চতুর্থ খণ্ড (স্নেহের দীপঙ্কর আচার্য এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়)
পঞ্চম খণ্ড (বন্ধুবর স্নেহপ্রতিম শ্রী নিতীশ রায় ও বউদিকে)
4 of 6

পাখি সব করে রব

পাখি সব করে রব

পরেশবাবুর ছোট্টমতো একটা বাগান আছে, অনেকটা রুমালি রুটির মতো। বিলিতি বইয়ে পড়েছিলেন সায়েবরা রিটায়ার করার পর খুরপি নিয়ে সকালে বাগান করেন। মাটি চটকাচটকি, পাতা ছেঁড়াছিঁড়ি, গাছের সঙ্গে মনের কথা। মন তরতাজা থাকে, মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা, মানুষের দুর্ব্যবহার গায়ে লাগে না। একটা প্রেম আসে মনের ফ্রেমে, তখন মহাপ্রভুর মতো আচণ্ডালে প্রেম দিতে ইচ্ছে করে, জগাই-মাধাইদের বলতে ইচ্ছে করে, মেরেছিস কলসির কানা, তা বলে কী প্রেম দোব না। দেহও ভালো থাকে। সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকে, গাঁটে গাঁটে গেঁটে বাত বাসা বাঁধার সুযোগ পায় না। খোলটা লঝঝড়ে হয়ে এলেও, বিলিতি গাড়ির মতো ভেতরের ইঞ্জিনটা গড়গড়ে থাকে। সেলফ মারা মাত্রই স্টার্ট। শুধু বাগানে হবে না, এর সঙ্গে ওয়াকিং চাই, আর লাইট লিটারেচার। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, এখন আর নতুন জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। এখন শুধু জীবন-সঙ্গীতের সঙ্গে, দাদরা বা কাহারবায় ঠেকা দিয়ে যাওয়া। সম, ফাঁক, ফাঁক সম।

সেই কারণেই কোর্ট ইয়ার্ডে পড়ে থাকা। যৌবনের সঙ্গে কোর্টশিপ শেষ। এখন ইয়ার্ডে ন্যুব্জ শরীর নিয়ে গাছের তলায় তলায় হামাগুড়ি দেওয়া। পাতা আসে, পাতা ঝরে। কখনওসখনও প্রেমিকার মতো গাছ দু-একটা ফুল উপহার দেয়। ফুল বুড়ো হয় না। যৌবন এবং মৃত্যু। মানুষ এক অখাদ্য জন্তু। শৈশব থেকে বার্ধক্য লম্বা একটা পথ। টিকিয়ে রাখাটা মহাসংগ্রাম। এক আনা আনন্দ পনেরো আনা নিরানন্দ। বাঁশের মাচায় বসে থাকা। তলায় সাপ-খোপ, বাঘ-ভাল্লুক, এদিকে ঘুণপোকার কটাস-কটাস। এই বুঝি মচকাল, এই বুঝি মচকাল। দর্শন থেকেই দর্শন আসে। ফিলজফি না পড়লেও চলে।

সব মরে হেজে গিয়ে সংসারটা এখন বেশ মাপে এসেছে, এক জোড়া জুতোর মতো। পুত্র, পুত্রবধূ, নিজে একটি পাপোশ, আর ডলপুতুলের মতো মজাদার একটি নাতনি। বছর চারেক বয়েস। কথার খই ফুটছে। অনন্ত কৌতূহল, অজস্র প্রশ্ন। পরেশচন্দ্রের সদাসঙ্গি।

এই যেমন এখন। পরেশচন্দ্র একটি চারাগাছের পরিচর্যা করছেন। শীতে কমলারঙের ফুলে সাজবে। গোড়ায় লাল পিঁপড়ের বাসা হয়েছে। নাতনি পাশে ঘুরঘুর করছে প্রজাপতির মতো। পরেশচন্দ্র নিজের মনেই বললেন, ‘ব্যাটারা আর জায়গা পেলে না!’

নাতনির নাম আপাতত পূজা। পরে পালটাতে পারে। দু-অক্ষরের সহজ নাম, এ কালে অচল। আনকমান নাম চাই। একটা কমিটি হয়েছে। সদস্য, সদস্যরা অনুসন্ধান করছেন। দু-একটা এসেওছে। আন্ডার কনসিডারেশান। ইতিমধ্যে যেসব নাম এসেছে, শুনলে পিলে চমকে যাবে, যেমন, হবির্ভূ, দেববর্ণিনী, সুমালী, কৈকসী, কুম্ভীনসী। এইসব নাম যদি ঘাড়ে চাপে, খুকি বলেই ডাকতে হবে।

পূজা জিগ্যেস করলে, ‘কাদের ব্যাটা বলছ?’

‘পিপঁড়েদের।’

‘ব্যাটা তো ছেলেদের বলে। ব্যাটারা কী পিঁপড়ে?’

‘কিছুটা।’

‘আমার বাবাও তোমার পিঁপড়ে?’

‘বলা যেতে পারে।’

‘তোমার বাবার তুমি পিঁপড়ে?’

‘অবশ্যই।’

পূজা কিছুক্ষণ ভেবে বললে, ‘মেয়ে পিঁপড়েদের কী বলে?’

পরেশচন্দ্র একটু চিন্তায় পড়লেন। শেষে বললেন, ‘পিঁপড়ে দিয়ে মেয়েতে যাওয়া যাবে না। সংস্কৃত ভাষাতে পিঁপড়েকে বলে পিপীলিকা। মেয়ে পিঁপড়েদের ভালো নাম, পিপীলিকা। ছেলে পিঁপড়েদের নাম পিপীলক।’

‘তার মানে, বাবা পিপীলক, না পিপীলিকা?’

পরেশচন্দ্র সংযত হলেন। ব্যাপারটা বেয়াড়া দিকে যাচ্ছে। গীতায় শ্রীভগবান বলছেন, যোগ: কর্মসু কৌশলম। কর্মে কৌশলই যোগ। আর সংসার গীতায় গৃহী পরেশচন্দ্র বলছেন, বাক্যং সংসারেসু কৌশলম। মিষ্টি কথা, তোয়াজের কথায় সংসার-শান্তি কিছুটা বজায় থাকে। পরিমাণ মতো তৈল প্রয়োগে, নাট, বল্টু, পিনিয়ন, হুইল সুস্থ থাকে, জং ধরে জ্যাম মেরে যায় না। তৈল একপ্রকার স্নেহজাতীয় পদার্থ, বাঙালির শরীরে তেলে আর জলে, তুমি আমাকে স্নেহ করো, আমি তোমাকে স্নেহ করি। এই কায়দায় নিজের দাম্পত্য জীবনটি বেশ সুখের হয়েছিল, যেন পালকি চেপে চলেছেন, দু:খ, সুখ, জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি, মিলন বিচ্ছেদের উপত্যকায় সময়ের শুঁড়ি পথ বেয়ে, রৌদ্র ছায়ার বৈপ্যরীত্যে। চোখ জল ফেলেছে, ঠোঁট হেসেছে, বুক খালি হয়েছে, বুক ভরেছে। জীবন বাণিজ্যের খাতায় লাভ, লোকসান সমান হয়েছে। এদিক-ওদিক সমান হয়েছে। গেম ড্র। নিজেকেই নিজে বলেন, ভালোই ব্যাট করেছিস বুড়ো। নো ফাটকা। ক্ষত হয়েছে, ক্ষত শুকিয়েছে, একটা ক্ষতই দগদগে হয়ে রয়েছে, শুকোতে চাইছে না কিছুতেই, সেটি হল জীবনসঙ্গিনীর গুডবাই করে সরে পড়া। শীতের রাতে গা থেকে লেপটি সরিয়ে নিয়েছেন মহাকাল। বসন্ত আর আসবে না বিপিনের। বিপিনবিহারী একা বাজাবেন বাঁশি হিন্দোলে।

পিপীলিকার লিঙ্গ নির্ণয় বন্ধ করে পরেশচন্দ্র নাতনির আকর্ষণ প্রজাপতির দিকে ফেরালেন। শোঁয়াপোকা কোন কায়দায় সুন্দর প্রজাপতি হতে পারে। বিচিত্র সেই উপাখ্যান সবে শুরু করেছেন পুত্রবধূর চা হস্তে আগমন। সম্পর্কটা প্রায় সমবয়সি বন্ধুর মতো। রুক্ষ একটা শ্বশুর ভেতর থেকে কিছুতেই বেরোতে চাইল না।

পরেশচন্দ্র রোজ এক অধ্যায় করে চণ্ডীপাঠ করেন সরবে, স্বাস্থ্যের কারণে। ব্লাড সারকুলেশান চনমনে হয়, শরীরে একটা হিট হয়। চণ্ডীর শুরুতে সুন্দর একটা কথা আছে। রাজ্যপাট হারিয়ে রাজা সুরথ বিষণ্ণ মনে অরণ্যে ঘুরতে ঘুরতে মেধা মুনির আশ্রমে গিয়ে হাজির হয়েছেন। রাজ্যের শোক, ঐশ্বর্যের শোক, সব হারিয়েছেন; কিন্তু মনে সব বাসা বেঁধে আছে। ভুলতে পারছেন না। হঠাৎ সেই আশ্রমের কাছে এক বৈশ্যের সঙ্গে দেখা। শোকাকুল, দুর্মনা সেই বৈশ্যের সঙ্গে আলাপ করে রাজা জানলেন, স্ত্রী, পুত্র, পরিবারবর্গ তার ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করে দূর করে দিয়েছে। বৈশ্য বনে চলে এসেছেন, অথচ সেই বিশ্বাসঘাতক পরিবারবর্গের শুভাশুভ চিন্তায় কাতর। রাজা অবাক হয়ে বলছেন, যারা আপনার সব কেড়েকুড়ে নিয়ে, ক্যাঁত করে লাথি মেরে বনে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাদের প্রতি এখনও আপনার এত স্নেহ কেন! তখন সেই বৈশ্য রাজাকে একটি সুন্দর কথা বলেছিলেন, পরেশচন্দ্র সেটি মুখস্থ করে রেখেছেন,

 এবমেতদ যথা প্রাহ ভবানস্মদগতং বচ:।

 কিং করোমি ন বধ্নাতি মম নিষ্ঠুরতাং মন:।।

মহারাজ! আপনি আমাকে যা বলবেন, সবই উচিত কথা; কিন্তু আমি কি করি, আমার চিত্ত কিছুতেই নিষ্ঠুর হতে চাইছে না।

পরেশচন্দ্রের সেই একই অবস্থা, বন্ধু থেকে কিছুতেই শ্বশুর হতে পারছে না।

উজ্জ্বল, ঝলমলে, শিক্ষিতা পুত্রবধূটি এখনও সুগৃহিণী হয়ে উঠতে পারেনি, ভুলে যায়, এলোমেলো হয়ে যায়, একটা পাঞ্জাবি প্রয়োজনে চাইলে, গোটা আলমারিটা মেঝেতে নেমে আসে, আলমারি চ্যুত পোশাকাদি সেই ভাবেই উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে থাকে সারাদিন। শ্বশুর নয়, বন্ধু পরেশচন্দ্র তখন নিজেই বসে যান গোছাতে, এই ভেবে, আনকোরা একটা মেয়ে কত করবে! একাল সেকাল নয়। গোছাতে গিয়ে লাভও হয়, নিজের হারানো জিনিস খুঁজে পান।

ভ্রমসংশোধনের এই সুফলটি তিনি স্ত্রীর সঙ্গে সংসার করতে করতে শিখেছেন। ফ্রয়েড যেভাবে শিখেছিলেন। তুমি তোমার কর্ম করো, তোমার অপকর্ম সামলাবার দায়িত্ব আমার। স্ত্রী মনোরমার জীবনে পাঁচটা ভুল ছিল। বানান ভুলের মতো। হবেই হবে, তিন স, দুই ন-এর মতো। বলে বলেও শোধরানো যাবে না। এক হল, বাথরুমে মাথায় মাখা তেলের শিশির ক্যাপ আলগা বসিয়ে রাখা, প্যাঁচ মারার ধৈর্য ছিল না। দুই, বাথরুমের আলো নেবাতে ভুলে যাওয়া। তিন, জানলার পাল্লা খুলে ছিটকিনি না দেওয়া! চার, যত্রতত্র টাকা ফেলে রেখে তুলতে ভুলে যাওয়া। পাঁচ, চায়ের কৌটোর ঢাকনা বন্ধ না করা। এ ছাড়া আর একটা মারাত্মক ভুল ছিল। সেটা হল হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে হারিয়ে ফেলা। আঙুলে ছিল দামী একটা নীলার আংটি। শনিকে কবজা করার জন্যে জ্যোতিষী দিয়েছিলেন। সেই আংটিটা রোজই খুলে রেখে আসত সোপ কেসে। সাবানের সঙ্গে সহবাস। পরেশচন্দ্র লিস্টটা এইভাবে তৈরি করেছিলেন, ক্যাপ, আলো, পাল্লা, ঢাকনা, টাকা/ছুঁচ, বিল, আংটি, ছুরির ফলা। ছুঁচ ছিল এক মহাসমস্যার। আকারে ক্ষুদ্র, স্বভাবে ভয়ঙ্করী। জোড়া যেমন লাগায়, বিদ্ধও করে তেমনি। জীবনে একটি স্ত্রীর মতো একটি ছুঁচও আসে, গোলাপের সঙ্গে কাঁটার মতো। ফুলশয্যার রাতে জীবনসঙ্গিনীকে আগাপাশতলা চেনা হয়। আর সেই সঙ্গিনী যেদিন প্রথম সেলাইকর্মে বসেন, তার কিয়ৎক্ষণ পরেই চেনা হয়ে যায় তাঁর জীবনসঙ্গিনী ছুঁচটিকে। যাবতীয় জামার বোতামের শূন্যস্থান পূর্ণ করতে বসেছে মনোরমা। প্রথম প্রথম, স্ত্রীদের এই সব টুকিটাকি কর্মে প্রভূত উৎসাহ থাকে। পরে বড় বড় কাজে স্ত্রীরা হারিয়ে যান। সেই দিনই পরেশচন্দ্র সোফায় চিরকাল যেভাবে বসেন, সেই ভাবেই ধপাস করে বসলেন, বসেই উ: করে লাফিয়ে উঠলেন। নিতম্বে হুল ফুটেছে। হুল নয়, মনোরমার ছুঁচ। সেই দিনই শিক্ষাগ্রহণ করলেন, নারীর সংসারে বসবে, তবে ধপাস করে নয়। যেখানে বসতে চাও, সাবধানে হাত বুলিয়ে দেখে নিয়ে, ধীরেধীরে স্থাপন করো নিজেকে। ইলেকট্রিক বিলও নিজের তত্বাবধানে রাখার শিক্ষা পরেশচন্দ্র স্ত্রীর কাছেই পেয়েছেন। আলো জ্বালাবার অধিকার আমাদের, বিলের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সংসারের গৌরী সেনের। আর দুটি সাঙ্ঘাতিক বস্তু হল, ছুরি আর বঁটি। পায়ে বঁটি পড়ে গেছে, কি বঁটির ওপর পা পড়ে গেছে, এইরকম দুর্ঘটনা পরেশচন্দ্রকে সংসারজীবনে বহুবার সামলাতে হয়েছে। মেয়েরা ভয়ানক দু:সাহসী। কোনও কিছুর তোয়াক্কা করে না। গনগনে উনুন থেকে আঁচলে ধরে কেটলি নামাচ্ছে। জ্বলন্ত প্রদীপের ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে ঠাকুরকে ফুল দিচ্ছে। পুত্রবধূ জয়া আধুনিকা হলেও স্বভাবে মনেরমা।

জয়া চায়ের কাপটা সিমেন্ট বাঁধানো বেদির ওপর রাখতে রাখতে বললে, ‘আমার এখন দুটো বাচ্চা।’

সঙ্গে সঙ্গে পূজা বললে, ‘কেন মা, তোমার তো একটাই বাচ্চা, আমি!’

‘তোর দাদাইয়াও আমার বাচ্চা, এই নিয়ে দুবার চা করলুম, একবারও খাওয়ার সময় হচ্ছে না।’

পূজা কচিকচি হাত দুটো জোড় করে, মুখের অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করে বললে, ‘দাদাইয়া! প্লিজ ! চা খেয়ে নাও, এনার্জি পাবে।’

এই হল ইংলিশ মিডিয়ামের গুণ, চার বছরের বাচ্চা পটাপট ইংরিজি বলছে, চলনে বলনে কি স্মার্ট! বাড়িতে কেউ এলে অভ্যর্থনা করে বসাবে, সব খবর নেবে, গলগল করে গল্প করবে। জিগ্যেস করবে, জল, চা, কিছু খাবেন কি না! সব কথার শেষে একটা গো থাকবে। তুমি কোথায় থাকো গো! অতিথি একেবারে অভিভূত। মিষ্টি মেয়ের মিষ্টি কথায় আর উঠতে ইচ্ছে করে না। পূজা আবার নাচ দেখাবে। কি নাচ দেখবে বলো, ভরত নাট্যম, না কথাকলি। আবার গানও শোনাবে, ভক্তিমূলক, মন কালী কালী বলো, অথবা রবীন্দ্রনাথ, মেঘের কোলে রোদ উঠেছে।

পরেশচন্দ্র চায়ে চুমুক দিচ্ছেন, পজা পিঠে হাত রেখে বলছে, ‘একটা বিস্কুট দেব দাদাইয়া?’

‘না রে, হাতে মাটিফাটি লেগে আছে।’

‘আমি তোমাকে খাইয়ে দোব।’

‘দাঁড়া, পরে এক কাপ চা আবার খাব, তখন হবে।’

পরেশচন্দ্র পুত্রবধূকে বললেন, ‘বাজার থেকে একটা ফিনাইল কিনে আনি।’

‘তোমাকে যেতে হবে না, ও আনবে বলেছে।’

পূজা সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলে, ‘ও কাকে বলে দাদাইয়া?’

‘মেয়েরা যাকে বিয়ে করে তাদের ও বলে।’

‘বাংলা ও, না ইংরিজি ও দাদাইয়া?’

‘প্রথমটায় বাংলা ও মাথায় পুঁটলি, সংসারের চাপে ত্যাড়াব্যাঁকা, ত্রিভঙ্গ মুরারি, শেষটায় ইংরিজি, একটা গোল্লা, সব ফাঁকা, শূন্য।’

এই দার্শনিক তত্ব পূজা কি বুঝল, কে জানে বিজ্ঞের মতো বললে, ‘বাবাইয়া তা হলে আমার মায়ের বাংলা ও, পরে তোমার মতো ইংরিজি ও হয়ে যাবে?’

জয়া বললে, ‘বেশ বলেছেন। আর এখন সময় নেই, আমি চললুম, পূজা এইবার পড়তে বোসো, আমি আসছি। বই, খাতা রেডি করো।’

এই পড়ানো ব্যাপারটা অতিশয় ভয়ের। পূজার মুখের উজ্জ্বল হাসি নিমেষে অন্ধকার। পরেশচন্দ্রও ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন। পরেশচন্দ্র এই পর্বটার নাম দিয়েছেন পেটাই সেসান। পড়াতে বসামাত্রই জয়ার চেহারা বদলে যাবে। মোলায়েম কোমল ভাব অদৃশ্য। প্রথম অশান্তি, অনেক কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না, পেনসিল, ইরেজার, ডায়েরি, বই, স্কেল। পেনসিল বেরোয় তো স্কেল পাওয়া যায় না, ইরেজার তো পাওয়াই যাবে না। দক্ষযজ্ঞের ক্ষেত্র প্রস্তুত। এরপর পড়া। সামান্য তর্জনগর্জন থেকে হুঙ্কার, অবশেষে কানমলা, গাঁট্টা। সব শেষে পিঠে গুমগুম। মেয়ের গলা ছেড়ে কাঁদার স্বাধীনতাও নেই। ফোঁপানিতেই থাকতে হবে। নিষ্পাপ দুটি চোখ জলে হাপুস। এরই নাম মানুষ ঢালাই। আগে ছিল, ওয়ান ইন ওয়ান, তারপর টু ইন ওয়ান, এখন অল ইন ওয়ান। মেয়ে নাচবে, গাইবে, ছবি আঁকবে, আবৃত্তি, অভিনয় করবে, সাঁতারু তীরন্দাজ হবে, যোগাসন করবে এবং ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবে।

পরেশচন্দ্র ব্যাপারটাকে সহজ করতে গিয়ে একটু ঘষা খেয়েছিলেন। মোলায়েম করে বললেও কথাটা ছিল এই, দাটস নান অফ ইওর বিজনেস। আপনাদের যুগ চলে গেছে। পরেশচন্দ্র বলেছিলেন, এ বি সি তো অ্যান্টি ক্লকওয়াইজে লিখছে, ডান দিক থেকে বাঁ দিকে নামছে।

উত্তর হয়েছিল, দিক দেখার দরকার নেই, দেখতে হবে এ-টা এ হচ্ছে কিনা। কম্পিউটারের যুগ। মানুষ আর লিখবে না, কি বোর্ড টিপলেই, অক্ষর, বাক্য। অঙ্ক হবে ক্যালকুলেটারে।

পরেশচন্দ্র ল্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। গ্রামের বাংলা স্কুলে বাঙালি মাস্টারমশাইদের কাছে পড়েছেন। পোশাক, ইজের, হাফশার্ট। সামনের সব বোতামই ছেঁড়া। কোমরের দড়ির বর্ধিত অংশ সামনে পেন্ডুলামের মতো দুলছে। চুলে চিরুনি পড়েনি, খোঁচা খোঁচা, মুখে তেল বেড়বেড় করছে। বগলে বই খাতা।

এ কালের রাজপুত্র, রাজকন্যারা যেন মৃগায়ায় যাচ্ছে। পিঠে পাঁচশো টাকা দামের ব্যাগে যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র। প্রতিটি খাতা মলাট দেওয়া, গুচ্ছের বই যার অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয়। এ কাঁধে জলের বোতল, ও কাঁধে টিফিন। ব্যস্তসমস্ত মায়েরা মহা উদ্বিগ্ন। পাড়ার স্কুল ফাঁকা। চিৎপুর যাচ্ছে চেতলায় পড়তে। বর্ণপরিচয় তিন দিনে হত, এখন কেজিতে নানা নকশায় এক বছরেও নড়বড়ে। শিক্ষিকারা হলেন মিস। ফুটকি মারা খাতায় এ বি সি-র নকশা। দেওয়ালে যে ঘড়ি ঝুলছে, সেই ঘড়ি দেখে ঘড়ি চিনলে চলবে না। নো ইওর থিঙ্কস, বইয়ের নাম। সেখানে আঁকা আছে, চেয়ার টেবিল, ক্লক, বক্স।

তফাতটা এই হয়েছে, পরেশচন্দ্র বলেন ওভেন, জয়া বলে আভেন। পরেশচন্দ্র বলেন, বার্ড। পূজা বলে ব্যার্ড। পরেশচন্দ্র বলেন দি, জয়া বলে দ্য। পরেশচন্দ্রর হস্তাক্ষর পড়া যায়, জয়ার হস্তাক্ষর ব্যস্ত ডাক্তারের প্রেসক্রিপশান। বাপের বাড়িতে চিঠি লিখেছিল, পায়ের ব্যথায় বাবা কাত। ওরা পড়েছিলেন অনেক কষ্টে, মায়ের দয়ায় বাবা মাত। পা টিপে টিপে, শোকার্ত, বিষণ্ণ মুখে সব বাড়ি ঢুকছেন। আলো চাল, ঘি, কাঁচকলা, ফল, নতুন ধুতি, শাড়ি ব্যাগে। প্যাঁকাটি আর মালসাটা কিনতে পারেননি। পরেশচন্দ্র দরজা খুলতেই সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘একি আপনি তো জ্বলজ্যান্ত বেঁচে আছেন দেখছি!’

বেঁচে থাকার যে কি লজ্জা, পরেশচন্দ্র সেদিন বুঝেছিলেন।

বেয়াইমশাই নামকরা আইনজীবী। তিনি বলেছেন, ‘মেয়েটা যে কী লেখে! আমার সুপ্রিমকোর্টে কেস ছিল। সব ক্যানসেল করে চলে এলুম। কোনও মানে হয়, মানিটারি লস!’

পরেশচন্দ্র বলছেন, ‘বেয়াইমশাই, মিজারেবলি সরি। মরতে পারলে খুব খুশি হতুম। আপফরচ্যুনেটলি বেঁচে আছি। ছি, ছি, কী লজ্জার কথা!’

বেয়াইমশাই সান্ত্বনা দিচ্ছেন, ‘না, না, সে আর আপনি কি করবেন! জন্ম, মৃত্যু কি কারও হাতে। যখন সময় হবে, তখনই হবে। আমারই ভুল, আমার বোঝা উচিত ছিল, মায়ের দয়ায় এই মর্ডান মেডিসিনের যুগে কারও মৃত্যু হতে পারে না।’

তারপর মেয়েকে খুব দাবড়াতে লাগলেন, ‘পয়সা খরচ করে লেখাপড়া শেখালুম, হাতের লেখা দেখো! জ্যান্ত মানুষ মরে বসে রইল। এরপর যদি লিখিস টাইপ করে দিবি। সারাদিন চেষ্টা করে ওই একটা লাইনের ওই পড়া বেরল। প্রথম পাঠে মনে হয়েছিল, মায়ের পেটে ক্যাঁত করে লাথি। উকিলি বুদ্ধি বললে, গর্ভাবস্থায় মাকে অনেক লাথি মেরেছিস, ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর অকারণে লাথি মারবি কেন!

পড়ায় জায়গায় পেটাই সেসান শুরু হওয়ার মুখে। পূজা সেভেন টপকে এইট-এ ল্যান্ড করে টেন জাম্প করে ইলেভেনে গিয়ে পড়ছে। গান হলে আড়ি বলে চালানো যেত। এ যে কাউন্টিং! সবে কাউন্টিং, এর পর অ্যালফাবেট, তারপর রাইমস। শেষ যখন হবে, মনে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হল। অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট।

পরেশচন্দ্র এই সময়টা ওয়াকিং-এ বেরিয়ে পড়েন। বেফাঁস কথা বলে ফেলতে পারেন। কথায় কথায় সোর্ড ফাইট হয়ে যেতে পারে। যে কসরতটা হচ্ছে, সেটা হল ছোট জুতোয় বড় একটা পা ঢোকাবার ধস্তাধস্তি।

মোড়ের মাথায় সাতসকালেই একজন বন্ধুগণ করছেন। ভীষণ ধমকধামক দিচ্ছেন জনগণকে। পারলে, হামানদিস্তায় থেঁতো করে, খলে মধু দিয়ে মেড়ে, চেটে চেটে খেয়ে ফেলেন। সমাজজীবন এখন হাইটেনশান লাইন। সব সময় ফোর ফর্টি ভোল্ট। মেরে ফেল কেটে ফেল।

উলটো দিক থেকে বিষ্ণুপদ আসছেন।

পরেশচন্দ্র বললেন, ‘কি হে ছিটকে এলে?’

‘আমরা হলুম খাটিয়ার ছারপোকা। একটু ঠুকলেই ছিটকে পড়ি। আজ কত্তা, গিন্নি দু’জনে মিলে ধরেছে। মিস খুব কড়কেচেন, ছেলে কিস্যু পারছে না। ক্লাসে গোপালঠাকুরটির মতো মুখ করে বসে থাকে। আর থেকে থেকে টিফিন কৌটো খুলে আঙুলে জ্যাম মাখিয়ে চকচক শব্দ করে চোষে। শুধু অশিক্ষিত নয় অসভ্যও। ছেলের আজ ছুটি। সে নিয়েছে পিঠের দায়িত্ব, মা ধরেছে কান। একেবারে পাখোয়াজ। মা বাঁধছে, বাপ ধামারে পেটাচ্ছে। বোল হল আর্ত চিৎকার। ছেলেগুলোকে এরা থানার বড়বাবুর কাছে পড়তে পাঠালেই তো পারে! হয় লকআপে ডেথ না হয় সাফ স্বীকারোক্তি, আমার মগজে কুলোচ্ছে না। বলতে গেলুম, বউমা, তোমার ডাল পুড়ে যাচ্ছে। ঝাঁঝালো উত্তর হল, যাক, অয়েল ইওর ওন চরকা। ডালের কেজি ছাব্বিশ। নাতির কেজি আশি। কোন কেজি সামলাবে একা হাতে! এদিকে আলুপলিটিকস। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী খেপে গেছেন। নেক্সট পি এম আলুর ব্যবসায় নেমে পড়তে বাধ্য হলেন। ওই বন্ধুগণ, হয়তো এখন ধমকাবেন, কেন আপনারা সুগার ধরাতে পারছেন না! জনে জনে সুগার! তা হলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়! আলু সমস্যার সমাধান তো জনগণের শরীরেই রয়েছে। সমাজে আনপ্রাোডাক্টিভ বৃদ্ধের সংখ্যা তো অনেক। তাদের গৃহসমস্যার সমাধানে খোলা হয়েছে বৃদ্ধনিবাস, এইবার আলুসমস্যার সমাধানে এগিয়ে আসুন সুগার নিয়ে। কেন সব বুড়োর সুগার হচ্ছে না, হবে না! জবাব চাই, জবাব দাও।’

বিষ্ণুপদ খানিক নেচে নিলেন।

ওদিকে বন্ধুগণ ম্যালেরিয়ায় ঢুকেছেন। মশা যদি কামড়ায় আমরা কী করতে পারি! মশার চাষ করছে কারা? রেল আর আর্মি। আর্মির আর্মড ফোর্সই হল মশা। কেন্দ্র আমাদের তেল সাপ্লাই করছে না। তাদের আর কত তেল দেওয়া যায়। মশাইরা মশাদের অনুরোধ করুন, তারা যেন না কামড়ায়। গান শোনাক ক্ষতি নেই, জীবনমুখী গান। আমরা টাস্ক ফোর্স গঠন করেছি। এইবার আর্মির কাছে কামান চাইব। আপনারা মশারির মধ্যে থাকুন, মশারি নিয়ে চলাফেরা করুন। মশা আমরা দমন করবই করব, করবই করব। গান শুরু হয়ে গেল। গণশত্রু এই মশা, রক্তের মজুতদার। নিপাত যাক, নিপাত যাক।

পরেশচন্দ্র বিষ্ণুপদকে নিয়ে একটা রাউন্ড মেরে এলেন। সব বুড়োরই এক অবস্থা। ঘড়ি টিকটিক করছে। তাদের কাছে পরিবারের একটাই প্রত্যাশা, টিকটিক বন্ধ করো, ব্যাটারির খরচ বাঁচুক অন্তত। ওষুধের ভীষণ দাম। এক একটা বুড়ো যা ওষুধ কনজিউম করে! সেই টাকা জমাতে পারলে একটা ওয়াশিং মেশিন হয়ে যাবে!

পরেশচন্দ্র রাউন্ড শেষ করে বাড়ি ঢুকতেই পূজা ছুটে এল, ‘দাদাইয়া! আমার পড়া হয়ে গেছে।’

‘তাই তো দেখছি। কি কি শিখলে আজ?’

‘টু প্লাস ওয়ান থ্রি, থ্রি প্লাস ওয়ান ফোর।’

‘বা:, ভেরি গুড?’

‘এইবার তুমি আমার সঙ্গে খেলবে দাদাইয়া?’

‘স্কুলে যাবে না, তোমার কেজি ওয়ান নার্সারিতে?’

‘আমাদের তো এখন ছুটি। তুমি কিচ্ছু জানো না বোকুরাম। জানো দাদাইয়া, আমার সঙ্গে জুলির না খুব ভাব হয়ে গেছে। আমি মাথায় হাত দি, ও আমাকে কিচ্ছু বলে না।’

জুলি হল বিশাল আকারের অ্যালসেসিয়ান। মনোরমার পোষা। ভালো মেয়ে। বাড়ির পেছনের দিকে থাকে। পেছনের বাগানে ঘুরপাক খায়। সামনের দিকে আসতে দেওয়া হয় না বাইরের লোকের ভয়ে। গ্রিলের গেট দেওয়া জায়গাটা তার বিচরণভূমি। ময়লা জামা-কাপড় পরা লোক দেখলেই ঘেউ ঘেউ, ফিটফাটদের দেখলে নীরব।

পরেশচন্দ্র নাতনিকে বললেন, ‘বেশি সাহস ভালো নয় মা, তোমার মা জানে?’ ‘হ্যাঁ, মা সব জানে।’

‘তা হলেও তুমি সাবধান হবে।’

কথা বলতে বলতেই অপরেশবাবু এলেন। নিজের গাড়ি আছে। সম্পন্ন মানুষ। সদা হাস্যময়। চেহারাটিও সুন্দর। বড় ছেলে আই. এ. এস., ছোটটির ওষুধের ব্যবসা। সম্প্রতি এই অঞ্চলে বাড়ি করেছেন।

পূজা বললে, ‘কী গো! এতদিন ছিলে কোথায়, আসোনি কেন? অনেক কাজ ছিল বুঝি? কী খাবে চা, না কফি!’

‘এখন কিচ্ছু না, তোর বাবা কোথায়? তোর বাবার সঙ্গে কাজ আছে।’

বাবা তো অফিসে!’

পরেশচন্দ্র বললেন, ‘আজ একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে।’

জয়া ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বললে, ‘জ্যাঠামশাই পেঁপে খাবেন, গাছপাকা, খুব মিষ্টি, বাবাকে দিচ্ছি।’

‘হ্যাঁ, পেঁপে খেতে পারি।’

জয়া পেঁপে কাটছে। দুই বন্ধু গল্পে মত্ত। পূজা এক ছুটে কোথায় যেন গেল। কেউ তেমন খেয়াল করলেন না। নতুন একটা খেলা শিখেছে ডিগবাজি। ডিভানে ডিগবাজি দেখাবার বাসনা প্রকাশ করেছিল। পরেশচন্দ্র বলেছিলেন, আমরা যে এখন বসে আছি মা।

জয়া পেঁপের প্লেট রাখছিল, এমন সময় পেছন দিকে কুকুরটা বীভৎস একটা গর্জন করে উঠল। ওদিকে তখন কাজের মেয়েটি কাজ করছিল, সে ডুকরে কেঁদে উঠল।

জয়া সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ল। পরেশচন্দ্র আর অপরেশচন্দ্র কাঠের পুতুল।

একটু পরেই পূজার হাত ধরে জয়া এল কাঁদতে কাঁদতে, ‘এই দেখো, আমার মেয়ের হাতটা জুলি কী করে দিয়েছে।’

ফিনকি দিয়ে রক্ত। যেন ছিন্নমস্তা! জামার সামনেটা রক্তে ভিজে গেছে। মেঝেতে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। কামড়েছে হাতের তালুতে। ফুলের মতো কচিকচি হাত। পূজার কিন্তু কান্না নেই। অবাক হয়ে গেছে। প্রথম রক্ত দেখছে, নিজের রক্ত। এক ফোঁটা, দু’ ফোঁটা নয়, রক্তের ধারা। ত্বক ভেদ করে অনর্গল বেরিয়ে আসছে, গাঢ় লাল রক্ত। একটু আগে হাসছিল, হাসছিল মেয়েটা। নিমেষে কী হয়ে গেল।

জয়া ভয়ে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। শুধু অঝোরে কাঁদছে।

পরেশচন্দ্র ঝট করে ভেবে নিলেন, প্রথমে যেভাবেই হোক রক্ত বন্ধ করতে হবে। মনে হচ্ছে ভেন রাপচার হয়েছে। অত বড় বড় দাঁত, এইটুকু একটা হাত।

‘হাতটাকে কাপড় দিয়ে কষকষে করে জড়াও। চেপে ধরো থাকো। চলো ডাক্তারখানায়।’

অপরেশচন্দ্র বললেন, ‘আমার গাড়ি।’

জয়া বললে, ‘কোন ডাক্তার!’

পরেশচন্দ্র বললেন, ‘সময় নেই ভাবার, যেতে যেতে ভাবা যাবে।’

মানুষে মানুষে সামাজিক গ্রন্থিবন্ধন শিখিল হয়ে এসেছে অবশ্যই। কাঁচির দুটি ফলা, রাজনীতি আর অর্থনীতি। সম্পর্ক ছেদন করলেও, অবশিষ্ট আছে কিছু। বাইরে ভিড় জমেছে। পূজা খুব পপুলার। কেউ কাকা, কেউ মামা, কেউ দাদা।

তাদেরই মধ্যে একজন ছোঁ মেরে পূজাকে কোলে তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে ছুটল।

পরেশচন্দ্র সামনের আসনে। গাড়ি এগোচ্ছে। পূজার হাতে জড়ানো কাপড়টা লাল হয়ে গেছে। অসীম সহ্যশক্তি। টু শব্দ নেই। গাড়ি এগোচ্ছে। তখনও ভাবা হয়নি যাওয়া হবে কোথায়? হাসপাতালে গেলে দেখবে না। ছোটাছুটিই সার হবে। এমন জায়গায় যেতে হবে, যেখানে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা হবে।

চকিতে মাথায় খেলে গেল, ডাক্তার ঘোষের নার্সিংহোম।

পরেশচন্দ্রের অনেক বিপদ ডাক্তার ঘোষ উদ্ধার করেছেন। তা ছাড়া পূজার জন্মও সেখানে। সেখানে সুদক্ষ মমতাময়ী এক পরিচালিকা আছেন, ডাক্তার মিস দাশগুপ্তও থাকতে পারেন।

কপাল ভালো, নার্সিংহোমে সেই মুহূর্তে এক নামি সার্জেনও রয়েছেন, ডাক্তার প্রধান।

অপারেশন থিয়েটারে তখন এক বৃদ্ধকে টেবিলে তোলা হয়েছে। পায়ে অপারেশন হবে। তাঁকে টেবিল থেকে নামিয়ে দেওয়া হল। সেই জায়গায় শোয়ানো হল পূজাকে। ডাক্তারবাবু সব্বাইকে। এমনকী পূজার মাকেও বার করে দিলেন নার্সিংহোমের একেবারে বাইরে। পরেশচন্দ্রকে বললেন, আপনি থাকুন, পাশে ডা: ঘোষের ঘরে গিয়ে বসুন। খালি ঘর। ছোট্ট একটা বিছানা। ছোট্ট একটা কালার টিভি অন করা, ক্রিকেট হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

বসতে না বসতেই বৃদ্ধা পরিচারিকা এক কাপ গরম কফি এনে দিলেন। বললেন, ‘ঝপ করে খেয়ে নিন। আপনার শরীর কাঁপছে।’

সত্য কাঁপছেন পরেশচন্দ্র। ওইটুকু কচি হাত, কেটে বাদ দিতে হবে না তো! কেন তিনি ডিভানে ডিগবাজি খেতে দিলেন না। পরেশচন্দ্র বসতে পারছেন না। অপারেশন রুমের দরজার কাছে যাচ্ছেন, আবার ফিরে আসছেন। যাচ্ছেন আর আসছেন।

হঠাৎ শুরু হল পূজার আর্ত চিৎকার। পরেশচন্দ্রের বুক ফেঁড়ে গেল যেন। পৃথিবীর সমস্ত বন্য কুকুর যেন তাঁকেই কামড়াচ্ছে। চিৎকার করেই চলেছে মেয়েটা। সহ্য করা যায় না। যেন জ্যান্ত পোড়াচ্ছে। গোটা নার্সিংহোম কাঁপছে। কারও মুখে কথা নেই। কেউ বলতেই পারছেন না, ভেতরে কী হচ্ছে!

দু’ঘণ্টা পরে বেরিয়ে এল পূজা। হাতে ব্যান্ডেজ। গলায় স্লিং। হাত বুকের কাছে ঝুলছে। একুশটা স্টিচ। সেই প্রথম লক্ষ করলেন কোন হাত! বাঁ হাত।

ডাক্তার প্রধান বললেন, ‘ক্ষতবিক্ষত! একটাই ভয় সেলুলাইটিজের। হাতটাকে সব সময় ওপরে কাঁধের দিকে তুলে রাখবেন, তা না হলে ফুলে যাবে। পেনকিলার, ঘুমের ওষুধ দেওয়া আছে। এখুনি ঘুমিয়ে পড়বে।’

বাড়িতে বেলা পাঁচটার সময় ঘুম একবার ভাঙল। মেয়ের মুখটা তপতপ করছে। পরেশচন্দ্র পাশ থেকে একবারও ওঠেননি। আনন্দের অংশ নেওয়া যায়, যন্ত্রণা ভাগ করা যায় না। সারাক্ষণ ভেবেছেন, মেয়েটি কী অসাধারণ! পৃথিবীর মতোই সহ্যশক্তি।

পূজা তাকিয়ে আছে পরেশচন্দ্রের দিকে। জল আসছে পূজার চোখে। এতক্ষণে কাঁদবে।

‘দাদাইয়া!’ কান্না জড়ানো গলা, ‘আমার কোনও দোষ নেই দাদাইয়া, আমার কোনও দোষ নেই, তুমি বাবাইয়াকে বলবে।’

পূজা নীরবে কাঁদছে।

পরেশচন্দ্র বললেন, ‘তোমার কোনও দোষ নেই।’

‘আমাকে বকবে না তো বাবাইয়া!’

কেন বকবে! আমি আছি, তোমার কোনও ভয় নেই। সব দোষ তো জুলির।’

না, দাদাইয়া, জুলিরও কোনও দোষ নেই। ও কথা বোলো না, তা হলে বাবাইয়া জুলিকে মারবে।’ পূজা আবার ওষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরেশচন্দ্র উঠলেন। বাড়িতে ঢোকার আগেই ছেলেকে ধরতে হবে। হেড স্ট্রং। ঢুকেই জয়াকে একচোট নেবে, সে বেচারার কোনও দোষ নেই। এরপর জুলিকে পেটাবে। তারই বা কী দোষ! সব দোষ তো এই বুড়োটার। কেন সে সজাগ থাকল না।

মোড়ের দিকে এগোবেন ভাবছেন, ছেলে গেট খুলে ঢুকল।

কিছু বলার আগেই জিগ্যেস করল, ‘কেমন আছে?’

‘তুমি জানো?’

‘রাস্তায় বললে।’

‘জয়াকে কিছু বলো না, ওর দোষ নেই।’

‘কেন বলব?’

‘জুলিকে মারবে?’

‘মারব কেন?’

পরেশচন্দ্র হালকা হলেন। মেয়েটার কী হয় ছাড়া আর কোনও ভয় রইল না।

রাত দশটায় পূজা একবার উঠল। পরেশচন্দ্র পাশে আছেন। তাঁর কাজ হাতটা ওপরে ধরে রাখা। কান্নাজড়ানো গলায় পূজা বললে, ‘দাদাইয়া, জুলিকে আমি এত ভালোবাসি, সে আমাকে কামড়ে দিল!’ পরেশচন্দ্র মনেমনে ভাবলেন, ভালোবাসার কামড়ই তো সাংঘাতিক।

পূজা বললে, ‘তোমার জানা কোনও দাঁতের ডাক্তার আছে?’

‘কেন মা? আছে।’

‘কাল ডেকে এনো তো, জুলির সব দাঁত তুলিয়ে দোব।’

ভয়, শঙ্কা, উৎকণ্ঠায় এতক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে থাকা বাড়ি হাসিতে ফেটে পড়ল।

ছাতে দুটো বিশাল খাঁচায় অনেক পাখি আছে পরেশচন্দ্রের ছেলের পাখির শখ। অজ্ঞাত কারণে পাখিগুলোও একসঙ্গে কিচিরমিচির করে উঠল, যেন, রাতি পোহাইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *