পাকিস্তানি শত্রুতা ও কয়েকজন কুখ্যাত শত্রু
পাকিস্তান বহুমুখি শত্রুতা চালায় বাঙলার বিরুদ্ধে;- বাঙলা ভাষাকে শরীর ও আত্মায় বিনাশ করাই ছিলো পাকিস্তানি লক্ষ্য। পাকিস্তান ও পাকিস্তানি শাসকচক্র সর্বাংশে মধ্যযুগীয়; সামন্ত-ও সেনা-তান্ত্রিক। পাকিস্তান ছিলো যে-কোনো প্রগতির শত্রু। পাকিস্তানের পিতাপিতৃব্যরা বেশ দূরদৃষ্টিসম্পন্নও ছিলেন;- একটি দুঃস্বপ্ন তাঁদের সব সময় তাড়া করতো যে পাকিস্তান নামক অপরাষ্ট্রটি অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে। সাতচল্লিশ থেকে একত্তর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাকিস্তানের প্রভুরা যে সমস্ত ‘ভাষণ’ দিয়েছেন, সেগুলোর পংক্তিতে পংক্তিতে দেখেছেন তাঁরা শত্রু কম্যুনিস্টদের, বিদেশের অনুচরদের, ইসলামবিরোধীদের। তাঁদের দুঃস্বপ্নে ঢুকে গিয়েছিলো বাঙালি ও বাঙলা ভাষা। এ-ভাষাটিই নাশ করবে পাকিস্তান- এমন বিশ্বাসে তাঁরা বাঙলা ভাষার বিরুদ্ধে লেগেছিলেন, এবং তাঁদের প্রতিটি পদক্ষেপ দেশকে এগিয়ে দিয়েছিলো বিনাশের দিকে। পাকিস্তানের জন্মের এক মাস আগেই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দীন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দিয়ে বাঙলাদেশে ভাষা-আন্দোলনের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। পাকিস্তানে বাঙলার সাথে যিনি প্রথম শত্রুতা শুরু করেন, তিনি পাকিস্তানের ‘পিতা’ মুহম্মদ আলি জিন্না। ১৯৪৮-এ খাজা নাজিমুদ্দিন বাঙলার সাথে শত্রুতা ও বিশ্বাসঘাতকতা শুর করেন। ১৯৪৮-এর মার্চ মাসে জিন্না ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন যাঁরা বাঙলা ভাষার পক্ষে আন্দোলন করছেন, তাঁরা ‘নানা বিদেশী এজেন্সির অর্থসাহায্যপুষ্ট’ চর; আর পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়।’ তবে ছাত্রদের প্রচণ্ড প্রতিবাদে দমে গিয়েছিলেন পাকিস্তানের পিতা।
পাকিস্তানি শত্রুতা ছিলো বহুমুখি : শাসকগোষ্ঠি কখনো বাঙলাকে ত্যাগ করতে চেয়েছে, কখনো দিয়েছে পৌত্তলিক উপাধি; কখনো লিপি পাল্টাতে চেয়েছে আরবিতে-রোমানে, কখনো করেছে যুক্তাক্ষরের নিন্দা; এবং সব দিকে লোক লাগিয়েছে বাঙলা ভাষাকে কোনো-না-কোনোভাবে আহত করতে। বাঙলার আলোবাতাসখাদ্যে বেঁচে থেকে যাঁরা বাঙলা ভাষার সাথে শত্রুতা ক’রে চিরকুখ্যাত হয়ে আছেন, তাঁদের তিনজন : খাজা নাজিমুদ্দিন, ফজলুর রহমান, ও নুরুল আমিন। এঁদের সাথে ছিলেন বহু আমলা, ক্ষমতালোভী রাজনীতিক, ও কিছু সুবিধাবাদী শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাজিমুদ্দিন ছাত্রদের অনেক দাবির মধ্যে মেনে নিয়েছিলেন এ-দাবিটি : ‘এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এই মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে এদেশের সরকারি ভাষা হিশেবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাঙলা তাহার স্থলে সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাঙলা।’ কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে-দাবিটি তিনি মেনে নিয়েছিলেন, সেটি এমন : ‘১৯৪৮-এর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাঙলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলোচনার জন্য যে-দিন নির্ধারিত হইয়াছে সেইদিন বাঙলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষাদিতে উর্দুর সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।’ কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা যেহেতু পাকিস্তানি নেতাদের অন্য নাম, তাই নাজিমুদ্দিন তাঁর চুক্তি পালন করেন নি। পাকিস্তানের বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান, উর্দু যিনি কোনোদিন ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারেন নি, ছিলেন বাঙলার প্রধান শত্রুদের একজন। অজস্র অপস্বাপ্নিকে পূর্ণ পাকিস্তানে ফজলুর রহমান আবির্ভূত হয়েছিলেন আরবিলিপির অপস্বাপ্নিকরূপে। তাঁরা কেউ ধর্মনিষ্ঠ না হ’লেও ইসলাম ও আরবিকে ব্যবহার করেছেন নবনব ষড়যন্ত্রের যন্ত্ররূপে; বাঙলাকে আরবিলিপির দ্বারা পর্যুদস্ত করা ছিলো এসব ষড়যন্ত্রের একটি। ফজলুর রহমান চট্টগ্রামের ইস্কুল শিক্ষক আবদুর রহমান বেখুদকে দিয়ে ‘হুরুফুল কোরান’-এর নামে আরবি বর্ণমালা দিয়ে বাঙলা বর্ণমালাকে বিনষ্ট করার চেষ্টা চালান। এ-মন্ত্রী তাঁর চক্রান্ত বাস্তবায়িত করার জন্য একজন উর্দুভাষী জনশিক্ষা পরিচালককে দিয়ে এমন প্রস্তাব পেশ করিয়েছিলেন যে ‘বাঙালী মুসলমানদের ভাষা উর্দুরই একটি রূপান্তরমাত্র এবং উর্দু হরফে লিখলে তা উর্দু বলেই মনে হবে।’
নূরুল আমিন কুখ্যাত হয়ে আছেন বায়ান্নোর রক্তপাত ঘটানোর জন্যে। কুখ্যাতিতে বাঙলার ইতিহাসে তিনি মীরজাফরের প্রতিদ্বন্দ্বী। একুশের মহাবিপ্লবের পর নূরুল আমিন ‘ভাষা আন্দোলনের অন্তরালে’ নামে যে-বেতার বক্তৃতা দিয়েছিলেন, বাঙলা ভাষার সাথে শত্রুতার ইতিহাসে সেটি লিখিত থাকবে কালো অক্ষরে। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ‘উজিরে আলা’; এবং সিদ্ধান্তে এসেছিলেন : ‘রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি আসল প্রশ্ন নয়, ইহার পশ্চাতে সরকারকে বানচাল করার জন্য বিদেশী দালাল ও অন্যান্যদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নিহিত।’ খুনের সফলতায় তৃপ্ত হ’য়ে তিনি জানিয়েছিলেন : ‘সরকার এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হইয়াছিলেন যেখানে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা ছাড়া আর গত্যন্তর ছিলনা। কম্যুনিষ্ট, বিদেশী চর, এবং হতাশ রাজনৈতিকদের ধ্বংসাত্মক চক্রান্ত অঙ্কুরেই বিনষ্ট হইয়াছে।…যদি দৃঢ়তার সঙ্গে এই অরাজকতা দমনে আমি ও আমার সহকর্মীগণ অগ্রসর হইতে না পারিতাম, তাহা হইলে জনগণ ও ইসলামের প্রতি কর্তব্য সম্পাদনের আমরা আপনাদের সামনে ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের সামনে নিশ্চয়ই অপরাধী সাব্যস্ত হইতাম।’ তাঁর দাবি চমৎকার, খুন না করলে তিনি অপরাধী হতেন! কিন্তু তিনি অপরাধী নিন্দিত ঘৃণিত হয়ে থাকবেন চিরকাল। বাঙলা বিনাশের চক্রান্তরূপে ওই গোষ্ঠি একরকম ‘পাকিস্তানি বাঙলা’ বিকাশেরও চেষ্টা করেছিলেন। এই ‘পাকিস্তানি বাঙলা’র চেহারা এমন :
গোজাশতা এশায়াতে আমরা অতীতে বাঙলা ভাষার নানা মোড় পরিবর্তনের কথা মোতাসারভাবে উল্লেখ করেছিলাম। বাঙলা ভাষা মুসলমান বাদশাহ্ এবং আমীর-ওমরাহদের নেক নজরেই পরওয়ারেশ পেয়েছিল এবং শাহী দরবারের শান-শওকত হাসিল করেছিল।- (মাহে-নও, ১ : ৭, ১৯৪৯)।
একটি সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ও গ’ড়ে উঠেছিলো পাকিস্তানের উদ্ভবের সাথেসাথেই, এবং তাঁদের সুবিধাবাদের ক্ষতিকর ক্রিয়া থেকে আমরা এখনো মুক্তি পাই নি। তাঁদের মূলধন, পাকিস্তানের শাসকদের মতোই ছিলো প্রতিক্রিয়াশীলতা। গোলাম মোস্তফা, যিনি বাঙলা ভাষার সাধনা করেছিলেন নিষ্ঠার সাথেই, তিনিও বাঙলা ভাষার বিরুদ্ধে একরাশ যুক্তি উপস্থিত করেছিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নামক একটি পুস্তিকায়। তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁচেছিলেন : ‘যে-ভাষা পাকিস্তানের অস্তিত্ব, স্বার্থ ও আদর্শের অনুকূল হইবে, সেই ভাষাই হইবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এ-সিদ্ধান্তের পর তিনি বাঙলা ভাষায় আবিষ্কার করেন ‘পাকিস্তানের অস্তিত্ব, স্বার্থ ও আদর্শের’ প্রতিকূলতা; আর উর্দুতে খুঁজে পান অনুকূলতা। সাম্প্রদায়িকতাবশত তিনি উপনীত হয়েছিলেন নিম্নরূপ সিদ্ধান্তে :
বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠত্ব লইয়া হিন্দুর ন্যায় মুসলমানেরাও যদি গর্ব করে, তবে সে-গর্ব আমাদের আত্মবিস্মৃতি ও দাসমনোভাবেরই পরিচয় বহন করে। আর ঠিক এই কারণেই উর্দুর দাবী বলিষ্ঠ হইয়া উঠে।
তাঁর এ-সাম্প্রদায়িক পথ ধ’রেই অনতিপরেই সৈয়দ আলী আহসান পাকিস্তান রক্ষার জন্যে রবীন্দ্রনাথকেও বর্জনের প্রস্তাব করেন। বাঙলার সাথে শত্রুতার এ-রূপ দেখে ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন ১৯৪৮ সালেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন :
বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালী হিন্দু মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। শীঘ্রই তা হ’লে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে।— (সওগাত, ৩০ : ১, ৯-১৪)।
তাঁর দূরদৃষ্টি বিস্ময়কর ও দুঃসাহসিক