পাগলদের মেয়ে
রাত বারোটার কিছু পরে সে চুপিসারে বিছানা থেকে নেমে হেঁটে গেল বসার ঘর অব্দি। তারপর জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বড় করে শ্বাস নিল একবার। তার নিজেকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রেতিনী বলে মনে হল যেন!
খুব অল্প, অল্প সরাল সে পরদাটা—নাহ, রাস্তার ওপারে কেউ নেই! কেউ নেই গাছটার তলায় বা কফি শপটার পা-দানিতে। কেউ কোথাও নেই। আরও একবার টর্চলাইটের মতো অনুসন্ধানী চোখ চারিদিকে ঘুরিয়ে নিল সে। আপনা থেকেই বেশ কিছুটা সরিয়ে ফেলল তখন পরদাটা। একটা চেপে রাখা শ্বাসকে বুক থেকে অল্প অল্প করে বেরিয়ে যেতে দিল।
কাঠ-কাঠ শরীরটা এবার একটু শিথিল হল বলেই বোধহয় একটা হাই উঠে এল তার মুখে। সে হাইটা তুলল, কিন্তু হাঁ বন্ধ করতে পারল না— স্থির হয়ে গেল ওই অবস্থায়! সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল! সে অপলক তাকিয়ে রইল পাগলটার দিকে। পরদা নামাতে ভুলে গেল, সরে যেতে ভুলে গেল—
তখন চোখগুলো ধকধক করে জ্বলছিল পাগলটার। ঠোঁটে সাপের ফণার মতো এক ক্রূরতাকে সে দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পেল! পাগলটা টেলিফোনের নীল বাক্সটার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে দেখছিল তাকে! তাকে, তাকে, তাকে! মাসের পর মাস তাকে হয় এই পাগলটা, নয় অন্য একটা পাগল, না, আরও একটা আছে কিংবা আরও— দিনে বা রাতে, আলো বা অন্ধকারে লক্ষ রাখছে। ঘুমোতে, খেতে দিচ্ছে না, রাস্তায় বেরোতে দিচ্ছে না, এমনকী গুনগুন করে গান গাইতেও ভয় করে তার! উন্মাদগুলো চোখে একেবারে পুঁতে ফেলেছে তাকে, পালাবার পথ নেই। এই পাগলটা মাঝে মাঝে ভ্যানিশ হয়ে যায়। তারপর যখন সে ধরে নেয় যে এবার সে মুক্ত, আর তাই শান্ত থাকতে থাকতে অসতর্ক, অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে ব্যালকনিতে দাঁড়ায় গিয়ে বা বিকেলে একটু হাঁটবে ভাবে ফুটপাত ধরে, তখনই হঠাৎ আবার ফিরে আসে পাগলটা! আবার উলটোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে দেখে সে পাগলটাকে। কিংবা পায়চারি করতে দেখে ধীরে ধীরে। যাই করুক, চোখ নিবদ্ধ তার দিকে, এই পশ্চিমের ব্যালকনির আর ঘরের জানালাগুলোর দিকে। সেই দৃষ্টির ভেতর মরণ-কামড় দেওয়ার বাসনা। সেই নির্নিমিখ চোখের মধ্যে ঘৃণার পুরু পরত, হিংস্র ছটফটানি!
ধরা পড়ে গিয়ে রত্না ছিটকে সরে যেতে চাইল জানালা থেকে, কিন্তু কী এক সম্মোহনীশক্তি তাকে আটকে রাখল। তার মনে হল পাগলের হাত থেকে আজ আর নিস্তার নেই, কেন না এই পাগল আর তার মধ্যের এই বাড়ির কংক্রিটের দেয়ালের অস্তিত্বটাই যেন মুছে গেছে, ফুটপাতও নেই, রাস্তাও নেই— যেন একটা চারিদিক খোলা জায়গায় সে একাকী দাঁড়িয়ে, আর তার মাত্র দু’ হাত দূরে ওই উন্মাদ যে এগিয়ে আসছে, আরও এগিয়ে আসছে তার দিকে, যাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছিঁড়ে নিতে পারে তার টুঁটি! রত্না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগল আর শুধু পরদাটা হাত থেকে খসিয়ে দেওয়ার মতো জোরটুকু ফিরিয়ে আনতে চাইল অসাড় আঙুলগুলোয়, যাতে পরদাটা পড়ে যায় আর সে লুকিয়ে পড়তে পারে আড়ালে। তখন একটা তীব্র শিস বুলেটের মতো ছুড়ে দিল পাগলটা, আর রত্নাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল!
অতীনকে সাড়ে ন’টার মধ্যে রওনা করে দিয়ে রত্না রান্নাঘরে ঢুকল। দু’ কাপ মতো চায়ের অনুপাতে দুধজল একসঙ্গে মিশিয়ে চাপাল ওভেনে। দু’ কাপ!— নিজেরই জন্য। সে চা খেতে ভালবাসে। তা ছাড়া বারবার চা করে খাওয়া ছাড়া সারাদিনে তার কাজটাই বা কী? তবে দামি চা-পাতা রত্নার খুব একটা ভাল লাগে না। দুধ দিয়ে, চিনি দিয়ে জমিয়ে বানানো মাঝারি মাপের চা-পাতার চা-ই তার প্রিয়। এমনকী তাদের আধা-মফস্সলের চায়ের সঙ্গে লেগে থাকা কেরোসিনের অল্প গন্ধও তার বেশ লাগে। অতীনের পছন্দ পানসে পানসে লিকার!
দুধজল ফুটে উঠলে গ্যাস নিভিয়ে চা-পাতা ভিজতে দিয়ে সে চলে এল শোবার ঘরে। এসে, আয়নার সামনে দাঁড়াল। নিজেকে দেখল ভাল করে। তার পরনের হাউসকোটটা হাত মুছে মুছে ঊরুর কাছটা সবসময় ভিজে আর অপরিচ্ছন্ন। এটাও কি তার আধা-মফস্সলি অভ্যেসগুলোর একটা, যা সে চেষ্টা করেও শুধরোতে পারল না? হাত-তোয়ালে তো কিনেছে সে কতবার, রান্নাঘরে, বাথরুমে রেখেওছে, কিন্তু ব্যবহার করতে ভুলে গেছে। কাজ করতে করতে ভিজে হাত, তেল-হলুদের হাত অবধারিতভাবে ঘষে ফেলেছে ম্যাক্সিতেই!
ক্লিপ খুলে চুলগুলো মুক্ত করে দিল রত্না। ঝাড়ল। সামনে টেনে নিয়ে হাতে পাকিয়ে নিল ঝরে-ঝুলে থাকা চুলগুলো। প্রতিদিন গোছা গোছা চুল উঠে যাচ্ছে— এরকম চললে ক’দিন পরে একেবারে ফাঁকা হয়ে যাবে মাথা— এই ভেবে সে যেই নিজের দিকে অভিযোগের চোখে তাকাল, বিরক্ত চোখে তাকাল— তার পাগলটার কথা মনে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ রত্না ভুলে গেল ভিজে ওঠা চা-পাতার কথা, বাকি পড়ে থাকা ঘরের কাজের কথা, স্নানের কথা। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে পৌঁছে গেল তাদের টাউনের বাজারে, তার হাতে ধরা দুধের ক্যান। তাতে টাটকা দুধ। কবেকার…!
সময়টা সন্ধে হব, হব, সে দুধ নিয়ে ফিরছিল বাড়ির দিকে, পরনে মা-র একটা শাড়ি, এক বেণী, চোখে কাজল। কপালে, মায়ের মাথার কাঁটার ডগা দিয়ে পরা এক বিন্দু কাজলেরই টিপ। সে সবজির বাজারটা পার হয়ে ফুটবল মাঠের পাশ দিয়ে শর্টকাট করবে ভেবে বাজারের পেছনের পথটা ধরে এগোচ্ছিল। তখনই ঘ্যাঁচ করে সাইকেলটা প্রায় তার ঘাড়ের ওপর দাঁড়াল এসে। সে নিজেকে বাঁচাতে সরে গেল একটু আর তাতেই ডাবের খোলা, শালপাতা, কলাপাতা, ঘুড়ি, ভাঁড়, পচা শাকসবজি মিলিয়ে তৈরি জলকাদায় ভরা আঁস্তাকুড়ের স্তূপটার ওপর উঠে পড়তে হল তাকে। চটিতে উঠে এল কাদা। শাড়িটা নোংরায় মাখামাখি হল। সাইকেল আরোহীকে অল্প আলোয় চিনে নিয়ে ভয় পেল রত্না। তদ্ত্ত্বেও চাপা স্বরে সে ধমকাল পাগলটাকে— ‘ভাস্করদা!’
পাগলটার ঘাড়টা হেলে গেল একপাশে আর তাকে জুলজুল করে দেখতে দেখতে মুখটা বেঁকে গেল অদ্ভুত হাসিতে। মেলায় বিক্রি হওয়া ঘাড়-নাড়া বুড়ো পুতুলগুলোর মতোই নড়তে লাগল ঘাড়টা। পাগলটা কিন্তু নড়ল না! সে বলল— ‘সরে যাও ভাস্করদা! নইলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। বাড়ি গিয়ে বলে দেব জেঠিমাকে। এতবড় সাহস ভর সন্ধেবেলা আমার রাস্তা। আটকাচ্ছ?’
এবার পাগলটার মুখের হাসি শুষে গেল, কিন্তু মাথা নড়া বন্ধ হল না। আড়ষ্ট জিভ নেড়ে পাগলটা বলল, ‘র-ত্-না!’ বলল, ‘তুই সবার কাছে বলে বেড়াচ্ছিস আমি নাকি বদ্ধ পাগল হয়ে গেছি?’
‘বলেছি তো! বলব না কেন? পাগলকে পাগল বলা যাবে না নাকি? সরো তুমি!’
‘না শোন রত্না, আমি পাগল?’
‘কেন সন্দেহ আছে? তুমি তো জন্ম ইস্তক চড় মাতালে ছিলেই আর এখন পুরো, পুরো অপ্রকৃতিস্থ!’
পাগলটা নেমে দাঁড়াল সাইকেল থেকে, ‘তুই বলছিস এসব রত্না? যখন, যখন…!’
‘কী? কী যখন?’
‘যখন তোর আমাকে ভাল লাগত, যখন ‘তুই আমাদের বিয়ের কথা বলতিস— সেই যে আমাদের ছাদে দাঁড়িয়ে গান শোনাতিস৷ তুই আমাকে, তোর তো সবই মনে আছে রত্না, তখন তো তোর আমাকে পাগল, ন্যালা-খ্যাপা, রগচটা বলে মনে হয়নি!’
‘এসব গল্প এখন জনে জনে করে বেড়াও নাকি ভাস্করদা? জানি, জানি এভাবেই আমার ভবিষ্যৎটা নষ্ট করে দেবার ইচ্ছে তোমার?’
‘কেন মিথ্যে বলছিস রত্না, আমাকে বাতিল করবার জন্যই আমাকে পাগল সাজালি তুই?’
‘বেশ করেছি পাগল সাজিয়েছি। তুমি যদি পাগল না হও, তুমি সেটা প্রমাণ করে দেখাও ভাস্করদা! সবাই জানে তুমি কেমন। পাগলামি তোমার কম দেখেছে এই টাউন? পরীক্ষার হলে খাতা ছিঁড়ে ফেলেছিল কে? আমি?’
‘সে আমি রাগ করে করে ফেলেছিলাম!’
‘এমন রাগের কথা কেউ কখনও শুনেছে? আর শিখার বিয়েতে বরযাত্রীদের মারধর করার ঘটনাটা?’
পাগলটা কটকট করে নখ কাটতে লাগল দাঁতে, ‘ওরা তোকে খারাপ মন্তব্য করেছিল— তোকে।’
‘তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিল যে, বেপাড়ার ছেলেদের মেরে-ধরে একটা মেয়ের বিয়ে ভেস্তে যাওয়ার মতো অবস্থা ঘনিয়ে তুলতে হবে? কী কেলেঙ্কারি বাধিয়েছিলে তুমি, তোমার মনে আছে?’
‘আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেছিল রত্না!’
‘ওইটাই তো তোমার পাগলামির লক্ষণ, মাথায় রক্ত চড়ে যাওয়া— বিভাসকে সেই কোন ছোটবেলায় তুমি জলে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিলে, তোমার বাঁশি ভেঙে দিয়েছিল বলে…!’
‘বলিস না রত্না, আর বলিস না! কিন্তু তারপরও তো তুই আমাকে ভালবেসেছিলিস! বলেছিলিস, ‘আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সব রাগ ভুলে যাও ভাস্করদা। আমার মাথার দিব্যি রইল! রাগ হলে ঘরে খিল দিয়ে বসে থাকবে’, বলিসনি?’
‘মিথ্যে কথা, এসব আমি কক্ষনও বলিনি!’
‘রত্না, এমন কেন করছিস তুই? দ্যাখ, এখন আমি ভাল হয়ে গেছি, আর তো রাগি না একদম। এখন রাগ গিলে নি, চেপে রাখি! তখন আমার ভয়ানক বমি হয়!’
‘জানি, এখন তুমি কথায় কথায় অজ্ঞান হয়ে যাও, তখন মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোয়, হাত-পা বেঁকে যায় তোমার। ম্যান্তার মা তোমাকে একদিন পেছনের উঠোনে বসে ছাই ঘাঁটতে দেখেছে। তুমি নাকি ছাই খাচ্ছিলে? মাগো, কী ঘেন্না!’
‘না, না’— পাগলটার হাত থেকে সাইকেলটা পড়ে যায়, কেননা পাগলটা দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে, ‘এটা মিথ্যে রত্না, তুই বিশ্বাস করিস না, নিশ্চয়ই আমি কিছু খুঁজছিলাম। হে ভগবান, এখন আমি যাই করি লোকে ভাবে পাগলামি!’
‘কেন? কেন ভাবে? লোকে কি তোমার শত্রু?’
‘তুই, তুই সবাইকে বুঝিয়েছিস যে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি—!’
‘আমি বুঝিয়েছি?’
‘ফরেনে থাকা ছেলেকে বিয়ে করে প্লেনে চড়ে সুখের রাজত্বে উড়ে যাবার লোভে তুই আমার দুর্বলতাটাকে পাগলামি বলে দেখাচ্ছিস সবাইকে।
নিজের স্বার্থসিদ্ধি করতে আমাকে পাগল সাজিয়ে দিলি তুই রত্না—এত বড় তঞ্চক তুই? আর আমি তোকে এখনও এত ভালবাসি যে তোকে ছেড়ে থাকতে থাকতে কষ্টে, অপমানে, আমি বুঝতে পারছি, আমি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছি এবার। সত্যিকারের পাগল!’
‘চুপ করো, সাইকেলটা তোলো। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে ভাস্করদা, তুমি আর আমাকে রাস্তাঘাটে বিরক্ত করবে না, মনে থাকে যেন!’
‘না রত্না, তুই এভাবে ছেড়ে যাস না আমাকে, আর-একটা সুযোগ দে, আমি আবার পরীক্ষায় বসব। একটা চাকরি ঠিক জোগাড় করব যেভাবে পারি, তুই পাশে থাকলে আবার সুস্থভাবে বাঁচতে পারব আমি!’
‘তোমাকে সুস্থভাবে বাঁচাবার দায় আমার নাকি? শোনো ভাস্করদা, আমাকে তুমি ভুলে যাও, মেয়েমানুষ ব্যাপারটাকেই ভুলে যাও তুমি, তোমার ঠাকুরদা পাগল ছিল, তোমার পিসিমা পাগল ছিল, পাগলামি তোমাদের রক্তে। এ বংশের বৃদ্ধি না হওয়াই মঙ্গল!’
‘র-ত্-না! এত নিষ্ঠুর তুই?’
‘চেঁচিয়ো না, লোকে দেখছে, পথ ছাড়ো!’
‘তোর টুঁটিটা ছিঁড়ে নিতে ইচ্ছে করছে আমার র—ত্—না!’
‘ওই তো, ওই তো, আবার জাগছে পাগলামি, তাই না? বললাম তো ভাস্করদা, তুমি পাগল নও কিনা সেটা তোমাকেই প্রমাণ করে দেখাতে হবে!’
‘কীভাবে প্রমাণ করব?’
‘কীভাবে আবার? শান্ত থাকো, ঠান্ডা থাকো, আমার পিছু নেওয়া বন্ধ করো…!’
‘রাস্তাঘাটে আজকাল খুব বেশি পাগলদের দেখি যেন!’ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে উদাস দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল রত্না।
‘কেন?’ আশ্চর্য হল প্রবাল, অতীনের বন্ধু। ‘খুব বেশি পাগল বেড়ে যাওয়ার তো কোনও কারণ নেই এখন!’
‘মানে? পাগল বাড়ার আবার নির্দিষ্ট কারণ থাকে নাকি?’ অবাক হল রত্না কথাটা শুনে। সে দেখল অতীনও ঘুরে তাকিয়েছে।
‘দেশে পাগলের সংখ্যা হঠাৎ বৃদ্ধি পায় সাধারণত একটা ব্যর্থ বিপ্লবের পর। জন্মগতভাবে যারা মানসিক ভারসাম্যহীন তারাও বাড়ি থেকে পালায় ফাঁক পেলেই, তবে রাস্তাঘাটের ভবঘুরে টাইপ পাগলগুলো বেশিরভাগই শোকে, দুঃখে বা প্রেমে পাগল, তাদের সংখ্যাও একটা হারে বাড়ে, হঠাৎ সংখ্যাবৃদ্ধি হওয়া অসম্ভব!’ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট, দেশলাই বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে অতীন হাসল।
‘তুই তো পাগলদের নিয়ে বেশ পড়াশুনো করেছিস প্রবাল!’
‘পড়াশুনো করতে লাগবে কেন? তোর মনে নেই আমাদের চোরবাগানের পাড়ায় কত পাগলের আমদানি ছিল!’
‘রত্নার সামনে বেশি পাগলের গল্প করিস না। ওর পাগলে ভীষণ ভয়! রাস্তায় একটা পাগল দেখল তো সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি ধরে বাড়ি…!’
‘আরে শোনোই না রত্না— মজা লাগবে— চোরবাগানের পাড়ায় একটা পাগল আসত যে একটা টাকাকে হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়ে বলত, ‘এক টাকা, এক টাকা, এক টাকা!’ সে কী রোমহর্ষক গলা ছিল পাগলটার। মা-রা তো খুব ভয় পেত ব্যাটাকে। তার বৈশিষ্ট্য ছিল যে, সে কিছুতেই এক টাকার কমে ভিক্ষে নিত না। একটা গোটা টাকা না দিলে সে পয়সা ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে যেত, আবার এক টাকার বেশি দিলেও ভিক্ষে অ্যাকসেপ্ট করত না— এতেই বোঝা যেত যে, সে একটা ভাল মাপের পাগল!’ হাসল প্রবাল!
চোরবাগানের পাড়ার কথায় অতীনের চোখ চকচক করে উঠল। হুইস্কির বোতলটাকে মোড়ক খুলে বের করে কাছের টেবিলে রাখতে রাখতে আগেই একটু হেসে নিয়ে বলল, ‘সেই যে একটা পাগল আসত। তোর মনে আছে প্রবাল— মা মুড়ি আর আলুপোস্ত খেতে দিয়েছিল বলে মাকে বলেছিল, ‘ছ্যাঃ, এ তো গোরুর খাদ্য!’ তখন আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা হলে পাগলের খাদ্য কী?’— সে মাথাটাথা চুলকে কী উত্তর দিল জানো রত্না?— ‘হালুয়া!’
ঊরু চাপড়ে চাপড়ে হাসতে লাগল প্রবাল আর অতীন। হাসি থামলে তার দিকে তাকিয়ে প্রবাল বলল, ‘তোমার চলবে নাকি?’ সে মাথা নেড়ে উঠে গিয়ে দুটো গ্লাস আর এক বোতল জল এনে দিল রান্নাঘর থেকে! তারপর আবার উদাস চোখে টিভি দেখতে লাগল।
তখন গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে প্রবাল প্রশ্নটা করল রত্নাকে, ‘তোমার যখন এত পাগলে এলার্জি তখন তোমার জীবনে একটা বিপজ্জনক পাগলের গল্প অবশ্যই আছে রত্না।’
প্রশ্নটা শুনে রত্নার চোখটা টিভি থেকে পিছলে এসে দাঁড়িয়ে গেল প্রবালের মুখে। বুকে ঝটপটিয়ে উড়তে লাগল অনেকগুলো বিচ্ছিরি কালো পাখি! সে মাথা নেড়ে বলল, ‘কোনও গল্প নেই!’
‘সে কী?’ গ্লাসে ছোট একটা চুমুক দিল প্রবাল— ‘কলকাতায় কী হয় জানো? এক-একটা পাগলই হয় এক-একটা পাড়ার বিশেষত্ব! সত্যি বলছি, ঠাট্টা নয়। বাইরের পাগল তো অনেক আসতই, কিন্তু চোরবাগানের নিজস্ব পাগল ছিল বন্ধু পাগলা। এমনিতে পাগলামি কিছুই করত না বন্ধু। ঘুরে ঘুরে বেড়াত আর পাড়ার মেয়ে-বউদের নানাভাবে হেল্প করতে চাইত কাজে-কন্মে। এই কাউকে পুজো দিতে নিয়ে যাচ্ছে, কারও কেরোসিন তুলে দিচ্ছে, কারও ছেলেমেয়ে স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছে, নিরীহ টাইপের। রাত হলে মেয়ে-বউরা যে-যার ঘরে ঢুকে গেলে তখনই যা একটু বেগড়বাঁই করত বন্ধু…!’
অতীন প্রবালের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিল— ‘সারারাত শিবমন্দিরের চালাতে বসে ভেউ ভেউ করে কেঁদে কেঁদে মহম্মদ রফির গান গাইত…!’ হা-হা করে হেসে উঠল অতীন, তাতে যোগ দিল প্রবাল।
সে চুপ করে আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠল। পটাপট টেনে টেনে দিল পরদাগুলো। বাইরে রাত বাড়ছিল।
বেশ মাতাল অবস্থায় চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে প্রবাল হাত চেপে ধরল রত্নার। বলল, ‘ছেলেরা তো প্রেমে ঘা খেয়ে পাগল হয়, কিন্তু মেয়েরা কেন পাগল হয় বলো তো?’
রত্নার অসহ্য লাগছিল মাতাল প্রবালকে, সে জোর করে হাত ছাড়িয়ে বলল, ‘আমি জানি না প্রবালদা!’
‘আমি জানি!’ বুকে আঙুল ঠুকল প্রবাল।
‘মেয়েরা পাগল হয় প্রেম প্রত্যাখ্যান করে— যখন টের পায় একদিন প্রেম আসলে কী!’ টলতে টলতে চলে গেল প্রবাল। ‘টের তো পায় ঠিকই!’ প্রবাল চলে যাওয়ার পর কোনওমতে একটা রুটি গলাধঃকরণ করে বাথরুমে গেল অতীন, পোশাক বদলাল আর কাত হয়ে পড়ল বিছানায়। এরপর সকালে উঠবে, দাড়ি কেটে, স্নান সেরে, জলখাবার খেয়ে অফিসে চলে যাবে। অফিস থেকে হয় কোনও মদের আসরে যাবে নয়তো সন্ধেবেলা ফিরলে বোতল আর গেলাসের বন্ধু সঙ্গে নিয়েই ফিরবে। আর সে সমস্ত দিন ধরে লুটিয়ে বেড়াবে এই ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রফলের ওপর। একা, একা! ফুরিয়ে যাওয়া মেয়ে!
এই, এ-ই তার জীবন এখন। অথচ কী জীবনের স্বপ্নই না একদিন দেখেছিল রত্না। আর কী মরিয়া হয়ে উঠেছিল সেই জীবনকে হাতের মুঠোয় পেতে!
খাবার টেবিলে বসে বসে রত্না দাঁতে ডলতে লাগল ঠান্ডা রুটি। তখন ও-ঘর থেকে অতীনের নাক ডাকার ঘড়ঘড় শব্দ ভেসে আসতে লাগল! খেয়ে উঠে সে ঘড়ি দেখল। বারোটা বেজে গেছে কখন! আজ আর তার কোনও অঙ্গচর্চা করতে ইচ্ছে হল না। সে শুধু শাড়িটা বদলে একটা ম্যাক্সি পরে নিল। তারপর ঘুমন্ত অতীনের মুখের দিকে দু’-চার মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে পা টিপেটিপে এগিয়ে গেল বাইরের ঘরের জানালার দিকে।
পরদাটাকে এক আঙুল সমান ফাঁক করল রত্না। তীক্ষ দৃষ্টি হেনে হেনে তন্নতন্ন করে খুঁজল পাগলটাকে, দেখতে পেল না। কিন্তু তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছিল পাগলটা তার খুব কাছেই আছে। তখন সে ইচ্ছে করেই অনেক, অনেকখানি সরিয়ে দিল পরদাটা আর দেখল— ও-ফুটপাতে নয়, একেবারে এ-ফুটপাতে, ঠিক তার জানলার নীচে, গাছে ঠেস দিয়ে দপদপানো চোখ মেলে তাকেই একদৃষ্টে দেখছে পাগলটা! মাগো! একটা কর্কশ শব্দ করে হেসে উঠল সেই পাগল আর প্রচণ্ড আঁতকে উঠে রত্না বসে পড়ল অন্ধকারে!
সকালে টেবিলে খাবার সাজিয়ে সে যখন অতীনকে তাড়া দিতে বাথরুমে উঁকি দিল তখন দাড়ি কাটতে কাটতে অতীন তাকে বলল, ‘প্রবাল, কাল মেয়ে-পাগলদের সম্পর্কে তোমাকে কী বলছিল রত্না?’
রত্না চমকে তাকাল অতীনের দিকে, তারপর বলল, ‘শুনিনি!’
অতীন বেরিয়ে গেলে সে রোজকার মতো চায়ের জল চাপাল, চা-পাতা ভিজতে দিয়ে রোজকার মতোই আয়নার সামনে দাঁড়াল গিয়ে, আর বেঁধে রাখা চুলগুলোকে খুলে মেলে দিল পিঠে।
তখন ফুলপিসির বড় ননদের ছেলে সুমিত দত্তই তার ধ্যান-জ্ঞান!
আমেরিকার গন্ধ তার গায়ে। সুমিত বলেছিল, বড় চুল খুব ব্যাকডেটেড! সে কচকচ করে কেটে ফেলেছিল চুল কাঁচি দিয়ে, তাদের হাফ গ্রাম, হাফ শহুরে এলাকায় কেউ তখন ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাত না। ভীষণ নিন্দে হত। সে সুমিত দত্তর জন্য লিপস্টিক লাগানো শুরু করল, তুলে দিল কাজলের টিপ, সপ্তাহে-সপ্তাহে মাথা ঘষতে লাগল শ্যাম্পু দিয়ে। তখন ক্রমশ আরও পাগলাটে হয়ে যাচ্ছিল ভাস্করদা। একদিন জেঠিমার গায়ে পর্যন্ত হাত তুলেছিল। শেষ অব্দি তাকে সবাই মিলে দিয়ে এল অনেক দূরের একটা মানসিক রোগীদের হসপিটালে।
বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেছিল তার সে-সময়। তাই সে আর ভাস্করদার কথা ভাবতে চায়নি। বরং বিয়ের সময় ভাস্করদা এখানে উপস্থিত থাকবে না ভেবে নিশ্চিন্ত বোধ করেছিল। এর মাত্র ক’দিন পরেই সুমিত দত্ত বিয়ে ভেঙে দেওয়ার ঘোষণা করেছিল ফুলপিসির কাছে। মুখ চুন করে ছুটতে ছুটতে এসেছিল ফুলপিসি সেই খবর নিয়ে। অন্য একটা কনভেন্টে পড়া মেয়েকেই সুমিত দত্ত আর ফুলপিসির বড় ননদের বেশি যোগ্য বলে মনে হয়েছিল হঠাৎই— যখন রত্নার সঙ্গে সুমিত দত্তের বিয়ের আর মাত্র একমাসই বাকি!
যে-অহংকারী পা ফেলে সুমিত দত্তর সঙ্গে হেঁটেছিল রত্না তাদের ছোট টাউনের এ-পাড়া ও-পাড়া, সিনেমা হল, রেলস্টেশন, পুজোমণ্ডপ— বিয়েটা ভেঙে যাওয়ার পর সেখানে টিকে থাকা অসম্ভব ছিল তার পক্ষে, তার মা-বোনের পক্ষেও। একেবারে উন্মাদ হয়ে যাওয়া ভাস্করকেও তখন ফিরিয়ে আনা হয়েছিল আবার। ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হত। ভাস্কর লাফাত, ঝাঁপাত, ভাঙচুর করত, মাথা ঠুকত…। সে মা-বোনসহ চলে গেছিল শিলিগুড়ি পাকাপাকিভাবে, মেজমামার কোয়ার্টারে।
খুঁজে খুঁজে অতীনকে বের করেছিল মেজমামাই। বিজ্ঞাপন এজেন্সির এক মাঝারি এক্জিকিউটিভের ঘরনি হয়ে সে এসে পৌঁছেছিল এরপর কলকাতায়। এই ভাড়া করা ফ্ল্যাটে শুরু হয়েছিল তার নতুন জীবন!
কিন্তু নতুন জীবন কি আদৌ তাকে বলা যায়! একটা-না-একটা পাগল তো সবসময়ই অত্যাজ্য এক ছায়া ফেলে রেখেছে তার জীবনে। ভয়ের ছায়া, গোপনীয়তার ছায়া, আত্মকরুণা আর আত্মনির্যাতনের ছায়া সেসব।
পাগলবিহীন জীবন সে তো পেল না কখনওই!
দরজায় কেউ বেল দিচ্ছে। রত্না সংবিৎ ফিরে পেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে এল শোবার ঘর থেকে। দরজা খুলে সে দেখল মা দাঁড়িয়ে। হাতে মিষ্টির বাক্স!
‘মা? কবে এলে তুমি? আশ্চর্য!’ সে খুশির আতিশয্যে জড়িয়ে ধরল মাকে।
দিন চারেক এসেছে মা। বোনের কাছে উঠেছে। মা এখনও শিলিগুড়িতেই থাকে মেজমামার কাছে। ফোনে পায়নি রত্নাকে মা যে আসার খবর জানাবে।
রত্না তৎপর হয়ে উঠল এতদিন পরে আসা মাকে যত্ন করতে। সে চটপট চায়ের সঙ্গে ফুলকপির বড়া ভাজল বেসন দিয়ে। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল ভাতের সঙ্গে কী বিশেষ রেঁধে খাওয়াতে পারে মাকে।
খেতে বসে অনেক অনেক কথা হল দু’জনের। এ-কথা ও-কথা বলতে বলতে মা হঠাৎ তার হাতটা ধরল আলতো করে, বলল, ‘রত্না শোন’— থমকাল মা। গভীর চোখে দেখল তাকে। আবার শুরু করল, ‘এসে আমি ওখানে গেছিলাম একদিনের জন্য!’ রত্না সঙ্গে সঙ্গে পিঠ সোজা করে বসল।
‘জানিস ভাস্কর একেবারে ভাল হয়ে গেছে; সত্যি রে, পুরো আগের মতো! বিয়ে করেছে, ছেলে হয়েছে। বাজারে তার এখন ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিনের শোরুম! আমার সামনে দিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে বউ নিয়ে গেল কীসব কেনাকাটা করতে, ছেলের জন্মদিন আসছে রোববার— তাই! যাওয়ার সময় আমাকে প্রণাম করে গেল!— দেখে শান্তি পেলাম খুব, মন থেকে একটা বোঝা নেমে গেল! ভাস্কর পাগল হয়ে যাওয়ার জন্য ওরা তো তোকেই দায়ী করেছিল।’
সে কোনও কথা বলল না, ছলোছলো চোখ মেলে তাকিয়ে রইল মা-র দিকে!
অনেকক্ষণ হল চলে গেছে মা। অতীনও ফেরেনি। সন্ধে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে রাতে। সে পরদাগুলো টেনে দিয়ে ফ্ল্যাটের সব আলো নিভিয়ে দিল। তারপর পরদা ফাঁক করে অপেক্ষা করতে লাগল পাগলটার। ভাস্করদা ভাল হয়ে গেছে— কিন্তু তাতে কী? সে জানে, একটা-না-একটা পাগল তাকে নজরে নজরে রাখছে ঠিকই। সে জানে, একদিন-না-একদিন চোরবাগানে বা টাউনের বাজারে কিংবা যে-কোনও কোথাও—কোনও নির্জন গলিপথে বা ফাঁকা রেলস্টেশনে, তাকে একা পেয়ে অতর্কিতে তেড়ে আসবেই কোনও-না-কোনও পাগল! তেড়ে এসে পথ আটকাবে! আড়ষ্ট জিভ নেড়ে বলবে, ‘র—ত্—না !’ বলবে সমস্ত কিছুর জন্য জবাবদিহি করতে! শীর্ণ, লম্বা, নোংরা হাতের পাতা মেলে ধরে বলবে— ‘ফিরিয়ে দে!’
সেই দিনটার ভয়ে ভয়েই সে বেঁচে আছে এখন!
কালি ও কলম, ফেব্রুয়ারি ২০০৫