
ব্রেকফাস্ট সেরে আমি আর সময় নষ্ট করলাম না৷ একটা রিকশা ধরে রানা প্যালেসের দিকে এগোলাম ফ্যান্টাকে নিজের চোখে দেখব বলে৷
৩
ইতালি বিশ্বকাপে প্রথম যেদিন দিয়েগো মারাদোনার পায়ের জাদু দেখেছিলাম সেদিনও এতটা চমকে উঠিনি৷ ফ্যান্টার প্র্যাকটিস দেখে যতটা হলাম৷ রানা প্যালেসের দরবার হলটা বিশাল৷ আগে বোধহয় রাজা-রাজড়াদের আসর-টাসর বসত৷ পুরো হলঘরটা এখনও কারুকার্যময়, সাজানো-গোছানো৷ সিলিং থেকে গোটা-কুড়ি ঝাড়বাতি ঝুলছে৷ অসম্ভব উজ্জ্বল লাগছে হলঘরটাকে৷ একপ্রান্তে গোটা-দশেক টার্গেট বসানো৷ সত্তর মিটার দূরত্ব থেকে তিরন্দাজি প্র্যাকটিস করছে দশজন৷ পাগলা প্লেটো বা ফ্যান্টা কোথায়, তা খোঁজার চেষ্টা করছি৷ হঠাৎ চোখে পড়ল দশ নম্বর টার্গেটে যে প্র্যাকটিস করছে, তার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে পাগলা প্লেটো৷
পুরো হলঘরটা নিস্তব্ধ৷ তির ছোড়ার টুই আর টার্গেটে গিয়ে লাগার থপ শব্দ ছাড়া৷ ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, তিরন্দাজরা প্রায় সবই বিদেশি৷ প্রত্যেকের পরনে ট্র্যাকস্যুট৷ তাতে দেশের নাম লেখা৷ দেখলাম কোরিয়ান, চিনা, থাই, জাপানি, মঙ্গোলিয়ান ছাড়া আমেরিকানরাও আছে৷ ফ্যান্টা যে হনুমান, ওকে দেখে চট করে তা বোঝা যাচ্ছে না৷ ওর পরনে নীল ট্রাউজার্স, ফুল হাতা শার্ট৷ মাথায় গল্ফ ক্যাপ৷ চোখে সানগ্লাস৷ একমাত্র ওর গায়েই ট্র্যাকস্যুট নেই৷ পিঠে ঝোলানো তূণ থেকে ফ্যান্টা এক-একটা করে তির টেনে নিচ্ছে৷ তারপর ছিলায় লাগিয়ে সেটা নিখুঁত নিশানায় পাঠিয়ে দিচ্ছে৷ দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম, পাগলা প্লেটো ঠিকই বলেছিল৷ ফ্যান্টার প্রত্যেকটা তির গিয়ে পড়ছে টার্গেটের সবথেকে ছোটো হলুদ বৃত্তে৷ দশটা তির ছুড়ে ও একশোয় একশো পয়েন্ট তুলে নিল৷
টার্গেট থেকে দশটা তির খুলে নিয়ে ফ্যান্টা ফের স্টার্টিং বক্সে ফিরে আসছে৷ এমন সময় দেখি, হাত তুলে ইশারায় পাগলা প্লেটো আমায় ডাকছে৷ কাছে যেতেই ফ্যান্টার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল৷ হাত নেড়ে বিড়বিড় করে ও কী যেন বলল৷ সেটা শুনে দু’হাত জোড় করে ফ্যান্টা আমায় নমস্কার করল৷ পাগলা প্লেটোর মুখে তৃপ্তির হাসি৷ আমায় বলল, ‘কী রে কালকেতু, কী দেখলি? যা বলেছিলাম, ঠিক?’
সত্যি কথাই বললাম, ‘এতটা আশা করিনি৷’
‘যাক, তুই যে স্বীকার করেছিস, তাতেই আমি খুশি৷’
‘এত ফরেনার দেখছি৷ এখানে কোনো কম্পিটিশন আছে না কি?’
‘হ্যাঁ, ফ্যান্টাকে তো সেই জন্যেই নিয়ে এসেছি৷ এখানে অবশ্য অলিম্পিক আর্চারির নিয়ম মেনে কম্পিটিশন হচ্ছে না৷ একটা ইউনিক কম্পিটিশন হবে৷ একেবারে মহাভারতের যুগের মতো৷ অর্জুনের লক্ষ্যভেদের কথা তোর মনে আছে? ঠিক সেই ধরনের৷’
‘তোর কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না৷’
‘বুঝিয়ে দিচ্ছি৷ দ্রৌপদীর স্বয়ংবর-সভায় কম্পিটিশনের কথা মনে করার চেষ্টা কর৷ পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ঠিক করলেন, মেয়ের সঙ্গে এমন একজনের বিয়ে দেবেন, যিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর এবং সেটা স্বয়ংবর-সভায় প্রমাণ করতে হবে৷ মাথার ওপর একটা চরকি ঘুরছে৷ ঠিক তার নীচে জলের বিরাট পাত্র৷ চরকির ছায়া জলে পড়ছে৷ চরকির দিকে না তাকিয়ে, স্রেফ জলে তার ছায়া দেখে, তিরবিদ্ধ করতে হবে৷ তুই নিশ্চয়ই জানিস, একমাত্র অর্জুন সেই চরকিতে তির লাগাতে পেরেছিল৷’
বললাম, ‘জানি, এই কারণেই দ্রৌপদী মালা দিয়েছিলেন অর্জুনের গলায়৷’
‘এই দরবার হলটা যাঁর, সেই মহেন্দ্রপ্রতাপ রানা নেপালের সবথেকে ধনী মানুষ৷ সবথেকে খেয়ালিও৷ ইদানীং উনি এখানে সিমিলিয়ার একটা কম্পিটিশনের ব্যবস্থা করেন৷ তবে, চরকির পেটে একটা হিরে লাগানো থাকে৷ যে লক্ষ্যভেদ করতে পারে, পুরস্কার হিসেবে সে ওই হিরেটা জিতে নেয়৷ হিরেটা খুব মূল্যবান৷ দাম কত জানিস? কুড়ি লাখ টাকা!’
তিরন্দাজি নিয়ে বিশ্বের কোথাও যে এই রকম কম্পিটিশন হয়, জানতাম না, টাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই এই কম্পিটিশনের খোঁজ পেলি কী করে?’
পাগলা প্লেটো বলল, ‘কাঠমান্ডুতে মিঃ গণেশ লামা বলে একজন আছেন৷ তিনি বোধহয় কারও কাছ থেকে ফ্যান্টার কথা শুনেছিলেন৷ তিনি মাস চারেক আগে একদিন মেদিনীপুরে গিয়ে হাজির৷ ফ্যান্টাকে কিনতে চান৷ শুনে তো আমার মাথা গরম হয়ে গেছিল৷ ফ্যান্টাকে আমি অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন করব বলে তৈরি করেছি৷ ও কি আলু-পটল, যে বিক্রি করে দিতে হবে? দূর-দূর করে মিঃ লামাকে আমি তাড়িয়ে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা৷ বারবার আসতে লাগলেন, আর ফ্যান্টার দাম বাড়াতে থাকলেন৷ শেষে দশলাখ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি হয়েছিলেন৷’
‘মিঃ লামাই কি তোকে কাঠমান্ডুতে নিয়ে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ৷ আমি গররাজি দেখে শেষে খুলে বললেন, কেন ফ্যান্টাকে কিনতে চাইছেন৷ মিঃ ল্যামার মুখেই আমি প্রথম এই কম্পিটিশনের কথা শুনি৷ হাত-পায়ে ধরে উনি আমাকে রাজি করালেন৷ এখন দেখছি, ওঁর কথা শুনে এখানে না এলেই ভালো হত৷’
‘কেন? দু’নম্বরি করছেন নাকি?’
‘বুঝতে পারছি না রে৷ মিঃ লামা বলেছিলেন, তোমার ফ্যান্টা কম্পিটিশন জিতলে প্রাইজের টাকাটা আধাআধি ভাগ হবে৷ অর্থাৎ কি না দশ লাখ আমাকে দেবেন৷ টাকাটা এখন আমার খুব দরকারও৷ কেননা, অ্যাকাডেমি চালাতে গিয়ে আমি দেশের বাড়িটাও বন্ধক দিয়ে ফেলেছি৷ সুদের টাকা গুনতে গুনতে এখন আমি জেরবার৷ তবে, যে কারণে আমি মিঃ লামার কথায় রাজি হয়ে গেছিলাম, সেটা হল, তিরন্দাজির কর্তারা তো ফ্যান্টাকে সুযোগ দেবে না৷ এখানে অন্তত আমি বুঝতে পারব, ও কতটা তৈরি৷’
‘এখন কেন তোর মনে হচ্ছে, না এলে ভালো করতি?’
‘আরে কাল সকালে অর্গানাইজারদের অফিসে খোঁজ করতে গিয়ে দেখি, ফ্যান্টার কোচ আর ম্যানেজার হিসেবে মিঃ লামা শুধু নিজের নাম দিয়ে রেখেছেন৷ মানেটা বুঝতে পেরেছিস? যদি ফ্যান্টা জেতে, তা হলে অর্গানাইজাররা পুরস্কারের টাকাটা মিঃ লামার হাতেই তুলে দেবেন৷ আমার কোনো দাবিই টিকবে না৷ এ নিয়ে ফোনে কাল রাতে আমার সঙ্গে মিঃ লামার একপ্রস্থ কথা কাটাকাটি হয়ে গেছিল৷ আজ সকালে মিঃ লামা পশুপতিনাথ মন্দিরে গিয়ে আমায় ধরেন৷ প্রথমে কাকুতি-মিনতি করছিলেন৷ তারপর মন্দির থেকে জোর করে ওঁর ডেরায় নিয়ে গিয়ে আমায় ভয় দেখাতে শুরু করেন৷’
তা হলে খাবারের দোকানে বসে আমি যা ভেবেছিলাম, সেটাই ঠিক৷ যে ভদ্রলোক প্রায় ধাক্কা মেরে পাগলা প্লেটোকে গাড়িতে তুলেছিলেন, ইনিই গণেশ লামা! জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী বলে তোকে ভয় দেখালেন?’
‘প্রথমে বললেন, গত চারদিন ধরে তুমি কাঠমান্ডুতে আছো৷ হোটেল খরচা আর গাড়িভাড়া সব তোমাকে এখুনি দিতে হবে৷ সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক টাকা৷ আমি তাতেও গোঁ ধরে থাকায়, মিঃ লামা রেগে গিয়ে বললেন, ফ্যান্টাকে নিয়ে কীভাবে তুমি নেপাল থেকে বেরোও আমি দেখব৷ বাকি জীবনটাও তোমাকে কাঠমান্ডুর জেলে কাটাতে হবে৷’
‘গাড়িভাড়া কীসের জন্যে চাইছেন উনি?’
‘আমরা তো মেদিনীপুর থেকে সরাসরি গাড়িতে করে এসেছি৷ প্লেনের টিকিট কাটতে গেছিলাম৷ এয়ারলাইন্স বলল, হনুমানকে প্লেনে তোলা যাবে না৷ ফ্যান্টাকে নিয়ে কত অসুবিধা বল তো?’
সত্যিই পাগলা প্লেটো তা হলে ফেঁসে গেছে৷ বেশ ভয়ও পেয়েছে বলে মনে হল৷ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এখানে আসার আগে তুই কি জানতি, কম্পিটিশনটা কী ধরনের হবে?’
‘মিঃ লামা আমায় বলেছিলেন৷ এখানে আসার আগে ফ্যান্টাকে তাই পনেরো দিন ধরে প্র্যাকটিসও করিয়েছি৷ প্রথম প্রথম চরকিতে তির লাগাতে পারছিল না কিন্তু এখন সহজে পারছে৷ মুশকিল হচ্ছে, মাথার উপর চরকি এখানে কতটা স্পিডে ঘুরবে, সেটা তো জানি না৷ তবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ফ্যান্টার যা ট্যালেন্ট, ও ঠিক অ্যাডজাস্ট করে নেবে৷’
‘এখানে ও কাদের সঙ্গে লড়বে, খোঁজ নিয়েছিস?’
‘ফ্যান্টার প্রতিদ্বন্দ্বী এখানে ন’জন৷ তাদের মধ্যে দুজনকে তুই রিও অলিম্পিকে দেখেছিস৷ ওই দ্যাখ, তিন নম্বর টার্গেটে প্র্যাকটিস করছে কোরিয়ার কু বোনচ্যান৷ রিও-র চ্যাম্পিয়ন৷ তার পাশের লেনে আমেরিকার ব্র্যাডি এলিসন৷ ব্রোঞ্জ জিতেছিল৷ আমাদের পাশে নয় নম্বর লেনে যে কালো ছেলেটাকে দেখছিস, সে হল আফ্রিকার চ্যাম্পিয়ন৷ নাইজিরিয়ার রজার গোমস৷ ছেলেটা এখানে গতবার পুরস্কার জিতেছিল৷ গণেশ লামা বলেছেন, ছেলেটা মন্ত্রপূত তির নিয়ে আসে৷ আফ্রিকার ওঝারা নাকি ঝাড়ফুঁকে ওস্তাদ৷ এই রজার গোমসকে নিয়েই আমার ভয়৷ ছেলেটা ম্যানেজার হিসেবে একজন ওঝাকে নিয়ে এসেছে৷ সে নাকি ওর প্রতিদ্বন্দ্বীদের হিপনোটাইজড করে দিতে পারে৷ ওই দ্যাখ, লোকটা ঠিক ওর পেছনেই দাঁড়িয়ে৷’
কথাটা অবশ্য পাগলা প্লেটো ভুল বলছে না৷ বিশ্বকাপ ফুটবল কভার করতে গিয়ে আমিও শুনেছি, খেলার মাঠে ওঝাদের প্রভাবের কথা৷ তুকতাক করে আফ্রিকান ওঝারা নাকি খেলার ফল উলটে দিতে পারেন৷ এক-একজন প্রচুর টাকা রোজগারও করেন৷ পাগলা প্লেটোর কথামতো আমি আফ্রিকান ওঝার দিকে তাকালাম৷ প্রায় ছ’ফুট লম্বা, ওজন দেড়শো কেজির মতো হবে৷ পরনে হলুদ-কালো ডোরা আলখাল্লা৷ কী ভয়ানক চোখ! চোখের দিকে তাকালে যে কেউ হিপনোটাইজড হয়ে যেতে পারে৷ পাগলা প্লেটোকে সাহস দেওয়ার জন্য বললাম, ‘লোকটাকে পাত্তা দিস না৷ ফ্যান্টাকে বুঝিয়ে দিস, ও যেন লোকটার চোখে চোখ না রাখে৷’
আমরা দুজন কথা বলছি, এমন সময় দেখি, নিজের লেন ছেড়ে গিয়ে ফ্যান্টা নয় নম্বরে চলে গেছে৷ মুখ খিঁচিয়ে ভয় দেখাচ্ছে রজার গোমসকে৷ ওকে মারমুখী হয়ে উঠতে দেখে, তিরন্দাজরা সবাই প্র্যাকটিস থামিয়ে দিয়েছে৷ দু-একজন গোমসের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল৷ একজন তো ধনুক দিয়ে খোঁচাই মারল ফ্যান্টাকে৷ ঘটনাটা দেখে পাগলা প্লেটো সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গেল ফ্যান্টার কাছে৷ কিছুতেই ওকে বাগে আনতে পারে না৷ ফ্যান্টা লাথি মেরে গোমসের সরঞ্জামগুলো উলটে দিল৷ ওর মুখ থেকে ক্রমাগত ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ শব্দ বেরোচ্ছে৷ লাফ মেরে মেরে ও আঁচড়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে গোমসকে৷ ভয় পেয়ে গোমস ওর ওঝার পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ল৷ গোলমাল হচ্ছে দেখে, দরবার হলের সিকিউরিটি গার্ডরা ততক্ষণে ভিতরে চলে এসেছে৷ কী করবে, ওরা বুঝতে পারছে না৷ ফ্যান্টাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কোনোমতে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে পাগলা প্লেটো৷ ধরে ধরে ওকে দশ নম্বর লেনে নিয়ে এল৷ আমি বুঝতে পারলাম না, কী এমন হল যে, ফ্যান্টা এমন খেপে গেল?
প্রশ্নটা করতেই পাগলা প্লেটো বলল, ‘ফ্যান্টা বলছে, ওর ফেভারিট তিরের ব্যাগটা রজার গোমস হাতসাফাই করেছে৷ এখানে আসার আগে ফ্যান্টা ছ’টা তির বেছে রেখেছিল, কম্পিটিশনে ওর মধ্যে পাঁচটা তির ব্যবহার করবে বলে৷ সব আর্চারেরই এ-রকম কয়েকটা ফেভারিট তির থাকে৷ ফ্যান্টা এখন বলছে, এখানে তিরগুলো খুঁজে পাচ্ছে না৷’
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু সবার চোখের সামনে থেকে তিরগুলো গোমস হাপিস করবে কী করে?’
‘বুঝতে পারছি না রে৷ ফ্যান্টা নিশ্চয়ই কিছু লক্ষ করেছে৷ না হলে এত চটে যেত না৷ ইনফ্যাক্ট, অ্যাদ্দিন ওকে আমি হ্যান্ডেল করছি, কিন্তু কোনোদিন এতটা রাগতে দেখিনি৷ এতগুলো লোক থাকতে ও রজার গোমসের উপরই বা চড়াও হতে যাবে কেন, বল?’
ইতিমধ্যে চার নম্বর লেন থেকে ব্র্যাডি এলিসন পাগলা প্লেটোর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে৷ ও বলল, ‘গোমসের ম্যানেজার লোকটা তোমাদের একটা নীল রঙের ব্যাগ তুলে নিয়েছে৷ আমি নিজের চোখে দেখেছি৷ ওকে সার্চ করো৷ নির্ঘাত পেয়ে যাবে৷’
কিন্তু, ওই বিশাল বপুর ভয়ানক লোকটাকে কে চ্যালেঞ্জ করতে যাবে? লোকটা কোমরে হাত দিয়ে কটমট করে ফ্যান্টার দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ হাতের কাছে পেলে যেন গলা টিপে ধরবে৷ দরবার হল-এ হই-হট্টগোল চলছে৷ এমন সময় ল্যাউড স্পিকারে হঠাৎ ঘোষণা, ‘আজকের মতো প্র্যাকটিস বন্ধ৷ রজার গোমস ও ফ্যান্টাকে অফিস ঘরে ডাকা হচ্ছে৷ দুজন যেন তাদের ম্যানেজারদের নিয়ে এখুনি হাজির হয়৷’
একটু পরে আরও যে দৃশ্যটা দেখলাম, অবিশ্বাস্য! নিজের চোখে না দেখলে সত্যিই বিশ্বাস করতাম না৷ কোত্থেকে যেন পালে পালে হনুমান আর বানর নেমে আসতে লাগল৷ তাকিয়ে দেখলাম, দরবার হল-এর ঘুলঘুলি, খিলান, জানলা দিয়ে ওরা নেমে আসছে৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওরা ঘিরে ধরল রজার গোমসের ম্যানেজারকে৷ তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল লোকটার উপর৷ অতর্কিত এই আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেল গোমসের ম্যানেজার-কাম-ওঝা৷ ধপাস করে সে উলটে পড়ল মেঝেতে৷ হনুমান আর বানরগুলো ওকে কামড়ে-আঁচড়ে দিতে লাগল৷ লোকটা তখন চিৎকার করতে লাগল, ‘ওহ জেসাস, সেভ মি…সেভ মি৷’ ওর গাল আর হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে৷ বানরের দল ততক্ষণে লোকটার আলখাল্লা ছিঁড়ে ফেলেছে৷ তখনই ওর পেটে নীল রঙের একটা ব্যাগ আমাদের চোখে পড়ল৷ তার মানে, এই ওঝাই ফ্যান্টার ফেভারিট তিরগুলো হাতিয়ে আলখাল্লার ভেতর লুকিয়ে রেখেছিল৷
ব্যাগটা দেখতে পেয়ে আফ্রিকান ওঝার পেটে দড়াম করে একটা লাথি কষিয়ে ব্র্যাডি এলিসন বলল, ‘ইউ ব্লাডি চিট৷’ ও ফের লাথি মারার আগেই সিকিউরিটি গার্ডরা অবশ্য ওকে সরিয়ে নিয়ে গেল৷
পাগলা প্লেটো দৌড়ে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল, ‘এই তো ফ্যান্টার তিরগুলো!’
এলিসন বলল, ‘এই তিরগুলো কম্পিটিশনে তোমরা ইউজ কোর না৷ কে বলতে পারে, মন্ত্র দিয়ে লোকটা তির অকেজো করে দিয়েছে কিনা? গতবার আমার সঙ্গেও ওঝা লোকটা নোংরা খেলা খেলেছিল৷ আমার ফেভারিট তিরের একটাও টার্গেটে লাগেনি৷ অর্গানাইজারদের আমি বলে দিচ্ছি, রজার গোমস যদি কম্পিটিশনে নামে, তা হলে আমি নামব না৷’
এই গণ্ডগোলের মধ্যে হঠাৎ আমরা আবিষ্কার করলাম, হনুমান আর বানরের দল উধাও৷ নিঃশব্দে কখন ওরা সরে গেছে আমরা কেউ টেরই পাইনি৷
৪
নেপালের বিরুদ্ধে ইন্ডিয়ান টিম ৩-০ গোলে জিতেছে৷ ম্যাচ রিপোর্ট আর ভাইচুং ভুটিয়ার ইন্টারভিউ লিখে কলকাতার অফিসে পাঠাতেই রাত ন’টা বেজে গেল৷ হোটেলের রেস্তোরাঁয় ডিনার করতে বসেছি, এমন সময় উদভ্রান্তের মতো হাজির পাগলা প্লেটো৷ এত রাতে ওকে দেখব আশা করিনি৷ উলটোদিকের চেয়ারে বসে ও বলল, ‘কালকেতু, আমার ভীষণ ভয় করছে রে৷’
অবাক হয়ে বললাম, ‘কেন, মিঃ লামা ফের তোকে শাসিয়েছেন না কি?’
‘না রে, উনি না৷ তোকে বললে হয়তো ভাববি, আমার মাথা খারাপ৷ কিন্তু এই বিদেশে কাকেই বা বলব? তুই ছাড়া ভরসা করার মতো আর কে আছে?’
কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, ‘ডিনার করে এসেছিস?’
‘আর ডিনার! ফ্যান্টাকে আমি বাঁচাব কী করে, সেটা ভাবতেই ডিনার লাটে উঠেছে৷’
‘ফ্যান্টার আবার কী হল?’
‘ওর জাতভাইরা আমার উপর নজর রাখছে৷’
‘ফ্যান্টার জাতভাই! মানে, তুই কি হনুমান আর বানরদের কথা বলছিস?’
‘ঠিক তাই৷ একটা জিনিস ভেবে দেখেছিস কালকেতু? দুপুরে হঠাৎ অতগুলো হনুমান আর বানর দরবার হলে হাজির হল কেন? ঠিক এমন একটা সময়ে এল, যখন আমরা মারাত্মক ঝামেলার মধ্যে পড়েছি৷ আড়াল থেকে ওরা কি আমাদের উপর লক্ষ রাখছিল? যেন আমরা বিপদে পড়তেই নেমে এল৷’
বিকেলে ম্যাচে রিপোর্টে ব্যস্ত থাকার জন্য দরবার হলের ঘটনাটা ভুলেই গেছিলাম৷ পাগলা প্লেটোর কথা শুনে খটকা লাগল৷ সত্যিই তো, অতগুলো হনুমান আর বানর ওই সময় এলই বা কেন? ওরা যদি গোমসের ওঝার উপর চড়াও না হত, তিরের ব্যাগটা তা হলে পাওয়াই যেত না৷ ওঝা লোকটাকে অবশ্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে৷ গোমসকে কম্পিটিশন থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু এ আবার কী নতুন পাগলামি শুরু করল প্লেটো! ফ্যান্টার জাতভাইরা ওকে ফলো করছে৷ সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম, ‘হঠাৎ তোর এ কথাটা মনে হল কেন?’
‘আরে ভাই, আমি টের পাচ্ছি যে৷ এখানে যেদিন আমরা মিঃ লামার গেস্ট হাউসে ঢুকলাম, সেদিন থেকেই মনে হচ্ছে, ওখানে হনুমান আর বানরদের ভিড় বাড়ছে৷ ফ্যান্টার কাছে যেতে চাইছে ওরা৷ জানলা খোলা রাখতে পারছি না৷ কেননা, হঠাৎ-হঠাৎ উঁকি মারছে৷ গেস্ট হাউসের গাছের ডালে দোল খাচ্ছে৷ একদিন ডাইনিং হলে ফ্যান্টাকে বসিয়ে আমি বেসিনে হাত ধুতে গেছিলাম৷ দেখি, সেই সুযোগে দুটো হনুমান দরজা দিয়ে ঢুকে পড়েছে৷ ভাগ্যিস কেয়ারটেকার ভদ্রলোক সেইসময় ডাইনিং হলে ছিলেন, হুস হুস শব্দ করে উনি হনুমান দুটোকে তাড়িয়ে দেন৷ কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছে, ওরা ফ্যান্টাকে আমার কাছ থেকে সরিয়ে নিতে চাইছে৷’
বললাম, ‘তোর নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে৷’
‘না রে, আমার ভুল হচ্ছে না৷ ফ্যান্টার মধ্যেও একটা পরিবর্তন লক্ষ করছি৷ এখানে আসার পর থেকে ও আমার কথা শুনছে না৷ ডায়েট চার্ট মানছে না৷ যত সব জাঙ্ক ফুড খেতে চাইছে৷ এই একটু আগেই ডিনারে বিস্কুট, কেক, চাউমিন খেতে চাইল৷ আমার ঘরে কোল্ড ড্রিংকসের বোতল রাখা ছিল৷ আমাকে না জানিয়ে সেটা খেয়ে ফেলেছে৷ কে ওকে এসব খেতে শেখাল, বুঝতে পারছি না৷ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, ওকে এখান থেকে নিয়ে চলে যেতে হবে৷’
‘তোর ফ্যান্টার কম্পিটিশন কবে?’
‘কাল সকালে দশটায় শুরু৷ কখন শেষ হবে বলতে পারছি না৷ তুই থাকবি তো ভাই?’
‘না রে৷ কাল বেলা এগারোটায় আমার কলকাতায় ফেরার ফ্লাইট৷ ন’টার মধ্যে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছোতে হবে৷ ইন্ডিয়ান টিমও ওই ফ্লাইটেই ফিরে যাচ্ছে৷’
‘তা হলে কী হবে? আমার জন্য না হয়, দু-একটা দিন থেকে যা ভাই৷ প্লেনের টিকিট পেতে তোর অসুবিধা হবে না৷ ও গণেশ লামা তোর ব্যবস্থা করে দেবেন৷ হোটেলের খরচাও তোর লাগবে না৷ গেস্ট হাউসে অনেকগুলো ঘর খালি পড়ে আছে৷’
প্রস্তাবটা মন্দ নয়৷ কলকাতায় এখন বড়ো খেলার ইভেন্টও নেই৷ চাইলে অফিস থেকে দু-তিনদিন স্বচ্ছন্দে ছুটি নিতে পারি৷ কাঠমান্ডু থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে পোখরা বলে একটা শহর আছে, সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নাকি অসাধারণ৷ হিমালয়ের পুরো অন্নপূর্ণা পর্বতমালা দেখা যায়৷ কে যেন কাল গল্প করছিল, পোখরায় একটা লেকের মাঝখানে তাল বারাহি নামে একটা প্যাগোডা আছে, সেটা না দেখে গেলে নাকি নেপাল ভ্রমণ সম্পূর্ণ হয় না৷ তাই বললাম, ‘ভেবে দেখি৷ অফিসের সঙ্গে একবার কথা বলতে হবে৷’
‘তুই এক্ষুনি কথা বলে নে ভাই৷ আমাকে একটা ইম্পরট্যান্ট কাজে বেরোতে হবে৷’
‘এত রাতে তুই যাচ্ছিস কোথায়?’
‘ফ্যান্টার জন্য তির জোগাড় করতে৷ ওর ফেভারিট তিরগুলো ইউজ করব না৷ কে জানে, গোমস ওঝা তুকতাক করে দিয়েছে কিনা৷ গণেশ লামা বললেন, এখানে একটা পুরোনো অস্ত্রশস্ত্রের দোকান আছে৷ সেখানে নাকি মন্ত্রপূত তির পাওয়া যায়৷ জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়৷ ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে আসতে পারব৷’
প্লেটো এ আবার কী পাগলামি শুরু করল? মন বলল, এত রাতে ওকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না৷ দেওয়াল ঘড়িতে দেখলাম, রাত দশটা৷ রাত বারোটায় ফিরে এলেও আমার অসুবিধে নেই৷ এমনিতে রোজ বারোটার আগে ঘুমোতে যাই না৷ বললাম, ‘একটু দাঁড়া, ডিনারটা শেষ করে নিই৷ চল তোর সঙ্গে আমিও যাব৷’
খুশি হয়ে পাগলা প্লেটো বলল, ‘তা হলে তো খুব ভালো হয়৷ চল, গণেশ লামা গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন৷’
তাড়াতাড়ি ডিনার শেষ করে নিলাম৷ রাতের কাঠমান্ডু খুব শুনশান হবে ভেবেছিলাম৷ কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে দেখলাম, বাজার, দোকানপাট সব খোলা৷ গাড়িতে যেতে যেতে আমার হঠাৎ একবার মনে হল বটে, কী ধরনের দোকান যে, এত রাতেও খোলা থাকে? কিন্তু, কম্পিটিশন নিয়ে পাগলা প্লেটো খুব টেনশনে রয়েছে৷ তাই কথাটা তোলার সুযোগ পেলাম না৷ ও ধরেই নিয়েছে, বিশ লাখ টাকার হিরেটা ফ্যান্টার কপালে নাচছে৷ ওর প্র্যাকটিস দেখে বাকি আর্চাররা নাকি সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে৷ প্লেটো বলেই ফেলল, ‘সব কিছু ডিপেন্ড করছে, মনের মতো একটা তির যদি পেয়ে যাই, তার উপর ভাই৷ আমি তো শুনলাম, যে দোকানে যাচ্ছি, সেখানে রামায়ণ-মহাভারতের আমলেরও তির পাওয়া যায়৷ যদি সেটা সত্যি হয়, তাহলে আমি সেই তিরটা চাইব, যা দিয়ে অর্জুন দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় জিতেছিল৷’
শুনে আমি চমকে উঠলাম৷ দ্বাপর যুগের তির কাঠমান্ডুতে পাওয়া যাবে কী করে? প্রশ্নটা তুললে ফের ও মহাভারতের কথা তুলবে৷ ওর মধ্যে না হয় পাগলামির লক্ষণ আছে৷ কিন্তু আমার মাথা খারাপ হল কী করে? ওর সঙ্গে বেরোনোর আগে একবারও আমার কেন মনে হল না, মন্ত্রপূত তির-ফির সব বাজে কথা? ঢালের রাস্তা দিয়ে গাড়ি দ্রুতবেগে নীচের দিকে নামছে৷ শহর থেকে গাড়ি বোধহয় অনেকটা বেরিয়ে এসেছে৷ আশপাশে বাড়ি-ঘর কম৷ জায়গাটা খুব নির্জন৷ পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে জিপিএস চালু করে দেখলাম, আমরা কাঠমান্ডুর থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরত্বে এসেছি৷ কাছাকাছি একটা জায়গা আছে, যার নাম হিপিপুর৷ যতসব অসামাজিক কাজকর্ম সেখানে হয়৷ চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে বিদেশ থেকে ভবঘুরে মানে…হিপিরা এসে ওখানে থাকত৷ মনে কু-ডাক দিয়ে উঠল৷ না, যে করেই হোক, গাড়িটাকে ফের হোটেলের দিকে ফেরাতেই হবে৷
দরকার হলে পাগলা প্লেটোকে মিথ্যে কথা বলতে হবে৷ ভেবে নিয়ে বললাম, ‘অর্জুনের ওই তির তুই পাবি কোথায় প্লেটো? ওটা তো নেই৷’
প্লেটো অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, ‘কে বলল নেই?’
‘রিসেন্টলি নরেশ কোচার বলে একজন লেখকের একটা বই বেরিয়েছে, ‘মহাভারতের অজানা কাহিনি৷’ তাতে পড়লাম৷ আমরা সবাই জানি, স্বয়ংবর সভায় অর্জুন লক্ষ্যভেদ করার পর, হেরে যাওয়া বহু রাজা মারাত্মক খেপে গেছিলেন৷ এই রাজারা ছিলেন নামকরা নামকরা সব বীর৷ দুর্যোধন, কর্ণ, জরাসন্ধ, অশ্বত্থামা, জয়দ্রথ, শিশুপাল, শল্যের মতো আরও অনেকে৷ ওঁরা কেউ তখন অর্জুনকে চিনতে পারেননি৷ কেননা পাণ্ডবরা তখন ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ছিলেন৷ সবার রাগ গিয়ে পড়েছিল রাজা দ্রুপদের উপর৷’
পাগলা প্লেটো বলল, ‘আরে, আমি জানি, জানি৷ সবাই দ্রুপদের উপর চড়াও হয়েছিলেন৷ অর্জুন আর ভীম তখন যুদ্ধ করে রাজাদের তাড়িয়ে দেন৷’
‘ঠিক৷ এই ঘটনার কথা আমরা সবাই জানি৷ কোচার লিখেছেন, একমাত্র জরাসন্ধই ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাননি৷ অর্জুনের লক্ষ্যভেদ পর্যন্ত উনি চুপ করে স্বয়ংবর সভায় বসে ছিলেন৷ তারপর অন্য রাজারা যখন হই-হট্টগোল শুরু করেন, তখন চুপিসারে জরাসন্ধ অর্জুনের সেই তিরটা খুলে নিয়ে দেশে ফিরে যান৷ তিরটা ভেঙে উনি দেখতে চেয়েছিলেন, কোনো ম্যাগনেটিক এনার্জি অর্জুন ব্যবহার করেছিলেন কিনা? সেই তির তুই পাবি কী করে? তিরটা জরাসন্ধই নষ্ট করে ফেলেন৷’
অ্যাদ্দিন পাগলা প্লেটো আমাদের জিজ্ঞেস করত, ‘কি, ঠিক বলছি তো?’ আজ চিন্তিত মুখে বলল, ‘তুই ঠিক বলছিস তো?’
ওষুধটা কাজে লেগেছে৷ বললাম, ‘বিশ্বাস না হয়, তুই কলকাতায় গিয়ে কোচারের বইটা আমার কাছ থেকে নিয়ে যেতে পারিস৷ পড়লে মহাভারত সম্পর্কে তোর ধারণাই পালটে যাবে৷’
‘কিন্তু মিঃ লামার বন্ধু যে বললেন, হিপিপুরের দোকানে আরও অনেক প্রাচীন অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে৷ কোনো এক যক্ষ নাকি চার হাজার বছর ধরে কালেকশন করেছেন৷ রামচন্দ্র যে তির দিয়ে তাড়কা রাক্ষসীকে বধ করেন, সেই তির থেকে শুরু করে একেবারে রাবণ-বধের তির পর্যন্ত, সব কিছুই নাকি ওখানে আছে৷ রামায়ণের যুগে তো আর তরোয়াল ব্যবহারের প্রচলন ছিল না৷ তখন অস্ত্র বলতে ছিল শুধু তির-ধনুক৷’
শুনে আমার হাসি পাচ্ছে৷ পাগলা প্লেটো এইসব আজগুবি গল্প বিশ্বাস করল কী করে! পুরাণে অবশ্য যক্ষদের কথা উল্লেখ আছে৷ ব্রহ্মা যখন প্রজা সৃষ্টি করেছিলেন, সেই সময় তাদের জন্ম৷ ব্রহ্মা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘন অন্ধকারের মধ্যে যক্ষদের তৈরি করেছিলেন বলে তারা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, বিকট দেখতে৷ যক্ষরা মানুষের বন্ধু কিন্তু রাক্ষসদের শত্রু৷ তারা ধনদেবতা কুবেরের অনুচর৷ ধনসম্পত্তি আগলে রাখে বলে, তাদের নামে একটা কথা চালু আছে, যখের ধন৷ সেই যক্ষদের একজন রামচন্দ্রের তিরগুলো নাকি সংগ্রহ করে রেখেছেন! এর থেকে হাস্যকর আর কী হতে পারে? প্লেটোকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মিঃ, লামার এই বন্ধুটি কে রে?’
‘ভীম তামাং৷ আমি একদিনই তাঁকে দেখেছি৷ ভদ্রলোক একটা অ্যান্টিক শপ-এর মালিক৷ প্রাচীন, দুষ্প্রাপ্য সব জিনিস বিক্রি করেন৷ কথা বলে দেখলাম, পুরাণ ওঁর মুখস্থ৷ উনিই বলেছিলেন, সেই যক্ষ নাকি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যবহার করা কয়েক কোটি তির সংগ্রহ করেন৷ আর লুকিয়ে রেখেছিলেন এখানকার কোনো গুহায়৷ নেপালে কয়েক বছর আগে যে ভূমিকম্পটা হয়ে গেল, তাতে সেই গুহার মুখ খুলে যায়৷ তখনই তিরগুলো আবিষ্কৃত হয়৷ লোকে বলে, ওগুলো সব কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের৷’
শুনে আমি হেসে বললাম, ‘তোকে একটা কথা বলি শোন৷ এই শহরটা হল ঠগ-জোচ্চোরে ভর্তি৷ তার প্রমাণ তো ল্যামাকে দিয়ে তুই পেয়েই গেছিস৷ আমার মনে হয়, তোর এই দোকানে গিয়ে কোনো লাভ নেই৷ লামা তোকে মিসলিড করার জন্য পাঠাচ্ছে৷ ওর কোনো অন্য মতলব আছে৷’
‘কী মতলব আছে বলে তোর মনে হয়?’
‘ফ্যান্টার কাছ থেকে তোকে দূরে সরিয়ে রাখা৷ হয়তো ফিরে গিয়ে দেখবি, ফ্যান্টাকে কোথাও গুম করে দিয়েছেন৷ জীবনেও ওকে তুই খুঁজে পাবি না৷ ফ্যান্টাকে একা রেখে তোর চলে আসা উচিত হয়নি৷’
শুনে সোজা হয়ে পাগলা প্লেটো আমার দিকে ঘুরে বসল৷ তারপর বলল, ‘কিন্তু ফ্যান্টার ঘরে তো আমি তালা দিয়ে এসেছি৷’
‘সামান্য একটা তালার কী মূল্য আছে রে? ডুপ্লিকেট চাবি যে লামার কাছে নেই, তুই জানলি কী করে? আমি আর-একটা বিপদও দেখতে পাচ্ছি৷’
‘কী বলছিস কালকেতু! আমার তো হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ভাই৷ আর-একটা বিপদ কী?’
‘ফ্যান্টার জাতভাই-দের কথা তুই ভুলে গেলি? তালা ভেঙে ওরাও তো ফ্যান্টাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে৷ তোর রক্তজল করা পরিশ্রম এভাবে নষ্ট হতে দিস না ভাই৷’
‘কী করা উচিত? বল তো কালকেতু? ফ্যান্টার তিরের কী ব্যবস্থা হবে তা হলে?’
‘ও ফেভারিট তিরগুলোই যাতে ব্যবহার করে, সেই ব্যবস্থা কর৷ তুই জানলি কী করে তিরগুলো আফ্রিকান ওঝা তুক করছে? না হয়, পরীক্ষা করে দেখ৷ তুকতাকে আমি বিশ্বাস করি না৷ আমার মনে হয়, তিরগুলো ঠিকঠাকই আছে৷ চল ভাই, গেস্ট হাউসে ফিরে চল৷ সময় নষ্ট করিস না৷’
রাজি হয়ে পাগলা প্লেটো ঘাড় নাড়তেই ড্রাইভারকে আমি বললাম, ‘গাড়ি ঘোরাও৷’
লোকটা ফিরেই তাকাল না৷ বরং গাড়ির স্পিড আরও বাড়িয়ে দিল৷ বুঝলাম সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না৷ পকেট থেকে রিভলভারটা বের করে ওর কানের কাছে ধরলাম৷ তারপর বললাম, ‘গাড়ি যদি না ঘোরাও, তা হলে খুলি ফুটো করে দেব৷’
হুমকিতে কাজ হল৷ ড্রাইভার ফের শহরের দিকে গাড়ি ঘোরাল৷ আমার হাতে রিভলভার দেখে পাগলা প্লেটোর মুখ হাঁ হয়ে গিয়েছে৷ দেখে মনে মনে হাসলাম৷ অবশ্যই আসল রিভলভার নয়৷ অফিসের সহকর্মী তথাগতর ছেলের জন্মদিন কাল৷ ওকে উপহার দেব বলে আজই হোটেলের পাশে চিনে দোকান থেকে খেলনা রিভলভারটা কিনেছিলাম৷ যেটা দেখতে একেবারে আসল রিভলভারের মতো৷
৫
হোটেলে ফিরে মনটা ছটফট করতে লাগল৷ পাগলা প্লেটোর ব্যাপারটা হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হচ্ছে না৷ এত রাতে ওকে হিপিপুরে নিয়ে যাওয়ার পিছনে অন্য কোনো মতলব ছিল না তো? ড্রাইভারটার মনোভাব দেখে তো মনে হচ্ছিল কোনো গোপন ডেরায় প্লেটোকে নিয়ে যেতে লোকটা বদ্ধপরিকর৷ এত রাতে ওকে খুন করে কোনো খাদে ফেলে দিলে, কেউ কিছু জানতেও পারত না৷ ভাগ্যিস, আমি ওর সঙ্গী হয়েছিলাম! ড্রাইভার যখন আমাকে হোটেলে নামিয়ে দেয়, তখন ওর কাছ থেকে লাইসেন্সটা কেড়ে নিয়েছিলাম৷ তারপর দু’চার থাপ্পড় মেরে ভয় দেখাই, রাতে ফের ওকে এ তল্লাটে দেখা গেলে পুলিশের হাতে তুলে দেব৷ সত্যিই কলকাতায় যদি এ ঘটনা ঘটত, তা হলে ড্রাইভারটাকে সুদীশের হাতে তুলে দিতাম৷
হোটেলের রুমে ঢুকে প্রথমেই সুদীশকে ফোনে ধরলাম, ‘কাঠমান্ডু পুলিশের কোনো বড়ো কর্তাকে তুই চিনিস?’
সন্ধেবেলায় কলকাতা এয়ারপোর্টে কোনো এক উগ্রপন্থী ধরা পড়েছে৷ তাকে নিয়ে তখন ব্যস্ত সুদীশ৷ অফিসে বসেই তাকে জেরা করছে৷ প্রশ্ন শুনে ও বলল, ‘কেন রে?’
প্রয়োজনটা অল্প কথায় বলতেই সুদীশ বলল, ‘চিনি৷ সুমিত প্রধান৷ কাঠমান্ডু পুলিশের স্পেশাল স্কোয়াডে আছে৷ সিঙ্গাপুরে একটা সময় আমরা একই সঙ্গে ট্রেনিং নিয়েছিলাম৷ ওকে তোর ফোন নাম্বারটা দিয়ে দিচ্ছি৷ মিনিট পনেরোর মধ্যেই ও তোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে৷’
সত্যিই আমার চিন্তা হচ্ছিল পাগলা প্লেটোকে নিয়ে৷ গেস্ট হাউসে ওকে নামিয়ে দেওয়ার সময় একটা জিনিস লক্ষ করেছি৷ ও গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে লোহার বড়ো গেটটা খুলে দিয়েছিল দুটো বড়ো হনুমান৷ মনে হয়, প্লেটোর চোখে সেটা পড়েনি৷ কেননা, ও তখন আমার সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত৷ গেট খুলে দিয়েই হনুমান দুটো গাছের আড়ালে সরে গেছিল৷ দেখে তখন মনে প্রশ্ন জেগেছিল, পাগলা প্লেটোর সন্দেহটাই কি তা হলে ঠিক? জাতভাইরা ফ্যান্টাকে ঘিরে রেখেছে৷ ফ্যান্টা ঠিক আছে তো? পাগলা প্লেটোকে জিজ্ঞেস করা দরকার৷ ওকে ফোন করার পর প্রথমবার রিং হয়ে গেল৷ দ্বিতীয়বার ফোন তুলে ও বলল, ‘কী ব্যাপার কালকেতু? তুই হঠাৎ ফোন করলি?’
বললাম, ‘কয়েকটা কথা তোকে জিজ্ঞেস করার ছিল৷ গণেশ লামা কি আর তোর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল?’
‘আরে, উনি নাকি রাত সাড়ে ন’টায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন৷ আমি তখন তোর হোটেলে৷ এখানে ফিরে কথাটা কেয়ারটেকারের মুখে শুনে, আমি একটু আগে ওঁকে ফোন করলাম৷ আশ্চর্যের কথা কী জানিস? মিঃ লামা বললেন, উনি নাকি আমার জন্য গাড়ি পাঠাতে পারেননি৷’
‘গাড়িটা তাহলে কে পাঠিয়েছিল?’
‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না৷ গাড়ি পাঠানোর কথা বিকেলে মিঃ লামা বলেছিলেন বটে, কিন্তু সেই গাড়ি হঠাৎ ব্রেক ডাউন হওয়ায় আসতে পারেনি৷ বাড়ি ফেরার পথে কালকের কম্পিটিশনের ব্যাপারে কথা বলার জন্য উনি আমার কাছে আসেন৷ কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে ভাই, গেস্ট হাউস থেকে যখন আমি গাড়িতে উঠে তোর হোটেলে যাই, তখন ড্রাইভার বলেছিল, গাড়িটা মিঃ লামা পাঠিয়েছেন৷’
‘একটা কথা মনে করে বল তো, কাঠমান্ডুতে আসার পর থেকে এমন কারও সঙ্গে কি তোর আলাপ হয়েছে, যাকে আগে চিনতিস না?’
খানিকক্ষণ চিন্তা করে পাগলা প্লেটো বলল, ‘ভীম তামাংয়ের কথা তো তোকে আগেই বলেছি৷ হ্যাঁ, আর একজনের কথা মনে পড়ছে৷ লোকটা নাম বলেছিল বিরজু শ্রেষ্ঠা৷ পরিচয় দেওয়ার সময় আরও বলেছিল, ও আমার খুড়তুতো ভাই ব্রতীনের বন্ধু৷ ওরা নাকি কার্শিয়ংয়ের কোনো স্কুলে একই ক্লাসে পড়ত৷’
‘তুই যে এখানে এসেছিস, তোর খুড়তুতো ভাই তা জানে?’
মনে হয় না৷ সে থাকে শ্যামবাজারে, আমি মেদিনীপুরে৷ জানার তো কথা নয়৷
‘ওর মনটা খুব ভালো৷ শ্যামবাজারে আমাদের বাড়িটা যখন আমি বিক্রি করে দিই, তখন আমার কাকা আপত্তি তুলেছিল৷ দলিলে নাকি লেখা ছিল, বাড়ির কেউ যদি তার অংশ বিক্রি করতে চায়, তা হলে সেটা জ্ঞাতিদের মধ্যেই করতে হবে৷ আমার তাতে আপত্তি ছিল না৷ কিন্তু কাকা যা দাম দিতে চাইছিল, আমার তা পোষাল না৷ তাই আমি আগরওয়াল বলে এক মাড়োয়ারির কাছে আমার অংশটা বিক্রি করে দিই৷ কাকার সঙ্গে মনোমালিন্য হলেও ব্রতীনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়নি৷ ও আমাকে সাপোর্ট করেছিল৷’
‘তোর এই খুড়তুতো ভাই কী করে?’
‘চিনে তৈরি খেলনার ব্যবসা করে৷ কাঠমান্ডুতে খুব সস্তায় বাচ্চাদের খেলনা কিনতে পাওয়া যায়৷ ব্রতীন নাকি প্রতি শুক্কুরবার রাতের প্লেনে কাঠমান্ডু আসে৷ শনিবার চিনে খেলনা কিনে ফের রোববার রাতের প্লেনে কলকাতা ফিরে যায়৷ শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে ওর খেলনার দোকানও আছে৷ কিন্তু ব্রতীনের কথা তুই এত জানতে চাইছিস কেন?’
‘কারণ আছে৷ বিরজু শ্রেষ্ঠাকে কি ব্রতীনই তোর কাছে পাঠিয়েছিল?’
‘না৷ ছেলেটা এসেছিল অন্য কারণে৷ ওর কাছে নাকি সাত…আট বছরের দুটো নেপালি ছেলে আছে, যারা আর্চারিতে দারুণ৷ আমার অ্যাকাডেমিতে ওদের দিতে চায়৷’
‘তুই কি ওদের নিবি?’
‘এখনও কথা দিইনি, ছেলে দুটোকে কিনে নিতে হবে৷ এক-একটা ছেলের জন্য এক-এক লাখ৷ টাকাটা পেলে ওদের বাপ-মা কোনোদিন খোঁজও নিতে যাবে না৷ এরকম দুটো ছেলে পেলে মন্দ হয় না৷ এরা অন্তত আমার সঙ্গে বেইমানি করবে না৷ গুরুকুলে থাকবে৷ আমার কথায় উঠবে-বসবে৷ সে যাক, কাল কম্পিটিশন জেতার টাকাটা পেলে আমি ডিসিশন নেব৷’
ফোনে হঠাৎ কাচ ভেঙে পড়ার ঝনঝন আওয়াজ শুনতে পেলাম৷ ও প্রান্তে পাগলা প্লেটো ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘কিছু একটা হয়েছে৷ বোধহয়, ফ্যান্টার জাতভাইদের উৎপাত৷ যাই গিয়ে দেখে আসি৷ পরে তোকে ফোন করছি, কেমন?’
ফোনটা ছেড়ে সোফায় গিয়ে বসলাম৷ পাগলা প্লেটোর কথা শুনে মনেই হল না, কী ধরনের বিপদ থেকে আজ উদ্ধার পেয়েছে, সে সম্পর্কে ওর কোনো ধারণা আছে৷ ও পুরস্কার জেতার সুখস্বপ্নে বিভোর৷ কোথাও কোনো ইভেন্ট কভার করতে গেলে অবসর সময়ে আমি রহস্য উপন্যাসের বইতে ডুবে থাকি৷ এ-বার তিনদিনের জন্য কাঠমান্ডু এসেছি বলে কোনো বই আনিনি৷ সুদীশের পরিচিত সুমিত প্রধান রাতেই যোগাযোগ করবে৷ শুয়ে পড়লে চলবে না৷ তাই আনমনা হয়ে টিভিটা চালিয়ে দিলাম৷ কিন্তু, টিভির পর্দার দিকে চোখ যেতেই চমকে উঠলাম৷ স্টার মুভিজে একটা সিনেমা চলছে, ‘দ্য এপস রিটার্নস’৷ ‘এপস’ কথাটার মানে হল ছোট ল্যাজওয়ালা বিশাল বপুর বানর বা বনমানুষ৷ ছবিটা আগেও একবার দেখেছি৷ আমাজনের জঙ্গল থেকে একটা বনমানুষকে এক সার্কাসের মালিক কয়েদ করে লোকালয়ে নিয়ে এসেছিল৷ তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য জাতভাইরা কীভাবে মানুষের বিরুদ্ধে লড়াই করল, গল্প তা নিয়ে৷
সিনেমাটা দেখতে দেখতে মনে হল, আরে এ তো পাগলা প্লেটো আর ফ্যান্টার গল্প৷ সত্যি সত্যিই কাঠমান্ডুর হনুমানকুল ফ্যান্টাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে নাকি? বাস্তবের ঘটনা অনেক সময় গল্পকেও ছাড়িয়ে যায়৷ এই যে ফ্যান্টার কাঠমান্ডু আসা, তার পরই হঠাৎ কাঠমান্ডুতে হনুমানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া, ফ্যান্টার বিপদে হনুমানদের পাশে এসে দাঁড়ানো, পাহারা দেওয়া…এ সব কাকতালীয় হতেই পারে না৷ প্রাণীজগতে প্রত্যেকের যোগাযোগের নিজস্ব নেটওয়ার্ক আছে৷ হনুমানদেরও নিশ্চয়ই আছে৷ আমরা ওদের যোগাযোগের ভাষা বুঝতে পারি না৷ ওরা বোধহয় মনে করছে, ফ্যান্টাকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছে৷ আসলে তো তা নয়! পাগলা প্লেটো একটা লক্ষ্য নিয়ে ফ্যান্টাকে তৈরি করছে৷ ইস, ফ্যান্টাকে যেন ওর জাতভাইরা ছিনিয়ে নিয়ে না যায়৷ তা হলে বেচারি একেবারে ভেঙে পড়বে৷
পাগলা প্লেটো আর ফোনে যোগাযোগ করেনি৷ মাথায় ফ্যান্টার কথাই ঘুরছে, এমন সময় কলিং বেলের আওয়াজ৷ দরজা খুলে দিতেই দেখি, আমাদেরই বয়সি একজন হাসিমুখে বাইরে দাঁড়িয়ে৷ নিশ্চয়ই সুমিত প্রধান৷ পরনে অবশ্য পুলিশের ইউনিফর্ম নেই৷ তবুও, শরীর-স্বাস্থ্য দেখে একটা আন্দাজ তো করা যায়৷ দেখে বোঝা যায় পুলিশের লোক৷ আমিও হেসে অভ্যর্থনা জানালাম, ‘প্লিজ কাম ইন৷’
ঘরের ভেতরে ঢুকে সুমিত প্রধান পরিষ্কার বাংলায় বলল, ‘ছোটোবেলাটা আমি দার্জিলিংয়ে কাটিয়েছি৷ বাংলা এখনও ভুলতে পারিনি৷ সুদীশদার মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি মিঃ নন্দী৷ বলুন, আপনার বন্ধুর সমস্যাটা কি?’
একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে সব বললাম৷ প্লেটোর পাগলামির কথা, আমার সন্দেহের কথাও৷ সব শুনে সুমিত প্রধান বলল, ‘গণেশ লামা লোকটার নাম শুনেছি বলে মনে হচ্ছে৷ আমি যার কথা ভাবছি, সে এখানকার একটা সার্কাস কোম্পানির মালিক৷ মার্কেটে তার অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী এসে গেছে বলে সে সার্কাস কিছুদিনের জন্য বন্ধ করে রেখেছে৷ বাকি দুজন…বিরজু শ্রেষ্ঠা আর ভীম তামাংয়ের কুলজি আমি বের করে ফেলছি৷ আপনি ড্রাইভারের লাইসেন্সটা আমাকে দিন৷ ওকে তুলে এনে পেটালেই সব উগরে দেবে৷ কী উদ্দেশ্যে ও আপনাদের হিপিপুরে নিয়ে যাচ্ছিল, ওর মুখ থেকে আগে শুনি৷’
ঘণ্টাখানেক কথা বলে সুমিত প্রধান বেরিয়ে গেল৷ আমিও চোখ-মুখে জল দিয়ে শুয়ে পড়লাম৷ কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, আন্দাজ নেই৷ ফোনের আওয়াজে আমার ঘুম ভাঙল৷ জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, আকাশটা একেবারে ঘোলাটে৷ প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে৷ ক’টা বাজে, বুঝতে পারলাম না৷ ফোন কানে দিতেই ও প্রান্ত থেকে সুমিত প্রধান বলল, ‘সরি মিঃ নন্দী৷ সাত সকালে আপনার ঘুম ভাঙাতে হল৷’
বললাম, ‘নেভার মাইন্ড৷ বলুন, কী খবর?’
‘খারাপ খবর মিঃ নন্দী৷ কাল রাতে কে বা কারা আপনার বন্ধুকে খুনের চেষ্টা করেছিল৷ আপনার হোটেল থেকে বেরোনোর পরই ফোনে খবরটা পাই৷ সঙ্গে সঙ্গে আমি লামা গেস্ট হাউসে ছুটে যাই৷’
খুনের চেষ্টা হয়েছিল…তার মানে পাগলা প্লেটো খুনও হতে পারত৷ কী ভয়ানক একটা খবর! জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার বন্ধু এখন কোথায়?’
‘সিটি হসপিটালে৷ কেউ ওকে বিষমাখানো তির দিয়ে মার্ডারের চেষ্টা করেছিল৷ তিরটা ছোড়া হয়েছিল সম্ভবত দশ-বারো মিটার দূর থেকে৷ আপনার বন্ধু খুব লাকি, তির কাঁধে ঢোকে৷ কয়েক ইঞ্চি এদিক-ওদিক হলে ওকে আর বাঁচানো যেত না৷’
‘এখন কেমন আছে?’
‘খুব অল্প সময়ের মধ্যে ট্রিটমেন্ট শুরু করা গেছে বলে, হি ইজ আউট অফ ডেঞ্জার৷ আমারই ভুল৷ আপনার কাছ থেকে শোনার পর যদি কাল রাতে ওয়াচারদের গেস্ট হাউসে পাঠিয়ে দিতাম, তাহলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না৷’
‘কখন হয়েছে এসব?’
‘কেয়ারটেকারের কথা অনুযায়ী, রাত বারোটা থেকে একটার মধ্যে৷’
‘গেস্ট হাউসে পৌঁছোনোর পর ক্রাইম সিন-এ আপনি কী দেখলেন মিঃ প্রধান?’
‘একতলায় আপনার বন্ধু যে ঘরে ছিলেন, তার দরজার সামনে উনি উপুড় হয়ে পড়ে ছিলেন৷ দরজার সামনেই একটা বড় ফ্লাওয়ার ভাস ছিল৷ সেটাও পড়ে ভেঙে যায়৷ সেই শব্দ শুনে কেয়ারটেকার ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে ওঁকে ওই অবস্থায় দেখতে পান৷ ওই সময় আপনার বন্ধুর জ্ঞান ছিল না৷ সম্ভবত, পড়ে যাওয়ার সময় কপালে ঠোক্কর খেয়েছিলেন৷ কেননা, কপালে একটা ইনজুরি দেখেছি৷’
‘যে তিরটা ওর শরীরে ঢুকেছিল, সেটা কী ধরনের৷’
‘না, কোনও ব্র্যান্ডেড তির নয়৷ মানে কম্পিটিশনে যে তির আর্চাররা ব্যবহার করে, সে রকম নয়৷ তিরটা সাইজে ছোট৷ সাধারণত, তিব্বতে পাওয়া যায়৷ ফলাটা অবশ্য লোহার৷ কাছ থেকে ছোড়ায় তিরের তিনভাগ শরীরের ভিতর ঢুকে গেছিল৷ ক্রাইম সিন দেখে মনে হল, কোনো কারণে দরজা খুলে আপনার বন্ধু বারান্দায় এসেছিলেন৷ আর তারপর যখন ঘরের ভিতরে ঢুকতে যান, তখনই তিরটা এসে লাগে৷’
চট করে আমার কাল রাতের ফোনের কথা মনে পড়ে গেল৷ পাগলা প্লেটোর সঙ্গে কথা বলার সময় ফোনে কাচ ভেঙে পড়ার আওয়াজ শুনেছিলাম৷ সম্ভবত কেউ ঢিল ছুড়ে জানলার কাচ ভেঙেছিল৷ যে-ই কাজটা করে থাকুক, সে চাইছিল প্লেটোকে ঘরের বাইরে বের করে আনতে৷ এ নিশ্চয় কোনো স্থানীয় লোকের কাজ৷ যতদূর জানি, ছোটো সাইজের তিরের ফলায় বিষ মাখিয়ে এরা ছোটোখাটো পশুপাখি শিকার করে৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ধরনের বিষ ইউজ করা হয়েছে, জানতে পেরেছেন?’
‘না৷ আমাদের ফরেনসিক টিম টেস্ট করে দেখেছে৷ দুপুরবেলাতেই রিপোর্ট পাওয়া যাবে৷ তারপর ডাক্তাররা ঠিকঠাক ট্রিটমেন্ট শুরু করবেন৷ যাক সে কথা, আমি কয়েক ঘণ্টা আগে ভীম তামাংকে তুলে এনেছি৷ ও ব্যাটা পুরোনো পাপী৷ পুলিশ ফাইলস-এ আমি দেখলাম, ওর বিরুদ্ধে চিটিংয়ের বেশ কয়েকটা কেস রয়েছে৷ গণেশ লামা বোধহয় গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার মারফত খবর পেয়ে গেছিল৷ মাঝরাত্তিরে নিজেই স্পেশাল ব্রাঞ্চে চলে এসেছে৷ বিরজু শ্রেষ্ঠা কোথাও শেল্টার নিয়ে বসে আছে৷ ড্রাইভারটাও পালিয়েছে৷ তবে, ওদের ধরতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগবে না৷ আপনার সন্দেহভাজন আর কেউ আছে নাকি?’
চট করে রজার গোমসের কথা মনে পড়ল৷ পাগলা প্লেটো ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ করায় গোমস কম্পিটিশন থেকে বাদ পড়ে গেছে৷ হয়তো সেই রাগটা ও পুষে রেখেছিল৷ কিন্তু যতই উগ্র মেজাজের হোক না কেন, বিদেশ-বিভুঁইয়ে কাউকে খুন করার চেষ্টা ও করবে না৷ নামটা বললে, সুমিত প্রধান হয়তো খুঁজে-পেতে ওকে তুলে আনবে৷ তাতে কোনো লাভ হবে না৷ বললাম, ‘না, তেমন কারও নাম মনে পড়ছে না৷’
‘আপনার বন্ধুর নিকটাত্মীয় কেউ আছেন, যাকে খবর দেওয়া দরকার?’
‘না, সেরকম কেউ নেই৷ সিটি হাসপাতালে গেলে কি এখন ওর সঙ্গে কথা বলা যাবে?’
‘মনে হয় না৷ বিকেলের দিকে হয়তো পারবেন৷ কিন্তু আপনার তো আজই ফেরার কথা, তাই না?’
কলকাতায় ফিরে যাওয়ার তো কথা৷ কিন্তু পাগলা প্লেটোকে এই অবস্থায় ফেলে যাই কী করে? আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমিত প্রধান বলল, ‘আপনি দু’তিনটে দিন থেকে যান মিঃ নন্দী৷ যা আবহাওয়া, তাতে আজ কোনো ফ্লাইট ছাড়বে কি না আমার সন্দেহ৷ এয়ারপোর্টে গিয়ে সারাদিন বসে থাকার চেয়ে আপনি বরং টিকিট ক্যানসেল করে দিন৷ ব্রেকফাস্ট করে আপনি আমার অফিসে চলে আসুন৷ কে আপনার বন্ধুকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল, সেই রহস্যটা উদ্ধার করুন৷’
সুমিতের পরামর্শটাই ঠিক মনে হল৷ ফোন ছেড়ে দেওয়ার পর আমার খেয়াল হল, এই রে…ফ্যান্টার কথা তো ওকে জিজ্ঞাসা করা হল না৷ আজ সকালেই কম্পিটিশন৷ পাগলা প্লেটো হাসপাতালে, গণেশ লামা পুলিশের হেপাজতে৷ তাহলে ফ্যান্টাকে কে রানা প্যালেসে নিয়ে যাবে?
৬
সুমিত প্রধান ছেলেটাকে যত দেখছি, ততই অবাক হচ্ছি৷ নাগাড়ে কাজ করে যেতে পারে৷ কাল প্রায় সারা রাত্তির জেগেছে৷ আজ সকালে নাকি ঘণ্টা দু-এক ঘুমিয়ে চলে এসেছে অফিসে৷ কাজপাগলরা চট করে কাজপাগলদের বন্ধু হয়ে যায়৷ সুমিতের সঙ্গে আমারও তেমন হল৷ মিঃ নন্দী থেকে আমি হয়ে গেলাম কালকেতুদা৷ আপনি থেকে আমিও ওকে তুমি বলতে শুরু করলাম৷ স্পেশাল ব্র্যাঞ্চে দেখা হতেই ও বলল, ‘ফ্যান্টা গেস্ট হাউসে নেই কালকেতুদা৷ কাল রাত থেকেই ও গায়েব৷’
এরকমই একটা খবর আমি আশা করছিলাম৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে কিডন্যাপ করতে পারে ওকে?’
সুমিত বলল, ‘সিম্পল৷ যে আপনার বন্ধুকে মার্ডার করতে চেয়েছিল নিশ্চয় সে৷’
বললাম, ‘গেস্ট হাউসের যে ঘরে ফ্যান্টা ছিল সেটা তল্লাশি করেছ?’
‘করেছি৷ আশ্চর্যের ব্যাপার হল ওর তিরন্দাজির সব সরঞ্জাম ঘরেই পড়ে আছে৷ এমন কী ওর পোশাক-আশাকও৷ যে ওকে গুম করেছে, সে হয়তো চায় না, ফ্যান্টা ওর পোশাকের জন্য কারও চোখে পড়ুক৷’
পাগলা প্লেটোর কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে গেল৷ ও যা ভয় পাচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত সেটাই হল৷ কী কুক্ষণেই না ও ফ্যান্টাকে কাঠমান্ডুতে নিয়ে এসেছিল! বেচারি এখন হাসপাতালে৷ খবরটা ওর কানে গেলে একেবারে ভেঙে পড়বে৷ ভাবতে লাগলাম, ফ্যান্টাকে গুম করে কার লাভ বেশি? সাধারণ চোখে দেখতে গেলে, অবশ্যই গণেশ লামা৷ পুরস্কারের টাকা একাই ভোগ করতে পারবেন৷ কিন্তু, ভীম তামাং বা বিরজু শ্রেষ্ঠার কী স্বার্থ থাকতে পারে? কেন জানি না, আমার মনে হল, পাগলা প্লেটোকে মেরে ফেলার চেষ্টা আর ফ্যান্টাকে মেরে ফেলা…একই লোকের কাজ নয়৷ একটা করতে গিয়ে অন্যটা করতে হয়েছে৷
দফায়-দফায় আমরা দুজন গণেশ লামা আর ভীম তামাংকে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম কিন্তু খুনের কোনও মোটিভ খুঁজে পেলাম না৷ লক-আপে বসে গণেশ লামা খোলাখুলিই বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার সঙ্গে প্লেটোবাবুর সামান্য মনোমালিন্য হয়েছিল৷ সেটা পরে মিটিয়ে নিয়েছিলাম৷ ওঁকে মেরে ফেলে আমার কী লাভ বলুন? বিশেষ করে, কম্পিটিশনের আগের দিন? ওদের জন্য অলরেডি আমার লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে গেছে৷ সেই টাকাটা তো জলে চলে গেল৷ কম্পিটিশনে ফ্যান্টাকে নামাতে পারলাম না৷ উলটে আমাকে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে আপনাদের এখানে এসে৷’
সুমিত জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার সার্কাস কোম্পানিটা বন্ধ হয়ে গেল কেন মিঃ লামা?’
‘একেবারে বন্ধ তো করিনি৷ নেপালে সার্কাস বিজনেসে এখন মারাত্মক কম্পিটিশন৷ নতুন নতুন খেলা দেখাতে না পারলে সার্কাস চালানো মুশকিল৷ আপনি নিশ্চয়ই জানেন সার্কাসে নেপালি ছেলে-মেয়েদের খুব চাহিদা৷ লক্ষ করে দেখবেন ভারতের সার্কাস কোম্পানিতে নেপালি ছেলে-মেয়েরাই বেশি খেলা দেখায়৷ ভারতীয় সার্কাসের মালিকরা অনেক টোপ দিয়ে ওদের নিয়ে যাচ্ছেন৷ কম্পিটিশনে ওদের সঙ্গে আমি পেরে উঠছিলাম না৷ আমার সার্কাসে তৈরি হওয়া ছেলে-মেয়েদেরই আমি রাখতে পারিনি৷’
‘সেই কারণেই কি ফ্যান্টাকে আপনি কিনে নিতে চেয়েছিলেন?’
‘ঠিক ধরেছেন৷ একটা হনুমান তিরন্দাজি করছে, এটা আমার সার্কাসের একটা বাড়তি আকর্ষণ হত৷ আমার রিংমাস্টার দুর্যোধন ওকে খুব চাইছিল৷’
জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমার মনে হচ্ছিল, গণেশ লামা সত্যি কথাই বলছেন৷ তবুও বললাম, ‘আপনি যে আমার বন্ধুকে খুন করতে চেয়েছিলেন, এই কারণটাই তো যথেষ্ট৷ যদি ও মারা যেত, তাহলে ফ্যান্টাকে আপনি বিনে পয়সায় পেয়ে যেতেন৷’
শুনে ওই স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়াতেও গণেশ লামা ঘামতে শুরু করলেন৷ রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বললেন, ‘আপনার ধারণা ঠিক না৷ আমি আপনাদের বলছি, এটা আপনার রাইভাল কোনো সার্কাস কোম্পানির কাজ৷ আমাকে বিপদে ফেলার জন্য ষড়যন্ত্র করেছে৷ আপনারা আমার গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকারের সঙ্গে কথা বলুন৷ ও আমাকে বলছিল, ঘটনার পর ও যখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, তখন দেখেছে লনে একটা বাচ্চা ছেলেকে ঘিরে কয়েকটা হনুমান আঁচড়ে-কামড়ে দিচ্ছিল৷ তারপরেই একটা মোটর সাইকেল ছুটে যাওয়ার আওয়াজ ও শুনতে পায়৷ আর হ্যাঁ, বারান্দায় একটা কালো কম্বলও ওর চোখে পড়েছিল৷’
সুমিত প্রধান বলল, ‘কই, পুলিশকে তো এই বাচ্চা ছেলেটা আর কম্বলের কথা কেয়ারটেকার বলেনি?’
‘ও এমন ঘাবড়ে গেছিল, হয়তো বলতে সাহস পায়নি৷’
সুমিত ফের প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, সেই সময় একজন পুলিশ অফিসার এসে বললেন, বিরজু শ্রেষ্ঠা আর ড্রাইভারটাকে ভক্তপুরে পাওয়া গেছে৷ ওদের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চে নিয়ে আসা হচ্ছে৷ শুনে সুমিত প্রধান বলল, ‘মিঃ লামাকে আপাতত ছেড়ে দেওয়া যাক কালকেতুদা৷ চলুন, ভীম তামাংকে পিটিয়ে আসি৷’
নামেই ভীম, আসলে রোগা-পটকা চেহারার এক মাঝবয়সি লোক৷ সুমিত আর আমি লক আপে ঢুকতেই লোকটা কাঁপতে-কাঁপতে উঠে দাঁড়াল৷ কোনো কথা বলার আগে সুমিত তাকে বিরাশি সিক্কার একটা চড় মেরে বলল, ‘তোর তো সর্বনাশ হয়ে গেল৷ মিনিমাম পাঁচ বছরের জেল৷ যা বলার সত্যি-সত্যি বলে ফেল৷ তাহলে আর মারধোর করব না৷’
মারধর মারফত খবর বের করা আমার পোষায় না৷ ভীম তামাংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ঠোঁটের কোণ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে৷ হাতজোড় করে লোকটা বলল, ‘আমি কিছু করিনি সাব৷’
‘করিসনি মানে? লামার গেস্ট হাউসে তাহলে গাড়ি পাঠিয়েছিলি কেন? হিপিপুরে নিয়ে যাওয়ার পথে কলকাতার লোকটাকে খাদে ফেলে দেওয়ার জন্য?’
‘কোন লোকটাকে সাব? আমি তো কাউকে গাড়ি পাঠাইনি!’
লক আপে ঢোকার আগে লক্ষই করিনি, সুমিতের হাতে দেড় হাত লম্বা একটা রবারের পাইপ আছে৷ ভীম তামাংকে ভয় দেখানোর জন্য পাইপটা সুমিত শূন্যে একবার ঘোরাল৷ তারপর সপাটে আঘাত করে বলল, ‘এখন চিনতে পারছিস না, তাই না? গেস্ট হাউসে যে লোকটার কাছে গণেশ লামা তোকে নিয়ে গেছিল…এবার তাকে মনে পড়ছে? লামাই কি তোকে সুপারিটা দিয়েছিল?’
পাইপটা গায়ে লাগার পরই ভীম তামাং তীব্র যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল৷ তারপর চিৎকার করে উঠে বলল, ‘না না সাব৷ কেউ সুপারি দেয়নি৷ আপনি প্লেটো সাহেবের কথা বলছেন? উনি তো আমার কাছে তির কিনবেন বলেছিলেন৷ আমার কাছে পুরোনো অনেক তির-ধনুক আছে৷ অ্যান্টিক শপে সেগুলো আমি বিক্রি করি৷’
সুমিত ধমক দিল, ‘রামচন্দ্র আর অর্জুনের তির, তাই না? ত্রেতা আর দ্বাপর যুগের তির কোত্থেকে তুই পেলি, আমায় বল৷ লোক ঠকানোর ব্যবসা করছিস?’
‘ওগুলো আমার কারখানার তির৷ নামগুলো আমিই দিয়েছি৷ যাতে বিক্রি করতে সুবিধে হয়৷’
‘তোর এগেনস্টে অনেক কমপ্লেন জমা হয়ে আছে ভীম৷ বিদেশিদের কাছে তুই জাল পুথিও বিক্রি করিস৷ ভাঁওতা দিস এই বলে যে, তিব্বতের কোনো গুম্ফা থেকে পাওয়া গেছে৷ দোকানের পিছনে তোর তির তৈরির কারখানাটা আমি সিল করে দিয়েছি৷ তুই যাতে দু’বছরের আগে জেল থেকে না বেরোতে পারিস, তার ব্যবস্থা করছি৷’
ভীমকে নানা রকম ভয় দেখিয়েও আমাদের মনে হল না, পাগলা প্লেটোকে মার্ডার করতে চাওয়ার পিছনে ওর কোনো উদ্দেশ্য আছে৷ ও শুধু অর্জুনের তির বলে…একটা সাধারণ লোহার তির গছিয়ে কিছু টাকা আদায়ের ধান্দায় ছিল৷ লকআপ থেকে বেরিয়ে এসে আমরা সুমিতের অফিসে গিয়ে বসলাম৷ ও জিজ্ঞেস করল, ‘কী বুঝলেন কালকেতুদা?’
গণেশ লামাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর থেকেই একটা কথা আমার মাথায় ঘুরছিল৷ ক্রাইম সিন-এ বাচ্চা ছেলেটার কথা৷ অত রাতে কে ওকে গেস্ট হাউসে নিয়ে গেছিল? একটা বাচ্চা ছেলে কাউকে খুন করতে চাইবে, এ হতে পারে নাকি? কেউ নিশ্চয় অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ছিল৷ কেয়ারটেকারের বক্তব্য অনুযায়ী, হনুমানের দল বাচ্চাটাকে আক্রমণ করেছিল৷ কথাটা মনে হতেই সুমিতকে বললাম, ‘বাচ্চা ছেলেটার খোঁজ কর তো৷ হনুমানের দল ওকে আঁচড়ে- কামড়ে দিয়েছিল৷ কাঠমান্ডুর কোনো নার্সিং-হোম বা হাসপাতালে ওর হদিশ পাওয়া যাবে৷ আমার মনে হয়, এই বাচ্চাটাই আমাদের কোনো ক্লু দিতে পারে৷’
‘ঠিক বলেছেন৷’ কথাটা শুনে সঙ্গে-সঙ্গে একজন অফিসারকে নির্দেশ দিল সুমিত, ‘যে করেই হোক এই বাচ্চা ছেলেটার খোঁজ আমার চাই৷’
সকালে ব্রেকফাস্ট করা হয়নি সুমিতেরও৷ ক্যান্টিনে গিয়ে দুজনে খেয়ে আসতে-না আসতে কে যেন এসে বলল, ‘বিরজু শ্রেষ্ঠা আর ড্রাইভারকে ভক্তপুর থেকে নিয়ে আসা হয়েছে৷’
শুনে খুশি হয়ে রবারের পাইপটা ড্রয়ার থেকে বের করে সুমিত বলল, ‘চলুন কালকেতুদা, ব্যাটাকে পিটিয়ে আসি৷ এই বিরজুকে অনেকদিন ধরে পুলিশ খুঁজছে৷ নেপাল থেকে বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের এ পাচার করে৷ আমাদের রেকর্ডে চোখ বুলিয়ে দেখলাম, প্রায় শ’খানেক বাচ্চা ছেলে-মেয়েকে বিক্রি করার অভিযোগ আছে বিরজুর বিরুদ্ধে৷ সেটা কতটা সত্যি, চলুন যাচাই করে আসি৷’
রবারের পাইপ সম্পর্কে কৌতূহলটা আমি সামলাতে পারলাম না৷ জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘পাইপ দিয়ে পেটানোর কারণটা কী?’
সুমিত বলল, ‘এটা ফাঁকা পাইপ নয়৷ এর ভিতরে বালি পোরা আছে৷ হাতে নিয়ে দেখুন, বেশ ভারী৷ মারলে চোটের নিশান থাকে না৷ অথচ মারাত্মক লাগে৷ একবার ট্রেনিং নিতে বার্মায় গেছিলাম৷ বার্মিজ পুলিশের হাতে এটা দেখেছি৷ এর কেরামতি দেখবেন চলুন৷’
লক আপে ঢুকেই দেখলাম, বিরজু আর গাড়ির সেই ড্রাইভার পাশাপাশি বসে আছে৷ কোনো কথা না বলে পাইপ দিয়ে সুমিত পেটাতে লাগল বিরজুকে৷ সপাং করে একটা আওয়াজ হচ্ছে, আর বিরজু যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাটা মুরগির মতো ছটফট করছে৷ দৃশ্যটা দেখে ড্রাইভার ছেলেটার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে৷ সুমিত কিন্তু কোনো প্রশ্নই করল না বিরজুকে৷ মারের চোটে যখন বিরজু মেঝেতে প্রায় অজ্ঞানের মতো পড়ে রয়েছে, সেই সময় ও ড্রাইভারের মুখের সামনে পাইপটা নাচিয়ে বলল, ‘কোনটা চাস বল? সত্যি কথাটা আগেই বলে দিবি, নাকি মেরে তোর পেট থেকে কথা বের করতে হবে?’
ড্রাইভারটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, ‘আমার কোনো দোষ নেই সাব৷ গাড়িটা আমার নয়৷’
সেই সময় বিরজু উঠে বসার চেষ্টা করতেই সুমিত জামার কলার ধরে ওকে টেনে তুলল৷ তারপর রাগি গলায় বলল, ‘পাঁচ-সাত বছরের বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের শেরপা বস্তি থেকে তুই তুলে আনিস৷ তারপর তাদের বিক্রি করে দিস ইন্ডিয়ান সার্কাসের মালিকদের কাছে. ঠিক কিনা বল?’
বিরজু হাঁফাতে-হাঁফাতে বলল, ‘আমি করি না সাব৷ ওদের বাবা-মায়েরা বিক্রি করে দেয়৷’
‘আর তুই দালালি করে, কমিশনের টাকা আদায় করিস বাপ-মায়ের কাছ থেকে৷ তুই কি জানিস এটা বে-আইনি? তোর পাঁচ বছরের জেল হতে পারে? যাক সে কথা৷ কাল রাতে তুই কোথায় ছিলি?’
‘ভক্তপুরে আমার বাড়িতে৷’
‘লামার গেস্ট হাউসে দু’দিন আগে গিয়েছিলি কেন?’
পাগলা প্লেটো আমায় আগেই বলেছিল, বিরজু দুটো বাচ্চা ছেলেকে ওর কাছে বিক্রি করতে গেছিল৷ কিন্তু বিরজু সে কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘আমাকে দুর্যোধন রিং মাস্টার ওই লোকটার কাছে পাঠিয়েছিল৷’
‘এই দুর্যোধন রিং মাস্টার কে?’
‘লামা সাবের সার্কাসের রিং মাস্টার ছিল৷’
‘ছিল মানে? এখন নেই?’
‘না৷ দুর্যোধন নিজের কোম্পানি খুলছে৷ লামা সাব সেটা জানেন না৷ দুর্যোধন আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, কলকাতার লোকটার কাছে গিয়ে তুই বলবি, লামা সাব তোকে পাঠিয়েছে৷’
‘কেন পাঠিয়েছিল, সেটা তো বললি না?’
বিরজু বলতে চাইছে না৷ অধৈর্য হয়ে সুমিত ফের বালিভরা পাইপ দিয়ে একবার আঘাত করল৷ সঙ্গে সঙ্গে বিরজু বলে উঠল, ‘বলছি বলছি৷ ফ্যান্টা সম্পর্কে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিল৷ দুর্যোধন বলেছিল, নতুন সার্কাসে ওই হনুমানটাকে আমার চাই৷’
‘প্লেটো সাবের ভাই ব্রতীন কি সত্যিই তোর বন্ধু?’
‘হ্যাঁ সাব৷ আমরা কাশিংয়ংয়ে একই স্কুলে পড়তাম৷ চিনে খেলনার ব্যবসার কথা আমিই ওর মাথায় ঢুকিয়েছিলাম৷ প্রচুর টাকা কামিয়েছে৷ প্রায়ই ব্রতীন কাঠমান্ডুতে আসে৷ গতকালও ও এখানে ছিল৷ এখানে দুর্যোধনকে পার্টনার করে ও সার্কাস কোম্পানি খুলছে৷ আজ ওর চলে যাওয়ার কথা৷’
কথাটা শুনে চমকে আমি সুমিতের দিকে তাকালাম৷
৭
এত তাড়াতাড়ি অপরাধী ধরা পড়ে যাবে, আমি ভাবতেও পারিনি৷ দুর্যোধনকে সঙ্গে নিয়ে ব্রতীন সার্কাস কোম্পানি খুলছে, এই তথ্যটা জানার পর আমরা আর অপেক্ষা করিনি৷ এয়ারপোর্ট থেকে ব্রতীনকে ধরে আনার জন্য সুমিত লোক পাঠিয়ে দিয়েছিল৷ আমরা জানতাম, আবহাওয়া খারাপ৷ প্লেন ধরার অপেক্ষায় ও এয়ারপোর্টেই বসে থাকবে৷ সুমিতের লোকেরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ব্রতীনকে তো বটেই, ধরে এনেছিল দুর্যোধনকেও৷ বাচ্চা ছেলেটারও খোঁজ পাওয়া গেছিল সিটি হসপিটালে৷ আসলে সে বাচ্চা নয়…বামন৷ গণেশ লামার সার্কাসের জোকার৷ উচ্চতায় মাত্তর সাড়ে তিন ফুট!
তিনজনকে আলাদা করে জেরা করতেই রহস্য ধরা পড়ে গেল৷ জোকার জোজোকে সুমিত যখন পেটাচ্ছিল, তখন আমার সত্যিই খারাপ লাগছিল৷ দু-তিন ঘা খেয়ে, ভয়ে সে সত্যি কথা বলে ফেলল৷ কাল রাতে লামা সাবের গেস্ট হাউসে ওকে নিয়ে গেছিল দুর্যোধন৷ মোটর সাইকেলে করে৷ চাকরিসূত্রে জোকার জোজো বহুবার ওই গেস্ট হাউসে গেছে৷ ফলে প্রতিটি কোণ ওর নখদর্পণে৷ দুর্যোধন ওকে বলেছিল, বাথরুমের জানলার তেরচা কাচ খুলে ফ্যান্টার ঘরে ঢুকতে৷ জোজো ভিতরে ঢুকে দরজা খুলে দেবে৷ তারপর দুর্যোধন কম্বল জড়িয়ে ঘুমন্ত ফ্যান্টাকে তুলে আনবে৷ এই ছিল প্ল্যান৷ জোজোকে গার্ড দেওয়ার জন্য দুর্যোধন তখন তির-ধনুক নিয়ে বাগানে গাছের আড়ালে অপেক্ষা করছিল৷
প্ল্যান ভেস্তে যায়, জোকার জোজো তাড়াহুড়ো করে জানলার কাচ খুলতে যাওয়ায়৷ কাচ ভেঙে পড়ার শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পাগলা প্লেটো৷ মারের ভয়ে দুর্যোধন স্বীকার করল, গেস্ট হাউসে প্লেটোকে খুন করার প্ল্যান ওদের ছিল না৷ প্লেটো তির কিনতে হিপিপুরে ভীম তামাংয়ের অ্যান্টিক শপে যাবে, খবরটা পেয়ে ও একটা গাড়ি ভাড়া নেয়৷ ড্রাইভারকে বলেও দিয়েছিল, যে করেই হোক, প্লেটোকে হিপিপুরে নিয়ে যেতেই হবে৷ প্লেটো একা গেলে হয়তো প্ল্যান অনুযায়ী কাজটা হত৷ কিন্তু আমি ওর সঙ্গী হওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি৷ হিপিপুরে প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে দুর্যোধন আর ব্রতীন যখন জানতে পারে, মাঝরাস্তা থেকে প্লেটো কাঠমান্ডু ফিরে গেছে, তখন ওরা দুজনও গেস্ট হাউসে চলে আসে৷
ব্রতীন ছেলেটাকে দেখে আমার খুব রাগ হচ্ছিল৷ কার্শিয়ংয়ের কনভেন্টে পড়া ছেলে, কতই বা বয়স হবে? ছাবিবশ-সাতাশ৷ সবে তো জীবন শুরু করেছে৷ সে কী করে এমন একটা জঘন্য ছক কষতে পারে? স্কুল লাইফে যখন প্লেটোর বাড়িতে যেতাম, তখন ওকে দেখেছি বলে মনে পড়ল৷ সবসময় দাদার পিছন পিছন ঘুরঘুর করত৷ সেই দাদাকে মেরে ফেলার চিন্তা ওর মাথায় এল কেন? সুমিত প্রশ্নটা করায় ব্রতীন বলল, ‘ছোটোবেলা থেকে রথীনদার অনেক পাগলামি সহ্য করেছি৷ জেঠামশাই আর আমার বাবা ওর জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন৷ আমি কার্শিয়াং-এ থাকায় অতটা আঁচ পেতাম না৷ জেঠামশাই আর জেঠিমা মারা যাওয়ার পর দাদার পাগলামি বেড়ে গেল৷ আচমকা শ্যামবাজারের বসতবাড়িটা বিক্রি করে দিল৷ আমার কাছে খবর এল, মেদিনীপুরে দেশের বাড়িতে গিয়েও দাদা জলের মতো টাকা খরচ করছে৷ তখনই ঠিক করলাম, না, আর নয়৷ হনুমানদের আর্চারি শেখানোর নাম করে টাকার শ্রাদ্ধ আর করতে দেব না৷’
পাগলা প্লেটোর নাম যে রথীন, সেটা আমি প্রায় ভুলেই গেছিলাম৷ অনেকদিন পর কারও মুখে এই নামটা শুনলাম৷ বললাম, ‘রথীনকে তুমি বোঝালে না কেন?’
ব্রতীন বলল, ‘অনেক বুঝিয়েছি কালকেতুদা৷ কিন্তু দাদা নিজেকে শোধরায়নি৷ আজকালকার যুগে নিজের পকেট থেকে খরচা করে কি কেউ খেলার উন্নতির কথা ভাবে? আপনি সাংবাদিক, আপনি ভালোমতো জানেন, লোকে আগে হিসেব করে, খেলার জন্য যা খরচ করছি তার থেকে কতটা বেশি রোজগার হচ্ছে৷ রথীনদা এসব বুঝতেই চাইত না৷ ওর জীবনের স্বপ্ন-টপ্ন আমায় বোঝাত৷ কালকেতুদা, আপনারাই ওকে বোঝাতে পারতেন৷ তা না করে রথীনদাকে আপনারা সবসময় বাহবা দিয়ে গেছেন৷’
শুনে আমার একটু রাগই হল৷ বললাম, ‘তাই বলে ওকে মেরে ফেলার কথা ভাববে তুমি?’
‘কালকেতুদা, অজ্ঞতা সহ্য করা যায়৷ কিন্তু মূর্খামি নয়৷ যখন শুনলাম, আমাদের দেশের বাড়িটাও রথীনদা বন্ধক দিয়েছে, আর তা হাতছাড়া হতে যাচ্ছে তখনই ডিসিশনটা নিলাম৷ এই মূর্খ লোকটার বেঁচে থাকার অধিকার নেই৷ সুযোগটাও পেয়ে গেলাম৷ এখানে দুর্যোধনের কাছে কথায়-কথায় একদিন ফ্যান্টার প্রসঙ্গ তুলেছিলাম৷ ও শুনে লাফিয়ে উঠল৷ ও-ই গণেশ লামাকে বোঝায়, ফ্যান্টাকে কিনে আনতে পারলে ওদের সার্কাসটা আবার নতুন করে চালু করা যেতে পারে৷ ভারতে…মানে আমাদের দেশে সার্কাসে বন্যপ্রাণীদের এখন ব্যবহার করা যায় না৷ আইনত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু নেপালে সেরকম কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই৷ এখানে যে-কেউ বন্যপ্রাণী পুষতে পারে, বংশ বাড়াতে পারে, বিক্রি করতে পারে৷ ফ্যান্টার অত্যাশ্চর্য পারফরমেন্সের কথা শুনে টোপটা খেয়ে গেল গণেশ লামা৷ ও বলল, চলো হনুমানটাকে কিনে আনা যাক৷’
বললাম, ‘সেটা তো বে-আইনি কাজ হত৷’
‘সেই কারণেই কম্পিটিশনের নাম করে রথীনদা আর ফ্যান্টাকে এখানে নিয়ে আসা৷ হিপিপুরে আমাদের একটা আড্ডা আছে৷ সেখানে রথীনদাকে নিয়ে যেতে পারলে, ওর কাছ থেকে সব সম্পত্তি আমার নামে লিখিয়ে নিতে পারতাম৷ তারপর ওর চিহ্ন আর কেউ খুঁজে পেত না৷ আমিও দেশে ফিরে আত্মীয়-স্বজনের কাছে রটিয়ে দিতে পারতাম, পোখরা যাওয়ার পথে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় রথীনদা মারা গেছে৷ কিন্তু মাঝখান থেকে আপনি আমাদের প্ল্যানটা ভেস্তে দিলেন৷ ড্রাইভারের মাথায় রিভলভার ধরে৷ তখন আমরা প্ল্যান-বি তৈরি করলাম৷ উপায় নেই, গেস্ট হাউসেই কাজটা সারতে হবে৷ পিস্তল বা রিভলভার ব্যবহার করে নয়, তাতে আওয়াজ শুনে লোক বেরিয়ে আসতে পারে৷ কাজটা করতে হবে তির দিয়ে…নিঃশব্দে৷’
‘ফ্যান্টাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ?’
‘ফ্যান্টাকে আমরা কিডন্যাপ করতে পারিনি৷ কম্বল চাপা দিয়ে ওকে ঘর থেকে বের করে এনেছিল দুর্যোধন৷ কিন্তু কাল রাতে অত বৃষ্টির মধ্যেও কোত্থেকে যেন একদল হনুমান চলে এল৷ ওরাই ফ্যান্টাকে ছিনিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেল৷’
বললাম, ‘তোমাদের প্ল্যান বি-ও তো সফল হয়নি৷ রথীন বেঁচে আছে৷ ও দিব্যি দেশের বাড়িতে ফিরে যাবে৷ তোমাকে কিন্তু কয়েকটা বছর কাটাতে হবে কাঠমান্ডুর জেলে৷’
ব্রতীনের জবানবন্দি শুনে আমি আর সুমিত কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে রইলাম৷ ব্রতীনকে লকআপে পাঠানো হল৷ নীরবতা ভাঙল সুমিত, ‘এই প্রথম একটা কেস পেলাম, তিন-তিনজন অপরাধী একসঙ্গে ধরা পড়ে গেল৷ এক তিরে তিন পাখি, কী বলেন কালকেতুদা? ভীম তামাং, বিরজু শ্রেষ্ঠা আর ব্রতীন সমাদ্দার৷’
…বিকেলে হাসপাতালে যখন পাগলা প্লেটোকে দেখতে গেলাম, তখন ও বেডে থম মেরে বসে আছে৷ পুলিশের কাছ থেকেই সম্ভবত সব শুনে ফেলেছিল৷ আমাকে দেখে বলল, ‘সব ক’টা বেইমান, বুঝলি কালকেতু৷ আমার মন বলছিল, ফ্যান্টা আমাকে ছেড়ে জাতভাইদের কাছে চলে যাবে৷ বাস্তবে সেটাই হল৷ না, কারও উপর আর আস্থা রাখতে পারছি না ভাই৷ খেলার মাঠে আর না৷ আমি আর দেশেও ফিরব না৷ হরিদ্বারের কোনো আশ্রমে গিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব৷’
পাগলা প্লেটোর গলায় একমুখী রুদ্রাক্ষের মালাটা চোখে পড়ল৷ সেদিকে তাকিয়ে মনে হল, সুদীশ নাগ ঠিকই বলেছিল৷ একমুখী রুদ্রাক্ষ মানুষকে সংসার বিমুখ করে তোলে৷ দশদিনের মাথায় সে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যায়৷ প্লেটোর গলার মালাটা বোধহয় খাঁটি৷ তিনদিনের মাথায় ফল দিয়ে দিল৷
—