পাখি

পাখি

ভারত মহাসাগর দিয়ে কার্গো শিপটা তরতর করে জল কেটে এগিয়ে চলেছে। ছোটো মালবাহী জাহাজ, জনাদশেক যাত্রী নেবার ব্যবস্থা আছে। অন্য কোনো জাহাজে স্থান না পেয়ে অগত্যা এরই একটা কেবিন ভাড়া করেছিলাম।

অস্ট্রেলিয়ান জাহাজ, ফ্রি ম্যান্টল থেকে গম বোঝাই করে যাত্রা শুরু করেছে, জাকার্তা, সিঙ্গাপুর, পেনাং, রেঙ্গুন হয়ে কলকাতায় যাত্রা শেষ হবে। জাহাজের ক্যাপ্টেন একজন আইরিশ। দীর্ঘ, বলিষ্ঠ চেহারা, চোখে-মুখে একটা আত্মপ্রত্যয়ের ভাব। যাত্রীদের মধ্যে এক আমিই ভারতীয় আর সব নানান দেশের। জাহাজ ছাড়ার তৃতীয় দিনে আমি ডেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমার আশেপাশে অন্যান্য যাত্রীরাও আছেন। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, সমুদ্রের বুক থেকে এই দৃশ্য যে কী অপূর্ব তা যিনি দেখেছেন তিনিই জানেন। আমি তন্ময় হয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, হঠাৎ এক ঝাঁক পাখি কোথা থেকে উড়ে এল; খুব নীচু দিয়ে জাহাজের সঙ্গে সমান তালে কিছুক্ষণ পাল্লা দিয়ে চলার পর আবার তারা অসীম শূন্যে মিলিয়ে গেল।

পাখিগুলি আমাদের এত কাছ দিয়ে উড়ছিল যে ওদের শরীরের প্রত্যেকটি অংশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বেশ বড়ো পাখি, আকারে বাজপাখির চাইতে বড়োই হবে, কুচকুচে কালো শরীর কিন্তু বুকের কাছটা ধবধবে সাদা। পাখিগুলি ডানা সম্পূর্ণ ছড়িয়ে দিয়েছে, বিরাট ডানা আর বিঘতখানেক লম্বা টকটকে লাল ঠোঁট, টিয়াপাখির মতো বাঁকানো। ওড়বার সময় পাখিগুলি আমাদের দিকে তাকাচ্ছিল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম বড়ো বড়ো কালো চোখে ঠিক যেন মানুষের মতো দৃষ্টি। পাখিগুলি অদৃশ্য হবার সঙ্গেসঙ্গে ডেকের মধ্যে একটা মৃদু গুঞ্জন উঠল। আমি আশ্চর্য হলাম, ক্রিশ্চানরা যেমনভাবে ‘ক্রস’ করে, প্রায় সকলেই তাই করছে।

আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন একজন বার্মিজ ভদ্রলোক। ভদ্রলোকের সঙ্গে এই ক-দিনেই আমার আলাপ জমে উঠেছিল। প্রোম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনি একজন অধ্যাপক, জীবতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেন আর সেইসূত্রেই অ্যাডিলেডে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে ফিরছেন। আমিও একজন অধ্যাপক অবশ্য জীবতত্ত্বের নয়, পদার্থবিদ্যার, তা জেনেও তিনি যেচে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। আমি তাঁকে সকলের এই অদ্ভুত আচরণের কারণ জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তিনি আমাকে এক বিস্ময়কর কাহিনি শোনালেন। এই পাখিগুলি নাকি ‘মৃত্যুদূত’; জাহাজে কারো মৃত্যু ঘনিয়ে এলেই এই পাখিগুলির দেখা মেলে। নাবিকদের দৃঢ় বিশ্বাস সমুদ্রের বুকে মৃত নাবিক বা যাত্রীর আত্মা এদের দেহে প্রবেশ করে, আবার মৃত আত্মার বাহক এই পাখিগুলি নাকি ইচ্ছেমতো কোনো জীবিত ব্যক্তির আত্মার মধ্যেও প্রবেশ করতে পারে।

আমি ভদ্রলোকের কথা শুনে সশব্দে হেসে উঠলাম, বিংশ শতাব্দীতে এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক ও উদ্ভট কল্পনা আমার কাছে হাস্যকর মনে হল। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম তার কয়েক হাত দূরেই আর একজন যাত্রী দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভদ্রলোক ঢ্যাঙা, সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে হাঁটেন আর গায়ের রং যাকে ইংরেজিতে বলে ডার্ক কমপ্লেকশন অনেকটা তাই, খুব সম্ভব ইউরেশিয়ান। ভদ্রলোক জাহাজে ওঠার পর থেকে সেই যে কেবিনে আশ্রয় নিয়েছেন আর কারুর সঙ্গে বড়ো একটা মেলামেশা করেন না, খাবার সময় ডাইনিং হলে এক কোনায় বসেন, অন্য লোকের সঙ্গ যেন পছন্দ করেন না। তিনিও যেমন সকলকে এড়িয়ে চলেন অন্যরাও তেমন তাঁকে পরিহার করে চলাটাই পছন্দ করেন। ভদ্রলোকের মুখটা ফ্যাকাশে, ঠিক যেন মৃতের মুখ কিন্তু চোখ দুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল। দু-চোখের নিবিড় কালো তারার শানিত দৃষ্টি যেন ছুরির ফলার মতো এসে বেঁধে। এককথায় তাঁর চেহারায় কেমন যেন একটা অপার্থিব ছায়া। ভদ্রলোক স্থির দৃষ্টিতে যেদিকে পাখিগুলি মিলিয়ে গেছে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি জোরে হেসে ওঠায় তিনি বোধ হয় বিরক্ত হলেন, ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকালেন। আমি ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করে মুখটা ফিরিয়ে নিলাম।

সেইদিন রাত্রে খাবার টেবিলে আমি আর সেই বার্মিজ অধ্যাপক মুখোমুখি বসেছি। প্রসঙ্গক্রমে সেই পাখির কথাও উঠল। আমি বেশ জোর দিয়েই বললাম যে ওই পাখির সম্বন্ধে প্রচলিত কিংবদন্তি স্রেফ কুসংস্কার ছাড়া আর কিছু নয়। অধ্যাপক মৃদু হেসে বললেন, সব কিছু প্রবাদের পেছনেই কিছু-না-কিছু ভিত্তি আছে, যুক্তি তর্ক দিয়ে সবসময় হয়তো তাদের ব্যাখ্যা চলে না। তিনি কথাটা শেষ করবার সঙ্গেসঙ্গেই একটা শোরগোলে আমরা সচকিত হয়ে উঠলাম। একজন বাইরে থেকে ছুটে এসে খবর দিল একজন খালাসি কেমন করে জানি রেলিং টপকে জলে পড়ে গেছে। আমি চমকে অধ্যাপকের মুখের দিকে তাকালাম। তাঁকেও বেশ বিচলিত মনে হল। সেই হতভাগ্য খালাসির সন্ধান আর পাওয়া গেল না।

এই ঘটনার পর দু-দিন কেটে গেছে। আমি রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর নিজের কেবিনে শুয়ে ছিলাম। ঘুম আসছিল না, অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করার পর আমি উঠে জাহাজের ডেকে গেলাম। ডেকে তখন কেউ নেই, নির্জন রাত, আমি অন্ধকারে এক কোনায় একটা চেয়ার টেনে বসলাম।

আকাশে এক ফালি চাঁদ ডেকের ওফর যেন আলো-ছায়ার মায়াজাল সৃষ্টি করেছে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সমুদ্রের হাওয়ায় চোখ দুটো বুজে আসছিল। হঠাৎ কারো মৃদু পদশব্দে আমার তন্দ্রা ছুটে গেল। রেলিঙের একেবারে ধার ঘেঁষে একটা ছায়ামূর্তি। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম মূর্তিটি সেই বিচিত্র স্বভাবের যাত্রীরর। ভদ্রলোকের সর্বাঙ্গে কালো পোশাক কিন্তু যা আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল তা হচ্ছে কালো ওভারকোটের বুকের কাছটা আলগা সাদা কাপড় দিয়ে এমনভাবে সেলাই করা যে মনে হচ্ছে ঠিক যেন কালোর ওপর সাদা গোলাকার একটা নকশা। অদ্ভুত পোশাক। ঠিক এই সময় চাঁদ মেঘে ঢেকে যাওয়ায় সমস্ত অন্ধকার হয়ে গেল। মেঘ সরে যাওয়ার পর চাঁদের আলোয় আমি স্পষ্ট দেখলাম একটা বিরাট কালো পাখি পাখা ঝটপট করতে করতে জাহাজের পাশ দিয়ে উড়ে গেল। সেই ভদ্রলোককে কিন্তু জাহাজের ডেকে দেখলাম না। তবে কি তিনি আমার অলক্ষে নিজের কেবিনে চলে গেছেন, না সমস্ত ব্যাপারটাই আমার দৃষ্টিভ্রম। আমি নিজেকে একটা চিমটি কেটে দেখলাম যে জেগে আছি না স্বপ্ন দেখছি। একটা দারুণ উত্তেজনায় আমার সর্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত হল। আমি পা টিপে টিপে ভদ্রলোকের কেবিনের দিকে গেলাম। মৃদু চাপ দিতেই দরজাটা খুলে গেল। কেবিনের মধ্যে মৃদু নীল আলো জ্বলছে, সেই আলোয় আমি দেখলাম বিছানাটা পরিপাটি করে বিছানো কিন্তু শূন্য কেবিন। আমি দরজাটা টেনে দিয়ে ডাইনিং হলের দিকে গেলাম দৈবাৎ যদি ভদ্রলোক পানীয়ের সন্ধানে সেখানে গিয়ে থাকেন। কিন্তু না, সেখানেও তিনি নেই। আমি আবার ডেকে ফিরে এলাম। তন্নতন্ন করে খুঁজেও ভদ্রলোকের কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না। একটা অশুভ সম্ভাবনায় আমি শিউরে উঠলাম। এই ঘটনা আমি ঘুণাক্ষরেও কারুর কাছে প্রকাশ করলাম না, এমনকী আমার বার্মিজ বন্ধুর কাছেও না। একটা অদৃশ্য শক্তি যেন আমাকে সাবধান করে দিল।

আরও কয়েক দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে আর একটা কাণ্ড ঘটে গেল। প্রথম থেকেই আমি লক্ষ করেছি জাহাজের ক্যাপ্টেন সেই বিচিত্র যাত্রীটিকে কেন জানি সহ্য করতে পারতেন না। তাকে দেখলেই ক্যাপ্টেনের চোখে-মুখে একটা বিজাতীয় ঘৃণার ভাব ফুটে উঠত। একদিন রাত্রে আমরা ডাইনিং হলে বসে নৈশভোজন সারছি, হঠাৎ সেই যাত্রীটি কী কারণে উত্তেজিত হয়ে একজন খানসামাকে গালাগালি দিয়ে তাঁর ট্রে থেকে খাবার ভরতি একটা কাচের পাত্র ছুড়ে ফেলে দিলেন। ঝনঝন শব্দে পাত্রটা ভেঙে গেল, খাবার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ক্যাপ্টেনও আমাদের সঙ্গে সেদিন খাচ্ছিলেন। দেখলাম তাঁর লাল মুখটা আরও লাল হয়ে উঠল। তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে সেই ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন, তারপর বাঁ-হাত দিয়ে তাঁর জামার কলার চেপে ধরে এক টানে তাঁকে দাঁড় করিয়ে ডান হাতে সজোরে তাঁর চোয়ালে এক ঘুসি মারলেন। ভদ্রলোক মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। ক্যাপ্টেন আবার তাঁর চেয়ারে ফিরে এসে যেন কিছু হয়নি এইভাবে খেতে লাগলেন। সেই ভদ্রলোক উঠে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেনের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন, ভয়ানক সেই দৃষ্টি, তারপর বড়ো বড়ো পা ফেলে ডাইনিং হল ছেড়ে চলে গেলেন।

ঠিক পরের দিন সন্ধেবেলা একটা অভাবনীয় ঘটনা ঘটল। আকাশে মেঘ করেছে, ঝড়ের পূর্বাভাস। আমরা ডেকে না বসে ডাইনিং হলে জমায়েত হয়েছি, গল্পগুজব চলছে এমন সময় একটা আর্তনাদে আমরা চমকে উঠলাম। মনে হল কেউ যেন আকুলকণ্ঠে সাহায্য প্রার্থনা করছে। আমরা সবাই প্রায় একসঙ্গে ডেকের দিকে ছুটলাম। ডেকে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার রক্ত যেন হিম হয়ে গেল। রেলিঙের ধারে জাহাজের ক্যাপ্টেন দাঁড়িয়ে আছেন, ডান হাত দিয়ে মুখটা আড়াল করে বাঁ-হাত দিয়ে তিনি নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন আর রেলিঙের ওপর বসা একটা বিরাট কালো পাখি দুই ডানা দিয়ে তাঁকে যেন আঁকড়ে ধরে তীক্ষ্ন চঞ্চু দিয়ে ঠোকর মারছে। আমাদের উপস্থিতিতে বাধা পেয়ে পাখিটা ক্যাপ্টেনকে ছেড়ে শূন্যে উড়ল আর সেই মুহূর্তে জাহাজের সেকেন্ড অফিসার তাঁর রিভলভারটা পাখির দিকে তাক করে গুলি ছুড়লেন। গুলিটা পাখির বাম ডানায় গিয়ে বিঁধল, সামান্য ছটফট করে পাখিটা অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। ক্যাপ্টেনকে রক্তাপ্লুত অবস্থায় তাড়াতাড়ি চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হল। ভাগ্য ভালো, ডান হাত দিয়ে তিনি মুখটা কিছুটা আড়াল করতে পেরেছিলেন তাই চোখ দুটো বেঁচে গেছে নয়তো হিংস্র পাখিটা ধারালো ঠোঁট দিয়ে তাঁর চোখ দুটোই উপড়ে ফেলত। এত হট্টগোলের মধ্যেও আমি কিন্তু সেই বিচিত্র যাত্রীটিকে ধারেকাছে কোথাও দেখলাম না। আমার মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করতে লাগল।

রাত্তিরে খাবার সময় সেই ভদ্রলোকের আবার দেখা পেলাম। কালো রং কোটের দুই পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে তিনি স্বভাবমতো কোনোদিকে দৃকপাত না করে তাঁর প্রতিদিনকার নির্দিষ্ট আসনটি দখল করে বসলেন। একপ্রস্থ খাওয়া শেষ হলে ভদ্রলোক কী কারণে যেন পকেট থেকে বাঁ-হাতটা বার করলেন আর সঙ্গেসঙ্গে আমি ভীষণ চমকে উঠলাম, ভদ্রলোকের বাঁ-হাতে ব্যান্ডেজ।

পরদিন সকালে জাহাজ সিঙ্গাপুরে নোঙর করল, ভদ্রলোক নেমে গেলেন। তাঁর সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *