বাংলাদেশ পাকিস্তানের মতো হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা না করে বরং পাকিস্তান বাংলাদেশের মতো হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা উচিত। পাকিস্তানেও বাংলাদেশের মতো হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। গত শনিবার রাতে পাকিস্তানের করাচি শহরে এক সেক্যুলার ব্লগার খুন হয়েছেন। নাম খুররাম জাকি। খুররাম তার এক বন্ধুর সঙ্গে একটি ক্যাফেতে বসে ডিনার করছিলেন। তখন দুটো মোটরসাইকেলে চারজন লোক এসে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। অন্য কারও দিকে অস্ত্র তাক করা হয়নি। আশেপাশের কয়েকজন আহত হয়েছেন। কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল খুররাম জাকিকে হত্যা করা। বাংলাদেশের প্রগতিশীল লেখক, ব্লগার, মুক্তচিন্তক, বুদ্ধিজীবী একের পর এক খুন হচ্ছেন। পাকিস্তানে এই হত্যাকাণ্ড সবে শুরু হয়েছে। অনুমান করছি ইসলামী মৌলবাদীরাই খুনগুলো করছে। খুন করেছে এই দাবি তো তারাই করছে।
খুররাম, আমার মন বলছে, নাস্তিক ছিলেন। খুররাম জাকির দোষ অনেক, তিনি শিয়া সম্প্রদায়ের লোক। সুন্নি মৌলবাদের নিন্দে করতেন। লাল মসজিদের ইমাম আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন খুররাম জাকি। লাল মসজিদ সুন্নি মৌলবাদীদের আখড়া, মনে আছে ২০০৭ সালে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লাল মসজিদে মোশাররফের মিলিটারি অপারেশন? আবদুল আজিজ বড়ই কট্টরপন্থি সুন্নি। তিনি কারও অনুরোধেই ২০১৪ সালে তালিবানিদের ঘটানো হত্যাযজ্ঞের নিন্দে করেননি। তালিবানরা পেশোয়ারের এক স্কুলে ঢুকে ১৩২ জন স্কুলছাত্রকে খুন করেছিল, সেই তালিবানি হত্যাযজ্ঞের নিন্দে করতে আবদুল আজিজ অস্বীকার করেন। তখন খুররাম জাকি ইমামের গ্রেফতার দাবি করেছিলেন। ‘সিপাই সাহাবা’ নামের এক নিষিদ্ধ জঙ্গি দলের বিরুদ্ধেও সরব হয়েছিলেন খুররাম। সম্প্রতি লন্ডনের নতুন মেয়র সাদিক খানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন, যে সাদিক খান পাকিস্তানে জন্ম নিয়েও শুধু ইওরোপের শিক্ষা সংস্কৃতি গ্রহণ করে আধুনিক তো হয়েছেনই, খাঁটি সেক্যুলারও হয়েছেন। খুররাম জাকি পাকিস্তানের নির্যাতিত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শিয়া, সুফি, আহমদিয়া, খ্রিস্টান, হিন্দুর মানবাধিকারের পক্ষে লিখতেন। মানবাধিকারের পক্ষে কলম ধরার এবং মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করার কারণে মৌলবাদীরা খুররাম জাকিকে খুন করেছে।
বাংলাদেশের মৌলবাদীরা কুপিয়ে মারে, পাকিস্তানেরগুলো গুলি করে। কুপিয়ে মারলে নাকি পুণ্য হয় বেশি। এক নম্বর বেহেস্তে স্থান জোটে। বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা পাকিস্তানের সন্ত্রাসীদের থেকে তুলনায় তাহলে পুণ্যবান। মৌলবাদ আর অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে কথা বললে বাংলাদেশে আর পাকিস্তানে আজকাল খুন হয়ে যেতে হয়। করাচিতে দু’বছর আগে আর্ট সেন্টারের ডিরেক্টর সাবিন মাহমুদকে খুন করেছে মৌলবাদীরা। বেলুচিস্তানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে— এই নিয়ে তিনি একটি তার সেন্টারে আলোচনার আয়োজন করেছিলেন। অপরাধ সেটিই। পারভিন রহমান নামের একজন মানবাধিকার কর্মীকেও খুন করেছে ওরা।
‘লেট আস বিল্ড পাকিস্তান’ নামের ব্লগের সম্পাদক ছিলেন খুররাম জাকি। ওই ব্লগের সম্পাদকমণ্ডলীর প্রধান আলী আব্বাস তাজ বলেছেন, তালিবান আর সুন্নি মৌলবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার কারণে খুররাম জাকিকে খুন হতে হয়েছে।
খুররাম জাকির মরদেহ পাকিস্তানের পতাকায় মুড়িয়ে কবর দেওয়া হয়েছে। শত শত মৌলবাদবিরোধী মানুষের ভিড় ছিল সেখানে। বাংলাদেশে এমন দৃশ্য দেখা যায় না। খুন হওয়ার পর চুপচাপ সরিয়ে ফেলা হয় মুক্তচিন্তক ব্লগারদের মৃত শরীর। গোপনে সৎকার করা হয়। মরদেহ পতাকায় মোড়ানো, শত শত মানুষের জমায়েত!— এসব হওয়ার মতো পরিবেশ এখন আর বাংলাদেশে নেই, এখনো পাকিস্তানে আছে।
বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে যে প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, লেখক, শিল্পী, মুক্তচিন্তক হত্যার যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, তা বড়ই ভয়ংকর। আর কোনও দেশ যেন বাংলাদেশের এই সংস্কৃতি অনুসরণ না করে। পাকিস্তানকে লোকে মৌলবাদী দেশ বলে। পাকিস্তানেও কিন্তু অন্যায়ের বিচার হতে দেখি। বাংলাদেশে এতগুলো সেক্যুলার ব্লগারকে সন্ত্রাসীরা মেরে ফেললো, কোনও খুনিকেই ধরা হলো না, শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা। আর পাকিস্তানে সালমান তাসিরকে যে ইসলামী সন্ত্রাসী খুন করেছিল, তার কবে ফাঁসিও হয়ে গেছে। পাকিস্তানে মুক্তচিন্তায় বিশ্বাস করা মানুষের বিচার হতে পারে, বাংলাদেশে কেন পারে না? পাকিস্তান যদি মৌলবাদী দেশ, তবে বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের চেয়েও বড় মৌলবাদী দেশ? আমরা কি একাত্তরে পাকিস্তানের চেয়েও বড় মৌলবাদী দেশ হওয়ার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম?
সোর্স : বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১২ মে, ২০১৬