পাগলা ডাক্তারের প্রেতাত্মা

পাগলা ডাক্তারের প্রেতাত্মা

তুমুল বর্ষণ হচ্ছে, তার ওপর রাতের বেলা। অবাক হবার কিছু নেই, পথ হারিয়েছে কালো ভ্যানের আরোহীরা। রাস্তা কাদায় প্যাঁচপ্যাঁচে হয়ে আছে, হেডলাইটের আলোয় কয়েক ফুটের বেশি দূর দেখা যায় না। অন্ধের মত এগোচ্ছে গাড়িটা।

এভাবে এগোনোর কোনও মানে হয় না, রনি ভাই, অয়ন হোসেন বলল। কখন অ্যাকসিডেন্ট ঘটে যায়, সবাই বিপদে পড়ব।

তাই বলে রাস্তার মাঝখানে বসে থাকারও তত যুক্তি দেখছি না, বলল রনি স্টিভেনস, গাড়ির পাঁচজনের মধ্যে সবার বড় সে, গাড়ি চালাচ্ছে। একারসভিলে কোনোরকমে পৌঁছুতে পারলে বাঁচি।

পিঙ্কারটন থেকে আজই রওনা দেবার দরকার কী ছিল?জিমি পারকারের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরল। রাতটা ওখানে কাটালেই চলত।

তখন কি ছাই বুঝেছিলাম, এমন বৃষ্টি নামবে?

উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়া এমনই, বলল অয়ন। কিছুই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। সাড়ে তেইশ ডিগ্রি ল্যাটিচিউডের যত ওপরে যাবেন, আবহাওয়ার স্থিতিশীলতা ততই কমতে থাকবে। মেরু অঞ্চলের কথাই ধরুন…

এই রে, শুরু হয়ে গেল জ্ঞানের কচকচানি! জিমি ফোড়ন কাটল। অয়ন, তুই পারিসও বটে!

বেশি বেশি পড়ার কুফল, পেছন থেকে ভিকটর জেমস খোঁচা, লাগাল।

এতক্ষণ চুপচাপ ছিল গাড়ির পঞ্চম সদস্য হ্যারি মরগান। হঠাৎ বলল, সামনে আলো দেখা যাচ্ছে!

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটা পুলিশের প্যাট্রল কার। সেটার পাশে ভ্যান থামাল রনি। হর্ন বাজাল।

প্যাট্রল কারের জানালার কাঁচ নামিয়ে একটা মুখ উঁকি দিল। অয়নও কাঁচ নামাল। চেঁচিয়ে বলল, এক্সকিউজ মি. অফিসার! একটু সাহায্য করবেন?

কী হয়েছে, বাছা?

আমরা একারসভিলে যাব। কিন্তু পথ খুঁজে পাচ্ছি না।

একারস্‌ভিল! এটা তো ওখানে যাবার রাস্তা না।

মানে?

মাইল তিনেক পেছনে একটা ডাইভারশন আছে। বাদিকে গেলে একারভিল। তোমরা বোধহয় ভুল করে ডানে চলে এসেছ।

সেরেছে! বিড়বিড় করল জিমি।

তা হলে উল্টো ঘুরতে হচ্ছে, বলল রিকি।

এ রকম রাস্তায় আবার ওদিকে যাবেন? অয়ন বলল।

কী করতে চাও তা হলে?

সামনে কী আছে, অফিসার? অয়ন প্রশ্ন করল। রাত কাটানোর মত কোনও আশ্রয় মিলবে?

মানসিক রোগীদের একটা ছোটখাট পুরনো হাসপাতাল আছে, অফিসার বললেন। চমৎকার কিছু নয়। তবে খুব বেশি বিপাকে পড়লে রাত কাটানো যেতে পারে।

বিকল্প কিছু তো দেখছি না।

তা হলে চলে যাও। আর হ্যাঁ, পাগলা ডাক্তারের ভূতের থেকে সাবধান থেকো।

মানে!

গেলেই জানতে পারবে। তা হলে চলি।

আপনার নামটাই তো জানলাম না।

সার্জেন্ট জ্যাকব।

আমি অয়ন হোসেন। ভাল কথা, এত রাতে এখানে কী করছিলেন আপনি?

অফিশিয়াল ব্যাপার, তোমার না জানলেও চলবে। আচ্ছা চলি, দেখা হবে।

প্যাট্রল কারটা চলে গেল। ঘাড় ফেরাতেই অয়ন দেখল, সবাই বাঁকা চোখে ওকে দেখছে।

কী হলো? ও অবাক।

মানসিক হাসপাতাল। তার ওপর ভূত আছে! তোমার কি মাথা খারাপ হলো? রনি বলল।

অসুবিধে কী? মানসিক হাসপাতালে কি সুস্থ মানুষ থাকে না? আই মিন, ডাক্তার-নার্সেরা? মাত্র এক রাতের ব্যাপারই তো৷

কিন্তু ভূত?

ভূত বলে কিছু নেই, অয়ন হাসল। যদি থাকেও, বেশ মজা হবে। দারুণ একটা অ্যাডভেঞ্চার হয়ে যাবে।

আমি এর মধ্যে নেই, সাফ সাফ বলে দিল রনি।

আমি আছি, ফস করে বলে বসল জিমি।

আর কেউ? রিকি রাগী গলায় বলল।

হাত তুলল ভিকটর, দেখাদেখি হ্যারিও। একগাল হাসল অয়ন। বলল, ভোটে আপনি হেরে গেছেন, রনি ভাই।

সব কটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, গরগর করতে করতে স্টার্ট দিল রনি।

.

কয়েকদিন আগে ষান্মাষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ছুটির শুরুতে কয়েক স্কুলের মাঝে একটা বেসবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। অয়নদের স্কুলের টিম লিডার ছিল রনি, ওরা দুজনও অংশ নিয়েছে ওতে। দারুণ খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ওদের দল। খুশিতে রনি ঘোষণা দিয়েছিল, পুরো দলকে নিয়ে সাইট-সিয়িং টুরে বেরুবে। প্রথমে সবাই নাচানাচি করলেও কাজের বেলায় দেখা গেল, ওরা পাঁচজন ছাড়া কেউ নেই। রনিও পেছানোর পাত্র নয়। এ কজনকে নিয়েই বেরিয়ে পড়েছে। গন্তব্য, উত্তরে কানাডার সীমান্তবর্তী এলাকা ঘুরে ফিরে দেখা। এক সপ্তাহের প্রোগ্রাম। তার মধ্যে আজ তৃতীয় দিন। বিকেল পর্যন্ত পিঙ্কারটনে ছিল ওরা। তারপর একারসভিলের দিকে রওনা দিয়েছে। পথে বৃষ্টি এসে সব গুবলেট করে দিয়েছে।

আধঘণ্টা পরেই হাসপাতালে পৌঁছে গেল ওরা। পথে একটা অ্যাম্বুলেন্স ওদের পাশ কাটিয়ে উল্টোদিকে চলে গেল। গেট বন্ধ। খোলার জন্য অয়নকেই নামতে হলো। ভিজে গেল ও! হেডলাইটের আলোয় নামফলকটা দেখা গেল :

ওয়াইল্ডারস অ্যাসাইলাম

দোতলা একটা বাড়ির সামনে এসে থামল মাইক্রোবাস। ঘন্টা বাজাতেই বয়স্ক একজন লোক এসে দরজা খুলল। নিজেদের পরিচয় দিল অয়ন। তারপর সমস্যাটা খুলে বলল।

ভেতরে এসো তোমরা, ভদ্রলোক দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন।

গাড়িটা কি ওখানেই থাকবে? রনি বলল।

তার প্রয়োজন নেই, বললেন ভদ্রলোক। আমাদের গ্যারেজ আছে।

তা হলে রেখেই আসি। কোথায় ওটা?

পেছনে।

ধন্যবাদ জানিয়ে ঘুরতে যাচ্ছিল রনি। কিন্তু অ্যাপ্রন পরা একজন লোক এসে বলল, চাবিটা আমাকে দিন। আমিই রেখে আসি। গ্যারেজের দরজাটা ছোট। গাড়ি ঢোকাতে আপনার অসুবিধে হবে।

আপত্তি না করে চাবিটা তাকে দিয়ে দিল রনি। লোকটা বেরিয়ে যেতেই বয়স্ক ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন।

আমি ড. জর্জ বার্নার্ড। এখানকার দায়িত্বে আছি। ওই যে গাড়ি রাখতে গেল, আমার অ্যাসিসটেন্ট–বেন টমসন।

কজন আছেন আপনারা, ডক্টরঃ জিমি প্রশ্ন করল।

তিনজন। বেন ছাড়া আরেকজন অ্যাসিসটেন্ট আছে আমার। পল ট্রেভারস।

তিনজনে কাজ চলে?

দিব্যি। রোগী তত বেশি নয়। মাত্র বানোজন।

আমার বেশ থ্রিল লাগছে, হ্যারি বলল। আগে কখনও মানসিক হাসপাতালে আসিনি।

ড. বার্নার্ড হাসলেন, আমিও খুশি হয়েছি। এখানে আমরা তেমন অতিথি পাই না।

কেন?

মানসিক হাসপাতালে কেউ কি সহজে আসতে চায়? কী আর বলব, রোগীদের আত্মীয়রাও এড়িয়ে চলে হাসপাতালকে… সহজে আসতে চায় না। ভয় পায়।

কীসের ভয়? ভূতের? অয়ন বলল।

কথাটা শুনে এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলেন ডাক্তার। তারপর বললেন, ভূতের কথা বললে কেন?

ও কিছু না। আসার পথে এক পুলিশ অফিসারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি এক পাগলা ডাক্তারের কথা বললেন। ব্যাপারটা কী?

এসো, ডাক্তার বললেন। তোমাদের একটা জিনিস দেখাই।

রুমের অন্যপ্রান্তে গেল সবাই। দেয়ালের সঙ্গে টাঙানো আছে একটা বিশাল পোট্রট। অ্যাপ্রন পরা একজন মানুষের ছবি, মাথায় ডাক্তারি টুপিও আছে। সেটা দেখিয়ে উ, বার্নার্ড বললেন, ইনি হলেন এই হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ড. জন ওয়াইল্ডার। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে হাসপাতালটা গড়ে তোলেন তিনি। এর পেছনে একটা ছোট্ট গল্প আছে।

ড. ওয়াইল্ডার ছিলেন তার পিতামাতার দ্বিতীয় সন্তান। তার বড় ভাই ছিলেন বেশ সফল একজন ব্যবসায়ী। একটা দুর্ঘটনায় ভদ্রলোক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ড. ওয়াইল্ডার তখন সবেমাত্র ডাক্তারি পাস করে বেরিয়েছেন। বড় ভাইকে তিনি খুবই ভালবাসতেন। তাকে ভাল করে তোলার জন্য প্রতিজ্ঞা করেন তিনি। কিন্তু কাজের চাপে খুব একটা সময় দিতে পারছিলেন না ডাক্তার। তখন তিনি এই হাসপাতালটা বানান, এটাকেই নিজের কাজের জায়গা করেন। ভাইকেও নিয়ে আসেন। অন্য রোগীদের পাশাপাশি ভাইয়ের চিকিৎসাও শুরু করেন।

কিন্তু লাভ হলো না। একদিন রাতে সবার অজান্তে তার ভাই আত্মহত্যা করে বসেন। ঘটনাটার আঘাত সহ্য করতে পারলেন না ডাক্তার। নিজেও মানসিক ভারসাম্য হারালেন। তার নাম হয়ে গেল–পাগলা ডাক্তার। এভাবে বেশ কয়েক বছর ছিলেন তিনি। তারপর মারা যান।

স্বাভাবিক মৃত্যু? অয়ন জানতে চাইল।

সেটা জানা যায়নি, তবে আত্মহত্যার আলামতও পাওয়া যায়নি।

মনটাই খারাপ হয়ে গেল গল্পটা শুনে, হ্যারি বলল। একজন ভাল মানুষের কী ভয়ানক পরিণতি!

ভূতের ব্যাপারটা কী? জিমি বলল।

বিরক্তির ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন ডাক্তার। বললেন, ওটা গুজব। লোকজন দাবি করে, ডা. ওয়াইল্ডারের অতৃপ্ত আত্মা নাকি এখনও হাসপাতালের আশপাশে ঘোরাফেরা করে। কেউ কেউ নাকি দেখেছেও। সব ফালতু কথা। আমি এত বছর ধরে আছিকই, কখনও দেখলাম না

একটা ঢোক গিলল রনি। তার আবার ভূতের ভয় বেশি।

বেন টমসন ফিরে এসেছে। রনিকে গাড়ির চাবি ফেরত দিয়ে বলল, চলুন আপনাদের থাকার জায়গা দেখিয়ে দিই।

তোমরা নিশ্চয়ই কিছু খাওনি। তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে নিচে এসো। আমি পলকে খাবার দিতে বলছি, ডাক্তার বললেন।

তাই তো বলি, পেটের ভেতর ছুঁচো নাচে কেন? ভোজনরসিক ভিক্টর বলল। এক্ষুণি আসছি, স্যর।

ওর বলার ধরন শুনে সবাই হেসে ফেলল। তারপর বেনের পিছু নিল।

অয়ন আর জিমি একটা রুম পেল। অন্য আরেকটা রুমে বাকিরা গিয়ে উঠল।

রাতে সাবধানে থেকো, রনিদের বলল বেন। এই ঘরেই বহু বছর আগে ড. ওয়াইল্ডার থাকতেন।

ঢোক গিলল রনি। বলল, অন্য কোনও রুমে থাকা যায় না?

আর কোনও ভাল কামরা নেই।

চলে যাচ্ছিল কেন। পেছন থেকে হ্যারি বলল, আপনি ভূতে বিশ্বাস করেন?

পাগলা ডাক্তারের প্রেতাত্মাকে নিজ চোখে দেখেছি আমি।

আর কিছু না বলে চলে গেল বেন।

রাতের খাওয়ার ফাঁকে ঘটনাটা অয়নকে জানাল হ্যারি। শুনে কোনও মন্তব্য করল না ও। শুধু একটু গম্ভীর হয়ে গেল।

খাওয়া মোটামুটি জমল। আইটেমগুলো তেমন আহামরি নয়, হয়তো দ্রুত আয়োজন করতে হয়েছে বলেই। তবে খিদে পেয়েছিল, খেতে মন্দ লাগল না।

আপনার রোগীরা সব কোথায়, ড. বার্নার্ড প্রশ্ন করল জিমি।

যার যার কেবিনে, ডাক্তার বললেন। রাতে ঘুমের ওষুধ দেয়া হয়। সবাইকে। মড়ার মত ঘুমোচ্ছ।

হালকা গল্প-গুজবের মধ্যে খাওয়া শেষ হলো। ডাক্তারকে বিদায় জানিয়ে যার যার কামরায় ফিরে গেল ওরা।

অয়ন আর জিমি শোওয়ার আয়োজন করছে, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। কেন এসেছে।

কিছু লাগবে তোমাদের? বলল সে। পানি নিয়ে এসেছি।

না, থ্যাঙ্ক ইউ।

ঠিক আছে, গুড নাইট। বলেও চলে গেল না বেন।

কিছু বলবেন, মি. টমসন? অয়ন জিজ্ঞেস করল।

ইয়ে… রাতে রুম থেকে বেরিয়ো না।

কেন?

মানে… অদ্ভুত সব ব্যাপার-স্যাপার ঘটে মাঝে মাঝে।

কী রকম?

নানা রকম শব্দ হয়, মাঝে মাঝে ঘরের দরজা আটকে যায়, কোনও বাতি জ্বলে না… যা হোক, এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। বিপদ ঘটতে পারে।

অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। সাবধানে থাকব।

আচ্ছা যাই, বাকিদেরও সাবধান করতে হবে।

বেন চলে যেতেই বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়ল অয়ন। কী যেন গভীরভাবে ভাবছে।

কী ভাবছিস? জিমি জিজ্ঞেস করল।

ভূতটা নিয়ে, অয়ন বলল। মনটা খুঁতখুঁত করছে।

সত্যি ভূত আছে ভাবছিস?

উঁহুঁ, একটা গণ্ডগোল আছে। কয়েকটা ব্যাপারে খটকা লাগছে।

মানেটা কী দাঁড়াল?

কিছু একটা ঘটবে আজ রাতে, আমি শিয়োর। পরক্ষণেই অয়ন হাসল। বলল, মনে হচ্ছে আরেকটা রহস্য পেয়ে গেছি।

.

ঘুমিয়ে পড়েছিল অয়ন আর জিমি। হঠাৎ জেগে উঠল। কাঁচা ঘুম ভাঙলে প্রথমে কিছুক্ষণ মাথা কাজ করে না। কিছু সময় পার হবার পর ওরা বুঝল, বাইরে একটা শব্দ হচ্ছে। ঘুম ভাঙার জন্য সেটাই দায়ী।

হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা টেবিল ল্যাম্পটার সুইচ টিপল অয়ন। জ্বলল না সেটা। হাতড়ে হাতড়ে দেয়ালের কাছে চলে গেল জিমি। ঘরের বাতি জ্বালার চেষ্টা করল। লাভ হলো না।

বাতি জ্বলছে না, অয়ন, বলল ও।

ভুতুড়ে ব্যাপার ঘটছে, অয়ন বুলল। ঠিক যেমনটা বলেছিল বেন। দরজাটার অবস্থা কী?

হাতল ধরে টানাটানি করল জিমি। বলল, খুলছে না।

স্বাভাবিক।

কী করা যায়, বল তো?

এখানে জড়সড় হয়ে বসে থাকলে হয়তো কিছুই ঘটবে না। নিকাটে রাতটা কাটিয়ে দেয়া যাবে। নতুবা গিয়ে দেখা যায়, ব্যাপারটা কী।

আমি বসে থাকতে রাজি নই।

আমিও না।

কিম্ভ বেরুবি কীভাবে? দরজা তো বন্ধ।

ধীরে, বন্ধু, ধীরে। ওয়ান অ্যাট আ টাইম। প্রথমে আলো দরকার।

কোনও আলো জ্বলছে না।

ভুল। আমাদের ভূত মহোদয়ের কাজকর্ম বড়ই কাঁচা। এইমাত্র হাতঘড়ির আলো জ্বালতে পেরেছি আমি। এখন দেখা দরকার আমাদের টর্চগুলোও জ্বলে কি না।

কটা বাজে?

দুটো দশ। ব্যাগ থেকে নিজের টর্চ বের করল অয়ন। সুইচ টিপতেই জ্বলে উঠল। বাহ, এই তো জ্বলছে!

জিমিও নিজের টর্চ বের করল। বলল, এবার? ঘর থেকে বের হব কী করে?

জানালাটা দেখ তো।

লাভ নেই, কবাট খুলে বলল জিমি। মোটা মোটা গরাদে লাগানো। তা ছাড়া মাটিও অনেক নিচে। লাফ দিলে হাড়গোড় ভাঙবে।

তা হলে দরজাটাই ভরসা।

দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল অয়ন। হাতলটা পরীক্ষা করল। তারপর শিস দিয়ে বলল, বাইরে থেকে চাবি মেরে দিয়েছে। কাজটা ভূতের চেয়ে মানুষের পক্ষেই বেশি সহজ।

পারবি খুলতে?

শিয়োর।

কীভাবে? তোর সেই তারের ম্যাজিক?

হ্যাঁ।

তার পাচ্ছিস কোথায়?

জবাব না দিয়ে পকেট নাইফটা বের করল অয়ন। টেবিল ল্যাম্পের তার কেটে ফেলল। তারপর দুখণ্ড তামা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কাজটায় ইতিমধ্যেই হাত পাকিয়ে ফেলেছে ও। মিনিট পাঁচেক লাগল তালাটা খুলতে।

দরজা খুলে করিডরে বেরিয়ে এল ওরা। পাগলা হাওয়ার শো শো শব্দ হচ্ছে। অথচ কোনও বাতাস নেই। মাঝে মাঝে খনখনে গলার একটা ভয়ঙ্কর অট্টহাসি হচ্ছে। নিজের অজান্তে কেঁপে উঠল ওরা।

বাকিদের অবস্থা দেখা দরকার, অয়ন বলল।

দুটো দরজা পরেই রনিদের রুম। সেটাও তালামারা। তার নিয়ে। ব্যস্ত হয়ে পড়ল অয়ন। একটু পরই খুলে গেল দরজা।

রুমের এক কোণে ভয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে আছে তিনজন। অয়নরা টর্চের আলো ফেলতেই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি ওদের শান্ত করল ওরা।

ওহ, তোমরা! রনি কাঁপতে কাঁপতে বলল। ভাবলাম ভূতটা বুঝি আবার এসেছে।

ড. ওয়াইল্ডার! অয়ন উত্তেজিত। দেখেছেন তাকে? জবাব না দিয়ে মাথা ঝাঁকাল রনি।

ঘটনাটা খুলে বলুন।

ঘুমুচ্ছিলাম, ভিকটর বলল। হঠাৎ ঝটকা দিয়ে দরজা খুলে গেল। দেখলাম, ড. ওয়াইল্ডার দাঁড়িয়ে। অবিকল পোট্রটটার মত পোশাক পরা।

অন্ধকারে দেখলে কীভাবে? জিমি বাধা দিল।

তখন করিডরে বাতি জ্বলছিল। ঘরের ভেতর আবছা আলো ছিল। তাতেই দেখা গেল।

তারপর?

প্রথমে ভূতটা কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিল। তারপর খনখনে একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। যাবার সময় দরজাটা টেনে দিল। ওটা আর খুলতে পারলাম না। এরপর বাতি নিভে গেল, শব্দও শুরু হয়ে গেল।

হুঁ, বলল অয়ন। ব্যাপারটা চেক করতে হচ্ছে।

কী চেক করবে? রনি বিস্মিত গলায় বলল।

চুপচাপ এখানে বসে থাকো। রাতটা কোনোমতে কাটাতে পারলে বাঁচি। সকাল হলেই ভাগব।

মোটই না, দৃঢ় গলায় বলল অয়ন। এটা আসলেই ভূত কি না জানতে হবে আমাকে।

বলে কী! মাথাটাথা খারাপ হয়ে যায়নি তো?

উঁহুঁ, মাথা নাড়ল জিমি। ও এরকমই। ব্লাডহাউণ্ডের মত, রক্তের গন্ধ পেয়েছে–এখন আর ঠেকাতে পারবেন না।

রক্ত কোথায় পেলে?

রক্ত না, ও গন্ধ পেয়েছে রহস্যের, বলল হ্যারি। ঠিক না?

একেবারে! জিমি হাসল।

বুঝতে পারছি, তোমাকে ঠেকানো যাবে না, হাল ছেড়ে দিল রনি। কী করতে চাও?

আলো জ্বলছে না কেন, জানা দরকার, অয়ন বলল। মেইন সুইচটা পেলে পরিষ্কার হয়ে যেত। ওটা খুঁজতে যাব।

একা গিয়ে বিপদে পড়ার দরকার কী? ভিকটর বলল। সবাই যাই।

গুড আইডিয়া! দুভাগ হয়ে যাব আমরা। জিমির সঙ্গে রনি ভাই আর ভিকটর, হ্যারি ও আমি আরেকদিকে।

অবজেকশন! রনি প্রতিবাদ করল। ব্যাড আইডিয়া! সবার একসঙ্গে থাকা উচিত।

না। তাতে সময় বেশি লাগবে। তা ছাড়া একদল বিপদে পড়লে অন্যদল সাহায্য করতে পারবে না।

শ্রাগ করল রনি।

কোথায় যাব আমরা? ভিকটর প্রশ্ন করল।

নিচতলায়, জানাল অয়ন। মেইন সুইচটা ওখানেই কোথাও হবে।

ওকে?

কাজ শেষে ডাইনিং রুমে ফিরব সবাই। আধঘণ্টার মধ্যে মেইন সুইচ না পেলেও ফিরব আমরা।

কাজে নেমে পড়ল সবাই। যার যার টর্চ নিয়ে নিচতলায় নামল। অয়নরা গেল ডানদিকের করিডরে, জিমিরা বামে।

নিচে নামার আগেই ভুতুড়ে শব্দটা থেমে গেছে। একটু অবাক না হয়ে পারল না অয়ন।

প্রথমে দুদলই ভুল করে রোগীদের ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর আবার খোঁজা শুরু করল। এর মধ্যে হঠাৎ আলো চলে এল।

চল, ফিরে যাই, হ্যারি অয়নকে বলল।

না, অয়ন মাথা নাড়ল। তল্লাশিটা শেষ করি। নতুন কোনও সূত্র মিলতে পারে।

একটা রুমে এসে ঢুকল ওরা। দেখে মনে হলো স্টোর, নানারকম জিনিসে বোঝাই। একটা একটা করে সব পরীক্ষা করতে লাগল ওরা।

কী খুঁজছ? হ্যারি বলল।

অস্বাভাবিক কোনোকিছু, অয়ন বলল।

এক বাক্স পরচুলাকে কি অস্বাভাবিক বলা চলে?

পরচুলা! অয়ন অবাক। কোথায়?

এই তো!

খোলা একটা বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হ্যারি, অর্ধেকটা পরচুলায় ভর্তি।

আজব ব্যাপার! চিন্তিত গলায় বলল অয়ন। মানসিক হাসপাতালে পরচুলার কী প্রয়োজন থাকতে পারে?

পেছনে ঠাস করে একটা শব্দ হলো। পাঁই করে ঘুরল ওরা। দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিল অয়ন। লাভ হলো না। এ দরজায় কোনও তালা নেই, সম্ভবত বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়েছে। বাতিও হঠাৎ নিভে গেল।

এবার? হ্যারি বলল।

জবাব না দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল অয়ন। ফাঁদে পড়ে গেছে ওরা। হঠাৎ একটা দুশ্চিন্তা ভর করল মাথায়। জিমি, ভিকটর আর রনি ভাই… ওরা ঠিক আছে তো?

.

মেইন সুইচ খুঁজে পায়নি জিমিরা। তার আগেই আলো জ্বলে উঠেছে। একটা রুম থেকে বেরুতেই দেখল, বেন আর পল করিডরে দাঁড়ানো। ওদের দেখে বেন বিস্মিত কণ্ঠে বলল, তোমরা এখানে কী করছ?

হড়বড় করে সব বলে দিতে যাচ্ছিল ভিকটর। চিমটি কেটে তাকে থামিয়ে দিল জিমি। বলল, শব্দ শুনে খোঁজ করতে এসেছি। আপনারা

কী করছেন?

রাতে দুজন রোগী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওদের কাছে এসেছিলাম। ভৌতিক কাণ্ড শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আটকা পড়ে গেলাম। এইমাত্র বেরিয়েছি।

রোগীদের কী অবস্থা?

ভাল না। শহরে বড় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আমি আর পল এখুনি যাচ্ছি।

আমরা কোনও সাহায্য করতে পারি?

দরকার নেই। আমরাই পারব। তোমরা শুয়ে পড়ো।

ডাক্তার কোথায়?

রুমে আছেন। ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। তোমরা যাও।

আর কিছু করার নেই। উল্টো ঘুরে হাটা ধরল ওরা তিনজন। এক ফাঁকে উল্টো ঘুরে তাকাল জিমি। দেখল, সাদা চাদরে ঢাকা দুটো স্ট্রেচার ঠেলে চলে যাচ্ছে বেন আর পল। চাদরের নিচ থেকে রোগীদের মাথার চুল বেরিয়ে আছে।

 ডাইনিং রুমে দাঁড়িয়ে অয়নদের জন্য অপেক্ষা করল। কিন্তু ওরা এল না।

আসছে না কেন? দুমিনিট পর বিড়বিড় করল জিমি। তারপর প্রস্তাব দিল, চলো, দেখে আসি।

একটা দরজায় ধুপ ধুপ করে ধাক্কার শব্দ শুনে সেটা খুলল ওরা। অয়ন আর হ্যারি বেরিয়ে এল।

থ্যাঙ্ক গড, অয়ন বলল। তোরা ঠিক আছিস?

ভুরু কোঁচকাল ভিকটর। বলল, প্রশ্নটা কি আমাদের করার কথা নয়?

কী হয়েছিল? জানতে চাইল জিমি। সংক্ষেপে বলল অয়ন। তারপর জিজ্ঞেস করল, তোরা কী পেলি?

কিছুই না, গোমড়ামুখে বলল জিমি। মেইন সুইচ পাবার আগেই আলো চলে এসেছে। বেন আর পলের সঙ্গে দেখা হলো। দুজন পেশেন্টকে শহরে নিয়ে যাচ্ছে।

তা-ই?

হ্যাঁ, তবে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। আমরা কোনও অসুস্থ পেশেন্টের দেখা পাইনি। আর কোনও রুমের দরজাও বন্ধ ছিল না। তা ছাড়া অসুস্থ রোগী ফেলে ড. বার্নার্ড ঘুমাচ্ছেন-এটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়।

মোট কজন পেশেন্ট দেখেছিস তোরা? উত্তেজিত কণ্ঠে বলল অয়ন। একটা চিন্তা মাথায় টোকা দিয়েছে ওর।

পাঁচ… না, ওই দুজন সহ সাত।

আমরাও সাতজনকে দেখেছি। মানে মোট দাঁড়াল চোদ্দ। কিন্তু হবার তো কথা বারোজন। বাকি দুজন এল কোত্থেকে?

কী বলতে চাও? রনি অবাক।

রোগীদের চেহারা দেখেছিস? অয়ন জিজ্ঞেস করল।

না, শুধু চুল, জিমি বলল।

মুখ চাওয়াচাওয়ি করল অয়ন আর হ্যারি। তারপর সমস্বরে বলে উঠল, পরচুলা!

মানে? জিমি কিছু বুঝতে পারছে না।

ব্যাখ্যা করার সময় নেই, বলল অয়ন। তোরা ড. বার্নার্ডকে খুঁজে বের কর। আমি যাচ্ছি বেন আর পলের পেছনে। ওই স্ট্রেচারে কী আছে, দেখা দরকার।

আমিও যাব, হ্যারি বলল।

ঠিক আছে, চলো।

পেছনদিকে গেছে ওরা, জিমি জানাল। সাবধানে থাকিস।

শিয়ার!

ড. বার্নার্ড দোতলায় থাকেন, আগেই শুনেছে ওরা। জিমিরা ওপরে উঠল। আর অয়নরা বেন আর পলের পথ ধরল।

ডাক্তারের রুমটা খুঁজে পেতে বেশিক্ষণ লাগল না। বাতি জ্বালতেই ওরা দেখল, ভদ্রলোক অঘোরে ঘুমুচ্ছেন। ধাক্কা দিয়ে জাগানো গেল না।

ব্যাপার কী? রনি বিড়বিড় করল। এতই গভীর ঘুম?

মনে হয় না, বেডসাইড টেবিল থেকে আধ খাওয়া পানির গ্লাস তুলে নেড়েচেড়ে দেখছে জিমি। ওনাকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়েছে।

চমৎকার আন্দাজ! পেছনে একটা খনখনে গলা বলে উঠল।

ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল ওরা। দেখল, দরজায় দাঁড়িয়ে পাগলা ডাক্তার। ভূত নয়, জলজ্যান্ত মানুষ। হাতে একটা পিস্তলও আছে। উজ্জ্বল আলোয় চেহারাটা তত ভয়ঙ্কর লাগছে না। বোঝা যাচ্ছে, ছদ্মবেশ নিয়েছে।

জীবনে বহু ছেলে-পিলে দেখেছি, কিন্তু এমন বিচ্ছু দেখিনি, বলল লোকটা। বাকি দুজন কোথায়? স্টোর থেকে বের হয়েছে, তারপর কোথায় গেল?

পারলে খুঁজে বের করুন, বলল জিমি।

তা তো করবই। আগে তোমাদের ব্যবস্থা করে নিই।

ভয় পেয়ে বড় বড় ঢোক গিলল ভিকটর আর রনি।

.

বেনদের ফলো করে অয়ন আর হ্যারি গ্যারেজে পৌঁছেছে। কয়েকটা ড্রামের আড়ালে লুকিয়ে দেখল, একটা স্ট্রেচার ইতিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ফেলেছে ব্যাটারা। এখন দ্বিতীয়টা নিয়ে ব্যস্ত। রীতিমত যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাদের, স্ট্রেচারটা দারুণ ভারী। ঘাম ছুটে গেছে দুজনেরই।

কী আছে ওতে, এত ভারী কেন? বিড়বিড় করল অয়ন।

কী মনে হয়? হ্যারি শুধাল।

নিরেট পাথর, নয়তো সোনা, বলল অয়ন। পাথর নিয়ে এত ঝামেলা করে না কেউ। কাজেই সোনা থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

সোনা! হ্যারির বিশ্বাস হচ্ছে না।

হুঁ, মনে হচ্ছে এরা স্বর্ণ চোরাচালানি। এগুলো নিশ্চয়ই কোথাও পাচার করতে নিয়ে যাচ্ছে।

কী করা যায়?

ঠেকাতে হবে ওদের। এখানেই!

কোনও প্ল্যান আছে?

ভাবছি।

স্ট্রেচারটা অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ফেলেছে বেন আর পল। এবার নিজেরা ড্রাইভিং ক্যাবে উঠে পড়ল। ঝড়ের বেগে চিন্তা করছে অয়ন। অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে এগজস্ট পাইপটা দেখা যাচ্ছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল, এক কোণে বেশ কিছু ছেঁড়া ন্যাকড়া পড়ে আছে। মুখে হাসি ফুটল ওর।

হ্যারিকে অপেক্ষা করতে বলে ন্যাকড়াগুলো নিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে চলে গেল ও। ন্যাকড়াগুলো পাকিয়ে এগজস্ট পাইপের ভেতর ভরে দিল। তারপর আবার হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে এল আগের জায়গায়।

কয়েক মুহূর্ত পরেই ইগনিশনের চাবি ঘোরাল বেন। ইঞ্জিন স্টার্ট হলো ঠিকই, কিন্তু এগজস্টে ধোয়া আটকে যাওয়ায় খখক করে কেশে উঠে থেমে গেল আবার। বিরক্ত হয়ে ঘোৎ জাতীয় একটা শব্দ করল বেন। তারপর আবার চেষ্টা করল, এবারও একই ঘটনা ঘটল। রেগে উঠল বেন। বারবার চেষ্টা করল, কিন্তু গাড়ি স্টার্ট নেয়াতে পারল না। শেষে বিরক্ত হয়ে দুজনেই নামল গাড়ি থেকে।

এদিকে ড্রামের আড়ালে নিঃশব্দ হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছে অয়ন আর হ্যারি। হঠাৎ অসাবধানে ড্রামের সঙ্গে ধাক্কা খেল হ্যারি। খটখট শব্দে নড়ে উঠল সেটা।

সর্বনাশ! ফিসফিসাল অয়ন।

ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়েছে বেন আর পল। গলা চড়িয়ে বলল, কে ওখানে?

একটা মাত্র শব্দ উচ্চারণ করল অয়ন, তারপরই দুজন ছুট লাগাল।

পালাও!

ধরো ওদের! গর্জে উঠল বেন। তারপর ধাওয়া করল।

করিডরে পৌঁছেই একটা দরজায় ডিসপোরি ফলক দেখল অয়ন। টান দিয়ে হ্যারিকে নিয়ে ঢুকে পড়ল সেখানে। বেকায়দা পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য অস্ত্র দরকার। ডিসপেন্সারিতেই পাওয়া যাবে তা। একটা বুদ্ধি এসেছে।

দুটো সিরিঞ্জ খুঁজে বের করো, হ্যারিকে বলল ও।

কেন? হ্যারি বিস্মিত কণ্ঠে বলল।

পরে বলছি, আগে বের করো।

অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওরা। ডাক্তার বাবা-মার সুবাদে ওষুধপত্র সম্পর্কে ভাল জ্ঞান আছে জিমির, ওর কাছ থেকে অয়নও কিছু শিখেছে। এখন সেটা কাজে লাগল। ঘুমের ইঞ্জেকশনের দুটো অ্যাল খুঁজে বের করল ও। হ্যারিও দুটো ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ নিয়ে তৈরি। খুশিতে শিস দিয়ে উঠল অয়ন। তারপর প্ল্যানটা ব্যাখ্যা করল।

এদিকে বেন আর পল করিডরে পৌঁছে কাউকে দেখতে পেল না। বুঝতে পারল, অয়নরা কোনও একটা কামরায় ঢুকে পড়েছে। একটা একটা করে রুম চেক করতে লাগল দুজনে। একসময় ডিসপেন্সারির দরজা খুলল। লাইট জ্বালতে গেল, কিন্তু তার আগেই আক্রমণ করল অয়নরা। ঘ্যাঁচ করে দুই শত্রুর পাছায় সুঁই বিধিয়ে ইঞ্জেকশন পুশ করল।

অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে গেল বেন আর পল, ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল। ধাক্কা দিয়ে তাদের ভেতরে ঠেলে দিল অয়ন আর হ্যারি। তারপর বেরিয়ে দরজা টেনে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল।

দরজায় ধাক্কা দিতে চেষ্টা করল বেনরা, কিন্তু ইঞ্জেকশনের প্রতিক্রিয়া শুরু হতেই ঢলে পড়ল।

গ্রেট! উত্তেজনায় বলে উঠল হ্যারি।

চল, জিমিদের কী অবস্থা দেখি, প্রস্তাব দিল অয়ন।

ডাক্তারের রুমের সামনে পৌঁছানোর আগেই অচেনা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে হ্যারিকে চুপ থাকার জন্য ইশারা করল অয়ন। তারপর আড়াল থেকে উঁকি দিল।

কী ব্যাপার? হ্যারি ফিসফিস করে জানতে চাইল।

পাগলা ডাক্তার জিমিদের দিকে পিস্তল বাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাহায্য দরকার ওদের।

ইঞ্জেকশন?

না, ঝুঁকি নেয়া হয়ে যাবে। ব্যাটা গুলি করে বসতে পারে।

তা হলে?

ওর মনোযোগ অন্যদিকে ফেরাতে পারলেই হয়, জিমি বাকিট। সামাল দিতে পারবে।

কীভাবে?

একটু হাসল অয়ন। চুপটি করে বসো, আর আমার খেলা দেখো।

করিডর থেকে একটা বালব খুলে নিল অয়ন। তারপর ড. বার্নার্ডের রুমের সামনে ছুঁড়ে দিল।

ফটাস করে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো বালবটা। পাই করে ঘুরল পাগলা ডাক্তার। এই সুযোগের অপেক্ষাই করছিল জিমি। চেঁচিয়ে উঠল ও, অ্যাটাক!

তারপর রনি আর ভিকটরসহ ডাইড দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। উড়ে গিয়ে করিডরে উপুড় হয়ে পড়ল লোকটা, হাত থেকে ছুটে গেল পিস্তল। ততক্ষণে অয়ন আর হ্যারিও লাফিয়ে পড়ল। পাঁচজনের সঙ্গে পেরে উঠল

সে, পরাস্ত হলো। হাত দুটো পিঠের দিকে ভাজ করে চিৎ করানো হলো তাকে।

ধস্তাধস্তিতে ছদ্মবেশ খুলে গেছে। মুখটার দিকে তাকিয়ে ভিকটর বিস্মিত কণ্ঠে বলল, লেফটেন্যান্ট জ্যাকব!

অবাক হইনি, বলল অয়ন। আসলে উনি কখন উদয় হন, সে অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি।

বেকুবের দল, ছাড়ো আমাকে! জ্যাকব চেঁচাল।

উঁহুঁ, সেটা হচ্ছে না, জিমি বলল। আপনার খেলা খতম। ভিকটর, দেখো তো দড়ি পাওয়া যায় কি না।

বেন আর পল কোথায়? রনি প্রশ্ন করল।

নিচতলায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে, মুচকি হাসল অয়ন। জেগে ওঠার পর নিজেদের জেলখানায় আবিষ্কার করে অবাকই হবে ওরা।

হোঃ হোঃ করে হেসে উঠল হ্যারি।

.

পরদিন সকাল। ডাইনিং রুমে বসে ব্রেকফাস্ট করছে ছেলেরা। সঙ্গে ড. বার্নার্ডও আছেন। ভোর হবার আগেই পুলিশ এসে তিন দুবৃত্তকে নিয়ে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স থেকে প্রচুর পরিমাণ স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়েছে–দামের দিক দিয়ে কয়েক লাখ ডলারের কম হবে না। ডাক্তার এখনও উদভ্রান্ত, কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না। ঘুমের ওষুধও এর জন্য কিছুটা দায়ী।

আমার মাথায় এখনও কিছু ঢুকছে না, বললেন তিনি। সবকিছু এলোমেলো মনে হচ্ছে।

সব খোলাসা করে দিচ্ছি, অয়ন বলল। বেন আর পল একটা স্বর্ণ চোরাচালান দলের সদস্য। এই হাসপাতালটাকে ওরা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করছিল। মোটা ঘুষ পেয়ে লেফটেন্যান্ট জ্যাকবও ওদের দলে ভিড়ে যায়, গ্রেফতার হবার পর স্বীকার করেছে সে। সে নিরাপত্তার দিকটা দেখত।

ঘাঁটি হিসেবে জায়গাটা বেশ নিরাপদ। নির্জন জায়গা, লোকজন সহজে আসে না–ভূতের ভয় ছড়িয়ে ওরা সেটা একদমই বন্ধ করে দিল। তা ছাড়া সীমান্তও খুব কাছে। চমৎকার ব্যবস্থা–মানুষের আকার করে স্ট্রেচারে সোনার বার সাজাত ওরা। মাথার কাছে একটা পরচুলা দিয়ে বাকিটা চাদর দিয়ে ঢেকে দিত। বাইরে থেকে বোঝার কোনও উপায়ই নেই।

কোথায় যেত এই সোনা?

কানাডায়। জ্যাকব বলেছে, পাহাড়ের ভেতর নাকি একটা গোপন সুড়ঙ্গ আছে। সেটার মধ্য দিয়েই সমস্ত স্বর্ণ পাচার হয়। সীমান্তরক্ষীরা জানতে পারে না। মোটামুটি নিরাপদ একটা প্রজেক্ট বলা চলে।

কিন্তু আমি কোনোকিছু টের পেলাম না কেন?

কারণ রোজ রোজ এমনটা ঘটে না। যেদিন প্রোগ্রাম থাকে, সেদিন ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয় আপনাকে। রোজ রাতে পানি খেয়ে ঘুমানোর অভ্যেস আপনার। আর সেই পানি এনে দেয় বেন। তাতেই ওষুধ মেশানো থাকে। কাল রাতে আমাদেরও দিতে চেয়েছিল, ভাগ্যিস নিইনি।

অয়ন, তুমি কখন থেকে সন্দেহ করতে শুরু করলে? রনি এবার প্রশ্ন করল।

এখানে পৌঁছানোর পর। বেনের আচার-আচরণ ভাল লাগছিল না আমার। মনে হচ্ছিল, জোর করে আমাদের ভয় দেখাতে চাচ্ছে। তা ছাড়া আরেকটা অসঙ্গতি লক্ষ করছিলাম।

কী?

কাল রাতে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জ্যাকব কোনদিকে গিয়েছিল, খেয়াল আছে?

সোজা সামনে, জিমি বলল।

কারেক্ট! কিন্তু এখানকার রাস্তাটা ওয়ান ওয়ে। হাসপাতাল পর্যন্ত কোথাও ভাগ হয়ে যায়নি। তা হলে জ্যাকব গেল কোথায়? তখনই চিন্তা ঢুকল, রাতের বেলা বৃষ্টির ভেতর সে করছিল কী? একটা অ্যাম্বুলেন্সকে পাশ কাটিয়েছিলাম আমরা, সেটারও কোনও সঙ্গতি নেই। হাসপাতালের সমস্ত স্টাফ উপস্থিত, কোনও অ্যাম্বুলেন্স বাইরে গেছে বা এসেছে, বলেননি ডাক্তার। মানে ব্যাপারটা তার অজ্ঞাতে ঘটেছে। আসলে ওটায় করে সোনা এসেছিল, আর জ্যাকব রাস্তা পাহারা দিচ্ছিল। আমরা এখানে আসছি শুনে বেনদের খবরটা দিতে আসে সে, তা ছাড়া ভূতের ভয়ও তো দেখাতে হবে। একটু চিন্তা করতেই বুঝলাম, আমাদের সারারাত রুমে বন্দি রাখতে চাইছে কেউ। দরজা আটকে দেয়া, ভূতের উদয় হওয়া… তারই অংশ।

জ্যাকব তার গাড়ি কাছে কোথাও লুকিয়ে এখানে এসে ওঠে, তারপর ছদ্মবেশ নেয়। পল ওকে পাহারা দিচ্ছিল। বেন এদিকে একটা নাটকীয় পরিবেশ তৈরি করে। পরে রাত হতেই জ্যাকব প্রথমে রনি ভাইদের কামরায় যায়। এরপর দরজায় তালা দিয়ে মেইন সুইচ অফ করে দেয়।

শব্দটা কীভাবে হচ্ছিল? হ্যারি জানতে চাইল।

সহজ। ফুল ভলিউমে টেপরেকর্ডার ছেড়ে দিয়েছিল সে, ব্যাটারিতে চলছিল। সবকিছু আগেই রেডি ছিল। যন্ত্রটা করিডরেই কোথাও লুকোনো ছিল, অন্ধকারে দেখতে পাইনি আমি আর জিমি।

যা হোক, আমরা দুজন বেরিয়ে পড়ায় ভয় পেয়ে যায় জ্যাকব। টেপরেকর্ডার বন্ধ করে, মেইন সুইচও অন করতে বাধ্য হয়-নইলে জারিজুরি ফাঁস হয়ে যেতে পারে। পরচুলা আবিষ্কার করে ফেলায় আমাকে আর হ্যারিকে স্টোররুমে আটকে দেয় সে-ই। বেন আর পল অবশ্য তাদের কাজ চালিয়ে যায়, ভেবেছিল জ্যাকব আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে। ওটাই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। নইলে ওদের ধরা একটু কঠিনই হয়ে যেত।

কিন্তু জ্যাকবকে তুমি সন্দেহ করলে কেন? ভিকটর বলল। সে তো সত্যি সত্যি তদন্তের জন্যেও আসতে পারত।

পুলিশ হলেই যে ভাল হবে, তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই, জিমি বলে উঠল। তা ছাড়া নিশ্চিত না হয়ে কাউকেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয় না অয়ন। ঠিক না?

এগজ্যাক্টলি!

দারুণ মজা হলো কিন্তু! হ্যারি বলল। অয়ন-জিমির অনেক গল্প শুনেছি, এবার রিয়েল অ্যাকশনে দেখলাম।

মাঝখানে বিপদে পড়লাম আমি, ড. বার্নার্ড বিমর্ষ গলায় বললেন।

হাসপাতালে কাজ চলবে কী করে? নতুন লোক পেতে দুতিনদিন লেগে যাবে।

আমরা সাহায্য করব, অয়ন বলে উঠল। সাইটসিয়িঙের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর হবে না সেটা।

অয়ন! প্রতিবাদটা সমস্বরে এল।

ছি, এমন করে না! অয়ন বলল। তা ছাড়া মানুষ তো মানুষেরই জন্য! নাকি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *