পাকদণ্ডী – ২.৫

॥ ৫ ॥

এখন কথা হল স্মৃতিকথা লিখতে গেলে লেখক কি লিখবেন আর কি বাদ দেবেন। তাঁর কাছে যে সব তথ্যের গুরুত্ব আছে ; বাইরের লোকে তার কি বুঝবে? তিনি যা দেখছেন, যা শুনছেন, যা পড়ছেন, যা ভাবছেন, তাই দিয়ে তাঁর মন তৈরি হচ্ছে। সেই মনের চোখ দিয়ে তিনি জীবন দেখছেন। ছোট ছোট সত্যি ঘটনা, নগণ্য সব সত্যিকার মানুষ, ভুলে-যাওয়া খুদে ঘটনা—এইসব দিয়ে তাঁর মনের পটভূমিকা তৈরি হচ্ছে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জীবন দেখছেন; সেই দেখাটুকু দিয়েই তাঁর সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে। তাই সেই দেখাটা হতে হবে সৎ, সততাপূর্ণ, উদার, ক্ষমাশীল। আর কোন নিয়ম মানতে চান না লেখক। কেবল ঐ জিনিসই তাঁর মনের ওপর রেখাপাত করে, অন্য সব কৃত্রিম সাফল্য ধুয়ে মুছে লুপ্ত হয়ে যায়। লেখক যেটাকে সত্যি বলে দেখছেন, সেটাই তাঁর কাছে সত্যি হয়ে উঠছে। জাত লেখকরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হন না। কলমের আগায় যে কথা ঝরে পড়ে তার উৎস হল মনের গহনে। কোনো অদৃশ্য অন্তর্বাসী পুরুষের ছাড়পত্র পেয়ে, তবে সে লেখা বেরোয়। তবু ভুল হয়, ব্যতিক্রম হয়, কারণ স্মৃতির আধার হল ভ্রান্তিশীল মস্তিষ্ক। আর যাঁরা হৃদয়ের তাগিদে না লিখে, অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে কৃত্রিম ভাবনা লেখেন, তাঁরা জাত লেখক নন। নিজের পক্ষে এইটুকুই আমার বলা দরকার। যদি কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকি, সে আমার ইচ্ছাকৃত নয়। যেমন যেমন মনে পড়েছে, তেমনি লিখে গেছি। সব জায়গায় হয়তো মাত্রা ঠিক থাকেনি।

সে যাই হক, ১৯৪১সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সকলের অলক্ষে একটা মহান্ যুগ শেষ হয়ে গেছিল। তার পরেই যে অত বড় একটা যুদ্ধ বাধবে। এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। মাঝে মাঝেই সন্ত্রাসমনা বন্ধু-বান্ধবরা পৃথিবীর আসন্ন দুর্বিপাকের কথা বলে যেতেন। তাতে আমি একটুও ভয় পেতাম না। থেকে থেকেই তো নানা ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী শুনে এসেছি। আরেকটা মহাযুদ্ধও তো আমাদের শৈশবে সংঘটিত হয়েছে, সে যুদ্ধের এতটুকু আঁচও আমাদের গায়ে লাগেনি। আমার বয়স তখন ৬-৭। বেলজিয়ম থেকে সর্বহারা একজন কম বয়সী শিক্ষিকা আমাদের শিলং-এর স্কুলে পড়াতে এলেন। কেউ একটু দুষ্টুমি করলে কেঁদে ফেলতেন। ১৯১৫ সাল থেকে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণে, প্রাইজের বদলে বড় বড় কার্ড দেওয়া হতে লাগল। তাতে ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রের মানচিত্র। সেলাই ক্লাসে আমরা সবাই যুদ্ধরত সেপাইদের জন্য গলাবন্ধ বুনতে লাগলাম। শুনলাম তাদের ‘টমি’ বলতে হয়। তারপর ক-বছর পরে যুদ্ধ থেমেও গেল। যেদিন খবর এল, সেদিন আমাদের স্কুল মোমবাতি দিয়ে সাজানো হল। বছরের শেষে আবার পুরস্কার দেওয়া হল। এই রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে, এবারো ঘাবড়াবার কোনো কারণ দেখলাম না।

কাগজে দেখতাম ইউরোপের দেশগুলো ঝগড়াঝাঁটি করতে করতে, ক্রমে দুটো দলে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। তার সঙ্গে আমাদের কি? আমরা যে পরাধীন সেই পরাধীন। আবার একদিন কাগজে একটা ছোট্ট খবর দেখলাম যে কাদের একটা জঙ্গী জাহাজ ব্যাংককের দিকে এগুচ্ছে। মনে হয় জাপানী জাহাজ। জাপানীরা শত্রুপক্ষের বন্ধু। তখনো ব্রিটিশদের বন্ধুদের ভারতের বন্ধু, আর শত্রুদের ভারতের শত্রু বলে মনে করার নিয়ম ছিল। তবে দেশে যে অন্যরকম মতের লোকও আছে তাও জানতাম।

এর দু’চার দিন পরে আমাদের প্রিয় বন্ধু অধ্যাপক সুশোভন সরকার এসে কথাচ্ছলে বললেন যে যুদ্ধ একটা বাধতে চলেছে এবং সেটা এই পূর্বদিকেও সে পাওয়া যাবে। শুনে অবাক হলাম। মানুষটি বিচক্ষণ ঐতিহাসিক। আরো বললেন যে দুটো ক্ষেত্রে যুদ্ধ হওয়ার কয়েকটা সুবিধা আছে। কলকাতায় যাদের কাজকর্ম নেই, এইরকম লোকদের অন্য কোথাও সরে যেতে বললেও আশ্চর্য হবার নেই। আলোক-নিয়ন্ত্রণ তো আরম্ভই হয়ে যাচ্ছে। তাই হলও অল্প সময়ের মধ্যে। কয়েক হাজার লোক অস্থায়ী চাকরি আর উর্দি পেল। কয়েক নিযুত কালো কাগজের ঘেরাটোপের দরকার হল আলো নিয়ন্ত্রিত করবার জন্য। অর্থাৎ যাতে বাইরে থেকে এক চিলতেও না দেখা যায়। খালি আলোর নিচে একটুখানি গোল জায়গায় আলো পড়ে। দরজা জানলায় কালো পরদা ঝুলনো হল। স্কাইলাইটে আঠা দিয়ে কালো কাগজ সাঁটা হল। গাড়ির হেডলাইট বে-আইনি হল। অন্য আলোর তিনভাগ কালো রঙের প্রলেপে ঢাকা পড়ল। সব নিয়ন বাতি, দোকানের হোটেলের সাইনবোর্ডের আলো নিবল। ক্রমে সমস্ত শহরটা একটা ভুতুড়ে চেহারা নিল। অবিশ্যি অল্পে অল্পে সইয়ে সইয়ে।

দেশের পূর্বাঞ্চল দিয়ে শত্রু আসবে অতএব ঐদিকের শহরগুলোতেই যত কড়াকড়ি, পশ্চিম দিক আলোয় আলো। আমাদের এক আত্মীয় বললেন ‘যত সব বাজে ব্যবস্থা। এরোপ্লেনে উঠে দেখলাম সব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।’ বেশ মজাও হত মাঝে মাঝে। রাস্তা থেকে এ-আর-পির লোকরা হাঁক দিত, ‘ও ১৭নম্বর মশাই, আলো নেবান, দেখতে পাচ্ছি।’ ১৭নম্বরের মশাই রেগেমেগে বলতেন, ‘যেতেই পারে না। প্রত্যেক আলোতে দেড় টাকা দামের ঘেরাটোপ দিয়েছি না!’ ‘তাহলে নেমে এসে দেখুন, রান্নাঘরের আলো দেখা যাচ্ছে কি না।’

ক্রমে সত্যি সত্যি বাড়তি নাগরিকরা কলকাতা থেকে সরতে লাগল। যাদের মফঃস্বলে ছুটি কাটাবার আস্তানা ছিল, তারা ছেলেপুলে নিয়ে সেখানে গেল। অন্যরা যে যেখানে পারে থাকবার জায়গা দেখতে লাগল। এরি মধ্যে যুদ্ধের আবহাওয়া আরো জমতে লাগল, হয় তো ব্যবস্থাপনার ফলেই। কারণ কে শত্রু কোথায় শত্রু ব্রিটিশ সরকারের সতর্কতায় কাগজে ঘুণাক্ষরেও আসল কথা বেরুত না। সুভাষ বোস নিজেদের বাড়ি থেকে অদৃশ্য হলেন এ খবর চেপে রাখা যায় নি। কিন্তু তারপর কোথায় গেলেন, কি করলেন, সে বিষয় সম্পূর্ণ ব্ল্যাক আউট। অবিশ্যি কিছু খবর আসতই। লোকের মুখ কে বন্ধ করবে? ভারতীয় নেতারা ব্রিটিশদের সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন তবে সাধারণ লোকের তাতে কি!

তারপর হাজরা রোডের বাড়িটাকে সরকারি কাজের জন্য নেওয়া হল। বাড়ি ছেড়ে দিতে হল। জিনিসপত্র এর ওর বাড়িতে জমা করে দিয়ে, হয়তো মার্চ মাসের কোনো সময় ছেলেমেয়ে আর গোটা দুই লোক নিয়ে আমিও কৃষ্ণনগরে একটা ভাড়া বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। উনি রইলেন কলকাতায়, হাসপাতাল ইত্যাদিতে ডিউটি নিয়ে। ঐ আমার বাংলার ছোট শহরের প্রথম অভিজ্ঞতা। এখন মনে হয় মন্দ ছিল না শহরটি। চুপচাপ শান্তশিষ্ট শহরটি হঠাৎ অভাবিত সংখ্যায় কলকাতাবাসীর আগমনে চঞ্চল। ঘর-বাড়ি, গোয়াল, শেড, সব ভাড়া হয়ে গেল। মাথার ওপর একটা ছাদ পেলেই লোকে খুশি। কলকাতায় বোমা পড়বে, সবার মনে এই ভয়! চুরি-চামারিও অসম্ভব বেড়ে গেল। স্থানীয় অধিবাসীরা বেশ বিরক্ত।

আমরা স্টেশনের বেশ কাছেই একটা একতলা বাড়ির আধখানা পেয়েছিলাম। কিছু ভারি ভারি সেকেলে তক্তাপোষ ছিল ঐ বাড়িতে। তাদের পায়াতে গায়েতে গুপ্ত খোপটোপ ছিল। বাড়ির মালিক গোপাল ঘোষকে বড় ভালো লাগত। তাঁর স্ত্রীটি মাটির মানুষ। জীবন কেটেছে বর্মায়, তাই সাধারণ বাঙালী ছোট শহরের বাসিন্দাদের চেয়ে একটু উদার দৃষ্টি। বর্মার গল্প বলতেন। সেখানে তাঁর ভাইয়ের পরিবার থেকে গেছিল। যুদ্ধের হাঙ্গামা বাধতেই বিধবা ভাইবৌ আর তাঁর মেয়েটি প্লেনে জায়গা পেয়ে চলে এসেছিলেন। ছেলেদের সে সময়ে প্লেনে জায়গা কুলোত না, তারা তিনচার জন, বড় দলের সঙ্গে হাঁটা পথে আসছিল। তাদের মা-বোন নানা রকম বিপদ আশঙ্কা করে কেঁদে কেটে একাকার হতেন।

কলকাতার হাঙ্গামা এড়াবার জন্য কৃষ্ণনগরে এসে বুঝলাম যুদ্ধের ঢেউ এইখানেই ভাঙছে। পরে অবিশ্যি খবর পেয়েছিলাম ছেলেরা সবাই নিরাপদে আছে। হাঁটা পথে যারা এসেছিল আর যারা থেকে গেছিল সবাই।

সব জায়গায় খালি যুদ্ধের সর্বনাশের গল্প। কলকাতা নাকি এবার বিধ্বস্ত হয়ে যাবে, আর উঠবে না। জানতাম সব বাজে কথা, তবু বড়ই মুষড়ে পড়তাম। জিনিসপত্রের ভারি সুবিধা ছিল। নদীর মিষ্টি মাছ, গয়লাবাড়ির খাঁটি গাওয়া-ঘি, ঘানি থেকে তেল, বাড়িতে দিয়ে যেত সরপুরিয়া, সরভাজা। কিচ্ছু ভালো লাগত না। তিন মাস ছিলাম, এক লাইনও লিখিনি মনে হচ্ছে। ডিকেন্সের রচনাবলী ২৪খণ্ড নিয়ে গেছিলাম। আগাগোড়া মন দিয়ে পড়তাম। সেগুলো আমার সারা জীবনের পাথেয় হয়ে আছে।

ভারি নিঃসঙ্গ বোধ করতাম, যদিও চেনা-জানা বন্ধু কেউ কেউ ছিলেন। সুরেন ঠাকুরের বড় জামাই ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আমার স্বামীর ছাত্রজীবনের বন্ধু। যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি স্পষ্ট বক্তা। ভারি ভালো লাগত। ভারি কৌতূহলও হত তাঁর বিষয়ে, কারণ তাঁর মা ছিলেন বিদ্যাসাগরের দৌহিত্রী আর বাবা ছিলেন রামমোহন রায়ের বংশের ছেলে, আবার বিয়ে করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতির মেয়েকে, এক রকম বলিষ্ঠতা আর উদারতা আর কোমলে কঠোরে মিশ্রণ ছাড়া। তাই বা কম কিসের।

আমার স্বামীর আরো কিছু বন্ধুবান্ধব ছিলেন। আমার কেউ ছিল না, যার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি। এরি মধ্যে হঠাৎ রবীন্দ্রলাল রায় শান্তিপুর থেকে এসে গল্পগুজব ক্যারিকেচিওর করে বাড়ি মাতিয়ে দিয়ে গেল। আমার ছেলেমেয়ে আর বাড়িওয়ালার বাড়ির সবাই মুগ্ধ।

কেষ্টনগরের দোলতলার মেলা দেখেছিলাম। রাজবাড়ির সামনে দোলের সময় থেকে এক মাস ধরে ঐ মেলা বসে। কত রকম স্থানীয় জিনিস, অপূর্ব সব মাটির পুতুল আর বাংলার শ্রেষ্ঠ মিষ্টান্ন, ঐখানে সবাই কিনে নিয়ে যেতে লাগল। সার্কাস হত। একদিন মেলায় মাঠে একটা বদমেজাজি উট আমাদের তাড়াও করেছিল। ধরতে পারলে নিশ্চয় খেয়েই ফেলত, অন্তত মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছিল। আমরা পালিয়ে বাঁচলাম।

তারপর ছেলেমেয়ের জ্বরজারি হতে লাগল, শেষ পর্যন্ত দার্জিলিং-এ দিদির কাছে যাওয়াই স্থির হল। আমার সুন্দর-জ্যাঠামশাই কেষ্টনগরে বাড়ি খুঁজছিলেন, ওঁদের কাছে ঘরদোর এবং অধিকাংশ জিনিসপত্র ছেড়ে আমরা কলকাতা চলে এলাম। ততদিনে হাজরা রোডের বাস উঠে গেছে। চৌরঙ্গীতে আমার স্বামীর চেম্বারের অন্য ডাক্তারটি চলে গেছিলেন, আমরা সেই খালি ঘরে উঠলাম। এসেই বুঝলাম কাজটা স্বার্থপরের মতো হল। মাসে দু-একবার আমার স্বামী কেষ্টনগরে যেতেন, দার্জিলিং এ হয়তো দুমাসে একবার হলেই ঢের। সত্যি কথা বলতে কি জীবনের ঐ তিনটি মাস আমি নষ্ট করেছিলাম। নিজের মনের অসন্তোষ নিয়ে ডুবে থেকে ভুলেই গেছিলাম এই সেই কৃষ্ণনগর, বাংলা সংস্কৃতির একটি লালনভূমি। দেখতেও বড় সুন্দর। গোপালবাবু একদিন রাজবাড়ির চারপাশের আমবাগানের মাঝে মাঝে বড় বড় ঘন কালো পুকুর আর বাঁধানো ঘাট দেখিয়ে বলেছিলেন, ঐ সব হল সেকালের রাজাদের জামাই-বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। পুকুরে বড় বড় মাছ ঘাই দেয়, আম-শাখা ফলের ভারে নুইয়ে পড়ে। কিন্তু জামাইরা আর নেই। সব অযত্নে পড়ে আছে। মনে আছে মনটা ভারি হয়ে উঠেছিল। আমার মাঝে মাঝে ঐ রকম হয়। মনটা নিষ্ফলা মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যায়। কিছু লিখতে পারি না। লিখতে হলে আমার মনের মুক্তির দরকার হয়। অন্যান্য সাংসারিক ভাবনা চিন্তা ঝেড়ে ফেলার ক্ষমতা বিধাতা খানিকটা দিয়েছেন। কিন্তু সৃষ্টির কাজ করতে যে অনাবিল স্বতঃস্ফূর্ত রসের উৎস দরকার, কৃষ্ণনগরে সে উৎসের মুখ চাপা পড়ে গেছিল, বোধ হয় বড় বেশি নিজেকে নিয়ে নিবিষ্ট থাকায়।

বাড়িতে উঠোনে একটা দোতলার সমান উঁচু গন্ধরাজ গাছ ফুলে ফুলে আলো হয়ে থাকত। রাস্তা থেকে লোকে তার সুগন্ধ পেত। পাঁচিলের বাইরে একটা বকফুলের গাছ ছিল। বকফুল যে এত সুন্দর হয় আগে জানতাম না। তখন এ-সব চোখে পড়ত না, এখন মনে পড়ে। কলেজ পাড়া, নদীর ধার যে কত সুন্দর পরে যখন গেছি তখন লক্ষ করেছি। ঐ গোপাল বাবুর পরিবার ছাড়া কেষ্টনগরের সাধারণ লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। কবি দ্বিজেন্দ্রলালের পিতৃভূমি; কুমুদনাথ চৌধুরী আর তাঁর ভাই প্রমথ চৌধুরী এখানকার গল্প করতেন; যতদূর জানি এই শহর তাঁদের বাবার কর্মস্থল ছিল। এ সব কানে শুনেছিলাম, মনকে নাড়া দেয়নি। কেষ্টনগরের প্রতি মনে কোনো দুর্বলতা জন্মায়নি, তাই লিখবার জোর পাইনি।

মনকে নাড়া দিয়েছিল এর অনেক বছর পরে, হয়তো ১৯৬০ হতে পারে। দেশ কবে স্বাধীন হয়েছে, আমি কয়েক বছর হল কলকাতার বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। কোনো এক সাংস্কৃতিক সম্মেলন উপলক্ষে, একদিন দুপুর বেলায় মহিলা উৎসব অনুষ্ঠিত হল। আমি প্রধান অতিথি হয়ে সেই উৎসবে যোগ দিয়েছিলাম।

আমার ভাষণ শেষ হলে মঞ্চের পিছন দিকের কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নেমে দেখি এক সারি ৬০-৭০ বছরের প্রৌঢ়া মাথায় কাপড় দিয়ে, আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি বললাম, ‘বলুন, আমি কি করতে পারি।’ তাঁদের মধ্যে যাঁর বয়স সবচেয়ে বেশি তিনি আমার দুই কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কিছু না মা, খালি তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই। তোমার গায়ে একটু হাত দিলেই আমাদের মন ভরে যাবে। লেখায় আর বেতারে আমাদের মনের কথা তো বলেইছ।’

মনে হল আমারো মন কানায় কানায় ভরে গেল। এই মানুষদের আগে জানতে পারিনি বলে লজ্জা হল।

কলকাতায় ফিরে দেখলাম চৌরঙ্গী পাড়াটা বদলে গেছে। রেড্ রোড অঞ্চল স্রেফ একটি সামরিক বিমান ঘাঁটি। চার দিকে মার্কিন সেপাইরা গিজগিজ করছে। আমাদের বাড়িতে ঢুকবার পথে মার্কিন সেপাই ডিউটি দিচ্ছে! আমাদের মধ্যে আর আমরা নেই। সত্যি কথা বলতে কি দার্জিলিং-এ গিয়েও বিশেষ কিছু লিখিনি। তবে মেলা বন্ধুবান্ধব পাওয়াতে সময়টা আনন্দে কেটেছিল। দিদি তখন মহারানী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। এম. এ. পাস করে এই অর্কিড-লী বাড়িতে আমি এসে মাসতিনেক বাস করে, এই স্কুলেই পড়াতাম। সেই বাড়ির এক তলায় দিদির আরামের কোয়ার্টার। বাগানে তেমনি বিলিতি ফুল ফোটে, কিন্তু পাহাড়ের গা আঁকড়ে প্রকাণ্ড তিন তলা স্কুলবাড়ি হয়েছে। আর সেই ছোট-ছোট নীল পাখিরা লাল টিনের ছাদের তলাকার তাদের পুরনো আবাস ছেড়ে কোথায় চলে গেছে।

আমার মা বাবাও ঐ সময় ছোট একটা বাড়ি ভাড়া করে দার্জিলিং-এ ছিলেন। আমার ছোট বোনও এম. এ.বি-টিপাস করে মহারানী স্কুলে পড়াচ্ছিল। বরফের পাহাড় তেমনি সুন্দর। নিত্য আমরা এখানে ওখানে বেড়াতে যেতাম, চড়িভাতি করতাম। সেই মুহূর্তে পৃথিবীর অধিবাসীদের একটা বড় অংশ পরস্পরকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছিল। সুভাষ বসু রহস্যময় ভাবে অদৃশ্য হয়েছিলেন। দার্জিলিং-এ ভারতে উপস্থিত জার্মানদের ও তাদের বন্ধুদের আটক করে রাখা হয়েছিল। তবে বোধ হয় খুব কড়াকড়ি ছিল না। এখানে ওখানে তাদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যেত। আবার মার্কিনরাও হাওয়া বদল করতে এসে ফল পাকুড়ের দাম বাড়িয়ে দিত। সবাই ভারি বিরক্ত।

নভেম্বর মাসের শেষে আমরা সবাই সমতলে নেমে এলাম। ততদিনে যুদ্ধের আবহাওয়ায় সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছিল। তখনো সুভাষ বোসের বাহিনীর কীর্তিসমূহ বেতারে আর সব কাগজে এমনি বেমালুম চেপে রাখা হয়েছিল যে মাঝে মাঝে গুজব শুনলেও কেউ বিশ্বাস করত না। হরদম সাইরেন বাজত, গড়ের মাঠের কিনারা থেকে খুদে ব্রিটিশ জঙ্গী বিমানরা খ্যাঁক খ্যাঁক করে উড়ে পড়ত। কট্-কট্ গুলি চলত। ভারি একটা হুটোপাটির ধুম পড়ে যেত, যেই সাইরেন বাজত। রাতে হলে ‘আলো নিবাওরে’, দিনে রাতে ‘দরজা জানলা বন্ধ কররে, পরদা টানরে!’ পুরনো বাড়ি, তার বিশাল বিশাল দরজা-জানলা, নড়বড়ে হুড়কো ছিটকিনি। তা সে অ্যান্টি-এয়ারক্রাফ্টের শব্দেই সড়সড় করে নেমে পড়ে, জানলা হাট হয়ে খুলে যায়। তাই বোমার ভয়ে নয়, এ-আর-পির ভয়ে দড়ি দিয়ে জানলা বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করলাম। আমাদের মাঝের ঘরে সবাই মিলে জড়ো হতাম। এ-আর-পি থেকে বলে গেছিল ঐটেই সবচেয়ে নিরাপদ। ছেলেমেয়ের হাতে কমলালেবু ধরিয়ে দিতাম। তিনতলা চারতলার সাহেব মেম ভাড়াটেরা নেমে আসত। তাদের মুখ গম্ভীর।

আমরা তখনো মেনে নিতে পারিনি যে দোরগোড়ায় যুদ্ধ এসে এই পৌঁছল বলে। এমন সময় মধ্য ইউরোপ থেকে দু তিনটি জু ডাক্তার সর্বস্ব খুইয়ে সপরিবারে এসে তিনতলা চারতলার ভাড়াটেদের বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। এঁরা সকলেই মধ্য ইউরোপীয় জু ডাক্তার। যে যার নিজের ক্ষেত্রে খ্যাতিমান। এঁদের দেখে বুকটা ধড়াস্ করে উঠেছিল। বিমর্ষতার মূর্তিমান প্রতীক।

আরো পরে একদিন বোধ হয় দিনের আলোয় অ্যান্টি-এয়ারক্রাফটের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন ধুম্ধাম গম্ভীর আওয়াজ হল। বাড়িটাড়ি কেঁপে একাকার। মেমরা চোখ ঢেকে ভগবানকে ডাকতে লাগল। বোমার শব্দের সঙ্গে ওদের বেদনাময় পরিচয় আগেই হয়ে গেছে। তারপরে সাইরেনে অল্‌ক্লিয়ার। জানলা খুলে দেখি সব যেমনকে তেমন, কিছুই বদলায়নি। পরে শুনেছিলাম কিছু লোক মারা গেছে।

এই রকম দু চার দিন হল। চাঁদনি রাতকে সবাই ডরাত, বলাবলি করত চাঁদের আলোয় আসবে জাপানী বোমারুরা! এখন দিনের আলোয় বোমা পড়ার ফলে সে ভয় দূর হয়ে গেল। মেমরা আমাকে বলত, ‘দেশে কত দুঃখ কষ্ট পাবার পর এখানে এসে মনে হয়েছিল ভগবান আছেন তাহলে। সর্বস্ব গেছে, কিন্তু প্রাণটা আছে, দুটো হাত আছে আবার খেটে খাব। এখানেও বোমা পড়ছে দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় তবে কি তিনি সত্যি নেই? আবার অল্-ক্লিয়ারের পর জানলা দিয়ে তাকিয়ে নিচের দিকে দেখি তোমাদের ছাদে কুকুর নিয়ে তোমার ছেলেমেয়ে খেলা করছে। অমনি সব বিশ্বাস ফিরে আসে। আমরা নিজেরা হিংসাহিংসি করি আর তাঁর ঘাড়ে দোষ চাপাই! ছিঃ।’

তারপর চল্লিশ বছর কেটে গেছে, এখনো কোনো জঘন্য হিংসাত্মক ঘটনার কথা শুনলে ঐ পোলিশ মহিলার কথা মনে পড়ে। যুদ্ধের শেষে তারা সকলে নিরাপদে ফিরে গেছিলেন। কেউ স্বদেশে, কেউ অতিথিপরায়ণ আমেরিকায়।

ঐ তিন চার দিন ছাড়া বোমাও পড়েছিল বলে মনে পড়ে না। শুনি বাঙালীরা নাকি বেজায় ভীতু। যুদ্ধের নাম শুনেই যে ভাবে সরে পড়েছিল, তাতে সেরকম মনে হতেও পারে। কিন্তু সত্যি যখন যুদ্ধের হাওয়া ঘনিয়ে এল—অবিশ্যি পৌঁছায়নি শেষ পর্যন্ত—তখন দেখলাম অল্‌ক্লিয়ারের সঙ্গে সঙ্গে শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চলতে লাগল। জিনিসপত্রের দাম খানিকটা বেড়েছিল, কিন্তু এখন যেমন চোখের পলক না ফেলতে অকারণে ডবল হয়ে যায়, সে তুলনায় কিছু নয়। তার ওপর রাশিরাশি বিদেশী খাবার দাবার বাসনপত্র কাপড় চোপড় জলের দরে বিক্রি হতে লাগল। আমাদের আয়া একবার একটাকা দিয়ে আটটিন মার্কিনী টুনাফিশ্ কিনে নিয়ে এল। খাকি রং মাখানো টিন, যেমন মিলিটারি মালের নিয়ম ছিল—যদিও ফুটপাতে বিক্রি হচ্ছিল— আমি তো বারবার খেতে মানা করলাম, ভাবলাম নিশ্চয় ‘তারিখ-অতিবাহিত’ জিনিস। তা সে শুনল না। চমৎকার একটা উত্তর দিল—’তা হতে পারে, মা। খেলে হয়তো মরে যায়। তবে আমরা গরীব মানুষ, আমাদের অত বড়মানুষি করলে চলে না।’ দিব্যি খেয়ে দেয়ে বহাল তবিয়তে রইল সবাই।

মাঝে মাঝে মনেই থাকত না যে একটা যুদ্ধের কাছাকাছি রয়েছি। এমন সময় আমাদের বড়ই স্নেহের পাত্র এক সমবয়সী জামাই বর্মার যুদ্ধক্ষেত্রে তার নিজের একজন অফিসারকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিল। হঠাৎ যুদ্ধটা বড় কাছাকছি এসে গেল। তার জন্য এখনো মন কেমন করে।

এর কিছুদিন পরেই যুদ্ধটা যেন গড়িয়ে গড়িয়ে থেমে গেল। সত্যি বলাই সাক্ষাৎ টের পেতে কিছু সময় লেগেছিল, যেমন শুরুর সময়ও লেগেছিল। এই যুদ্ধের ব্যর্থতা নৈরাশ্যের কথা বাদ দিয়ে, অনেক মজার ঘটনা ঘটত। আমার এক আত্মীয় যুদ্ধ থামার সময় বর্মায় ছিল। তাকে হুকুম দেওয়া হল কলকাতায় গিয়ে নতুন পোস্টিং পেতে হবে। কলকাতায় এসে শুনল পাকা অর্ডার আনতে দিল্লী যেতে হবে। গেল। শ্রান্ত ক্লান্ত শরীরে সেখানে কিছুদিন এ-অপিস্ সে-অপিস্ করবার পর, পাকা ‘অর্ডার পেল, ‘তোমার যে কলকাতায় পোস্টিং হবে সে তো জানা কথা।’ মাঝখান থেকে সময় ও টাকা খরচ আর হয়রানির এক শেষ।

সে যাই হক আস্তে আস্তে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে এল আর আমাদের দেশের দুঃখের দিনও ঘনিয়ে এল, তা শুনে যতই না অদ্ভুত লাগুক। স্বাধীনতা অবধারিত, কিন্তু বিনা পয়সায় তো আর কিছু হবার নয়। অতীতে কয়েকজন প্রাতঃস্মরণীয়, দেশপ্রেমিক শহীদ নিজেদের জীবন দিয়েছিলেন বটে; ষড়যন্ত্রকারীরা ছন্নছাড়া জীবন কাটিয়েছিলেন; অপূর্ব সব দেশপ্রেমের গান লেখা হয়েছিল; রামমোহন থেকে শুরু করে বহু মহান্ নেতা বারবার দেশোদ্ধারের পথ দেখিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের ছাত্রজীবনে কংগ্রেস কর্মীরা দলে দলে জেলে যেতেন। সে জেলে যাওয়ায় সে রকম কষ্ট ছিল না, দু-চারটি ক্ষেত্রে ছাড়া। কিন্তু স্বাধীনতার ঠিক আগেই বাংলায় যে নির্মম দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তার বেদনার সঙ্গে হয়তো শুধু বঙ্কিম বর্ণিত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের তুলনা করা যায়। এ-কষ্ট সাধারণ লোকের সবচেয়ে বেশি লেগেছিল।

শুনেছিলাম কোনো খরা বা বন্যা বা মহামারী দুর্ভিক্ষ এ নয়। একেবারে মানুষ-ঘটিত ব্যাপার। বিদায় নেবার মুখে ব্রিটিশরা তাদের খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থাপনা তুলে নেওয়াই ছিল এর প্রধান কারণ। কারণ যাই হোক, লক্ষ লক্ষ গ্রামের মানুষ না খেতে পেয়ে মরে গেল। যারা মরল না তারাও অমানুষ হয়ে গেল। শহরের ব্যবস্থাপনা বেশি ভালো, এই সরল বিশ্বাসে লক্ষ লক্ষ গ্রামের লোক কলকাতায় এসে খাবারের দোকানের সামনে মরে রইল। লুটপাট করে খাবার মনুষ্যত্বটুকুও ততদিনে তাদের শেষ হয়ে গেছিল।

দলে দলে ভদ্রঘরের মা-বাবারা ছেলেমেয়ের হাত ধরে ভিক্ষে করছে দেখে, এই প্রথম দেখলাম অবস্থাপন্ন বাঙালী মেয়েরা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এ আমার সেই ফ্যাশানেব্‌ল সমাজসেবা নয়। এ হল মরা-বাঁচার কথা। এই সময় আমি প্রথম কমিউনিস্টদের জনসেবার দৃষ্টান্ত দেখলাম। আমাদের কমিউনিস্ট বন্ধু নীরেন রায়ের উৎসাহে বই তো অনেক পড়েছিলাম। সে সব হল গিয়ে নীতির ব্যাপার। আর এ হল ঐ যে বললাম—মরা-বাঁচার কথা।

মেয়েদের একটা সেবা-সমিতি, নাম মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। তারা আমাকে ডেকে নিয়ে গেল। বন্ধুরা কেউ কেউ বললেন, ‘ওসব ওদের দল বাড়াবার চেষ্টা। জনসেবার নাম করে লোকের দুর্বলতার সুবিধে নেয়।’ যাঁরা বলতেন, বলাবাহুল্য, তাঁরা কেউ জনসেবার ধার ধারতেন না। ও-কথা শুনে বেজায় চটে যেতাম। তাঁদের কাছ থেকে যেমন করে পারি চাঁদা আদায় করতাম। কিন্তু ঐ কমিউনিস্ট মেয়েদের স্বার্থশূন্য অক্লান্ত পরিশ্রম, ওদের নিয়মানুবর্তিতা, ওদের নিখুঁত অর্গানাইজেশন—সংগঠন নীতি বললে যেন যথেষ্ট বলা হয় না—দেখে আমি স্তম্ভিত এবং মুগ্ধ। একদিনও ওরা রাজনীতির কথা বলেনি, বা দলে টানবার চেষ্টা করেনি। আমি চিরকাল সব রাজনীতির দল এড়িয়ে চলেছি, এখনো তাই। কিন্তু ঐ মেয়েদের দেখে আমি বুঝলাম নারীত্বের কি অসীম শক্তি। কোনো ন্যাকামি, বাড়াবাড়ি নেই, কোনো ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য নেই। এই কাজগুলো করা দরকার, তাই করতে হবে। আর কি অপূর্ব কর্মক্ষমতা। মেয়েগুলো আমার আজীবনের বন্ধু হয়ে গেল। এখন বেশি দেখা হয় না, নানান নতুন রাজনীতির দল হয়েছে, তাতে কেউ কেউ যোগ দিয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি মানুষের স্বকীয়তা বদলায় না, খালি অভ্যাস বদলায়। কয়েকজনের নাম না করে পারছি না যেমন—মণিকুন্তলা সেন, কমলা চট্টোপাধ্যায়, অনিলা দেবী, আর সেই আরেকজন যার নাম করলে চটে যাবে, ছোট্ট-খাট্টো মানুষটি, ধরন-ধারণ বেজায় বেরসিক। কিন্তু ওর স্বামীর অন্য রকম মত। এদের সংস্পর্শে এসে আমি কৃতার্থ হয়ে গেছি। যদিও ধন্যটন্য শব্দ ওরা পছন্দ করবে না জানি। আমার লেখার এখানে ওখানে আমি নিজেই ওদের প্রভাব দেখতে পাই।

এতটুকু আবেগের উচ্ছ্বাস দেখিনি, কিন্তু কাজের কি মহিমা! ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ কটা দিন। কমিউনিস্টরা জনপ্রিয় ছিল না; কাজ দেখে আমার মতো আরো অনেকে ওদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম। মনে হয় ২০-২৫টা লঙ্গরখানা চালাত ওরা। কয়েকটাতে গিয়ে বুভুক্ষু মানুষের ন্যাড়া চেহারা দেখে শিখলাম যে আগে দেহের প্রয়োজনগুলো মেটাতে হয়, তবে না সে মনের বিকাশ হয়। একজন মাকে দেখেছিলাম ছোট্ট ছেলেমেয়েদের বাঁ হাত দিয়ে ঠেলে রেখে ডান হাতে নিজে খিচুড়ি খেয়ে নিচ্ছে। কি কষ্ট হয়েছিল।

তবে লঙ্গরখানাগুলো সরকারি সাহায্যও পেত। ভারতীয় ফুড কমিটি বলে একটা সমিতি হয়েছিল। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমিও গেছিলাম। দেখলাম কাজের কাজ অনেক হলেও, কর্তাব্যক্তিদের অনেকেরি একটু বেশি পরিপুষ্ট চেহারা। দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় কেমন যেন দৃষ্টিকটু মনে হত। স্টেট্সম্যানের অ্যালেক্ রীডকে বললাম, ‘আমাদের দেখে কে বলবে দেশে দুর্ভিক্ষ চলেছে!’ কাষ্ঠ হেসে রীড্ বলেছিল, ‘কিম্বা হয়তো দেখে ভাববে এইবার দুর্ভিক্ষের আসল কারণটা পাওয়া গেছে!’ এমনি করে ১৯৪২, ১৯৪৩ কেটেছিল। পথঘাট আবার আগের মতো আলোকিত হলেও, মানুষের মন অবধি সে আলো পৌঁছতে ঢের দেরি। সামাজিক মূল্যবোধ কোথাও এতটুকু নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পুরনো প্রতিষ্ঠিত মানগুলো ভেঙে গেলেও, তার জায়গায় নতুন কিছু গড়ে ওঠেনি। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আমলের তেজ নিবে গেছিল, কিন্তু সে-যুগের সামাজিক মূল্যগুলোকে শিক্ষিত বঙ্গসমাজ প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করত।

করতে গিয়ে বিষম বৈষম্য দেখা দিচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ নেই। তবু জ্ঞানীগুণীর অভাব ছিল না। তাঁরা নীতিগত ভাবে ভারি উদার মতামত পোষণ ও প্রকাশ করতেন। কিন্তু কাজ অবধি সেগুলোকে পৌঁছতে দেবার কথা উঠলে ঘাবড়ে যেতেন। নমুনা স্বরূপ দুটো একটা নাম দিতে পারলে আরো ভালো হত সন্দেহ নেই, কিন্তু সে না দিলেই বুদ্ধির কাজ হবে।

মোট কথা অ্যালেক রীডকে আমরা বেজায় ভালবাসতাম। স্নেহশীল, উদারচেতা, বুদ্ধিমান মানুষটি। সে আবার বাঙালী মেয়ে বিয়ে করেছিল। ঐ মেয়েও আমাদের সমবয়সী বন্ধু। তার আগের বিয়ে নানা কারণে আইনের সাহায্যে ভেঙে গেছিল। সে বছর আমরা এক সঙ্গে দার্জিলিং গেছিলাম। বিকেলে বেড়াতে বেরিয়েছিল আমার বন্ধু, তার মায়ের সঙ্গে। ফিরে এসে মা রেগেমেগে বললেন, ‘অমুকের স্ত্রী পাছে আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাই মুখ ঘুরিয়ে তাড়াতাড়ি একটা দোকানে গিয়ে ঢুকল।’

মনে আছে সেখানে অধ্যাপক সুরাওয়ার্দি ছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল ইউরোপে কাটিয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘তাতে অত গরম হবার কি আছে বুঝলাম না। ওঁদের মতে যারা অসামাজিক কাজ করেছে, ওঁদের সমাজ তাদের সঙ্গে মেশে না! তাতে কি দোষটা হল বুঝলাম না।’

তারপর যাকে বলে চায়ের পেয়ালায় তুফান উঠল। আমার সঙ্গে দেখা হতেই ঐ সামাজিক বন্ধুরা বললেন, এমন জায়গায় আছে যে যাবারো জো নেই। আমি বললাম, ‘তোমরা তো অমুকের বাড়িতে লাঞ্চ খেতে গেছিলে। তিনি বিয়ে ভাঙ্গেননি বটে, কিন্ত আরেক জনের সঙ্গে ঘর করেন শুনেছি!’ কিছুটা তর্কাতর্কির পর তাঁরা মানলেন এ ব্যবহারটা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণতার প্রমাণ হয়ে যায়। সবাই মিলে পরদিন বিকেলে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন ঠিক হল। ভাবলাম,বাঃ, এই তো বেশ! কেমন যুক্তি দিয়ে মন ফেরানো গেল। দুঃখের বিষয়, পরদিন দূর থেকে তাঁদের আসতে দেখে, সাহেব হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, ‘আমার স্ত্রীর সঙ্গে যারা মেশে না, আমিও তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে মিশি না।’ এই বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল! সমতলে তখন দুর্ভিক্ষের প্রকোপ কমে এলেও মানুষের যথেষ্ট দুঃসময় চলেছিল, তখন পাহাড়ে অভিজাত হাওয়া-বদল করনেওয়ালারা এই সব সূক্ষ্ম সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে তর্ক করতেন। অথচ তাঁরাও যে জনসেবা করতেন না, তা নয়।

আসলে আজ অবধি দুর্নীতি সুনীতি, সামাজিক-অসামাজিকের মধ্যিখানের দেওয়ালটা কোথায় বুঝতে পারি না। যা নিষ্ঠুর, যা অন্যের ক্ষতিকারক, যা কুরুচিপূর্ণ ও জঘন্য, সে সবই পরিত্যাজ্য এই রকম ভাবি। আবার দেখি সামাজিক মানুষরা অসামাজিক চরিত্রের গল্প—তা সত্যই হোক, কি বানানোই হোক—ভারি উপভোগ করেন এবং বন্ধুদের কানে কানে পরিবেশন করেন। অথচ সত্যিকার মানুষের এতটুকু স্খলন-পতন-ত্রুটি দেখলে মারমুখো হয়ে ওঠেন। অবিশ্যি ঐ সব ঘটনা এখন আর সম্ভব নয়। শুনেছি নাকি কলকাতার সব অপেক্ষমান বিয়ে ভাঙা কেসের শুনানি নিতেই আড়াই বছরের বেশি সময় লাগবে।

সেবার দার্জিলিং-এ মাসখানেকের বেশি থাকিনি। আর কখনো দার্জিলিং-এ একটানা এক মাস থাকিওনি। যতদূর মনে হয় ঐ বছরেই লক্ষ্ণৌতে আমার মেসোমশাই সুরেন মৈত্র হৃদ্ রোগে আক্রান্ত হয়ে, ৬৭ বছর বয়সে মারা গেলেন। মেসোমশাইয়ের সঙ্গে আমার ভারি সুন্দর একটা স্নেহের সম্বন্ধ ছিল। বাবার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পর, জ্যাঠামশাইয়ের আর মেসোমশাইয়ের কাছ থেকে সর্বদা যে গভীর স্নেহ পেয়েছিলাম তার তুলনা হয় না। তার ওপর মেসোমশাই সাহিত্য ভালোবাসতেন। চমৎকার কবিতা লিখতেন সুরেশ্বর শর্মা নামে। ভাবতাম ছদ্মনাম কেন? কিছু বলতেন না। সুন্দর অনুবাদ করতেন। তাঁর ব্রাউনিং পঞ্চাশিকা আর জাপানী ঝিনুক (নগুচির কবিতা) বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। কবিতা পড়ে শোনাতে ভালোবাসতেন। পড়তে পড়তে হয়তো হঠাৎ পড়া বন্ধ করে বললেন, ‘কিছু দেখতে পাচ্ছি না। চোখ দুটো একদম গেছে!’ আমি ওঁর নাক থেকে চশমা তুলে আঁচলে মুছিয়ে, আবার নাকে বসিয়ে বলতাম, ‘এবার পড়।’ হয়তো সাধারণ ছোট একটা স্মৃতিকণা, কিন্তু আমার কাছে মূল্য আছে। এমনি সব ছোট ছোট সাধারণ ঘটনা দিয়ে আমার স্মৃতির খাতা ভরে আছে। দুঃখের সময় সেগুলি ভেবে সান্ত্বনা পাই, নিরাশার সময় বল পাই।

বোঝাই যাচ্ছে নানান্ পত্রিকাতে ছোটদের, বড়দের জন্য গল্প প্রবন্ধ লেখা, ছাড়া এতাবৎ কোনো বড় কাজে হাত দিইনি। ক্রমে মনটা তৈরি হয়ে আসছিল! ১৯৪৩ সালে আমার ৩৫ বছর বয়স। লেখক বন্ধুরা তত দিনে স্বনামধন্য হয়ে উঠেছেন। আমার খালি মনে হত যখন বলবার মতো কিছু আমার মনের মধ্যে ফুটবে, তখনি আমি লেখিকা হয়ে উঠব। জোর করে কিছু হবার নয়।

॥ ৬ ॥

নিজের জীবনের কথা লেখার চেয়ে অন্যের জীবন-কথা লেখা অনেক বেশি সহজ। পরের কথা বলতে গেলে বাইরে যেটুকু প্রকাশ পায় শুধু সেইটুকুই লেখা হয়, মানুষটা কি বলল, কি করল, কোথায় ছিল, কোথায় গেল, কাকে কি চিঠিপত্র লিখল, ডাইরিতেই বা কি গোপন কথা লিখে রাখল, অন্য লোকে তার বিষয়ে কি বলেছিল, কি সন্দেহ করেছিল ইত্যাদি। যথেষ্ট খ্যাতনামা হলে তার উইল, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র, দৈনিক খরচপত্রের হিসাব—এ পাঠও বাদ পড়ে না। মধ্যিখান থেকে আসল মানুষটা—যার সমস্তটা কথায়, বা কাজে বন্দী হবার নয়—সেই খসে পড়ে। অবাঙমনসগোচরের কি আর চলচ্চিত্র হয়?

নিজের বেলা সব অন্যরকম। মনের গহনের সমস্ত অস্ফুট চিন্তা পর্যন্ত আগের থেকেই জানা হয়ে থাকে, কোনো নিচ অযোগ্য ইচ্ছা বা চিন্তাও নিজের কাছে গোপন থাকে না। সমস্ত বিফলতা ব্যর্থতা হতাশা বেদনা নিয়ে নিজেই পদে-পদে নিজের মুখ চেপে ধরতে হয়, লজ্জা ঢাকতে হয়। নিজের অন্তরের মতো নির্মম সমালোচক জাত-লেখক আর কোথায় পাবেন? জাতীয় পুরস্কারের ছটায়, নিজের কাছে নিজের অযোগ্যতা আরো প্রকট হয়ে ওঠে। ভাগ্যিস্ বাইরের কেউ দেখতে পায় না।

এ-সব আমার মন-গড়া কথা নয়, সব শিল্পীই সব সৃষ্টিকার-ই এ-কথা জানেন। জেনেও যদি সত্য থেকে বিচ্যুত না হবার চেষ্টা করি, যদি ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলবার সৎসাহস না পাই, তাহলে আমার অযোগ্যতাই প্রমাণ হয়ে যাবে। সাহিত্য-লোকে কাপুরুষের জায়গা নেই। কোনো রকম মানসিক ব্যভিচারেরও জায়গা নেই, কারণ সে-ও দুর্বল কাপুরুষতা, কিন্তু তা-ও শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে, এ-ও আমি বিশ্বাস করি।

এমনিধারা চিন্তা একদিনে তৈরি হয়নি, জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছিল নিজেকে জানতে। ছাত্রাবস্থায় আমার প্রধান অনুশীলনের বিষয় ছিল ইংরিজি সাহিত্য। কতবার মনে হয়েছে ঐজন্যেই বাংলা লিখবার জোর পেয়েছি। ইংরিজি ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে ভারি একটা বলিষ্ঠ ধরনের উদারতা আছে। তাকে আয়ত্ত করতে পারলে যে-কোনো ভাষায় লেখা অনেক সহজ আর জোরালো হয়ে ওঠে। ইংরিজিতে লিখব বলে আমি ইংরিজি পড়িনি, এমন শিক্ষণ আর কোথাও পাব না জেনেই ইংরিজি সাহিত্য বেছে নিয়েছিলাম। ঐরকম মৌলিক, নির্ভীক, স্বকীয়তাপূর্ণ, জোরালো ভাবে আমাদেরও লিখতে হবে। অনেক বাংলা লেখায় পরিচ্ছন্নতার অভাব দেখি। এক কথায় যা লেখা যায়, আমরা তাকে দশ কথায় লিখি।

যেমন ছোট গল্পই ধরা যাক। ওদের সেরা লেখকরা এক পদক্ষেপে গল্পের মধ্যিখানে চলে যান। তারপর আর এক মুহুর্তের জন্যে পাঠকের মনকে রেহাই দেন না। আমরা অনেকেই পাতার পর পাতা ইনিয়ে বিনিয়ে, হাজার রকম কৈফিয়ৎ আর ব্যাখ্যানা দিয়ে তবে গল্প শুরু করি। যেন একটা অন্যায় কাজ করতে যাচ্ছি। অথচ কত ভালো ভালো বাঙালী ছোট-গল্প লেখক দেখতে পাই। ছোট গল্পের মধ্যিখানে আমরা মনোবিশ্লেষণ করতে গিয়ে, সব মাটি করে দিই। ভালো ভালো প্লটের জোর কমিয়ে দিই।

এ-সমস্তই আমার নিতান্ত নিজের মতামত। ১৯৪৩-৪৪ পর্যন্ত এই সব ভেবেছি, বেশির ভাগ ইংরিজি বই-ই পড়েছি, পত্র-পত্রিকায়, গল্প প্রবন্ধের সমালোচনা লিখেছি। সমালোচকদের কাছে নিজেকে খুব একটা ধরা দিইনি। বলেছি তো অধ্যাপক নীরেন রায় কেবলি বলতেন—‘কিচ্ছু করতে পারনি! তোমার বয়সে লিন-য়ুটাং কি করেছিলেন মনে হয় না কখনো?’

১৯৪৪ সালে আমাদের পারিবারিক জীবনের স্বচ্ছ স্রোত বিঘ্নিত হল! আমার মাতৃসমা ননদের একমাত্র মেয়ে বিধবা হয়ে তার তিনটি অনূঢ়া কন্যা নিয়ে আমাদের বাড়িতে এল। বন্ধুরা অনেক বারণ করেছিলেন, বলেছিলেন, বিপন্ন আত্মীয়-বন্ধুদের টাকা দিয়ে সাহায্য করতে হয়, ঘরে আনতে হয় না। আনলে তোমাদের সমস্ত জীবন-ধারা পাল্টে যাবে। কথাটা মেনে নিতে পারিনি। সে যাই হক ১৯৪৪ সালের শীতকালে তারা সকলে এল। পাড়াগাঁয়ে জন্ম, সেখানে মানুষ। কথায়বার্তায় সাজসজ্জায়, মতামতে পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষার আর কুসংস্কারের ছাপ। আবার তার সঙ্গে কেমন একটা স্বচ্ছ সরলতা, যা আমার মনে ধরে গেল। সেখানেও বড় মেয়েরা গ্রামের স্কুলে পড়ত। এখানে এনেই কোথায় দেব তাই নিয়ে সমস্যা।

সে সময়ে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়, মধুপুরে যুদ্ধকালীন ব্যবস্থাপনাতেই ছিল। সেখানে ভরতি করে দিলাম। পরের বছর ঐ স্কুল কলকাতার পুরনো আবাসে ফিরে এলে, যাতায়াতের অসুবিধার কথা ভেবে মেয়ে তিনটিকে দক্ষিণ কলকাতার কমলা গালর্স্ স্কুলে ভরতি করে দিলাম। কবি বিষ্ণু দের বুদ্ধিমতী স্ত্রী প্রণতি ঐ স্কুলের অধ্যক্ষা ছিলেন। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে ভাড়া বাড়িতে অনাড়ম্বর ভাবে চললেও, বিদ্যালয়টি বড় ভালো ছিল। ততদিনে আমার ভাগ্নীর মেয়েদের দেহ মন থেকে পাড়াগাঁয়ে ভাবটি মুছে গিয়ে, তাদের এখন কলকাতার আর পাঁচটি কায়দাদুরস্ত চালাক-চতুর মেয়ে থেকে আলাদা করে চেনা যেত না। বাড়িতেও আমার এক ছেলে এক মেয়ের জায়গায় এক ছেলে চার মেয়ে মানুষ হতে লাগল। বলা বাহুল্য কোণ-ঠাসা হয়ে ছেলেটা দিনের বেশির ভাগ সময় কোণের ঘরে কাটাত। বয়সে সে ভাগ্নীর বড় মেয়ের চেয়ে দেড় বছরের ছোট আর পাকামিতে তার হাঁটুর কাছেও পৌঁছয়নি। মাঝ মাঝে মনে হত বাড়িতে বুঝি প্রমীলা রাজ্যের পত্তন হয়েছে।

আরেকটু আগে পেলে মনের মিলটা আরো গভীর হত আমার হয়তো, কিন্তু আসল সমস্যা তাদের নিয়েও নয়,..আমার দুঃখিনী, বুদ্ধিমতী, প্রায় নিরক্ষরা বুড়ি ননদকে নিয়েও নয়। তিনি তাঁর পুজো-আচ্চা, রান্নাবান্না, কাঁথা সেলাই, আচার-বড়ি-আমসত্ত্ব তৈরি আর সংযত ছোঁয়াছুঁয়ি নিয়ে দিনের অর্ধেকটা সময় কাটাতেন, বাকিটা সময় আমার চার দিকে বিরাজ করতেন। আমি যেখানে যেতাম সেখানে যেতে চাইতেন, যা করতাম করতে চাইতেন, সকলের সঙ্গে আশ্চর্য দক্ষতার সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতেন। আমার গিন্নিপনার অর্ধেকটা আমি তাঁর কাছে শিখেছি আর কত যে স্নেহ পেয়েছি, সারা জীবন ধরে বলে বলেও তার যথেষ্ট স্বীকৃতি দেওয়া যায় না।

সমস্যা আমার মুখ্যু ভাগ্নীকে নিয়ে। মুখ্যু হলে কি হবে, অতি আশ্চর্য তার আত্মসম্মান। নিজের ঘরে একদা রানীর মতো বিরাজ করেছিল, তারপর বিধির বিধানে সে রাজ্য গেল। দূরদর্শিতার অভাবে তার স্বামী কিছু রেখে যায়নি। মানুষটা যদিও দেবতার মতো ছিল। উলিপুরের সংসার তুলে দিয়ে, জিনিসপত্র অর্ধেক জলের দরে বেচে দিয়ে, অর্ধেক দান বিলি করে, যৎসামান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে আমার সামনে যখন দাঁড়াল, আমি ওর মুখের দিকে চেয়ে ভাবলাম এ তো একটা সম্পূর্ণ মানুষ নয়, এর আধখানাকে সেখানে রেখে এসেছে।

বছর বত্রিশ বয়স, লম্বা, সুশ্রী, অসহিষ্ণু, কিন্তু চোখের দৃষ্টি অম্লান। হঠাৎ দেখলে মনে হত খিট্‌খিটে, আসলে তা নয়। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে শেখেনি, বাধ্য হয়ে তিনটে মেয়ে নিয়ে মামার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে যতই আদর পাক, স্বাধীন মানুষকে অপরের দায়িত্ব হতে হচ্ছে, এই তিক্ত সত্য তার আত্মসম্মান বরদাস্ত করতে পারছিল না। তার নাম সুরমা। আমার মায়ের নামও ছিল সুরমা। আমার মা তিন বছর বয়সে অনাথা হয়ে, পরের ঘরে মানুষ হয়েছিলেন। সেই প্রথম দিন থেকে সুরমাকে অন্তরে স্থান দিয়েছিলাম। আদর দিয়ে, শাসন দিয়ে, শিক্ষা দিয়ে, যত্ন দিয়ে কিশোরী কন্যা মানুষ করা তেমন কঠিন কাজ নয়। তিনজনেই লেখা পড়া শিখে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। উত্তরাধিকার সূত্রে ধন-সম্পদ কিছু না পেলেও, তার চেয়েও ভালো জিনিস পেয়েছিল। সে হল এক রকম উচ্চাকাঙক্ষা,বড় হবার প্রবল বাসনা। সেইটেই তাদের জীবনের মূলধন ছিল। আমি তাদের পথ করে দিয়েছিলাম, এই মাত্র।

আমার আসল গর্ব সুরমাকে নিয়ে। ফ্ল্যাটে বস্তুতঃ এতগুলো লোকের জায়গা ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশে জায়গা নেই বলে কোনো কথাও নেই। ডাক্তারের চেম্বারের সঙ্গে লাগানো তিনটি বড় বড় ঘর। তাতে আমরা নয়জন মানুষ। বড় টেবিলে দু ব্যাচে খাওয়া হয়। রাতে মাটিতে ঢালা বিছানা হয়। নিজেরাই পাতে, নিজেরাই তোলে। আমাদের বুড়ি আয়া আমোদিনী নিজে দুঃখী হলেও, অন্য দুঃখী এসে এ-বাড়ির আদর যত্নে ভাগ বসাবে, এ-কথা ভাবলেও তার পিত্তি জ্বলে যেত। মস্ত রান্নাঘরে আমিষ নিরামিষ আলাদা সেক্শন হয়ে গেল।

রোজ সন্ধ্যায়, আমাদের বড় শোবার ঘরটি একটা নারী-শিক্ষা-কেন্দ্র হয়ে যেত। আমি তার একচ্ছত্র মাস্টারনী। ছাত্রীদের বয়স ৭ থেকে ৩২। বলা বাহুল্য ছেলেটা আমাদের ছোট শোবার ঘরে বুদ্ধিমান জীবের মতো গা-ঢাকা দিয়ে থাকত। তার-ও সামান্য মাস্টারি করতে হত। সমিতি-টমিতি ছাড়লাম। বন্ধুরা বললেন—হয়ে গেল তোমার সাহিত্য সাধনা, এবার সংসারের চাকার তলায় তলিয়ে যাবে!

তা অবিশ্যি হয়নি। কে না জানে কাজের লোকদের হাতে সব চেয়ে বেশি কাজের সময় থাকে। আমার মনের মধ্যে একটা দরজা খুলে গেল, আমার অন্তরবাসী সেই সত্তাটি আমাকে ঘাড় ধরে শেখাতে লাগল। অনেক রাতে, পড়ুয়ারা শুয়ে পড়লে পরে এবং আমার স্বামীর আপত্তি সত্ত্বেও। লেখাটা নিজের থেকেই আসত। খাটতাম সুরমার জন্য। যে দিন থেকে কাগজে পড়েছিলাম সোভিয়েট ইউনিয়নে পাঁচ বছরে নিরক্ষরতা ঘুচে গেছিল, সে দিন থেকে এ-বিষয়ে বেজায় কৌতূহল ছিল। সুরমা আমার সে কৌতূহল মেটাল। বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। গ্রামের স্কুলে যেটুকু শিখেছিল কোন্ কালে ভুলে গেছে। ঠিক করলাম তাকে তৈরি করে নিজের পায়ে দাঁড় করাব। যাতে আর কোনো কালে পরের কাছে সাহায্য চেয়ে তার ঐ অপূর্ব আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ না হয়।

ওর মা, আমার ছোড়দির মহা আপত্তি। ‘এ বয়সে আবার লেখা-পড়া হয় নাকি! একটা ভাগ্নীকে দু-মুঠো খেতে দিতে পারবি না?’ তাঁকে বোঝালাম যাতে ঐ দু-মুঠোর জন্য কারো কাছে হাত পাততে না হয়, তাই করে দিতে চাই। আমার স্বামীর কোনো আপত্তি না থাকলেও, খুব একটা ভরসাও ছিল না।

শুনলাম বিদ্যাসাগর বাণীভবনে বৈধব্যের সব নিয়ম পালন করতে হয়, থান পরা, নিরামিষ খাওয়া, একাদশী ইত্যাদি। তাতে আমি খুশি নই। শেষ পর্যন্ত সরোজনলিনীতে ভরতি করলাম। বাড়ি থেকে যাওয়া আসা করত। সাধারণ লেখা পড়া, দরজির কাজ, কারুকার্য, তাঁত, উল-বোনা, ক্রুশ বোনা, সব কিছুতে চার বছরে দক্ষ হয়ে উঠল সুরমা। বাড়িতে ওর মাস্টারি করে করে আমিও তাঁত ছাড়া সব কিছুতে এমনি দক্ষ হয়ে উঠলাম যে আমার মেয়ের বিয়ের সময় পর্যন্ত দরজি ডাকতে হল না!

চার বছরে সুরমা পাস্ করে পাকা দরজি হয়ে বেরোল। সেই ইস্তক নিজের পায়ে নিজে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের বা আর কারো কাছ থেকে কখনো একটা পয়সা চায়নি, এমনি তার আত্মপ্রত্যয়। মনে হয় ঐটেই সব। প্রথমে আমার বন্ধুবান্ধবের চেষ্টায় দুটো একটা মহিলা-সমিতিতে সেলাই শেখানোর কাজ। তারপর সেই কাজের গুণ দেখে আরো প্রসার। শেষে বহু বছর বাটানগরের বালিকা বিদ্যালয়ে সেলাইয়ের টিচার। এখন সম্মানের সঙ্গে অবসর নিয়েছে। এ আত্মপ্রত্যয়টাই সব। মনে হত ওটি এক রকম অহংকার। জাঁক নয়, দেমাক নয়, নিজের গুণ গেয়ে বেড়ানো নয়, স্রেফ্ নিজের উপর বিশ্বাস, বিধাতার মঙ্গল-বিধানে অব্যক্ত আস্থা। যত দেখি তত আশ্চর্য হই। এখন নিজের চেষ্টায় আর মেয়ের কিঞ্চিৎ অর্থসাহায্যে ছোট একটি সরকারি ফ্ল্যাট্ কিনেছে। সেখানে কয়েকটি মেয়েকে সেলাই শিখিয়ে অবসর জীবনকে কর্মময় করে তুলবে।

এর একটা অন্য দিক্-ও আছে। উপকারীর প্রতি প্রায় সব মানুষেরি মনে ক্ষোভ জমে থাকে। যে মানুষটা আমার দুর্বলতম মুহূর্তের সাক্ষী, তাকে ক্ষমা করা খুব সহজ নয়। তবু সুরমাকে আর তার মেয়েদের নিয়ে আমার অনেক গর্ব। ওদের কাছে পেয়ে আমার মনের একটা বিশেষ জায়গা সবুজ-শ্যামল হয়ে উঠেছিল। আমার প্রায় সব বড়দের উপন্যাসেই অনাথা, গৃহহারা অথচ লড়াই-করা মেয়েদের নিয়ে কারবার। ভঙ্গুর দুঃখিনীদেরো শেষ পর্যন্ত পায়ে বল জুগিয়েছে। একটা গোটা অনাথ পরিবারকে বলিষ্ঠ সুন্দর হয়ে উঠতে দেখে এ সব গল্প অংকুরিত হয়েছিল। বাস্তবের মধ্যে এদের প্রাণ। আমার গল্পে, হতাশা ব্যর্থতার স্থান নেই, তাদের নির্মূল করার ইঙ্গিত আছে।

সে যাই হক সাংসারিক কাজ যেমন বেড়ে গেল, তেমনি অনেকগুলি উৎসাহী সাহায্যকারিণীও পেয়ে গেলাম। যা কিছু বাস্তব বিদ্যে ছিল আমার, সব ওদের শেখাতে চেষ্টা করতাম। ওরা বুঝে নিয়েছিল সংসারের কোনো কাজ-ই ঘৃণ্য নয়, নোংরা দূর করা নোংরামি নয়। একবার ধাঙ্গড়দের ধর্মঘট হল। জমাদাররা ক-দিন এল না। সব বাড়িতে অভিযোগ, আমাদের বাড়িতে ছাড়া। এই সমস্তই আমার পুরস্কার। চারটে মেয়েই কাজ-কর্মে দক্ষ। দু-জন বিদেশে ঘরকন্না করছে।

এইসমস্ত দিয়ে মনের একটা পটভূমিকা তৈরি হল। এবার আমার মনের মধ্যে নিজেও একটা দিকদর্শন যন্ত্রের সন্ধান পেলাম। কিন্তু সচেতনভাবে অমুক বিষয়ে কিছু লেখা দরকার বলে কখনো লিখতে বসিনি। বড়দের যে অজস্র ছোট গল্প কলমের আগায় আসত, সবই রসের ব্যাপার। ছোটদের জন্য যা লিখেছি শুরু থেকেই তাও রসেরি ব্যাপার। ভাবি সাহিত্যরচনার প্রধান উপজীব্যই রস। উপজীব্য হলেও রস জমানো তার প্রধান উদ্দেশ্য নয়। সে উদ্দেশ্য হল সত্যের উন্মোচন।

ক্রমে বয়স হতে চলল চল্লিশ, কিন্তু সেই অকালমৃত বদ্যিনাথের বড়ির পর কোনো বই প্রকাশ করবার চেষ্টাও করলাম না! ইংরিজিতে বাংলায় গল্প প্রবন্ধ ছাপা হত। গল্প সব বাংলায়। ছোটদের জন্য বড়ই পক্ষপাতিত্ব। পি-ই-এনের সদস্যা। শুনেছি সাহিত্যিক আড্ডায় নামকরা লেখকদের ছায়ায় গিয়ে বসলেও লেখার হাত খোলে। আমার সে-সব সুযোগ হয়নি। তবে বাপ-জ্যাঠাদের যে সুনিবিড় ছায়াতে শৈশব কেটেছিল, সেইটে কেমন করে আমার মনের মধ্যে এমন একটা চন্দ্রাতপ তৈরি করে রেখেছিল যে আর কিছুর আমার দরকার হয়নি।

আমার ভাগ্নী সুরমা একটা বড় ভালো কথা বলে, ‘মুখ্যুরা সবচেয়ে ভালো শেখাতে পারে। আমি মুখ্যু ছিলাম বলে আমি ঠিক বুঝতে পারি আমার অল্পশিক্ষিত ছাত্রীদের কোথায় কোনটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে।’ মনটা শুনে নেচে উঠেছিল, ঠিক বলেছে সুরমা। অনেক জ্ঞান না থাকলে যে জিনিস বোঝা মুশকিল, মুখ্যুদের সেটা কি করে বোঝানো যায়? যারা নিজেরা মুখ্যু ছিল, তারাই জানে কি করে বোঝানো যায়।

ভাবি আমার লেখার বেলাও তাই। কাজ চলার মতো মোটামুটি বাংলা ব্যাকরণ শিখে নিয়েছিলাম। বাংলা-সাহিত্যের ইতিহাস শখ করে পড়েছি। সংস্কৃত আদৌ পড়িনি। কনভেন্টে ইংরিজি শিখেছি খুব ভালো করে, ইংরিজি সাহিত্য গুলে খেয়েছি—এখনি অত হিংসা, অত যৌন-কথা থাকে যে অখাদ্য লাগে। অবশ্যি ভালো বইও অনেক বেরোয়। বাংলাকে আমি একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাষা মনে করি; সংস্কৃতের ঠেকো না দিলেও চলে মনে করি; যতখানি ঠেকো দরকার, খুঁজলে তাকে বাংলা ব্যাকরণেই পাব মনে করি। কিন্তু সাধারণ পাঠকরা যদি মানে বুঝতে না পারে তাহলে আমার সে লেখার কতটুকু সার্থকতা! আমি তো পণ্ডিত নই, পণ্ডিতদের জন্যে লিখিও না, আমার সাধারণ দেশবাসীদের জন্যে লিখি। ভাষা যদি স্বচ্ছ হয়, তাহলে সব কথাই তাদের বোধগম্য হবে। এই মনে করে লিখি। ইচ্ছা করে সরল করি না, সহজ ভাষাতেই মনের মধ্যে চিন্তাগুলো আসে। সত্য বড় সরল হয়। জটিলতার সঙ্গে কুটিলতার সম্পর্ক থাকতে পারে বলে ভয় পাই। জল স্বচ্ছ, আলো স্বচ্ছ, আমাদের পূর্ব-পুরুষদের প্রার্থনাগুলোও তারি মতো স্বচ্ছ—অসতো মা সৎ গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়। ওর বেশি আমার কাম্য নয়। পণ্ডিতের বংশে জন্মেছি, পাণ্ডিত্যকে আমি শ্রদ্ধা করি, কিন্তু সাধারণের জন্য লিখি। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের জনসাধারণ লিখতে পড়তে জানে না, সে অন্য কাহিনী।

বলেইছি তো সাল তারিখ মনে পড়ে না। তবে এর কয়েক বছর আগে আমার মেজদি পুণ্যলতা চক্রবর্তীর বড় মেয়ে কল্যাণী হঠাৎ এক দুঃসাহসিক অভিযান করে বসেছিল। নিজের খরচে ‘মেয়েদের কথা’ বলে একটি মেয়েদের মাসিক পত্র প্রকাশ করতে আরম্ভ করে দিল। মন্দ ছিল না কাগজটি, যতদূর মনে হয় বেশির ভাগ মেয়েদের লেখাই বেরুত। তবে হয়তো বড় বেশি গম্ভীর বিষয় থাকত, খুব সরসতা করত না কেউ। যদিও কল্যাণী নিজে ভারি সরস ছিল। পরে সারা জীবন দুঃস্থ মেয়েদের উন্নতির জন্যে কাজ করেছিল, এখনো করে। কাগজে দু-একটা গল্প ইত্যাদি লিখেছিলাম। দুঃখের বিষয়, কিছুদিন পরে কাগজটি উঠে গেল। মেয়েদের কাগজের কথা খুব একটা না ভাবলেও, ছোটদের পত্রিকার কথা অনেক সময় মনে হত। ছোটদের পত্রিকা সম্পাদনা করব এ-কথা নয়, একটা মনের মতো কাগজ পেলে তাতে লিখি এই রকম ভাবতাম।

ছিল কিছু ভালো ছোটদের মাসিক পত্রিকা, তার মধ্যে মৌচাক, রামধনু এবং আরো কিছু। আসল কথা হল এমন একটা কাগজ খুঁজছিলাম যার উপর নিজে কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে পারব। নিতান্তই দুরাশা, কি-ই বা আমার কৃতিত্ব যে এতখানি প্রতিপত্তি হবে! শৈশব থেকে সন্দেশ পড়ে মানুষ হয়েছি, ছোটদের কাগজ বিষয়ে কতকগুলো ধারণা মনের মধ্যে গড়ে উঠেছে, তা সে-সব কাজে লাগাবার সুযোগ পাচ্ছি কোথায়! বলা বাহুল্য বয়স্কদের বইপত্র সম্বন্ধে এমন কোনো উচ্চাশা পোষণ করাকে তখন ধৃষ্টতা মনে করতাম। ভালো করেই জানতাম বয়স্কদের প্রকাশক সম্পাদকরা প্রায় কেউই মনের দরজা খোলা রাখেন না। তখনো রাখতেন না, এখনো রাখেন কি না সন্দেহ।

ছোটদের বইপত্রের জগৎ আলাদা। ১৯৪৩, ৪৪, ৪৫ এর মধ্যে বেশ কিছু অতিশয় গুণী শিশু সাহিত্যিক দেখা দিলেও, উপেন্দ্রকিশোর বা যোগীন সরকারের পর কেউ সে রকম নতুন কিছু সংযোজন করেন নি। হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, দুঃসাহসিক অভিযানের চমৎকার সব মৌলিক ও ছায়া অবলম্বনে গল্প লিখলেও, ছোটদের পত্রিকার উপর বিশেষ কোনো নীতিগত পরিবর্তন আনেননি। একটা বিষয়ে উন্নতি হয়েছিল। সেটি হল পাঠকদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে। খুব কাজ হয়েছিল মনে হয় না। এই রকম আষার ধারণা ছিল। সবে তার সূত্রপাত হয়েছিল। কিন্তু সে-ও অনেকখানি বলতে হবে।

এমন সময় এক দিন কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হল। সেই সুকুমার সুমুজ্জ্বল কামাক্ষীর বর্ণনা দেওয়া শক্ত। আমার চেয়ে হয়তো আট দশ বছরের ছোট, পাৎলা, ফরসা মানুষটি, চোখে সরল দৃষ্টি। এমন মিষ্টি মানুষ আমি কম দেখেছিলাম। ওর বাবা পরম জ্ঞানী আর ধার্মিক ছিলেন। শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রীটে ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই ধর্মালোচনা হত। অন্য বিষয়েও আলোচনা হত। ওদের সকলকে ভারি উদারচেতা বলে মনে হত। কামাক্ষীর ছোটভাই দেবীকে ভালো লাগত। অল্প কথা বলত, বুদ্ধিমান। মনে আছে একবার ওদের বাড়িতে যামিনী রায় এসেছিলেন, শিল্প সৃষ্টি সম্বন্ধে কিছু বলবেন। কামাক্ষী আমাকেও যেতে বলল।

গিয়ে দেখি চাঁদের হাট, বুদ্ধদেব, অধ্যাপক অমিয় চক্রবর্তী, এবং বহু সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধব। আমাকে অমিয়বাবুর পাশে বসাল। তখনো সভার কাজ আরম্ভ হয়নি। অমিয়বাবুর সঙ্গে সেই আমার শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনার সময় থেকে প্রীতির সম্বন্ধ। এখনো তাই। ভাবলাম এই সুযোগে বুদ্ধদেবের বৈশাখীতে সদ্য প্রকাশিত অমিয়দার আধুনিক কবিতাটির মানে জেনে নিই। আমি আবার মানে না বুঝলে রস উপভোগ করতে পারি না, নিজেও পারি না আবার বন্ধুবান্ধবরা পারে বলেও বিশ্বাস করিও না।

কবিতাটির শুধু গোড়াটুকু মনে আছে,

“বিশুদ্ধ একজন নলিনীচন্দ্র পাকড়াশী,

মাছ, বা ল্যাংড়া আম—ইত্যাদি’’

সত্যি বলছি আজ পর্যন্ত ওর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি না। তা অমিয়দাকে মানে জিজ্ঞাসা করাতে, উনি কেমন যেন ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। জীবনে কখনো ওঁকে কটু বা রূঢ় কথা বলতে শুনিনি। তখনো বলেননি। খালি বললেন, ‘কবিতা লিখলেই কি তার মানে বলতে হয়ই?’ আমিও অর্বাচীনের মতো বললাম, ‘লিখলেই বলতে হয় না। কিন্তু ছাপবার পর কেউ জানতে চাইলে নিশ্চয় বলবেন।’

শান্ত কোমল মানুষটি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে, উঠে গেলেন। তারপর বুদ্ধদেবকে কি যেন বললেন। তারপর তাঁকে আর দেখতে পেলাম না। কবিতাটির মানেও জানা হল না। কিছুক্ষণ বাদে বুদ্ধদেব এসে ভারি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘খুব ভালো কাজ করা হল। কবিরা কত স্পর্শকাতর, তা ভুলে গেলে চলবে কেন? উনি বাড়ি চলে গেলেন, বলছেন শরীর ভাল লাগছে না। এখন যামিনীবাবুকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের কাজটা কাকে দিয়ে করাই ভেবে পাচ্ছি না।’ যাই হক শেষ পর্যন্ত কাউকে পাওয়া গেছিল নিশ্চয়। আর কেউ এই খুদে নাটিকাটি লক্ষ করেছিল কিনা জানি না। অমিয়দার বহু সুন্দর কবিতা পড়ে যে গভীর আনন্দ পেয়েছি, তার কথা মনে করে আমার চুপ করে থাকা উচিত ছিল।

তা কামাক্ষী সেদিন এসে বলল, ‘রংমশালের ভার নিয়েছি। একটা কিশোর উপন্যাস চাই।’ এ আবার কেমন কথা? উপন্যাস লিখেছি নাকি কখনো? সে বলল, ‘না লিখে থাকলে, এখন লেখবার সময় হয়েছে।’ কিছুতেই ছাড়ল না। ধারাবাহিকভাবে বেরোবে। ওর কথা শুনে কেমন একটা শখ চেপে গেল। লিখেই ফেলা যাক। মুশকিল হল যে মাথায় আপনা থেকে গল্প না গজালে গল্প লিখতে পারি না। রাতে সেই কথা ভাবতে ভাবতে ঝপ করে একটা গল্প গজাল। সকালের আগে ডালপালা বিস্তার করে মনের মধ্যে একটা গাছ হয়ে গেল।

কামাক্ষী বলেছিল এই কাগজে প্রেমেন্দ্র মিত্রের হট্টমালার দেশের তিনটি অধ্যায় বেরিয়ে বন্ধ হয়ে গেছিল। তাই ভয় ভয় করছিল। ওঁর গল্পের পর কি আমারটি জমবে? এইখানে বলে রাখি এর ১৪/১৫ বছর পরে আমরা যখন বেতার বিভাগে কাজ করি, তখন প্রেমেন বাবু ঐ গল্প শেষ করতে সাহায্য করার সম্মান আমাকে দিয়েছিলেন। সম্প্রতি তার নতুন মুদ্রণ হচ্ছে।

সে যাই হক, কামাক্ষীর কথায় ‘পদী পিসির বর্মী বাক্স’ লেখা হয়েছিল। পাঠকরা মহাখুশি। পরের বছর ‘ভয় যাদের পিছু নিয়েছে’ ধারাবাহিক ভাবে বেরুল। আরো পরে যখন বই হল, নাম হল তার ‘গুপির গুপ্ত খাতা’। গুপি নাম আমি বড় ভালোবাসি। নাতিকেও ডাকি গুপি। কি ভালো নাম রংমশাল। তা-ও টিকল না। বছর ২/৩ এর মধ্যে উঠে গেল। আবার কেউ রংমশাল নাম দিয়ে একটা জোরালো ছোটদের পত্রিকা বের করলে পারে।

কামাক্ষীদের পাড়ায় শ্রীযুক্তা মীরা চৌধুরী বলে আমাদের এক পুরনো বন্ধু থাকতেন। আমার মেসোমশাই সুরেন মৈত্রের ভাইঝি। আমার চাইতে কয়েক বছরের বড়। নানা রকম সমাজসেবার কাজে জড়িয়ে থাকতেন। তাঁর ডাকনাম বাবলি। বাবলিদি এখনো আমার প্রিয় বন্ধু। এক দিন কামাক্ষীর ভাই দেবী এসে আমাকে বলল, বাবলিদি শ্রীমতী নাম দিয়ে একটা মেয়েদের মাসিক পত্রিকা বের করছেন, আপনার সহযোগিতা চাইছেন।’

‘মেয়েদের কথা’র স্বল্পায়ুতা দেখেও আমার শিক্ষা হয়নি। শ্ৰীমতীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। বাবলিদি বললেন, ‘একটা আধুনিক কালের মেয়েদের নিয়ে ধারাবাহিক গল্প দাও। তার প্রধান চরিত্ররা হবে মেয়ে এবং শেষটা হবে সুখের।’ এখন আর আমি উপন্যাস-টুপন্যাস দেখে ঘাবড়াই না। ‘শ্রীমতী’ বলে আমার বয়স্কদের জন্য প্রথম উপন্যাস লেখা হল। তারপর ‘জোনাকি’ লেখা হল। সবই আজকালকার (মানে ৩৫ বছর আগেকার) মেয়েদের নানা সমস্যা নিয়ে, গল্পের শেষে ভালো ভালো পাত্রের সঙ্গে সকলের বিয়ে দিয়ে দিলাম। সবাই খুব খুশি। মাঝেমাঝে সম্পাদিকার অনুপস্থিতিতে দেবীতে আমাতে সম্পাদনার কাজও সারতাম। বলা বাহুল্য কিছুদিন পরে বাবলিদির শখও মিটে গেল, অন্য কাজেও বিব্রত হয়ে পড়লেন, কাগজও উঠে গেল। ততদিনে বয়স্কদের জন্য উপন্যাস লেখায় সাহস জমেছে বুকে। সেই সঙ্গে মনে মনে এও বুঝেছি বড়দের চাইতে ছোটদের জন্য লেখায় আনন্দ বেশি। সার্থকতাও। এ-কথা জেনেও আরো অনেকগুলো বড়দের উপন্যাস লিখে ফেললাম।

তা লিখলে কি হবে! ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আমার আর কোন বই ছাপা হয়নি, কোন প্রকাশক আমার কাছে আসেননি, আমিও কোন প্রকাশকের কাছে যাইনি। ওদিকে বাড়ি ভরা পড়ুয়ার দল ক্রমে বড় হচ্ছে, আমার এতটুকু ফুরসৎ থাকছে না। একদিকে প্রাইভেট টিউটর আর অন্য দিকে বাড়ির দরজি। বাইরের কাজ যতই কমিয়ে আনি, ঘরের কাজ ততই বাড়ে। ঘরের কাজও যতই বাড়ে মনের ভিতরকার গল্পগুলো ডানা ঝাপটিয়ে, পালক উড়িয়ে, দম বন্ধ করে আনে। রাত এগারোটা অবধি লেখা ধরলাম। সব গল্পের প্রথম শ্রোতা বাড়ির সাতজন নানা বয়স্ক বাসিন্দা। ভারি তরতাজা তাদের কাঁচা কাঁচা অনভিজ্ঞ মতামত। অমনি আন্দাজ করে নিতাম পাঠকরাও কি বলবে। মাঝে মাঝে একটু-আধটু বদলাতাম। ছোটবেলায় আমার ভাই-বোনদের কাছে যা পেতাম, মাঝবয়সে এদের কাছেও সেই সরল স্পষ্টবক্তার মন্তব্য শুনতাম।

এর মধ্যে একটা শনিবার মেট্রোতে তিনটের ছবি দেখে বেরোতেই আমার ভাইপো মানিক, অর্থাৎ সত্যজিৎ বলল, ‘তোমার সব ছোটদের গল্প আমাকে দেবে? বই হবে।’ বললাম, ‘কে বই করবে?’ ও বলল, ‘এ-দেশের সবচেয়ে ভালো প্রকাশক।’ বললাম, ‘কে সে?’ সে বলল, ‘সিগনেট প্রেস’। আমি বললাম, ‘তুই তার সঙ্গে জড়িত আছিস?’ মানিক বলল, ‘আছি!’ অমনি রাজি হয়ে গেলাম। পরে বদ্যিনাথের বড়ির সব গল্প এবং আরো কতগুলি বাছাই করা গল্প নিয়ে গেল মানিক। বলে গেল ও-ই ছবি আঁকবে।

১৯৪৮ সালে ‘দিন-দুপুরে’ বেরোল। এবং দিলীপ গুপ্ত বলে একজন অবিস্মরণীয় মানুষের সঙ্গে আমার চেনাজানা হল। আর আমি ফিরে চাইনি। সাহিত্যের দুর্গম পাহাড়ের একটি ধাপে দিলীপ আমাকে পা রাখার জায়গা করে দিল। যদিও সে আমার চেয়ে ১০ বছরের ছোট ছিল। তার কথা পরে বলা যাবে। তার আগে ভারতের স্বাধীনতা-লাভের কথা না বললে লোকে আমার নিন্দা করবে। যদিও সত্যি সত্যি কতখানি স্বাধীনতা হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো খট্কা লাগে।

ভাবি স্বাধীনতা আবার কাকে বলে? প্রথম মহাযুদ্ধের পর শিলং-এ কখনো স্বাধীনতার কথা শুনিনি। খালি কয়েকজন বলিষ্ঠ নির্ভীক যুবককে একবার একটা বড় জলপ্রপাতের মুখ বেয়ে বেয়ে উঠতে দেখেছিলাম। বড়রা বলেছিলেন, ‘ওরা বোলপুরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্কুলের ছাত্র। ওদের প্রাণে ভয়-ডর নেই।’ কেন জানি না স্বাধীনতার কথা বললেই তাদের চেহারা মনে পড়ত। বারো তেরো বছরে কলকাতায় এসে অবধি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাহস, ত্যাগ, আদর্শবাদ ইত্যাদির কথা শুনে এসেছিলাম। সুভাষ, চিত্তরঞ্জন, গান্ধী ইত্যাদির কথা জানলাম। সন্ত্রাসবাদীদের কথাও জানলাম। কিন্তু কারো কাছে স্বাধীনতার নগ্ন চেহারাটা কেমন হবে শুনলাম না।

ভাবতাম ব্রিটিশরাই আমাদের শত্রু। ওদের তাড়াতে পারলেই দেশটা সঙ্গে সঙ্গে একটা মহান শক্তিতে পরিণত হবে ইত্যাদি। হল যখন স্বাধীন, প্রথমটা অত টেরই পাওয়া গেল না। সবই আগের মতো, তবে আগের চেয়ে কাজে একটু ঢিল দিয়ে চলতে লাগল। দিল্লিতে ইংরেজ বড়লাট রইলেন। তিনি নাকি আমাদের স্বাধীন হবার পথ খোলতাই করে দেবেন। বেকুব বনে গেলাম। কে বন্ধু কে শত্রু গুলিয়ে গেল।

ব্যাপকভাবে দাঙ্গা হল। কত লোকের যে কত ক্ষতি হল তা বলবার নয়। দলে দলে উদ্বাস্তু এল। ত্রাণ শিবির হল। বেথুন-কলেজের পেছনে একটা কেন্দ্র হল। সেখানে বছর দেড়-দুই বয়স্ক শিক্ষা মস্ক করলাম। হ্যাঁ, বলতে ভুলেই যাচ্ছিলাম আমাদের নিজেদের জাতীয় সঙ্গীত হল, দেশ দু-ভাগ হল, গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে স্বাধীনতা উৎসব হল। লোকের বাড়িতে বাড়িতে ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭ সালে খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি হল। মনে আছে আমাদের তামিল বন্ধু ডাক্তার কৃষ্ণনের বাড়িতে ভোজসভা হল। খাওয়া-দাওয়ার পর, রাত বারোটায় বেতার-কেন্দ্র থেকে বিশেষ স্বাধীনতা অনুষ্ঠান হল। তাতে অমল হোম, কালিদাস নাগ এবং আরো অনেকে পরাধীন যুগে লেখা নানা রকম স্বাধীনতার কবিতা, গান, প্রশংসাবাণী পাঠ করলেন, চমৎকার সব দেশপ্রেমের গান হল। রাত বারোটার পর অনুষ্ঠানের শেষে ঘোষণা করা হল এত কষ্টের পর দেশ এবার স্বাধীন হয়েছে। তোমরা জয়ধ্বনি দাও।

তাজ্জব বনে গেলাম। স্বাধীনতা লাভ করার পর তো কেউ আর স্বাধীনতার গান লেখে না, প্রশংসা করে না। দেশকেও বোধহয় এখন আর কেউ ভালোবাসে না। খালি নিন্দে করে আর সুবিধে পেলেই বিদেশে গিয়ে রাশি রাশি টাকা কামায় আর যারা যেতে পারেনি তাদের ঈর্ষার কারণ হয়। কেবলি শুনি ও-সব দেশের জীবনযাত্রা কত আরামের, কত ভালো, এই পোড়া দেশে কেউ থাকে নাকি। কই কেউ তো আর বলে না এই দেশ আমার মা। মায়ের মতো কেউ নেই আমার। আমার গভীর দুঃখী মায়ের চোখের জল আমি মুছিয়ে দেব। প্রাণ-পাত করে দেশকে বড় করতে চেষ্টা করব। আমরা সৎ হব, সৎসাহসী হব, পরিশ্রমী হব, বিশ্বাসযোগ্য হব, বলিষ্ঠ হব, জোরাল হব, ভালোকে ভালো বলব, মন্দকে মন্দ বলব। আমরা ছাড়া কে আমাদের মায়ের দুঃখ ঘুচোবে!

আর তো কেউ এ-সব বলে না।

তবে ১৯৪৭ সালে ঠিক করলাম দেশটা এখন স্বাধীন হয়েছে, এবার ছোটবেলাকার সেই আমার স্বপ্নের শহরটাকে দেখে আসি। সেখানকার কনভেন্টের ফিরিঙ্গিরা আমাদের নেটিভ বলত। এখন সে জায়গা কেমন হল দেখে আসি। ঐ বছর পুজোর সময় আমার ছোট বোন লতিকা, আমার ছেলে, মেয়ে আর আমি শিলং গেলাম। সুরমা, তার মা আর মেয়েদের সঙ্গে কাশী গেল। অক্টোবরের কাশীও নাকি বড়ই উপভোগ্য।

॥ ৭ ॥

১৯৪৭ সালের পুজোর ঠিক আগে শিলং গেলাম। সেখানে নেহাৎ জলে পড়ব না। সেখানে মোটর কোম্পানিতে আমার বড়পিসিমার নাতি অশোক কাজ করে। লাইমখ্‌রাতে সপরিবারে থাকে। অশোকের মা আমার বৌদিও থাকেন। অশোক আমার মা-বাবার কাছে ৮/৯ বছর বয়স থেকে মানুষ, আমার সহোদর, ভাইদের চেয়ে কোনোদিক দিয়ে আলাদা নয়। আমার চেয়ে দুই বছরের ছোট। সে গৌহাটি এসে তার স্টেশনওয়াগনে করে আমাদের নিয়ে যাবে। প্রায় এক মাস তার কাছে থাকব।

২৭ বছর পরে শিলং যাচ্ছি। বারো বছর বয়সে শেষ দেখা শিলঙের প্রতিটি নীল সবুজ পাহাড়ের চুড়ো আমার মুখস্থ, শহরের পথ-ঘাট, গাছপালা, বাড়ি-ঘর, খেলার মাঠ, ঘোড়দৌড়ের মাঠ, গল্ফ-গ্রীন, চোখ বুজলেই দেখতে পাই। মনে করলেই সরল গাছের বনের মধ্যে বাতাস বইবার নিরন্তর শোঁ-শোঁ শব্দ শুনতে পাই। শিলং আমার মনের মধ্যে গাঁথা ছিল; তার কিছু ভোলা আমার পক্ষে অসম্ভব। অনেকগুলো খাসিয়া কথাও হঠাৎ মনে পড়ে গেল। মাছকে বলে ভখা, অ-খাসিয়ারা উদ্খার, ভগবান উবনোই। মেয়েদের নামের আগে কা থাকবে, পুরুষদের নামের আগে উ। সেই সব স্নেহময়ী দাসীদের চেহারা মনে পড়ল, যারা আমাদের সব সুখের সুখী, দুঃখের দুঃখী ছিল; যাদের কোল ঘেঁষে বসে ছোটবেলা থেকে কত ভয়াবহ গল্প শুনে শিউরে উঠে তাদেরি গায়ে পিঠ মুখ ঘষতাম; যাদের থলি থেকে পানের বোঁটা খাবার বাসনা কিছুতেই দমন করতে পারতাম না। ভাবলাম সবাই নিশ্চয় মরে যায়নি। অনেকের বাড়ি আমার চেনা ছিল, সেখানে যাবার পথ জানা ছিল। বলা বাহুল্য তাদের কাউকে খুঁজে পাইনি। স্বপ্ন ভেঙে গেলে আর কি তাকে ফিরে পাওয়া যায়? মনে আছে পূজা কন্‌সেশন পাওয়া গেল। কিছু কম দামে সেকেণ্ড ক্লাসে বার্থ রিজার্ভ করা হল। সেকালে চারটে ক্লাস ছিল। আমরা সাধারণত সেকেণ্ড ক্লাসেই যেতাম। খুব আরামের ব্যবস্থা থাকত। দুঃখের বিষয়, সেটি ছিল মহালয়ার আগের দিন। শিয়ালদায় আমাদের করিডর ট্রেন অপেক্ষা করছিল। আমাদের খুদে কম্পার্টমেন্টে আমরা পাঁচজন—লতিকা, আমার ছেলেমেয়ে, আমি এবং কল্যাণী, সে কবি জীবনানন্দ দাশের আত্মীয়া।

ভেবেছিলাম বেশ আরামেই যাওয়া যাবে, সবাই মিলে গল্প করতে করতে সান্তাহার অবধি যাওয়া যাবে। সেখানে গাড়ি বদল করে মিটার গেজে উঠতে হবে। বার্থ রিজার্ভ করা থাকবে। সেই সুযোগে নতুন দেশ পূর্ব পাকিস্তানটাকে দিব্যি দেখে নেওয়া যাবে। সঙ্গে যথেষ্ট খাবার-দাবার নেওয়া হয়েছে। সেকালে রেল-ভ্রমণ একটা আনন্দের ও আরামের ব্যাপার ছিল।

শিয়ালদায় গাড়ি ছাড়বার আগেই স্বাধীনতার প্রথম আস্বাদটুকু মুখে লাগল। দলে দলে ইণ্টার আর থার্ড ক্লাসের যাত্রীরা (নিশ্চয়ই ঐ সব ক্লাসে জায়গা না পেয়ে) আমাদের গাড়িতে উঠতে লাগল। দেখতে দেখতে বাইরের গলি পথটাতে নড়বার জায়গা রইল না। তখন তারা আমাদের খোপটুকুতে আসবার চেষ্টা করতে লাগল। আমরা দরজা খুলিনি। আর শুধু শিয়ালদায় নয়, যেখানেই গাড়ি থামে, সেখানে দলে দলে হাসিমুখে লোক ওঠে। দেশ স্বাধীন হবার পর এই তারা প্রথম ‘বাড়ি’ যাচ্ছে। ‘বাড়ি’ যে এক মুলুকে আর তাদের আবাস যে অন্য মুলুকে, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তখনো তাদের হয়নি। মহা খুশি হয়ে তারা পূর্ব পাকিস্তানে ‘বাড়ি’ যাচ্ছে। তখনো পাসপোর্ট বা ভিসার নাম শোনেনি কেউ। সুখের বিষয় সান্তাহারে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল, গাড়িও খালি হয়ে গেল। পূর্ব-পাকিস্তানের অতি ভদ্র কর্মচারিরা (যারা ৬ মাস আগেও আমাদের ভাই-ব্রাদার ছিল) আমাদের নতুন ট্রেনে জায়গা খুঁজে দিলেন। সেকালে ৫টা বার্থ নিলেই সেকেণ্ড ক্লাসের গাড়ি রিজার্ভ করা যেত।

গাড়িতেই আমাদের জন্য গরম খাবার এল। সেকালে রেলের রেস্তোরাঁর খাবারের মতো সস্তা ও সুস্বাদু খাবার অন্য কোথাও পাওয়া যেত না। আমরা তখনো স্বাধীনতায় অভ্যস্ত হবার সময় পাইনি বলে পরাধীন জীবনের নিয়মগুলোই চলে আসছিল।

যথা সময়ে গাড়ি ছাড়ল। তার আগে গার্ড এসে বলে গেলেন দরজা-জানলা ভেতর থেকে যেন বন্ধ করে রাখি এবং গাড়ি চলাকালে কোনো মতেই যেন না খুলি। তা বাইরে থেকে যে যাই বলুক। রিজার্ভ গাড়িতে অন্য যাত্রী উঠতে পারে না।

গাড়ি ছাড়বার ১০ মিনিটের মধ্যে বাইরে থেকে দরজায় ধাক্কাধাক্কি—‘ও দিদি, দরজা খুলুন, নইলে পড়ে মরব। তাড়াতাড়ি অন্য গাড়িতে না উঠে ভুলে এখানে উঠেছি। পরের স্টপেই নেমে যাব।’ বলা বাহুল্য আমরা কান দিইনি। ভাগ্যিস গার্ড সাবধান করে দিয়েছিলেন। নইলে ওর ঐ কাতর—‘এই পড়ে গেলাম, এই মরে গেলাম’ শুনে কি হত কে জানে। তার ওপর ছেলেকে জ্বর গায়ে নিয়ে যাচ্ছি। এক সময় দুত্তোর বলে সম্ভাব্য ডাকাতটি খসে পড়ল, আমরাও বাকি রাতটা অঘোরে ঘুমোলাম।

সকালে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে আমিনগাঁও ঘাটে গাড়ি পৌঁছল। তখনো রেলের পুল তৈরি হয়নি, নদী পারাপার হতে হয় স্টীমারের সঙ্গে জোড়া ‘ফ্ল্যাট’-এ চেপে। ফ্ল্যাটের দোতলা চারদিক খোলা চমৎকার একটা বৈঠকখানাঘরের মতো। খাবার ঘর, ছোট ছোট ক্যাবিন, গোসলখানাও ছিল। আমি অত লক্ষ্য করিনি গোড়ায়। এই সেই ব্ৰহ্মপুত্র। এই নদীই মৈমনসিংহে আমার পিতৃপুরুষদের নিবাস, সেই গালগল্পে মুখর কিশোরগঞ্জের পাশ দিয়ে বয়ে যায়। এরি তীরে আমাদের গ্রাম মসূয়া। ছোটবেলায় শুনেছিলাম ছয় মাইল খাতের মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদ কেবলি দিক বদলায়। কখনো বাঁ তীর, কখনো বা ডান তীর ঘেঁষে চলে। যদিও হিমালয় ভেদ করে আসার সময়কার রূপের সঙ্গে এই নদীর তুলনা হয় না, তবু বর্ষায় তার সংহারিণী সৌন্দর্য দেখলে বুক কাঁপে, হৃদয় মুগ্ধ হয়।

আমরা তার কিছুই দেখলাম না, তবু মনে হল এমন সুন্দর নদী আর হয় না। চওড়া, গভীর, দূরে সকালের আলোয় একটা অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। কে যেন বলল ঐ উমানন্দ, ওখানে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি জল আছে, কত তীর্থযাত্রী ডুবে মরেছে। মনে পড়ল যখন এম. এ. পড়তাম গৌরাঙ্গবাবু বলে আমাদের গ্রন্থাগারিক সপরিবারে ওখানে প্রাণ হারিয়েছিলেন। মনটা খারাপ হয়ে গেল। আজ দেখলাম শুশুক মাছ সকালের রোদে ডিগবাজি খাচ্ছে, গা থেকে জল ঝরছে।

দেখতে দেখতে পাণ্ডুঘাটে জাহাজ লাগল। অশোক সেখানে গাড়ি নিয়ে এসেছিল। সেখান থেকে গৌহাটি গেলাম। পথে কামাখ্যা পাহাড় দেখতে পেলাম। এ-সবই আমার চেনা নাম। তবে শেষ দেখা ২৮ বছর আগে। চেহারাগুলো কেমন ভুলে ভুলে গেছিলাম। আবার দেখে প্রাণ জুড়ল। গৌহাটি তখনো আসামের রাজধানী। দেশ সদ্য স্বাধীন, বিশেষ কোনো অদল-বদল হয়নি, নতুন ব্যবস্থা খুব বেশি মালুম দেয় না। দৈনন্দিন জীবন তো নয়ই।

দুপুরে এক জায়গা খাওয়া-দাওয়া করে, অশোকের ল্যাণ্ডরোভার চড়ে বিকেলের মধ্যে রওনা হলাম। যতই পাহাড়ের দিকে এগোই ততই আমার শৈশবটা আমার নাড়ি ধরে, স্নায়ু ধরে টানাটানি করে। তখনো বড়পানি—নদীতে বাঁধ দিয়ে বিজলী-সরবরাহের উদ্দেশ্যে বিশাল জলাধার হয়নি। সেই চেনা সুন্দরী বড়পানিকে দেখতে পেলাম। আমার কথা বন্ধ হয়ে গেছিল, মনে হচ্ছিল এই ২৮ বছরে কিছুই বদলায়নি। প্রকৃতি বদলায় না, মানুষের হাত না পড়লে। সেই পাহাড়, সেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ে পথ, সেই একদিকের খাদের নিচে বড়পানি নদী তার জলের সম্ভার নিয়ে পাথরের ওপর দিয়ে ফেনা ছিটিয়ে ছুটে চলেছে। সেই নংপোর ঘর-বাড়ি, চায়ের দোকান। কুয়াশার সেই সুগন্ধ। মাঝখানের এই ২৮ বছরের সুখই বা কি আর দুঃখই বা কি? মনের মধ্যে সব গুলিয়ে যেতে লাগল। আমার ছাড়া আর কারো শৈশব-স্মৃতির সঙ্গে এ-সব পথ জড়িয়ে নেই। আহা, ঐ তো বাঁ হাতের স্রোতস্বিনীর ওপর সেই ময়দা পেশার কলের মস্ত চাকা তেমনি ঘুরছে! শেষ যখন দেখেছিলাম ওরি সামনে পথের ধারে গরুর গাড়ির গরু খুলে দিয়ে, কাঠের জ্বালে কালো হাঁড়িতে গাড়োয়ানরা রান্না চাপিয়েছিল। আজো তাই দেখলাম। বুকের মধ্যে অতীতকে নিয়ে চললে পদে পদে তার দেখা পাওয়া যায়।

মনে পড়ছিল ডান হাতে বিশপ-বিডন ফল্‌স্‌ দেখার পথ। তাকে চিনতে পারলাম না। এত বাড়িঘর তো ছিল না! টিলার ওপর বাজার বসত। মনে হচ্ছিল খুব উঁচু টিলা, কতবার চড়েছি। তার ধাপে ধাপে আর পায়ের কাছে কি সুন্দর করে ফল তরকারি সাজিয়ে বসত মেয়েরা। এইখানেই কোথাও ছেলেদের হাইস্কুল যাবার পথ। দাদা, কল্যাণ সেখানে পড়ত। মনে পড়ল স্কুলের গোল পিতলের ঘণ্টা একটা উঁচু ঝাউগাছে ঝুলত। তার ওপর দু-বার বাজ পড়েছিল। আমরা বাঁ দিক দিয়ে লাইমোখরা যাবার পথ ধরলাম। ও-সব পুরনো চিহ্ন খুঁজে পেলাম না।

এই দিকেই তো পুলিস-বাজার। সেখানে ২৮ বছর আগেও বিপিনবাবুর দোকান থেকে পরস্পরের জন্মদিনের উপহার কিনতাম। চার ছয় আনায় কি ভালো ভালো জিনিস পাওয়া যেত। দিদি আমাকে একটা আঙুর-পাতার মতো মিনে করা ব্রুচ্ দিয়েছিল আমার ১০ বছরের জন্মদিনে। সেটা কবে কোথায় হারিয়ে ফেলেছি বলে বেজায় দুঃখ হতে লাগল। দিদি ছয় আনা দিয়ে ব্রুচটা হয়তো কিনেছিল, কিন্তু এখন আমার কাছে তার দাম আমার সমস্ত শৈশবের সমান। এক সময় অশোকের বাড়িতে পৌঁছলাম। সেন্ট এড্মাণ্ডস্ স্কুলের পেছনে এই বসতির বদলে তখন ছিল সরল বন। তার তলায় তলায়, বুনো ভায়োলেট ফুল ফুটত। মাঝে মাঝে বসন্তকালে প্রকৃতির শোভা উপভোগ করতে শেখবার জন্য আমাদের এখানে নিয়ে আসা হত। আমরা গোছা গোছা ফুল কুড়োতাম। গাছের ডালে বেগনির ওপর ছিট ছিট অর্কিড ফুটতে দেখেছিলাম। আমার মধুর শৈশবের সঙ্গে তারাও কোথায় বিদায় নিয়েছে। রেখে গেছে বাঁধানো সড়ক, তার দুধারে ছোট ছোট বাগান-যুক্ত সারি সারি টিনের চাল দেওয়া ছোট ছোট বাড়ি।

দু-দিন মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ল। ছেলেটার জ্বরও ছাড়েনি। তারপর প্রথম যেদিন রোদ উঠল, আমার ছোটবেলার জায়গাগুলো সবাইকে দেখাতে নিয়ে গেলাম। সেণ্ট এড্মাণ্ডসের সামনের টিলার মাথায় লোরেটো কন্ভেন্ট আর তার পাশে চমৎকার গির্জা। নিচের সড়ক থেকে পাকদণ্ডীর মতো পথ উঠে গেছে। ওপরটাকে সমান করে ঘর বাড়ি, বাগান করা হয়েছে।

সে-সব খুঁজে পেলাম না। শুনেছিলাম আগুন লেগে স্কুলের কাঠের বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছিল দু-দু বার। এবার অনেকটা নিচে, পাহাড়ের গা কেটে স্কুলবাড়ি হয়েছে। সে গির্জাও নেই। তার বদলে ভারি আভিজাত্যময় ধনী চেহারার এক চমৎকার গির্জা। নাকি বিদেশের ভক্তদের চাঁদায় তৈরি হয়েছে। ভেবেছিলাম একবার গিয়ে দেখে আসব। গির্জার ভেতরটা এখনো সেই রকম সুন্দর গম্ভীর কিনা দেখে আসব। সব উৎসাহ চলে গেল। বুঝতে পারলাম এ সবের সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নেই।

হাই — উইন্ড্স্ নামে যে লম্বা বাড়িটির স্মৃতি আমার মনের একটি কোমল উষ্ণ কোণ জুড়ে বিরাজ করত, মন খারাপ হলে তার এক সারি আলোকিত জানলা দিয়ে আমাকে আদর করে ডেকে নিত, সে-ও দেখলাম অন্যরকম দেখতে হয়েছে।

পশ্চিম দিকের মস্ত ঝাউগাছটি নেই। তার পায়ের কাছটি ঘিরে মা ভায়োলেট ফুলের গাছ লাগিয়েছিলেন। কাছে গেলেই তার মিষ্টি গন্ধ নাকে আসত। বাড়ির সামনের যে ন্যাসপাতি গাছে আমি গাছে-চড়া শিখেছিলাম, যার মিষ্টি ফলের স্বাদ এখনো আমার মুখে লেগে আছে, তাকেও দেখতে পেলাম না। পূর্বদিকে তিনটি মস্ত মস্ত গন্ধরাজ লেবুর গাছ ছিল। সেখানে আমাদের সুইট-পী ফুটত। তার জায়গায় একটা বড় গন্ধরাজ।

বলা বাহুল্য বাড়ির তখনকার বাসিন্দারাও আমাদের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাননি। তবু আজ পর্যন্ত শিলং বললেই আমার সেই ছোটবেলাকার শিলং-এর চেহারাই মনে পড়ে। কালের জবর-দখলীদের আমার মন মানতে চায় না। দেখলাম যেখানে যেখানে মানুষের হাত পড়েনি সেখানেই আমার ছোটবেলাটি আঁকড়ে রয়েছে। নদীর জল কমে গেছে, বন পাতলা হয়ে গেছে, লক্ষ লক্ষ নতুন বাড়ি। কিন্তু পাহাড়ের আকৃতি তেমনি আছে, তেমনি নীল নভোতলে রূপোলী তুলি দিয়ে আঁকা ছবির মতো বহুদূরের হিমালয় দেখতে পেলাম। সেই সব ছোটবেলাকার প্রিয় পাহাড়ি ফল আরেকবার চোখে দেখলাম। টক লাগল। তবে সে সময়ও মা বলতেন—বড় টক, কি করে খাস?

সব পুরনো জায়গাগুলো একবার করে ঘুরে দেখে এলাম। মনের মধ্যে কয়েক বছর ধরে ঐ বিশেষ জায়গাটির জন্য যে আঁকু-পাঁকু ভাব জমেছিল, সেটি শান্ত হল। আসলে আমার ছোটবেলাকার শিলং ছিল ভারি পরিচ্ছন্ন কোমল সাহেবী ভাবাপন্ন; অতি সুন্দর প্রকৃতির মাঝখানে বসানো, অতি আরামের একটি ছোট শহর। গল্ফ খেলা, টেনিস খেলা, ঘোড়দৌড়, ফুটবল, মিলিটারি কুচকাওয়াজ, পিকনিক ইত্যাদির কোনোটাকেই এদেশে উদ্ভাবন বলা চলে না। কিন্তু এখানে তাদের চেহারায় আগ্রহ ছিল, উগ্রতা ছিল না, রেষারেষি ছিল না, বিদ্বেষ ছিল না। কেমন যেন মিলেমিশে সকলে সুখ বাস করত! সাহেবরা ‘নেটিভ’ শব্দ ব্যবহার করত, স্কুলে মাঝে মাঝে ‘নেটিভ’ মেয়েদের ওপর অবিচার হত। কিন্তু যখন দেখা গেল ক্লাসে তারাই বেশি নম্বর পায়, এমন কি ইংরিজিতেও, তখন সবাই মেনে নিত। আমাদের স্কুলের খাঁটি মেম শিক্ষিকারা দিশি মেয়েদের ওপর কখনো অন্যায় করতেন না। ফিরিঙ্গিদের কথা আলাদা।

হয়তো চা-বাগানের সাহেবরা, গল্ফ-উৎসাহীরা, মিলিটারি সাহেবরা, আই-সি-এসরা, জায়গাটারপরিচ্ছন্নতা রক্ষা করতেন। মোট কথা, বড় ভালো জায়গা ছিল, যেমন সুন্দর তেমনি আরামের; খুব শীতও না, খুব গরমও না। সেই পুরনো শহরে আমার মন বাস করে, এখনকার শহরে নয়। তারপর আরো ৩৫ বছর কেটে গেছে। শুনেছি এখন মশারির তলায় শুতে হয়, শীতকালেও বড় একটা জল জমে বরফ হয় না। দলাদলি আছে। এ জায়গায় আমার বাস ছিল না। একদিন-ও ঘুঘু পাখির ডাক শুনিনি।

খুব ঘটা করে দুর্গাপুজো হল। কালীপুজো হল। তারপর আমার স্বামী একদিন এসে আমাদের নিয়ে এলেন। অশোকের মা, স্ত্রী ছেলেমেয়েদের মিষ্টি ব্যবহারে সুখে কেটেছিল সময়।

এর আগে রাতে ঘুমিয়ে মাঝেমাঝেই স্বপ্ন দেখতাম শিলং-এ ফিরে গেছি। মনটা উদ্বেল হয়ে উঠত। ফিরে এসে আজ পর্যন্ত আর কখনো আমি শিলং-এর স্বপ্ন দেখিনি।

ফিরে এলাম ১৯৪৭ সালের শেষের দিকে। ততদিনে মানিক সত্যি সত্যি আমার বইয়ের কাজ অনেকখানি এগিয়ে এনেছিল। দিলীপ গুপ্ত বলে একজন অসাধারণ মানুষকে একদিন সে সঙ্গে করে নিয়ে এল। দিলীপের মামা মামী মা বোন আমার অচেনা হলেও, আমার স্বামীর অচেনা নয়। দিলীপ আমার চেয়ে ১০ বছরের ছোট ছিল, মানিক ১৩ বছরের ছোট। আমার ৩৯ শেষ হয়ে এসেছে, ওদের ২৯ আর ২৬। খুব একটা অভিজ্ঞ বলা চলে না। দুজনেরি দু-রকমের জন্মগত প্রতিভা। দিলীপকে আমি একটি অসাধারণ চরিত্র বলে মনে করি। আমার সারা জীবনে এমন আরেকজন প্রকাশক দেখলাম না। দিলীপ তার লেখকদের লেখা সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভাবে ছেপে ও প্রকাশ করে, সবচেয়ে বেশী লাভ ও খ্যাতি পাবার কথা চিন্তাও করত না। সে অন্য ধাতুতে গড়া ছিল।

আমার বারে বারে মনে হয়েছে দিলীপ তার লেখকদের মধ্যে থেকে তাদের শ্রেষ্ঠ সম্ভাব্য সৃষ্টি প্রস্ফুটিত করিয়ে নিতে জানত। কার দৌড় কতখানি এক নিমেষে বুঝে নিতে তার খুব অসুবিধা হত না। আমার লেখা যদি ভালো হত, আমার বই যদি লোকের ভালো লাগত, দিলীপ বোধ হয় আমার চেয়েও বেশি খুশি হত। কোনো দ্বিতীয় শ্রেণীর জিনিস তার হাত থেকে বেরোত না। সব দিকে তার চোখ ছিল, কাগজ ভালো, কালি ভালো, মলাট ভালো, ব্লক ভালো, ছবি ভালো, লেখক ভালো। সম্ভাব্য লেখককে কেমন করে তার স্বকীয়তা নষ্ট না করে দিয়ে, প্রথম শ্রেণীর লেখকে দাঁড় করিয়ে দিতে হয়, দিলীপ তা জানত। প্রতিভা খুঁজে বেড়াত সে, তার মাথায় একটা গাইগার কাউণ্টার ছিল গুণ খুঁজে বের করার। অজেয় রায় বলে আমাদের এক অপেক্ষাকৃত কম-বয়সী লেখক বন্ধু আছেন। তিনি একটা বড় ভালো কথা বলেন। তিনিই হলেন উত্তম প্রকাশক যিনি সাহিত্যরসিক, সাহিত্যপ্রেমিক, সাহিত্যঞ্জ, কিন্তু যাঁর নিজে বিখ্যাত সাহিত্যিক হবার বাসনা নেই। তবেই তিনি নিজেকে নিয়ে নিবিষ্ট না থেকে, অন্য সৃষ্টিকারদের তৈরি করতে পারবেন। শ্রেষ্ঠ প্রকাশক শুধু তৈরি করা বই ছেপে বিক্রি করেন না। তিনি সম্ভাবনাময় লেখক চিনে, তাকে দিয়ে উত্তম সাহিত্য রচনা করান। এ একটি বিধিদত্ত গুণ, হীরের চেয়েও মূল্যবান, হীরের চেয়েও বিরল। এত অল্প সময়ের মধ্যে দিলীপের প্রকাশক জীবন যে শেষ হয়ে গিয়েছিল সেটা বাংলা সাহিত্যের দুর্ভাগ্য।

কত কথাই মনে পড়ে। আদর করে পাণ্ডুলিপি প্রায় মাথায় তুলে নিয়ে গেল। ছবি আঁকবে সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রতিভা যার। সে সত্যজিৎ। অতি আড়ম্বর দিলীপ সইতে পারত না, আনাড়ি কাজ, ভুল ত্রুটি বরদাস্ত করত না। তারপর একদিন এক প্যাকেট বই, এক বাক্স সন্দেশ, এক গোছা ফুল, আর এক গাল হাসি নিয়ে দিলীপ এসে হাজির হল। আমি কৃতার্থ হয়ে গেলাম। বইয়ের নাম দিন-দুপুরে, ওর মধ্যেকার একটি গল্পের নামে। তাছাড়া সাবালিকা হয়ে ঐ আমার প্রথম গল্প। বড়দার মৃত্যুর পর সন্দেশ বেশ ক-বছর বন্ধ ছিল। তারপর বড়দার ছোট মণিদার (সুবিনয়ের) সম্পাদনায় আবার যখন বেরোতে আরম্ভ করল, আমি তখনো কলেজে পড়ি। হয়তো ১৯২৮ সাল। তারিখ গুলিয়ে যায়, ডাইরি রাখিনি কখনো। এখনি সমস্ত ভুলে যাই বলে ছোট ছোট উপহার পাওয়া নোট বইতে টুকে রাখি। তাও কোথায় টুকে রাখি তার ঠিক নেই, দরকারের সময় খুঁজে খুঁজে হদ্দ হই।

দিন-দুপুরের কাহিনী সেই অতিশয় ব্যবহৃত স্বপ্ন—প্লট হলেও, স্রেফ রসের জোরে উৎরে গেল। মণিদা দু-এক মাস বাদে-বাদেই গল্প চেয়ে নিতেন। বইখানি পাঠকদের মনে ধরে গেল, তা সে যত না লেখার গুণে, তার চেয়ে ঢের বেশি নিখুঁত প্রকাশনা আর উপস্থাপনার জোরে। এ-বিষয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই। ঐ এক রকম বলতে গেলে আমার প্রথম সফল বইয়ের মতো সর্বাঙ্গসুন্দর বই আর আমার নেই, অমন আত্মনিবেদিত প্রকাশকও আর দেখিনি। ওর পরে আমার যে প্রায় নব্বুইটি বই প্রকাশিত হয়েছে, তার কতকগুলিতে আমার অর্থলাভ হয়েছে অনেক বেশি, প্রতিষ্ঠা পেয়েছি যথেষ্ট, কিন্তু প্রকাশনার দিক থেকে ওর ধারে কাছেও কেউ যায় না। লোককে জানিয়ে দিত দিলীপ,এই সব বই পড়ে দেখ তোমরা, মনে হয় ভালো লাগবে। খুদে এক নোট বই বের করত মাঝে মাঝে, তার নাম ছিল ‘টুকরো কথা’, তাতে সংক্ষিপ্তাকারে সিগনেটের বইয়ের পরিচয় দেওয়া থাকত। অনেক সময় বই থেকে ছবি নিয়ে, তাও দেওয়া হত। কোনো রংচঙে, চটকদার, যাকে বলা যায় চিল্লানো—চিত্র নয়। সাদাকালোয় বইয়ের ইলাস্ট্রেশন তুলে দেওয়া হত। প্রত্যেকটি বইয়ের স্বকীয়তা ফুটে উঠত।

আজকালকার মতো বহুল প্রচারের চেষ্টা করত না দিলীপ। যতদূর মনে পড়ে বড়জোর ৩,৩০০ কপি ছাপত একেক বারে। দিন-দুপুরেও বোধ হয় তাই ছেপেছিল। তারপর ‘পদী-পিসির বর্মী বাক্স’ সাহস করে ৫,৫০০ ছাপল। আমার কি ভয়। শেষটা ওদের ক্ষতির কারণ হব না তো! কিন্তু দিলীপের ব্যবসা—বুদ্ধি ছিল তীক্ষ্ণ। আমার যতদূর বিশ্বাস কেবল মাত্র বার্নার্ড শ – র অনুবাদের ব্যাপারে ওকে নিরাশ হতে হয়েছিল। দিলীপের কথা বলে বলে আমি শেষ করতে পারি না। তার কর্মকুশলতার জুড়ি নেই, তার উদার গুণগ্রাহিতার তুলনা নেই। গ্রন্থলোকে সে একটা ঐতিহ্যের মতো। তাকে অনুসরণ করে বহু প্রকাশকের উত্তরণ হয়েছে। একমাত্র সে-ই বাংলায় ভালো বই প্রকাশ করেছে এ কথা বললে অন্যায় এবং অবিচার হবে। তাছাড়া ওর আগেও উপেন্দ্রকিশোর বলতে চেষ্টা করেছিলেন যে বইকে হতে হবে নির্ভুল, নিখুঁত। পাঠ্যাংশ, প্রকাশন, উপস্থাপনা সব হবে যতদূর ভালো করা যায়। ছাপার ভুল পারতপক্ষে থাকবে না। সেকালের সন্দেশ পত্রিকা এই আদর্শের নিদর্শন। ভুল ছাপা খুঁজতে হয়। ছবির, কাগজের বাঁধাইয়ের তুলনা হয় না। পাঠ্যাংশের কথা তো বাদই দিলাম।

এখানে সমসাময়িক ছোটদের (এবং বড়দের) পত্রিকার পক্ষ নিয়ে দুটি কথা বলতে হয়। আমার জ্যাঠামশাই তাঁর সন্দেশকে কখনো তার অমন গুণ-সম্ভার নিয়েও নিজের পায়ে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেননি। চিরকাল পকেট থেকে তার খরচ দিয়েছেন। দাম ছিল বোধ হয় তিন আনা। লেখকরাও বিনি পয়সায় লেখা দিতেন, ছবির বেশির ভাগই নিজে ও নিজের ছেলে – মেয়ে (সুকুমার—সুখলতা) আঁকতেন। উৎকৃষ্ট কাগজ এখনকার তুলনায় জলের দরে এবং অপর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত। তবু পত্রিকার পেছনে টাকা ঢালতে হত। ছোটদের বই সস্তায় হয় না। পৃথিবীর কোনো দেশেই হয় না। কিন্তু পকেট থেকে পয়সা ঢাললে ব্যবসা হয় না। কাজেই হাজার হাজার বই হাজার হাজার সংখ্যায় বের করা হয়। লেখক এবং শিল্পী যতই ভালো হক না কেন, দিলীপের, সেই পারফেক্শনিস্টের, মানের ধারে কাছে পৌঁছয় না। বই সে-রকম না হলেও, পাঠ্যাংশের মান এতটুকু খর্ব হয়েছে, এ-কথা বলা ঠিক নয়। মান বিচার করতে হলে অযোগ্য লেখা বাদ দিয়ে, শুধু শ্রেষ্ঠ রচনার কথাই ধরতে হবে। এত নতুন নতুন বিষয়ে এত অতি ভালো বই এর আগে প্রকাশিত হবার সম্ভাবনাই ছিল না। যাঁরা আজকালকার শিশু সাহিত্যের নিন্দা করেন, তাঁদের অনুরোধ করি, প্রতি বছর ছোটদের জন্যে যে-সব ভালো ভালো বই বেরোয় সেগুলি সহানুভূতির সঙ্গে পড়ে দেখবেন। বইয়ের কথা উঠলে আমি নেশাখোরের মতো হয়ে যাই, আপনারা আমার প্রগল্ভতা ক্ষমা করবেন।

সিগনেট প্রেসের কথা বললে আমার বহুদিনের প্রিয় বন্ধু নীলিমাদেবী (গুহ-ঠাকুরতা)-কে বাদ দেওয়া যায় না। একজন প্রতিভাবান মানুষের কাছাকাছি আরো কয়েকজন গুণী বন্ধু ও সাহায্যকারী না থাকলে, পৃথিবীর প্রায় কোনো স্বপ্নই বাস্তবে পরিণত হয় না। উপেন্দ্রকিশোরের সঙ্গে সঙ্গে সর্বদা আমার ছোট জ্যাঠামশাই কুলদারঞ্জন ও আরো বন্ধু-বান্ধব ছিলেন। তেমনি দিলীপের শাশুড়ি নীলিমাদেবী যদি সব সময় সহযোগিতা না করতেন, সিগনেট্‌ প্রেস মাটির পৃথিবীতে ঠাঁই পেত কিনা বলতে পারি না। অতিশয় বুদ্ধিমতী, নানা বিষয়ে জ্ঞানী, অক্লান্তকর্মী এই মানুষটি কোনোদিনই যথার্থ স্বীকৃতি পাননি। নিজেও গুণী লেখিকা, শিল্পীও বটে। প্রকাশনালয়ের কোনো কাজকেই তিনি হেয় মনে করেন না। সিগনেট প্রেসের নিতান্ত দুঃসময়ে, নীলিমাদেবীর কাছ থেকে আমার দু-তিনটি পাণ্ডুলিপি এনেছিলাম। নিখুঁত হস্তাক্ষরে নিজের হাতে কপি করে রেখেছিলেন। সেই পাণ্ডুলিপি অন্য প্রকাশককে আরো কয়েক বছর পরে দেবার সময় আমার বড়ই কষ্ট হয়েছিল।

সে যাই হোক, ১৯৪৮ সালে দিন-দুপুরে প্রকাশিত হল বটে, কিন্তু আমি এমন একজনকে হারালাম যিনি আশৈশব আমার সকল সুখের সুখী, সকল দুখের দুখী। তিনি আমার ছোট জ্যাঠামশাই, কুলদারঞ্জন। ইউ-রায়-এণ্ড-সন্সের ছায়ায় তাঁর জীবন কেটেছিল। মৌলিক কিছু না লিখলেও, বেতালপঞ্চবিংশতি, কথাসরিৎসাগর, পুরানের গল্প, ওডিসিয়ুস, ইলিয়াড, রবিনহুড, জুল ভার্ন ও কন্যান ডয়েলের নানা গল্প সহজ করে কিংবা অনুবাদ করে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন। তারপর প্রায় ৭০ বছর কেটে গেছে; সে ভাষাও সেকেলে হয়ে গেছে, লোকে তাঁকে ভুলতে বসেছে। কিন্তু আমি তাঁর কাছ থেকে যে স্নেহ ও সহযোগিতা পেয়েছি, তা ভুলবার নয়। ঐ বছর ৭৩ বছর বয়সে হৃদরোগে তিনি মারা গেলেন। কথা বলতে বলতে স্বর্গে গেলেন। পরে দেখলাম পায়ের তলায় একটু ধুলো লেগে আছে। শিল্পীও ছিলেন ছোট জ্যাঠা, ফটোগ্রাফ এনলার্জ করে প্রায় প্রমাণ মানুষের মাপ দিয়ে, হাতে করে এমন সুন্দর রং করতেন যে হঠাৎ দেখলে মনে হত জলজ্যান্ত মানুষটিকেই দেখছি। আছে হয়তো এখনো এর-ওর বাড়িতে সে-সব ছবি। মাছ ধরতে পাগল। গান গাইতেন ভালো। বাবা আর ছোটজ্যাঠামশাই দু-বছরের ছোট বড়। চেহারায় বা স্বভাবে দুজনার মধ্যে কোনো সাদৃশ্য ছিল না, কিন্ত পিঠোপিঠি দুই ভাই একেবারে হরিহরাত্মা। বাবা বছরখানেক হল চলৎশক্তি হারিয়ে, ক্রমে জীবন সম্বন্ধে উদাসীন হয়ে যাচ্ছিলেন। এখন তাঁর ধন-দার মৃত্যু সংবাদ তাঁকে দেবার সাহস কারো হল না।

ততদিনে আমার বাপের বাড়ির সকলের বয়স আরো কয়েক বছর বেড়ে গেছে। মেজভাই কল্যাণ বিয়ে করেনি, অন্য ভাইরা করেছে। দিদি আর ছোটবোন লতিকা অধ্যাপনা করে। দিদি গোখ্লে কলেজে, লতিকা স্কুলে। সবাই এক যৌথ পরিবারের মতো এক বাড়িতে থাকে। সমবায়ের নিয়মে ব্যবস্থাপনার পারিপাট্যে খুশি না হয়ে পারতাম না। লোকে দেখে আশ্চর্য হত। আজকালকার দিনেও কেমন উপযুক্ত ও রোজগেরে ভাইবোন বুড়ো মা বাপের সঙ্গে একান্নবর্তী হয়ে বাস করছে। বাবার মৃত্যুর পর যৌথ পরিবার ভেঙে গেছিল।

বাড়ির মাস্টারি কিন্তু আমার সমানে চলেছিল। তাতে নিজেরও অনেক লাভ হয়েছিল। বহু ভুলে যাওয়া তথ্য আবার নতুন করে জানা হয়ে গেল। ১৯৪৯ সালে আমার ছেলে রঞ্জন আর আমার ভাগ্নীর বড় মেয়ে হাসি, দুজনেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিল। তার আগের কয়েক মাস হঠাৎ দেখলে বোঝা যেত না কে পরীক্ষা দিচ্ছে, ওরা না আমি? পরীক্ষা ছাড়া অন্য ভাবনা-চিন্তাও ছিল।

এর কিছুদিন আগে আমার স্বামী একবার হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। হৃদ্‌যন্ত্র আর কখনো আগের মতো জোরালো হল না। সেরকম হলে এতগুলো পোষ্য নিয়ে আমি কি করব, তাই কত ভাবনা। আমি বলতাম মজুমদার টেলারিং বলে দোকান খুলে রাশি রাশি টাকা রোজগার করব। বলা বাহুল্য করিনি কখনো রাশি রাশি টাকা রোজগার, দরকারও হয়নি। ওরা যখন ম্যাট্রিক দিল, তার অনেক আগেই সুস্থ হয়ে উনি স্বাভাবিক কাজকর্ম করছেন।

খুব একটা নিজের দেশ দেখবার সময় পাইনি এতদিন। দক্ষিণ ভারত দেখার বড় শখ। এই প্রস্তাবে পণ্ডিচেরী থেকে দিলীপ আর মাদ্রাজ থেকে আমার শান্তিনিকেতনের পুরনো বন্ধু, অন্ধ্র পত্রিকার সম্পাদক ও মালিক শম্ভুপ্রসাদ উৎসাহ দিয়ে চিঠি লিখলেন। শম্ভু আমার ভ্রমণ-ক্রম তৈরি করে ফেলল। মাদ্রাজে গিয়ে তার বাড়িতে উঠে ভ্ৰমণ-সূচিটি পাকা করা হবে। কমলা তো কেঁদেই আকুল, তাকেও নিয়ে যেতে হবে। সবাই মিলে অনেক বোঝানো হল এখন স্কুল খোলা, কি করে যাবে, সে-ও ম্যাট্রিক দিলে, তাকেও দেশ দেখাতে নিয়ে যাব। নিজেও বিশেষ কিছু দেখিনি, আমারো দেখা হবে।

মনে আছে ৭ই এপ্রিল রঞ্জনের পরীক্ষা শেষ হল। ৮ই এপ্রিল মাদ্রাজ মেলের সেকেণ্ড ক্লাস্ কামরায় দুটি বার্থ রিজার্ভ করে রওনা দিলাম। এখন ভেবে আশ্চর্য হই আমার কতটুকু বাস্তববুদ্ধি ছিল! সঙ্গে কোনো ওষুধপত্র নিইনি। ভেবেছিলাম দুজনের এমন অটুট স্বাস্থ্য, তবু যদি নিতান্তই ওষুধপত্র দরকার হয়, বহু ওষুধের দোকান আছে, কিনে নেওয়া যাবে। এ আমাদের এক রকম তীর্থযাত্রা। লট-বহর সঙ্গে যত কম থাকে ততই ভালো। একটি হোল্ডলে পাৎলা বিছানা, একটি স্যুটকেসে কাপড় চোপড়। একটি টিফিন ক্যারিয়ার, একটি জলের বোতল। যাত্রীদের আবার এর বেশি কি লাগতে পারে। কিছু টাকাকড়ি। আবার শম্ভুর কাছে চেক্ ভাঙানো যাবে। শম্ভুর কথাও কিছু বলতে হয়। তেলেগু ব্রাহ্মণ, লম্বা, জোরালো শরীর, পরিষ্কার রং, দেখতে সুন্দর নয়, কিন্তু ব্যক্তিত্বের ছাপ ছিল, সবাই ওকে সমীহ করে চলত। সর্বদা সাদা খদ্দর পরত, খালি মাথা, বাঙালীদের মতোই কাছা দিয়ে কাপড় পরত, নিরামিষ খেত, কম কথা বলত। বিশ্বভারতীর কলেজের মামুলী ক্লাস করত না। বিদ্যাভবনে বিধুশেখর শাস্ত্রীমশায়ের আর ক্ষিতিমোহনবাবুর কাছে ভাষা শিক্ষা করত। আমার চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণীর ইংরিজি অনার্স ক্লাসের খাতায় ওর নাম লেখা ছিল। কিন্তু একদিনও ক্লাসে আসেনি। আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট।

একবার কেউ ওকে আমার কাছে এনেছিল, তখন জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘ক্লাসে আস না কেন?’ বলেছিল, ‘মেয়েদের কাছে কিছু শিখতে আমার লজ্জা করে।’ বলে এমন সরলভাবে হেসেছিল যে দেখতে দেখতে ওর সঙ্গে ভারি একটা স্নেহের সম্পর্ক হয়ে গেছিল।

ভারি বিনয়ী মানুষটি। নিজের কথা, কিম্বা বাড়ির কথা কিছু বলত না। সাদাসিধা পোশাক, পায়ে মোটা চপ্পল, যে কোনো গেরস্ত বাড়ির ছেলের মতো দেখাত। ও নিজে মাদ্রাজের স্টেশনে অপেক্ষা করছিল। আমরা দুজনে ক্লান্তিতে অবসন্ন। দু-দিন দু-রাতের যাত্রা। সঙ্গের খাবার ফুরিয়ে গেলে, রেলের বেয়ারারা খাবার দেয় না। বলে ‘আগের জংশনে মীল-টিকিট কিনেছেন?’ সে আবার কি জিনিস? একজন বাঙালী সহযাত্রী তখন শুধু যে রহস্য বুঝিয়ে দিলেন তা নয়, তারপর থেকে সব জংশন স্টেশনে নিজের সঙ্গে আমাদেরও মীল-টিকিট কিনে আনলেন। আমরা দাম দিয়েই খালাস। দামও খুব কম। এই রকম যেখানে যখন গেছি, প্রায় সর্বদা এত সদয় বন্ধু পেয়েছি যে বলবার নয়। একমাত্র বেহারের কোনো কোনো জায়গায়, সে সৌভাগ্য হয়নি। মোট কথা ক্লান্ত কলেবরে সেকণ্ড ক্লাস গাড়ি থেকে আমাদের নামিয়ে শম্ভু কোমল কণ্ঠে বলল, ‘এখনকার সেকেণ্ড ক্লাস হল আগের ইণ্টার। কষ্ট তো হবেই।’ এই বলে আমাদের তার ক্যাডিলাক গাড়িতে তুলল! |

॥ ৮ ॥

১৯৪৯ সালের বছর গুণলে মাত্র ৩৩ বছর আগেকার কথা। কিন্তু এই ৩৩ বছরেই শুধু আমাদের দেশেই নয়, গোটা পৃথিবীর হালচাল বদলে গেছে। আমরা যে সব গুণকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলাম, এখন দেখি সে-সব অচল। সেই পুরনো চোখেই আমাদের ভ্রমণের জায়গাগুলো দেখেছিলাম, এখনকার যাত্রীরা হয়তো অন্য চেহারা দেখেন। তাছাড়া যদি ৩০ বছরকে এক পুরুষ বলে গোণা হয়, তাহলে এখন হল নতুন এক পুরুষের কথা। সে যাক গে, শম্ভু আমাদের তার বাগান ঘেরা সুন্দর দোতলা বাড়িতে নিয়ে তুলল। ওর স্ত্রীর নাম কামাক্ষী, সবাই ডাকে কামাক্ষী-আম্মা, দেখে মনে হল বুঝি বাঙালী। সাদাসিধে, লাজুক মেয়ে। তাদের গুটি পাঁচেক ছেলেমেয়ে, স্কুল কলেজে পড়ে। শাশুড়িও আছেন, ধবধবে ফর্সা, পরমাসুন্দরী। ভারি অতিথিপরায়ণ সবাই। আমাদের কোথায় রাখবে, কি খাওয়াবে ভেবে পায় না। তেলেগু ব্রাহ্মণের রান্নাঘরে নিরামিষ ব্যবস্থা। ভাবে আমাদের কষ্ট হবে। আমরা সত্যি যে ইড্লি, দোসা, নারকেলের চাটনি, গাওয়া ঘি, সাম্বার, রসম্ খেয়ে সুখে আছি, বিশ্বাস করতে চায় না, তবে টক দইয়ের সঙ্গে যখন বাটা চিনি এনে দিল, তখন খুশি না হয়ে পারলাম না। টক দই একটু ইয়ে।

গাড়ি করে সমস্ত মাদ্রাজ ও তার চারদিকের বহু দ্রষ্টব্য জায়গা দেখিয়ে দিল, মহাবলিপুরম, কাঞ্চিপুর ইত্যাদি। একজন চালাক-চতুর ছোকরা এসে আমাদের দক্ষিণ ভারত যাত্রাসূচী তৈরি করে দিল। কোন গাড়িতে কটার সময়ে কোন জায়গায় যাব, সেখানে কি কি দ্রষ্টব্য, থাকার কি ব্যবস্থা, এমন কি যানবাহনের কি সুবিধা, সমস্ত নিখুঁৎ ভাবে লিখে দিল। আমরাও সেটি শিরোধার্য করে আরামে দক্ষিণ ভারত দেখলাম। ওর কথা বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল কারণ, হাঁ বলতে মুণ্ডুটাকে এ-পাশ ও-পাশ নাড়ছিল আর না বলতে ওপর নিচ করছিল। আমরা করি ঠিক তার উল্টো! শম্ভুরা আসলে অবস্থাপন্ন লোক। অম্রুতাঞ্জনের মালিক, ও নিজে অন্ধ্রপত্রিকার সম্পাদক। এমন বিনয়ী স্নেহশীল মানুষ কম দেখেছি। বছর দশেক হল পরলোকে গেছে।

ঐ তালিকা অনুসারে দেশ দেখলাম। এটা ভ্রমণ কাহিনী নয় বলে বিস্তারিত বিবরণ বাদ দিলাম। তেত্রিশ বছর আগের কথা, তবু ঐ সব জায়গার কথা মনে হলে মনটা তৃপ্তিতে ভরে যায়। ত্রিবান্দ্রামের অ্যাকোয়েরিয়ম,পদ্মনাভের মন্দির দেখলাম। কন্যাকুমারী দেখলাম। কি পরিষ্কার ঝরঝরে সব দেবস্থান। আমাদের দেশের মতো জল স্যাঁৎস্যেঁতে, রান্নাবান্না এবং বাসি খাবারের গন্ধামোদিত নয়। ভোগ দেওয়া হল ফল ফুল নারকেল। দেখলেও চোখ জুড়োয়। কন্যাকুমারী যাবার পথে সমুদ্রতটের বাস্-পথটি যেমন সুন্দর, মাদ্রাজ থেকে ত্রিবান্দ্রাম যাবার বনপথ আর সাগরবেলার পথও তেমনি। মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম।

কন্যাকুমারীতে একজন স্থানীয় লোক বলেছিল, ‘আমরা হিন্দু বলে এই মন্দিরকে ভক্তি করি; আসলে কিন্তু খ্রীশ্চান গির্জার মেরি-আম্মা আরো বেশি দয়াময়ী!’ কন্যাকুমারীতে রাজার হোটেলে ছিলাম। সেখান থেকে পাহাড় ঘেরা সুন্দর পথ পার হয়ে মাদুরার ট্রেন ধরলাম। মাদুরার মীনাক্ষীর মন্দির মেরামত হচ্ছিল, দেখা হল না। একটা হোটেলে কষ্ট করে থাকলাম। নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ফুর্তির চোটে সঙ্গে ওষুধপত্রও নিইনি। অসুস্থ শরীরেই রামেশ্বর দেখলাম। পুরনো জায়গায় গেলেই মনটা কেমন করে। বিশেষ করে যদি মন্দির হয়। তবে ঐখানে ৩৩ কোটি দেবতার মূর্তি আছে শুনে সন্দেহ প্রকাশ করাতে, পাণ্ডা চটে গিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস না হয়, গুণে দেখতে পারেন।’ পাম্বান পুলের তলায় দেখলাম টলটলে সমুদ্রের জল, খুব গভীরও নয় হয়তো। স্পষ্ট চোখে পড়ল পুলের দুধারে যতদূর চোখ যায় মস্ত মস্ত চারকোণা চ্যাপ্টা পাথর, প্রত্যেকটির মধ্যিখানে একটি গোল ছ্যাঁদা! পাণ্ডা বলেছিল ওগুলো হল রামের সেতুর ধ্বংসাবশেষ! বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছিল।

যখন তিরুচিরপল্লী পৌঁছলাম আমার শরীর আবার সুস্থ। রক্ ফোর্টের চুড়োয় উঠলাম। এখন ভাবলেও মাথা ঘোরে। সেখানে গণেশমূর্তির পুজো সবে শেষ হয়েছে। আমরা দুজন দুটি টাকা দিলাম। পুরোহিত গণেশের মাথায় জড়ানো সুগন্ধী ফুলের একটি গোড়ে মালা আমাকে দিলেন। তাই দেখে আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার অবাক হল, ‘ওঁরা তো বাইরের লোককে দেবতার মালা দেন না।’

সেখান থেকে পণ্ডিচেরি। দিলীপ রায়ের বাড়িতে উঠব, সাতদিন থাকব। মন বড় খুশি। কৌতূহলও যথেষ্ট ছিল, বহু বছর ধরে নানা রকম বিপরীত বিবরণী পেয়েছি। দিলীপকে আমরা বড়ই ভালোবাসি। তাছাড়া আমার ভাগ্নে কল্যাণ চৌধুরীও সেখানে। কল্যাণ আমার বন্ধু অলকার ছোট ভাই, বাঘ-শিকারী কুমুদনাথ চৌধুরীর বড় ছেলে। আমার সমবয়সী বন্ধুও বটে। আর ছিল শান্তিনিকেতনের শিল্পীকবি নিশিকান্ত রায়চৌধুরী। এরা দুজন সেখানে কেমন ঠাঁই পেয়েছে, কতখানি মানিয়ে নিল জানবার বড় ইচ্ছা। আসলে পণ্ডিচেরি আশ্রমে আমার অনেক পরিচিত ও প্রিয় মানুষ ছিলেন। পিতৃতুল্য চারু দত্তও সেখানে শেষ জীবন কাটাচ্ছেন।

রাতদুপুরে। বোধ হয় বিরুধনগর বলে একটা স্টেশনে গাড়ি বদল করতে হল। পণ্ডিচেরির ছোট গাড়ি অপেক্ষা করছিল, কিন্তু আমাদের কুপেতে দেখি অন্য একটা লোক শুয়ে আছে। ঘরময় কিসের গন্ধ। আর কোথাও জায়গা নেই। গার্ডকেও পাওয়া গেল অনেক পরে। ঐ লোকটিকে কিছু বলতে একেবারে অনিচ্ছুক। বলে কিনা ‘আপনি ঐ কুপেতেই যান। আপনার ছেলে স্থানাভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীতে যাক।’ মহা রেগেমেগে গেলাম। বললাম, ‘পণ্ডিচেরি গিয়ে এর একটা বিহিত করব, আমার রিলেটিভ্ দিলীপ রায়কে বলেটলে।’ বলবামাত্র গার্ডের মুখে একটা চমক খেলে গেল, ‘দিলীপ রায়। তিনি আপনাদের আত্মীয়! তাঁর বাড়িতে উঠবেন! আগে বলেননি কেন? মহা অপরাধ করে ফেলেছি, আমাকে ক্ষমা করবেন।’ এই বলে পায়ে ধরে আর কি! আমিও অবাক। দিলীপের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব এসব লোকের ওপরেও মন্ত্রের মতো কাজ করবে আমি ভাবতেও পারিনি। আনন্দে মন ভরে গেল।

গার্ড তখুনি কুপেতে ঢুকে ঘুমন্ত লোকটিকে হিড়হিড় করে টেনে বের করে আনল! মনে হল ফিরিঙ্গি এবং ঠিক প্রকৃতিস্থ নয়। বগলে এক বোতল হুইস্কি। যদিও পণ্ডিচেরির বাইরে ও-সব নিষিদ্ধ। টলতে টলতে সে লোকটাও বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘ফরগিভ, ফরগিভ! রেসপেক্টস্ টু দিলীপ রায়!’ তারপর গার্ড আমাদের জন্য কি করবে ভেবে পায় না। কফি আনি? চা আনি? কোল্ড ড্রিংকস আনি? পাখার হাওয়া পাচ্ছেন তো? বাথরুমটা ঠিক আছে তো ইত্যাদি। মোদো লোকটা বোতল নিয়ে পাশের গাড়িতে গিয়ে উঠল।

ট্রেন ছাড়বার আগে দুহাত জোড় করে গার্ড বলল, ‘একটা বিনীত প্রেয়ার, ম্যাডাম, দাদাজির কাছে আর আমার অপরাধের কথা তুলবেন না!’ তাকে আশ্বস্ত করে আমরা রওনা হয়ে গেলাম।

ভোরে পণ্ডিচেরিতে নেমে দেখি সকালের সাদা আলোয় কি প্রশান্ত সুন্দর শহর। তখনো সকলের ঘুম ভাঙেনি। বহু যাত্রী নামল। দু-দিন পরেই শ্রীঅরবিন্দের দর্শন। ভক্ত তো তাঁর কম ছিল না। তার চেয়েও বেশি সংখ্যক কৌতূহলী জনতা। যতদূর মনে হয় ঝটকা বলে একরকম ঠিকে গাড়ি পেলাম। দিলীপ বলেই ছিলেন ওঁর নাম করলেই সোজা ওঁর বাড়ি নিয়ে যাবে। কোনো অসুবিধা হবে না। প্রায় কুড়ি বছর ধরে ওখানে বাস। আশ্রমের সবচাইতে নাম করা অধিবাসী। সেখানে অসংখ্য উঁচুদরের জ্ঞানীগুণীরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও দিলীপের ব্যক্তিত্ব জ্বলজ্বল করত।

পৌছবার কথা ছিল তাঞ্জোর দেখে, পরের দিনই। দেখলাম যারা আসলে সংসারী নয়, তাদের বাড়ির সুবিধা-অসুবিধাগুলোও ঢিলেঢালা মতো। ভোরে ওঠা দিলীপের অভ্যাস। ছাদে গিয়ে গলা সাধতেন। সাধুই হন, ভক্তই হন, কণ্ঠশিল্পীর নিয়মনিষ্ঠা থেকে এতটুকু ভ্রষ্ট হতেন না। মোটা মানুষ, আমাদের সাড়া পেয়ে থপথপ করে দৌড়ে নেমে এসে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, দুজনকে একসঙ্গে। বক্ষটিও তেমনি উদার ছিল। সে সহাস্য অভ্যর্থনা এ জন্মে ভুলবার নয়। দোরগোড়া থেকে আদর করে আমাদের জন্য গুছিয়ে রাখা ছোট শোবার ঘরটিতে নিয়ে গেলেন। স্নানের ঘর আলাদা।

পুরনো ফরাসী প্যাটার্নের বাড়ি। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সদর দরজাটি বিশাল এবং অতি সুন্দর দেখতে এক ফুট লম্বা পেতলের চাবি দিয়ে খুলতে হয়। ভেতরে ফুলগাছ, ফুলে ভরা লতা, টবে ফার্ন গাছ, পাতাবাহার, তকতক ঝকঝক করছে। ৩৩ বছর পরে খুব খুঁটিয়ে বর্ণনা দিতে পারব না। তবে একটা খোলামেলা ঝরঝরে ভাব সর্বত্র। যা আসবাব ও সাজসজ্জা ছিল সব সুন্দর, কিন্তু অনাড়ম্বর। আইবুড়োর বাড়িঘর কি করে এত পরিচ্ছন্ন, ঘরকন্নাই বা এত গোছালো কি করে হতে পারে, প্রথমটা ভেবে পাচ্ছিলাম না। পরে আমাদের কুটুম্বিনী রানীদিকে দক্ষ হাতে উৎকৃষ্ট সুজির মোহনভোগ করতে দেখলাম। শুনলাম দিলীপের ঘরকন্নার দেখাশুনা করার ভার শ্রীমা ওঁকে দিয়েছিলেন। ঘড়ি ধরে ডিউটি করতেন। ভোরে এসে জলখাবারের ব্যবস্থা। দুপুরে আশ্রমের রান্নাঘর থেকে, ওখানকার যেমন নিয়ম, এক তরকারি ভাত দই আর কলা আসত। রানীদি হয়ত একটু আলুর দম করে দিলেন। এ-বাড়ির খাওয়াদাওয়া চুকলে,নিজের বাসায় ফিরে স্নানাহার সেরে আবার হয়তো তিনটের থেকে রাতের খাওয়াদাওয়া অবধি দেখলেন। নিজের ব্যবস্থা অন্যত্র। এর আগে সুগায়িকা সাহানাদির ওপর এই ভার ছিল। ঐ সময় তাঁর শরীর খারাপ হয়েছিল।

সাত দিন ছিলাম ওখানে। অন্য রকম এক জীবনযাত্রার আস্বাদ পেলাম। একে একে সব চেনাজানার বাড়ি গেলাম। মনে হল শ্রীঅরবিন্দের চেয়েও এঁদের ওপর শ্রীমায়ের প্রভাব বেশি। তাই হওয়াই স্বাভাবিক। শ্রীঅরবিন্দ মৌনী এবং অদর্শন। সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে। শুধু যাঁরা তাঁর সাধনার মর্ম হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন তাঁদের সঙ্গে তাঁর মানুষে-মানুষে সম্বন্ধ থাকত। তাও যা কিছু জিজ্ঞাস্য সংক্ষেপে তা লিখে পাঠাতে হত। তিনি আরো সংক্ষেপে উত্তর লিখে দিতেন। নিত্য কথা বলতেন নাকি শুধু তাঁর ডাক্তারের সঙ্গে, মাদারের সঙ্গে আর বিশেষ প্রয়োজনে দু-একজনের সঙ্গে।

কিন্তু মাদারের প্রভাব দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না। যে কাজে মা এতটুকু অসন্তুষ্ট হবেন সে-কাজ মরে গেলেও আশ্রমবাসীরা করবে না। যাকে যে কাজ দিয়েছেন প্রাণপাত করে তা পালন করবে। মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কোনো কাজে এতটুকু অযত্ন বা গাফিলতি নেই। দু’জন সাধক রোজ আশ্রমের বাড়িগুলির ঝুল কালি ঝেড়ে মুছে, মাটি থেকে কুটোটুকু তুলে নিয়ে যেতো। দুজন বাগান ঝাঁট দিয়ে, শুকনো পাতা উড়িয়ে, ঝোপঝাড়ের ঝুলো পাতা তুলে ধরে তার নিচে ঝাঁট দিয়ে, সব একেবারে তকতকে করে রাখত। দুপুরের খাওয়ার পর বৈশাখ মাসের ঐ চড়চড়ে রোদে খানিকটা দূরস্থিত ছাপাখানায় যাদের ডিউটি, তারা কাজ করতে যেত। তাদের মধ্যে আমার একটি শান্তিনিকেতনের আয়েসী ছাত্রও ছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করাতে সে বলল, ‘বাঃ মন দিয়ে কাজ করব না? না করলে মা যে অসন্তুষ্ট হবেন।’ সে অবাক হয়ে গেল, ‘সাজাও দেবেন না, ভালো করে করলে পুরস্কারও দেবেন না। তাতে কি?’ ভাবলাম আমাদের দেশে এই রকম দু-চারজন গুরু থাকলে ভবিষ্যতের জন্য ভাবনা থাকত না। কাজের মতো সাধনা আছে! এখানে কাজের উঁচু নিচু নেই, সব কাজের সমান মর্যাদা।

যতদূর সম্ভব সাদাসিধা নিরামিষ খাওয়া। একদিনের দুপুরের খাওয়ার কথা বলি, উচ্ছে আর টোমাটো দিয়ে কাঁচা কলাইয়ের ডাল, ভাত, দই, কলা। আড়চোখে ছেলের দিকে চাইলাম। আরেকটু হলে পড়েই যেতাম! সোনাহেন মুখ করে পুত্র ঐগুলো খাচ্ছেন এমনি স্থান-মাহাত্ম্য! বাড়িতে হলে—থাক্গে।

বেকারিতে গিয়ে দেখলাম দুজন পণ্ডিত লেক পাঁউরুটি তৈরি করছেন। একজন ঠাসা ময়দাকে একেক কোপে একেক পাউণ্ড মাপে কাটছেন। আরেকজন সেটি ওজন করে দেখছেন প্রায় প্রত্যেকবার মাপ নির্ভুল। আরো একজন টিনে করে ওগুলোকে বেক হতে নিয়ে যাচ্ছেন। কি খুশি সবাই। বাইরে এক চিলতে জমি। তার মধ্যিখানে মখমলের গালচের মতো খুদে ঘাসজমি। ঘাসজমির চারদিকে ফুলের বাহার। মানুষগুলি যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা সকলে পরম বিদ্বান, অনেকে এক সময়ে বড় বড় পদ অলংকৃত করেছেন।

খালি মনে হত আমাদের দুনিয়া দেখার ভঙ্গিতে গলদ আছে। মূল্যবোধ ঠিক নয়। সন্ধ্যেবেলায় দিলীপের বাড়িতে জ্ঞানীগুণী আর সাধারণ লোকরা আসতেন। আলোচনা হত, গান হত, কত গভীর কথা হত। সব সময়ে মতে মিলত না। কিন্তু ফেলে দেবার মতোকোনো কথাই নয়। সংসার-ত্যাগী আর সংসারীর কি এক রকম চোখ হতে পারে কখনো।

ঐখানে MONOD বলে এক আধবয়সী ফরাসীর সঙ্গে আলাপ হল। ফরাসী দূতাবাসে কোনো কাজ করতেন, শ্রীঅরবিন্দের ভক্ত, দিলীপের বন্ধু। আমার সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে গেল। পরে দেশে ফিরেও চিঠিপত্র লিখতেন, কলকাতায় এসে দেখা করতেন। বেশ কিছু বছর আর উত্তর পাই না। ভাবি তাঁর সময় হয়েছিল, চলে গেছেন।

এখানে ভয়ে ভয়ে অরবিন্দের সাধনা সম্বন্ধে আমার মোটামুটি যে ধারণা হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু না বললে এ বিবরণী অসম্পূর্ণ থাকবে। তবে একটা কথা বলে রাখি, আমি নিতান্ত বাইরে থেকে আগন্তুক, সংসারধর্মী, পড়াশুনো ভালবাসি। কিঞ্চিৎ আদর্শবাদীও, তাই যেমন যেমন বুঝেছিলাম, তাই বলছি। হয়তো আমার বোঝার ভুল-ও হতে পারে। আমার ভাগ্নে কল্যাণকে দেখলাম, নিশিকান্তকেও দেখলাম। কেমন যেন সাবধানী হয়ে গেছে। আগেকার সেই প্রাণখোলা ভাবটি আর নেই, যদিও স্নেহের কোনো অভাব দেখিনি। দিলীপের অনুপস্থিতিতে ওখানকার বন্ধুবান্ধবরা আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে শ্রীঅরবিন্দ এক সুকঠিন ও জটিল সাধনা করছেন। উনি যোগবলে ওপর থেকে শক্তি নামিয়ে মানুষের আত্মা ও প্রকৃতি উন্নত করবেন। আপাততঃ আশ্রমবাসীদের দিয়ে কাজ শুরু হবে। তবে সেই প্রক্রিয়াটা যে কি কেউ বলতে পারলেন না এবং কৌতুহলীদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতেও আগ্রহী মনে হল না।

মুশকিল হল, আমি আবার অন্য রকম ভাবি। আমি মনে করি এসবের মধ্যে জটিলতার বা কঠিন কিছুর স্থান নেই। ওপর থেকে শক্তি নামানো কি, তাও বুঝলাম না। বরং মনে হত মানুষের নিজের মধ্যেই সুপ্ত শক্তি আছে, সেটিকে জাগ্রত করতে পারলেই কাজ হবে। কোনো অনুশীলন বা চর্চা না করে এই রকম মনে হত। ভাবতাম শ্রীঅরবিন্দকে নিশ্চয় এরা ভুল বোঝে। অনেকে তো ঐখানে ১৫-২০ বছর আছে। তাদের আত্মার তো বিশেষ উন্নতি দেখি না। আশ্রমে বসে বসেই যে-রকম পরনিন্দা পরচর্চা শুনতাম, তাতে অবাক হতাম। তার ওপর রেষারেষি এবং ঈর্ষা। টাকাকড়ি বা মান-সম্মানের জন্যও নয়। ঐ বুঝি কোনো অযোগ্য ব্যক্তি মায়ের কাছ থেকে বেশি আদর পেয়ে গেল। এই রকম একজন বয়স্কা বাঙালী মহিলা বললেন, ‘এদের জ্বালায় কিছু করার জো নেই। আগে শ্রীভগবানের জন্য আমরা কজনা রাঁধতাম, তিনি একটু ভালোমন্দ খেতে পেতেন। তা হিংসুটেদের সইবে কেন, দিল আমাদের ভাগিয়ে। তা কি এমন ভালো খাওয়াদাওয়া হচ্ছে এখন শুনি!’ ভাগ্যিস্ কোনো উত্তরের অপেক্ষায় থাকেননি, তাই বেঁচে গেলাম।

পরে দিলীপের কাছে গল্প করতে তিনি বললেন, ‘বাস্তবিকই তাই। ওঁরা চমৎকার বাংলা রান্না করতেন। শ্রীঅরবিন্দ সত্যিই খুশি ছিলেন। কিন্তু অন্যরা আপত্তি করাতে, উনিই সে ব্যবস্থা তুলে দিলেন। তারপর একদিন আমাকে লিখলেন, “now that the food is equally unpalatable to all, I hope everybody is satisfied!” যতদূর মনে হয়, ভারি রসিক লোক ছিলেন অরবিন্দ।

বলা বাহুল্য মানুষটির কাছে ঐ দর্শনের দু মিনিট ছাড়া—যাবার সুযোগ পাইনি। ওঁর লেখা সাবিত্রী ইত্যাদি আর চিঠিপত্র পড়ে এটুকু বুঝেছি যে উনি একজন অসাধারণ মনীষী ছিলেন। ওঁর সেই সুগভীর চিন্তা আর জটিল তর্কজাল ভেদ করার ক্ষমতা আমার তো নেই-ই, বিশেষ ভাবে নিজেকে প্রস্তুত না করলে অন্য কারো আছে কিনা তা-ও সন্দেহ। তবে দিলীপের ছিল। আরো কয়েকজন মনীষী ওখানে জীবনের অনেক বছর কাটিয়েছেন, তাঁদেরো ছিল। এ-ও মনে হয় যে সে প্রস্তুতির জন্য ওখানে যে যেতেই হবে, তাই বা কেন? বলেছি তো আমি বাইরের লোক এবং এ-সব আমার নিতান্ত নিজের মতামত। অনুশীলন করলে বদলাবে কিনা বলতে পারি না।

সাধারণ আশ্রমবাসীদের আমার আর পাঁচজন চেনা বন্ধুদের মতোই মনে হল। তাঁদের সঙ্গে শ্রীমায়েরি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ, শ্রীঅরবিন্দ ধরাছোঁয়ার বাইরে এক অপূর্ব আদর্শের মতো। কিন্তু মা-কে তাঁরা কাছে পেতেন, নিজেদের মনের কথা বলতে পারতেন, উপদেশ পেতেন, উপায় পেতেন। রোজ দেখতাম সকালে ধ্যানের পর সকলে যখন মাকে প্রণাম করতেন, অনেকে তাঁকে ফল, ফুল বা অন্য শ্রদ্ধার্ঘ দিতেন। আর মাও ঐসব ফুল ফল থেকে বেছে বেছে কিছু নিয়ে, পাশে দাঁড়ানো সাধকদের কাউকে বলে দিতেন কার শরীর খারাপ, কার মন খারাপ, তাদের এসব দিলে ভালো হবে। এই দেখে আমার মনটা কেমন করে উঠেছিল। মায়ের মতোই উনি সব সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার পিছনে ছিলেন। বলা যায় আশ্রমের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার আর প্রত্যেক আশ্রমবাসীর অনুপ্রেরণা ছিলেন মা। তার বদলে অবিশ্যি একান্ত এবং সম্পূর্ণ আত্মসর্মপণ আশা করতেন। সাধকের জীবন এমনি হবেই। খুব সহজ নয়।

বলেছি তো আমার যাবার ২/১ দিন পরেই ২৪ এপ্রিল। সেদিন শ্রীঅরবিন্দ আর মা একসঙ্গে দর্শন দিতেন। না হলে শ্রীঅরবিন্দর দেখা পাওয়াই দায় হত। মাকে অবিশ্যি রোজ ভোরে তাঁর বাসস্থানের দো-তলার ঝোলা বারান্দায় দেখা যেত! নিচের রাস্তায় ভক্তের ভিড় জমে যেত। অনেকে হাত জোড় করে ঐ এক মুহূর্তের দেখার জন্য প্রতীক্ষা করে থাকতেন। এক দণ্ডের দর্শন থেকে সারাদিনের পাথেয় সংগ্রহ করে নিতেন! তারপর যে যার কাজে চলে যেতেন। নীরবে এসব সম্পন্ন হত। ঐ ভক্তদের মধ্যে আমার শান্তিনিকেতনে প্রথম দেখা পিতৃপ্রতিম চারু দত্তও ছিলেন। এখানে তাঁকে অন্যরকম মনে হয়েছিল।

যেমন মনে হয়েছিল তেমনি লিখলাম। আমি ওঁদের শিষ্যত্ব নিইনি, কিন্তু মহৎকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছি। সে যাই হক, ২৪ এপ্রিলের দর্শন অন্যরকম। আশ্রমে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এমনিতেই সমুদ্রের ধার আর খেলার মাঠ আর বাড়িগুলির চারদিকে দেয়াল ঘেরা খুদে হাতা ছাড়া খোলা জায়গা চোখে পড়েনি আজ সে সব জায়গাতেও লোকজন গিজগিজ করছে। এঁরা সাধারণ তীর্থযাত্রীদের মতো কেনাকাটা হৈ-হুল্লোড় করতে আসেননি। যার যার মনের তাগিদে, কিম্বা মনের প্রশ্নের জ্বালায় এসে জড়ো হয়েছেন। কোথাও হট্টগোল নেই, একটা গম্ভীর প্রতীক্ষার ভাব।

দিলীপের বাড়ি থেকে আমরা দশ-বারোজন অতিথি অভ্যাগত এক সঙ্গে গিয়ে সারি বেঁধে একটা সিঁড়ির নিচে দাঁড়ালাম। শুনলাম ঐ সিঁড়ি দিয়ে উঠে, ওপরের পুলে বসা শ্রীঅরবিন্দ আর শ্রীমাকে দেখে, ওপাশের আরেকটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে হবে। বারবার বলা হল যেন পা ছুঁয়ে প্রণাম করার চেষ্টা না করি, বা দাঁড়িয়ে ভক্তি নিবেদন করার চেষ্টা করা না হয়।

লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, দিলীপের আরেক অতিথি বললেন, মামিমা, খালি হাতে দেব-দর্শনে যেতে নেই। আমি নিরাকারে বিশ্বাসী। খালি মনে যেতে হয় না ভাবি, খালি হাতের কথা মনে হয়নি। তিনি আমার ছেলে আর আমার হাতে একটি করে পাতার আর একটি করে ফুলের মালা দিয়ে বললেন, ‘পাতাটি শ্রীঅরবিন্দের, ফুলেরটি মায়ের।’

সিঁড়ি দিয়ে উঠে তাই দিলাম। যেন দুটি নিঁখুৎ আঁকা মূর্তি, কোনো প্রাণের স্পন্দন দেখতে পেলাম না। এত সুন্দর সাজানোর মধ্যে দৃষ্টিকটু শুধু তিনটি কাঠের প্যাকিং-কেস, ওঁদের পায়ের কাছে বিরাজ করছে। শ্রীঅরবিন্দ বসেছেন কৌচে, মা সিংহাসনে। ফুলের মালা আর তোড়া ফেলা হচ্ছে দুটি ছোট প্যাকিং-কেসে আর বড়টিতে টাকাকড়ি, গয়নাগাটি, কাপড়চোপড় এবং অন্য শৌখীন উপহার। মনে যে সুর বাজছিল, তার তাল কেটে গেল। এইরকমই মনে পড়ছে। লিখে তো রাখিনি, কিছু কিছু ভুলেও গিয়ে থাকতে পারি। আমি ঐ দর্শনে অভিভূত হয়নি। অন্য সিঁড়ি দিয়ে নেমে, সকলের সঙ্গে দিলীপের বাড়ি ফিরে একসঙ্গে জলযোগ করলাম। ভক্তরাও কত মামুলী বিষয়ে আলোচনা করছে দেখে আশ্চর্য হলাম। খালি দিলীপকে দেখলাম না, হয়তো নিজের ঘরে চলে গেছিলেন। কোনো বিষয়ে উনি সাধারণ লোকের মতো ছিলেন না।

সেদিন আমরা সকলে বাড়িতে বসে আশ্রমের খাবার না খেয়ে, দুপুরে রান্নাঘরে গিয়ে সকলের সঙ্গে খেয়েছিলাম মনে আছে। বিকেল থেকেই ভিড় কমতে আরম্ভ করল। সন্ধ্যায় দিলীপ ভজন গাইলেন। গান তো নয়, দেবপূজা। ভজন যেমন হওয়া উচিত। গানের শেষে কারো সঙ্গে কথা না বলে অভিভূতের মতো নিজের ঘরে গিয়ে দোর দিলেন।

পর দিন সকাল থেকে আবার সব নিত্যনৈমিত্তিকের নিয়মে চলতে লাগল। আমরা আরো ক-দিন থাকলাম। তার মধ্যে একদিন শ্রীমায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পেলাম। বড়ই স্নেহের সে দেখা। আমি আশ্রমের জন্য একটা সামান্য চেক্ নিয়ে গেছিলাম। মা একটা অসামান্য বই দিয়ে আমাদের দুজনকে আশীর্বাদ করলেন।

দেখতে দেখতে ফেরার দিন এসে গেল। তার মধ্যে একদিন আমার অনুরোধে নিশিকান্ত তার আঁকা ছবির প্রদর্শনী করল। অপূর্ব সব বৃক্ষহীন দৃশ্য, পাহাড়, সাগর, মন্দিরের মতো মূর্তি। কোথাও আগেকার সেই প্রাণের উচ্ছলতা খুঁজে পেলাম না। কান্না পাচ্ছিল।

সাহানাদি একদিন গান শোনালেন। বড় ভালো লেগেছিল। কত পুরনো গান। দিলীপ যাননি। বাড়ি ফিরতেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন লাগল?’ উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলাম। দিলীপ বললেন, ‘একটু বেসুরো মনে হয়নি?’ রেগে গেলাম, ‘না, হয়নি। সুর-বেসুরো তোমার মতো অত টের পাই না। আমি বড় সুখী।’ দিলীপের হাসি এখনো যেন শুনতে পাই।

ভোরে চলে আসব, বাঁধা ছাঁদা হয়ে গেছে। নতুন ফরাসী বন্ধু মনো সাহেব এসেছেন, আরো অনেকে এসেছেন। দিলীপ বললেন, ‘কি কি ভালো লেগেছে সে তো অনেক শুনলাম। মন্দ লাগেনি কিছু?’

মুশকিল হল আমাকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে আমি সাধ্যমতো তার উত্তর দিই। এবারো দিলাম। অনেকে বিরক্ত, অনেকে স্তম্ভিত। দিলীপ ভালোভাবে নিয়ে, যথাসাধ্য উত্তর দেবার চেষ্টা করলেন। আমি বললাম, ‘আশ্রমবাসীদের বড়ই অসহিষ্ণু মনে হল। অন্যের দোষ-দুর্বলতা বিষয়ে বড় বেশি সচেতন। এখানে এসে শুনেছি আমরা সংসারের কীট। আমরা কিন্তু জানি যে নিজেদের দোষের আর অন্ত নেই। তাই অন্যের বিষয়ে উদার হওয়া শক্ত হয় না। আরো বলেছিলাম এখানে সাধনার জীবন, তাহলে এতসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এত নিন্দা পরচর্চা কেন। দিলীপ বলেছিলেন, ‘এরা এখানে আসার আগেও যেমন ছিল, এখনো তাই। বরং আরো আত্মকেন্দ্রিক হবার বেশি সুযোগ পায়।’ বলতে শুরু করেছিলাম, তাই আরো বললাম, ‘শ্রীঅরবিন্দ আর শ্রীমাকে যত দেখলাম শুনলাম, তত শ্রদ্ধা হল। কিন্তু আশ্রমের সাধিকারা পরে সাদা কাপড়, গায়ে গয়না নেই। তাহলে মার এত সিল্ক সাটিন হীরে মানিক্য, চোখে রং, মুখে রং কেন?’ এবার দিলীপ ভালো উত্তর দিতে পারলেন না। বললেন, ‘এসবে ওঁর কোনো লোভ নেই, উনি এর উপরে। ভক্তরা দেয়। না পরলে মনে কষ্ট পাবে, তাই পরেন। প্রসাধনও ঐজন্যেই। ভক্তেরা দেখতে চায় তাদের মায়ের কত রূপ, তাই সাজেন। নইলে সাজসজ্জার ওঁর কি-ই বা দরকার?’ এই মর্মে, যদিও অন্য ভাষায় দিলীপ উত্তর দিয়েছিলেন। আমার মন ওঠেনি।

পরদিন বিদায় নিয়ে সন্ধ্যার গাড়ি ধরলাম। সেটি ছিল রবিবার। মদ্যপিপাসুরা চারদিকের শুকনো প্রদেশ থেকে এসে শনি রবি সরসভাবে কাটিয়ে, অল্পবিস্তর অপ্রকৃতিস্থ কিন্তু পুরোপুরি খোশমেজাজে, ভিড় করে গাড়ি চাপল। দেখলাম আরেক দল নারী পুরুষ, নিজেদের গায়ে, দু-তিনটি করে রেশমি কাপড় জড়িয়ে, শুল্ক এড়িয়ে, মাদ্রাজ চলেছেন। একজন ইন্সপেক্টর হাসি হাসি মুখে, সামান্য টলতে টলতে আমাদের কামরায় ঢুকে বলল, ‘সব চেক করব, খুলে দেখান।’ আমি সুটকেস খুলে দিয়ে, তারপর বেডিং দেখিয়ে বললাম, ‘ওটা খুললে তোমাকে ফের বেঁধে দিতে হবে।’

লোকটা হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, ‘আমার দিকে তাকিয়ে বলুন আমার কি তেমন অবস্থা আছে? ঠিক আছে। ধরে নিলাম আপত্তিকর কিছু নেই।’

আমাদের সঙ্গে মাদ্রাজ অবধি আমাদের এক কুটুম্ব এলেন। সে দিনটা শম্ভুর বাড়িতে থেকে, সন্ধ্যায় কলকাতা রওনা হলেন। আমরা আরেক দিন থাকলাম। শম্ভুরা যে কি আদর যত্ন করল সে আর কি বলব। যা যা দেখা বাকি ছিল, সব দেখিয়ে দিল। সন্ধ্যাবেলায় যাত্রা করার আগে, শম্ভুর স্ত্রী আমাকে রেশমী শাড়ি, ফুলের মালা, কুমকুম দিয়ে সাজিয়ে, ওদের নিয়ম অনুসারে রওনা করে দিল। শম্ভু গাড়িতে তুলে দিল। আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। কত সৌভাগ্য করে অযোগ্যরা এত আদর পায়।

শম্ভুর কাকা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কেমন লাগল আমাদের দেশের লোকদের?’ বলেছিলাম, ‘পথে বেরিয়ে এতজন ভালো লোকের দেখা পাব আশা করিনি।’ তিনি বললেন, ‘আমাদের একটা প্রবাদ আছে, ভালো লোকরা পথে বেরুলে ভালো লোকের দেখা পায় আর মন্দরা মন্দ লোকের দেখা পায়।’

ফিরে এলাম ১লা মে, ১৯৪৯। স্টেশনে ওঁর সঙ্গে দেখলাম দিদি আর ছোট বোন আর আমার কন্যা এসেছে। বাড়ি পৌঁছে স্নানটান সেরে, দিদিদের দেব বলে মাদ্রাজী শাড়ি বের করতেই, দিদি কেঁদে বলল, ‘বাবা কাল সকালে মারা গেছেন।’

॥ ৯ ॥

মনে হয় যতদিন মানুষের মা-বাবা বেঁচে থাকে, ততদিন তাদের সম্পূর্ণ সাবালকত্ব লাভ করার পথে একটা বাধা থাকে। সে বাধাটা অবিশ্যি সম্পূর্ণ মানসিক এবং এক তরফা। বয়স্ক এবং শক্ত-সমর্থ স্বাধীন ছেলে-মেয়েদের জীবনে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ, সামর্থ্য কিংবা ইচ্ছা কজন বুড়ো মা-বাপেরই বা থাকে? বরং দেখা যায় কোনো এক অজ্ঞাত মুহূর্তে দুই পক্ষের ভূমিকা পাল্টেছে এবং ছেলেমেয়েরাই অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেছে, বা করবার চেষ্টা করছে। আর ছেলেমেয়ের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল হতে হলে তো কথাই নেই। তবু মনে হয় বাপ-মা নিতান্ত জরাগ্রস্ত না হলে, সন্তানদের মানসিক নাবালকত্বর একটুখানি থেকে যায়। অন্ততঃ এ-কথা মনে হয় যে আমার কার্য-কলাপের জন্যও এঁদের কাছে যেন জবাব দিতে পারি এবং এঁরাও আমার কাজের জন্য কিছুটা দায়ী। আসলে এসব কিছুই নয়। মা-বাবা গেলেই হঠাৎ যেন বয়সটা অনেকখানি বেড়ে যায়। মাথার ওপর থেকে একটা চন্দ্রাতপকে তুলে নেয়। নিজেদের কেমন অসহায় মনে হয়। আমার বাবার সঙ্গে আমার ২৫ বছর বয়সের পর থেকে কোনো সম্পর্ক ছিল না। আমার ওপর অভিভাবকত্ব ছাড়তে চাননি বলেই তাঁর সঙ্গে আমার বিরোধ। তার পর ১৬ বছর কেটে গেছিল, বাবাকে বাদ দিয়ে জীবন কাটাতে আমি অভ্যস্থ হয়ে গেছিলাম। ভাই-বোনেদের যত কষ্ট হয়েছিল, আমার তার কিছুই হয়নি। শুনতে হৃদয়হীন লাগলেও এই হল সত্য। এ বিবাদ যে বাবার দিক থেকে কোনো দিনও মিটবার নয়, এ-ও আমি জানতাম। অথচ তিনি নিজেই সর্বদা আমাদের স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে আর নিজের কর্মফল নিজে বহন করতে বলতেন।

আক্ষেপের স্থান না থাকলেও, যখন দেখলাম চোখের সামনে ও-বাড়ির জীবনযাত্রার ছন্দটা বদলে গেল, তখন যথেষ্ট কষ্ট হয়েছিল। শেষ দু বছর বাবা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে পঙ্গু হয়ে এসেছিলেন। কোনো রকম দাবিও ছিল না। মনে হত কথা বলতে অনিচ্ছুক, পরে শক্তিও কমে গেল। তবু তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের প্রভাব সমস্ত বাড়ির উপর বিরাজ করত। চার ছেলের বিয়ে হয়েছে, একটি দুটি ছেলেমেয়েও হয়েছে, তবু সব কিছু চলছিল আগেকার নির্দিষ্ট নিয়মে। সে নিয়মটি ছিল যুক্তিযুক্ত, সুস্থ, শান্তিপূর্ণ। মুস্কিল হল যে স্বাধীন মতামত বলতে বাবা তাঁর নিজের বিচারের বাইরে কিছু পছন্দ করতেন না। বাবা যখন সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন, তখনো নিয়মটি নিজের বলিষ্ঠতার জোরে দাঁড়িয়ে রইল।

কিন্তু তাঁর তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে হাওয়া পাল্টে গেল। ঐ সংসারের সুন্দর ঐক্যে ক্রমে চিড় ধরে গেল। দিদি মহারানী স্কুলের অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে গোখেল কলেজে অধ্যাপনা করতে লাগল। সংসারে কোনো অশান্তি দেখা যেত না। চতুর্থ ভাই সরোজের সুব্যবস্থায় কো-অপারেটিভের নীতিতে সুন্দরভাবে গৃহস্থালী চলত। আজ পর্যন্ত আমার মনে হয় বর্তমানে বাসস্থান, চাকর বাকর বাড়ির মাস্টার ছোটদের তদারকি ইত্যাদি সাংসারিক বিষয়ে সহজেই নিষ্পত্তি হতে পারে সরোজের সেই ‘গার্হস্থ্য সমবায়ের’ নীতির সাহায্যে। এই নিয়ে একটা গল্পও লিখেছি।

তবে মা সংসার পরিচালনা থেকে সরে না দাঁড়ালে এমন ভালো নিয়মটা হয়তো উদ্ভাবিতই হত না। সবাই মাথাপিছু সমান হারে টাকা জমা দিল; যে যার ক্ষমতা বুঝে একেক জন একেকটা ডিপার্টমেন্টের ভার নিল। ব্যস্ মেশিনের মত গেরস্থালী চলতে লাগল। তবে বেশিদিনের জন্য নয়। ছোট ভাই যতি আলাদা ফ্ল্যাট নিল। ছোট বোন লতিকা কার্সিয়ং-এ ডাও হিল্ স্কুলের ইতিহাস বিভাগের ভার নিয়ে, সেখানে যাবার তোড়জোড় করতে লাগল।

এদিকে মা-কে খুব সুখী মনে হত না। সারা জীবন যে মানুষ একা হাতে নীরবে, নির্বিবাদে একটা বড় সংসার পরিচালনা করে এসেছে, হঠাৎ তাকে ছুটি দিলে, তার কি বাকি থাকে? বই পড়ে, উল বুনে, জ্যাম জেলি করে, কোনো কাজের মেয়ের মন ওঠে না, তা তার যত বয়সই হক না কেন। মা-র তখন ৬৫ বছর বয়স। আমি ভাবতাম আরো ১০ বছর মা এইভাবে কাটিয়ে যাবেন। কিন্তু মন যে খারাপ, তার কি হবে?

লতিকা মাকে বলল, ‘ওসব চলবে না। ডাও হিলে আমি কটেজ পাব। তার দেখাশুনা কে করবে? ও আমার আসে না। তুমি না গেলে আমার বড্ড কষ্ট হবে।’ ব্যস্, আর কথা নেই। কোনো দিনও মা-কে নিজের সুখ-সুবিধার জন্য কিছু করতে দেখিনি। আবার অন্য লোকের কষ্ট দেখলে কোনো কাজে পিছপা হতেও দেখিনি। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে গেল লতিকার সঙ্গে মা যাবে, ওদের পুরনো কাজের লোক বিষ্ণু যাবে। লতিকা একরকম তার কোলে-পিঠ মানুষ, সুতরাং তার কর্তাগিরির সীমা নেই। এ ছাড়া ছুটি-কাটাতে আমরা সবাই পালা করে তো যাবই।

কাঠের বাক্সে বাসনপত্র প্যাক হল। জিনিসের তো আর অভাব ছিল না। গরম কাপড়-চোপড় কেনা হল, বোনা হল। মা পাহাড় ভালোবাসেন, তার ওপর ওখানকার ঘর সংসার দেখতে হবে। আবার তাঁর মুখে হাসি ফুটল! যতদূর মনে হয় ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে, বাবা যাবার এক বছর পরে ট্রেনে করে মা, লতিকা, বিষ্ণু রওনা হলেন। সঙ্গে দু-একজন গেল, কারা তা মনে নেই। আসলে মা-র জন্য এই প্রথম আমাদের মনে ভাবনা ঢুকেছিল। বাবা থাকতে থাকতেই মা-র ব্লাড-সুগার ধরা পড়েছিল। ক্রমে রোগা হয়ে যাচ্ছিলেন, খাওয়া-দাওয়ার বড় বেশি ধরকাট, ভাত বন্ধ, মিষ্টি বন্ধ। মিষ্টি বন্ধে আপত্তি ছিল না, কিন্তু দুপুরে এক মুঠো ঝোল-ভাত না খেলে মা-র কষ্ট হত। মুখে কিছু বলতেন না। মা-মরা মেয়ে, পরের বাড়িতে মানুষ, সেখানে অনেক স্নেহ পেলেও, মুখ ফুটে কোনোদিনও কিছু দাবি করতেন না। ঐ দাবি না করাটাই স্বভাব হয়ে গেছিল। দু-তিনবার কথা নেই বার্তা নেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছিলেন। ডাক্তার বললেন বেশি ইন্‌সুলিন পড়েছে। ইদানীং কিন্তু বেশ ভালোই ছিলেন আর সেখানকার পরিষ্কার ঠাণ্ডা হাওয়ায় যে দেখতে দেখতে শরীরের উন্নতি হবে, তাতে কারো মনে সন্দেহ ছিল না।

আমার ৪২ বছর বয়স। ‘দিন দুপুরের’ পর ‘পদীপিসির বর্মি বাক্স’ বেরোল। সিগনেটের প্রকাশনা, মানিকের মলাট, অহিভূষণ মালিকের আঁকা ছবি। দিলীপ গুপ্তের পরিকল্পনা, সে কথা বলাই বাহুল্য। ‘শ্রীমতী’ মাসিকপত্রে প্রকাশিত বড়দের উপন্যাস ‘শ্ৰীমতী’ আর ‘জোনাকি’ও বেরোল। ছিমছাম সুন্দর চেহারা, নিয়ে। তারপর হয়তো আমার আরো ৮০টা বই বেরিয়েছে, কিন্তু এমন সুন্দর একটিও নয়। সন তারিখ গুলিয়ে গেছে। আনন্দবাজারের রবিবাসরে, যুগান্তরে, গল্প ভারতীতে, সচিত্র ভারতে রসের গল্প লিখি। সমবয়সী লেখকদের তুলনায় কিছুই করিনি। সমস্ত মন পড়ে থাকে ছোটদের জন্য লেখার দিকে। জানি ও পথে কেউ নাম পায় না, কড়ি পায় না, পুরস্কার পায় না। তবে এ-ও জানি তাতে কিছু এসে যায় না। এখানেই আমার আসল কাজ। তবু নানা রকম রসের কথা মনে জমা হয়; সম্পাদকরা গল্প চান; লিখতে বেশ মজাও লাগে। তাছাড়া কতকগুলো কথা গল্পের ভেতর দিয়ে পাচার না করলে হয়তো বলবার আর সুযোগই পাব না, কিম্বা বললেও কেউ শুনবে না, কিম্বা চটে যাবে। তাই লিখতেই হয়। কিন্তু সত্যি কথাই বলব আমার হৃদয় মথিত করে, দম বন্ধ করে দিয়ে ‘আর কোনোখানে আর আরো দু তিনটে গল্প বাদে, বড়দের জন্যে লেখা আমার কোনো গল্পের জন্ম আমার হৃদয়ের মর্মমূলে নয়, বরং আমার মস্তিষ্কের উষ্ণ অসহিষ্ণু কোষে কোষে।’ সত্যিকার সাহিত্যের জন্ম সেখানে নয়। ‘হলদে পাখির পালক’ লেখার আগে হয়তো দু মাস আমার মুখে অন্ন রোচেনি, রাতে চোখে ঘুম নামেনি। সত্যিকার সাহিত্য কেউ স্বেচ্ছায় সৃষ্টি করতে পারে না। সে আপনি জন্ম নেয়। কিসের তাগাদায়, কার আশীর্বাদে, তা জানি না। শুধু জানি সে আমার অন্তরবাসী কেউ, তার ওপর আমার কোনো অধিকার নেই। এই আমার বিশ্বাস আর নিজের অভিজ্ঞতা। অন্যদের কথা জানি না।

আমার স্বামী মাঝে মাঝে আমাকে মনে করিয়ে দিতেন ‘এত রকম কাজে জড়িয়ে পড়লে লিখবার সময় কি করে পাবে?’ বোঝাতে চেষ্টা করতাম সময়ের জন্য লেখা বসে থাকে না। সময় হলে সে নিজেই সব বাধা সরিয়ে, দরজা ভেঙে দেখা দেবে। আমি শুধু যেখানে যা ভালো জিনিস দেখি—শিশিরের উপর সূর্যের ঝিকিমিকি, নীল আকাশের বুকের সারি, ছোট ছেলের গালে টোল, বাতাসের মুখে শুকনো পাতার ঘূর্ণি, উনুনের আঁচে দাবানল, সব জমা করি। যত শব্দ শুনি টিনের চালে বৃষ্টি পড়া, গাছের পাতায় বাতাস বওয়া, মাথার ওপর বুনো হাঁসের আঁক-আঁক শব্দ, বালির পাড়ে ঢেউ ভাঙা, দুরন্ত ছেলের নাম ধরে মায়ের ডাক—তাও জমা করে রাখি। যেখানে যত সুগন্ধ আমার নাকে এসেছে, লম্বা লম্বা কাহিনীসুদ্ধু আমার মনে জমা আছে। যত ভালো কথা শুনেছি, ভালো দৃশ্য দেখেছি, ভালো জিনিস ভেবেছি—সব রেখে দিয়েছি। সারা জীবন ধরে তারা আমাকে রাজ্যেশ্বরী করে রেখেছে। এখন যদি তাদের বিলিয়ে না দিই, তাহলে তাদের রাখব কোথায়? চলে যাব তো খালি হাতে, রাজ্যের আনন্দ নিশ্চিন্তে ফেলে রেখে।

ছেলে প্রি-মেডিকেল পড়ে, মেয়ের বারো বছর বয়স। তাদের নিয়ে গেলাম কার্সিয়ং-এর ডাও হিলে। দার্জিলিং যাওয়া আসা করতে, সিঞ্চল লেকে পিকনিক করতে, কার্সিয়ং রেলস্টেশন আমার খুব চেনা। এক দিকে তাকালে নিচের সমতলভূমি দেখা যায়—নদীনালা, গাছ-পালা, ধানক্ষেত। আরো কাছে চা-বাগানের লাল টিনের চালের বাড়িঘর। কিন্তু শহরটা একেবারে রসহীন। গাড়ি চলাচলের একটা চওড়া রাস্তা। সেই রাস্তা থেকে নিচের দিকে গুটি কতক পথ নেমে গেছে আর ওপর দিকে ডাও হিলের খাড়া পথ বারো শো ফুট উঠে গেছে। ঐ পাহাড়ের গায়ে কতকগুলি মিশনারি প্রতিষ্ঠান; একটা বড় গির্জা, কতকগুলো ফিরিঙ্গি বোর্ডিং স্কুল। অনেক উপরে, আঁকাবাঁকা পাঁচ মাইল পথ চড়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত ডাও হিল স্কুল, একটা ছেলেদের স্কুল, বনবিভাগের একটা শিক্ষাকেন্দ্র, যক্ষ্মারোগের আরোগ্য নিকেতন ইত্যাদি আছে বলে শুনতাম। নিচে দিয়ে এর আগে কতবার যাওয়া আসা করেছি, ডাও হিল পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্যের বিষয়ে সন্দেহও করিনি।

সমতলের দিকে মুখ করে, বরফের পাহাড়কে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকে ডাও হিল্। তার মাথার উপর দিয়ে পুরনো মিলিটারি রাস্তা একেবারে দার্জিলিং অবধি চলে গেছে। তবে সাধারণ লোককে সেটা ব্যবহার করতে বড় একটা দেখা যেত না। পাহাড়ের মাথায় চড়লে হিমালয় নিজে এসে ধরা দেয়।

কার্সিয়ং অবধি রেলের লাইনের প্রতিটিবাঁক ছিল বড় পরিচিত। এরোপ্লেনে বাগডোগরায় নেমে. ট্যাক্সি নিয়ে কার্সিয়াং স্টেশনে আসা। আগে ভাবতাম দার্জিলিং যাবার পথে নগণ্য একটা স্টেশন। কিছু দোকান-পাট, হোটেল রেস্তোরাঁ থাকলেও, চোখে লাগার মতো কিছু নেই। কয়েকটা দু-তিন তলা বাড়ির মধ্যিখান দিয়ে পথ উঠে গেছে। জীপ কিম্বা সরকারী বন-বিভাগের শক্তিশালী ট্রাক ছাড়া এক ছোট মোটর গাড়ি ঐ পথে ওঠে। আমাদের জন্য ছোট গাড়ি ঠিক করা ছিল! দেখি পাকদণ্ডী পথের ধারে ধারে সুন্দর সুন্দর বাড়ি, বাগান। এ সব বাড়ি কলকাতার বাড়ির মতো নয়। লাল টিনের চাল দেওয়া, ছোটবেলায় শিলং-এ দেখা বাংলো বাড়ির মতো। সেই রকম কাঠের ওপর লাল বা ব্রাউন রং করা গেট। গেটের ওপর লতানে গোলাপ। মনটা অন্য রকম হয়ে গেল। শিলং-এর স্মৃতি মন জুড়ে বসল। শিলং মানেই মা। মাকে বাদ দিয়ে কলকাতায় দিব্যি বছরের পর বছর কাটিয়েছি, বয়স হয়েছে ৪২, তবু হঠাৎ মার জন্য মন কেমন করে উঠল।

ডাও হিলের পথের শেষটুকু বড্ড খাড়া। শেষের বাঁকটাতে খানিকটা পেছিয়ে এসে দম নিয়ে তবে গাড়িটা কায়দা করতে পারল। তার উপরে স্কুলের বড় বাড়ি, বোর্ডিং, শিক্ষিকাদের ছোট ছোট বাংলো, ঝাউগাছের সারি, পাহাড়ি ফুল। সেখানকার জমি যেন র‍্যাদা দিয়ে সমান করে চেঁচে বেড়াবার জায়গা, বড় খেলার মাঠ তৈরি করা হয়েছে। স্কুলের অধ্যক্ষা বিলেত থেকে পাশ করা, খাঁটি বিলিতি মেম, শিক্ষিকারাও দুজন ছাড়া সবাই ফিরিঙ্গি, কেউ ফর্সা কেউ মেশানো। তখনো ফরসা ফিরিঙ্গিরা এদেশে ছিল। লেখাপড়া, খেলাধূলা, হাতের কাজ, রান্নাবান্না ইত্যাদি শেখার চমৎকার বন্দোবস্ত ছিল। কিন্তু ছাত্রী সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম এবং হয়তো ৯০ শতাংশ কালো অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান। তাদের জিজ্ঞাসা করলে বলত বড় হয়ে তারা হেয়ার-ড্রেসিং সেলুনে কাজ করতে চায়। শুনে শুনে হতাশ হতাম। এর জন্য এমন এলাহি ব্যবস্থা! তবে বিলিতি কোম্পানিরা অনেক আগেই বড় বড় অনুদান দিয়ে রেখেছিল ঐ সমাজের ছেলে-মেয়েদের খৃষ্টীয় নীতিতে শিক্ষা দেবার জন্য। সরকার হঠাৎ হস্তক্ষেপ করে নিয়ম পাল্টাবার পথে অনেক বাধা ছিল। তারপর ৩০ বছরের বেশি কেটে গেছে, এখন শুনি ব্যবস্থাপনার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমার মনে হয় স্বাস্থ্যকর জায়গায়, সুনিয়ন্ত্রিত আবাসিক বিদ্যালয়ের খুবই প্রয়োজন আছে। ভালো বোর্ডিং খুব বেশি নেই আমাদের। প্রাইভেট স্কুলের বড় বেশি খরচ, অথচ যাঁদের বদলির চাকরি তাঁরা ছেলেমেয়েকে বোর্ডিং-এ রাখতেই বাধ্য হন। ভাষা সমস্যা অবস্থাটিকে আরো সঙ্গীন করে তোলে। ঐ ডাও হিলে চমৎকার এবং বিশাল দুটি আবাসিক বিদ্যালয় হতে পারে, যেখানে ভবিষ্যতের নাগরিকরা মানুষের মতো বড় হয়ে উঠবার সুযোগ পাবে। এখনও স্কুলের অবস্থা কেমন তা অবিশ্যি জানি না।

এত কথা ঐ প্রথম দেখাতেই অবিশ্যি মনে হয়নি। বলেছি তো আমার এই বৃত্তান্তের সময়কালের গোলমাল আছে। তাতে মনে পড়ছে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা ছিল না, একথা ভুল। যুদ্ধ বাধে ১৯৩৯ সালে, কবির মৃত্যু হয় ১৯৪১ সালে, অর্থাৎ দু বছর পরে। তবে ভুলও ঠিক নয়। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে পৃথিবীর অন্যান্য মাটিতে যুদ্ধ লাগলেও, তার ঢেউ এসে ভারতের জীবনযাত্রায় এবং চিন্তাধারায় প্রতিহত হতে হতে কবির জীবন শেষ হয়ে এসেছিল। তিনি বড় জোর ব্ল্যাক্ আউট দেখে গেছিলেন। যুদ্ধের কালো ছায়া তখনো ভালো করে নেমে আসেনি।

আমি ভালো করেই জানি এসব খুঁটিনাটি কথা আসলে অবান্তর, এতে আমার প্রিয়জনদের ছাড়া কারো কোনো কৌতূহল না থাকাই স্বাভাবিক, তবু তারা এসে বারে বারে বিঘ্ন ঘটায়। মনে মনে বলি আমি লেখিকা না হলে আমার স্মৃতিকথা কেউ পড়তে চাইত না। একটা সবুজ শ্যামল মাটিতে কেমন করে ঠাঁই পেয়ে যাই, যেখানে আমি লেখিকাও নই, আমার স্মৃতিকথার এক কানাকড়িও দাম নেই। সেখানে শত শত অখ্যাত অনাবশ্যক চেনা-অচেনা মুখ এসে ভিড় করে আর আমার মনে হয় আমার জীবন সার্থক হয়ে গেল।

ডাও হিলের ওপরকার প্রথম ধাপেই একটানা একটা বাংলো বাড়ি। সেখানে শিক্ষিকাদের আবাস। প্রত্যেকের গুটি তিনেক ঘর, স্নানের ঘর, রান্নাঘর। সব বিলিতি ধাঁচে সাজানো। কেমন একটা পরিপাটি ভাব। হয়তো প্রথম দেখায় প্রাণহীন, কিন্তু দরজা জানলায় পরদা দিলে, কৌচে দুটো রঙীন কুশন ফেলে রাখলে, দেয়ালের কোণার তিন ঠেঙো খুদে টেবিলে চোঙার মতো ফুলদানিতে তিনছড়া গ্ল্যাডিওলি সাজিয়ে রাখলে, চিমনির ওপরকার সরু তাকে একটা বড় মতো ঘড়ি বসালে—যার টিকটিক শব্দ কালের পদধ্বনিকে ছাপিয়ে উঠে অনন্তের জানান দেয়—অমনি বাড়িখানি একটি কোমল স্নেহের নীড় হয়ে যায়। সেখানে আমার মা আছেন। মনের পাখি ডানা গুটিয়ে বসে। জীবনের সব ভুলচুক, অবুঝ অন্যায় এক মুহূর্তে ক্ষমা পেয়ে যায়। গিয়ে দেখলাম আমার ছোট বোন লতিকার কার্সিয়ং-এর বাড়ি সেই রকম একটি মনের আবাস।

খুব একটা বড় চাকরি করত না লতিকা। কলকাতার ইতিহাসে এম-এ, বি-টি, ভালো ইংরাজি জানে বলে, ডাও হিল্ স্কুলের ইতিহাস বিভাগের নম্বর ওয়ান। চারিদিকে খুব একটা জ্ঞানসাধনার আবহাওয়াও দেখলাম না। কিন্তু সব কিছু পরিচ্ছন্ন, নিয়মানুবর্তী ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে। একেবারে নিষ্প্রাণও নয়। অনেকগুলি “বে-সংসারী” নানা বয়সের মহিলাকে দিনের পর দিন এভাবে স্বর্গে রেখে দিলেও কি মাঝে মাঝে হাওয়া গরম হয়ে উঠবে না? আমার মতো দর্শকের কাছে ব্যাপারটা ভারি উপভোগ্য। আর শুধু আমার কেন, মা-ও দেখলাম নৈর্ব্যক্তিক ভাবে লতিকার সহকর্মিণীদের খিটিমিটি দেখে মজা পান! ওখানে আমি অনেক গল্পের খোরাক পেয়েছিলাম আর পাহাড়ে প্রকৃতি দেখে রোজ নতুন করে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম।

এর মধ্যে আমার ভাই সরোজ তার ছোট মেয়েকে রেখে ফিরে গেল। ক-দিন পরেই সে যে কি নিদারুণ ঝড়ঝাপ্টা প্রাকৃতিক দুর্যোগ! মনে হত সাইক্লোনের মুখে পাহাড়চুড়ো উড়ে যাবে। বিজলির তার ছিঁড়ে গেল, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হল, হাট-বাজার বন্ধ হল। তবু নিশ্চিন্তে মা-র কাছে রইলাম। খবরের কাগজ আসে না, চিঠিপত্র বন্ধ, রেডিওতে যা খবর পাওয়া যায়। মা এতটুকু ঘাবড়ালেন না, চাল ডাল তেল নুন আলু চা চিনি ময়দা বাড়িতে মজুত আছে, তবে আবার ভাবনা কিসের! এমন ধীরস্থির মানুষ আর জন্মে দেখলাম না।

লতিকা কাজকর্ম করে, মা সংসার দেখেন। যখন যে রকম পরিস্থিতি হয়, তার সেই রকম ব্যবস্থা করেন। ফলে বাড়ির আর সকলেও এতটুকু ঘাবড়ায় না। তারপর ঝড়ের দাপট কমে গেল। প্রকৃতি ঠাণ্ডা হল। ভাঙাচোরা পাহাড়ে রাস্তায় আবার জোড়াতালি লাগল। মোটর চলল। রেলগাড়ির লাইন ধ্বসে গেছে, মেরামত হচ্ছে। তারি মধ্যে ছুটি ফুরোল। সরোজ সাবধানে আবার এসে কদিন থেকে, মেয়েকে নিয়ে গেল। আমরাও বাগডোগরা অভিমুখে রওনা দিলাম। ভাবি জীবনটা কি আশ্চর্য, ভবিষ্যৎ কত গোপনীয়। অনিশ্চিত। সরোজ যে বাসে কার্সিয়ং এসেছিল, তার সামনে সামনে একটা ছোট মোটর যাচ্ছিল। হঠাৎ সেই গাড়িশুদ্ধ একশো ফুট রাস্তা ভেঙে নিচের খাদে পড়ল। শুনে সকলের চক্ষুস্থির। তবে দিন-সাতেকের মধ্যে মাটি আবার শক্ত হল। আমরা ফেরার পথে তাণ্ডবের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া ভয়াবহ কিছু দেখিনি। অন্ধকারময় কার্সিয়ংএ মা আর লতিকাকে রেখে আসবার সময় মনটা একটু খারাপ হয়ে গেছিল।

কলকাতায় পৌঁছে দেখি মনের মধ্যে একটা দরজা খুলে গেছে। ক্রমে লেখার কাজ একটু একটু করে জায়গা দখল করে নিতে লাগল। নিজের বিলম্বের কথা মনে করে নিজেই আশ্চর্য হই। ছোটদের বড়দের পত্রিকায় লেখা বেরোত, মৌচাকে, রামধনুতে, সচিত্র ভারতে, গল্প ভারতীতে, যুগান্তরে, আনন্দবাজার পত্রিকায়, কিন্তু সে আর কতটুকু। ছড়ানো ছিটনো জিনিস ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না। অর্ধেক তো হারিয়েই যায়। কপি জমা করে রাখার কথাও মনে হত না।

বড়দের ক্ষণস্থায়ী ‘শ্রীমতী’ পত্রিকায় আমার ধারাবাহিক ‘শ্রীমতী’ বেরিয়েছিল, একথা আগে বলেছি। সম্পাদিকা মীরা চৌধুরীর নিয়ম ছিল গল্প হবে নারী-কেন্দ্রিক আর সমাপ্তি হবে সুখের। সেই নিয়মেই ‘শ্ৰীমতী’ লেখা হয়েছিল, তবে তার আসল বক্তব্যটি মনের মধ্যে অনেক দিন ধরে ঘুরেছিল। এমন কি প্রথম অধ্যায়ের প্রথম দৃশ্যটি বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া। কাগজে বেরুনো এক, বই হয়ে বেরুনো আর। সেদিকে আমার যত্ন ছিল না। ভাবতাম তার জন্য ঢের সময় পড়ে আছে। হাতটা আরো পাকুক। কাগজে লেখার বেশ একটা নিশ্চিন্ত অ-স্থায়িত্বের ভাব আছে। তাতে খানিকটা নিরাপত্তা থাকে। কিন্তু সেই লেখাই বই হয়ে দেখা দিলে সর্বজনের সমালোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। লেখা বলতে তখনো বড়দের জন্য লেখার কথাই বেশি ভেবেছি। তার জন্য প্রয়াস করতে হবে জানতাম। আমার চাইতে দক্ষ অভিজ্ঞ খ্যাতনামাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হবে। ছোটদের জন্য লেখা আপনা থেকে মনের মধ্যে জমা হতে থাকে, এতটুকু কষ্ট করতে হয় না। কষ্ট শুধু তখন, যখন আমার মন যা বলে, হাত তা লিখতে পারে না। যথার্থই বলছি ছোটদের জন্য লেখাগুলোয় আমার তেমন কৃতিত্ব নেই। সেগুলি আমি অন্য কোনো জায়গা থেকে পাই, আর আমার সেই হৃদয়বাসী অদৃশ্য পুরুষের তাগাদায় লিখি।

ক্রমে ক্রমে ছোটদের লেখা সম্বন্ধে কতকগুলি ধারণাও আমার মনে দানা বাঁধতে লাগল। সঙের খেলা দেখালে হবে না। ছোটদের সাহিত্যর উপজীব্য হল সরসতা আর সততা। শুধু এমন জিনিস লিখতে হবে যা পড়লে ছোটদের মনে সব সৃষ্ট জীবের প্রতি সহানুভূতি আর শ্রদ্ধা আসে। সৃষ্টিকর্তার মঙ্গল বিধানে আস্থা থাকে। তাহলেই লেখার মধ্যে আনন্দ ফুটে উঠবে। সে এমন আনন্দ যা দুঃখের গল্পেও হারিয়ে যাবে না। এই সব ভাবি। মুখে বিশেষ কিছু বলি না। ভাবি কি সুন্দর বিশ্বজগত; বেঁচে থাকায় কত মজা। এ-ও ভাবি যে যা কিছু মন্দ, তার সঙ্গে কখনো বোঝাপড়া হয় না। মাস্টারনীর মতো শোনায়। ভাবি তা তো বটেই। ছোটদের জন্য যারা গল্প কবিতা লেখে, তারাই মাস্টারদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। যদিও ছোট বেলায় শুনতাম টেরি কাটা, হাত-ঘড়ি পরা, নবেল পড়া হল গিয়ে অধঃপাতে যাবার ধাপের পর ধাপ!

এখন টের পাই ঐ-সব চিন্তা কিছু আমার মনগড়া নয়, অক্ষর চিনে অবধি সন্দেশের পাতায় জ্যাঠামশাইদের আর তাঁদের বন্ধুর লেখার ছত্রে ছত্রে পরোক্ষভাবে এই শিক্ষাই পেয়েছি। মনটা ঐ ভাবেই তৈরি হয়ে এসেছে। ভাবতাম বড়দের জন্য লেখা হবে আমার কাজ; ছোটদের জন্য লেখা আমার অবকাশ যাপনের নেশা। ১৯৫২ সালে সিগনেট প্রেস্ থেকে ‘শ্রীমতী’ প্রকাশিত হবামাত্র, বাংলার যত স্কুল-কলেজের ছাত্রী ও তাদের শিক্ষিকারা তাকে লুফে নিলেন। ঐ একই নীতিতে ১৯৫৬ সালে ‘জোনাকি’-ও প্রকাশ হল সিগনেট থেকে। তার আগেই রংমশালে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ‘পদি-পিসির বর্মী বাক্স’-ও বই হয়ে বেরিয়েছিল। আমার পড়ুয়া-ভাগ্য বড় ভালো। যাদের জন্য বই লিখি তারা খুব খুশি হয়। বলা বাহুল্য তারা যতটা হয়, পণ্ডিতরা ততটা হন না। আমি বাপের দিকে, মায়ের দিকে পণ্ডিত বংশের মেয়ে, পাণ্ডিত্যকে বড় শ্রদ্ধা করি, কিন্তু আমার নিজের বাংলা ভাষার ব্যাকরণের দিকটাতে, বা সংস্কৃতে কোনো দখল নেই। আমার কাজ অন্য ক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্র সকলের সহানুভূতি পায় না। কোনো কোনো বন্ধু এ-ও বলেছেন যে এত লেখাপড়া শিখে এ-ভাবে ছোটদের জন্য লিখে সমস্ত আহৃত জ্ঞান নষ্ট করা অন্যায়। সেই ১৮৯৩ সালে যোগীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর অবিস্মরণীয় ‘হাসি ও খেলা’ সম্পাদনা করে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা পাবার যে দাবি এদেশে প্রথম পেশ করেছিলেন, তারপর প্রায় ৬০ বছর কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত শিশু সাহিত্য তার নায্য অধিকার পায়নি। সাহিত্যের ইতিহাসে বা মূল্যায়নে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায়টি আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ বাদ পড়ে যায়। সাহিত্যিকদের তালিকা থেকে শিশু-সাহিত্যিকরাও বাদ পড়েন, যদি না অন্য কোনো বয়স্কদের ক্ষেত্রে তাঁদের উল্লেখযোগ্য অবদান থাকে। এবং যদিও ইয়োরোপের নোবেল পুরস্কার বিজয়ীদের মধ্যে একাধিক শিশু-সাহিত্যিকের নাম দেখতে পাওয়া যায়, আমাদের দেশের রবীন্দ্র পুরস্কার বরং দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর বয়স্ক লেখকদের দেওয়া হয়, তবু কোনো প্রতিভাবান শিশু-সাহিত্যিকের কথা চিন্তা করা হয় না। এমন কি অতুলনীয় ‘শতবর্ষের বাংলা শিশুসাহিত্য’ বইটির প্রণেতা খগেন মিত্রের নাম সে সময় কেউ করেছিলেন বলে শুনিনি। অবশ্য আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করছি বর্তমান বাংলা সরকার গত তিন বছর ধরে শিশু-সাহিত্যের জন্য বিদ্যাসাগর পুরস্কার দিয়ে, সেই অবিচারের কিছুটা ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। তাঁদের পরিকল্পিত ও প্রকাশিত ‘আলোর ফুলকি’ নামক সংকলন গ্রন্থেও উনিশ শতকের প্রথম অর্ধের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনা থেকে বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধের কবি সুনির্মল চক্রবর্তীর নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। আমার কেবলই মনে হয়েছে এইখানে কাজ করবার বিশাল ক্ষেত্র পড়ে আছে। সেই ক্ষেত্র কেবলই আমার মনকে টানে। তাই বয়স্কদের জন্য সাহিত্য রচনায় যতখানি একাগ্রতা আর নিষ্ঠা দরকার, তা আমি দিতে পারি না।

ছোটদের সাহিত্যকে এতখানি গুরুত্ব দেবার অন্য কারণও আছে। শুধু অনুরাগ আর অনুপ্রেরণা ছাড়াও, যুক্তির দিক থেকে বলা যায় মানবজাতির ভবিষ্যৎ গঠনে বড়দের সাহিত্য থেকে শিশুসাহিত্যের ভূমিকা অনক বড়। শিশুসাহিত্য দিয়েই মানুষের ছেলেমেয়েদের চিন্তাধারা তৈরি হয়। তাদের মনে বলিষ্ঠ আদর্শবাদ অঙ্কুরিত করার এই হল সময়। মূল্যবোধও এই সময় অনেকখানি তৈরি হয়ে যায়। পরে পড়শুনা করে মানুষ আনন্দ পায়, প্রয়োজনীয় তথ্য পায়, সময় কাটে, তর্কের বিষয়বস্তু থাকে, নিজেকে সংস্কৃতিবান বলে প্রমাণ করার সুবিধা হয়, কিন্তু কৈশোরে তৈরি মনটি ক্কচিৎ বদলায়। যতই এসব ভাবি মন ততই ছোটদের জন্য লেখার দিকে ঝোঁকে। অবশ্য আসল কারণটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। একটা সময় দ্রুত এসে গেল যখন শুধু যে নিজেরও আর বড়দের জন্য লিখতে তেমন ভালো লাগত না তা নয়। তার ওপর বহু নাম করা বড়দের সাহিত্যিকদের পুরস্কারপ্রাপ্ত বই পড়েও যথেষ্ট আন্তরিকতা, সততা, বলিষ্ঠতা খুঁজে পেতাম না। কয়েকজন দেশ-কালোত্তর মহাপুরুষ ও মহানারীকে এই তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছি। দুঃখের বিষয়, যথেষ্ট সৎসাহসের অভাবে কারো নাম না করাই বাঞ্ছনীয় বলে মনে হচ্ছে। এই শেষের তালিকায় বেশ কিছু বয়ঃ-কনিষ্ঠও আছেন।

কেন যে আমি ছোটদের জন্য লিখি সে বিষয়ে যথেষ্ট কেন, হয়তো কিঞ্চিৎ বেশিই বলা হল শিশু বলতে আমি ৫-৬ বছরের শিশু থেকে ১৬-১৭ বছরের কিশোর ও তরুণদের কথাও মনে করি।

আমার বাড়ির লোকেরা আমার সাহিত্যকর্মের বহর দেখে যে খুব সন্তুষ্ট ছিল না, সে কথা বলাই বাহুল্য। খানকতক বড়দের আর ছোটদের বই, বহু পত্রিকায় গল্প প্রবন্ধ, কিছু অনুবাদ। ব্যস্, ঐ অবধি। ওকে কিছু সাহিত্যকর্ম বলা যায় না। সমবয়সীরা অনেকে ততদিনে তাঁদের যা যা দেবার ছিল, তা প্রায় নিঃশেষ করে এনেছেন। অমি তখনো সংসারে প্রায় ডুবে আছি। বাড়িটাকে একটা ছোটখাট আবাসিক বিদ্যালয়ও বলা চলত। কয়েকটা সমাজসেবী সংগঠন থেকে মুক্তি পাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতাম। কবিবন্ধু শ্ৰীঅন্নদাশঙ্কর রায় ও তাঁর স্ত্রীর প্ররোচনায় একটু একটু করে পি-ই-এনের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ছি। নিজের মধ্যে খানিকটা উৎসাহের অভাবও টের পেতাম। বোধ হয় কোনো সংস্থার বা সংগঠনের পদ্ধতি অনুসরণ করার সঙ্গে বেড়াজালের সাদৃশ্য দেখতে পেতাম বলে চিরকাল কোনো কিছুতে আত্মসমর্পণ করতে ঘাবড়াই। এমন কি আমার দীর্ঘকালের এই সুখ-শান্তির সংসারের মধ্যিখানেও টের পাই আমার সত্তার অন্তঃস্তলে একটা জায়গা আছে যেখানে আমি একান্ত একলা। সেখানে আমি কারো মেয়ে নই, বোন নই, স্ত্রী নই, মা নই, বন্ধু নই। সেখানে আমার আমিত্বের সঙ্গে বোঝাপড়া করতেই জীবন গেল। কিন্তু তাতে আমার জীবনের স্বাভাবিক আনন্দগুলো উপভোগ করাতে কোনো অসুবিধাও হয়নি। তবে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে ঐসবের নীচে তলিয়ে গিয়ে শেষটা জীবনের আসল কাজটাই বাকি থেকে যাবে না তো?

১৯৫২ সালের গরমের ছুটিতে আরেকবার লতিকার কাছে কার্সিয়ং-এ গেলাম। সে তখন ডাও হিল্ স্কুলের অধ্যক্ষা হয়েছে। পাহাড় চুড়োর সুন্দর বাংলোয় অবস্থান। বলা-বাহুল্য বিদায়ী মেম অধ্যক্ষার আয়ের অর্ধেকও আয় নেই! মা তখনো তার বাড়ির কর্ত্রী, পুরনো লোক বিষ্টু রান্নাবান্না করে এবং লতিকার পদমর্যাদা উপেক্ষা করে ধমকধামক করে। একবার বিদ্যালয় পরিদর্শনার্থে তখনকার রাজ্যপাল—শিক্ষাবিদ্ ডঃ হরেন মুখোপাধ্যায় সস্ত্রীক ডাও হিলে এলেন। স্ত্রীটি আবার মায়ের সেকালের বেথুন কলেজের বন্ধু। কাজ হয়ে গেলে, বসবার ঘরে চা এবং স্কুলের রান্নাঘরে তৈরি উৎকৃষ্ট কেক বিস্কুটের সদ্ব্যবহার হচ্ছে। এমন সময় পরদার আড়াল থেকে বিষ্টু আঙুল নেড়ে লতিকাকে ডাকল। সে দরজার কাছে যেতেই বলল, ‘কি, পেয়েছ কি! সকালের দুধ খাওনি কেন?’ জানি না বিশিষ্ট অতিথিরা শুনতে পেয়েছিলেন কি না, আমি কিন্তু পেয়েছিলাম!

আমরা ফিরে এলাম ছুটির শেষে। তারপর আগস্ট মাসের গোড়ায় এক দুঃখের শেষরাতে ট্রাঙ্ককল পেলাম, মা আর নেই। ৬৮ বছর বয়স হয়েছিল। ২০ মিনিটের হৃদরোগের ফলে পাট তুলে গেলেন চলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *