পাক্কিটাডাও চোকরা
রিং-টাং চা-বাগানের ম্যানেজার গিলিগান উদোম হয়ে বাথরুমের লাগোয়া ঘরে, দুটি পা ইজিচেয়ারের লম্বা কাঠের হাতলে তুলে দিয়ে বসেছিল। আর গিলিগানের খিদমদগার, ব্যক্তিগত বেয়ারা অনামা, ইটালিয়ান জলপাই-তেল মাখাচ্ছিল তার সাঁতরাগাছির ওল-এর মতো শরীরে।
পার্সেলে ডেইলি টেলিগ্রাফের বাণ্ডিল, আর্মি-নেভি স্টোরস-এর প্রি-ক্রিসমাস ক্যাটালগ সব এসেছে আজ। কবে পার্সেল আসে সেই অপেক্ষায় হাঁ করে থাকে ‘হ্যারো-ইটনের’ লালমুখো ছাত্ররা।
কাগজ মেলে বসে, গিলিগান গভীর মনোযোগের সঙ্গে ‘হোম’-এর খবর পড়ছিল আর অনামা, সাহেবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, প্রতি রোমকূপে রোমকূপে মালিশ করে করে পরতে পরতে তেল বসাচ্ছিল তার শরীরে।
একটু পরই অন্য বেয়ারারা কেরোসিনের টিনে গরম জল বয়ে নিয়ে এসে বাথটাবে ঢেলে দেবে। জল গরম হচ্ছে বাংলোর পেছনে বাবুর্চিখানার সামনের নিমগাছতলায়। একটি পেল্লায় কাঠের উনুনে।
ভালো করে চান করার পর বাথটাব থেকে বেরোলে, অনামা তাকে তোয়ালে দিয়ে মুছে জামাকাপড় পরিয়ে দেবে। তার পর সার সার ফুলের টব-বসানো চওড়া বারান্দায় সাদা-রঙা বেতের চেয়ারে বসে আজ বিয়ার খাবে গিলিগান ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার ম্যাক-আর্থারের সঙ্গে।
ম্যাক-আর্থার স্কটসম্যান। কয়েক দিনের ছুটিতে জঙ্গল ছেড়ে এসেছে। গিলিগানরা জংলি সাহেবদের বলে ‘জাঙ্গল-ওয়ালা’। যারা ব্যাবসা করে বা বানিয়া, সেইসব সাহেবদেরও ছোটো চোখে দেখে আর্মির এবং সিভিল সার্ভিস-এর সাহেবরা। ওদের ঠাট্টা করে বলে, ‘বক্সওয়ালা’।
কলকাতার মিসেস উড, মেমসাহেবদের জন্যে জামাকাপড় বানিয়ে লোক মারফত পাঠাতেন সাহেবদের বাংলোতে বাংলোতে। লোকগুলো তাদের বাক্স বিছিয়ে বসত বারান্দায়। সেই থেকেই বানিয়াদের নাম হয়েছে ‘বক্সওয়ালা’।
গিলিগানের একজোড়া ঝুপড়ি নস্যি-রঙা পুরুষ্ট গোঁফ ছিল। ম্যাক-আর্থারের মুখময় রুপোলি-রঙা দাড়ি গোঁফ। জাঙ্গল-ওয়ালারা হাজামতদের সেবা থেকে বঞ্চিত ছিল, বলেই দাড়ি কামানো বা গোঁফ ছাঁটার বিলাসিতা বিশেষ থাকত না। বাঘ, হরিণ, ভাল্লুক, বুনো মোষ আর বাইসনের চামড়াতে মোড়া থাকত তাদের বাংলো। হাতির দাঁত ও পা-ও থাকত। প্রত্যেক ফরেস্ট বাংলোর একটি ঘর তাদের জন্যে রিজার্ভ করা থাকত তখনকার দিনে।
স্কটল্যাণ্ডের উৎসব ‘হ্যাগেস’। হ্যাগেস-এর সময়ে কার্ড পাঠাত ম্যাক আর্থার সব সাহেবদের। লেখা থাকত ‘ইউ আর ইনভাইটেড টু সি দ্য হ্যাগেস’। স্কটিশ-কিল্ট পরে ধুমসো সাহেবরা নাচানাচি করত। বিলিতি ব্যাণ্ড বাজত। তা দেখে এবং শুনে, আমাদের মতো নেটিভরা ধন্য বোধ করত নিজেদের। খিদমদগারির মধ্যে, পরের পদসেবা ও পদলেহনের মধ্যে, পরম আত্মসম্মানজ্ঞানহীনতার মধ্যেও বেঁচে থাকার তালিম আমরা বহু বছর আগেই নিয়েছিলাম। শুধু তাই-ই নয়, এই আত্মাবমাননার মধ্যে আমরা চিরদিন এক পরমশ্লাঘাও বোধ করে এসেছি।
মাঝে মাঝেই বাংলোতে বড়া-খানার আয়োজন হত। অনেক সাহেব-মেম আসতেন ঘোড়ায় চড়ে। তখন গাড়ি সবে এসেছে ভারতবর্ষে; তবে ওইরকম জংলি জায়গার সাহেবদের কাছে মোটর গাড়ি ছিল না। মোটর চলার মতো রাস্তাও তখনও বিশেষ হয়নি। হুইস্কি বইত জলের মতো। তার পর ডিনার সার্ভড হলে তার সঙ্গে শেরি আর পোর্ট। ডিনারের পর লিডিং-লেডি অন্যান্য মেমসাহেবদের নিয়ে বসবার ঘরে এসে বসতেন। সাহেবরা খাবার ঘরে গুলতানি করতেন। তার পর সকলে বসবার ঘরে এলে যে সবচেয়ে বাঘা সাহেব তাঁর মেমসাহেব বলতেন এবার আমরা উঠব।
তাঁরা চলে গেলে তবেই অন্যরা যেতে পারতেন। প্রোটোকল এইরকমই ছিল।
তখনকার দিনে ওইসব জংলি জায়গায় খুব কম মেমসাহেবই আসতেন। ব্যাচেলার সাহেবদের বাংলোর আউট-হাউসে একজন করে নেটিভ রক্ষিতা থাকত। গিলিগানেরও ছিল। অনামারই বউ সে। নাম কুজাতা। সেই আউট-হাউসকে বলা হত ‘বিবিখানা’।
সাহেব রাতে অনামার নিজেরই স্ত্রীকে সম্ভোগ করবে বলে ভালো করে সাহেবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জলপাই-তেল লাগিয়েছিল অনামা। আলেকজাণ্ডার এমনি এমনি বলে যাননি: সত্যিই সেলুকাস। বিচিত্র এদেশ।
ঘুঘুডাকা, ছায়াঢাকা, পাতা-ফিসফিস দুপুরে অনামা তার বউ কুজাতার কাছে যেত। বউকে আদর করতে করতে শুধোত তোকে কে বেশি আনন্দ দেয়? সাহেব, না আমি? সাহেব কি আমার থেকেও ভালো?
অনামার নির্লোম বুকে মাথা নামিয়ে হারামজাদি মার্জারির মতো কুজাতা বলত মিটিমিটি হেসে, দুজনে দুরকম। দুজন পুরুষ কখনো একরকম হয় নাকি? কুজাতা বলত, সাহেবের গায়ে পচা টক-দইয়ের গন্ধ। আরও বলত, নস্যি-রঙা চুলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সাহেবের পুরুষাঙ্গটি দেখলেই তার নাকি বুনো-বেজির কথা মনে হত। মস্ত একটা বেজি।
অনামা বলত, আর আমারটা?
তোরটা দিশি সাপ। বাদামি সাপ। ফণা নেই, ছোবল নেই। হেলে সাপ। এলেবেলে।
অনামা গর্বে আনন্দে সাহেবের বেজির স্তুতিতে হি-হি করে দাঁত বের করে হেসে বলত, তাই-ই তো বেজির হাতে মরল সাপ এ-জন্মে। বল? সাপ কি পারে বেজির সঙ্গে কখনো?
গিলিগানের ঔরসে কুজাতার গর্ভে যে-ছেলেটি জন্মেছিল তার বয়েস এখন বারো। তার রং সাহেবদেরই মতো। চুলও নস্যিরঙা। বড়ো হলে সেও হয়তো বেজি পুষবে একটা। যে-বেজি খেলে বেড়াবে যুবতীদের পেলব কোমল ঊরুমূলের দূর্বাঘাসে।
গিলিগান সাহেবের দয়ার শরীর। ক্লাবে ছেলেটাকে একটা কাজও জুটিয়ে দিয়েছেন। অদ্ভুত কাজ। একমাত্র এদেশে এবং হয়তো আফ্রিকার কোনো কোনো জায়গায় এই চাকরিতে বহাল হয় ছোঁড়ারা। ছোঁড়ার ডেজিগনেশান ‘পাক্কিটাডাও চোকরা।’
সাহেবরা যখন ক্লাবের লনে বসে গল্প করেন, পান করেন, খান-দান; তখন নানারকম পাখি এসে তাঁদের বিরক্ত করে। যদিও মস্ত মস্ত রঙিন সব গার্ডেন-আমব্রেলা পোঁতা থাকে। ফিশফ্রাই নিয়ে বেয়ারা আসছে, হঠাৎ কাকে-চিলে ছোঁ মেরে ফ্রাই হাওয়া করে দিল। পড়ে রইল শুধু আলু ভাজা।
এই ছোঁড়াদের কাজই ছিল পাখি-তাড়িয়ে বেড়ানো। লাল-রঙা শর্টস আর নীল-রঙা শার্ট পরে হাতে ডাণ্ডা নিয়ে তারা তাদের বাপেদের রক্ষা করত পাখিজনিত বিরক্তি থেকে। তাই-ই নাম ছিল, ‘পাক্কিটাডাও চোকরা।’
ছোঁড়া মাইনে পেত পাঁচ টাকা। ছোঁড়া তার মা-বাপের হদিশ জানত না। জন্মের পরই অন্য বাগানের কুলি-লাইনে তাকে চালান করে দিয়েছিল গিলিগান। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, টাইফয়েড, কালাজ্বর, সাপ, বিছে—ওসব কিছুর হাত থেকেই যখন বেঁচে উঠল ছোঁড়া, ভক্ত পেল্লাদের মতো, তখন দয়াময় বে-বাপ তাকে ক্লাবে এই চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিল।
২
ক্লাবে এক বুড়ো বেয়ারা ছিল। যারা অল্প বয়েসেই আত্মসম্মান খোয়ায় জীবনে, তারা বুড়ো হলে বেজন্মা শেয়ালের মতো হয়ে ওঠে। সেই বিহারি বুড়ো আর বাঙালি ক্যাশিয়ারবাবু মিলে পরামর্শ করে একদিন ছোঁড়াকে বলল: তোর বাপ কে? তা তুই জানিস?
‘পাক্কিটাডাও চোকরা’ বলল, আমার বাপ পল্টনে আছে। যুদ্ধ করছে পেশোয়ারে। মাও গেছে বাপের সঙ্গে।
তোর মুন্ডু। সে যুদ্ধ করছে, ‘বিবিখানায়’। তোর মায়ের সঙ্গে। অন্যরকম যুদ্ধ। ওই দেখ, তোর বাপ। ওই যে গিলিগান সাহেব।
গিলিগানের পাশে উইক-এণ্ডে গলফ খেলতে-আসা পুলিশসাহেব রবার্টসন বসেছিলেন। ছোঁড়ার মাথা গুলিয়ে গেল। কোনটা তার বাপ বুঝতে পারল না। বুড়ো বেয়ারা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, গুঁফো গিলিগান।
কথাটা শুনে ছোঁড়ার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। কিন্তু কী করবে বুঝতে পারল না। ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে-রাতে। ভেবে কূল পেল না।
শুধু পাখিই নয়। ক্লাবের এলাকার মধ্যে যা-কিছু ঢুকে পড়ে, সবই তাড়াতে হয় ছোকরাকে। ভুটান পাহাড় থেকে কখনো হাতির দল নেমে আসে। বাঘ বা চিতার তাড়া খেয়ে দৌড়ে আসে বার্কিংডিয়ার। অথবা, মাদি শম্বর; বাচ্চা নিয়ে। ছোকরা কাক তাড়ায়, চিল তাড়ায়; ছাতারে তাড়ায়। সাপ তাড়ায়, বেজি তাড়ায়; শুধু নিজের বে-বাপকে তাড়াতে পারে না। দৌড়ে বেড়ায় ছোঁড়া। তার লাল শর্টস আর নীল শার্টে রোদের মধ্যে তাকে একটা মস্ত রঙিন পাখি বলে মনে হয়। পাখির মতো উড়ে বেড়ায় ‘পাক্কিটাডাও চোকরা।’
হ্যারো-ইটনে পড়া সাহেবরা যা কিছুই করে তারমধ্যে একটা ক্লাস থাকে। ক্লাব খুব পছন্দ করে তারা। রংচঙে ছাতার নীচে বসে, ঝলমলে পোশাক পরে, হলুদ বুড়বুড়ি-ওঠা বিয়ার খেতে খেতে তাদের ঔরসের টুকরো-টাকরাদের রোদে ঝকমক করতে দেখে খুব খুশি হয় তারা। ‘পাক্কিটাডাও চোকরার’ গতিস্মানতার মধ্যে এই হতভাগা দেশের অনেক দুঃখ গ্লানি এবং আত্মসম্মানজ্ঞানহীনতা প্রস্তরীভূত হয়ে থাকে। তাজমহলের এবং কোনারকের গর্বের মতোই পাক্কিটাডাও চোকরাদের অপমানের ও লজ্জার ইতিহাস পাশাপাশি লেখা থাকার কথা। যদি এই দেশে কখনো সৎ ও স্বাধীন ইতিহাস লেখা হয় ভবিষ্যতে। দেশের ইতিহাস।
এক সন্ধ্যায় গিলিগান বাংলোর বারান্দায় বসে হুইস্কি-পানি খাচ্ছিল। পায়ের কাছে শুয়ে-থাকা তার অ্যালসেশিয়ান কুকুর হঠাৎ ঘাউ-ঘাউ করে উঠল। সাহেব চমকে চেয়ে দেখলেন বাঙালি ক্যাশিয়ারবাবু।
বাবু, হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সাহেবের পায়ে। কুকুরটার পায়েই এসে পড়ল তাঁর মাথাটা। কুকুরটা, মানুষটাকে সারমেয়রও অধম ভেবে লজ্জা পেল। পা সরিয়ে নিল।
কোই হ্যায়?
সাহেব বললেন।
তার পরও বললেন, কোই হ্যায়?
ডেক্কোটো কেয়া মাংতা বাবু? হোয়াটস দ্য ম্যাটার?
বাবু সাহেবের পা দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, ইয়োর লাইফ ইজ ইন ডেনজার স্যার। ‘পাক্কিটাডাও চোকরা’ সাহেবকে খুন করবে বলে মতলব করেছে।
গিলিগান অনামাকে শুনিয়ে, গলা তুলে বলল: কিন্তু কেন? হোয়াই?
বাবু বলল, তা জানি না সাহেব। কিন্তু জানি যে, খুন সে করবেই।
তার পাখি তাড়ানো ডাণ্ডার মধ্যে সরু ছুঁচোলো লোহার শিক ভরে নিয়ে একদিন সে আপনার বুকে ঢুকিয়ে বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে।
গিলিগান বলল, বাবু, ইউ ইণ্ডিয়ানস আর আনগ্রেটফুলস।
বাবু ফিসফিস করে কী যেন বললেন সাহেবকে।
সাহেব সব খিদমদগার, বেয়ারাদের চলে যেতে বললেন। এলাকা ফাঁকা হলে মিরজাফরের জাতের একজন মানুষ ফিসফিস করে অনেক কথা বললেন সাহেবের কানে।
গিলিগান রেগে আরও লাল হয়ে গেলেন। তক্ষুনি পুলিশের রবার্টসনের কাছে একটি চিঠি পাঠালেন ঘোড়সওয়ার দিয়ে। ব্যাপারটা তো সোজা নয়। রাজাকে মারার ষড়যন্ত্র, অর্থাৎ বিদ্রোহ। রিং-টাং-এর ইতিহাস থেকে ছোঁড়ার অস্তিত্ব, ছোঁড়ার নাম মুছে ফেলতে হবে। এক্ষুনি।
বাবু হাতজোড় করে দাঁড়িয়েই ছিলেন। কুকুরটাও বসল। কিন্তু বাবু দাঁড়িয়েই থাকলেন।
এবার গিলিগান একটু কাশলেন। বললেন, নাউ টেল মি। হোয়াটস দ্য ডিল। ডোন্ট টেল মি দ্যাট ইউ হ্যাভ কাম হিয়ার টু ওয়ার্ন মি উইদাউট এনি মোটিভ।
বাবু হাত কচলালেন না:। বাবুর বিশেষ বড়ো কিছু চাইবার ছিল না। না, না, সেরকম বড়ো কিছুই নয়।
আসলে এ ঘটনা যে সময়ে ঘটেছিল, সেই সময়ের শিক্ষিত, স্বাধীন অধিকাংশ মানুষ; নিজেদের আজ যতখানি নীচে নামাতে পারেন, ততখানি নীচে নামিয়ে আনতে পারতেন না। ক্যাশিয়ারবাবু তো ছিলেনই। চিরদিনই ছিলেন। কিন্তু উঁচুতলার অধিকাংশ মানুষেরাই তখনও মানুষই ছিলেন। কুকুর কিংবা চড়ুই পাখি হয়ে ওঠেননি।
বাবু বললেন, হাত-কচলে; পঞ্চাশ টাকা মাইনে বাড়াতে হবে। আর এক্সটেনশান চাই আরও দু-বছর।
সাহেব ক্লাবের অনারারি সেক্রেটারি। রিং-টাং-এ তাঁর যে-ক্ষমতা, তার সঙ্গে যেকোনো দেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার তুলনা করা চলে।
সাহেব একমুহূর্ত কী ভাবলেন।
তার পর বললেন, ডান।
৩
বাবু চলে গেলেন, গিলিগান হাঁক ছাড়লেন, বললেন, কোই হ্যায়? এক বড়ড়া পেগ। হুইস্কি অ্যাণ্ড পানি।
অনামা দৌড়ে গেল হুকুম তালিম করতে। তার বউ তখন বিবিখানায় চান করে উঠে ‘রুহ-খস’ আতর মাখছিল সারাশরীরে ঘষে-ঘষে। গিলিগান আতরের গন্ধ বড়ো ভালোবাসেন।
একটা ‘ব্রেইন-ফিভার’ পাখি বাইরের অন্ধকারে চমকে চমকে ডাকছিল। গিলিগান একবার বাইরের অন্ধকারে তাকালেন। এমন অন্ধকার, যেন মনে হয় মুখে থাপ্পড় মারছে। এমন অন্ধকারেই বাবুদের মুখ লুকোতে সুবিধে হয়।
তার পর হুইস্কির গ্লাস তুলে নিয়ে গিলিগান ভাবতে লাগলেন যে, ভারতে ব্রিটিশ-রাজ তার নিজের জোরে টিকে নেই। কখনোই ছিল না। এই ক্যাশিয়ার বাবুদের মতো লোকগুলোই,যে-ক্ষমতা তাদের নয়, সেই ক্ষমতা নির্লজ্জের মতো, আত্মসম্মানহীনতায় তুলে দিয়েছে শাসকদের হাতে। চাবুক হাতে করে এদের সামনে দাঁড়ালেই হল। চাবুক মারা পর্যন্ত অপেক্ষা করার মতো সময়েরও দরকার নেই এদের। হাওয়াতে সপাং-সপাং শব্দ শুনেই কেঁই-কেঁই করে কুকুরের মতো পায়ে পড়ে। এরা। এই মহান ভারতের মানুষ।
হুইস্কিতে একটা চুমুক দিয়ে নিরুচ্চারে গিলিগান বললেন: ‘গড সেভ দ্য কিং’।
৪
গিলিগান-এর এবং কুজাতার জারজ সন্তান লাল টুকটুকে ছেলেটা ক্লাবের প্যান্ট্রির মেঝেতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। ক্যাশিয়ারবাবুর সঙ্গে আসা চারজন ঘোড়সওয়ার পুলিশ ওকে পেটে লাথি মেরে ঘুম থেকে তুলল। ক্লাবের ক্যাশবাক্স থেকে এক-শো টাকা চুরি গেছে। টাকাটা দেওয়ালে ঝোলানো ছোঁড়ার জামার পকেট থেকেই বেরুল। হাতে-নাতে চোর ধরা পড়ল। এখনকার মতো তখনও আইন একটা প্রচন্ড তামাশাই ছিল।
তখন অবশ্য দিনকাল, রীতি-নীতি অন্যরকম ছিল। আজকের দিনের গিলিগান আর ক্যাশিয়ারবাবুরা নিজেদের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্যে এ-ধরনের অনেক নতুন নতুন অস্ত্র প্রয়োগ করেন। তখনকার দিনের ব্যাপার-স্যাপার বড়ো সোজাসুজি এবং ক্রুড ছিল। ভন্ডামি কম ছিল অনেক। অস্ত্রশস্ত্রও আজকালকার মতো এত বিধ্বংসী ও কুটিল ছিল না। ইনকাম-ট্যাক্স, কাস্টমস, ফেরা অ্যাক্ট ইত্যাদি কত অস্ত্র আছে এখন দিশি স্বৈরাচারীদের হাতে। দিশি স্বৈরাচারী!
ছোঁড়াকে হাত-কড়া পরিয়ে ঘোড়ার পিঠে পিছমোড়া করে বেঁধে সদরে নিয়ে গেল। ঘোড়সওয়ার পুলিশেরা।
ওরা চলে যেতেই ক্যাশিয়ারবাবু এক-শো টাকার নোটটা বুড়ো বেয়ারাকে দিয়ে বলল, তুমি পঞ্চাশ নিয়ে আমাকে পঞ্চাশ দিয়ো।
চার দিন পর এস পি রবার্টসন ছোঁড়াটাকে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিল।
বলল, যা:, তোর ছুটি। রবার্টসনরা আর পুলিশের ইনফর্মার এবং দালালরা তখনও ছিল। এখনও আছে। একই ট্র্যাডিশান সমানে চলেছে। বদলায়নি কিছুই।
কোমরে-বাঁধা হোলস্টার থেকে আস্তে করে ওয়েবলি-স্কটের রিভলবারটা বের করে নির্ভুল নিশানায় ‘পাক্কিটাডাও চোকরার’ হৃদয় যাতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তেমন করে একটি গুলি করল পেছন থেকে রবার্টসন। ছোঁড়া এই দেশের সোঁদা-গন্ধ মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। দমকে দমকে রক্ত বেরুতে থাকল টুকটুকে মুখটি থেকে। কাতরাতে কাতরাতে ছোঁড়া বলল, আঃ, মা! আঃ, বাবা!
মরার সময় ওর মনে হল যে, এই দেশটা শুধু গিলিগানের নয়, ক্যাশিয়ারবাবুর নয়; বুড়ো বেয়ারাটারও নয়। দেশটা তার, তার কুজাতা মায়ের, তার অনামা বাবার এবং কোটি কোটি মানুষের, যারা এখনও কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে আছে; সারমেয়র মতো ল্যাজ নাড়ছে। যতদিন ওরা গিলিগানদের মদত জোগাবে, ততদিন গিলিগানরাই মসনদে বসে থাকবে। বংশপরম্পরায়।
পুলিশের ডায়েরিতে লেখা হল, যেমন পরে বহুবার হয়েছে। ডায়েরিতে লেখা হল: ‘শট, হোয়াইল ট্রায়িং টু এস্কেপ ফ্রম পোলিস কাস্টডি।’
রিভলবারের আওয়াজে নির্জন জঙ্গলের মধ্যে শয়ে-শয়ে পাখি উল্লাসে কাকলিমুখর হয়ে উঠল পাক্কিটাডাও চোকরাটির মৃত্যুতে। যে-পাখিদের সে তাড়িয়ে বেড়াত, সেই ছোট্ট ছোট্ট পাখি, ছোট্ট ছোট্ট সুখের সব পাখিরা সবাই আনন্দে মাতল।
রিভলবারটি হোলস্টারে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে রবার্টসন নিরুচ্চারে বলল, ‘গড সেভ দ্য কিং।