1 of 2

পাখি

পাখি

আজ সকাল থেকে রুমনির ওপর দিয়ে যেন একটি ঝড় বয়ে গেল। ঝড়ের পরের ডালপালা ভাঙা গাছের মতোই অবস্থা তার। এখন পর্যন্ত এককাপ চা খাওয়ারও অবকাশ হয়নি। পটলাটাও ছুটি নিয়ে তিন দিনের জন্যে পাথরপ্রতিমাতে তার দেশে গেছে। একমাত্র মামার বিয়ে। সজনেখালিতে বরযাত্রী যাবে। অবশ্য ছুটিছাটা নেয়ই না বলতে গেলে। ও ছেলেমানুষ। তাই ছুটি চাইলে ‘না’ করা যায় না।

রুমনির মেজোছেলের সমবয়েসি পটলা। ওদের পরিবারে বাড়ির ছেলের মতোই থাকে, হাসিঠাট্টা খুনসুটি করে ছেলেদের সঙ্গে, ছেলেবেলাতে মা মারা গেছে। মামাবাড়িতেই মানুষ। রুমনির স্বামী গগনেন্দ্রও পুত্রস্নেহে দেখে পটলাকে। পটলাও গগনেন্দ্রের পা টিপে দেয়, ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে দেয়।

গগনেন্দ্র বলে, ময়দানে গিয়ে গরিবের প্রতি দরদে গলা ফাটিয়ে লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে বক্তৃতা করার চেয়ে নিজের নিজের বাড়ির কাজের লোকেদের ভালো করে দেখাশোনা করাটা আসল সোশ্যালিজম।

কথাটা হয়তো ঠিকই বলে গগনেন্দ্র।

রুমনি ভাবে, পটলার প্রতি গগনেন্দ্রর যতটুকু দরদ আছে, তা তার বিনি মাইনের স্ত্রীর প্রতি নেই। রুমনিরা তো স্বামীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারে না। তাদের কপালকে মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ই বা কী? দশ বছরের বিবাহিতজীবনে একটি অ্যাবর্শান নিয়ে চার বার সন্তানধারণ করেছে। সূর্যোদয় থেকে গভীর রাত অবধি রুমনির কাজ। কতরকমের যে কাজ।

গগনেন্দ্র মানুষটি বড়ো আত্মকেন্দ্রিক। সোজা করে বললে বলতে হয় স্বার্থপর। নিজের পছন্দসই খাওয়া ছাড়া আর কোনোই শখ নেই। যদিও অভাব তেমন নেই। অর্থ যথেষ্ট উপার্জন করে। সরকারি চাকরির সামান্য আয়ে এত সচ্ছলতা সম্ভব নয়। রুমনির ঘোর সন্দেহ হয় যে, গগনেন্দ্র ঘুস খায়। ভয়েই কখনো জিজ্ঞেস করতে পারেনি স্বামীকে। হয়তো ঘেন্নাতেও।

রুমনির বাবা রীতিমতো আদর্শবান কমিউনিস্ট ছিলেন। প্রমোদ দাশগুপ্তের স্নেহধন্য। আজকাল সেই ধরনের কমিউনিস্ট বেশি দেখতেই পায় না রুমনি। গগনেন্দ্রর বাবা ছিলেন, কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী। রুমনির বাবার সহপাঠী। দুজনে ভিন্ন রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তখনকার দিনের রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে একে অন্যের প্রতি, কোনো অসূয়া ছিল না। ছিল না বলেই দুই পরিবারের মধ্যে এমন মেরু-মিলন সম্ভব হয়েছিল।

পটলাটা থাকলে এতক্ষণে এককাপ চা করে দিত রুমনিকে। বেশি করে দুধ চিনি দিয়ে এবং একটু আদা দিয়ে। ছেলেটারই যা একটু মায়াদয়া আছে রুমনির ওপরে।

রুমনির সারাদিনে এই একটু অবকাশ, এই সময়টুকুতেই পাখিটার সঙ্গে একটু কথা বলে, তাকে দানা আর জল খেতে দেয় নিজের হাতে আর জানালার সামনে তার প্রিয় চেয়ারটি পেতে বসে বাইরে উদ্দেশ্যহীনভাবে চেয়ে থাকে চা খেতে খেতে। চোখে যা আসে তাই দেখে, বিশেষ কিছু দেখবে বলে চোখ মেলে না।

খুব ভোরে উঠে, পটলা নেই বলে, ডাঁই জামাকাপড় বিছানার চাদর কেচে ছাদে মেলে দিয়েছে। সেগুলো উঠিয়ে নেওয়ার সময় হল। রোদ বেশ কড়া আজ।

সাদামাটা রংচটা সরকারি ফ্ল্যাটবাড়িটা ‘L’ শেপ-এর। নীচে এক চিলতে মাঠমতো। ওপরে বড়ো ছাদ। কমন লন। বড়োলোকের বাড়ির ‘লন’-এর মতো সাজানো-গোছানো নয়। একটা জারুল গাছ আছে। বছরের এই সময়টাতে বেগনে-রঙা ফুলে ভরে যায়। একটি অমলতাস গাছও আছে। এখন হলুদ ফুলে ফুলে ভরে গেছে। কোনো সরকারি কর্মচারী যে কবে লাগিয়েছিলেন কে জানে? উলটো দিকের দেওয়ালের পাশে লাগানো, একটা বারোমেসে জবা গাছ, একসার করবী দেওয়ালের গায়ে গায়ে।

এইসব মানুষকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করে রুমনির। মানুষটি কবে চলে গেছেন ফ্ল্যাট ছেড়ে, হয়তো অবসরও নিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু গাছ যখন লাগিয়েছিলেন তখন ফুল ফুটবে বলেই লাগিয়েছিলেন। কিন্তু সে-ফুলের শোভা নিজে দেখতে পাবেন না তাও জানতেন হয়তো। এমন উদার পরোপকারী মানুষ এখনও সংসারে কিছু আছেন বলে পৃথিবীটা গোসাপের মতো বুকে হেঁটে ধীরে ধীরে চলেছে।

এ-বাড়ির হাতাতে একটা পাগলা কোকিল আছে। যে, থেকে থেকেই ডেকে ওঠে। যদিও বসন্ত চলে গেছে বহুদিন। বসন্ত কখন যে আসে এই কেজোপাড়ায় তা এখন বোঝা পর্যন্ত যায় না। কোকিলের ডাকে বুকের মধ্যেটা হু-হু করে ওঠে। কৈশোরে ফিরে যায় রুমনি—যখন শেষরাতে নরম নরম বেগুনি ফুলের মতো রাশ রাশ স্বপ্ন দেখত অনেক। যেমন সব কিশোরীই দেখে। জীবনটা নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কবিতাও লিখত তখন। একটি উজ্জ্বল উষ্ণ ডিমের মতো সেই বেগুনি স্বপ্নের জীবনটা কখনো যে তার হাত থেকে পথের ধুলোয় হঠাৎ পড়ে গিয়ে এমন করে ভেঙে যাবে, থোড়-বড়ি-খাড়া-খাড়া-বড়ি-থোড়ের হয়ে যাবে, তা কখনো ভাবেনি রুমনি।

আসলে, নিজের জীবনটাকে শক্ত করে ধরার সুযোগই হয়নি ওর। বড়োই আলতো করে ধরেছিল হয়তো। এখন কখনো কখনো মনে হয়।

গগনেন্দ্র মানুষটার মধ্যে অন্য অধিকাংশ পুরুষেরই মতো একটুও রোমান্টিকতা নেই। রুমনির মাঝে মাঝে মনে হয়, সপ্তাহে দু-তিন দিন আধো-অন্ধকার শোয়ার ঘরের খাটে শুয়ে শায়াসুদ্ধু শাড়ি তোলা আর সাত দিন হাঁড়ি ঠেলা ছাড়া তার জীবনে আর অন্য কিছুই নেই। জীবনটা পুরোপুরিই বৈচিত্র্যহীন হয়ে গেছে। তার সুন্দর প্রত্যাশী শরীরটির ছিদ্রপথে রোমশ ইঁদুরের মতো দ্রুত প্রবেশ ও প্রস্থান করেই ফুরিয়ে যায় গগনেন্দ্র। রুমনির শরীরে যে আরও অনেক আনন্দের ঝরনার উৎসমুখ আছে সেসবের খোঁজ রাখেনি কোনোদিনই। গগনেন্দ্রর হঠকারী বেসুরো solo কোনোদিনও সুরেলা বৃন্দগান হয়ে ওঠেনি। সেইসব বোধ তার ভাবনারও বাইরে। ‘স্ত্রী’ মানে দাসী, রাঁধুনি, সন্তান উৎপাদনকারী এক প্রাণী যদিও মনুষ্যজাতিরই অন্তর্ভুক্ত, এই কথাই গর্বভরে জেনেছে। তার এই জানার মধ্যে কখনো কোনো দ্বিধাও ছিল না। নিজেকে গলিয়ে তড়িঘড়ি ছিদ্রপথে ডাবুতে ঢেলে দিয়ে গগনেন্দ্র কোলবালিশ জড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়েছে অন্য দশজন পুরুষেরই মতো।

কোকিলটা আবারও ডাকল। কোথা থেকে ডাকছে দেখা যাচ্ছে না। টিয়ার খাঁচাটা দানা ও জল দেওয়ার জন্যে একটু আগেই খুলেছিল যে, তা ভুলেই গেছিল রুমনি। হঠাৎই ওকে চমকে দিয়ে ‘ফরফর’ করে ডানা মেলে পাখিটা উড়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গেল তো গেল আকাশে উড়ে না গিয়ে তাদের তিনতলার ফ্ল্যাটের কোনাকুনি যে ছোট্টফ্ল্যাটটা আছে, যে-ফ্ল্যাটে মাঝবয়েসি এক পুরুষ একা থাকেন মাস দুয়েক হল, সেই ফ্ল্যাটেরই জানলা দিয়ে তারমধ্যে সেঁধিয়ে গেল।

চা খাওয়া মাথায় উঠল রুমনির। কী করবে ও এখন, আগে মনু জোয়ারদার থাকতেন অ্যানিম্যাল হ্যাসব্যান্ড্রি ডিপার্ট-এর। পটলার কাছেই শুনছে যে, ভদ্রলোক একা থাকেন সবসময়ে। লেখাপড়া নিয়েই। উনি সরকারি কর্মচারী নন। কোনো আত্মীয়র ফাঁকা ফ্ল্যাটে থাকেন। উনি নাকি লেখক। তবে গল্প, উপন্যাস লেখেন না বোধ হয়। লিখলে,গত ছ-মাসের মধ্যে অন্যান্য ফ্ল্যাটের সাহিত্যভক্ত মহিলাদের কাছে তাঁর নাম নিশ্চয়ই শুনত।

এখন পাখি খুঁজতে অজানা অচেনা ভদ্রলোকের ফ্ল্যাটে সে একা অসময়ে যায়ই বা কী করে? পটলা থাকলে তাকেই পাঠিয়ে দিত। অথবা পটলাকে সঙ্গে করে যেত, এই পাখিটি বাড়ির সকলেরই খুব প্রিয়। রুমনির বড়োছেলে তাকে একটি ছড়া শিখিয়েছে। গগনেন্দ্ররা তিন পুরুষের কংগ্রেসি। নেহরু পরিবারের খুব ভক্ত। সেইসূত্রে বড়ো-দু-ছেলেও ভক্ত। ছড়াটি হল:

নেড়ু নেড়ু নেড়ু, বাবা কত্তে যাবে বেড়ু?
চিংকি কাকা চুষনি দেবে রুশি মামা ভেড়ু
বাবা কত্তে যাবে বেড়ু?



আজকে রাহুল গান্ধি আসছেন। ময়দানে সেজন্যে মস্ত মিটিং। একে রবিবার, ছুটির দিন, তায় দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রীর আগমন বলে কথা। ভিড়ে—ভিড়াক্কার। পুলিশ, কম্যাণ্ডো, অ্যাম্বুলেন্স এবং ক্যাডারে ছয়লাপ। আলুকাবলি, বুড়ির চুল, মোগলাই পরোটার চলমান দোকানিদেরও ভিড় লেগে গেছে। কংগ্রেসের পতাকাতে ছেয়ে গেছে চারদিক। যত লাফাঙ্গা, ভ্যাগাবণ্ড, পকেটমার, চোর, বদমাশ সব শামিল হয়েছে এই ভিড়ে। শুধু কংগ্রেস বলেই নয়, সব পার্টির জমায়েতেই এখন এমনই হয়।

আদর্শর কারণে কেউ আজকাল আর রাজনীতি করে না। টু-পাইস কামাবার ধান্দাতেই করে। দুঃখ হয় গগনেন্দ্রর। তার বাবা, কি রুমনির বাবারাও অন্যরকম ছিলেন।

গগনেন্দ্রর ছোটোছেলে হুব্বার বয়স চার। সে তার লম্বাচওড়া বাবার কাঁধে চড়ে চলেছে পুণ্যভূমির দিকে। তার অনর্গল প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে চলেছে গগনেন্দ্র, বাগবাজার থেকে এসে চৌরঙ্গির মোড়ে মিনিবাস থেকে নেমে।

রাহুল গান্ধি কে বাবা?—প্রশ্ন করল হুব্বা।

রাজীব গান্ধির ছেলে।

রাজীব গান্ধি কে বাবা?

ইন্দিরা গান্ধির ছেলে। বড়োছেলে।

অ। তা ইন্দিরা গান্ধি কে বাবা?

আঃ। পন্ডিত জওহরলাল নেহরুর মেয়ে। একমাত্র সন্তান।

পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু কে ছিলেন বাবা?

আঃ। তাও জানিস না? তোদের স্কুলে শেখায়টা কী? ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ব্যারিস্টার।

জওহরলাল যদি নেহরু হয় তাহলে মেয়ের পদবি ‘গান্ধি’ হবে কেন বাবা?

গগনেন্দ্রর মেজোছেলে ডাব্বু প্রশ্ন করল।

পশ্চিমবঙ্গের সব বাড়ির মেজোগুলোই বেশি বুদ্ধি ধরে এবং পরে ‘মেজোকর্তা’ হয়। লক্ষ করেছে গগনেন্দ্র।

আঃ! গান্ধির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল, তাই।

মহাত্মা গান্ধির ছেলের সঙ্গে?

উঃ। না রে বাবা। ফিরোজ গান্ধির সঙ্গে। ফিরোজ পার্সি আর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ছিলেন গুজরাটি। ও গান্ধির সঙ্গে এই গান্ধির কোনো সম্পর্ক নেই।

তিনি কোথায় থাকতেন? মানে ফিরোজ গান্ধি?

তিনিও লোকসভার সদস্য ছিলেন। খুব ভালো বক্তৃতা করতেন। তাঁর দাম্ভিক শ্বশুরের সঙ্গে তাঁর পটত না। তিনি অত্যন্তই স্বাধীনচেতা ছিলেন। লোকসভাতে পর্যন্ত শ্বশুরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হত, তার পর ফিরোজ রাগ করে কাশ্মীরে চলে যান এবং সেখানেই অকালে মারা যান।

ছোটো বলল, যাচ্চলে। ফুরিয়েই গেল।

ডাব্বু বলল, এই ইন্দিরা গান্ধিই না দাদুর বহরমপুরের জমিদারি লোপ করে দিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। শুধু তাঁরই কেন? ভারতের সব রাজা ও জমিদারদেরই সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছিলেন।

কেন?

জনগণের ভালোর জন্য। আরও কত কী করেছিলেন। ব্যাঙ্কে, কয়লাখনিতে আরও সব কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলেন।

আর তাঁর নাতিই মহারাজা হবে ভারতবর্ষের?

হ্যাঁ। সেটাই সত্যি। তাঁর নাতিই শুধু কেন? তিনি নিজে, তাঁর বড়োছেলে রাজীব, রাজীবের বিদেশি বউ সোনিয়া এবং তাদের আদরের ছেলে রাহুলও এখন রাজা হতে চলেছে।

এই রাজার প্রজা করা হবে?

কেন আমরা?

বলেই বলল, এবার ঘাড় থেকে নাম রে বাবা, ঘাড় টনটন করছে।

ডাব্বু বলল, হুব্বাকে নামাবে কিন্তু রাজা তো আর নামছে না। ক-পুরুষ হল বাবা?

তা চার পুরুষ হল।

নামলে, ফুচকা খাওয়াবে তো বাবা? হুব্বা বলল।

খাওয়াব। একটু পরে। এই তো একঘণ্টাও হয়নি ডিমসেদ্ধ, পটলসেদ্ধ দিয়ে ফ্যানাভাত খেয়ে এলি।

ঠি আছে।

আজকাল ছেলে-মেয়েদের সময়ের ভীষণই দাম। তারা ‘ঠিক আছে’ বলে সময়ের অপব্যবহার করে না। বলে ঠি আছে।

ডাব্বু বলল, রাহুল গান্ধির বয়েস কত বাবা? মা বলছিল, আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির জমাদার গিরিডির পাপ্পু কাহারেরই সমান।

ওরকমই হবে।

ওই বয়েসেই রাহুল গান্ধির অত বুদ্ধি? এত বড়ো দেশ শাসন করবে? পড়াশুনোতে খুব ভালো বুঝি?

তা জানিনে বাবা। ওসব ছেলেপুলে বুদ্ধির ঝুড়ি নিয়েই জন্মায়। ফটাফট ইংরেজি বলতে পারে। আর ইংরেজি বলতে পারা আর বুদ্ধি থাকা তো একই জিনিস।

তাই বুঝি?

ডাব্বু বলল, তালে যারা ইংরেজি বলতে পারে না, তারা সবাই বুদ্ধু? জার্মানরা, জাপানিরা, চিনেরা—সবাই বুদ্ধু?

গগনেন্দ্র বিরক্ত হয়ে বলল, এসেছিস কংগ্রেসের জেনারেল সেক্রেটারি এবং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে, তার বক্তৃতা শুনতে, তারমধ্যে অত কথা কীসের? সর্বভারতীয় সব তাবড় তাবড় বাঙালি নেতারা একবাক্যে তাঁকে রাজা বলে মেনে নিতে যাচ্ছেন, সে কি এমনি এমনি? তাঁদেরও কি বুদ্ধি নেই নাকি?

তাও তো বটে।

ডাব্বু বলল।

এই অকাট্য যুক্তির পরে আর কেউ কথা বলল না। হুব্বা ঘাড় থেকে নেমেই ফুচকাওয়ালার খোঁজ করতে লাগল। এদিকে আকাশে একটি কালো শকুনের মতো রাহুল গান্ধির হেলিকপ্টার দেখা গেল অনেক দূরে। আকাশে একটু মেঘ মেঘ করেছে। ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। বাঙালি জনতা যারা দোকানে দোকানে বাংলা ভাষাতে সাইনবোর্ড টাঙাবার জন্যে আন্দোলন করেন, মিছিল করেন নিয়মিত, তারাই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন : রাহুল গান্ধি কি জয় হো। রাহুল গান্ধি কি জয়। মুবারক হো। ছোটেসরকার যুগ যুগ জিয়ো।



না:। আর দেরি করা যাবে না। উঠল রুমনি। বাইরের দরজার চাবিটা আয়নার সামনে থাকে। সেটি তুলে নিতে নিতে আয়নাতে একঝলক দেখে নিল নিজেকে। তাড়াতাড়ি হাউসকোটটা বদলে নিল। এটা বাঁ-বগলের কাছে ছিঁড়ে গেছে অনেকটা। চুলে একটু চিরুনি বুলিয়ে নিল। মুখে পাউডারের পাফটা হালকা করে বোলাল। তাকে যে কেমন দেখতে ভুলেই গেছে রুমনি।

বাড়ি থেকেও কোথাওই বেরোয় না বলতে গেলে। তার আর রূপচিন্তা কীসের? মুহূর্তের জন্যে হলেও বহুদিন বাদে নিজেকে মনোযোগের সঙ্গে দেখল ও। দেখে খুশিই হল। মাঝ তিরিশে পৌঁছে এই যত্নহীন, প্রেমহীন, ধন্যবাদহীন, হাড়ভাঙা পরিশ্রমের জীবনে তার পরমদয়ালু যৌবন এখনও তাকে ছেড়ে যায়নি। ড্রয়ার থেকে বার করে পারফিউমের শিশিটা তুলে একবার চকিতে স্প্রে করল বগলতলিতে স্তনসন্ধিতে। পুজোর সময়ে তার দুবাইবাসী নন্দাই তাকে এনে দিয়েছিল। এত কিছু করল পাঁচ মিনিটেরও কম সময়ে। তার পর দরজা টেনে দিয়ে বেড়িয়ে পড়ল। মোবাইল ফোন আছে একটা কিন্তু সেটা গগনেন্দ্রর কাছেই থাকে।

ফ্ল্যাটটার সামনে পৌঁছে দরজার বেল টিপল রুমনি। প্রথমবার কোনো সাড়া এল না। দ্বিতীয় বার টেপার পরে চটি ফটফট করে বন্ধ দরজার দিকে কারো এগিয়ে আসার আওয়াজ পেল। দরজাটা খুলেই একজন সম্ভ্রান্ত সুদর্শন ভদ্রলোক হেসে বললেন, আজ আমার দিন খুব ভালো কাটবে।

রুমনি পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা লম্বা ও দোহারা কাঁচা-পাকা চুলের ভদ্রলোককে অপলকে দেখতে লাগল। এমনটা বহুদিন হয়নি। বাকরোধ হয়ে গেল ওর। সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, বড়ো বিপদে পড়ে এলাম।

ভদ্রলোক বললেন, আপনার বিপদটাই আমার সম্পদ।

আমার পাখিটা আপনার ফ্ল্যাটে উড়ে এসেছে। এখনও কি আছে? না আবার অন্য কোথাও উড়ে গেল?

আছে। সে এখন পপকর্ন খাচ্ছে।

পপকর্ন? বাড়িতে ছিল?

হ্যাঁ। গতকাল আমার এক বন্ধুর ছেলে এসেছিল। তার জন্যে নিয়ে এসেছিলাম।

তার পর একটু চুপ করে থেকে ভদ্রলোক বললেন, পাখির নাম কী?

পাখি।

বা:। সুন্দর নাম তো।

টিয়া না চন্দনা?

ওই হবে দুটোর একটা।

পাখি পাবেন। এখন একটু বসুন। এসেছেনই যখন কষ্ট করে। যতদিন ধরে এই ফ্ল্যাটে এসেছি ততদিন ধরেই আপনাকে চোরের মতো দেখি।

কী করে?

আপনি তো রোজই সকালে এই সময়টা জানলার সামনে বসেন এসে। তারিয়ে তারিয়ে চা খান। মাঝে মাঝে গানও গান। দূর থেকে গান শোনা যায় না কিন্তু বোঝা যায় যে গান গাইছেন।

তার পর ভদ্রলোক বললেন, জানেন, আপনি যে অমলতাস গাছটার দিকে চেয়ে গান করেন আমিও সেই গাছটা রোজই দেখি। কালিদাসের লেখাতেও এই অমলতাসের কথা আছে। একবার মধ্যপ্রদেশের ধার জেলাতে মান্ডুর দুর্গে গেছিলাম। রুপমতী আর রাজহাবাদুরের মান্ডু। ভারি সুন্দর সেই দুর্গ। সেখানে অনেক অমলতাস দেখেছিলাম। বাওবাব গাছও দেখেছিলাম আফ্রিকাতে। ইংরেজরা যে গাছকে বলে Upside down tree। পূর্ব আফ্রিকাতে সে গাছ অনেকই আছে। মান্ডুতেও আছে। স্থানীয় মানুষেরা তাদের বলে ‘বিলাইতি ইমলি’।

আপনি অনেক দেশ ঘুরেছেন না?

নিজের এই সুন্দর দেশটাকেই তো পুরোপুরি দেখে উঠতে পারলাম না। এমন দেশ সত্যিই আর কোথাও নেই। কত বৈচিত্র্য এই দেশে।

আপনার আসল দেশ কোথায়?

ভারতবর্ষে।

না, না, আসল দেশ।

বললামই তো। ভারতবর্ষই আমার দেশ।

কোথায় থিতু হবেন?

সেইটেই তো ঠিক করা হয়নি আজ অবধি। আমিও একটি পাখিই। বলতে পারেন পরিযায়ী পাখি। যদি তেমন সুযোগ-সুবিধে হয়, তবে এই ফ্ল্যাটেই থেকে যেতে পারি বাকি জীবন।

আপনার স্ত্রী এবং সন্তানেরা কি এই এক-কামরার ফ্ল্যাটে আঁটবেন?

স্ত্রী, সন্তান আমার নেই, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই।

সে আবার কী কথা?

সকলেই যা করে, তা করব না বলেই ঠিক করেছিলাম আমি ছেলেবেলা থেকে।

কেন? এমন ধনুক-ভাঙা পণ?

আমি এরকমই।

কীরকম?

অন্যরকম। আপনার ভালো লাগে না অন্যরকম হতে?

আমি নিরুপায়। আমার অন্যরকম হওয়ার উপায় নেই। এই জীবনকে আমার ভালো লাগাতেই হবে। রুমনি বলল।

হঠাৎই পাখিটা বলে উঠল ডাব্বু উঠে পড়ো। স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

ভদ্রলোক চমকে উঠলেন আর রুমনি হেসে উঠল।

ডাব্বু কে?

আমার মেজোছেলে।

আপনার ক-ছেলে-মেয়ে?

তিন ছেলে।

মেয়ে নেই?

না:।

এই না:-এর মধ্যে একটু দুঃখ ঝরে পড়ল যেন। সেটা কান এড়াল না ভদ্রলোকের। একটিও মেয়ে না থাকার দুঃখ সব মায়েরাই বোঝে। আশ্চর্য। পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও যেন সেই দুঃখের রকমটা বুঝলেন ভদ্রলোক।

একটু চা করি? এই প্রথম আমার কাছে এলেন।

চা-ই তো খাচ্ছিলাম এতক্ষণ। কী দরকার?

সে তো আপনার চা, আমার চা তো নয়। দুধ, চিনি আলাদা দিচ্ছি। পাঁচ মিনিটও লাগবে না। ‘কুরকুরে’ খাবেন চা-এর সঙ্গে? ‘বিস্কফার্ম’-এর ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কিট?

না না কিচ্ছু না। চা-ও না হলে চলত। পাখিকে খাঁচায় রেখে আমার ছাদে যেতে হবে। অনেক জামাকাপড় মেলা আছে। মনে হচ্ছে, ঝড়বৃষ্টি আসবে। আকাশ ক্রমশ কালো করে আসছে, দেখছেন না?

তাহলে চা-টা খেয়ে আগেই জামাকাপড়গুলো তুলে ফেললে হত।

পাখি যদি উড়ে যায়। আপনার তো খাঁচা নেই।

না। আমার খাঁচা নেই। কিন্তু পাখিরা তো ওড়বার জন্যেই।

কিছু পাখি থাকে খাঁচাতেই জীবন কাটাবার জন্যে। তারা উড়তে পারে না। তা ছাড়া উড়ে যাবেই বা কোথায়?

সাহস করে উড়ে যেতে পারলে থাকার অভাব কি হয়? তা ছাড়া, খাঁচায় থাকার দরকারও তো তখন আর থাকে না।

তা ঠিক। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে রুমনি বলল।

গ্যাস-এর উনুনের পরে ছোটো কেটলিটা চাপিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আজ তো রবিবার। আজ তো সকালে আপনার একা থাকার কথা নয়।

বাড়িসুদ্ধু সবাই রাহুল গান্ধির মিটিং-এ গেছে।

তাই? ভদ্রলোকের গলায় যেন কৌতুক ঝরে পড়ল।

গণতন্ত্রে প্রত্যেক মানুষের পছন্দও আলাদা আলাদা। কেউ কংগ্রেসি, কেউ কমিউনিস্ট, কেউ বিজেপি, কেউ বা অন্য কোনো দলের।

বলেই বলল, আপনার কোন দল?

আমি নির্দল। পছন্দ করার মতো দল পাইনি তাই। ভদ্রলোক বললেন।

আপনি কি লেখক?

লেখক বলতে আপনি যা-বোঝেন আমি তেমন লেখক নই। আমি লেখক অবশ্যই তবে কোনো এস্টাবলিশমেন্টের লেখক নই। আমার গলায় বকলস-এর দাগ নেই। আমি এই সুন্দর দেশটাকে আরও সুন্দর দেখতে চাই। সব রাজনৈতিক নেতাদেরই খতম করতে চাই।

রুমনির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। বলল, আপনি নকশাল?

আমি অ্যাক্টিভিস্ট নই, থিয়োরেটিশিয়ান।

তার পর বললেন, কথাটা কি বুঝলেন?

লেখাপড়া তো বেশি করিনি। উচ্চমাধ্যমিক পাস আমি। বেশি বুঝব কী করে?

বেশি না বোঝাই ভালো। এটুকু বুঝলেই হবে যে, কোনো রাজনৈতিক দলই আমাকে পছন্দ করে না। তাই আমি একলা থাকি, একলা পড়ি, একলা ভাবি, একলা লিখি।

তার পরই বললেন, দেখুন, আপনাকে নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলে ফেললাম। যা আমার পক্ষে বিপজ্জনক। কিন্তু সংসারে আপনার মতো মানুষ থাকেন, সংখ্যাতে যদিও তাঁরা খুবই কম, যাঁদের বিশ্বাস করা যায়।

বিশ্বাস করে কখনো ঠকেননি জীবনে?

বার বার ঠকেছি। কিন্তু ওই ….

ওই কী?

ওই একটা রোগ। কিছু মানুষের ওই রোগ থাকে। বারে বারে শিকার হওয়ার পরও বিশ্বাস করা তারা ছাড়তে পারে না।

রুমনি উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। ভদ্রলোক একটি লেসঢাকা ট্রেতে চারটি ক্রিম ক্র্যাকার বিস্কিটে পাতলা করে মাখন লাগিয়ে লিকারের পট, এবং চিনির পট আলাদা করে এনে রুমনির চেয়ারের সামনের টি-পয়ে রাখলেন।

আপনি তো খুব সংসারী।

তাই? যার সংসার নেই সে-ই হয়তো সংসারী হয়। এটাকে ট্র্যাজেডিও বলতে পারেন, কমেডিও।

রুমনি বলল, আপনার ক-চামচ চিনি?

চার চামচ।

চার চামচ? অবাক হয়ে তাকাল রুমনি ভদ্রলোকের মুখে। আশ্চর্য! আজকাল প্রায় কেউ চিনি খান না।

হ্যাঁ। আজকালকার ফ্যাশন। আমি খাই। আমার জীবনে মিষ্টত্ব বলতে তো শুধুমাত্র এই চিনিই।

আপনি কিন্তু খুব সুগৃহিণী। আপনার মতো গোছানো কোনো পুরুষমানুষ আমি আগে দেখিনি।

কী করব! বহুদিন যে বিদেশে ছিলাম। সেখানে সব কাজই তো নিজেকেই করতে হত। অনেকদিন নানা দেশে থেকে শিখেছি যে, ওদের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হল স্বাবলম্বনের শিক্ষা এবং অন্যের প্রাইভেসিকে সম্মান করার শিক্ষা। অথচ আমাদের মধ্যে যাঁরা পশ্চিমি দেশে থাকি ফিরে এসে এই দুই শিক্ষাকে পুরোপুরি ভুলে যাই।

বা:। খুব সুন্দর চা তো। কী চা এটা?

অরেঞ্জ পিকো। দার্জিলিং থেকে আমার এক ছাত্রী প্রতি দু-মাস অন্তর পাঠায় যেখানেই থাকি না কেন। দু-তিন প্যাকেট জমে গেছে আপনি নেবেন একপ্যাকেট?

ভয়ার্ত গলায় রুমনি বলল, না না, আমার স্বামীকে কী বলব? আপনার ঘরে এতক্ষণ ছিলাম, চা খেয়েছিলাম জানলেই তো কুরুক্ষেত্র হবে। তার ওপর যদি চা নিয়ে যাই……

তাই? আপনার নামটা তো বললেন না।

আমার নাম রুমনি।

ভালোনাম?

ভালো খারাপ দুই-ই।

আপনার নাম দিলাম পাখি।

আর আপনার নাম?

আমার নাম বীরু মজুমদার। কারোকেই আমার নামটা বলার দরকার নেই। এ-বাড়ির যাঁরা আমাকে চেনেন, মায় আপনার পটলা পর্যন্ত, আমাকে বুড়োবাবু বলেই জানে।

বুড়োবাবু মানে? আপনি কি বুড়ো?

বুড়ো নই? বয়েস প্রায় ষাটের কাছাকাছি হল। মনে না হলেও শরীরে বুড়োই।

তাই মনে হয়?

রুমনি কিছু বলার আগেই দড়াম করে খোলা জানালার একটা পাল্লা পড়ল উতল হাওয়ায়। রুমনি চিন্তার গলাতে বলল, দেখলেন ঝড় উঠল। আমার এবারে যেতেই হবে কাপড়গুলো তুলতে।

আমিও যাব আপনার সঙ্গে সাহায্য করতে। চা-টা আর অন্তত দুটো বিস্কিট খেয়ে নিন। আর দেখা হয় কি না হয়! না খেলে,আমার খারাপ লাগবে।

দেখা হবে না কেন? আপনি কি চলে যাবেন এখান থেকে?

থাকা না-থাকা কি আমার নিজের হাতে? আমি আপনার ওই পাখিরই মতো। উড়ে গেলেই হল ফুড়ুৎ করে। তার পর কার খাঁচায় থাকতে হবে কে জানে! আপনার কখনো উড়তে ইচ্ছে করে না?

উড়ব কী করে? আমার দু-পায়েই যে শিকল।

তার পর বলল, আপনি মানুষটা ভীষণ রহস্যে ঘেরা।

রহস্যহীন জীবন কি জীবন? তবে দুর্ভেদ্য রহস্য নেই কিছু। তেমন করে কেউ চাইলে রহস্য উদঘাটিত হতেই পারে। বলেই, বুড়োবাবু উঠে জানালাগুলো বন্ধ করে দিলেন।

বললেন, ভয় কি আর একটা? ঝড় ঘরে ঢুকে পড়ার ভয়, ঘরের বাইরে পাখি উড়ে যাওয়ার ভয়। কী বলেন?

রুমনি ভাবল, দরজা-জানালা বন্ধঘরে আরও কত ভয়। কতরকম ভয়।

ও উঠে পড়ে বলল, ধন্যবাদ।

কেন? ধন্যবাদের কী করলাম?

বা:, আমার পাখিকে ধরে দিলেন, লপচু চা আর বিস্কিট খাওয়ালেন।

এবারে যাই। চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে রুমনি উঠে দাঁড়াল।

চলুন। ভদ্রলোক বললেন।

বলেই, রুমনির সঙ্গে উনিও উঠে তেতলার সিঁড়ি ধরে ছাদে গিয়ে পৌঁছোলেন। ওরা উঠতে উঠতে ঝড় উঠে গেছে পুরোপুরি। ছাদের লম্বা তারের সঙ্গে ক্লিপ দিয়ে আটকানো জামা-কাপড়গুলো উথালিপাথালি করছে। দু-জনে তাড়াতাড়িতে দু-হাত দিয়ে জামাকাপড়গুলোখুলতে যেতেই শুকোতে দেওয়া রুমনির ম্যাক্সিতে জড়িয়ে গেল দুজনেই। জড়িয়ে যেতেই বুড়োবাবু রুমনিকে জড়িয়ে ধরে প্রথমে ওর দু-চোখে, তার পর কপালে, তারও পরে ঠোঁটে এবং স্তনসন্ধিতে চুমু খেলেন। সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনার অভিঘাতে বিবশ হয়ে গেল রুমনি। তার দু-হাঁটুর সব জোর অন্তর্হিত হল। দু-হাত দিয়ে ও বীরু মজুমদারকে এমন নির্ভরতাতে জড়িয়ে ধরল যে, অত জোরে গগনেন্দ্রকেও সে জড়িয়ে ধরেনি কোনোদিন। প্রথম বার কনসিভ করার পরে যখন ওর অ্যাবর্শন হয়েছিল পাঁচ মাসের মাথায়, তখনও নয়।

তার পর দুজনে দুজনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি জামাকাপড়গুলি তুলে নিয়ে যখন নীচে নামল ছাদ থেকে তখন বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টিও পড়তে আরম্ভ করেছে।

সিঁড়ি দিয়ে জামাকাপড়ে আবৃত হয়ে নামতে নামতে বীরু মজুমদার অস্ফুটে বললেন, রাহুল গান্ধির প্রথম মিটিংটা জলেই গেল।

ওঁর ঘরের সামনে এসে ভদ্রলোক বললেন, আগে কি জামাকাপড়গুলো নিয়ে যাবে, না পাখিটা? এতগুলো জামাকাপড় একা নেবেই বা কী করে? একটু থেমে বললেন, তোমাকে তুমিই বলছি। প্রথমত, বয়েসে তুমি অনেকই ছোটো। তা ছাড়া যাকে চুমু খাওয়া যায়, সেই জোরেই তাকে তুমি বলাই যায়। রুমনি তখনও একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। জবাবে কিছুই বলল না। তার জীবনে আজকের দিনটি একটি বিশেষ দিন, দিন বিশেষ। কথা ঘুরিয়ে রুমনি বলল, একাই তো মেলতে গিয়েছিলাম। একাই কেচেছি।

না:। তুমি স্বছন্দে বিদেশে থাকতে পারতে। স্বয়ম্ভরতার বক্তৃতা তোমাকে দেওয়া আমার ঠিক হয়নি।

বলেই বলল, আমি যাই তোমার সঙ্গে। জামাকাপড়গুলো শুকিয়ে যে ফুলে গেছে।

ভয়ার্ত গলাতে রুমনি বলল, না, না,আপনি আসবেন না। কেউ দেখে ফেললে! উলটো দিকের ফ্ল্যাটের মিসেস ব্যানার্জি আছেন—সাংঘাতিক মহিলা। আমার স্বামী ফেরামাত্র রিপোর্ট করবেন।

তাহলে তুমি এগুলো নিয়ে যাও। একটু পরে আমিই তোমার পাখিকে নিয়ে যাব। পাখি আমার ফ্ল্যাটে উড়ে এসেছিল আমি তো তাকে তোমার জিম্মাতে দিতে যেতেই পারি। পাখি তোমার নীড়ের পাখি।

দরজার চাবি খুলতে খুলতে বীরু মজুমদার বললেন, একবার ভেতরে আসতে হবে রুমনি। তোমাকে বড়ো করে একবার ছোটো আদর করব। আর আমি যদি এখানে থাকি এবং এমন হঠাৎ করে কোনো সুযোগ ঘটে যায় তাহলে তোমাকে একদিন বড়ো আদরও করব। যার স্মৃতি আমার বাকি জীবনের সর্বক্ষণের সঙ্গী হবে।

রুমনি উত্তর না দিয়ে বুড়োবাবুর ঘরের মধ্যে দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে ঢুকে গেল।

উত্তেজনা এবং ভালো লাগায় বিবশ রুমনি পাঁচ মিনিট পরে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে একটি ‘রুহ খসস’ আতরের ছোটো শিশি দিলেন ভদ্রলোক। বললেন, তোমার স্বামী তোমাকে আদর করার আগে তোমার স্তনসন্ধিতে মেখো, আমার কথা মনে পড়বে। সুগন্ধি চা নিয়ে গেলে উনি হয়তো বুঝতে পারতেন। রুহ খসস-এর গন্ধ উনি বুঝতে পারবেন না। সব পুরুষে সব সুগন্ধর খোঁজ রাখেন না।

রুমনি বাইরের দরজার লক খুলে একডাঁই কাপড়জামা নিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই বীরু মজুমদার রুমনির পাখিকে একটি পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিয়ে এলেন। রুমনি পাখিকে খাঁচাতে ভরে দিতেই পাখি বলল, সব দেখেছি, হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব।

বীরু মজুমদার হেসে উঠলেন। বললেন, ভাঙগে যা।

তার পর যাওয়ার আগে রুমনির গ্রীবাতে একটি চুমু খেয়ে বললেন, ভালো থেকো, সুখে থেকো। মেয়েদের গ্রীবাও যে চুমু খাওয়ার একটি জায়গা একথা বিবাহিতজীবনের এতগুলো বছরেও কখনো জানেনি রুমনি।



এখন রাত হয়েছে প্রায় এগারোটা। গগনেন্দ্র এবং ছেলেরা শুয়ে পড়েছে। কাল সকালে ওঠা নেই। ছেলেদের স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি গরমের জন্যে একসপ্তাহ বাড়িয়ে দিয়েছে সরকার। গগনেন্দ্র এমনিতেই সাড়ে এগারোটা নাগাদ বেরোয় ধীরেসুস্থে—ওর বছরে দু-একদিনই তাড়া থাকে। আজ রাতে বিছানাতেও ডিউটি নেই রুমনির। পটলা থাকলে খুব নীচু ভলিউমে বাংলা সিরিয়াল দেখে বারোটা সাড়ে-বারোটা অবধি। মাঝে মাঝে রুমনিকেও ডেকে নেয় ভালো সিরিয়াল থাকলে। আজ সেও নেই। ছেলেদের ঘরে এবং তাদের শোয়ার ঘরে ঘুম নেমেছে এখন। জানলার পাশে চেয়ার পেতে বসে আছে রুমনি। আজ সারাটাদিন ঘোরের মধ্যে কেটেছে। রাতেও ঘোর কাটেনি। ওর চেয়ারে বসে বীরু মজুমদারের জানলা-খোলা ফ্ল্যাটের দিকে চেয়েছিল রুমনি। ঝড়বৃষ্টি হওয়াতে আবহাওয়া ঠাণ্ডা হয়েছে একটু। একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। নীচের মাঠটার এককোনাতে একটি কাঁঠালি চাঁপা গাছে অজস্র ফুল ফুটেছে। রাতের বেলা ফুলের গন্ধ যেন জোর হয়। বীরু মজুমদার টেবিল-এর সামনে বসে টেবিললাইট জ্বেলে কী যেন লিখছে। বড়োরাস্তা দিয়ে ট্রাম এবং বাস যাওয়ার আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ওদের ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে দিয়েই যাচ্ছে। দু-তিনটি নেড়িকুকুর একটা বেড়াল দেখে ‘ভুক ভুক’ করে তাকে তাড়া করল। বীরু মজুমদার কি দেখতে পাচ্ছে যে, রুমনি জানলার পাশে বসে তার ঘরের দিকে চেয়ে আছে? আজ বিকেলে গা ধুয়ে উঠে স্তনসন্ধিতে একটু ‘রুহ খসস’ লাগিয়েছিল রুমনি। গন্ধটা খুব গাঢ় কিন্তু তীব্র নয়। নবাব আর বেগমেরা এসব ব্যবহার করেন। এই গন্ধ অচেনা রুমনির কাছে। ওর গ্রীবাতেও সামান্য একটু লাগিয়েছে, যেখানে বীরু মজুমদার ওকে চুমু খেয়েছিল।

এমন সময় নীচে দুটি পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল। একটি জিপ এবং একটি ভ্যান। ভ্যান থেকে জনা চারেক পুলিশ রাইফেল নিয়ে নামল। জিপ থেকে দুজন অফিসার নামলেন। তাঁদের কোমরে রিভলবার গোঁজা। দুজন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা ফ্ল্যাটে ঢুকে গেলেন। একটু পরে বীরু মজুমদারের ঘরের বড়ো আলোটা জ্বলে উঠল। একটি গেরুয়া-রঙা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে বীরু মজুমদার গিয়ে দরজা খুললেন। তার একটুক্ষণ পরে পুলিশ অফিসাররা তাঁকে নিয়ে ঘরের বাইরে এলেন। রুমনি জানলা দিয়ে মুখ বের করে গলা বাড়িয়ে নীচে তাকিয়ে রইল। ওর বুকটা ভয়ে কাঁপতে লাগল। একটু পরেই বীরু মজুমদারকে নিয়ে তাঁরা ভ্যানটার পেছনে গেলেন। ওঁকে উঠতে বললেন বোধ হয়। একটু পরেই বীরু মজুমদার ওপরে রুমনির জানলার দিকে তাকালেন। রুমনি তো তাকিয়েই ছিল। তার পরই বীরু মজুমদারকে নিয়ে ভ্যানের মধ্যে ঢুকিয়ে ভ্যানের দরজা বন্ধ করে দিল পুলিশেরা। যে দুজন পুলিশ নেমেছিল তারাও উঠল। অফিসারেরা জিপে গিয়ে উঠলেন। বাড়ির লিফটম্যানও বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। তার ডিউটি রাত বারোটা অবধি। বারোটোর থেকে সকাল ছ-টা অবধি লিফট অটোম্যাটিক থাকে। পটলাটা থাকলে কাল সকালে লিফটম্যানের কাছ থেকে বিস্তারিত খবর পাওয়া যেত।

পাগলা কোকিলটা কৃষ্ণচূড়ার ডাল থেকে ‘কুহু কুহু’ ডেকে উঠল। মানুষটা রুমনিকে পাখি বলে ডেকেছিল। কিন্তু রুমনি-পাখি তো ডাকতে জানে না। শুধু কাঁদতে জানে। রুমনির বুক চোখের জলে ভিজে গেল। সেই জলের জন্যে ‘রুহ খসস’ আতরের গন্ধটা আরও তীব্র হল যেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *