পাগলাঘণ্টি

পাগলাঘণ্টি

আজ পৃথিবী খালি করে দিয়ে সবাই যেন বেড়াতে চলে গেছে। তাই মনে হচ্ছে এখন গােষ্ঠতলায়। বেশির ভাগ বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ। ভেতরে কেউ আছে কিনা বােঝা যায় না। সামনে দোল! দু-দিন আগে গেছে ঈদ। আসলে আজ ঈদের পরের পয়লা রবিবার। বেলা ন-টা অবধি শীত থাকে এখনও বাতাসে। রাত ন-টার পর সেই শীত আবার ফিরে আসে।

এখন দুপুরবেলা। গােষ্ঠতলার রূপশ্রী সেলুনের ঝাপ বন্ধ। কৃপাসিন্ধু মেডিকেল হল সেই সন্ধে সন্ধে খুলবে আবার। সবেধন যে পিচরাস্তাটি ধরে সাইকেল ভ্যান, স্কুটার, বাঁশবােঝাই গাে-গাড়ি দেড়মাইল উজিয়ে তবে বাস রাস্তায় উঠেই ডাইনে ট্রামডিপাে নয়তাে বাঁয়ে গড়িয়া পাড়ি জমায়—তারই দুধারে বটতলায় বসা সকালের বাজার কখন উঠে গেছে।

ভাটিতে একখানি সাইকেল রিকশা এসে বটতলা ডাইনে ফেলে বাঁয়ে দেবনাথ পাড়ায় ঢুকল। পরপর সব গেরস্থ বাড়ি। মাঝারি বয়সের এক ফুলপ্যান্ট রিকশা থেকে নেমেই চারদিক তাকাল। রাস্তার দুপাশে বাড়িগুলাে যেন ঘুমুচ্ছে। পকেট থেকে পয়সা বের করে দিতেই রিকশাওয়ালা অবাক গলায় জানতে চাইল, এ কী দিলেন?

কেন? ঠিকই তাে দিয়েছি। দেড় টাকা— দেড় টাকা! ঠিক হল ? তাই তাে দিই আমি রােজ।

কী বলছেন? আরও তিন টাকা দিন। ভাড়া এখন সাড়ে চার টাকা। বাস রাস্তা থেকে গােষ্ঠতলার বটতলা মােড়। যাকে ইচ্ছে হয় জিজ্ঞেস করুন না—

কাকে জিজ্ঞেস করব। রাস্তায় তাে একজন লােকও নেই।

আরও তিন টাকা দিল লােকটি। তারপর মসমস করে হেঁটে ডান হাতের পয়লা বাড়িটি ছেড়ে সাদা দোতলা বাড়ির ল্যান্ডিংয়ে উঠে এল। শেষে লােহার গেটের ভেতরে দিয়ে হাত গলিয়ে কলিংবেল টিপল।

 একটু বাচ্চা মতাে কাজের ছেলেই হবে, ঘুম-চোখ ডলতে ডলতে এসে দোর খুলে দাঁড়াল, কাকে চাই? লােকটি তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই ঘরে ঢুকে পড়ল। ঢুকতে ঢুকতে চেঁচিয়ে উঠল, দুপুরবেলা এ কী ইয়ার্কি? যা এক গ্লাস জল নিয়ে আয় শঙ্কর। কেউ ফোন করেছিল?

বলতে বলতে লােকটি পাখা খুলে দিয়ে টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়ল। তারপর গায়ের বুশ শার্টটা এক ঝটকায় খুলে ফেলে ফের চেঁচিয়ে উঠল সে—কোথায় গেলি? জল পরে দিস। জামাটা আগে হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে দে।

পাশের ঘরের ভেতর থেকে একজন মহিলার গলা ভেসে এল, কার সঙ্গে কথা বলছিস নিমু?

 ছেলেটি লােকটির হাত বাড়িয়ে ধরা ঘামে-ভেজা বুশ শার্টখানা নিয়ে গলা তুলে বলল, দেখুন তাে মা—কে এসেছেন একজন। ঠিক বুঝতে পারছি না। আবার শঙ্কর শঙ্কর বলে ডাকছেন—

পাশের ঘরের ভেতর থেকে দুপুরে ঘুমনাে সংসারী গিন্নিবান্নি গলা—ভারী আর বেশ চওড়া, ‘কতবার বলেছিনা দেখে শুনে দরজা খুলবি নে। রাত জেগে পাড়ায় ভিডিও দেখে দেখে দুপুরে আর চোখ খুলতে পারিস নে। ফিরুক আজ ও—ধরে যখন ঠ্যাঙাবে—আমি কিন্তু বাঁচাতে যাব না।’

পাশের ঘরের দরজার দিকে পিঠ ফিরে বসা লােকটি এই কথাগুলাে শুনতে শুনতে বেশ তারিয়ে তারিয়ে হাসছে। সে হাসিতে কোনও শব্দ নেই।

 নিমু এবার পশ্চিমের বন্ধ কাচের জানলা দিয়ে এসে পড়া রােদে লােকটির খােলা পিঠ, কাধ, কঁচাপাকা মাথা দেখতে পেল। বেশ ভারী চেহারা। প্যান্টের ওপর দিয়ে বড়াে ভুঁড়ি ভেসে উঠছে। সে ভুঁড়ির বাড়তি দুপাশ পেছন থেকে দেখা যায়। এ বাড়ির দাদাবাবুর কোনও দাদা-টাদা হবেন নিশ্চয়। নয়তাে এভাবে নিজের বাড়ির মতাে করে কেউ কি ডান পা-খানা টেবিলের ওপর তুলে দেয়—ঠিক টেলিফোন আর খাতাপত্তরের পাশে? গিন্নিমায়ের কথা শুনতে শুনতে কি বন্ধ জানলার দিকে অমন হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকতে পারে? | ঘরে পরার চটি পায়ে গলাতে গলাতে শাড়ির আঁচল—দুহাতে মাথার চুল সিজিলমিছিল করতে করতে দুই ঘরের মাঝের দরজায় এসে দাঁড়িয়েই চমকে উঠল, ওমা! কে? কে আপনি? | লােকটি উঠে দাঁড়িয়ে চেয়ারখানা ঘুরিয়ে নিল মাঝের খােলা দরজার মুখােমুখি। তারপর ধপ করে চেয়ারে বসেই একগাল হেসে বলল, কী হচ্ছে বীথি? হুইস্কি খাই তাে আমি। তাও সন্ধের পর। তুমি তাে কোনওদিন ওসব খাও না। দুপুরবেলাই ভুল বকছ? আমাকে চিনতে পারছ না ?

 বাইরে রােদের তাত। বন্ধ কাচের জানলা দিয়ে যে আলাে এখন ঘরের ভেতর, তাতেও যেন বেশ ভাপানাে গরম। সবার মনে এখনও ফেব্রুয়ারির খাঁটি শীতের স্মৃতি মুছে যায়নি। ইলেকট্রিক ওয়ালক্লকের সেকেন্ডের কাটা অবিরাম ব্যাঙ লাফাচ্ছে। এই ঘরের বাইরেই ঠাঠা দুপুরের শান্ত দেবনাথপাড়ার পানাপুকুর, পাইনবাবুদের ফুটবলমাঠ, ঘরবাড়ি পড়ে আছে। প্লাস্টিকের নেমপ্লেটটা সদর দরজায় লটকানাে বলে অলকার চোখে পড়ল—

অলকা মিত্র সরকারি শিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ।

থতমত খেয়ে অলকা গায়ের আঁচল ভালাে করে টেনে নিল। একজন লােক তার মুখােমুখি তাকিয়ে। একদম খালি গা। ঘামে ভেজা বুশ শার্টটা চেয়ারের কাধে। পায়ে সু। রীতিমতাে স্বাস্থ্যবান। ভালাে কাটের ট্রাউজার। ঘরের চাপা আলােয় মাথার সাদা জায়গা চিক চিক করছে। চওড়া কবজিতে স্টিলফ্রেমের ঘড়ি। চেয়ার জুড়ে বসে গাল বােঝাই করে হাসছে। তারই বসার ঘরে—তাদেরই চেয়ারে বসে—তারই মুখে তাকিয়ে—

রীতিমতাে চেঁচিয়ে উঠল অলকা মিত্র। কে? কে আপনি? আপনাকে তাে চিনি না আমি—

একথায় লােকটির মুখের হাসি আরও বেশি বেশি মজায় ভরে গেল। ভালাে করে দেখাে বীথি। এবারও আমাকে চিনতে পারছ না? আজ তােমার এ কী হল বীথি !

বীথি? কে বীথি? এখানে বীথি বলে কেউ থাকেই না। কে আপনি? আমার স্বামী এখন বাড়ি নেই। আপনি যান এখন। দোর বন্ধ করে দে নিমু— | বারাে-চোদ্দো বছরের হাফপ্যান্ট-পরা খালি গা নিমু সাহস করে লােকটিকে উঠে যেতে বলতে পারল না। যদি ধাঁ করে এক ঘা বসিয়ে দেয়। সে এই অচেনা লােকটার হাত পায়ের এলাকার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। লােকটার মুখে তখনও হাসি। তুমি বীথি নও। তাহলে তুমি কে—বলতে বলতে লােকটি উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে এক-পা এগিয়ে এল।

ভয়ে অলকা মিত্র ভেতর-ঘরের দিকে পিছিয়ে এল। এখন চেঁচালে বাইরের কেউ শুনতে পাবে না। এ-ঘরের পেছন দিককার দরজা খুলে বাড়িওয়ালার দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। পিছিয়ে একবার পেছনের দরজার কাছে গিয়ে পড়তে পারলেই অলকা টুক করে ছিটকিনিটা নামিয়ে দেবে। তারপর সােজা সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে দোতলায় ওঠা। কিন্তু এখন তাে মানসী একা বাচ্চা নিয়ে ঘুমুচ্ছে।

অমলবাবু অফিসে। সিড়ি ঘরে মানসীর শ্বশুরের অয়েল পেইন্টিং।

আমি? আমি অলকা মিত্র। তুমি অলকা! তাহলে আমি কে?

লােকটার একথায় একবার অলকার মনে হল পাগল নয়তাে? কিন্তু চোখের চাউনিতে সেরকম তাে নেই।

সে আমি কী করে বলব? এ কী? ভেতরে ঢুকছেন কেন? এ কী ? | লােকটি ভেতরের ঘরে ঢুকে পড়ে বলল, খাটটা এভাবে সরিয়েছ কেন? আমি তাে জানলার কাছে মাথা দিয়ে শুই বীথি—

চুপ করুন। এক্ষুনি বেরিয়ে যান বলছি। আমি বীথি নই, অলকা। অলকা মিত্র—আমি কিন্তু চেঁচিয়ে উঠব— | একথায় কান না দিয়ে লােকটি খেতে বসার জায়গায় এসে পড়ল। খাবার টেবিলে নুনদানিটা খােলা ছিল। তার ঢাকনা চাপা দিতে দিতে বলল, কত দিন না বলেছি বীথি—খােলা থাকলে রাতে আরশােলা এসে বসে নুনে। এই শঙ্কর জামাটা টাঙিয়ে দিলি না হ্যাঙ্গারে—?

নিমু তার নাম বদলে দেওয়ায় ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকল।

অলকা মিত্র চড়া গলায় বলল, না, দেবে না নিমু। এটা আমাদের বাড়ি। আপনি কে? বেরিয়ে যান বলছি—

আমি কে!—বলে ভীষণ মজায়—নিজের ওপর দারুণ কনফিডেন্স নিয়ে লােকটি চাপা গলায় হাসল। আর তখনই ফোনটা বেজে উঠল।

অলকা ফোন ধরতে যাচ্ছিল। তাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে লােকটি রিসিভার তুলে নিয়ে কানে লাগাল, হ্যালাে?

ওপাশের গলা যেন চুপসে গেল। অলকা আছে? এখানে অলকা বলে কেউ তাে থাকে না। সঙ্গে সঙ্গে সরকারি শিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ অলকা মিত্র চেঁচিয়ে উঠল, কী হচ্ছে? ফোনটা ছাড়ুন। আমাকে চাইছে নিশ্চয়। ওর ফোন করার কথা

ওপাশ থেকে ফোনে ভেসে এল, এটা কত নম্বর ? লােকটি পালটা জানতে চাইল, আপনি কত নম্বর চাইছেন?

ফোর সেভেন ওয়ান ট্রিপল জিরাে সেভেন। মানে আমার ওয়াইফকে চাইছিলাম—আমি প্রসূন মিত্র।

ফোর সেভেন ওয়ান ট্রিপল জিরাে সেভেন ? নাঃ! সরি। রং নাম্বার। আমি কমল গুহ কথা বলছি। আমার স্ত্রী বীথি গুহ। এখানে অলকা বলে কেউ তাে থাকেন না।

অলকা ছুটে এসে রিসিভারটা কেড়ে নিতে গেল। পারল না কমল গুহ রিসিভার হাত দিয়ে উঁচুতে তুলে তার নাগালের বাইরে নিয়ে গেল।

দিন। দিন বলছি। আমার ফোন। ওটাই তাে আমাদের নম্বর—কেন মিছে—

রং নাম্বার বললেন? | লােকটি কানে রিসিভার লাগিয়ে তখন বলতে লাগল, এটা সেভেন টু থ্রি ডবল জিরাে সেভেন।

অলকা একদম বােবা হয়ে গেল। সে বুঝতেই পারছে না—এটা কি কোনও বিপদ? না, কোনও খেলা? ফোনের রিসিভার লােফালুফির খেলা?

ফোন নামিয়ে রেখে সারা মুখে একটা তৃপ্তি ছড়িয়ে কমল গুহ বলল, দেখেছ বীথি—কী আশ্চর্য! তুমি কিছুতেই বীথি হতে চাইছ না। নাম ভাড়িয়ে অলকা থেকেই যাচ্ছ। তােমার এ-রসিকতা ফোনের ওদিককার লােকটা টের পেল কী করে? ওর তাে জানার কথা নয়। আবার ন্যাকামাে, বলছে কী জান ?—আমার ওয়াইফ অলকা মিত্রকে চাইছি। আচ্ছা বল তাে—এখানে অলকা কোথায়? | অলকা মিত্র কী বলবে? সে নিজে দুপুরবেলা এমনভাবে ভেতর থেকে আচমকাই লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি। সে কি তাহলে আদপেই অলকা নয় ? অলকা বলে কেউ এখানে থাকে না। এক পলকে চেনাজানা। প্রসূন হয়ে গেল লােকটা? আর লােকটা হয়ে গেল কমল গুহ?

এ তাে ভারী অন্যরকম। নতুন গরমের চড়া রােদ এ-ঘরে বন্ধ কাচের জানলা দিয়ে ঢুকে রীতিমতাে মিহি। তার ভেতর একটা লােক আমাকে বলছে—আমি বীথি গুহ—তার বউ—সে নিজে কমল গুহ। আমাদের ফোন নম্বর হয়ে যাচ্ছে রং নম্বর। প্রসূন হয়ে যাচ্ছে লােকটা। এ কীসের আভাস? আমাদের একমাত্র ছেলে নাগপুরে এন সি সি-র ক্যাম্প করতে গেছে। আমি—আমরা—প্রসূন আর আমি কি কোনও ভূমিকম্পের দরজায় এসে দাঁড়ালাম ?

ঠিক এই সময় নিজের কথার তােড়ে ডুবে থাকা কমল গুহ যেন বেশ নিশ্চিন্ত গলায়—এ বাড়িকে নিজের বাড়ি—আর এ বাড়ির গিন্নি সরকারি শিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ অলকা মিত্রকে প্রসূন মিত্রের ওয়াইফ থেকে নিজের ওয়াইফ বীথি গুহ করে ফেলতে পেরে—যেন বা কোনও ন্যায্য অধিকার ফিরে পাওয়ায় নিশ্চিন্ত হয়ে সেই চেয়ারটায় ফের ধপ করে বসল।

তারপর কমল গুহ পায়ের সু খুলতে খুলতে হাসি হাসি গলায় বলতে থাকল—গত তিরিশ বছর ধরে আমরা যে বাড়িই ভাড়া করেছি তার কোনওটাতেই তাে তিন চার বছরের বেশি থাকিনি বীথি। আশ্চর্য দেখাে—ছেড়ে আসা বাড়িগুলাের কাছাকাছি গেলেই তারা আমায় টানে। খােলা জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে—আমি যেখানে শুতাম—বসতাম—সেখানে এখন কে শুয়ে আছে—কে বসে আছে—কেমন করে শুয়ে আছে—কেমন ভাবে বসে আছে— | অলকা মিত্র কোনও জবাবই দিল না। নিমুটা আনতাবাড়ি দরজাটা খুলে দিয়ে কী এক গণ্ডগােল পাকিয়ে দিয়েছে। এখন এর ভেতর থেকে বেরােই—

কী করে?

বুঝলে বীথি—কলকাতার নানান পাড়ায় সেসব বাড়িতে যাবার রাস্তাগুলােও আমাকে টানে—সেসব রাস্তায় খালি সাইকেল রিকশা দেখলে টক করে উঠে বসি তাতে—রিকশাওয়ালাকে ডিরেকশন দিয়ে সেসব বাড়ির একদম কাছে চলে যাই। আমি এক একদিন নিজেই ভীষণ অবাক হয়ে যাই—যখন সেসব বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে পড়ে একসময়কার চেনা ডাক্তারখানায় বসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলি—ডাক্তারবাবু! প্রেসারটা একটু দেখে দিন তাে

অলকা মিত্র এবারও কোন জবাব দিল না। সে বাড়িওয়ালার দোতলার সিঁড়িঘরে যাবার ছিটকিনি তােলা বন্ধ দরজায় তাকিয়ে। যদি এখন মানসী দোতলা থেকে নেমে এসে দরজার ওপিঠে নক করে ডাকত—কাকিমা আছেন নাকি? তাহলে— | অলকা ছুটে গিয়ে ছিটকিনিটা নামিয়ে দিতে পারত। এখানে এখন সব কিছু তছনছ দশা। কে কী তার কোনও ঠিক নেই। এতদিনের টেলিফোন নম্বর অব্দি এখন অন্য আরেক নম্বর। নিমু শঙ্কর। আমি একটু একটু করে বীথি হয়ে যাচ্ছি। অথচ দরজার ওপারেই সিড়িঘরে এখনও আজ ভােরেও যে-পৃথিবীটা ছিল, তা এখনও আস্ত রয়ে গেছে। একটুও টসকায়নি।

অলকার মন চাইল,—খুব করে চাইল—এখন একটা ডেলিভারি কেসের কল আসুক তার। সে যত দূরেরই লেবার কেস হােক না কেন—তবু সরকারি শিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ অলকা মিত্র সেখানে আজ এখুনি যাবে—দরকার হলে সাইকেল-ভ্যানের পেছনে পা ঝুলিয়ে বসে সে চলে যাবে সেখানে। রাস্তা ফুরিয়ে গেলে ধেনােমাঠ ভেঙে অলকা সেখানে যাবে। একটা জরুরি কল আসুক তার এখুনি। এখান থেকে সে ভেঙে-ছিড়ে বেরিয়ে যেতে চায়। নয় তাে সবই অলকার তছনছ হয়ে যাচ্ছে।

নিদেনপক্ষে হাবার মতাে দাঁড়িয়ে থাকা নিমু তাে ট্রানজিস্টরটা খুট করে চালিয়ে দিতে পারে। ওয়াল ক্লকে সওয়া তিনটে। এখন বিবিধ ভারতীতে আধঘণ্টার ক্লাসিকাল প্রােগ্রাম—অনুরঞ্জনী। একবার আমির খায়ের মেঘরাগের গলা নয়তাে বুদ্ধদেবের সরােদে ভৈরবী কানে ঢুকলেই তাে অলকা মিত্র ফের তার নিজের জায়গায় ফিরে আসতে পারে। কিংবা সুলােচনা সহস্রবুদ্ধির ললিত গৌরী ঠিক তাকে এখান থেকে টেনে বের করে নিয়ে যেতে পারে। একা একা ফাঁকা বাড়িতে এসব শুনে অলকার এখন অনেকটাই মুখস্থ।

 জুতাে জোড়া খুলে একদম যেন চেনা র্যাকে রাখতে রাখতে কমল গুহ পাখার স্পিড বাড়িয়ে দিল। তারপর বলল, এ বাড়িতেও তাে তিন বছর হয়ে গেল বীথি। এ বাড়িটা এবার বদলাব।

যেন শেষ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল অলকা মিত্র। কে বীথি? আমি অলকা। আমরা এবাড়িতে আছি তেরাে বছর হয়ে গেল।

কমল গুহ অলকা মিত্রর মুখােমুখি দাঁড়াল। তারপর সিধে তাকিয়ে তার দুই কাঁধে দুখানি হাত রাখল। আজ তােমার কী হয়েছে বীথি?

হাত দুখানি বেশ ভারী লাগল অলকার। তার চোখের সামনে আস্ত একটা মানুষ দাঁড়িয়ে। পেছনে জানলা বলে কমলের সারাটা মাথাই কালাে দেখাচ্ছে। অলকা কোনও কথা বলতে পারল না। সে দেখল, কমল আবছা আলােয় অনেকটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে।

একা একা দুপুরে কঁকা বাড়িতে খারাপ লাগে। বুঝি বীথি সবই বুঝি। বাসুর বিয়ে হয়ে গিয়ে আরও ফাঁকা। তার ওপর শঙ্করটার ঘটে যদি একটুও বুদ্ধি-বীথিতে আর কোনও আপত্তি জোগাল না অলকার। শুধু বলল, শঙ্কর কোথায় ? ও তাে নিমু। আমাদের নিমু—

ওই হল। তুমি যদি ওকে নিমু মনে করে আনন্দ পাও তাে তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই বীথি। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে বাসু

 কে বাসু ?

কেন বীথি? বাসু আমাদের মেয়ে—বাসন্তিকা গুহ। এই এপ্রিলে ওর বিয়ের এক বছর হবে। বাসু এখন বাসন্তিকা দত্ত।

কী বাজে কথা বলছেন আপনি সেই থেকে। আমার কোনও মেয়েই নেই। আমাদের একটা মাত্র ছেলে। বারাে ক্লাসে উঠে এন সি সি-র নাগপুরে। ওকে তিন বছরেরটি কোলে নিয়ে তেরাে বছর হল এ-বাড়িতে ভাড়া এসেছি আমরা। সেই এইটিটুতে—

কড়া রােদে একা কোনও মেঘ ভেসে গেলে তার ছায়া খুব স্পষ্ট করে পড়ে নীচের মাঠে। অলকার একথায় তেমনিই একটি ছায়া পড়ে কমলের মুখে মিলিয়ে গেল। সে আস্তে আস্তে বলল, সেই এইট্টিটু? তুমি যদি এসব ভেবে খুশি হও বীথি, তাে তাই সই। তুমি নিশ্চয় এভাবেই স্বপ্ন দেখে থাক। বুঝতে পারছি। মা গিয়েছিলেন বাষট্টি বছর বয়সে। আমার বাষট্টি পূর্ণ হবে আর দিন কুড়ি বাদে। কাল রাতে কী ছাই স্বপ্ন দেখেছিলাম তা মনে নেই। আজ বাড়ি ফেরার পথে লেক মার্কেট থেকে বড়াে কোয়ার রসুন কিনলাম পঁচিশ গ্রাম। যা দাম! এক কোয়া ছাড়িয়ে খেতে খেতে হাঁটছি আর ভাবছি—যদি মায়ের আয়ই পেয়ে থাকি তাে আর আছি বড়ােজোর বিশ দিন। ঠিক এই সময় কাল রাতের স্বপ্নটা মনে পড়ে গেল বীথি—

কমলের গলায় কী ছিল। এবার বীথি বলায় অলকার মুখে আর আপত্তি জোগাল না।

কমল গুহ নিজের কথার তােড়েই ডুবে আছে। সে বলতে থাকল, আমাকে কাল শেষ রাতে জাগিয়ে তুলে সময়মতাে টয়লেটে পাঠাবার জন্যে কত কাণ্ড দ্যাখাে বীথি। হাজার টাকার কয়েকখানা নােট বাজে কাগজ ভেবে দু-টুকরাে করে ছিড়ে ফেলেছি। বুঝতে পারে আঠা খুঁজছি। জোড়া লাগাব। অমনি বাতাস উঠে হাজার টাকার কয়েকখানা টুকরাে উড়ে গিয়ে রাস্তায় পড়ল। আমি পড়িমড়ি কুড়ােচ্ছি। বােঝাে আমার দশা। হাজার টাকার কয়েকখানা নােটের টুকরাে বলে কথা। হারিয়ে গেলে তাে গেল। ঘুম ভেঙে গেল। হাঁটছি আর ভাবছি—এমন স্বপ্ন ঘুমের ভেতর কোত্থেকে এল। আমাদের হাজার হাজার জন্মের স্মৃতি ঘিলুর ভেতরকার খােপে খােপে জমা থাকে। একটি খােপে হয়তাে জমানাে ছিল—হারিয়ে ফেলার দুঃখ, লােকসানের কষ্ট। আমার শরীরের কেমিস্ট্রি সেই লকারের চাবি খুলে ফেলল—যেনবা প্রেসিডেন্সি জেলে কয়েদিরা দেওয়াল টপকাচ্ছে। জোরে জোরে পাগলাঘন্টি বেজে উঠল। সার্চলাইট এসে পড়ল লক্ষ বছরের মেমারি ব্যাঙ্কের বিশেষ একটি লকারের ওপর।

অলকা মিত্রের মাথার ভেতর কে পাগলের মতাে ঘণ্টা পিটতে শুরু করে দিল। ঢং ঢং ঢং। সে একসঙ্গে এতসব মনে করতে পারছে। সার্চলাইটের ফোকাস এসে পড়ল। তাতে সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। পরের পর নানান সন। নানান তারিখ।

১৯৭৮, ১ সেপ্টেম্বর।

১৮২২—

এবার তারিখটা অন্ধকারে মুছে গেছে। সেখানে সার্চলাইটের আলাে পৌছয়নি। আবার

১৯০৩, ৮ আগস্ট।

১২১৩, ২ এপ্রিল।

১৩১২, ২২ জুন।

এরপর শুধুই সন আর তারিখের মিছিল বা থাক। জায়গাটা কেমন অন্ধকারের বড়াে এক পােচড়া যেন। এবড়াে খেবড়াে। কয়েদিদের কায়দায় সেখান থেকে স্মৃতিগুলাে লকার খুলে-ফেলা আলাের তাড়া—পিছু হটছে। হটছে। হটছেই। এক ঝলক মনে পড়ে যায়। আবার হারিয়ে ফেলে সরকারি শিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ অলকা মিত্র।

হঠাৎ কমল গুহ বলল, এখন ডালের বড়া খেলে কেমন হয় বীথি? ফস করে অলকার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ডাল ভিজিয়েছি কি? দেখােই না। কাল রাতে তাে বলছিলে ভেজাবে—

রান্নাঘরে গিয়ে একই সঙ্গে অবাক আর খুশি হল অলকা। সে ডাল ভিজিয়ে রেখেছে কাল রাতে। একবার তার মনে হল—কার জন্যে ভিজিয়েছি? প্রসূনের জন্যে? না কমলের জন্যে? না, কোনও এক স্বামীর জন্যে ? কাল রাতে কি ? , ১২১৩ সনের ২ এপ্রিল রাতে? উঁহু, ১৩১২ সনের ২২ জুন রাতে—

অলকা বলল, শঙ্কর একটু বেটে দে না বাবা শঙ্কর? অবাক হয়ে নিমু অলকার মুখে তাকাল। কমল বলল, দে না বাবা বেটে। চায়ের সঙ্গে সবাই খাব। নিমু ডবল অবাক হয়ে গ্যাসের সিলিন্ডারের পাশ থেকে শিল-নােড়া বের করল সাবধানে।

খানিকবাদে বিকেল আসতে না আসতেই কালােজিরে, কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে মেখে প্রথম বড়াটি যখন অলকা মিত্র কড়াইয়ে ডুবােতেলে ছাড়ল—ঠিক তখনই দরজায় বেল—এখন আবার কে এল?—বলতে বলতে খাঁটি স্বামীর মতাে মুখ করে খুব বিরক্ত হয়ে কমল গুহ সদর দরজায় গেল।

একমুখ সাদা দাড়ি। গায়ে হেঁড়া ফতুয়া। কঁাধে চামড়ার ঝােলা। হাতে একজোড়া কালাে শু। পালিশ করায় চিকচিক করছে। টিপিকাল মুচি। তার মাথার পেছনে দূরে পাইনবাবুদের ফুটবল মাঠে বল নিয়ে ছেলেরা নেমে—

গেছে। কালাে হাফপ্যান্টের বাইরে খেলােয়াড়দের তরুণ সব থাই রােদে ঝকঝক করে উঠল।

কী ব্যাপার? হামাকে চিনলেন না বাবুজি—

তুমি? হামি বটতলার পুরানা মুচি। রাজি বাবুজি। পহচানা নেহি? কী ব্যাপার? হাপনি রিকশায় আসছেন দেখলম। পর সন বীত গয়ে—হামায় পালিশ করতে দিয়ে অউর ওয়াপস নেননি বাবুজি। পড়েই ছিল। তারপর তাে চলে গেলেন একরােজ। ইহাঁসে বাড়ি বদল করে কোথায় গেলেন—জানি না—এই লিন। হামি ঝাড়পােছ করকে লে আয়া—

ওঃ! তুমি সেই রাজিন্দর। রাতে আর কর্নেট বাজাও না?—বলতে বলতে কালাে মােকাসিন পায়ে গলাল কমল গুহ।।

বাজাই বাবু মাঝেসাঝে। আজকাল কৌন বাজা শুনে বাবুজি?

কমল গুহ মােকাসিন পায়ে মসমস করে ঘরের ভেতর ফিরে এল। রাজিন্দরকে পালিশের পয়সা দিতে হবে। পনেরাে বছর পরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *